চন্দ্রাহত

চন্দ্রাহত

আজ কণিকার বিয়ে।

কণিকাদের তিনতলা বাড়ি ঝলমল করছে। ছাদ থেকে নীচ পর্যন্ত ঝুলছে হলুদ আলোর মালা। গেটে বেত দিয়ে তৈরি হয়েছে চোখ-ধাঁধানো তোরণ। তোরণের মাথায় সবুজ ঘাসের ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা ফুলের পাপড়ি দিয়ে লেখা—‘কণিকা-শ্যামলের শুভবিবাহে স্বাগতম’। সাউন্ড বক্সে নিচু ভল্যুমে সানাই বাজছে। বিসমিল্লার সানাই। রাগের নাম সাহানা। হাতে সুদৃশ্য গিফ্‌ট প্যাকেট নিয়ে নিমন্ত্রিতরা দামি গাড়ি থেকে নামছে। সুট, ধুতি পাঞ্জাবি, বেনারসির খসখস আওয়াজ। গয়নার টুং টাং শব্দ। বিদেশি সেন্টের মায়াময় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ফিসফাস, খিলখিল হাসি, নিচু গলায় গল্প। মনে হচ্ছে, এই বাড়ি থেকে ফোয়ারার মতো আনন্দ উপচে পড়ছে।

যদিও ঘটনা উলটোরকম। এত আয়োজনের ব্যাপারে খোদ কনেরই আপত্তি ছিল। কণিকা তার মাকে বলেছিল, ‘জাঁকজমক কিছু করার দরকার নেই। যেটুকু না করলেই নয় শুধু সেটুকু করো লোকজন বেশি না এলেই ভাল হয়।’

কণিকার মা মঞ্জুদেবী বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, ‘কেন? বড়মেয়ের বিয়েতে আমরা জাঁকজমক করব না কেন?’

কণিকা মায়ের রাগ বুঝতে পেরে সামান্য হাসে। বলে, ‘এলাহি ব্যাপার দেখলে শ্যামল অস্বস্তিতে পড়তে পারে।’

‘কেন? অস্বস্তির কী হল?’

ওরা তো তেমন কিছু করতে পারবে না সেই কারণেই বলছি।’

মঞ্জুদেবী দাঁতে কিড়মিড় জাতীয় আওয়াজ করে বলেন, ‘ওদের না পারাটা কি আমাদের অপরাধ?’

‘অপরাধের কথা হচ্ছে না মা। তবে বিয়েটা আমাদের মাথায় রাখা উচিত। সকলের সামর্থ্য সমান হয় না। আমরা আলো জ্বালালাম, বিরাট প্যান্ডেল খাটালাম, লম্বা মেনুতে লোক খাওয়ালাম অথচ এরা তেমন কিছুই পারল না, সেটা কেমন দেখাবে?’

মঞ্জুদেবী রাগে হিসহিস করে ওঠেন, ‘খুবই খারাপ দেখাবে। কিন্তু তার জন্য তো আমরা দায়ী নই কণি। ওদের সামর্থ্য কতখানি আমি গোড়া থেকেই জানি। যেদিন থেকে তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছ সেদিন থেকেই জানা হয়ে গেছে। নতুন করে আর আমাকে এসব শোনাতে এসে না। আমরা আমাদের সামর্থ্য মতোই মেয়ের বিয়ে দেব। তার বেশি দেব না, কমও দেব না। যতটা জাঁকজমক করা আমাদের পক্ষে দরকার ততটাই করব।’

কণিকা একইভাবে শান্ত গলায় বলল, ‘জাঁকজমকের আবার দরকার অদরকার কী?’

মঞ্জুদেবী কঠিন চোখে মেয়ের মুখের দিকে মুহুর্তখানেক তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘দরকার-অদরকার বুঝতে পারলে তুমি এই কাজ করতে না। এই বাড়ির মেয়ে হিসেবে তোমাকে যা মানায় তাই করতে।’

কণিকার বাবা মনোময় চ্যাটার্জি উলটোদিকের সোফায় বসে ছিলেন। তিনি স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা করেন। বলেন, ‘আহা, কণি যখন বলছে, থাক না, আমরা ছোট করেই না হয় করলাম।’

মঞ্জুদেবী এবার আর গলা নিচু রাখতে পারলেন না। উত্তেজিত হয়ে চিক্কার করে উঠলেন।

‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আমাদের একটা সম্মান আছে। তোমার পরিচিত লোকজন আসবে। এত বড় বিজনেস। সেখানকার লোকজন তো সব হেঁজিপেজি নয়। ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। সবাই কী ভাববে সেটা একবার ভেবে দেখেছ? সবাই ভাববে, এই বিয়েতে আমাদের সায় নেই, তাই ঘর অন্ধকার করে মেয়েকে কোনওরকমে পার করছি। সত্যি কথাটা সবাইকে জানানোর দরকার কী? তার থেকে আলো জ্বেলে, সানাই বাজিয়ে, পেট পুরে পোলাও মাংস খাইয়ে না হয় মিথ্যেটাই বলব। বলব, বড়মেয়ের বিয়েতে আমরা খুব খুশি। হিরের টুকরো জামাই পেয়ে আমাদের আহ্লাদের শেষ নেই।’

মনোময়বাবু মুখ নামিয়ে বলেন, ‘এসব কথা আর এখন তুলে লাভ কী মঞ্জু? ডিসিশন যখন হয়েই গেছে…।’

মঞ্জুদেবী ঝাঁঝের সঙ্গে বলেন, ‘ডিসিশন আমার হয়নি। ডিসিশন হয়েছে তোমার মেয়ের। এটা তার একার সিদ্ধান্ত। তুমি নিজেই মেয়ের সামনে বলো না, এই বিয়েতে তোমার মত আছে? বলল, চুপ করে আছ কেন?’

কথা শেষ করে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন মঞ্জুদেবী। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বলতে বলতে গেলেন, ‘তোমার মেয়ের মাথায় গোলমাল হয়েছে। মাথার গোলমাল না হলে কেউ এ কাজ করতে পারে না। তুমি ওকে বোঝাও। এখনও সময় আছে।’

মনোময়বাবু চুপ করে হাতের আঁকিবুকি কাটতে থাকেন। তিনি জানেন, মঞ্জু ভুল কিছু বলছে না। কণিকা সত্যি পাগলামি করছে। এই বিয়েতে তাঁরও মত নেই। মত থাকার কোনও কারণ নেই। কোনও সুস্থ মানুষ এই বিয়েতে মত দিতে পারে না। ওই ছেলেকে কণিকার সঙ্গে কোনওভাবেই মানায় না। তার ওপর শোনা যাচ্ছে, আলাপ পরিচয়ও অতি অল্পদিনের। বছরখানেকও হয়নি ছোকরা গ্রামের দিকে কোনও এক ব্লক অফিসে চাকরি জুটিয়েছে। সেই চাকরি এখনও পাকা হয়নি। প্রবেশন পিরিয়ড চলছে। কাজ পাকা হবে কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ রয়েছে। মঞ্জু যখন তাঁকে ঘটনাটা বলে তখন তিনি বিজনেসের কাজে চেন্নাইতে। কানে টেলিফোন ধরে টানা এক মিনিট চুপ করে থাকেন।

‘তুমি শিয়োর মঞ্জু?’

মঞ্জুদেবী ফুঁপিয়ে ওঠেন। বলেন, ‘কণি বলছে, আমরা যদি রাজি না হই তা হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওই ছেলেকে বিয়ে করবে।’

‘না না, এখনই মেয়ের সঙ্গে কোনও কনফ্রনটেশনে যেয়ো না মঞ্জু। তুমি শান্ত হও।’

মঞ্জুদেবী ডুকরে উঠে বলেন, ‘কী বলছ তুমি? আমি শান্ত হব। এই কথা শোনার পর কোনও মা শান্ত হয়ে থাকতে পারে? ছি ছি! কোথাকার কোন এক ভ্যাগাবন্ড…কণির কত ভাল বিয়ের ব্যবস্থা আমি করছিলাম তুমি জানো না?’

মনোময় চ্যাটার্জি চুপ করে থাকেন। তিনি জানবেন না কেন? খুবই জানেন। ইতিমধ্যে গোপনে ছেলে দেখা শুরুও করেছিল মঞ্জু। দুটি ছেলের খবরও বলেছিল তাঁকে। পাত্র হিসেবে দু’জনেই চমৎকার। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ছ’মাসের মধ্যে স্টেটসে সেটল করবে। কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা। অন্যজন ডাক্তার। পড়া কমপ্লিট করেছে। আর একদিনও এই পোড়ার দেশে থাকতে চায় না। ছেলের ধারণা এদেশে ডাক্তারি করাও যা খেতে লাঙল চালানোও তাই। এদেশের রোগীদের ট্যাবলেট, ক্যাপসুলের থেকে জড়িবুটিতে বেশি কাজ দেয়। ওই ছেলে ইতিমধ্যে লন্ডনের তিনটি হাসপাতালে অ্যাপ্লাই করে ফেলেছে। ওখানে গিয়ে এফ আর সি এস-টাও করবে। তবে দু’জনেই নাকি এখন বিয়ে করার ব্যাপারে গাঁইগুঁই করছে। ওদের বাড়ির লোকেরাও ছাড়ছে না। তারা চায় বাইরে যাওয়ার আগে বিয়েটা সেরে নিক। মঞ্জুদেবীর মতে ও কিছু নয়। ভাল ছেলেরা বিয়ের আগে ওরকম একটু-আধটু গাঁইগুঁই করে। ভাবে সংসার করলে কেরিয়ার রসাতলে চলে যাবে। চিন্তার কিছু নেই কণিকার সঙ্গে আলাপ হলে এরা বুঝতে পারবে, তাঁর মেয়ে ফেলনা কিছু নয়। সেও সবার আগে কেরিয়ার পছন্দ করে। ক’দিন আগেই মঞ্জুদেবী গদগদভাবে স্বামীকে বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছে, কণি দুই ক্যান্ডিডেটকেই মিট করুক। তারপর না হয় নিজেই বেছে নিক। বিয়ে কোনও হেলাফেলার বিষয় নয়। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চলে না। আজকাল জীবনসঙ্গী নিজেই পছন্দ করে নিতে হয়।’

মনোময়বাবু বলেছিলেন, ‘তুমি তা হলে মেয়ের সঙ্গে কথা বলো।’

সেই কথা বলতে গিয়েই যে বিপদ হয়েছে মনোময়বাবু বুঝতে পারছেন। তিনি নিজেই সামলে নিয়ে বললেন, ‘এই ছেলে কী করে?’

‘ভিক্ষে করে। ভিক্ষে। হি ইজ আ বেগার। তোমার মেয়ে একজন ভিখিরিকে বিয়ে করতে চলেছে।’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন মঞ্জুদেবী।

‘তুমি এতটা এক্সাইটেড হয়ো না মঞ্জু। বিপদ ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হয়। তুমি কণিকে বুঝিয়ে বলেছ?’

‘তোমার অসভ্য মেয়ে বলতে দিল কই? কথা শুরুর আগেই বলল, আমি খবর পেয়েছি তোমরা আমার জন্য ছেলে খুঁজছ। খামোকা পরিশ্রম করে লাভ নেই মা, আমি বিয়ের ব্যাপারে ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। ছেলের নাম…।’

কথা শেষ করতে পারলেন না মঞ্জুদেবী। রিসিভার চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, “সেই ছেলে নাকি কোন পাড়াগাঁয়ে সামান্য চাকরি করে।’ ফোন রাখার আগে মনোময় চ্যাটার্জি চিন্তিত গলায় বলেন, ‘তুমি আর এটা নিয়ে ঝামেলা কোরো না মঞ্জু। কণি যদি সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে চলে যায় সেটা আরও বড় কেলেঙ্কারি হবে। আমি নেক্সট অ্যাভেলেবল ফ্লাইটেই কলকাতায় ফিরছি।’

পুরো একটা দিন অবাক হয়ে ভেবেছিলেন মনোময়। তাঁর ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ে এত বড় গাধা কী করে হল? শুধু ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পড়েছে না, কণিকা বি. এ. এবং এম. এ. দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস! গাধা না হলে তার পরেও কেউ এই কাণ্ড করতে পারে? আমেরিকা, লন্ডন ছেড়ে গ্রামে গিয়ে সংসার পাতার সিদ্ধান্ত নেয়? তিনি ঠিক করেন মেয়ের সঙ্গে নিজে কথা বলবেন। তার মায়ের মতো রাগের কথা নয়, কথা বলবেন ঠান্ডাভাবে। তিনি জানতে চাইবেন, ওই ছেলের মধ্যে মেয়ে কী দেখেছে? কোন প্রতিভা? মায়ের সঙ্গে জেদাজেদি থাকলেও মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মধুর। অনেক কথাই সে সহজভাবে বাবাকে বলতে পারে। বলতে ভালোওবাসে। গোড়া থেকে নিজে হাতে ট্যাকল করলে সমস্যা এতটা দূর যেত না বলে মনে হয়। কণিকা নিজের ভুল বুঝতে পারত।

‘তোমার মা যা বলেছে তা কি সত্যি?’

কণিকা অবাক হয়ে চোখ বড় করে। বলে, ‘মা কী বলেছে তা তো জানি না বাবা।’

‘তুমি নাকি কাকে বিয়ে করবে ঠিক করে ফেলেছ।’

বাবার সঙ্গে সহজ হলেও কণিকা লজ্জা পায়। যতই হোক বিয়ের কথা। সে মাথা নিচু করে নিচু করে তার উত্তর বুঝিয়ে দেয়।

‘তুমি কি ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেলেছ কণি।’

মাথা নামানো অবস্থাতেই কণিকা বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। নিয়ে ফেলেছি। তোমাদের হয়তো আরও কয়েকটা দিন পরে জানাতাম। কিন্তু মা যেভাবে আমার জন্য ছেলে খুঁজতে উঠে পড়ে লেগেছে, তাই এখনই বলে রাখলাম।’

‘ও।’

মনোময় চাটার্জি মুখের সামনে হাত মুঠো করে কাশলেন। মেয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, ঘটনা অনেকদূর নয়, পুরোটাই গড়িয়ে গেছে। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘ছেলে শুনলাম চাকরিবাকরি তেমন কিছু করে না। তোমার মা বলছিল।’

কণিকা শান্ত গলায় বলে, ‘মা পুরোটা ঠিক বলেনি, খানিকটা ঠিক বলেছে। শ্যামল চাকরি পেয়েছে কিন্তু মাইনেপত্র ভাল নয়। তবে কোয়ার্টার পেয়েছে। এইসব ছোট চাকরিতে প্রবেশনে থাকার সময় সাধারণত কাউকে কোয়ার্টার দেওয়া হয় না। ওকে দিয়েছে।’

হবু স্বামীকে ‘কোয়ার্টার দিয়েছে’ বলার মধ্যে মেয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করছে বলে মনোময়বাবুর মনে হল। তিনি দুঃখিত হলেন। কলকাতা থেকে দূরে অজ পাড়াগাঁয়ে সামান্য একটা এলেবেলে কোয়ার্টার নিয়ে তাঁর মেয়ে গর্ব করছে। দুঃখের বিষয়। মেয়েকে তিনি এভাবে মানুষ করেননি। তিনি যেভাবে মানুষ করেছেন, তাতে তার স্বামী লন্ডনে টেমস নদীর ধারে কোয়ার্টার পেলে গর্ব করা উচিত। নিজের প্রতি এক ধরনের হতাশা তৈরি হল মনোময়বাবুর। সেই হতাশা লুকিয়ে তিনি হাসবার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘গুড। সেই কোয়ার্টার কেমন তা কি তুমি জানো কণি? ক’টা ঘর?’

ইচ্ছে করেই আগে ছেলেতে না গিয়ে ছেলের ঘরবাড়ি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাইছেন মনোময়।

কণিকা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘কোয়ার্টার কেমন জানি না বাবা। তবে শুনেছি ঘর দুটো বেশ ছোট। তবে ছাদ খুব বড়।’

মনোময়বাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘ছাদ বড়! বড় ছাদ খুব একটা কাজে লাগবে কি?’

কণিকা উজ্জ্বল চোখে বলে, ‘বাঃ লাগবে না? ওখানে তো বেশিরভাগ সময়েই সন্ধের পর কারেন্ট থাকে না। ভ্যাপসা গরমে ঘরের মধ্যে শুয়ে মরব নাকি? মাদুর নিয়ে ছাদে চলে গেলেই হবে। জানো বাবা, খানিকটা দূরেই একটা জঙ্গল মতোও আছে। বড় কিছু নয়, ছোট জঙ্গল। গায়েই একটা দিঘি। তাই সন্ধের পর বাতাস খুব প্লেজেন্ট। রাতের দিকে শীত শীত করে। বাড়ির কাছে জঙ্গল বা দিঘি থাকা একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই না বাবা?’

মনোময় চ্যাটার্জি ঢোঁক গিলে বলেন, ‘তুমি দেখছি খুব ডিটেইলসে খবর নিয়েছ মা। পাড়াগাঁয়ে দিঘি থাকবে, জঙ্গল থাকবে, সাপখোপ, মশা মাছি থাকবে এটা আর আশ্চর্যের কী? শহরে গাছপালা, ওয়াটার বডি থাকলে সেটাই মজার। বিদেশে এরকম অনেক আছে।’

কণিকা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘খবর আমি নিইনি, ও বলছিল। খোলামেলা জায়গা ও খুব ভালবাসে তাই সব বলছিল।’

মনোময় ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন। নিজের মেয়েকে কি তাঁর খানিকটা অচেনা লাগছে? কী এমন ঘটল যে মেয়ে এতটা বদলে গেছে।

‘ছাদের কথা তো হল, বাথরুম ও কিচেন? এগুলো ঠিক আছে?’

‘ঠিক নেই বাবা। শুনেছি কিচেনের অবস্থা খুবই খারাপ। বৃষ্টির সময়ে টিনের শেড থেকে জল পড়ে। বাথরুমও সেইরকম। উঠোন পেরিয়ে যেতে হয়। জলের সমস্যাও আছে। গরমের সময় সমস্যা বাড়ে। যদিও খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

মনোময়বাবুর মনে হল নিশ্বাস থমকে গেছে। কণিকা এসব কী বলছে! তিনি বললেন, ‘কেন? সমস্যা হওয়ার কথা নয় কেন?’

কণিকাকে এমনিতেই খুব সুন্দর দেখতে। সে সুন্দর করে হাসতে পারে। বাবার দিকে তাকিয়ে সুন্দর হেসে কণিকা বলল, ‘শ্যামল বলেছে, কাছেই একটা কুয়ো আছে। সেই কারণে খুব কিছু সমস্যা হবে না। জানো তো বাবা, কুয়ো থাকলেই সঙ্গে দারুণ একটা বাঁধানো কুয়োতলা থাকে। আমি অবশ্য এখনও জানি না, এখানকার কুয়োতলাটা বাঁধানো কিনা।’

মনোময় চ্যাটার্জি অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। তিনি কী শুনছেন! যা শুনছেন তা কি ঠিক শুনছেন? তাঁর মেয়ে উঠোন পেরিয়ে বাথরুমে যাবে। কুয়ো থেকে জল তুলবে! এরপর হয়তো বলবে কুয়োতলায় বসে দুপুরে নভেল পড়বে। মঞ্জু ঠিকই বলেছে, কণিকার মাথায় গোলমাল হয়েছে। নইলে যে মেয়েকে একগ্লাস জল নিজে নিয়ে কোনওদিন খেতে হয়নি সে মেয়ে এসব কী ভাবছে!

মনোময়বাবু বুঝেছিলেন, কণিকাকে আর কিছু বলে লাভ নেই। যে হবু স্বামীর কোয়ার্টারের কুয়ো নিয়ে উত্তেজিত, আনন্দিত—তাকে কিছু বলে লাভ কী? স্ত্রীকে সেকথা বলেও ছিলেন। মঞ্জুদেবী বলেছিলেন, ‘দেখবে এই মেয়ে কত বড় বিপদে পড়ে। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিয়ো।’ মনোময় চ্যাটার্জি সেই বিপদ আঁচ করতে পারলেন না, এমন নয়। পারলেন। এক সপ্তাহ রাতে ঘুম হল না। কাজে মন দিতে পারলেন না। মেয়েকে এখন বকাঝকা করে লাভ হবে না। সে এখন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। এই ছেলের কাছ থেকে তাকে সরিয়ে আনা অসম্ভব। ওর মায়ের মতো জোর খাটাতে চাইলে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। তা ছাড়া কণিকার প্রতি কঠোর হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। উপায় একটাই, ছেলেকে যদি কিছু করা যায়। খড়কুটো চেপে ধরার মতো করে মনোময় চ্যাটার্জি একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন। কিছুদিন পরে কণিকাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তুমি যদি চাও, আমি ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারি কণি। মুম্বই বা চেন্নাইতে, যদি বলো কলকাতাতেই আমি ওর একটা কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দেব। তুমি অন্য ভাবে নিয়ো না। আমার মনে হয় না, ওরকম একটা অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়ে তোমার বেশিদিন ভাল লাগবে। তুমি স্যুট করতে পারবে। আমি যে কাজের ব্যবস্থা করব তাতে মাইনেপত্র খারাপ হবে না। আই থিঙ্ক এটার থেকে তো বেটার হবেই। তা ছাড়া আমাদের টাচে থাকতে পারবে। যদি আরও কোনও দরকার হয় আমি তো রইলাম।’

কণিকা বাবার প্রস্তাব শোনার পর মুচকি হাসে। বলে ‘থ্যাঙ্কু বাবা। কিন্তু এর কোনও দরকার নেই। শ্যামল এরকম একটা জায়গাতেই থাকতে চায়। সে পুরুলিয়া টাউনের প্রপারেও থাকার চান্স পেয়েছিল। নেয়নি। আসলে তার একটা উদ্ভট শখ আছে। ফাঁকা জায়গা না হলে সেই শখ ভাল করে মেটানো যায় না।’

‘শখ! কীসের শখ?’ মনোময় অবাক হন।

কণিকা উদ্ভাসিত মুখে বলে, ‘থাক বাবা। সেই শখের কথা জেনে তোমদের লাভ নেই। মা এমনিতেই ভেঙে পড়েছে। তার ওপর যদি এটা শোনে তা হলে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।’

মনোময়বাবু এবার খানিকটা কঠিন গলায় বলেন, ‘তোমার মায়ের ভেঙে পড়াটা কি অকারণ হয়েছে বলে মনে করো কণি? মায়েরা তো মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভাববেই। যাই হোক, তুমি যদি শ্যামলের শখের কথা না বলতে চাও বোলো না। আমি তোমাকে জোর করব না। শখ মেটানোর সঙ্গে ফাঁকা জায়গায় কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারছি না। সে কি বাগান করে? গার্ডেনিং? করলে অসুবিধে কী? আমাদের বাদুর ফার্ম হাউস তো আছেই। উইক এন্ডে না হয় তোমরা চলে গেলে। নো বডি উইল ডিসটার্ব ইউ।’

কণিকা শক্ত মুখে বলে, ‘আমি যতদূর চিনি শ্যামল শ্বশুরমশাইয়ের বাগানবাড়িতে গিয়ে শখ মেটানোর মতো ছেলে নয়। তা ছাড়া গার্ডেনিং সে করেও না। তার স্বভাব অন্য। ইনফ্যাক্ট ওর এই স্বভাবের কথা যেদিন আমি জানতে পারি সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই ছেলেকে আমি বিয়ে করব। তোমরা যদি মনে করো, আমার এই বিয়েতে বাড়ির সম্মানে বড় ধরনের ধাক্কা লাগছে তা হলে আমি না হয় বাইরে গিয়েই বিয়ে করে নিচ্ছি। কত মেয়েই তো বিয়ের জন্য বাড়ি ছাড়ে। ছাড়ে না?’

কথা শেষ করে কণিকা দু’হাতে মুখ ঢাকে এবং ফুঁপিয়ে ওঠে। মনোময়বাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে গাঢ় স্বরে বলেন, ‘ইটস ওকে। তুমি শান্ত হও কণি। আমরা চাই তুমি সুখী হও। আমার বিশ্বাস তুমি নিশ্চয় ঠিক মানুষকেই বেছেছ। তার কোনও একটা সুন্দর স্বভাব তোমাকে স্পর্শ করেছে।’

কণিকা মুখ থেকে হাত সরিয়ে বড় বড় ভেজা চোখদুটো তুলে বলে, সুন্দর কিনা জানি না বাবা, তবে তার এই শখের কথা তুমি শুনলেও মুগ্ধ হবে।’

মনোময় চ্যাটার্জি একদৃষ্টিতে মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কণিকা ফিসফিস করে বলতে থাকে, ‘বাবা, শ্যামল হল একজন মুন লাভার। চাঁদের ভক্ত। একটু ভক্ত নয়, ভীষণ ভক্ত। জ্যোৎস্না দেখলে সে পাগলের মতো হয়ে যায়। জাস্ট লাইক আ ম্যাড। পূর্ণিমার দিনগুলোতে সে কিছুতেই ঘরে থাকতে চায় না। থাকলেও সব আলো নিভিয়ে বসে থাকবে। নইলে ছুটে চলে যাবে ছাদে। ছাদ না থাকলে পথে পথে ঘুরবে। কতবার যে জ্যোৎস্না দেখতে সে কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে গেছে। গভীর রাত পর্যন্ত খোলা ছাদে বা মাঠে শুয়ে ঠান্ডা লাগিয়ে ফিরেছে গা ভরতি জ্বর নিয়ে। একবার তো নিউমোনিয়া হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে কাঁকড়াঝোড়ের জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে গেল। বিরাট টেনশনের ব্যাপার। খুঁজে পাওয়ার পর সবাই যখন চেপে ধরল সে জানাল, একটা চকচকে পথ ধরে হাঁটছিল। খানিক পরে খেয়াল হয়, ওটা আসলে কোনও পথই নয়! চাঁদের আলো। ব্যস রাস্তা হারিয়ে গেল। বোঝো কাণ্ড। তারপর থেকে ওর বন্ধুরা কেউ আর এর সঙ্গে বাইরে যেত না। গেলেও অমাবস্যা দেখে যেত। সবাই ঠাট্টা করে বলত চাঁদে পাওয়া ছেলে। ওই ছেলেকে প্রথমে আমি তেমন আমল দিতাম না। বিশ্বাস করো। আমল দেবার মতো কী গুণই বা তার আছে? কিন্তু যেদিন শুনলাম…।’

কণিকার চোখ চকচক করছে। মনোময়বাবু সেদিকে তাকিয়ে রইলেন অবাক হয়ে। বিড়বিড় করে বললেন, ‘শুধুমাত্র এই কারণে তুমি এই ছেলেকে পছন্দ করলে!’

‘শুধুমাত্র! একে তুমি শুধুমাত্র বলছ! মা বুঝবে না, কেউ-ই বুঝবে না, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্তত বুঝতে পারবে। একজন চাঁদে পাওয়া মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানোর লোভ কোনও মেয়ে ছাড়তে পারে? অনেক কষ্ট হবে জেনেও পারে না।’

স্ত্রীকে এই অদ্ভুত কথাটা বলেননি মনোময়াবাবু। বললে বিরাট ঘাবড়ে যাবে সেই ভয়ে বলেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘ওই ছেলের নাকি কীসব শখটখ আছে। তাতেই তোমার মেয়ে মুগ্ধ হয়েছে। মঞ্জুদেবী বলেছিলেন, ‘ওসব বাজে কথা। এই ছেলে আসলে বিরাট বদ। মিথ্যে ভুজুংভাজুং দিয়ে বড়লোকের সুন্দরী মেয়েকে কবজা করেছে। ছোড়দি বলছিল, নিশ্চয় জলপড়া ধরনের কিছু খাইয়ে দিয়েছে কিনা খবর নিয়ে দেখ।’

চিন্তিত মনোময় বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আঃ, চুপ করবে?’

মঞ্জুদেবী চুপ করেই গেলেন। তবে বিয়ের সময় জাঁকজমকের কিছু কম করলেন না। বাড়ির সামনেই প্যান্ডেল করে নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে পাতা হয়েছে লাল ভেলভেটের সোফা। রয়েছে চা-ককি, ঠান্ডা পানীয়। মূল খাবার জায়গা তিনতলার ছাদে। বিয়ের আসর বসছে বাড়ির পিছনে। বাগানের একটা অংশে শামিয়ানা টাঙিয়ে নেওয়া হয়েছে।

সমস্যা হল এখনও বর এসে পৌঁছায়নি। যদিও বিয়ের লগ্না রাত বারোটা বেজে তিপান্ন মিনিটে। বরের চলে আসার কথা আটটায়। এখন সাড়ে আটটার কিছু বেশি হয়ে গেছে। মনোময়বাবু বরযাত্রীর জন্য বাসের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। এসি ভলভো বাস। কণিকা সেই পরিকল্পনা বাতিল করেছে। বরযাত্রীর সংখ্যা নাকি কিছুতেই দশের বেশি হচ্ছে না। দু’- একজন কমও হতে পারে। দুটো গাড়িতেই ধরে যাবে। মনোময় মেয়ের কথা শুনে বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি কী করে জানলে দশের বেশি হবে না?’

কণিকা শান্ত গলায় বলে, ‘শ্যামল বলেছে। ওর অত আত্মীয়-টাত্মিয় নেই। যারা আছে তারাও সকলে আসবে না।’

‘ও। তা হলে গাড়ির কথাই বলে দিচ্ছি। ক’টা গাড়ি বলব? তিনটে বলি?’

‘বাবা, ওরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে আসবে।’

নিজেরা ব্যবস্থা করে আসতে আসতে বরযাত্রীরা রাত দশটা বাজিয়ে ফেলল। ততক্ষণে অতিথিরা অনেকেই চলে গেছে। বারবার ফোন করেও বর বা তার বাড়ির লোকদের ধরা যায়নি। টেনশনে মঞ্জুদেবীর প্রেশার বেড়ে গেল। তাঁকে ফাঁকা ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘আমি জানতাম, আমি জানতাম এই ছেলে বিরাট গোলমাল করবে। গোলমালের এখন কী দেখলে? পরে আরও দেখবে।’

মনোময়বাবু চাপা গলায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘উফ, তুমি চুপ করবে? বাড়ি ভরতি লোক। কণি কাঁদছে, তুমি চেঁচাচ্ছ, কী ভাবছে সবাই?’

বাড়ি যতটা বড় করে সাজানো হয়েছিল, বিয়ে ততটা হইচই করে হল না। বর দেরি করে আসার রাগ চট করে কেউ ভুলতে পারল না। শান্তভাবেই বিয়ে শেষ হল। বাড়তি কোনও উচ্ছাস ছাড়াই। আরও শান্তভাবে পরদিন বিকেলে কণিকা বাপের বাড়ি ছেড়ে রওনা দিল হাতে গোনা দু’-তিনটে সুটকেস আর ব্যাগ নিয়ে। সবাই ভেবেছিল, মেয়ে চলে যাওয়ার সময়ে মঞ্জুদেবী খুব কান্নাকাটি করবেন। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। তিনি থমথমে মুখে মেয়েজামাইকে আশীর্বাদ করলেন।

মঞ্জুদেবী কাঁদলেন চারবছর বাদে। বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় জামাই গাছে ফাঁস ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করার ঠিক তিনদিন পর আড়াই বছরের নাতনির হাত ধরে মেয়ে যখন ফিরে এল তখন। তবে সেই কান্নার মধ্যে দুঃখের থেকে আনন্দই বেশি ছিল। নাতনিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ইস কী চেহারা হয়ছে দু’জনের? চুলে তেল নেই, গায়ের পোশাক ময়লা। ছি ছি। দাঁড়া দু’দিনে তোদের ভোল পালটাছি। মা মেয়েকে জলে চুবিয়ে কেমন কাচি দেখবি।’

মনোময় চ্যাটার্জি ছিলেন তিনতলার বারান্দায়। তাঁর শরীর ভাল নেই। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। সপ্তাহে তিনদিনের বেশি কাজে বেরোন না। তার ওপর আজ মেয়ে আসছে শুনে আরও বেরোননি। কণিকার পায়ের আওয়াজে মুখ ফেরালেন।

‘আয় মা।’

কণিকা বাবার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল চেয়ারের পাশে। তারপর কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠল। মনোময়বাবু মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত গলায় বলেন, ‘কাঁদিস না মা। কাঁদিস না। তুই তো চেষ্টা করেছিলি। এই কবছরে সেবা, চিকিৎসা কোনওটাই তো কম করিসনি। মাঝখানে তো কদিনের জন্য একটু ভালও হয়েছিল শুনলাম। আসলে কী জানিস অসুখটাই এরকম।’

কণিকা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমারই ভুল বাবা। আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম নরমাল। তখন আমার বোঝা উচিত ছিল। সন্দেহ করা উচিত ছিল। পুরনো অসুখ, ট্রিটমেন্ট কিছু নেই।’

পরম স্নেহে মেয়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে মনোময়বাবু বললেন, ‘মানুষ তো ভুল করে। করে না? এবার অন্যভাবে শুরু কর। তোর রেজাল্ট ভাল। ইচ্ছে করলে চাকরি করতে পারিস। যদি চাস আমার বিজনেসও দেখতে পারিস। আমার শরীরটা ভাল নেই। তুই যদি দায়িত্ব নিস বড় নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারি।’ বাবার কোলে মাথা রেখে কণিকা আকুলভাবে কাঁদতে লাগল।

সতেরো বছর পর।

সৌমী কলেজ থেকে ফিরল সন্ধের মুখে। ফিরেই বিরাট হইচই শুরু করে দিল। রোজই করে। চিৎকার করে দিদিমাকে খাবারের অর্ডার দেয়। ড্রইংরুমে রাখা দাদুর ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বকর বকর করে। কাচের ধুলো পরিষ্কার করে। ফুল গুছিয়ে রাখে। তারপর দুটো করে সিঁড়ি টপকে সোজা চলে আসে তিনতলায়। মায়ের কাছে। কণিকা সবদিন বাড়ি থাকে না। অফিসে আটকে পড়লে ফিরতে রাত হয়। এত বড় ব্যাবসা একা হাতে সামলানো সহজ কথা নয়। মনোময়বাবু মৃত্যুর আগে অনেকটা গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। মাইনে করা লোকজনও অনেক। তবু সবদিকে খেয়াল রাখতে হয়।

আজ কণিকা বাড়ি আছে। নিজের ঘরে বসে অফিসের কাগজপএ ঘাঁটছিল। সৌমী এসে লাফ দিয়ে খাটে উঠে পড়ল। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আই লাভ ইউ মামি।’

কণিকা গলা থেকে মেয়ের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘যাও, আগে চেঞ্জ করে এসো।’

সৌমী মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আজ একটা দারুণ কাণ্ড হয়েছে মা!’

কণিকা চোখ থেকে চশমা খুলল। সৌমীকে দেখতে ভারী সুন্দর হয়েছে। যত বড় হচ্ছে, তার রূপ বাড়ছে। সবাই বলে, মায়ের মতো স্নিগ্ধ চেহারা পেয়েছে মেয়েটা। শুধু চেহারা নয়, মাথাও খুব পরিষ্কার। কণিকা ঠিক করে রেখেছে, কলেজের পাট শেষ হলেই মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে। খোঁজখবরও শুরু করেছে! কণিকা মেয়ের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘মজার কাণ্ড পরে শুনব। আগে তুমি চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে এসো।’

‘না আগে শুনতে হবে।’

‘উফ! তুমি কিন্তু দিন দিন খুব অবাধ্য হয়ে যাচ্ছি সৌমী। যত বড় হচ্ছ কথা না শোনাটা একটা হ্যাবিটে দাঁড়াচ্ছে।’ মিথ্যে রাগ দেখায় কণিকা।

সদ্য কৈশোর পেরোনো সৌমী একটু উঠে বসে। মায়ের চোখে নিজের ঝলমলে চোখ রেখে বলে, ‘আজ কী হয়েছে জানো মামি? আজ আমি একটা দারুণ ছেলেকে মিট করেছি। আমাদের কলেজেই পড়ে। সেকেন্ড ইয়ার ফিজিক্স। দ্য বয় ইজ আ মুন লাভার। বাংলায় কী বলব? চন্দ্রপ্রেমিক? নাকি চাঁদপাগল? ফুল মুন হলেই সেই ছেলে পাগল হয়ে যায়। টোটাল ম্যাড। মুন লাইট দেখার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে। কেউ ঠকাতে পারবে না। কী দারুণ না মামি?’

কণিকা নিস্পলক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘মামি, ওই ছেলে আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে একদিন মুনলাইট এক্সপিডিশনে যাবে কথা দিয়েছে। মুনলাইট এক্সপিডিশন কী বলো তো? জ্যোৎস্নায় খোলা আকাশের নীচে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো। উফ! কী রোমান্টিক! আমরা ঠিক করেছি গ্রামটামের দিকে কোথাও চলে যাব। রিভার সাইড বা ফরেস্ট তুলে সবথেকে ভাল হয়। আমি বলেছি, গাড়ি আমি দেব। তুমি কিন্তু বারণ করতে পারবে না।’

কণিকা বারকয়েক কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে চারপাশের সবকিছু দুলছে। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে জলে।

উদিতা বিশেষ বর্ষপূর্তি সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *