চলন্তিকা
অকৃতজ্ঞ এবং কৃতঘ্ন শব্দ দুটির অর্থ একই কিনা, সে বিষয়ে শোভনলালবাবুর মনে একটু সন্দেহ আছে।
কিন্তু সন্দেহ নিরসনের কোনও উপায় এই মুহূর্তে তাঁর হাতে নেই। বাংলা অভিধানটা গত সপ্তাহেই নির্মলা দেবী নিয়ে গেছেন, বলেছিলেন পরের দিন সকাল হতে-না-হতে ফেরত দিয়ে যাবেন, দেননি।
কেউ কথা রাখেনি। নির্মলা দেবীও কথা রাখেননি। এই সপ্তাহের মধ্যে একদিন বাজারে, দুদিন বাসস্ট্যান্ডে নির্মলা দেবীর সঙ্গে শোভনলালবাবুর দেখা হয়েছে। তাকে দেখে নির্মলা দেবী চোখের কোনায়, ঠোঁটের প্রান্তে মৃদু, অভ্যস্ত হাসি হেসেছেন। কিন্তু অভিধান নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি।
শুধু নির্মলা দেবীর কাছে নয়, অনেকের কাছেই অনেক কিছু পাওনা আছে শোভনলালবাবুর।
হিসেব করতে গেলে লম্বা ফিরিস্তি হয়ে যাবে। সব মনে পড়বে না। এত মনে থাকে নাকি কারও।
আর মনে থেকেই বা কী লাভ? একবার কোনও জিনিস হাতছাড়া হলে যতই মনে করে তাগাদা দেওয়া যাক, সে কি আর সহজে ফেরত পাওয়া যায়। আসল কথা হল, সহজে বা কঠিনে, কোনওভাবেই ফেরত পাওয়া যায় না।
এর যে ব্যতিক্রম নেই তা অবশ্য নয়।
এই তো এগারো নম্বর বাড়ির ছোট নাতনিটার হঠাৎ জ্বর হয়েছে। আড়াই বছরের টগবগে, ছিমছাম মেয়েটা, নামটাও সুন্দর, মাছের নামে নাম মৌরলা। ঝলমল করে খেলে বেড়ায় শোভনলাল চক্রবর্তীর বাড়ির সামনের রাস্তায়, পাশের ছোট পার্কে। সেই মেয়েটা জ্বরে পড়তে তার মা নমিতা এসে শোভনলালবাবুর থার্মোমিটার ধার নিয়ে গেল। পুরনো দিনের হিকস কোম্পানির অতি বিশ্বস্ত থার্মোমিটার। নমিতা এসে মেয়ের জ্বরের কথা বলে থার্মোমিটারটা চাইতে, বিশেষ করে মৌরলার কথা মনে করে শোভনলালবাবু তাকে থার্মোমিটারটা দিয়ে বললেন, সাবধানে ব্যবহার করবে। খুব পুরনো জিনিস।
থার্মোমিটার নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে যেতে মৌরলার মা দেখল শোভনলালবাবুর বাইরের ঘরের দেয়ালে বড় সাইনবোর্ড, সুকুমার রায় থেকে বেমালুম চুরি করে এই নোটিশটি তিনি দিয়েছেন,
কেঁদে কেঁদে হেসে হেসে
ভুগে ভুগে কেশে কেশে
দেশে দেশে ভেসে ভেসে
এত ভাল বেসে বেসে
টাকা মেরে পালালি শেষে!..
দেয়ালের এই নোটিশ তথা বিজ্ঞাপন দেখে নমিতা একটু থমকিয়ে দাঁড়াল। মৌরলাকে শোভনলালবাবু খুব ভালবাসেন, আন্তরিক স্নেহ করেন। মৌরলা অনবরতই এ বাড়িতে, যে বাড়ির নাম শোভন কুটির, যাতায়াত করে। তার পিছু পিছু নমিতাকেও প্রায়শই যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু নমিতা এই নোটিশ তথা বিজ্ঞপ্তি এই দেয়ালে এর আগে কখনও দেখেনি।
নমিতাকে থমকিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে, সুবুদ্ধি শোভনলালবাবু প্রশ্ন করলেন, কী হল?
নমিতা কিছু না বলে নোটিশ বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখে শোভনলাল বললেন, ওই বিজ্ঞাপন তোমার জন্যে নয়। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে মৌরলার জ্বর দেখে সঙ্গে সঙ্গে থার্মোমিটারটা ফেরত নিয়ে এস। আমি এই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।
নমিতা তখনও থমকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বিশেষ করে এই কথা শোনার পরে সে আরও গোলমালে পড়ে গেছে। থার্মোমিটারটা রেখে যাবে কিনা সে ভাবছিল।
কিন্তু সেটা খুব খারাপ দেখাবে। বুড়ো মানুষেরা একটু গোলমেলে হয়। নমিতার শ্বশুরমশায়, মানে মৌরলার ঠাকুরদাও খুব গোলমেলে। একটু মানিয়ে চলতে হয়।
নমিতা থার্মোমিটার নিয়ে বেরিয়ে যেতে শোভনলালবাবু নিজের বাড়ির সদর দরজার বাইরে রাস্তার ওপরে এসে দাঁড়ালেন। তার দৃষ্টি নমিতার দিকে। কখন নমিতা মেয়ের জ্বর দেখে। থার্মোমিটার ফেরত নিয়ে আসবে, তার কাছ থেকে সেই থার্মোমিটার উদ্ধার করে বাড়িতে ঢুকে ওষুধের বাক্সে সেটা আবার ঢুকিয়ে রাখবেন, এই মুহূর্তে শোভনলালবাবুর সেটাই একমাত্র চিন্তা।
শোভনলালের এই দুশ্চিন্তার মূলে অবশ্য ঘনিষ্ঠ কারণ একটা আছে। নমিতার শ্বশুর ভূদেবচন্দ্র দস্তিদার যেকোনও জিনিস ধার করায় এক্সপার্ট এবং ধার করে ফেরত না দেওয়ায় আরও বেশি এক্সপার্ট।
ভূদেববাবুর কাছে কী কী জিনিস পাওনা আছে তার একটা তালিকা মনে মনে মুখস্থ আছে শোভনলালবাবুর।
শুধু ভূদেববাবুর কাছে কী পাওনা আছে তা নয়, দূরে-কাছের বহুজনের কাছে তার যা পাওনা আছে কিছুই ভোলেননি শোভনলাল।
গলির মোড়ের পীতাম্বরবাবু রেল কোম্পানির বড় চাকরি করতেন। সেই ভদ্রলোক বাড়িতে আত্মীয়কুটুম হঠাৎ চলে আসায় একটা বড় মশারি বছর দেড়েক আগে এক সন্ধ্যাবেলা এসে ধার। করে নিয়ে গিয়েছিলেন। আত্মীয়েরা চলে যাওয়ার পরে পীতাম্বরবাবু বলেছিলেন, মশারিটা ধোপাবাড়ি থেকে কাচিয়ে ফেরত দিয়ে আসব। শোভনলাল বলেছিলেন, তার কী দরকার? প্রয়োজন হলে আমি নিজেই কাচিয়ে নেব।
কিন্তু সে সুযোগ আর শোভনলাল শেষ পর্যন্ত পাননি। পীতাম্বরবাবু প্রথম প্রথম এড়িয়ে চলতেন, এখন আর দেখা হলেও উচ্চবাচ্য করেন না। মশারিটা বোধহয় ধোপাবাড়ি থেকে কেচে আজও আসেনি।
এর চেয়ে অনেক মারাত্মক ধারিয়ে হলেন গলির মোড়ের ওপারের জগদম্বা দেবী। অঘ্রান মাসের শেষ শনিবারে পূর্ণিমা পড়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় জগদম্বা দেবী তাদের গৃহে সত্যনারায়ণ ঠাকুরের পুজো করেছিলেন। পুজোর দিন সকালে প্রসাদ খাওয়ার নিমন্ত্রণ করার জন্য নাতির হাত ধরে এসে শাখ, কাসর ঘণ্টা, তামার কোষাকুষি, চন্দনের পাটা ধার করে নিয়ে যান জগদম্বা। ফেরত দেওয়ার নামগন্ধ নেই।
শোভনলালবাবু মধ্যে একদিন সকালে নিজে থেকে জগদম্বা দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন জিনিসগুলো উদ্ধার করতে। ভদ্রমহিলার নাতি, ঠাকুমা, কাপড় ছাড়ছে, এই বলে বাইরের ঘরের। মুখে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখল, ভেতরে এসে বসতে পর্যন্ত বলল না। এদিকে শোভনলাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবে গেলেন, প্রৌঢ়া বিধবার কাপড় ছাড়তে এতক্ষণ কেন লাগে?
জগদম্বা দেবীর সঙ্গে কিন্তু দেখা হল না। এক ঘণ্টা পরে নাতি এসে জানাল, ঠাকুমা, পুজোয় বসে গেছে। বিরক্ত হয়ে শোভনলালবাবু বললেন, তোমাদের বাড়িতে আমার শাখ, কাসর ঘণ্টা এসব আছে। সেগুলো নিতে এসেছি।
নাতি এবার নিজ দায়িত্বে বলল, কিন্তু সে তো এখন ফেরত দেওয়া যাবে না। সরস্বতী পুজোর পরে পাবেন। শোভনলাল মিনমিন করে বললেন, কিন্তু আমার বাড়িতেও যে সরস্বতী পুজো আছে। কোনও জবাব না দিয়ে জগদম্বার কিশোর নাতি তার মুখের ওপরে সদর দরজা বন্ধ করে দিল।
অপমানিত শোভনলালবাবু রাস্তায় নামতে নামতে জগদম্বা দেবীর বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, পুজো-টুজো নয়, দোতলার বারান্দায়, সাদা প্লাস্টিকের ইজিচেয়ারে বসে জগদম্বা দেবী নীল-মেরুন প্রিন্টেড কাপড়ের সাদা লেস লাগানো আধুনিক ঘটিহাতা নাইটি পরে সকালের খবরের কাগজ পড়ছেন।
শোভনলাল অত্যন্ত ভাল লোক, তার মনে রাগ-বিদ্বেষ কিছু নেই। সকালবেলায় ঝলমলে রোদে ইটরঙা জগদম্বা কুটিরের দোতলার বারান্দায় প্রতারিকা জগদম্বাকে মোহিনী বেশে দেখে তার মনটা কেমন হয়ে গেল। শীতের বাতাসের হু হু ভাবটা তার মনের মধ্যেও ঢুকে গেল। এ অবশ্য সাত দিন। আগের কথা। এই সাত দিন শোভনলালবাবু ক্রমাগতই জগদম্বা দেবীর কথা ভেবেছেন। এদিকে সরস্বতী পুজোও এসে গেছে, পুজোর জিনিসপত্রগুলি ফেরত পাওয়া দরকার।
কিন্তু এই মুহূর্তে শোভন কুটিরের দরজায় দাঁড়িয়ে শোভনলাল জগদম্বার চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন। এখন ভাবছেন নমিতার এত দেরি হচ্ছে কেন, জ্বর দেখতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে?
একটা দুশ্চিন্তাও শোভনলালবাবুর মাথায় দেখা দিয়েছে, নমিতার শ্বশুর ভূদেব দস্তিদার যদি জানতে পারেন যে তাঁর বাড়িতে একটা থার্মোমিটার ঢুকেছে সেটা কিছুতেই বেরোতে দেবেন না, সেটা তাঁর ধর্মই নয়।
ভূদেব দস্তিদার ধার নেননি এমন কোনও দ্রব্য পৃথিবীতে নেই। শতরঞ্জি, ঝুলঝাড়ু, কাঠের মই, বড় বালতি, চায়ের পেয়ালা, পঞ্জিকা এমনকী ঘাস কাটার কল পর্যন্ত ভূদেববাবু শোভন কুটির থেকে কখনও না কখনও ধার নিয়েছেন এবং তারপর আর ফেরত দেননি।
শোভনলালবাবু ভূদেববাবুর ধার রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করে কোনও কূল পান না, কখনওই পাননি। ভূদেববাবুর বাড়িতে এক চিলতে বাগান নেই, ঘাস নেই। ঘাসকাটা কল তার কী কাজে লাগছে শোভনবাবু কিছুই অনুমান করতে পারেন না।
একবার নমিতাকে জিজ্ঞাসা করায় সে অবশ্য অদ্ভুত একটা উত্তর দিয়েছিল। তার শ্বশুরমশায় নাকি ছাদের ওপর ঘাসকাটা কল চালান।
নমিতার কাছে শোভনবাবু জানতে চেয়েছিলেন, তোমরা কি ছাদে মাটি ফেলে ঘাসের চাষ করেছ? নমিতা সেদিন শোভন কুটিরে এসেছিল মৌরলাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। মৌরলাকে হস্তগত করে এ প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে সেদিন চলে গিয়েছিল।
আজ নমিতার কাছে ছাদে ঘাসকাটা কলের ব্যবহারের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। কিন্তু থার্মোমিটার নিয়ে নমিতা আসছে কোথায়?
এদিকে বাড়ির মধ্য থেকে বুড়ো হুলো বেড়ালটা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। শোভনলালবাবুর পায়ে ঘুর ঘুর করছে আর পিঠ ঘষছে। রেডিয়োর মতো ঘরঘর শব্দ করে বলে এ বেড়ালটার নাম আকাশবাণী।
শোভন কুটিরে প্রাণী বলতে মোট দুজন। শোভনলালবাবু আর আকাশবাণী। শোভনলাল দীর্ঘদিন বিপত্নীক। দুই ছেলে দুজনেই বাইরে। বড়টি দিল্লিতে চাকরি করে। ছোটটি বিদেশে পড়ায়। দুজনেরই ঘরসংসার আছে, কদাচিৎ বুড়ো বাপের কাছে আসতে পারে। তার একই মেয়ে, সেও বিয়ে হয়ে শিলিগুড়িতে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছে।
নমিতার দেরি দেখে কী করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না শোভনবাবু। নিজেই এগিয়ে যাবেন নাকি থার্মোমিটারটা উদ্ধার করতে, এইরকম ভাবছিলেন।
এমন সময় নমিতাকে তাদের বাড়ির দরজায় দেখা গেল। সে এদিকেই আসছে।
একটু আগে তার মুখে যেমন একটা চিন্তিত কালচে ভাব দেখা গিয়েছিল এখন সেটা কেটে গেছে। বেশ হাসিমুখ।
নমিতা থার্মোমিটারটা হাতে করে নিয়ে এসেছে। সে এসে প্রসন্ন কণ্ঠে বলল, জ্বরটা একদম কমে গেছে। প্রায় ছেড়েই গেছে বলা যায়। প্রথমবারে থার্মোমিটার দেখে বিশ্বাসই হল না। তাই একটু সময় পরে আবার দেখলাম, আরও কম। এখন তো মেয়ে ঘামছে, জ্বর ছাড়ল বলে।
আকাশবাণী বেড়ালটা নমিতাকে চেনে, খুবই পছন্দ করে। নমিতাদের বাড়িতে গেলে তাকে নমিতা মৌরলার উদ্বৃত্ত দুধ, কখনও বা দুয়েক টুকরো মাছের কাটা খেতে দেয়। এখন রাস্তায় নমিতাকে দেখে আকাশবাণী তার ঘরঘরানি আরও বাড়িয়ে দিল, তার পায়ে মাথা ঘষতে লাগল।
নমিতার কাছ থেকে থার্মোমিটারটা ফেরত নিয়ে শোভনলাল তার পুরনো কৌতূহলের সূত্র ধরে নমিতাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি সেদিন বলছিলে না, তোমার শ্বশুর মশায় ছাদে ঘাসকাটা কল ব্যবহার করেন। তোমাদের ছাদে কি ঘাস আছে? ভূদেববাবু ছাদে ঘাসকাটা কল দিয়ে কী করেন? নমিতা বলতে যাচ্ছিল যে তার শ্বশুরমশায় ছাদে ঘাস কাটেন না, ওটা ছাদের ওপর চালান কাক, চিল, পায়রাকে ভয় দেখানোর জন্যে, যখন আমসত্ত্ব কি ডালের বড়ি, চাল কি ডাল ছাদে রোদে দেওয়া হয়।
কিন্তু সে কিছু বলার আগেই পথের ওপাশে দেখা গেল জগদম্বাবাহিনী এই দিকেই আসছে।
জগদম্বাবাহিনী অর্থাৎ স্বয়ং জগদম্বা দেবী এবং তাঁর সেই অশিষ্ট নাতি, যার নাম ভোম্বা।
তখন আকাশবাণী নমিতার পায়ে পিঠ ঘষছে।
জগদম্বা দেবীর নাতি ভোম্বা ছুটে এসে বেড়ালটাকে কোলে তুলে বলল, ঠাকুমা, এই বেড়ালটা।
আকাশবাণীর ভোম্বাকে খুব পছন্দ হয়নি। ভোম্বার আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থায় সে ফোঁস করে উঠল। ভোম্বা তাকে আরও চেপে ধরল।
নমিতা জগদম্বা দেবীকে ভালই চেনে। তার আশঙ্কা হল আকাশবাণী বোধহয় জগদম্বার বাসায় গিয়ে কিছু চুরি-টুরি করে খেয়েছে। তাই নালিশ করতে এসেছেন।
শোভনলালবাবু অবশ্য জানেন যে আকাশবাণী অন্য বাড়িতে গিয়ে চুরি করে খাওয়ার বেড়াল নয়। বাড়িতে তার যথেষ্ট খাবার আছে, তা ছাড়া অন্য বাড়িতে সে কদাচিৎ যায়।
কিন্তু জগদম্বা যা বললেন তা শুনে নমিতা ও শোভনলালবাবু দুজনেই বিস্মিত হয়ে গেলেন। জগদম্বা দেবীর বাসায় খুব ইঁদুর হয়েছে, তিনি এই বেড়ালটাকে এক সপ্তাহের জন্য ধার নিতে চান। দুবেলা ভোম্বা এ বাড়িতে এসে খাইয়ে-দাইয়ে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া সারাদিন আর রাতের বেলা জগদম্বা দেবীর বাসায় কাটাবে। সবগুলো ইঁদুর মারা হয়ে গেলে তিনি নিজে এসে বেড়াল ফেরত দিয়ে যাবেন।
জগদম্বার কথা শুনতে শুনতে আকাশবাণী ফাঁচ ফাঁচ করছিল। সে কী বুঝতে পারল কে জানে, হঠাৎ ভোম্বার কোল থেকে মুখ বাড়িয়ে জগদম্বা দেবীর হাত কামড়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে রক্তারক্তি কাণ্ড।
এর পরের ঘটনা বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। জগদম্বা নাতিকে নিয়ে দ্বৈত আর্তনাদে পাড়া মাথায় করে তুললেন। লোকজনের ভিড় হয়ে গেল। প্রায় থানা-পুলিশ হয়ে যায় আর কী। সুযোগ বুঝে মোড়ের দিক থেকে দুজন হোমগার্ডও এগিয়ে এল।
জগদম্বা চেঁচামেচি থামিয়ে তাদের কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগে শোভনলালবাবু বললেন, আমার বাড়ি থেকে শঙ্খ, কাসর, ঘণ্টা এইসব পুজোর জিনিস চুরি গেছে।
জগদম্বা দেবীর হাত দিয়ে তখনও টপটপ করে রক্ত ঝরছে। একে বেড়ালের কামড় তার ওপরে শোভনলালবাবুর এই মিথ্যা ভাষণ, ধার দিয়ে চুরি হয়েছে বলে, তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। নাতির হাত ধরে ধুপ ধুপ করে বাড়ি ফিরে গেলেন।
আধঘণ্টার মধ্যে ভোম্বা একটা থলেতে করে শঙ্খ, ঘণ্টা, চন্দনপাটা সব ফেরত দিয়ে গেল। জানলার মাথায় বসে আকাশবাণী সব পর্যবেক্ষণ করছিল, শোভনলালবাবু জিনিসগুলো সব মিলিয়ে নিলেন। এর মধ্যে পাড়ায় কী করে রটে গেল যে মহান উত্তমর্ণ শোভনলালবাবুর পোষ বেড়ালের মাথা খারাপ হয়ে গেছে, সে লোককে কামড়াতে শুরু করেছে। শোভনলালবাবুর কাছ থেকে কিছু নিয়ে যারা ফেরত দেয়নি, বেছে বেছে তাদেরই নাকি কামড়াচ্ছে।
বিকেল নাগাদ লম্বা লাইন পড়ে গেল। এত জিনিস লোকে ধার নিয়েছিল শোভনলালবাবুর মনেই ছিল না। পেতলের গামলা, কাঁসার বাটি, অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই, স্টিলের থালা, বেতের চেয়ার, কাঠের টুল থেকে শুরু করে এক কেজি চাল, এক কাপ চিনি-তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই।
এমনকী শেষের দিকে নমিতা এসে শ্বশুরের ধার নেওয়া ঘাসকাটার কল ফেরত দিয়ে গেল। শোভনলালবাবু ভেবেছিলেন, নমিতা বুঝি থার্মোমিটারটা আবার চাইতে এসেছে। কিন্তু তা নয়। মৌরলার জ্বর ছেড়ে গেছে, ওটা আর দরকার হবে না। নমিতার সঙ্গে তাদের কাজের মেয়ে ঘাসকলটা নিয়ে এসেছে।
শুধু নির্মলাদেবীই ব্যতিক্রম। তিনি চলন্তিকা ফেরত দিতে এলেন না। কোনও দিন আসবেন কি, কে জানে?