৮
গ্রীষ্মের রাত, যার যেখানে খুশি শুয়ে পড়তে পারে। অতিথিদেরও বাড়ি ফেরার কোনও গরজ নেই, কারণ কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম খেয়ালও করিনি। পিউয়ের গানটাই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পরেও আরও কিছুক্ষণ আড্ডা জমেছিল কিনা জানি না।
কে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমার মাথায়। ঘুমের মধ্যে মনে পড়ে না কোথায় শুয়ে আছি। কলকাতায় আমার নিজের বিছানায়? না, তোষক টোষক তো নেই। কোনও সমুদ্রের তীরে? না, না এটা দিকশূন্যপুর, টিলার ওপর বন্দনার বাড়ি। বন্দনাদি আমায় আদর করছে?
চোখ মেলে একটা নারী মুখই দেখলুম, বন্দনাদি নয়। রোহিলা! একবার বুকটা কেঁপে উঠল। ওর আবার আবার পাগলামি জেগেছে নাকি?
আকাশে এত আলো কেন? মাঝরাতে মেঘ সরে গিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে। রোহিলার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বসে আছে আমার শিয়রের কাছে, মুখের চন্দনের ফোঁটাগুলি মাখামাখি হয়ে গেছে। চুল থেকে খসে গেছে সেই পারিজাত ফুল।
রোহিলা ফিসফিস করে বলল, নীললোহিত, নীললোহিত, ওঠো? যাবে না?
আধো ঘুমের মধ্যে বললুম, কোথায় যাব?
রোহিলা বলল, বাঃ, আমাদের এখান থেকে চলে যাবার কথা নয়? দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এবার আমি উঠে বসে চোখ মুছলুম।
লম্বা বারান্দাটার এক পাশে শুয়ে আছে জয়দীপ। তার থেকে কিছুটা দূরে সুরথ আর ইসমাইল। বসন্ত রাও ও আরও কয়েকজন বোধ হয় ফিরে গেছে। মেয়েরা কেউ বাইরে নেই।
রোহিলা বলল, চলো, চলো।
আমি বললুম, কিন্তু ব্যাপারটা যে বদলে গেছে। সুরথ আর সুন্দররাজন তোমাকে নিয়ে যাবে বলেছে।
গাঢ় চোখে তাকিয়ে রোহিলা বলল, ছিঃ! তুমি আমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে চাও?
—ওরা যে নিজের থেকেই বলল?
—তুমি না শপথ করেছিলে, আমাকে ছেড়ে যাবে না?
—রোহিলা, ওরা বলছে, আমি বাইরের লোক।
—আমার যে আর ভেতর-বাইরে বলে কিছু নেই। তুমি আমাকে তাজমহলে নিয়ে যাবে না? তা হলে আমাকে একা যেতে হবে?
—না, একা যাবে না।
রোহিলা আমার হাত ধরে টেনে বলল, ওঠো, ওঠো, শিগগির ওঠো। এরপর খুব দেরি হয়ে যাবে।
জয়দীপ জোরে জোরে কিছু বলে উঠল, আমরা দু’জনেই চমকে তাকালুম। না, ও জাগেনি, ঘুমের ঘোরেই কথা বলে। …আমাকে সরবত খেতে দিয়েছিলে, তার মধ্যে বিষ ছিল, ব্যাঙ্কের ভল্টে বিষ ছিল, একটা নীল রঙের সাপ, না, না। আমি রানিকুঠি যাইনি…
রাত্তিরবেলা জয়দীপের পাশে বসে কেউ নোট করে নিলে ওর পূর্ব জীবন বৃত্তান্ত জেনে যেতে পারে।
বন্দনাদিকে কি বলে যাওয়া উচিত? যদি অন্য কেউ জেগে ওঠে? যাক, বন্দনাদি ঠিক বুঝে নেবে। রোহিলার ব্যাকুলতা দেখে আর সময় নষ্ট করা যায় না।
জ্যোৎস্না তো নয়, ভোর হয়ে এসেছে। সূর্য ওঠার আগেকার নীল, নরম আলো। জঙ্গলের দিকটায় কুয়াশার মতন সরে সরে যাচ্ছে অন্ধকার। এর মধ্যেই দূরে কোথাও একটা চোখ গেল পাখি ডাকাডাকি শুরু করেছে।
টিলা থেকে আমরা হাতে হাত ধরে হুড়মুড় করে নেমে পড়লুম। রাস্তায় এসে প্রায় ছুটতে শুরু করল রোহিলা। আমি বললুম, দাঁড়াও, দাঁড়াও, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?
রোহিলা একবার পেছন দিকটা দেখে নিয়ে বলল, যদি পুলিশ এসে পড়ে? ওরা ভোরবেলাতেই আসে, আমি জানি। তার আগেই আমাদের নদী পার হতে হবে!
রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া ফুল ঝরে পড়েছে অনেক। নির্মল বাতাসেরও যেন একটা নিজস্ব গন্ধ আছে।
রোহিলা, বন্দনাদি এরা কেউ এখানে জুতো পরে না। আমি ঝোলা ব্যাগটা এনেছি শুধু, চটি পরতে ভুলে গেছি। ঝরা ফুল মাড়িয়ে মাড়িয়ে যেতে অসুবিধে হচ্ছে না।
হঠাৎ থমকে গিয়ে রোহিলা বলল, যদি পুলিশ এসে পড়ে, তুমি কী করবে? তুমি আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবে?
—সে রকম সম্ভাবনা নেই। এত ভয় পাচ্ছ কেন?
—হঠাৎ খুব ভয় পেয়েই তো আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, এক্ষুনি এসে ওরা আমায় ধরে নিয়ে যাবে। বলো না, যদি আসে, তুমি কী করবে? তুমি কথা দিয়েছো, আমাকে ছেড়ে যাবে না।
—ছেড়ে যাব কেন? পুলিশ এলে বলব, আমাকেও নিয়ে চলো। জেলের ভেতরটা কেমন হয় একবার দেখে আসব। দু’দিন পরেই তো আমাদের ছেড়ে দেবে!
—ছেড়ে দেবে? কেন?
—তুমিও কোনও অন্যায় করোনি, আমিও কোনও অন্যায় করিনি। সেটা ওরা বুঝতে পেরে যাবে!
–কাল রাত্তিরে আমি কি অন্যায় করেছি? বসন্ত রাওকে দেখলেই আমার রাগ হয়ে যায়।
—হ্যাঁ, তুমি অন্যায় করেছ। বসন্ত রাও ভালো মানুষ। সে কতবার ক্ষমা চেয়েছে!
—আমি অন্যায় করেছি। তার জন্য কেউ আমায় শাস্তি দিল না কেন?
–আর একটু হলে আমিই তোমাকে শাস্তি দিতুম!
—তুমি শাস্তি দিতে? তুমি কি আমাকে মারতে?
—আবার যদি ও রকম পাগলামি করো, তা হলে একটু মারব নিশ্চয়ই।
–ওমা, তাহলে তোমার সঙ্গে আমি যাব কেন? আমাকে কেউ কখনও মারেনি। আমার মা…থাক বলব না। তুমি আমাকে সত্যিই মারবে?
—প্রথমেই মারব না। আগে সাবধান করে দেব। বলব, এই, রোহিলা, আবার পাগলামি করছ? শান্ত হও! শান্ত হও! যদি তুমি শান্ত হয়ে যাও, ব্যস, তাহলে আর শাস্তি দেবার প্রশ্নই উঠবে না।
—তুমি বিশ্বাস করো, আমি ওই সুলোচনা নই, ও রকম বিচ্ছিরি, বিদঘুটে নাম আমার হতেই পারে না। আমি রোহিলা। তুমি বিশ্বাস করো, সত্যি করে বলো?
একশো ভাগ সত্যি বিশ্বাস করি। কারণ, আমি সুলোচনা নামের কারুকে চিনি না। আমি রোহিলাকে চিনি, রোহিলাখণ্ডে যার জন্ম, যার বয়েস এখন ছ’ বছর!
রোহিলা আমার হাত চেপে ধরে বলল, এই চুপ চুপ। ওই পাথরটার আড়ালে।
রোহিলা আমাকে সবুজ শ্যাওলায় ঢাকা একটা বড় পাথরের আড়ালে নিয়ে এল। পাশের মাঠ দিয়ে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে, বেশ বয়স্ক মানুষ, পেছন দিক থেকে মুখটা দেখা যাচ্ছে না।
এত ভোরে আর কেউ জাগেনি। কিন্তু বৃদ্ধরা বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারে না। অনেকের মর্নিং ওয়াকের বাতিক থাকে। বাতের ব্যাধি কমাবার জন্য ও অনেককে হাঁটাহাঁটি করতে হয়।
বৃদ্ধটি হাঁটতে হাঁটতে মাটি থেকে কী যেন কুড়োচ্ছেন।
তিনি বেশ খানিকটা দূরে যাবার পর আমি বললুম, লুকিয়ে পড়ার কী দরকার ছিল? কেউ দেখলে ক্ষতি কী? এখানে তো কেউ কারুকে বাধা দেয় না কোনও ব্যাপারে?
রোহিলা বলল, সে জন্য নয়। আমরা বেশ লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি, এটা ভাবতে ভাল লাগে না?
—এই গাছগুলো আমাদের দেখছে। শালিক পাখিরা দেখছে। ওরা ঠিক বুঝতে পেরে গেছে, তুমি চলে যাচ্ছ।
—আমি যে আবার ফিরে আসব, সেটা কি ওরা বুঝতে পারছে?
—ডাক্তার দেখাবার পর যদি তোমার মন বদলে যায়? তোমার আর ফিরতে ইচ্ছে না করে?
—তুমি কী বলছ, নীললোহিত? সেরকম হতে পারে নাকি? না, না, না, আমি কিছুতেই বাইরে থাকব না। এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কোথাও নেই। এখানে নিঃশ্বাস ফেলতে কী আরাম হয়। ওই একটা লোক ছাড়া আমাকে এ পর্যন্ত আর কেউ বিরক্ত করেনি। আমার আর কোথাও ঘর নেই।
—আমি সেজন্য বলছি না। এখানে যারা থাকে, তারা সবাই তো একটু একটু পাগল। রোগী পাগল নয়, স্বর্গীয় পাগল বলা যেতে পারে। প্রথম থেকেই তুমি যেমন ছিলে। খুবই মজার পাগলামি। ডাক্তারের চিকিৎসা যদি সেসব দূর করে দেয়, একবার অতি সাধারণ সুস্থ মানুষের মতন হয়ে ওঠো, তাহলে যদি তোমার এখানে ফেরার ইচ্ছাটা চলে যায়? তখন হয়তো আবার টাকা পয়সার চিন্তা, প্রেম, বিয়ে, ঘর-সংসার করার বাসনা ফিরে আসে?
—তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? তা হলে আমি যাব না। আমি সারাজীবন এরকম পাগলই থাকতে চাই। আমি পাগল হয়েছি, তোমার তাতে কী? কেন তোমার সঙ্গে যাব?
—আমি বুঝি তোমায় জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছি?
—তুমিই তো বললে, এখানে যদি পুলিশ আসে, তখন আমার এখানে থাকা উচিত নয়। দিকশূন্যপুরে যাতে কোনও গোলমাল না হয়, সেইজন্যই আমি যেতে রাজি হয়েছি। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।
—এটা বুঝি আমার ওপরে দয়া?
—ওঃ হো, তোমার রাগ হয়েছে? হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে যাবই তো। বেশ করব। তুমি আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য। কারণ, তুমি আমার বন্ধু।
—তুমি সুরথ কিংবা সুন্দররাজনের সঙ্গেও যেতে পারতে। আমি তোমাকে এখান থেকে জোর করে ধরে নিয়ে পালাচ্ছি না। তুমি আমার সঙ্গে পালাচ্ছ। তুমি আমাকে ডেকে তুলেছ।
—আমাকে বকুনি দিয়ো না, প্লিজ। জানো তো আমার মাথার ঠিক নেই! আমরা দু’জনেই এক সঙ্গে পালাচ্ছি, সেটাই ভাল না?
রোহিলার মাথাটা চেপে ধরে বললুম, এই তো দিব্যি মাথা ঠিক আছে। প্রথম থেকেই যাব না যাব না বলবে না!
রোহিলা বলল, বুঝতে পারছি, মাঝে মাঝে আমাদের একটু একটু ঝগড়া হবে। প্রেম প্রেম ন্যাকামির চেয়ে ঝগড়া ভাল। তবে বেশি নয়।
–প্রেম ব্যাপারটাকেই তোমার ন্যাকামি মনে হয়?
—নীললোহিত, খাঁটি প্রেম কাকে বলে তা যে আমি জানি না। কখনও বুঝলামও না। শাড়ি পরার বয়েসের আগে থেকেই লোকেরা আমাকে বড় কষ্ট দিয়েছে। আমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। আমি যেন একটা হরিণ, আর পুরুষরা সব বাঘ। আমি শুধু তাদের খাদ্য। যখন ফিল্মে অভিনয় করতুম, তখন একজন প্রোডিউসার ছিল, খুব বুড়ো। একটাও দাঁত নেই, মাংস খাবার ক্ষমতা নেই, তবু সে আমাকে পুষতে চেয়েছিল। বলেছিল, আমার সারা গা গয়নায় মুড়ে দেবে! সেই থেকে আমি ঘেন্নায় একটাও গয়না পরিনি।
—সত্যি তোমার খুব দুর্ভাগ্য। প্রেমহীন একটা জীবন মানে তো পুরোটাই ব্যর্থ জীবন। অবশ্য, তুমি এখনও বাচ্চা মেয়ে, মনটাকে খোলা রাখো, একদিন কোনও কোনও মানুষ হয়তো তোমাকে সত্যিকারের ভালবাসবে।
—তুমি আর গুরু ঠাকুরের মতন উপদেশ দিয়ো না তো! আমি বাচ্চা মেয়ে, আর তুমি খুব পাকা!
কথায় কথায় আমরা পৌছে গেলুম নদীর ধারে। পুব দিগন্তে উঁকি মারছে টুকটুকে লাল সূর্য। অনেক পাখিরা জেগে উঠেছে এর মধ্যে, ডানা মেলে উড়ে আসছে এক ঝাঁক বক।
আগের দিন যে গাছটার তলায় দেখেছিলুম, ঠিক সেখানেই বসে আছেন অচিন্তনীয়। হাওয়ায় উড়ছে তাঁর সাদা দাড়ি। জোরে জোরে শ্লোক পড়ছে। ওং জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম …
চোখ বুজে ছিলেন, কী করে টের পেলেন জানি না, চোখ খুলে তাকালেন আমাদের দিকে।
লুকোবার চেষ্টা করে লাভ নেই, ইনি আমাদের পলায়নের প্রথম সাক্ষী। বললুম, সুপ্রভাত অচিন্তনীয় দাদা। আমরা চলে যাচ্ছি।
উনি দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, পারবে না। যেতে পারবে না।
আমার মজা লাগল। উনি এখনও সেই একই কথা বলছেন কোন যুক্তিতে?
বললুম, এই তো দেখুন না, আপনার সামনে দিয়েই যাচ্ছি, এক্ষুনি নদী পেরুব!
অচিন্তনীয় এক গাল হেসে বললেন, ওরে বাবা, নদী পেরুলেই কি সব কিছু পার হওয়া যায়? জীবনটা হচ্ছে এক অকূল পারাবার!
বললুম, জীবনের কথা জানি না। আপাতত দিকশূন্যপুর ছেড়ে যাচ্ছি। মাস দেড়েকের মধ্যে রোহিলা ফিরে আসবে আশা করি।
অচিন্তনীয় তবু নঞর্থক মাথা দোলাতে লাগলেন।
বড় পাথরটার আড়ালে গিয়ে রোহিলা বলল, ওঁকে দেখলে আমার গাটা কেমন যেন ছমছম করে।
—আমার কিন্তু মানুষটাকে বেশ ভাল লেগেছে। একেবারেই সাধারণ মানুষের মতন নয়। এককালে ম্যাজিশিয়ান ছিলেন, সংস্কৃত শ্লোক টোক জানেন, উনি ইচ্ছে করলেই বড় কোনও শহরে নাম করা গুরু হতে পারতেন। হাত ঘুরিয়ে হাওয়া থেকে একটা ফুল কিংবা সন্দেশ কিংবা মাদুলি বার করতেন। ভক্তরা মোহিত হয়ে যেত। হাজার হাজার শিষ্য জুটে যেত। সেই লোভ দমন করা সোজা কথা নয়!
—হ্যাঁ, আমি এরকম শহুরে সাধু দেখেছি। ওরা বুঝি সবাই ম্যাজিক জানে?
–খানিকটা তো শিখে নিতেই হয়। ম্যাজিক ছাড়া হাওয়া থেকে ফুলটুল বার করা কোনও ক্রমেই সম্ভব নয়।
—আমাকে একজন সাধু ওই রকমভাবে একটা সোনার আংটি দিয়েছিল।
–কত প্রণামী দিয়েছিলে?
—হ্যাঁ, কত যেন দিয়েছিলুম, ঠিক মনে নেই।
—বেশি টাকা প্রণামী দিলে সোনার আংটি, আর কম দিলে ফুল কিংবা হর্তুকি! ম্যাজিশিয়ানদের কাছে এটা জল-ভাত!
কথা বলতে বলতে পাথরের গায়ে সেই ভাঙা মুর্তিটার দিকে চোখ পড়ে গেল। একটি পুরুষেরই মূর্তি গড়ে উঠছিল, কোমর বন্ধের কাছে তলোয়ারটা অবিকৃত রয়েছে।
—এটা কার মূর্তি গড়ছিলে রোহিলা?
—আকাশের কালপুরুষের।
—নদীর ধারে এরকম একটা ভাস্কর্য কী সুন্দর মানাত। কেন নষ্ট করে দিলে? কত দিন সময় লেগেছে, কত নষ্ট করেছো, তবু ভেঙেচুরে দিলে?
—যখন আমার কপালের মাঝখানে ব্যথা করে, তখন যে সব কিছু ভাঙতে ইচ্ছে করে। এমনকী নিজেকেও! ছবিগুলো সব কুচিকুচি করে ফেলেছি।
—এই ছবি আঁকা দিয়েই তো তোমার নতুন জন্মের শুরু। ফিরে এসে আবার আঁকবে। এখানে আবার কালপুরুষের মূর্তি গড়তে হবে।
—উপদেশ দিয়ো না। আমার যদি ইচ্ছে হয়…এই, এই নীললোহিত, আমার যে জলে নামতে ভয় করে খুব। নদী কী করে পার হব, যদি ডুব-জল থাকে?
—শোনো রোহিলা, শুধু এই নদী নয়, এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে, মাঝে মাঝে নানান অসুবিধে হবে, ছোটখাটো বিপদও হতে পারে, তখন আমার ওপরেই ভরসা রাখা ছাড়া তোমার গতি নেই। তুমি তো বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে কিছুই জানো না!
—কীরকম বিপদ হতে পারে?
—সে যখন আসবে তখন বোঝা যাবে। আর একটা কথা, জলে নামবার সময় শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকবে। ছটফট করবে না। যদি ডুব-জল থাকেও, আমি তোমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাব। যদি আঁকুপাঁকু করো, ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরো, তাহলে মহা বিপদ, তখন কিন্তু আমি তোমায় খুব মারব, জোরে জোরে মারব। জলের মধ্যে সাঁতার না-জানা যুবতী মেয়ের আলিঙ্গনও মৃত্যু ফাঁদ হতে পারে। জড়িয়ে ধরবে না খবর্দার, হালকাভাবে ভেসে থাকবে!
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রোহিলা। গাঢ় চোখে চেয়ে বলল, নীললোহিত, তুমি আমাকে এমন ধমকে ধমকে বলছ কেন? একটু ভাল করে বলো, একটু মিষ্টি করে বলো। আমাকে নিয়ে যেতে হচ্ছে বলে কি তোমার রাগ হচ্ছে?
ছ’বছরের বালিকার মতন এবার বুঝি সে ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলবে। সত্যি আমার গলার স্বর বেশি রূঢ় হয়ে গেছে।
ওর পিঠে হাত রেখে বললুম, না, না, রাগ হবে কেন? আমরা তো অ্যাডভেঞ্চার করতে যাচ্ছি। সাঁতার না জানলে এটাই নিয়ম। তুমি ভয় পেয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরলে দু’জনেই মরব।
রোহিলা আস্তে আস্তে বলল, না, আমরা কেউ মরব না। জীবন কত সুন্দর।
রোহিলা না থাকলে আমি পা-জামা, পাঞ্জাবি খুলে উলঙ্গ হয়েই সাঁতরে যেতে পারতুম। এখন সব ভেজাতেই হবে। রোহিলার পুঁটুলি ও আমার ঝোলা ব্যাগটা এক হাতে মাথার ওপর তুলে, আর এক হাতে রোহিলাকে ধরে পা দিলুম জলে।
দু’একদিন আগে বৃষ্টি হয়েছে বলে চন্দ্রহার নদীতে কিছুটা জল বেড়েছে। মৃদু স্রোত আছে। ভেতরে বড় বড় পাথর, হোঁচট খাবার খুব সম্ভাবনা। রোহিলা মুখটা এমন করে আছে, যেন জল নয়, ও হাঁটছে আগুনের ওপর দিয়ে।
—তুমি তিন বছর ধরে আছ, তোমাকে কেউ সাঁতার শিখিয়ে দেয়নি? বন্দনাদিকে বললেই পারতে।
—তোমার মনে আছে, এখানে স্নান করতে এসেই সেই লোকটা প্রথমে আমাকে সুলোচনা বলে ডেকেছিল? তারপর থেকে আর একবারও আমার এই নদীতে নামতে ইচ্ছে করেনি!
—সেই লোকটি দোষ করে থাকতে পারে, কিন্তু নদী তো কোনও দোষ করেনি!
—তবু, আজ এতদিন পর তোমার সঙ্গে আবার নদীতে নেমেছি, সেটাই আমার ভাল লাগছে।
জল বাড়ছে ক্রমশ, কোমর ছাড়িয়ে গেল। আমার দুটো হাতই জোড়া, যদি ডুব জল হয়, সাঁতার কাটব কী করে? রোহিলা দুহাতে আমার হাত চেপে ধরে আছে। যেখানে আমার বুক জল, সেখানে ওর গলা পর্যন্ত ডুবে গেল। ফিস ফিস করে বলল, ভয় করছে, আমার ভয় করছে। তবু আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরব না। সেরকম হলে, তুমি আমাকে ঠেলে দিয়ো আমি স্রোতে ভেসে যাব!
আমি বললুম, ভয় নেই, ভয় নেই। একটা গান আছে শোনো : আমি মাঝিগিরি জানি ভাল, ভয় পেয়ো না, ব্রজাঙ্গনা। আমার হোক না কেন জীর্ণ তরী, কর্ণধারের গুণ জানো না, মাঝিগিরি জানি ভাল—
কোথায় তোমার সেই জীর্ণ তরী?
—মনে করো, এই শরীরটাই নৌকো।
—মনে করতে পারছি না যে।
—শোনো, আমি সাঁতরে ঠিক তোমাকে ওপারে নিয়ে যাব, তাতে আমাদের জিনিসগুলো ভিজবে, কিংবা ফেলে দিতে হতে পারে।
—সব ফেলে দাও, কিছু আসে যায় না।
পেছন ফিরে দেখলুম, নদীর অর্ধেকের বেশি পার হয়ে এসেছি, তা হলে আর বেশি জল হবে না। সত্যি কথা বলতে কী, আমারও বেশ ভয় করছিল, সাঁতার না-জানা কারুকে নিয়ে কোনওদিন তো আগে নদী পার হইনি। ভয়টা লুকোবার মধ্যই কথা বলে যাচ্ছিলুম অনবরত।
আর একটু আসবার পর রোহিলা একটা পাথরে হোঁচট খেল, আমার হাত ছেড়ে গেল।
আতঙ্কে চিৎকার করে হাবুডুবু খেতে শুরু করলেও আমি তখুনি ওকে ধরতে গেলুম না। স্রোত তেমন বেশি নয়। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমার ব্যাগ ও রোহিলার পুঁটুলিটা এক এক করে ছুড়ে দিলুম পাড়ে। আমার সামান্য যা টাকাকড়ি আছে, তা এই ব্যাগে।
এরপর রোহিলাকে ধরতে যেতেই পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে ও আঁকড়ে ধরল আমার গলা। বেশি জল হলে দু’জনকেই ভেসে যেতে হত। খানিকটা নাকানি-চোবানি খেতে হল আমাকেও, তারপর পায়ের তলায় মাটি পেয়ে রোহিলাকে পাঁজাকোলা করে উঠে এলুম ওপরে।
বালির ওপর শুয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রোহিলা বলল, নীললোহিত, নীললোহিত, আমরা ডুবে যাচ্ছিলুম! এত কাছে এসে।
—সেই তুমি আমার গলা জড়িয়ে ধরেছিলে!
—মনে থাকে না, মনে থাকে না, সত্যি গলা জড়িয়ে ধরেছিলুম বুঝি? ও মা, ছি ছি, তুমি আমাকে মারলে না তো?
—জীবনে কোনও মেয়ের গায়ে হাত তুলিনি যে!
—আমাকে মেয়ে ভাবলে কেন? মনে করতে, পথে চলার একজন সঙ্গী।
—তুমি জলজ্যান্ত একটি মেয়ে, অথচ তোমাকে মেয়ে ভাবব না?
–একজন মেয়ে বুঝি বন্ধু, সঙ্গী, সহযাত্রী, সহকর্মী এই সব হতে পারে না? সে সব সময় শুধু মেয়ে?
—এই সবই হতে পারে। এই সব, এবং সে মেয়ে। তার গায়ে একটু হাত ছোঁয়ালে রোমাঞ্চ হবেই। অন্যদের কথা জানি না, আমি এই রকমই।
—তুমি যে জল থেকে আমাকে কোলে করে তুলে আনলে, তাতে তোমার কষ্ট হল, না রোমাঞ্চ হল?
—কষ্ট হয়নি। একটু একটু রোমাঞ্চিত হয়েছি। ওসব কথা থাক, এরকম ভিজে জামাকাপড় পরে তো যাওয়া যাবে না। তুমি শাড়িটাড়ি বদলে নাও।
—আমরা তাহলে সত্যি দিকশূন্যপুর ছেড়ে এ পারে চলে এসেছি? তিন বছর পরে, এই প্ৰথম?
—অচিন্তনীয়বাবু শুধু শুধু আমাদের ভয় দেখাচ্ছিলেন।
—এখানে আর একটু শুয়ে থাকি না? বেশ ভাল লাগছে!
—না, ওঠো। এখনও জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা পথ বাকি আছে। তারপর গাড়ি ধরার জন্য কতক্ষণ বসে থাকতে হবে তার ঠিক নেই।
নদীর ধারে অনেক ঝোপঝাড় রয়েছে, আব্বুর অসুবিধে নেই। আমিও একটু দূরে গিয়ে ভিজে পাজামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরে নিলুম। ঊষালগ্নেই নদীতে স্নানটা হয়ে গেল, সারাদিন আর ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। চিরুনিটা ফেলে এসেছি বন্দনাদির বাড়িতে। যাক গে, আঙুল দিয়েও চিরুনির কাজ চালানো যায়।
রোহিলা একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরে নিয়েছে। কাছে এসে বলল, আমার তোয়ালে নেই, তোমারটা দেবে?
আজকাল সভ্য সমাজে একজনের তোয়ালে অন্য কেউ ব্যবহার করে না। দিকশূন্যপুরে বুঝি সেরকম কোনও বাধা নেই। অবলীলাক্রমে আমার তোয়ালেটা তুলে নিয়ে রোহিলা চুল মুছে ফেলল। ওর চিরুনিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চুল আঁচড়াবে না?
পরস্পরের জিনিস ব্যবহার করলে মানুষ অনেক কাছাকাছি চলে আসে।
ভিজে কাপড়টাপড় কী করে নেওয়া হবে? এসব কথা আগে চিন্তা করা হয়নি।
রোহিলার জিনিসপত্র কোনওক্রমে ভরা হল আমার ব্যাগে। ওর পুঁটলিটায় বেঁধে নিলুম আমাদের দু’জনের ভিজে পোশাক। আবার যাত্রা শুরু। রেল স্টেশনের কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত এক কাপ চাও পাওয়া যাবে না।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটার পর রোহিলা বলল, নীললোহিত, তুমি কোনও কথা বলছ না কেন?
সত্যিই তাই, আমি কথা বলছিলুম মনে মনে নিজের সঙ্গে। জঙ্গলের গাছপালা, পাখিদের দিকেও চোখ নেই। বারবার প্রশ্ন করছি, নীললোহিত, তুমি কী করতে যাচ্ছ, তা কি জানো? এই মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে কি তুমি বিপদে ফেলে দেবে? তাজমহলে গিয়ে শুয়ে থাকা, ও সব তো নিছক রোমান্টিক চিন্তা। বাস্তব অতি কঠোর। তোমার কাছে রয়েছে ঠিক তিনশো বারো টাকা, তা দিয়ে দু’জনের আগ্রা পর্যন্ত ট্রেনের টিকিটই হবে না। বিনা টিকিটে ট্রেনে চাপবে নাকি? তারপর অপমান, নির্যাতন, অথবা জেল? একা হলেও ঝুঁকি নেওয়া যেত, কিন্তু এই সরল মেয়েটি, যার কোনও বাস্তবজ্ঞানই নেই, সে যদি হ্যাংলা লোকজনদের হাতে পড়ে!
এই টাকায় কোনওক্রমে কলকাতায় পৌঁছনো যেতে পারে, তাও ট্রেনে কিছু না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু সেটা না হয় সহ্য করা গেল। কিন্তু তারপর? কোথায় থাকবে রোহিলা? মুমুদের ফ্ল্যাটটা অনেক বড়, সেখানে রাখা যায় না? মুমুর বাবা চন্দনদা পরোপকারী ধরনের মানুষ, তিনি রোহিলার চিকিৎসার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। আরও কয়েকজন দাদা শ্রেণীর লোকদের কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রোহিলা একটি সুন্দরী যুবতী। তাকে দেখে বউদিরা যদি রেগে যায়?
রোহিলার মুখে দুশ্চিন্তার কোনও রেখা নেই। আমি ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি, তা জিজ্ঞেস করেনি একবারও। বরং বেশ উচ্ছল হয়ে আছে। একটি ব্যাপারে ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে, আমি ব্যাঘ্র প্রজাতির কেউ নই, কোনও ছলছুতোয় ওকে আমি খেয়ে ফেলব না!
কিন্তু এতটা নিশ্চিন্তও কি হওয়া যায়? আমি কি নিজেকেও ঠিক ঠিক চিনি? ভদ্রতা-সভ্যতা আমাদের সংযত হতে শিখিয়েছে, কিন্তু রাত্তিরবেলা কি আমরা পাশাপাশি উদাসীন হয়ে শুয়ে থাকতে পারব? আমি কি মহাত্মা গান্ধীর চেলা হতে পারি?
ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললুম। দু’দিন খাইনি।
রোহিলা বেশ অবাক হয়ে বলল, এ কী, তুমি সিগারেট খাও? আগে তো দেখিনি!
—দিকশূন্যপুরে থাকার সময় লুকিয়ে রাখি, এখন তো বাইরে চলে এসেছি।
—আমি তো ধোঁয়ার গন্ধ সইতে পারি না।
—তুমি তা হলে একটু দূরে দূরে হাঁটো। তুমি নদী পেরিয়ে এসেছ, এরপর যত যাবে তোমাকে কারখানার ধোঁয়া, গাড়ি-ট্রাকের ধোঁয়া, ডিজেলের ধোঁয়া কত কিছু সহ্য করতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়া আর কতটুকু!
—তাতে আমার খুব কষ্ট হবে যে!
—হ্যাঁ, কষ্ট তো হবেই। সহ্যও করতে হবে। দিকশূন্যপুরের বাইরের জগৎটা এইরকমই।
—তোমাদের কষ্ট হয় না?
—অভ্যেস হয়ে গেছে, তাই টের পাই না। রেললাইনের পাশের কোনও বাড়িতে যদি তুমি ঘুমোতে চাও, ট্রেনের শব্দে ঘুমই আসবে না। যারা সেখানে বছরের পর বছর থাকে, তারা সে শব্দ শুনতেই পায় না!
টিলার ওপর সেই বড় শিমুলগাছটা দিক চিহ্ন। তার পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর ছড়ানো। এক একটা পাথর এমনই আলাদা, যেন মনে হয় আকাশ থেকে পড়েছে।
একটা পাথরের পাশে শুয়ে আছে একজন মানুষ। টাক মাথা, বেঁটে, হৃষ্টপুষ্ট। কালো প্যান্ট ও ঘি রঙের হাওয়াই শার্ট পরা, পায়ে জুতো-মোজা
রোহিলা একটা ভয়ের শব্দ করে উঠল।
লোকটি জেগেই আছে, আস্তে আস্তে উঠে বসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?
বাসুদেবন! আমার প্রথমেই চিন্তা হল, ওর সঙ্গে কি পুলিশ আছে? কাছাকাছি আর কারুকে দেখা যাচ্ছে না। ও এই রাস্তা দিয়ে এল কেন? নুন পাহাড়ের পেছনের রাস্তাটা দিয়ে তবু অনেকখানি গাড়িতে আসা যায়, যেখানে ব্রিজ ভাঙা, সেখান থেকে পায়ে হাঁটা। এদিকে হাঁটার রাস্তা অনেকখানি, নদী পার হবার কোনও ব্যবস্থা নেই। পুলিশের এত কী দায় পড়েছে যে এতখানি হাঁটবে, তারপর পোশাক ভিজিয়ে নদী পার হবে?
পুলিশ তা হলে আসেনি? বাসুদেবনের নিছক একটা অভিযোগকে পুলিশ পাত্তা দেয়নি? সেটাই সম্ভব। তবে আর একা বাসুদেবনকে ভয় পাবার কী আছে?
বাসুদেবন এবার উঠে দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ, সুলোচনা?
রোহিলা আর্তনাদ করে বলে উঠল, না, না। আমি সুলোচনা নই! সুলোচনা নই! নীললোহিত, আমাকে ওই নামে ডাকতে বারণ করো। তাহলে আবার আমার মাথাব্যথা করবে। ওকে বারণ করো।
বাসুদেবন তবু বলল, সুলোচনা, দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
আমি এক পা এগিয়ে গিয়ে বললুম, কেন ওকে ওই নামে ডাকছেন? ও যখন বলছে ওটা ওর নাম নয়।
বাসুদেবন আমার দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, তুমি চুপ করো। তোমার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না!
আমি বললুম, এই মহিলা এখন আমার সঙ্গে রয়েছেন, সুতরাং আমার সঙ্গেই আপনাকে কথা বলতে হবে।
বাসুদেবন বলল, কেন তোমার সঙ্গে কথা বলব? তুমি একটা বাইরের লোক, কেন আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ?
বাইরের লোক, বাইরের লোক শুনতে শুনতে আর মেজাজ ঠিক রাখা যাচ্ছে না। আমি কি পৃথিবীর বাইরের, অন্য কোনও গ্রহের প্রাণী?
বেশ চেঁচিয়ে বললুম, এই মহিলা একজন অ্যাডাল্ট, ইনি যার সঙ্গে ইচ্ছে যেতে পারেন। বাইরের লোক, ভেতরের লোক আবার কী? আপনি সরে দাঁড়ান!
বাসুদেবন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বাঃ বেশ কথা। একজন উটকো লোক আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যাবে, আর আমি চুপ করে থাকব?
রোহিলা আবার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, মিথ্যে কথা! আমি কারুর বউ না!
আমি বললুম, দেখছেন, ও অস্বীকার করছে। তবু আপনি জোর করে স্বামীত্ব ফলাবেন! এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? আপনার সঙ্গে যে বিয়ে হয়েছিল, তার প্রমাণ কী?
—তোমাকে কেন প্রমাণ দিতে যাব হে ছোকরা?
—তা হলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। রাস্তা ছাড়ন!
এরপরেই আমি একটা মারাত্মক ভুল করলুম। বাসুদেবন একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি তার বুকে হাত দিয়ে জোরে ঠেলে সরিয়ে দিলুম।
বাসুদেবন কয়েক পা পিছু হটে গেল, সঙ্কুচিত হয়ে গেল তার চোখ দুটো। তারপরই কিছু একটা শপথ উচ্চারণ করে সে ছুটে এসে আমার নাকে মারল এক প্রবল ঘুষি।
তাতেই আমার মাথা ঘুরে গেল। লোকটার হাতে এত জোর? তবু কোনওক্রমে সামলে নিয়ে আমি ফিরে এসে ওর মাথাটা চেপে ধরতে গেলুম। বেঁটে লোক, ওর মাথাটা ধরে ঘুরিয়ে দিতে পারলেই কাবু হয়ে যাবে।
বাসুদেবন পর পর কয়েকটা ঘুষি চালাল আমার মুখে, ঘাড়ে। আমি ছিটকে পড়ে গেলুম অনেকটা দূরে।
একটি মেয়েকে নিয়ে দুজন পুরুষের লড়াই। এ ক্ষেত্রে আমিই নিশ্চয়ই নায়ক, কারণ রোহিলা স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে চলেছে। বাসুদেবন ওর ওপর জোর ফলাতে চাইছে। সে অবশ্যই ভিলেন। কাব্যে, উপন্যাসে, থিয়েটারে, চলচ্চিত্রে এই রকম পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নায়কই জেতে। কিন্তু আমি যে হেরে ভূত হয়ে যাচ্ছি!
আমার নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে, মাথা ঘুরছে। একটা দাঁতও ভেঙে গেছে বোধহয়। বাসুদেবনের মুষ্টি একেবারে লোহার মতন, বেঁটে চেহারাতেও এত শক্তি! সিনেমায় সাসপেন্স তৈরি করার জন্য প্রথম দিকে নায়ক খুব মার খায়, হারতে হারতে শেষের দিকে নবোদ্যমে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বেদম পেটাতে পেটাতে ভিলেনকে চিৎপটাং করে দেয়। কিন্তু আমার যে আর উঠে দাঁড়াবার শক্তিই নেই। এই অবস্থায় ওকে আবার আক্রমণ করতে গেলে ও আমাকে একেবারে মেরেই ফেলতে পারে।
একটা ছাই রুমালও নেই পকেটে, রক্ত মুছব কী করে। ঘাস-পাতা তুলে রক্ত মুছবার চেষ্টা করলুম। ঘুষোঘুষি দেখে রোহিলা প্রথমটায় বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল, এবার ছুটে এল আমাকে সাহায্য করবার জন্য। বাসুদেবন নিষ্ঠুরের মতন রোহিলার ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দূরে বসিয়ে দিল। তারপর বলল, চুপ করে এখানে বসে থাকো! না হলে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখব।
আমি কোনওক্রমে হাঁটু গেড়ে উঠে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলুম একজন বর্বর লোক রোহিলাকে কলুষ হাতে স্পর্শ করছে, তবু আমি বাধা দিতে পারছি না। ধিক আমাকে।
রোহিলা অসহায়ের মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
বাসুদেবন আমার দিকে চেয়ে বলল, তুমি এখন যাবে, না আরও মার খাবে? আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা আছে। তুমি সরে পড়ো। গেট লস্ট!
আমি দু’ বার মাথা ঝাঁকিয়ে, খানিকটা ধাতস্থ হবার চেষ্টা করে বললুম, ওই মেয়েটি আমার ভরসাতেই এসেছে, এখন আমি যদি ওকে ফেলে চলে যাই, সেটা আমার পক্ষে চরম কাপুরুষতা হবে না? তার বদলে আমার মরে যাওয়াই উচিত নয়?
বাসুদেবন বলল, তোমাকে আমি মারতে চেয়েছি নাকি? তুমিই তো প্রথম আমাকে ধাক্কা দিয়েছ! আমার গায়ে হাত তুলেছ!
আমি বললুম, আপাতত মারামারির কথা থাক। আমি আপনাকে দুটো একটা প্রশ্ন করতে পারি? একটু সময় দেবেন!
–বলো!
—দেখুন, আপনার গায়ে খুব জোর, আপনি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, লোভী ধরনের মানুষ। না, না, রাগ করবেন না, আগে সবটা শুনুন, আপনি একটি মেয়ের ওপর জোর করে অধিকার ফলাতে চান, মোজা সুদ্ধ জুতো পরেছেন, সংসারী লোকদের মতন। ঠিক আছে, এ রকম মানুষ অনেক আছে। কিন্তু আপনার মতন মানুষ, দিকশূন্যপুরে এলেন কেন? ওখানে তো কিছু পাবার নেই। ওখানে সবাই স্বার্থত্যাগের সাধনা করে। আপনি ওখানে অত দিন পড়েছিলেন কীসের জন্য? দিকশূন্যপুরে এলে সবার মন পরিষ্কার হয়ে যায়….
—আমি নিষ্ঠুর, লোভী, স্বার্থপর? তুমি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো? আমি কত কিছু ছেড়ে এসেছিলুম তা জানো? খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, অৰ্থ। আমি একজন লেখক, আমার তেইশখানা উপন্যাস আছে, চারখানা নাটক, চারখানা প্রবন্ধের বই। সব ছেড়ে এসেছিলুম এই দিকশূন্যপুরে শান্তি পাবার জন্য।
এত কষ্টের মধ্যেও আমার হাসি পেয়ে গেল। এই বাসুদেবন একজন লেখক! আমি মার খেলুম একজন ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-প্রাবন্ধিকের কাছে? বাসুদেবনের চেহারাটা এতই খারাপ যে লেখক হবার সবরকম যোগ্যতাই ওর আছে। অবিশ্বাস করার কিছু নেই।
অনেকটা আপন মনেই বললুম, দক্ষিণ ভারতীয় লেখকরা খুব শক্তিশালী। আমাদের বাংলার লেখকরা রোগা-পটকা, কোল কুঁজো, অকাল-বুড়ো, পেট রোগা, একদম মারামারি করতে পারে না।
বাসুদেবন বলল, আমি অল্প বয়েসে বক্সিং শিখেছি। কেন, তোমাদের রবীন্দ্রনাথও তো কুস্তি করতেন।
আমি বললুম, হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ অল্প বয়েসে কুস্তি করতেন বটে, কিন্তু কখনও কারুর সঙ্গে মারামারি করেছেন, এমন শুনিনি। কিংবা কোনও মেয়ের জন্য মারামারি করে থাকতেও পারেন, জীবনীকাররা চেপে গেছে।
বাসুদেবন বলল, আমার রাগটা বেশি। এই একটা রিপু আমি দমন করতে পারিনি। দিকশূন্যপুরে এসে অনেকটা কমেছিল বটে, কিন্তু কেউ আমার গায়ে হাত তুললে আমি সহ্য করতে পারি না।
—আপনি একজন লেখক হয়ে কি জানেন না যে কোনও মেয়েকে জোর করে কখনও পাওয়া যায় না?
—জোর করে মানে? এই মেয়েটি আমার স্ত্রী, হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ যদি আবার তার দেখা পাই, তার সঙ্গে কথা বলতে চাইব না? সেটা অন্যায়?
—আপনি রাত্তিরবেলা ওর বাড়িতে গিয়ে হামলা করেছিলেন।
—হামলা করেছিলুম? যতবার ওর সঙ্গে কথা বলতে গেছি, ও পালিয়ে অন্য লোকের আড়ালে লুকিয়েছে। কেঁদেকেটে লুকিয়েছে। তাই রাত্তিরবেলা গেছি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে। শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছি। নিজের স্ত্রীর কাছে রাত্তিরে দেখা করতে যাওয়া মানে হামলা? আমি জোর করে ওর হাত ধরে টানাটানি করেছি? ও বলুক তো! কথা বলতে গেছি, ও চেঁচিয়ে মেচিয়ে এমন নাটক করল, যেন আমি একটা ডাকাত, কিংবা ধর্ষণকারী। লোকজন এনে আমাকে কী অপমানই না করল। বিনা দোষে সবার সামনে ও আমার হেনস্থা করল।
—দিকশূন্যপুরের মানুষ কেউ কি আপনাকে খারাপ কথা বলেছে? কেউ বলে না তো কখনও।
—খারাপ কথা না বললেও সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে, সেটাই কি যথেষ্ট অপমান নয়? সেদিন এমন রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠেছিল যে হয়তো কারুকে মেরেই বসতুম।
—আপনার কি ভুল হতে পারে না? ও বলছে, ওর নাম সুলোচনা নয়, আপনাকে ও চেনে না। তারপরেও কি আপনার দাবি টেকে?
বড় পাথরটার কাছে একটা চামড়ার ব্যাগ পড়ে আছে। বাসুদেবন সেটা তুলে নিয়ে খুলতে খুলতে বলল, তুমি প্রমাণের কথা বলছিলে, আমি দিকশূন্যপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম সেটাই জোগাড় করার জন্য। আমার নিজস্ব সব জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে, একজন ফটোগ্রাফার বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে এটা পাওয়া গেল।
একটা বড় আকারের ফটোগ্রাফ সে ছুড়ে দিল আমার সামনে।
সেটা কোনও বিবাহবাসরের ছবি নয় অবশ্য। হোটেলের ঘরের মতন একটা ঘরে পাশাপাশি বসে আছে দুজন নারী-পুরুষ। একজন সুট পরা বাসুদেবন, শালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি নিশ্চিত রোহিলা। যমজ ছাড়া একেবারে একরকম চেহারা দুজনের হতে পারে না। গল্প উপন্যাসে অবশ্য অনেক সময় থাকে যে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও একজনের সঙ্গে আর একজনের হুবহু মিল, কিন্তু তা গল্পই!
ভেবেছিলুম, গায়ের জোরে যখন পারা গেল না, তখন কোনওক্রমে যদি কথার মারম্যাচে ওকে জব্দ করা যায়। কিন্তু এই ছবি দেখিয়ে ও যে আবার আমাকে ধারাশায়ী করে দিল!
ছবিটা তুলে নিয়ে বাসুদেবন সেটা রোহিলার সামনে ফেলে দিয়ে বলল, সুলোচনা, এটা দেখো, চিনতে পারো না?
মুখ থেকে হাত সরিয়ে রোহিলা বেশ আগ্রহের সঙ্গেই ছবিটা তুলে নিল। দেখল মন দিয়ে। তারপর কাতর কণ্ঠে বলে উঠল, না, আমি সুলোচনা নই। এই মেয়েটি আমি নয়। তোমাকে আমি চিনি না। তুমি কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছ?
বাসুদেবন আমার দিকে তাকাল। আমি একেবারে নিরুত্তর।
বাসুদেবন রোহিলাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কোন হোটেল, তোমার মনে নেই?
রোহিলা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে এবার দৃঢ় ভাবে বলল, আর একটাও কথা বলবে না আমার সঙ্গে!
তারপর সে ডান দিকে ফিরে দৌড় মারল। উঠতে লাগল শিমুল-চূড়া টিলাটার ওপর।
বাসুদেবন তাকে তাড়া করে গেল না, ব্যস্ততার ভাবও দেখাল না।
অনেকটা বন্ধুর মতন গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই টিলার ওপর ভাগে ও কি লাফিয়ে টাফিয়ে পড়তে পারে?
আমি বললুম, সে রকম সম্ভাবনা নেই। টিলাটার কোনও দিকেই খাড়াই নেই, সব দিক ঢালু হয়ে নেমেছে। লাফালে খানিকটা গড়িয়ে পড়তে পারে মাত্ৰ।
পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে বাসুদেবন বলল, তোমার নাকে এখনও রক্ত লেগে আছে, মুখটা ভাল করে মুছে নাও। আমি দুঃখিত। কিন্তু প্রথমেই আমাকে ঠেলে দেওয়া তোমার ঠিক হয়নি।
মুখটা মুছতে মুছতে বললুম, আমিও দুঃখিত। তুমি একজন লেখক তা জানলে আমি কিছুতেই তোমার গায়ে হাত দিতুম না। রোহিলাকে নিয়ে তুমি একটা উপন্যাস লিখতে পারো না?
—ও সব কথা এখন থাক। রোহিলা নয়, ওর নাম সুলোচনা। ও যে বারবার অস্বীকার করছে, চ্যাঁচামেচি করছে, এটা ওর অভিনয় নয়? ও একসময় ভাল অ্যাকট্রেস ছিল।
—দিনের পর দিন অভিনয় করে যাবে, কেউ বুঝতে পারবে না। এতবড় অভিনেত্রী পৃথিবীতে জন্মেছে?
—ও যতবার বলে, আমি তোমাকে চিনি না, ততবার আমার বুকের মধ্যে অপমান ফুঁসে ওঠে। একসময় অনেক লোক, অনেক সুন্দরী মেয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যাকুল হত। অথচ যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, সে-ই আমাকে চিনবে না?
—কোথায় একটা কিছু বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো সত্যিই ওর মনে নেই।
—অ্যামনেশিয়া? এত দীর্ঘস্থায়ী অ্যামনেশিয়া হয়? নীললোহিত, ও তোমাকে আগেকার জীবনের কথা কিছু বলেছে?
—কিছু কিছু বলেছে। ফিল্মে অভিনয় করত ঠিকই, তবে তামিল ফিল্মে নয়। মালয়ালম ফিল্মে, দু-একটা হিন্দি ছবিতেও। নায়িকা ছিল না, সহ-নায়িকা, ওকে শুধু শরীর দেখাতে হত, বারবার মরে যেতে হত। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে, আগুনে ঝাঁপিয়ে, জলে ডুবে…মরতে মরতে ক্লান্ত হয়ে বাঁচবার জন্য ও দিকশূন্যপুরে চলে আসে।
—এর অনেকটাই ঠিক। এই সব মনে আছে, শুধু আমার সঙ্গে বিয়ের কথাটাই মনে নেই? দেখো, আমার সঙ্গে ওর বয়েসের অনেকটা তফাত, তাই এই বিয়েটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। আমিও ফিল্মের সঙ্গে অনেকটা জড়িত ছিলাম, চিত্রনাট্য লিখেছি, সংলাপ লিখেছি, অনেক অভিনেত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হত, পরিচয় ছিল। সুতরাং ওর মতন একটি মেয়েকে দেখে আমার মাথা ঘুরে যাবার প্রশ্ন নেই। ও নিজে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ফিল্ম লাইনে এই ধরনের মেয়েদের অনেকেই জ্বালাতন করে। আবার এই ধরনের মেয়েরা পটাপট অনেকের প্রেমেও পড়ে যায়। ও কোনও ফিল্মের নায়ক বা প্রোডিউসারের সঙ্গে মেলামেশা করত না, ও সত্যি অন্যরকম, অনুভূতি অনেক সূক্ষ্ম। আমার সঙ্গে এসে গল্প করত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মনের কথা খুলে বলত, কাঁদত। সুলোচনা সেইরকমই একদিন খানিকটা কান্নাকাটির পর হঠাৎ বলেছিল আমরা বিয়ে করে একসঙ্গে থাকতে পারি না?
—আর্থার মিলার আর মেরিলিন মনরো?
—শুনলে হাসির কথা মনে হবে। কিন্তু অনেকটা সেই রকমই। এক রূপসী তরুণী উঠতি তারকা বিয়ে করতে চাইল একজন মধ্যবয়স্ক, টাকা মাথা লেখককে। পাঁচ-সাতজন পরিচিত লোকদের নিয়ে ছোট্ট অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমরা হনিমুনে যেতে পারিনি, তখন ওর শুটিং চলছিল মধ্যপ্রদেশে।
—রোহিলাখণ্ডে?
–ঠিক তাই। আমিও সেখানে ছিলুম। সুলোচনা থাকত ইউনিটের সঙ্গে, আমি একটা হোটেলে। বিয়ের মাত্র ন দিন পরে ও হঠাৎ উধাও! কারুকে কিছু বলেনি। আমি সে দিন সকালেও ঘুণাক্ষরে কিছু টের পাইনি।
—সে দিন থেকে সুলোচনার মৃত্যু, রোহিলার জন্ম!
—কিন্তু চলে যাবে কেন, আমাদের ঝগড়া-বিবাদ হয়নি, আমি ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি, একটুও রাগারাগিও করিনি, তবু চলে যাবে কেন, কেন, হোয়াই? এর উত্তর না জানলে আমার পৌরুষে ঘা লাগে না? তোমার সঙ্গে চলে যেতে চায় যাক, কিন্তু আমাকে উত্তরটা দিয়ে যেতে হবে।
—লেখকমশাই, আমি বাইরে থেকে এসে দিকশূন্যপুরের একটি সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছি, এ রকম মনে হতে পারে আপনার। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। দিকশূন্যপুরের দুজন ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেছেন, রোহিলার মাঝে মাঝে যে পাগলামি চাপে, সেটা অভিনয় নয়। সেটা সত্যিকারের মনোরোগ। আপনি বারবার ওকে সুলোচনা নামে ডেকে, ওর পুরনো পরিচয়টা খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করে ওকে পাগলামির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। চিকিৎসা না করলে ক্রমশ ও একেবারেই পাগল হয়ে যেতে পারে। দিকশূন্যপুরের অনেকেই বাইরে আর এক পাও বাড়াতে চায় না। দু-একজন রাজি বটে, কিন্তু রোহিলা তাদের সঙ্গে যেতে রাজি নয়। অগত্যা আমিই ওকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। আমার বদলে আপনি যদি সে দায়িত্ব নিতে চান, আমি আপত্তি জানাব না। কিন্তু রোহিলাকে কি আপনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে পারবেন? জোর করতে গেলে আরও উল্টো ফল হবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটুক্ষণ চুপ করে রইল বাসুদেবন। তার মুখখানা কুঁকড়ে গেছে। ভুরুতে যন্ত্রণার লেখা। ডান হাতটা একটু একটু কাঁপছে। সেই হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে মুখের কাছে এনে সে আবার বলল, তুমি আজ আমার খুব ক্ষতি করলে। আমি তোমাকে মেরেছি। রাগ হয়ে গেলে আমার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, কিন্তু কারুকে মারলে তারপর বেশ কয়েকদিন আমার দারুণ ডিপ্রেশান আসে, নিজেকে অনবরত ধিক্কার দিই, মরে যেতে ইচ্ছে হয়। এই হাত দিয়ে কোনও মানুষকে মারলে তারপর এই হাত দিয়ে কি আর সাহিত্য রচনা করা যায়? ছি ছি ছি ছি, কেন তুমি আমায় বাধ্য করলে?
আমি বললুম, অনেকগুলো কেন হয়ে যাচ্ছে। আমারটা তো বলেই দিয়েছি, আমার ভুল হয়েছে। রোহিলার কাছ থেকে উত্তর পাবেন কিনা, চেষ্টা করে দেখুন!
রোহিলা টিলার ওপর উঠে যাচ্ছে, এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।
বাসুদেবন বলল, চলো, আমরা দু দিক থেকে উঠি। এক সঙ্গে গেলে ও যদি অন্য দিক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে।
আমি বললুম, আপনি পেছন দিকটা দিয়ে ঘুরে আসুন। আমার সময় লাগবে, জোরে জোরে উঠতে পারব না।
টিলার ওপরে শিমুল গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে রোহিলা। দুটো হাত দু দিকে ছড়ানো, যেন ও পাখির মতন উড়ে যেতে চায়। আকাশ এখন নির্মেঘ। এক সময় মানুষ বেরিয়ে ইচ্ছে হলেই পাখি হয়ে যেতে পারত। বউ কথা কও, গৃহস্থের খোকা হোক, ঠাকুর গোপাল ওঠো ওঠো, চোখ গেল এই সব যে পাখিরা ডাকে, তারা কি একসময় মানুষ ছিল না?
নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দিকশূন্যপুর। এতক্ষণে ওখানকার নর-নারীরা জেগে উঠেছে। ওখানে যে আর পুলিশের বুটের আওয়াজে বাতাস কলুষিত হবে না। তা ওরা এখনও কেউ জানে না।
বাসুদেবন আর আমি প্রায় একই সময়ে উঠে এলুম ওপরে। আমার মাথাটা এখনও টলটল করছে। বাপ রে। লেখকদের কলমের জোরের কথা আগে শুনেছি, হাতেরও এত জোর থাকে।
বাসুদেবন বলল, সুলোচনা, তুমি শুধু আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও! আমি জোর করব না, আমার সঙ্গে যেতে বলব না। তুমি শুধু একটা কথার উত্তর দাও। তুমি কেন আমাকে বিয়ে করেছিলে, কেন তবু হঠাৎ ছেড়ে চলে এসেছিলে? আমি কী দোষ করেছি?
রোহিলা আমার দিকে ফিরে বলল, নীললোহিত, তুমি ওকে বলো, আমার বুকে একটা ছুরি বিধিয়ে দিতে। আমাকে একেবারে শেষ করে দিতে বলো। আমি আর পারছি না। পারছি না!
তারপর হাত জোড় করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, হে ঈশ্বর, আমি কারুর সন্তান নই, আমার মা-বাবা নেই, ভাই-বোন নেই, আমি কারুর স্ত্রী নই, প্রেমিকা নই, আমি সম্পূর্ণ একা। একা থাকার অপূর্ব আনন্দের স্বাদ আমি পেয়েছি। এরা কেন আমার সেই আনন্দ কেড়ে নিতে চায়?
রোহিলার এই কথার মধ্যে এমন একটা গভীর কান্নার সুর আছে, যা শুনলে বুকটা মুষড়ে ওঠে।
বাসুদেবন বলল, আমি তোমার কোনও আনন্দ কেড়ে নিতে চাই না। তুমিই আমার কাছ থেকে দিকশূন্যপুর কেড়ে নিয়েছো। তোমার জন্য আমাকে দিকশূন্যপুর ছেড়ে যেতে হল, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হল। আবার জড়িয়ে গেলুম মায়ার বন্ধনে। বালু নায়ারকে মনে আছে, সে আমার একটা গল্প নিয়ে একটা বিগ বাজেট ফিল্ম করতে চায়, দারুণ ভাবে আমায় খোঁজাখুজি করছিল। আমারও মনে হল, সাহিত্য জগৎটাই আমার নিজস্ব সচ্ছন্দের জগৎ, নির্জনে সাধনা আমার সইল না। আমি ফিরে যাচ্ছি।
আমার হাত ছুয়ে বাসুদেবন বলল, নীললোহিত, তুমি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। আমি আর সুলোচনাকে খুঁজতে আসব না।
আমি বললুম, আপনি ওকে একবার রোহিলা বলে ডাকুন না। রোহিলার সঙ্গে আপনার ভাব হতে পারে।
বিষাদমাখা মুখে কয়েক পলক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল, না, তা পারব না। মিথ্যাচরণ আমার ধাতে নেই।
পেছন ফিরে সে দ্রুত নামতে লাগল টিলা থেকে।
রোহিলা আমার কাছে এসে হাত ধরে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, নীললোহিত, ও কোথায় চলে গেল?
——ফিরে চলে গেল।
—কোথায়?
—তুমি শুনলে না, ও আর দিকশূন্যপুরে যাবে না! অনেক সন্ন্যাসী যেমন পাহাড় থেকে সংসারে নেমে আসে, আবার গৃহস্থ হয়ে যায়, বাসুদেবনও আবার শহুরে জীবনে ফিরে যাচ্ছে। আবার লেখালেখি করবে, ওর গল্পের ফিল্ম হবে।
—না, আমি শুনিনি। কান বন্ধ করে ছিলুম। ও সত্যি আর দিকশূন্যপুরে আসবে না?
—ওকে মিথ্যেবাদী ধরনের লোক বলে তো মনে হল না।
—ও আবার পুলিশ নিয়ে আসবে না?
–ও মোটেই পুলিশের কাছে যায়নি। লোকে ভুল বুঝেছে। ও একজন লেখক। ও তোমার একটা ছবি আনতে গিয়েছিল।
—ওই ছবি দেখে তুমি আমাকে সুলোচনা ভেবেছিলে? ঠোঁটে রং মাখা একটা বিশ্রী মেয়ে, ক্যাটকেটে রঙের পোশাক পরে আছে, পায়ে হাই হিল, ভুরু আঁকা, আমি ও রকম হতে পারি? দেখে ঘেন্না করছিল আমার। আমি সুলোচনা নই, সুলোচনা নই, সুলোচনা নই, তাকে চিনি না, চিনি না, চিনি না-
—এই এই, আবার শুরু করো না! আমি তো তোমাকে অনেকবার বলেছি, আমি সুলোচনা নামে কারুকে চিনি না, রোহিলাকে চিনি। সুলোচনাকে নিয়ে আমি কেন মাথা ঘামাতে যাব? তুমি বাসুদেবনকেও আগে চিনতে না?
—চিনতুম না, চিনতুম না, চিনতুম না
—ঠিক আছে, ঠিক আছে।
—নীললোহিত, ওই লোকটা যদি দিকশূন্যপুরে আর ফিরে না আসে, তা হলে আমি দিকশূন্যপুর ছেড়ে যাব কেন? তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
–তোমার চিকিৎসার জন্য।
—কীসের চিকিৎসা? আমি পাগল? কেউ আমাকে সুলোচনা বলে না ডাকলে আমি ঠিক হয়ে যাব। বাইরে গেলে, ডাক্তাররা আমাকে ইঞ্জেকশন দেবে! আমি যদি বদলে যাই? যদি ওই লোকটার মতন আমারও আর ফিরতে ইচ্ছে না করে? দিকশূন্যপুর আমার জীবনসর্বস্ব, এ জায়গা আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না। আমাকে নিয়ে যেয়ো না, প্লিজ, নিয়ে যেয়ো, পুলিশ আসবে না, আঃ কী আনন্দ, কেউ আমার নামে দোষ দেবে না, আমাকে ফিরিয়ে দাও!
—ফিরেই যাবে? ঠিক আছে, যাও তা হলে।
—আমি যে একলা নদী পার হতে পারব না। তুমি আমাকে পৌঁছে দেবে না?
আমার এখন, আঃ বাঁচা গেল, মনে মনে বলে ওঠা উচিত। ট্রেন ভাড়া, রাস্তায় খাবার ব্যবস্থা, কলকাতায় রাখার সমস্যা, চিকিৎসার বন্দোবস্ত, এই সব নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আনন্দে আমার লাফিয়ে ওঠা উচিত।
তবু মনটা কেন খারাপ খারাপ লাগছে? একলা এসেছি, একলা ফিরে যাব, এটাই স্বাভাবিক, তবু কেন বিস্বাদ লাগছে ঠোঁট।
রোহিলা বলল, আজকের সকালটা কী সুন্দর হয়ে গেল। সূর্যকে এখন আকাশের মুকুটের মতন দেখাচ্ছে। গরম নেই। বাতাস কী নরম, মনে হয় না, এই বাতাসেও সাঁতার কাটি? ঘাসের মধ্যে কত ছোট ছোট ফুল ফুটেছে, দ্যাখো, দ্যাখো, শিমুল গাছটা মাথা নেড়ে কী যেন বলতে চাইছে!
আমি এ সব কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। বরং একটা অবান্তর কথা মনে পড়ল। আজ কোন ট্রাক ড্রাইভারটা আসবে? সেই ছাগল-চোর, না সেই দৈত্য চেহারার উদার? বড় রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা? আর তিনটি মাত্র সিগারেট আছে, শেষ হয়ে যাবে।
রোহিলা বলল, তুমি আর কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারো না? বেশ মজা হবে!
—না, রোহিলা, তা আর সম্ভব নয়। আমি যে বাইরের লোক।
—ও রকম কথা আর একদম বলবে না। নীললোহিত, তুমি শপথ করেছিলে, আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমি ফিরে যাচ্ছি, এটা কিন্তু ছেড়ে যাওয়া নয়। তুমি দূরে চলে গেলেও তুমি আমার কাছে থাকবে। তোমার সঙ্গে দেখা না হলেও দেখা হবে। আমরা এক সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব, আমরা গান গাইব, গাছের তলা থেকে ফুল কুড়োব। তুমি দূরে থাকবে, তবু এ সব হবে! কথা দাও!
এ সব কথার মর্ম আমি আর বুঝতে পারছি না। আমার মুখখানা ট্রেনের যাত্রীদের মতন হয়ে গেছে। অনেক ভিড়ের মাঝখানে বসে থাকা এক বেকার ছোকরা, সে জীবনে কারুর সঙ্গে একসঙ্গে বৃষ্টি ভেজা, গান গাওয়া, ফুল কুড়োন নেই। দিকশূন্যপুর থেকে সে জীবন লক্ষ যোজন দূরে।
তবু বললুম, হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। বেলা হয়ে যাচ্ছে, এবার চলো-
দুজনে টিলা থেকে নামতে লাগলুম নদীর দিকে।
এরপর আর দিকশূন্যপুরে আমার ফেরার কোনও মানে হয় না। সবার কাছে বিদায় নিয়ে এসেছি। চোখে ভাসছে কলকাতা, অথচ দিকশূন্যপুরও টানছে। কী যে অদ্ভুত এই দো-টানা!
জানি, আবার আমাকে আসতেই হবে। অনেকদিন কেজো, ব্যস্ত, যুক্তিসম্মত মানুষদের মধ্যে থাকতে থাকতে মন ছটফটিয়ে উঠবে, মনে হবে, কিছু দিন আবার সেই দিব্য-উন্মাদদের সঙ্গে কাটিয়ে আসি না কেন! কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে আসব এদিকে। না আর কেউ জানবে না।
***