চতুষ্পাঠী – ৩

তিন

বিলু আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে, জল যেন চোখের কোণাতেই রয়ে যায়। সামনে বাবার ছবি। তারানাথ স্মৃতি-তীর্থ বলছেন, ব্রহ্মচারী, এবার এদিকে আয়। এখনো অনেক কাজ বাকি। হোমকুণ্ড তৈরি। সমিধ দিতে হইবে।

বিলু কাপড় চাপা দেয় চোখে। জল টেনে নেয় গেরুয়া বসন। আবার আসনে এলে কামাখ্যা পুরোহিত বলেন এবার উদীচ্যকর্ম তারপর কিঞ্চিৎ ব্যাদপাঠ। তারানাথ স্মৃতিতীর্থ বলেন, আর ব্যাদপাঠ…। হুঃ। ব্যাদের শ্লোকের উচ্চারণই করতে পারে না কেউ। সব শেষ হইয়া গেল। কামাখ্যা পুরোহিত বললেন জহরলাল, বিধান রায় দুই জনেই কুষ্মাণ্ড। আমার এক ভাইগনা জহরলালী বিবাহ করল—এক কৈবর্ত কন্যা—রেজিস্ট্রারি। তারানাথ বলল মহা সংকটের দিন আসতাছে অনঙ্গ, তোমার আমার ঘরেও এইসব ঢুকবে। সংস্কৃত, সংস্কৃতি কিছুই থাকবে না। অনঙ্গমোহন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, এত নিরাশাব্যঞ্জক কথা কইয়ো না কামাখ্যা ভাই, সংস্কৃত সহজে মরব না, মরতে পারে না।

যাবদ্ ভারতবর্ষং স্যাদ যাবদ বিন্ধ্য-হিমাচলৌ
যাবদ গঙ্গা চ গোদা চ তাবদেব হি সংস্কৃতম্।

যতদিন গঙ্গা গোদাবরী, ততদিন সংস্কৃত ভাষা আছে। অনঙ্গমোহন হঠাৎ ডাকতে থাকেন—অসীম-অসীম…। অসীম কাছে ধারে ছিল না।

কাজের বাড়ি। অল্প হলেও নিমন্ত্রিত কয়েকজনের পাত পড়েছে ততক্ষণে। অঞ্জলি নিজেই পরিবেশন করছিল। অঞ্জলি শুনল—অসীম- অসীম—অনঙ্গমোহনের ঐ ডাকের ভঙ্গিমায় বেশ ক্ষোভ মেশানো ছিল। অসীম যে কিছুটা একটা অন্যায় করেছে অঞ্জলি বেশ বুঝতে পারছিল। ঐ বুড়ো অসীমকে বড় আশকারা দেয়। নিজের নাতি বিলুর চেয়েও ভালবাসে। অঞ্জলির মোটেই এসব ভাল লাগে না। এই সময় অসীম কিছু ধমক-ধামক খাবে বুড়োর কাছে। অঞ্জলিও ডাকতে লাগল অসীম, অ্যাই অসীম…

বিজু ওদের ঘরেই ছিল। ও জানালা দিয়ে অসীমকে দেখতে পায় রাস্তায়। খগেন পাগলার পেছনে লেগেছে। অসীম সুর করে বলছে, মোহনবাগান হেরেছে। খগেন পাগলা তেড়ে গিয়ে বলছে, তোর বাপ মরেছে। অসীম বলছে, কমুনিস পার্টি এম.এল.এ, খগেন বলছে, তোর বাপের ছ্যাদ্দ খেয়ে লে।

বিজু একবার শিখার দিকে চায়। মিটি মিটি হাসে। বাইরে তখন অসীম-অসীম। বিজু বলে অসীম অসীম করে মায়, অসীম গেছে কাদের নায়। অনঙ্গ বুড়ো চিল্লায়, অসীম রে তুই ঘরে আয়। ততক্ষণে অনঙ্গমোহন জানালা দিয়ে অসীমকে দেখতে পেয়েছেন। অনঙ্গ অসীমকে ডাকেন, গলার শির ফুলে যায়, অ্যাই অসীম, বেতরিবত, লঘু, কুষ্মাণ্ড, হতভাগা, আয়।

অসীম আসে, অসীমের পায়ে কাদা। অনঙ্গমোহন বলে ব্যাদ্দপ, তরে না কইছি সর্বক্ষণ আমার পাশে থাকবি, সমস্ত উপনয়ন প্রক্রিয়া লক্ষ্য রাখবি, বলেই একটা থাবড়া তোলেন, মারেন না, বলেন এক চপেটাঘাতে মৃতকল্প কইরা দিমু, বে-আক্কুইল্যা, শয়তান কাঁহাকা।

তারানাথ স্মৃতিতীর্থ অনঙ্গমোহনের কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, বড় বেশি উত্তেজিত হও তুমি, আর উত্তেজিত হলে বড় বেশি যাবনিক শব্দ ব্যবহার কর। ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহ্, সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ…অনঙ্গমোহন মাথা নিচু করেন। আকস্মিক ক্রোধের কারণে না যাবনিক শব্দ ব্যবহারের কারণে বোঝা যায় না। অনঙ্গমোহন অসীমের মাথায় হাত রেখে বলেন—শুন, আমি তোমার পিসামশয়, কিন্তু আমি তোমার আচার্য, গুরু। আমার চতুষ্পাঠীতে তুমি অধ্যয়ন কর। চতুষ্পাঠী। হ, হ, চতুষ্পাঠী। আমি গুরু। তুমি তোমার ঘরবাড়ি ছাইড়া, পিতা-মাতা ত্যাগ কইরা এই আমার কাছে আসছ, প্রাচীনকালের গুরুকুল প্রথায় যেমন হইত। তুমি গুরুগৃহে আছ। ব্যাকরণ কাব্য পাঠাদির মাধ্যমে সংস্কৃত শিক্ষা করবা যেমন, সংস্কৃতিরও শিক্ষা করবা। কইছিলাম না, আজ আমাগোর লগে থাকবা, চূড়াকরণ, উপনয়ন, চরুহোম, যাগ-যজ্ঞ দেখবা, আর তুমি অপদার্থ, রাস্তায় রাস্তায় ভো ভো ঘুরতাছ? পাষণ্ড।

বোবাঠাকুর, মানে অসীমের বাবা, ভীষণভাবে মাথা নাড়ছেন, সম্মতির মাথা নাড়া, আঙুলে আঙুল লাগাচ্ছেন, যেন ঠিক কথা—ঠিক কথা। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে, গালের কষ দিয়ে গড়াচ্ছে লালা, কামাখ্যা পুরোহিত বললেন, যজ্ঞবেদি তৈয়ার।

অনঙ্গমোহন বললেন, কামাখ্যা, তোমার পাঁতি অসীমরে দাও। ও কিঞ্চিৎ তন্ত্রধারী করুক। কামাখ্যা পুরোহিত বললেন, বেশি-বেশি কইরো না অনঙ্গ, তোমার অসীম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারব না। অনঙ্গমোহন বললেন অসীম আমার ছাত্র। ঠিকই করবে। কামাখ্যা বললেন, স্নেহ বড় অন্ধ। তুমি অরে নিয়া অতিরিক্ত ভাবতাছ। অনঙ্গমোহন হাসলেন। বললেন-

মূর্খো বদতি বিষ্ণায়
ধীরো বদতি বিষ্ণবে
দ্বয়োরেব সমং পুণ্যং
ভাবগ্রাহী জনার্দনঃ।

বুঝলা না? চতুর্থীর একবচনে বিষ্ণু শব্দ বিষ্ণবে হয়, কিন্তু বিষ্ণায় কইলেও খোদ বিষ্ণুর বুঝতে ভুল হয় না। তারানাথ বললেন এটা কূট তর্ক। অর্থহীন। তাইলে আর মন্ত্রই-বা কেন। মন্ত্রপাঠ না কইরা, শেষকালে যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্‌ভবেৎ ইত্যাদি কইয়া দিলেই তো হয়। হে প্ৰভু যা ভুল উচ্চারণ করছি, যে যে মন্ত্র আদৌ উচ্চারণ করি নাই, তুমি পূর্ণ কইরা লও। তাহলে তো শূদ্রও পূজা যাগযজ্ঞ করতে পারে, দোষ কী?

অনঙ্গমোহনের বেশ লাগে। আহা, যেমন পণ্ডিত সভা। পণ্ডিত সমাবেশ। পণ্ডিতদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক না হলে কি ষোলকলা পূর্ণ হয়?

অনঙ্গমোহনের পিতা নীলকমল বিদ্যালঙ্কার ছিলেন পণ্ডিতপ্রবর। যে কোনো শ্রাদ্ধ, উপনয়ন এমন কি বিবাহ বাসরেও তাঁকে ঘিরে থাকত অন্য পণ্ডিতরা। প্রায়ই বিতর্কসভা বসত। তুলনায় কমবয়সী হলেও নীলকমলকেই মধ্যস্থ হতে হত। পণ্ডিত বিতর্কে দুটি পক্ষ থাকত। উত্তরখণ্ড এবং পূর্বখণ্ড। একদল প্রশ্ন করতেন, অন্যদল উত্তর দিতেন। প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না হওয়া পর্যন্ত প্রশ্নোত্তর চলতেই থাকত। মধ্যস্থের ভূমিকা ছিল কিছুটা বিচারকের। প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক হল কি না মধ্যস্থই বিচার করতেন। একটি চতুষ্পাঠীর অধ্যাপক ও তাঁর ছাত্র বা প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে একটি দল হত। কলাপ ব্যাকরণের সঙ্গে পাণিনির সূক্ষ্ম বিতর্ক, মনুর সঙ্গে পরাশরের বা সর্বানন্দকৃত তান্ত্রিক ঘটস্থাপন পদ্ধতির সঙ্গে প্রচলিত ঘটস্থাপন পদ্ধতির প্রভেদ কিংবা নৈষধ চরিতের অনুপ্রাসাধিক্য রসহানি করেছে কি না—এরকম বহু বিষয়েই নীলকমলের মীমাংসাই স্বীকৃত হত। অনঙ্গমোহন বসে বসে দেখতেন ওঁর পিতা কেমন সর্বত্র জিতে যাচ্ছেন। ন্যায়শাস্ত্রের ফক্কিকারি ধরে ফেলছেন। নীলকমলের পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীর সমস্ত ছাত্র আচার্য গরবে উল্লসিত থাকত অপাদান শুদ্ধির কারণে। অপাদান শুদ্ধি কথাটা বললে এখন কি কেউ আর বুঝবে? এরকম কত কথা হারিয়ে গেল। অসীমকে জিজ্ঞাসা করলেন অনঙ্গমোহন, অপাদান শুদ্ধির অর্থ নি বুঝস অসীম্যা—অসীম ইতস্তত না করেই বলে—অপাদান কারক? ব্যাসবাক্যসহ শুদ্ধ করে অপাদান কারক লেখা? উপস্থিত পণ্ডিত সকল হেসে উঠলেন। তারানাথ বললেন, এইসব কি আর অরা জানে? অনঙ্গমোহন ব্যাখ্যা করলেন—ভাল গুরুর নিকট পাঠ নেয়ার নাম হইল অপাদান শুদ্ধি। তোমার অপাদান শুদ্ধি আছে অর্থাৎ প্রকৃষ্ট আচার্যের নিকট পাঠ নেয়া আছে।

এ সময় বাড়িতে শোরগোল। বিখ্যাত কেউ এসেছে যেন।

বিলুর মা যেন হঠাৎ উল্লসিত।

আরিব্বাস। কী সৌভাগ্য আমাগোর। ভাবতেই পারি নাই আপনেরা যে এত কষ্টটষ্ট করে আসবেন।

—আরে আপনি বলছেন, আসতেই তো হবে।

—তা তো হইল। কিন্তু বৌদি তো এখন এখানেই আছে। আনলেন না যে?

—কত বললুম। ওর দিদির সঙ্গে সিনেমা যাবে ঠিক করে রেখেছে। জয়া বই।

—আপনেরা যে আসছেন, কী যে ভাল লাগছে, আসেন।

—ছেলে কোথায়?

—ও তো ঘরে। পৈতার ঘরে। পৈতা শেষ হয় নাই। একটু কাজ বাকি আছে অখনো।

—তা যাই, দেখিগে, আপনাদের পৈতে-টৈতে এসব তো আমাদের হল না, সামনের জন্মে যদি বামুন হয়ে জন্মো নিতে পারি, হে হে হেঃ।

অঞ্জলি ঘরে ঢোকে, সঙ্গে তিনজন পুরুষ। একজন ধুতি আর ফুলশার্ট পরা, দুজন ফুলপ্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট। একজনের গায়ে টেরিলিনের জামা। জামার ভিতর থেকে দেখা যায় গেঞ্জির জালিমা। অঞ্জলি বলে আমার অফিসের লোকজন। কামাখ্যা পুরোহিত সাত তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ান এবং বিলুর মাথার ঘোমটা টেনে দেন। অনঙ্গমোহনের কানের কাছে মুখ রেখে প্রশ্ন করেন, ব্রাহ্মণ তো?

অনঙ্গমোহন টেরিলিন পরা ভদ্রলোকটিকে চেনেন। আগেও কয়েকবার দেখেছেন। নামটা ঠিক মনে নেই, তবে পদবি মনে আছে, যশ। বর্ধমানের লোক। বৌমার চাকরির জন্য অনেক করেছেন উনি। অন্য ভদ্রলোক দুজনকে অনঙ্গমোহন চেনেন না।

অঞ্জলি আরও দু-পা এগিয়ে যায়। যশবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, আসুন। অনঙ্গমোহন অঞ্জলির চোখের দিকে তাকায়, কিন্তু অঞ্জলি সে সময় তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে নেই, ফলে চোখাচোখি হয় না।

—বিলু ওঠ। তোর যশকাকু এসেছে।

—বৌমার ঘোমটা পড়ে গেছে। অনঙ্গমোহন চাকরিরতা বৌমার পুরুষ বন্ধুদের দেখেন। অনঙ্গমোহন অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে ইশারায় নঞর্থক ভঙ্গি করেন, অঞ্জলির ব্যস্ততা এখন ওর অফিসের অতিথি নিয়ে।

বিলু, এই যে, দ্যাখ তোর যশকাকু এসেছে। আর মুখার্জিকাকুর কথা শুনিস না, এই যে মুখার্জি, আর ইনি রামকুমার মণ্ডল। মণ্ডলকাকু।

যশকাকু বলেন, এক্কেবারে নিমাইয়ের মতো লাগছে। কলির নিমাই।

কামাখ্যা ও তারানাথ পরস্পরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।

কামাখ্যাচরণ চিৎকার করে বললেন—ঘোমটা দেও, ঘোমটা দেও বিলু। যশবাবু বললেন—ঘোমটা দেবে কেন? নতুন বৌ নাকি। তারানাথ বললেন— নিয়ম। আমাগোর নিয়ম।

এই বলে ঘোমটা টেনে দিলেন।

যশ আস্তে আস্তে মুখার্জির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-বাঙালদের অনেক আজব নিয়ম। বিলু শুনল ব্যাপারটা। বিলু জানে ও বাঙাল। বাঙাল দেশ বিলু দ্যাখেনি কোনোদিন। দাদুর কাছে, মার কাছে চৌমহনী, দেওয়ানবাড়ি, গোয়ালন্দ এইসব কথা শুনেছে শুধু। বিলুর জন্ম বাগবাজারে, তবু সে বাঙাল। ইস্টবেঙ্গল হারলেই বিলু শুনত বাঙাল—পুঁটি মাছের কাঙাল। বাঙাল নিয়ে খুব ছড়া কাটে খগেন পাগলা। বাঙালু রস খাইলু ভাঁড় ভাঙিলু পয়সা দিলু না…

যশকাকুর হাতে ফোলিও ব্যাগ। চেন খোলার শব্দ পেল বিলু। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে বিলু দেখল দুটো প্যাকেট, লাল বুটিবুটি কাগজে মোড়া। একটা লম্বামতো বাক্স আর একটা চৌকা বাক্স। বিলু তাড়াতাড়ি ঝোলাটা নিয়ে এল। ভবন ভিক্ষাং দেহি। যশবাবুর হাতটা ঝোলার মধ্যে ঢুকল, তারপর বেরিয়ে এল ঐ লাল পাথর আর চকলেট পাথরের আংটি পরা হাত। বিলু অসীমের দিকে চাইল, অসীমের চোখে কৌতূহল।

কী আছে ঐ বাক্সে?

অঞ্জলি বলল, এসব আবার আনতে গেলেন কেন আপনারা? এসবের কোনো দরকার ছিল না। বড়জোর একটা টাকা দিয়ে দিলেই পারতেন।

আপনি চুপ করুন তো, এসব আমাদের ব্যাপার। যজ্ঞিবাড়ি যাচ্ছি, খালি হাতে যাব নাকি? মণ্ডলবাবু বললেন।

আসলে মণ্ডলবাবু জানিয়ে দিলেন ঐ যে দুটো প্যাকেট কেনা হয়েছে, তার মধ্যে মণ্ডলবাবুরও অবদান আছে।

অঞ্জলি ওদের সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেলে কামাখ্যা পুরোহিত তাঁর নিজের থলি থেকে বের করলেন একটা মহাভৃঙ্গরাজ তেলের শিশি। ঐ শিশিতে কিছুটা জল। পবিত্রবারি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই একটু ছিটাইয়া দিই, কেমন? তারানাথ স্মৃতিতীর্থ বললেন—এইসবের কিছু জানি না আমি। অনঙ্গমোহনের শূন্যদৃষ্টি। এই মুহূর্তে একটা অনাচার হয়ে গেল। উপনয়নের মধ্যে শূদ্র প্রবেশ। বৌমাকে এখন আর তেমন কিছু বলতে পারেন না অনঙ্গমোহন। চাকরিরতা। ছেলে জগদীশের চাকরিটাই বৌমা পেয়েছে। ভাত-কাপড়ের জন্য বৌমার ওপরই নির্ভর। এই নির্ভরশীলতাজনিত হীনম্মন্যতাবোধ মাঝে মাঝেই অনঙ্গমোহনকে ক্রোধী করে তোলে। মাঝে মাঝে বলেই ফেলেন—ভাইবো না বৌমা, তোমার খাই, তোমার পরি। আমারও চতুষ্পাঠী আছে, পণ্ডিত বৃত্তি আছে, অঞ্জলি তখন ঠিক আছে, ঠিক আছে বা তা তো জানিই—এমন কায়দায় বলে যে তার ব্যঞ্জনার্থ বেশ বুঝতে পারেন অনঙ্গমোহন। অঞ্জলির ঘাড় কাত করা, দ্রুত হেঁটে যাওয়া, কথা না শোনার ভান বা ঐ ক্ষুদ্র বাক্যপ্রয়োগ যথা—জানা আছে, জানা আছে, বা ঠিক আছে—ইত্যাদি কথার ভাবসম্প্রসারণ করলে যা যা অর্থ প্রকাশ পায় তা হচ্ছে, অনঙ্গমোহন মনে মনে হিসেব করেন—

১. কত টাকা পণ্ডিতবৃত্তি পান তা জানি, তাতে আপনার গ্রাসাচ্ছাদন হয় না।

২. আপনি বিপত্নীক। আপনার স্ত্রী নাই। গরম জলটা, হরতকি ছেঁচা, কাপড় কাচা ইত্যাদি কর্ম কে করে শুনি?

৩. আপনি বৃদ্ধ। পুত্র নাই, স্ত্রী নাই। আমি ছাড়া কে আপনাকে দেখবে। সুতরাং ভো ভো গর্দভঃ তুমি আমার ওপর নির্ভরশীল

কামাখ্যা পুরোহিতের ভ্রূকুঞ্চিত মুখের দিকে একঝলক তাকালেন অনঙ্গমোহন। তারানাথও গুম হয়ে বসে আছেন। অসীমকে বললেন দ্যাখ তো বাবা, জিজ্ঞাসা কর ব্রাহ্মণ-ভোজনের আর দেরি কত? কামাখ্যা পুরোহিত বললেন, এত তাড়া কিসের? স্মৃতিতীর্থ আস্তে আস্তে বললেন অনাচার পুরী মধ্যে যঃ পলায়তি স জীবতি, বলেই হাসলেন। এটা কিন্তু একটা রসিকতা। অনঙ্গমোহনও কথাটা শুনলেন কিন্তু রসগ্রহণ করতে পারলেন না। কথাটা বরং ঝাঁঝালো শোনাল। অব্রাহ্মণ ঘরে এসেছে, ব্রহ্মচারী শূদ্রমুখ দর্শন করেছে— তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে। এখন কি আর তপোবন আছে না চতুরাশ্রম আছে। এখন তো সব প্রতীক মাত্র। স্মৃতির পণ্ডিতরা এরকম মনু-সর্বস্বই হয়। আর বেরসিক, যারা যজমানি করে। কাব্যরসগ্রহণ করতে পারে না। দণ্ডী, বিলহন, কালিদাস পড়া থাকলে বুঝতে পারতেন যুগে যুগে আচার-বিচার পাল্টায়।

কামাখ্যা পুরোহিত তাঁর পবিত্র জল ছিটিয়ে দিলেন ঘরের মধ্যে আর বিলুর গায়ে। কামাখ্যা পুরোহিতের ছেলে, রেলে কাজ করে। প্রচুর পাস পেয়ে থাকেন। পাসগুলি ব্যবহার করে তিনি মন্ত্র এবং বাস্তবের সমন্বয় ঘটিয়েছেন।

জলশুদ্ধির মন্ত্রটা হল-

গঙ্গেচ যমুনেচৈব গোদাবরি সরস্বতি
নর্মদে সিন্ধুকাবেরি জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু।

অর্থাৎ এই জলে যেন গঙ্গা গোদাবরী যমুনা সরস্বতী নর্মদা সিন্ধু আর কাবেরীর জল মিশে যায়। রেল কোম্পানির সহৃদয় সহায়তায় এই মন্ত্রকে সত্য করেছেন কামাখ্যাচরণ। সিন্ধুর জলটাই জোগাড় করতে পারেননি তিনি, এছাড়া সব। কামাখ্যাচরণ বা তাঁর রেল চাকুরে পুত্র তীর্থক্ষেত্রে গেলেই তীর্থবারি সংগ্রহ করেছেন। তারপর জলগুলো মিশিয়ে একটা তাম্রকলসে ভরে রেখেছেন। যখন যজমানিতে যান ছোট শিশি করে ঐ পুণ্যবারি নিয়ে যান। তাম্রকলসে কাদা লেপা মাটির সরার ঢাকনা থাকলেও বাষ্পীভবন ঠেকানো যায় না। তাম্রকলসের জল ক্রমশ কমে আসে। তখন কামাখ্যাচরণ তাঁর মতিলাল কলোনিস্থিত বাসভবনের পিছনের পানাপুকুরের জল ঐ পবিত্র কলসে মিশিয়ে নেন। তাতে জল-মাহাত্ম্য হ্রাস পায় না। পুকুরের জল মিশলেও পবিত্র নদীর জলগুলি রয়েই যায়। কোনো দিনই শেষ হবে না। হোমিওপ্যাথি ওষুধও এরকম।

বিলুর সামনে তাম্রকুণ্ড আর ছিপকোষা। মোটা পৈতের সঙ্গে চামড়ার ঘসায় কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগছে। উত্তরীয় শুষে নিচ্ছে ঘাম। কামাখ্যা পুরোহিত বললেন—নাও, তাম্রকুণ্ডের জল নাও। তারপর ঐ জল মাথায় ছিটাও। এই গরমে জল ছেটাতে ভালই লাগছে। কামাখ্যা পুরোহিত মন্ত্র পড়ান—ওঁ শন্ন অপো ধণ্বন্যা, শমনঃ সন্তু নূপ্যাঃ শন্নঃ সমুদ্রিয়া আপঃ। শমনঃ সন্তু কৃপ্যাঃ। অনঙ্গমোহন বলেন—এর অর্থ জানো বিলু? হে মরুভূমির জল আমাদের মঙ্গল কর। হে জলময় দেশোৎপন্ন জল আমাদের মঙ্গলদায়ক হও। হে সমুদ্রোপন্ন জল, আমাদের মঙ্গল বিধান কর। কূপোপন্ন জল আমাদের মঙ্গল করো।…হে জলসমূহ, তোমরা সুখদায়ক, তোমরাই আমাকে অন্নভোগের অধিকারী কইরা দিছ এবং রমণীয় ব্রহ্মের সঙ্গে সংযোজিত কইরা দিছ। হে জল। হে প্রিয় জল। পুত্রস্নেহাতুরা জননী যেমন…ওঁ যো বঃ শিবতমো রস স্তস্য ভাজয়তেহ নঃ। উশতীরিব মাতরঃ। পুত্রস্নেহাতুরা জননীরা যেমন তার নিজের স্তন্য রসসুধা পান করায় তার পুত্রকে, তুমিও তেমনই জল…অনঙ্গমোহনের গলাটা ক্রমশ ভারী আর উদাত্ত হয়ে আসছিল। গলাটা কাঁপছিল।

অসীম ঝোলা থেকে বার করলো বাক্সদুটো। বিলু অসীমের দিকে কটমট করে তাকাল। অসীম আবার বাক্সদুটো ভরে দিল সেই ঝোলায়। কী আছে কী—বাক্সে?

বিলুর মামা জেসপ কোম্পানির ফিটার। পৈতের কদিন আগে জিজ্ঞাসা করেছিল পৈতেয় কী নিবি বিলু? বিলু বলেছিল যা চাইব তাই দেবে মামা? বিলুর মামা বলেছিল—তা কি সম্ভব? তুই যদি আংটি চাস, ঘড়ি চাস আমি কী করে দেব, অন্য কিছু, যা আমি দিতে পারব আর তোরও কাজে লাগবে। ভীষণ সমস্যায় পড়ল বিলু। কী চাইবে বিলু? আশ্চর্য রুমাল? আপনার পছন্দমতো কাহারও সামনে বশীকরণ-সুগন্ধী মিশ্রিত আশ্চর্য রুমালটি নাড়িয়া দিলে সে স্ত্রী বা পুরুষ যেই হউক না কেন, আপনার বশীভূত হইবে। নাকি ম্যাজিক লণ্ঠন। পর্দায় আপনার প্রিয় চিত্রতারকার ছবি দেখুন। মোহন সিরিজ নেবে, মোহন সিরিজ? পরিত্রাতা মোহন, সমুদ্রবক্ষে মোহন, অজানা দ্বীপে মোহন, মোহন ও বিষকন্যা…নাকি তিরিশ দিনে স্বাস্থ্যবান হন। মহামৃতসালসা। পুরা কোর্স ২৮ টাকা। শিবরাম চক্রবর্তীর বই। ক্রিকেট ব্যাট নেবে, ক্রিকেট ব্যাট? উইলো কাঠের?…বিলু কিছু বলতে পারছিল না। মামা বলেছিল ঠিক আছে, তোকে একটা টেরিলিনের জামা দেব, দেখবি কি হাল্কা। দশ মিনিটে জল শুকিয়ে যায়…মামা কখন আসবে কি জানি। আজকেও ওভারটাইম?

হে জল, সকল তোমরা সকল পদার্থকে তৃপ্ত কর, সম্পূর্ণ কর। সেই সুধারসে আমরাও যেন তৃপ্তি লাভ করি।

বিলুদের একটাই কলঘর। সব ভাড়াটের একটাই কলঘর। শিখা যখন স্লান করে কলঘর থেকে বের হয়, ওর গায়ের থেকে সুগন্ধ বের হয়। শিখা রোজ সাবান মেখে স্নান করে।

মহাপ্রলয়ের সময় কেবল সত্যস্বরূপ পরম ব্রহ্মই আছিলেন। তারপর জলময় সমুদ্র উৎপন্ন হইল। তারপর সেই সমুদ্র থিক্যা উৎপন্ন হইল সূৰ্য, চন্দ্র…সমুদ্রে কি ঢেউ, কি সুন্দর ঢেউ। মা, বাবা আর বিলু সিনেমায় গিয়েছিল। সমুদ্রের ঢেউ দেখছিল বিলু। বাবা বলেছিল, ওগুলো মিছিমিছি। ওগুলো ছবি। মা সিনেমায় টিফিন বেলায় ঝালনুন ছিটানো বাদাম, লাল লাল বাদাম মুখে বলেছিল, একদিন আমরাও পুরী যামু…অ্যাঁ!

যিনি সূর্যমণ্ডল মধ্যবর্তী তেজের প্রাণস্বরূপ, সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়কারিণী শক্তির অভিন্ন আধারস্বরূপ, যিনি …

কী আছে ঐ বাক্সয়? যে বাক্সদুটো যশকাকু দিয়ে গেল? যে বাক্সটা লম্বা, তাতে নিশ্চয়ই পেন আছে। আর ও চৌকোটায়? জ্যামিতি বাক্স? জ্যামিতি বাক্স তো ওর আছে। ওর দিদিরটাই। পেন্সিল কম্পাসটা হারিয়ে ফেলেছিল স্বপ্না, বাবা তারপর নিয়ে এসেছে একটা কোত্থেকে যেন। তাছাড়া জ্যামিতি বাক্স হলে আরও বড় হত। তবে কি খেলনা? ধুস! এখন খেলনা কী করবে বিলু। টিফিন বাক্স? কী হবে ওটা দিয়ে? বিলু কখনও টিফিন নেয় না। অনেকে নেয় বটে, পাউরুটি জেলি, মাখন রুটি, মদন শীলের বাড়ি থেকে ওদের চাকর আসে, টিফিন বেলায় ইস্কুলের সামনে রকটায় দাঁড়ায়। মদন শীল সন্দেশ খায়, আপেল খায়, তারপর দুধ খেয়ে হাতের চেটোয় ঠোঁট মুছতে মুছতে ইস্কুলে ঢোকে। মদন কি জানে, একটা পেয়ারায় তিনটে আপেলের সমান উপকার, বিধান রায় বলে গেছেন? বিলুর বাবা তো তাই পেয়ারা খাবার জন্য পাঁচনয়া দিত। এখনও মাঝে মাঝে দাদুর থেকে পাঁচনয়া-দশনয়া নিয়ে যায় বিলু। পাঁচ পয়সার কুড়মুড়ে বিস্কুটের উপর গৌর পাত্র মাখিয়ে দেয় গৌরের স্পেশাল ঘুগনি। তারপর পাউডারের কৌটো ঝাঁকিয়ে মিহি মশলার আস্তরণ।

.

ওই ভাল। কী দরকার টিফিন নিয়ে? তাছাড়া দিচ্ছেই-বা কে? মা তো চলে যায় অফিসে।

এটা টিফিন কৌটোই যদি হবে, এত সুন্দর প্যাকিং কেন? তাছাড়া টিফিন কৌটো হলে তো আরও হাল্কা হত। তবে কী আছে ঐ চৌকো বাক্সে? তবে কি খেলনাটা? ঐ যে, একটা লাট্টু মতো, বাঁই বাঁই ঘোরে, তার তলায় আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিতে হয় চাঁদ, তারা, সাপ, মাছ। তখন চাঁদ নাচে, তারা নাচে, সাপ নাচে, মাছ নাচে। তারার পাঁচটা কোনা, আঁকাবাঁকা সাপ, ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ, সুঠাম মাছ, প্রত্যেকেই নাচে যে যার মতো। ঐ লাটুটার তলায় বোধহয় চুম্বক আছে আর ঐ মাছ-তারা-চাঁদ-সাপ সব টিনের। জেলেপাড়ার মোড়ে একটা ট্যারা লোক এইসব বিক্রি করে। বেলুন, বাঁশি, সিনেমার বাক্স, সেই টিনের তৈরি সিনেমার মধ্যে ফিলিম দিলে দেখা যায় সায়রাবানু, আশা পারেখ, দেব আনন্দ, রাজকাপুর, কল্পনা…। ফট করে টিপে দিলেই মুরগি ডিম পাড়ে। আর ঐ ড্যানসিং স্টার। চাঁদ-তারা নাচে। ওরা আকাশের। সাপ, মাছ নাচে, ওরা জল মাটির। একই চাকার তলে আকাশ ও পৃথিবী নাচে। ঐ খেলনাটা বড় পছন্দ বিলুর। দশ আনা দাম। দশ আনা মানে হল বাষট্টি পয়সা। কোথায় পাবে বাষট্টি পয়সা বিলু? বিলু একদিন ওর বাবার দাড়ি কামানোর বাক্সে ষাট পয়সা পেয়েছিল। দাড়ি কামানোর বাক্সে কেন পয়সা ছিল বিলু বোঝেনি, ও খুঁজছিল একটা ব্লেড। পয়সাগুলো পেয়ে ও ভাবছিল, পয়সাগুলো নিয়ে নেবে কি না, নাকি মাকে দিয়ে দেবে। বিলুর ঐ আকাশভরা সূর্যতারা খেলনাটার উপর বড় লোভ ছিল। ও ভাবল, ওর ইচ্ছের কথা জেনে ওর বাবাই এই পয়সা কটা পাইয়ে দিয়েছে। বিলু পয়সা কটা হাতের মধ্যে নিয়ে হাতজোড় করে বলেছিল—হে বাবা, বাবা গো, তুমি যদি বেঁচে থাকতে তাহলে চাঁদ-তারা খেলনাটা চাইলে তুমি ঠিকই কিনে দিতে। এখন এটা আমি নিচ্ছি…

কিন্তু বিলু ঐ খেলনাটা শেষ পর্যন্ত কেনেনি। একটা রজনীগন্ধার মালা আর ধূপকাঠি এনেছিল।

সেই বাক্সটা যদি থাকে তো বেশ হয়। ভাল হয়। তবে এই বাক্সটা যেন আরও একটু বড় আর ভারী। কী আছে ঐ বাক্সটায়?

সুমিতা এল। বিলু তখন আহ্নিকরত। সুমিতা বলল, আরে বিপ্লব, এ যে দেখি বৈপ্লবিক কাণ্ড। ঘরটা একেবারে তপোবন হয়ে গেছে। যজ্ঞবেদী, ঋষিবালক, সমবেত ঋষিসমূহ এবং হরিণ শিশু। হরিণ শিশু বলেই ঘরের কোণায় বসে থাকা বেড়ালটার দিকে তাকাল সুমিতা। তখনই বেজে উঠল পৃথিবী আমারে চায়…রেখো না বেঁধে আমায়, কারণ প্যাকেটের মোড়কটা ততক্ষণে খুলে ফেলেছে বিলু। বিলু চিৎকার করে উঠল—রেডিও, ছোট রেডিও। যশকাকু দিয়েছে। বোবাঠাকুর যন্ত্রটার দিকে স্থির চেয়ে রইলেন। উচ্ছ্বাসসূচক গোঁ গোঁ শব্দ বার করতে থাকলেন মুখ দিয়ে। কামাখ্যা পুরোহিত বললেন—মা, গৃহে যেটি আছে, আমার পুত্র আনছে আর কি, সেটি আকৃতিতে আরও বৃহৎ। বিদ্যুৎ লাগে। ইয়ার দেখি তারটার কিছুই নাই। কী আশ্চর্য কও দেখি।

তারানাথ বললেন-আশ্চর্যের কী। আমাদের দ্যাশে প্রাচীনকালে এই সবই আছিল। ঐ যে দৈববাণী হইত, ঐগুলি রেডিও বার্তাই আসলে। এখন ঐ দৈববাণীরেই নাম দিছে আকাশবাণী। …

ইয়ে রেডিও সিলোন কী পঞ্চরংগী কারিক্রম হ্যায়। ডম ডম ডিগা ডিগা/মৌসম ভিগা ভিগা…কাঁটা ঘোরাচ্ছে বিলু…

সবই ছিল, সবই ছিল, বেতার ছিল, বাইস্কোপ ছিল, এরোপ্লেন ছিল।

হ হ—বিমান তো ছিলই। অনঙ্গমোহন হঠাৎ যেন উৎফুল্ল হলেন। প্রাপ্তা মুহূর্তেন বিমান বেগাৎ কুলং ফলাবর্জিত পুগমালম। কোনখান হইতে কইলাম? সুমিতার দিকে তাকিয়ে সহাস্যে প্রশ্ন করেন আনন্দমোহন। ক্ষণেক চিন্তা করে সুমিতা চিৎকার করে বলে, রঘু বংশম, রঘু বংশম। এতে বয়ং সৈকত ভিন্ন…। অনঙ্গমোহন পুলকিত হয়ে ওঠেন। সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে নেন ছাত্রীগর্বে গর্বিত অনঙ্গমোহন। অসীমের দিকে তাকিয়ে বলেন, ইয়ার অর্থনি বুঝ অসীম্যা? সমুদ্রের কূল ঝিনুকের মুক্তাসমূহ দ্বারা শোভিত, সুপারি গাছগুলি ফলভারে আনত, আমরা বিমানের দ্রুতগতিতে মুহূর্ত মধ্যে পৌছিলাম।

অনঙ্গমোহন বললেন, আরও আছে। রামচন্দ্র সীতারে কইতাছেন, ওগো করভোরুমৃগপ্রেক্ষিণী, করভোরু অর্থনি বুঝলা, যে নারীর উরু হাতির শুঁড়ের মতো। ক্রমশ নীচের দিকে সরু হইতাছে। তুমি দ্যাখ…এযা বিদূরীভবতঃ সমুদ্রাৎ সকাননা নিষ্পততীব ভূমিঃ। সুমিতা বলতে শুরু করে—সমুদ্ৰ ক্ৰমশ দূরে সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সকাননা ভূমি থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে সমুদ্র। কখনও দেবতাদের সঙ্গে, কখনও মেঘেদের সঙ্গে, কখনও পাখিদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে বিমানটি। আমার মনের মতো।

বাঃ সুন্দর স্মৃতিশক্তি তোমার। অনঙ্গমোহন উঠে দাঁড়িয়ে সুমিতার পিঠে হাত রাখেন। পিঠের দিকটা অনেকটা গোল করে কাটা ব্লাউজ।

কী ব্যাপার? গান হচ্ছে, ঘরের রেডিওর গান। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল উল্লসিত অঞ্জলি। সুমিতা পিঠের হাতটার থেকে সরে দাঁড়াল। বিলু বলল, মা, যশকাকুরা দিয়েছে দ্যাখো…।

যশকাকুরা পান চিবুতে চিবুতে ঘরে এল। বলল—ওঃ ডারুণ। ডারুণ রান্না হয়েছে। যেমন টরকারি, টেমন মাছ। বাঙালরা, মানে পূর্ব বাংলার লোকেরা যা রান্না করে, জবাব নেই…

অঞ্জলি বলল, আবার রেডিও কিনতে গেলেন কেন—ছি ছি।

যশবাবু বললেন, এটাকে বলে ট্রানজিস্টার।

তা কেন কিনতে গেলেন এত দাম দিয়ে? লজ্জায় ফেললেন।

ভাইপোকে দিলুম। রিলে শুনবে। লজ্জা কী?

কামাখ্যা পুরোহিত মহাভৃঙ্গরাজ তেলের শিশিটা আবার বার করেছেন। বিলু ট্রানজিস্টারটির নব ঘোরাতে থাকে।…আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল—

পাকিস্তান আবার কচ্ছ সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীচাবন তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছেন। উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় বোমাবর্ষণ করেছে। এডোয়ার্ড হোয়াইট ও জেমসম্যাকডিভিট নামে দুই মার্কিন মহাকাশচারী মহাকাশযান জেমিনি থেকে বের হয়ে মহাশূন্যে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটেছেন। দণ্ডকারণ্যের অন্তর্গত মানা উদ্বাস্তু শিবিরে বিক্ষোভকারী উদ্বাস্তুদের উপর গুলি চালনার ফলে দুজন নিহত হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *