চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য পেয়

জঠর-তত্ত্ববিৎ বুধগণ উদর-সেবাকে চারি ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। চর্বণ করা, শোষণ করা, লেহন করা ও পান করা। আহারের অনুষঙ্গিক ও অত নিকট সম্পর্কীয় একটি পদার্থ আছে, পুরাতন নস্য-সেবকেরা তাহাকে অনাদর করিয়াছেন যথা, ধূমায়ন অর্থাৎ ধোঁয়ান। যাহা হউক, “ভক্ষণ ও ভক্ষণায়ন’ সভার সভ্যগণ তঁহাদের শাস্ত্রের পাঁচটা পরিচ্ছেদ নির্মাণ করিয়াছেন, প্রথম চর্ব্য; দ্বিতীয় চোষ্য; তৃতীয় লেহ্য; চতুর্থ পেয় ও পঞ্চম ধৌম্য। এই শেষ পরিচ্ছেদটাকে অনেকে রীতিমতো পরিচ্ছেদ বলিয়া গণনা করেন না, তাঁহারা ইহাকে পরিশিষ্ট স্বরূপে দেখেন।

আমাদের বুদ্ধির খোরাককেও এইরূপ পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়। শ্রীযুক্ত লালা আহার-বিহারী উদরাম্বুধি মহাশয় দেখিবেন, তাঁহাদের ভোজের সহিত বুদ্ধির ভোজের যথেষ্ট সৌসাদৃশ্য আছে।

চর্ব্য। কাঁচা, আভাঙা সত্য। ইহা একেবারে উদরে যাইবার উপযোগী নহে। গলা দিয়া নামে না, পেটে গিয়া হজম হয় না। ইহা অতিশয় নিরেট পদার্থ। ইংরাজি বুদ্ধিজীবী ঔদারিকগণ ইহাকে পতদঢ়ড় বলেন। যদি ইহাকে দাঁত দিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া, বিশ্লেষণ করিয়া, রহিয়া বসিয়া না খাও, যেমন পাও তেমনি গিলিতে আরম্ভ কর তবে তাহাতে বুদ্ধিগত শরীরের পুষ্টি সাধন হয় না। এইটি না জানার দরুন অনেক হানি হয়। স্কুলে ছেলেদের ইতিহাসের পাতে যে আহার দেওয়া হয় তাহা আদ্যোপান্ত চর্ব্য। বেচারিদের ভাঙিবার দাঁত নাই, কাজেই ক্রমিক গিলে। কোন্‌ রাজার পর কোন্‌ রাজা আসিয়াছে; কোন্‌ রাজা কোন্‌ সালে সিংহাসন প্রাপ্ত হইয়াছে ও কোন্‌ সালে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে, এই-সকল শক্ত শক্ত ফলের আঁঠিগুলি তাহাদের গিলিতে হয়। মাস্টারবর্গ মনে করেন, ছাত্রদের মনের ক্ষেত্রে এই যে-সকল বীজ রোপণ করিতেছেন, ভবিষ্যতে ইহা হইতে বড়ো বড়ো গাছ উৎপন্ন হইবে। কথাটা যে চাষার মতো হইল; কারণ, এ যে ক্ষেত্র নয়, এ পাকযন্ত্র। এখানে গাছ হয় না, রক্ত হয়। আজকাল য়ুরোপে এই সত্যটি আবিষ্কৃত হইয়াছে ও পাঠ্য ইতিহাস লিখিবার ধারাও পরিবর্তিত হইয়াছে। এখনকার ইতিহাস কতকগুলা ঘটনার সংবাদপত্র ও রাজাদিগের নামাবলী নহে। অবশ্য চর্ব্য পদার্থের কাঠিন্যের কমবেশ পরিমাণ আছে। কোনোটা বা চিবাইতে কষ্ট বোধ হয় না মুখে দিলেই মিলাইয়া যায়, কোনোটা চিবাইতে বিষম কষ্ট হয়। যাঁহাদের বুদ্ধি দাঁত-ওয়ালা, চর্ব্য তাঁহাদের স্বাভাবিক খাদ্য। তাঁহারা কঠিন কঠিন চর্ব্যগুলিকে লইয়া বিশ্লেষণ দাঁত দিয়া ভাঙিয়া, মুখের মধ্যে আনুমানিক ও প্রামাণিক যুক্তির রসে রসালা করিয়া লইয়া এমনি আকারে তাহাকে পরিণত করেন যে, তাহার চর্ব্য অবস্থা ঘুচিয়া যায় ও সে পরিপাকের উপযোগী ও রক্ত-নির্মাণক্ষম হইয়া উঠে। ইহা একটি শারীর-তত্ত্বের নিয়ম যে, খাদ্য যতক্ষণ চর্ব্য অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ পতদঢ়ড় যখন কেবলমাত্র পতদঢ়ড় রূপেই থাকে, ততক্ষণ তাহা রক্ত নির্মাণ করিতে পারে না, রক্তের সহিত মিশিতে পারে না। তাহার সাক্ষ্য, আমাদের অসংখ্য এম-এ বি-এ’দের খাইয়া খাইয়া পিলে হয়; উদরী হয়; কাহারো কাহারো বা অপরিমিত চর্বি হয়, ও বাহির হইতে বিষম বলিষ্ঠ বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু বল হয় না।

আমরা এখনও ভালো করিয়া চর্ব্য খাইতে পারি না, আমরা চোষ্য খাইয়া থাকি। যাহাদের দাঁত উঠে নাই তাহারা শোষণ করিয়া খায়। মাতৃস্তন্য শোষণ করিয়া খাইতে হয়। অর্থাৎ মাতার শরীরে চর্ব্য দ্রব্য সকল হজম হইয়া সার দুগ্ধরূপে পরিণত হয়, সন্তান তাহাই শোষণ করিয়া খায়। অনেকগুলি সহজ সত্য আমরা অতীত কালের স্তন হইতে পান করি। বহুবিধ অভিজ্ঞতার চর্ব্য খাইয়া খাইয়া অতীতের স্তনে সেই দুগ্ধ জন্মিয়াছিল। আমরা বিনা আয়াসে তাহা প্রাপ্ত হই। তাহা আর চিবাইতে হয় না, একেবারে পরিপাকের উপযোগী হইয়াই থাকে। কোনো কোনো মাতার স্তনে দুগ্ধ অধিক থাকে, কাহারো দুগ্ধ কম থাকে। আমরা একটা বিলাতি দাইয়ের দুগ্ধ পান করিতেছি, আমাদের মায়ের দুধ কম। এই অস্বাভাবিক উপায়ে দুধ খাওয়া অনেকের সহে না, অনেকের পক্ষে ঘটিয়া উঠে না, ইহা বড়োই ব্যয়সাধ্য। পণ্ডিতদিগের মত এই যে, আমাদের সাহিত্য-মা যদি ভালো ভালো পুষ্টিকর খাদ্য খাইয়া, দুধ কিনিয়া নিজে খাইয়া, শরীর সুস্থ রাখিয়া স্তনে প্রচুর পরিমাণে দুগ্ধ সঞ্চার করিতে পারেন, তবে দাই নিযুক্ত করা অপেক্ষা তাহাতে অনেক বিষয়ে ভালো হয়। সন্তানদের সে দুধ ভালোরূপে হজম হয়, সকল সন্তানই সে দুধ পাইতে পারে ও তাহা ব্যয়সাধ্য হয় না। এইখানে একটা কথা বলা আবশ্যক, নিতান্ত শিশু-অবস্থা অতীত হইয়া গেলে একটু একটু করিয়া চর্ব্য দেওয়া আবশ্যক, তাহাতে দাঁত শক্ত হয়, দাঁত উঠিবার সহায়তা করে। অনেক সময়ে চিবাইয়া দাঁত শক্ত করিবার জন্য ছেলেদের হাতে চুষি দেয়। বড়ো বড়ো উন্নত সমাজ এক কালে এইরূপ খাদ্য ভ্রমে চুষি চিবাইয়াছে, তাহাতে আর কিছু না হউক, তাহাদের দাঁত উঠিবার অনেকটা সহায়তা করিয়াছে। মধ্যযুগের য়ুরোপীয় পণ্ডিতমণ্ডলীতে এইরূপ কূট তর্কের চুষি চিবানোর প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। আমাদের ন্যায়শাস্ত্রের অনেকগুলি তর্ক এইরূপ চুষি, অতএব দাঁত উঠিবার সহায়তা করিতে কঠিন দ্রব্যের বিশেষ আবশ্যক। আমাদের, বোধ করি, এতটুকু দাঁত উঠিয়াছে যে, একটু একটু করিয়া চর্ব্য খাইতে পারি। অতএব হে বঙ্গবিদ্বন্মণ্ডলী, একটা ভালো দিন স্থির করিয়া আমাদের অন্নপ্রাশন করা হউক। হে মাসিকপত্রসমূহ, আমাদের কেবলমাত্র দুগ্ধ না দিয়া একটু একটু করিয়া অন্ন খাইতে দিয়ো।

“লেহ্যে’র কোঠায় আসিবার আগে “পেয়’ সম্বন্ধে আলোচনা করা আবশ্যক। প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের শরীরের পক্ষে চর্ব্য যেরূপ আবশ্যক, পেয়ও সেইরূপ আবশ্যক। শরীরের তরল জলীয় অংশ পূরণ করাই পানীয় দ্রব্যের কাজ। অতএব, ইহা শরীরের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। বুদ্ধিজীবী লোকদের খোরাককে কবিতাই পানীয়। ইহা তাঁহাদের রক্তের জলীয় অংশ প্রস্তুত করে, ইহা তাঁহাদের শিরায় উপশিরায় প্রবাহিত হয়। ইহা কখনো মাদকের স্বরূপে তাঁহাদের মুহ্যমান দেহে চেতনার বল সঞ্চার করে, অলস শরীরে স্ফূর্তি ও উদ্যমের উদ্রেক করে, সময় বিশেষে আবেশে গদগদ করিয়া দেয়। আবার কখনো শীতল জলস্বরূপে সংসারের রৌদ্রদগ্ধ ব্যক্তির পিপাসা শান্তি করে, শরীর শীতল করে। দেহের রক্ত উষ্ণ হইয়া যখন একটা অসংযত উত্তেজনা শরীরে জ্বলিয়া উঠে তখন তাহা জুড়াইয়া দেয় অর্থাৎ, অকর্মণ্যকে উত্তেজিত করে, অশান্তকে শান্তি দেয়, শ্রান্ত ক্লান্তকে বিশ্রাম বিতরণ করে। অতএব বয়স্ক বুদ্ধিজীবী লোকদের পক্ষে বুদ্ধির খাদ্য চর্ব্য সকলও যেমন আবশ্যক, আবেগের পানীয় কবিতাও তেমনি উপযোগী।

চর্ব্য কঠিন ও পেয় গভীর, কিন্তু লেহ্য তরল, অগভীর ও বিস্তৃত। যাহাদের শোষণ করিবার বয়স গিয়াছে, অথচ দাঁতের জোর কম, তাহারা লেহ্য খাইয়া বাঁচে। অধিক চিবাইতে হয় না, অধিক তলাইতে হয় না, উপর হইতে লেহন করিয়া লয়। এই বেচারিদের উপকার করিবার জন্য অনেক দন্তবান বলিষ্ঠ লোকে কঠিন কঠিন চর্ব্য পদার্থকে বিধিমতে গলাইয়া, রসে পরিণত করিয়া লেহ্য বানাইয়া দেন। নিতান্তই যাহা গলে না তাহা ফেলিয়া দেন। বলা বাহুল্য যে, এইরূপ গলাইতে অধিকাংশ সময়ে পানীয় পদার্থের আবশ্যক করে। প্রক্টর সাহেব কঠিন জ্যোতির্বিদ্যাকে পানীয় পদার্থে গলাইয়া জনসাধারণের জন্য মাঝে মাঝে প্রায় এক-এক পাত্র লেহ্য প্রস্তুত করিয়া দেন। আজকাল ইংলণ্ডে এই লেহ্য সেবনের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব পড়িয়াছে। ম্যাকমিলান, ব্ল্যাকবুড প্রভৃতি দোকানদারেরা এইরূপ নানা প্রকার পদার্থের লেহ্য প্রস্তুত করিয়া ইংলণ্ডের ভোজনপরায়ণদের দ্বারে দ্বারে ফিরিতেছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত আশঙ্কা করিতেছেন যে, লেহ্য সাহিত্যের অধিক প্রাদুর্ভাব হইলে লোকের দাঁতের ব্যবহার এত কমিয়া যাইবে যে, দাঁত ক্রমশই শিথিলতর হইয়া পড়িবে।

এই সকল প্রকার খাদ্য ও পানীয়ের আবার নানা প্রকার আস্বাদন আছে, কোনোটা বা মিষ্ট, কোনোটা বা তিক্ত, কোনোটা বা ঝাল, কোনোটা বা অম্ল। কোন্‌ প্রকারের খাদ্য মিষ্ট তাহা বলিবার আবশ্যক নাই, সকলেই জানেন। যাহা তীব্র, ঝাঁঝালো বিদ্রূপ; যাহাতে বেলেস্তরার কাজ করে; যাহা খাইতে খাইতে চোখে জল আসে, তাহাই ঝাল। অনেকের নিকট ইহা মুখরোচক, কিন্তু শরীরের পক্ষে বড়ো ভালো নহে। সচরাচর লোকে বলিয়া থাকে “ঝাল ঝাড়া’। অর্থাৎ মনে জ্বালা ধরিলে আর-একজনকে জ্বালানো। বেচারি পূর্ববঙ্গবাসীগণ ক্রমাগতই ঝাল খাইয়া আসিতেছে। অম্লরস ঝালের মতো ঝাঁঝালো উষ্ণ নহে। ইহা বড়ো ঠাণ্ডা আর হজমের সহায়তা করে। ইহার বর্ণ লঙ্কার ন্যায় লাল টক্‌টকে নয়, দধির ন্যায় বিশদ, স্নিগ্ধ। ইহাকে ইংরাজিতে বয়লষয়ক্ষ বলে, বাংলায় কিছুই বলে না। ইহার নাম বিমল, অপ্রখর রসিকতা। ইহা মুচকি হাসির ন্যায় পরিষ্কার ও শুভ্র। ইহা দুধকে ঈষৎ বিকৃত করিয়া দেয়, কিন্তু সে বিকৃত পদার্থ অন্যান্য বিকৃত পদার্থের ন্যায় ঘৃণাজনক, দুর্গন্ধ ও বিস্বাদ নহে। সেই বিকারের কেমন একটি বেশ মজার স্বাদ আছে। আমাদের বঙ্কিমবাবুর সকল লেখায় এইরূপ কেমন একটু অম্লরসের সঞ্চার আছে, মুখে বড়োই ভালো লাগে। তাঁহার কমলাকান্তের দপ্তরে অনেক সময়ে তিনি শুষ্ক চিড়া-সকল দই দিয়া এমন ভিজাইয়া দিয়াছেন যে, সে চিড়ার ফলারও ভোক্তাদের মুখরোচক হইয়াছে। “ঘোল খাওয়ানো’ বলিয়া একটা কথা আমাদের শাস্ত্রে প্রচলিত আছে, তাহার অর্থ–মুচকি হাসিয়া অতি ঠাণ্ডা ভাবে একজনের পিত্ত টকাইয়া তুলা, ইহাতে ভোজন-কর্তার হাস্য ও পিত্ত একসঙ্গে উদ্দীপিত করে; ঝালের সে গুণটি নাই, অশ্রুর সহিত তাহার কারবার! অতিরিক্ত টক ভালো নহে। টক কেন, সকল দ্রব্যেই প্রায় অতিরিক্ত কিছুই ভালো নহে। যখন মিষ্ট খাইয়া খাইয়া রুচি খারাপ হইয়া গেছে তখন তিক্ত কাজে দেখে। সম্পাদকগণ ও গ্রন্থকারবর্গ আমাদের বাঙালি পাঠকদের মিষ্ট ছাড়া আর কিছু খাওয়াতে চান না। যাহা পাঠকদের মুখে রোচে, তাহাই তাঁহার সংগ্রহ করিয়া দেন, স্বাস্থ্যজনক হউক আর না হউক। তাঁহারা ক্রমাগত পাঠকদের শুনাইতে থাকেন– “আমাদের দেশের যাহা-কিছু তাহাই ভালো, বিদেশ হইতে যাহা আনীত হয় তাহাই মন্দ। যাহা চলিয়া আসিতেছে তাহা হইতে ভালো আর কিছু নাই, নূতন আসিতেছে, তাহা অপেক্ষা মন্দ আর কিছু হইতে পারে না’ এই-সকল কথা আমাদের পাঠকদের বড়োই মিষ্ট লাগে, এইজন্য দোকানেও প্রচুর পরিমাণে বিক্রয় হয়। আমার বোধ হয় এখন একটু একটু তিক্ত খাওয়াইবার সময় আসিয়াছে, নতুবা স্বাস্থ্যের বিষম ব্যাঘাত হইতেছে।

কথা প্রসঙ্গে তামাকের কথাটা ভুলিয়া গিয়াছিলাম। জঠর-তত্ত্বের যে পরিচ্ছেদে এই তামাকের কথা আছে, তাহার নাম ধূমায়ন। বুদ্ধির ভোজে নভেলকে তামাক বলে। বুদ্ধিজীবীগণ ইহাকে বুদ্ধিগত শরীরের পক্ষে অপরিহার্য আবশ্যক বলিয়া বিবেচনা করেন না। তাঁহাদের অনেকে ইহাকে মৌতাতের স্বরূপে দেখেন। বড়ো বড়ো আহারের পর এক ছিলিম তামাক বড়ো ভালো লাগে, পরিশ্রম করিয়া আসিয়া এক ছিলিম তামাক বিশেষ আবশ্যক। নিতান্ত একলা বসিয়া আছি, হাতে কিছু কাজ নাই। বসিয়া বসিয়া তামাক টানিতেছি। ইহার মাদকতা শক্তি কিয়ৎ পরিমাণে আছে। কিন্তু ইহার ফল উপরি-উল্লিখিত ভোজ্যসমূহের অপেক্ষা অনেকটা ক্ষণস্থায়ী ও লঘু, খানিকটা ধোঁয়া টানিলাম, উড়িয়া গেল, তামাক পুড়িয়া গেল, আগুন নিভিয়া গেল, লঘু ধোঁয়ার উপর চড়িয়া সময়টাকে আকাশের দিকে চলিয়া গেল। তামাকে আবার নানাবিধ শ্রেণী আছে। অনেক আষাঢ়ে আছে, যাহাকে গাঁজা বলা যায়। বঙ্কিমবাবু ডাবা হুঁকায় আমাদের যে তামাক খাওয়ান এমন তামাক সচরাচর খাওয়া যায় না। ইহার গুণ এই, ধোঁয়া অনেকটা জলের মধ্য দিয়া ঠাণ্ডা হইয়া আসে। বঙ্কিমবাবুর হুঁকার খোলে অনেকটা কবিতার জল থাকে। এক-এক জন লোক আছে, তাহারা হুঁকার জল ফিরায় না; দশ দিন দশ ছিলিম তামাক সাজিয়া দেয়, একই জল থাকে। এক-এক জন পাঠক আছে, তাহাদের চূরট না হইলে চলে না। তাহারা বর্ণনা চায় না, কবিত্বপূর্ণ ভাব চায় না, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভাবের লীলাখেলা দেখিতে চায় না; তাহারা মাথায়-আকাশ-ভাঙা, গা-শিওরনো, চমক-লাগা ঘটনার দশ-বারোটা গরম গরম টান টানিয়া একেবারে সমস্তটাই ছাই করিতে চায়। কোনো কোনো নবন্যাসবর্দার আমাদের গুড়গুড়িতে তামাক দেন। তাহার দশ হাত লম্বা, দশ পাক পেঁচানো নলের মধ্য দিয়া ধোঁয়া মুখের মধ্যে আসিতে অনেকটা দেরি করে। কিন্তু একবার আসিলেই অবিশ্রাম আসিতে থাকে। কোনো কোনো হুঁকায় আগুন (interest) নিভিয়া যায়। কোনো কোনো কলিকায় পাঠক যদি শ্রম স্বীকারপূর্বক প্রথম প্রথম খানিকটা ফুঁ দিয়া দিয়া আগুন জাগাইয়া রাখিতে পারেন, তবে শেষাশেষি অনেকটা ধোঁয়া পান।

মাসিক সংবাদপত্রের ভাণ্ডারে উপরি-উল্লিখিত ভোজের সমস্ত উপকরণগুলিই থাকা আবশ্যক। সকল প্রকার ভোক্তার খোরাক জোগানো দরকার। বিভিন্ন বিভিন্ন দোকনে ফুরন করা থাকে, কিন্তু তাহারা প্রতিবারে সময়মতো সরবরাহ করিতে পারে না, কাজে এক-একবার এক-এক শ্রেণীর পাঠক চটিয়া উঠেন। ভারতীয় নিমন্ত্রণ-সভায় সম্পাদক মহাশয়, স্বর-রহস্য, জ্যামিতি, ভৌতিক বিজ্ঞান, অধ্যাত্মবিদ্যা প্রভৃতি যে-সকল দাঁতভাঙা চর্ব্যের পরিবেশন আরম্ভ করিয়াছেন, তাহাতে উপস্থিত প্রস্তাব-লেখক বিশেষ ভীত ও ব্যাকুল হইয়া তাঁহার নিকট সবিনয় নিবেদন করিতেছে যে, যে-সকল গুরুপাক খাদ্যের মাসিক বরাদ্দ হইয়াছে, তাহাদিগকে আর-একটু লেহ্য আকারে পাতে দিলে মুখে তুলিতে ভরসা হয়, নচেৎ তাহাতে পাত পূরিবে বটে, কিন্তু পেট পূরিবে না।

ভারতী, শ্রাবণ, ১২৮৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *