চম্পারণ আর এক গান্ধীর খোঁজে – বিশ্বজিৎ রায়
”দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার পর দেশের রাজনীতিতে আমাকে কে চিনত? হিন্দুস্তানের সহেগ আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে চম্পারণ। চম্পারণের কৃষক জেগে ওঠার পর তার সঙ্গে সঙ্গেই জেগে ওঠে গোটা দেশ।” উনিশশো সতেরোয় ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে চম্পারণের কৃষক সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দিনগুলো মনে রেখে গান্ধীজীর স্মৃতিচারণ। নীলকুঠির সাহেবদের অত্যাচারে জর্জর প্রথম যুদ্ধের দিনগুলি থেকে চৌত্রিশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা—বারংবার চম্পারণের পাশে ছুটে এসেছেন তিনি। নেপাল ও উত্তরপ্রদেশের কোল—ঘেঁষা, জঙ্গল ও পাহাড়ঘেরা উত্তর বিহারের এই জেলার মাটি, মানুষের কাছে ফিরে ফিরে এসেছেন মিস্টার গান্ধী—তাঁর ‘বাপু’তে রূপান্তরের বছরগুলোয়। গঙ্গার প্রবাহ থেকে অনেকদূরে হিমালয়ের তরাই—ছোঁয়া এই প্রান্তভূমির মানুষকে জাতীয় সংগ্রামের মূল ধারায় মেলানোর স্বপ্ন নিয়ে তিনি হেঁটেছেন বিশাল জেলার পূর্ব থেকে পশ্চিমে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে তাই প্রচারের আলো এসে পড়ছে চম্পারণের উপরও। ‘৭২ সালেই পূর্ব ও পশ্চিম দুই জেলায় বিভক্ত হয়েছে আদি চম্পারণ। কিন্তু তাতে আর ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি বা সমাজসংস্থান এতটুকুও বদলায়নি। আজাদির পঞ্চাশ বছরে আদতে কতটা বদলেছে ‘বাপু কি কর্মভূমি’? কেমন আছেন সেই অত্যাচারক্লিষ্ট রায়তদের আজকের প্রজন্ম? অন্ত্যজের অন্ত্যজ যে মানুষগুলির ম্লান, মূক মুখে ভাষা দিতে দুর্গম, প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে কস্তুরবাকে নিয়ে বুনিয়াদি স্কুলের বলয় গড়ে তোলেন গান্ধীজী, আজ তাঁদের শিক্ষা কত দূর এগোল? নেহরুর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে রাও—মনমোহন—চিদম্বরমের বাজার অর্থনীতি কী পরিবর্তন এনেছে গান্ধীগ্রামগুলির আমজনতার জীবনে? এ সব সাতপাঁচ প্রশ্ন নিয়েই ছুটেছিলাম পটনা থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূরে চম্পারণের গভীরে।
পশ্চিম চম্পারণের সদর বেতিয়া থেকে চম্পারণের শেষ বড় রেল স্টেশন নরকটিয়াগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার হাল তবু সহনীয়। কিন্তু নরকটিয়া থেকে ১৭ কিমি দূরে বিথিহারোয়ার গান্ধী আশ্রম যাওয়ার রাস্তায় অন্নাপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। ক্ষতবিক্ষত খোয়া ওঠা রাস্তার মাঝে মাঝে পিচের কালি জানান দেয় কখনও এখানে অ্যাসফল্টের আস্তরণ ছিল। আদিগন্ত মানুষ সমান আখের খেত, মাঝে মধ্যে সবুজ ধানের ঢেউ। নেচেকুঁদে চলেছে ট্র্যাকটরের পর ট্র্যাকটর। মাঠে মাঠে ব্যস্ত কিসান—মজুর। দূরে শিবালিক পাহাড়ের ছায়া আর নেপাল সীমান্তের জঙ্গল। চতুর্দিক সবুজে মাখামাখি। হঠাৎ মনে হবে যেন পাঞ্জাব—হরিয়ানায় পৌঁছে গিয়েছি। ভুল ভাঙে ভয়বহ রাস্তাঘাট, মলিন ছিরিছাঁদহীন ইঁটের পাঁজরা বের করা বাড়ি আর খোড়ো ঘরের গ্রামগুলি দেখে। পাঁক আর আবর্জনায় বর্ষার গ্রাম নরককুণ্ড। সেখানে গা এলিয়ে মানুষ ও মহিষের সন্তান। দু’ জনেরই ক্ষয়াটে শরীর প্রমাণ দেয় চম্পারণ দেশের তথা বিহারের সবচেয়ে অনুন্নত জেলাগুলির তালিকার মাথার দিকে।
বিথিহারোয়ায় গান্ধী পৌঁছন ‘১৭—র ১৬ নভেম্বর। চার দিন পর সেখানে আসেন কস্তুরবা। গ্রামের সম্পন্ন রায়ত মুকুটধারী প্রসাদ চৌহানের বাড়িতে থেকে রামনারায়ণ দাসের জমিতে আশ্রম আর পাঠশালার নির্মাণ শুরু করেন। খবর পেয়ে বেলবা কুঠির দুর্দান্ত কুঠিয়াল এ সি আমন সেই খোড়োঘরে আগুন লাগিয়ে দেন। অকুতোভয় গান্ধী ও তার সঙ্গীরা ফের সেই ঘর তৈরিতে হাত লাগান। আজ সেই আশ্রম প্রাঙ্গণে পাকা ঘর। গান্ধীর আবক্ষ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন বর্ষীয়মান প্রয়াগলাল চৌরাশিয়া। তাঁক ঘিরে বিথিহারোয়া, শ্রীরামপুর, ভৈইরিয়া, মৌলওয়া—সহ আশাপাশের বিভিন্ন গ্রামের পথচলতি মানুষের ভিড় জমছিল।
কেমন আছেন গান্ধীগ্রামের মানুষ? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে কী পেলেন আপনারা? প্রশ্ন শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বৃদ্ধ প্রয়াগ প্রসাদ, ”স্রিফ নীলহা গয়া। বেট—বেগারি নেহি হ্যায়। বাকি কুছ নেহি পায়া। জুলুম কা রূপ বদলা। পরিবর্তন এহি হুয়া।” তল্লাটের মানুষ একথায় সমস্বরে সায় দিয়ে তাঁদের দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসল। বিথিহারোয়া পঞ্চায়েতের ৯টি গ্রাম তো বটেই, ধনধাহা ব্লকের বহু গ্রামেই আজও বিদ্যুৎ নেই, জানালেন প্রাক্তন মুখিয়া জগন্নাথ প্রসাদ, ”বিদ্যুতের লাইন এসেছিল এই গ্রামে। কিন্তু ৮ বছর আগে তার চুরি যাওয়ার শাস্তিস্বরূপ আজও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। বহু মিনতি করেও লাভ হয়নি।” গ্রামের কাছে একটা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে বটে। কিন্তু সেটা নাম কা ওয়াস্তে। ডাক্তারবাবুকে কয়েক মাস চোখে দেখেননি গ্রামবাসীরা। গ্রাম থেকে কয়েক কিমি দূরেই গণ্ডকের নহর বা সেচ খাল। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে গ্রামের বড় নলকূপ বা বোরিং পাম্প অচল। সেচের অভাবে আজও ধুঁকছেন গান্ধীগ্রামের রায়ত। পানীয় জলের সঙ্কটে গোটা কয়েক সরকারি টিউওয়েল ভরসা। সেগুলিও প্রায়শই বিকল হওয়ায় নিজেদের খরচেই মেরামতি করার বিধান দিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তারা।
প্রত্যন্ত গ্রামের অনগ্রসর, নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ছড়ানোর তাগিদে প্রায় ৮০ বছর আগে যেসব বুনিয়াদি স্কুলের পত্তন করেছিলেন গান্ধী ও তাঁর সহযোগীরা, সেগুলির অবস্থা আজ শোচনীয়। বিথিহারোয়ার স্কুলের পাকাবাড়ি জুটলেও শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৪৫০ ছাত্রকে যেখানে পড়ানোর ব্যবস্থা, সেখানে নয় জন শিক্ষকের মঞ্জুরি থাকা সত্ত্বেও মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে কাজ চলছে। ”৭৪—৭৫ সাল থেকে এই অচল অবস্থা চলছে। গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় শিক্ষক চলে যাওয়ার পর এখন আমিই একা সামলাই,” অম্লান বদনে বললেন শিক্ষক রামকুমার সিংহ। দুপুরে খালি গায়ে গান্ধী আশ্রমে বসে তিনি যখন কথা বলেছিলেন, তখন দূরে স্কুলের ঘরে বসে থেকে হাপিত্যেশ ছাত্র বই বগলে বাড়ি ফিরে আসছে। এই গ্রামে বা আশেপাশে মাধ্যমিক স্কুল নেই। তার জন্য দু’ কিমি হাঁটতে হবে। কলেজ ১৭ কিমি দূরে নরকটিয়া বা আরও দূরের সিকটা, বাগহা বা বেতিয়ায়।
নারীশিক্ষার জন্য ৮০ বছর আগেই গান্ধীজী উদ্যোগ নিলেও চম্পারণ বা বিহারের আজকের শাসকেরা সময়ের চাকাকে উল্টোদিকে ঘোরানোই পছন্দ করেন। সেই কারণেই বিথিহারোয়ার গান্ধী আশ্রমের অদূরেই কস্তুরবা গান্ধী গার্লস হাইস্কুলটিতে আজ ছাগল চরে। নামে হাইস্কুল হলেও আসলে পাঠশালা। খোড়ো চালের দেওয়ালবিহীন একটি চৌহদ্দিতে গুটিকয়েক বেঞ্চ পাতা। সরকারি অনুমোদন না মেলায় ক্লাসরুম বাড়ানো যায়নি। গুটিকয় ছাত্রী আসে কখনও। মাস্টাররা মধ্যে উঁকি দিয়ে যান। ”৮৬ সালে গ্রামের লোকেরা মিলে মেয়েদের স্কুলটা শুরু করি। রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী থেকে ব্লক অফিসার—দশ বছর ধরে লিখলেও কোন ফল পেলাম না। স্কুলটা কার্যত উঠেই গিয়েছে,” হতাশ গলায় জানালেন স্কুলের সংগঠক অনুপপ্রসাদ চৌরাশিয়া। অথচ এ গ্রামেই মেয়েদের পড়ানোর জন্য একদিন ছুটে এসেছিলেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, বাবন গোখলে, তাঁর স্ত্রী অবন্তিকা বাই, গান্ধীপুত্র দেবদাস গান্ধীর সঙ্গে কস্তুরবাও। কস্তুরবা গ্রামে মেয়েদের রামায়ণ—মহাভারতের গল্প শোনাচ্ছেন, এই দৃশ্যটি আজও প্রবীণদের চোখে ভাসে।
বিথিহারোয়ার গান্ধী স্কুলটি তবু পাকাবাড়ি জুটেছে। কিন্তু বেতিলয়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বৃন্দাবন গ্রামের বিশাল একতলা বেসিক স্কুলটি এখন প্রায় পোড়োবাড়ি। অধিকাংশ ঘরই ভগ্নস্তূপ। খোলার চাল, কড়িবরগা ভেঙে পড়েছে। বর্ষায় গজিয়ে ওঠা বুনো ঝোপে সাপের বাসা। গুটিকয়েক ঘরের মাথায় এখনও ছাদ থাকায় সেখানেই শখানেক ছাত্র আর জনা পাঁচেক শিক্ষকের ঠাঁই। বেলা তিনটা নাগাদ পৌঁছে অবশ্য তাঁদের কাউকেই দেখা গেল না। স্কুলের বিশাল চবুতরায় শিশম গাছ আর বুনো ঝোপের ফাঁকে মহিষ চরে বেড়াচ্ছে। ডাক বিলি করতে আসা পোস্টম্যান গঙ্গাবিষ্ণু মাহাতোর আক্ষেপ, ”তল্লাটের সবচেয়ে নামী স্কুল ছিল একসময়। এখন প্রায়দিনই স্কুল বসে না। মাস্টার নেই, ঘর নেই, পড়ুয়ারা এসে কী করবে।” সরকারি প্রহসন এমনই যে এই ভগ্নস্তূপ স্কুলের লাগায়ো বাড়িতেই রাজ্য শিক্ষা দফতরের সহকারী পরিদর্শকের অফিস।
তার চেয়েও বড় পরিহাস বৃন্দাবনের মাটিতে নবোদয় স্কুল। পাঁচিল ও কাঁটাতার ঘেরা বড় বড় বাড়ির বিশাল স্কুল কম্পাউন্ডের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ—ত্রিহুত রাউত ও ভোলা রাউতদের ম্লানমুখে আক্ষেপ, ”এই স্কুলে বৃন্দাবন বা আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়তে পায় না। এখানে ভর্তি হতে গেলে অনেক টাকা লাগে। আমরা পাব কোথায়! সব শহরের ছেলেরা আসে পড়তে এখানে।” সবচেয়ে তিক্ত অশীতিপর মথুরা ভগতের মন্তব্য। গ্রামের একপ্রান্তে গান্ধীজীর একটি ছোট মূর্তিকে ঘিরে আধুনা নিশ্চিহ্ন তাঁর পর্ণকুটির প্রাঙ্গণের গাছপালার দেখভাল করেন অস্থিচর্ম বৃদ্ধ। নিজে থাকেন পাশের একটি ঝোপটিতে। কুটিরবাসী সস্ত্রীক গান্ধী তাদের ছাগলের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মথুরা ভগত যেন সেদিনের সেই দারিদ্র ও পীড়নক্লিষ্ট রায়তের প্রতিমূর্তি। রীতিমত রুষ্ট গলায় তাঁর ক্ষোভ, ”বাপুর তৈরি গরিবদের স্কুল ভেঙে নেতা—মন্ত্রী—আমলাদের কী যায় আসে। ওদের বাচ্চচাদের জন্য নেহরুর নাতির স্কুল তো চলছে রমরমিয়ে। আমাদের পড়াশুনো তো বটেই, জমিও কেড়ে নিয়েছে সরকার ভুলিয়ে ভালিয়ে।”
গ্রামের লোকের সবার অভিযোগ, গান্ধী আশ্রমের জমি ও বাড়ি সরকারে ন্যস্ত হলেও তা তাঁদের পূর্বপুরুষের জমি। গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে তা তাঁকে তাঁরা দান করেন। সেই জমি গরিবদের মধ্যে বিতরণের বদলে সেখানে নবোদয় স্কুল গড়া হয়েছে। সেই বিচ্ছিন্ন এলিট শিক্ষার উজ্জ্বল দ্বীপকে ঘিরে আজ গান্ধীগ্রাম, বৃন্দাবনে অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর হতাশার অন্ধকার। প্রত্যন্ত বিথিহারোয়ার মতো জেলা সদরের কাছাকাছি এই গ্রাম বা তার আশেপাশেও বিদ্যুৎ নেই। রাস্তাঘাট কদর্য। গ্রামের বুকে খাদি ভাণ্ডার ক্ষুদ্র শিল্প ভবন ইত্যাদির উপস্থিতি স্বাধীনতাপূর্ব বছরগুলোয় গান্ধী—অনুরাগীদের গ্রামোন্নয়নের প্রচেষ্টার মূক সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে। বিশেষ করে গান্ধী প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির মর্মান্তিক হাল দেখে বোঝা যায় কেন আজ দুই চম্পারণ বিহারের নিরিখেও সাক্ষরতায় এত পিছিয়ে। সাক্ষরতার প্রশ্নে জেলাগুলির মধ্যে তৃতীয় সারিতে ঠাঁই গান্ধীর চম্পারণের।
‘৪৭—এর অগস্ট মধ্যরাতের যেসব জাতক ভাগ্যের সঙ্গে অভিসারে বেরিয়েছিলেন, তাঁদের সারিতে ছিলেন রাজা রাম, জগদীশ রাম, নাগা মুশাহর, দশরথ মাঝি, অশোক মল্লিকদের পূর্ব প্রজন্মও। স্বাধীনতার সফল কতটা পৌঁছোল নিম্নবর্ণপ্রধান চম্পারণের ডোম—চামার—মুশাহরটোলিতে? বিথিহারোয়ার শ্রীরামপুরের রাস্তার ধারে একথা শুনে মুখিয়ে উঠলেন জনমজুর জগদীশ, ”কিছু পাইনি আমরা। শুধু গান্ধীর কল্যাণেই হোক বা চাপাকল কম থাকায়, ছুয়াছুঁত অনেক কমেছে।” বিথিরোয়ার চামারটোলিতে শখানেক ঘরের বসত হলেও গোটা পঁচিশেক কাচাবাচ্চচা পড়তে যায় কি না চল্লিশোর্ধ্ব জগদীশের যথেষ্ট সন্দেহ। মোটামুটি একই অবস্থা মারগাড্ডির মুশাহর টোলার, জানালেন নানা মুশাহর। কারণ জানতে চাইলে মাথা নিচু করে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ‘পাসি’ (রস সংগ্রাহক) চৌধুরির মন্তব্য, খেতে জোটে না দু’বেলা, পড়তে পাঠাব কী! সংসার চালানোই দুষ্কর। চতুর্দিকে সবুজ আখখেত এবং ট্রাকটরের ধুকপুকুনি যে সমৃদ্ধির চালচিত্র তা শুধু বহিরাগতের বিভ্রমের কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু চম্পারণের গরিবগুর্বোর কাছে তা এক মর্মান্তিক ব্যাঙ্গ। ”৮০ শতাংশ লোকই ভূমিহীন। বিথিহারোয়ার পঞ্চায়েতের ৯টি গ্রামের চামার—ডোম—মুশাহরদের অধিকাংশেরই একচিলতে জমি নেই।” জানালেন প্রাক্তন মুখিয়া জগন্নাথ সাউ। ”আর ক’দিন দিনমজুরি জোটে! ফি বছর গ্রাম কে গ্রাম ঝেঁটিয়ে চম্পারণিয়া মানুষ চলে যায় পঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশে জন খাটতে।” জগদীশ রামের একথায় সমস্বরে সায় জানালেন পথের ধারের মাঠে ব্যস্ত ভূমিহীন মজুরের দল। জগদীশের মতোই অনেকেই ভোট দেননি জীবনে। ভোট আসে যায়, তাঁরা ব্যস্ত রুটির জোগাড়ে। চার কেজি গম আর নগদ কুড়ি টাকা ওই মজুরি মেলাই তাঁদের সর্বোচ্চ স্বপ্ন। গ্রামে গম পেষাইয়ের কল না থাকায় জাঁতায় পিষে গমের খিচুড়ি খেয়েই রাত কাটে ধাঙড় মুশারটোলার।
ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রয়ে গিয়েছে নির্বাচনী ইস্তাহারেই বন্দি। ”আরা ছাপরা বালিয়ার লোক এসে চম্পারণিয়াদের জমি দখল করেছে বহুকাল আগেই। আমরা তো আজ নিজভূমে পরবাসী।” মথুরা ভগতের এই ক্ষোভের প্রতিধ্বনি একের পর এক গান্ধীগ্রামে। বিথিহারোয়ার হাজার একরের মালিক রঘুনাথশরণ, শঙ্করশরণ সিংহের মতো ‘বহিরাগত’ রাজপুত জমিদাররা। একশো আট ঘর ডোডম—মুশাহরকে সরকারি খাসজমির ২ একর করে পাট্টা দেওয়া হয়েছিল বছর কয়েক আগে। ”পাট্টা পেলেও লাভ হয়নি। জমির দখল নিতে যেতে বন্দুক নিয়ে তাড়া করেছিলেন অরবিন্দপ্রসাদ চৌহানের লোকজন। এখন জনমজুরিই ভরসা।” রাজা রামের এই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি টোলায় টোলায়।
আজাদির ফসল উঠেছে আজকের শাসকদের গোলায়। এই অরবিন্দ চৌহানের বাবা মুকুটধারী চৌহানই এই গ্রামে গান্ধীজীর সবচেয়ে কাছের অনুরাগী ছিলেন। গান্ধী আশ্রমের চত্বরে তাঁরও আবক্ষ মূর্তি। বছর চারেক আগেও গান্ধীজীর কোনও মূতি সেখানে না থাকায় ‘আনপড়’ লোক তাঁর মূর্তিতেই গান্ধী—প্রতিকৃতি ভেবে মালা দিত। তিনি আজও নমস্য। কিন্তু তাঁর ছেলে প্রচুর ভূ—সম্পত্তির মালিক হওয়ার সুবাদে আজ গ্রামের মুখিয়া। বলা বাহুল্য রাজনীতির অন্দরমহলে তাঁর অবাধ গতিবিধি। ”বছরের অধিকাংশ সময়টাই দিল্লিতে থাকেন মুখিয়াজি।” তাঁর বাড়ির লোকের গর্বিত মন্তব্য। বিথিহারোয়া যে সংরক্ষিত কেন্দ্রের অধীন সেই ধনধাহার বিধায়ক অশীতিপর ভোলারাম তুফানি আজ পশুপালন কেলেঙ্কারির মামলায় লালুপ্রসাদের সহ—অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দি। দেশের ‘প্রথম ডোম মন্ত্রী’ হিসাবে নিজেকে যিনি পরিচয় দেন, সেই বৃদ্ধ একদা ভগৎ সিংহের সহযোগী হিসাবে ফাঁসির আদেশ শুনেছিলেন ইংরেজের আদালতে। মণ্ডল রাজনীতির কল্যাণে তিনি মন্ত্রী হলেও তুফানি আজ তাঁর শিকড় থেকে উৎপাটিত, ধাঙড়টোলি থেকে অনেক দূরে।
স্বাধীনতার আগে বিহারের অন্যতম বৃহৎ জমি বেতিয়া রাজ এস্টেট—সহ ছটি বড় এস্টেট—এর জেলা চম্পারণ আজও বাস্তবে সামন্ততন্ত্রের গড়। মধ্য বিহারের তুলনায় এখানে বৃহৎ ভূস্বামীদের সংখ্যা অনেক বেশি। রাজনীতিতেও এঁদের নিয়ন্ত্রণ প্রবল স্বাভাবিকভাবেই। এঁদের কেউ কেউ জমিদার—জমানায় রাজ্য—রাজনীতিতে চম্পারণের ঔজ্জ্বলের কথা স্মরণ করে নানা দলও গড়েছেন। যেমন দিলীপ বর্মার চম্পারণ বিকাশ পার্টি। বেতিয়া রাজার ‘দেওয়ানজি’র বংশজ বলে পরিচিত শিকারপুর এস্টেটের অন্যতম উত্তরাধিকারী এই বিধায়ক দানধ্যানে প্রচুর সুনাম কুড়িয়াছেন। কিন্তু ভূমি সংস্কার সঙ্গত কারণেই তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। নেই মুখ্য ধারার দাবিদার ‘জাতীয় দল’গুলির নেতাদেরও।
তবে চম্পারণের রায়তদের আজকের প্রজন্মের জীবনে নীলকরদের ভূমিকা নিয়েছে দুই জেলার মানচিত্রে ছড়ানো নয়টি বিশাল চিনি মিল। দিগন্ত ছোঁয়া আখের খেত আর পাশের গ্রামগুলির অর্থনীতি ও জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এই মিলগুলি। চম্পারণের মানুষ তাই বলেন, ”নীলহা গয়া, মিলহা আয়া।” নীল সাম্রাজ্যকে হঠিয়ে জায়গা নিয়েছে আখ সাম্রাজ্য। কিন্তু বদলায়নি সেই দাদন ব্যবস্থা, জবরদস্তি ঋণের জালে ফাঁসিয়ে রায়তের ফসল ও জমি বেদখলের ফন্দিফিকির।
রাজকুমার বর্মা জানান, ”আশেপাশের সবই হরিনগরের রাজা সাহেবের জমি। ভবানীপুর ফার্ম, শ্রীরামপুর ফার্ম, হরিপুর ফার্ম—কমপক্ষে হাজার দুই একর জমি তাঁরই।” কে এই হরিনগরের রাজা?
চম্পারণের রাজকাহিনীতে এমন কোনও বংশের কথা তো লেখা নেই। হেসে ভুল ভাঙালেন গ্রামে প্রবীণ শিবশংকর মাহাতো, ”আরে সে রাজা নয়, ইনি হলেন হরিনগর সুগার মিলের মালিক রামকৃষ্ণ নারায়ণ লাল পিতি। মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী। মুম্বইতে থাকেন। এখানে লোকে ওঁকে রাজাসাহেব বলেই জানে।” মিল দুটো বিড়লাদের। সরকার অধিগৃহীত দুটি মিল আপাতত বন্ধ। চাকিয়া এবং চনপটিয়া মিল দুটিকে বিহার রাজ্য চিনি বিকাশ নিগম ব্যক্তি পরিচালনার হাতেতুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সব ক’টা মিলই স্বাধীনতার আগে স্থাপিত। আজ উৎপাদনকারী কৃষকদের সঙ্গে মিলগুলির সম্পর্ক এবং এদের চিনি উৎপাদন ব্যবস্থা ও কারিগরি—সবটাই আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে। ফলে শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ।
”নীলকররা তিনকাঠিয়া তথা একবিঘা জমির মালিককেও তিন কাঠায় নীল চাষে বাধ্য করেছিল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে কৃষকদের অনমনীয় সংগ্রাম ওই ব্যবস্থা রদ করতে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করে। কৃষকরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছেমতো ফসল বোনার অধিকার পেলেন। কিন্তু স্বাধীন ভারতে চম্পারণের রায়তের সেই অধিকার আজ ফের খর্বিত।” সতেরোর ঝড়ের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সাঠি গ্রামের মধ্য কৃষক ধনেরিলাল যৌবনে পটনায় কলেজে পড়তে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ”গান্ধীজী আজ ফিরে এলে চম্পারণের কৃষকদের জন্য নিশ্চিত আন্দোলনে নামতেন। জানেন আমরা নিজেদের আখ ইচ্ছেমতো বেচতে পারি না। সরকারি আইনে বাধা আছে। মিলপ্রতি কমান্ড এরিয়া নির্দিষ্ট। এর বাইরে গিয়ে বিক্রির চেষ্টা করলেই হাজতবাস, জরিমানার সম্ভাবনা।”
নগদি ফসল, তৈরি বাজার—স্বাধীনতার আগে থেকেই চম্পারণের কৃষিযোগ্য জমির অধিকাংশটাই ছেয়ে ফেলেছে আখের খেত। সেচের তুলনামূলক উন্নতি, গণ্ডক বুড়িগণ্ডকের পলির আশীর্বাদ, উচ্চফলনশীল বীজ আর রকমারি সার জমির উৎপাদনতাশীলতাও বাড়িয়েছে। পরিণতিতে আজ জোগান বেশি, বাজার কম। আর মিলের আমলা, ঘুষখোর সরকারি কর্মচারী এবং ভূস্বামীরা মিলে এরই সুযোগ নিয়ে ছোট চাষিদের নানা কায়দায় শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কায়দা হল ‘চালান বা পুরজি মাফিয়াচক্র’। জোগান বেশি বলে মিলে ভিড় এড়াতে খেতের আখ পৌঁছানোর দিনক্ষণ অগ্রিম জানিয়ে কৃষককে ‘পুরজি বা চালান’ দেওয়া হয়। সেই চালানে জালিয়াতি করে, ঘুষ দিয়ে অগ্রাধিকারের তালিকায় নাম তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় পুরজি কালোবাজারি মহল। এঁদেরই যোগসাজশে চম্পারণের আখ চলে যায় রাজ্যের বা দেশের অন্যান্য চিনি মিলে। কিন্তু লাভের কড়ি খায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। নরকটিয়াগঞ্জের লাইন ব্রডগেজ হয়ে গোরখপুর পৌঁছলেও চম্পারণের চাষিরা ফসল নিয়ে বৃহত্তর বাজারে পৌঁছতে পারেন না। পশ্চিম জেলার দুর্গম বাগহি মহকুমার গ্রামগুলির কৃষক গণ্ডকের উপর সেতুর অভাবে নেপাল অথবা উত্তরপ্রদেশে অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য হন। ”তার উপর রয়েছে দাদন প্রথার আর সুদখোরি। সার বীজের জন্য মিল ঋণ দেয় আমাদের। টাকাটা আসলে ব্যাঙ্কের। তারা ১১ শতাংশ হারে সুদ দিলেও মিল কিষাণকে ১৩ থেকে ১৮ শতাংশ হারে কর্জ মেটাতে বাধ্য করে। গরিব কিসান ব্যাঙ্কে গেলেও বাবুরা হাঁকিয়ে দেয়। মিলের বাবুদের সঙ্গে ওদের দহরম মহরম।”— কুড়িয়াকোঠিতে ভগ্নস্তূপ নীলকুঠির পাশের মাঠে ভাড়ার ট্রাকটর চালাতে চালাতে বললেন বৈজনাথ চৌহান। তাঁর অভিযোগ মিলের ঋণ ঠিক সময়ে না শুধলে তাঁর ফসল ক্রোক থেকে ঘটিবাটি বিক্রিতে তৎপর প্রশাসন—মিল ও ব্যাঙ্কের বাবুরা। কিন্তু মিলের কাছে ফসলের দাম বাবদ পাওনা বকেয়া পেতে বছরের পর বছর জুতো ছেঁড়ে কৃষকের। ”কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা কৃষকরা পাবে মিলগুলির থেকে। তা শুধু গত তিন বছরের হিসাব।”—বেতিয়ার সাংবাদিক ও আইনজীবী অভয়মোহনের মন্তব্য। দিল্লির সেন্ট স্টিফেনস—এর ফসল অভয়মোহন ঋণের দায়ে জর্জরিত আর বকেয়া পাওয়া পেতে হয়রান কৃষকদের পটনা—মতিহার—বেতিয়ায় ছুটোছুটি দেখতে দেখতে তিক্ত। এতটাই যে, তাঁর সখেদ মন্তব্য, ”এ বোধহয় নীলকরদের অভিশাপ। কুঠির ভূতগুলো চম্পারণ ছাড়বে না কিছুতেই।”
রুখুসুখু, নগ্নগাত্র, হেঁটো ধুতি সম্বল গান্ধীর সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি মথুরা ভগত নিরে হারানো জমিও ফেরত চান না। আজকের শাসকদের কাছে তাঁর প্রার্থনা:”বাপুর তৈরি স্কুলটাকে বাঁচিয়ে দাও যাতে গাঁয়ের গরিব ছেলেমেয়েগুলো পড়তে পারে। টুকরো জমি জুটিয়ে দাও যাতে ভূমিহীন মানুষগুলো খেয়েপরে বাঁচতে পারে। আলো এনে দাও যাতে ঘামের সঙ্গে সেচের জলও পায় ফসল।” বৃদ্ধের আরও বিশ্বাস, বাপু বেঁচে থাকলে চম্পারণের মানুষের দুঃখ থাকত না। এই বিশ্বাস সত্যি হোক না হোক, গান্ধীপুত্র রাজামোহন বৃন্দাবন—দর্শনে এসে ভিজিটরস বুকে লিখে যান, কিতনা প্রেরণা, কিতনা পীড়া। মথুরা ভগত, আপকো ইনসাফ কব মিলেগা?
উত্তর মিলবে হয়তো স্বাধীনতার একশো বছরে।