চন্দ্রপিশাচ রহস্য
(পর্ব-১)
****
হিজলপোঁতা পরগণা কোনখানে বলাে দেখি?
পারবে না জানতুম।
ঐ যেই মুলুকে বিদ্যেধরী নদীর শেষ চড়াটা শেষ হয়েছে, ঠিক সেইভেনে। এ পরগণার ভূস্বামী হল সোঁদরবন তল্লাটের সেকালের কুখ্যাত ডাকাইত গােপালঠাকুরের পৌত্র শ্রী কমলেশ ঠাকুর। স্বভাবে সে পিতামহের ধারে কাছেও যায়নি এ কথা প্রজারাও স্বীকার করে শতমুখে। গােপালঠাকুর যতখানিই দুর্দমনীয় প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, কমলেশ ততখানিই বিনম্র, সুশিক্ষিত এবং প্রজাদরদী। মােটামুটি আড়াইশাে সাধারণ রায়ত, গােটা ষাটেক লাঠিয়াল পরিবার (এঁনারা করমুক্ত), আর টুকিটাকি কয়েক ঘর জেলে, হাঁড়ি, কামার, কুমাের মিলিয়ে কমলেশের নিঝঞ্জাট সংসার। হিজলপোঁতার সাথে বাইরের ভূখণ্ডের যােগাযােগ রক্ষা করতে দুইটি খেয়াঘাট। কুলতলি আর সাতমাথা ঘাট। এই সাতমাথা ঘাটের অদূরে রয়েচে সঙ্কীর্ণ পথের রেলগাড়ির রাস্তা। তাতে সাগরের লবন, চুন বানাবার শামুকখােলা, পাট, নীল প্রভৃতি বােঝাই হয়ে সদরে পৌঁছুতাে। সাধারণ যাত্রীদের চড়ার ব্যবস্থাও ছিল বটে, কিন্তু রবিবার ইংরাজ সাহেবদের ছুটির দিনটি ইস্টিশান থাকতাে শুনশান। সেই দিন ব্যতীত রােজই এই রেলের গাড়ি দিনে দুইবার যাওয়া-আসা করতাে।
হিজলপোঁতায় থাকতাে একটি ওঝার পরিবার। সূদন আর তার স্ত্রী ক্ষণা। এঁর পিতা মধুসূদন নামকরা ওঝা ছিল এবং সেই কারণেই গােপালঠাকুর তাঁকে দুই বিঘে ভূমি দান করে বসত করতে দিয়েছিলেন। একটু আগেই গাঁয়ে ঢােকার সময়ে যে দুপাশে ধান, গম, জনাই ঘেরা বিশাল চাষের এলাকা পেরিয়ে এলে, তার প্রান্তেই সূদনের বাড়ি।
সূদন কিন্তু ঝাড়ফুঁক একেবারেই করে না। নিজের উদাসীন খেয়াল আর সামান্য চাষবাসেই মেতে থাকে স্বামী স্ত্রী। গাঁয়ের লােকে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– “সূদনটা বড়াে সিধে। তার বাপের গুণ কিছুই পেলে না। এতবড় গুণীর ছেলে হয়েও কোনও বিদ্যেই শিখলাে না সে।” কখনও বড়াে বুড়ােরা তার সামনেই প্রশ্ন করতাে, কিন্তু সূদন এসব শুনেও গা করতাে না। বলতাে, “কি করবাে তােমরাই বললা। আমার এসব তন্ত্রেমন্ত্রে যে একেবারেই বিশ্বাস নাই। সব বুজরুকি বৈ তাে নয়। আমার এসব মানতে ইচ্ছে হয় না।” এই বলে রাগে দুমদাম করে সে স্থান ছেড়ে চলে যেতাে। লােকজন এই সরলসিধা, বােকা বােকা ছেলেটির রাগের বহর দেখে হেসে কুটিপাটি হতাে।
এমনি ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলাে হিজলপোঁতার। তা সেবার শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে মনসাপূজার দিন কি একটা ভালাে যােগ পড়েছিলাে। দলে দলে সাধু সন্ন্যাসীরা চলেচেন গঙ্গা আর সাগরের সঙ্গমে। সংক্রান্তির দুইদিন পূর্বে ঘাের অমাবস্যার রাত্তিরে বিদ্যেধরীর ঘাটে একখানি নৌকা এসে ঠেকলাে। তাতে বােঝাই সাধুদের দল। রাত্তির হয় দেখে পাটনী তার নৌকা থামিয়ে রান্নাবান্নার আয়ােজন করতে বসল। বেশিরভাগ সাধু চড়াতেই আশ্রয় নিলাে আর কয়েকজন গ্রামে চললাে কোনও গৃহস্থালির ভিতর আশ্রয় নিতে।
**********
ক্ষণা সন্ধ্যার পরে উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে কিছু রাঁধচিলাে। সূদন ভিতরের ঘরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে কিছু একটা করছে, এমন সময়ে দোরের বাইরে মানুষের পদশব্দ কানে এল। সূদন একটু অবাক হল। এমনিই তাদের ঘরখানি গাঁয়ের একদম একটেরে এলাকায়। লােকজন কেউই তাদের ঘরে আসে না বড়াে একটা। ইতস্ততঃ করে দুয়ােরের আগল খুলতে দেখলাে একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ সাধু দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছােটোখাটো চেহারা, মাথার শ্বেতবর্ণ কেশরাশি কাঁধ ছাড়িয়ে নেমেচে, গালে শুভ্র শ্মশ্রুগুফের পারিপাট্য। ক্ষণা তাড়াতাড়ি ঘােমটা টেনে দিলাে। সাধু হেসে কইলাে,
-“বাছা , আমি একজন সাধু। চলেচি সঙ্গমে। আজ রাত্তিরটুকু আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছি। তােমরা…”
কথা শেষ না হতেই সূদন ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালাে। সাধুবাবার পায়ের নিকট মাটির পাতিল, সরা, খন্তা, কাঠকুটো, আলােচাল আর দুটি আলু রেখে প্রণাম করল দুজনে। সাধু সন্তুষ্ট চিত্তে আশীৰ্ব্বাদ করল।
সাধুর নাম বাসবানন্দ। সে খন্তা দ্বারা নিজের রান্নার উনুন খুঁড়তে খুঁড়তে গল্প করচিলাে গৃহস্থের সঙ্গে। টুকিটাকি কথা হতে হতে ক্ষণা বাসবানন্দের গেরুয়া ঝােলাখানি কুলুঙ্গির উপরে তুলে রাখার অভিপ্রায়ে তুলে ধরতেই টের পেলাে যে ঝােলাটি বিলক্ষণ গুরুভার। ক্ষণার হাত ফসকে সেটি শান বাঁধানাে মেঝেতে পড়ে গেল এবং তারা সবিস্ময়ে খেয়াল করলে যে ঝােলার ভিতর থেকে ধাতুনির্মিত চওড়া এবং ভারী একখানি চৌকোণা খন্ড উঁকি মারচে।
সাধু তড়িঘড়ি এসে সেখানা তুলে নিয়ে সন্তানস্নেহে হাত বােলাতে থাকলাে। সূদন আর তার স্ত্রী বিস্মিত চক্ষে যখন বাসবানন্দের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে, তখন সাধু গম্ভীর কন্ঠে চাপা স্বরে বলে উঠলাে,
-“তােরা ভারী অবাক হয়েছিস বাছা, তাই না? ভাবচিস সাধুর ঝােলায় হয় রইবে লােটা, আর নাহয় তাে কপনি। এখানা আবার কি বস্তু! তাইতাে? আসলে এই জিনিসটার জন্যেই রাতে বাইরে থাকতে সাহস করিনি আমি।”
কৌতূহল সূদন বা ক্ষণার বিলক্ষণ হচ্ছিলাে বটে, কিন্তু তারা কুণ্ঠায় সেটা স্বীকার করলে না। বাসবানন্দ কয়ে চললাে,
-“এই দিব্য বস্তুখানি যে কত সহস্র সহস্র যুগ ধরে আমাদের গুরুকূলে হাতবদল হয়ে আসছে, তা কেউ খোঁজ রাখে না। প্রত্যেক গুরুদেব তাঁর বয়সকালে নিজের সবচাইতে নির্লোভ আর পণ্ডিত শিষ্যকে এই তাম্রলিপিটির উত্তরাধিকার দিয়ে যান। এতে একখানি শ্লোক লেখা ছিল বলে শুনেছি, কিন্তু সেটি বহু পূর্বেই ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। আমার উর্ধ্বতন চতুর্থ গুরুদেব শ্রীশ্রী নীলরুদ্র স্বামী সেই ক্ষয়ে আসা শ্লোকের মানে উদ্ধার করে প্রাচীন বাঙ্গালায় খােদাই করে রাখেন। এই সেই শ্লোক। কালাে হয়ে আসা তাম্রনির্মিত পট্টের উপরে ক্ষয়টে অক্ষরে লেখা রয়েছে একটি চতুষ্টয়ঃ ছড়া…
দৌষ্মন্তেয়র মহা-রাজ্য,
হৃদয়-জোড়া অঙ্গ,
রাজাও আছেন সেইখেনে এক,
এ এক ভারী রঙ্গ।
রাজা সেথায় অঙ্গনামা,
পড়চে মনে তাঁকে?
গয়নাগাঁটি লুকিয়ে দিতেই,
পড়ল রাজা পাঁকে।
রাজার নামের ভূষণ থাকে,
অঙ্গও পায় ত্রাণ,
শিবসায়রের অতল তলে,
করিবে সন্ধান।
অনন্যপর গুণে বাঁধা,
রক্ত-ঋণে ঋণী,
তিন রক্তে করালে স্নান,
তােমার হবেন তিনি।”
সূদন নিষ্পলক হয়ে শুনে চলেচে। সাধুবাবা গভীর ক্ষোভের স্বরে বলতে থাকে,
-“কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য, আমি একজন নির্লোভ, খাঁটি শিষ্য পাইনি আজও। আর পাবােও না। এই শ্লোকের মানে আমি উদ্ধার করতে অক্ষম, আবার এ জিনিস বেহাতে দেওয়ার নিয়ম নাই। তাই সঙ্গমে গিয়ে ভগবানের জিনিস তাঁকেই ফিরিয়ে দিয়ে আসবাে সাগরের জলে। তাই তােদের আজ এর কথা জানালাম, নচেৎ কক্ষনাে কইতুম না।”
রাতে খাওয়ার পালা সাঙ্গ করে, ঝােলাটি মাথার কাছে রেখে, বাসবানন্দ শয়ন করল।
**********
রাত দ্বিতীয় প্রহরে পড়বার মুখেই বাসবানন্দের নিদ্রা ভেঙে গেল। বাইরের বিস্তৃর্ণ ধূধূ ক্ষেতখামার, জঙ্গলের থেকে শৃগালের দল প্রহরের ডাক ডাকছে। কি বিশ্রী জোরালাে আওয়াজ।
সামান্য পরেই ভূলটা বােঝা গেল। নাহ, বেশি দূরে নয়, মনে হচ্চে বাড়ির ঠিক বাইরেটাতেই তারা ডাকছে।
কিম্বা…
কিম্বা হয়তাে আদৌ বাইরে নয়…!
সাধুর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলাে। সে চকিতে খেয়াল করল তার মাথার কাছে ঝােলাটা অদৃশ্য। পা টিপে টিপে শােবার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাে সে। উনুনে তখনও হাঁড়ি চাপাননা। সেই হাঁড়িতে উঁকি মারতেই বাসবানন্দের হাত পা হিম হয়ে এল। এ কোথায় আশ্রয় নিয়েছে সে! হাঁড়িতে রয়েছে সিদ্ধ করা মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ঘরের চারদিকে এবার চোখ ফিরাতেই দেখা গেল গােটা গৃহে তন্ত্রমন্ত্র, তুকতাক আর ভয়ঙ্কর কালােবিদ্যার সামগ্রী ছড়িয়ে রয়েছে। এই দিকটায় সে সন্ধ্যায় আসেনি, তাই চোখেও পড়েনি। ভিতরের একটি ঘর থেকে মিটমিটে পিদিমের আলাে এসে বাইরের ঘরে লম্বা হয়ে পড়েছে। তার আলাে কাঁপচে বাতাসে। সাধু নিঃশ্বাস স্তব্ধ করে সেই দরজার ফাঁকে চোখ রেখে থরথর করে কেঁপে উঠলাে।
ভিতরে রয়েছে আট দশটি ভীষণ আকৃতির শৃগালের দল। ক্ষণা আর সূদন। পরিতৃপ্তির সঙ্গে হাতায় করে সেই মানুষের দেহাংশ একেকটি জন্তুর সামনে দিচ্চে, আর তারা সন্তুষ্টির সঙ্গে সেগুলি ছিড়ে খাচ্চে এবং মধ্যে মধ্যে মুখ তুলে ভয়ানক ভাবে ডাকচে। সামনে রাখা সেই তাম্রফলকটি। আরাে ভয়ানক আশ্চর্যের বিষয় এই যে, একেকটি শৃগাল একেক টুকরা মহামাংস মুখে নিচ্চে আর অবিকল মনুষ্যকণ্ঠে সুর করে একেকটি শ্লোকের মানে বলে দিচ্ছে। সাধু চিত্রার্পিতের ন্যায় কিছুক্ষণ শােনার পর বুঝতে পারলাে কী ভয়ংকর এক শক্তির সন্ধান সে এতদিন বয়ে বেড়িয়েছে নিজের অজান্তেই।
এই আপাতঃ সরলদর্শন দম্পতি অতি ভয়ানক মানুষ। অন্য সময় হলে। হয়তাে বা বাসবানন্দ পলায়ন করে জীবন রক্ষা করতাে, কিন্তু এই বিপজ্জনক শক্তির সন্ধান তাে এই শয়তানের হাতে ফেলে রেখে পালানাের উপায় নাই। বড়াে প্রমাদ ঘটবে তাহলে।
সাধুবাবা ইতস্ততঃ করে এক ধাক্কায় দোর খুলে ফেললাে। তাকে দেখামাত্র শৃগালের দল পড়িমরি দৌড়ে পালালাে। সূদন আর তার স্ত্রী কিন্তু বিচলিত হল না। বাসবানন্দ যখন কম্পিত হাতে ফলকটি তুলে নিয়ে বেরুবার জন্য পিছন ঘুরেচে, তখনই সূদন ফিসফিস করে কি যেন একটা মন্তর পড়ে উঠলাে, আর তৎক্ষণাৎ দুবার দুটো ভারী পদশব্দ পাওয়া গেল। বাসবানন্দ পিছন ঘুরে তাকাতেই তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া যেন স্তব্ধ হয়ে এল!
সূদনের আর ক্ষণার ঠিক পিছনে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েচে দুখানা ভয়ংকর আকৃতির প্রেতমূর্তি। তাদের চোখ আগুনের ভাঁটার মতাে জ্বলচে। সেদিকে তাকিয়েই সূদন ব্যাঙ্গ মেশানাে বক্র স্বরে কইলাে,
– “আমার বাঁ দিকে কে এসেছিস?”
বাম দিক হতে উত্তর এল,
-“আজ্ঞা, আমি ছিদাম বারুই। ঠাই দখিনের বটগাছে।”
-“বেশ। আর আমার ডান দিকে?”
-“মালেক, আমি অছিরুদ্দি। থাকি পূবের জঙ্গলে।”
-“বেশ বেশ। এইবার তােরা এই হতভাগা সাধুটাকে ছিড়ে ফেল। আর তামার খন্ডটা আমার হাতে এইখেনে এনে দে।”
বাসবানন্দ ইষ্টস্মরণ করে দৌড় লাগালাে, কিন্তু পলকের মধ্যে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সূদনের আজ্ঞাবহ দুই প্রচণ্ড প্রেত। ক্ষুরধার নখের আঘাতে সাধুর মুন্ডটি মাটিতে ভূপাতিত হল। তাম্রফলকটি সূদনের হাতে নিবেদন করে পিশাচদ্বয় অদৃশ্য হল।
সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। বাসবানন্দের ধপধপে শ্বেতবর্ণ চুল আর দাড়িগোঁপ এখন তাজা রক্তে মাখামাখি হয়ে হাঁ করে বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কড়িকাঠের পানে। আর দেহটা তিন চারিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ক্ষণা খিলখিল করে হেসে টুকরােগুলি কুড়িয়ে নিয়ে মস্ত হাঁড়িটাতে ঢােকালাে।
এই দম্পতি মােটেই সহজ মানুষ ছিল না। সূদনের রক্তে দৌড়াচ্ছে তার গুণীন বাপ মধুসূদনের মহাবিদ্যে। উপরন্তু অল্প সময়ে প্রচুর শক্তি অর্জনের জন্য তারা বেছে নিয়েছিলাে কালাে এবং অপশক্তির সাধনার পথ। সৎপথে শক্তি আদায় করতে বিস্তর সময়ের প্রয়ােজন, কিন্তু আঁধারের পথে তা পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত সহজেই। সম্মােহন, দ্বারণ, বশীকরণ, মহাডামর, ভূতডামর প্রভৃতি হয়েছিলাে তাদের করায়ত্ত। এই সময়ে তাদের হাতে এসে পড়ল এই অফুরন্ত মহাশক্তির ভান্ডারের সন্ধান। শৃগালরূপী যক্ষিণীদের মুখে শ্লোকের মানে শােনার পর তারা বুঝেছে যে এই বস্তু একবার হাতে এলে দেশজয় করতে পারে তারা। হয়ে উঠবে অবধ্য।
সকালে বাক্সপেটরা গুছিয়ে নিয়ে শয়তান যুগল বেরিয়ে পড়ল সূদুর তিব্বত প্রদেশের পানে সেই অমােঘ কাঙ্ক্ষিত বস্তুর খোঁজে। গাঁয়ের লােকজন শুধােললা, “এ কী সূদন! এই বীজতলা চাড়ানাের সময়ে দেড় বিঘে ফলন্ত জমি ফেলে রেখে চললে কোথা?”
সূদন মাথা নীচু করে জবাব দিলাে, “মনটা ভালাে নেই খুড়াে। বিষয় আশয় আর পােয় না আমার। সংসারে কেবল সঙ সাজাই সার। চললুম একটু তীর্থ করতে। ফিরতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হতে পারে।”
তাদের চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে উদাস ভাবে গাঁয়ের লােকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, “সূদনটা অমন বাপের কোনও গুণই পেলে না। ছেলেটা বড্ড সরল সিধা।”
**********
(পর্ব-২)
****
সূদন আর ক্ষণা ফিরে এল প্রায় হপ্তা ছয়েক পর। তার পাকা ফসল পাঁচ ভূতে লুটপাট করে খায়নি। কয়েকজন যে চেষ্টা করেনি তাও নয়, তবে এই দেড় মাস তার বসতবাড়ীর চতুর্দিকে অস্বাভাবিক রকম শেয়ালের হুয়া হুয়া শব্দ শােনা গিয়েছে। তাই এই গা ছমছমে পরিবেশে সাহস জুটিয়ে কেউ আর চৌহদ্দির ভিতরে প্রবেশ করেনি। একদিন মধ্যেরাত্তিরে সূদন তল্পিতল্পা নিয়ে ঘরে ঢুকে দোর দিয়েছে। কেউ তাদের বড় একটা খোঁজ নেয়নি। তাদের প্রান্তিক ঘরখানিতে এমনিতেই মনুষ্য সমাগম কোনও কালেই ছিল না। কিন্তু গােলমাল শুরু হল অন্য দিক দিয়ে।
এই ঘটনার পরের দিন গাঁয়ের শাঁখারি হরিচরণকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে তিন চারিটি গাঁয়ে শাঁখা, নােয়া, সিন্দুর বেচতাে। নিবাস নর-নারায়ণপুরে। তার গাঁ থেকে তার পরিবার হিজলপোঁতায় এসে বিস্তর সন্ধান করল। তার স্ত্রী কইলাে, “জনার্দনের বাপ গতকাল বেরুবার সময়ে বললে যে হিজলগাঁয়ে আসবে। রাতে বাড়ি না ফেরায় আজ আমরা খোঁজে এসেছি।”
জমিদার কমলেশ লোক লাগিয়ে দিলাে, আর সাঁঝবেলায় সেই লােকজন এসে খবর করলে যে হরিচরণের টিকিটিও দেখেনি কেউ, উপরন্তু গাঁয়ের নদীপাড়ের সন্ন্যাসীকে আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কমলেশ ধন্ধে পড়ল। পরপর দুইজন নিখোঁজ! যদিও দুইজনের একজনও তার প্রজা নয়, কিন্তু তবুও তারা হারিয়েছে তাে তার তালুক থেকেই। পরের দিনেও খোঁজ মিললাে না। বরং সেদিন রাত্তিরে ঘটলাে একটা মারাত্মক ঘটনা, যা শান্ত হিজলপোতাকে তার ভিত সমেত নাড়িয়ে তুললাে।
সেইদিন ছিল পূর্ণিমা। দুইজন বালক তাদের গােরু বাছুর চরাতে গিয়েছিলাে উত্তরদিকের নাবাল জলা-জমিতে। মজে আসা ঘােড়ামারী নদীর খাত এখন এই আশ্বিনের শুরুতেও প্রচুর জলা ঘাসে ভর্তি। গােচারণের উপযােগী স্থান বটে। এই দুই বালক কিন্তু আদতে রাখাল পরিবারের নয়। একজন লাঠিয়াল শিবরামের ছেলে আর অপরজন সর্দার ভীমের নাতি। দুইজনের নামই বিষ্ণু। ছােটো বিষ্ণু আর বড় বিষ্ণু।
তারা দিব্যি আরাম করে ঘােড়ামারীর চরের অশ্বখগাছের নীচে শুয়েছিলাে, আর গােরুরা নিজেরাই চরে চরে ঘাস খাচ্চিলাে। ভুক ভুক শব্দ করে তাদের পাহারা দিচ্চে বড় বিষ্ণুর পােষা কুকুর ভূলাই।
সন্ধ্যার ঠিক মুখে কিসের যেন তীব্র আওয়াজে ছােটোবিষ্ট্রর তন্দ্রা ছুটে গেল। নিদ্রালু ঘােরে প্রথমটায় সে কিছু বুঝতে পারলে না, কিন্তু পরমুহূর্তেই সটান সােজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চমকে উঠলাে। এমনিতেই কখন যে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। পালের গােরুগুলি ভয়ার্ত স্বরে ভয়ানক চিৎকার করছে, আর ভূলাই কুঁই কুঁই শব্দ করে, পেটের তলে লেজ ঢুকিয়ে দক্ষিণ দিকের ক্ষেতের পানে তাকিয়ে বেদম চ্যাঁচাচ্চে। কুকুরটির শরীরের প্রতিটি রােমকূপ যেন শিউরে রয়েছে। সেদিকে মুখ ফেরাতেই আবছা আঁধারে তার চোখে পড়ল বড়াে বিষ্ণু এলােমেলাে পা ফেলে গাঁয়ের দিকে এগােচ্চে। একটু পরেই সে আঁধারে মিশে গেল। তার নাম করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেও যখন লাভ হল না, তখন অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে ছােটোবিষ্টু দুড়দাড় করে গ্রামের দিকে দৌড় লাগালাে।
**********
সন্ধ্যার কিছু পরেই একত্রে পঁচিশ ত্রিশ ঘর প্রজা ভেঙে পড়ল জমিদারের দেউড়ির সুমুখে। হাতে মশাল এবং পাকা লাঠি। কমলেশের পক্ষে এইবার আর এই নিরুদ্দেশ মেনে নেওয়া সম্ভব হল না। লাঠিয়ালের সর্দার ভীমের নাতি উধাও! এ অপমান লেঠেলরা সহজে মেনে নেবে না। এরা কর মুক্ত প্রজা। জমিদারি চালাতে গেলে বিপদে আপদে এরাই ভরসা। কমলেশ তাদের সঙ্গে লােকজন পরিবেষ্টিত হয়ে ক্রন্দনরত ছােটোবিষ্ণুকে সঙ্গে নিয়ে চললাে নাবালের দিকে, যেদিকে প্রথম ঘটনাটা ঘটেছে।
যাবার পথে তারা দেখলাে গােরু বাছুরগুলি পথ চিনে নিজেরাই গাঁয়ে ইতস্ততঃ ফিরে এসেছে। তাদের চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা ভয় মাখা। দলবল নিয়ে ঘােড়ামারীর বাঁওড়ে পৌঁছে চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও সূত্র পাওয়া গেল না। দলটি যখন হতাশ ক্ষোভে ফিরে আসতে যাচ্ছে, তখন তাদের কানে এল অতি ক্ষীণ কুঁই কুঁই শব্দ।
খুঁজে খুঁজে দেখা গেল একটি ঝােপের আড়ালে বসে বসে ভূলাই কেবলই কেঁদে চলেছে।
কমলেশ নীচু হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে মুখ তুলে চাইলাে, আর ভুক ভুক করে দক্ষিণদিকে তাকিয়ে চ্যাঁচাতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করে অতগুলাে মানুষ ঝােপঝাড় ভেঙে চলতে শুরু করল। সামনে সামনে চললাে ভূলাই। অসীম সাহসী কুকুর, যে চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতাে কিছু একটা দেখেও অকুস্থল ছেড়ে পালায়নি। পৃথিবীর যে আদিম গুহামানবটি সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে কুকুরকে নিজের পােষ মানিয়েচিলাে বন্ধু হিসেবে, তার বন্ধু নির্বাচনে কোনও ভুল ছিল না।
গাঁয়ের সীমান্তের কাছাকাছি এসে ভূলাই ডাক থামিয়ে নিঃশব্দে চলতে শুরু করল, আর তার পিছনে প্রায় পঁয়ত্রিশ জন লেঠেল। তারাও এগােচ্চে অতি নিঃসাড়ে। এইভাবে এগােতে এগােতে ভূলাই যে বাড়িটার সামনে গিয়ে থামলাে সেদিকে তাকিয়ে প্রতিটি মানুষ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। এ যে মধুর ব্যাটা সূদনের বাড়ি। সেই দুর্বল সিধেসাধা ছেলেটা এসব কাজে জড়াতে পারে নাকি! ছিঃ! কুকুর নিশ্চয়ই কিছু ভুল করে থাকবে। ভূলাইয়ের বােবা চোখের আকুতিকে অগ্রাহ্য করে যখন গােটা দলটি চলে যেতে উদ্যত হয়েছে, এমন সময়ে তীক্ষ স্বরে সূদনের ঘরের ঠিক ভিতরেই যেন অনেকগুলি শিয়াল কেঁদে উঠলাে, এবং আকাশ ফাটিয়ে একটা মরণ চিৎকার জেগে উঠেই বন্ধ হয়ে গেল। বৃদ্ধ ভীম বুক চাপড়ে কেঁদে উঠলাে “বিষ্ণুউউউউ।”
**********
জাত লেঠেলদের বলিষ্ঠ পদাঘাতে মােটা কাঠের দরজা খড়কুটার মতাে ভগ্ন হয়ে ছিটকে পড়ল। ঘরে পা রাখতেই নজরে এল এক বীভৎস নারকীয় দৃশ্য!
বড়াে বিষ্টুর মৃতদেহটি ছড়িয়ে পড়ে রয়েচে ঘরের মেঝেতে। ছড়ানাে এইজন্যই কইলাম, কারণ ধড়ের থেকে মুন্ডটি আলাদা করা। হাত, পা, চুল, সব বিভক্ত করা হয়েচে কেটেকুটে। সেগুলি হাঁড়িতে ঠেসে দেওয়া হয়েছে। গােটা গৃহে রক্তের তাজা স্রোত। ভীম সর্দার অচৈতন্য হয়ে ঢলে পড়ল।
এতগুলি লাঠিয়ালের সঙ্গে স্বয়ং ভূস্বামীকে দেখেও সূদনের ভাবান্তর হল না। তার পূর্বের সেই সারল্য আর সাধাসিধে ভাব আর নাই। তার জায়গায় মুখের পরতে পরতে খেলা করচে কুটিল অভিসন্ধি। কমলেশ দাঁতে দাঁত চেপে বললাে, “হারামজাদা পাষণ্ড! এই তবে তাের আসল রূপ! তােকে চিনতে বড়াে দেরী করে ফেলেচি। পুৰ্বেই জানলে লােকগুলিকে মরতে হতাে না।”
সূদন এ কথায় হাে হাে করে হেসে প্রত্যুত্তর করল, “আবারও ভূল করলেন কৰ্ত্তামশায়। এখনও কিছুই চেনেননি। আমি মধূ ওঝার ব্যাটা। আমার সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা আপনার এই ষন্ডামার্কা মুখগুলাের নাই। বহু কষ্ট করে ইতিহাসের প্রায় বিস্মৃত এক মহাশক্তির খোঁজ পেয়েছি আমরা। আজ পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। এখন আকাশে গ্রহণ শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ এই হতভাগার রক্তে আহুতি দিয়ে সেই শক্তিকে ইতিমধ্যেই বশীভূত করেছি আমরা। বাধা দিও না। তােমাদের কোনও ক্ষতি করবােনা আমি। কিন্তু বাধা দিতে এলে সবংশে নিৰ্ব্বংশ হবে তােমরা।”
লেঠেলরা এই অপমানে একযােগে ক্রুদ্ধ চিৎকার করে উঠলাে। তাই শুনে সূদন রক্তচক্ষে চেয়ে কইলাে, “তবে রে। দেখ তবে আমাদের শক্তি।”
ক্ষণা এসে দাঁড়ালাে স্বামীর পাশে, আর দুইজনে মিলে বিড়বিড় করে কি যেন মন্তর পড়তে লাগল।
লেঠেল সহ জমিদার হতভম্ব হয়ে দেখলাে সূদনদের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েচে একজোড়া মিশকালাে ছায়ামূর্তি। ভয়ঙ্কর তাদের অবয়ব। চোখে তাদের তীব্র জিঘাংসা। সূদন সেদিকে না তাকিয়েই হাসি মুখে শুধােলাে,
-“আমার ডানদিকে কে এসেছিস?”
জড়িত স্বরে উত্তর এল,
-“প্রভু, আমি রমাকান্ত সাঁপুই। থাকি কুলতলির বাদাড়ে।”
– “আর আমার বাঁ দিকে?”
খােনা মেয়েলি কণ্ঠে জবাব এল,
-“হুজুর, আমি হীরামতি বেদেনী। ডেরা দখিণের পােড়া শিবতলায়।”
সূদন বক্র সুরে আদেশ দিলাে, “বেশ বেশ, তােরা আমার আজ্ঞাবহ। এই মুহূর্তে তােরা এখানে উপস্থিত সবকয়টি মানুষ এবং ঐ কুকুরটিকে…
সূদনের মুখের কথা শেষ করবার পূর্বেই শিবরামের হাতের পাকা বাঁশের আঘাত পড়ল তার ব্রহ্মতালুতে। কাটা কলাগাছের ন্যায় ভূপতিত হল সূদন। ক্ষণা এই দৃশ্য দেখামাত্র ভয়ানক তীক্ষ স্বরে ডুকরে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বামীর সদ্যমৃত দেহটার উপর, আর দুই পলক পরেই আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অশ্রুভেজা গলায় সেই প্রেতমূর্তি দুইটার দিকে চেয়ে বললে, “তােরা দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? এই মুহূর্তে এই শয়তানের দলের উপরে তােরা…
আবার বিদ্যুৎবেগে লাঠির আঘাত পড়ল তার মাথায়। এবার আঘাত করেচে ভীম। লেঠেল সর্দার ভীমসেন। সে লুপ্ত চৈতন্য ফিরে পেয়েছে, আর নাতির শােকে অস্থির তার শরীরে বল ফিরে এসেচে দ্বিগুণ হয়ে। সেই এক আঘাতেই শয়তানীর মাথা চৌচির হয়ে গেল। স্বামীর পাশাপাশি তার অপবিত্র শব পড়ে রইলাে বিস্রস্ত অবস্থায়। দুইজনের মৃত্যু ঘটামাত্র সেই প্রেতমূর্তি দুটো একলাফে বাড়ির ছাদ ভেদ করে মিলিয়ে গেল। ভূলাই কিছু একটা দেখে নিজের লেজ গুটিয়ে নিয়ে করুণ সুরে আকাশে মুখ তুলে ডেকে উঠলাে। সেই অপয়া একটানা ডাক শুনে অভিজ্ঞ ভীমের মন কিসের যেন ভয়ে কু ডেকে উঠলাে। আকাশে তখন গ্রহণের অপচ্ছায়া কেটে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ স্বমহিমায় প্রকাশ পেয়েছে।
***********
এই ঘটনার পর আরও দুই রকম ঘটনা ঘটলাে।একটি লােকচক্ষুর সুমুখে, অপরটি অন্তরালে। প্রথম ঘটনাটি হল এই যে, দিন কয়েকের মধ্যেই সাধারণ প্রজারা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডটি ভূলে দৈনন্দিন জীবনস্রোতে মগ্ন হয়ে গেল, আর অপর ঘটনাটি হল অতি অশুভ। সূদন এবং ক্ষণা চন্দ্রগ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণে মরেছিলাে। লােকজন বলে, গ্রহণে মরলে মৃত ব্যক্তি বিকৃতির শিকার হয়। কথাটা হয়তাে নেহাই মিছে নয়। ঠিক দুইখানি পূর্ণিমার রাত পার করে জেগে উঠলাে এই শয়তান দ্বয়ের বিকৃত প্রেতাত্মা। তারা গ্রহণের সকল রকমের দোষ মাথায় করে পরিণত হয়েছে ভয়ঙ্কর চন্দ্রপিশাচে। উপরন্তু তাদের মৃত্যুর পূর্বেই লাভ হয়েচে সৃষ্টি চরাচর বিনাশকারী এক গুপ্ত মহাশক্তি। এই অমঙ্গলকারী দুই শক্তির বলে অসামান্য শক্তিধর হয়ে উঠলাে এই জোড়া শয়তান।
গাঁয়ের লােকেরা মহামারীর ভয়ে পরদিন প্রভাতে তাদের লাশদুটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েচিলাে মজা নদীর বাঁওড়ে। এখন প্রেতযােনী লন্ধ হয়ে পূর্ণ চেতনা ফিরে পাবার পর তারা ডেরা নিলাে সেই বাঁওড়েরই এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে। কিন্তু একটি ব্যাপারে তারা খেয়াল করলে যে, সেই গােপন শক্তির প্রভাবেই সম্ভবতঃ, তাদের গতিবিধির উপরে একটি বিশেষ বাধা সৃষ্টি হয়েছে। সূদন দিনমানে সর্বত্র যাতায়াত করতে পারে, কিন্তু চন্দ্রালােকিত রাতে নয়। চাঁদের বিন্দুমাত্র আলাের কণা অবধি তার শরীরে পড়লে যেন মৃত্যুযন্ত্রণা আরম্ভ হয়। ক্ষণার ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত। সে সূর্যালোেক কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। সূর্যের আলাে তার শত্রুর।
অতঃপর এই জোড়া পিশাচ দম্পতি চমৎকার মতলব এঁটে ফেললাে। একজন শিকার করতে আরম্ভ করল দিনের বেলায়, আর অপরজন ঘুটঘুটে রাতে। ক্ষণা ভােরের আলাে ফোটার আগেই সুড়ঙ্গে আশ্রয় নিতাে, আর সূদন রাতের চাঁদ ওঠার পূর্বেই ডেরায় ফিরে আসতাে। এদের কথা এই দুইমাসে লােকজন আর স্মরণ রাখেনি। এমনকি যেহেতু এই দীর্ঘ সময়ে কোনও উপদ্রব ঘটেনি, তাই বর্তমান উৎপাতের সঙ্গে কেউই তাদের মেলাতে পারলাে না কোনওভাবেই। এমনকি তারা এও জানলে না যে আততায়ী আসলে একজন নয়, দুইজন।
এই পর্যায়ক্রমে ঘটতে থাকা হত্যাকাণ্ডগুলির ফলে গােটা তালুকে ভীষণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় প্রতি চার পাঁচদিন অন্তর অন্তরই একেক ঘর থেকে মৃত্যুর ক্রন্দনধ্বনি উঠতে লাগলাে। এর থেকে মুক্তি খুঁজে পেতে লাঠিয়ালের একটি ছােটো দল শিবরামের নেতৃত্বে বেরিয়ে পড়ল সাগরের দিকে আর জমিদার কমলেশ ঠাকুরের আদেশানুক্রমে অন্ততঃ জনা পাঁচেক নামজাদা গুণীন আর পীর এসে বারে বারে গ্রামকে বেঁধে দিয়ে গেল, কিন্তু ফল হল শূন্য।
আসলে এর কারণটা বুঝতে গেলে তােমাদের গ্রামবন্ধনের পদ্ধতিটি হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। মন্ত্র বন্ধন পাঁচ প্রকার হয়। জল বন্ধন, বৃক্ষ বন্ধন, দেহ বন্ধন, গ্রাম বন্ধন এবং শ্যা বন্ধন। একজন গুণীন একটি বিশেষ মন্ত্র পড়তে পড়তে একটুকরাে খড়, কাঠি অথবা বাণ দ্বারা গােটা গ্রামের যতটুকু দন্ডী কেটে দিতে পারেন, সেটুকু স্থান বন্ধনের আওতায় পড়ে।
এরও দুইটি ভাগ রয়েছে। আবিষ্টম আর প্রবিষ্টম। প্রবিষ্টমের ফলে বাইরের কোনও দেহধারী বা দেহহীন কেউ গন্ডীর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। যেমন লক্ষণ ঠাকুরের টানা লক্ষণ-রেখা। আর অপরটি হল আবিষ্টম। এর ফলে গন্ডীর অভ্যন্তরে থাকা কেউ ঐ রেখা লঙ্ঘন করে বেরুতে পারে না। যে স্থানে এসে রেখাটি যুক্ত হয়, তাকে বলে বন্ধনের জোড় অথবা চোখ। এই চোখের স্থানে একটি কড়ি অথবা মাটির সরা, কিম্বা বাঁশের টুকরাে দিয়ে দ্বারবন্ধ করা হয়, এবং ঐ বস্তুটিকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হয়। পূনরায়ঃ ঐ বস্তুটি দ্বারস্থানে ছোঁয়ালেই বন্ধন কেটে যায়। এই গুণীন ও পীরের দল প্রতিবারই এই চোখগুলিকে গাঁয়ের কোথাও সযত্নে লুকিয়ে রাখতাে, কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও টের পেত না যে হত্যাকারী আদপেই একজন নয়, বরং দুইজন।
পিশাচ দুটির মধ্যে একটি সবসময়ই লুকিয়ে গ্রামের মধ্যেই থাকতাে। গুণীনের দল যদি এই বন্ধন দিনের বেলায় করতাে, তবে সূদন ঐ চোখটি হাতিয়ে নিয়ে বন্ধন কাটিয়ে দিয়ে সেটি আবার পূর্বস্থানে রেখে আসতাে, আর এই প্রক্রিয়া রাতে হলে সেই কাজটি করতাে ক্ষণা। ফলে তাদের নরমেধযজ্ঞ অবাধই রইলাে।
হিজলপোতার মাটিতে মূৰ্ত্তিমান অভিশাপের ন্যায় আবর্তিত হতে থাকা এই ঘাের অশুভ এবং ভীষণ তীক্ষ্ণবুদ্ধি চন্দ্রপিশাচের চাপা আতঙ্কের কথাই আজ তােমাদের বলতে চলেচি। শােনাে তবে।
**********
বৃদ্ধ লেঠেল চরণ সর্দার দীর্ঘ আট হপ্তা অসুস্থ থাকার পরে সেইদিন একটু সুস্থ বােধ করছিলাে। তা, পড়ন্ত দুপুরের বেলায় কাঁধে গামছাটি ফেলে, হাতে যষ্টি নিয়ে সে বেরুলাে নদীর পাড়ে একটু হাঁটতে। বেশ কিছুটা হেঁটে সে যখন সাতমাথার খেয়াঘাটের পাশের ঝাউবনটা পার করছে, হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও ভীষণ শব্দে বাঘ গরগর করে উঠলাে। চরণ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকলাে, কিন্তু সেও জাত লেঠেল। চকিতে বাম হাত দিয়ে যষ্টির মাথার ছুঁচলাে লােহার ফলাটাকে মুক্ত করে এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকলাে।
বাঘ ডেকেচে সত্য বটে, কিন্তু এ কেমন বাঘ? বাঘের হুঙ্কার চেনে না এমন শিশুও পাওয়া যায় না এ তল্লাটে, কিন্তু এ তাে সোঁদরবনের সেই রায়বাঘার আওয়াজ নয়। একটু যেন ভিন্ন। ইতিউতি দেখতে দেখতে আচমকা চরণের নজরে এল, সামনে নাতিউচ্চ ঢিবিটার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘ। তারই দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোট চাটচে সে। সোঁদরবনের জঙ্গলে চিতাবাঘ? চরণ সর্দার যুবাকালে কিছু বৎসর উত্তরে ছিল। সে চিতাবাঘ চিনতাে। অবাক হওয়া সত্ত্বেও হাতের যষ্টিটা বাগিয়ে ধরে এক পা এক পা পিছােতে শুরু করল সে।
এভাবে দুই তিন পা পিছােতেই বাঘটা কানফাটানাে গর্জন করে চরণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঘটার ঝাঁপ দেওয়া অবস্থাতেই বৃদ্ধ ক্ষিপ্রবেগে লােহার ফলাটা বাগিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাে। সামান্য সময় পরেই চোখ খুলে হতবাক হয়ে সে দেখলাে কোথায় বাঘ কোথায় কি! কিচ্ছু নাই। বেশ খানিকটা সময় ধরে চরণ চারিদিকে লক্ষ্য করল, কিন্তু কারুর কোনও অস্তিত্বই নাই কোথাও। অগত্যা পুরােপুরি আশ্বস্ত হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ টের পেলাে ঠিক তার পিছনেই কেউ একটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মড়মড় করে শুকনাে পাতায় তার পায়ের আওয়াজ হচ্ছে এবং সেটি আর যাই হােক, কিছুতেই বাঘ নয়!
**********
পরদিবসে দিগ্বিজয়ী লাঠিয়ালের সর্দার চরণের টুকরাে টুকরাে মৃতদেহটা পাওয়া গেল সাতমাথার ঘাটের পৈঠার উপর। লাশের চোখমুখে একরাশ আতঙ্ক। হাত, পা, কণ্ঠনালী মায় বলিষ্ঠ আঙুলগুলাে অবধি তীব্র আক্রোশে টেনে ছিড়ে নেওয়া হয়েছে। গ্রামের লােকেরা রীতিমতাে আঁতকে উঠলাে এই ঘটনায়। গােটা পরগণায় চেপে বসল এক অজানা মহাভয় কিন্তু ভাগ্যং ফলতিঃ সর্বত্র। মৃত্যুর সেই ছিল সবে শুরু। ঠিক তিনদিন পরেই আবার অপঘাতে মরলাে কমলেশের জমিদারির সরকারমশায় শ্রী শুদ্ধোধন সরকার।
সে এই এস্টেটের জমিদার-সরকারও বটে, আবার বাজার-সরকারের কাজও তাকেই সামলাতে হতাে। তা, সেইদিন সকাল সকাল বিশালদেহী শুদ্ধোধন দুই হাতের বাজারের থলিতে প্রচুর আনাজপত্র ভরে জমিদারবাড়িতে ফিরচিলাে। পথে বেশ কিছু লােকজন চলাচল করচে। নাগেশ্বরের থান পেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই আচমকা সে দেখলাে ভীম লেঠেলের ছয় বৎসরের নাতনীটি কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে। শুদ্ধোধন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধােলাে-
– “ও কে ও? শঙ্করী না? কী হয়েছে মা তাের?”
শুদ্ধোধনের পাশাপাশি আরও জনা পাঁচ ছয় লােৰ গাগ্রহ বশে দাঁড়িয়ে গেল। শঙ্করী কাঁদতে কাঁদতে সরকারমশায়কে বললাে, “তােমার কাছেই যাচ্ছিলেম কাকা। দাদামশায়কে কিসে যেন একটা ধরেচে। গায়ের মধ্যে ছাপ ছাপ। দাদামশায় তাকে ভীষণ গালি পাড়ছে আর তার গলা টিপে ধরছে, কিন্তু গায়ের জোরে পেরে উঠছে না। শীগগির চলাে কাকা।” এই বলে সে উঁ উঁ করে কাঁদতে থাকলাে।
শুধু শুদ্ধোধন নয়, পাশে উপস্থিত সবকয়টি মানুষ একযােগে হনহন করে রওয়ানা দিলাে লেঠেলপাড়ার উদ্যেশে। কুলতলির গাছে ঢাকা সরু নদীর পাড়ের পথ দিয়ে আগে আগে চলচে শঙ্করী, পিছনে পিছনে সাত আটজন লােক। তারা কতক্ষণ চলেচে ঠিক ঠাহর হয়নি, কিন্তু শুদ্ধোধনের যেন রাস্তাখানি কেমন ঝাপসা ঝাপসা ঠেকলাে। সে পার্শ্ববর্তী রমেশ বারুইয়ের উদ্যেশে কইলাে, “ও রমেশ, বলি আমার যেন কেমন কেমন ঠেকচে। বলি এই নদীর পথটা এত ঝাপসা লাগছে কেন?”
রমেশ মােলায়েম সুরে হেসে বললে, “কি যে বলেন সরকারমশায়। এই ভর সন্ধ্যায় পথঘাট ঝাপসা লাগবে না তাে কি আলােয় ফটফট করবে?”
শুদ্ধোধনের বুকের মধ্যে কেউ হাতুড়ি পিটতে শুরু করল। ঘাের কেটে সম্বিৎ ফিরে পেতেই তার মনে সহস্র প্রশ্ন এসে ভীড় করল।
সন্ধ্যা ! আশ্চর্য!
সে তাে সদ্য বাজার করে ফিরচিলাে, এমন সময়ে ভীমের নাতনীটি এসে ডাক দিলাে, কিন্তু তখন তাে খুব সকাল! তাহলে সে কতক্ষণ হেঁটেছে? তার সঙ্গের লােকগুলােই বা এত নির্বিকার কেন? ভীমের নাতনীই বা এতগুলি পাড়া বেপাড়া গ্রাম পেরিয়ে তার কাছেই বা সাহায্যের জন্যে এল কেন? এতখানি পথে আর কেউ ছিল না?
কিন্তু এসবের উত্তর আর পাওয়া যাবে না। বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। সে সভয়ে দেখলে যে তার সঙ্গে এতক্ষণ অনুগমন করা সেই লােকগুলাে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শঙ্করীর সেই আকুতিপূর্ণ মুখ আর নাই। তার ঠোট চিরে দুইখানি কুকুরদাঁত বেরিয়ে এসেছে। সে কিছু একটা ফিসফিস করতেই ঠিক তার পিছনে এসে দাঁড়ালাে দুইখানি প্রেতমূর্তি। আদেশ পেয়েই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল শুদ্ধোধনের ঘাড়ে।
বাজারের থলিটি ছিটকে পড়ে গিয়ে সবজিগুলি গড়াগড়ি খেতে লাগল, আর সেগুলির গায়ে এসে পড়ল কয়েকটি তাজা রক্তের ছিটা।
এইরকম আরও অনেকগুলি নৃশংস হত্যাকাণ্ড উপর্যুপরি ঘটে যাবার পরে কমলেশের প্রজারা ভীরু শশকের ন্যায় দিন কাটাতে থাকলাে। দিনের আলােয় টুকিটাকি দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে ফেলেই বিকেল বিকেল ঘরের দোর বন্ধ করতাে তারা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হতাে না। প্রজারা অথবা গুণীনরা এইটে আদপেই জানতাে না যে হত্যাকারী মােটেও একটি নয়, আসলে দুইটি। একজন রাতে জাগে এবং অপরজন দিনে। তাই দিনেমানেও পরপর অনেকগুলি মানুষ মারা পড়ল বেঘােরে। গ্রামের মন্তরপড়া বাঁধন যে কিভাবে খুলে যাচ্চে বারেবারে তা কেউ হদিস পেলাে না এবং এর ফলেই এই শয়তানকে জব্দ করার আশাও ত্যাগ করল সকলে। সূদন আর ক্ষণার পিশাচ ছিল যতখানি নৃশংস, ততখানিই সুচতুর এবং ততােধিক ছলনাময়। শিকারকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ফন্দিফিকির তারা বেশ রকম জানতাে। তেমনই একটি ছলনা তারা প্রয়ােগ করল আবার। এবারের শিকার হতভাগ্য বৃদ্ধ ভীম।
এক শনিবারের মাঝ রাত্তিরে ক্ষণা ভীমের গৃহে উঁকি দিলাে। ঘরে জনা আষ্টেক লােক আর ভীমের নাতনী ঘুমুচ্চে। ক্ষণা অতি নিঃশব্দে ভীমসেনের তােরঙ্গের ভিতরে কিছু নর করােটি, কয়েকটি হাড়গােড় আর সিন্দুরে ছােপানাে গুটিকয়েক লেবু রেখে, তােরঙ্গের ডালাটি খুলে রেখে এল।
পরদিন সকালে সেদিকে চোখ যেতেই প্রতিটি মানুষ একেবারে আঁতকে উঠলাে। একে একে অনেক লােক জমা হল তার গৃহে। একেই তারা রয়েছে ভীষণ এক ভয়ের আবহে, তার মধ্যে এসব কীর্তি দেখে তাদের দৃঢ় ধারণা হল যে ভীমসেনই যত নষ্টের মূল। সেই নিশ্চয়ই তন্ত্রমন্ত্র করে এসব করচে। বৃদ্ধ ভীমের শরীরে যদি অসুরের বল না থাকতাে, তবে গ্রামবাসীরা তখনই তাকে ছিড়ে টুকরাে করে ফেলতাে, কিন্তু সে সাহস কেউ পেলাে না। কমলেশও ভীমকে ভালােবাসতাে। তাই ছেলে বুড়াে নির্বিশেষে সবার নিদানে বৃদ্ধ ভীম হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গ্রাম ছাড়লাে। এই গ্রামে সে বড়াে হয়েছে। তার ছেলে, পুত্রবধূ, নাতনী, সবাই পড়ে রইলাে। আদরের নাতিটা এই গ্রামের অলিতে গলিতে খেলে বেড়াতাে ক’দিন আগেও। পিছন ফিরে সেদিকে তাকিয়ে শিশুদের মতাে কেঁদে উঠলাে সে।
একেই ক’দিন আগেই নিজের প্রাণধিক নাতিকে হারিয়েছে সে। তার উপরে এই জঘন্যতম অপবাদে তার মাথা খারাপ হয়ে গেল প্রায়। সে পাথরের মতাে ভাবলেশ শূন্য দৃষ্টিতে এলােমেলাে পায়ে চলতে থাকলাে সাতমাথার ইস্টিশানের দিকে। সন্ধ্যায় রেলের গাড়িটা ঢুকলে তার সামনে ধাক্কা খেয়ে মরবে সে। চলতে চলতে বিকেল পেরিয়ে ইস্টিশানে এসে উঠলাে ভীম। কুলি মজুর আর খাবার বিক্রেতারা হৈচৈ করচে, রেলগাড়িও একটু আগেই ঢুকে পড়েছে। সেখানেও জনমজুরদের চ্যাঁচামেচি হট্টগােল ভেসে আসছে। ভীম গিয়ে বসল গাড়ির একদম মাথার দিকের মেঝেতে। গাড়ি চলতে শুরু করলেই সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে। বসে বসে একদৃষ্টিতে রেলের এঞ্জিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ভীম টের পেলাে তার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্চে। পুড়ুক। একটু পরেই সব যন্ত্রণার অবসান।
সন্ধ্যার মুখে একটা তীব্র বাঁশির শব্দ কানে এল। তার মানে এইবার গাড়ি ছাড়বে। এঞ্জিনের থেকে ভক ভক করে একরাশ কালাে ধোঁয়া এসে দশদিক ছেয়ে ফেললাে, আর সেই ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করেও ভীম দেখতে পেলাে তার সামনে কোনও রেলগাড়িই নেই। বিস্মিত ভীম চোখ ফেরালাে ইস্টিশানের দিকে, কিন্তু কি আশ্চর্য! এতক্ষণ এতগুলি লােক হৈ হৈ করছিলাে, কিন্তু এখন সেখানে একটি মানুষের ছায়া অবধি নাই।
আচমকা ভীমের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলাে। আজ সে রেলগাড়ি দেখবে কেমন করে! আজ তাে রবিবার! আজ গাড়ি আসে না। সে মরতেই এসেছিলাে, কিন্তু এইবার তার অন্তরাত্মা শুষ্ক হয়ে উঠলাে ভয়ে। পালানাের জন্যে পিছনে ঘুরতেই ভীম বুকফাটা চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। তার থেকে হাত দশেক ব্যবধানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্ষণা। সেই ক্ষণা, যাকে ভীম নিজের হাতে পিটিয়ে মেরেছে। এই রাকুসীই তার নাতির দেহের টুকরােগুলাে..
ভয় চলে গিয়ে বৃদ্ধের দেহে ভর করল প্রতিহিংসার চরম ইচ্ছে। বারবার সে চাইলাে ছুটে গিয়ে ওই শয়তানীর গলাটা টিপে ধরে, কিন্তু সে হাজার চেষ্টায়ও নিজেকে নড়াতে পারলাে না কোনওভাবেই। নিস্ফল ছটফট করতে করতে তার দু চোখের কোল বেয়ে টপটপ করে জল গড়াতে থাকলাে। এককালের দুর্দান্ত লেঠেল বৃদ্ধ ভীমসেন তার দীর্ঘ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে। অসহায়ের মতাে নিশ্চল পড়ে রইলাে।
পিশাচিনী সেইদিকে তাকিয়ে ভয়ংকর শব্দে হেসে উঠলাে, আর তারপর দূর্বোধ্য স্বরে কি যেন ফিসফিসিয়ে উঠলাে। সঙ্গে সঙ্গে তার পিছনে আবির্ভূত হল দুইখানি ভয়ালদর্শন প্রেতাত্মা। ভীমের চোখে চোখ রেখে ক্ষণা শুধােলাে,
-“আমার ডানদিকে কে এসেছিস?”
খোনা স্বরে উত্তর এল, “আজ্ঞা, আমি রতিকান্ত ডােম। থাকি বেদেপাড়ার তেঁতুল গাছে।”
-“বেশ বেশ। আর আমার বাঁ দিকে কে এসেছিস?”
-ভরাট কণ্ঠে জবাব এল, “ব্রাহ্মণ। নাম কালীপদ মুখুজ্জে। নিবাস রায়দীঘড়া।”
**********
ছিটকে উঠে ক্ষণা সেদিকে তাকিয়ে দেখলাে একটি কৃষ্ণবর্ণ প্রেতমূর্তি অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে, আর তার বুকে পা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক দীর্ঘদেহী যুবা। পরণে শ্বেতশুভ্র কামিজ আর ধুতি। কপালে রক্তসিন্দুরের টিকা। চোয়াল কঠিন। চক্ষু শাণিত।
ক্ষণার ইশারায় দ্বিতীয় প্রেতটি ভীষণ জোরে লাফ দিলাে কালীপদর কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে, আর তার সামনে পৌঁছানাে মাত্র কালীপদ নিজের ডানহাতের তর্জনী ঠেকিয়ে দিলাে তার ললাটে। চিড়িক করে একটা শব্দ হল, আর পরমুহূর্তেই রতিকান্ত ডােমের পিশাচ সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়ল ইস্টিশানের জমিতে। নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করে বাতাসে মিলিয়ে গেল রাক্ষসী।
ভীমের বন্ধন আগেই কেটে গিয়েছিলাে। কালীপদ তাকে হাতে ধরে দাঁড় করিয়ে ধীরে ধীরে বললে, “এই শয়তান দুটো গােটা একটি দিনের মধ্যে আর জ্ঞান ফিরে পাবে না। এর অধিক অজ্ঞান করে রাখার বিদ্যে আমার নাই।”
তারা পথ ধরলাে অভিশপ্ত হিজলপোঁতা গ্রামের। শিবরাম সর্দারের দল এখানে ওখানে খুঁজে খুঁজে অবশেষে সন্ধান পেয়েছিলাে রায়দীঘড়ার কালীপদ মুখুজ্জের, কিন্তু তখনই কালীপদ আসতে পারেনি তাদের সাথে, কারণ তখন তার দাদার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে যাওয়াটা আশু প্রয়ােজন ছিল। ভস্মসুরের সে। ঘটনা তাে তােমরা জানােই। সেই আপদ বিদেয় হবার পরপরই কালী রওয়ানা দেয় হিজলগাঁয়ের দিকে এবং আজকেই সাঁঝের মুখে সাতমাথার শেষ খেয়ায় এপারে এসে পৌঁছেচে। মাঝি তাকে পৌঁছে দিয়েই উধশ্বাসে নৌকা নিয়ে চলে গিয়েচিলাে। সে রাত্তিরটা কালী নদীর পাড়েই কাটাবে বলে মনস্থ করেছিলাে, কিন্তু ভীমের চিৎকার কানে যাওয়ায় সে তড়িঘড়ি এদিকে ব্যাপারটা দেখতে এসেছিলাে। এসে দেখলাে ব্যাপার বড়াে সঙ্গীন।
হিজলপোঁতা গাঁয়ে তখন বেশ একটা ভিড় জমে উঠেছে। বহুদিন পর এই প্রথম সবাই রাত্তিরে বাইরে বেরিয়েছে। ভীমের মুখে কালীপদর আশ্চর্য কীর্তির কথা শুনে তাদের অনেকখানি সাহস ফিরে এসেছে। কমলেশ ভগ্ন স্বরে কইলাে, “ঠাকুরমশায়, আমাদের রক্ষা করুন। এই হতভাগা শয়তানটার যন্ত্রণায় আমার প্রজারা নিৰ্ব্বংশ হতে বসেছে। এতবার এত গুণীনকে দিয়ে গ্রাম বন্ধন করেও কি করে যেন কেটে যায় সেগুলি। কি যে করি।”
কালীপদ একখাবলা মাটির তাল শুকে আবার ফেলে দিয়ে বললাে,
-“বাঁধন আঁটবে কোত্থেকে? গন্ডীর বাইরেও তাে ভূত জাগে।”
কমলেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল- “মানে? কে জাগে?”
কালীপদ মুচকি হেসে চাপা গলায় বললে, “লালকমল ঘুমায় আর নীলকমল জাগে।”
**********
সবার সব কথা শােনার পর কালীপদ জানালাে, “দেখাে বাবারা, তােমাদের কথা শুনে মনে হচ্চে একটিবার ওই সূদন না কি নাম বললে, তার ঘরখানা একবার দেখা প্রয়ােজন। কাল সকালে যাবাে সেইভেনে।”
কালীপদ সঙ্গে থাকলে যে বিপদ হবে না, তা গাঁয়ের লােকেরা বিলক্ষণ বুঝেচিলাে, তাই সকাল হতেই দল বেঁধে কালীকে সঙ্গে করে এসে ঢুকলাে সূদনের গৃহে। কপাট ভাঙা। উঠানে আগাছা গজিয়ে উঠেছে। ভিতরের ঘরে মেঝেতে এখনও শুকনাে রক্তের দাগ কালচে হয়ে লেগে রয়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে ভীম চক্ষু বুজলাে। এই ঘরেই বিষ্ণুর ছিন্নভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি পড়েছিলাে।
কালীপদ এ-ঘর ও-ঘর তল্লাশি করে একখানি কাঠের বাক্সের সন্ধান পেলাে। হরিকিঙ্কর পাটনী জানালাে, এই বাক্সখানা হাতে নিয়েই সূদনরা গাঁ ছেড়েছিলাে। কালী চাড় দিয়ে ডালা খুলে ফেললাে। ভিতরে কতকগুলি কম্ফর্টার, একটি জীর্ণ বর্ষাতি, মােটা মুগারের শাল, গলাবন্ধ প্রভৃতি রয়েছে। কালীপদ সেদিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দেখে একজন বললে, “ও কী এমন দেখচেন ঠাকুর?”
কালীপদ উত্তর দিলাে, “দেখচি যে মানুষ কোন পরিস্থিতিতে ঘোর ভাদ্রমাসে তীর্থে বেরুলেও গরম পােষাক আর বর্ষাতি নিয়ে বেরােয়। শয়তানগুলাে মনে হচ্ছে কোনও ঠান্ডার দেশে গিয়েছিলাে। যেমন তেমন ঠান্ডা নয়, হাড়কাঁপানাে ঠান্ডা, যেমনটি তিব্বতের দিকে হয়। প্রশ্ন হল বর্ষাতি কেন? বৃষ্টির জন্য তাে নয় বুঝতেই পারছি। তাদের কি কোনও জলে নামবার দরকার পড়েচিলাে? কি জানি।
ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এইবারে বেরুলাে একখানি তামার তৈয়ারী করা ফলক। সেখানি হাতে নিয়ে কালীপদ ভ্রু কুঞ্চিত করে একবার পড়ল। দ্বিতীয়বারও পড়ল। তৃতীয়বার পড়ার সময়ই তার কুঞ্চিত যুগল সােজা হয়ে গেল। হতবিহ্বল কণ্ঠে নিজের মনেই বলে উঠলাে, “হা ঈশ্বর! এ কী ভয়ংকর বিপদ ঘনিয়ে এল! সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত হয়েছে বুঝি! এইবারে বুঝলাম এই শয়তানরা একসাথে দুইজনে সূৰ্য্য এবং চাঁদের আলােতে বেরুতে পারে না কেন।”
কমলেশও অবাক কম হয়নি। সে বললে, “কি সৰ্ব্বনাশ হয়েচে ঠাকুর? আমাদেরও বলুন দয়া করে।”
-“শােনাে কমলেশ, যে মহাশক্তির নাগাল সূদনরা পেয়েছে, তা দিয়ে বিশ্বচরাচরে প্রলয় ঘটানাে যায়। এত অক্ষর ধরে ধরে বােঝাবার সময় তাে নাই, তাই মােটের উপর বলে যাচ্চি শােননা… দৌন্তেয়, অর্থাৎ দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার পুত্রের নাম ছিল ভরত। তাঁর নামেই তার রাজ্যের বা আমাদের দেশের নামকরণ হয়। সেই ভরতের মহা রাজ্য, অর্থাৎ মহা-ভারত। তার হৃদয়ে বা মধ্যস্থানে অঙ্গ থাকে। সত্যিই আছে বটে। মহাভারতেও উল্লেখ ছিল। বর্তমানের বেহার প্রদেশের ভাগলপুর এলাকার প্রাচীন নাম ছিল অঙ্গ। সেখানকার রাজা অঙ্গনামা, অর্থাৎ মানবদেহের একটি অঙ্গের নামে তাঁর নাম। অঙ্গরাজ কর্ণ। কুন্তীপুত্র অতিরথ কর্ণ। তাঁর গয়নাগাঁটি, অর্থাৎ কবচ আর কুন্ডলের কথা তােমরা সকলেই জানাে, সেগুলি দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণ সেজে নিয়ে নেবার ফলেই যুদ্ধে অপরাজেয় কর্ণের রথের চাকা পাঁকে, তথা মাটিতে বসে গিয়েছিলাে। রাজার নামের গয়না মানে হল কানের গয়না, অর্থাৎ কুন্ডল এবং অঙ্গাণ বা কবচটি লুকানাে রয়েছে শিবসায়র বা মানস সরােবরের জলের গভীর তলে। কর্ণের সহজাত কবচ আর কুন্ডলটি ইন্দ্রকে কেটে দেবার সময়ে তাতে মহাবীর কর্ণের রক্ত লেগেছিলাে। সেই রক্তের আনুগত্যের প্রভাব কাটানাের জন্যে তিনটি নরের রক্তে সেগুলিকে স্নান করাতে হবে। শয়তান দুটি তাইই করেছিলাে। তােমরা তাদের হত্যা করার আগেই সেই শক্তি তারা পেয়ে গিয়েছিলাে কমলেশ। এই কবচ কুন্ডলের মধ্যে একটি চান্দ্রশক্তির বলে বলীয়ান, অপরটি সূৰ্য্যের। তাই আকাশে চন্দ্র সূৰ্য্য থাকাকালীন অঙ্গরাজ কর্ণ ছিলেন অবধ্য। এখন সামনে বড়াে বিপদ। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে দাও আমাকে একটু।
***********
কালীপদ বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ কপাল টিপে বসে রইলাে। তারপর উঠে বললাে, “কমলেশ, আজ সকলকে জানিয়ে দাও প্রতিটি মানুষ যেন আজ বিকেলের মধ্যে তােমার কাছারিঘরে চলে আসে। আজ রাতে সেখানেই সকলে মিলে থাকা হবে, আর আমাকে একটু আটা এনে দাও।”
বিকেলের মধ্যে সকলেই যে যার কাঁথা কম্বল নিয়ে আশ্রয় নিলাে জমিদারের প্রকাণ্ড কাছারিবাড়িতে। সন্ধ্যার ঠিক পূর্বে গাঁয়ের চিনু ডােমের বিধবা জটিলা এসে উপস্থিত হল সেখানে। সে হিজলপোঁতায় ভিক্ষা করে খায়। এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে কারুর না কারুর পাকাবাড়িতে রাতে আশ্রয় নিতাে। জটিলা কাছারিঘরে প্রবেশের মুখে দরজা আটকে দাঁড়ালাে স্বয়ং কালীপদ। বুড়ীর পরিচয় জানার পর স্নেহাদ্র স্বরে কালীপদ বললাে,
-“তুমি তাে মা এই ঘরে থাকতে পারাে না। আমি বুঝতে পারচি এ কথা বড়াে কঠিন, কিন্তু আমি একজন সাধক এবং তান্ত্রিক। শুদ্ধাচারে থাকি। একজন ডােমের সঙ্গে রাতে এক ঘরে থাকতে পারি নে। আমি অশুদ্ধ হলে সবার বিপদ। তুমি অন্যত্র যাও।”
বুড়ী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদচে দেখে কালীপদর দয়া হল।
-“বেশ, তুমি আজ বাইরের দূর্গাদালানে শুয়ে থাকো। শ্রীদূর্গার বিগ্রহের থেকে তফাতে থাকলেই হবে। আমি দালানের চারদিকে মন্তর পড়ে বেশ করে বেঁধে দেবাে। কারুর সাধ্য নাই তা ভেদ করে ঢােকে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো”
যখন এই সকল কথাবার্তা চলচে, সূদন কিন্তু সবার অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনেচে। কালীর সামনে আসেনি বটে, কিন্তু জটিলার বন্দোবস্তটা শােনার পর সে মনে মনে হেসে উঠেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটু পরেই চাদ উঠবে। তাকে এখন যেতেই হবে, কিন্তু রাতে আসবে ক্ষণা। আজ দেখা যাবে তান্ত্রিকের বন্ধনের দৌড়। একটু হেসে সে এগিয়ে চললাে তার ডেরা নদীর বাঁওড়ের দিকে।
***********
রাতের দ্বিতীয় প্রহরে ক্ষণা বেরুলাে শিকার ধরতে। কাছারিঘরে পিদিম জ্বলচে। বাইরে সাদা গুঁডাের দাগের দন্ডী কাটা। কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠে সে বাতাসে ভেসে এল দূর্গাদালানের ঠিক সামনেটায়। পৌষের শীত মাথায় করে অসহায় ভিক্ষু বৃদ্ধা শুয়ে রয়েচে মেঝেতে। তার মাথার পাকা চুলের গােছা, জীর্ণ বসনাঞ্চল বেরিয়ে রয়েছে অনেকখানি, কিন্তু হলে হয় কি, দালানের চতুর্দিকে বাঁধন দেওয়া রয়েছে। সহস্রবার প্রচেষ্টা করেও রাক্ষসী সেই বেড়া ভাঙতে পারলাে না। ভাের হতে যায়। আর দেরী করা যাবে না। শেষবারের মতাে চেষ্টা করার জন্যে বাঁধনের প্রাচীরে ধাক্কা দিলাে সে, আর টের পেলাে বন্ধনের জোড়ের কাছটা যেন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মরীয়া প্রেতিনী ঐ ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করার জন্য ভয়ানক জোর প্রয়ােগ করতে করতে হঠাৎ জোড়ের মুখ আলগা হয়ে সে ভিতরে এসে পড়ল। আর কোনও বাধা নাই। ক্ষণা পৈশাচিক হাসি হেসে নীচু হয়ে বৃদ্ধার চুলের মুষ্টি ধরে দিলাে এক সজোরে টান, আর সাথে সাথে আটার গুঁড়াে মাখানাে শ্রীদূর্গার পরচুলা খুলে এল, এবং চাদরের তলা থেকে বেরিয়ে এল ছদ্মবেশী কালীপদ মুখুজ্জে আর গম্ভীর শব্দ এল—
প্রবিষ্টে যদ্ বিদেহায়াৎ, তদ্ আবিষ্টে বন্ধনম/
দ্বারবন্ধম ইদম কৃত্বাঃ, তন্ত্রাচারঃ ইথ্যঃ সমাপয়াৎ।
ক্ষণা ছিটকে উঠে পালাতে গিয়ে আবিষ্কার করল জোড়ের মুখ বজ্র আঁটুনিতে এঁটে গিয়েছে। কালীপদ এক লাফে দন্ডীর বাইরে বেরিয়ে এল। তার চিৎকারে অসংখ্য লােক দৌড়ে এসে দেখলাে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দূর্গাদালানের ভিতরে কলে ধরা পড়া ইন্দুরের ন্যায় ছটফট করে দৌড়ে চলেছে এক ঘাের কৃষ্ণবর্ণ মূৰ্ত্তি। সে বেরুতে পারছে না। হঠাৎ সেই শয়তানী রাক্ষসী ভয়ঙ্কর শব্দে চিৎকার করে উঠলাে। সেই শব্দের অভিঘাতে আশপাশের গাছপালা অবধি নড়ে উঠলাে। সকলে পূর্বদিকে চোখ তুলে দেখলাে, আকাশ আলাে করে উঁকি মারচেন সৰ্ব্বপাপহারী দিনমণি সূৰ্য্যদেব। তার প্রথম পবিত্র কিরণ দালানে পড়া মাত্র সেই পিশাচিনীর অশুভ মূৰ্ত্তি সূক্ষ্ম পালকের মতাে গুঁড়াে গুঁড়াে হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, আর ঠং করে মাটিতে এসে পড়ল একজোড়া তাম্র নির্মিত কানের কুন্ডল।
**********
কুন্ডলজোড়া হাতে নিয়ে কালীপদ কেঁদে ফেলেছিলাে। সকলে মহা আনন্দ করলেও কালীপদর ভ্রুকুটি এখনও কুটিল হয়েই রইলাে। একখানি আপদ বধ হয়েছে সত্য, কিন্তু আসল সমস্যা তাে শুরু। সে তার তন্ত্রেমন্ত্রে অপর শয়তানটিকে সাময়িক তাড়াতে পারবে ঠিকই, কিন্তু তাকে নিধন করতে গেলে তাকে চাঁদের আলােতে টেনে আনতেই হবে। এই শৃগালের মতাে মহা ধূর্ত পিশাচগুলি ফাঁদে পা দেবার বান্দা নয়। একটিকে কোনও গতিকে বােকা বানানাে গিয়েছে, কিন্তু এই ঘটনা জেনে অপরটি একশােগুণ সতর্ক হয়ে উঠবে। তাকে চাঁদের আলােয় টানা যায় কী ভাবে?
দৈব কুন্ডলটি নিয়ে কাছারিঘরের ভিতরে এসে দেখলাে সেখানে জটিলা বুড়ী আর ভীম রয়েছে। ভীমের শরীর তখনও প্রবল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কালীপদ জটিলার একবার মাথায় হাত বুলিয়ে ভীমকে আলতাে করে ঠেলা দিয়ে ডাকলাে। বৃদ্ধ ভীম ধড়মড় করে উঠে বসেই কইলাে, “কী ঠাকুর! এঃ, এ যে বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে? সেই শয়তানীর কিছু খবর এল বাবাঠাকুর?”
কালীপদ উদাস স্বরেই বললে, “সে হতভাগী চিরতরে শেষ হয়েচে ভীম। কিন্তু অপরটিকে যে কি করে মারি কিছুতেই মাথায় আসছে না। তা, সে দেখা যাবেন। কিন্তু এখন তাে বিকেল নয় ভীম। সবে সকাল হয়েছে। তুমি হঠাৎ বিকেল ভাবলে কেন?”
বৃদ্ধ লজ্জিত ভাবে উত্তর দিলাে, মাপ করবেন ঠাকুরমশায়। জ্বরের ঘােরে ঘুম থেকে উঠেচি তাে, তাই ঠাহর হয়নি ঠিক। তার উপরে আজ বাইরে এত লােক হৈ হল্লা করছে, এমনটি তাে অন্যদিনে সকালে সাধারণত হয় না। বিকেলের দিকে তাও হয়। তাই আর কি….
কালীগুণীন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখে আকাশ পাতাল ভেবে সূদনের বধােপায় চিন্তা করছিলাে। বৃদ্ধের এই কথাটি কানে যেতেই শরবিদ্ধ হরিণের ন্যায় লাফিয়ে উঠলাে। উচ্ছ্বাস বিহুল স্বরে বলে উঠলাে, “তাইতাে ভীম সর্দার। তাইতাে! আমার মাথায় আগে কেন এল না!”
কালীপদ অনেকগুলি লােকজনকে ডেকে কইলাে, “আজ ত্রয়ােদশী। আমি আগামী পরস্য অমাবস্যার রাতে ভবাণীর পূজা করে ঐ পিশাচের বধের অস্ত্র তৈয়ার করবাে। তােমরা আয়ােজন করাে। আমার সঙ্গে কয়েকজন চলাে। নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ ধ্যান করে আমি নদীর থেকে জল আনবাে। সেই জলকে মন্ত্রপূতঃ করবাে।
এই কয়ে চারজন প্রজাকে নিয়ে নদীর দিকে চললাে।
**********
ভােরের থেকে বেলা গড়ালেও ক্ষণা ফিরলাে না দেখে সূদন তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাে, তা গাঁয়ের একস্থানে মানুষের জটলা দেখে অদৃশ্য ভাবে পাশে দাঁড়িয়ে সে শুনতে পেলাে কি ভয়ানক চালাকি করে হতভাগা গুণীন তার জুড়িদারকে বধ করেছে। শ্রবণমাত্র সূদনের পিশাচচক্ষু দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরুলাে। সে উপস্থিত সবকয়টি মানুষকেই একযােগে হনন করার মানসে এক সজোরে ফু দিলাে, কিন্তু সেই ফুৎকার একটি মানুষকেও স্থানচ্যুত করতে পারলাে না। কালীপদ প্রতিটি প্রজার কণ্ঠে মন্তরপড়া মাদুলী পরিয়ে দিয়েছে। ক্ষোভে পাগল হয়ে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ তার চোখে পড়ল জনা চারেক লােক নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েচে। আরও একটু এগিয়ে তার চোখ থেকে পুনরায় ফুলকি ছুটতে লাগল।
শয়তান গুণীনটা একা একা নদীতে জল ভরতে নেমেছে। সূদনের পক্ষে এর থেকে সুবর্ণ সুযােগ আর হবে না। সে নিঃসাড়ে এক পাশ দিয়ে জলে নেমে ডুব দিলে, আর মগ্ন হওয়ামাত্র সে পরিণত হল এক ভয়ঙ্কর দর্শন কুম্ভীরে। কালনেমির ছদ্মরূপের মতাে ভয়ালদংষ্ট্রা সেই জীব অতি নিঃশব্দে এগিয়ে চললাে কালীপদকে লক্ষ্যস্থির করে। গুণীন অপর দিকে ফিরে জলপূর্ণ ঘট হাতে নিয়ে চক্ষু মুদ্রিত করে স্তব করচে। একদম এক হাতের নাগালে পৌঁছে জলরাশিকে ভীষণভাবে আলােড়িত করে এক মানুষ সমান করাল। মুখব্যাদ্যান করে কালীপদকে গিলতে গেল সেই ভয়াল জন্তু, আর মুহূর্তের মধ্যে ধুর্ত গুণীন বিদ্যুৎবেগে পিছন ফিরে নিজের তর্জনী স্পর্শ করিয়ে দিলাে কুম্ভীরের চোয়ালে।
চিড়চিড় করে একটা শব্দ হওয়ার সাথে সাথে সেই চারজন প্ৰজা দেখলাে নদীর পাড়ের মাটিতে পড়ে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্চে সূদন ওঝার অশরীরী। সেই কাতরাতে থাকা প্রেতের দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর কণ্ঠে কালীগুণীন কইলাে,
-“আজ ত্রয়ােদশী তিথির দ্বিপ্রহর। তুই এখন আগামী তিন দিন একটানা অচৈতন্য রইবি। আমি আগামী পরশু অমাবস্যার মধ্যরাতে চন্ডীর পূজা করে তােকে বধ করবাে। অচেতন অবস্থাতেই মৃত্যু হবে তাের। এই পূজায় আমাকে নিজের সমস্ত তন্ত্রশক্তি ত্যাগ করে একজন সাধারণ মানুষ হয়ে বসতে হবে। সে সময়ে তুই পাপাত্মা যাতে অনিষ্ট না ঘটাতে পারিস, তাই তােকে অচল করা প্রয়ােজন ছিল। এই নিদ্রা তাের আর ভাঙবে না। তােমরা সবাই পূজার আয়ােজন করাে।”
সূদন অজ্ঞান হতে হতেও বাতাসে মিলিয়ে গেল।
**********
আজ অমাবস্যা তিথি। সকাল থেকেই পূজার তােড়জোড়ে ব্যস্ত গাঁয়ের লােক। চন্ডীর মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণে। বাইরের দিকে। আলাদা করে মােটা পাটের দড়ির কড়ি তৈরি করে হােগলাপাতার ছাদের একখানি নিচ্ছিদ্র মন্ডপ বানানাে হয়েছে। এখানে পূজার পূর্বে কালীপদ ধ্যানে বসবে।
কিন্তু গুণীনের হিসেবে একটি মারাত্মক ভূল ছিল। নির্ধারিত সময়ের আগেই এক দুপুরে সূদনের মগ্নচৈতন্য ফিরে এল। সে ধড়মড় করে উঠে বসেই হাজির হল কমলেশের গৃহের নিকটে। অনেক লােকজন পূজার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ভারে ভারে দৈ মিষ্টান্ন আসচে। ফুল, সুগন্ধির ছড়াছড়ি। কেউ, এমনকি খােদ কালীপদ অবধি ঘুণাক্ষরে টের পেলে না যে সাক্ষাৎ শমন আজকেই জেগে উঠেছে।
সূদন একটা হিংস্র নিঃশ্বাস ফেললাে।
আজ অমাবস্যা!
আজ বড়াে সুযােগ।
প্রথমতঃ আজ চাঁদের আলাে রইবে না, ফলে আজ পুরাে দিন ও রাত সে অষ্টপ্রহর সময় পাবে। আর দ্বিতীয়তঃ আজ লােকমুখেও সে শুনেচে যে অমাবস্যার রাতে পূজার আগে ঐ পাষণ্ড গুণীন নিজের সব দৈবশক্তি সাময়িক ভাবে ত্যাগ করবে। অপেক্ষা করতে হবে সেই মহা ক্ষণের। আজ তার ক্ষণার হত্যাকারীর শেষ দিন।
**********
সন্ধ্যার একটু আগেই কালীপদ প্রবেশ করল সেই নিচ্ছিদ্র সাধনা মন্ডপে। বাইরে প্রহরায় থাকলাে ভীম আর শিবরাম। পাহারার কারণ সূদন নয়, বরং যাতে কোনও প্রজা হঠাৎ ঢুকে না পড়ে। সূদনের আসা সম্ভব নয় নিশ্চিত হয়েই আজ কালীপদ সাধনক্ষেত্রের বাইরে বন্ধনও করেনি। ভবাণীর পূজা হােক আর যাই হােক, চাদের আলাে ছাড়া ত্রিজগতের আর কোনও কিছুতেই তার বধ সম্ভব নয়। কালীপদর ক্ষমতা নাই অমাবস্যায় মন্ত্রবলে চাঁদ ফোটানাে। তাই, কালীগুণীনের ঠিক পিছনে সে ঘাপটি মেরে ওৎ পেতে রইলাে।
কালীপদ অনেকক্ষণ যাবৎ নানান মন্ত্রোচ্চারণের পরে নিজের গলা ও হাতের সবকয়টি তাগা, তাবিজ, মাদুলী খুলে মাটিতে রাখলাে। মহাচতুর সূদন প্রথমে ভেবেছিলাে হয়তাে এসবই কালীগুণীনের ভড়ং বা মিথ্যাচার, কিন্তু সত্য সত্যই সে দেখলাে গুণীনের দেহের থেকে পুঞ্জীভূত শক্তিরাশি বেরিয়ে আসছে, আর তা প্রবেশ করচে ঐ মালা, মাদুলীর মধ্যে। সূদন মানুষ নয়, পিশাচ। সে নিজের সহজাত ক্ষমতা দ্বারা বুঝতে পারলাে যে সত্যই কালীপদ এখন একজন অতি সাধারণ মনুষ্য বিশেষ। এর অধিক কোনও শক্তিই এখন তার আর নাই।
ধ্যান শেষে কালীপদ যখন উঠে দাঁড়াতে যাবে, সেই মুহূর্তে সূদন এসে তার পিঠে নিজের লােমশ পা দিয়ে সজোরে পদাঘাত করল। কালীপদ ছিটকে চার পাঁচ হাত দূরে গিয়ে পড়ল। সূদন চকিতের মধ্যে সেই মন্ত্রবিষ্ট বস্তুগুলি এক টানে ছিনিয়ে নিয়ে অট্টহাসি হেসে উঠলাে। কালীপদ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলাে,
-“শয়তান…
বাইরে ভীম আর শিবরাম সাধনাক্ষেত্র রক্ষায় নিযুক্ত ছিল। তারা কালীপদর শেখানাে সঙ্কেত ধ্বনি শােনা মাত্র চালার আড়ার কড়ি রূপে ব্যাবহৃত পাটের দড়ি ধরে মারলাে এক টান। হুড়মুড় করে হােগলাপাতার পলকা চালা ভেঙে পড়ল, আর সূদন আকাশের দিকে তাকিয়ে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে দেখলাে সেইখেনে এই অমাবস্যার রাতেও জ্বলজ্বল করচে ক্ষয়াটে হয়ে আসা চন্দ্রদেব।
ভয়ংকর আর্তনাদ করতে করতে দাপাতে লাগল আর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করল। মন্ডপের বাইরে শতশত লােক হাঁ করে দেখলাে সূদনের অমন অপরাজেয় প্রেত ধীরে ধীরে বিন্দুবিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল, আর ধপ করে মাটিতে এসে পড়ল একখানি অদ্ভুতদর্শন তামার তৈরি বর্ম।
**********
পরদিন সকালে কালীপদকে ইস্টিশানে এগিয়ে দিতে একটি ছােটোখাটো বরযাত্রীর সমান ভিড় হয়েছিলাে। কৃতজ্ঞ কমলেশের প্রশ্নের জবাবে কালীগুণীন কইলাে,
-“ভীমকে ডাকতে এসে যখন দেখলুম, সে নিদ্রাজনিত জড়তার হেতু দিন ও রাত গুলিয়ে ফেলেছে, তখনই আমার মাথায় এল যে তাইতাে! এমনটি তাে আমাদেরও মাঝে মধ্যে হয়। আসলে নিদ্রা থেকে জাগার পর অনেকক্ষণ আমাদের বুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ হয় না। তখন তাকে যা উপস্থাপিত করা হয়, সে সেইটেই বিশ্বাস করতে থাকে। আমি সূদনের অজ্ঞান হবার আগে তাকে শুনিয়েছিলাম যে অমাবস্যাতেই আমি যজ্ঞে বসবাে। আমার অচৈতন্য করার দৌড় ওই একটি দিন অবধিই সীমিত, তা ভীম জানে। আমি জানতুম ওর জ্ঞান চতুর্দশীর দিনেই ফিরে আসবে এবং ফিরলেই সে গাঁয়ে হানা দেবে, তাই লােকজনকে শিখিয়ে রেখেছিলাম তারা যেন সারাদিন ধরেই অমাবস্যা আর পূজা নিয়েই নিজেদের মধ্যে আলােচনা করে। ফলে সূদন সেসব শুনে আর পূজার আয়ােজন দেখে সত্যিই ধরে নেয় যে কাল অমাবস্যাই ছিল। চেষ্টা করলে এইরকম বিভ্রান্তি তৈরি করাই যায়। দশচক্রে ভগবান ভূত আর কি। আমি শক্তি ত্যাগ করবাে জেনে সে আমার পিছনে পিছনেই ঘুরছিলাে, তা আগেই টের পেয়েছিলাম। আমি চাঁদ ওঠার আগেই মন্ডপে ঢুকে পড়ি, সঙ্গে সূদনও। মন্ডপের ভিতরে থাকায় ও চাঁদ ওঠার সময়ে টের পায়নি। এইবার আর কোনও ভয় নাই।”
***********
পৌষের সকালের নরম রৌদ্রে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেই রেলগাড়ি চলে এল। ভীম সর্দার কালীপদর কানের কাছে মুখ এনে কইলাে,
-“কী হে ঠাকুর, এইটেও আবার সত্যিকারের রেলগাড়িই তাে?” কালীপদ মন খুলে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলাে।
-সমাপ্ত-