চতুষ্পাঠী – ৫

পাঁচ

উপনয়নের পর ডিম খেতে পাচ্ছে না বিলু। পেঁয়াজ রসুন ডিম এসব তো নিষেধই, বাইরের কিছু কিনে খেতেও নিষেধ করে দিয়েছেন অনঙ্গমোহন। বাজারে কিছুদিন ধরে চালের টানাটানি। রেশনে চালের বরাদ্দ কমিয়ে গম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়িতে রুটি হচ্ছে। প্রফুল্ল সেন বলছেন, গম খান। চাল কম খান। অনঙ্গমোহন রুটি খেতে চান না। খৈ এবং গুড়সমেত কাঁসার থালায় আজকাল বড় তীব্র ঠং শব্দ শোনেন অনঙ্গমোহন। বিলু বেশ ভালো কায়দায় রুটি খায়। একটা শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে রুটিতে মাখিয়ে নেয়, সঙ্গে একটু সরষের তেল এবং নুন। গরম গরম খেতে হেভি লাগে। রুটির সঙ্গে তরকারি খেতে নিষেধ করেন অনঙ্গমোহন। সিদ্ধ ব্যঞ্জন লবণ প্রয়োগে উচ্ছিষ্ট হয়।

আজ রান্নাঘরে সস্প্যানে ভাতের ফ্যানের উপর ডিমের খোলা ভাসছে। তাহলে আজও মামলেট হয়েছিল। বিলুর মা সাড়ে ন’টার সময় কাজে চলে যায়, তখন রান্নাঘরে তরকারির খোসা ছড়ানো থাকে, শিলনোড়ায় শুকনো মশলা, কখনো ভাতের ফ্যানের উপর ভেসে থাকে ডিমের খোলা। অবশ্যই হাঁসের। মুরগির ডিম ঢোকে না। স্বপ্নার মরনিং স্কুল। স্বপ্না স্কুল থেকে এসে রান্নাঘর পরিষ্কার করে, অনঙ্গমোহনকে খেতে দেয়। এখন ঢাকা উঠিয়ে বিলু দেখল মামলেট রাখা আছে, একাকী, অনাথ। অন্য সব ডাল-তরকারি থেকে বিচ্ছিন্ন। আলাদা করে ঢাকা দেওয়া, অন্য ডাল-তরকারিতে যাতে স্পৰ্শদোষ না লাগে। মামলেটটার থেকে বেরিয়ে আসছে লঙ্কার কুঁচির সবুজ আভাস। আহা ডিম। কেন যে পৈতা হল।

অনঙ্গমোহন তাঁর টোল খুলে বসেছেন। তিনটি মাদুর গোটানো থাকে বারান্দায়। বারান্দাটা ঘরেরই লাগোয়া এবং বারান্দার দক্ষিণ দিকে একটি জানালা আছে। দক্ষিণের জানালার তলায় জেলেপাড়ার বস্তি। চারিদিক ঘেরা কিন্তু আচ্ছাদনহীন কলঘর, দোতলার বারান্দার দক্ষিণের জানালা দিয়ে দেখা যায়। চৈত্রে, যখন দক্ষিণ দিক থেকে হু হু করে হাওয়া আসে, তখন ঐ দক্ষিণের জানালার শিক ধরে শিখার বাবা গান করেন, আজি দখিন দুয়ার খোলা—ঐ জায়গাটা এখন পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠী। বারান্দাটার এই অংশটুকু লাল সিমেন্ট করা। মসৃণ। শিখা ও স্বপ্না এক্কা-দোক্কা খেলত, এখন খেলে না। এখানে একটা ছোট্ট গর্ত আছে, ওটা পিল। ওখানে গুলি খেলা যায়। বিলু ও অসীম গুলি খেলে। জায়গাটা এখন এই মুহূর্তে পূর্ণচন্দ্ৰ চতুষ্পাঠী। অনঙ্গমোহন বসেছেন একটি আসনে। মাদুরে সুমিতা ও ডাক্তারবাবু। মেঝেতে বসে আছে অসীম। অনঙ্গমোহন বললেন, পঞ্চমে পঞ্চমাংস্কৃতীয়ান্নবা—এটাই হইল সূত্র। বুঝলানি অসীম। অসীম মাথা চুলকোল। অসীম ব্যাকরণের আদ্য পড়ছে। ডাক্তারবাবুও তাই। সুমিতা কাব্যের আদ্য-মধ্য পাস করেছে। উপাধি দেবে। উপাধি পাস করলেই কাব্যতীর্থ হয়ে যাবে সুমিতা। সুমিতা অনঙ্গমোহনের গৌরব। অসীম ও ডাক্তারকে বিদায় করে সুমিতাকে নিয়ে বসবেন অনঙ্গমোহন। অনঙ্গমোহন বললেন—বর্গপ্রথমাঃ পদান্তাঃ পঞ্চমে পরে পঞ্চমান্যপদান্তে তৃতীয়ান্নবা। অর্থাৎ বর্গের পঞ্চম বর্ণ পরে থাকিলে পদান্তে স্থিত বর্গের প্রথম বৰ্ণ স্থানে সেই বর্গের পঞ্চম অথবা তৃতীয় বর্ণ হয়। যথা বাক্যুক্ত মতি এখানে ক হইল প্রথম বর্ণ। আর পঞ্চমবর্ণ ঙ। তা হলে গিয়া বাঙমতী। তারপর তৃতীয় বর্ণ অর্থাৎ গ্ হইয়া বাগ্মতী হইল। তাইলে বাক্যুক্ত মতি সমান সমান বাগ্মতী। সেইরূপ প্রাকযুক্ত কথন সমান সমান প্রাগকথন। ক স্থানে গ। সংস্কৃত এইরূপ সূত্ৰ-বদ্ধ ভাষা। নড়চড় হইবার উপায় নাই।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন—পণ্ডিতমশাই, আমরা যে বলি, কাগের ডিম, বগের ডিম। এখানে ক স্থলে গ হয় কেন?

সুমিতা অনঙ্গমোহনের দিকে মুখ টিপে হাসল। অনঙ্গ সুমিত্রার ভ্রূভঙ্গি প্রত্যক্ষ করে বললেন—অপৃষ্ঠ বহুভাষাতে।

অনঙ্গমোহন বললেন-তোমরা ভ্রান্তিবশত কাকরে কও কাগ। বকরে বগ। দ্বিপ্রহর শব্দাগত দুপুররে তোমরা কও দুকুর, পিপড়ারে কও পিমড়ে। এইসব ভ্ৰম।

পণ্ডিতমশাই কিছু মনে করবেন না। আমনারাও কিছু ভুল উচ্চারণ করেন। টাকাকে বলেন টাহা। এই ‘আমনারা’ মানে কী বলতে চাইছে এই ডাক্তার ছাত্র, অনঙ্গমোহন বুঝে নেন। আমনারা মানে বাঙালরা।

একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় অকস্মাৎ। তখন সদ্য কলকাতা এসেছেন অনঙ্গমোহন। অনন্তনাথ জ্যোতিভূষণের বাড়িতে রয়েছেন। এক পণ্ডিত- নিমন্ত্রণে তারকেশ্বর পাঠালেন অনন্তনাথ। ট্রেনে বসেছিলেন। জানালা দিয়ে কয়লার গুঁড়ো আসছিল। ধুতি এবং নামাবলীতে কুঁচি-কুঁচি কয়লার গুড়ো ভেসে এসে পড়ছিল। পাশে বসে কথা বলছিল দু’জন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। বলছিলেন, তেভাগার ঝামেলি মিট্‌মিটন্তি হল নে, অছতো আবার আরেকটা আইন আসছে। আবদুল্লা রসুল আর ভূপালপাণ্ডা খুব নাফাচ্ছে। আর একজন বলল, চাষে আর কিছু থাকবেনি। দিনকে দিন খরচ বাড়ছে অছতো ফসলের ভাগ ওদেরকেই দিতে হবে। অরাজক। অন্যজন, ট্যাক্সো দিচ্ছি আমরা অছতো চেল্লাচ্ছে নাঙল যার জমি তার। অনঙ্গমোহনের সামনে বসে ছিল একটি যুবা। হাতে একই বই—মৃদু মৃদু হাসছিল। পরনে ফুলপ্যান্ট ও জামা। হঠাৎ বলল—এই রেল কোম্পানির অবস্থাটাই দেখুন না। কয়লা ওড়াচ্ছে, অছতো ট্রেনের জানালা নামানো যায় না, অছতো আবার ভাড়া বাড়ল। অনঙ্গমোহনকে লক্ষ করলেন সেই মধ্যবয়সী দুজন পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাল। একজন বলে উঠল, খুব তো ড্রেস লাগিয়েচ। ফুলপ্যান্টালুন গলিয়েচ। অছতো ভদ্রতা শেখনি।

মনে মনে রসিক যুবকটিকে তারিফ করেছিলেন তিনি।

সেই দিনই তারকেশ্বরে আর এক ঘটনা। ফলারের সময় পরিবেশনকারীকে অনঙ্গমোহন বললেন, দধির সঙ্গে কিঞ্চিৎ চিড়া দেও। পরিবেশনকারী বলল— চিড়া কি আবার, বলুন চিড়ে। একটু পরে অনঙ্গমোহন বললেন, সামান্য গুড়ে দেও। একথা শুনে সে হেসে উঠল। একজন ভাটপাড়ার পণ্ডিত টিপ্পনী কাটল, ‘বাঙালা যদি মনুষা, হরিহরি, প্রেতাস্তদাকিদৃশ্য।’

অনঙ্গমোহন পরবর্তী সূত্রে চলে যান। বলেন, সন্ধিবৃত্তি দ্রুত শেষ কর। আরও অনেক পড়া আছে। অসীম উশখুশ করে। বলে ইস্কুল যাব। অনঙ্গমোহন বলেন, আর একটা সূত্র। বর্গপ্রথমেভাঃ শকারঃ স্বরযবর পরচ্ছ… কাশতে থাকেন অনঙ্গমোহন। অসীম উঠে পালায়। ডাক্তার জীবন মজুমদার জিজ্ঞাসা করলেন—রাত্রে বাড়ে? কপাল ঘামে? জল পিপাসা কেমন? কাশির দমকের মধ্যেই অনঙ্গমোহন হাত বাড়িয়ে বললেন, থামো। থামো। জীবন মজুমদার হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। ‘হোমিওপ্যাথিক অমৃত’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। সহজ হোমিও চিকিৎসা। ছড়ার ছন্দে বিরচিত। কাশির দমক থামলে অনঙ্গমোহন বললেন, আগে সূত্রটি শেষ করি, পরে তোমার প্রশ্নাদির উত্তর। তোমার হোমিও প্রশ্ন বড় দীর্ঘ প্রলম্বিত হয়। বৰ্গপ্রথমেভ্য শকার…জীবন ডাক্তার বললেন—কিন্তু অসীম ভাই যে নেই…। অনঙ্গমোহন দেখলেন অসীম পালিয়েছে। তিনি কপালে মৃদু চপেটাঘাত করলেন। সুমিতাকে বললেন, আমার এরকমই অদৃষ্ট। দেখ দেখি, গুরুগৃহে থাইক্যা ও কেমন গুরুর অবাধ্য হয়…। ঝনঝনায়তে। সুমিতা বলল, অসীমভাইকে নিয়ে বড় বেশি উচ্চাশা আপনার, কিছু মনে করবেন না।

এই চতুষ্পাঠীতে ছাত্ররা পরস্পরকে ভাই বলে সম্বোধন করে। অনঙ্গমোহনের এই রকমই নির্দেশ। অনঙ্গমোহনের পিতার চতুষ্পাঠীতেও এরকমই নিয়ম চালু ছিল। বয়স নির্বিশেষে সব ছাত্রই পরস্পরের ভাই। মাধবভাই, আশুভাই, শশাঙ্কভাই, এমনকি রশিদভাই। গুরুকুলের এমনই নিয়ম। এক গুরুর দীক্ষিতরা যেমন পরস্পরের গুরুভাই। তেমনই একই আচার্যের ছাত্ররা পরস্পরের গুরুভাই। এই প্রাচীন নিয়ম এখনো চালু রাখতে চান অনঙ্গমোহন।

জীবন ডাক্তার বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই বললেন, কদিন ধরে এরকম কাশি হচ্ছে পণ্ডিতমশাই? পণ্ডিতমশাই ডাকটা খুব একটা পছন্দসই নয় অনঙ্গমোহনের। সুমিতা যখন আচার্যদেব বলে ডাকে তখন হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে অনঙ্গমোহনের।

কাশি কি শুকনো?

কাশির সঙ্গে গয়ের ওঠে, গয়ের?

এই ছাত্রটিকে একেবারেই অপছন্দ অনঙ্গমোহনের। অথচ বলতে পারেন না, তোমার মতো ছাত্রের দরকার নেই আমার। কারণ পাঁচজন ছাত্র না দেখাতে পারলে সরকারি সাহায্য পাওয়া যায় না। এই জীবন ডাক্তার যদি পুনঃপুন অকৃতকার্য হয় এবং সেইসঙ্গে অধ্যবসায় বজায় রাখে তবে সে এই টোলের একটি স্থায়ী ছাত্র হিসাবে বহুদিন পাঁচজনের একজন থাকতে পারে। এ কারণেই জীবন ডাক্তারকে রুষ্ট করেন না অনঙ্গমোহন, বরং তুষ্টই করেন।

জিভটা দেখান তো পণ্ডিতমশাই।

অনঙ্গমোহন জিহ্বা প্রদর্শন করলেন।

জীবন ডাক্তারের তিন দিনের ওষুধ দু’টাকা। জেলেপাড়ার মোড়ে তার চেম্বার, খুব ভিড়। অনঙ্গমোহনও তারই শরণাপন্ন। জীবন ডাক্তার একদিন সাদা সাদা গুঁড়োর মধ্যে একফোঁটা ওষুধ ফেলে বললেন—ঝুঝলেন পণ্ডিতমশাই, এ হচ্ছে অ্যাটমিক ওষুধ। অ্যাটমিক অ্যাকশন। সংস্কৃতে শুনেছি সব আছে। অ্যাটমের কথা আছে?

অ্যাটম? মানে অণু-পরমাণু? অনঙ্গমোহন মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন, নিশ্চয় আছে। সবই আছে। সংস্কৃত ভাষা হইল হীরার খনিবিশেষ। এর মধ্যে থিক্যা সব সংগ্রহ কইরা নিতে হয়। জীবন ডাক্তার বললেন—বুঝলেন পণ্ডিতমশাই, সংস্কৃতটা শিখে নিতে পারলে হোমিওপ্যাথি নিয়ে একটা রিসার্চ করা যেত। এই দেখুন না, মহেন্দ্রবাবুর হোমিওপ্যাথির বইয়ের ফার্স্ট পেজে কী লেখা আছে—সমঃ সমং শময়তি। ল্যাটিনে হল সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টাম। আচ্ছা, সংস্কৃতে অ্যাটম, মানে অণু-পরমাণু সম্পর্কে কি বলা আছে? অনঙ্গমোহন বলেন—আছে, আছে, প্রচুর আছে। অণু আর পরমাণু এই শব্দ দুটোই তো সংস্কৃত।

এইভাবেই শুরু হয়েছিল জীবন ডাক্তারের সংস্কৃত প্রেম। আজ চার মাস যাবৎ অনঙ্গমোহনের টোলে যাওয়া আসা। শোনা যায়, এর আগে জীবন ডাক্তার কাজী সব্যসাচীর কাছে চার মাস আবৃত্তিচর্চা করেছিলেন, মনোহর আইচের কাছে ব্যায়াম শিক্ষা নিয়েছিলেন আড়াই মাস।

মিষ্টি পছন্দ না নুন? ও হ্যাঁ, সে তো আমি জানিই, মিষ্টি পছন্দ।

—দিনে বাড়ে না রাত্রে বাড়ে?

তেমন কিছু নয় জীবন। ঔষধ না হলেও চলবে। সামান্য অনিয়ম হয়েছিল। রোজই গঙ্গাস্নান করি, গত পরশুদিন কলের জলে স্নান করেছিলাম।

—অসুখ অবহেলা করবেন না পণ্ডিতমশাই। সামান্য একদিন অসামান্য হয়। ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল। বলুন পণ্ডিতমশাই, রাত্রে বাড়ে?

রাত্রেই বাড়ে মনে হয়।

ওঃ পেয়ে গেছি। স্পঞ্জিয়া থার্টি।

দমকে দমকে কাশি রাত্রে বৃদ্ধি হয়।

স্পঞ্জিয়া থার্টি দিলে আরাম নিশ্চয়।

আমার হোমিওপ্যাথিক অমৃত বইতে লিখে রেখেচি আমি।

বিলু রান্নাঘরে ঢুকে ঢাকনা উঠিয়ে দেখে নেয় কী কী রান্না হয়েছে। দেখলে চারটে আলুর গোল্লা, ডাল, আর একটু দূরে অন্য বাটিতে ঢাকা মামলেট। একটা থালায় নটেশাক কুঁচি করা আছে। বোঝাই যাচ্ছে, রান্না করার সময় পায়নি মা। ডিমের মামলেটটা একটু খুঁটে নেয় বিলু। পাপ হল? ধুর। আত্মাকে কষ্ট দিতে নেই। চম্পা কেবিনে আলুর দম কুড়ি পয়সা প্লেট, ডিমের ওমলেট চল্লিশ পয়সা। ওমলেট না মামলেট? বাড়িতে বলে মামলেট, দোকানে লেখা থাকে ওমলেট। খুঁটে নেয়া ঐ ডিমের টুকরো মুখের মধ্যে চালান করে দেয় বিলু। জলে ভরে ওঠে মুখ। আহা, ময়ূরপঙ্খী ভিড়িয়ে দিয়ে সেথায়, রেখে এলাম তারে…সাত সাগর আর তের নদীর পারে। ফটাফট তেল মেখে নিল বিলু। আজ খেলা আছে, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। বিলু মোহনবাগান। জার্নেল সিং, রহমন, অরুময়, চুনী গোস্বামী…। ট্রানজিস্টরটা ইস্কুলে নিয়ে যাবে বিলু।

স্বপ্না এসে গেছে স্কুল থেকে। সাদা ফ্রক, সামনের দিকে ঝালর। স্বপ্না হাত-মুখ ধুয়েই রান্নাঘরে যায় এবং সোজা সেই বিচ্ছিন্ন বাটিটার ঢাকনা তোলে, খপ করে তুলে নেয় ডিমের টুকরোটা। বিলুর মুখের সামনে আরতির মতো ঘোরায়। বিলু বলে, এক চড় মারব। স্বপ্না ডিমটা দাঁত দিয়ে কাটে।

বিলু আর স্বপ্নাকে দু’পাশে বসিয়ে অঞ্জলি ভাত খাইয়ে দিত। একটা ডিমের চারভাগের এক ভাগ থাকত থালাটার পাশে। ডাল দিয়ে মাখা ভাত। মায়ের হাত শুধু ডিমটাকে ছুঁয়ে স্বপ্নার মুখে চলে যেত, আর বিলুর মুখে যখন যেত তাতে লেগে থাকত ডিমের শাঁস, ডিমের কুচি, ডিমের গন্ধ। স্বপ্না মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করত। বলতো, আমায় তুমি রান্নাবাটি খেলার মতো মিছিমিছি ডিম দাও, আর ভাইরে দাও সত্যি সত্যি ডিম। অঞ্জলি বলত, থাম। ভ্যানর ভ্যানর করলে একটুও দিমু না। তুই মেয়ে না?

অসীম খেলে এল, পায়ে কাদা। খালধারের যুগোস্লাভ সাহেবদের বল কুড়িয়ে দেবার খেলা। ওরা একটা টেনিস কোর্ট করেছে। ওরা খেলে।

বিলু অসীম আরও সব অনেকে আছে, যারা বল কুড়িয়ে দেয়। ওরা মাঝে মাঝে বলে মোসিসো ও কে চান্দা, কিংবা বলে পিচকোমাতে…। যুগোস্লাভ সাহেবরা সল্টলেকে মাটি ফেলেছে। গঙ্গায় বড় বড় মাটি কাটার জাহাজ। ঐ জাহাজ থেকে জল মিশিয়ে গঙ্গার মাটি পাইপে করে যাচ্ছে লবণ হ্রদে। লাল রঙের ঐ মোটা পাইপের মধ্যে শিরশির, শিরশির। লবণ হ্রদ ভরাট হয়ে চলেছে। অসীম সিঁড়ি দিয়ে উঠছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বলছে নরঃ নরৌ নরাঃ। বেঞ্চির উপর দাঁড়া। ফলম ফলে ফলানি, বেঞ্চির উপর দাঁড়াবনি।

স্কুল স্ট্রাইক। ছনি মনি গেটে দাঁড়িয়ে আছে, ঢুকতে দিচ্ছে না কাউকে। ছনি মনি দুই ভাই যমজ। হেভি মোটা। চাঁদিদা বক্তৃতা দিচ্ছে—ট্রামে বাসের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ ট্রাম-শ্রমিকরাও পথে নেমেছেন। ট্রাম-শ্রমিকরা ধর্মঘট করছেন। গতকাল ছাত্র মিছিলের উপর পুলিস লাঠি চালিয়েছে নৃশংসভাবে। বিলু এখন কী করবে? বাড়ি যাবে না। স্কুলের দু’তিনজন আজ ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমায় যাবে। স্কুলের পাঁচিলে পোস্টার মারা তিন দেবীয়া। ব্র্যাকেটে বড় হাতের এ। দেবানন্দ, নন্দা, কল্পনা, সিমি। বিলু এখন বাড়ি যাবে না। কোথায় যাবে বিলু? কয়েকটা ছেলে চলল খেলার মাঠে। র‍্যামপার্ট থেকে খেলা দেখবে। বিলু যাবে না। ওর নতুন ট্রানজিস্টার। ট্রানজিস্টারে রিলে শুনবে বিলু। আজ মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা।

নেতাজি বয়েজ ক্লাবের সামনের দেয়ালে খবর কাগজ সাঁটা। বিলু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে খবর কাগজ পড়ে। বসিরহাটের গ্রামে ক্ষুধার্ত নর-নারী কর্তৃক চাউলের লরি লুঠ। মঙ্গল গ্রহের ছবি পাঠাচ্ছে ম্যারিনা। আমেরিকা আরও পঞ্চাশ হাজার সেনা পাঠাল ভিয়েতনামে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অসীম। অসীম অন্য ইস্কুলে পড়ে। অসীমের স্কুলেও স্ট্রাইক। অসীম খবর কাগজের এক জায়গায় আঙুল তুলে দেখাল। ঐ দ্যাখ বিলু, বিলু দেখল জন্ম নিরোধে লুপ লাগান। লুপ আবার কী?

অসীম খিক খিক করে হাসল। রহস্যের হাসি।

অসীম খুব বাজে বাজে কথা বলে। বলে ব্যাটাছেলে আর মেয়েদের নিয়ে। বিলু বিশ্বাস করেনি। কী সব বিচ্ছিরি কথা। কিন্তু সেদিন যে ইস্কুলে পরাগ মিলন পড়াল, পুংকেশর আর গর্ভকেশর। পুংকেশর যদি গর্ভমুণ্ডের মধ্যে পতিত হয় তবে বীজ তৈরি হয়। এসব তবে কী? গাছেদেরও তো প্রাণ আছে। ফুলেদেরও।

অসীম আবার বলল, বিলু, তুই একটা মদন। চ সিনেমায় যাই। বিলু বলল, পয়সা? অসীম বলল, হলের সামনে চ, শোকেসে ছবি দেখব। জ্যান্ত সিনেমার মরা ছবি। পয়সা লাগে না।

পাঁচমাথার মোড় পেরিয়ে বিলু আর অসীম হাতিবাগানের দিকে যায়। চিত্রা সিনেমায় ‘হকিকত’। সৈন্যের পোশাক পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে আর একটা মেয়ে কাঁদছে। দর্পণায় ‘জিদ্দি’। একটা মেয়ে নাচছে। অসীম বলল, আশা পারেখ। আর ঐ দ্যাখ জয় মুখার্জি। লাইন পড়ে গেছে। পঁয়ষট্টি পয়সার লাইনে লোক দাঁড়িয়ে গেছে। মিনার হলে ‘আকাশ কুসুম’। লোকজন নেই। ফাঁকা। অসীম বলল, বাজে বই। রাধা হলে ‘জয়া’। ঘোমটা পরা সন্ধ্যা রায়।

ঘোমটা পরা বৌটি কে সরে এল দ্রুত? মা না? রাস্তা পার হচ্ছে মা। পিছনে যশকাকু। মা দ্রুত পার হয়ে গেল রাস্তা। যশকাকু বলছে, ‘কী হল কী হল’? মা এখন এখানে কেন? মা কি অফিসে যায়নি? মায়ের অফিসও কি স্ট্রাইক? যশকাকু মা’র কাঁধে হাত দিয়ে কী যেন বলতে চায়। মা ঝটকায় সরে যায়। অসীম তখনো রবিবার মর্নিং শো-এর ইংরাজি সিনেমার ছবি দেখতে তন্ময় হয়। ‘মা’ বলে চিৎকার করে ডাকবার জন্য অনেকটা শ্বাসবায়ু গ্রহণ করে বিলু। কিন্তু নিঃশব্দে ছেড়ে দেয় সে বাতাস। সে বাতাসের রঙ যেন কিছুটা কালো। আহ্নিকের সময় প্রণায়াম যেমন। বায়ু গ্রহণ কইরা সে বায়ু কিছুক্ষণ ধারণ করবা। সেই বায়ু ধীরে ধীরে ছাড়বা, আর মনে মনে কল্পনা করবা—এই বায়ুর রঙ কৃষ্ণ বর্ণ। অন্তরের যা কিছু কালিমা এই বায়ুর সহিত নির্গত হইতাছে। দাদু বলেছিল।

অসীম বলল, এবার কোথায় যাবি বিলু?

বিলু বলল, বাড়ি যাব।

দেশবন্ধু পার্কে চল।

কেন?

কত দিন ঘাস দেখি না। গাছ দেখি না।

আমি বাড়ি যাব। বিলু বলল।

অশোকনগরে না, আমাদের বাড়ির পিছনে একটা বড় কদমগাছ আছে। বর্ষাকালে ফুলে ফুলে ভইরা যায়। গাছতলায় কী সুগন্ধ। দেশবন্ধু পার্কে কদমগাছ আছে। অসীম বলল।

আমার কদমগাছে দরকার নেই।

বস্তুত বিলু কদমগাছ ও কদমফুল ঠিকঠাক চেনেই না। কদমফুল সম্পর্কে বিলুর যেটুকু ধারণা হয়েছে তা হল, বিরামের দোকান থেকে। বাঁধানো ছবিতে গোপিনীর বস্ত্রহরণ।

সর্বস্ব হারায়ে বালা হরিনাম স্মরে।
কদম্বের ডালে বসি হরিলীলা করে।

গাছে ঝুলছে ডেক্রন, ট্রিংকল, শিখাদের যেমন ঝোলে, আর গাছের ডালে গোল গোল বলের মতো হলুদ হলুদ ফুল।

—চ বিলু, কুমারটুলি যাই।

-কেন?

—ঠাকুর গড়া দেখি চ। খুব ভাললাগে আমার

—এখন আবার কী ঠাকুর।

—কিছু না কিছু আছেই।

—না, যাব না।

-তা হলে গঙ্গার ধারে চ।

—না।

—তা হলে কোথায় যাব?

কী বলবে বিলু? এখন কোথাও যাবার জায়গা নেই বিলুদের। কোনো কাজ নেই, কোনো উদ্দেশ্য নেই।

শেষ পর্যন্ত বিলু একা একা বাড়ি ফিরে আসে।

মোহনবাগান এক গোলে জিতে গেল। তেমন আনন্দ হল না। অসীম মৌলিক আর সীতেশ দাসকে ঢুকতেই দিল না জার্নেল সিং। চুনী কি কাটাল, তবু বিলুর যেন কিচ্ছু ভাল লাগছে না।

সন্ধের আগেই অঞ্জলি এল। চুল বেয়ে জল পড়ছে। ছাতাটা মেলে দিয়ে ঘরের কোণাটায় রাখল। অনঙ্গমোহন একটা জলচৌকির উপরে কিছু একটা লিখছিলেন। কাগজটা খোলাই রেখে অন্য একটা বই থেকে কিছু একটা খুঁজছিলেন। ছাতা থেকে ঐ খোলা কাগজের উপর জল পড়ল। সমীপেষুর মুর্ধন্য-ষ-এর উপর জলের ফোঁটা পড়ল। আনন্দবাজারের ‘আ’ গেল লেপ্টে। তখন অনঙ্গমোহন ইটা কি করলা ইটা কি করলা করতে করতে ছাতাটার গায়ে ধাক্কা মারেন। দুর্বল ছাতাটা উল্টে যায়, ডাঁটিটা উপরের দিকে। অঞ্জলি কিছু বলে না। অন্যদিন হলে এ নিয়ে একটা ছোটখাটো ঝগড়া শুরু হয়ে যেত। অঞ্জলি ছাতাটা সরিয়ে রাখে। বিলু একাকী জানালার ধারে বসে ছিল। বটের পাতাগুলি জানালার শিকের কাছাকাছি এসে গেছে। বৃষ্টিধোয়া পাতাগুলি উজ্জ্বল সবুজ। বিলু ওর মায়ের দিকে সোজাসুজি তাকাল না। অনঙ্গমোহন তাঁর লেখা কাগজটার দিকে তাকালেন। বিলুকে বললেন, দেখছ নি, ইশ। আবার লিখতে হইব। তারপর গলাটা একটু নামিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলেন—কিছু তো কওন যাইব না।

অন্যদিন অফিস থেকে ফিরে অঞ্জলি যা যা করতে হয়, আজ তাই তাই করছিল না। তক্তপোশের কোণায় মাথাটা কিছুক্ষণ টিপে ধরে বসে ছিল। অঞ্জলি এলে অনঙ্গমোহন চা পান। আজ সে রকম লক্ষণ দেখতে না পেয়ে বিলুকে বললেন—একটা চিঠি লিখতাছিলাম আনন্দবাজারে। শুন।

সম্পাদক সমীপেষু। দীর্ঘদিন যাবৎ লক্ষ্য করিতেছি যে, আপনারা বাঙ্গালা ভাষা লইয়া কদাচার করিতেছেন। সন্ধি সমাস প্রত্যয় ইত্যাদির মূল সূত্রগুলি মান্য করিতেছেন না, যথেচ্ছ বানান লিখিতেছেন। গতকল্য ভাণ্ডারকে লিখিলেন ভান্ডার। অজ্ঞান না লিখিয়া অগ্‌গান লিখিলেন। চঞ্চলের স্থলে চনচল, লন্ডনকে লনডন ইত্যদি। কোমলমতি বালকদিগের মনে ইহার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইবে সন্দেহ নাই।

আপনারা আপনাদের পত্রিকায় কথ্যভাষার প্রয়োগ করিতেছেন। তপোবনে, বনোমধ্যে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে বল্কল পরিহিতাবস্থায় দেখিয়া পুলকিত হইয়া বলিয়াছিলেন, কিমিব হি মধুরাণা মণ্ডনং নাকৃতীনাম। কিন্তু পরবর্তীকালে শকুন্তলা যখন রাজঅন্তঃপুরে ছিলেন, দুষ্মন্ত তাহাকে বল্কল পরিতে দেন নাই। বল্কলে স্বাভাবিক শোভা প্রকাশ পায় সত্যকথা, কিন্তু তাহাতে মর্যাদা হানি হয়।

অঞ্জলি বিলুর সামনে এসে দাঁড়াল। বিলু একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই মুখ নামিয়ে নিল। অঞ্জলি বিলুর মাথায় একবার হাত দিল। সামান্য বিলি কেটে দিল চুলে। তারপর বলল, আজ একবছর হল। চাকরির।

বিলু ওর মায়ের মুখের দিকে পরিপূর্ণ তাকাল একবার।

অঞ্জলির মুখে মেঘ।

অঞ্জলি বলল, দশ টাকা মায়না বাড়ল।

মাইনে বাড়লে কেউ কাঁদে নাকি? অথচ মায়ের চোখের কোণায় টলটল করছে ওটা জল না? লালুভুলু বইতে অনেকদিন পর লালু আর ভুলুর দেখা হলে ওরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না। খুব আনন্দ হলেও তো মানুষ কাঁদে।

—মাইনে বাড়াতে তোমার খুব আনন্দ হয়েছে, না মা?

ঠিক তক্ষুণি হু হু কেঁদে ওঠে অঞ্জলি। অনঙ্গমোহনের চিঠির উপরে, অন্তঃপুরের বিসর্গটার উপর টপ করে একফোঁটা জল পড়ে যায়। অঞ্জলি ঘর ছেড়ে চলে যায় দ্রুত। ব্যাপারটা কেন এরকম হল বিলু কিছুই বুঝতে পারে না। অনঙ্গমোহন ধ্যাবড়ানো বিসর্গর অশ্রুবারি নিজের চাদরে শুষে নেন। বিসর্গটার মধ্যেই কেমন যেন দুঃখ জড়ানো থাকে—বিলু মাঝে মাঝেই ভাবে। দুঃখ শব্দটার মাঝখানে বিসর্গটা যেন চোখের দু-ফোঁটা জল।

চা নিয়ে এল অঞ্জলি। পরিপূর্ণ বিধবা নারী। অফিসে যাবার হাল্কা ছাপা শাড়িটা পরিবর্তন করে নিয়ে থান চাপিয়ে নিয়েছে। সর্বাঙ্গ ঢাকা কাপড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা হাত, তাতে চায়ের কাপ। চায়ের প্রথম চুমুকটা দিতে এখনো ইতস্তত করেন অনঙ্গমোহন। বাড়িতে চা ঢুকুক অনঙ্গমোহন পছন্দ করতেন না। আমার নাম চা, আমি ম্যালেরিয়া দূর করি ইত্যাদি বিজ্ঞাপনেও ভজেননি অনঙ্গমোহন। জগদীশের মৃত্যুর পর তাই শ্যালক বোবাঠাকুরই তাঁকে চা খেতে অনুরোধ করেছিলেন মূলত খিদে মারার প্রয়োজনে। বাবা আপনার চা, এই উচ্চারণ এবং মেঝেতে কাপটি রাখবার শব্দের মধ্যে এক আশ্চর্য বিষাদ টের পান অনঙ্গমোহন। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু হয়েছে বৌমা? অঞ্জলি বলে, কী আবার হবে। এক বছর হল চাকরির। দশ টাকা মাইনে বাড়ল। আপনার সুবিধে হল আর একটু। আপনার এই টোলে আর একটা কাউকে ধরে নিয়ে আসুন। ছাত্র বাড়ান।

অঞ্জলি বিলুকে একটা টাকা দেয়। বলে যা বিলু, সন্দেশ নিয়ে আয়, সন্দেশ। বাড়ির সবাইকে সন্দেশ খাওয়াই। অন্য কিছু আনিস না, সন্দেশই। সন্দেশ নাকি উঠে যাবে শুনছি। একটু থেমে অঞ্জলি বলে, অফিসেও আজ সন্দেশ খাইয়েছি। হাতিবাগানে এসেছিলাম মিষ্টি কিনতে। বুঝলি বিলু, সবাই এমন করে ধরল যে, সন্দেশ উঠে যাচ্ছে সন্দেশ খাওয়াও, সন্দেশ খাওয়াও…হঠাৎ যেন হালকা হয়ে উঠল বিলুর মনটা। যেন হঠাৎ ওড়া আনন্দবাতাসে এঁটো শালপাতা নেচে ওঠে গলির রাস্তায়। বিলু বলল, ও, বুঝেছি মা, বুঝেছি, তুমি হাতিবাগানে মিষ্টি কিনতে গিয়েছিলে তখন।

ও, তুই দেখেছিলি? তুই কেন গিয়েছিলি হাতিবাগান?

—এমনি। ইস্কুল স্ট্রাইক। অসীম বলল, চ ঘুরে আসি।

-কোথায় কী মিষ্টি পাওয়া যায় আমি তার কী চিনি ক? তাই যশবাবু সঙ্গে আসল।

চু যাব চরণে যাব রাক্ষসটার মাথা খাব, চু যাব চরণে যাব রাক্ষসটার মাথা খাব…বিলু ধায়

খগেনের দোকানে বেগুনি ভাজছে। আঃ, কী গন্ধ বাতাসে। বেগুনিগুলো গরম তেলের মধ্যে কী হুড়োহুড়ি লাগিয়েছে যেন ইস্কুলের টিপিনবেলা। কতদিন এসব খায়নি বিলু। পৈতের পর এক বছর বাইরের জিনিস খাওয়া মানা। স্কুলে যেদিন গৌরের কাছ থেকে দশ নয়ার ঘুগনি নিয়ে যাচ্ছিল, পণ্ডিত স্যার দেখেই বলেছিলেন, এই যে বিপ্লব, অনঙ্গপণ্ডিতের নাতি, তোমারও এই অবস্থা? এইসব অখাদ্য খাও? সেদিন উপনয়ন হয়েছে না? একটাকায় আটখানা সন্দেশ হয়, তবে কি একজনের দুটো করে? কিন্তু ওরা তো পাঁচজন। দাদু, মা, স্বপ্না, বিলু আর অসীম। তা হলে কী করে কুলোবে? তবে কি অসীমকে দেবে না মা? তাহলে আবার তো সেদিনের মতো হবে। মাছ কম ছিল বলে অসীমকে দেয়নি অঞ্জলি, স্বপ্না আর বিলুকে দিয়েছিল, অনঙ্গমোহন এর পরদিন অনুগ্রহণ করেননি। তাহলে হয়তো মা-ই খাবে না। বিলু ভাবে। মা তো অফিসেই খেয়েছে। বরং নাই খাক। বিলু খাবে না। সন্দেশ দেখলেই সেই বাবার কথা মনে পড়ে। হাত থেকে সন্দেশ পড়ে যাওয়া মনে পড়ে। কিন্তু খাব না বললেই কি অঞ্জলি শুনবে? তার চেয়ে অন্য এক কাজ করা যাক। বিলু মনে মনে অন্য বুদ্ধি করে। ও বেগুনি খাবে চার আনার। আর বারো আনার বোঁদে। ছটা সন্দেশের পরিবর্তে বোঁদে হলে ভাল। নিয়ে যাবে। বাড়িতে বলবে, ওর ভাগেরটা ও দোকানেই খেয়ে এসেছে। টেস্ট করে দেখতে হয় না বুঝি, জিনিসটা ভাল কি না? বিরামের দোকানে অনেক বাঁধানো ছবি আছে। নরকের শাস্তির ছবিতে পরস্ত্রী রমণের আর পরপুরুষ গমনের শাস্তি দুটো সবচেয়ে অসভ্য। অসীম বোধহয় ঠিকই বলে। কিন্তু মিথ্যা করার শাস্তিটাও কম কী? জিভ টেনে ধরে ছুরি দিয়ে কেটে দিচ্ছে। জীবনে কম মিথ্যে বলেনি বিলু, আজ একটু পরেই আর একটা মিথ্যা কথা বলবে। সমস্ত মিথ্যা কথাগুলো একসঙ্গে হয়ে শাস্তি হয়। সব গ্যাস। ফালতু। এসব কিসু নেই। স্বর্গ, নরক কিসু নেই। ঠাকুরও কি আছে? ভগবান?

বিলুর বাবার অসুখের সময় কতবার ভগবানকে ডেকেছে বিলু তার ঠিক নেই। মহাদেব কৃষ্ণ, বাগবাজার ঘাটের জগন্নাথ, শেতলা, কাউকে বাদ রাখেনি। শেষে যখন হিক্কা শুরু হল, তখন ব্যোমকালী তলায় গিয়ে মা কালীকে সোজাসুজি এবং স্পষ্টভাবে বলে দিল, দেখ মা কালী, তুমি আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দাও। যদি বাবা বেঁচে যায়, তাহলে বুঝব আছ, তুমি সত্য। আর যদি বাবা মরে যায় তাহলে তুমি নেই।

বিরামের দোকান থেকে সন্দেশ কিনে খগেনের দোকানে আসে। চার আনায় পাঁচটা বেগুনি। খগেনের দোকানে তখনো বেগুনি ভাজা চলছে। বিলু ফুটন্ত তেলে বেগুনির লীলাখেলা দেখে। খগেনের কর্মচারী ওর নিজস্ব বাংলায় বলল, তবে পণ্ডিতমশাইয়ের নাতি অছন্তি না?

বিলু মাথা নাড়ায়।

তাংকর দেহটা কেমতি আছে ম?

দেহটা?

শরীরটা। সকালবেড়ে গঙ্গায় আমরা একসঙ্গে স্নান করি। আমিও ব্ৰাহ্মণ অছি না? তমার দাদু দু’দিন আসে নাহি।

—ঠিকই বলেছেন। দাদুর একটু জ্বর জ্বর ছিল।

—সেই আমি ভাবথিলি। তমার পিতামহটা বড় পণ্ডিত ম।

বিলু চুপ করে থাকে।

তোমার উপনয়ন হল না দুই মাস পূর্বে?

হ্যাঁ।

ভল ভল। তোমরা বড় ব্রাহ্মণ বংশ।

বিলু চুপ করে থাকে।

এখন কি নিবে?

বেগুনি। পাঁচটা।

কে খাবে?

বিলু চুপ করে থাকে। সত্যিই তো, কে খাবে বেগুনি? বিলুর দাদু তো মহাপণ্ডিত, দোকানের ভাজাভুজি খান না। বিলুর মা তো ব্রাহ্মণ বিধবা, আর বিলুর তো উপনয়ন হয়েছে।

বিলু বলল, দিদি খাবে আর দিদির বন্ধু।

পাঁচটা বেগুনি আছে ঠোঙায়। এখানে খাওয়া চলবে না। রাস্তায় খেতে খেতে যাবে। খুব সাবধানে খেতে হবে যেন চেনা কেউ দেখে না ফেলে।

দাদু আসছে না? দাদুই তো। তাড়াতাড়ি বেগুনির ঠোঙাটা পকেটে ঢোকাল বিলু। ওর উরুতে তাপ লাগছে। দ্রুত পা চালাল বিলু। অনঙ্গমোহন সামনে এসে পড়েছেন। বিলু পাশ কাটিয়ে এগোতে গেল। অনঙ্গমোহন বললেন—বিলু, অসীমরে দেখছস? বিলু মাথা নাড়ায়। অনঙ্গমোহন বলেন, কুষ্মাণ্ডটা এখনও আসে নাই ঘরে। বিলু এগোয়। অনঙ্গমোহন ডাকেন বিলুরে, বিলু দাঁড়া। তারপর গলাটা নামিয়ে বলেন, সন্দেশ অসীমের জন্যও রাখিস। আমি একটু দেইখ্যা আসি, নচ্ছারটা গেছে কোথায়। বোধহয় সাহেবদের লগে খেলতাছে। বিলু বাড়িতে ঢুকল। সিঁড়ির মুখেই কলঘর। কলঘরে ঢুকেই ছিটকিনি বন্ধ করল বিলু।

পরদিন সকালবেলায় বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড। শিখার বাবা চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে—আমি যত বলি কলঘর চাবি দেওয়া থাক, চাবি দেওয়া থাক, আমার কথা কেউ শোনে না এখনও। বস্তির ছোটলোকগুলো যখন-তখন বাথরুমে ঢোকে, নোংরা করে যায়। এখন কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড। পণ্ডিতমশাই তো গঙ্গা নাইতে যান, আর অন্য একজন তো চ্যানই করে না, এদিকে আমার তো আপিস আছে, সাড়ে নটায় বেরুতে হবে।

অনঙ্গমোহন ততক্ষণে গঙ্গাস্নান সেরে নামাবলী গায়ে আহ্নিকে বসেছিলেন, শিখার বাবা এসে বলল, পণ্ডিতমশাই, বাথরুমের চৌবাচ্চায় বস্তির কোনো ছেলে হেগে রেখে গ্যাচে, এখন ব্যবস্থা করুন।

অনঙ্গমোহন জলশুদ্ধি আসনশুদ্ধি করে সব শন্ন আপ ধন্বন্যাঃ শুরু করেছিলেন, ঠিক সেই সময় সব শুনে মন্ত্র থামালেন।

ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কলে জল আসে। শিখার বাবার বহুদিনের অভ্যেস, ভোরে উঠে সদ্য আসা কলের জলে দাঁত মেজে নেন। তারপর কলের জলে বসে স্নান করে নেন। তার একটা ছড়া আছে, বলেন মাঝে মাঝে।

গঙ্গায় নায় পাপীতাপী
পুকুরে নায় চোর
কলের জলে চ্যান করে যে
তার বহু পুণ্যের জোর।

স্নান সেরে চৌবাচ্চার পাইপটা কলের মুখে লাগিয়ে দেন। আজ পাইপটা লাগাতে গিয়ে দেখলেন এই ব্যাপার।

বিলু চুপ করে ছিল। একদম চুপচাপ। বিলু সাতেও নেই পাঁচেও নেই। অসীম বোধহয় জমাদার ডাকতে চলে গেছে। বিলু বই খুলে বসল। টোলের বই। বিলুও গত মাসে অনঙ্গমোহনের টোলে ভর্তি হয়ে গেছে। সকালবেলায় আধঘণ্টা টোলের পড়া করে নিয়ে স্কুলের পড়া করে। বিলু খাতা খুলে অত্র চতুর্দশাদৌ স্বরাঃ, এইসব পড়ছে। অনঙ্গমোহন আবার আহ্নিক শুরু করেছেন, বিলু পড়ছে তেষাং…দ্বৌ…তেষাং দ্বৌ তেষায় দাবনোস্য সাবর্ণ। অনঙ্গমোহন ছিপকাষায় ঠং শব্দ করে বিলুর দিকে চোখ পাকালেন। ভুল পড় ক্যান, ঠিক কইরা পড়। তেষায় দ্বৌ দ্বারন্যোন্যস্য সার্বনৌ। বিলু ঠিক পড়বে কি। বিলুর কি মনে আছে? মন কি থাকতে পারে এ খাতায়? ওসব যে কার কীর্তি বিলু কি জানে না?

গতকাল বেগুনি নিয়ে কলঘরে ঢুকেছিল বিলু। পকেট থেকে বার করেছিল ঠোঙাটা। বেগুনি তখনো যথেষ্ট গরম ছিল। একটা বার করে কামড়াল। একটু ফুঁ দিল। ধোয়াময় হাওয়া বের হল। হাওয়ায় সুগন্ধ। একটু একটু করে খাচ্ছিল বিলু। যেন শেষ না হয়ে যায়। এমন সময় কলঘরে করাঘাত।

কে?

অনঙ্গমোহনের কণ্ঠস্বর। আমি। একটু খোল। পদপ্রক্ষালন কইরা যাই।

বিলু, তৎক্ষণাৎ বাকি বেগুনি চারটে চৌবাচ্চার জলে ফেলে দেয়। তারপর মুখের অর্ধচর্বিত বাকিটা জল দিয়ে গিলে নেয়। দরজা খোলে।

অসীমরে পাইছি। বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, ঐ গোরা সাহেবগুলির সঙ্গে ক্রীড়া করতাছিল। বিলু বোঁদের ঠোঙাটা নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অনঙ্গমোহন বলেছিলেন—তুই এতক্ষণ কী করতাছিলি? বিলু সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে বলেছিল—মুখ হাত ধুচ্ছিলাম।

কলঘরে এমনিতেই আলো কম থাকে, ছোট একটা জানালা। জমাদার জিজ্ঞাসা করল, টর্চ আছে? শিখার বাবার টর্চ ছিল। জমাদারের হাতে কেন দেবে টর্চ? তাই চুপ করে ছিল। জমাদার ভাল করে চৌবাচ্চাটা দেখল। চৌবাচ্চার জল প্রায় শেষ। তলার দিকে যা ভাসছে তা ভাল করে দেখে বলল, লাগতা হায়, টাট্টি উদ্ভি নেহি হায়। চৌবাচ্চার তলায় গোঁজা ন্যাকড়া টেনে জল বার করে দিল, তারপর তলা থেকে বার করে আনল ফুলেফেঁপে থাকা চারটি বেগুনি।

অঞ্জলির সে কী হাসি। বিলুকে জড়িয়ে ধরল চুপি চুপি। অনেকদিন, অনেক অনেক দিন পর। বলল দুষ্টু ছেলে।

মায়েরা কী করে সব বোঝে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *