চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ – শিকার-ভ্রষ্ট শার্দ্দূল
নবমীর বলিদান শেষ হইয়া গেলে রাঘব সেনের আত্মীয়বর্গ একত্রিত হইয়া রুধিরাক্ত কদম মাখিয়া বাদ্যসহ নৃত্য করিতে করিতে গঙ্গাস্নানে গমন করিলে পূজাবাড়ী ক্ষণকালের জন্য জনতাশূন্য ও নিস্তব্ধ হইল। এই সময়ে অতিকায় রাঘব সেন নিভৃত বৈঠকখানায় শিকার-ভ্রষ্ট শার্দুলের ন্যায় ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করিয়া ইতস্তত বিচরণ করিতেছিল; ভাবিতেছিল, “জুলিয়া কি প্রকারে পলাইল, কে তাহার উদ্ধার সাধন করিল? বাগানের সুড়ঙ্গপথ তিন-চারি জন ব্যতীত আর ত কেহই জানে না; যাহারা জানে, তাহারাও ত কেহ কল্য রাত্রে এখানে ছিল না; ক্ষুদে একবার আসিয়াছিল বটে, কিন্তু সে-ও ত তৎক্ষণাৎ গুদামের চাবি লইয়া চলিয়া গিয়াছিল; আমি স্বহস্তে সুড়ঙ্গদ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছিলাম, তবে সে কেমন করিয়া বাহির হইয়া গেল? আমি কেন না তাহাকে হত্যা করিলাম! যাক, সে কুহকিনী মুসলমানী, যথা ইচ্ছা যাক, সে আমার কি করিতে পারিবে?”
রাঘব এইরূপ চিন্তা করিতেছে, এমন সময়ে রতন শর্ম্মা একটি বাক্স লইয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “এই লও সেনজা, দেওয়ানের সেই গহনার বাক্স লও; আমি তোমার মুক্তির পথও পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছি। আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হইল, আমার পাপব্রত উদযাপন হইল, এখন আমি চলিলাম, তুমি আর আমার দেখা পাইবে না।”
এই বলিয়া সে প্রস্থান করিল, রাঘব সেন অনেকবার তাহাকে ডাকিল, সে উত্তর দিল না, আর ফিরিল না।
পরক্ষণেই দারোগা ফতেউল্লা আসিয়া উপস্থিত হইল। রাঘব তাহাকে একখানি স্বতন্ত্র আসন নির্দ্দেশ করিয়া সংবাদ জিজ্ঞাসিলে, দারোগা উত্তর করিল, “সব ঠিক করিয়া দিয়াছি, মশাই; আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, হুগলীর ফৌজদার এই সকালবেলা আসিয়াছিল, তেনার সামনে তামাম বামাল ধরা পড়িয়াছে, ভীম সর্দ্দার আর টিকারাম তেওয়ারীও গ্রেপ্তার হইয়াছে।”
রাঘব। আর দেওয়ান?
দারোগা। সে বেটা শ্বশুরকে সাথে নিয়ে কলিকাতায় গেছে।
রা। তাকে ধরতে পারনি, অ্যাঁ?
দা। সেজন্য ভাবনা কি মশাই, আমি এখনই গিয়া তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসছি।
রা। তার দেখা পাবে কোথা?
দা। কেন মশাই, আমি খবর পেয়েছি, সে বিশ্বনাথ ঘোষের কাছে ফৌজদারীতে নালিশ করতে গেছে। সেখানে যাব, আর তাকে গ্রেপ্তার করব—এই আমার হাতে পরওয়ানা রয়েছে, এখন মশাই, আমি চললেম।
রা। বেলাটা অনেক হয়েছে, কিছু খেয়ে গেলে হত না?
দা। না মশাই, সেলাম, আর দেরি করতে পারব না।
দারোগা চলিয়া গেলে রাঘব সেন যেন কতকটা শান্তিলাভ করিয়া অন্তঃপুরে প্রস্থান করিল।