সাত
মা কালীর কাছে মানত ছিল সুরবালার, সে অনেকদিন আগে। বিলু তখন খুব ছোট। দু’বছরের বিলুর ডিপথেরিয়া হয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল কলোনির লোকজন। মানতটা সে সময়েরই। বিলু ভাল হয়ে গেলে কালীমাকে পাঁঠা দেবে।
আজ দেব কাল দেব করে পাঁচ বছর কেটে গেল। শেষকালে সুরবালা মরিয়া।
সকালবেলা স্নান করেই পতির চরণামৃত পান করার অভ্যেস সুরবালার। একটা ছোট বাটিতে সামান্য জল, অনঙ্গমোহনের ঠ্যাংটা টেনে ঝট করে বুড়ো আঙুলটা স্পর্শ করিয়ে ঢক করে গিলে ফেলে জল। সে দিনও তাই হল। আহ্নিকে বসেছিলেন অনঙ্গমোহন, সুরবালা কোত্থেকে উদয় হয়ে ঠ্যাং টানল। ঢক করে জলটা খেয়েই কানের ফুলদুটো খুলে সামনে রাখলেন—এই দুলজোড়া বেইচ্যা পাঁঠা কিন।
ক্যান?
আমি মা কালীরে স্বপ্ন দেখছি রাইতে।
অনঙ্গমোহন আবার প্রথম থেকে শুরু করে—ওঁ প্ৰজাপতিঋষি গায়ত্ৰীচ্ছন্দ…
শোনছেননি আমার কথা। স্বপ্ন দেখেছি। এইবারেই কালীপুজোয় সোনাচাকার মাঝের ঘরে মানতের পাঁঠা বলি দিমু।
সোনাচাকার মাঝের বাড়ি এখন আর পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী-কুমিল্লা সীমান্তের সুপারিগাছ ছাওয়া গ্রাম নয়। দমদম বিমানবন্দরের কাছে এক কাচ-কারখানার চিমনির পাশে টালির চালা আর বাঁশের বেড়ার একটি ঘর। এখানে কামাখ্যা চক্রবর্তী থাকেন। উনি সর্বানন্দ বংশীয়। সোনাচাকায় তাঁদের গ্রামের বাড়িতে পৌষ সংক্রান্তির দিন কালীপুজো হত। এখন এই মতিলাল কলোনির বাড়িতেও হয়। বিশ-পঁচিশ জন সর্বানন্দ বংশীয়রা আসেন। সর্বানন্দ বংশীয়দের বলা হয়ে থাকে সর্ববিদ্যা। সর্বানন্দ ছিলেন মেহারের এক কালীসাধক ব্রাহ্মণ। কামাখ্যা পুরোহিত নিজেকে কামাখ্যাচরণ সর্ববিদ্যা অভিহিত করে থাকেন। পৌষ সংক্রান্তির রাতে সর্বানন্দ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন এই কারণে ঐ দিনই কালীপূজা হত সোনাচাকার সর্ববিদ্যাদের ঘরে। একটি কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি ছিল। মেজতরফের ঘরেই স্থাপিত ছিল ঐ কালীমূর্তি। কামাখ্যা সর্ববিদ্যা সেই কালীমূর্তি মাথায় করে বর্ডার পার করেছিলেন।
পৌষ সংক্রান্তির দিন সকালবেলা একটি পাঁঠা এবং বিলুকে নিয়ে অনঙ্গমোহন, সুরবালা এবং অঞ্জলি হাজির হয়েছিলেন গ্রাম-সোনাচাকার মেজতরফের বাড়ি। নৌকো করে যেতে হত জনাই খালের ভিতর দিয়ে। আজ সাইকেল-রিকশায় এলেন। সুরবালা ও অঞ্জলি। কোলে কালো পাঁঠা। বিলু ও অনঙ্গমোহন পদব্রজে। ষোল নম্বরের বি প্লটের সামনে খেজুরগাছে টিনের পাতে লেখা সর্ববিদ্যা কালীমন্দির।
সুরবালা সুর তুলে বললেন, ও মা, কী সুন্দর মন্দির হইয়া গেছে।
পাঁচ ইঞ্চির গাঁথনি, লাল সিমেন্টের মেঝে, এর মধ্যে লাল রঙের পাকা বেদি, বেদির ওপরে কালো পাথরের কালী।
ওমা, কী সুন্দর গাছ লাগাইছেন আশা বৌদি, কত জবা গাছ।
কামাখ্যাচরণ পরিকল্পনা করে লাগিয়েছেন সব। সর্ববিদ্যা কালীমন্দির মোটামুটি স্বয়ম্ভর। বারটা জবা গাছ আছে বাড়িতে, কয়েকটা তুলসী ঝোপ, একটা বেলগাছ, একটা আমগাছ। সুতরাং বিল্বপত্র, রক্তপুষ্প, তুলসী এবং আম্রপল্লবের ব্যাপারে এই মন্দির স্বয়ম্ভর। একটি সবৎসা গাভীও আছে। সুতরাং আসনশুদ্ধি, বেদিশুদ্ধি ইত্যাদির জন্য গোময় ও গোমূত্র সংগ্রহের কারণে বাইরের খাটালে দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। দুটি নারকেলের গাছও আছে। নারকেলের নাড়ু তো প্রায়ই লাগে।
সুরবালা গাছপালাগুলিকে দেখছিলেন। খেজুর গাছের গায়ে পাঁচটি ক্ষতচিহ্ন। পাঁচবার রস দিয়েছে এই গাছ। এখন, এই মুহূর্তে তাঁর পূর্ববাংলার ফেলে আসা ঘরের জন্য আপসোস মনে এল না তেমন, বরং শেঠবাগান কলোনির কথা মনে পড়ল, মাটির কথা মনে পড়ল। ঐখানে টিকে থাকতে পারলে হয়তো দুটো নারকেলগাছ বড় হয়ে যেত এতদিনে।
কামাখ্যাচরণের বড় ছেলে রেলে কাজ করে। বছরখানেক হল, আলাদা হয়ে রেলকোয়ার্টারে উঠে গেছে। আজ ছেলেটিও সপরিবারে আছে। কামাখ্যা পুরোহিতের ছোট ছেলেটি বেকার। বিবাহযোগ্য কন্যা আছে একটি ।
আশালতা বলেন, ভালই হইছে আগেভাগে আইছ ভইন। কত কাজ। আস, কাপড় ছাড়, ঠাকুরঘরে আস।
কামাখ্যাচরণের কত শুদ্ধাচার। এনামেলের বাসন বাসায় ঢোকে নাই। পিতলের আর পাথরের থালে নৈবেদ্য। পাড়াপড়শিরা কেউ সন্দেশের বাক্স এনে দিলে ফেরত দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, মিষ্টির দোকানে সিঙাড়া, কচুরি এসব তৈরি হয়। শাস্ত্রানুসারে তণ্ডুল জাতীয় পদার্থ-মধ্যে লবণ প্রয়োগে সেই খাদ্য উচ্ছিষ্ট তুল্য হয় এবং ঐ সিঙাড়া-কচুরির স্পর্শদোষে সন্দেশাদি মিষ্টান্ন দ্রব্যও অপবিত্র হয়।
কামাখ্যাচরণ প্রকৃতই শাস্ত্রানুরাগী ব্রাহ্মণ। জগৎপতি সূর্যদেব উদিত হবার পরে যে দন্তধাবন করে, সে পাপিষ্ঠ। কামাখ্যাচরণ সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা পূর্বে শয্যা ত্যাগ করেন। নিমডালে দন্তধাবন করেন। পুকুরে অবগাহন করেন। গামছা পরিধানরত অবস্থায় পুষ্পচয়নে যান। নিজ গৃহে জবা ও টগর ভিন্ন অন্য ফুল গাছ না-থাকায় প্রতিবেশীর বাড়িতেও যেতে হয়। যেহেতু মায়ের পূজার ফুল, কেউ সরাসরি আপত্তি করে না। তবে মেঘনাস্মৃতি নামে যে ঢঙের বাড়িটা, ও বাড়ির একটা ছোঁড়া, যে নাকি আবার জেসপ কোম্পানিতে কাজ করে, একদিন বলছিল—ঠাকুরমশাই, আপনি এবার থেকে গামছার তলায় একটা আন্ডারপ্যান্ট পরে আসবেন প্লিজ। তখন বারান্দায় তার স্ত্রী হাসছিল। লজ্জাহীনা।
কলিকালের কিরূপ ধর্ম এই প্রসঙ্গে এই গামছা এবং আন্ডার-প্যান্টঘটিত গল্পটা কামাখ্যাচরণ একদিন অনঙ্গমোহনকে বলেছিলেন। অনঙ্গমোহন তখন মনে মনে ভেবেছিলেন, পণ্ডিত ও পুরোহিতের এই হল তফাত। অনঙ্গমোহন ঠাকুরমশাই নন। উনি হলেন আচার্য। পণ্ডিত।
কামাখ্যাচরণের কালীমন্দিরের এখন বেশ মাহাত্ম্য। প্রণামী বাক্সে খারাপ টাকাপয়সা হয় না। অনেকেই অফিস যাবার সময় মন্দিরে কপাল ঠেকিয়ে যান, একটু ঘুরপথ হলেও। কলোনিতে নতুন বিয়ে হলে নববিবাহিত দম্পতি এখানে এসে কালীমাতা দর্শন করে যান। এই পাড়ার একজন লটারির টিকিট কিনে কামাখ্যাচরণকে অনুরোধ করেছিলেন, একবার মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে দিতে। সেই ভদ্রলোক লটারির সেকেন্ড প্রাইজ পেয়ে গিয়েছিলেন। তার বাড়িটার নাম যদিও বিক্রমপুর ভবন, কিন্তু লৌকিক নাম হচ্ছে লটারি বাড়ি। উনি কালীমাকে একটি সোনার জিহ্বা দান করেছেন। ঐ লটারি বাড়ির গিন্নি ও আজ পূজার দিন সকাল থেকেই রয়েছেন। তাঁরা মিত্র। কায়স্থ নৈবেদ্য স্পর্শ করতে পারবেন না। তবে কালীমায়ের পাশে বসে থাকতেও তাঁর শান্তি।
বিলু বার বার ঘুরেফিরে এসেই পাঁঠাটাকে আদর করছিল। নরম চকচকে লোম। লোমের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল বার বার। মাথায় ছোট দুটো সদ্য ওঠা শিং-এর ফুটকি। যেন বিসর্গ চিহ্ন। বিলুর জন্যই মরতে হবে একে।
কামাখ্যাচরণ পাঁঠাটাকে পরখ করলেন। পূজায় চাই নিখুঁত পাঁঠা। পাঁঠাকে খেতে দিলেন কাঁঠালপাতা, তারপর শিশি থেকে এক গণ্ডুষ জল ছড়িয়ে দিলেন পাঁঠাটির গায়ে। সেই শিশির জল, যেখানে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী ইত্যাদি নদীর জল মেশানো আছে। শিশির জল শেষ হয়ে এলে আবার পুকুরের জল মিশিয়ে দেন তিনি। অনঙ্গমোহনের ছাত্র জীবন মজুমদার ব্যাপারটা শুনেছিলেন। উনি বলেছিলেন, বাঃ, এ যে হোমিওপ্যাথিক মাহাত্ম্য। যত ডাইলিউট হয় তত শক্তি বাড়ে। কামাখ্যাচরণ সকালবেলা স্নান আহ্নিকের পর যে মায়ের প্রসাদ খান সেটিও মারাত্মক। ড. মজুমদার ঐ জিনিসটির নাম দিয়েছেন মোলাসেসিয়াম। গুড় ইংরিজি মোলাসেস্। কামাখ্যা পুরোহিতের মাতৃবিয়োগ হয় অকস্মাৎ। মরণকালে উপস্থিত ছিলেন না কামাখ্যাচরণ। যজমানিতে পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। মাতৃবিয়োগের সংবাদ পেয়ে দ্রুত ছুটে এসেছিলেন কামাখ্যাচরণ। কাঁদলেন। তারপর এক টুকরো পাটালি গুড় মৃত মায়ের মুখের ভিতর ঠেলে দিলেন। আঙুল দিয়ে মুখের মধ্যে ঘোরাবার চেষ্টা করলেন গুড়ের টুকরোটা, তারপর আঙুল বেঁকিয়ে বার করে আনলেন। বললেন, মায়ের প্রসাদ। কণামাত্র প্রসাদ গ্রহণ করতেন স্নান আহ্নিকের পর। কিন্তু কণামাত্র হলেও তো একদিন শেষ হয়, তাই শেষ হবার আগেই তার সঙ্গে আধ সের গুড় মিশিয়ে দিয়ে কৌটোয় রেখে দিয়েছিলেন যত্ন করে। পার্টিশনের পর দরকারি জিনিসপত্রের সঙ্গে ঐ কৌটোটাও নিয়ে এসেছিলেন। ঐ কৌটোর আবার শেষ হয়ে যাবার আগেই আবার আধ সের যোগ হয়েছে, এই কয় বছরে তিনবার হয়েছে এরকম। মায়ের মুখের প্রসাদ এইভাবে কখনোই শেষ হয় না।
কামাখ্যাচরণের ছোট ছেলে মানিক পাঁঠাটাকে দেখে গেল একবার। ঘাড়টা টিপল। কালাচাঁদও দেখে গেল পাঁঠাটা। কালাচাঁদ প্রতিদিন সকালে আসে। পুজোর জোগাড়যন্ত্র করে। নারায়ণ পুজোটা কালাচাঁদই করে, আর যে দিন কামাখ্যা যজমানিতে সকাল সকাল চলে যান, কালীপুজোটাও কালাচাঁদকেই করতে হয়। কালাচাঁদ মাসিক বেতন পায়। এই কালাচাঁদকে মাইনে দিয়ে রাখবার কোনোই প্রয়োজন ছিল না, যেখানে মানিকের মতো একটা গাভুর ছেলে রয়েছে। মানিক আই.কম পাস। নাইটে বি.কমও পড়েছিল। পার্ট ওয়ানটা পাস করতে পারেনি। চাকরির চেষ্টা করছে। ও যদি মন্দিরটার দিকে একটু দেখত, একটু পুজোআচ্চা পৌরোহিত্যে মন দিত, তা হলেও ওর ভবিষ্যৎটা মোটামুটি চলে যেত।
পাঁঠার গলায় জবার মালা। কালাচাঁদ পাঁঠাকে স্নান করিয়ে এনেছে, তাই গায়ের লোমে কার্পেটের মসৃণতা আর নেই, ছোট ছোট শিং দুটোয় সিঁদুরের ফোঁটা। কামাখ্যাচরণ ওঁ অস্ত্রায় ফট্ মন্ত্রে ছাগশিশুটিকে নিরীক্ষণ করলেন, কুশোদক দ্বারা প্রোক্ষণ করলেন। সুরবালা এবং অঞ্জলি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মানসিক কার? কামাখ্যাচরণ জিজ্ঞাসা করলেন। সংকল্প বাক্য কার নামে হবে? অঞ্জলি বলল, বিপ্লব ভট্টাচার্য। বিলু কি রকম অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। কামাখ্যাচরণ মন্ত্রঃপূত জল ছিটিয়ে দিলেন পাঁঠাটার গায়ে। পাঁঠাটার কানের কাছে মুখ দিয়ে বলল, ওঁ হৈং হৌং ইমং পশুং স্বৰ্গং প্রদর্শয় মুক্তিং নিয়োজয় স্বাহা। পাঁঠাকে নিয়ে যাওয়া হল হাড়িকাঠের দিকে। হাড়িকাঠে চাপানো হল। ঠ্যাং ধরল মানিক। কালাচাঁদের হাতে খাঁড়া। খড়গ ওঠাল কালাচাঁদ। চারিদিকে জয় মা, কাঁসর-ঘণ্টা। ইমং ছাগপশু বহ্নি দৈবতং ভূভ্যমহং ঘাতয়িস্যে। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ। মানুষের আর্তনাদ। হায়রে…. কী সর্বনাশ হল। সুরবালা কপালে করাঘাত করে মাটিতে পড়ে গেল। পাঁঠার মাথাটা শরীরেই রয়েছে। বলি হয়নি। এ কী করলে মা, মাগো, আবার খড়গ তোলে কালাচাঁদ। হাতের শির ফুলে উঠেছে আরও, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে খড়গাঘাত করে কালাচাঁদ। অখণ্ডই রয়ে গেল, সুরবালা লুটোপুটি খায়। আমারে খা, মা তুই আমারে খা। আমি হতভাগিনী। আমার দান নিলি না ক্যান…অঞ্জলি গড়াচ্ছে। মানিক পাঁঠাটার পা ছেড়ে দিয়েছে। কালাচাঁদ উন্মাদের মতো নিজের মাথায় কিল মারতে থাকে। তখন মাথা ঠাণ্ডা রাখেন অনঙ্গমোহন। সুরবালাকে বলেন, ব্যাকুলা হয়ো না। কামাখ্যাচরণের কানে কানে কিছু বলেন। কামাখ্যাচরণ নিজে হাতে খড়গ তুলে নেন। তারপর কি ভেবে আবার খড়গ তুলে দেন কালাচাঁদের হাতে। নিজে পা দুটি চেপে ধরলেন। বললেন, সবাই স্থির হও। মাতৃনাম উচ্চারণ কর। জয় মা। খড়গ নেমে আসে। এইবার শিরচ্ছিন্ন হয়। ঝটপট করতে থাকে ছাগ-কবন্ধ।
এবার ছাগরক্তের টিপ পরিয়ে দিলেন কামাখ্যাচরণ বিলুর কপালে—ওঁ ঐং হ্রীং শ্রী ক্লিন্নে মদদ্রব স্বাহা। কামাখ্যা পুরোহিত বললেন, এই ছাগমুণ্ড দেবীকে উৎসর্গ করা যায় না। এটা বিঘ্ন-বলি। একটিমাত্র কোপে ছাগের শিরশ্ছেদন করতে হয়। একাধিক কোপ মানে তো জবাই, সে তো মুসলমানরা করে। বলি-বিধিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, এককোপে বলি না হলে সেই পশু উৎসর্গ করা চলে না।
নিয়মানুযায়ী সেই ছাগশিশুকে এক হাজার আট টুকরো করে হোম করা হল।
ঐ হোমে কি কালী খুশি হবেন? পাড়াপড়শিরা সন্দেহ করতে লাগল। বলিতে বিঘ্ন হলে নানা অমঙ্গল। সংসারে কারো না কারোর ক্ষতি হয়েই থাকে।
যে দেবী যত উগ্রা, যত হিংসা, সেই দেবীই তত জাগ্রতা। বলিতে বিঘ্ন ঘটার পর ভক্তরা সবাই একটা না একটা অমঙ্গল আশঙ্কা করছিল এবং একটা অমঙ্গল কি কামাখ্যাচরণ নিজেও চাইছিলেন না? এমন একটা অমঙ্গল যা নিজের পরিবারের মধ্যে হল না। যদি কালাচাঁদের উপর দিয়েও অমঙ্গলটা হয়ে যায়?
কিন্তু কালাচাঁদ কিছুদিনের মধ্যে পোস্ট অফিসের পিওনের চাকরি পেয়ে গেল।
প্রণামী বাক্সে টাকাপয়সা অনেক কম কম পড়তে লাগল। কালী যদি সত্যিই জাগ্রত হতেন, অ্যাদ্দিনে কাউকে খেতেন।
মিত্রগিন্নী একদিন শেষ রাতে শুনলেন, ঠাকুরবাড়িতে কান্নার রোল। ধড়মড় করে উঠে বসলেন, মা কালী কাউকে নিয়েছেন বোধহয়। তারপর বুঝলেন স্বপ্ন। সবাই ভাবল, মা-কালী নিশ্চয়ই কাউকে নেবেন। কিন্তু নেওয়া আর হচ্ছিল না। তাই হচ্ছিল না মায়ের গায়ে নতুন কোনো অলঙ্কার, নতুন সোনার চোখ, নতুন কোনো কানের কিংবা গলার অলঙ্কার। কালীর মাহাত্ম্য আর থাকছিল না। মানিক এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের অফিসারকে মোটা কিছু ঘুষ দেবে ভেবেছিল। কালীর ওপর ভরসা নেই।
ঐ বিঘ্ন-বলির এক বছরের মধ্যেই বিলুর ঠাকুমাকেই খেলেন কালী। ঐ খালপাড়ে। মানসিকটা ওঁরই ছিল কিনা। যেদিন সুরবালা মারা গেলেন, সেদিন ভোরবেলা পেচ্ছাপ করতে উঠে মানিক একবার নাকি মন্দিরে উঁকি দিয়েছিল এবং দেখেছিল, কালীর মুখে যেন রক্ত লেগে আছে।