চতুষ্পাঠী – ৮

আট

—এই বছর একটা দুর্গাপুজোর তন্ত্রধারী হইবা অনঙ্গ?

কামাখ্যা পুরোহিত এসে অনঙ্গমোহনকে বললেন।

—তন্ত্রধারী ক্যান?

—পূজা করতে তো পারবা না। অইভ্যাস তো নাই তোমার, সেই কারণে তন্ত্রধারী করতে কই। আমাগোর পাড়ার বারোয়ারি পূজা। দেয়-থোয় ভালই।

—তুমি কর না ক্যান?

আমিই তো করতাম। আর মানিক করত তন্ত্রধারী। এই কয় বছরে মন্দিরের কাজকর্ম বাইড়া গেছে গিয়া। মন্দিরের চূড়া করছি। দশমীর দিন মন্দিরের চূড়ায় ঘটস্থাপন করামু। বহুলোক মন্দিরে আসতাছে, খুবই জাগ্ৰত কালী। অখন আর বারোয়ারি-টারোয়ারি পূজা করার সময় নাই আমার। মানিকরে এবার পূজা করতে পাঠামু। তুমি শুদ্ধ উচ্চারণ কইর‍্যা মন্ত্রগুলি…

—কামাখ্যা ভাই, এসব আমার কাম নয়। তুমি তো জানোই, এইসব আমি করিনা।

—দেখ, তুমি ভ্রান্ত অহমিকা লইয়া আছ। যজমানি যদি সংস্কৃতজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ না করে তবে করবটা কে?

যজনং যাজনং চৈব
অধ্যয়নং অধ্যাপনম্‌
দানং প্রতিগ্ৰনং চৈব
ষটকর্ম ব্রাহ্মণান্বিতম্।

এই কথা তো শাস্ত্ৰবচন।

এবার যেন একটু রেগে ওঠেন অনঙ্গমোহন। বলেন, এইসব অর্বাচীন শ্লোকরে শাস্ত্রবচন বানাও তোমরা, যজমানরা। প্রতিগ্রহণ যদি ব্রাহ্মণের কার্য হয়, তবে আমি অগ্রদানীর মতো প্রেতোৎসর্গ গ্রহণ করি? পিণ্ড খাই?

অঞ্জলি এগিয়ে এল। বলল, হ্যাঁ, দরকার হলেও এসব করবেন না? কেন করবেন না? সবাই তো করে। অঞ্জলির মুখের দিকে তাকালেন অনঙ্গমোহন। গলা দিয়ে নীল শিরা নেমে গিয়েছে শরীরের ভিতরে। উত্তেজিত হলে ঐ শিরা স্ফীত হয়। অনঙ্গমোহন দেখতে চেয়েছিলেন, ঐ শিরার স্ফীতি কতটুকু। কিন্তু এইমাত্র মুখের দিকে চেয়ে ওর মুখটা কী রকম অসহায় মনে হল। চোখের মণিটা যেন জ্যৈষ্ঠের জলহীন জলাশয়ের ভয়ার্ত শাপলা।

কেন যে করবে না কী করে বোঝাবেন অনঙ্গমোহন, কীভাবে বোঝাবেন? কামাখ্যা বললেন, হেই কথাটাই তো রিয়ালাইজ করতে পারতাছে না অনঙ্গভাই। ব্রাহ্মণ সন্তান, পূজা করব। এর মধ্যে অন্যায়-বা কী?

কামাখ্যার মুখে ইংরেজি শব্দটা শুনে একটু যেন আশ্চর্য হলেন অনঙ্গমোহন। অনঙ্গমোহন লক্ষ করেছেন, কামাখ্যার পরনে ধুতিটি বেশ পাতলা। মিলের ধোলাই ধুতি। এবং চাদরটি গাঢ় রক্তবর্ণ। কণ্ঠে রুদ্রাক্ষ মালা। সর্বানন্দ বংশীয়রা কখনোই তান্ত্রিকচারী ছিলেন না। সর্বানন্দের পূর্বপুরুষরা শৈব মন্ত্রানুসারী ছিলেন। সর্বানন্দের সিদ্ধিলাভের পর তার বংশধরেরা কালীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু বাহ্যত কেউই তান্ত্রিক আচারাদি করতেন না। রক্তবর্ণ চাদরটির দিকে তাকিয়ে রইলেন অনঙ্গমোহন।

পূজা করইন্যা লোকের কিছু অভাব আছে নি বৌমা। মেদিনীপুরের লোক ঘুইরা বেড়াইতাছে। আমি চাইছিলাম, পূজাটা আমাগ্যোর দ্যাশের মধ্যেই থাক। ভাল কেলাব। বহু টাকা চাঁদা উঠায়। বহু লোক দেখতে আসে, বহু প্রণামী পড়ে। প্রণামী-টনামী পুরোহিতই পায়। এইবার তো আরও বেশি লোক আইব। কেলাবের মাতব্বরে কইল, এ বছর ভারতমাতার পূজা হইব। অসুরের মুখ হইব আয়ুব খাঁর মতন।

অঞ্জলি বলল, বাবু আপনি কিছু একটা করুন। আমি একা আর পারছি না। গলার শির ফুলে উঠছে অঞ্জলির। ফেল করা ছাত্রের মতো মাথা নিচু করেন অনঙ্গমোহন। পাশের ঘর থেকে গান—’আর দেরি নয় ধরগো তোরা।’

অঞ্জলি চলে গেলে ফিস ফিস করে অনঙ্গমোহন বলে—বৌমার পয়সায় আমি খাই না, বৌমারটার পরি না। আমার পণ্ডিত বৃত্তি আছে। ঐ বৃত্তি বৃদ্ধি পাইয়া মাসে পঞ্চাশ টাকা হইবার কথা আছে। অথচ বৌমার ধারণা যে, আমি গলগ্রহ…

কামাখ্যা পুরোহিত বলেন—সত্য কথা স্বীকার কর অনঙ্গভাই। তোমার ঐ টাকায় দুইজনের গ্রাসাচ্ছাদন হয় না।

দুইজন ক্যান?

তুমি আর অসীম…। আবার মাথা নিচু করলেন অনঙ্গমোহন।

তালে কী স্থির করলা অনঙ্গমোহন? ফাইনাল কও। পূজাটা করতাছ তো?

একটু চিন্তা করতে দাও।

চিন্তার কী আছে। পৌরোহিত্য তুমি আরও করছ। নতুন কিছু নয়।

সে তো গৃহস্থের বিপদে। এক্ষেত্রে তো এমন নয় যে, আমি ছাড়া ঐ পূজাই হইব না।

যাও, তোমরা সব যাও। নেকসট ডে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে শেখাব। বাগবাজার সার্বজনীন পূজার ফাংসনে গাইবে সব। এখন যাও।

অজিতবাবুর ছাত্রীরা এখন চলে যাবে। সুমিতা একলা থাকবে কিছুক্ষণ। স্পেশাল ক্লাস। রবিবার। ঐ ঘরের থেকে লুচি ভাজার গন্ধ আসবে এবার। —এবার যাই অনঙ্গ। যুদ্ধের বাজার। সন্ধ্যায় সব আবার অন্ধকার।

স্বপ্না এক কাপ চা নিয়ে আসে। কামাখ্যা চায়ের কাপটা নিয়ে বলে, বাঃ, তোমার নাতনিটি তো বিবাহযোগ্য হইয়া উঠছে। মুখটা ঠিক তোমার স্ত্রীর মতো।

পাশের ঘরে এবার কোমল গা। গা-এর উপরেই পা দেবে। তারপর মা গা রে সা। তোর এবার মরাগাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী।

কামাখ্যাচরণকে বাসে তুলে দেবার জন্য অনঙ্গমোহনও সঙ্গে যাচ্ছিলেন। অনঙ্গমোহন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, কামাখ্যাভাই, আচ্ছা কইতে নি পার ঈশ্বর কিরূপ? আচমকা এই প্রশ্নে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যান কামাখ্যাচরণ।

—কও, ঈশ্বর কিরূপ।

—ঈশ্বর? ঈশ্বর আবার কিরূপ? ক্যান? এইসব প্রশ্ন ক্যান?

—না, জিগাই, ঈশ্বর কিরূপ।

—তেজোময়ং বিশ্বমননত্তমাদ্যং…

—সংস্কৃত-টংস্কৃত ছাড়। খোদ বাংলায় তোমার অনুভবের কথা কও।

—তেজোময় ঈশ্বর, সর্বব্যাপী।

সর্বব্যাপী হয় যদি, তবে এটা জাগ্রত আর অন্যটা নিদ্রিত, এইসব কী কইরা হয়?

—হয়। ঈশ্বর কোথাও প্রকট, কোথাও অপ্রকট।

—তুমি বিশ্বাস কর কামাখ্যাভাই, মনে মনে সত্যই বিশ্বাস কর, হাঁচা হাঁচা-ই বিশ্বাস কর যে, তোমার বাসার সর্ববিদ্যা কালী বড়ই জাগ্রত?

ইয়াতে কোনো সন্দেহ আছে নি?

তুমি বিশ্বাস কর, তোমার কালী আমার স্ত্রীরে খাইছে?

লোকের তাই ধারণা।

তোমার ধারণা কী?

আমারে জেরা কর ক্যান?

ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? সগুণ না নিৰ্গুণ?

ঈশ্বর নির্গুণ কিন্তু গুণের আধার। ভগবান নিরাকার কিন্তু কখনো কালী রূপে, কখনো কৃষ্ণ রূপে, কখনো মহাদেব শিব রূপে প্রকট হন। আসলে সবই এক।

—সবই এক?

—এক ছাড়া কী। কিন্তু একের মধ্যেই দুই। এক প্রকাশক আমারে কইছিল, একখান বই লেইখ্যা দেন, পয়সা দিমু। একের মধ্যে দুই। ব্যাকরণ আর রচনা। ব্যাকরণ না হয় হইল, কিন্তু কী রচনা? না মহাকাশ অভিযান, চীনের বিশ্বাসঘাতকতা, ভারতের খাদ্যসমস্যা…আমি কই দরকার নাই।

—বাইচলামি করতাছি না কামাখ্যা, তর্ক করতাছি। পণ্ডিতের তর্ক, অধ্যাপকের তর্ক। চতুষ্পাঠীর পণ্ডিতরা যেরূপ তর্ক করত।

—আমি তো পণ্ডিত না অনঙ্গভাই, পুরোহিত।

—পুরোহিতও পণ্ডিত হয়। তুমিও ব্যাকরণতীর্থ কামাখ্যা। আমার বাবার টোলে তুমিও এক বছর ন্যায়শাস্ত্র পড়ছিলা।

—সেই অতীতের কথা অনঙ্গভাই, দীর্ঘ অতীত।

—শুন কামাখ্যা, আইজ তোমারে ছাড়ুম না আমি। কও, ঈশ্বর এক না বহু।

—ঐ যে কইলাম, একের মধ্যে বহু। আসলে একই কিন্তু বহুরূপ

—তাহলে নারায়ণ, গণেশ, মহাদেব, ছিন্নমস্তা, মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, ওলাওঠা সবই এক?

—সবই এক। যে কালী সেই কৃষ্ণ।

—আর ওই যে সন্তোষী মাতা নামে এক দেবীর নামে চিঠি আসতাছে?

—সন্তোষী মাতা? সেইটা আবার কী?

—এক দেবী। চিঠি আসতাছে, এই দেবীর পূজা না করলে অমুক শাস্তি, আর পূজা করলে অমুক অমুক লাভ।

—সেই চিঠির কথা আমি জানি না।

—কামাখ্যা, তুমি গন্ধেশ্বরী পূজা জান?

—জানি।

—জাতাপহারিণী পূজা?

—জানি।

—হনুমান পূজা?

—সেইটা ঠিক এখনো…

-আচ্ছা কামাখ্যা, তোমার কখনো মনে হয় না, গীতার সপ্তম অধ্যায়ের অব্যাক্তং ব্যক্তি মাপন্নং শ্লোকটার কথা যেখানে বলছে—স্বল্পবুদ্ধি ব্যক্তিরা ঈশ্বরের অব্যক্ত রূপ না বুইঝ্যা মানুষের আকৃতি মনে করে।

—সেইটা তো বুঝি অনঙ্গভাই, কিন্তু মানুষ তো অত কঠিন জিনিস বুঝে না, নিরাকার কল্পনা করা খুবই কঠিন, তাই একটু ইজি কইরা ভাবে।

—কিন্তু তুমি তো বুঝ যে এইটা ঠিক না। তুমি কি বুঝ না, এতগুলি দেবদেবী সবই মনুষ্য-কল্পনা? আদপে এইসব অস্তিত্বহীন। মানুষেরে প্রতারণা করা হইতাছে।

—প্রতারণা? ছি ছি? তা ক্যান। গীতাতেই কি কয় নাই, ঐ যাং ডাং তনুং ভক্তাঃ শ্রদ্ধয়াৰ্চিতুমিচ্ছন্তি, শ্লোকে-ভক্তরা যে মূর্তিতে আমাকে পূজা করে আমি সেই মূর্তিতেই আবির্ভূত হই।

—কিন্তু তার পরবর্তী শ্লোক মনে আছে তোমার? বলা আছে, ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি পূজা অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাজ।

—কিন্তু এইটা তো যুগ যুগ ধইরা চলতাছে। হঠাৎ আইজ হইল কী তোমার? তুমি এইসব কইতাছ ক্যান?

—ভাবতেছি, কেবলমাত্র পয়সার জন্য, দক্ষিণার জন্য, কাপড়ের জন্য, চাউলের জন্য, ফলফলাদির জন্য আমি ভুল শিক্ষা দিমু? ভগবান তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রার ঊর্ধ্বে। অথচ ইহা গচ্ছ ইহা তিষ্ঠ কইরা তারে খাওয়াই। অথচ নিজেরাই ভোগ করি। দেখ আমি আহ্নিক করি। এইটা আমার জীবনাচার। বিষ্ণু পূজা, নারায়ণ পূজাও করি। এইটা আমার ব্যক্তিগত অভ্যাস। কিন্তু যজমানের বাড়ি গিয়া তার মঙ্গল কামনায় বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করাটায় মন সায় দেয় না আমার। আমার কী ক্ষমতা আছে যে, মন্ত্রদ্বারা আবাহন কইরা ঘটের মধ্যে দেবতারে আনতে পারি। ফলফলাদি নৈবেদ্য দিয়া তারে তুষ্ট করি? তারপর তারে কই এইটা দাও, সেইটা দাও…

কথা বলতে বলতে তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বেলগাছিয়া ব্রিজের ওপরে। তলা দিয়ে বয়ে গেছে খাল। খালের জল এখন প্রায় নেই। কামাখ্যাচরণ বললেন—উৎকট গন্ধ আসতাছে এই খালের জল হইতে। চল সামনে যাই।

অনঙ্গমোহন জলটাকে দেখেন। সত্যিই। স্রোতহীন জল। সুন্দরবনের স্টিমার আসত চার-পাঁচ বছর আগেও। লবহ্রদের জলাভূমির গা দিয়ে এই খাল বিদ্যাধরী নদীতে গিয়ে পড়ত। এখন লবণূহ্রদে মাটি পড়েছে। জলাভূমি হয়ে গেছে উঁচু ডাঙা। কালক্রমে একদিন ওখানে অট্টালিকা হবে, শহর হবে, জনপদ হবে…।

অনঙ্গমোহন বললেন—শুন কামাখ্যা, আজ এইখানে একটা সত্য কথা কই। আসলে বড় অসহায় আমরা। সংস্কৃত ভিন্ন আর কিছুই জানি না আমরা সংস্কৃত আমাগোর বৃদ্ধা মাতা। এই মা আর আমাগরে খাওয়াইতে পরাইতে পারে না। তবু আমরা তাঁরে আঁকড়াইয়া ধইরা আছি। আমরা বস্তুবিদ্যা জানি না। তুমি পূজা পদ্ধতি জান, অঙ্গন্যাস করন্যাস জান। জলশুদ্ধি আসনশুদ্ধি জান, আর মানুষ, আমার দ্যাশের মানুষ অল্পবুদ্ধি, সেইহেতু তুমি ফৰ্দমালা দাও, তোমার গ্রাসাচ্ছাদন হয়। আর আমি?

অনঙ্গমোহন চুপ করে যান। কামাখ্যাও কথা বলে না। একানব্বই নম্বর বাস খালধার ছেড়ে চলে যায়। এই বাসে ওঠা হল না কামাখ্যাচরণের।

এই যে চতুষ্পাঠী কইরা মরতাছি। ক্যান? এই ছাড়া আর করবার কীই-বা আছে আমার। এখন আর জমিদারি নাই কামাখ্যা, জমি দেয় না কেউ। সরকারি সামান্য বৃত্তি, তার নাম আবার ডি.এ, ইংরাজি কথা। ডি.এ-র বাংলা অর্থ হইল দুর্মূল্যভাতা। দুর্মূল্যভাতা সর্বক্ষেত্রে মূল বেতনের সঙ্গে দেয়। আমাগর বেতন নাই, অথচ ডিএ, এই ডিএটুকু পাইতে গেলে তা চতুষ্পাঠী চালাইতেই হয়। কম কইর‍্যা পাঁচজন ছাত্র তো রাখতেই হয়। পরীক্ষায় বসাইতে হয়। অভ্যাসবশে তাই করতাছি আমি।

বাইরের ছাত্র পড়াইতে কয় অনেকে। সংস্কৃতের ছাত্র। কিন্তু ইস্কুলের ছাত্ররা আমার কাছে ক্যান আসব? ইস্কুলের বিএ পাস মাস্টার। তারা তো টিউশনি চায়। আর পরীক্ষার প্রশ্ন থাকে ইংরাজি হইতে সংস্কৃতে অনুবাদ কর। এইসব কি আমি পারি? তবুও চেষ্টা করলে কি জুটে না? কিন্তু কি কইরা পয়সা নিয়া ছাত্র পড়াই কও? চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকরা তো পয়সা নিয়া পড়াইত না। এই যে সরকারি ডিএ রূপ সামান্য দক্ষিণা গ্রহণ করি, তাহাতে শর্ত আছে যে, আমি চতুষ্পাঠীতে সর্বক্ষণের জন্য অধ্যাপনারত আছি কি না। কও, চতুষ্পাঠী ছাড়া কুত্র গতি? আর কীই-বা করতে পারি আমি।

এই যে অধ্যাপনা করতাছি। জানি গাত্রলোম করতাছি। ছাত্রের সন্ধানে ঘুইরা ছাত্র পাই না। সুমিতার মতন ছাত্রী কালে-ভদ্রে পাই। আর শিক্ষাক্রম? সেই যে প্রাচীন পাঠ্যসূচি ছিল, শতাবধি বৎসরের, তার যে কী যৌক্তিকতা আছে সেই সম্পর্কেও প্রশ্ন জাগে আমার। আমি হিতোপদেশের কথাই কই। হিতোপদেশ তো বালকদিগের জন্য। বৃদ্ধস্য তরুণী বিষয় বালকের কাছে কেমনে ব্যাখ্যা করা যায়? বৃদ্ধের পক্ষে তরুণী কি কারণে বিষতুল্য, তারপর স্থানং নাস্তি ক্ষণো নাস্তি শ্লোকে বলা হয়, নারীমাত্রেই পুরুষ পাইলে লোভী হয়। স্থান পাইলেই সঙ্গম করে। আমারে পড়াইতেই হয়। নারীগণের প্রিয় অপ্রিয় জ্ঞান নাই। গরু যেমন নতুন নতুন ঘাস খাইতে চায়, নারীও তেমন নতুন নতুন পুরুষ চায়—গাবর্ণমিবারণ্যে প্রার্থয়ন্তে নবং নবং। কও কামাখ্যাভাই, এগুলি কি রকম কথা? আমার বৌমা যে চাকরি করে… চাকরিস্থলে কত পুরুষ…। কামাখ্যাচরণ বললেন—এগুলি ঋষিবচন। এগুলি ঠিকই কথা। এই কারণেই মহামতি মনু কইছেন—পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে পুত্রশ্চ স্থবিরে—অনঙ্গমোহন বললেন, কিন্তু মাতা স্বসা দুহিতা ন বিবিক্তাসনা ভবেৎ। এইটা আবার কী? এইসব কী? বিশ্বাসোনৈব কর্তব্য স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ। সুহৃদভেদে আছে—উদ্যোগহীনা, দৈবপরবশ, সাহসহীন ও অলস লোককে লক্ষ্মী ভজনা করেন না, যেমন যুবতী স্ত্রী বৃদ্ধপতিকে আলিঙ্গন করতে পারে না-এরূপ ক্যান কামাখ্যা? পঙ্গু যেমন গিরি লঙ্ঘন করতে পারে না এই উপমা তো আরও ভাল হইত। আর হিতোপদেশের উপসংহারে কী আছে শোনবা? আশীর্বচন কইর‍্যা গুরুদেব শিষ্যগণের কইলেন, এই নীতিজ্ঞানগুলি সতত বেশ্যার মতো বক্ষে জড়াইয়া মুখ চুম্বন করতে থাকুক। নীতিবারবিলাসিনী সততং বক্ষস্থলে সংস্থিতা …

এইসব তো শিখাইতেছি আমি। অথচ সংস্কৃত অর্থ এইসবই নয়। সংস্কৃত হীরার খনি। অঙ্কশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, বস্তুবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা কত কিছুর আকর। এইগুলি সব শেষ হইয়া যাইতেছে। আর আমি ছাত্র ধইরা ধইরা হিতোপদেশ অমরকোষ শিখাই আর তুমি গণেশরে ফল খাওয়াও। নারায়ণরে ঘুম পাড়াও আর বাণলিঙ্গ শিবরে স্নান করাও—আর জোর কইরা বিশ্বাস কর, ঐ স্নানে লিঙ্গের শান্তি হইল। বৃহস্পতি স্মৃতির ঐ বাক্যটা মনে আছে কামাখ্যাভাই, যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানি প্রজায়তে। যুক্তিহীন গ্রহণ বর্জনে ধর্মহানি হয়।

—বৃহস্পতি স্মৃতি?—এইসব দরকার নাই অনঙ্গ। আমার ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি, স্তোত্রমালা পুরোহিতদর্পণ মনে রাখলেই চলবে। আর বিশ্বাস।

—সত্য কথাই কইল্যা কামাখ্যা, ঐ বিশ্বাস, বিশ্বাসের ভ্রম না থাকলে, খামু ক্যামনে?

—এই কূট ব্যবস্থাও তাঁরই। তাঁরই ইচ্ছা।

-যেন শুক্লীকৃতা হংসাঃ শুকাশ্চ হরিতীকৃতা
ময়ুরাশ্চিত্রিতা যেন স তে বৃত্তিং বিধাস্যতি।

যিনি হাঁসেদের করেছেন সাদা, শুক পাখিদের সবুজ বানাইছেন, আর ময়ূররে করছেন নানা বর্ণে বিচিত্র, আমাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা তিনিই করেন।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। সন্ধ্যা নামে। রাস্তার আলোয় কালো কালো ঠুলি। জ্বলে উঠল ঠুলি পরা আলো।

কামাখ্যাচরণ বললেন, আর দেরি নয়। দিনকাল বড় খারাপ। যুদ্ধ। অনঙ্গমোহনও বললেন, যুদ্ধ। যুদ্ধ কথাটার সঙ্গে সঙ্গেই ছড়িয়ে দিলেন দীর্ঘশ্বাস। তারপর বললেন, চায়ের দোকান তো করতে পারি না কামাখ্যা, অহং বোধে লাগে, বরং পূজাই করি। কি কও? কামাখ্যা এবার যেন একটু রেগে গেলেন। রাগতস্বরে বললেন—দেখ অনঙ্গভাই, এটা আমার কোনো ঠেকা নয়। পূজা করলে তুমি যদি মনে কর, অধঃপতিত হইবা, কইর না। তোমার অভাব, অসুবিধা আমি জানি। তোমারে ভালবাসি, সেই কারণেই তোমারে কইলাম। বলেই চটির ফটাস ফটাস শব্দ করে বাসে গিয়ে বসলেন। অনঙ্গমোহন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে বাস ছাড়ল। অনঙ্গমোহন তখন এগিয়ে গেলেন। কন্ডাক্টারের খড়িবেড়িয়া খড়িবেড়িয়া শব্দের চেয়েও জোরে চিৎকার করলেন—কামাখ্যা, আমি রাজি। আমি রাজি।

আর তক্ষুণি তর তর করে চোখ বেয়ে জল নামল।

গাড়িগুলোর হেডলাইটের অর্ধেক কালো। রাস্তার আলোর চোখে ঠুলি। কেমন একটা ভয় ভয় রাস্তা। লোকজন কম। পানের দোকানে রেডিওর সামনে মানুষের জটলা। কলাইকুণ্ডায় পাকিস্তান বিমান হানা দিয়েছিল। এখন যদি বোম পড়ে, একটা, এইখানে? বোম কী শব্দ? সংস্কৃত ব্যোম শব্দাগত? ব্যোম, অর্থাৎ আকাশ। আকাশ হইতে পড়ে যাহা? নাকি ইংরাজি। ইংরাজি যদি হয়, এমনকি হইতে পারে না—সংস্কৃত ব্যোম শব্দই ইংরাজিতে বোম হইয়াছে? সংস্কৃতই তো সকল ভাষার আদি জননী। অর্বাচীন ভাষাবিদ্রা এটা স্বীকার করে না। ভারতীয় সেনাদের ইছোগিল খাল অতিক্রম। টালার খালপুল অতিক্রম করে ঘরমুখো হতে থাকেন অনঙ্গমোহন। আচ্ছা, ভারতীয় সৈন্য কি পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে পারে না? পারে যদি? পারলেই কি আবার ফিরে পাবেন অনঙ্গমোহন গোবর নিকানো উঠান, কলাগাছের পাতার আন্দোলন, সুপারির সারি, চতুষ্পাঠী, চতুষ্পাঠী। ছাত্রদের জলঝাঁপ? এখন কি ওখানেও প্লাস্টিক নেই? সর্বত্রই প্লাস্টিক। এখন ওখানেও কি যন্ত্রপাতি কলকব্জা নেই। বস্তুবিদ্যা নেই? সোনাচাকা দত্তপাড়া দেবপাড়ার ছেলেরা কি মটোরবিদ্যা, হিসাবরক্ষা ছেড়ে চতুষ্পাঠীতে আসত?

বাড়ির ভিতরে ঢোকেন অনঙ্গমোহন। বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় নিষ্প্রদীপ। ইংরাজি নাম ব্ল্যাক আউট। কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার। সিঁড়ির গোড়ায় কলঘরের পরিচিত পুরাতন গন্ধ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবেন—এ সময় ‘প্লিজ আর একবার’ এই বাক্য শোনেন অনঙ্গমোহন। অজিতবাবুর কণ্ঠস্বর স্পষ্টতই। ‘না আর না’। চাপা নারী-কণ্ঠ। সুমিতার। অনঙ্গমোহন স্থাণুবৎ। ইঃ, জর্দার গন্ধ। সুমিতা। শাড়ির খসখস। আর চুপ করে থাকা যায় না—

অনঙ্গমোহন চিৎকার করেন—কী হইতেছেটা কী? তখনই ঝটাপট পদশব্দ। শব্দ উপরে যায়। শব্দ নিচে নামে। আঁচল ওড়ানো হাওয়া নেমে যায়। হাওয়ায় প্রসাধন-মাখা গাত্রগন্ধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *