চরিত্র
ট্রেন ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। অপরেশ জানালার ধারে গুছিয়ে বসলেন। স্টেশনে যাঁরা বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাঁদের হাসি জড়ানো সসম্ভ্রম মুখের দিকে অপরেশ শেষবারের মতো তাকালেন। জোড়া জোড়া হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে এখনও বুকের সামনে ঝুলছে। অপরেশ তাঁর মুচকি হাসি, ছড়ানো প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে নিলেন। সবই তাঁর মাপা। সময়ের ফিতে তাঁর পকেটে ঘোরে। তাঁর সাহিত্যও ওই একই গুণে সমৃদ্ধ।
অপরেশ পকেট থেকে একটা দামি লম্বা সিগারেট বের করে ধরালেন। দুটো দিন অনেক সভাসমিতি করলেন। সাহিত্যের আলোচিত অনালোচিত বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক সারগর্ভ কথা এই শহরের মানুষকে শুনিয়ে গেলেন! ক-জন বুঝেছে সন্দেহ! এই সব শিল্পশহরের যান্ত্রিক মানুষ সাহিত্যের কিছু বোঝে বলে মনে হয় না। খায়-দায় বংশ বৃদ্ধি করে আর প্রসাধনের মতো মাঝে মাঝে সাহিত্য শিল্প ধর্ম আদর্শকে পাউডারের মতো ঘাড়ের কাছে লেপ্টে ঘুরে বেড়ায়। মহান সাহিত্য, মহৎ শিল্পকর্ম, দর্শনের গাম্ভীর্যে বোঝার ক্ষমতা হাজারে একজনের হয়তো থাকে, তাঁরা কেউ এই ধরনের সভায় আসেন না। তবু এই সব সভায় আসতে হয়, তা না হলে জনপ্রিয়তা থাকে না। জনপ্রিয়তা না থাকলে বই বিক্রি হয় না। জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে রেখে অপরেশ এই সব ভাবছিলেন। তাঁর আশেপাশে কারা বসে আছেন ভ্রূক্ষেপ করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। মানুষ সম্পর্কে চিরকালই তাঁর একটা উপেক্ষার ভাব আছে।
সন্ধ্যে হয়ে এল। বাইরেটা ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। প্রথম শ্রেণির কামরা। আদৌ ভিড় নেই। বসার সময় অপরেশ একপলকে যেটুকু দেখেছিলেন, সারা কামরায় জনা ছয় যাত্রী বসে আছেন। তিনজন অবাঙালি, মনে হয় ব্যবসায়ী। দুজন বাঙালি। হয়তো উচ্চপদে চাকরি করেন। আর একজন মহিলা। বাঙালিও হতে পারেন, অবাঙালিও হতে পারেন। আধুনিকাদের জাত বোঝা শক্ত।
অপরেশ ভেবেছিলেন অবাঙালি তিনজন না হলেও বাঙালি দু-জন এতক্ষণে যেচে তাঁর সঙ্গে আলাপ করবেন। ট্রেন ছাড়ার প্রাক্কালে সকলেই তাঁর বিদায়পর্ব লক্ষ করেছেন। অপরেশ যে অবশ্যই একজন মানী, গুণী মানুষ তাও বুঝেছেন। অপরেশ নিজে আলাপ করেন নি, করবেনও না; কিন্তু সহযাত্রীদের করা উচিত ছিল। অবাঙালি তিনজন ব্যবসার কথা বলে চলেছেন। বাঙালি দু-জন অফিসের কথা। ভদ্রমহিলা ট্রেন ছাড়ার আগেই ‘হ্যাডলি চেজ’ খুলে বসেছেন। কোনো দিকেই তাঁর দৃকপাত নেই।
অপরেশ ভদ্রমহিলার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। সামনে আয়না নেই। তবু মনে হল তাঁর দৃষ্টিতে হয়তো একটু লোভ, কিংবা কোনো আকাঙ্ক্ষা চুঁইয়ে পড়তে চাইছে। যে দৃষ্টি শিশুর চোখের মতো উদাস নয়, অর্থহীন নয়, তেমন দৃষ্টি দিয়ে কোনো সুন্দরী মহিলাকে দেখা অপরাধ। অপরেশ চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। একটা সুডৌল, সুগৌর হাতের উপর তাঁর চোখ দুটো আটকে রইল।
কী নাম হতে পারে মহিলার! অপরেশ একটা নাম রাখলেন—শিলাবতী। তাঁর পরবর্তী কোনো উপন্যাসের চরিত্রে শিলাবতীকে প্রতিষ্ঠিত করতে আপত্তি কী? বয়স পঁচিশ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। ইংরেজিতে এম. এ.। কলকাতার বাইরের কোনো কলেজের অধ্যাপিকা। অবিবাহিতা। এরপর কী হবে! ছকে বাঁধা রাস্তায় কোনো সহকর্মী প্রেম নিবেদন করবেন। প্রত্যাখ্যান। আত্মহত্যা! অপরেশ নিজের কল্পনার দীনতায় মনে মনে একটু হাসলেন। জীবন থেকে কাহিনি কত দূরে সরে যেতে চায়। মহিলা বই থেকে চোখ তুলে অপরেশের দিকে হঠাৎ তাকালেন। অপরেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মহিলা পাশে রাখা একটা ফ্ল্যাস্কের দিকে হাত বাড়ালেন।
অপরেশ যখন আবার তাকালেন মহিলা তখন ছোটো ছোটো চুমুকে চা খাচ্ছেন। অপরেশের মনে হল তিনি একটা সুখের ছবি দেখছেন। চলন্ত ট্রেনে বই পড়া। চা খাওয়া ঈষৎ আয়েস করে বসা। যে জীবনে সুখ আছে, যে জীবনে ভ্রমণ আছে, রহস্য উপন্যাস আছে, ফ্লাস্কের চা আছে, সে জীবন প্রেমের ফাঁদে পড়বে না। প্রেমে সুখ নেই। প্রেম আষ্টেপৃষ্ঠে দুঃখের ফাঁদে বাঁধা। শিলাবতীর জীবন শুরু করবেন বিবাহের পর থেকে। নামকরা ডাক্তারের স্ত্রী শিলাবতী। কলকাতায় চলেছে মার্কেটিং-এ। শিলাবতীর প্রাক বিবাহিত জীবনের ছবি আঁকার ক্ষমতা অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই অপরেশের।
অপরেশ চায়ের একটা ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করলেন। প্রথম শ্রেণিতে বসে প্ল্যাটফর্মের ভাঁড়ের চা খাওয়া চলে না। অপরেশ চায়ের আশা ছেড়ে দিলেন। চা জুটবে আবার কাল সকালে। ভোরবেলা বিছানার কাছে টি-পয়ের উপর রমলা এক কাপ চা রেখে যাবে। আজ বিশ বছর ধরে এর কোনো ব্যতিক্রম হয় নি। কি শীত কি গ্রীষ্ম। রমলা অপরেশের নিতান্ত সাদামাটা স্ত্রী। তিন সন্তানের জননী। অপরেশ খ্যাতিমান সাহিত্যিক না হয়ে কোনো কারখানার শ্রমিক হলেও রমলার কিছু এসে যেত না। নিতান্তই সাংসারিক স্ত্রী। সংসারধর্ম ছাড়া তার বাড়তি কোনো আকাঙ্ক্ষাও নেই। মোটা-সোটা শ্যামবর্ণ নিতান্তই এক মহিলা। ইদানীং একটু সন্দেহ-প্রবণও বটে। রং এবং শরীরের জন্যে একটু হীনমন্যতাও বোধ হয় দেখা দিয়েছে। কোনো পাঠিকা প্রশংসা করে চিঠি লিখলে রমলা আজকাল কেমন যেন কঠোর হয়ে ওঠে। কোনো সুন্দরী পাঠিকা হঠাৎ অপরেশের সঙ্গে দেখা করতে এলে রমলা প্রথমে কিছু বলে না, পরে গভীর রাতে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এ এক ভালো জ্বালা হয়েছে!
অপরেশের মনে আজকাল একটা ক্ষীণ আপসোস ধূপের ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে ওঠে। জীবন কোনো প্রতিশ্রুতির সীমানা চিহ্ন থেকে শুরু হয় নি। সাধারণ শিক্ষার সাধারণ কেরানি। অল্পস্বল্প লেখার বাতিক ছিল। খ্যাতি এল অতি ধীর পায়ে। জীবনের মধ্য সীমায়। রমলাকে যখন বিয়ে করলেন তখন জীবনে রমলাকে বেমানান মনে হয় নি, মেনে নিতে কোনো অসুবিধে হয় নি। এখন কিন্তু একটু অন্যরকম মনে হয়। মনে হয় সংসারে কাজের লোক পেয়েছেন, সন্তানের জননী পেয়েছেন, সেবার মানুষ পেয়েছেন কিন্তু মনের কোনো সঙ্গী পান নি। শিলাবতীকে রমলার আসনে বসালে কেমন হয়? ট্রেনের কামরার ওপ্রান্তে নয়, একেবারে অপরেশের পাশে, কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে। পরিপাটি পরিচর্যার ফুরফুরে তৈলবিহীন চুল হাওয়ায় উড়ে মাঝে মাঝে মুখে এসে লাগছে। সিল্কের শাড়ির আঁচল উড়ে উড়ে আসছে। গাঢ় নীল ব্লাউজের আবরণ পেরিয়ে শরীরের চিকন শুভ্র অংশে অপরেশের চোখ পড়ছে। অবাঙালি তিনজন হঠাৎ কী এক রসের কথায় হইহই করে হেসে উঠলেন। বাঙালি ভদ্রলোক দু-জনের একজন ব্রিফ কেস খুললেন, ফটফট করে শব্দ হল, বন্দুকের গুলির মতো! ভদ্রমহিলা বই থেকে চোখ তুললেন। চোখাচোখি হল অপরেশের সঙ্গে। অপরেশ একটু অপ্রস্তুত হলেন।
বাইরেটা আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার নদী প্রান্তর দ্রুত পেছিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আলোর বিন্দু আসছে আবার চলে যাচ্ছে। অপরেশ চোখ বুজোলেন। শিলাবতী কি রমলার আসনে বসতে পারবে! ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় ভালোই মানাবে। কিন্তু কলকাতার বাড়িতে। কাকডাকা ভোরে স্নান সেরে শিলাবতী কি বেড-টি দিতে পারবে? পারবে তার পঙ্গু মার সেবা করতে। পারবে অপরেশের পাঞ্জাবি কেচে পরিপাটি করে ইস্ত্রি করে দিতে! শিলাবতীকে জননীর আসনে, গৃহকর্তীর আসনে বসাতে অপরেশের কষ্ট হল। শিলাবতী কমরেড, শিলাবতী স্ত্রী, শিলাবতী জননী নয়। অসম্ভব! প্রকৃতির নিয়মে শিলাবতী হয়তো গর্ভবতী হবে, জননী হবে না। হতে পারে না। শিলাবতীর স্থান তাহলে কোথায়! সাহিত্যিক অপরেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। শিলাবতীকে নিয়ে তিনি কী করবেন! কলকাতার কোনো নামজাদা হোটেলে উঠবেন! নিউ আলিপুরের কোনো বাড়িতে! নিজের জীবনধারায় শিলাবতীকে স্থান দিতে পারলেন না অপরেশ। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানকে শিলাবতীর গলা জড়িয়ে ধরতে দিয়ে অপরেশ মনের চোখে দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করলেন, ভালো লাগল না। শিলাবতী পোষা কুকুরের উপদ্রব সহ্য করবে কিন্তু নিজের সন্তানের গ্রাম্য আদরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। ঝকঝকে গাড়ির পেছনের আসনে কুকুর রেখে শিলাবতী পশু চিকিৎসালয়ে যেতে পারে, কিন্তু তোয়ালে মুড়ে নিজের সন্তানকে কোলে ফেলে রিকশা চেপে রাজপথ দিয়ে কোনো হাসপাতালের আউটডোরে যেতে পারে না, যাওয়া উচিতও নয়। অপরেশ অবশেষে হাল ছেড়ে দিতে চাইলেন। রমলাকে সামনে রেখে তিনি চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন, কল্পনাকে প্রসারিত করতে পারেন, শিলাবতীকে নিয়ে নয়। শিলাবতীর জীবন-পরিকল্পনার কোনো খবরই তাঁর জানা নেই। অপরেশ আবার চোখ বুজোলেন। একটু তন্দ্রার মতো আসছে। অনেক ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন।
ইয়ার্ডে ট্রেন ঢুকছে। অজস্র আলোর লাল চোখ সাঙ্কেতিক ভাষায় ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে। অদৃশ্য কলকব্জার চাপে এক লাইন থেকে আর এক লাইনে ট্রেন পাশে হেঁটে হেঁটে প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে চলেছে। রাত প্রায় দশটা। দূরপাল্লার অধিকাংশ ট্রেন বেরিয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মে তেমন ভিড় নেই। শিলাবতী আগে আগে চলেছেন। কাঁধে ফ্লাস্ক, হাতে একটা দামি স্যুটকেস। অপরেশ পিছনে। শিলাবতীর চলার ধরন, ব্যক্তিত্বের ছাপ মনে ধরে রাখতে চাইছেন। দৃশ্যটা চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে। হঠাৎ দেখা, আবার মিলিয়ে যাওয়া।
স্টেশনের বাইরে একটা মেরুন রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ঝকঝকে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পাজামা পাঞ্জাবি পরা ঋজু বনেদি চেহারা। হাতে ওয়ালনাটের ছড়ি। পায়ে ভেলভেটের চটি। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা। কোলে একটি ফুটফুটে দুরন্ত শিশু। মুখের ভাবে শিলাবতীর আদল আসে। শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্যে অপরেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
শিলাবতী দ্রুত বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে বৃদ্ধকে প্রণাম করলেন। বৃদ্ধ বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখলেন। বৃদ্ধের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে শিলাবতী মহিলাকে চুম্বন করার ভঙ্গি করলেন, শিশুটিকে ছিনিয়ে নিলেন নিজের কোলে। শিশুটি একহাতে শিলাবতীর চুল খামচে ধরল। কষ্টে কেশ মুক্ত করে শিশুটিকে আদরে আদরে অস্থির করলেন। শিশুটি কেঁদে ওঠায় সকলে সমস্বরে হেসে উঠলেন। মিলন পর্ব শেষ হল। গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ হল। বৃদ্ধই গাড়ি চালাবেন।
অনেকক্ষণ হল গাড়িটা চলে গেছে। পেছনের লাল আলো অপসৃয়মাণ স্মৃতির মতো পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল। নির্জন রাস্তায় অপরেশ দাঁড়িয়ে। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। একটা খালি ট্যাক্সির প্রয়োজন কিন্তু শিলাবতীদের চিন্তায় এতই আচ্ছন্ন যে দৌড়ঝাঁপ করার শক্তিটাই যেন চলে গেছে। কাপড়ের কোঁচা লুটোচ্ছে পায়ের কাছে।
ধূপের ধোঁয়ার মতো ক্ষীণ আক্ষেপ যেন হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। শিলাবতীকে সহজেই রমলার আসনে বসানো যায়। বসন্তকালের মতো হাওয়া দিচ্ছে। অপরেশের মনে হল সে যেন কতকালের বিরহী। দুঃসহ একটা বেদনার বোঝা নিয়ে রাজপথে মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় কেউ যদি তাকে হাত ধরে নিয়ে যায় ভালো হয়। শিলাবতীকে নিয়ে সে উপন্যাস লিখবে। তার পরবর্তী কাহিনির নায়ক হবে অপরেশ নায়িকা শিলাবতী। কী নাম রাখবে? সারাটা পথ একটা নামের সন্ধানে কখন ফুরিয়ে গেল অপরেশ টের পেলেন না। মনে হল সময় ইদানীং বড়ো সংক্ষিপ্ত।