চন্দ্রাবতী – প্রবাসজীবন চৌধুরী
বারো শতাব্দীর কাহিনি৷
রাজপুতানায় আলওয়ারের কাছে একটি বেশ বর্ধিষ্ণু পাহাড়ি গ্রামে থাকত এক বাজিকর আর তার স্ত্রী৷ ওদের ছেলে-মেয়ে ছিল না৷ ওরা ছোটো ছেলে-মেয়েদের নানারকম খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার করত৷ ওদের দু-টি বাঁদর আর একটি ভাল্লুক ছিল৷ এদের নানারকম খেলা ওরা দেখাত রাস্তায় রাস্তায়, আর সঙ্গে অনেকরকম পুতুলের খেলা আর গল্পসল্পও করত৷ ওদের দেখলেই চারদিক থেকে ছোটো ছেলে-মেয়ের দল ছুটে আসত, আর মহা আনন্দ-উৎসাহে কলরব করতে করতে ওদের ঘিরে দাঁড়াত৷
খেলা দেখানো শেষ হলে ওদের ছোটো বাঁদরটি একটি বাটি হাতে ছেলে-মেয়েদের মাঝে ঘুরত, আর যারা পয়সা দিত তাদের সেলাম করত৷ বাজিকর আর তার স্ত্রীকে সকলেই চিনত৷ ওরা আবার মাঝে মাঝে নানারকম আজগুবি পোশাক পরে বেরিয়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে চমক আর হুল্লোড় লাগিয়ে দিত৷ সকলেই ওদের খুব ভালোবাসত, কেবল পাঠশালার মাস্টারমশাইরা ওদের তেমন সুনজরে দেখতেন না-কারণ ওদের দেখলেই পাঠশালার ছেলেরা বাইরে যাবার জন্য হইচই শুরু করে দিত৷ অবশ্য বাজিকরও খুব কদাচিৎ পাঠশালার পড়ার সময় রাস্তা পার হত, কেননা সেও চাইত যে ছেলেদের পড়ার ব্যাঘাত না হয়৷
এখন আলওয়ারে এল ঘোর বিপদ৷ শুরু হল পাঠানের আক্রমণ৷ দেখতে দেখতে দিগন্ত ছেয়ে তারা এগিয়ে এল৷ রাজপুত সৈন্যরা হারতে লাগল প্রত্যেক লড়াইয়ে৷ বীরেরা দলে দলে প্রাণ দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে৷ খবর শুনে মেয়েরাও দলে দলে জহরব্রত করে আগুনে ঝাঁপ দিতে লাগলেন৷
এই পাহাড়ি গ্রামটিতেও এইসব খবর এসে পৌঁছোল৷ অনেকেই পালিয়ে গেল পাহাড়ের আরও দুর্গম স্থলে-যেখানে ঘনঘোর অরণ্য আর বাঘ-ভাল্লুকের ভয়৷ কী দুঃসহ ক্লেশ আর ত্রাসের করাল ছায়াই এসে পড়ল ওদের উপর! তবু অনেকেই পারল না পালাতে৷ কোথায় পালাবে? ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে, বউ আর বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে কত দূরে-বা যাবে! কী খাবে? বহু লোকই গ্রামে রয়ে গেল-নিয়ত ডাকতে লাগল ভগবানকে৷ জানে যদি পাঠানেরা আসে তাদের আর নিস্তার নেই৷ আরও জানে-ধ্বংসের শেষ মুহূর্তে ওরা মেয়েদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে, আর নিজেরা যুদ্ধ করতে করতে মরবে৷ শুধু শিশুদের আর অক্ষম বৃদ্ধদের নিয়েই ভাবনা৷ চাপা কান্নার ব্যথায় সারা গ্রামটি গুমরাতে লাগল৷
২
বাজিকর তার স্ত্রীকে বললে, ‘আমাদের আর ভাবনা কী হে-কাচ্ছাবাচ্ছা, লটবহর কিছুই নেই৷ আমাদের এ সামান্য মালপত্র আর খেলার সরঞ্জাম জানোয়ারগুলোই নিয়ে যেতে পারবে৷
বাজিকরের স্ত্রী চন্দ্রাবতী বললে, ‘তা তো বটেই৷’
চন্দ্রাবতী মুখে বলল বটে, আসলে কিন্তু চিন্তার ভারে তার নাওয়া-খাওয়া ঘুচে গেছে৷ মনে এতটুকু স্বস্তি পায় না-ভাবনার নেই অন্ত৷
বাজিকর পরদিনই ভোরে বেরিয়ে পড়বে স্থির করে ফেলল৷ ওরা যাবে দক্ষিণের দিকে৷
গভীর রাতে চন্দ্রাবতী স্বামীকে জাগিয়ে বললে, ‘ওগো একটা কথা শোনো৷ আমি ভাবছি-আমাদের সেই ছোটো ছোটো শিশু মুখগুলোকে এখানে দুশমনদের হাতে ফেলে যাই কী করে? . . . কোনো ব্যবস্থা করা যায় না?’
‘সে কী করে হবে বল চন্দ্রা?’ স্তিমিত স্বরে জবাব দেয় বাজিকর৷
‘ওরাই এতদিন আমাদের খাওয়াল,’ বলতে লাগল চন্দ্রাবতী-‘কত যে ভালোবাসে আমাদের-আর আজ কিনা ওদের বিপদের মুখে ফেলে রেখে আমরা পালিয়ে যাব?’
রুদ্ধ কান্নার স্রোত চন্দ্রাবতীর কথার সঙ্গে ঝরতে থাকে৷ একটু থেমে চন্দ্রাবতী আবার ধীরে ধীরে বলে, ‘শোনো গো, এক কাজ করা যায় না? সকলের বাড়ি বাড়ি সকালে গিয়ে বলে আসি-যারা তাদের ছেলে-মেয়ে আমাদের সঙ্গে দিতে চায়-আমরা সঙ্গে নেব৷ সঙ্গে বেশি করে আটা, চাল আর চিনি নিয়ে আমরা যদি ওপরের ভৈরব মন্দিরে চলে যাই-তাহলে কেমন হয়? ছেলে-মেয়েরা আমাদের কাছে বেশ ভুলে থাকবে৷ আর সঙ্গে আরও ক-জন ঝি-চাকর নিতে হবে ওদের কাজকর্ম করার জন্য৷ দুশমনরা চলে গেলে আমরা আবার ওদের নিয়ে গ্রামে ফিরে আসব৷’
বাজিকরকে হাসিমুখে উঠে বসতে দেখে চন্দ্রাবতীর মুখেও হাসি ফুটে উঠল৷ অনেক পরামর্শ করে ওরা দু-জনে এই উপায়টাই স্থির করে ফেলল৷
৩
ভোরেই ওরা গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি ঘুরে ওদের প্রস্তাব জানালে৷ গ্রামের বুড়োরাও অনেক ভেবে প্রস্তাবটি অনুমোদন করলেন৷ সেই আসন্ন বিভীষিকার ভয়-ভাবনায় কাতর বেশিরভাগ বাপ-মাই অশ্রু গোপন করে, পরের দিন ভোরে ছেলে-মেয়েদের ওদের কাছে এনে দিল৷ শিশুগুলো এই বিচ্ছেদের দুঃখের তীব্রতা বিশেষ অনুভব করল না-বহুদিন পর বাজিকর ও তার দলবলের মধ্যে এসে তারা আনন্দে কলরব করতে করতে পথ চলতে লাগল৷ চন্দ্রাবতী ওদের মধ্যে কখনো কারুর হাত ধরে, কখনো কারুকে কোলে নিয়ে নানারকম নাচ-গান করতে করতে এগোতে লাগল৷ বাপ-মার অশ্রুতে ঝাপসা দৃষ্টিপথ হতে আস্তে আস্তে প্রায় আশি-নব্বইটি শিশুর অবোধ আনন্দের করুণ শোভাযাত্রা ক্রমেই ওপর দিকের পাহাড়ে পথের বাঁকে মিলিয়ে আসতে লাগল৷ এই শোভাযাত্রার পিছনে করূণ মুখে চলছিল আট-দশটি ক্লান্ত বৃদ্ধ ঝি-চাকর-বামুন৷ তাদের মাথায় বস্তা বস্তা আটা, চাল, চিনি, শাক-সবজি আর অন্যান্য খাবার জিনিস৷ প্রতি গৃহস্থই দিয়েছে তাদের সঞ্চয় ছেলে-মেয়েদের জন্য৷ কত মা লুটিয়ে পড়লেন ধূলায় বাছার মুখে শেষ চুমো দিয়ে, কত বাবা বুকের মাণিককে সেই শোভাযাত্রার সারে গেঁথে দিয়ে দু-হাতে বুক চেপে হাহাকার গোপন করলেন আর বৃদ্ধ দাদু-দিদিমারা দু-চোখ কাপড়ে মুছতে মুছতে ভগবান ভৈরবের কাছে নাতি-নাতনির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা জানাতে লাগলেন৷
আড়াই দিনের পথশ্রান্ত শিশুর দল অবশেষে পাহাড়ি পথের অগুন্তি আঁকাবাঁকা পেরিয়ে ঘুরে ঘুরে এসে পৌঁছোল ভৈরবমন্দিরের পাদমূলে৷ বৃদ্ধ পূজারি আগেই খবর পেয়েছিলেন৷ মন্দির সংলগ্ন বিরাট দালানটি দিলেন শিশু অতিথিদের জন্য; বেলা পড়ে এসেছে দেখে দু-জন বৃদ্ধ বামুন রান্না চড়িয়ে দিল৷ পূজারি মন্দির পরিচালককে দিয়ে আগেই মন্দির চত্বরের ওপাশে ছোটো ছাউনি বেঁধে দু-টি বড়ো বড়ো উনুন করিয়ে রেখেছিলেন৷ পাহাড়চূড়ার ঘন অরণ্যে গোপন এই মন্দিরতলে নিভৃত পবিত্র পরিবেশে এসে শিশুর দল যেন সব ক্লান্তি ভুলে গেছে৷ ওদের যেন সীমাহীন ছুটির আনন্দে পেয়ে বসেছে৷ পাঠশালা নেই, বাড়ির শাসন নেই-এবার বাজিকরের খেলা যত খুশি দেখবে৷
রান্না শেষ হওয়া পর্যন্ত ওদের জাগিয়ে রাখার জন্য চন্দ্রাবতী নিজের শ্রান্তি ভুলে তাড়াতাড়ি খেলার সরঞ্জাম খুলে ফেলল৷ তারপর শুরু হল নানারকম পোশাক পরে শিশুদের মন ভোলানোর পালা! কখনো বাঘের সাজ, কখনো ভাল্লুকের সাজ, আবার কখনো-বা পাগড়ি পরে গোঁফ লাগিয়ে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যোদ্ধার সাজ-এইসব সাজছে৷ কখনো আবার খুব সুন্দর ঝলমলে রাজকুমারীর বেশে সেজে ওদের গল্প বলছে৷ চন্দ্রাবতীকে কী সুন্দরই না দেখায় তখন৷ ছেলে-মেয়েরাও ওর কাছটিতে ঘেষেঁ এসে ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে৷ ও হয়তো ঠাট্টা করে কোনো ছোটো ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, ‘একী খোকন! তুই অমন করে আমার পানে চেয়ে কী দেখছিস? আমায় বিয়ে করবি? বিয়ে করবি তো ঘোড়া কোথায় তলোয়ার কোথায়, আর তোর গোঁফজোড়াটাই বা কোনখানে?’ ছেলেটি লজ্জায় চন্দ্রাবতীর বুকে মুখ লুকোয় আর শিশুর দল হুল্লোড় করে হেসে ওঠে৷ এই আড়াই দিনের পথচলার সময়ে চন্দ্রাবতীর স্নেহ-মায়া ওদের মনে আরও গভীর জাল ফেলেছে৷
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে বেশ রাত হয়ে গেল৷ চন্দ্রাবতী চাকরদের সাহায্যে শিশুদের জন্য সাজানো-গোছানো সারি সারি শোবার জায়গা করে ফেলেছে৷ চন্দ্রাবতীর দু-টি হাতে যেন দশভুজার আশীর্বাদ মূর্ত হয়ে উঠেছে৷ নক্ষত্রের মতো চারিদিকে ঘুমে-ভরা শিশুমুখের রাশির মাঝে চাঁদের মতোই বসে চন্দ্রাবতী কত বীর রাজপুত্রের কাহিনি বলে ওদের ঘুম পাড়ায়৷ জ্যোৎস্না-প্লাবিত অন্তহীন আকাশে হেলান দিয়ে ঘন অরণ্যে ঘেরা সুপ্রাচীন ভৈরব মন্দিরের মুকুটপরা গিরিশিখরও স্বব্ধ হয়ে শুনতে লাগল তার চোখে দেখা সেইসব কাহিনি৷
অনিশ্চিত বিভীষিকার ত্রাসের মধ্যে গ্রামের দিনগুলো কাটতে লাগল অতি ধীরে৷ পুরুষদের অস্ত্রগুলো রোজই আরও ঝকমকে আর মেয়েদের জহরব্রতের আয়োজন নিখুঁত হতে লাগল৷ এর মধ্যে ভৈরব মন্দির হতে দু-বার চন্দ্রাবতী শিশুদের কুশলবার্তা পাঠিয়েছে তাদের বাপ-মার কাছে; আর শিশুদের জন্য ভালো বিছানা, খাবার আর নানারকম পোশাক আনিয়ে নিয়েছে৷ গ্রামের বড়োলোকেরা তাঁদের সব কিছুই শিশুদের জন্য লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন৷ আহা! এই দারুণ বিপদে যদি শিশুগুলোও রক্ষা পায়-এই ত্রাস আর ক্লেশের যেন কিছুই না পায় তারা!
প্রতিদিন রাতে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়লে চন্দ্রাবতী ঝি-চারকের সাহায্যে নানারকম পর্দা দিয়ে দালানটি এক-একদিন এক এক রকমভাবে সাজাত৷ বাঘ, ভাল্লুক, ময়ূর আর অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের নানারকম ছবি দিয়ে আগেই ভালো করে সাজিয়ে ফেলেছিল চারদিক৷ এক-একদিন বনের নানা রঙের ফুল আর মালায় দালানটি সাজিয়ে রেখে, ভোরে ঘুমভাঙা শিশুদের মধ্যে উৎসব জাগিয়ে দিত৷
৪
সেদিন গ্রাম থেকে চাকরটি জিনিস আনার সঙ্গে খবর আনল শত্রুরা গ্রামের সীমানায় এসে পড়েছে; দুই-এক দিনের মধ্যেই সব ছাই হয়ে যাবে গ্রামের৷ তারপর ভৈরব মন্দিরের আশ্রিতদের অদৃষ্টে কী আছে কে জানে!
খবর শুনে খানিক স্তব্ধ হয়ে থেকে চন্দ্রাবতী চলে গেল বনপথ দিয়ে৷ স্তূপাকার ফুলে বাজরা ভরতি করে মাথায় করে নিয়ে ফিরে এল৷ তখন সন্ধ্যা হয় হয়৷
শিশুরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে চন্দ্রাবতী দুই-তিনটি ঝি-চাকরের সাহায্যে সমস্ত দালানটি ফুলের সাজে অপরূপভাবে সাজাল৷ সব সাজানো-গোছানোর কাজ শেষ হলে চন্দ্রাবতী দেবমন্দিরের রুদ্ধ দ্বারের কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল৷ চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বললে, ‘দয়াময় ভৈরোঠাকুর, এই শিশুগুলোকে রক্ষা করো৷ ওরা তো কোনো দোষই করেনি জীবনে৷ ওদের কেন কষ্ট দেবে? তোমার কোপ যেন সব পড়ে একা আমার ওপর৷ আমায় মেরো তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে, কিন্তু ওদের যেন রক্ষা হয় ঠাকুর৷’
চোখের জলে চন্দ্রাবতীর কাজল ধুয়ে যায়৷ খানিক পরে চন্দ্রাবতী ফিরে এসে শিশুদের শিয়রে বসে গালে হাত দিয়ে কী ভাবে! হঠাৎ আয়না আর কাজল-লতা বার করে টেনে টেনে কাজল পরে৷ বৃদ্ধা ঝি শুয়ে শুয়ে চেয়ে থাকে আর বলে, ‘চন্দ্রা, তুই যে এত সুন্দরী তা আগে কখনো বুঝতে পারিনি৷ রাত দুপুরে কার জন্য সাজছিস এত? কিছু খেলিও না রাতে৷ না খেলে চলবে কী করে? বাচ্চাগুলো তোর মুখ চেয়েই আছে-তোর মুখ শুকনো দেখলে ওদের মুখও শুকিয়ে যাবে যে!’
‘আমার মুখ কখনো শুকনো দেখাবে না রে,’ হেসে বলে চন্দ্রাবতী; ‘আমি জাদু জানি যে৷ এই সাজপোশাক সব ঠিক করে রাখছি, ভোরে উঠেই যে ওদের নতুন খেলা দেখাতে হবে৷’
সত্যিই চন্দ্রাবতী নেচে হেসে গুনগুন করে গান গেয়ে সব সাজাতে গোছাতে লাগল৷ বাজিকর মন্দিরের চাতালের এক কোণে হেলান দিয়ে শুয়ে তামাক খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে চন্দ্রার দিকে চেয়ে দেখছিল৷ চন্দ্রাবতী ছুটে তার কাছে গিয়ে বললে, ‘মনে রেখো গো-তুমি কাল ভোরে উঠেই ভাল্লুকের সাজটা পরে নেবে, আর আমি ফুলের সাজ, ফুলের মুকুট পরে ফুলরানি সাজব৷ তুমি নেচো আর আমি গাইব . . .’
‘চন্দ্রা-আমি আর পারছি না’-বাধা দিয়ে বাজিকর বলে, ‘ভাবছি ওদের শেষ পরিণতি কী, আর তোরই বা কী?’
‘যাও, তোমার অত ভাবতে হবে না-‘তেড়ে উঠে চন্দ্রাবতী বলে, ‘মনে করে সকালে ভাল্লুকের সাজটা পোরো৷ যা ভাবার ভাববেন ভৈরো দেবতা৷ তুমি আমি কে? একদিন তো মরতে হবেই৷ যতদিন আছি, হেসেখেলে কচিমুখে হাসি ফুটিয়ে দিই৷’
ভোরের অরুণ-আলোর আভাস পূর্ব আকাশে ফুটতে না ফুটতেই পাহাড়চূড়ায় ভৈরব মন্দিরের অঙ্গনে শিশুদের অফুরন্ত আনন্দের কাকলি জেগে উঠল৷ ছেলে-মেয়েদের খাইয়ে-দাইয়ে ভালো ভালো পোশাক পরিয়ে চন্দ্রাবতী মন্দিরের চাতালে বসিয়ে দিল৷ তারপর শুরু হয় খেলা৷ বাজিকর সাজে ভাল্লুক আর চন্দ্রা ফুলরানি৷ চন্দ্রাবতী একটার পর একটা গান গেয়ে ভাল্লুককে নাচায়৷ কখনো একতারা, কখনো খঞ্জনি, আবার কখনো ঢোলক বাজায়৷ কীসব মজার মজার গান! শিশু দর্শকদের কচি কচি মুখে হাসি ফুরায় না৷ কলরবের সঙ্গে পড়তে থাকে কচি হাতের তালি৷
চন্দ্রাবতী ভাল্লুকের হাত ধরে টেনে এনে একটি টুলে বসায়, তারপর বলে, ‘তোমার নাম কী?’
‘ভোঁমা সিং৷’
‘কী খাও?’
‘মধু আর চামচিকে৷’
‘সর্দি হলে কী করো?’
‘দুষ্টু ছেলের একটা কান তেলে ভেজে মধু দিয়ে খাই৷’
‘এখন দেখছি তোমার সর্দি হয়েছে-না ভাল্লুক?’
‘হ্যাঁ, বড্ড সর্দি হয়েছে৷’ বলে ভাল্লুক বার কতক নানা ভঙ্গি করে হাঁচে আর শিশুর দলে হুল্লোড় পড়ে যায়৷
‘বেশ! তাহলে তোমার ওষুধ খুঁজে নাও-কেমন?’
ভাল্লুক আস্তে আস্তে এগোয় আর ছেলে-মেয়েদের মুখের কাছে মুখ এনে শোঁকে৷ ছেলে-মেয়েরা পালায় আর ভাল্লুকও তাদের পিছু ধাওয়া করে৷ খুব একটা হইচই হাসির ধুম পড়ে যায়৷ শেষে একটা কানের মতো জিনিস নিয়ে ভাল্লুক চন্দ্রার কাছে এসে দাঁড়ায়৷ অমনি ছেলে-মেয়েরা যে যায় জায়গায় চুপ করে বসে৷ ভাল্লুক কানটা উঁচু করে ধরে আর চন্দ্রা বলে, ‘এইটা হল একটা দুষ্টু ছেলের কান! ভোঁমা সিং! এই কানটা কী বলছে-কান পেতে শুনে ঠিক ঠিক বলে যাও৷’
চন্দ্রা কানকে প্রশ্ন করে, ‘কী করতে তুমি?’
‘পড়া করতুম না৷’
‘আর কী করতে?’
‘মার কথা শুনতাম না৷’
‘আর কী করতে?’
‘পাখির বাসায় ঢিল ছুড়তুম৷’
‘আর কী করতে?’
‘দুপুর বেলায় ঘুমোতুম না৷’
‘আচ্ছা বেশ! এসব আর করবে?’
‘কখনোই না৷’
সঙ্গেসঙ্গে ছেলে-মেয়েরাও বলে ওঠে, ‘কখনোই না৷’
তখন চন্দ্রা বা ফুলরানি ভাল্লুক ভোঁমা সিংকে বলে, ‘আচ্ছা ভোঁমা সিং, তুমি কানকে ছেড়ে দাও-আমি এক্ষুনি জাদুমন্তরে তোমার সর্দি সারিয়ে দিচ্ছি৷’ বলে ভাল্লুকের নাক ধরে ওপর দিকে একবার আর নীচের দিকে একবার টেনে ছেড়ে দিল৷
ভোঁমা সিংও সেলাম করে বললে, ‘হ্যাঁ ফুলরানি, আমার সর্দি একেবারে সেরে গেছে৷’
‘বেশ৷ এবার তাহলে কানটা দুষ্টু ছেলের কাটা জায়গায় গিয়ে জোড়া লেগে যাক৷’ বলেই ফুলরানি কানটায় মন্তর পড়ে দিতেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল!
তখন ছেলের দলে দারুণ হুড়োহুড়ি আর হাসি! এ ওর কান টেনে বলে-‘এই যে সেই কানটা৷’
এমনি করে খেলার পর খেলা! নাচ, গান, গল্প দিয়ে চন্দ্রাবতী ওদের ভুলিয়ে রাখে-সারাক্ষণ শিশুর দল যেন মেতে থাকে৷ ক্রমে বেলা বাড়ে৷ রৌদ্র খর হয়৷ চন্দ্রা বলে, ‘এবার নাওয়া-খাওয়া করবে চলো তোমরা৷’
‘না না না৷ আর একটা-আর মাত্র একটা!’ শিশুদের সমস্বরে কাকুতি ধ্বনিত হতে থাকে৷
অগত্যা আর একটা নতুন খেলার জন্য চন্দ্রা তৈরি হয়৷ কিছুক্ষণের মধ্যে চন্দ্রা এবার সেজে এল এক অপরূপ সুন্দরী রাজকুমারীর বেশে৷ রাজকুমারী রূপবতী বনে ফুল তুলতে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছে-ঘন গহন বনে দুঃখের গান গেয়ে সে পথ খুঁজছে৷ হঠাৎ পাহাড়ের গুহা থেকে বার হয়ে এল এক বিরাট ভাল্লুক৷ রাজকুমারী ভয়ে শিউরে উঠতেই ভাল্লুক বললে, ‘রাজকুমারী রূপবতী! ভয় পেয়ো না৷ যদি আমায় বিয়ে করো তো তোমাকে কিছু বলব না৷ আদর করে নিয়ে যাব গুহায় আর টাটকা সোনার বরণ মধু দেব খেতে৷’
রাজকুমারী তখন আরও ভয় পেয়ে বললে, ‘ও ভাল্লুক মশাই! আপনার দু-টি পায়ে পড়ি, আমায় ছেড়ে দিন৷ দয়া করে যদি বন থেকে বার হবার পথ বলে দেন-আপনি আর যা চান তাই দেব, কিন্তু বিয়ে আপনাকে করতে পারব না; কারণ আমার বিয়ে অনেক আগেই ঠিক হয়ে গেছে একজন পরম সুন্দর রাজকুমারের সঙ্গে৷’
‘না, তা হবে না’-বলে মাথা নেড়ে, থাবা বাড়িয়ে ভাল্লুক যেই রাজকুমারী রূপবতীকে ধরতে গেছে, অমনি দূর পাহাড়ে পথের বাঁকে একসঙ্গে ঘোড়ার খুরের শব্দ জেগে উঠল-যেন অনেক অশ্বারোহী একসঙ্গে ভৈরো মন্দির লক্ষ করে ছুটে আসছে৷ এক নিমেষে এই মায়ার খেলা স্তব্ধ হয়ে যেতেই সহসা মন্দির চাতালের পাশের ঘন লতার জাল সরিয়ে বার হয়ে এলেন মণিমাণিক্য-ঝলকানো অপূর্ব রাজবেশে এক পরম সুন্দর মুসলমান রাজকুমার৷ চন্দ্রার সামনে এগিয়ে এসে বাদশাজাদা বললেন, ‘ভয় পেয়ো না-আমরা তোমাদের বন্ধু! ওই যে অশ্বারোহীরা আসছে ওরা আমার অনুচর৷ আমিই এই সৈন্য বাহিনীর সেনাপতি৷ যখন আমার চরেরা খবর দিল যে, গ্রামের সকল শিশুকে নিয়ে এক জাদুকরি ও তার স্বামী পালিয়েছে ভৈরো মন্দিরে, তখন আমার আর কৌতূহলের অন্ত রইল না সেই জাদুকরীকে দেখার৷ দু-তিন দিন আগে তোমাদের গ্রামের এক বড়োলোকের কাছ থেকে অনেক খাবার-দাবার ও পোশাক নিয়ে যে মূক-বধির ভৃত্যটি এসেছিল-সে আমিই৷ চন্দ্রাবতী, তোমার জাদুর খেলা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি৷ আমারও দেশে ছোটো ভাই-বোন আছে৷ আমিও একসময় শিশুই ছিলাম৷ জাদুকরেরা আমাকেও জাদু করত-পাঠশালা হতে পালাতুম৷ ইচ্ছা করে, এখানেই থেকে যাই তোমাদের এই নিত্য উৎসবের মাঝে৷ এত রস আমি জীবনে পাইনি-এত নির্মল আনন্দ যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, তা আমার কল্পনায় ছিল না! . . . মন যা চায় তা তো হয় না-কঠিন কর্তব্যের ভার৷ হ্যাঁ, অভিযান আমাদের শেষ হয়েছে৷ এবার আমার মুসলমান বাহিনী ফিরবে৷ তোমাদের এ গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি কেবল চন্দ্রাবতীর জাদুর খেলায়৷ আমার সৈন্যরাও গ্রামের মাটি ছোঁয়নি৷ . . . এবার এই শিশুদের তাদের বাপ-মার কাছে পাঠিয়ে দাও৷’
একটু থেমে সেনাপতি আবার বললেন, ‘এবার আমার যাওয়ার সময় হয়েছে৷ অনুচরেরা এসে পড়ল৷ কেবল একটা প্রার্থনা আছে আমার-আমি এই জাদুকরিকে আমাদের বেগম মহলে নিয়ে যেতে চাই৷’
এতক্ষণ সকলে যেন পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে শুনছিল বাদশাজাদার কথা৷ চন্দ্রাকে নিয়ে যাবার কথায় রাজপুত রক্ত যেন সংবিৎ ফিরে পেল৷ কিন্তু কেউ কিছু বলবার আগেই চন্দ্রাবতী সেনাপতির সম্মুখে এসে হাত জোড় করে বললে, ‘হুজুর, আমি পথে পথে এই বাচ্চাদের তামাশা দেখিয়ে বেড়াই৷ এ না করতে পারলে আমি একদিনও বাঁচব না৷ আপনার সুন্দরী বিদুষী বেগম মহলে আমার মতো মূর্খ জাদুকরিকে কি মানায়?’
বাদশাজাদা হেসে বললেন, ‘আমি এই জবাবই আশা করছিলাম চন্দ্রা! আমি ছদ্মবেশে এই দুই-তিন দিন সর্বদা তোমার কাছে কাছে থেকেছি-তোমার স্নেহ-মায়ায় মূক-বধির ভৃত্যটিও বঞ্চিত হয়নি৷ গভীর রাতে তুমি যখন ভৈরো দেবতার রুদ্ধ দ্বারের সামনে লুটিয়ে কাঁদতে তখনই অনুভব করেছি যে, এই পবিত্র-আত্মা নারীকে কখনো হিরা-জহরত মান-মর্যাদার লোভ দেখিয়ে জয় করা যায় না৷ . . . হৃদয় আমার খুশিতে ভরে উঠেছে৷ দেশে আমারও মা-বোন আছে; তুমি আমার বোনই হলে চন্দ্রা!’ তারপর হাত থেকে হিরার আংটি খুলে চন্দ্রার হাতে দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই নাও ভাইয়ের স্মৃতিচিহ্ন৷’
চন্দ্রাবতী চকিতে তার সাচ্চা জরি ও রেশমের ওড়না হতে কিছু জরি ও রেশম নিয়ে নিপুণ হাতে একটি রাখি তৈরি করে পলকে সেনাপতির হাতে পরিয়ে দিয়ে বললে, ‘এই নাও ভাই সাহেব, তোমার বোনের উপহার!’
ততক্ষণে পাঁচ জন অশ্বারোহী সৈনিক সেনাপতির দুগ্ধবরণ ঘোড়াটি নিয়ে এসে পৌঁছেছে৷ একটি শিশুর হাতে স্বর্ণমুদ্রায় ভরা একটি চামড়ার থলি দিয়ে বাদশাজাদা ভাল্লুকের দিকে ফিরে বললেন, ‘ভাল্লুকভায়া! সর্দি সেরেছে? যাও এবার রূপবতী রাজকুমারীকে তার নিজের জায়গায় নিয়ে যাও৷’
মুহূর্তের মধ্যে ঘোড়ার দ্রুতগতি খুরের ধ্বনি পাহাড়ে পথের নীচের দিকে মিলিয়ে গেল আর চন্দ্রাবতী সেইখানেই দু-চোখভরা জল নিয়ে ভৈরব দেবতার উদ্দেশে হাত জোড় করে লুটিয়ে পড়ল মন্দিরে-অঙ্গনের ধুলায়৷