সাত
উপেন্দ্র চিঠিখানি শেষ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, মুখ তুলিয়া হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা।
তাহার পরক্ষণ হইতে দিবাকর কেবলই ভাবিতে লাগিল তাহার বিবাহের কথা। শচী কেমন, সে কি করে, কি ভাবে, কি পড়ে, তাহার সহিত বিবাহ হইলে কিরূপ ব্যবহার করিবে, এই-সব। রাত্রে পড়াশুনায় অত্যন্ত ব্যাঘাত ঘটিতে লাগিল। আজ তাহার মন মাতাল হইয়া উঠিল। অথচ মাতাল যেমন তাহার কল্পনার আতিশয্যে স্পষ্ট করিয়া কিছুই ভাবিতে পারে না, তাহার মনও তেমনি সুস্পষ্ট কিছুই উপলব্ধি না করিতে পারিয়া আকাশ-কুসুম গাঁথিয়া ফিরিতে লাগিল, কিছুতেই কাজ করিল না।
পরীক্ষার ভয় চাবুকের মত যতবার তাহাকে ফিরাইয়া আনিয়া পাঠে নিযুক্ত করিল, ততবারই সে উধাও হইয়া গিয়া আর একদিকে স্বপ্ন রচনা করিতে লাগিল। বহুক্ষণ অবধি এই বিদ্রোহী মনের পিছনে ছুটাছুটি করিয়া কিছুই না করিতে পারিয়া দিবাকর অনুতাপ করিতে লাগিল যে, তাহার সময় বৃথা নষ্ট হইয়া যাইতেছে। কিন্তু কি অভূতপূর্ব পরিবর্তন! কিসের নেশা যে তাহাকে অকস্মাৎ এমন মাতাল করিয়া তুলিয়াছে, তাহার হেতু খুঁজিতে গিয়াই যে কথা মনে আসিল, অত্যন্ত লজ্জার সহিত দিবাকর তাহার প্রতিবাদ করিয়া দৃঢ়ভাবে এই কথা বলিল যে, ইহাতে তাহার সম্পূর্ণ অনিচ্ছা এবং একান্ত বিতৃষ্ণা। যদি পূজনীয় কাহারো মন এবং মান রক্ষা করিতেই হয় ত নিতান্ত উদাসীনের মতই করিবে। এই বলিয়া দ্বিগুণ আগ্রহের সহিত উচ্চকণ্ঠে পড়িতে আরম্ভ করিয়া দিল। কিন্তু মনকে আজ সংযমে রাখা শক্ত। সে যে খেলার মাঝখান হইতে চলিয়া আসিতেছে, যে আকাশ কুসুমের অর্ধেক গাঁথা মালা ফেলিয়া রাখিয়া জবরদস্তি পড়া মুখস্থ করিতেছে তাহা সম্পূর্ণ করিবার সুযোগ অনুক্ষণ খুঁজিয়া ফিরিতে লাগিল। তা ছাড়া এই যে কল্পনার বসন্ত বাতাস এইমাত্র তাহার দেহ স্পর্শ করিয়া গিয়াছে, সে স্পর্শ কি মধুর! তাহার চতুর্দিকে যে সৌন্দর্য-সৃষ্টি চলিতেছিল—সে কি সুন্দর! সূর্যের দিকে মুখ তুলিয়া চক্ষু বুজিলেও যেমন আলোকের সঞ্চার বিচিত্র বর্ণে অনুভূত হইতে থাকে, পড়া তৈরির একান্ত চেষ্টার মধ্য দিয়াও অস্পষ্ট মাধুর্যের সাড়া তেমনি করিয়া তাহার সমস্ত দেহে ধীরে ধীরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতে লাগিল। কণ্ঠস্বর তাহার মন্দ হইতে মন্দতর, দৃষ্টি তাহার ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসিতে লাগিল এবং এই-সমস্ত ধরপাকড় বাদাবাদির মাঝখানে হঠাৎ এক সময়ে সে নিজেই এই নূতন খেলায় মাতিয়া গেল। তাহার চোখের সুমুখে অসংখ্য আলো, কানের কাছে অগণিত বাদ্য ও মনের মাঝখানে একটা বিবাহের বিরাট সমারোহ অবতীর্ণ হইয়া আসিল; এবং ইহারই কেন্দ্রস্থলে সে নিজেকে বরবেশে কল্পনা করিয়া রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তাহার পরে এ পর্যন্ত যত-কিছু সে শুনিয়াছিল, যাহা-কিছু সে দেখিয়াছিল, ছায়াবাজির মত সমস্তই মনের মাঝখান দিয়া বিচিত্র বর্ণে অসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটিয়া চলিয়া গেল। কোথাও সে স্থির হইতে পারিল না, কিছুই ঠিকমত হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না, শুধু বিস্মিত পুলকে স্বপ্নাবিষ্টের মত স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
আট
বিপিনের নিমন্ত্রণ রাখিয়া আসার পরদিন আকণ্ঠ পিপাসা লইয়া সতীশচন্দ্র যখন ঘুম ভাঙ্গিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিল, তখন বেলা দশটা। তাহার ঘর তখনও বন্ধ। আজ সকাল হইতেই মেঘমুক্ত আকাশে রৌদ্র অত্যন্ত প্রখর হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছিল, সেই খর-উত্তাপে সমস্ত জানালা-দরজা তাতিয়া উঠিয়া এই রুদ্ধ ঘরের ভিতরটা যে কিরূপ অসহ হইয়াছিল, তাহা এতক্ষণ সে নিজে টের না পাইলেও তাহার সর্বশরীর ইহার জবাবদিহি করিতেছিল।
সমস্ত বিছানা ঘামে ভাসিয়া গিয়াছে এবং সমস্ত অন্তরিন্দ্রিয় জলের অভাবে উন্মত্তের মত হাহাকার করিতেছে। এমনিধারা দেহ-মন লইয়া সতীশচন্দ্র ভগবানের নূতন দিনের মধ্যে সচেতন হইয়া উঠিয়া বসিল, এবং ব্যস্ত হইয়া শিয়রের জানলাটা খুলিয়া ফেলিতেই এক ঝলক রৌদ্র তাহার মুখের উপর গায়ের উপর পড়িয়া যেন তাহাকে একমুহহূর্তে দগ্ধ করিয়া দিয়া গেল।
সমস্ত রাত্রি মাতামাতি করিয়া বেলা দশটায় ঘুম ভাঙ্গার গ্লানি মাতালেই জানে। এই গ্লানি পরিপাক করিয়া সতীশ, বেহারী বেহারী, করিয়া ডাকিতে লাগিল। বেহারী ছুটিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল।
সতীশ বলিল, শিগগির এক গ্লাস জল আন ত রে!
বেহারী প্রশ্ন করিল, তামাক দিতে হবে না?
না, জল আন।
চান করবেন না?
এখন না, তুই জল আন।
বেহারী তথাপি গেল না, কহিল, আহ্নিকের—
আহ্নিকের ইঙ্গিতে সতীশ আগুন হইয়া ধমক দিয়া উঠিল, পাজী কোথাকার, তোর অত খোঁজ কেন? যা, জল আন গে!
ধমক খাইয়া বেহারী জল আনিতে নীচে নামিয়া গেল। রান্নাঘরের বারান্দায় বসিয়া সাবিত্রী সুপারি কুচাইতেছিল, স্মিতহাস্যে জিজ্ঞাসা করিল, সতীশবাবু তামাক দিতে বললেন?
বেহারী মুখ ভার করিয়া কহিল, না, জল চাই।
স্নান করলেন না, আহ্নিক করলেন না—জল কি হবে?
বেহারী বিরক্ত হইয়া বলিল, আমি তার জানি কি! হুকুম হলো জল চাই, নিয়ে যাচ্চি।
সাবিত্রী জাঁতি রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আচ্ছা, আমিই নিয়ে যাচ্ছি—তুমি খানিকটা বরফ কিনে আনো গে।
বেহারী পয়সা লইয়া বরফ কিনিতে গেল।
সাবিত্রী উপরে উঠিয়া গিয়া কহিল, যান, চান করে আসুন, আমি ততক্ষণ আহ্নিকের জায়গা করে রাখি।
সতীশ মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল, বেহারী কোথায়?
সাবিত্রী হাসি চাপিয়া বলিল, সে বরফ কিনতে গেছে। বাবু, দোষ করে শাস্তি নেওয়া ভাল—তাতে প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়। আপনি সন্ধ্যে-আহ্নিক না করে কোনও দিন কি জল খান যে, আজ জলের জন্যে হাঙ্গামা কচ্ছেন? যান, দেরী করবেন না।
সাবিত্রীর কাছে প্রতিবাদ নিষ্ফল বুঝিয়া সতীশ উঠিয়া পড়িল এবং তোয়ালে কাঁধে ফেলিয়া স্নান করিতে নামিয়া গেল।
আহারান্তে সতীশ আর একবার নিদ্রার আয়োজন করিতেই সাবিত্রী আসিয়া দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইল। তাহাকে যেন দেখিতেই পায় নাই এইভাবে সতীশ দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া পড়িল।
সাবিত্রী মনে মনে হাসিয়া বলিল, রাত্রের কথাগুলো বাবুর মনে আছে কি না জানতে এলুম।
সতীশ জবাব দিল না।
সাবিত্রী কহিল, তবে ঘুম ভাঙ্গলে দয়া করে একবার ডেকে পাঠাবেন, সেগুলো একবার মনে করে দিয়ে যাবো। বলিয়া কবাট বন্ধ করিয়া চলিয়া গেল।
বিগত রাত্রির সমস্ত ঘটনা সতীশের মনে থাকা সম্ভবও নয়, ছিলও না। বিপিনবাবুর মজলিস হইতে কখন কেমন করিয়া আসিয়াছিল, কাহার সহিত আসিয়াছিল, আসিয়া কি করিয়াছিল—এ-সমস্ত তাহার মনের মধ্যে এলোমেলো ও অস্পষ্ট হইয়াছিল। এই অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করিবার স্পৃহা যে তাহার একেবারেই ছিল না তাহা নহে, কিন্তু একটা অনির্দেশ্য লজ্জার আশঙ্কা তাহাকে যেন কোনমতেই পা বাড়াইতে দিতেছিল না। তাহার সান্ধ্য কীর্তিটাই মনে ছিল। এইটাই এতক্ষণে তাহার মেঘাচ্ছন্ন স্মৃতির আকাশে শুকতারার মত জ্বলিতেছিল, কিন্তু অধিকতর জ্যোতিষ্মান্ দুষ্টগ্রহও যে ওই মেঘের আড়ালেই উদ্যত হইয়া আছে, সাবিত্রীর ইঙ্গিত সেইদিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করিবামাত্রই তাহার চোখের ঘুম মরুভূমির বাষ্পের মত উবিয়া গেল। গত সন্ধ্যায় হতবুদ্ধি হইয়া প্রদীপ নিবাইয়া ফেলার ফলটা যে শেষ পর্যন্ত কিরূপ দাঁড়াইবে, সে সম্বন্ধে তাহার মনে যথেষ্ট উৎকণ্ঠা ছিল; কিন্তু তথাপি তাহার মধ্যে সত্যকার দোষ কিছুই ছিল না বলিয়া তাহাকে দুর্ভাগ্য বলিয়া সে একরকম করিয়া সান্ত্বনা লাভ করিতেছিল এবং দোষ না করার মধ্যে যে একটা সত্যকার জোর প্রচ্ছন্ন হইয়া থাকে সেই জোর তাহার অজ্ঞাতসারেও তাহাকে আশ্রয় দিতেছিল, কিন্তু সাবিত্রী এখন যাহা বলিয়া গেল, যে অন্ধকারের মধ্যে পথ নির্দেশ করিয়া গেল, তাহার মধ্যে প্রবেশ করিবার সাহস তাহার কোথায়? তাহার মাতাল হইবার অভিজ্ঞতা ছিল বটে, কিন্তু অচেতন হইয়া পড়িবার অভিজ্ঞতা সে কোথায় পাইবে? সে কেমন করিয়া আন্দাজ করিবে, সে কি করিয়াছিল না-করিয়াছিল! কত মাতালকে কত কাণ্ড করিতে সে ত নিজের চোখেই দেখিয়াছে। এখন নিজের বেলা কোন্ কাজটাকে সে কি সাহসে অসম্ভব বলিয়া দূরে সরাইয়া দিবে? তাই এই সম্ভব-অসম্ভবের সমস্যা তাহার যতই জটিল হইয়া উঠিতে লাগিল, পীড়িত-চিত্ত তাহার ততই সম্ভব-অসম্ভবের মধ্যে রেখা টানিয়া দিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। পুনর্বার তাহার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিয়া উঠিল এবং আর একবার উঠিয়া বসিয়া জীবনে মদ স্পর্শ না করিবার প্রতিজ্ঞা আবার একবার উচ্চারণ করিয়া সে প্রায়শ্চিত্ত করিল।
জানালা খুলিয়া দিয়া সতীশ ডাকিল, বেহারী!
বেহারী রাখালবাবুর বিছানা রোদে দিতেছিল, ডাক শুনিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
সতীশ বলিল, আচ্ছা, যা কচ্চিস কর—সাবিত্রীকে এক গ্লাস জল আনতে বলে দে!
বেহারী বলিল, আমিই আনচি বাবু, তিনি এখন আহ্নিক করচে।
সতীশ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আহ্নিক করচে কি রে?
আজ্ঞে, তিনি ত রোজ করে। একাদশীর দিনে একফোঁটা জলও খায় না। আমরা কত বলি বাবু, কিন্তু তিনি মাছও খায় না, রাত্তিরেও খায় না—তিনি ভদ্দরনোক কিনা তাই।
সতীশ অধিকতর আশ্চর্য হইয়া বলিল, ভদ্দরলোক কি রে—
হাঁ বাবু, ভদ্দরনোক। বলিয়া বেহারী জল আনিতে যাইতেছিল, সতীশ ডাকিয়া বলিল, সাবিত্রী রাত্রে যদি ভাত খায় না তবে কি খায়?
কি আর খাবে বাবু! থাকলে কোনদিন একটু জলটল খায়—না থাকলে কিছুই খায় না।
বাসার আর কেউ জানে?
বেহারী বলিল, ঠাকুরমশায় জানে, আমি জানি, আর কেউ জানে না। তিনি বলতে মানা করে দেছে।
সতীশ বলিল, আচ্ছা, তুই জল আন।
বেহারী দুই-এক পা যাইতেই সতীশ পুনর্বার ডাকিল, আচ্ছা বেহারী—
আজ্ঞে?
ভদ্দরলোক তুই জানলি কেমন করে?
জানি বৈ কি বাবু! ভদ্দরনোকের মেয়ে শুধু অদেষ্টের ফেরে—
আচ্ছা আচ্ছা, তুই যা জল আন।
বেহারী চলিয়া গেলে সতীশ বিছানার উপর উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল। সাবিত্রীকে সাধারণ দাসীর সহিত এক করিয়া দেখিতে কোথায় যে তাহার একটা ব্যথা বাজিত, কেন যে মন তাহার হীনতা ও গুপ্ত লাঞ্ছনার চাপে নিঃশব্দে মাথা হেঁট করিত, তাহা সে কিছুতে ধরিতে পারিতেছিল না। আজ বেহারীর মুখের এতটুকু পরিচয়েই শুধু আনন্দিত বিস্ময়ে নহে, তাহার সমস্ত মন যেন কোন আপরিচিতের ক্লেদাক্ত বাহুপাশ হইতে অকস্মাৎ মুক্তি
পাইয়া পবিত্র হইয়া বাঁচিল। সে বেহারীর কথাটাকে সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে একমুহূর্ত দ্বিধা করিল না।
জল আনিতে বিলম্ব হইতে লাগিল। কোন কারণে দেরী হইতেছে মনে করিয়া সে খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তবু বেহারীর দেখা নাই। পিপাসায় তাহার ক্লেশ বোধ হইতে লাগিল, সে আর একবার বেহারীকে ডাকিবে মনে করিয়া উঠিয়া বসিয়াই দেখিল জলের গ্লাস হাতে লইয়া সাবিত্রী আসিতেছে। এই আচারপরায়ণা হতভাগিনীকে
আজ সে নূতন চক্ষে দেখিল এবং সেই পলকের দৃষ্টিপাতেই তাহার হৃদয়ের অন্ধ্র-রন্ধ্র করুণায় ও শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ
হইয়া উঠিল। যে কথা অন্য কোন সময়ে তাহার মুখে বাধিত, এখন বাধিল না। সে হাত হইতে জলের গ্লাস লইয়া সমস্তটুকু নিঃশেষে পান করিয়া খালি গ্লাস নীচে রাখিয়া দিয়া বলিল, অনেক কথা আছে।
সাবিত্রী মৌন-মুখে চাহিয়া রহিল।
সতীশ বলিল, প্রথম দফায় আমাকে মাপ করতে হবে।
সাবিত্রী শান্ত-কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, দ্বিতীয় দফায়?
সতীশ বলিল, কাল কখন কি করে এসেছিলাম বলতে হবে।
সাবিত্রী উত্তর দিল, শেষ রাত্রে গাড়ি করে।
তার পরে?
রাস্তার উপরেই শোবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ভাল করিনি। তুলে আনলে কে?
আমি।
আর কে ছিল? এতবড় জড় পদার্থটাকে ওপরে তোলা হলো কি প্রকারে?
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, আপনার ভয় নেই—বাসায় কেউ কিছুই জানে না।
সতীশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বাঁচলাম! কিন্তু তোমার সঙ্গে কোন রকমের দুর্ব্যবহার করিনি ত?
না।
সতীশ অতিশয় প্রফুল্ল হইয়া বলিল, তবে কি কথা মনে করে দিতে চাচ্ছিলে?
আপনার শপথ। আপনি দিব্যি করেছেন আর কোন দিন মদ খাবেন না।
হঠাৎ দিব্যি করতে গেলাম কেন? এ-রকম দুর্বুদ্ধি ত আমার হবার কথা নয়।
বোধ করি আমার কথায় হয়েছিল।
সতীশ কণ্ঠস্বর নত করিয়া বলিল, আমার মনে পড়েছে সাবিত্রী। তোমাকে ছুঁয়ে শপথ করেছি, না?
সাবিত্রী নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।
সতীশ বলিল, তাই হবে; কিন্তু, কাল সন্ধ্যার কথাটা তোমার মনে আছে ত?
এবার সাবিত্রী হাসিয়া ফেলিল। ঘাড় নাড়িয়া সাবিত্রী বলিল, আছে।
লোকে শুনতে পাবে বোধ হয়; তার উপায় হবে কি?
সাবিত্রী সহসা গম্ভীর হইয়া বলিল, হবে আবার কি! অন্য কোন বাসায়, না হয় বাড়ি চলে যান।
তুমি?
সাবিত্রীর মুখে কোনরূপ উদ্বেগ প্রকাশ পাইল না। শান্ত সহজভাবে বলিল, আমি ভাবিনে। এ বাসার বাবুরা রাখেন, ভালোই; না রাখেন আর কোথাও কাজের চেষ্টা করে চলে যাব; যেখানে খাটবো, সেইখানেই দুটি খেতে
পাব। আর কোন কথা আছে?
সতীশের সমস্ত মন যেন পর্বতের শিখর হইতে গড়াইয়া পাদমূলে পড়িয়া একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেল। তাহার এখানে থাকা না থাকায় সাবিত্রীর কিছু আসে যায় না। এ সম্বন্ধে সে একেবারে উদাসীন! সে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আর তাহার কোন কথা বলিবার নাই। কারণ, সাবিত্রীর এই নিঃশঙ্ক সংক্ষিপ্ত জবাবের পরে আর কোন প্রশ্নই তাহার মুখে আসিল না। অথচ, কত কথাই না তাহার বলিবার ছিল। সাবিত্রী খালি গ্লাসটা তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল, সতীশ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
হায় রে মানুষের মন! এ যে কিসে ভাঙ্গে, কিসে গড়ে, তাহার কোন তত্ত্বই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। এই যে কতটুকু আঘাতে একেবারে মাটিতে লুটাইয়া পড়ে, আবার কত প্রচণ্ড আঘাতও হাসিমুখে সহ্য করে তাহার কোন হিসাবই পাওয়া যায় না। অথচ, এই মন লইয়া মানুষের অহঙ্কারের অবধি নাই। যাহাকে আয়ত্ত করা যায় না, যাহাকে চিনিতে পর্যন্ত পারা যায় না, কেমন করিয়া ‘আমার’ বলিয়া তাহার মন যোগানো যায়! কেমন করিয়াই বা তাহাকে লইয়া নিরুদ্বেগে ঘর করা চলে!
সাবিত্রী অনেকক্ষণ চলিয়া গেলেও সতীশ তেমনিভাবে বসিয়া রহিল। তাহার অন্তরটা ঠিক দুঃখে-কষ্টে নয়, কি একরকমের জ্বালায় যেন জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠিতে লাগিল। যাহাকে ভালবাসি, সে যদি ভাল না বাসে, এমন কি ঘৃণাও করে, তাও বোধ করি সহ্য হয়, কিন্তু যাহার ভালবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি, সেইখানে ভুল ভাঙ্গিয়া যাওয়াটাই সবচেয়ে নিদারুণ! পূর্বেরটা ব্যথাই দেয়, কিন্তু শেষেরটা ব্যথাও দেয়, অপমানও করে। আবার এ ব্যথার প্রতিকার নাই, এ অপমানের নালিশ নাই। যাহার ভালবাসিবার কথা নহে, সে ভালবাসে না—ইহাতে কাহারও কি বলিবার থাকে! তাই, এই না-থাকাটাতেই লাঞ্ছনা এত বেশী বাজে—বেদনার হেতু খুঁজিয়া মিলে না বলিয়াই ব্যথা এমন অসহ্য হইয়া পড়ে।
যাহা হউক, সাবিত্রীর এই নিশ্চিন্ত ও সরল কর্তব্য নির্ধারণ শুধু তাহার একলার হৃদয়ের মানচিত্রটাই উদ্ঘাটিত করিল না, তাহা সতীশের নিজের হৃদয়ের ছবিটাও বাহিরের আলোকে টানিয়া আনিয়া ফেলিল। এই দু’খানি মানচিত্রকে পাশাপাশি রাখিয়া সে স্তম্ভিত হইয়া রহিল। সে নিশ্চিত জানিয়াছিল, সাবিত্রী ভালবাসে, সে বাসে না। এখন দেখিল ঠিক বিপরীত, সেই বাসে, সাবিত্রী বাসে না। এই ঘৃণিত কথাটা স্বীকার করিতে শুধু লজ্জাতেই তাহার মাথা কাটা গেল না, নিজের মনের এই নীচ প্রবৃত্তিতে তাহার নিজের উপরে ঘৃণা জন্মিয়া গেল। তাহার গত রাত্রির কাজগুলা লজ্জাকর সন্দেহ নাই; তাহার জীবনে এমন অনেক রাত্রির অনেক লজ্জা জমা হইয়া আছে সত্য, কিন্তু এই ইতরতার তুলনায় সে-সমস্তই একেবারে অকিঞ্চিৎকর হইয়া গেল!
এ বাসায় ত আর একদিনও থাকা চলিবে না। এখানে থাকা না থাকা সম্বন্ধে সে যে সম্পূর্ণ উদাসীন নয়, এ কথা সে ত কোনও মতেই স্বীকার করিতে পারিবে না। সে কঠোর প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিল যে, বেদনার গুরুভারে মন যদি তাহার ভাঙ্গিয়া অণু-পরমাণু হইয়াও যায়, তথাপিও না। কোনমতেই এই নীচতাকেই প্রশ্রয় দিয়া সে একেবারে অধঃপথে যাইবে না।
বাহিরে যে বেলা পড়িয়া আসিতেছিল, ঘরের মধ্যে সতীশের হুঁশ ছিল না। সহসা বাসায় প্রত্যাগত কেরানীদের শব্দ-সাড়ায় সে চকিত হইয়া জানালার বাহিরে উঁকি মারিয়াই বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল এবং তৎক্ষণাৎ একটা পিরান গায়ে দিয়া চাদর কাঁধে ফেলিয়া অলক্ষিতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। এখনি হাত-মুখ ধুইবার প্রস্তাব লইয়া সাবিত্রী আসিয়া পড়িবে এবং খাবার জন্য জিদ করিতে থাকিবে। আজ তাহার কিছুমাত্র ক্ষুধা ছিল না; কিন্তু সাবিত্রী সে কথা কোনমতে বিশ্বাস করিবে না, অনুরোধ করিবে, পীড়াপীড়ি করিবে, হয়ত বা শেষে রাগ করিয়া চলিয়া যাইবে। এই-সমস্ত মৌখিক স্নেহের বাগ্বিতণ্ডা হইতে তাহার জীবনে আজ এই প্রথম সে নিজকে অকৃত্রিম ঘৃণার সহিত দূরে সরাইয়া লইয়া গেল।
পথে ঘুরিতে ঘুরিতে সন্ধ্যার প্রাক্কালে দর্জিপাড়ার একটা গলির মোড়ে হঠাৎ পিছনে পরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনিতে পাইল—ছোটবাবু না?
সতীশ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, হ্যাঁ, মোক্ষদা নাকি?
মোক্ষদা বহুদিন পূর্বে তাহাদের পশ্চিমের বাড়িতে দাসীর কাজ করিত, ছুটি লইয়া কলিকাতায় আসিয়া আর ফিরিতে পারে নাই। বলিল, হাঁ বাবু, আমি। ছোটবাবু, আমার একখানা চিঠি পড়ে দেবেন?
সতীশ হাসিমুখে বলিল, এতবড় শহরে একখানি চিঠি পড়িয়ে নেবার আর কি লোক পেলে না ঝি? কৈ, চিঠি কোথায়?
ঝি বলিল, চিঠিখানি আমার ঘরে আছে বাবু। সাহস করে অচেনা লোককে দিয়ে পড়াতে পারিনি, পাছে আর কিছু বা থাকে। তবে আমাদের বাড়িতেই একটি মেয়ে আছে, সে লিখতে পড়তে জানে, কিন্তু তাকেও আজ দু’দিন ধরে পাচ্চিনে, এত রাত্তির করে বাড়ি ফেরে যে তখন আর সময় হয় না।
সতীশ জিজ্ঞাসা করিল, বাড়ি তোমার কত দূরে?
ঝি বলিল, এখান থেকে একটু দূর পড়ে বৈ কি! বড় রাস্তার ওধারে একটা গলির মধ্যে। বাবু, যদি আপনার ঠিকানাটা বলে দেন, তা হলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে আমি না হয় কালই যাই, চিঠিটা পড়িয়ে আনি।
আচ্ছা, বলিয়া সতীশ তাহার শোভাবাজারের ঠিকানাটা বলিয়া দিল, এবং কোথা দিয়া কেমন করিয়া যাইতে হয়, বুঝাইয়া বলিতে বলিতে পথ চলিতে লাগিল। কতক্ষণ আসার পরে ঝি এক জায়গায় হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, বলতে সাহস পাইনে বাবু, যদি একবার পায়ের ধূলা দেন, ঘর আমার এখান থেকে আর বেশী দূরে নয়।
সতীশ ক্ষণকাল কি ভাবিয়া বলিল, আচ্ছা চল।
তাহার আজ বাসায় ফিরিতে একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। পথে পথে ঘুরিয়া রাত্রি অধিক হইলে, সাবিত্রী ঘরে চলিয়া গেলে বাসায় ফিরিবে, এই সঙ্কল্প করিয়াই সে বাহির হইয়াছিল। তাই, সহজেই সম্মতি দিয়া গোটা-দুই গলি পার হইয়া তাহারা একটা মেটে দোতলা বাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
‘একটু দাঁড়ান’, বলিয়া মোক্ষদা ভিতরে প্রবেশ করিল এবং অনতিবিলম্বে একটা কেরোসিনের ডিবা হাতে লইয়া ফিরিয়া আসিয়া পথ দেখাইয়া উপরে লইয়া গেল। ওধারের কোণের ঘরে একটি ছোট টুলের উপর পিতলের পিলসুজে প্রদীপ জ্বলিতেছিল, সেই ঘরখানি দেখাইয়া দিয়া সবিনয়ে বলিল, একটু বসুন, আমি তামাক সেজে আনি।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া এই ছোট ঘরটির পরিচ্ছন্নতা দেখিয়া সতীশ আরাম বোধ করিল। একধারে একটা জলচৌকির উপর মাজাঘষা কতকগুলি পিতল-কাঁসার বাসন ঝকঝক করিতেছে এবং তাহারই পাশে একটি ছোট আলনাতে কয়েকটি কাপড় গোছান রহিয়াছে। দেওয়ালে ব্রাকেটের উপর একটি টাইমপিস ঘড়িতে আটটা বাজিয়া গেল। সতীশ চৌকাঠের বাহিরে জুতা খুলিয়া রাখিয়া তক্তপোশে পাতা সাদা ধবধবে বিছানাটির উপর গিয়া বসিল এবং ঘরের অন্যান্য আসবাবগুলির মনে মনে পরীক্ষা লইতে লাগিল। প্রথমেই নজর পড়িয়া গেল একটি ছোট শেল্ফের উপরে। কতকগুলি বই সাজানো ছিল, সতীশ উঠিয়া গিয়া একখানা সংগ্রহ করিয়া আনিল এবং প্রথম পাতা উলটাইতেই দেখিতে পাইল, ইংরাজী অক্ষরে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নাম লেখা। সে বইখানি রাখিয়া দিয়া আরও তিন-চারিখানি বই খুলিয়া ওই একই নাম দেখিয়া বইগুলি যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল।
মোক্ষদা বাঁধা হুঁকায় তামাক সাজিয়া আনিল।
সতীশ হুঁকা হাতে লইয়া বলিল, ঝির ঘরটি চমৎকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, উঠতে ইচ্ছে করে না।
মোক্ষদা একটুখানি হাসিয়া বলিল, উঠবেন কেন বাবু, বসুন। এ ঘরটি কিন্তু আমার নয়, আর একটি মেয়ের।
সতীশ প্রশ্ন করিল, তিনি কোথায়?
মোক্ষদা বলিল, সে এক বাবুদের বাসায় কাজ করে। আসতে প্রায়ই রাত হয়ে যায়, তাই ঘরের চাবি আমার কাছে থাকে। আমাকে মাসী বলে ডাকে।
সতীশ বলিল, তা ডাকুক, কিন্তু ভুবনবাবুটি আসবেন কখন?
ঝি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ভুবনবাবু আবার কে?
ভুবনচন্দ্র মুখুয্যে—চেনো না?
অকস্মাৎ ঝি ভ্রূ প্রসারিত করিল—ও! আমাদের মুখুয্যেমশাই? না না, তাঁকে আর আসতে হবে না!
কেন, মারা গেছেন নাকি?
মোক্ষদা দুই চক্ষু দৃপ্ত করিয়া বলিল, না, মারা যাননি, কিন্তু গেলেই ছিল ভাল। তিনি বামুনমানুষ, বর্ণের গুরু, আমাদের মাথার মণি, নারায়ণতুল্য। তাঁকে অভক্তি করছি নে, তাঁর চরণের ্ধূলো নিচ্চি; কিন্তু কোনদিন দেখা পেলে তিনটি ঝ্যাঁটা মুখে গুনে মারব, তবে আমার নাম মোক্ষদা।
সতীশ হাসিয়া উঠিল। বলিল, রাগের মাথায় বামুনমানুষকে যেন অভক্তি করে মেরে বসো না! বেশ ভক্তি করে গুনে গুনে মেরো, তাতে পাপ হবে না। কিন্তু তিনি লোকটি কে?
মোক্ষদা উদ্ধতভাবে বলিয়া উঠিল, লোকটির পরিচয় আর কি দেব বাবু, তিনি মানুষ নয়, চামার। এই মেয়েটিকে যে পথে বসিয়ে গেলি বাপু, এই কি তোর আপনার লোকের কাজ হলো? ছি ছি, গলায় দেবার দড়ি জুটল না!
সতীশ অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল, কে তিনি? কি করেছেন তিনি?
হঠাৎ দ্বারের বাহির হইতে জবাব আসিল, লোকটিকে আপনি চেনেন না, কি হবে আপনার তাঁর কথা শুনে?
সতীশ চমকিয়া উঠিল।
মোক্ষদা মুখ ফিরাইয়া কহিল, সাবি নাকি! কখন এলি তুই?
সাবিত্রী ঘরে ঢুকিয়া বলিল, এইমাত্র আসছি। বাবুটিকে কোথায় পেলে মাসী?
মোক্ষদা কহিল, ইনিই আমাদের ছোটবাবু, সাবিত্রী। আজ দু’দিন হলো বৌমার কাছ থেকে একখানি চিঠি পেয়েছি, তা পড়াতে পাইনি, তাই বললুম বাবু যদি দয়া করে পায়ের ধূলো দেন।
সাবিত্রী বলিল, তবে পায়ের ধূলো তোমার ঘরে না দিয়ে আমার ঘরে কেন?
মোক্ষদা ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, তা রাগ করিস কেন সাবি, আমার ঘরে ত ভদ্রলোককে বসানো যায় না, তাই তোর ঘরে বসিয়েছি। কত বড়দরের লোক এঁরা—কোথায় আহ্লাদ করবি, না রাগ করছিস?
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, রাগ করব কেন মাসী, রাগ নয়। কিন্তু অমনি অমনি পায়ের ধূলো নিলে যে পাপ হয়। কিছু জলযোগ করান উচিত—হাঁ বামুনঠাকুর, আপনার ক্ষিদে পেয়েছে কি?
সতীশ অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বসিয়াছিল, ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।
সাবিত্রীর অভদ্র প্রশ্নে বিরক্ত হইয়া মোক্ষদা বলিয়া উঠিল, এ তোর কি-রকম কথার ছিরি সাবিত্রী। ভদ্রলোকের সঙ্গে কি এইরকম করে কথা কইতে হয়?
সাবিত্রী জোর করিয়া হাসি চাপিয়া বলিল, এ আর মন্দ কথা কি মাসী? আচ্ছা, ওঁর ক্ষিদের কথা না হয় আর জিজ্ঞাসা করব না, তুমি কিন্তু দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে আনো, আমি ততক্ষণ জায়গা করে রাখি।
মোক্ষদা অস্ফুটে বকিতে বকিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেলে সাবিত্রী কহিল, কাল রাত থেকেই ত একরকম উপোস চলছে—বিকেলবেলা যে কেমন করে পালিয়ে এলেন তাও টের পেলুম না। এখন উঠুন, সন্ধে-আহ্নিক করে কিছু
খান। ওই আলনার ওপরে কাচা কাপড় আছে, পরে আমার সঙ্গে আসুন—না না, দেরী নয়, উঠুন।
সতীশ মাথা নাড়িয়া বলিল, আমার ক্ষিদে নেই।
সাবিত্রী বলিল, না থাকলেও খেতে হবে। তার প্রথম কারণ, ক্ষিদে নেই এ কথা বিশ্বাস করলুম না, দ্বিতীয় কারণ—
সতীশ মুখের ভাব অত্যন্ত শক্ত করিয়া বলিল, দ্বিতীয় কারণটা মিছে কথা, ওই প্রথমই সব। সমস্ত বিষয়েই তোমার জিদ আর জবরদস্তি। এই জিদের সঙ্গে কারু পারবার জো নেই।
সাবিত্রী মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, তবে মিথ্যে চেষ্টা করা কেন?
সতীশ আরও গম্ভীর হইয়া বলিল, তা নয় সাবিত্রী! আজ আমার চেষ্টা কোনমতেই মিথ্যা হবে না। হয় তোমার
দ্বিতীয় কারণ বলো, না হয় সত্যি বলছি তোমাকে, আমি কোনমতেই এখানে কিছু খাবো না।
সতীশের গোঁ দেখিয়া সাবিত্রী নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বলিল, আমি ভাবছি আজ আপনি এলেন কেন? আজ আমার জন্মদিন তাই, নিজে এসে যখন দাসীর ঘরে পায়ের ধূলো দিয়েছেন, তখন শুধু শুধু আপনাকে ছেড়ে দিতে পারিনে। ‘পারিনে’ বলিয়াই সাবিত্রী হঠাৎ থামিয়া গেলো বটে, কিন্তু তাহার অন্তরের গোপন ব্যথাটা তাহারই কণ্ঠস্বরের মুক্ত পথ ধরিয়া এমনি অকস্মাৎ সতীশের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল যে, কয়েক-মুহূর্তের জন্য সতীশের সমস্ত বোধশক্তি অসাড় হইয়া গেল। বুদ্ধিমতী সাবিত্রী ইহা চক্ষের নিমিষে অনুভব করিয়া তাহার সমস্ত কথাটাকে সহজ পরিহাসে পরিণত করিয়া হাসিয়া বলিল, ভগবান আজ আপনাকে আমার অতিথি করে পাঠিয়েছেন, সুতরাং খেতেও হবে, দক্ষিণাও নিতে হবে,—আজ নিতান্তই জাতটা মারা গেল দেখচি।
এতক্ষণে সতীশের সহজ শক্তি ফিরিয়া আসিল, জিজ্ঞাসা করিল, সত্যিই কি আজ তোমার জন্মদিন?
সাবিত্রী বলিল, সত্যি।
সতীশ বলিল, তবে এমন দিনে যদি এসেই পড়েচি ত দোকানের কতকগুলো বাসী মেঠাই-মণ্ডা খেয়ে পেট ভরাব না। তা ছাড়া ও-সব ত আমি কোনদিনই খাইনে।
সাবিত্রীও তাহা জানিত। মনে মনে লজ্জিত হইয়া বলিল, কিন্তু আজ যে রাত হয়ে গেছে!
সতীশ বলিল, হলোই বা রাত। আজ বাসায় ফিরে গিয়ে ত বকুনি খেতে হবে না যে, রাতকে আজ ভয় করতে হবে। যাই বল তুমি, কোন মতেই আমি ও-সব খাব না।
তোমার সঙ্গে পারবার জো নেই, বলিয়া সাবিত্রী হাসিয়া উঠিয়া গেল।
সতীশ বসিয়া ছিল, শুইয়া পড়িল। এই ক্ষুদ্র কুটীর এবং এই নির্মল শুভ্র শয্যা ছাড়িয়া যাইতে কোনমতেই তাহার
মন উঠিতেছিল না, অথচ, আত্মসম্ভ্রম অক্ষুণ্ণ রাখিয়া বসিয়া থাকিবারও কোনও সদুপায় ছিল না। এখন, এই খাবার তৈরির বিলম্বের সম্ভাবনা তাহাকে যেন একটা আসন্ন কর্তব্যের কঠিন দায় হইতে অব্যাহতি দিয়া গেল।
সে পাশবালিশটা জোর করিয়া জড়াইয়া ধরিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। চলিয়া যাইবার সময় সাবিত্রী বাহির হইতে শিকল তুলিয়া দিয়া গিয়াছিল, ইহাও যেমন সে টের পাইয়াছিল, তাহার ‘তুমি’ সম্ভাষণও সে তেমনি লক্ষ্য করিয়াছিল। নির্জন ঘরের মধ্যে এই নবলব্ধ তথ্য দুটি, যাদুকর ও তাহার মায়াকাঠির মত তাহার মনের মধ্যে অপূর্ব ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করিয়া চলিতে লাগিল। আজই দুপুরবেলা যে-সমস্ত ভালবাসার আবর্জনা তাহার মনের ভিতর হইতে ভাটার টানে বাহিরের দিকে ভাসিয়া গিয়াছিল, জোয়ারের উলটা স্রোতে আবার তাহারা একে একে ফিরিয়া আসিয়া দেখা দিতে লাগিল। আজই দুপুরবেলায় আত্মাভিমানের আঘাতের সুতীব্র জ্বালা নিজের মনের নীচ প্রবৃত্তির দিকে তাহার চোখ খুলিয়া দিয়াছিল, জ্বালার উপশমের সঙ্গে সঙ্গেই সে চক্ষু আপনি মুদ্রিত হইয়া গেল। এমনি করিয়া নিজেকে লইয়া খেলা করিতে করিতে একসময়ে বোধ করি সে একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ দ্বার খোলার শব্দে জাগিয়া উঠিয়া পাশ ফিরিয়া দেখিল সাবিত্রী মোক্ষদাকে লইয়া ঘরে ঢুকিতেছে। মোক্ষদা চিঠিখানি সতীশের হাতে দিয়া বলিল, দেখুন ত বাবু, বৌমা কি লিখেচেন?
সতীশ সমস্তটা পড়িয়া লইয়া বলিল, তাঁদের ফিরতে এখনও মাস-দুই দেরী আছে।
মোক্ষদা জিজ্ঞাসা করিল, আর কোন কথা নেই?
সতীশ চিঠিখানি ফিরাইয়া দিয়া বলিল, না, আর বিশেষ কিছু নেই।
আমার মাইনের কথাটা বাবু?
না, সে কথা নেই।
টাকার কথা নাই শুনিয়া মোক্ষদা মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া চিঠির জন্য হাত বাড়াইয়া বলিল, তা থাকবে
কেন, থাকবে যত-সব বাজে কথা! দিন চিঠি। কাল সাবিত্রী আমাকে একখানা জবাব লিখে দিস ত। হাঁ লা, বাবুর খাবার দিবি কখন? রাত কি হয়নি?
সাবিত্রী বলিল, বামুনঠাকুর সন্ধ্যে-আহ্নিক করবে না, অমনি খাবে?
মোক্ষদা বিরক্ত হইয়াই ছিল, আরো বিরক্ত হইয়া বলিল, শোনো কথা একবার! এ কি তোর পুরুতঠাকুর, না ভট্চায্যিবামুন পেয়েচিস যে পূজো-আহ্নিক করতে যাবে?
সতীশ হাসিয়া বলিল, ও কি ঝি, সব ভুলে গেলে! আমি ত চিরকালই সন্ধ্যে-আহ্নিক করি।
মোক্ষদার বোধ করি হঠাৎ মনে পড়িয়া গেলে। অপ্রতিভ হইয়া বলিল, ও মা, তাই ত!
সাবিত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিল, দে মা, শিগ্গির বাবুর একটা জায়গা করে দে। তোর ঘরে ত সমস্তই ঠিক আছে। দে মা, দে, আর দেরী করিস নে—বলিতে বলিতে মোক্ষদা স্থানান্তরে চলিয়া গেল।
ঘণ্টা-খানেক পরে, সতীশের আহারের সময় ঘরে কেহ উপস্থিত নাই—অন্ধকার বারান্দা হইতে মোক্ষদা ইহা লক্ষ্য করিয়া একেবারে জ্বলিয়া উঠিল। রান্নাঘরে আসিয়া দেখিল সাবিত্রী চুপ করিয়া বসিয়া আছে। রুষ্টস্বরে বলিল, এ তোর কি রকম আক্কেল সাবিত্রী! এ কি কাঙ্গালী-ভোজন হচ্চে যে, যা হোক দুটো ফেলে দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বসে আছিস!
সাবিত্রী কি ভাবিতেছিল, চমকিয়া বলিল, দরকার হলে উনি চেয়ে নেবেন।
এমন বুদ্ধি না হলে আর দাসীবৃত্তি করতে যাস! কোথায় তুই নিজে দাসী-চাকর রাখবি, না—
সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, নিজেই দাসী হয়ে আছি। তাতেই বা দোষ কি মাসী, খেটে খেতে লজ্জা নেই।
মোক্ষদা রাগিয়া বলিল, কে বললে নেই? আমার মত বয়সে না থাকতে পারে, কিন্তু তোর বয়সে আছে। তা থাক না থাক, বাবুকে যখন খেতে বলেছিস, তখন বসে থেকে খাওয়াগে যা। মানুষের কপাল ফিরে যেতে বেশী দেরী লাগে না!
সাবিত্রী চলিতে উদ্যত হইয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কি বকচো মাসী! উনি শুনতে পাবেন যে!
মোক্ষদা তৎক্ষণাৎ স্বর নত করিয়া বলিল, না না, শুনতে পাবেন কেন! আর একটা কথা তোকে বলে রাখি বাছা। ভগবান কপালের মাঝখানে যে দুটো চোখ দিয়েছেন সে দুটো একটু খুলে রাখিস। ঘড়ির চেন, হীরের আংটি না থাকলেই মানুষকে ছোটো মনে করিস নে।
আচ্ছা, বলিয়া সাবিত্রী হাসিয়া চলিয়া যাইতেছিল, মোক্ষদা আবার পিছন হইতে ডাকিয়া বলিল, শোন্ সাবিত্রী!
সাবিত্রী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কি?
আয় দেখি একবার আমার ঘরে, একখানা ঢাকাই কাপড় বের করে দি, পরে যা।
সাবিত্রী হাসি চাপিয়া বলিল, তুমি বার কর গে মাসী, আমি এখনি আসচি।
সতীশের খাওয়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল, সাবিত্রী ঘরে ঢুকিয়া বলিল, চোখ বুজে খাচ্চো নাকি?
সতীশ মুখ তুলিয়া বলিল, না।
কিন্তু, চোখ দুটি ত ঘুমে ঢুলে আসচে দেখচি।
বাস্তবিকই তাহার অত্যন্ত ঘুম পাইতেছিল। গত রাত্রির উচ্ছৃঙ্খল অত্যাচার আজ অসময়েই তাহার চোখের পাতা দুটিকে ভারী করিয়া আনিতেছিল, সে সলজ্জ-হাস্যে কবুল করিয়া বলিল, হাঁ, ভারী ঘুম পাচ্চে।
সাবিত্রী জিজ্ঞাসা করিল, আর কিছু চাই কি?
সতীশ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, কিছু না, কিছু না; আমার খাওয়া হয়ে গেছে।
বাহিরে পায়ের শব্দে সাবিত্রী টের পাইল, মোক্ষদা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে; বলিল, বাবু আমাকে একখানি ঢাকাই শাড়ি কিনে দিতে হবে।
সে কোনদিনই কিছু চাহে না, সুতরাং এ কথার তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া সতীশ আশ্চর্য হইয়া গেল। সে মোক্ষদার আগমন টের পায় নাই। মুখ তুলিয়া সবিস্ময়ে বলিল, সত্যি চাই?
সত্যি বৈ কি!
পরবে কখন?
আজ পরবার সময় নেই বলে কোনও দিন সময় হবে না, এমন কি কথা আছে! তা ছাড়া আর একটি কথা; আমি খেটে খাই বলে মাসী দুঃখ করছিলেন, তাই মনে কচ্চি আর খেটে খাবো না—এখন থেকে বসে বসে খাবো।
সতীশ হাসিয়া বলিল, বেশ ত।
শুধু বেশ হলেই ত হবে না, ওই সঙ্গে একটি দাসী না হলেও আর মান থাকচে না—তাও আপনাকে রেখে দিতে হবে। আপনাকেই—কথাটা সে শেষ করিতে পারিল না, মুখে আঁচল গুঁজিয়া দিয়া উৎকট হাসির বেগ রোধ করিতে লাগিল।
মোক্ষদা কাঁচা লোক নহে। সে একমুহূর্তে সমস্তটা বুঝিয়া লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিল, বাবু বুঝি সাবিত্রীকে চেনেন?
সাবিত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিল, মাসীর সঙ্গে এতক্ষণ বুঝি তামাশা হচ্ছিল? তা এ ত ভালো কথা, আহ্লাদের কথা! আগে বললেই ত চুকে যেত! বলিয়া হাসিয়া বাহির হইয়া গেল।
আহারান্তে সতীশ আর একবার শয্যায় আসিয়া বসিল। সাবিত্রী ডিবা ভরিয়া পান আনিয়া দিল এবং বাঁধা হুঁকায় তামাক সাজিয়া আনিয়া সতীশের হাতে দিয়া পায়ের কাছে মাটিতে বসিয়া পড়িয়া হঠাৎ একটুখানি হাসিয়া মুখ নীচু করিল। সতীশের বুকের মধ্যে ঝড় বহিতে লাগিল। সর্বদেহে কাঁটা দিয়া যেন শীত করিয়া উঠিল। ক্ষণকালের নিমিত্ত তাহার হুঁকা টানিবার শক্তিটুকু পর্যন্ত রহিল না। মিনিট দুই এইভাবে নীরবে কাটিবার পরে সাবিত্রী সহসা মুখ তুলিয়া বলিল, রাত হলো, বাসায় যাবে না?
সতীশ শুষ্ক-গলায় বলিল, না গেলে থাকব কোথায়?
এইখানেই থাকবে। না যেতে পার ত কাজ নেই—মাসী এখনও জেগে আছে, আমি তার বিছানাতেই শুতে পারব—বলিয়া সাবিত্রী সতীশের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
একমুহূর্তের জন্য সতীশ নির্বাক হইয়া রহিল, কিন্তু পরক্ষণেই প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া একেবারে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, নাঃ—চললাম।
আচ্ছা, আর একটু বোসো, বলিয়া সাবিত্রী উঠিয়া গিয়া সতীশের জুতাজোড়াটা বাহির হইতে তুলিয়া আনিল, এবং আঁচল দিয়া পা মুছাইয়া দিয়া জুতার ফিতা বাঁধিয়া দিতে দিতে আস্তে আস্তে কহিল, বাসার লোক যদি জানতে পারে?
কেমন করে জানবে?
আমিই যদি বলে দি!
কি বলবে তুমি—বলবার ত কিছু নেই।
সাবিত্রী আবার একটু হাসিয়া বলিল, কিছুই নেই? সত্যি বলচো?
সতীশ চুপ করিয়া রহিল।
সাবিত্রী মৃদুকণ্ঠে কহিল, বলবার কথা না থাকলে কি জানি, আজ তোমাকে আমি ছেড়ে দিতে পারতুম কি না। বলিয়া হঠাৎ চুপ করিয়া গেল। কিন্তু পরক্ষণেই প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, না, তুমি বাসায় যাও। কিন্তু এই দুষ্টুবুদ্ধি যদি না ছাড় ত একদিন সমস্ত প্রকাশ করে দেব তা বলে দিচ্ছি।
এ কি রহস্য! ইহার ভিতরের কথাটা ঠিক ধরিতে না পারিয়া সতীশ ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, বললেই বা। বাসার লোক ত আমার গার্জেন নয়।
সাবিত্রী কহিল, নয় জানি। কিন্তু মাসী আমার সে ভারও অনায়াসে নিতে পারবে। তার জিভকে ঠেকিয়ে রাখবে কি দিয়ে?
মোক্ষদার ইঙ্গিতে সতীশ মনে মনে ভয় পাইলেও মুখে বলিল, টাকা দিয়ে।
সাবিত্রী বলিল, তাতে শুধু টাকার অপব্যয় হবে, কাজ হবে না। তা ছাড়া মাসীকেই না হয় টাকায় বশ করবে, কিন্তু আমাকে বশ করবে কি দিয়ে?
সতীশ ফস করিয়া বলিয়া ফেলিল, ভালবাসা দিয়ে।
সাবিত্রীর ওষ্ঠপ্রান্তে কঠিন চাপা-হাসির আভাস দেখা দিল, কহিল, এই নিয়ে চারবার হলো।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ, ইতিপূর্বে আরও তিনজন এই জিনিসটিই দিতে চেয়েছিলেন।
তুমি নাওনি?
না। জঞ্জাল জড় করে রাখবার মত জায়গা নেই আমার।
সতীশ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। সাবিত্রীর বিদ্রূপের হাসি এবং কণ্ঠস্বর কিছুই তাহার লক্ষ্য এড়ায় নাই, তাই তাহার দুপুরবেলার কথাগুলোও মনে পড়িয়া গেল, এবং পড়ামাত্রই প্রেমের নদীতে জোয়ার শেষ হইয়া ভাটার টান ধরিল। সাবিত্রীর কথাগুলাকে সে তামাশা বলিয়া ভুল করিল না। হঠাৎ অত্যন্ত কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিল, তারা নির্বোধ! তাদের এমন বস্তু দেওয়ার প্রস্তাব করা উচিত ছিল যা বাক্সে তুলে রাখতে কারো জঞ্জাল বলে মনে হয় না। আমিও নির্বোধ কম নই, কেননা, আমিও ভুলেছিলাম ও-বস্তুটা তোমাদের কত অবহেলার সামগ্রী! এতটা বয়সে এত বড় ভুল হওয়া আমার উচিত ছিল না। আচ্ছা, চললাম।
কথাটা সাবিত্রীকে শূলের মত বিঁধিল। ‘তোমাদের’ বলিয়া সতীশ যে তাহাকে কাহাদের সহিত অভিন্ন করিয়া দেখিল, সাবিত্রীর তাহা বুঝিতে বাকী রহিল না। কিন্তু পরিহাস কলহে পরিণত হইয়া হাতাহাতির উপক্রম হইতেছে দেখিয়া সে চুপ করিয়া গেল। সতীশ কিন্তু থামিতে পারিল না, বলিল, শিকারী বঁড়শিতে মাছ গেঁথে খেলিয়ে যেমন করে আমোদ করে, এতদিন আমাকে দিয়ে বোধ করি তুমি সেই তামাশাই করছিলে,—না?
সাবিত্রী আর সহিতে পারিল না। তড়িৎবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বঁড়শিতে গেঁথে তোমাকে টেনেই তোলা যায়—খেলিয়ে তোলবার মত বড় মাছ তুমি নও।
সতীশ নির্মমভাবে বিদ্রূপ করিয়া বলিল, নই আমি?
সাবিত্রী কহিল, না, নও তুমি। তাহার ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। সতীশের মুখের প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া বলিতে লাগিল, অসচ্চরিত্র! আমার মত একটা স্ত্রীলোককে ভালবেসে ভালবাসার বড়াই করতে তোমার লজ্জা করে না? যাও তুমি—আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে মিথ্যে অপমান করো না।
এই অপমানে সতীশ আরও নির্দয় হইয়া উঠিল। এবার অমার্জনীয় কুৎসিত বিদ্রূপ করিয়া বলিল, আমি অসচ্চরিত্র! কিন্তু সে যাই হোক সাবিত্রী, তোমার নামটা কিন্তু তোমার বাপ-মা সার্থক দিয়েছিলেন।
সাবিত্রী সরিয়া গিয়া চৌকাঠ ধরিয়া ক্ষণকাল স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া শুধু বলিল, যাও! তাহার মুখ ফ্যাকাশে বিবর্ণ হইয়া গিয়াছিল।
সতীশ অপমান ও ক্রোধের অসহ্য জ্বালায় সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করিয়া বলিল, কিন্তু যাবার আগে আর একবার আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে দেবে না? কিংবা আর কোনও খেলা—আর কিছু—
হঠাৎ দুজনের চোখাচোখি হইল। সাবিত্রী এক-পা কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল, তুমি কসাইয়ের চেয়েও নিষ্ঠুর,—তুমি যাও! তুমি যাও! তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যাও! না যাও ত মাথা খুঁড়ে মরব—তুমি যাও!
তাহার কণ্ঠস্বরের উত্তরোত্তর এবং অস্বাভাবিক তীব্রতায় অকস্মাৎ সতীশ ভীত হইয়া উঠিল এবং আর একটি কথাও না বলিয়া বাহির হইয়া গেল। কিন্তু অন্ধকার বারান্দার শেষ পর্যন্ত আসিয়া তাহাকে থামিতে হইল। কোন্ দিকে সিঁড়ি, কোন্ দিকে পথ, অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। পকেটে হাত দিয়া দেখিল, দেশলাই নাই। এই নিরুপায় অবস্থা-সঙ্কটের মাঝখানে মিনিট-পাঁচেক চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া আবার তাহাকে সাবিত্রীর ঘরের দিকে ফিরিয়া আসিতে হইল। বাহির হইতে দেখিল, সাবিত্রী মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া আছে। আস্তে আস্তে ডাকিল, সাবিত্রী! সাবিত্রী সাড়া দিল না। পুনর্বার ডাকিয়াও সাড়া না পাইয়া সতীশ ঘরের মধ্যে আসিয়া সাবিত্রীর মাথায় হাত দিল। ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিল, চক্ষু মুদ্রিত এবং মুখের মধ্যে আঙ্গুল দিয়া বুঝিল, সাবিত্রী মূর্ছিত হইয়া আছে। মুহূর্তের জন্য তাহার মনের মধ্যে একটা ভয় ও সঙ্কোচের উদয় হইল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই সাবিত্রীর অচেতন দেহটা তুলিয়া লইয়া শয্যায় শোয়াইয়া দিল, এবং চাদরের এক অংশ কলসীর জলে ভিজাইয়া লইয়া মুখের উপর, চোখের উপর ছিটাইয়া দিয়া একখানা হাত-পাখা লইয়া বাতাস করিতে লাগিল। মিনিট দুই-তিন পরেই সাবিত্রী চোখ মেলিয়া মাথার উপর কাপড় টানিয়া দিয়া পাশ ফিরিয়া শুইয়া বলিল, তুমি যাওনি?
সতীশ চুপ করিয়া বাতাস করিতে লাগিল।
সাবিত্রী বিছানা হইতে উঠিয়া প্রদীপ হাতে লইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, চল, তোমাকে দোর খুলে দিয়ে আসি।
তার পরে নিঃশব্দে পথ দেখাইয়া নীচে নামিয়া আসিল এবং দ্বার খুলিয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।
মূর্ছিত সাবিত্রীকে শয্যায় শোয়াইতে সেই যে মুহূর্তের জন্য তাহার অচেতন দেহখানি তাহাকে বুকে তুলিয়া লইতে হইয়াছিল, সেই অবধি সতীশ কি রকম যেন অন্যমনস্ক হইয়াছিল; এখন দরজার বাহিরে আসিতেই তাহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল এবং কি একটা কথা বলিবার জন্য মুখ তুলিতেই সাবিত্রী বলিয়া উঠিল, না, আর একটি কথাও না, তোমার দেহটাকে ত তুমি পূর্বেই নষ্ট করেছ, কিন্তু সে না হয় একদিন পুড়েও ছাই হতে পারবে, কিন্তু একটা অস্পৃশ্য কুলটাকে ভালবেসে ভগবানের দেওয়া এই মনটার গালে আর কালি মাখিয়ো না। হয় তুমি কালই ও-বাসা ছেড়ে চলে যাও, না হয়, আমি আর ওখানে যাবো না। বলিয়াই সাবিত্রী উত্তরের জন্য প্রতীক্ষামাত্র না করিয়া সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিল।