চতুষ্পাঠী – ৯

নয়

—ও নাতনি, নাতনি গো, আমার টোলে ভর্তি হইবা?

—ধুৎ, অনঙ্গমোহনের প্রস্তাবে স্বপ্না বিব্রত। ভাবছে ঠাট্টা।

ধুত্তেরি ক্যান? তোমার নাম লিখলাম খাতার মইধ্যে। মাঝে মাঝে সময় পাইলে বইসো।

আমি তো মেয়ে। আমি আবার কী পড়ব?

—ওমা। বোকার মত কথা কও সোনা। মেয়েরা পড়ে না নাকি? খনা লীলাবতী, গার্গী…সুমিতা।

—ওরা সব ভাল মেয়ে দাদু, আমি বোলে ফেল করি। নিজের ইস্কুলের পরীক্ষাতেই পাস করতে পারি না…

-পারবা। এই পরীক্ষায় পাস করতে পারবা। তুমি আইজ থিকা ভরতি হইলা।

—না দাদু না, আমার স্যান্‌সকৃট ভাল লাগে না।

—ভাল লাগে না? না লাগুক গিয়া, তুই আমারে বাঁচাইবার লাইগা ভর্তি হ। তোর নাম থাক। পূজার পর পরিদর্শক আইবে। টোল পরিদর্শক। অন্তত পাঁচজন ছাত্র না দেখাইতে পারলে এই টোলের আর অনুমোদন থাকব না গো সোনা। তুই ভর্তি হ।

—স্বপ্না মাদুরের কাঠিগুলোর উপর হাত বুলোতে থাকে। অনঙ্গমোহন লাল খাতাটা বার করেন।

বড় বড় করে লেখা পূর্ণানন্দ চতুষ্পাঠী। তারপর ছোট করে—সকল বিভবসিদ্ধৈপাতু বাগদেবতা নঃ। ছাত্র তালিকা।

১। শ্রীমতী সুমিতা দত্ত। কাব্য-উপাধি পরীক্ষার্থিনী।

২। শ্রী অসীম চক্রবর্তী। ব্যাকরণের আদ্য। পরীক্ষার্থী।

৩। শ্রী বিপ্লব ভট্টাচার্য। ব্যাকরণের আদ্য।

৪। শ্রী জীবন মজুমদার। ব্যাকরণের আদ্য।

পাঁচ নম্বরে শ্রীমতী স্বপ্না ভট্টাচার্যের নাম লিখলেন অনঙ্গমোহন। চোখ বুজে বিড়বিড় করলেন—ওঁ গং গণপতায় বর বরদ। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এইবার আমাকে প্রণাম কর। স্বপ্না সুন্দর করে প্রণাম করল। স্বপ্নার ফ্রকের পিঠের ছিঁড়ে যাওয়া অংশটা দেখে চোখ বুজলেন অনঙ্গমোহন। স্বপ্না প্রণাম শেষে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—ইশ, কতদিন পর ভাল করে প্রণাম করলাম তোমাকে।

অনঙ্গমোহন ভাবলেন, এবার জীবন ডাক্তারকে আর একবার অনুরোধ করবেন। দু’মাস হয়ে গেল, আসছে না।

সেদিন চেম্বারে গিয়েছিলেন। জীবন ডাক্তার বলেছে—এখন দেশ বিপন্ন। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, তার উপর সীমান্তে চীনা সৈন্য সমাবেশ। এখন কি সংস্কৃত পড়ার সময়?

এখন জীবন মজুমদারের চেম্বারে গিয়ে অনঙ্গমোহন দেখলেন—একটি হাতে লেখা পোস্টার

বোমার শব্দে যদি চমকান
ক্যাম্ফর থার্টি তক্ষুণি খান।
আঘাত যদি পান, বোমার কারণ
সঙ্গে সঙ্গে করুন আর্ণিকা গ্ৰহণ
দেশ মায়ের আহ্বান
প্রতিরক্ষায় করুন দান।

অনঙ্গমোহন দরজা ঠেলে উঁকি দিলেন। জীবন ডাক্তার বললেন, বাইরে বসুন। অনঙ্গমোহন তাঁর মাথাটা বাইরে টেনে আনলেন। মাথাটা বেশ ভারী মনে হল। ঘাড়কে মনে হল গ্রীবা। একটু পরে টিং টিং। ভিতর থেকে ডাক—পণ্ডিতমশাই আসুন। টিং টিং। অনঙ্গমোহন ভিতরে গেলেন। জীবন ডাক্তার বললেন, কী ব্যাপার? অনঙ্গমোহন বললেন—তেইশ সেপ্টেম্বর সকাল হইতে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি হইছে। এবার টোলে আসবা?—এখন হবে না পণ্ডিতমশাই। পাবলিকওয়ার্কে বড় জড়িয়ে গেছি। কাউকে বলবেন না। করপোরেশনে ইলেকশানে দাঁড়াতে বলছে আমাকে…আশীর্বাদ করবেন, অ্যাঁ?

অনঙ্গমোহনের উচিত, জীবন মজুমদার নামটা কেটে দেওয়া। অথচ পরিদর্শক আসবেন। পূজার পর যে কোনোদিন আসতে পারেন। কোনদিন আসবেন তা সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদে গেলে হয়তো জানতে পারবেন। সেই দিনটা অন্তত জীবন মজুমদার যদি থাকে।…পৃথকভাবে অনুরোধ করবেন অনঙ্গমোহন।

অনেকের টোলেই খাতা ভরা নাম। বেশিরভাগই কাল্পনিক নাম। পরিদর্শক যে দিন আসবেন সেদিন সব ছাত্র থাকবেই এমন কোনো কথা নেই। অনঙ্গমোহন এইসব পারবেন ন। ঐ খাতায় দশ-বারটা মিথ্যা নাম ঢুকিয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

খালপাড়ে গুলি খেলারত অসীম এবং বিলুকে ডাকলেন অনঙ্গমোহন।

—শুন। কথা আছে।

—অসীম তখন বিলুকে খাটাচ্ছিল। পাঁচ এ প্যাচা। ছয়ে ছ্যাঁচোর।

—শুন তোমরা। কথা আছে।

ওরা খেলা থামিয়ে সামনে দাঁড়ায়।

অনঙ্গমোহন বলেন, তোমরা তো পাড়ায় পাড়ায় টো টো কইরা বেড়াও। দু-চাইর জনরে বুঝাইয়া আনতে পার না?

কোথায় আনব? বিলু জিজ্ঞাসা করে।

আমার টোলে।

—একথা বলেই মরমে মরে গেলেন অনঙ্গমোহন। কথাটা এমন করে বলা হল যেন কোনো কুটনীকে বলা হচ্ছে, রাজ অন্তঃপুরের জন্য নবযৌবনা নারী সংগ্রহ করার জন্য।

—আমরা কোত্থেকে লোক ধরব?

—না ঠিক এইভাবে ধইর না আমার কথাটা। লোক ধরবা ক্যান? তোমরা কি গয়ার পাণ্ডা? আসলে আমার কওয়ার উদ্দেশ্য—অনেকে আছে সংস্কৃত শিখতে চায় কিন্তু আচার্যের সন্ধান পাইতেছে না। তাদের আচার্যের সন্ধান দিতে পার তোমরা, আমার কাছে লইয়া আসবা। বলবা, সংস্কৃত শিক্ষা করতে পয়সা লাগে না। অবৈতনিক। বোঝলা না?

ওরা ঘাড় নাড়িয়ে চলে যায়। সাতে সাত ছেলের বাপ বানাবার জন্য গুলি টিপ করে অসীম। বৌমাকেও বলবেন নাকি অনঙ্গমোহন। যশবাবু লোকটি তো ভালই। বৌমাকে যদি বলা যায় তার অফিসের কেউ সংস্কৃতপ্রেমী আছে কি না? তার কপালের কুঞ্চনকে বড় ভয় অনঙ্গমোহনের। কথাগুলিও আজকাল বড় বক্রী। শান্তস্বভাবের বৌমা চোখের সামনে ক্রমশ ক্রূরা হয়ে উঠছে। এইসব বাইরে বের হবার ফল। মনুকে যতই সমালোচনা করা হোক না, মনুর বচন মিথ্যা নয়। গৃহবধূরা বাইরে বের হলে শৃঙ্খলা থাকে না।

চার-পাঁচ বছর আগেও এরকমটা ছিল না। পাঁচ-সাতজন ছাত্র সর্বদাই থাকত। তিন-চারজন প্রতি বছরই পরীক্ষা দিত। গত বছর পরীক্ষা দেবার কেউ ছিল না বলে অসীমকে গত বছর পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। অসীম বলেছিল—আমি তো শিওর ফেল করব পিসামশয়। অনঙ্গমোহন বলেছিলেন, হ। তুই নিশ্চিত ফেল করবি। পাস-ফেল গুরুত্বহীন। এইটা তোর আমার জীবনধারণের প্রশ্ন। তুই ফেল কইর্যাই আমারে বাঁচা। অসীম মুখ বুজে পরীক্ষা দিয়েছিল। চুপচাপ ফেল করে এসেছিল।

এই বছর দুইজন পরীক্ষা দেবে ভাবা গিয়েছিল। অসীমকে কিছুটা পড়িয়েছেন অনঙ্গমোহন। এ বছর আদ্য পরীক্ষা দেবার কথা। আর সুমিতা। সুমিতার কথা ছিল উপাধি পরীক্ষা দেবার।

সুমিতা আসে না।

সুমিতা আসেনি দিন দশেক হয়ে গেল। ঐ ঘটনার পর আসেনি সুমিতা। বড় লজ্জা পেয়েছে ও। অজিতবাবুকে জিজ্ঞাসা করবেন কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না অনঙ্গমোহন। যেন সেই প্রবাদ বাক্যের দেখন্তির লাজ। অজিতবাবুর মোকাসিন জুতোর মসমস তো কমেনি একটুকুও। গত দিনও ঐ ঘরে ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান’ হল। সুমিতা আসেনি। গত রাতে অজিতবাবুর স্ত্রীর কান্না শুনেছেন বারান্দা থেকে। অসীম ঠেলা মেরে ডেকেছিল—পিসেমশাই। ঐ শোনেন—শিখার মা কাঁদে। চাপা আওয়াজ শুনেছিলেন অনঙ্গমোহন। প্রথমে ভেবেছিলেন, দাম্পত্যশব্দ। পরেই মনে হল, কান্না চেপে রাখার প্রচেষ্টা। তারপরই অজিতবাবুর কণ্ঠ। বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর জয়া, তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না। তুমি যা বলবে…

ফলমূলাদি দান করিয়া বালিকাকে, রতিযোগে তরুণীকে, প্রেমবাক্য দ্বারা প্রৌঢ়াকে বশীভূত করা যায়…

শোন জয়া, বিশ্বাস কর, তোমার কাছে গোপন করার কিচ্ছুটি নেই।

কোন গোপন ব্যাপার নিয়ে এত গণ্ডগোল? যে গোপন ব্যাপার অনঙ্গমোহন দেখেছিলেন সেই ঘটনা তো কেউ জানে না। কাকপক্ষীকেও বলেননি অনঙ্গমোহন। তখন, অন্যের দাম্পত্যসংলাপ শ্রবণ করা সমীচীন নয়, এই বিবেচনায় প্রস্রাব করে আবার শুয়ে পড়েছিলেন অনঙ্গমোহন।

আজ অনেক ভাবনার পর একটা মীমাংসায় এলেন অনঙ্গমোহন। উনি নির্বিকল্প নির্বিকারভাবে অজিতবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন—আইচ্ছা, সুমিতা আসে না কেন, কিছু জানেন?

আসে না বুঝি?

না।

আমার গানের ক্লাসেও আসেনি।

শরীর অসুস্থ হইল নাকি?

কে জানে?

ঠিকানাটা জানেন নাকি?

অজিতবাবু একটু গলার জোড় বাড়ালেন। কার ঠিকানা—সুমিতার? ঠিকানা তো নেই। ছিল, হারিয়ে-টারিয়ে গেছে। রান্নাঘরে অজিতবাবুর স্ত্রী আছেন। রান্নাঘর থেকে ঐ ঠিকানা না থাকার বাক্যরচনা কি উনি শুনতে পাবেন?

অনঙ্গমোহনের কাছেও ঠিকানা ছিল। কাব্যের আদ্য এবং মধ্য পরীক্ষা দিয়েছে। আজ চার বছর যাবৎ সংস্কৃত শিক্ষা করছে সুমিতা। পরীক্ষার সময় ঠিকানার দরকার হয়। কোথাও লেখা আছে নিশ্চয়ই। খুঁজতে থাকেন। একটা ১৯৫৭ সালের ডায়েরি ছিল, যার মধ্যে যাবতীয় ঠিকানা লেখা। হরি ঘোষ স্ট্রিটে থাকে সুমিতা, এটা জানেন অনঙ্গমোহন। কিন্তু ঐ ডায়েরিতে পেলেন না। বছর চারেক আগে একটি কাগজে একটি ছন্দোবদ্ধ ঠিকানা দিয়েছিল সুমিতা। কোনো একটা বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন অনঙ্গমোহন। কোন বই মনে পড়ছে না কিছুতেই। পরীক্ষার ফর্ম পূরণ তো সুমিতা নিজেই করত ইংরাজি ভাষায়। বইগুলির পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকেন অনঙ্গমোহন। অবশেষে শ্রীহর্ষ রচিত ‘নৈষধ’ চরিত বইটির মধ্যে ঠিকানাটা পেয়ে গেলেন অনঙ্গমোহন-

‘আমার ঠিকানা যদি কভু চাহ কেহ
হরিঘোষ স্ট্রীটস্থ একুশ নম্বর গৃহ।’

ঠিকানা তো পাওয়া গেল। এবার প্রশ্ন সুমিতার বাড়ি যাওয়া উচিত কি না। গত চার বছরে সুমিতা কখনই তেমনভাবে তার গৃহে নিমন্ত্রণ করেনি। কয়েকবার বলেছে পণ্ডিতমশাই, আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাব। আমার বোনেদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। মা খুব খুশি হবেন। সুমিতা পিতৃহীনা। তবে সম্পত্তির আয়ে তাদের চলে—এই কথা অনঙ্গমোহন জানেন।

অনঙ্গমোহন স্থির করেন সুমিতার বাড়িতেই যাবেন। বয়ঃপ্রাপ্তা নারীর কামবাসনা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। সংস্কৃত সাহিত্যে নারীর কামবাসনার দৃষ্টান্ত তো অজস্র। তবু কেন সুমিতার কথা মনে হতেই পাপিষ্ঠা শব্দটি মনে আসে? কেন স্খলিতা শব্দটি মনে আসে? পরপত্নী সম্ভোগার্থে দেবরাজ ইন্দ্রের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। শুধু ইন্দ্ৰ কেন, বরুণ, বায়ু অনেকেই। তাদের তো পাপিষ্ঠ বলি না। ক্যান? সে দিন ঐ নিষ্প্রদীপ অন্ধকারে কী হয়েছিল? কালিকা পুরাণের কপোতমুনি যেমন বলেছিলেন—সুন্দরী! তোমাকে দর্শন করিয়া অবধি তোমার সম্ভোগের নিমিত্ত কাম আমাতে সঙ্গত হইয়া নিরন্তর পীড়া দিতেছে তার উপশম কর।

তারপরই কি ‘ইঃ, জর্দার গন্ধ?’

তাই কি? সুমিতা কি পড়েনি কামের বিচিত্রলীলা। হে বিশালাক্ষ্মী, দেখ দেখ ঐ চটকপক্ষী নিজ প্রিয়ার উৎসঙ্গে থাকিয়া পুনঃ পুনঃ রমণ দ্বারা কামীদিগকে উৎকণ্ঠিত করিতেছে। ঐ দেখ মাংসস্বাদ তৃপ্ত সিংহ নিজ প্রিয়াকে পুনঃ পুনঃ লেহন করিতেছে এবং স্বয়ং প্রিয়া কর্তৃক লিহ্যমান হইয়া প্রীতি অনুভব করিতেছে। ঐ দেখ, মার্জারী ভূমিতে লুণ্ঠিত হইয়া স্বীয় উদর প্রদর্শন করিতেছে আর মার্জার তাহাকে নখদন্তে দংশন করিতেছে বটে কিন্তু মার্জারীর তাহাতে সুখ জন্মিতেছে।

সুমিতা তো ত্রিংশতি বর্ষীয়া অনূঢ়া নারী।

কিন্তু সতী ধর্ম? সতী ধর্ম তো হিন্দু আদর্শ। ম্লেচ্ছ জীবনধর্মে সতীত্বের এতটা মূল্য নাই। কন্দর্প—মদন কথা পড়তে পারে, রতিবর্ণনা পড়তে পারে কিন্তু সতীত্ব ধর্ম থেকে বিচলিত হওয়া তো চলবে না। সুমিতার এটা অন্যায়।

কিন্তু আচার্য তো অভিভাবকতুল্য। শিক্ষাগুরু। পাঠ্যবিষয় ব্যতিরেকেও জীবনের সমস্ত শিক্ষাই তো আচার্যেরাই দেয়। এ স্থলে আচার্যের কর্তব্য কী?

আচার্য অনঙ্গমোহন স্থির করেন, সুমিতার বাড়িই যাবেন। ইনস্পেকটার আসছে সুমিতা, টোলে আস শিগগির।

অনঙ্গমোহন একটা চিঠি পেলেন খামে। ছাপা প্যাডে কামাখ্যাচরণের হস্তাক্ষর সম্বলিত চিঠি।

সর্ববিদ্যা গণনালয় ও দীনময়ী চতুষ্পাঠী।

চতুষ্পাঠী? চতুষ্পাঠী কবে করল কামাখ্যাচরণ?

কামাখ্যাচরণ চতুষ্পাঠীর অধ্যাপক? দীনময়ী তাঁর মায়ের নাম। মাতৃনামে চতুষ্পাঠী। ব্যাকরণতীর্থ তো আছে, চালাইতেই পারে। কিন্তু অনুমোদন? নতুন চতুষ্পাঠীর অনুমোদন তো বন্ধ আছে কিছুকাল যাবৎ। রাজদ্বারে জানাশোনা থাকলে সকলি সম্ভব। আর গণনালয়? জ্যোতিষশাস্ত্রের উপাধি তো কিছু নাই তার। তবে দেশের সত্যই তো দুর্দিন। অনায়কা বিনশ্যান্তি নস্যান্তি শিশুনায়কঃ। সুতরাং অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি।

আবার পড়তে থাকেন অনঙ্গমোহন।

সর্ববিদ্যা গণনালয় ও দীনময়ী চতুষ্পাঠী।

গুপ্তপ্রেস ও বিদ্যানিধি প্রভৃতি পঞ্জিকার অনুমোদক। সিদ্ধপুরুষ সর্বানন্দ বংশীয় মহামহাধ্যাপক শ্রীপঞ্চানন ন্যায়ভূষণের প্রপৌত্র শ্রীকামাখ্যাচরণ চক্রবর্তী ব্যাকরণতীর্থ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী। মতিলাল কলোনী। ২৪ পরগণা। প্রকাশিত গ্রন্থ ভগবান্নামশতক। অপ্রকাশিত গ্রন্থ স্ত্রী চরিত্র। নীতিকথা। ধ্যানমালা। সেবক—মতিলাল কলোনীর প্রসিদ্ধ সর্ববিদ্যা শ্রীশ্রীকালীমন্দির। এখানে সুলভে কোষ্ঠি, ঠিকুজি প্রস্তুত, যোটক বিচার, প্রশ্নগণনা, স্বপ্নফল বিচার, কবচ সংস্কার হইয়া থাকে। মণি ও মূল ধারণ সম্পর্কে পরামর্শদান ও গ্রহশান্তির জন্য পূজা ও স্বস্তায়নাদি করা হয়।

এরপর চিঠি। সাদর সম্ভাষণমাবেদনমিদম। পূজা কমিটির সহিত সবিশেষ কথা কহিয়া রাখিয়াছি। তুমি নিশ্চিত আসিও। আমার স্বহস্ত লিখিত পাতি ছাড়াও পুরোহিত-দর্পণ মদগৃহে আছে। পঞ্চাশাবধি টাকা দক্ষিণা দিতে হইবে এই মর্মে সেক্রেটারির সহিত কথা কহিয়া রাখিয়াছি। ইতি। ত্বদেক শমশৰ্মণঃ কামাখ্যাচরণ দেবশর্মণঃ।

কামাখ্যা। তুমি জ্যোতিষও ধরলা। তুমি তো ব্যাকরণ পড়ছ। পাণিনির ঘটনা মনে নাই? তার হাতে ভাগ্যরেখাই ছিল না। জ্যোতিষী কইল পাণিনি, তোমার জীবনে কিচ্ছু হইবে না। তুমি নির্বুদ্ধি, ভাইগ্যহীন।

জ্যোতিষবিদ্যা ঠিক না বেঠিক অনঙ্গমোহন জানেন না। তবে জানেন, চাঁদে মানুষ গেছে। মঙ্গলের ছবি আসছে পৃথিবীতে। রাহু আর কেতুর অস্তিত্ব নেই। এই যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এত লোক মারা যাচ্ছে তাদের সবারই কি মৃত্যুযোগ এই সময়ে ছিল? সুমিতার ঘর্মাক্ত হাতে একদিন অনঙ্গমোহন লক্ষ করেছিলেন, বাল্যবৈধব্য রেখা। তবে কি ভৃগু পরাশর জৈমিনী মিথ্যা? ঋষিবচন মিথ্যা? মিথ্যা ভাবতে সংস্কারে বাধে ব্রাহ্মণসন্তান অনঙ্গমোহনের। তবে ভৃগু-পরাশর-জৈমিনী কারুর সঙ্গেই কারু মিল নেই, একথা অনঙ্গমোহন জানেন। সুতরাং সিদ্ধান্ত এই, জ্যোতিষ বড় জটিল বস্তু। উত্তম জ্ঞান না থাকলে, অপাদান শুদ্ধি না থাকলে জ্যোতিষচর্চা করা উচিত নয়। কামাখ্যা যা করছে তা অর্থের জন্য। অর্থের জন্য এত দুঃখ।

অর্থানামৰ্জ্জনে দুঃখ মর্জ্জিতানাঞ্চ রক্ষণে

নাশে দুঃখং ব্যয়ে দুঃখং কিমর্থং দুঃখভাজনম্।

অর্থ অর্জনেও দুঃখ, অর্জিত অর্থের রক্ষণাবেক্ষণেও দুঃখ। নাশে দুঃখ, ব্যয়ে দুঃখ।

কামাখ্যা তুমি এখন অধম। ধনলোভী। অধমা ধনমিচ্ছন্তি। মানোহি মহতাং ধনং। মানীলোকের সম্মানই ধন।

অনঙ্গ, এই যে বড় বড় কথা কও, উচ্চমার্গের চিন্তা কর, প্যাটে দিবা কী? যাবন্মুখংগতং পিণ্ডং তাবন্মধুরভাষণং। যতক্ষণ খাদ্য, ততক্ষণ মধুর মধুর কথা। সুতরাং মীমাংসা এই—ভো ভো—পাষণ্ড। তুই ছাত্রীবাড়ি যা।

ছাত্রীবাড়ি বিশাল বাড়ি। বাহির মহল—ভিতর মহল। বাহির মহলে ওয়েলকাট সেলুন প্রোঃ মধুসূদন প্রামাণিক। প্রজ্ঞা সোস্যালিস্ট পার্টির কার্যালয়, স্বস্তিকা প্রেস। প্রেসের একজনকে সুমিতা দত্তর নাম জিজ্ঞাসা করাতে বলে দিল—দোতলায়।

সরু সিঁড়ি। পলেস্তারা থেকে একটা প্রাচীন গন্ধ উঠে আসছে। কাঠের রেলিং বড় দুর্বল। কোনোমতে দোতলায় উঠলেন। দোতলার বারান্দার পাশেই বেশ কয়েকটা কয়লার ড্রাম দেখতে পেলেন অনঙ্গমোহন। আবার কয়লা। সেই কয়লার ড্রাম।

এই যে সুমিতাকে দেখেন অনঙ্গমোহন, প্রসাধনে পদ্মগন্ধা, আয়তলোচনা, শ্যামাঙ্গী, ঈষৎ ন্যুব্জ—সুরসিকা, বিদ্যাপরাত্মা, এভাবে থাকে?

লম্বা বারান্দার প্রথম ঘরে জিজ্ঞাসা করলেন অনঙ্গমোহন, সুমিতা কোন ঘরে থাকে। একজন লুঙ্গিপরা গেঞ্জি গায়ে দেওয়া লোক বেরিয়ে এল।

কোন সুমিতা? খ্যাংড়া সুমিতা না মুটকি সুমিতা?

—সুমিতা দত্ত।

—এ বাড়িতে সবাই দত্ত।

—এত ঘর প্রত্যেকেই দত্ত বংশীয়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। এগারো ঘর। তা আপনি কী জন্য এসেছেন বলুন ঠাকুরমশাই, বুঝে নেব। মনে হয়, আপনি ঘটক, তবে খ্যাংড়াদের ঘরে যান। পাঁচটা ছেড়ে দিয়ে। আমি আবার সিনেমার সিট দেখাই কি না, তাই ঠিকভাবে বললুম।

—আমায় দেইখ্যা ঘটক মনে হয়? আমি ঘটক? ঘটকালি করি?

ঐ হল আর কি। বামুনের তিন ফুঁ। শাঁখে ফুঁ, মানে পুজো করা বামুন, কানে ফুঁ মানে মন্তর দেয়া বামুন, আর উনুনে ফুঁ মানে রান্নার বামুন। এছাড়া চার নম্বর বামুন হল ঘটক। আপনি কোনটা?

—আমি অধ্যাপক

—ঐ হল আর কী। তবে মনে হচ্ছে, মোটাটার ঘরেই যাবেন। এক্কেবারে কোণার ঘর। ন’কাকার মেয়ে।

অনঙ্গমোহন লম্বা বারান্দা দিয়ে সামনে এগিয়ে যান। বারান্দার লোহার রেলিং-এর উপর শুকোচ্ছে লুঙ্গি, জামা, শাড়ি, সায়া, ছোটজামা। কোথাও ঝুলছে টিয়ার খাঁচা, কোনো ঘরের সামনে তুলসীগাছ। পায়ের তলায় পাথরের মেঝে। সাদা পাথরের। পাথরের ওপর ছোপ ছোপ দাগ। একেবারে শেষ ঘরের সামনে দাঁড়ালেন অনঙ্গমোহন। দরজা বন্ধ। দরজা ধাক্কা দিতেই কর্কশ কণ্ঠে-কে র‍্যা?—শুনে আর দরজায় ধাক্কা দিলেন না অনঙ্গমোহন। একটি সতের-আঠার বছরের তরুণী দরজা খুলল। আর দরজা খুলতেই অন্য একটি বালিকা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চৌকির তলায় সেঁধিয়ে গেল। ঠিক বালিকা তো নয়, যুবতী। যুবতীলক্ষণ সবই আছে। কোমর থেকে নিচের অংশটুকু সরু। ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে পা-টা টেনে নিয়ে চলেছে মেয়েটা।

অনঙ্গ বললেন—সুমিতার খোঁজে এসেছিলাম আমি।

ও। আপনার কাছেই বুঝি দিদি সংস্কৃত শেখে?

হ্যাঁ।

আবার কার খোঁজে এয়েচে র‍্যা? হতচ্ছাড়িটাকে চায় তাই না? বলে দে, ওকে দেবে না। নিতে হয় সেজটাকে নিক।

মেয়েটি চিৎকার করে উঠল মা, তুমি থামো।

—থামব? একটুও থামব না আমি। থ্যাটারে নাচাবে আর আমি চুপ করে থাকব? দে আমার গয়না, দে। দে আমার ঝুমকো…

মেয়েটি বলে—কিছু মনে করবেন না। মা মাঝে মাঝে এরকম করে।

অনঙ্গমোহন দেখলেন বিশাল খাট, সিংহের থাবার মতো পায়া। খাটের কোনায় বসে বিড় বিড় করে যাচ্ছেন সুমিতার মা—ঐ প্রৌঢ়া মহিলা। দেয়ালে প্রাচীন দেরাজ। বন্ধ দেয়ালঘড়ি। ফ্রেমে বাঁধানো দুখানি বিশাল ছবি প্ৰায় কালো হয়ে এসেছে। অনঙ্গমোহন ঐ দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে?

—আমাদের পূর্বপুরুষ। ঠাকুর্দার বাবা আর মা। ছবিদুটো এ ঘরেই রয়ে গেছে।

ঐ বংশের সবাই এখানে?

—তা কেন? দত্ত বংশ কত বড় বংশ। আমাদের জ্ঞাতিরা কেউ আছে বালিগঞ্জ, কেউ নিউ আলিপুর। সব বাড়ি করে চলে গেছে। শ্রীরামপুর- বালিতেও আছে। আমরা যারা বাড়িটাড়ি করতে পারিনি, তারাই এখানে আছি।

—সুমিতা কোথায়?

—বড় দি এখন কোথায় তা কি জানি আমি? কখন কে কোথায় যায়—আপনার কাছে যায় না?

-বহুদিন যায় না।

—যায় না বুঝি? সময় পাচ্ছে না হয়তো। কত কাজ দিদির। তিনটে-চারটে টিউশনি, গান শেখা, ভাড়া আদায়, সংস্কৃত শেখা…

—ভাড়া আদায় মানে?

—একতলায় ভাড়াটে আছে না? আমাদের ভাগে প্রেসটা, আর একটা ঘর। বিহারিদের ভাড়া দেওয়া আছে। এভাবেই তো চলছে।

—তোমার অন্য ভগিনীরা?

মেজদি তো নাটকটাটক করে। আমার পরের বোনটাকে দেখলেন— হাঁটতে পারে না। ছোটবেলায় পোলিও না কি হয়েছিল।

তুমি?

—আমি বিএ-তে ভর্তি হয়েছি মণীন্দ্র কলেজে।

এসব কিছুই জানতেন না অনঙ্গমোহন। এত কথা সুমিতা কিছুই বলেনি শুধু এটুকুই জানতেন যে, সুমিতা পিতৃহীনা। জানতেন, তাদের ভাই নেই, কিন্তু তারা চার বোন। জানতেন তারা দত্তবংশীয় কায়স্থ।

—দিদি এলে কিছু বলতে হবে ঠাকুরমশাই?

অনঙ্গমোহন এ মুহূর্তে ঐ মেয়েটির ভ্রম সংশোধনের ইচ্ছা হল না।

—তোমার দিদি পড়তে যায় না। সেই কারণে চিন্তিত আছি। কইও, অবশ্য যেন যায়। এ কথা বলেই অনঙ্গমোহনের মনে হল—এই বাক্যের মধ্যে ততটা ওজন নেই। তখন বললেন—কইও ইন্সপেক্টার আইবে। টোল পরিদর্শন হইবে। তার এখন নিয়মিত আসাটা প্রয়োজন। একথা বলে আবার অনঙ্গমোহনের মনে হল—এই কথার মধ্যে ততটা টান নেই। তখন বললেন—কইও আচার্য, অর্থাৎ আমি প্রবল উৎকণ্ঠার মধ্যে আছি। সে যেন যথাশীঘ্র আমার সঙ্গে দেখা করে। আর কারোর সঙ্গে নয়, শুধু আমার সঙ্গে। বোঝলা? এই কথা বলে চলে যাচ্ছিলেন অনঙ্গমোহন। মেয়েটি সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

সিঁড়িতেই সুমিতার মুখোমুখি হলেন অনঙ্গমোহন। সুমিতা চমকে গিয়ে মাথা নিচু করে রইল। অনঙ্গমোহনও তখন স্থির। সুমিতা মুখ নিচু করে অস্ফুট স্বরে বলল—অজিতবাবুর অফিসে রিসেপশনিস্ট-এর চাকরি খালি আছে। এরপর আর কোনো শব্দ ছিল না। কোনো কথা ছিল না। অনঙ্গমোহন দেখলেন, সুমিতার গালের দুপাশে জলের রেখা। অনঙ্গমোহনের ইচ্ছা হল, সুমিতার চিবুক স্পর্শ করে বলেন-হে জল, হে চক্ষুনির্গত জল পৃথিবীর মঙ্গলকারক হও। ওঁ শন্ন আপো ধন্বন্যা শমনঃ সন্তুঃ নূপ্যাঃ। অনঙ্গমোহন কিছুই বললেন না। আর দাঁড়ালেন না। আস্তে আস্তে সুমিতার পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে এলেন।

রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলেন হাতিবাগানের দিকে। সুমিতা কাঁদে কেন? অনুতাপে কাঁদে। অনুতাপ তো মহতের লক্ষণ। ব্রহ্মা বলিলেন, হে ঋষিগণ। প্রকৃতি হইতে প্রথমত মহত্ত্বের উৎপত্তি হইয়াছে। ঐ মহত্ত্বকে সমুদয় সৃষ্টির আদি সৃষ্টি বলিয়া কীর্তন করা যায়। ঐ মহাপ্রভাবসম্পন্ন মহ সকলের হৃদয়ে বিদ্যমান রহিয়াছে। ইহা অণিমা লঘিমা, প্রাপ্তি, ঈশান, অব্যয় ও জ্যোতিস্বরূপ।

পিছু ডাক শুনলেন অনঙ্গমোহন। আচার্যদেব…পিছনে সুমিতা। অনঙ্গমোহন দাঁড়ালেন।

সুমিতা এগিয়ে আসে।

—কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলেন যে?

-বলার কীই-বা আছে।

—কিছুই বলার নেই?

অনঙ্গমোহনের যেটা বলার আছে, সেটা আসল বলা, সেই বলাটা ঝপ করে বলে ফেললেন—ইন্সপেক্টার আসতাছে। এখন কামাই কইরো না সুমিতা। রোজই আসা দরকার।

—ঠিক আছে, আসব।

-পরীক্ষা সামনে। ঠিকমতো অধ্যয়ন দরকার।

—আচ্ছা, করব।

—আচ্ছা সুমিতা, একটা কথা জিগাই, কাব্যতীর্থ হইয়া তুমি কী করবা? —জানি না।

—তুমি তো শুধু কাব্যসুধা লাভ করবার জন্য কাব্যপাঠ করতাছ, এটাই কি সত্য?

—এটা সত্য নয়। আচার্যদেব—

—তবে?

—জানি না। আমার তো করার কিছু নেই পণ্ডিতমশাই। সবই তো দেখে গেলেন আমাদের অবস্থা। আচ্ছা কাব্যতীর্থ হয়ে একটা টোল খুলে দেখা যায় না?

—টোল খুলবা? ক্যান?

—এই ধরুন। যদি মাসে চল্লিশ, পঞ্চাশ টাকা যা পাওয়া যায়—আসলে এটা একটা কথার কথা। টোল খুলতে যাব কেন, আর টোলে পড়াবার মতো আমার যোগ্যতাই-বা কী আছে। এমনি ভাবছিলাম। আসলে অজিতবাবুর কাছে গান শিখতে যেতাম। আপনি পাশের ঘরে পড়াতেন। ভাবলাম, যাই শিখি, পয়সা যখন লাগছে না—তারপর উৎসাহ পেয়ে গেলাম। ভাল লাগতে লাগল। এই আর কী, আচ্ছা পণ্ডিতমশাই, কাব্যতীর্থ হয়ে গেলে স্কুলে চাকরি হয় না—স্কুলে?

—তা হয়তো হয়। তোমার তো বিএ ডিগ্রি আছে…আমার তো ঐসব ইংরাজি ডিগ্রি-টিগ্রি নাই। তোমার হবে।

—তাও হবে না, পণ্ডিতমশাই। ইস্কুলে তো ক্লাস এইটে নমো নমো করে একটু সংস্কৃত পড়ানো হয়, টিউশনি করছি তো, দেখছি সংস্কৃত কী পড়ানো হচ্ছে। তারপর ক্লাস নাইন থেকে তো আর সংস্কৃত নেই। শুধু যারা আর্টস পড়ে, তাদের সংস্কৃত আছে। চাকরির স্কোপ মানে সুযোগ কমে গেছে খুব। দেশের মহতী বিনষ্টি আশঙ্কা কইর‍্যা আমাগোর ধ্যানেশনারায়ণ, ব্যারিস্টার নির্মল দাশগুপ্ত, আইসিএস সত্যেন মোদক বহু দরবার করছিল। আমার কাছে সই চাইল অরা, সই দিলাম, মিছিল কইরা হরেন চৌধুরীর কাছে গেলাম। হরেন চৌধুরী ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। কম করি নাই।

তারপর?

—একটা কমিটি হইল। ঊনিশশ ষাইট সালে। সেই কমিটিতে সুনীতিবাবু, শ্রীকুমারবাবু, তারপর বৈজ্ঞানিক কি বোস যেন?

-সত্যেন বোস?

—হ হ, সত্যেন বোস, শিশির মিত্র, এছাড়া গৌরীনাথ শাস্ত্রী, শশিভূষণ দাশুগুপ্ত আরও সব বড় বড় লোকজন ছিলেন। সেই কমিটির অভিমত ছিল—পঞ্চম হইতে অষ্টম শ্রেণির প্রত্যেকের সংস্কৃত শিক্ষা আবশ্যিক, আর বিজ্ঞান বাণিজ্যাদি শাখা ছাড়া অন্য শাখায় এগার শ্রেণি পর্যন্ত সংস্কৃত আবশ্যিক কর। কিন্তু সেই অভিমত গ্রাহ্যই হইল না।

—এখন সাইন্সের আর কমার্সের ছেলেরা আর স্যাংস্কৃট পড়ছে না।

—শুনেছি, পাশ্চাত্যে ডাক্তারিতেও ল্যাটিন ভাষা পাঠ্য হচ্ছে, জার্মান দেশের লোক সংস্কৃত শিখতাছে। আর আমরা কেরেবাই কেরেবাই করতাছি। সব আছে। সংস্কৃত ভাষায় সব আছে। ন জানে বিদ্যতে কিং তন্মাৰ্ধমত্র সংস্কৃতে। সংস্কৃত ভাষা হীরার খনি। জাপানে যে অ্যাটম বোম ফেলল আমেরিকা, সেই ফর্মুলা তো শুনেছি সংস্কৃতে ছিল। এক সংস্কৃতজ্ঞ জার্মান সাহেব সংস্কৃত মন্থন কইর‍্যা উদ্ধার করেছিলেন।

সুমিতা ছদ্ম অবাক হল। বলল—তাই নাকি?

—এই যে নামীদামী বিলাতি ঔষধ। সব ফর্মুলা আয়ুর্বেদশাস্ত্রে আছে।

—ও।

—এই যে যুদ্ধ হইল। প্যাটন ট্যাঙ্ক। মিগবিমান, মর্টার। কিছুই নতুন নয়। বিমান তো রঘুবংশম্-এ দেখেছই। অগ্নিবাণ, জলবাণ, সর্পবাণ এইসব রামায়ণ-মহাভারতেই আছে।

—তাই তো…

—আসলে এইসব আর কেউ চিন্তাই করে না। সংস্কৃতের ওপর অবহেলায় দেশের যে কী ক্ষতি হইতেছে…কী নাই সংস্কৃত ভাষায়? ধ্বনির্বিজ্ঞান, ছন্দ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, আয়ুর্বেদ, অঙ্কশাস্ত্র..শ্রীধরাচার্যের নাম শুনছ তোমরা?

—না পণ্ডিতমশাই।

অঙ্কবিদ্। শ্রীধরাচার্য, ব্রহ্মগুপ্ত। এই যে ইনজিনিয়ার ইনজিনিয়ার কও তোমরা—সংস্কৃতে ইনজিনিয়ারিংও পড়ানো হইত। বিশ্বকর্মা কত বড় ইনজিনিয়ার। আমি বিশ্বকর্মাকে স্বর্গস্থিত দেবতা মনে করি না। স্বৰ্গনামক স্থানটি সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। বিশ্বকর্মা মানুষ। আর ময়দানব? তার মতো ইনজিনিয়ার আছে কে? ময়দানব ইচ্ছা করলে এরকম দশটা হাওড়ার পুল বানাইতে পারত। ইন্দ্রপ্রস্থে ময়দানব কী করছিল শুনবা?

—কী পণ্ডিতমশাই?

—অগ্নির অনুরোধে অর্জুন খাণ্ডব বন দহন করলেন। ঐ বনে থাকত এক দানব, তার নাম ময়। ময় আর্তনাদ কইরা কয়—রক্ষা কর হে ধনঞ্জয়। অর্জুন তারে বাঁচাইবার চেষ্টা করতেই কৃষ্ণ বিরত করলেন। কৃষ্ণ কইলেন, তোমার প্রাণের বিনিময়ে অর্জুনরে কী দিবা কও। ময় কইল—আমি কী দিমু? আমি স্থাপত্যবিদ্যা ছাড়া আর তো কিছুই জানি না, তখন শ্রীকৃষ্ণ কইলেন—তবে হে ময়, তুমি ইন্দ্রপ্রস্থে নির্মাণ কর এমন এক মনোহরপুরী যার তুলনা পৃথিবীতে নাই।

—এসব কি সত্যি কথা পণ্ডিতমশাই?

ময়দানবের এই গল্পটা সত্য কি না জানি না। তবে ইন্দ্রপ্রস্থ যে সত্য তাতে সন্দেহ কী! আর ময়দানবও সত্য। ময়দানব ছিলেন রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর পিতা। রাবণের লঙ্কাপুরী তো ময়দানবেরই করা।

—কিন্তু পণ্ডিতমশাই, কাগজে পড়লাম, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন এঁরা বলছেন, রামায়ণের লঙ্কা মানে সিংহল নয়, তারপর পুষ্পকরথ কবি-কল্পনা। লঙ্কাপুরীর বর্ণনায় সত্যের চেয়ে কল্পনা বেশি।

—তাঁদের মাথা খারাপ হইয়া গেছে গিয়া। তাঁরা তো পাশ্চাত্য-ঘেঁষা লোক। তাঁরা কী জানেন? এইসব কুক্কুট মাংসভুক আধুনিক সংস্কৃত-জানা গবেষকরা কোন্ দিন কইবে ভাস্করাচার্য মিথ্যা, আর্যভট্ট মিথ্যা, চরক-পতঞ্জলি মিথ্যা। শল্যচিকিৎসা মিথ্যা। গণেশের যে হাতির মাথা, এটা একটা কঠিন শল্যচিকিৎসা নয়?

—আর্যভট্ট-চরক-পতঞ্জলির সঙ্গে ঐ গণেশের ব্যাপারটা মিলিয়ে নিচ্ছেন পণ্ডিতমশাই?

—ক্যান? দোষটা কী তাতে? সবই তো প্রাচীন ভারতের ব্যাপার। এই যে নারদ যে ঢেঁকির উপর শূন্যমার্গে বিচরণ করত, সেইটা কী? হেইডা তো রকেট। কাগজে রকেটের ছবি দেখি না? অ্যাক্কারে ঢেঁকির মতন। ইংরাজি পড়া আধুনিক পণ্ডিতরা কইবে নারদ মিথ্যা। তাইলে রাম মিথ্যা, কৃষ্ণ মিথ্যা, বাণভট্ট মিথ্যা, কালিদাস মিথ্যা…

আপেল মিথ্যা, নেশপাতি মিথ্যা, আঙুর মিথ্যা…ফলের দোকানগুলি অতিক্রম করছিলেন অনঙ্গমোহন। এই যে থরে-বিথরে সজ্জিত সুমিষ্ট ফলাদি তাহা টুলোপণ্ডিতের ভোগের নিমিত্ত নহে। পুনঃ পুনঃ উল্লম্ফন করিয়াও শৃগাল যখন উচ্চে সন্নিবিষ্ট দ্রাক্ষাফলগুলি স্পর্শ করিতে অপারগ হইল তখন শৃগাল সিদ্ধান্ত করিল যে…

—এখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন পণ্ডিতমশাই?

—না, এমনই।

—কটা আঙুর খাবেন, পণ্ডিতমশাই?

—নাঃ। আঙুর এখন টক।

—দিই না কিছুটা।

নাঃ, দরকার নাই। তুমি বরং আমার চতুষ্পাঠীতে নিয়মিত আসো। ইন্সপেক্টার আসতাছে।

এবারকার পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বাঙালিদের জয়জয়কার। মেজর জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরী। এয়ার ভাইসমার্শাল রঞ্জন দত্ত। ছয়টি প্যাটন ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছেন একা মেজর ভাস্কর রায়। কাশ্মীর যুদ্ধে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়েছেন অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

যুদ্ধে নেমে পড়েছে অসীম চক্রবর্তী। বিপ্লব ভট্টাচার্য। ছাত্রধরার যুদ্ধ। অসীম ইস্কুলের গেটের ধারে পোস্টার সেঁটে দিয়েছে আঠা দিয়ে—বিনা পয়সায় সংস্কৃত শিক্ষা। সংস্কৃত শিখিয়া উপাধি লাভ করা যায়। যোগাযোগ করুন পণ্ডিত অনঙ্গমোহন ভট্টাচার্য, ঠিকানা…

বিলু বাবলুদাকে বলল বাবলুদা, বিকম পাস করে অফিসে চাকরি পেয়েছে। অনেক পড়ে। ঘরে অনেক বই। রাষ্ট্র ও বিপ্লব, ভোলগা থেকে গঙ্গা, কী করিতে হইবে, পদাতিক, ছাড়পত্র, ঘুম নেই, আরও কত কী। বিলু বলল—দাদুর কাছে সংস্কৃত পড়ো না, বাবলুদা। বাবলু বলল—ধুস্। পাড়ার অভয়দা সাহিত্যিক। ‘গলিত হৃদয়’ নামে বই আছে। ওয়াল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। হাতে সবসময় বই থাকে। অভয়দাকেও বলল বিলু। অভয়দা বলল, সংস্কৃত তো খুব ভাল জিনিস। তবে এখন তো টাইম নেই। ‘দুঃস্বপ্নের কাল’ নামে একটা যুগান্তকারী উপন্যাস শুরু করেছি। ওটা আগে শেষ হোক।

ন্যাড়াদা বাগবাজারের মোড়ে ফুটপাতে চায়ের দোকান দিয়েছে। বিলুকে দেখে ন্যাড়াদা বলল, আরে বিলু যে, বহুদিন পর। কী খবরটবর বল। কালির বড়ি ঝাড়ছিস না আর?

বিলু লজ্জা পেল। সেই কবেকার কথা মনে রেখে দিয়েছে ন্যাড়াদা।

বিলু বলল, কী যে বল ন্যাড়াদা। এসব মনে রেখে দিয়েছ?

-খারাপ জিনিসগুলো কিন্তু মনেই থেকে যায়। আমি যা যা খারাপ কাজ করেছি, ভুলিনি।

-এখন আর খারাপ কাজ কর না?

—চেষ্টা করি যাতে না করতে হয়।

—একটা ভাল কাজ করবে? উপকার?

—কী উপকার? তোর?

—হ্যাঁ। মানে আমার দাদুর। আমার দাদুর টোলের মেম্বার হবে? মানে ছাত্র? আমিও হয়েছি। কঠিন কিছু নয়। পরীক্ষায় বসবে। দাদুই ইম্পর্টেন বলে দেবে। পয়সা লাগে না।

—মাগ্‌না?

— হ্যাঁ।

—তাতে তোর দাদুর লাভ?

—লাভ মানে গভমেন্ট থেকে একটা টাকা পায় দাদু।

অসীমের ইস্কুল থেকে কয়েকজন ছাত্র এল।

বলছে, পণ্ডিত স্যার কোন্ ঘরে থাকে?

শিখার বাবা বললেন, পণ্ডিত স্যার? পণ্ডিত আবার স্যার হলেন কবে থেকে?

ছেলেরা বলল—অনঙ্গমোহন ভট্টাচার্য…

এসব শুনে অনঙ্গমোহন এগিয়ে এলেন। বেশ পুলকিত হলেন। চারজন ছাত্র। আহা। বাতাপি। বাতাপি।

একটি ছেলে বলল—আপনি নাকি স্যার বিনে পয়সায় সংস্কৃতের টিউশনি করবেন, সেইজন্য এলাম। অনঙ্গমোহন বললেন—বিনা পয়সায় টিউশনি ক্যান? একটি ছেলে বলল—হয় না? অনেকে পুণ্য করার জন্য ফিরিতে কাপড় দেয়, কম্বল দেয়, দরিদ্রনারায়ণ ভোজন হয় …

অন্য একটা ছেলে বলল—আমাদের কুশারীবাবু স্যার যেমন ভাল ছেলেদের ফিরিতে পড়ায়—সেরকম আপনিও সংস্কৃত ফিরিতে পড়াবেন শুনলাম…

অনঙ্গমোহন তখন বুঝিয়ে দেন ব্যাপারটা। স্কুলের সংস্কৃত আর টোলের সংস্কৃত পাঠের মধ্যে প্রচুর তফাত। তবে এটাও বললেন—টোলে ভর্তি হয়ে যদি আদ্য পরীক্ষা দেবে বলে কথা দেয় তারা, উনি বিনা দক্ষিণায় ব্যাকরণ কৌমুদী বুঝিয়ে দেবেন।

—পরস্মৈপদী, আত্মনেপদী, লট, লোট, অনুজ্ঞা—এসব হেভি কঠিন। বুঝিয়ে দেবেন?

-দেব।

—ট্রানস্লেশন?

—বাংলা থেকে সংস্কৃতে করিয়ে দেব।

—ঠিক আছে, তাহলে পড়ব।

তখন টোলের পাঠ্যবইগুলি দেখান অনঙ্গমোহন।

সন্ধিবৃত্তি, অমরকোষ, মিত্ৰলাভ।—

ও বাব্বা, হেভি কঠিন। এসব পারব না।

অসীমদের স্কুলের বিমলেন্দুবাবু একদিন হাজির হয়েছিলেন। অনঙ্গমোহনের সঙ্গে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলেন। ‘বাংলা পড়াই, বিএ-তে স্যাংস্কৃট ছিল। এম এ ইন-বেঙ্গলি’। অনঙ্গমোহন কোথায় বসাবেন ভেবে পান না। ঘরে এক্ষুণি বৌমা ঢুকবে। দরজা বন্ধ করে কাপড় ছাড়বে। আপিস যাবার কাপড় পরবে। ঘরের সামনের বারান্দাটায় টুকরোটুকু, যা অনঙ্গমোহন এবং অসীম ভোগ করে থাকে, যে বারান্দায় কোনো চৌকি নেই, চেয়ার নেই, সেই বারান্দাতেই মাদুর পেতে দিলেন। বললেন—বসুন, একটু অসুবিধে হবে আর কী। ‘না না, অসুবিধা কী, অসুবিধা কী?’ এই বলে কোঁচা সামলে মাদুরেই বসলেন।

অনঙ্গমোহনও বসলেন। একটু দূরে। মুখে সামান্য সামান্য হাসি। লজ্জাজনিত এক ধরনের হাসি হয়। কিছুটা বিনয়। লজ্জা দদাতি বিনয়ং। কী হেতু, এই দীন গৃহে আগমন?

হেতুটা অবশ্য অনঙ্গমোহন আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এ সবই অসীমের ক্রিয়াকাণ্ড। গুরুর প্রতি অসীমের অনুরাগ সত্যই অতুলনীয়।

—ঐ, একটা পোস্টার দেখলুম কিনা, সংস্কৃত শেখাচ্ছেন আপনি। টোল আছে আপনার, তাই না?

—যথার্থই অনুমান আপনার।

—তা আপনার টোলটা কোথায়?

—এই এখানেই।

—এখানেই মানে?

—এই আমার টোল, এই আমার বাসস্থান।

—আচ্ছা আজকাল টোলে গভর্মেন্ট ডিএ কীরকম দিচ্ছে?

—যৎসামান্য। কায়ক্লেশে একজনের খাই-খরচও হয় না। যা বাজার, চাল দেড় টাকা। মুগডাল পাঁচসিকা…

-ঐ যা হয়। যা আসে বুঝলেন। আমি ভাবছি একটা কাব্যতীর্থ করে নিয়ে একটা টোল খুলে দেব। একটা পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করে দেবেন তো পণ্ডিতমশাই—আমি আসব মাঝে মাঝে। বিএ-তে স্যাংস্কৃট ছিল। কী কী বার ক্লাস নেন?

অনঙ্গমোহন কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ ছিলেন। তারপর বললেন, আপনার আসার দরকার নেই।

-কেন?

—সরকারি পণ্ডিতবৃত্তি আপনি পাইবেন না। শুধু মিছা আইস্যা ফল কী?

-কেন, পাব না কেন?

—ঐ বৃত্তির জন্য অঙ্গীকারপত্রে লিখতে হয় যে, আমি সর্বসময়ের অধ্যাপক। আমার আর অন্য আয় নাই, অন্য কিছু করি না।

বিলু ওদের ফার্স্ট বয়কে প্রায় ফিট করে ফেলেছিল, কিন্তু অল্পের জন্য হল না।

হেডস্যার এসে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা যে প্রেয়ার কর, কী প্রেয়ার কর?

ওরা প্রেয়ার করে—হে তবোবান সনা দেবী হে তব পশোবিতা। শ্বেত রবার দ্বারা নিত্যাঃ শ্বেত লংকা ভূষিতা…। বহুদিন ধরেই চলে আসছিল। বিলুও তাই করত। অল্প কিছুদিন হল, বিলু আবিষ্কার করেছে, ওরা ভুল বলছে। এটা সংস্কৃত নয়।

ফার্স্ট বয়কেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন হেড স্যার? ফার্স্টবয় বলল — হে তপোবান সনা দেবী তারপর একে একে ছ’জন পারল না। বিলুকে জিজ্ঞাসা করতেই বিলু বলে দিল—শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা। শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা। ভীষণ খুশি হলেন হেড স্যার। বললেন, ভেরি গুড। বললেন, বোর্ডে লিখে দাও বিপ্লব, সবাই লিখে নেবে। লাস্ট বেঞ্চিতে বসা বিলুর সে কী রেলা। ফার্স্ট বয় জিজ্ঞাসা করেছিল, কী করে রে বিপ্লব? বিলু ওর দাদুর কথা বলেছিল। তারপর লাইনে এনে ফেলেছিল। ও ঠিক করেছিল ছুটির পরই বিলুর সঙ্গে যাবে। টোলে ভর্তি হবে।

ছুটির পর ফার্স্টবয়কে সঙ্গে করে নিতে চাইল বিলু। ফার্স্টবয় তখন এলো না। বলল, প্রেয়ারটা তো লিখেই নিয়েছি। ফালতু ফালতু টোলে ভর্তি হয়ে কী লাভ? টাইম লস। বরং অংক করলে কাজ দেবে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই অনঙ্গমোহনের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিল বিলু, খুশি খুশি ভাব।

…রাজা শালিবাহন ছিলেন মূর্খ। রাজা তার এক নবপরিণীতা রাণীর সঙ্গে জলকেলি করতাছিলেন…

দাদু কাউকে ফিট করেছে নির্ঘাত। বিলু জানে, এটা হল প্রথম দিনের লেসন। বিলু দেখল, ন্যাড়াদা বসে আছে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। সুমিতাদিও রয়েছে।

তারপর রাজা তো রানীর গায়ে জল ছিটাইতে শুরু করলেন। রানী বলতেছেন, মোদকং দে হি। অর্থাৎ মা উদকং দেহি। জল দিও না। আর মূর্খ রাজা করল কি একটা মোয়া আইন্যা রানীর হাতে দিয়া কয়—মোদক খাও। রানীর তখন হায় হায়। রাজারে খুব অপমান করল।

তারপর রাজা ভাবল, এভাবে তো চলে না। এবার লিখাপড় শিখন লাগে। রাজা তখন পণ্ডিত সর্ব্ববর্মাচার্য্যেরে ডাইকা আনলেন। কইলেন, আমারে তাড়াতাড়ি ব্যাকরণ শিখাও। তখন সৰ্ব্ববর্মাচার্য্য একটা সহজ ব্যাকরণ রচনা করলেন। সেই ব্যাকরণের নাম কাতন্ত্র বা কলাপ।

সুমিতা বলল—এই গল্পটা যতবার শুনি পণ্ডিতমশাই, ততবার ভাল লাগে। অনঙ্গমোহন বললেন, সংস্কৃত ভাষা বড় মনোহর। হীরার খনি। সুমিতা বলল, আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? আপনি কলাপ বা কাতন্ত্র কেন পড়ান? পাণিনি পড়ান না কেন?

