চন্দ্রভস্ম – রমাপদ চৌধুরী

চন্দ্রভস্ম – রমাপদ চৌধুরী

শীত-নিষুতির কালো কালো মাটিতে নেই এতটুকু আওয়াজের লেশ। ঘামতেলে মাজা

চকচকে সড়কটা সিধে আঁধারের বুকে মুখ লুকিয়েছে। মুখ লুকিয়ে ছুটে গেছে আলো-ঝলমল শহর অবধি।

ঠাণ্ডা বাতাসের ঠোঁটের কাঁপনে বেজে উঠছে না এক ফোঁটা ভাঙা শিস। ঘাসের ডগায় নিশীথ-কীটও নিশ্চুপ। নেই ঝিঁঝির ডাক, নেই ঝড়ের দাপট।

কিন্তু একটু আগেই এ-পল্লীর এই ছোট দুনিয়াটাকে থমকে দিয়েছে পর পর কয়েকটা শব্দের ঝাঁকানি। যুগ্মমণির দীপ্তি নিবিয়ে হর্ন বাজিয়ে পাঁচিলে গা ঢেকেছে দুখানা মোটর বাস। খানিকটা চিৎকার, খানিক হাসি আর ফটক বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। হট্টগোল একটু রোজই হয় এমন সময়, তারপর ঝিমিয়ে পড়ে সবাই।

তন্দ্রাক্লান্ত পাতালপুরীর মত ঝিমিয়ে পড়ে ঐ পাঁচিল-ঘেরা বস্তিটা।

পাঁচিলের ওপাশটা দেখবে? নিজের চোখে দেখতে চাও ওদের দৈনন্দিন জীবনের চলচ্চিত্র? ভাষা সংযত কর। ঠিক ওদেরই মত রসহীন, ঘা খাওয়া আর ঘেয়ো রুগীর ছবি ফোটাও তোমার ভাষায়। চাঁদ ওরাও দেখে—তা জানি। আকাশের কোণে শুক্লপক্ষের রাতে যে চাঁদ ভেসে ওঠে, আলোর প্রলেপ মাখানো বরফের চাকতির মত সাদা চাঁদ—ওরাও দেখে। কিন্তু বুড়ো রুখন তার পায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখেছে, দেখেছে ওর পায়ের পাতার শ্বেতকুষ্ঠের চাকাগুলো আরো সাদা আর চকচকে। তাই বলছি, মর্মরশুভ্র মোমবাতির আলোয় যদি যুবতী মাংনার মুখ দেখতে চাও, আপত্তি করব না। কিন্তু দোহাই তোমার, ওর চোখের তারা দুটো যেন তোমার চোখের নীল কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে চেষ্টা কোর না।

বাস থামল। লোহার ফটক পেরিয়ে গিয়ে। উথলে পড়ল এক ঝলক গোলমেলে চিৎকার। যাত্রীরা নেমে গেল একে একে। এই দিনযাত্রীর দলে নতুনের আগমন ঘটে খুব কম। পুরোন দলের কেউ কেউ হয়তো ছিটকে অনুপস্থিত থেকে যায় কোন দিন। তেওয়ারীর কাছে দুটো কিলচড়, বিরতিবিহীন পাঁচ মিনিটের অশ্রাব্য কটুক্তি আর ধারালো ধমক জমা থাকে পরের দিনের জন্যে। তবু তারা ফিরে আসে।

গ্যারেজে বাস রেখে ড্রাইভার দুজন চলে যায় ছেঁড়া কোটের কলারে কান ঢেকে। বিড়ি টানতে টানতে। সশব্দে ফটক বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আসে তেওয়ারী। আর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে গজল্লা করে ওরা। অনেক অনেক মেয়ে-মরদ কচি ছেলে আর কানা বুড়োর দল জটলা পাকিয়ে গুলতান করে। মেয়েগুলোর হাসি থামে না। বুড়োদের মুখে অশ্লীল মন্তব্য শুনে অশ্লীলতর জবাবের দেমাক দেখিয়ে হেসে ওঠে তারা। তা বলে কলহাস্যের তুফান ওঠে না। ওদের গায়ে যে ছেঁড়া চট আর নোংরা কালি। কালো রঙ মাখানো শণের নকল চুলের মত জট পাকিয়ে আছে মাথার ঝুঁটি। কাকলি নয়, ওদের কণ্ঠস্বরে সুরের কলঙ্ক। তবু ওরা হাসাহাসি করে। হাসি-রঙ্গ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। হাসে না কেবল বাচ্চাগুলো। চোখ জড়িয়ে আসা ঘুম হটিয়ে ক্ষিদেয় ট্যাঁ-ট্যাঁ করে। পুরুষগুলো রেগে টেঁটিয়ে ওঠে, ধমক দেয়। হ্যাঁ, পুরুষই। জোয়ান না হোক, মরদ ওরা একশোবার। জোয়ারের বীজ আর জলো ডাল খেয়ে তো আর জোয়ান হওয়া যায় না।

তেওয়ারীর হাঁক শুনে সারি বেধে দাঁড়ায় ওরা। এটুকু নিয়মানুবর্তিতা মজ্জায় ঢুকেছে ওদের।

একটু পরেই বাঙালীবাবু জহর এসে হাজির হয়।

—ভিখুরাম।

—হাজির, দশ আনা।

নোটবই দেখে নাম ডাকতে শুরু করে জহর।

—তাহের আলি।

—হাজির, এক রুপিয়া ছ পয়সা।

—পঞ্চা।

—হাজির, সাড়ে বারো আনা।

পর পর নাম ডেকে যায় জহর। ওরা একে একে সামনে এসে হাজিরা দেয়। মুদ্রার অঙ্কটা। জানিয়ে তেওয়ারীর হাতে তুলে দেয় গুনে গুনে। জহর প্রত্যেকের নামের পাশে চিহ্ন দিয়ে টাকা-পয়সার পরিমাণটা লিখে রাখে। ক্ষুদ্রাকার ভিস্তির মত একটা চামড়ার থলেতে পয়সাগুলো জমা করে তেওয়ারী।

এবার মেয়েদের নাম ডাকা হয়।

—সন্‌কা।

—হাজির গো।

—কত? একটু রুখেই জিজ্ঞেস করে জহর। হোক মেয়েমানুষ, ঠিকুজি মিলিয়ে বয়সের দৌলতে হলই বা যুবতী, তা বলে ভদ্রবংশজাত শিক্ষিত জহর ওদের কথার সরস উন্মাদনাটুকু সহ্য করবে কোন্ রুচিতে। জহর তাই চটে ওঠে। ওদের হালকা রসিকতা আর কথা বাড়াবার প্রয়াসের মধ্যে জহর দেখতে পায় একটা অতি কুৎসিত অসম্মানের লোলুপতা।

তাই কঠোর স্বরে প্রশ্ন করে, কত?

গুনে তো দেখি নাই গো, দাঁড়াও দেখি। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে সন্‌কা, তারপর আস্তে আস্তে গুনতে থাকে হাতের পয়সাগুলো।

বলে, ছ আনা দেড় পয়সা।

তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচিয়ে ওঠে জহর, এত কম?

—কম হচ্ছে তো করব কি!

নাকের ভেতর দিয়ে শুধু একটা শব্দ করে জহর।

তেওয়ারী বলে, কাল ফির কোম হোবে তো খানা বন্ধ হোবে।

উত্তর দেয় না সন্‌কা, ঠোঁট টিপে ভেংচি কেটে সরে পড়ে।

রুখন দিয়েছে মোট তিন আনা, তবু অবিশ্বাস করেনি জহর। দু-এক পয়সা হয়তো চুরি করে। অমন সবাই করে। সে আর তেওয়ারীও তো রোজই কিছু-না-কিছু মারে ভাগাভাগি করে। যা জমা হয়, তার সবটাই তো আর তুলে দেয় না মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর হাতে। কিন্তু মেয়েগুলোকে বিশ্বাস নেই। পুকুর চুরি করে ওরা। কমবয়েসী মাংনা মেয়েটা, দেখতে নেহাত খারাপ নয়। এক নোংরা, এ ছাড়া হাতে-পায়ে কোথাও নেই এতটুকু ঘা-ফোড়। লোকে অন্তত দুবার ফিরে তাকাবে ওর দিকে। অথচ কোন দিন পাঁচ-ছ আনার বেশি জমা দিল না। সন্‌কা, রাউতী, মাংনা—ওদের কোনটাকেই বিশ্বাস করে না জহর। তবু উপায় তো কিছু নেই। তেওয়ারীর মারফত দুটো বাক্‌বকুনি দিয়ে থেমে যেতে হয়। বেশি সন্দেহ ঘটলে তেওয়ারী নিজেই মেয়েগুলোর কোমরের ঘুনসিতে হাত বুলিয়ে দেখে নেয়। একদিন ছেঁড়া কাপড়টাই টেনে খুলে নিয়েছিল মাংনার, মেয়ে-মরদ সবার সামনে। ঝেড়ে-ঝুড়ে কাপড়ের খুঁটগুলো যখন দেখছিল তেওয়ারী, তখন লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল জহর। অথচ মাংনা শুধু হেসে ফেলে কাপড়টা কেড়ে নিয়েছিল তেওয়ারীর হাত থেকে। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখেছিল জহর, তারপর নিজেরই ওপর ঘেন্নায় বিষিয়ে উঠেছিল তার মন। চাকরিটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিনই। কিন্তু মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর কাছ থেকে মাসের শেষে মাসোহারা, অদূরে নি-ভাড়া টালির ঘর, আর পর্যাপ্ত উপরির মায়া তো কম নয়।

মোম গলে গলে পিরিচ ভরে উঠেছে তোমার। দীর্ঘ সুশুভ্র মোমবাতিটা খাটো হয়ে এসেছে অনেকখানি। মিছেই তিল তিল করে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে তুলেছ ওকে। দাও, নিবিয়ে দাও বাতিটা। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় দেখতে পাবে দেড়শো ছায়াশরীর এগিয়ে চলেছে আবছা আঁধারে। মাটি-গোবরের ছিটে-দেওয়া চাঁচর আর চিকের প্রাসাদে ঢুকছে ওরা।

লম্বা উঠোনের মাটির মেঝেতে পাতা পড়ে গেছে সারি সারি। হলুদের ভ্যাপসা গন্ধ। চচ্চড়ির মত কি যেন দিয়ে যায় হাতা ভরে। মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায় ওরা। লোকটার মায়া-দয়া আছে, পেট ভরে খেতে দেয়। যত খুশি খেতে পারে ওরা।

পেট ভরে খাচ্ছিল রাউতী। মাংনার মানা না শুনেই খাচ্ছিল। হঠাৎ সারা গা তার কেমন-কেমন করে উঠল। বুক থেকে গলার নলি অবধি একটা বাস্পগোলক যেন ওঠানামা করল বারবার। পেট থেকে পেঁচিয়ে উঠল একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ। নিজের নাকেই টের পেল রাউতী। অম্লকষায় অনুভব করলে জিভ আর মাড়ির পাশে। পাতের পাশেই বমি করে ফেললে যা-কিছু খেয়েছিল। মাংনা বসে ছিল পাশেই। তার গায়েও লাগল খানিকটা। তবু চটল না সে। এমন তো প্রায়ই হয়।

একটু সহানুভূতির স্বরে বললে, খা রাক্ষুসী খা, পাঁচ-মেসো পেট নিয়ে গিলতে তো ছাড়াবি না।

রাউতী জবাব দিলে না, সে তখন নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে।

—আ মলো, বললাম বলে মাগীর আবার কান্না!

মাংনার কথায় ফিরে তাকিয়ে হেসে ফেললে রাউতী। আসলে বমি করতে গিয়ে এমন এক-আধ ফোঁটা জল আসেই চোখে। মাংনা তাই দেখে ভেবেছে রাউতী বুঝি-বা কাঁদছে।

—কাঁদিনি লো কাঁদিনি। হেসে জবাব দিলে রাউতী। তারপর পিঠের নোংরা কাঁথাটায় চোখ মুখ নাক ঝেড়ে নিলে সে। উঠে গিয়ে মুখ ধুয়ে এল চৌবাচ্চার জ্বলে। এসে সেই পাতাটাই পরিষ্কার করে বসলে।

—আবার খাবি নাকি? মাংনা জিজ্ঞেস করলে।

বিস্ময়ের স্বরে রাউতী বললে, খাবনি? যা খেইছিলাম, তা তো উল্টি হয়ে গেল।

—মাগী, মরবি তুই মরবি। খানিক থেমে মাংনা আবার বললে, ছেলেটাকেও মারবি হতচ্ছাড়ি।

প্রথমে কথাটায় হেসে উঠেছিল রাউতী, তারপর হঠাৎ থমকে গেল যেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে মাংনার দিকে।

বললে, তু এমোন কথা বললি মাংনা?

মুখের গ্রাস থামিয়ে মাংনা বললে, বলেছি বেশ করেছি। তারপর কি ভেবে সান্ত্বনার স্বরে বললে, ও মরবার জাত লয় রে।

রাউতী ক্রোধে ভেংচিয়ে উঠল, উ মরবার জাত লয় রে! তু বলবি কেনে?

মাংনা হাসতে হাসতে বললে, বেশ, আর বলবনি।

রাউতী হয়তো এত সহজে ছাড়ত না, কিন্তু ওদিকে তখন তুমুল ঝগড়া শুরু হয়েছে তাহির আলি আর রুখনের মধ্যে। খিচুড়ি-মাখা হাতেই হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছে দুজনে। ওদের ঝগড়া থামাবার জন্যে কেউ একটা কথাও বলছে না। এমন প্রায়ই হয় কিনা।

শুধু সন্‌কা তাহিরের উদ্দেশে বললে, থামা দাও মিঞা ছায়েব, অ লাগরের সাথে নড়তে লারবে। উ আমাদের তালপাতার ছেপাই।

কিছুক্ষণ পরে আপনা থেকেই তারা হাতাহাতি ছেড়ে বাক্‌যুদ্ধে নেমে এল, তারপর অভুক্ত খাদ্যের দিকে মন দিয়ে ক্রমে ক্রমে চুপ করে গেল।

একে একে খাওয়া হয়ে গেল সকলের। নিজের নিজের পাতা হাতে করে এক কোণে জমা করে রেখে চৌবাচ্চার জলে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। খেয়েও নিল সেই জল। তারপর লম্বা লম্বা কপাটবিহীন ঘরের মাটিতে ছেঁড়া চাটাই পেতে শুয়ে পড়ে সকলে। এই স্বল্প সময় নিদ্রাশান্তির লোভে একে একে গা এলিয়ে দেয় তারা। ছেঁড়া কাঁথা নয়তো কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। জবাই-করা মুর্গির মত নেতিয়ে থাকে দেড়শো ছায়াশরীর।

চোখে ঘুম আসে না শুধু পঞ্চার। ও জানত ওর চোখে আজ ঘুম আসবে না।

আর একজন। ঘুমিয়ে ছিল, এখনই জেগে উঠেছে। তাহির আলি।

—কি মিঞা, নিদ্‌ আসছে নাই?

ফিরে না তাকিয়েই তাহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, না।

—কেন ছাহেব?

—শালার ঘায়ে রস কাটতিছে ভাই, বড় চুলুক-চুলুক করতিছে। ঘা বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিতে থাকে তাহির। হাঁটু থেকে কুঁচকি অবধি দগদগে ঘা। শেয়ালে-খাবল-মারা খরগোশের মত লাল-লাল মাংস ঝুলছে ঘা থেকে। পরনের ময়লা কাপড়টা ঘায়ের ওপর বুলিয়ে রস আর রক্ত চুপসে নেবার চেষ্টা করছে তাহির।

এদিকে পঞ্চা মনে মনে চটছিল তাহিরের ওপর।

বিফল মনে এবার চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করলে সে। খানিকক্ষণ পড়ে রইল চুপ করে। খসখস শব্দ হল কিসের। চোখ চেয়ে তাকালে পঞ্চা। দেখলে একটা মেয়েলী চেহারা এগিয়ে আসছে তাহিরের দিকে। কিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল পঞ্চা। সে যে জেগে আছে তা কি টের পায়নি মেয়েটা?

—কি গো, জ্বালানপোড়ান লাগতিছে?

—হুঁ।

—শোও দিনি মানিক, আমি হাত বুলিয়ে দিছি।

তাহির চটে উঠল এবার। নিজের জ্বালায় মরছে বেচারা, সে সময় সোহাগ ভাল লাগে না।

বললে, যা যা ভাগ। মানকামি করতি হবে নি তোরে।

সন্‌কা কিন্তু শুনলে না সে কথা। আস্তে আস্তে তাহিরের মাথাটা টেনে নিলে নিজের কোলের ওপর। তারপর তাহিরের ঘায়ের চারপাশে হাত বোলাতে বোলাতে বললে, ঘুমাও মিঞা, ঘুমাও, রাত কেটে এল।

পঞ্চা এই ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে সরে এল। কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে একটা থুড়থুড়ে বুড়ী। গাল বেয়ে লালা পড়ছে তার। ল্যাললেলে হয়ে উঠেছে মাথার পুঁটুলির একপাশ। তাকে ডিঙিয়ে পঞ্চা সটান চলে এল মাংনার কাছে।

পেটের ভেতর হাঁটু সেঁধিয়ে শুয়ে আছে সে। পরনের কাপড়টা খাটো স্বল্পতার জন্যে শরীরের অনেকখানি অনাবৃত, তাই শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে মাংনা। ঘুমের মাঝে কাঁপছে।

বুকের ওপর বরফের মত একটা ঠাণ্ডা হাতের হঠাৎ-স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল তার। চমকে চোখ চেয়ে চাপা গলায় বলে উঠল, কে?

—আমি পঞ্চা। ফিসফিস করে উত্তর দিলে সে।

—কি?

এ কথার জবাব নেই। মাংনার বুকের ওপর থেকে হাতখানা তুলে নিয়ে চুপ করে বসে রইল।

মাংনার ঘুমটা ইতিমধ্যে ভালভাবেই ছেড়ে গেছে। পঞ্চার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মিষ্টি করে বললে সে, কি, বলছিস কি?

ভ্যাবাচাকা খেয়ে মাথা নেড়ে পঞ্চা শুধু বললে, না।

চুপচাপ বসে রইল সে বহুক্ষণ। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করলে, তোর নাম মাংনা কেন হল রে?

ক্ষেপে গেল মাংনা। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে আর বলবার মত কথা পেল না মিন্‌সে!

বললে, তোর নাম পঞ্চা কেন?

—বাপ দিয়েছিল তাই। মুখ কাচুমাচু করে বললে পঞ্চা।

মাংনা বললে, আমারও তাই।

নিরুপায় হয়ে পঞ্চা উঠে দাঁড়াল।

নিজের মনেই ঠোঁট টিপে হাসলে মাংনা। তারপর হঠাৎ উঠে বসে পঞ্চার হাত ধরে একটা ঝাঁকানি দিয়ে পাশে বসিয়ে দিলে তাকে।

বললে, মাগনায় পেয়েছিল কিনা আমায়, তাই মা নাম রেখেছিল মাংনা।

পঞ্চার সাহস বাড়ল। বললে, ইখানটা বেশ গরম তো।

কি, রুচিতে বাধছে তোমার? এখানকার এই ছোট্ট পৃথিবীটা ঘৃণ্য মনে হচ্ছে? মনটাকে একটু সজীব করে তোল, দেখবে এদের এই ছোট দুনিয়াটা তোমার পৃথিবীর চেয়ে কম লোভনীয় নয় এদের কাছে, আরাম আর আনন্দ এরাও পায় শীতের রাতের উষ্ণতায়। এদের আকাশেও ওঠে চাঁদ, যে চাঁদ ঢেলে দেয় ইন্দ্রনীলার জ্যোতি তোমার শিয়রে। অজস্র-তারকা আকাশের দিকে তাকিয়ে এরাও রোমাঞ্চ অনুভব করে। কিন্তু তোমার মত আলস্যের গ্রন্থিতে হাত বেঁধে পড়ে থাকতে পায় না। পুবদিগন্তে রূপালী রশ্মির আলো চমক দেবার আগেই উঠে পড়ে ওরা।

মোটর বাসের হর্ন বাজছে।

ধড়মড় করে উঠে পড়ে সকলে। হাতের চেটোয় চোখ কচলায়। অন্ধকার ঘোচেনি তখনও। ওরা চিৎকার আর হল্লা করতে করতে বেরিয়ে আসে। ড্রাইভার দুজন মোটা কম্বলের কোটে গা ঢেকে বসে আছে নিজের নিজের গাড়িতে। কমফর্টার জড়িয়ে কান আর মাথা ঢেকেছে। কোটের লম্বা হাত থেকে দুটো আঙুল বের করে বিড়ি টানছে। এদিকে তেওয়ারী আর বাঙালীবাবু জহরও এসে হাজির।

একে একে খাতা দেখে নাম মিলিয়ে দেড়শো কঙ্কালসার ছায়াশরীরকে তুলে দিল তারা মোটরে। গা ঝাড়া দিয়ে নড়েচড়ে যাত্রা শুরু করলে দুখানি বাস। লম্বা পিচঢালা পথ ধরে শহরের দিকে এগিয়ে চলল তারা।

ভোরের রাতের দূর-শহরে গ্যাসদীপের কৃত্রিম জোছনা। আর অজস্র-আলো বিজলী বাতির ফাঁকে ফাঁকে দু-এক টুকরো সাঙ্কেতিক নীলিমা, সড়কের মোড়ের মাথায় রেড লাইটের সাবধানী।

পথের কোণে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্টসংখ্যক লোক নেমে যায়। এই বিরাট শহরের অতিচঞ্চল জনারণ্যের মাঝে মাঝে। পথে পার্কে, দোকানের সামনে আর সিনেমার দরজায়, কলেজের গেটে আর মন্দিরে দরগায় মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর দেড়শো জীবন্ত মুদ্রাচুম্বক নেমে যায়।

ষোল বছর বয়স হল পিলুয়ার। অথচ চেহারা দেখে মনে হয়, এমন দশটা শীতও যায়নি ওর ওপর দিয়ে। মাথায় একটা ভেলভেটের লাল টুপি, নর্দমার ময়লা লেগে একটা দিক কালো হয়ে গেছে। ওপরের ঠোঁট কাটা, জিভ দিয়ে চাটে বারবার। এ-হেন পিলুয়া নামে সকলের আগে। সঙ্গে থাকে তার চার চাকায় বসানো কাঠের একটা ট্রলি, তার ওপর বসে আছে কিংবা শুয়ে আছে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে একটি সজীব মাংসপিণ্ড। মাথাটা সুবৃহৎ, কাঁধটা চওড়া, বুকটা যে-কোন ব্যায়ামবীরের সমান। কিন্তু ব্যস্‌, ওই অবধি। কোমরের নিচে থেকে পা পর্যন্ত সরু আর লিকলিকে। পাঁচ মাসের শিশুর চেয়েও সরু পা তার। পক্ষাঘাত বা অন্য কোন কারণে নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ অবশ। তাই জীবটিকে কাঠের ট্রলিতে বসিয়ে গলি গলি টেনে নিয়ে বেড়ায় পিলুয়া। একটা বিশ্রী আর্তনাদ করতে করতে পিলুয়া ভিক্ষে করে।

শহরের কলিজার মধ্যে সবচেয়ে সচ্ছল অংশটিতে মাংনা দাঁড়ায় তার দেহের লোভানি মেলে। রুখন ভিখুরাম তাহির পঞ্চা সকলেরই এক-একটা বাঁধা জায়গা আছে, সন্‌কা রাউতী সাবিয়া—তাদেরও আছে বাঁধা জায়গা। সবাই ভিক্ষে করে, কেউ কানা চোখ আর ভাঙা পা দেখিয়ে, কেউ বা তাজা চোখ মাজা মুখ দেখিয়ে।

সিধু দপ্তরীর গলিতে একটা সরাইখানা আছে মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর। যখন মাঝআকাশে উঠবে দিনের সূর্য, খানিকটা বা ঢলে পড়বে পশ্চিমের দিগন্তে, তখন খাবার সময় হবে ওদের। একে একে এসে সরাইখানায় জড়ো হবে, গলার নম্বরি চাকতি দেখিয়ে খেতে পাবে ডাল আর ভাত।

সরাইখানায় বিনিপয়সায় খানা খেয়ে আবার যে যার জায়গায় ফিরে যায়। ভিক্ষে করে সেই রাত দশটা অবধি। তারপর আসে মোটর বাস, নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজায়। ওরা আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকে। বার তিনেক হর্ন বাজিয়ে যার পাত্তা মেলে না, সে পড়ে থাকে পিছনে। মোটর বাস আর সেদিন অপেক্ষা করে না তার জন্যে।

পিলুয়া তাই পিছনে পড়ে রইল সেদিন। বাস ধরতে পারল না। ফুটপাথের পাশে একটা ময়রার দোকানের বড় উনুনটা বেশ নিবে গেছে তখন। হাতড়ে হাতড়ে ভেতরের হাইগুলো দেখলে পিলুয়া। না, হাত-পা পুড়ে যাবার ভয় নেই। বড় উনুনটার মুখে ছাইয়ের গাদায় বেশ আরাম করে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে শশায়া যাবে। ব্যাঙাচি আর ব্যাঙাচির কাঠের ট্রলি টেনে তুলল রোয়াকের ওপর। তারপর শুয়ে শুয়ে পরদিন তেওয়ারীর কাছে প্রাপ্য চড়চাপড়ের আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করলে। কি কুক্ষণেই বায়োস্কোপের নেশা ধরেছিল তার! কাছের বায়োস্কোপটার। একটা পার্কের কোণে মাটি খুঁড়ে চুরির পয়সা জমা করে রাখছিল এতদিন। আজ কয়েক আনা জমেছে দেখে ছবিটা দেখতে গিয়েছিল পিলুয়া। তাই মোটর ধরতে পারেনি।

পর্দার গল্পটা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। ওর চেয়ে বছরখানেকের বড় ছেলেটা কি কেরামতিই না দেখালে। একটা পুল উড়িয়ে দিলে বোমা দিয়ে, ট্রেন লুঠ করলে, ঝাপ দিল তিনতলা থেকে, বুড়োটাকে খুন করে তার মেয়েকে নিয়ে পালাল। সাবাস্‌, সাবাস্‌,। সকলের সঙ্গে পিলুয়াও হাততালি দিয়েছে ঘন ঘন।

ওদের মধ্যে বায়োস্কোপের নেশা ধরেছে আর একজনের। পঞ্চা। একটা ইংরেজী সিনেমার সামনে রঙিন ছবি একটি মেয়ের—নেশা ধরিয়ে দিয়েছে পঞ্চার। যেমন করে হোক পয়সা বাঁচিয়ে দেখবেই সে। পোস্টারের ছবিটা দেখেছে সে। পরীর দেশের ছবি, পরীদের চেয়েও সুন্দরী এক মেমসাহেব, শুধু বুকে কোমরে এক টুকরো মলমল। ও-ছবিটা দেখবে পঞ্চা দিন কয়েকের মধ্যেই। টিকিটঘরটা কোথায়, জেনে নিতে হবে। পিলুয়াটা জানে ওসব। পঞ্চা খুঁজছিল তাই পিলুয়াকে, কিন্তু নাম ডাকের সময় দেখলে পিলুয়া ফেরেনি।

—কি রে, খুঁজছিস কোন্‌ পেয়ারের মাগীকে? কথার শেষে হেসে উঠল মাংনা।

চমকে ফিরে তাকিয়ে পঞ্চা বললে, তুমাকে লয় গো, তুমাকে লয়।

হাজরি খতম হয়ে গেছে তখন। রাউতীকে ইশারায় দূরে ডেকে নিয়ে গেল বাঙালীবাবু জহর। আড়চোখে দেখে হাসল মাংনা। আসুক আজ মুখপুড়ী, দেখবে সে একচোট। এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল তার কাছে?

খাবার সময় পাশে এসে রাউতী বসল। মাংনা একটা ঠেলা দিলে তার গায়ে।

—কি বললে রে তোর লাগর?

—কে?

—কেন, ওই হাজ্‌রেবাবু, জানি না নাকি কিছু?

প্রতিবাদ করে উঠল রাউতী, না, মাইরি না। ও অন্য কথা কইছিল।

—কি কথা?

ফিসফিস করে একে একে সব খুলে বললে রাউতী। ও যে আসন্নপ্রসবা তা মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর কানেও নাকি রটে গেছে। বাঙালীবাবু জহর জানিয়েছে তাকে, সে যদি এখন থেকে রোজ এক টাকা করে জমা দিতে পারে, তা হলে বাকী যা লাগবে মূলচাঁদই দেবে—দিয়ে তার ছেলেকে মানুষ করবে তারা। লেখাপড়া শেখাবে। ভদ্রলোকের জায়গায় ভালভাবে থাকতে খেতে দেবে, অনেক বড় চাকরি করে দেবে তার ছেলের। বড় হবে তার ছেলে, ভদ্রলোক হবে।

রাউতীর কথা শুনতে শুনতে মাংনার চোখেও স্বপ্ন নামল। সেও যদি এমনি একটা ছেলে পেত, তাকেও হয়তো লেখাপড়া শেখাত। সেও বড় হত, মানুষ হত। আহা, ঠিক ওই হাজরিবাবুর মত যদি দেখতে হয় তার ছেলেকে। পঞ্চা? না, অমন কাঙালীর মত চেহারা না হওয়াই ভাল।

মাংনা বললে, পারবি তুই রোজ এক টাকা করে দিতে?

—খু-উ-ব। টেনে টেনে মিটমিটে হাসি হেসে বললে রাউতী।

সত্যি করেই পরের দিন থেকে এক টাকা করে জমা দিতে শুরু করলে রাউতী। মাঝ থেকে চুরিটা বন্ধ হল এই যা। তা হোক, কি-ই বা দরকার? পয়সা জমিয়ে করবেই বা কি সে! একদিন তো খেতে না পেয়ে এখানে এসেছিল, যা দু-চার পয়সা পেয়েছে, তাই জমা দিয়েছে। তার জন্যে এক হাতা কম খিচুড়ি তো খেতে হয়নি কোনদিন। অসময়ে মূলচাঁদ মারোয়াড়ী সরে দাঁড়াবে না। ঠিক খেতে দেবে। মিঠাইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াতে হবে না। শীতের কাঁপুনি আর বর্ষার জল সহ্য করে ফুটপাথে পড়ে থাকতে হবে না। আর, আর ছেলে বড় হবে। মানুষ হবে।

মোমবাতিটা আবার জ্বেলেছ? ভাবছ, কাহিনী আমার শেষ হয়ে গেছে? না, এর পর আছে ওদের জীবন-নাট্যের শেষ অঙ্ক। শেষ দৃশ্যটা দেখতে চাও তো চল, এগিয়ে চল। দুটো বছরকে রাখো পিছনে ফেলে। ওদের ঘুম ভেঙে যাবে, আস্তে পা টিপে-টিপে এস, দেখবে এস। রাউতীর ঘুম ভাঙিও না। একবার জেগে উঠলে আর ঘুম নামবে না ওর চোখে। ভাববে, তার ছেলের কথা। কোন্ সুদূরে নাকি মানুষ হচ্ছে তার ছেলে। বহুবার বাঙালীবাবু জহরের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে সে। তার ছেলেকে শুধু একটিবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছে। প্রায় ছ মাস হল তার দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে গেছে তারা। মানুষ করবে তাকে, জহর বলেছে। রাউতী বিশ্বাস করেছে সে কথা। তা বলে তুমি যেন বিশ্বাস কোর না। চল, দেখবে চল। ওই যে তেওয়ারীর কুঠরি থেকে খানিক দূরে আর একখানা ঘর, ওখানে কেউ যেতে পায় না। এই ছোট দুনিয়ার নিষিদ্ধ দেশ ওটা। দেখতে পাচ্ছ, কপাটে ঝুলছে একটা তালা? ও-তালার চাবি আছে এক তেওয়ারীর কাছে। ওখানে ঢুকতে পায় শুধু মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর অর্থপুষ্ট কয়েকজন উড়ে চাকর। কি আছে জান ওর ভেতর? খোলা জানালায় উঁকি মার, মোমবাতিটা তুলে ধর গরাদের পাশে। কি, ভয়ে পিছিয়ে আসছ কেন? ওরা মানুষ হচ্ছে। হাঁড়ির আকারের বড় বড় জালার ভেতরে বসে রয়েছে ওরা। হাঁড়ির কানাটা চেপে রয়েছে প্রত্যেকের কোমরে। কোমরের ওপর থেকে সমস্ত শরীরটা বেড়ে উঠেছে ওদের নিয়মিত পানাহারে। শুধু কোমরের নিচের অংশটায় নেই পরিবর্ধন। বার বছর পরেও ওদের পা দুখানা থাকবে বার মাসের শিশুর। লিকলিকে। অবশ নিম্নাঙ্গের জন্যে ওরা বসতে পারবে না, শুতে পারবে না, দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু পথিকের করুণা উদ্রেক করতে পারবে।

ভবিষ্যতের অনেক অনেক পিলুয়ার কাঠের ট্রলিতে ব্যাঙাচির অভাব হবে না।

আর, মূলচাঁদ মারোয়াড়ীর চামড়ার থলিটা জলভরা ভিস্তির মত কেঁপে ফুলে উঠবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *