চম্পার প্রতিপক্ষ

চম্পার প্রতিপক্ষ

চম্পাকে সেদিন যখন বলেছিলাম টিভির মেয়েটা আমার কাছে আসলে আসতেও পারে, তখন কী করে ভাবব সত্যি সত্যি সে আমার খোঁজ করবে! দৈনিক নতুন প্রহর পত্রিকার আফরোজা দিতি আমাকে ফোনে জানাল হল্যান্ড থেকে একটা মেয়ে এসেছে ঢাকায়, সে একাত্তরের যুদ্ধশিশু, দত্তক বাবা-মার কাছে বড় হয়েছে রটারড্যামে। এইটুকু শুনে বললাম, ‘কয়েক দিন আগে মনে হয় ওর ইন্টারভিউ দেখলাম টিভিতে, কী যেন নাম?’ দিতি উত্তেজিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, ও-ই। নাম লিওনা কোবার।’

দিতিকে অনেক দিন ধরে চিনি। এক সময় ঘন ঘন আসত। একবার ইন্টারভিউও করেছিল। এখন সে বেশ সিনিয়র, সম্ভবত ফিচার এডিটর বা এ রকম কিছু। দিতি জানাল মেয়েটা গুলশানে একটা গেস্ট হাউসে উঠেছে। এসেছে সপ্তাখানেক হলো। একাই এসেছে। নিজের সম্বন্ধে মিডিয়ায় কথা বলেছে। পত্র-পত্রিকা ভালো কভারেজ দিয়েছে। একটা টেলিভিশন চ্যানেলও তাকে ইন্টারভিউ করেছে, যেটা আমি দেখেছি।

‘যদিও বলছে মাকে খুঁজতে এসেছে, আসলে সে এ দেশ সম্বন্ধে জানতে চায়, বিশেষ করে যুদ্ধশিশু ও সে সময় নির্যাতিত মেয়েদের বিষয়ে’ বলে দিতি মূল কথায় এলো, ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চায়। কখন আসবে?

আমি তখন ভাবছিলাম চম্পার কথা, কিছুতেই আসবে না জানি, তবু মনে হলো মিথ্যা কথা বলে যদি আনানো যায়-আমার শরীর খারাপ শুনলে দৌড়ে আসবে। দিতিকে বললাম পরের দিন আসতে, বিকালের দিকে।

অনেক ভাবলাম চম্পাকে খবর দেব কি না–মিথ্যা শরীর খারাপের কথা বলে। মন থেকে ঠিক সায় পেলাম না, এলে তো প্রথমেই ওর পরিচয় দিতে হবে। কথা তো বলতে পারবে না, তবু ব্যাপারটা কিভাবে নেবে কে জানে। সেও যুদ্ধশিশু, বসবে মোড়া বা পিঁড়িতে বা বাঁকাতেড়া হয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর তারই মতো আরেকজন সোফায় বসে গড়গড়িয়ে ইংরেজি আওড়াবে। দৃশ্যটা কল্পনা করে ভাবলাম কী দরকার ওকে বিড়ম্বনায় ফেলার! এমনিতেই এত তটস্থ থাকে!

টিভিতে ছোটখাটো দেখালেও বাস্তবে লিওনা বেশ লম্বা, অন্তত পাঁচ ফুট সাত-আট তো হবেই। গায়ের রঙ কালো ও শ্যামলার মাঝামাঝি, ছোট নাক- বোঁচাই বলা চলে, পাতলা ঠোঁট, সামনের দাঁত দুটো উঁচু। দিতি ওরই বয়সি, কিছুটা ছোট হতে পারে, তবে ওর পাঁচ দুই-আড়াইয়ে লিওনার পাশে একটু বেশিই বেঁটেখাটো লাগছিল। দিতি পরিচয় করিয়ে দিয়ে শুধু আমার নামটা বলল, বুঝলাম ফিরিস্তি যা দেওয়ার আগেই দিয়ে রেখেছে। লিওনা আমার কাঁধে হাত রেখে বড়রা যেমন মাথা ঝুঁকিয়ে ছোটদের মুখে তাকায় সেভাবে তাকাতে আমি হাত বাড়ালাম, সে আরও ঝুঁকে আমার গালে গাল ঠেকাল। হালকা-পাতলা হলেও ওর ঝুঁকে পড়া শরীরের বেগ সামলাতে আমার কষ্টই হলো।

ভেতরে এসে বসে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাঁধের বড়সড় ব্যাগ খুলে পানির বোতল বের করল। কয়েক ঢোক খেয়ে সুস্থির হয়ে বলল এত পানি জীবনে খায়নি, একটু পর পর পিপাসা লাগে। জানাল এ কয়দিন নানা জায়গায় গিয়েছে, সংসদ ভবন দেখে খুব ভালো লেগেছে, সাভার স্মৃতিসৌধও সুন্দর। তবে গ্রামের দিকে যাওয়া হয়নি, যদি দিতি নিয়ে যায় যাবে। বলতে বলতে দেয়ালের এক কোণে মাদার তেরেসার ছবি দেখে উঠে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড খুঁটিয়ে দেখল, পাশেই একটা গ্রুপ ছবিতে বেশ কয়েকজন বয়স্ক নারী—কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। দাঁড়ানো বা বসার ধরন প্রায় সবারই আড়ষ্ট, চেহারায় বয়সের কঠিন ছাপ। গ্রুপ ছবিতে চোখ হাঁটিয়ে সে হঠাৎ আমাকে ও দিতিকে চমকে দিয়ে বলল, ‘এখানে কেউ আমার মা হলেও হতে পারে। এরাই তো তারা, না?’

খুবই অবাক হলাম। সবে কয়দিন হলো এসেছে, ঘোরাঘুরি হয়তো অনেক করেছে, অনেক মানুষের সঙ্গে কথাও নিশ্চয় বলেছে, তাই বলে ঘরে ঢুকেই গ্রুপ ফটোটাকে নিশানা করবে, আর এমন তাক লাগানো কথা!

কী বলব, হকচকিত অবস্থা সামলে বললাম ঠিকই ধরেছে, এখানে সবাই আমরা যাদের বলি বীরাঙ্গনা—ওয়ার হিরোইন।

‘সবাই গরিব আর বুড়ো-বুড়ো।

‘ছবিটা বেশি দিন আগের না, ওদের তো বয়স হয়েছে, আর ওরা গরিবও।’

‘পাকিস্তানিরা শুধু গ্রামের গরিবদেরই ধরেছিল, ওদের নিয়েই ক্যাম্প করেছিল?’

‘তা ঠিক না, শহরের মেয়েরাও ছিল, তবে সংখ্যায় কম?’

‘কেন, কম কেন?’

আমি একটু সময় নিলাম। এ মেয়ে আমি যা খুশি বলব আর সে শুনে যাবে, সেজন্য আসেনি। বললাম, ‘শহরের বা শিক্ষিত পরিবারে সাবধানতা ছিল, তারা জায়গা বদল করেছে যখন প্রয়োজন মনে করেছে। আর গ্রামের দিকে কাজটা সৈন্যদের জন্য হয়তো সহজ ছিল। হতে পারে ওপর থেকে ইনস্ট্রাকশনও ছিল।’

জবাবটা যেন তার মনে ধরল না। আমার কথা মন দিয়ে শুনল, তবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো না।

গ্রুপ ফটোটার দিকে ইশারা করে বলল ওদের সবাইকে আমি পেলাম কী করে?

‘সবাই কোথায়? এখানে তো মাত্র সতেরোজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এরা ও আরও অনেকে একটা রিহেবিলিটেশন সেন্টারে ছিল, ঢাকায়। আমরা সেটা দেখাশোনা করতাম। সে তো অনেক আগের কথা, চল্লিশ বছরেরও আগের এখন ওদের বয়স হয়েছে, কেউ কেউ মারাও গেছে। তবে কেউ কেউ আমার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রাখে। বছর দুয়েক আগে এই বাড়িতে ছবিটা তোলা। আমারও তো অনেক বয়স হয়েছে, তাই মনে করলাম ওদের ডাকি, যে কজন এসেছিল, এরা তারা।

‘আমি কি ওটার একটা কপি পেতে পারি?’

ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিতে সে সুস্থির হয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। একটু পর বলল, ‘আমি যেটুকু জানি, মানে বইপত্র পড়ে জেনেছি, ভিকটিমরা প্রায় সবাই গরিব পরিবারের, ধনী বা শিক্ষিতরা কি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল?’

জবাব দিল দিতি। জবাব বলতে রীতিমতো বক্তৃতা। দেখলাম দিতি ইংরেজি মোটামুটি ভালোই বলে, অন্তত আমার চেয়ে ভালো। শুনতে কিছুটা ক্লিশে লাগলেও সেই ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, পঁচিশে মার্চ, মুক্তিযুদ্ধ, বুদ্ধিজীবী হত্যা—এক কথায় জগাখিচুড়ি বক্তৃতা। লিওনা ধৈর্য ধরে শুনল। হাবভাবে মনে হলো না সে নতুন কিছু শুনছে।

আসার আগে দিতি যে তাকে পুনর্বাসনকেন্দ্র সম্বন্ধে ভালেই ধারণা দিয়েছে, লিওনার কথায় বোঝা গেল। এমনও হতে পারে, নিজেই পড়াশোনা করে জেনেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইল। কবে, কিভাবে কেন্দ্র হলো, আমরা কোথা থেকে এলাম, মেয়েদের কিভাবে আনা হতো এসব।

চা না কফি খাবে জিজ্ঞেস করতে লিওনা খুশি হয়ে বলল চা।

চা খেতে খেতে তার পালক বাবা-মা, দুই ভাই-বোন, নিজের লেখাপড়া নিয়ে বলল। সেদিন টিভিতে তার ইন্টারভিউতে এসব শুনেছি বলতে লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ভীষণ এক্সাইটেড ছিলাম, টিভিতে তো কখনো যাইনি, বেশি বকবক করেছি। ওরা আমাকে ইন্টারভিউয়ের ক্লিপ দিয়েছে, আমার বাবা-মা তো বিশ্বাসই করতে পারছে না আমি এখানে এত কভারেজ পাচ্ছি। আসার আগে যখন বাবা-মাকে বললাম যাচ্ছি, ওরা ভয়ে ছিল কোনো বিপদে না পড়ি। এখানে সবাই এত সাহায্য করছে আমাকে! আর গত তিন-চার দিন ধরে যেখানেই যাচ্ছি দিতি আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, ও-ই আমার গাইড, কোথায় যাব তা তো জানি না, দিতি ঠিক করে দেয়। কাল যখন আমাকে তোমার কথা বলল, আমি ভাবলাম কী আশ্চর্য, আমার তো প্রথমে তোমার সাথেই কথা বলা উচিত ছিল।’

জিজ্ঞেস করলাম কেমন লাগছে এখানে এসে।

লিওনা একটু সময় নিয়ে বলল, ‘এয়ারপোর্টে নেমেই ধাক্কা খেয়েছিলাম— সবাই আমার মতো দেখতে। এমন তো কখনো দেখিনি। ইমিগ্রেশনে যে মহিলা পাসপোর্টে সিল মারছিল, সে তো আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথাই বলবে না, দু-একটা প্রশ্ন যা করেছিল বাংলায়, আমি যতই বলছিলাম তার কথা বুঝতে পারছি না, সে বাংলাই চালিয়ে যাচ্ছিল।’

‘তার পর?’

‘তেমন সমস্যা হয়নি। ইমিগ্রেশনে ওরা গৎবাঁধা দু-একটা প্রশ্নই করে, জবাব পাওয়াটা খুব জরুরি না, সিল মেরে সামনে থেকে ভিড় সরায়। তবে ওই মহিলা ইংরেজি জানত, আমার সামনে একজন আমেরিকান ছিল, তার সঙ্গে ইংরেজিই বলেছিল। আমার বিদেশি পাসপোর্ট দেখেও আমি বাংলা জানি না, বাঙালি না, বিশ্বাস করতে নিশ্চয় তার অসুবিধা হচ্ছিল। মজার না? আর যে গেস্ট হাউসে আছি, ওখানকার ফ্রন্টডেস্কের লোক, রুম সার্ভিস সবাই উঠতে-বসতে বাংলা চালাচ্ছে।’

বলতে বলতে দেখলাম ও আমার কাছ ঘেঁষে বসছে, আমার মুখে তাকিয়ে কিছু বলবে বলবে করেও কী ভেবে চোখ সরিয়ে নিল। একটু পরে বলল, ‘পত্রিকায় আমার সম্বন্ধে লিখেছে আমি আমার মাকে খুঁজতে এসেছি। এটা ঠিক না। আমার বায়োলজিক্যাল মাকে কী করে পাব! তার তো কোনো ট্রেস নেই। আর আমি তেমনভাবে ফিলও করি না, আমাকে যে বড় করেছে সে-ই আমার মা। তবে একটা কিউরিওসিটি তো থেকে যায়। যদি নাম-ঠিকানা পেতাম, আমি অবশ্যই যেতাম, তবে দেখা পেলে …’

লিওনা থামল, যেন কথা খুঁজতে। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে হাসল। মনে হলো কথাটা শেষ করবে না, কিন্তু করল, ‘যদি দেখা পেতামও, আমার মনে হয় না কোনো স্ট্রং এফিনিটি ফিল করতাম। বরং হয়তো সমস্যাই হতো। চলে যাওয়ার পর ব্যাপারটা হন্ট করত, আমি শিওর না, তবে মনে হয় করত। এক মা যাকে মা বলে জানি, তার পাশে আরেকজন যাকে চিনি না সে ঘোরাঘুরি করত। আমি মনে হয় ফ্যান্টাসাইজ করছি, কিন্তু হতেও তো পারে, পারে না?’

আমি ওর কথায় গেলাম না, এর জবাব কী দেব! প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, ‘তোমার নিশ্চয় দেশটাকে দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল, যেখানে তোমার জন্ম।’

নিজের কানে কিছুটা বোকা-বোকা শোনাল কথাটা। লিওনার হয়তো তা মনে হলো না, অথবা সে যে পরিবেশে বড় হয়েছে সেখানে কেউ কিছু বললে গুরুত্ব দেওয়াই নিয়ম বলে মাথা নাড়ল, ‘তা তো বটেই। তবে ব্যাপারটা বেশ জটিল। আমার জন্ম এ দেশে একজন অচেনা মহিলার গর্ভে, আর সেটা মোটেও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নয়। আমার জন্ম হয়েছে নির্মমতায় ও চরম অনিচ্ছায়। প্রেগনেন্সি টারমিনেট করার মতো অবস্থা ছিল না বলে আমার জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, আর পরপরই ত্যাগ করা হয়েছে। ফলে গোটা ব্যাপারটা যে চরম আনওয়ান্টেড এটা আমাকে এক সময় ভোগাত। সেজন্য এ দেশে আসলে কী ঘটেছিল, কী পরিস্থিতিতে আমাকে এখান থেকে নেওয়া হলো এসব অনেক দিন ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, সেই থেকে দেশটাকে দেখার ইচ্ছাও জেগেছিল। তুমি মনে কিছু করো না, সে ইচ্ছায় এক ধরনের বিতৃষ্ণা ছিল, অ্যা সেন্স অব ডিসগাস্ট। কিন্তু এখানে আসার পর মানুষজন আমাকে এত ভালোবেসে গ্রহণ করল, আমার মনে হলো আমি মোটেও আনওয়ান্টেড নই। আরও বুঝলাম পরিস্থিতিই আমার বায়োলজিক্যাল মাকে বাধ্য করেছিল আমাকে ত্যাগ করতে, কিন্তু সে আমার ভালো চেয়েছিল বলে মাদার তেরেসার হোমে রেখে এসেছিল, পথেঘাটে ফেলে দেয়নি।’

লিওনা গুছিয়ে কথা বলে, যা বলতে চায় পরিষ্কার করে বলে। ভাবছিলাম তাকে কী বলি, সে শক্ত মেয়ে, তবু তাকে খানিকটা আশ্বস্ত করতে বললাম, ‘তোমার মা চেয়েছে তুমি ভালো পরিবেশে বড় হও, তোমাকে মাদার তেরেসার হোমে দিয়ে সে নিশ্চয় অনেক কেঁদেছে। কিন্তু ধরো, যদি সে তোমাকে তার নিজের কাছে রেখে দিত?’

লিওনা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। একটু পরে আস্তে বলল, ‘এভাবে তোমার ঘরে বসে গল্প করতাম না, চা খেতাম না।’

‘আরেক কাপ খাও।’

হেসে মাথা নাড়তে আমি দিতিকে বললাম ও যেন বানিয়ে আনে।

লিওনা এ সময় একটা প্রশ্ন করল যার জবাব সোজা হলেও সরাসরি ওকে বলা কঠিন। বলল, ‘আমি জানি বিদেশ থেকে যারা ওয়ার বেবিদের দত্তক নিতে এসেছিল তাদের সাহায্য করতে তোমাদের সরকার সে সময় আইন করে কাজটা সহজ করে দিয়েছিল। সরকার কি চাচ্ছিল যত বেশি ওয়ার বেবি বিদেশিরা নিয়ে যায় ততই ভালো? দেশে দত্তক নেবে এমন মানুষজন ছিল না?’

কী বলি! সোজাসাপটা তো বলতে পারি না ও যা ভাবছে তাতে ভুল নাই। ওকে কি বলতে পারি দেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবে এমন মানুষ সত্যিই ছিল না! তাই বিদেশে যারা গিয়েছে বেঁচে গেছে আর দেশে যারা থেকে গেছে তারা লাঞ্ছনা ছাড়া কিছু পায়নি।

কথা ঘুরিয়ে অন্যভাবে বললাম, ‘আমাদের সমাজ তো রক্ষণশীল, এখানে নানা ধরনের স্টিগমা কাজ করে, অনেক বিষয় যা একটা লিবারেল সমাজ সহজে মেনে নেয় এমনকি উৎসাহী হয়েও এগিয়ে আসে তা তুমি অন্য জায়গায় আশা

করতে পারো না

লিওনা কী বুঝল কে জানে। হতে পারে, জবাবটা সে জেনেও এমনি জিজ্ঞেস করেছে। সে এ প্রসঙ্গে না গিয়ে জানতে চাইল, ‘দেশে যারা রয়েছে, তারা কেমন আছে? আমার খুব ইচ্ছা তাদের কারো সাথে দেখা করি।’

‘দেখা হলে কী করবে?’

লিওনা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। যেন এমন কথা ভাবেনি, অথচ ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়।

‘তার কথা শুনব।’

‘সে যদি তোমাকে দেখে ভয় পায়?’

‘ভয় পাবে? আমি আর সে তো একই।’

একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘না, তুমি আর সে এক না। এখানেই তোমার মায়ের কৃতিত্ব, নিজে না পারলেও সে তোমার জন্য সুন্দর জীবন দিয়ে গেছে।’

‘মাফ করো, আমি বুঝিনি।

কী করে ওকে বোঝাই সে আর দেশে থেকে যাওয়া তার মতো একজন কিছুতেই এক না। সে নিজে সুবিধাভোগী শুনতে তার ভালো লাগবে? আর শুধু সুবিধাভোগী বললে কিছুই বলা হয় না। মূল ব্যাপার তো শ্রেণিচরিত্রেও তারা একে অন্যের ঘোর বিপরীত।

লিওনা অপেক্ষা করছে দেখে বললাম, ‘তুমি উন্নত দেশে শিক্ষা-দীক্ষা পেয়েছো, দেশে যে আছে সে তো এসবের সুযোগ পায়নি, থার্ড ওয়ার্ল্ডের গরিব দেশ, বোঝোই তো।’

‘সেটা কিছুটা বুঝতে পারছি, তবে ঢাকায় আসার আগে আমি যেমন ভেবেছিলাম তার চেয়ে এ শহর অনেক উন্নত, এত গাড়িটাড়ি, সুন্দর বাড়িঘর, হাইরাইজ, অবশ্য ট্রাফিকের অবস্থা বেশ খারাপ।’

ভাবলাম প্রসঙ্গটাকে পাশ কাটানো গেছে, ও ঢাকার বাড়িঘর ও গাড়ি দিয়ে দেশকে মাপতে চাচ্ছে। মনে মনে বললাম ওর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক, এ থেকে যদি ধরে নেয় তার জন্মস্থান গরিব হলেও যতটা ভেবেছিল ততটা নয়, মন্দ কী! মাকে পেল না, ঢাকার গাড়ি-বাড়ির স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাক।

লিওনা কিন্তু মূল বিষয় থেকে সরল না, বলল, ‘আমি কি তেমন কারো সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

দিতি চা নিয়ে আসতে কথা ঘোরাতে দিতির চা বানানোর প্রশংসা করলাম। হঠাৎ চা বানানোর কথায় দিতি থতমত চোখে তাকাল, যার মানে ফোটানো পানিতে শুধু টিব্যাগ ছেড়ে প্রশংসা পাওয়া বাড়াবাড়িরও বাড়াবাড়ি।

‘পাওয়া যাবে কাউকে? আমার জন্য বড় অভিজ্ঞতা হতো।’ লিওনা নাছোড় ‘দেখব চেষ্টা করে।’

বললাম বটে, এদিকে মাথায় তো চম্পার মুখই ঘুরছে। সেদিন যখন এমনি এমনি লিওনার সঙ্গে দেখা করার কথা তুলেছিলাম, তার চেহারার কী অবস্থা! মনে আছে বারবার ‘না আম্মা না আম্মা’ করছিল, যেন তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে যাব।

লিওনা বিদায় নেওয়ার সময় দেয়াল থেকে গ্রুপ ছবিটা নামিয়ে বললাম, ‘এটাই নিয়ে যাও, আমার কাছে প্রিন্ট আছে, ফ্রেম করিয়ে নেব।’

দিতি খবরের কাগজে মুড়ে ছবিটা দিতে খুশি হয়ে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে লিওনা সেই আগের কথাটা আবার বলল, ‘যা বললাম, এ ছবির একজন হলে হতেও পারে।’

.

ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ শুয়েছিলাম। জবা এসে বাতি জ্বালাল। স্কুলের অঙ্কখাতা মেলে বলল অঙ্কগুলো কঠিন, ক্লাসে বকা খেয়েছে, একটাও পারেনি। বললাম আগামী মাস থেকে টিচার আসবে, অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি সব দেখিয়ে দেবে। জবা অবাক হয়ে তাকাল, বাড়িতে টিচার এসে পড়াবে এ খবর তার জানার কথা নয়। আমিও কি জানতাম, সে খাতা মেলে ধরতেই মুখ থেকে কথাটা বেরোল। চম্পার পড়ালেখার সুযোগ হয়নি, লিওনা রটারড্যামে নামি স্কুল-কলেজে পড়েছে, চম্পার মেয়ের অন্তত দেশে পড়ালেখার সুযোগ হোক।

জবা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আমার বাঁ হাতের কনুই চেপে আস্তে আস্তে মুচড়ে দিচ্ছিল। হাতটা প্রায়ই অবশ অবশ লাগে, ওষুধ খেয়ে কাজ হয়নি, ফিজিওথেরাপিতে নাকি উপকার মেলে। কে যায় এসব করতে! জবা-ই আমার ফিজিওথেরাপিস্ট, কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে হাতটাকে বেশ চাঙা করে তোলে।

জিজ্ঞাসা করলাম শুধু বকা খেয়েছে, না কানমলাও? জবা দাঁত বের করে হাসল, তার মানে খেয়েছে। প্রায়ই খায়। সরকারি প্রাইমারি স্কুল, কানমলা ছাড়া মাস্টারদের হাতে বেতও চলে।

শোয়া থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না। জবা জানতে চাইল বিদেশি মহিলাটা যে এসেছিল, কোন দেশের?

বললাম, ‘কে বলল বিদেশি?’

জবা ঘাড় নাড়ল, মুখে বলল, ‘একজন দেশি, অন্যজন যে লম্বা সে বিদেশি।’

‘দেখেই বুঝে গেলি?’

‘দেখলে বুজা যায়।’

‘আর কী বুঝলি?’

‘বড় লোক।’

‘কিভাবে?’

‘দেখলেই …’

।জবাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। লিওনাকে দেখে বুঝতে পারছে সে এখানকার না, যদিও বিদেশি বলতে যেমন বোঝায় লিওনার কথা না শুনে তেমন ভাববার কারণ নেই; সাধারণ বাঙালি মেয়েদের চেহারা, মাথায় বেশ লম্বা এই যা। খটকা লাগল এই ভেবে লিওনা বলেছে তাকে যারা দেখছে সবাই বাঙালি বলে ধরে নিচ্ছে, আর জবা এক ঝলক দেখেই বলছে বিদেশি। চম্পা দেখলে কী বলত? আমার মনে হচ্ছে, কিছুই বলত না, ভয় পেত কি না আমি নিশ্চিত না, তবে হিংসা করত। নিশ্চয় করত।

লিওনার একটা কথা মনে পড়ছে। সেই যে বলেছিল তার মায়ের দেখা যদি পেত, সমস্যায় পড়ত-পালক মায়ের পাশে একজন অজানা-অচেনা অদৃশ্য মা ঘুরঘুর করত। আর যে কথা বলেনি—পালক বাবার মুখটাও কি হঠাৎ হঠাৎ অচেনা লাগত বা একেক সময় বদলে যেত?

ছেঁড়া পালে ঝড়ো হাওয়া

টেলিভিশনে দেখা মেয়েটাকে চম্পা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। কে বলবে সে তারই মতো! নামটা মনে রেখেছে, লিওনা। সে যদি দেশে থাকত, নাম হতো লীনা বা বীণা। তার নামে নাম চম্পাও হতে পারত, বা গোলাপি, ফুলি। লিওনা নামটা সুন্দর। বিদেশিদের নাম বড় খটোমটো হয়। বস্তিতে হঠাৎ হঠাৎ এনজিওর লোকজনের সঙ্গে বিদেশিরা আসে, মহিলাই বেশি। কী একেকটা নাম! একবার একজন এসেছিল, সে কিছু কিছু বাংলা শিখেছিল। কেমন আছেন, আমি ভালো আছি, আপনার নাম কী—এই পর্যন্তই বাংলার দৌড়। তবে বিদেশিদের যে অভ্যাস, কথা বলা শুরু করার আগেই নিজের নাম বলে হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই মহিলাও হাত বাড়াতে চম্পা কী করে, নিজের হাত শাড়িতে ঘষে মহিলার তুলতুলে সাদা বিলাতি ইঁদুরের মতো হাতটা নিতে নামটা শুনেছিল, নাম তো না একটা পটকার আওয়াজ পেয়েছিল। সে তুলনায় লিওনা শুনতে কানে আরাম লাগে। টেলিভিশনে যতক্ষণ লিওনাকে দেখাচ্ছিল, চম্পা বোঝেনি ও কে, কথাবার্তা বোঝার তো প্রশ্নই ওঠে না। পরে যখন আম্মার কাছে সব শুনল, হাঁ হয়ে থাকা ছাড়া করার কী ছিল!

একে তো লিওনা খোলাখুলি কথা বলেছে দেখে তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল, আবার যখন ভাবছিল সে তার মতো হলেও বিদেশে বড় হওয়ার কারণে কত আলাদা, চম্পার মনে হয়েছিল সে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে। আম্মার বাসায় সে রাতে মাথায় ঝামেলাটা টোকা দিয়ে সরে গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে সে একে মাথা থেকে সরাতে পারছে না। কী হতে পারত যদি তার মা-ও তাকে দিয়ে দিত বিদেশি কারো কাছে? মা তো বলেছে আম্মার কারণেই সে বেঁচে আছে, নইলে চম্পা বলে কেউ দুনিয়ায় থাকত না। হতে তো পারত, লিওনার মতো সেও চালান হয়ে যেত বিদেশে, সাদা মানুষের দেশে! নামটা কি তা হলে চম্পা থাকত! চিন্তাটা এখন যত আজগুবিই মনে হোক, যতবার লিওনার মুখ মনে পড়ছে, মাথায় কুটকুট কামড়াচ্ছে।

বিদেশিদের বাচ্চা নেওয়ার বিষয় চম্পা জানত না, তা না। আম্মার মুখেই শুনেছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেশ কিছু বাচ্চা বিদেশিরা নিয়ে গিয়েছিল। বেশিরভাগ বাচ্চা নিয়েছিল শিশু ভবন থেকে। ওখানে অনেক বাচ্চার জন্ম হয়েছিল, চম্পার যেমন হয়েছিল পুনর্বাসনকেন্দ্রে, আবার অনেক মা নানা জায়গা থেকে এসে সেখানে বাচ্চা রেখেও গিয়েছিল। এসব শুনে ভাববার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। লিওনাকে সেদিন টিভিতে দেখার পর যা নিয়ে কখনো ভাবেনি তা-ই যেন জট পাকাতে লাগল। যেসব মা তাদের বাচ্চাদের শিশু ভবনে রেখে গিয়েছিল, তারা তো জানত না কে বা কারা তাদের বাচ্চা নিচ্ছে, কোথায় নিচ্ছে। যারা নিয়েছে তারাও বাচ্চাদের মায়ের নাম, বাড়িঘরের খোঁজ পায়নি। তবে কেউ কেউ হয়তো নাম-ঠিকানা রেখে গিয়েছিল। তেমন হলে কেউ মায়ের খোঁজ পেলে পেতেও পারে। যদি পায়ও, সে ঘটনা কেমন হবে—ভালো না মন্দ, সুন্দর না অসুন্দর কে বলতে পারে! সেই মায়ের কি সাহসে কুলাবে সামনে আসার, আর যে আসবে মাকে খুঁজতে, লিওনার মতো তুবড়ি ছোটানো ইংরেজি বুলির মুখে মা যদি সামনে আসেও, একজন অন্যজনকে দেখে কি গলা জড়িয়ে কাঁদতে লেগে যাবে, না মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ভাববে এ কে?

লিওনা এত বছর পরে কেন এলো? মা-র নাম-ধাম জানা নাই, কী তালাশ করতে এলো? দেখে তো মনে হয়নি মায়ের জন্য দুঃখ-কষ্টে আছে। তবে? কিছুতেই সুরাহা করতে না পেরে চম্পা ভাবল মানুষের কত ধরনের খেয়াল থাকে লিওনার ঘটনাটা হয়তো খেয়াল ছাড়া কিছু না।

পরপরই অন্য কথা মাথায় এলো। লিওনা যতই পালক বাবা-মার আদর-যত্নে বড় হোক, সে যে তার আসল মাকে কোনো দিন দেখল না, কেমন ছিল তার মা, বেঁটে না লম্বা, কালো না ফরসা, কিছুই জানল না এটা হয়তো তাকে সময় সময় জ্বালাতন করে। মা বলে কেউ কোনো দিন ছিল কি না, এমন চিন্তাও তাকে ভোগাতে পারে। ছোট যখন ছিল, তখন হয়তো সমস্যা ছিল না, যত বয়স বাড়ছে, জ্বালাটা খোঁচাখুঁচি শুরু করেছে।

কথাটা চম্পা এভাবে আগে ভাবেনি, এখন যখন ভাবছে, সে চমকে খেয়াল করল শেফালি বেগমের মুখটা অবিকল চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। দুলে দুলে মুখটা কাছে আসছে, ডান ভুরুতে ঝুঁকে পড়া জড়ুলটা চকচক করছে, চোখ দুটো ভারী পাপড়ি নাড়িয়ে তাকে দেখছে, আর এত কাছে থাকায় চোখ দুটো বড় বড় দেখাচ্ছে, মণি দুটো এগিয়ে এসে তার চোখে ঠেকে যাচ্ছে। কিন্তু চোখে ঝাপসা দেখছে কেন চম্পা? মা-র চোখ জোড়া কি ঢুকেই গেল তার চোখে, করকর করছে, জ্বলছে। চম্পা সুস্থির হয়ে ভাবল শেফালি বেগম সামনে না থাকলেও তার ছোঁয়া সে পাচ্ছে, লিওনা তো ভাবতে পারবে না সামনাসামনি না থেকেও এভাবে চোখে চোখে ঠোকাঠুকি সম্ভব!

.

সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেকক্ষণ। মান্তুর দেখা নাই। অন্যান্য দিন চম্পা আসার আগেই সে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে রাখে। মান্তুর মতিগতি ভালো ঠেকছে না। চম্পা সাবধান করার পর ঘরে আর আড্ডা বসায়নি, তবে ফাঁক পেলেই যে শাহজাদার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় এ খবর চম্পা যেমন জানে, মান্তুও গোপন রাখার দরকার মনে করে না। শাহজাদাকে নিয়ে চম্পা নিজে থেকে আর কথা তোলেনি। মান্তু তো সাফ জানিয়েছে তার একটা খুঁটি দরকার, শাহজাদা সেই খুঁটি। কে কার খুঁটি বলা মুশকিল। মান্তু বোকাসোকা হলেও এত বড় গাধা না যে ধরে নেবে শাহজাদা তাকে নিয়ে সংসার করবে, তবে নামকাওয়াস্তে বিয়ে করলে করতেও পারে। মান্তু চম্পাকে বলেছিল ব্যাংকে তার জমানো টাকা আছে, টাকার কথা কি শাহজাদাকে বলে দিয়েছে? মেয়েটার ধৈর্য দেখে চম্পা অবাক না হয়ে পারে না, এত বকাঝকা করে, কথাবার্তাও মাঝে মাঝে বন্ধ রাখে, মান্তুর কিছু যায়-আসে না। একটা ছুতা পেলেই বেহায়ার মতো ঢলাঢলি জুড়ে দেবে।

সকালে হালকা জ্বর নিয়ে চম্পা কাজে গিয়েছিল। এমন জ্বরজারিতে সে কাবু হয় না, খারাপ লাগলে একটা জ্বরের ট্যাবলেট খেয়ে কাজকর্ম যা করার করে। দিনটা খারাপ যায়নি, তবে বিকাল থেকে হাত-পা ভারী-ভারী, মাথাটাও ধরে আছে। ভেবেছিল ঘরে এসে একটা ঘুম দেবে, কিন্তু মান্তুকে না দেখে রান্না চড়াতে হবে ভেবে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। মান্তুর কারণে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। রান্নাবান্না মান্তু এক হাতেই করে, আর ঝটপট যা-ই রাঁধে, খেতে বসে মন ভরে যায়। মান্তু জানে সে কথা, বলবে এ তার হাতের মজা। হাতের মজার কাহন গাইতে গিয়ে তার আবদুর রহমানের বাপ কোন রান্নাটার বেশি তারিফ করত এ নিয়ে একবার মুখ খুললে ধমক দিয়ে না থামালে চলতেই থাকবে।

ঘুমিয়ে পড়েছিল চম্পা, চোখ খুলল মান্তুর নড়াচড়ায়। এক গাদা বাজার নিয়ে এসেছে, আনাজপাতি ছাড়াও পাউরুটি, বিস্কুট, ছেলের জন্য টুপি, পাঞ্জাবি, জুতা, চকোলেট, আবার একটা বড় প্যাকেট-ঠাসা আরও কিসব। চম্পাকে একটা ছোট চারকোনো বাক্স দিয়ে বলল, ‘কিরিমটা মাখবা, বিদেশি, চেহারা-সুরতের কী অবস্থা করছো!’ বলতে বলতে তার হয়তো খেয়াল হলো চম্পা কিছু বলছে না, চোখ বুজে পড়ে আছে। কপালে হাত দিয়ে ‘জ্বর বান্দাইলা ক্যামনে’ বলে পলিথিনমোড়া দুইটা প্যাকেট বের করে বলল, ‘আইজ রান্দুম না, এই দেখো বিরিয়ানি আনছি, তুমার কানাফুরকানের জিনিস না, ভালা জায়গা থাইকা আনছি। উঠো, খাইয়া লও, আমি মাথা টিপ্যা দিমু। উঠো।’

খেতে বসে চম্পা বলল, ‘ঘটনা কী, অত টেকার গরম?’

মান্তু হাসল, হাসলে তাকে সুন্দরই লাগে, বলল, ‘কইছি না তুমারে আমার কিছু টেকা আছে, আবদুর রহমানের কিছু জিনিস কিন্যা রাখলাম। আরও কিছু কিনছি একজনের লাইগা, জিগাইবা না।’

খেয়ে শুয়ে পড়তে চম্পা টের পেল জ্বর বাড়ছে, সঙ্গে হাতে-পায়ে ব্যথা। সকালে একটা নাপা খেয়েছিল, মান্তু আরেকটা খাওয়াল, তার পর বাতি নিভিয়ে পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে গিয়ে বাটিতে করে পানি এনে গামছা ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে লেগে গেল। চম্পা মানা করল, শুনল না।

ভোর রাতে ঘুম ভাঙতে চম্পা বুঝল গায়ে জ্বর নাই, মাথাও হালকা লাগছে। রাতে কতক্ষণ মান্ত্র জলপট্টি দিয়েছে বলতে পারবে না। এখন সে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। বেশি সময় গেল না, মান্তু এপাশ-ওপাশ করে উঠে পড়ল। চম্পা জেগে আছে দেখে মাথায় হাত দিয়ে অনেকটা যেন হতাশ গলায় বলল, ‘জ্বর নাই তো।’

বাইরে আলো ফুটছে দেখে চম্পা উঠতে যাবে, মান্তু তাকে ঠেলে শুইয়ে বলল আরও কিছু সময় যেন শুয়ে থাকে, সে খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছে। চম্পারও ইচ্ছা করছিল কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে। কাজে কামাই দেওয়া যাবে না, বড় অর্ডার নিয়ে ফ্যাক্টরি এ সময় মুশকিলে, সময়মতো কাজ তুলতে হুকুম জারি হয়েছে কেউ যেন কামাই না দেয়, দিলে চাকরি খতম। দরকারে অন্তত সপ্তা দুয়েক রোজ চার-পাঁচ ঘণ্টা ওভারটাইমও করতে হবে।

মান্তু বিছানা ছেড়ে নেমে দরজা খুলে আবার ফিরে এলো। এলো তো এলো, চৌকিতে উঠে বসল। কিছু যে বলতে এসেছে হাবভাবে পরিষ্কার। খামোখাই এপাশে-ওপাশে চেয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘একখান কতা কই, গোস্সা কইরো না।’

চম্পা ধরে নিয়েছিল সে শাহজাদাকে নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু মান্তু যা বলল সে কল্পনাও করেনি। ‘আজগর ভাই আইছিল’, মান্তু আস্তে আস্তে বলল।

চম্পা চমকে উঠে ভেবে পেল না কী বলবে। সারা রাত মাথায় জলপট্টির শোধ তুলতে এমন তাজ্জব কথায় তার ইচ্ছা হলো লাথি ঝেড়ে মান্তুকে চৌকি থেকে ফেলে দেয়।

মান্তু জানাল পাঁচ-ছয় দিন আগে সে তার ছেলেকে এতিমখানায় দেখতে গিয়েছিল। নিজেরই গ্রাম, তবে সে বরাবর আবদুর রহমানকে দেখেই চলে আসে, বাড়িমুখো হয় না। সেদিন ফেরার পথে রেলস্টেশনে আসার সময় নাম ধরে পেছন থেকে চেঁচানো শুনে দেখল আজগর। ‘কী কমু তুমারে, চিনা যায় না, শইল-গতর শুকাইয়া কাঠি কাঠি, চোখমুখ বইসা গেছে। এত দিন পরে দেখা, একটা কিছু কওয়া লাগে, জিগাইলাম অসুখ করছে নাকি? উল্টা আমারে জিগায় কেমন আছি। কইলাম খুব ভালা আছি। আর ওই সুময় মাথার ঠিক আছিল না গো চম্পাবু, ভুল কইরা ফালাইছি। কইছি, জোরে গলার রগ ফুলাইয়াই কইছি, তুমিও ভালা আছো।’

এখানে শেষ হয়ে গেলে কথা ছিল না। আজগর নাকি এর পর তার পথ আগলে ছিল, পথেঘাটে মানুষের সামনে পথ আগলানো ছাড়া আর কী করতে পারত, না হলে নাকি চম্পার খবর জানাতে তার পায়ে পড়ত। মান্তু যতই বলেছে জানে না, সে তত জেদ ধরেছে জানতে। ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছিল, সামনে এই আপদ, মান্তু নাকি তখন বলেছে সে আর চম্পা এক সাথে থাকে, বস্তির নাম বলতে চায়নি, আপদ বিদায় করতে বলে ফেলেছে। শুধু বস্তির নাম ধরে আজগর এখানে চলে আসবে মান্তু নাকি ভাবেনি। গত সন্ধ্যায় সে কাজ থেকে ফিরছে, এমন সময় তোরাবের টঙের দোকানের সামনে দেখে আজগরকে। পাশ কেটে চলে আসবে, কিন্তু ওই দিনের মতো আজগর পথ আগলে দাঁড়ালে কী করার থাকে! পারলে নাকি গতকালও তার পায়ে পড়ত ঘরটা চিনিয়ে দিতে। কী আর করে মান্তু, ঘরেই তো ফিরছিল। আজগর তার পেছন পেছন এসে দূর থেকে ঘর দেখে চলে গেছে।

চম্পা বাধ্য হয়ে শুনল, কতটা সত্যি কতটা বানানো আন্দাজ করা মুশকিল। লাথি ঝাড়ার ইচ্ছাটা তখনো যায়নি, মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। গোটা ঘটনাই হয়তো ওর সাজানো। প্রথম দিন এখানে এসেই মান্তু আজগরের কথা তুলেছিল।

মেজাজ সামলে চম্পা বলল, ‘শাজাদা না তোর খুটি, ওরে যাইয়া ক আমার একটা কাম করা লাগব। ওই আজগর না খাজগর যুদি আরেক দিন আসে, ওর য্যেন টেংরি ভাইঙা দেয়, পারব না? না পারলে কিয়ের খুটি, কিয়ের গুণ্ডা!

মান্তু থতমত খেয়ে চেয়ে থাকলে চম্পা বলল, ‘তুই আমার কত বড় দুশমন, আমি তর কী করছি তুই ওরে ঘর চিনাইতে গেরামে গিয়া এইখানে নিয়া আসলি! শাজাদারে ক আমার লগে দেখা করতে, আইজই।’

মান্তু কান মুলে বলল যা বলেছে সব সত্যি, একটা কতা যদি মিছা বলে থাকে সে তার বাপের পয়দা না, জাউরা, সে গু খায়।

যুদ্ধশিশু রানির হার

কথা ছিল লিওনার অনুরোধ রাখতে চেষ্টা করব। দেশে বড় হয়েছে এমন একজন যুদ্ধশিশুর দেখা পেলে তার জন্য বড় অভিজ্ঞতা হবে বলেছিল লিওনা। বড় অভিজ্ঞতা হবে জানা কথা। তাই বলে হাতের কাছের চম্পাকে তো ঠেলে দিতে পারি না। যদিও টিভিতে লিওনাকে কথা বলতে দেখে আমার ইচ্ছা হয়েছিল চম্পাকে ওর কাছে নিয়ে যাই, পরে যখন দিতির ফোন পেয়ে জানলাম লিওনাই আমার কাছে আসছে, আমি মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলি, আর লিওনাকে দেখার পর তো মনে হয়েছে চম্পাকে কিছুতেই ওর মুখোমুখি করা যাবে না—অবশ্য সেটা মোটেও সহজ কাজ হতো না। যে বিষয়টা আমাকে পীড়া দিয়েছে, চম্পাকে যদি জোরাজুরি করে ওর সামনে আনতেও পারতাম, লিওনার ঠিকই একটা অভিজ্ঞতা হতো, কিন্তু চম্পা কিছুতেই ওকে ওর সমগোত্রীয় ভাবতে পারত না; নিজের গ্লানিবোধ ওকে আরও বেশি পেয়ে বসত, সেই সঙ্গে হীনম্মন্যতা আর অসহায়ত্বও।

লিওনার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেছে, এর মধ্যে নিশ্চয় ফিরে গেছে। লিওনা মাথা থেকে সরতে না সরতে আরেক যুদ্ধশিশুর ঘটনা গত দুই-তিন দিন ধরে আমাকে রীতিমতো দখল করে রেখেছে। অটোয়া থেকে প্রকাশিত দেশে-বিদেশে পত্রিকায় একটা বড়সড় লেখা পড়ে জানলাম ভালো পরিবেশে মায়া-মমতার বন্ধনে থেকেও সব দত্তক বাচ্চার অবস্থা লিওনার মতো নয়। পত্রিকাটা পাঠিয়েছে আমার স্বামীর এক সময়ের ছাত্র আখতার, অনেক দিন হলো সে কানাডার বাসিন্দা। যে লেখাটার কথা বলছি সেটা কানাডায় দত্তক হয়ে চলে যাওয়া এক যুদ্ধশিশুকে নিয়ে। এও মেয়ে, নাম রানি। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুস্তফা চৌধুরী। বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশুরা অনেক দেশেই গিয়েছে, তবে কানাডায় দত্তক হয়ে যাওয়া শিশুদের ঘটনাটা সে সময় আমাদের খুব নাড়া দিয়েছিল। কানাডা সরকার ও কানাডিয়ান কয়েকটা নামি এনজিও তখনকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে নিখুঁতভাবে দত্তক নেওয়ার কাজটা সেরেছিল ও বাচ্চাদের কানাডায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। দেশের কাগজে কিন্তু এত বড় ঘটনাটা মোটেও প্রচার পায়নি। খুব সম্ভবত বাংলাদেশ অবজারভার ছাড়া অন্য কোনো কাগজ নিউজটা কভার করেনি। ঘটনাটা বড় এজন্য যে এয়ার কানাডার একই ফ্লাইটে পনেরোটা বাচ্চা চলে গিয়েছিল। এদের মধ্যে আটজন ছেলে, সাতজন মেয়ে। রানি এদের একজন। শিশু ভবনে ওর মা ওকে রেখে যাওয়ার সময় নিজের নাম-ঠিকানা দিয়ে যায়নি, আর বাচ্চার নাম বলে কিছু থাকার কথাও নয়। খাতায় নাম পাওয়া গেছে রানি। সেটা নিশ্চয় শিশু ভবনের কর্মীদের কারো দেওয়া।

কানাডায় পৌঁছার পর রানির নতুন নাম রাখা হয়েছিল রানি জয় মরাল। রানির বিষয়ে লিখতে গিয়ে মুস্তফা চোধুরী প্রচুর খেটেছেন। তাঁর লেখাতেই এর প্রমাণ মেলে। দেশে নানা দলিলপত্র ঘেঁটেছেন, আবার কানাডায় রানির পৌঁছানো থেকে শুরু করে দত্তক বাবা-মায়ের বাড়িতে তার বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, গান-বাজনায় তালিম নেওয়া ইত্যাদি যত্ন করে তুলে ধরেছেন; যদিও শেষরক্ষা হয়নি, মেয়েটার পরিণতি ছিল মর্মান্তিক।

মুস্তফা চৌধুরীর লেখায় রানির কথা পড়ছিলাম আর চোখের সামনে লিওনাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। দুজনই মা-পরিত্যক্ত, দুজনই দুই উন্নত দেশে তাদের পালক বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই রানিকে লিওনার সঙ্গে মেলানো যাবে না। ছোট থাকতে রানি চটপটে ও হাসিখুশি ছিল, সহজে যে কারো সঙ্গে মিশতে পারত। সুন্দর ভায়োলিন বাজাত, পড়শি এক ভারতীয় পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। সে ওই বাড়িতে নাচ শিখতে যেত। শিশুদের নাচ শেখাতেন বাড়ির কর্ত্রী মিসেস লাল। রানি অল্প দিনেই নাচ রপ্ত করেছিল, এমনকি ধ্রুপদী ভারতীয় নৃত্য পর্যন্ত। রানির পালক বাবা-মা রবিন মরাল ও বারবারা মরাল মনেপ্রাণে চাইতেন সে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির সাথে ভালোভাবে পরিচিত হোক। তাঁরা খুঁজে খুঁজে বাঙালি ও পূর্বভারতীয় পরিবারের সঙ্গে রানির যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতেন।

এতদূর পর্যন্ত ভালোই চলছিল। রানিকে ছোটবেলাই তার জন্মবৃত্তান্তসহ বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিয়ে আসার ঘটনা তারা বলেছিলেন। ব্যাপারটা সে কতটা বুঝেছিল এ নিয়ে তাদের মনে কিছুটা সংশয় থাকলেও তারা দেখতে পাচ্ছিলেন সে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক কিশোরী হয়ে বেড়ে উঠছে। কিন্তু বয়স পনেরো-ষোলো হতে তারা লক্ষ করলেন রানি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তার হাসিখুশি, বহির্মুখী স্বভাবে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে, দিন দিন সে অন্তর্মুখী ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। বন্ধু-বান্ধবহীন একাকিত্বই তার সঙ্গী। এ সময় একদিন সে আত্মহত্যার চেষ্টাও করে বসে। পালক বাবা-মা তখন ভাবলেন যদিও রানিকে তার সম্বন্ধে তারা যেটুকু জানেন বলেছেন, তারপরও সে নিশ্চয় কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য ধরে রাখতে পারছে না। তারা এও ভাবলেন এমন কি হতে পারে সে তার বাস্তব অবস্থার সাথে পরিত্যক্ত, পরিচিতিহীন যুদ্ধশিশুর কাল্পনিক চিত্রকে মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে? অতীতহীন হয়ে সে নিজের বর্তমান-ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না? তারা তখন চিন্তা করলেন রানিকে যদি তার জন্মদেশ থেকে ঘুরিয়ে আনা যায়, সে হয়তো পরিস্থিতির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে পারবে। কথাটা রানিকে জানাতে সে খুশিই হলো না, তাদের মনে হলো উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়ল। কিছু দিন গেল যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করতে। তার পর রানির জন্মদেশে যাত্রা। সেটা ১৯৮৯।

ঢাকায় পৌঁছে রানির আনন্দ দেখে কে! রবিন ও বারবারার মনে হলো মেয়েটাকে তারা আগে কখনো এত আনন্দে ভাসতে দেখেননি। তাকে নিয়ে তারা শিশু ভবনে গেলেন। এ ছাড়া আরও দু-একটা অনাথ আশ্রমে। রানি যেন এরই অপেক্ষায় ছিল এত বছর। শিশু ভবনের রেজিস্টারে নিজের নাম ও জন্মের তারিখ নিজের চোখে দেখে সে এতই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিল যেন সে তার অতীতকে দেখতে পাচ্ছে, এমনকি রবিন ও বারবারার মনে হয়েছে সে তার অতীতের সঙ্গে যেন যোগাযোগও করতে পারছে। তাদের তখন মনে হয়েছে সব কিছুতে সে নিজের অজানা অতীতের ছোঁয়া পাচ্ছে, আর এসবের মধ্যে তার অদেখা, কাল্পনিক মা-র মুখও বুঝি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। জন্মদাত্রী মায়ের ওপর তার রাগ-ক্ষোভ বা অভিমান ছিল না। মনে হচ্ছিল সে তার অতীত ও বর্তমানকে যুক্তি দিয়ে বিচার করার শক্তি খুঁজে পাচ্ছে।

কানাডায় ফিরে যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যে তাকে আবার সেই পুরনো বিষণ্ণতা পেয়ে বসে। ব্যাপারটা তখন শুধু বিষণ্নতা ছিল না, সে প্রায়ই অশান্ত হয়ে উঠত। পালক বাবা-মায়ের তখন মনে হতো বাংলাদেশে গিয়ে সে এক ধরনের শান্তি পেয়েছিল ঠিকই, তবে ফিরে যাওয়ার পর তার মধ্যে অস্থিরতা ও অনিরাপত্তাবোধ দেখা দিতে শুরু করে—যেন সে তার অতীত-বর্তমানের টানাপড়েন থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না। অথচ বাংলাদেশে যাওয়ার পর তাদের উল্টোটাই মনে হয়েছিল, আর ফিরে গিয়ে তাদের মনে হলো অদেখা-অজানা অতীত তার জীবনে এমনভাবে হানা দিচ্ছে সে এর উপস্থিতিতে বিপর্যস্ত হচ্ছে। যে পালক মা বারবারাকে সে তার একমাত্র মা বলে জেনে এসেছে, তার এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষ যেন সে চারপাশে দেখতে পেত। অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। চিকিৎসা আগে থেকেই চলছিল, কিন্তু তার অবস্থা তখন এতই খারাপ, পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। চিকিৎসায় রানি সাড়া দেয়নি। শেষপর্যন্ত সে নিজের সাথে যুদ্ধে হেরে যায়।

মুস্তফা চৌধুরী কানাডার নানা জায়গা ঘুরে যে পনেরোজন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের সাথে কথা বলেছেন, তাদের পালক বাবা-মায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, তাদের বেড়ে ওঠার গল্প শুনেছেন। রানির মতো কাউকে তিনি পাননি। আসলে রানি যে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগে ভুগে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল, তা অন্যদের মধ্যে তিনি দেখেননি। দ্বন্দ্ব একেবারেই ছিল না তা হয়তো না, তবে রানির মতো ভুক্তভোগী কেউ ছিল না। মুস্তফা চৌধুরী লিখেছেন রানির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কখনো না-দেখা জন্মদাত্রী মাকে তার কানাডীয় বাস্তব জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা। কাজটা কঠিন ছিল বলে হেরে গিয়ে মেয়েটাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।

রানির কাহিনি পড়ে এক সময় চমকে উঠলাম। লিওনার কথা মনে পড়ল। সেই যে লিওনা বলেছিল সে যদি তার আসল মায়ের দেখা পেত তা হলে সমস্যায় পড়ত—একজন অজানা, অচেনা মা তার চারপাশে ঘুরঘুর করত। এমন একটা পরিস্থিতি যা রানির বেলায় ঘটেছিল তা সে কী করে আগেভাগেই চিন্তা করতে পেরেছিল!

কয়েক দিন চম্পার খোঁজ-খবর নাই। ফোনও করেনি, সে কি ভাবছে জবা এখন আমার কাছে আছে বলে ঘন ঘন ফোন করলে আমি কী ভাবব! চম্পাকে পেলে রানির কথা বলতাম। লিওনার সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা তাকে বলব না ভেবেছিলাম, শুনতে তার ভালো লাগবে না। কিন্তু রানির কাহিনি শুনলে সে অন্তত এটুকু সান্ত্বনা পেত—বিদেশে দত্তক হয়ে গিয়ে আরামে-আয়েশে থেকেও রানির চেয়ে সে ভাগ্যবান, তার একজনই মা, আর সে মা কল্পনার কেউ না, তাকে সে চেনে, জানে। চাইলে তার কাছে যেতেও পারে।

শান্ত শেফালি দীপ্ত শেফালি

‘আমি মেরাজ ফকির গো মা’ বলে চুল-দাড়ি-গোঁফে আলুথালু বুড়োসুড়ো যে লোকটা দরজায় তাকে কোনো দিন দেখেছি বলে মনে পড়ল না। তবে নামটা চেনা-চেনা মনে হতে সে কাঁচুমাচু মুখে ‘আমি শেফালির …’ বলতে নজর করে দেখলাম। হ্যাঁ, সে শেফালির … বাবা বটে। বাবা বলার অধিকার হারিয়েছে বলে কি বলতে লজ্জা না ভয় পাচ্ছে কে জানে! কেন্দ্রে গিয়ে আমাকে না পেয়ে ঠিকানা ধরে বাসায় এসেছে।

বাবা-মাকে নিয়ে শেফালির সঙ্গে কখনো কথা হতো না, আমি তো বলতামই না, সেও না। চম্পা হওয়ার আগে শেষবারের মতো তারা দুজন এসেছিল, তার পর আর খবর নাই। এত দিন পরে কী মনে করে জিজ্ঞেস করতে মেরাজ ফকির জানাল শেফালির মা-র শরীর খুব খারাপ, বাঁচার আশা নাই, মেয়েকে শেষবারের মতো দেখতে চায়। শেফালি কি রাজি হবে তার সাথে বাড়ি যেতে?

জবাবে আমি কী বলি! মনে মনে বললাম তোমাদের কাছে মেয়ে মরে গেছে অনেক আগে, এখন মরা মেয়েকে নিতে এসেছো মরো-মরো মাকে দেখাতে! লোকটা বলল সে নাকি মাঝে মাঝে কেন্দ্রে এসে আশপাশে ঘোরাঘুরি করে চলে যায়। শেফালির সামনে না পড়লেও একবার দূর থেকে শেফালিকে বারান্দায় কাপড় মেলতে দেখেছে। শেফালির মেয়ে হয়েছে এ খবর জানে।

তাকে বললাম শেফালি এখন একটা কাজ করে, সারা দিন কাজের জায়গায় থাকে। যাবে কি যাবে না তার ব্যাপার, সে বরং শেফালির সঙ্গে দেখা করুক, তবে সন্ধ্যার আগে হবে না। আমি খবর দিয়ে রাখব যাতে দেখা করতে পারে। বেলা তখন দুপুর, খেয়ে যেতে বললাম। রাজি হলো না, বলল সন্ধ্যায় কেন্দ্রে শেফালির জন্য অপেক্ষা করবে, সে সময় আমি কি থাকতে পারব? যার মানে একা মেয়ের সামনে যেতে ভরসা পাচ্ছে না। রাগ হলো কথা শুনে, তবে তাকে কিছু বলতে বাধল।

মেরাজ ফকির চলে যেতে ভাবলাম দেখি শেফালি কী সিদ্ধান্ত নেয়। আমি যাব না, বাবা-মেয়ের মোলাকাত না-ই দেখলাম। যদি শেফালি যেতে রাজি হয়, তার জন্য ভালোই হবে। কাজ করতে মাস দুয়েক রোজ বাইরে যাচ্ছে, পরিবর্তন যে এর মধ্যে কিছু কিছু হয়েছে দেখতে পাচ্ছিলাম। দোকানপাটে নিজে নিজেই গিয়ে এটা-ওটা কিনছে। চম্পার জন্য চুড়ি, কানের দুল, নিজের জন্য ভ্যাসলিন, সাবান। কোনো দিন আবার অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসও। দিনকয়েক আগে নিয়ে এসেছে পুরু, শক্ত খোসাওয়ালা টেনিস বল সাইজের এক ধরনের পানি ফল, আছড়ে ফাটালে ভিতরে আনারদানার চেয়ে খানিকটা বড় কালো কালো গুটি, দাঁতে কামড়ে ভাঙলে কষাটে-মিষ্টি স্বাদের শাঁস, খেতে মন্দ না। কোথায় পেল এ জিনিস, জীবনে দেখিনি। শেফালি জানাল বর্ষার মৌসুমে তাদের গ্রামের বাজারে এ ফল ওঠে, নাম পুকল না পাকুল। কাজ থেকে ফেরার সময় ফুটপাথে দেখে নাকি লোভ সামলাতে পারেনি, কত কাল খায়নি। বললাম, ‘খা, পেট খারাপ করলে আমাকে বলবি না।’ নিজে খাওয়ার চেয়ে সে আমাকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খেলাম দু-চারটা, তবে প্রশংসা করার মতো কিছু পেলাম না। হতাশ হয়ে বলল, ‘তুমি শওরের মানুষ, এর মজা কী বুজবা!’ অন্য ঘটনাও আছে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে শেফালি ও বাকি তিনজন মিলে চাঁদা তুলে আমার জন্য শাড়ি কিনেছে। আমি যেমন পরি—হালকা রঙের সরু পাড়ের সুতির। চেঁচামেচি করলাম কতক্ষণ। কে শোনে সেসব! তারা আমাকে শাড়িটা পরিয়েই ছাড়বে। পরলাম, ভালোই লাগল, মনে হলো এমন আনন্দ ওরা অনেক দিন পায়নি। ওদের সঙ্গে অন্য মেয়েরাও যোগ দিল। বাইরে থেকে খাবার আনালাম, ওদের সাথে খেলাম, খাওয়ার পরে ওরা গান ধরল, সম্ভবত মালতীর শেখানো ঝুমুর বয়াতির গান।

বাসায় ফিরে ফুরফুরে লাগছিল। কেন্দ্র উঠে যাবে এমন গুজবে কিছু দিন ধরে যে ভয়ে ছিলাম তা যেন আর তেমন দুশ্চিন্তার কারণ বলে মনে হলো না। মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে, মানিয়েও নিচ্ছে, নিজেদের ব্যবস্থা ওরা এখন নিজেরা করতে পারবে, কিছু দিকদিশা দিলেই হবে। সবচেয়ে যা ভালো লাগল, তারা আনন্দ উপভোগ করার মানসিকতা ফিরে পাচ্ছে।

মেরাজ ফকির শেফালির সামনাসামনি হবে, আমার সন্দেহ ছিল, যদিও মনে মনে চেয়েছি তারা মুখোমুখি হোক, আর মায়ের শরীর খারাপ শুনে শেফালি বাড়ি যেতে রাজি হলে এর চেয়ে ভালো কী হতে পারে! শুনে অবাক হলাম শেফালি নাকি বাপকে পেয়ে যত্ন-আত্তি করে বসিয়েছে, তাদের কী কথাবার্তা হয়েছে কেউ না জানলেও শেফালি অন্যদের বলেছে অসুস্থ মাকে দেখতে সে তার বাপের সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে। কেন্দ্রে মেয়েরা কতটা অবাক হয়েছিল বলতে পারব না, তবে আমি মনে মনে চাইলেও ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি শেফালি সত্যি সত্যি যাবে। সে রাতেই সে মেরাজ ফকিরের সঙ্গে চলে গিয়েছিল। চম্পাকে রেখে গিয়েছিল অন্য কারো জিম্মায়।

ঘটনাটা সাড়াজাগানো বললে কম বলা হয়। যে শেফালি কখনই বাড়িঘর, বাব-মা-ভাই নিয়ে কথা বলত না, কেউ কিছু জানতে চাইলেও সাড়া দিত না, সে মায়ের অসুখের খবর পেয়ে বাড়ি যাবে আর ঠিক পরদিন সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গেই ফিরে আসবে তা আমার কাছে ধাঁধা ছাড়া কী!

‘কেমন দেখলি মাকে?’

আমার কৌতূহলচাপা প্রশ্নে শেফালি যা বলল তা চমকে দেওয়ার মতো। বলল মা বাঁচবে না বাপের কথায় আগেই আন্দাজ করেছিল, গিয়ে দেখলও তাই; তবে মরার আগে মাকে শেষ দেখা দেখতে সে যায়নি, গিয়েছে এটা বোঝাতে যে বাপ-মাকে সে মাফ করে দিয়েছে—তার মাফ ছাড়া ওদের কবরের আজাব কোনো দিন শেষ হবে! হাঁ হয়ে শুনলাম। এমন ঘোরপ্যাচের কথা শেফালির মুখ থেকে এত সহজে বেরোতে পারে ভাবিনি। সে তবে কবরের আজাব নিয়েও ভাবে? ধর্মকর্ম করতে তাকে কোনো দিন দেখিনি। অন্য মেয়েদের কেউ কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, রোজার সময় রোজা থাকত। শেফালিকে চেষ্টা করেও তারা সে পথে নিতে পারেনি।

বাড়ি যাওয়ার ঘটনাটা নিয়ে শেফালি কেন্দ্রের মেয়েদের কী বলেছিল, সে সময় না জানলেও পরে শুনেছি রাতেই নাকি গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল শেফালি বাড়ি এসেছে। আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন, বিশেষ করে মহিলারা উঠানে জড়ো হতে শুরু করেছিল। শেফালির বাবা মেয়েকে নিয়ে দরজা আটকে ছিল, কিন্তু শেফালি নাকি জোর করে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলেছে, ‘ছিরাঙ্গনারে দেখতে আইছো, দেখো।’

দিন দিন শেফালির পরিবর্তন চোখে পড়ছিল। কেন্দ্রের চার দেয়ালে এত দিন বন্দি থেকে তার চিন্তা-ভাবনা, মুখের কথা, কথার যুক্তি সবই যেন চাপা পড়ে গিয়েছিল। দেখে বোঝা যায়নি অপেক্ষায় ছিল কবে বাইরে যাবে। কাজের জায়গায় সে অন্যদের চেয়ে ভালো করছিল। এসবের মধ্যে আমার চোখে যা পরিষ্কার ধরা দিচ্ছিল—সে অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে পড়ছে। একদিন বলল কেন্দ্রে তার থাকতে ভালো লাগে না, কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা ভালো, খাওয়াদাওয়ায় খরচ নাই, তবু তার দমবন্ধ লাগে। আরও বলল, এত দিন তো বাইরে বেরোয়নি, তাই জানত না, এখন রোজ সকালে যখন কাজে বেরোয়, গলির রাস্তায় লোকজন টিটকারি দেয়। ‘একবার যখন আমারে বাইর করছো, দুইন্যাটা চইরা-ফিরা দেখি—এইখানে থাকলে অইব না। আর কত দিন তুমার আচলে বাইন্দা রাখবা!’

‘কী করবি?’

‘কাজ-কাম তো কিছু শিখছি। আরও কয়টা দিন যাউক, নিজে নিজেই একটা কিছু করুম। তুমি দুয়া করবা।’

কথা শুনে তারিফ না করার কারণ ছিল না। তবে সে যে বাইরে বেরোতে না বেরোতেই এতটা জোর পেয়ে যাবে, এ চিন্তার বিষয় না হলেও অবাক করার তো বটেই। নিজের সাথে যুদ্ধটা সে কখন করল, নাকি চুপচাপ করে গেছে, আমি টের পাইনি?

.

এ সময়ই জাফর সাদেক ঘটনাটা ঘটায়। কী করে সে শেফালির খোঁজ পেল, কে যোগাযোগ করিয়ে দিল কিছুই জানতে পারিনি। শুধু জানলাম শেফালি যে এত দিন মুখ বুজে ছিল, সেই মুখ খুলতে গিয়ে আড়াল-আবডাল তো মানেইনি, মুভি ক্যামেরার মুখোমুখি চোখধাঁধানো আলোয় কিছুটা দিশেহারা দেখালেও মাথায় যেন তার রোখ চেপেছিল যা কোনো দিন বলেনি বলবে। আলো ঠিকরানো মুখ, ডান ভুরুর ওপরে ঘোর বাদামি জড়ুল আর দীর্ঘদিন ছিপিবদ্ধ মুখ ও চাপা নিঃশ্বাসের ভারে তীব্র চাউনি—জাফর সাদেকের কী কপাল, এমন বীরাঙ্গনা তার ক্যামেরায় ধরা দিয়েছিল!

ক্যামেরার ফোকাস ঝলসানো চোখের দৃষ্টিতে স্থির হতে গিয়েও যেন টিকতে পারছিল না। এলিয়ে পড়ছিল পানপাতা মুখে, কানঘেঁষা ঝুরিঝুরি চুলে আর আমাকে যা বরাবর টানত—তার চিবুকের দরাজ মায়ায়। কিন্তু তাকানোয় মায়া-টায়া ছিল না, তীব্র সেই চোখ অচেনা লাগছিল, মনে হচ্ছিল ঠিকরানো আলোটাকে হটিয়ে সে তার খানিকটা কোঁচকানো দৃষ্টিকে একের পর এক ফুলকির মতো ছুড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মুখে কথাও ফোটাচ্ছে, আর জাফর সাদেক যেন প্রতিটা ধ্বনি, ধ্বনিতরঙ্গকে শূন্য থেকে একের পর এক তুখোড় বাজের ছোঁ-তে লুফে নিচ্ছে। সে কি কল্পনা করেছিল তিন বছরের আড়মোড়া ভেঙে শেফালির গলা অনর্গল কথার তোড়ে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে! নিজের কাহিনি নিয়ে কোনো দিন মুখ খোলেনি, অথচ ক্যামেরার ইতরামি তোয়াক্কা না করে জাফর সাদেকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছে, প্রয়োজনের বেশিই দিয়েছে—গ্রামে মিলিটারির হামলার মুখে দলছুট হয়ে এক ছাড়াবাড়িতে গিয়ে হাঁফ ছাড়ার পরপরই অভাবনীয় কারসাজিতে কিভাবে ধরা পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিল।

এতটুকু বললেই যা বলার বলা হয়ে যেত, কিন্তু শেফালিকে তখন থামায় কে! সে বলে গেছে, একটা স্কুল ঘরে আরও অন্তত ডজনখানেক মেয়ের সাথে বর্বরতায় বিক্ষত দিন-রাতের কথা। সাবলীল গলা, যেন অনেক দিন ধরে একটু একটু করে তৈরি করে গলাকে ছেড়ে দিতে তার মোটেও বেগ পেতে হয়নি। চমকের আরও বাকি ছিল। শুধু ধরা পড়া আর ক্যাম্পের নিগ্রহে থেমে গেলে শেফালি মানুষের চোখে বড়জোর একজন বেলাজ বীরাঙ্গনা হয়েই থাকত। সে পরে যা হয়েছে তা কি হতে পারত! সে কেবল শেফালি থাকেনি, শেফালি বেগম হয়ে তার পরিচিতিকে হু হু ছড়িয়েছে।

শেফালি কি তখন ভেবেছিল আর কী বলবে বা বলা উচিত? মনে হয় না। ছিপি খুলে গলা ছেড়ে দেওয়ার পর তার হয়তো কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না নিজের ওপর। না কি চোখে-মুখে ঠিকরানো আলোর দাপট সয়েও সে ঠান্ডা মাথায় যা বলার বলেছে? তৈরি হয়েই ছিল বলবে বলে, সুযোগ পাচ্ছিল না বলে কথার বারুদ চেপে রেখেছিল মাথায় বা বুকে-পেটে কোথাও? এ শেফালি আমার অচেনা, তিন বছর গায়ে গায়ে লেগে ছিলাম বলতে গেলে, টের তো পাইনি ধিকিধিকি আঁচ নিয়ে বুকে-পেটে বা মাথায় বারুদটা কী করে টিকে ছিল।

জাফর সাদেক তাকে প্রশ্ন করেছিল স্বাধীন দেশে তার কেমন লাগছে? দ্রুত পলক ফেলে শেফালি সোজা ক্যামেরায় চোখ রেখেছিল, একটু আগের কোঁচকানো চোখের পাতা পরিপাটি, আলোটা যেন তাকে আর উত্ত্যক্ত করছিল না। শেফালি ধীরে, পরিষ্কার গলায় বলেছিল, দেশটা স্বাধীন হয়ে তাকে পরাধীন করেছে; যুদ্ধটা যদি না হতো তার মতো লাখ লাখ মেয়ের জীবন বরবাদ হতো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *