চল্লিশের কোঠায় রাসূল (সাঃ)
আমাদের জীবন অনেক দ্রুত বদলায়। পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অভিযোজ্যতা আমাদের মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর মূল্যবান স্বভাব। পরিবর্তনের যে গুরুত্ব আছে তা কিন্তু বেশিরভাগ লোকই বুঝে। কিন্তু বদলাতে পারে না। তারা ভয় পায় আরামের জায়গা ছেড়ে অনিশ্চয়তাময় পুরোপুরি নতুন ও অপরিচিত জায়গাকে। চল্লিশে পৌছে রাসূল বড়সড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। যেটা বদলে দিয়েছে তাঁর, তাঁর বন্ধুবান্ধব, সমাজের জীবন। এই সময়টাতে তিনি একাধারে প্রত্যাদেশ বা অহী পেতে থাকেন। মক্কা ছেড়ে মদিনায় বসতি গড়েন। পরিবর্তন একটা প্রক্রিয়া। কোনো ঘটনা না। এতে প্রয়োজন ধৈর্য, নিবেদন ও চর্চা।
পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া
রাসূল (সাঃ) এর শিশুকাল ছিল মানসিক বিকাশ ও আবেগ ভালোবাসার। কৈশোরে তিনি তাঁর প্রাণশক্তি ব্যবহার করেছেন অভিজ্ঞতা অর্জনে। যুবক বয়সে তিনি তাঁর সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন সমাজসেবায়। ৪০ বছর বয়সে তিনি বড়সড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। অপ্রত্যাশিত ঘটনা সামলাতে শেখেন।
এই অধ্যায়ে আমরা প্রায়ই পরিবর্তন বা বদল’ শব্দদুটো দেখব। কারণ এ সময়টাতে তিনি নিজে তো বটেই; পরিবার, বন্ধুবান্ধব অনেকের পরিবর্তন দেখেছেন। এই অধ্যায়ে আমরা কথা বলব, চল্লিশের কোঠার রাসূল (সাঃ) এর জীবন নিয়ে। সেই সঙ্গে যারা তাঁর পাশে ছিলেন, তাদের অনুপ্রেরণামূলক কাহিনিগুলোও বলব।
পরিবর্তন সহজ না। এজন্য প্রশিক্ষণ দরকার। এই অধ্যায়ের আরেকটি মূলশব্দ ‘পরিবর্তন’। কেউ কেউ পরিবর্তনের জন্য প্রশিক্ষণের গুরুত্বকে খাটো করে দেখেন। মনে করেন, তথ্য শুষে নিলেই বুঝি আপনাআপনি মানুষ বদলে যায়; বরং এজন্য প্রয়োজন যেকোনো পরিবর্তনের পর নতুন সময়ের সাথে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য নিজের আচরণকে খাপ খাইয়ে নেওয়া।
এই অধ্যায়ে আমরা আরও দেখব, কোন কোন কারণ মানুষকে পরিবর্তনের জন্য তাড়া দেয়। বিশেষভাবে দেখব সেই সব প্রভাব সৃষ্টি করা পরিস্থিতিগুলো, যেগুলো মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আকাক্ষা জাগিয়ে তোলে। রাসূল (সাঃ) এর ডাকে বদলে যাওয়া অনেক মানুষের কাহিনি শুনব। আমরা পরিবর্তনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলব। সেই সাথে পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী বদলে যাওয়া, অকেজো অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া এবং যেটা বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে, সেগুলো নিয়েও কথা বলব।
আমরা আরও দেখব, মক্কায় অবতীর্ণ হওয়া কুরআনের আয়াতগুলোতে প্রথম দিকের কনভার্টেড মুসলিমদের পরিবর্তনের ধারা ও কার্যকারণ। কেমন করে এ আয়াতগুলো তাদের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছিল? না- বদলানো মূর্তিপূজারীদের কথাও শুনব। কেনই-বা তারা বদলাতে চায়নি, তাও জানব।
কেন সাধারণভাবে বেশিরভাগ লোক বদলে যেতে ভয় পায়, বা বদলানোর চিন্তাকে বাতিল করে দেয়? আমাদের কিছু অভ্যাস, পরিবেশ। নিজেদের বদলানোর পথে বড় বাধা। প্রয়োজনে এসব অভ্যাস আর পরিবেশও ছেড়ে দিতে হয়। রাসূল (সাঃ) যে মক্কা ছেড়ে মদিনায় গেলেন। কেন? আসুন জেনে নিই।
৪০ বছরে পরিবর্তন
চল্লিশ বছর বয়সকে মানুষের জীবনের পালাবদলের সময় ধরা হয়। এ বয়সের উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন,
যখন সে বলিষ্ঠ হয়, চল্লিশ বছরে পৌছে তখন বলে, ‘প্রভু, আমাকে, আমার বাবা মাকে যে-অনুগ্রহ দিয়েছেন, সেজন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করার সামর্থ্য দিন! আহকাফ : ১৫
৪০ বছর বয়সে হওয়া রাসূল (সাঃ) এর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন শুরু করব। পর্বত গুহায় রাসূল (সাঃ) চিন্তামগ্ন। হঠাৎ করে অভূতপূর্ব একটা ব্যাপার ঘটে গেল। মহান আল্লাহর এক বার্তাবাহক (ফেরেশতা) তাঁর সামনে এসে বললেন, পড়! রাসূল (সাঃ) ভীষণ ভয় পেলেন। তিনি বার বার বলছিলেন, তিনি পড়তে জানেন না। আতঙ্কে তাঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ফেরেশতা তাঁকে খপ করে ধরে প্রচণ্ড জোরে ঝাকি দিলেন।
আবার বললেন, ‘পড়’! রাসূল (সাঃ) এর সামনে পড়ার মতো কিছুই ছিল না যদিও। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়ব? ফেরেশতা আবার তাঁকে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘পড়’! রাসূল (সাঃ) আবারও বললেন যে তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন। পড়তে জানেন না। ফেরেশতা শেষবারের মতো তাঁকে ঝাঁকি দিলেন। এবার এত জোরে যে তাঁর মনে হলো আত্মা বুঝি দেহ থেকে বের হয়ে যাবে। তিনি আবার বললেন, ‘পড় তোমার সেই প্রভুর নামে যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। আল আলাক :১
ফেরেশতা জিবরাঈলের সাথে রাসূল (সাঃ) এর এই ঘটনার পর তাঁর জীবন খোলনলচে বদলে গিয়েছিল। পর্বত গুহায় রাসূল (সাঃ) কে শারীরিকভাবে যন্ত্রণাময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ফেরেশতা জিবরাঈল তাঁকে কঠিনভাবে চেপে ধরেছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি তাকে আবার দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। লম্বা সময় ধরে তিনি যদি না-আসতেন তাহলে চিন্তিত হয়ে পড়তেন।
পরিবর্তন আমাদের সবার জন্য প্রচণ্ড কঠিন বা যন্ত্রণাময় হতে পারে। কারণ, এটা একজন মানুষকে আরামের জায়গা থেকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে অপরিচিত জায়গায় নিয়ে যায়। কিন্তু একবার যখন সে নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়, তখন আর ব্যথা থাকে না। মানুষ আসলে পরিবর্তন নিয়ে দোনমনা করে না, তারা আসলে পরিবর্তনের সাথে আসা কষ্টকে ভয় পায়। আপনাকেও কষ্ট সহ্য করার জন্য তৈরি থাকতে হবে। দিনশেষে এগিয়ে থাকার জন্য মূল্য দিতে হবে। বড় কোনো পরিবর্তন ফ্রি ফ্রি আসে না।
রাসূল (সাঃ) খুব দ্রুত সাতজন মানুষের জীবন বদলে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা (৫৫ বছর), তাঁর কন্যা যাইনাব রাদিয়াল্লাহু আনহা, রুকাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা ও উম্মু কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা ; তাঁর চাচাত ভাই আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু (১০ বছর); সে-সময়ে তাঁর পালকপুত্র (পালকপুত্রে বিধান পরে বাতিল হয়ে যায়) যায়েদ ইবনে হারিসা রাদিয়াল্লাহু আনহু (৩০ বছর); তাঁর বন্ধু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু (৩৮ বছর)।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আরও পাঁচজন লোককে বদলে দিয়েছিলেন। ওসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু (৩৪ বছর), আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু (৩০ বছর), তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ, সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু (১৯ বছর), আয যুবাইর ইবনে আল আওওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু (১৬ বছর)। মজার বিষয় হচ্ছে, এই লোকগুলোর মধ্যে পরিবর্তন এত দ্রুত কীভাবে হলো? সাধারণভাবে মানুষের মাঝে আইডিয়াগুলোই বা কীভাবে ছড়ায়?
লিডারশিপ ও ম্যানেজমেন্ট থিউরিতে কানেক্টরনামে একটা কথা আছে। এরা জানেন কীভাবে মানুষের সাথে লিংক করতে হয়। এরা একজন থেকে আরেকজনে অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনামূলক আইডিয়া নিয়ে যায়। আজকের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ঠিক যেভাবে করে। এ ধরনের লোকদের মাধ্যমে আইডিয়া সফলভাবে ছড়ায়।
আবু বকর আস সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এখানে একজন কানেক্টর। তিনি বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। যেমন সা’দ ছিলেন টিনএজ বয়সী। অন্যদিকে ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর বয়স ছিল ৩৪।
পরিবর্তনের আইডিয়াতে যারা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, দ্রুতই তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৩ থেকে ২০। এরপর ৩০। প্রথম দিকের ইসলামি ইতিহাসবিদ ইব্ন্ হিশাম এমনটাই বর্ণনা করেছেন।
আমরা এখন এমন কিছু লোকদের ব্যাপারে জানব, যারা তাদের জীবন। বদলে ফেলেছিলেন (এক্ষেত্রে ইসলামে ফিরে এসেছিলেন)। আপনারা যারা নিজেদের জীবন বদলাতে চাচ্ছেন তাদের জন্য এই অভিজ্ঞতাগুলো নতুন কিছু দিতে পারে।
আমরা বিশেষ করে তাদের দিকে নজর দেব, যারা নিজেদের পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তাদের কাহিনি জানব, যাতে আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে মেলাতে পারি।
আমর আস সুলামী (রাঃ)
আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর দ্রুত বদলে যাওয়া বেশ চমকপ্রদ ব্যাপার। রাসূল (সাঃ) এর সাথে খুব সংক্ষিপ্ত এক আলাপের পর তিনি তার জীবন পুরোপুরি বদলে ফেলেন। তাদের আলাপের শুরু হয়েছিল এভাবে
– কে আপনি?
– আমি নবি।
– নবি কী?
– আমাকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন।
– কেন তিনি পাঠিয়েছেন?
– আত্মীয়তার সম্পর্ক জুড়তে, মূর্তি ভেঙে গুড়ো গুড়ো করতে, মহান
আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করতে।
– ঠিক আছে, আমি আপনাকে অনুসরণ করব।
এই আলাপচারিতার সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমর কী অসম্ভব দ্রুত বদলে ফেলেছিলেন নিজেকে! একটা কারণ হতে পারে যে, ইসলামের আগে তিনি তাওহিদবাদী ছিলেন। কাজেই রাসূল (সাঃ) যখন মূর্তি ভেঙে গুড়ো গুড়ো করার কথা বললেন, সেটা তার কাছে বোধগম্য হয়েছে, গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু আরবের অনেকে তাওহিদবাদীই রাতারাতি বদলে যাননি। এক্ষেত্রে আমরের বেলায় কোথায় আলাদা কিছু ছিল?
কেউ কেউ বলতে পারেন, এটা আল্লাহর তরফ থেকে পথনির্দেশ। কিন্তু আরও কিছু মূল ফ্যাক্টর ছিল এই আলাপে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একটা ফ্যাক্টও ছিল, অন্যের সাথে কথা বলার সময় রাসূল (সাঃ) এর আশ্বস্ত করার সামর্থ্য। সফল আলাপচারিতায় শুধু মুখের কথার বাইরেও অনেক ব্যাপারস্যাপার থাকে। যেমন- রাসূল (সাঃ) এর আন্তরিক মুখভঙ্গী, কণ্ঠে দরদ, প্রাণবন্ত দেহভঙ্গিমা- যা আমরা এই সংলাপ পড়ে উপলব্ধি করতে পারছি না।
জুদি বার্গুন (Judee Burgon) ১৯৯৬ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, শুধু মুখের অঙ্গভঙ্গী দিয়ে ২০ হাজার ভিন্ন ভিন্ন হাবভাব প্রকাশ করা যায়।
আর মুখের হাবভাব মিথ্যা বলে না। ১৯৬৭ সালে উকলা (UCLA) গবেষণা থেকে বলা হয়েছে যে, ৯৩ ভাগ যোগাযোগই অবাচনিক (৫৫ ভাগ শারীরিক নড়াচড়া থেকে, ৩৮ ভাগ কণ্ঠস্কর থেকে), মাত্র সাতভাগ আসে শব্দ বা কথা থেকে।
রাসূল (সাঃ) এর এক সমসাময়িক ব্যক্তি তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, তাঁর চেহারা দেখেই বুঝেছি, কোনো মিথ্যুকের চেহারা এমন হতে পারে না। আমর ও অন্যান্যরা কীভাবে দ্রুত বদলে গিয়েছিল সেটা বুঝার জন্য রাসূল (সাঃ) এর কথা বলার স্টাইল খেয়াল করুন। কল্পনা করার চেষ্টা করুন অন্যের সাথে কথা বলার সময় তাঁর মুখভঙ্গী, কষ্ট, দেহভঙ্গী।
এবার আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর সাথে রাসূল (সাঃ) এর আলাপের শেষ অংশ দেখি:
– আমি আপনাকে অনুসরণ করব।
– আজকে পারবেন না। দেখছেন না, আমি এবং আমার লোকেরা কী অবস্থায় আছি? আপনি আপনার লোকদের কাছে ফিরে যান।যদি শোনেন আমি এসেছি, তাহলে আমার কাছে আসবেন।
এই ঘটনার আরেকটি নজরকাড়া দিক হচ্ছে, রাসূল (সাঃ) কে না-দেখেই দশ বছরেরও বেশি সময় আমর মুসলিম ছিলেন। এরপর আবার রাসূল (সাঃ) কে দেখেন যখন তিনি মদিনায় বসতি গড়েন।
হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন শুনলেন রাসূল মদিনায় এসেছেন, তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘আমাকে চিনতে পারছেন’?
– হ্যাঁ। মক্কায় দেখা হয়েছিল আপনার সাথে। ক্ষণিকের সেই আলাপচারিত কতটা ছাপ ফেলেছিল সেটাও এখান থেকে বুঝা যায়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)
মক্কার পূর্ব দিকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে হুযাইল নামক জায়গা থেকে আবদুল্লাহ এসেছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি এখানে মেষ চড়াতেন। একবার তিনি যখন মেষ চড়াচ্ছিলেন, তখন রাসূল (সাঃ) তাঁর পাশ দিয়ে গেলেন। ভেড়ার দুধ খেতে চাইলেন। আবদুল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তিনি পারবেন না, কারণ ভেড়াগুলো তার না। রাসূল (সাঃ) তখন তাকে বললেন কমবয়সী একটা ছাগল নিয়ে আসতে।
তিনি কুরআনের একটা আয়াত পড়লেন, ছাগলের ওলান দুধে ভরে উঠল। রাসূল (সাঃ) ও আবদুল্লাহ পিয়াস মিটিয়ে খেলেন। আবদুল্লাহর জন্য এটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
মানুষ কীভাবে বদলায়?
আবদুল্লাহ ও আমর দুজনের বেলাতেই আসল প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে ও কেন কিছু লোক রাতারাতি পুরোই বদলে যায়। মহান আল্লাহর পথনির্দেশ তো ছিলই, রাসূল (সাঃ) ও তাদের অনুভূতির ওপর বড় ধরনের নাড়া দিতে পেরেছিলেন।
চিপ (Chip) ও ড্যানি হিথ (Dan Heath) এই যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে নাড়া পড়লে মানুষের বিশ্বাস ও অভ্যাস যতটা বদলায়, তারচেয়েও বেশি বদলায় মানুষ যখন তার আবেগের পর্যায়ে নাড়া খায়।
এর মানে এই না যে, যুক্তি মানুষকে বদলাতে পারে না। যুক্তি ও আবেগ দুটোই কাজ করে। তবে পরিবর্তনের বেলায় এদুটোর যেটার আধিপত্য বেশি সেটাই পরিবর্তনের প্রকৃতির ওপর বেশি প্রভাব ফেলবে।
যুক্তিচিন্তা মানুষের মধ্যে যে-পরিবর্তনগুলো আনে সেগুলো খুব নির্দিষ্ট। স্পষ্ট। যেমন- আপনি যখন আপনার খরচের হাত কমাতে চান এবং বেতনের দশ ভাগ জমাতে চান, তখন ঐ বুঝা যায় যে পাঁচবছর পর আপনি একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য এমন করছেন।
যৌক্তিক এই পরিবর্তন একটা ক্রমধারা মেনে চলে। আর তা হচ্ছে, বিশ্লেষণ-চিন্তা-পরিবর্তন বা (Analyze-Think-Change)’। অন্যদিকে যে পরিবর্তন আবেগে দোলা দিয়ে আসে সেটার ক্রমধাপ আলাদা। দেখা -অনুভব-পরিবর্তন বা (See-Feel-Change)। বড় ধরনের ব্যাপক পরিবর্তনে এটা প্রায়ই দেখা যায়।
ড্যান আর চিপ হিথ লিখেছেন,
সাধারণত এমন হয় না যে, না-বুঝার কারণে মানুষ বদলাতে পারেনি। ধূমপায়ীরা জানে সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, কিন্তু তাও ছাড়ে না। কিছুটা হলেও আমরা তাদের এই অবস্থা বুঝতে পারি। কীভাবে করতে হবে এটা জানা, আর করার জন্য উদ্দীপ্ত হওয়া এদুটোর মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা আমরা জানি। কিন্তু অন্যের আচরণ পরিবর্তনের বেলায় প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে তাকে কিছু শেখাতে হবে।
আবেগের কারণে বদলে গেছেন এমন আরও নজির আছে। এর কারণ, তারা যা দেখেছেন বা শুনেছেন তা তাদের ভালোর দিকে বদলে যেতে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে।
দাউস গোত্রের একজন নেতা তুফাইল আমর। মক্কার দক্ষিণে আল বাহা নামক জায়গায় তিনি থাকতেন। রাসূল (সাঃ) কে তিনি কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করতে শোনেন। আর তাতেই তার হৃদয়ে শিহরণ বয়ে যায়। তিনি বলতে বাধ্য হন, আমার জীবনে এর চেয়ে ভালো কিছু শুনিনি কখনো। তিনি ইসলামে আসার পর তার পরিবারসহ আরও ৭০ জনকে ইসলাম গ্রহণে রাজি করান। আল কুরআনের শব্দ আর রাসূল (সাঃ) এর বাচনভঙ্গি দুটোই বেশ শক্তিশালী ছিল।
দিম্মাদ সালাবা ছিলেন প্রসিদ্ধ ডাকিনিবিদ। জিনের আসর ও জাদুটোনা থেকে মানুষকে মুক্ত করতেন। তার পরিবর্তন ছিল পুরো ১৮০ ডিগ্রি। তিনিও রাসূল (সাঃ) এর মুখে কুরআন পাঠ শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বলেছেন, ‘এরকরম কথা তো কোনো দিন শুনিনি।
আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন গিফার অঞ্চলের তাওহিদবাদী। মক্কা থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে গিফার। রাসূল (সাঃ) এর সাথে দেখা করে জায়গায় দাঁড়িয়েই ইসলামে প্রবেশ করেন। কুরাইশ বা অন্যরা কী করবে না-করবে এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। হাদীসে পাওয়া যায়, ইসলাম গ্রহণের কারণে একদল মূর্তিপূজারি দুষ্কৃতিকারীরা তার ওপর হামলা করেছিল।
এই তিনজন মানুষের প্রত্যেকের বেলায় কমন ব্যাপার হচ্ছে পরিবর্তনের চিন্তার ব্যাপারে তাদের খোলামন। পরিবর্তনের ব্যাপারে যাদের মন বন্ধ, তারা একে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখবে। বদলে যাওয়ার পর কী কী বদলাতে হবে (যেমন অভ্যাস, স্মৃতি ইত্যাদি) সেগুলোতে তাদের নজর ছিল না; বরং পরিবর্তনের পর নতুন যে জীবনব্যবস্থায় তারা কাটাবেন, সেদিকে তাদের খেয়াল ছিল।
পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া
অন্য শতাব্দীগুলোর সাথে একুশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় পার্থক্য দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। টেলিফোন থেকে মোবাইল, এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে উইকিপিডিয়া, ইটপাথরের মার্কেট থেকে অনলাইন শপিং আরও কত কী! যে কারণে পরিস্থিতির দাবি মেনে বদলে যাওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা।
পরিস্থিতির দাবি মেনে বদলে যাওয়া মানে শুধু নতুন নতুন জিনিস শেখা না। যেসব জিনিস এখন আর কাজে লাগে না, সেগুলো ভুলে যাওয়াটাও এর মধ্যে পড়ে। ভুলে যাওয়া কঠিন। সবাই তা পারে না। বিশেষ করে নির্দিষ্ট একটা বয়সে পৌছার পর। ভুলে যাওয়ার জন্য পরিবর্তনকে বরণ করতে হয়। একে সামলানোর আত্মবিশ্বাস লাগে। প্রফেসর বিল লুকাস বলেছেন,
আজকের জমানায় টিকে থাকতে হলে প্রতিভার ব্যাপারে ভিন্ন চোখ গড়তে হবে। আইকিউয়ের মতো সংকীর্ণ ধরনের বুদ্ধিমত্তার ধরা বাঁধা ধারণার ওপর নির্ভর করার দিন আর এখন নেই। সামনের দিনগুলোতে দিনে দিনে আমরা আগ্রহী হবো মানুষের মন কীভাবে কোনো জিনিস ভুলে যাওয়ার দিকে যাচ্ছে সেদিকে। যাতে বিভিন্ন পরিবেশে লাগাতার সে তার বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে পারে।
ভুলে যাওয়ার এই সামর্থ্যই তুফাইল ও দিম্মাদের অভিজ্ঞতার অনুপ্রেরণামূলক দিক। পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে তুফাইল ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। আমি খারাপ থেকে ভালো আলাদা করতে পারি। এই লোকের কথা আমি কেন শুনব না?
দিম্মাদ ছিলেন ডাকিনিবিদ। কিন্তু সত্য চেনার পর অতীতের এই বিদ্যা ভোলার জন্য তিনি পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন। আমি জ্যোতিষী, জাদুকর, কবিদের কথা শুনেছি। কিন্তু এমন কথা আমি জীবনে শুনিনি।
পরিবর্তনের বেলায় অনেকের চ্যালেঞ্জ হলো, পরিচিত ও আরামদায়ক কিছু ছেড়ে পুরোপুরি নতুন ও অপরিচিত কিছু হাতে নেওয়া। আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর বেলাতে তা-ই হয়েছিল। কাফেলা আর সফরকারীদের লুট করাই ছিল তার কাজ। কিন্তু সেটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নতুন জীবন রীতি গ্রহণ করেছিলেন।
যত ইচ্ছাই থাকুক, অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া সবসময় কঠিন। কারণ অতীত স্মৃতি হৃদয়ে কড়া নাড়তে পারে। কিন্তু নতুন ও অপরিচিত কিছুর সাথে স্মৃতিকাতরতার কিছু নেই। তবে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার পুরোনো সুখ (দ্রুত টাকা, লুট করে নিজের ক্ষমতা জাহির) ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন। ভবিষ্যতের দিকে চিন্তার মোড় ঘুরিয়েছিলেন (যেমন- কীভাবে কুরাইশদেরকে তার ইসলামে আসার কথা বলবেন)।
পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটা ভালো মানসিক কৌশল। পুরোনো স্মৃতি নিয়ে আহাজারির মানসিকতা ছেড়ে নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতির জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করুন। আপনার নতুন অভ্যাস কীভাবে আপনার জীবনকে আরও সুন্দর করবে সেটা কল্পনা করুন। পুরোনো অভ্যাস ফেলে দিলে কী হারাবেন, এগুলো চিন্তা করে মাথা খারাপ করবেন না। পরিবর্তনের পর আপনার অবস্থা কল্পনা করুন যাতে পরিবর্তনের ব্যাপারে অধীর আগ্রহ বাড়ে। আর অতীতের সাথে জোড়া কমে।
আমি বলছি না যে এতে পরিবর্তনের পথ সহজ হবে। তবে এতে পরিবর্তনের কষ্ট অনেকটা কমবে।
কুরআনে পরিবর্তন
আমি এখন পরিবর্তনের ভাষার প্রকৃতি নিয়ে কথা বলব। কুরআনের প্রথম দিকের সূরাগুলো নাজিল হয়েছিল রাসূল (সাঃ) মক্কায় থাকা অবস্থাতে। মক্কাবাসীরা কুরআনের সেই ভাষাভঙ্গিমার প্রতি কীভাবে সাড়া দিয়েছিল?
কুরআনের প্রায় চারভাগের তিনভাগ সূরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। শুরু হয়েছে যখন ফেরেশতা জিবরাঈল রাসূল (সাঃ) কে বলেছেন, ‘পড়!
মাক্কী সূরাগুলোতে মহান আল্লাহর একত্ব, শক্তিশালী নৈতিক মূল্যবোধের, গুরুত্বের কথা বলেছে, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করেছে, নবি-রাসূল ও বিশ্বাসীদের অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি বলেছে, জান্নাতের তাক লাগানো বর্ণনা ও জাহান্নামের ভয়াবহতার কথা বলেছে।
মাক্কী সূরাগুলোর ছন্দ দ্রুত। ঠিক যেন ও সময়ে যারা বদলে গিয়েছিল তাদের মতো। কুরআনের ১১৪টি সূরার ৮৬টি সূরা রাসূল (সাঃ) মক্কায় থাকা অবস্থায় নাযিল হয়েছে। ৪ হাজারেরও বেশি আয়াত আছে এই সূরাগুলোতে। শুরু হয়েছে ‘পড়’! দিয়ে। শেষ হয়েছে ৮৩ নম্বর সূরা আল মুতাফফিফীন দিয়ে।
কুরআনের আয়াত সব মক্কাবাসীর মন জয় করেনি। তবে বেশ ভালো পরিমাণ মানুষের মনকে বদলে দিয়েছিল। এমন বড়সড় পরিবর্তনের পথে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
মক্কার সংখ্যাগরিষ্ঠর এই পরিবর্তনকে কীভাবে দেখেছে
মক্কার নেতাগোত্রীয় লোকেরা সমাজের তৎকালীন অবস্থায় ভালো উপকার পাচ্ছিল। যে কারণে স্বাভাবিকভাবে তারা এই পরিবর্তনের ঘোরবিরোধী ছিল। যেকোনো বড় পরিবর্তনে জয়ী, পরাজয়ী থাকে। মক্কার বেশিরভাগ আয় হতো মূর্তিপূজারী তীর্থযাত্রীদের মক্কা সফর থেকে। এই রীতি যদি তাওহিদবাদী ধর্ম বদলে দেয়, তাহলে তা শহরের আয় ও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এর দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন,
তারা বলে, আমরা যদি তোমার সাথে পথনির্দেশ অনুসরণ করি, তাহলে আমাদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে’। আল কাসাস : ৫৭
মক্কাবাসী যেভাবে পরিবর্তনে বাধা দিয়েছে
- কাবায় সালাত আদায়ের সময় মুসলিমদের হয়রানি করেছে। তোমরা কি তাকে দেখেছ যে, একজন দাসকে বাধা দেয় যখন সে সালাত পড়ে? আল আলাক : ৯-১০
- রাসূল (সাঃ) ক্ষমতার পেছনে ছুটেছেন এমন গুজব ছড়িয়েছে।
- ইসলামের দিকে ফিরে আসাদের ওপর শারীরিকভাবে হামলা করেছে। কখনো কখনো মেরে পর্যন্ত ফেলেছে। যেমনমক্কাবাসীরা বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু -কে নির্যাতন করেছে। সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু কে শহীদ করে ফেলেছে।
আগেই বলেছি, পরিবর্তনের জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলানোর মানসিকতা ও ভবিষ্যত জীবনের প্রতি নজর দিতে হয়। আরও দরকার নতুন দক্ষতায় প্রশিক্ষণ যেটা পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এখন দেখব নতুন ফিরে আসা মুসলিমরা নতুন জীবনের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য কী করেছিলেন।
প্রশিক্ষণের গুরুত্ব
তিন বছরব্যাপী ইসলাম গ্রহণকারী নব-মুসলিমরা আল আরকাম নামে এক সাহাবীর বাড়িতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যেকোনো প্রক্রিয়াতে প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নতুন জীবন রীতিতে অভ্যস্ত হওয়ার ব্যাপারটা চর্চার সাথে আসে। লেকচার আর লেসনের মাধ্যমে না। আমি এখানে প্রশিক্ষণের গুরুত্বের কথা বলব আল আরকামের বাড়িতে কী হতো সেটা বলে।
আব্বাসিদ শাহজাদা যখন আল আরকামকে অনেক পরে মসজিদ বানান তখন থেকে এটি আল খুযায়রানের বাড়ি নামে পরিচিত হয়। বায়তুল্লাহর সীমানা বাড়ানোর কারণে এখন আর এটি নেই।
আল আরকামের বাড়িতে ৪০ জন পর্যন্ত মানুষ এক হতে পারত। তারা সেখানে রাসূল (সাঃ) এর কাছ থেকে শিখতেন, ইবাদত করতেন, নতুন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতেন। নতুন কনভার্টদের মন জয় করবেন কীভাবে সেটাও শিখতেন।
প্রশিক্ষণ মানে যা শিখছি তা চর্চা করা। শেখা ও চর্চা দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২১ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ শুধু শেখা না, যা শিখছি তা চর্চা করাও। ইসলামে আসা সাহাবীগণ যদি আল আরকামের বাসায় প্রতিদিন দুঘণ্টা করে মোট তিন বছর প্রশিক্ষণ নেন, তাহলে মোট সময় দাঁড়ায় ২ হাজার ঘন্টা।
শুধু শিখে আসল পরিবর্তন আসে না। আসে প্রশিক্ষণ ও চর্চার মাধ্যমে। কাজেই প্রশিক্ষণের গুরুত্বকে নিচু করে দেখবেন না। প্রশিক্ষণের মধ্যে আছে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ সেশনে উপস্থিত হওয়া।
কেউ কেউ প্রশিক্ষণকে পাত্তা দেন না। শুধু নিজেদের তথ্য বাড়ানোর দিকে নজর দেন। যে কারণে তাদের কাজের মধ্যে এসব তথ্যের কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। কেউ আবার প্রশিক্ষণ নিতে বিব্রতবোধ করেন। মনে করেন তিনি যেকোনো একটা দক্ষতা জানেন না, এটা জানলে অন্যরা না-জানি কী মনে করবে।
এই নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। তবে বীরত্ব তো সেখানেই, যখন নিজেকে আরও ভালো মানুষে পরিণত করার জন্য কেউ কঠিন অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্মার্ট প্রশিক্ষক আপনাকে উৎসাহিত করবে, আপনাকে গড়ে উঠতে নাড়া দেবে। কিন্তু অন্যের সামনে আপনাকে বিব্রত করবে না।
নিরাপদ পরিবেশ
স্মার্ট প্রশিক্ষক প্রশিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ দেয়। যেখানে সে একবার ভুল করলে বারবার শুধরানোর সুযোগ পায়। যেখানে পরিণামের ভয় না করে কোনো নির্দিষ্ট দক্ষতায় তার ঘাটতি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারে।
আল আরকামের বাড়িতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা সাহাবীগণ এমন পরিবেশই পেয়েছিলেন। রাসূল সেখানে শান্ত ও সহমর্মী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের পথনির্দেশ দিয়েছেন। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি; বরং নজর দিয়েছেন তাদের আচরণের উন্নতির দিকে। যেমন- কীভাবে সঠিকভাবে সালাত পড়বে।
রাসূল (সাঃ) এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছিলেন যেখানে প্রশিক্ষার্থীদের ভুলের ভয় করতে হতো না। হাসি-তামাশার পাত্র হতে হতো না। ফলে তারা গড়ে উঠতে পারতেন। আল আরকামের এই নিরাপদ পরিবেশ যেকোনো ট্রেনিং কোর্সেই থাকা উচিত। আপনি এতদিন ধরে কতটা জানেন, তার চেয়ে এখানে থাকবে বারবার প্রচেষ্টার সুযোগ। নজর থাকবে আপনার শক্তিমত্তার দিকটা ব্যবহারের ওপর।
নিজের পরিস্থিতি বদলান
পরিবর্তন এবং পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষণের গুরুত্বের কথা বলতে যেয়ে আমরা নজর দিয়েছি ব্যক্তির ওপর। তবে কখনো কখনো ব্যক্তির নিজেকে তার পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলাতে হতে পারে। মক্কা ছেড়ে রাসূল (সাঃ) যখন মদিনায় গেলেন কিংবা নতুন ইসলামে আসা কিছু সাহাবীগণ যখন। ইথিয়োপিয়ায় চলে গেলেন তখন কিন্তু তারা তা-ই করেছিলেন।
কীভাবে নিজের পরিবেশ বদলাবেন এটা নিয়ে কথা বলার আগে এবং যারা। নিজেদের পরিবেশ বদলে ইথিয়োপিয়াতে বসতি গড়েছিলেন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে ফায়দা নেওয়ার আগে, তাদের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে আপনাকে কিছু ধারণা দিই। নিজেকে বা যেখানে আছি সে জায়গা কেন বদলাতে হবে, সে ব্যাপারে এই ঘটনা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে হয়ত।
ইথিয়োপিয়া
এক শ’রও বেশি মক্কাবাসী ইথিয়োপিয়াতে থাকতেন। তাদের ২১ জনের সেখানে স্থায়ী বসতি ছিল। বাকিরা মদিনায় স্থানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানে ছিলেন। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না কীভাবে তারা তাদের নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি, তারা সবাই একসাথে ছিলেন। সেখানে জন্মানো ও বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে মূল্যবোধ ধরে রাখতে বেশ সতর্ক ছিলেন তারা। ইউরোপে যে ৪৪ মিলিয়ন মুসলিম।
বসবাস করেন এবং কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকায় ৪ মিলিয়ন তাদের জন্য এটা ভালো অনুপ্রেরণা হতে পারে। জাফর ইব্ন্ আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু, ২৭ বছর বয়স্ক যুবক। ইথিয়োপিয়ান নেতা আন নাজ্জাশীকে ইসলামে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন তার চমৎকার ক্ষুদেভাষণ আর মনমোহিনী কুরআন তেলওয়াত দিয়ে। সূরা মারইয়াম পাঠ করেছিলেন তিনি।
ইথিয়োপিয়ায় হিজরতকারী মুসলিমদের থেকে আমরা কী উপকার পেতে পারি?
নতুন ইসলাম গ্রহণকারীরা তাদের পরিবেশের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছিলেন। আয যুবিন সাঁতার শিখেছিলেন। আম্নি নামে এক বালিকা স্থানীয় ভাষা রপ্ত করেছিল। আপনিও আপনার আশেপাশের সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে পারেন। কনভার্টরা এক জায়গায় থেকেছিল একত্রে থাকার জন্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে তাদের পরিচয় অটুট রেখেছিল। আপনিও এমন লোকদের সাথে থাকুন, যারা আপনাকে সহযোগিতা করবে। আপনি হয়ত কনভার্ট না। তবে হতে পারে নতুন করে ইসলামে ফিরে এসেছেন। আপনার জন্যও তাই একথাগুলো প্রযোজ্য।
দৃষ্টিভঙ্গি বদলান
আশপাশ বদলানো মানে শুধু নতুন দেশে যাওয়াই না। আপনার উন্নতির পথে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি বাধা দিচ্ছে সেগুলোও। যখন আমরা বলি মেজাজ হারাবেন না, সিগারেট খাওয়া ছাড়ুন, শরীরের বাড়তি ওজনের দিকে নজর দিন, তখন আমরা বলি আপনার সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলান যেটা আপনার মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে, সিগারেট খেতে বলছে বা অতিরিক্ত খেতে বলছে। নিজের ঘরে থেকেই আপনি এটা করতে পারেন।
চল্লিশের কোঠায় রাসূল মক্কাতে কাটিয়েছেন। পঞ্চাশের-এর কোঠায় তিনি নিজেকে এমন এক পরিস্থিতিতে দেখতে পান, যেখানে তাকে মদিনায় যেতে বাধ্য হতে হয়। পরে সেখানেই বসতি গড়েন। এই অবস্থার কথা আমরা এমন এক দৃষ্টিকোণ থেকে বলব, যেটা আপনাকে আরও ভালো হতে অনুপ্রাণিত করবে।
রাসূল (সাঃ) এর জীবনের মূল ঘটনা
চল্লিশের কোঠায় রাসূল (সাঃ) এর জীবনের মূল ঘটনাগুলো আবার দিচ্ছি-
- ৪৩ তম বছর- আল-আরকামে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত
- ৪৫ তম বছর- মুসলিমদের প্রথম দল ইথিয়োপিয়াতে যায়।
- ৪৬ তম বছর- মুসলিমদের দ্বিতীয় দল ইথিয়োপিয়াতে যায়।
- ৪৭-৫০ তম বছর- মূলধারার মাক্কী সমাজ থেকে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর পরিবার ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
দ্বন্দ্ব
একটা সময় রাসূল (সাঃ) ও পরিবর্তন বিরোধীদের মধ্যকার সম্পর্কে চুড়ান্ত অবনতি হয়। মক্কায় প্রায় ৪০ জন উচ্চবর্গের নেতাগোছের লোক ছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন রাসূল (সাঃ) ও হাশিমীদের (রাসূল (সাঃ) এর পরিবার) সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। মানে তাদের সাথে কোনো আর্থিক লেনদেন হবে না। তাদের কাউকে বিয়ে করবে না।
আধুনিক পরিভাষায় একে বলা যায়, সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখা। অর্থনৈতিক বয়কট। কারণ তখন মক্কার জীবন এমন ছিল না যে, কেউ আলাদাভাবে থেকে জীবন চালাতে পারবে। ৩ বছরেরও বেশি সময় হাশিমীদেরকে চরম খাদ্যাভাবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তা আরও বাড়ত যদি না মক্কার এক নেতা হিশাম ইবনে আমরের খারাপ না-লাগত। খারাপ হতে থাকা মানবিক পরিস্থিতি দেখে এবং এই বয়কট শেষ করার জন্য তিনি কোনো পদক্ষেপ না-নিতেন, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহতার দিকে যেত। আচ্ছা, হিশাম ইবনে আমর কীভাবে নিজে নিজে এই উদ্যোগ নিলেন? চলুন দেখি।
যোগাযোগের মাধ্যমে বদল
হিশাম নীরব থাকেননি। তিনি অন্য আরেক স্থানীয় নেতা যুহাইরের সাথে এ নিয়ে আলাপ করেন। তিনিও তাদের এই অবস্থা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন। তবে কিছু করার আগে তিনি আরও লোক খুঁজতে বলেন। হিশাম আল মিত’আমের কাছে যান। তিনিও অনুরূপ কথা বলেন এবং আরও লোক খুঁজতে বলেন। এবার হিশাম আবু আল বাহরীর কাছে যান। তিনি তাকে পঞ্চমজন খুঁজতে বলেন। তো শেষমেষ তারা ছয়জনের গ্রুপে পরিণত হন। যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং সফলভাবে বয়কট শেষ করেন।
খেয়াল করুন, হিশাম কিন্তু কাউকে তাদের মন বদলাতে রাজি করেননি। তারা আগে থেকেই বিষয়টা নিয়ে একমত ছিলেন। তিনি শুধু সংযোগকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ঠিক আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু -এর প্রথম দিকের মুসলিমদের সাথে যেভাবে কানেক্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন, ঠিক সেভাবে।
পরিবর্তনের উপকরণ
যেসব আন্দোলন সফলভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসে তার মধ্যে যা থাকে: অনুপ্রেরণামূলক চিন্তা, ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব, নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী। আজ কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। বেশিরভাগই ফেসবুক আর টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মাধ্যমে সংযুক্ত। এরা একটি চিন্তার পেছনে এক হতে পারে এবং পরিবর্তন দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে।
কীভাবে সাধারণত পরিবর্তন ঘটে সে ব্যাপারে সেথ গোডিন তার সাড়া জাগানো বই ট্রাইবস’-এ বলেছেন-
[‘পরিবর্তনের জন্য’] আন্দোলন ঘটে যখন লোকেরা একে অপরের সাথে কথা বলে, যখন চিন্তা গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং সবশেষে একে অপরের সমর্থন পেয়ে তারা সেই কাজটার দিকে এগিয়ে যায়, যেটা তারা সবসময় জেনে এসেছিল সঠিক কাজ।
হিজরত
বয়কট শেষ হলেও রাসূল (সাঃ) এর অবস্থা খুব একটা উন্নত হয়নি; বরং আরও অবনতি হয়েছিল। কারণ কয়েকদিনের ব্যবধানে তাঁর চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজা মারা যান। তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়দাতার মৃত্যুতে বিরোধীরা নতুন সমারোহে নাজেহাল অভিযান শুরু করে। চাচা মারা যাওয়ার আগে কুরাইশরা আমার সাথে ঘৃণ্য কিছু করতে পারত না। রাসূল স্মৃতিচারণ করে বলেছেন।
৫৩ বছর বয়সে রাসূল (সাঃ) মক্কা ছেড়ে চলে যান। শেষ দশ বছর মদিনাতে কাটান। পরের অধ্যায় ও শেষ অধ্যায়ে আমরা মদিনা জীবন নিয়ে কথা বলব এবং আরও বলব আরব উপদ্বীপে পরিবর্তনের জন্য তিনি যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে। আমরা এই অধ্যায়ের শেষে চলে এসেছি। আমার লক্ষ্য ছিল পরিবর্তন সৃষ্টির জন্য আপনাকে উদ্দীপ্ত করা, রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর কিছু বন্ধুদের অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ দেওয়া।
আমরা তাঁর জীবনের বাঁকবদল করা মুহূর্ত দেখেছি। এর শুরু হেরা পর্বতগুহায় অহী অবতীর্ণ দিয়ে আর শেষ মদিনায় হিজরত করে। বলেছি নিজের উন্নতি ও ভালো কোনো পরিবর্তনের পথে কীভাবে আপনি এই বাঁকবদল মুহূর্ত থেকে উপকৃত হতে পারেন।
পরিবর্তনে পেছনে কী কী কাজ করে তাও দেখেছি। আবেগি ও যৌক্তিক ব্যাপারস্যাপার; পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, নতুন জীবনের আকাঙ্ক্ষা, কীভাবে নিজেকে বিকশিত করা যায় তা নিয়ে চিন্তা এবং সফলভাবে পরিবর্তন আনতে দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছেন।
আমাদের একবিংশ শতাব্দী ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন এখন একটা বাজওয়ার্ড। মানে চারিদিকে একই কথা। পরিবর্তন চাই। বদল চাই। এজন্য সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এবং পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন নিজেকে দ্রুত বলানোর ক্ষমতা।
নবিজির চল্লিশের কোঠার জীবন থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
(নোটঃ এখানে ৪০ মানে আক্ষরিক অর্থে চল্লিশ না। আমি আসলে জীবনের একটা পর্যায় বুঝাচ্ছি। যে বয়সটাতে মানুষ পরিণত মনের অধিকারী হয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে এটা একেক বয়স হতে পারে)।
রাসূল (সাঃ) তাঁর চল্লিশে | পরিণত বয়সে আপনি |
জিবরাঈল ফেরেশতা যখন তাঁকে চেপে ধরেছিল তখন তিনি প্রচণ্ড যন্ত্রণা পেয়েছিলেন, কিন্তু তবু তিনি বার বার তাঁকে দেখতে চেয়েছেন। লম্বা সময় ধরে তার দেখা না-পেলে তাঁর মন খারাপ হতো। | পরিবর্তনের জ্বালা সহ্য করুন। কারণ এটা আগুনের পরিক্ষা যা আপনাকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবে। |
রাসূল (সাঃ) নিজেকে ও তাঁর বন্ধুদের আল আরকামের বাড়িতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য। | একবিংশ শতাব্দীতে টিকে থাকতে হলে আপনাকে শিখতে হবে। তবে প্রতিষ্ঠালাভ করতে হলে শিখতে হবে, প্রশিক্ষণ নিতে হবে, চর্চা করতে হবে। |
রাসূল (সাঃ) মক্কা ছেড়ে মদিনায় বসতি গড়ে তাঁর পরিবেশ বদলে ফেলেছিলেন। | আপনার পরিবেশ যদি আপনাকে টেনে ধরে রাখে, তাহলে পরিবেশ বদলান। সেটা হতে পারে জায়গা অথবা অবস্থা। |
.
১. এই বিষয়ের ওপর আমি রিচার্জ কচ ও গ্রেগ লকউড-এর সুপার কানেক্ট হারনেসিং দ্য পাওয়ার অফ নেটওয়ার্কস অ্যান্ড দ্য স্ট্রেন্থ অফ উইক লিঙ্কস বইটা পড়তে বলব।
২. সুইচ: হাউ টু চেঞ্জ থিংস হোয়েন চেঞ্জ ইজ হার্ড, চিপ হিথ ও ড্যান হিথ
৩. দেখুন: এম রায়ন, অ্যাডাপ্টিবিলিটি: হাউ টু সারভাইভ চেঞ্জ ইউ ডিডন্ট আন্ধ ফর।