অনঙ্গমোহন বললেন, কাতন্ত্রের মধ্যেই পিছনের পুকুরের শাপলা, নোনাফলের গাছ। বাড়ির উঠান। বাবা যে কলাপ ব্যাকরণই পড়াইতেন।

বিলুকে দেখে অনঙ্গমোহন বলেন—অসীম্যাটা কই রে? বোধহয় সাহেবদের লগে খেলতাছে। ধইরা লইয়া আয় তো।

অসীম বাবলুদাদের ঘরেই ছিল। জ্ঞান শুনছিল। বাবলুদা বলছিল, রাশিয়ায় গরিব বড়লোক সব সমান। বিলু ভাবত গ্যাস। আজকাল অনেকের কাছেই শুনছে এইসব। হেমন্ত বসুর বক্তৃতা হল সেদিন, এই কথাই তো বললেন উনি। তা অসীমকে নিয়ে এল বিলু।

অনঙ্গমোহন স্বপ্নারও হাত ধরে টেনে আনলেন। বসালেন। প্রত্যেকের মাথায় চাঁটি মেরে গুনতে লাগলেন—এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ। স্বপ্না বলল—উঃ! দাদু লাগে। অনঙ্গমোহন বললেন—এই আমার পাঁচ। হাতের পাঁচ। আসুক তো দেখি ইনেস্পেক্টার।

অনঙ্গমোহন প্রায় বালকের মতন। পাঁচজন ছাত্রকে একসঙ্গে পেলেন দীর্ঘদিন পর।

হাততালি দিতে গিয়েও সামলে নিলেন। হঠাৎ সুমিতার দিকে তাকিয়ে বললেন—তাইলে?

পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠী তাইলে ঠিকঠাক চলতাছে, কি কও?

এবার পঞ্জিকার ভিতর থেকে কি একটা বার করতে গিয়েও বার করলেন না। বেশ চোখ নাচিয়ে বললেন—কও তো দেখি কী? কে পারে :

অপদো দূরগামী চ
সাক্ষরো ন চ পণ্ডিতঃ
অমুখঃ স্ফুটবক্তাচ
যো জানাতি স পণ্ডিতঃ

সুমিতা অনুবাদ করতে লাগল—

পা নেই কিন্তু দূরে যায়
অক্ষর জানে কিন্তু পণ্ডিত নয়
মুখ নেই কথা বলে
যে জানে সে পণ্ডিত।

সবাই কড়িকাঠের দিকে চেয়ে ভাবছিল, এমন সময় স্বপ্নাই চেঁচিয়ে উঠল—চিঠি চিঠি, ঠিক কিনা?

একদম ঠিক। অনঙ্গমোহন ওর পিঠ চাপড়ালেন। তারপর বললেন—এই হইল সেই চিঠি—বলে পঞ্জিকার ভিতর থেকে বের করলেন একটা খাকি রঙের খাম। বললেন—সরকারি চিঠি। জানতে চায়, আমার টোলের ছাত্রসংখ্যা কত। নাম পাঠাও। ইনেসপেক্টার আইস্যা মিলাইবে। দিয়া দেই পাঁচখানা নাম। আমার আর অসুবিধা কী? সবার নামই তো জানি। তোমার নামটা কী লিখি।

ন্যাড়াদা বলল, স্বপন সরকার।

স্বপ্নভঙ্গ কইরো না কিন্তু। আসবা ঠিকমতো। কর কী?

—বললুম না, দোকান। চায়ের দোকান।

—দোকান? তবে অধ্যয়ন করতে আসবা কেমনে?

—কেন? দুপুরে তো দোকান লাগাই না।

—তা সংস্কৃত পরীক্ষাটা দিবা তো? পয়সা লাগে না—

—এসেছি যখন দেবো ঠিকই।

—তা সংস্কৃত শিখতে আসছ ক্যান? কাব্যতীর্থ হইয়া টোল দিতে চাও নাকি?

—মানে?

—তাইলে ঠিক আছে।

—আসলে কি, ভাবলাম চান্স যখন পেয়েছি সংস্কৃতটা শিখি। কলেজে তো পড়তে পারিনি। রোজগারের ধান্ধায় নেমে গেছি…

বয়স? বয়সটা লিখন লাগে তো…অনঙ্গমোহন বললেন।

লিখুন সাতাশ।

এবার অনঙ্গমোহন নিশ্চিন্ত হয়ে নামটা ঢুকিয়ে রাখলেন পঞ্জিকার ভিতর। বাঃ। আইচ্ছা, এই শ্লোকটার অর্থ কও তো দেখি, কে পারে?

গোমাংসং পতিতং দৃষ্টা
খণ্ডং খণ্ডং মহীতলে
শিবা কাকা ন গৃহন্তি
গৃহ্নন্তি পণ্ডিতা জনাঃ-

গোমাংস পইড়া আছে। কাকেও নেয় না, শৃগালেও খায় না, পণ্ডিতরা কুড়াইয়া লয়।

সুমিতা হেসে উঠল। বলল, এটা আগেও কতবার বলেছেন পণ্ডিতমশাই। এখানে গোমাংস সন্ধি হয়েছে। গোম অর্থ পৃথিবী। পৃথিবীর অংশ। মানে নারায়ণশিলা।

সুমিতা খুব হাসছে। সারা শরীরে ঢেউ।

ঢ-অং। শিখার মা বেশ জোরেই বলেছিল। অনঙ্গমোহন শুনল। ইতোমধ্যে শিখার মা দু’একবার উঁকি দিয়ে গেছে। অনঙ্গমোহন তা লক্ষ করেছেন। সুমিতা প্রতিক্রিয়াহীন। সে এসব গ্রাহ্যেই আনে না।

সুমিতা এবং ন্যাড়াকে বিদায় করে অনঙ্গমোহন যখন উঠে আসছিলেন, তখন ঠিক সিঁড়ির মুখটাতেই শিখার মার মুখোমুখি হলেন। পণ্ডিতমশাই, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

গলায় বেশ ঝাঁঝ

ঘরে নিয়ে গেল শিখার মা। বলল—শিখা বিজু—তোরা একটু ও-ঘরে যা। ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিল শিখার মা। খাটের ওপর টানটান চাদর পাতা। চেয়ার দুটিও বোধহয় নতুন। এই চেয়ারটায় বসুন। বসলেন। গদি কী পেলব। ঘরে ঘি-এর গন্ধ। হালুয়া খাচ্ছিল কন্যা দুটি। কণা কণা পড়ে আছে।

—দেখুন পণ্ডিতমশাই, আপনার ঐ সুমিতা কিন্তু ব্যাড ক্যারেকটার

ঘরে ডাকার কারণ যে এটা হতে পারে, পূর্বাহ্ণেই আঁচ করেছিলেন অনঙ্গমোহন। তবু তিনি শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে রইলেন।

—দেখুন, মেয়েরা বড় হয়েছে আমার। ঐ পাজি মেয়েটিকে আপনি আসতে নিষেধ করে দিন। গান শিখতে আর আসে না। আমি বলে দিয়েছি।

আপনার কাছেও যেন না আসে।

—কেন, বিষয়টা কী?

—সে অনেক কথা। আপনি আমার বাবার মতো। সব বলা যায় না। মেয়েটা আমার কর্তার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছে। এর থেকে যা বোঝার বুঝে নিন।

—কিন্তু তালি কি এক হাতে বাজে মা?

—ঐ মেয়েটাই বদ। পরশু দিনও ট্রাম ডিপোর কাছে দাঁড়িয়েছিল—ওঁর আসার টাইমে। ব্যাটাছেলেদের তো একটু ইয়ে হবেই কিন্তু ঐ মেয়েটা তাই বলে তক্কে তকে থাকবে?

—কিন্তু সুমিতা যে আমার ছাত্রী। উপাধি পরীক্ষা দেবে।

—আপনার পায়ে পড়ি পণ্ডিতমশাই। আপনি নিষেধ করে দিন এখন। আমরা বরানগরে জমি কিনেছি, বাড়ি করে উঠে যাব, তারপর না হয়…

—সে তো বহুকালের ব্যাপার, কিন্তু ওর তো সামনেই পরীক্ষা।

—অ্যাদ্দিনে বাড়ি হয়ে যেত পণ্ডিতমশাই। উপাধি কি কম পায়? ও যে টাকাপয়সা কী করে কে জানে। আপনি ওকে ছাড়িয়ে দিন। কেন মিছিমিছি পড়ান, ও কি পয়সা দেয়? খেতে পায় না অথচ সাজগোজের বহর কি।

—সুমিতার খুব মেধা। পরীক্ষায় ভাল ফল করবে।

—ওসব কিছু জানি না পণ্ডিতমশাই। আমি আপনার মেয়ের মতো। এই আপনার পায়ে ধরছি। আপনি শুধু…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *