চরৈবেতি
সন্ধে হয়ে এসেছে। নদীর ওপারে অনুচ্চ পাহাড়ের চুড়োয় তখনও সূর্যাস্তের শেষ আলোটা যাই যাই করেও রয়ে গেছে। অসংখ্য পাখির কলরবের মধ্য দিয়ে সারা আকাশ জুড়ে নিঃশব্দে নামছে রাত। একটু বাদেই পাখিদের ডাক আর শোনা যাবে না। তখন গভীর অন্ধকারের ভেতর কেবল শান্ত ছোট্ট নদীটার ছলছল শব্দ রাত্রির নৈঃশব্দ্যকে অনুরণিত করবে।
কর্নেল নিরঞ্জন ঘোষের বাংলোটা ঠিক নদীর ধারেই। তার বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে দময়ন্তী মুগ্ধ বিস্ময়ে প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপান্তর দেখছিল। আরও তিনজন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে ছিল। সমরেশ, কর্নেল ঘোষ আর তাঁর স্ত্রী রত্নাবলী। রত্নাবলী দময়ন্তীর ছেলেবেলার বন্ধু। ওরই আমন্ত্রণে এরা এসেছে এখানে।
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা। তোরা কী সুখেই যে আছিস, রত্না!’
রত্না মৃদু হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, সুন্দর জায়গা সন্দেহ নেই। তবে ওই সৌন্দর্যটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই এখানে। হঠাৎ একটা জুতোর কালি কিনতে হলেও ছুটতে হবে হায়দ্রাবাদ— ছ-ঘণ্টার ড্রাইভ। আর্মি আমাদের সবরকম কমফর্টই দেয় বটে, তবু শহরের জীবনটার জন্য মন কেমন করে।’
কর্নেল ঘোষ হেসে উঠলেন। বললেন, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস…’
রত্না কপট কোপে ধমকে উঠল। বলল, ‘চুপ করো। তোমার তো খালি কাজ আর কাজ। আমার সময় কী করে কাটে ভেবে দেখেছ কখনো? ক্লাবে সেই একই লোক, একই আলোচনা। সবসময় ভালো লাগে না। আর তার ওপর কী যে আজকাল হয়েছে ওর। ভালো করে কথাই বলে না।’
দময়ন্তী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’
‘কী জানি কী হয়েছে আজকাল। কেমন গোমড়া হয়ে গেছেন দেখ না। সবসময় অন্যমনস্ক, কী যেন চিন্তা করে।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে, নিরঞ্জনবাবু? মানে বলতে যদি কোনো বাধা না থাকে—’
নিরঞ্জন মাথা নেড়ে ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘আরে না, না। রত্নার যত সব পাগলামি।’
রত্না বলল, ‘না, পাগলামি নয়। তুমি দময়ন্তীকে বলো, প্লিজ। আমাকে বলবে না, আমি জানি। কিন্তু ওকে তো জানো, ওকে বলো তোমার কী হয়েছে।’
নিরঞ্জন কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রত্নার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি কি এইজন্যে তোমার বন্ধুকে এখানে ডেকে এনেছ নাকি? একথা জানলে তো…’
দময়ন্তী মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আমাকে আসতে দিতেন না, তাই না? কেন শুনি? রত্না আমার বন্ধু, তাকে তার কোনো বিপদ-আপদে আমি সাহায্য করতে পারি না? ও যদি আমায় ডেকে এনেই থাকে, তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?’
‘আহা, তা নয়। এটা তো আমার ব্যক্তিগত কোনো প্রবলেম হতে পারে। কোনো টপ সিক্রেট ব্যাপারও হতে পারে। জানই তো, আমরা এখানে যে কাজ করি, সেটা ভীষণ রকমের গোপন, কাকপক্ষীও টের পায় না।’
সমরেশ বলল, ‘চারদিকে সিকিউরিটির বহর দেখে তাতে সন্দেহ থাকে না বটে। সেরকম গোপন কোনো ব্যাপার হলে আপনি কিচ্ছু বলবেন না মশাই। কোত্থেকে কী হয়ে যাবে, শেষটায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনেই না দাঁড়াতে হয়।’
নিরঞ্জন হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আমাদের দেশে এমন ফায়ারিং স্কোয়াড এখনও নেই হে যে তোমাকে কায়দা করতে পারে।’
দময়ন্তী বলল, ‘তাহলে ওকেই বলুন।’
নিরঞ্জন এবার সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘রত্না, দেখো তোমার বন্ধুর কাণ্ড। রহস্যের গন্ধ পেয়ে ক্ষেপে উঠেছে একেবারে। এরপরে না কামড়ে দেয়!’
রত্না বলল, ‘দেবেই তো। দেওয়াই উচিত।’
নিরঞ্জন আবার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, বলব। কিন্তু সবটা বলব না। আর যেটুকু বলব সেটুকুও তোমরা তিনজনেই কখনো কারোর সঙ্গে আলোচনা করবে না, এ ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’
দময়ন্তী আর সমরেশ একসঙ্গে হাত তুলে বলল, ‘আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘দেখো দময়ন্তী, আমি যে তোমাকে কথাগুলো বলতে যাচ্ছি, সেকথাগুলো সত্যিই বাইরে ছড়ানো উচিত নয়। তবুও যে তোমাকে বলছি, তার দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ, আমি জানি, তুমি অনেকদিন অপরাধতত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছ, এ ব্যাপারে তোমার সুনাম আছে, কাজেই তোমাকে বিশ্বাস করা যায়। তোমার যদি পেট আলগা হত, তাহলে তুমি এতটা সুনাম করতে পারতে না।’
রত্না বলল, ‘কিন্তু সমরেশদা? ওর বেলা?’
নিরঞ্জন কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘ওকেও বিশ্বাস করা যায়, কারণ ও যদি বাইরে গিয়ে কোনো কথা বলেও, তাহলেও ওর কথায় কেউ গুরুত্ব দেবে না। পাত্তাই দেবে না!’
দময়ন্তী বলল, ‘ওর কথা থাক। এবার দ্বিতীয় কারণটা বলুন।’
‘হ্যাঁ, দ্বিতীয় কারণ হল, যাকে আমরা সন্দেহ করে রিপোর্ট তৈরি করেছি, আমার কিন্তু ধারণা সে নির্দোষ। কিন্তু এটা আর্মি, এখানে আমরা কোনোরকম ঝুঁকি নিতে পারি না। আমার ভাবতে খারাপ লাগছে যে হয়তো মিথ্যে ভিত্তিহীন সন্দেহের কোপে একটি নিরীহ লোকের রুজিরোজগারের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আপনি কি রিপোর্টটা সাবমিট করে দিয়েছেন?’
‘না, এখনও দিইনি। আর দু-একদিনের মধ্যেই দেব।’
‘ভালো। এবার বলুন, কী হয়েছে। মানে, যতটা বলা সম্ভব আর কি!’
‘তোমরা তো জানই, আমাদের এই জায়গাটা হচ্ছে একটা মিলিটারি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সংস্থা। এখানে কয়েকজন নামকরা বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার আর টেকনিশিয়ান, সেনাবাহিনীর পরিচালনাধীনে যুদ্ধসংক্রান্ত কোনো কোনো ব্যাপারে গবেষণা করে থাকেন। এসমস্ত গবেষণার ফল কখনো কখনো বাইরে প্রকাশ করা হয়, কখনো একেবারেই গোপন রাখা হয়। এখন ব্যাপার হয়েছে কী, সম্প্রতি আমাদের এই সংস্থার অত্যন্ত গোপন কোনো কোনো কাগজপত্র দেশের বাইরে চালান হয়ে গেছে। কে এই কীর্তি করছেন এবং কীভাবে করছেন সেটা আমরা অনেক চেষ্টা করেও নিশ্চিতভাবে ধরতে পারিনি। কাজেই শেষ পর্যন্ত আমাদের জনৈক সহকর্মী, যার ওপরে আমাদের সকলেরই অল্প-বিস্তর সন্দেহ হয়েছে, তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রেকমেন্ডেশন দিয়ে রিপোর্ট দিতে যাচ্ছি ওপরমহলে। তবে, তাতে বিবেক বড়ো জ্বালাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, আপনি বললেন, ‘আমাদের সন্দেহ হয়েছে। আমাদের মানে কাদের?’
‘আমার আর আমার সহকর্মী মেজর ডি কে রাও-এর। গোপনীয় কাগজপত্র যে বাইরে পাচার হচ্ছে, সে-খবর আমরা দু-জন ছাড়া এখনও কেউ জানে না বলেই আমাদের ধারণা এবং ওপরমহল থেকে আমাদের ওপরেই আদেশ হয়েছে ইনভেস্টিগেট করে রিপোর্ট দেওয়ার।’
‘কীভাবে কাগজপত্র বাইরে যাচ্ছে? মানে, কী উপায়ে নয়, কী বেশে? হাতে লেখা চিরকুট, না সিগারেটের বাক্সের খোলের ভেতরে লেখা, না মাইক্রোফিলম, না এমনি ফিলম, না ডাকটিকিটের পেছনে লেখা?’
‘না, না, অত ছোটোখাটো ব্যাপার নয়। মস্ত বড়ো এ-জিরো সাইজের প্রিন্ট, যেটা চার ভাঁজ করলেও একটা প্রমাণ সাইজের ম্যাগাজিনের চেহারা নেয়, সেইরকম কাগজ বেরিয়ে যাচ্ছে। মোটা কাগজের ওপর প্রিন্ট, ওজনও কম নয়।’
‘পুরো প্রিন্ট বেরিয়ে যাচ্ছে? কেন? সমরেশ প্রশ্ন করল।’
‘অন্য কোনোভাবে বের করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই। মাইক্রো ফিলম বল, সাধারণ নেগেটিভ ফিলম বল বা অন্য যেকোনোরকম রিপ্রোডাকশনের জন্যে চাই ক্যামেরা এবং অন্যান্য সাজসরঞ্জাম। সেসমস্ত ব্যবস্থা এখানে করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই পুরো প্রিন্টই বের করে দেওয়া হচ্ছে। এখানকার অবস্থাটা আরও একটু বিশদভাবে বলি। তাহলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে।
‘এই যে নদীর ধারে দুটো বাংলো দেখছ, এ দুটো হল আমার আর রাওয়ের। আমরা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোক বলে এই বাংলো দুটো পেয়েছি। যাঁরা গবেষক, তাঁরা কিন্তু থাকেন ওই পাঁচিল-ঘেরা জায়গাটার মধ্যে। ওখানে ষোলোটা কোয়ার্টার আছে। আর, আছে ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। একজন আছেন ডিরেক্টর পদে আর তাঁর অধীনে পনেরোজন গবেষক কাজ করেন। ওই এনক্লোজারের ভেতর ঢোকা বা বেরোনো কিন্তু বড়ো সহজ নয়। সিকিউরিটির প্রচণ্ড কড়াকড়ি। এমনকী আমাদের ঢোকা বা বেরোনোও তল্লাশির হাত থেকে রেহাই পায় না।’
‘সমরেশ প্রশ্ন করল, যারা ল্যাবরেটরিতে বা ওয়ার্কশপে সাধারণ কাজ করে, তারা কোথায় থাকে?’
‘তারা থাকে ওই এনক্লোজারের ওপাশে কোয়ার্টার্সে। এখন, এই সমস্ত জায়গাটাই আবার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। কাজেই, ভেতরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের এখান থেকে ঢুকতে বা বেরোতে দু-বার সিকিউরিটির মুখোমুখি হতে হয়। এ অবস্থায় কারোর পক্ষেই ক্যামেরা বা গুপ্তচরবৃত্তির অন্যান্য কোনো সরঞ্জাম ভেতরে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন, যদিও অসম্ভব নয়।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আমরা যখন এলুম, তখন তো কোনো তল্লাশি তেমন হল না?’
নিরঞ্জন হাসলেন। বললেন, ‘সে আমি সঙ্গে ছিলুম বলে হয়তো। তবে যখন বেরোবে, তখন কিন্তু হবে। বেশ ভালোভাবেই হবে। এমনকি আমি সঙ্গে থাকলেও।
‘সে যাই হোক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, ড্রইংগুলো যাচ্ছে কেন, এবং কীভাবে। কেন যাচ্ছে বোঝা কঠিন নয়। গুপ্তচরবৃত্তি চিরকালই ছিল, এখনও আছে। আর ক্যামেরা বা সেরকম কোনো সরঞ্জাম ভেতরে ঢোকানো যাচ্ছে না বলে আস্ত প্রিন্টগুলোই বেরিয়ে যাচ্ছে।
‘কিন্তু কীভাবে যাচ্ছে? ওখান থেকে বাইরে বেরোনোর রাস্তা দুটো— স্থলপথ আর আকাশপথ। স্থলপথে যে অত বড়ো প্রিন্টগুলো বেরোবে, সেটা অসম্ভব বলে মনে হয়। আর আকাশপথে যেতে হলে সাহায্য নিতে হয় কোনো পাখির। কিন্তু কোন পাখি? পায়রা হতে পারে না। একটা এ-জিরো প্রিন্ট ভাঁজ করে গোল করে পাকালে আকারে আর ওজনে একটা প্রমাণ সাইজের পায়রাকে ছাড়িয়ে যাবে। তাহলে কি ঈগল পাখি? আসবে কোত্থেকে?’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘প্রিন্টটা তো ছিঁড়ে ছিঁড়েও পাঠানো যেতে পারে? পরে সবকটা টুকরো জোড়া দিলেই হল।’
‘হ্যাঁ, সে-সম্ভাবনার কথা প্রথমেই মনে আসে বটে। কিন্তু ঘটনাটা তা ঘটছে না। আমাদের কাছে যে খবর এসেছে তাতে জানা গেছে যে আস্ত প্রিন্টই বেরিয়ে যাচ্ছে। আর এ জিনিস ছিঁড়ে ছিঁড়ে পাঠানোর রিস্ক বোধ হয় যিনি পাঠাচ্ছেন তিনি নিতে চান না।’
‘ওখান থেকে নদীটা কত দূরে?’
‘অনেক দূরে। ওই ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি এনক্লোজারটা ঘিরে আছে একটা দশ ফুট উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপর কাঁটাতারের বেড়া আর প্রতি পঞ্চাশ ফুটে একটা করে ওয়াচ-টাওয়ার। ওই টাওয়ারগুলোর মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা। পাঁচিলের দু-ধারে সারারাত আলো জ্বলে। পাঁচিলের পর প্রায় সত্তর ফুট চওড়া খালি জায়গা। তারপর নদী। ওই খালি জায়গাটাতেও সারারাত আলো দেওয়া থাকে। এতসব পেরিয়ে নদীতে কিছু ছুড়ে ফেলা অসম্ভব।’
‘কিন্তু ধরুন, নদীর ধারে বেড়াতে বেড়াতেও তো সবার অলক্ষ্যে কেউ কিছু ছুড়ে দিতে পারে। অনেকেই তো সকালে ওদিকে বেড়ান দেখি।’
‘তা বেড়ান। কিন্তু তাদের সকলকেই তল্লাশি পেরিয়ে আসতে হয়। তা ছাড়া যে পোশাকে তাঁরা বেড়ান— হাফপ্যান্ট আর স্পোর্টস গেঞ্জি— তাতে কিছু লুকিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন, তাই না?’
‘আচ্ছা, ভেতরে তো ওয়ার্কশপ আছে, ‘জিজ্ঞেস করল সমরেশ, আর সেখানে যখন কাজ হয় তখন নিশ্চয়ই আপনার সিকিউরিটি স্টাফ ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না? বেশ, তাহলে আমি তো ওখানে কাজ করতে করতে ছোটো ছোটো টুকরোয় একটা খেলনা গ্লাইডার বানাতে পারি। টুকরোগুলো লুকিয়ে বাড়ি নিয়ে এসে অ্যাসেম্বল করে তার ভেতরে কাগজটা পুরে রাত্রিবেলা আকাশে উড়িয়ে দিতে পারি। একটা ছোটোখাটো মডেল গ্লাইডার একটা প্রিন্ট নিয়ে অনায়াসে উড়ে নদী পার হয়ে ওই জঙ্গলের ভেতর গিয়ে পড়তে পারে। আপনারা যখন আলো জ্বেলে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন, তখন আলোর ওপর দিয়ে আমার গ্লাইডার বেরিয়ে যাচ্ছে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এরকম তো হতে পারে?’
নিরঞ্জন মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, হতে যে পারে না তা নয়। তবে, এই আইডিয়াটা আমার মাথাতেই আসেনি। তার কারণও আছে। আমাদের ওয়ার্কশপে প্রত্যেকের একটা জব-কার্ড থাকে আর সেই কার্ডের বাইরে কেউ কোনো কাজ করলেই তাকে জবাবদিহি করতে হয়। তবে, তুমি বলতে পার, সুপারভাইজার বা সিনিয়র স্টাফের তো আর জব-কার্ড থাকে না, তারা তো যখন যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন। তা পারেন, কিন্তু তাঁদের ওপরেও নজর রাখা হয়। সিকিউরিটি ঘাড়ের ওপর থাকে না ঠিকই, কিন্তু ওয়ার্কারদের ভেতরে স্পাই আছে। কাউকে কোনো অদ্ভুত কাজ করতে দেখলেই তারা আমাদের খবর দেয়। এমনকি, কেউ তাঁর রান্নাঘরের ছুরি শান দেওয়ালেও আমরা খবর পাই।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, ভেতরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের প্রত্যেকের পক্ষেই কি এই ড্রইংগুলো পাওয়া এবং পাচার করা সম্ভব?’
‘না। এটা সম্ভব পাঁচজনের। প্রথম, ডিরেক্টর ডক্টর অমর প্রভাকর যোশী; দ্বিতীয়, চীফ ইঞ্জিনীয়ার ডক্টর সুধীর তরফদার; তৃতীয়, চীফ ডিজাইন ইঞ্জিনীয়ার কৃষ্ণ আইয়ার; চতুর্থ, ড্রইং অফিস রেকর্ড কিপার দর্শন দাস এবং রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর ডক্টর গেব্রিয়েল ডিসুজা। দর্শন দাস ছাড়া বাকি চারজনই বাড়িতে ড্রইং নিয়ে যেতে পারেন, নিয়ে যানও, রাত্রে পড়াশুনো করবার জন্য। দর্শন দাস সব ড্রইংয়ের জিম্মাদার, একাই একটা ঘরে বসে ড্রইংয়ের হিসেবপত্র রাখে, কাজেই তার পক্ষে জামার তলায় লুকিয়ে ড্রইং বাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এঁরা ছাড়া আর কারোর পক্ষেই হিসেব বা রেকর্ড না রেখে ড্রইং পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই, পাচার করার প্রশ্নই ওঠে না।
এঁদের মধ্যে কাকে আপনি সন্দেহ করছেন?’
‘চীফ ইঞ্জিনীয়ার সুধীর তরফদারকে।’
.
‘কেন?’
‘অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, ভদ্রলোক বেশ অসামাজিক। অকারণেই রূঢ় হন। এতদিন আমরা ভাবতুম সেটা অহংকার— কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, রূঢ়তাটা লোকজনকে কাছে ঘেঁষতে না দেওয়ার একটা অস্ত্রও তো হতে পারে। যে গুপ্তচরবৃত্তি করে, সে তো সবসময়েই সকলকে এড়িয়ে চলতে চায়, তাই না?
‘দ্বিতীয়ত, ডক্টর তরফদার মাঝে মাঝেই ছুটি নেন। নিয়ে হায়দ্রাবাদে একটা ছোটো হোটেলে গিয়ে ওঠেন। সেখানে, একটি মেয়ে তাঁর কাছে আসে। মুসলমান মেয়ে, বোরখা পরা, কিন্তু অভিজাত ঘরের বলেই মনে হয়। মেয়েটিকে আমরা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু পারিনি। হায়দ্রাবাদে গলির মধ্যে একটি বোরখা পরা মেয়েকে অনুসরণ করা বোধ হয় ভগবানেরও অসাধ্য। তবে, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এটাও ভয়ানক সন্দেহজনক ব্যাপার।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘হোটেলের ঘরে চ্যালেঞ্জ করেননি ওঁদের?’
‘না। এখনও করিনি। নিঃসন্দেহ না হয়ে চ্যালেঞ্জ করলে ইনভেস্টিগেশনটা ভেস্তে যেতে পারে। তরফদারকে ধরতেও পারব না, অথচ অন্যপক্ষ সাবধান হয়ে যাবে। তবে করব। রিপোর্টটা পাঠিয়ে দিই আগে, তারপর চ্যালেঞ্জ করব।’
‘আর কোনো কারণ?’
‘হ্যাঁ, এই ডক্টর তরফদারের আর একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে। উনি মাঝে মাঝেই ওয়ার্কারদের কাছ থেকে টাকা ধার করেন, আবার দু-একদিনের মধ্যেই তা শোধ দিয়ে দেন। এটা যে কেন করেন, তার কারণটা আমরা এখনও বের করতে পারিনি। জিজ্ঞেসও করা যায় না। ভদ্রতায় বাধে আর জিজ্ঞেস করলেও রূঢ় উত্তর পাব জানি।’
‘ভদ্রলোক বিবাহিত?’
‘ছিলেন। বছর দশেক হল স্ত্রী মারা গেছেন।’
‘ছেলেপুলে আছে?’
‘আছে। একটি মেয়ে। সে বিলেতে কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করে।’
‘তার কাছ থেকে চিঠিপত্র আসে না?’
‘আসে। খুব ভালো করে পরীক্ষা করেই সেসব চিঠি তরফদারকে দেওয়া হয়। কোনো গোলমাল পাওয়া যায়নি।’
‘বয়েস কত ভদ্রলোকের?’
‘ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ হবে। তবে দেখলে অনেক কম বয়েস বলে মনে হয়।’
‘বাকি চারজন সম্পর্কে বলুন। যা মনে আসে।’
‘প্রথম, ডক্টর যোশী। বয়েস ছাপ্পান্ন-সাতান্ন। শান্ত, ধীর প্রকৃতির লোক, কিন্তু মাঝে মাঝে রেগে যান। তখন আবার ওঁকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। ইনিও বিপত্নীক। ছেলেমেয়েরা সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। কোনোরকম নেশা ওঁর নেই, একমাত্র বইপড়া ছাড়া। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ওঁর নিজের হাতে তৈরি বলতে পার, আর এটিকে চালানও একজন অটোক্র্যাটের মতো। শ্রমিকরা ওঁকে অসম্ভব ভালোবাসে, অফিসাররা দু-চক্ষে দেখতে পারেন না। অফিসাররা ওঁকে আড়ালে ডিরেক্টরের বদলে ডিক্টেটর যোশীসাহেব বলে থাকেন।
‘দ্বিতীয় কৃষ্ণ আইয়ার। খুব হাসিখুশি ফুর্তিবাজ লোক। বহু বছর বিলেতে আমেরিকায় কাটিয়েছেন, কিন্তু তাতে ওঁর চরিত্র পাল্টায়নি। একজন খাঁটি ভারতীয়। দক্ষিণ ভারতীয় তো বটেই, কিন্তু তাই বলে সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি নেই। খুব ভালো বীণা বাজান, তবে কেবল কর্ণাটকী রাগ নয়, হিন্দুস্থানী রাগেও ওঁর সমান দক্ষতা। বয়েস পঁয়তাল্লিশ। খুব সম্ভব অবিবাহিত, যদিও শুনেছি, অল্প বয়েসে বিদেশে নাকি একজন বিদেশিনীকে বিয়ে করেছিলেন, তবে সে-বিয়ে টেকেনি। ওঁকে জিজ্ঞেস করলে হাসেন, বলেন প্রথম যৌবনে নাকি এক বাঙালি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। তা, অন্য তরফ থেকে কোনো সাড়া না আসায় এতই মুষড়ে পড়েছিলেন যে আর বিয়ে করে উঠতে পারেননি। এটা সত্যি কথাও হতে পারে, ঠাট্টাও হতে পারে।
‘তৃতীয় দর্শন দাস। এলাহাবাদের বাঙালি। পরিষ্কার হিন্দি বলেন, যদিও বাংলাটা বলেন থেমে থেমে। বয়েস পঞ্চাশ। আইয়ারের আন্ডারে কাজ করেন। খুব নির্বিরোধী লোক, কারোর সাতে-পাঁচে থাকেন না। কথা কম বলেন, কাজকর্মেও ভালো।’
দময়ন্তী বাধা দিল। বলল, ‘কিছু প্রিন্ট যে ওঁর রেকর্ড থেকে খোয়া গেছে, তা উনি জানেন?’
‘হয়তো জানেন, তবে জানলেও রিপোর্ট করেননি। না জানতেও পারেন। অনেক প্রিন্টই তো থাকে ওঁর জিম্মায়। একটা প্রিন্ট সরিয়ে তার জায়গায় আর একটা রেখে দিলে ধরা কঠিন। কে আর সবকটা প্রিন্ট খুলে খুলে দেখে, বলো?’
‘বিবাহিত?’
‘হ্যাঁ। স্ত্রীর নামটি খুব ফ্যাশনেবল— সাহানা। কিন্তু মানুষটি নিতান্ত সাদামাটা, ভালো লোক। যেমন স্বামী, তেমনি স্ত্রী। ওঁদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে কলকাতায় চাকরি করে, মাঝে মাঝে আসে। মেয়েও বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে বিদেশে থাকে।’
‘এঁদের চিঠিপত্র আসে?’
‘আসে। কোনো গোলমাল নেই বলেই মনে হয়।’
‘এরপর?’
‘এরপর ডক্টর গেব্রিয়েল ডিসুজা। ইনি একটি চিজ। যেমন পণ্ডিত, তেমনি চ্যা*ংড়া। অফিসে এক মূর্তি, বাইরে আর এক। এঁর বাবা কেরালার লোক, মা আমেরিকান। জন্ম লন্ডনে, লেখাপড়া প্যারিসে, অধ্যাপনা ম্যানিলায়। শেষপর্যন্ত এখানে। একজন সত্যিকারের আন্তর্জাতিক লোক। কাউকে পাত্তা দেন না, ডক্টর যোশীকে পর্যন্ত না। অফিসের বাইরে সর্বক্ষণ হইচই করে সময় কাটান। তবে, কাজে নাকি অসাধারণ। এঁর স্ত্রী সারদা মারাঠী। তবে ইনিও আন্তর্জাতিক মহিলা। এঁদের দু-জনেরই বয়েস পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হবে, যদিও চলাফেরা হাবভাব দেখলে পঁয়ত্রিশের বেশি মনে হয় না। এঁদের একটি ছেলে— ইম্যানুয়েল ওরফে জো। দশ বছর বয়েস, মহা বিচ্ছু।’ বলে নিরঞ্জন চুপ করলেন।
দময়ন্তী কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। এবার বলুন, এঁদের হাবভাব চালচলন, অভ্যেস, বাতিক ইত্যাদির মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেন? ডক্টর তরফদার সম্পর্কে অবশ্য কিছু বলেছেন। এ ছাড়াও যদি কিছু মনে আসে, তাও বলুন।’
‘বেশ। যা মনে আসছে, তাই বলছি। প্রথমত, ডক্টর যোশী। আগেই বলেছি, ভদ্রলোক ভীষণ বদরাগী। কিন্তু সম্প্রতি দেখছি, ওঁর রাগ যেন অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। অথচ তার ঠিক কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কাজকর্ম সব তো ঠিকঠাকই চলছে। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন?
‘এরপর, কৃষ্ণ আইয়ার। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত বীণা বাজান। অনেক সময় রাতও কাবার হয়ে যায়। কিন্তু তখন সারা বাড়ির আলো নেভানো থাকে, এমনকি জানলা বন্ধ করে পর্দা পর্যন্ত টেনে দেওয়া থাকে। আইয়ার অবশ্য বলেন যে পাছে প্রতিবেশীরা বিরক্ত হন, তাই ইনি এরকম করে থাকেন। কিন্তু ওঁদের বাংলোগুলো এত দূরে দূরে যে খুব বেশি পাওয়ারের স্টিরিও সেট পুরো ভল্যুমে চালালে তবেই কারোর বিরক্তি হতে পারে। তা নয়তো নয়।
‘তৃতীয়, দর্শন দাস। ওঁর যেটা চোখে লাগে, সেটা ওঁর ভালোমানুষী। এত অস্বাভাবিক শান্ত লোক দেখা যায় না। ওঁর বাড়ি থেকে কোনো শব্দ আসে না, কেউ যে সেখানে থাকে তাই মনে হয় না। এমনকি ছেলে যখন আসে তখনও। কেমন যেন ভূতুড়ে বাড়িটা।
‘চতুর্থ, ডিসুজা,। এরকম একজন আন্তর্জাতিক লোক, প্রচণ্ড ফ্যাশনেবল, স্মার্ট, শিক্ষিত, তেমনি তাঁর স্ত্রী, অথচ সমস্ত পরিবারটা অসম্ভব নোংরা। জামাকাপড় অত্যন্ত আধুনিক, কিন্তু সাতজন্মে কাচা হয় না। দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া দুষ্কর। বাড়িও তেমনি। ভেতরে ঢুকলেই বাসি, পচা, খাবারের ভ্যাপসা গন্ধ, দেওয়ালে ঝুলকালি, টেবিল-চেয়ার ময়লা, মাছি ভনভন করছে। এমনকি বাগানটা পর্যন্ত জঙ্গল করে রেখেছেন। আমরা মালী দিয়ে থাকি, তা সত্ত্বেও কোনো ফুলগাছ না, তরিতরকারি না, কেবল গুচ্ছের কলাগাছ।’
‘কলাগাছ?’ দময়ন্তী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। ওঁরা নাকি ভীষণ কলা খেতে ভালোবাসেন। মিসেস ডিসুজা রত্নাকে বলেছেন, মাঝে মাঝেই নাকি ওঁর রান্না করতে ইচ্ছে করে না। তখন পুরো পরিবার স্রেফ কলা খেয়ে লাঞ্চ বা ডিনার সারেন।’
‘বলেন কি? মিস্টার ডিসুজা আপত্তি করেন না?’
‘করেন না বলেই মনে হয়। করলে অনেক আগেই লাঠালাঠি লেগে যেত।’
সমরেশ বলল, ‘বেশ বোহেমিয়ান ব্যাপার, তাই না?’
‘তা বলতে পারো। আর নববিবাহিত দম্পতি হলেও এতে আশ্চর্য হবার কিছু থাকত না। কিন্তু এরকম একটা পরিবারে এ ধরনের ছন্নছাড়া ভাব আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এটা আমার কাছে বেশ অস্বাভাবিক বলে মনে হয়।’
দময়ন্তী অনেকক্ষণ আকাশের বুকে আবছায়া পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। সমরেশ আর কর্নেল ঘোষ গোটা চারেক সিগারেট ধ্বংস করার পর, দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে বসল। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা নিরঞ্জনবাবু, আপনি যদি একজন গুপ্তচর হতেন, তাহলে কি ডক্টর তরফদার যা করছেন, তা করতে পারতেন?’
পাল্টা প্রশ্ন করলেন নিরঞ্জন, ‘কিরকম?’
‘ধরুন, ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি এনক্লোজারে থেকে এবং একথা ভালো করে জেনে যে আপনার গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে, আপনি ছুটি নিয়ে হায়দ্রাবাদে গিয়ে একটি বোরখা পরা মেয়ের সঙ্গে একটা হোটেলে দেখা করতে পারতেন? ব্যাপারটা অত্যন্ত নির্বোধের মতো কাজ হত না?
‘দ্বিতীয়ত, আপনি যদি গুপ্তচর হতেন, তাহলে আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন, যাতে অন্য লোকের দৃষ্টি আপনার প্রতি আকৃষ্ট না হয়। ঝগড়াঝাঁটি করে, অভদ্র বা রূঢ় ব্যবহার করে, নিজেকে আনপপুলার করে তুলতেন না। তাই না?’
নিরঞ্জন হাত নেড়ে বললেন, ‘ঠিক তাই। আর সেইজন্যেই তো ওঁকে ধরি ধরি করেও ধরছি না। রত্নার ধারণা, ভদ্রলোক একটি মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করতে চান। কোনো সামাজিক বা পারিবারিক বাধার জন্য তা করতে পারছেন না, অথচ মেয়েটিকে ছাড়তেও পারছেন না। সেইজন্যেই এত খিটখিটে হয়ে তাকেন আর হায়দ্রাবাদে যান অভিসারে। রত্নার এই ধারণাটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত বলেই আমার মনে হয়।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আচ্ছা, এই পাঁচজনকে আমরা একবার দেখতে পারি না?’
‘দেখতে পার, কিন্তু জেরা করতে পার না।’
‘ভেতরে যেতে পারি?’
‘না।’
দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘আচ্ছা, বুঝেছি। কিন্তু এঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে তো পরিচিত হতে পারি?’
‘তা পার। কিন্তু স্ত্রী তো মোটে দু-জন। সাহানা দাস আর সারদা ডিসুজা।’
‘ওতেই হবে। ওঁদের সঙ্গে একটু কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। রত্না তো ওদের একদিন নেমন্তন্নও করতে পারিস। কতদিন খাওয়াস না বল তো? আমরা এসেছি, দুটো ভালোমন্দ রেঁধেছিস, তখন প্রতিবেশীদেরও একটু বলতে হয় না?’
নিরঞ্জন সহাস্যে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। ব্যবস্থা হবে। তবে রাও-এর স্ত্রী রাধাকেও ডাকতে হবে। তা না হলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হবে না। আর ইয়ে হয়েছে, মানে, তোমাকে আমি অবশ্য এই নেমন্তন্নের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করব না কিন্তু ব্যাপারটা কি ঘটছে বুঝতে পারছ?’
দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘পুরোটা বুঝিনি। তবে ডকুমেন্ট বাইরে যাওয়া বোধ হয় আটকানো কঠিন হবে না। কিন্তু আপনি তো বিভীষণটিকেও পাকড়াও করতে চান, তাই না?’
নিরঞ্জন ভ্রূকুটি করে বললেন, ‘তার মানে, কীভাবে মাল পাচার হচ্ছে তুমি বুঝতে পেরেছ, অথচ নাটের গুরুটি কে তা বুঝতে পারনি। এই তো? কীভাবে পাচার হচ্ছে বলে তুমি মনে কর?’
দময়ন্তী বলল, ‘একদম স্থির নিশ্চিত না হয়ে আপনাকে কখনো বলতে পারি? আমার অনুমান যদি ভুল হয়? তখন তো আপনি খুব হাসবেন।’
নিরঞ্জন হাত নেড়ে বললেন, ‘না, না, হাসব না। তুমি বলো।’
সমরেশ বলল, ‘কোনো লাভ নেই, মশায়। সব রহস্যের কিনারা না হওয়া পর্যন্ত কিচ্ছু বলবে না।’
নিরঞ্জন সহাস্যে বললেন, ‘বল কী? না, না, তাহলে জিজ্ঞেস করব না।’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। আর একটা কথা মেনুটা আমি ঠিক করব। রত্না যদি রাঁধতে না পারে তো আমি রাঁধব।’
‘মেনুতেও রহস্য? বল কি? তা দেখো দময়ন্তী, এটা হল অন্ধপ্রদেশ। তার ওপর শহর থেকে দূরে। তুমি চাইলেই তো আর এখানে অক্টোপাসের শুঁড় বা উটের দুধ বা বাওবাব গাছের ছাল পাবে না!’
রত্না বলল, ‘কেন পাবে না? দরকার হলে যেখান থেকে হোক, তাই যোগাড় করে দেবে। দেশের জন্যে আর্মি, নেভি, এয়ার ফোর্স সারা দুনিয়া ঢুঁড়ে মালমশলা যোগাড় করে। পারবে না মানে?’
দময়ন্তী দু-হাত নেড়ে বলল, ‘দাঁড়া, উত্তেজিত হোসনে। আমার মেনু মোটেই রহস্যময় নয়, বেশ সিম্পলই হবে। হয়তো একটা জিনিসই পেতে অসুবিধে হবে, তা হল মাছ। বাংলার বাইরে বাঙালির ওটাই তো সবচেয়ে বড়ো কষ্ট।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘না, না, ওটার কোনো অভাব এখানে নেই। মাছ অর্ডার দিলেই পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে অর্ডার ছাড়াও, বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে যায়। এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা গ্রাম আছে। মানি বলে সেই গ্রামের একজন লোক মাছ ধরে এখানে বিক্রি করে।’
‘বেশ, তাহলে তো আর কোনো চিন্তাই নেই। ভালো কথা, মিসেস ডিসুজা মাছ খান তো? বা, বাঙালি রান্না খাবেন তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব খাবেন। মাঝে মাঝে তাঁর রান্না করতে ইচ্ছে না করতে পারে, কিন্তু শখের রান্না খেতে কোনোই আপত্তি নেই তাঁর। চিন্তা কোরো না— মহিলা সর্বভুক!’
‘আর একটা প্রশ্ন। মিস্টার আইয়ারের বাড়িতে টেপরেকর্ডার আছে?’
‘আছে।’
.
পরদিন সকালে দময়ন্তী, রত্না আর সমরেশ সকালের চা-পর্ব শেষ করবার আগেই কর্নেল ঘোষ তাঁর প্রাত্যহিক মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে এলেন। সঙ্গে ওয়াকিং স্টিক হাতে একজন অতিথি। ইনিও কর্নেলের মতোই হাফপ্যান্ট আর স্পোর্টস গেঞ্জি শোভিত। অত্যন্ত সুপুরুষ, কাঁচা-পাকা চুল। বয়েস পঁয়তাল্লিশের ওপারে নয়। এঁর চোখ দুটি দেখবার মতো— গভীর আর উদাস, অথচ মুখের হাসিটি অত্যন্ত অন্তরঙ্গ।
কর্নেল ঘোষ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি মিস্টার কৃষ্ণ আইয়ার, আমাদের চীফ ডিজাইন ইঞ্জিনীয়ার। এঁকে বলেছিলুম দময়ন্তীর বিষয়ে— ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর ওর অনুরাগের কথা আর কি। তা, উনি শুনে তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলেন। তাই ধরে নিয়ে এলুম।’
পরিচয় পর্ব শেষ হলে আইয়ার এক কাপ চা নিয়ে টেবিলে বসলেন। সমরেশকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারও নিশ্চয়ই সঙ্গীতে অনুরাগ আছে?’
শুনে সমরেশ বিষম-টিষম খেয়ে একাকার। কোনোরকমে সামলে নিয়ে যথাসাধ্য বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘না, মানে, গান-টান আমার একেবারেই আসে না, বুঝলেন। আসলে আমি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার, কাজকর্ম সেরে ওসবের চর্চা করার কোনো সময়ই পাই না।’
আইয়ার হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তবে তো আপনার কাজের খুবই চাপ, মনে হচ্ছে! আমিও তো ইঞ্জিনীয়ার— মেটালার্জিক্যাল। আমিও কিছু কাজ করে থাকি। কিন্তু তাই বলে জীবন থেকে সঙ্গীতকে বিদায় দিতে বাধ্য হইনি এখনও।’
রত্নাবলী বলল, ‘সমরেশদার জীবনে সঙ্গীত কোনোদিন ছিলই না তো, বিদায় দেবার প্রশ্নই ওঠে না। সমরেশদা গান আর খবরের তফাত বুঝতে পারে না। রেডিয়োতে খবর হচ্ছে— পাশের ঘর থেকে বলে, কী বাজে গাইছে লোকটা, বন্ধ করে দাও তো যন্ত্রটা।’
আইয়ার হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বলেন কী? বাঙালি হয়ে গানের কান নেই? এ যে অবিশ্বাস্য। আমার তো ধারণা ছিল, সঙ্গীতপ্রীতি বাঙালি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।’
রত্নাবলী সহাস্যে বলল, ‘সকলের নয়। তার বদলে বাঙালি জীবনের আর একটি অংশ সমরেশদাকে পুরোপুরি অধিকার করে রয়েছে।’
‘সেটা আবার কি?’
‘ফুটবল। এখানে এসে ইস্তক ক্যাঁওম্যাও করে যাচ্ছে, হায়দ্রাবাদের খবরের কাগজগুলো কলকাতা লিগের খবর কেন ছাপে না, সেইজন্য।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘সঙ্গীত যে বাঙালী জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ— এরকম ধারণা আপনার কী করে হল? আপনি বুঝি বাঙালীদের সঙ্গে মিশেছেন খুব?’
আইয়ার বললেন, ‘না, তা অবশ্য মিশিনি। তবে, যে ক-জনকে জানবার সুযোগ পেয়েছি, দেখেছি তাঁরা প্রত্যেকেই গানের খুব ভক্ত— তা সে ক্লাসিকাল গানই হোক বা টেগোর সঙই হোক।’
‘আপনি কলকাতায় গিয়েছেন কখনো?’
‘একবার গিয়েছিলুম একটা সেমিনারে। দু-দিন ছিলুম।’
‘কোন হোটেলে ছিলেন?’
‘হোটেলে নয়। আমি ছিলুম আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আমার বাবার মামাবাড়ি কলকাতায়। কী যেন জায়গাটার নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে— বালীগঞ্জ। অদ্ভুত নাম।’
‘আপনি কি সঙ্গীতচর্চা করেন?’ দময়ন্তী এমনভাবে প্রশ্নটা করল, যেন সে আইয়ার সম্পর্কে আগে কিছুই শোনেনি।
আইয়ার মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ। সামান্য। আমি বীণা আর বেহালা বাজাবার চেষ্টা করে থাকি।’
‘আর আপনার স্ত্রী?’
আইয়ার আবার জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আমার তো স্ত্রী নেই। আমি একা থাকি।’
‘একা থাকেন? খারাপ লাগে না?’
‘নাঃ। খারাপ লাগবে কেন? বেশ তো আছি। অফিস থেকে বাড়ি এসে নিশ্চিন্ত আরাম— কেউ বিরক্ত করবার নেই, ঘ্যানঘ্যান করবার নেই। আমি পুজো সেরে, বীণা নিয়ে বসি। আপনমনে যতক্ষণ খুশি বাজাই।’ বলে হাসতে লাগলেন।
‘আর আপনার রান্নাবান্না? সেসব করবার লোক আছে বুঝি?’
‘নাঃ। রান্নাও নিজেই করি। যখন খুশি, যা খুশি। আর হ্যাঁ, রান্নার কথায় মনে পড়ল। আমি কিন্তু বাঙালি রান্না খুব পছন্দ করি।’
‘বলেন কি? বাঙালি রান্নার সঙ্গে আপনার পরিচয় হল কি করে?’
ভদ্রলোক একটা অত্যন্ত রহস্যময় হাসি হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘আজ নয়, অন্য কোনোদিন বলব। আর তা শুনেই-বা কী হবে? ভয়ানক ট্র্যাজিক গল্প। শুনে চোখের জল রাখতে পারবেন না।’
দময়ন্তী অত্যন্ত করুণ মুখ করে বলল, ‘আপনি কিন্তু আমার কৌতূহল খুব অন্যায়ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছেন।’
আইয়ার আবার হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘ভালোই তো, ভালোই তো। কৌতূহল থাকলে ভবিষ্যতে আবার দেখা হবার সম্ভাবনাটা প্রবলতর থাকে। তাই না? যা হোক, আমি কিন্তু এসেছিলুম একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবার জন্য। কবে, কখন আমরা আপনার গান শুনতে পারি?’
এবার দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘কর্নেল সাহেব আপনাকে আমার সঙ্গীতপ্রীতির কথা বলেছেন, কিন্তু পারদর্শিতার কথা নিশ্চয়ই বলেননি। বলতে পারেনও না। কারণ আমি গান ভালোবাসি, কিন্তু কখনো গাইবার চেষ্টাও করিনি।’
সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, ওই একজায়গায় আমাদের খুব মিল। ভগবান আমাদের গলায় এতটুকু সুরও দেননি। তাতে অবিশ্যি অসুবিধে কিছু নেই। দু-জনেই মনে মনে ভাবি, বাব্বা, খুব বেঁচে গেছি।’
.
দুপুর বেলা লাঞ্চ সেরে নিরঞ্জন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে জিপে উঠতে যাচ্ছেন, একটা অ্যাম্বাসাডার এসে পাশে দাঁড়াল। দুটো গাড়ির চালকরাই নেমে এলেন। বারান্দা থেকে দময়ন্তী, রত্না আর সমরেশ পরিষ্কার দু-জনের কথাবার্তা শুতে পেল
নিরঞ্জন গলাটা একটু তুলেই বললেন, ‘আরে, এই যে তরফদার সাহেব, কোথায় চললেন? হায়দ্রাবাদে নাকি? আবার ছুটি নিয়েছেন? পারেনও মশাই।’
রত্না ফিসফিস করে বলল, ‘অকারণে তরফদারকে খোঁচাচ্ছে! এক্ষুনি খেপে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দেবে।’
তরফদার কিন্তু চেঁচামেচি করলেন না। দময়ন্তী গলা বাড়িয়ে চট করে ভদ্রলোককে দেখে নিল। সত্যিই ভদ্রলোককে দেখলে ছেচল্লিশ বা সাতচল্লিশ বছর বয়েস বলে মনে হয় না। দীর্ঘাকৃতি শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই, হাত-কাটা সাদা শার্ট আর জিনস-এর ভেতর দিয়ে স্বাস্থ্য যেন উপচে পড়ছে। মুখ যে খুব সুদর্শন তা নয়, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে রাগেডলি হ্যান্ডসাম। চুল পাকেনি একটাও, তবে কপাল বেশ চওড়া হয়ে গেছে।
তরফদার যেন একটু অন্যমনস্কভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁ মশাই, জাহানারা আলমের আপনি কখনো নাম শুনেছেন? তাঁর সম্পর্কে কিছু জানেন?’
নিরঞ্জন একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কি ব্যাপার বলুন দিকি? তেড়েফুঁড়ে অফিসে যাচ্ছি, আর আপনি রাস্তায় ধরে মহিলাদের খোঁজখবর জানতে চাইছেন? আমি মশাই সংসারী লোক, বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘর করি, মহিলাদের খোঁজখবর রাখার সাহস আমার আছে?’
তরফদারের গলাটা গম্ভীর হল। বললেন, ‘ইয়ার্কি রাখুন। জানেন যদি তো বলুন।’
নিরঞ্জন হাত নেড়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ভদ্রমহিলা তো মনে হচ্ছে মুসলমান! হায়দ্রাবাদীদের ধরে জিজ্ঞেস করলেই তো জানতে পারতেন?’
তরফদারের গলা এবার ক্রুদ্ধ হল। বললেন, ‘দুর, দুর! যত সব অশিক্ষিত ইডিয়েট। আপনি শিক্ষিত লোক বলেই প্রশ্নটা করেছিলুম। জানেন না যখন, তখন আর কী করা যাবে। চলি।’
নিরঞ্জন সহাস্যে বললেন, ‘দাঁড়ান মশাই, দাঁড়ান। এত অল্পেই চটে যান কেন বলুন তো? জাহানারা আলমের নাম শুনিনি— তা কখনো হয়? ওঁর নাম শোনেননি কে? ”ডেকান ট্রিবিউন” কাগজটা তো প্র্যাকটিক্যালি চলে ওঁর লেখার জন্য। প্রচণ্ড জ্ঞানীগুণী মহিলা বলে শুনেছি। যেমন আগুনের মতো লেখা, তেমনি দুর্দান্ত গান। আর শুনেছি, তেমনি দারুণ ছবি আঁকেন। তবে, ওঁর শত্রু অনেক, অনেককে চটিয়েছেন— বিশেষত যেসব ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক মনে করতেন যে তাঁরা যা খুশি অন্যায় করে পার পেয়ে যেতে পারেন, তাঁরা তো ভদ্রমহিলাকে দু-চক্ষে দেখতে পারেন না।’
তরফদারের গলা আবার নরম হয়ে এল। বললেন, ‘হ্যাঁ, ওঁর অনেক শত্রু। আচ্ছা, ইন্ডিয়ান আর্মি কি ওঁকে প্রোটেকশন দিতে পারে?’
নিরঞ্জন ভয়ানক আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বললেন, ‘ইন্ডিয়ান আর্মি? আপনি কি পাগল হয়েছেন? আর শুনেছি, ভদ্রমহিলার বয়েস এখন তিরিশের সামান্য ওপরেই হবে। ওঁর তো নিজেরই সাবধান হওয়ার বয়েস হয়েছে। আপনি এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলুন তো?’
তরফদার আবার ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, ‘আমি ভদ্রমহিলাকে ভালো করে চিনি, তাই মাথা ঘামাচ্ছি।’
নিরঞ্জন যেন কথাটা কানে তুললেন না। চিন্তিতভাবে বললেন, ‘প্রোটেকশনের কথাটা বললেন কেন? কী হয়েছে? ওঁর যদি সত্যি কোনো ভয়ানক বিপদ এসে থাকে, হয়তো আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি। ইন্ডিয়ান আর্মির তরফ থেকে হয়তো নয়, মিস আলমের একজন গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে। তবে হ্যাঁ, ইন্টেলিজেন্সে আমার এক্সপেরিয়েন্সটা হয়তো কাজে দিতে পারে! কী হয়েছে বলুন তো?’
তরফদার পুনশ্চ নরম হলেন। বললেন, ‘দুটো লোক সর্বত্র, সর্বদা ওঁকে ফলো করবার চেষ্টা করছে। ক্ষতি এখনও করতে পারেনি, কিন্তু ওদের ডিটারমিনেশনটা নাকি ভীতিপ্রদ। জাহানারা অনেকবারই ভাড়াটে গুন্ডার মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু এরা সেই স্তরের লোক নয়! ভাবলেশহীন ঠান্ডা, যন্ত্রের মতো এরা পেছনে লেগে থাকে। জাহানারা ওদের ফাঁকি দিলেও তারা বিচলিত হয় না। আবার আসে।’
নিরঞ্জন ভয়ানক গভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কীরকম দেখতে লোক দুটো? খুনি খুনি চেহারা কি?’
‘খুনিদের চেহারার কোনো বৈশিষ্ট্য থাকে কি না আমার জানা নেই। তবে শুনেছি, এদের একজন রোগা, কালো, লম্বা, খোঁচা খোঁচা চুল, পাকানো গোঁফ আর অন্যজন মাঝারি হাইট, ফর্সা, ভালো স্বাস্থ্য, গলায় চেনে ঝোলানো ক্রস, মাথাজোড়া টাক।’
‘বাব্বাঃ, মিস আলমের তো অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি। ওই দুই হারামজাদা বোধ হয় মিস আলমের এর অর্ধেকের অর্ধেকও দেখতে পায়নি। নাঃ, সত্যি, মহিলার অবিশ্বাস্য প্রতিভা। ওঁকে প্রোটেকশন দেবার কোনো দরকার হবে বলে মনে হয় না। তা, আপনি পুলিশে খবর দিয়েছিলেন?’
‘না। আপনি দয়া করে আমাকে পুলিশের কথা বলবেন না।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, বলব না। তাহলে এক কাজ করা যাক। আপনি আমাকে একবার হায়দ্রাবাদে নিয়ে চলুন। মিস আলমের সঙ্গেও পরিচিত হওয়া যাবে, আর ওই দুই মর্কটকে জুতো-পেটা করে আসা যায় কি না, তাও দেখা যাবে।’
তরফদার এবার খুশি হলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই ভালো। আমি আজই গিয়ে কথাবার্তা বলে আসছি।’
দুটো গাড়ি চলে যেতেই দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘ওই দুই মর্কটকে চিনিস নাকি, রত্না?’
রত্না বিমর্ষ মুখে বলল, ‘চিনি না আবার! একটা তো দামোদর প্রসাদ আর অন্যটা নিশ্চয়ই অ্যান্টনি! দুটোর কপালেই গভীর দুঃখ আছে।’
‘আর জাহানারা?’
‘না, ওঁকে চিনি না। তবে, নাম শুনেছি। আর শুনেছি, ওঁর বাবা ডক্টর সামসুজ্জামান আলম নাকি আদতে বাঙালি— হুগলি জেলার লোক, তবে বোধ হয় দু-পুরুষ হায়দ্রাবাদে আছেন। হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক, আর মেয়েরই মতো ঠোঁটকাটা। কাউকে পাত্তা দেন না। সবাই ওঁকে যমের মতো ভয় পায়, আর তেমনি শ্রদ্ধাও করে।’
রত্না চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কিন্তু জাহানারা! ওই কাঠখোট্টা লোকটাকে বিয়ে করবে? এঁঃ, আর লোক খুঁজে পেল না! কিন্তু দেখ দময়ন্তী, আমার সন্দেহ একদম ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। গোড়াতেই ধরেছি যে এর মধ্যে একটা ভালোবাসা-টালোবাসার ব্যাপার আছে। কি, ঠিক ধরিনি?’
দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘এখনও ঠিক বলা যাচ্ছে না।’
রত্না আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘তার মানে? তরফদার সাহেবের প্রতি তোর এখনও সন্দেহ আছে?’
‘আছে বই কি। বরং আরও বেড়েছে! এই পুরো ব্যাপারটাই সাজানো হতে পারে। তরফদার তো নিরঞ্জনবাবুর কাছে বিয়ের ব্যাপারে সাহায্য চাননি, চেয়েছেন জাহানারাকে তাঁর অনুসরণকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। তরফদার স্পষ্টতঃই জানেন না যে অনুসরণকারীরা নিরঞ্জনবাবুরই লোক। তিনি কিন্তু পুলিশের কাছে যাননি। যেভাবে পুলিশের কথা না বলার জন্য তিনি বললেন, তাতে মনে হতে পারে যে ঘুসখোর পুলিশ ইনফ্লুয়েনশিয়াল শত্রুদের টাকা খেয়ে জাহানারাকে সাহায্য তো করবেই না, উলটে ক্ষতিই করবে। কিন্তু লক্ষ করেছিস নিশ্চয়ই যে অনুসরণকারী দু-জন সাধারণ ভাড়াটে গুন্ডা নয় বলেই তরফদারের ধারণা। তাহলে পুলিশের কাছে যেতে বাধা কোথায়?’
সমরেশ জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু জাহানারার পরিচয় আজকে হঠাৎ নিরঞ্জনবাবুর কাছে প্রকাশ করার কি কারণ থাকতে পারে?’
‘দেখ, আমাদের দেশে যখন খবর এসেছে যে এখান থেকে গোপনে ইনফরমেশন বিদেশে চলে যাচ্ছে, তখন যারা গুপ্তচরবৃত্তি চালাচ্ছে, তারাও নিশ্চয়ই জানতে পেরেছে যে তাদের খেলাটা ধরা পড়ার আর বেশি বাকি নেই। এখন, তরফদার যদি তাদের দলভুক্ত হন, তাহলে তাঁকে নিশ্চয়ই সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। তাহলে আজকের এই পরিচয় প্রকাশের কারণটি খুবই স্পষ্ট। প্রথমত, তিনি বাজিয়ে দেখে নিলেন যে নিরঞ্জনবাবুর জাহানারার ওপরে ধারণা বেশ ভালো। তখন তিনি এমন একটা ভাব করলেন যেন তাঁদের দু-জনের প্রেম এবং তিনি জাহানারার নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। ব্যস, তাহলে নিরঞ্জবাবুর তরফদারের ওপর থেকে সন্দেহটা চলে যাবার সম্ভাবনাটা প্রবল হয়, যেমন হয়েছে রত্নার।’
‘তার মানে, তুমি বলতে চাইছ, তরফদার আর জাহানারা দু-জনেই এর মধ্যে জড়িত?’
‘হতেও তো পারে।’
.
বিকেলের দিকে একটা জিপ এসে কর্নেল ঘোষের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। দময়ন্তী আর রত্না বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, দু-জনেই কৌতূহলী হয়ে উঠে দাঁড়াল। জিপ থেকে নামলেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক, একমাথা পাকা চুল, আর আশুতোষ মার্কা পাকা গোঁফ, সামান্য স্থূল বেঁটে শরীর, পরনে ঢলঢলে সাদা প্যান্ট আর ততোধিক ঢলঢলে ফুলহাতা শার্ট।
রত্না একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আরে, দাসবাবু যে। কী ব্যাপার?’
দাসবাবু মাটির থেকে চোখ না তুলে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমাকে কর্নেল ঘোষ পাঠিয়েছেন সমরেশবাবুকে ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য। ডক্টর যোশী ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চান।’
‘ডক্টর যোশী? সে কি? কেন?’
‘আজ্ঞে, সে তো আমাকে বললেন না। তবে আমার মনে হচ্ছে কি, কোন ইলেকট্রিক্যাল প্রবলেম আছে— তাই নিয়ে কথা বলতে চাইছেন।’
‘ও। আচ্ছা, আপনি এখানে এসে বসুন, আমি সমরেশদাকে ডেকে দিচ্ছি। উনি বোধ হয় ঘুমোচ্ছেন। তৈরি হতে সময় লাগবে কিছু। আপনি বরং ততক্ষণ একটু চা খান।’
‘অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে বারান্দায় উঠে এলেন দাস। বললেন, ‘না, না, চায়ের কোনো দরকার নেই। আমি বসছি, আপনি ওঁকে বলুন।’
‘কেন? চা খাবেন না কেন? রয়েছে তো। আপনি ততক্ষণ এঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চা খান। ইনি আমার বন্ধু, দময়ন্তী, সমরেশদার স্ত্রী।’
সসঙ্কোচে একটা নমস্কার করে দাস কোনরকমে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। দময়ন্তী ওঁর দিকে এক পেয়ালা চা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা মিস্টার দাস, আপনি বোধ হয় প্রবাসী বাঙালি, তাই না?’
ঘাড় কাত করে মি দাস বললেন, ‘হ্যাঁ। আমি এলাহাবাদের।’
‘এখানে অনেকদিন আছেন?’
‘না। বছর পাঁচেক। তার আগে ছিলুম ডিফেন্স প্রোডাকশনে।’
‘এই রিসার্চ অর্গানাইজেশনটা তৈরি হয়েছে কত বছর হল?’
‘ছ-বছর।’
‘তার মানে, আপনি প্রায় গোড়া থেকেই এখানে আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘এলাহাবাদে কি আপনাদের নিজেদের বাড়ি?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেখানে যান মাঝে মাঝে?’
‘হ্যাঁ।’
যতক্ষণ সমরেশ না বেরোল, ততক্ষণ এই হ্যাঁ-না-হ্যাঁ-না করেই আলাপচারী করে গেলেন দাস। চলে যাওয়ার পর রত্না জিজ্ঞেস করল, ‘কী মনে হল রে তোর?’
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘মনে হল যেন একটি দেওয়ালের সঙ্গে এতক্ষণ বাক্যালাপ করলুম।’
‘সন্দেহজনক?’
‘ঘোরতর!’
‘কেন?’
‘কেন কী? একটা লোকের এরকম নিরঙ্কুশ নিরেট হবার কোন প্রয়োজন হয় কি?’
‘এটাই হয়তো স্বভাব।’
‘হতে পারে! নাও হতে পারে। কোন গোপন অপরাধের বোঝা বইছেন— তাও তো হতে পারে।’
.
.
সন্ধেবেলা সমরেশ আর নিরঞ্জন একসঙ্গে ফিরলেন। এসেই নিরঞ্জন হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। বললেন, ‘দময়ন্তী, রত্না, সবাই এখানে এসো। অনেক কথা বলবার আছে। আমরা এই বারান্দায় বসেই চা খাব, আর যাবতীয় সংবাদ শোনাব।’
দময়ন্তী বলল, ‘বেশ, বেশ। সব সংবাদই বেশ পর্যায় পরম্পরা বলবেন কিন্তু। আদ্যোপান্ত হওয়া চাই।’
সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, তাই হবে। তোমরা শুধু মাঝে মাঝে ততঃকিম, ততঃকিম বলবে। আর চা আর পকোড়া সাপ্লাই দিয়ে যাবে।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘সমরেশ, তাহলে কোথা থেকে শুরু করি?’
সমরেশ বলল, ‘দর্শন দাস থেকেই শুরু করুন।’
‘হ্যাঁ, সেই ভালো। এলাহাবাদ থেকে আমাদের ইন্টেলিজেন্স খবর দিচ্ছে যে সাহানা দাস দর্শন দাসের বিবাহিতা স্ত্রী নন। সাহানা দাসের আসল নাম শেফালি ভট্টাচার্য। তিনি বিবাহিতা, তাঁর স্বামীর নাম প্রফুল্ল ভট্টাচার্য।’
দময়ন্তী আর রত্না একসঙ্গে আঁতকে উঠে বলল, ‘কী সর্বনাশ।’
‘হ্যাঁ, অনেকটা তাই বটে। সাহানার বাবা ছিলেন এলাহাবাদের নামকরা ডাক্তার। প্রফুল্ল সাহানাকে, থুড়ি, শেফালিকে গান শেখাতেন। তার থেকে প্রেম, তার থেকে বিয়ে। শেফালির তখন ষোলো বছর বয়েস। প্রফুল্ল ছিল একেবারে অপদার্থ, লেখাপড়া তো হয়নি, গানেও কিছু হল না। ইতিমধ্যে বাবুর আবার ধর্মে মতি হল। প্রায়ই তিনি সাধুদের আখড়ায় যান, সেখানে কারণটা আশটা চলে। তারপরে ভৈরবীচক্র। ইতিমধ্যে শেফালির বাবা ভগ্নহৃদয়ে মারা গেছেন। শেফালির দাদারা বা বোনেরা তাকে প্রায় ত্যাগই করেছে। তখন শেফালির অত্যন্ত দুর্দশা। সে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা।
‘দর্শন দাস তখন কুড়ি বছরের তাজা যুবক। তাঁর বুকে শেফালির দুঃখটা বড়োই বাজল। সে এগিয়ে এল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, যাতে মেয়েটির দুঃখ কিছুটা কমে। তার থেকে পুনশ্চ প্রেম, কিন্তু পুনশ্চ বিয়ে হতে পারল না। অতএব, চলো আমরা পালিয়ে যাই কোনো দূর দেশে, যেখানে শুধু তুমি আর আমি।
‘ভাগ্যিস ইতিমধ্যে দর্শন বি এ-টা পাশ করে ফেলেছিল, নাহলে যে কী হত বলা কঠিন। ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে সে একটা চাকরি জুটিয়ে নিল। নাহলে কপোত-কপোতী ‘শুধু তুমি আর আমি’র দেশ খুঁজতে খুঁজতেই ডানা ভেঙে আছড়ে পড়ত, তাতে সন্দেহ নেই।
‘এই চাকরি করতে করতেই নাইট স্কুলে পড়ে সে ড্রাফটসম্যানশিপ পরীক্ষা পাশ করে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং অফিসে ঢোকে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে এইখানে।
‘এসব কিন্তু বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে, প্রফুল্ল এখনও আছেন। এই ত্রিশ বছরেও কপোত-কপোতী কিন্তু তাঁর খপ্পর থেকে পালাতে পারেনি। যতদূর জানা গেছে, তাঁদের পালাবার এক বছরের মধ্যেই প্রফুল্ল তাদের খোঁজ পায় এবং সেই থেকে সে আজ পর্যন্ত ক্রমাগত দর্শন আর সাহানাকে ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছে। সাহানার প্রতি তার কিছুমাত্র মমতা নেই কিন্তু ডিভোর্সও সে দেবে না। সে পরমানন্দে ভৈরবীচক্র চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সাহানার ছেলেপুলে হয়েছে, তারা বড়ো হয়েছে, মানুষ হয়েছে, তাতে প্রফুল্লর লাভ হয়েছে আরও বেশি। সে বোধ হয় আরও বেশি করে দোহন করছে এই অসহায় দম্পতিকে।’
রত্না বলল, ‘মাগো, কী বিচ্ছিরি ব্যাপার! তাই দাসবাবুকে সবসময় অমন চোর চোর ভাবে ঘুরতে দেখি। কিন্তু যাই বল, দাসবাবুর কিন্তু কোনো দোষ দেখি না। সমাজ ওঁকে যে চোখেই দেখুক না কেন, আমি তো বলব, উনি ভালো কাজই করেছেন। কি বলিস, দময়ন্তী?’
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ, ওই ভালোমানুষ প্রৌঢ় ভদ্রলোকের ভেতর যে একটা ঋজু আর অনমনীয় পৌরুষ লুকিয়ে আছে, ভাবাই যায় না। সত্যি, কী ভয়ঙ্কর কাহিনি!’
নিরঞ্জন বললেন, ‘দর্শন দাসের ওপর তোমার শ্রদ্ধা খুব বেড়ে গেল মনে হচ্ছে?’
‘তা বাড়ল। তবে একটা কথা জানতে পারলে ভালো হত যে ব্ল্যাকমেল করে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য তাঁর কাছ থেকে কত টাকা আদায় করে?’
দময়ন্তীর প্রশ্নটা শুনে নিরঞ্জন অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তোমার সন্দেহ, দর্শনের অনেক টাকার দরকার, তাই না?’
দময়ন্তী প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। বলল, ‘হয়তো। এবার বলুন, আর কি খবর দেবার আছে।’
নিরঞ্জন সমরেশের দিকে চেয়ে বলল, ‘এ মহিলার সঙ্গে ঘর কর কি করে? পেটের থেকে কোনো কথা বের করা যায় না! যাক গে, সে তোমার ব্যাপার তুমি বুঝবে। এখন শোনো, দ্বিতীয় খবর। ডক্টর যোশীর ছোটোমেয়ে লাজবন্তী একজন আমেরিকান সাহেবকে বিয়ে করেছে আমেরিকায়। সে আজ প্রায় বছর দেড়েক হতে চলল। সম্প্রতি জানা গেছে যে সেই সাহেবের সঙ্গে সিআইএ-র একটা যোগাযোগ আছে। এবং এই যোগাযোগটা নেহাত ক্ষীণ নয়।’
‘ডক্টর যোশী জানেন সেকথা?’
‘জানেন। আজ সকালে একটা ইলেকট্রিক্যাল প্রবলেম নিয়ে মেনটেনান্স স্টাফের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন আর মাথা ঘুরে পড়ে যান। দুপুরের দিকে সুস্থ হয়ে আবার অফিসে এলে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি যখন ওঁকে বললাম, কেন আপনি এত উত্তেজিত হন? আপনি কি বোঝেন না যে এতে আপনার কতদূর ক্ষতি হচ্ছে? উনি তখন বললেন, উত্তেজিত হব না কেন? জান তুমি যে আমার ছোটোজামাই কার্ল একজন সিআইএ এজেন্ট? আমি সম্প্রতি দিল্লীতে গিয়ে জানতে পেরেছি। আর, তারপর থেকে আমার মাথায় যেন রক্ত উঠে আছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি, কিন্তু সবসময় পারি না।’
‘সমরেশকে ডাকলেন কেন?’
‘ওইজন্যেই। আমি ওঁকে বলেছিলুম যে তাঁর যখন মনে হচ্ছে যে তাঁর স্টাফ তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছে, সত্যি কথা বলছে না, তখন উনি ইচ্ছে করলে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। সেরকম একজন আমার বাড়িতেই মজুদ আছেন। তা আমি ভেবেছিলুম, উনি হয়তো সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে আসবেন যদি রাজি হন। রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু ঝোঁকের মাথায় ওকে অফিসেই নিয়ে আসতে বললেন। ব্যাপারটা যে খুব আইনসঙ্গত হল, তা নয়। তবে ডিরেক্টর হিসেবে একটু উলটোপালটা কাজ করবার অধিকার তাঁর আছে। তা ছাড়া, আমি তো সঙ্গে আছিই।’
দময়ন্তী সমরেশকে প্রশ্ন করল, ‘কিরকম দেখলে ভদ্রলোককে?’
সমরেশ বলল, ‘পাকা আমটির মতো চেহারা। লালচে গায়ের রং। বয়েস যথেষ্ট হয়েছে, তবে একদম সোজা আছেন। সিভিলিয়ান হয়েও স্মার্টনেসে এই মিলিটারির লোকেদেরও হারিয়ে দিতে পারেন।’
‘আজকের যে প্রবলেম নিয়ে উনি এত রাগারাগি করলেন, সেটা কি সত্যিই এতটা গুরুত্বপূর্ণ?’
‘না। ব্যাপারটা কোনো প্রবলেমই না। কেন যে ওঁর ধারণা হয়েছে যে ওঁর মেনটেনেন্স স্টাফ ওঁকে খালি ধাপ্পা দেওয়ার তালে আছে, তা উনিই জানেন। আমি তো কোন কারণ দেখলুম না।’
সমরেশের কথা শুনে দময়ন্তী ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে হঠাৎ নিরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ডক্টর যোশীকে আপনি কোনো পার্টিতে যেতে দেখেছেন কখনো?’
নিরঞ্জন প্রশ্নটা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বললেন, ‘পার্টিতে? হ্যাঁ, দেখেছি বই কি! এখানেও দেখেছি, দিল্লিতেও দু-একবার দেখেছি।’
‘কি করেন পার্টিতে?’
‘কি করেন মানে?’
‘মানে, এই মদ-টদ খেয়ে হইহুল্লোড়…’
‘ডক্টর যোশী… মদ খেয়ে… হইহুল্লোড়! ক্ষেপেছ তুমি? ভয়ানক সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক। হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভেজিটেরিয়ান, টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট টীটোটলার! শুনেছি, নিউক্লিয়ার কেমেস্ট্রি আর হিন্দু শাস্ত্র— দুটোতেই নাকি অগাধ জ্ঞান। পার্টিতে গিয়ে নাক সিটকে একগ্লাস টম্যাটো জুস আর দুটো আলু ভাজা খেয়েই কেটে পড়েন। উনিও বাঁচেন, পার্টিওয়ালারাও বাঁচে। কিন্তু এ প্রশ্নের হেতু?’
‘পরে বলব। এবার বলুন, আর কি খবর দেবার আছে।’
নিরঞ্জন সমরেশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আরও একটা খবর আছে বটে। তরফদার সাহেব সম্প্রতি ক্যারাটে শিখতে আরম্ভ করেছেন বলে সংবাদে প্রকাশ। হায়দ্রাবাদে স্ট্যানলি আলেকজান্ডারের ক্যারাটে স্কুলে নাম লিখিয়েছেন।’
‘স্ট্যানলি আলেকজান্ডার!’
‘ভয় নেই, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ অন্ধ্রের লোক। চেহারা দেখলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় বটে, কিন্তু আসলে অত্যন্ত ভদ্র, গোবেচারা মানুষ। তরফদার নাকি বলেছেন যে তাঁর ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে, সেইজন্য এক্সারসাইজ করার এই ব্যবস্থা।’
‘উনি আপনার সঙ্গে মর্নিং ওয়াক করেন না?’
‘নাঃ।’
‘আচ্ছা, মিস্টার আইয়ারের মতো আপনি ওয়াকিং স্টিক নিয়ে বেরোন না কেন? বেশ স্টাইলিশ স্টাইলিশ দেখাত।’
‘রত্না বলে উঠল, চুপ কর। ওর এমন কি বয়েস হয়েছে যে এখনই ওয়াকিং স্টিক নিয়ে বেরোতে হবে? আইয়ারের স্টিক নিয়ে বেড়ানোটা বাতিক। যখনই হেঁটে বেরোন, হাতে স্টিক।’
সমরেশ হঠাৎ উজ্জ্বল মুখে চেয়ারের ওপর খাড়া হয়ে বসল, ‘এই হয়েছে। —তার পরমুহূর্তেই চুপসে গিয়ে বলল, নাঃ, হল না।’
নিরঞ্জন সহাস্যে বললেন, ‘কী হল না, সমরেশ? তুমি ভেবেছিলে, ওই স্টিকটা যদি ফাঁপা হয় তাহলে তার মধ্যে একটা প্রিন্ট পাকিয়ে ঢুকিয়ে নিয়ে বের করে নেওয়া যায়, তাই না?’
সমরেশ বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই বটে। তবে সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল যে যেরকম সরু স্টিক আইয়ারের হাতে দেখলুম, তার ভেতরে একটা এ জিরো সাইজের প্রিন্ট যতই পাকানো থাক না কেন, তা ঢোকানো যাবে না।’
দময়ন্তী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বাইরের অন্ধকারে গেটের পাশে একটা গলা খাঁকারির শব্দ শুনে থেমে গেল।
নিরঞ্জন তাড়াতাড়ি উঠে গেটের সামনের আলোটা জ্বেলে দিলেন। যে লোকটি সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে ঢুকল, সে একজন স্থানীয় লোক। রোগা, লম্বা, কালো, পরনে সাদা হাত কাটা শার্ট আর সাদা লুঙ্গি, বয়েস পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চান্ন যা কিছু হতে পারে।
তাকে দেখে রত্না বেজায় খুশি হয়ে উঠল। বিশুদ্ধ বাঙালি হিন্দিতে তাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে, দময়ন্তীকে বলল, ‘এই হচ্ছে মানি। আমাদের মাছ সাপ্লাই দেয়। আয়, তোর কি লাগবে না লাগবে, এর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নে।’
অতঃপর দুই মহিলা বাঙালি হিন্দিতে এবং শ্রীযুক্ত মানি তেলেগু হিন্দিতে পরমোৎসাহে মাছ সংক্রান্ত আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সমরেশ একগাল হেসে নিরঞ্জনকে বলল, ‘অদ্ভুত আমাদের স্বভাব! দেখুন, আপনার গৃহিণী ওই মানিকে দেখে যতটা পুলকিত হয়ে উঠল, আপনাকে দেখে কখনো হয়েছে?’
নিরঞ্জন বললেন, কক্ষণো না।
.
মানি অর্ডার নিয়ে চলে গেলে রত্না আর এক রাউন্ড চা আর পকোড়া নিয়ে এল। দময়ন্তীকে বলল, ‘আমাদের এখানে মাছ কীরকম সস্তা দেখেছিস?’
দময়ন্তী ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘সত্যি, আমরা কলকাতার লোক, এরকম মাছের দাম যে হয়, তা চিন্তাই করতে পারি না। আচ্ছা নিরঞ্জনবাবু, মানিকে কি আপনি খবর দিয়েছিলেন, না সে নিজে নিজেই এসেছিল?’
নিরঞ্জন বলল, ‘আমি খবর পাঠিয়েছিলুম। কেন?’
‘আপনি খবর পাঠিয়েছিলেন? ও! আমি ভেবেছিলুম অন্যরকম।’
‘আমার খবর দেওয়াটা কি ভুল হয়েছিল?’
‘না, না, তা নয়। আসলে ভুল হয়েছে আমার।’
‘কী যে তুমি বলতে চাইছ, বুঝতে পারছি না। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার, গতকাল থেকে আমরা যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি, তারপর থেকে চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে-না-হতেই তার পাঁচজনের মধ্যে চারজন সাসপেক্টের সঙ্গে তোমাদের দেখা হয়ে গেল। আইয়ার আর তরফদার এলেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, দর্শন দাসকে আমি কায়দা করে পাঠালুম আর ডক্টর যোশীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সমরেশের।’
দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘আমার ধারণা এর খানিকটা কাকতালীয়, খানিকটা নয়। আমি এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আজ দুপুরে রত্নাকে দিচ্ছিলুম। এবং আমি খুব আশ্চর্য হব না, যদি এখন ডক্টর গেব্রিয়েল ডিসুজা এখানে উপস্থিত হন।’
বলতে-না-বলতেই খোলা গেটের ভেতর দিয়ে হুশ করে একটা সাদা রঙের ফিয়াট ঢুকে এসে বারান্দার সামনে সশব্দে ব্রেক কষে দাঁড়াল। নিরঞ্জন লাফ দিয়ে উঠে বিস্ফারিত চোখে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘অদ্ভুত! অবিশ্বাস্য! এ যে সত্যিই ডক্টর ডিসুজা।’
ধূলিধূসরিত, নানা জায়গায় তোবড়ানো গাড়িটার ড্রাইভারের সিট থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনিই নিশ্চয় ডক্টর ডিসুজা। রোগা, লম্বাটে চেহারা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, বেশ ফিলম-স্টার মার্কা চেহারা, পরনে লাল কালোয় ডোরাকাটা শার্ট আর জিনস, মুখে পাইপ। ভদ্রলোক গায়ে প্রচুর পারফিউম লাগিয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকদিন না-কাচা ঘেমো টেরিলিনের জামা থেকে যে বিকট গন্ধ বেরোয়, তা চাপা দিতে পারেননি। বরং দুটো গন্ধ একত্র হয়ে বিকটতর হয়েছে।
বারান্দার তিনটে সিঁড়ি এক লাফে উঠে এসে একগাল হেসে মার্কিনী অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে বললেন, ‘হ্যালো, এভরিবডি! রত্না, আমি আইয়ারের কাছে শুনলুম যে তোমার বাড়িতে নাকি একজন সুন্দরী মহিলার আগমন হয়েছে। একই ছাদের নীচে দু-জন সুন্দরী মহিলা! তা চুলোচুলিটা কেমন জমেছে, বলো?’ বলে একটা চেয়ার দখল করে বসলেন।
রত্না হেসে বলল, ‘চুলোচুলি হবে কেন? ও আমার বন্ধু দময়ন্তী। দময়ন্তী, ইনি ডক্টর ডিসুজা। …আর ইনি সমরেশ, দময়ন্তীর গৃহকর্তা।’
দময়ন্তী নমস্কার করল। এবং সমরেশও। ডিসুজার কাছে গিয়ে করমর্দন করার কিছুমাত্র উৎসাহ দেখাল না।
ডিসুজা সমরেশকে আগাপাশতলা নিরীক্ষণ করে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার?’
‘হ্যাঁ।’ বলল সমরেশ।
‘কোথায় চাকরি করেন? গভর্নমেন্টে?’
‘না। কলকাতার একটা ফার্মে। প্রাইভেট সেক্টর।’
ডিসুজা পাইপে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘দেখুন, আপনার সঙ্গে প্রথম আলাপেই আপনাকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি বলে হয়তো আপনার মনে হচ্ছে যে আমি একটি বেয়াদব জংলি। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। আপনি যে ডক্টর যোশীর সঙ্গে আজ দেখা করেছিলেন এবং ট্রান্সফর্মারের প্রবলেমটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাতে আমাদের মেনটেনেন্স স্টাফের মধ্যে একটা অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছে যে এতে করে তাদের অপমান করা হয়েছে। তা, আমি জানতে এসেছি যে পুরো ব্যাপারটা কি। সেটা জানলে হয়তো আমি ওদের শান্ত করতে পারব। বুঝতেই তো পারছেন, এদের নিয়েই আমাকে সারা বছর কাজ চালাতে হবে।’
সমরেশ কিছু বলার আগেই নিরঞ্জন বাধা দিলেন। বললেন, ‘ব্যাপারটা আমি বুঝিয়ে বলছি। দোষ যদি কিছু হয়ে থাকে তো সে আমার।’ বলে সমস্ত ব্যাপারটা বিস্তারিতভাবে বললেন।
ডক্টর ডিসুজা পাইপে ঘন ঘন টান দিতে দিতে গভীর মনোযোগ সহকারে সব শুনলেন। নিরঞ্জনের বলা শেষ হলে হেসে উঠে বললেন, ‘ওঃ, এই ব্যাপার! আমাদের এই ডিক্টেটরটিকে নিয়ে আর পারা যায় না! এমন মোগলাই মেজাজ নিয়ে আজকালকার দিনে কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো যায়? নিজের পরিবারই চালানো যায় না। কী বলেন আপনারা?’ বলে তাঁর দুই পুরুষ শ্রোতার দিকে তাকালেন।
সমরেশ বলল, ‘আপনি তো আর আপনার পরিবার নিয়ে আসেননি, কাজেই যা খুশি তাই বলতে পারেন। আমরা তো তা পারি না। আমাদের যা বলার তা আপনাকে পরে আড়ালে বলব।’
ডক্টর ডিসুজা হো হো করে হেসে উঠলেন— চোখ পিটপিট করতে করতে বললেন, ‘তাহলে বলি, শুনুন।’ —বলে ঝাঁক বেঁধে একগাদা বিবাহিত জীবনের ওপর চুটকি ছেড়ে গেলেন একটার পর একটা। তার সবকটাই অসভ্য গল্প, কয়েকটা তো রীতিমতো অশ্লীল। কিন্তু এতই মজার যে শ্রোতারা সবাই হেসে অস্থির।
হঠাৎ গল্প থামিয়ে ডিসুজা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে! এবার চলি।’
রত্না বলল, ‘যাবেন মানে? চা খেয়ে যান!’
শুনে ডিসুজা বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে রত্নার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন অনেক কষ্টে বললেন, ‘চা? এই সময়? আমি? চা?’ বলে বারান্দার রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়ে আকাশটা দেখে নিলেন।
‘কী দেখছেন?’ রত্না জিজ্ঞেস করল।
‘দেখছিলুম সূর্যটা কোথাও আকাশে রয়ে গেছে নাকি। তাহলে অবিশ্যি অন্য কথা ছিল। কিন্তু দেখছি সূর্যাস্ত হয়েই গেছে। অতএব এখন তো আমার পক্ষে চা খাওয়া সম্ভব নয়। শুধু চা কেন, কফি, শরবত, কোল্ড ড্রিঙ্ক, দুধ, জল, এসব একটাও আমার খাওয়া বারণ। খেলেই শরীর খারাপ হবে।’ বলে হাসতে হাসতে একলাফে বারান্দা থেকে নেমে গাড়িতে উঠে সশব্দে স্টার্ট দিলেন।
নিরঞ্জন চিৎকার করে বললেন, ‘আপনার লোকেদের সঙ্গে কি কাল দেখা করব?’
ভেতর থেকে সচিৎকার জবাব এল, ‘দরকার নেই। আমি ম্যানেজ করে নেব!’ পরমুহূর্তেই গাড়িটা সাঁ করে বেরিয়ে চলে গেল।
.
দময়ন্তী বলল, ‘বিশ্বাস করুন নিরঞ্জনবাবু, ডিসুজার আসাটা নিতান্তই কাকতালীয়। আমি স্রেফ আন্দাজে বলেছিলুম। এর পেছনে যুক্তি-টুক্তি কিছু ছিল না।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘হবেও-বা। তবে আজ সারাদিনে যা কিছু ডেভেলপমেন্ট হল, তাতে তো মনে হচ্ছে পাঁচজনকেই ভীষণভাবে সন্দেহ করা দরকার। কেবল বেচারি তরফদারকে সন্দেহ করাটা নিতান্তই একপেশে ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে।’
দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘কীরকম?’
‘কীরকম, মানে? তরফদারের গোলমাল যেসব ছিল তার কিছুটা হয়তো পরিষ্কার হল, কিন্তু তাতে সন্দেহ চলে যাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। ডক্টর যোশীর তো কথাই নেই। দর্শন দাসের টাকার দরকার। ডিসুজা তো গোলমালের ডিপো। আইয়ার অতটা না হলেও তার সকাল বেলা আসার কারণ হয়তো, যেমন তুমি বলেছ, তোমাদের দেখা। ডিসুজারও তা হতে পারে। ডক্টর যোশীরও সমরেশকে ডেকে পাঠানো সন্দেহজনক।’
সমরেশ বলল, ‘হক কথা। আমার তো মনে হচ্ছে, পাঁচজনই একসঙ্গে কাজ করছে। রত্না যা একটা ডিনার খাইয়েছে, তারপরে এর বেশি আর চিন্তা করতে পারছি না।’ বলে দময়ন্তীর দিকে হাত নেড়ে সম্পূর্ণ বেসুরো গলায় গান জুড়ে দিল, ‘পঞ্চচরের বেদনা মাধুরী দিয়ে, বাসর রাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে… চলো, শুতে যাই।’
দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘চুপ করো, অসভ্যতা কোরো না। পঞ্চচর নিয়ে তোমার এখন চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। কাল রাত্রে রত্নার নেমন্তন্নপর্বটা চুকে যাক, তারপরে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘বলো কী? আশা করি, তোমার কথাই ঠিক হবে।’
‘নিশ্চয়ই ঠিক হবে। আপনি শুধু দেখবেন কালকের নেমন্তন্নটা যেন ঠিকমতো হয়, মানে মিসেস দাস আর মিসেস ডিসুজা যেন অবশ্যই আসেন। তা না হলে কিন্তু একটু অসুবিধে হবে।’
.
মিসেস দাসকে দেখলেই বোঝা যায় যে ভদ্রমহিলা অত্যন্ত নির্বিরোধী ভালোমানুষ। রোগা দোহারা চেহারা, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, দু-হাতে শাঁখা আর সাত-আটটা করে লাল কাচের চুড়ি। পরনে অতি সাধারণ মিলের শাড়ি; আর মুখে একটা শান্ত, প্রসন্ন হাসি। সহস্র দুঃখ-কষ্টের ভেতরেও এই হাসিটি ম্লান হবে তা মনে হয় না। তাঁর অতীত ইতিহাস যাদের জানা আছে, তাদের এঁকে দেখলে নিঃসন্দেহে একটা কথাই মনে হবে যে কতদূর অত্যাচারিত হয়েছিলেন ইনি একসময় যাতে তাঁকে বিদ্রোহে জ্বলে উঠতে হয়েছিল।
ভদ্রমহিলা দুপুর গড়াতে-না-গড়াতেই এসে হাজির। এসেই সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।
রত্না অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘এ কী মিসেস দাস? আপনি এ সময়ে?’
মিসেস দাস বললেন, ‘আপনি সরুন তো, আমাকে রান্না করতে দিন।’
রত্না বলল, ‘সে কী? কেন? আপনাকে নেমন্তন্ন করেছি কি রান্না করিয়ে নেবার জন্যে নাকি? না, না, সে হবে না।’
সাহানা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হবে, খুব হবে।’
দময়ন্তী বলল, ‘না, মিসেস দাস, এ হয় না। আপনি কি ভাবছেন যে অফিসারদের স্ত্রীদের সঙ্গে আপনাকেও নেমন্তন্ন করা হয়েছে বলে কোনো গোলমাল হবে? আর তাই, আপনি রান্না করে দিয়ে চটপট এখানেই খেয়ে নিয়ে চলে যাবেন?’
সাহানা মাথা নীচু করে চুপ করে রইলেন।
রত্না বলল, ‘এমন কথা ভাবার আপনার কোনোই কারণ নেই মিসেস দাস। নেমন্তন্ন কেবল তাদেরই করা হয়েছে, যারা বাঙালি রান্না খেতে ভালোবাসে। তাদের সেকথা বলেও নেওয়া হয়েছে। আর শুধু সিনিয়ার অফিসার কেন, জুনিয়ারদের স্ত্রীদেরও বলেছি। মিসেস সিংহ, মিসেস হুসেন— এদেরও বলা হয়েছে। আর আপনি একমাত্র বাঙালি মহিলা হয়েও নিমন্ত্রিত হবেন না? এ কখনো হয়? এতে যদি গোলমাল হয়, তো হবে।’
সাহানা আস্তে আস্তে বললেন, ‘শুনলুম, মিসেস রাও-কেও বলেছেন। উনি তো…’
‘হ্যাঁ, রাধা একমাত্র একসেপশন। ওর জন্যে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। ওকে নেমন্তন্ন না করে কি করি বলুন? না করলে তো রাও আবার সাতদিন অভিমান করে থাকবে।’
সাহানা মৃদু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার আপনি সরুন। মাছটা আমাকে রাঁধতে দিন।’
দময়ন্তী বলল, ‘কেন আপনাকে রাঁধতে দেব? আপনার রান্না কি খুব ভালো?’
রত্না বলল, ‘ওমা, তা বুঝি জানিস না? মিসেস দাসের মাছের কালিয়া এখানে ফেমাস। উনি তো মাঝে মাঝে রান্না করে বাড়ি বাড়ি বিলিয়ে আসেন। আমাকেও কতবার দিয়েছেন।’
সাহানা মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললেন, ‘না, না, আমি দেব কোত্থেকে। আমরা কি আর মাছ কিনতে পারি? যা দাম! ছুঁতেই পারি না।’
‘তবে মাছ পান কোত্থেকে?’
‘আইয়ার সাহেব পাঠান। উনি তো বাংলা দেশের রান্নার ভীষণ ভক্ত। মাছ খেতে ভালোবাসেন, কিন্তু রাঁধতে পারেন না। তাই আমাকে পাঠান রেঁধে দিতে। আর পাঠান একেবারে আস্ত মাছ। নিজে নেন দু-পিস, বাকিটা বিলিয়ে দিতে বলেন।’ বলে মৃদু হেসে বললেন, ‘কিন্তু আমার কী মনে হয়, জানেন?’
‘কি?’
‘রাঁধতেও উনি পারেন। কিন্তু আমাকে পাঠান, কারণ উনি জানেন, আমরা বাঙালি অথচ মাছ খেতে পাইনে। এমনি এমনি পাঠালে আমাদের আত্মসম্মানে লাগতে পারে, তাই আমাকে দিয়ে রান্না করিয়ে নেন।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘বাঙালিদের উনি খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ। ওঁর মুখেই শুনেছি যে অল্প বয়েসে যখন বম্বেতে ছিলেন, তখন একটি বাঙালি পরিবারের সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। সেই পরিবারের একটি মেয়েকে উনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মেয়েটি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারপর থেকে উনি আর বিয়ে করেননি। অথচ বাঙালিদের প্রতি, বিশেষত বাঙালি মেয়েদের প্রতি ওঁর কিন্তু কোনোরকম রাগ বা অভিমান নেই। এটা ওঁর মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আমি শুধু ভাবি, যে মেয়েটি ওঁকে প্রত্যাখ্যান করল, আজ তার কী অবস্থা হয়েছে।’
দময়ন্তী বলল, ‘অল্প বয়েসে যখন মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা হয়নি, তখন মেয়েরা এরকম ভুল করেই থাকে মিসেস দাস। তার জন্যে পরে সারাজীবন পস্তাতে হয়।’
সাহানা ধীর শান্ত গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ ভাই, তা ঠিক। তবে ভগবান সে-ভুল সংশোধন করবার সুযোগও সামনে এনে দেন। ভগবানের সেই দান যে গ্রহণ করতে পারে, তাকে আর পস্তাতে হয় না। না পারলে অন্য কথা।’
‘আচ্ছা, মিসেস ডিসুজাকে আপনার কেমন লাগে?’
‘খুব ভালো লোক। ওঁকে বাইরে থেকে দেখলে ভুল বোঝার সম্ভাবনা, কিন্তু উনি সেরকম নন। আসলে, বড্ড ছেলেমানুষ। স্বামীটিও তাই। তাই ওঁদের সংসারটা কেমন যেন অগোছালো ছন্নছাড়া।’
‘শুনেছি, আপনাদের যোশী সাহেব নাকি ওঁকে একদম দু-চক্ষে দেখতে পারেন না।’
‘না, না, সে কি কথা? এটা একদম ভুল। আমার স্বামীর মুখে শুনেছি, ডক্টর ডিসুজাকে সবাই যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। একটু হইচই করেন হয়তো। তা সে তাঁর ছেলেমানুষী…।’ বলে সাহানা সস্নেহে হাসলেন। বললেন, ‘তা ছাড়া যোশী সাহেব দেবতুল্য লোক। জানেন, রাস্তায় দেখা হলে উনি আগে নমস্কার করে বসেন। বিপদে-আপদে সকলের আগে এগিয়ে আসেন। উনি কাউকে অপছন্দ করেন, এ আমি বিশ্বাস করি না।’
.
মিসেস দাসের পর নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সকলের আগে এলেন মিসেস ডিসুজা। তাঁর স্বামীর মতোই সাদা ফিয়াট চালিয়ে হুশ করে গেটের ভেতরে ঢুকে বারান্দার সিঁড়ির সামনে ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়ালেন। তারপর দরজা খুলে যখন বেরোলেন, তখন তাঁকে দেখে সমরেশ মুগ্ধ, বিস্মিত, হতচকিত এবং অতিশয় পুলকিত হল।
হঠাৎ দেখলে মেমসাহেব বলে ভুল হয়। মাথায় কাঁধ পর্যন্ত লম্বা লালচে চুল, তার ভেতরে একজোড়া অতিকায় চশমা গোঁজা, সুউচ্চ নাক, বড়ো বড়ো চোখ, টকটকে ফর্সা রং, লম্বায় ভারতীয় মেয়েদের তুলনায় একটু বেশিই বলা চলে। একটা লাল সোয়েট শার্ট আর ব্রাউন কর্ডুরয়ের জিনস যে ফিগারটি ঢেকে রেখেছে, কালিদাসের আমলে অমন ফিগারওলা মেয়েরা একটু সামনে ঝুঁকে অলসগমনে চলাফেরা করতেন। কিন্তু যুগ পাল্টেছে। ইনি গাড়ি থেকে মেমেই হুপ করে এক লাফ দিয়ে তিনটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন। দুটো স্টিলেটো হিলের ওপর নিখুঁত টু পয়েন্ট ল্যান্ডিং। সমরেশ একেবারে বিমোহিত হয়ে পড়ল।
নিরঞ্জনের দেখে অভ্যেস আছে, কাজেই তিনি অতটা মুগ্ধ হলেন বলে মনে হল না। বরং হইচই করে উঠলেন, ‘এই যে সারদা এসে গেছে। সুস্বাগতম, সুস্বাগতম। তোমার জন্যে আমরা সবাই এতক্ষণ ব্যাকুল হৃদয়ে অপেক্ষা করছিলুম।’
সারদার গলাটাও মেমসাহেবদের মতো, একটু মোটা আর ভারী। তাঁর স্বামীর মতোই মার্কিনী অ্যাকসেন্টে বললেন, ‘বাজে কথা বোলো না। তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে কেন? করবে রত্না, কারণ সে-ই আমাকে নেমন্তন্ন করেছে।’
নিরঞ্জন কপট দুঃখে ম্রিয়মাণ হলেন। বললেন, ‘এরকম কথাটা কী করে বলতে পারলে? আমি তোমার জন্য চিরকাল অপেক্ষা করে আছি, এবং থাকবও।’
সারদা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, ‘অ, শাট আপ! তুমি কি আমার সঙ্গে কেবল ইয়ার্কি দেবে, না এই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে?’
নিরঞ্জন দুঃখপ্রকাশ করে তাড়াতাড়ি সমরেশের পরিচয় দিলেন। সমরেশ কিছু বলার আগেই সারদা অপাঙ্গে তাকে একবার দেখে নিয়ে একটা সংক্ষেপে ‘হাই’ বলে স্টিলেটোর ওপর বন করে ঘুরে গেলেন। উদ্দেশ্য রান্নাঘরের দিকে যাওয়া। কিন্তু রত্না আর দময়ন্তী আগেই বারান্দায় এসে গেছে।
আবার একপ্রস্থ পরিচয় পর্ব হল। সারদা বললেন, ‘কী দারুণ গন্ধ বেরিয়েছে রত্না! কী মেনু?’
রত্না বলল, ‘এখন বলব কেন? খাওয়ার সময় দেখতে পাবে।’
সারদা মুখটা করুণ করে বললেন, ‘ডিনার কখন? আই’ম ফ্যামিশড।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘তাই নাকি? তাতে চিন্তিত হবার কিছু নেই। আমি এখুনি তোমার খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করছি।’
‘কি রকম?’
‘তোমার জন্য স্পেশাল একছড়া কলা আজ বাজার থেকে এনেছি। চাও তো পুরো ছড়াটাই এনে দিই।’
‘নিরঞ্জন, আমি শিগগিরই একদিন তোমাকে খুন করব। করবই! রত্নাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, তার এই উপকারটুকু করা আমার বিশেষ কর্তব্য।’
‘এই দেখো, ভালো করতে গেলে, খারাপ কথা শুনতে হয়। আমরা তো সবাই জানি যে কলা হচ্ছে তোমার স্টেপল ফুড, প্রধান খাদ্য— যেমন আমাদের পূর্বপুরুষদের ছিল আর কি।’
‘রাবিশ! কলা শুধু আমারই স্টেপল ফুড, তাই না? বাকি সবাই যেন কলা পছন্দ করে না? সবাই করে। তোমার অবগতির জন্যে জানাই, আমাদের কলাগাছের চারা কলোনির সবাই নিয়ে গেছে। নেয়নি একমাত্র তরফদার, গুলাটি, বর্মণ আর মিত্তাল।’
‘বল কী? ডক্টর যোশীও নিয়েছেন?’
‘নিশ্চয়ই। তফাতের মধ্যে আমরা সাহস করে বাড়ির সামনের বাগানে লাগিয়েছি, বাকি সক্কলে লাগিয়েছে রান্নাঘরের পেছনে। যেন বাড়ির সামনে কলাগাছ লাগানো মহা অপরাধ আর কতগুলো স্টুপিড ফুলগাছ লাগানো খুব ভালো কাজ। আমাদের ওসব ভাঁড়ামো নেই, বুঝলে? যা পছন্দ করি, তা সকলের সামনেই করি, আড়ালে করি না।’
‘বাজে কথা! এই যে তুমি আমাকে পছন্দ কর, কই সেকথা তো সকলের সামনে বলো না? অবিশ্যি আড়ালেও বলো না, কিন্তু সেটা কোনো বড়ো কথা নয়।’
সারদা বিস্ফারিত চোখে পুনরাক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই কলরব করতে করতে অন্যান্য নিমন্ত্রিত মহিলারা এসে উপস্থিত হলেন। লড়াইটা আপাতত মুলতুবি রইল।
.
রাত অনেক হয়েছে। অতিথিরা সবাই চলে গেছে। রত্না আর দময়ন্তী সব সাফসুতরো করে বারান্দায় এসে বসল। তাদের কর্তারা অবশ্য আগে থেকেই বসে ছিলেন।
নিরঞ্জন একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘কি হল, সমাধান হয়ে গেছে?’
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, হয়ে গেছে। আপনিও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন?’
নিরঞ্জন হেসে ফেললেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, কিছুটা বুঝেছি। সবটা নয়।’
রত্না বলল, ‘কী বুঝেছ তুমি?’
‘তোমার বন্ধু ঠিকই বলেছিল। কার কার ব্যবহারে অস্বাভাবিকত্ব আছে, সেটা বিশ্লেষণ করলেই ব্যাপারটা ধরা পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে যেটা অস্বাভাবিক মনে হয়, সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে পারে। আবার তার উল্টোটাও ঠিক। আমি যদি বাঙালি না হতুম, তাহলে হয়তো অনেক আগেই বুঝতে পারতুম।’
দময়ন্তী বলল, ‘খুব সত্যি কথা। আর আপনি পুরুষমানুষ বলেও একটু অসুবিধে ছিল।’
‘ঠিক বলেছ। আসলে, তুমি কিভাবে এগোচ্ছ, সেটা বিশ্লেষণ করেই কিন্তু আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি। কেবল বুঝতে পারিনি, জিনিসটা বাইরে যাচ্ছে কী করে।’
‘বুঝতে পারেননি? সারদার কথাতেও বুঝতে পারেননি?’
‘সারদার কথায়?’ বলে নিরঞ্জন চুপ করে গেলেন। অনেকক্ষণ নীরবে সিগারেট টেনে হঠাৎ চেয়ারের হাতলে চাপড় মেরে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘আরে, ঠিক বলেছ তো! সারদার কথায়… দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি একটা ফোন করে আসি। আজ রাত্রেই রেড করতে হবে।’ বলে এক দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেলেন।
রত্না বলল, ‘সমরেশদা, আপনি সব বুঝতে পেরেছেন?’
সমরেশ প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘কিছুমাত্র না। তুমি কি বোঝার চেষ্টা করছ নাকি? ওর মধ্যেই যেয়ো না। বদহজম হবে, রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখবে। তার চেয়ে পানটা বেশ ভালো করে চিবিয়ে খেয়ে নিশ্চিন্ত মনে একটা ঘুম দাও। স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।’
রত্না বলল, ‘আমি তো ভাবছিলুম, বুঝি আমিই কিছু বুঝতে পারছি না।’
এমন সময় নিরঞ্জন বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘ব্যস, সব ব্যবস্থা পাকা। তাহলে দময়ন্তী, কাল সকালে চলো, আমরা সবাই মর্নিং ওয়াকে যাই। মিস্টার কৃষ্ণ আইয়ারের সঙ্গে, তখন একটু পরামর্শ করে নেওয়া যাবে।’
দময়ন্তী সহাস্যে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো।’
সমরেশ কাতর মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকেও যেতে হবে। মর্নিং ওয়াক করলে আমার আবার কেমন শরীর খারাপ লাগে। মাথা টিপটিপ করে। কান কটকট করে।’
নিরঞ্জন বাধা দিয়ে বললেন, ‘অলসের ঢিবি! না, না, তোমাকেও যেতে হবে।’
রত্না বলল, ‘আমি কিন্তু যেতে পারব না। ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে। সাতসকালে বেরিয়ে গেলে আমার চলবে না।’
.
নিরঞ্জন বললেন, ‘দেখো সমরেশ, মর্নিং ওয়াক করবে বেশ তেজের সঙ্গে। অমন থপাস থপাস করে হেঁটো না তো!’
ব্যাজার মুখে সমরেশ বলল, ‘এত সকালে উঠলে, তেজ বলে আর কিছু থাকে?’
‘কেন থাকে না! এই তো যাঁরা এখানে মর্নিং ওয়াক করছেন, কেউ তোমার মতো এমন নিস্তেজ হয়ে আছেন? ওই তো মিস্টার আইয়ার।’
আইয়ার তিনজনকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। ওয়াকিং স্টিকের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই যে কর্নেল ঘোষ। অতিথিদের স্বাস্থ্যের দিকে বেশ নজর দিচ্ছেন দেখছি। ওঁদেরও এই মর্নিং ওয়াকের বদভ্যেস ধরিয়ে দিচ্ছেন?’
কর্নেল ঘোষ বললেন, ‘মিস্টার আইয়ার, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো হল। আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল আমাদের।’
আইয়ার তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘বেশ তো চলুন, ওই পাথরটার ওপর বসি। বলুন, আমি আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি।’
নদীর ধারে একটা বেশ বড়োসড়ো কালো মসৃণ পাথরের ওপর চারজনে বসলেন। নিরঞ্জন বললেন, ‘মিস্টার আইয়ার, আপনার খুব সম্ভবত জানা নেই যে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে একটা খুব নোংরা কাজ চলেছে।’
আইয়ার ভুরু দুটো একটু ওপরে তুলে বললেন, ‘নোংরা কাজ? কীরকম?’
‘আমাদের গোপন কাজের বেশ কিছু খবর বিদেশে চলে যাচ্ছে।’
‘সে কী? খবর মানে? কীরকম খবর?’
‘খবর মানে, ড্রইং বেরিয়ে যাচ্ছে। পুরো ওয়ার্কিং ড্রইং।’
‘পুরো ড্রইং! এই সিকিউরিটির ভেতর দিয়ে! আশ্চর্য!’
‘আশ্চর্যই বটে। এ ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে পরামর্শ।’
আইয়ার বললেন, ‘তাহলে তো এখানে বসে কথা বলাটা ঠিক হবে না। চলুন, আপনার কোয়ার্টার্সের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে, কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে। কিছু মনে করবেন না, এসব কথা আপনার অতিথিদের সামনে বলাটা কি ঠিক হবে? শত হলেও ওঁরা বাইরের লোক।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই। তবে এ ব্যাপারে আপনাকে একটু বিশদভাবে বলা দরকার। আমার অতিথিদের সম্পূর্ণ পরিচয় আপনার জানা নেই। বিশেষত, এই মহিলার। উনি কেবল রত্নার বন্ধু বা কলকাতার একটা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকাই নন, উনি একজন অপরাধবিজ্ঞানীও। উনি অবশ্য ছুটি কাটাতেই এসেছিলেন আমার কাছে, কিন্তু রহস্যের জট ছাড়িয়েছেনও উনিই। কাজেই, এ বিষয়ে যাবতীয় পরামর্শ ওঁর সামনে এবং ওঁর সঙ্গেও করা যেতে পারে। অবশ্য, আনঅফিশিয়ালি।’
আইয়ার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘অপরাধবিজ্ঞানী! হাউ ইন্টারেস্টিং, হাউ ভেরি ইন্টারেস্টিং!’
চারজন কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটলেন। তারপর নিরঞ্জন বলতে শুরু করলেন, ‘দেখুন, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ হয় প্রথমে পাঁচজনের ওপর— ডক্টর যোশী, ডক্টর তরফদার, আপনি, দর্শন দাস এবং ডক্টর ডিসুজা। কারণ আপনারাই একমাত্র লোক যাঁরা ড্রইং বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। প্রথমে সন্দেহটা তরফদারের ওপরেই হয়, কারণ উনি মাঝে মাঝেই হায়দ্রাবাদে যান, সেখানে একটি মুসলমান মেয়ের সঙ্গে দেখা করেন গোপনে। কাজেই আমি তাঁর নামে একটা গোপন রিপোর্ট প্রায় পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। এই সময়েই দময়ন্তী আমার এখানে আসে। দময়ন্তী, এরপর থেকে তুমিই বলো।’
দময়ন্তী বলল, দেখুন, কর্নেল ঘোষ প্রথমে ধরতে পারছিলেন না যে ড্রইংটা বেরিয়ে যাচ্ছে কি করে। ওই এনক্লোজারের ভেতর থেকে সেটা বেরোতে পারে মাত্র দু-ভাবে। এক জলপথে, অন্যটা আকাশপথে। আকাশপথে অসম্ভব, জলপথেই সম্ভব এবং স্বাভাবিক। কিন্তু কিভাবে? নদী ওখান থেকে অনেক দূরে, ছুড়ে ফেলা অসম্ভব। অন্য উপায়, ড্রেনে ফেলে দেওয়া কোনো কৌটোয় ভরে। একসময় না একসময় সেটা ভাসতে ভাসতে নদীতে গিয়ে পড়বে। কিন্তু সেখানে একটা অসুবিধে আছে। ড্রেন দিয়ে কোনো কৌটো ভেসে যেতে দেখলে কেউ-না-কেউ কৌতূহলবশে সেটা তুলে দেখতে পারে, ড্রেনের যেখানে নদীতে আউটফল সেখানে লোহার শিকে সেটা আটকে গেলে সিকিউরিটি তুলে চেক করতে পারে। অতএব এমন একটা কন্টেনার বা ধারক নিশ্চয়ই ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মূল্যবান ডকুমেন্টটা নিয়ে দরকার হলে সকলের চোখের সামনে দিয়েই ভাসতে ভাসতে নদীতে গিয়ে পড়বে। যদি লোহার শিকে আটকিয়েও যায়, তাহলেও সিকিউরিটি সেটা দেখতে পেলে ছুড়ে নদীতেই ফেলবে, চেক করবে না।
সেটা কি হতে পারে? একটু ভাবলেই বোঝা যায়, সেটা একটা জিনিসই হতে পারে— অতি সাধারণ অথচ অত্যন্ত এফেকটিভ— কলাগাছের থোড় বা কাণ্ডের ভেতরের অংশটা। এটা জলে ডোবে না, জলে অনেকদিন অক্ষত থাকে অথচ এ জিনিসটা জলে ভেসে যেতে দেখলে কেউ ফিরেও তাকায় না। থোড় গোল এবং এর ভেতরটা কুরে ফাঁপা করে নিলে চমৎকার কৌটোয় পরিণত হয়। তার ভেতর একটা প্রিন্ট চার ভাঁজ করে গোল করে পাকিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখটা মোম দিয়ে সিল করে দিলেই কাজ হাসিল।’
আইয়ার মৃদু হেসে বললেন, ‘আইডিয়াটা চমৎকার, তাই না?’
‘সত্যিই চমৎকার। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, এ কাজ কার পক্ষে করা সম্ভব। দেখা যাচ্ছে, সকলের পক্ষেই। তরফদার ছাড়া প্রত্যেকের বাড়িতেই কলাগাছ আছে। তরফদার বাঙালি হিসেবে থোড়ের ছেঁচকির পক্ষপাতী হতে পারেন এবং কারো কাছ থেকে থোড় ধার করতে পারেন। অতএব কাউকেই এখান থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না।
‘এবার দেখা যাক, প্রত্যেকের অতীত জীবন থেকে এমন কিছু দুর্বলতা বের করা যায় কি না, যা ভাঙিয়ে অন্য কোনো দেশের রাজশক্তি তাকে গুপ্তচরবৃত্তিতে টেনে আনতে পারে। দেখা যাচ্ছে, এখানেও একমাত্র আপনি ছাড়া আর সকলেরই অতীত বা কোনো ক্ষেত্রে বর্তমান সেই দুর্বলতা যোগান দিতে পারে।’
‘যথা?’
‘যথা, প্রথমত ধরুন ডক্টর যোশী। কোনো অজ্ঞাত কারণে মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড রেগে যান, অথচ স্বভাবত তিনি শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী। পরে জানা গেল তাঁর ছোটোজামাই সিআইএ-র সঙ্গে যুক্ত। অতএব তাঁর স্নায়ু প্রায়ই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
‘দ্বিতীয়ত, ডক্টর তরফদার। দীর্ঘদিন বিপত্নীক অথচ তাঁর স্বাস্থ্য আর প্রকৃতি তাঁকে ব্রহ্মচর্য পালনে নিশ্চয়ই পদে পদে বাধা দিচ্ছে। তিনি একটি চমৎকার মেয়ের প্রেমে পড়েছেন, তাঁর সঙ্গে গোপনে দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে, অথচ তাঁর শ্রদ্ধেয় অথচ বদরাগী, পণ্ডিত কিন্তু গোঁড়া, বাবার ভয়ে এবং তাঁর অপমান হবে, এই চিন্তায় বেশিদূর এগোতে পারছেন না। মেয়েটি মুসলমান এবং ধর্মভীরু। এটা হতেই পারে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র তাকে ধোঁকা দিয়ে তার মাধ্যমে তরফদারকে দোহন করছে। যদিও আমরা জানি যে মেয়েটির দেশপ্রেম সন্দেহাতীত এবং খুব সম্ভবত তার বাবার কাছ থেকে যে বিষম বাধা আসবে বলে ভয় করা গিয়েছিল তা আসেনি, তবু সন্দেহটা যায় না; কারণ মেয়েটির অন্যত্র অন্য কোনো দুর্বলতা এক্সপ্লয়েটেড হচ্ছে কি না, তা আমরা জানি না।
‘তৃতীয়ত, দর্শন দাস। কোনো একটি কারণে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছে কেউ। অতএব সবসময়েই তাঁর অর্থাভাব। যদিও তাঁর প্রয়োজন কম এবং এই অন্যায় দারিদ্র্য তিনি বিনা অভিযোগেই বহন করেন, তবু টাকা টাকাই। অনেক টাকার লোভ, সাহানার মতো স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, সামলানো কঠিন হতে পারে।
‘চতুর্থত, ডক্টর ডিসুজা। তাঁরও দর্শন দাসেরই অবস্থা, অর্থাৎ অর্থাভাব। কিন্তু ব্ল্যাকমেলের জন্যে নয়, নিজেদের স্বভাবের জন্যে। স্বামী-স্ত্রী দু-জনেরই উড়নচণ্ডী স্বভাব, কাজেই হিসেবপত্র করে খরচ ওই সংসারে হতে পারে না। সেইজন্যেই গাড়ির অমন দশা, জামাকাপড় অপরিষ্কার এবং মাঝে মাঝে স্রেফ কলা খেয়ে একবেলার ভোজনপর্ব শেষ করা। নিজেদের স্টাইল বজায় রাখতে এরকম অবস্থায় অনেকেই পড়েন দেখেছি। অতএব তাঁরও টাকার দরকার।
‘পঞ্চমত আপনি।’
‘আমি?’ আইয়ার হেসে উঠলেন বিস্ফারিত চোখে।
‘হ্যাঁ, আপনি। আপনার অতীত কিন্তু আমরা কেউ জানি না। একমাত্র একটি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে আপনার ব্যর্থ প্রেম ছাড়া। সেটার কথায় পরে আসছি, কিন্তু আপনার অজ্ঞাত অতীতও আপনার প্রতি সন্দেহ বাড়ায়ই, কমায় না।
‘অতএব দেখা যাচ্ছে, অতীত ঘেঁটে এ রহস্যের জবাব পাওয়া কঠিন। সুতরাং, হয়তো কলার ভেলাটা অনুসরণ করলেই এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে। মানে, মোডাস অপার্যান্ডিটা বিশ্লেষণ করলে কিছু আলো হয়তো দেখা যাবে।’
‘আপনি বিশ্লেষণ করেছেন?’
‘হ্যাঁ, করেছি। থোড়ের খোলের ভেতর প্রিন্ট ভরে ড্রেনের জলে ফেলে দেওয়াটাই শেষ কথা নয়। সেটা জল থেকে উদ্ধার করাও খুব জরুরি। সেটা কে করে এবং কীভাবে?
‘সকলের সন্দেহ এড়িয়ে সে-কর্মটি করতে পারে একজনই, সে একজন জেলে। মানি একজন স্থানীয় লোক হতেও পারে, না হতেও পারে। তার বাড়িতে কাল রাত্রে রেড হয়েছে, সে ধরা পড়েছে। তার কাছ থেকে অনেক কথাই জানা যাবে। কিন্তু যদি সে স্থানীয় লোকও হয়, তাহলে টাকা খেয়ে তার মুখ বন্ধ রাখায় কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। ভেলা যেদিন জলে ভাসানো হবে, তার আগের দিন তাকে মাছ অর্ডার দেবার নামে ডেকে ভেলাটা তোলার কথা বলে দিলেই হল। কাকপক্ষীও টের পাবে না।
‘এটি কিন্তু আপনাদের পাঁচজনের সবাই করতে পারেন না। সম্পূর্ণ নিরামিষাশী ডক্টর যোশী এখানে এসেই বাদ হয়ে যাচ্ছেন। বাকি চারজনের মধ্যে দর্শন দাসও বাদ হয়ে যাচ্ছেন, কারণ মাছ কেনার পয়সা তাঁর নেই, তিনি কখনো অর্ডার দেন না। সবাই জানে, তাঁর কপালে মাছ খাওয়া জোটে আপনার কৃপায়। হয়তো, এই একই কারণে ডিসুজাকেও বাদ দেওয়া যেতে পারে।
‘যে দু-জন বাকি রইলেন, তার মধ্যে কিন্তু সবচেয়ে উজ্জ্বল ছবিটি আপনার।’ বলে দময়ন্তী একটু চুপ করল।
আইয়ার নীরবে মাথা নীচু করে হাঁটছিলেন। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, ‘থামলেন কেন? বলে যান।’
‘আপনার কয়েকটা জায়গায় ভুল হয়েছিল।’
‘কীরকম?’
‘প্রথমত, আপনার সামান্য ছুতোয় আমাদের দেখতে আসা। তবে, আপনি আমাকে সন্দেহ করেননি, সমরেশকে করেছিলেন। কিন্তু সমরেশকে দেখে আপনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এই ভেবে যে আমরা নেহাতই বেড়াতে আসা অতিথি। আদতে অবশ্য আমরা তাই ছিলুম।
এই নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন বলেই আপনার দ্বিতীয় ভুলটা হয়। আপনি চিন্তা না করেই আমাকে একটা কথা বলে ফেলেছিলেন।’
‘কি কথা?’
‘আপনি বাড়ি ফিরে পুজো সেরে বীণা নিয়ে বসেন। আপনি একা থাকেন অতএব পুজোটা লোক দেখানো নয়। তার মানে, আপনি একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু। কোনো নিষ্ঠাবান দক্ষিণ ভারতীয় মাছ খান, এটা ভাবা যায় না। একথাটা আপনিও জানেন। তাই মাছ খাবার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আপনাকে তৈরি করতে হয়েছে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে ব্যর্থ প্রেমের কাহিনিটা রটনা করে।
‘আপনার তৃতীয় ভুল শ্রীমতী দাসকে দিয়ে মাছ রান্না করিয়ে বাড়িবাড়ি বিলোনো। এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। আপনি ভেবেছিলেন, এতে আপনার মহত্ত্ব এবং মৎস্যপ্রীতি দুটোই প্রচারিত হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে আর একটা ব্যাপারও বেশ পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে আপনার বাড়িতে মাছ রান্না হয় না। রান্না করা দু-টুকরো মাছ আসে যেটা আপনি খান না, পত্রপাঠ ফেলে দেন, তার সন্ধান কেউ রাখে না। নিরঞ্জনবাবু বাঙালি বলে আপনার মাছ খাওয়ার গল্প শুনে কিছুই অস্বাভাবিক দেখেননি বরং পুলকিত হয়েছেন, আমি হইনি।
‘চতুর্থ, আপনার ওয়াকিং স্টিক নিয়ে বেড়ানো। আপনার বয়েস বা স্বাস্থ্য এমন নয় যে আপনাকে লাঠি হাতে ঘুরতে হবে। তবে, অনেকে ঘোরে স্টাইলের জন্য। আপনিও হয়তো সেই কারণেই ঘোরেন। কিন্তু আর একটা সম্ভাবনাও থাকে, সেটা হল, ড্রেনে কোথাও থোড়টা আটকে গেছে দেখলে স্টিকটা দিয়ে কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই সেটা ঠেলে ড্রেনের মাঝখানে দিয়ে দেওয়া যায়। কেউ যদি দেখেও, সে ভাববে আপনার সিভিক সেন্সের তুলনা নেই, আপনি ড্রেনটা যাতে কোথাও চোকড হয়ে না যায়, তাই দেখছেন।
‘আমি যা বুঝেছি তা হচ্ছে, যে রাত্রে আপনার বাড়ি সারারাত বীণা বাজে, সেদিন আসলে চলে টেপরেকর্ডার। আপনি রান্নাঘরের পেছনে গাছ কেটে থোড় বের করে উপযুক্ত কন্টেনার বানিয়ে ড্রইং ভরে ড্রেনে ভাসিয়ে দেন হয়তো আপনার বাড়ির বাগানের ভেতরেই। পরদিন সকালে ময়লা ফেলার লোকেরা এসে শুকনো পাতা, কাটা গাছটাও নিয়ে যায়। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। কলা বাগান ঘন ঝাড় হয়ে গেলে অনেকেই অমন গাছ কেটে বাগান পরিষ্কার করে ফেলে।
‘ইতিমধ্যে মানি খবর পেয়ে গেছে। সে মাছের সঙ্গে আপনার জিনিসটাও তোলে। তারপর কার কাছে কীভাবে সেটা পাচার হয়, তা অবশ্য আমাদের জানা নেই।’
দময়ন্তী চুপ করল। আইয়ার একইভাবে নতমস্তকে নীরবে কিছুক্ষণ হাঁটলেন। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে ফিকে হেসে বললেন, ‘আমাকে এসব কথা শোনালেন কেন? আমাকে তো সোজাসুজি গ্রেপ্তার করতে পারতেন।’
নিরঞ্জন বললেন, ‘হ্যাঁ, তা হয়তো পারা যেত। কিন্তু আপনি বুদ্ধিমান লোক, আপনার কাছে আমরা একথাই প্রমাণ করলুম যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও সকলকে ফাঁকি দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজেই আপনার কাছে আমাদের দু-জনের অনুরোধ, আপনি আমাদের বলুন, আপনি এ কাজ কেন করলেন এবং আর কারা এর সঙ্গে জড়িত আছে। হয়তো আপনি আবার এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবেন, কিন্তু তখন একথাও মনে রাখবেন যে বুদ্ধির লড়াইয়ে আবার আপনার হার হতে পারে।’
আইয়ার আবার কিছুক্ষণ নীরবে চিন্তা করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘না, এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করব না। আপনি যদি আমায় গ্রেপ্তার করে জেরা শুরু করতেন, আমি অবশ্য তাহলে কিছুই বলতুম না। কিন্তু আপনি যখন আমার বুদ্ধিবৃত্তির কাছে অনুরোধ রেখেছেন, তখন সেটা রক্ষা না করা আর সম্ভব নয়। তবে কি জানেন? বাঙালি মেয়ের কাছে প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার গল্পটা কিন্তু মিথ্যে নয়। একবার বহু বছর আগে হেরেছিলুম, আজ আবার হারলুম। তবে আজকের হারায় দুঃখ পাইনি, বরং বেশ আনন্দ হয়েছে। ওই আপনার বাড়ি এসে গেছে। চলুন, ভেতরে গিয়ে বসা যাক।’