চতুষ্পাঠী – ১৮

আঠের

পথ বহুদূর সামনে চড়াই তবুও মিছিল এগিয়ে যাও।
রাত কত হ’ল প্রশ্ন কোরো না শুধু বোবাদের ভরসা দাও
মৌন মিছিলে যদি জাগে আজ ভাঙা পাঁজরের যন্ত্রণা
তবু রোদে পোড়া হাসি মুখে দাও এগিয়ে চলার মন্ত্রণা।…
হৃদয় এখন প্রশ্ন করো না কী পেতে পারতে পেয়েছ কই
আজকে মিছিলে স্বপ্না তোমার বাসর পাতার সময় নাই
তার চেয়ে এসো মৌন মিছিলে বুকের আগুন ছড়িয়ে যাই।

১৪ মার্চের বসুমতী কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর লেখা ঐ কবিতাটি জোরে জোরে পড়ছিল বিলু। ১৩ মার্চ কলকাতায় মৌন মিছিল বেরিয়েছিল, বিশাল মিছিল। মিছিলে ছিলেন অনেক বিশিষ্ট লোক। বহু জায়গায় সৈন্য নেমেছে। বাদুড়িয়া, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর আরও বহু জায়গায় আগুন জ্বলছে। কলকাতায় ট্রাম পুড়ছে, বাস পুড়ছে, গুলি চলছে, মানুষ মরছে, চাল সাড়ে তিন টাকা কিলো। সমস্ত স্কুল বন্ধ। আজ এপ্রিলের ছয়। হরতাল। অঞ্জলিও কাজে যায়নি। আজ অনেক ঠোঙা হবে। বিলু বলে, এই কবিতাটা থাক। এটা কাটব না। এটা দিয়ে ঠোঙা বানাব না। বিলু আবার পড়ে কবিতাটি। যখন বিলু দ্বিতীয়বার পড়ে-আজকে মিছিলে স্বপ্না তোমার বাসর পাতার সময় নাই, তখন অনঙ্গমোহন আচমকা বলেন—স্বপ্নার বিবাহ স্থির করছি আমি…

প্রত্যেকের চোখ অনঙ্গমোহনের দিকে স্থির। অঞ্জলি ভীষণ অবাক গলায় বলে, কার সাথে।

—কেন? ন্যাড়া?

স্বপ্না মাথা নিচু করে দেয়।

অঞ্জলি বলে, সে তো ব্ৰাহ্মণই নয়।

অনঙ্গমোহন বলেন, আমিই পরিবারের কর্তা। আমার নামেই রেশন কার্ড। এই আমার সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত শব্দের মধ্যভাগে বড় বেশি জোর দেন অনঙ্গমোহন। ফলে থুথু ছিটোয়। এই অনঙ্গ-সিদ্ধান্ত। অনঙ্গমোহন নিজেই এর টীকাভাষ্য করেন। যেখানে জীবন অরক্ষিত, যৌবন আক্রান্ত, সেখানে প্রতিলোম বিবাহ অবৈধ নয়। ঋতুমতী কন্যার বিবাহ-প্রয়োজনে যদি কালাশৌচ সংক্ষিপ্ত করা যায়, কালপ্রয়োজনে এই বিবাহও অন্যায় নয়। আসুন মহর্ষি গৌতম, পরাশর, মনু, আসুন কল্লুকভট্ট, রঘুনন্দন। আপনারা পূর্ব পক্ষ হন, আমি উত্তর পক্ষ। কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিতা ন কর্তব্যোঃ বিনির্ণয়ঃ। আমি ধর্ম নষ্ট করি নাই। ধর্ম কাষ্ঠ পুত্তলিকা নয়। ধর্ম চলচ্ছক্তি যুক্ত। সহায় হন বিদ্যাসাগর। নষ্টেমৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবেচ পতিতে পতৌ মনে আছে আমার। আমি বিবাহ দিমু। চরৈবতি।

ক’দিন আগেই ন্যাড়াকে একাকী পেয়ে অনঙ্গমোহন সোজা প্ৰশ্ন করেছিলেন—আমার নাতিনি স্বপ্নার প্রতি তোমার অনুরাগ কীরূপ?

ন্যাড়া ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলেছিল—না, আমি মানে…

—সত্য বল ন্যাড়া, তুমি যে সংস্কৃত শিখতে আমার কাছে আস সেইটা শুধুই কি সংস্কৃতের জন্য…

ন্যাড়া কোনো উত্তর দেয় না।

অনঙ্গমোহন আবার বলেন—আমি সংস্কৃত সাহিত্যপাঠ করছি। অনুরাগের যে অন্ন নাই…এবং যা বললেন না তা হল অন্নহীন যৌবন প্রাণহীন প্ৰাণী। চিল শকুন উড়ে আসে। কখনো-বা ধর্মের নামে। শাস্ত্রের নামে। অন্নই প্রাণ। মহর্ষি উদ্দালকও তার পুত্রকে বলেননি কি, বৎস শ্বেতকেতো…অন্নই প্ৰাণ? অন্নই মন?

ন্যাড়া থাকে ওর দাদার সংসারে। একটা ছোট কোম্পানির কেরানি ওর দাদা। অনঙ্গমোহন দেখা করলেন। ন্যাড়ার দাদা বলল—ওর কথা আমি কিচ্ছু বলতে পারব না, ন্যাড়া হল খামখেয়ালি। যতটা পেরেছি করেছি। কাউকে বুঝতে দিইনি যে ন্যাড়া আমার সৎ ভাই। করুক লাভ-ম্যারেজ, নিজেরটা নিজে খাবে, আমার কী?

এক অদ্ভুত প্রণালীতে বিবাহ দিলেন অনঙ্গমোহন। কোনো সংহিতায়, কোনো স্মৃতিশাস্ত্রে, কোনো পৌরোহিত্য বিধিতে এরকম বর্ণনা নেই। তিনি নিজে সম্প্রদান করলেন, শালগ্রামশিলা সামনে রাখলেন। ওঁ সোমং রাজানং বরুণমগ্নি থেকে এনাং কন্যাং প্রজাপতি দেবাতাকামহং সম্প্ৰদদে পর্যন্ত নিজের সম্প্রদানের মন্ত্র পুরো সংস্কৃতে মন্ত্র পাঠ করলেন। কিন্তু পুরোহিত দর্পণের যেখানে যেখানে সালঙকারাং কথাটা আছে, সেখানে বাদ দিলেন, কারণ স্বপ্নার গায়ে কোনো অলংকার ছিল না। সম্প্রদান শেষে যেখানে ন্যাড়া কিংবা স্বপ্নার মন্ত্রপড়ার ব্যাপার ছিল, সেখানে স্রেফ বাংলায় মন্ত্রপাঠ করানো হল। সম্প্রদানের পর যজ্ঞ হল। যজ্ঞের আগুনে লাজ অর্থাৎ খৈ দিতে বলা হয়, অনঙ্গমোহন বলছিলেন, স্বপ্না—মন্ত্র বল—আমার পতি দীর্ঘায়ু হইয়া শত বৎসর বাঁচুক। জ্ঞাতিরা আমাকে স্নেহ করুক। আমি য্যান সংসারে শ্রী আনতে পারি। স্বপ্না পাথরের শিলে দাঁড়াল, ন্যাড়া মন্ত্র বলল—তুমি এই শিলায় উঠো। পাথরের মতো সহিষ্ণু হও। এইবারে পাণিগ্রহণ। হাত ধর তোমরা। বল হে দেবতা সকল, যদি পারো আশীর্বাদ কর। কও ন্যাড়া, কও—আমরা যেন এক প্রাণ থাকি, একমন থাকি। কও ওঁ অন্নপাশেন মণিনাং প্রাণ সূত্রে গ্রন্থিনা…আহা, বাংলায় কও—অন্নই বন্ধন। অন্নের বন্ধনে তোমারে বাঁধলাম আমি, আহারে দু’গাল অন্নের জন্য ভাতের জন্য, শেষের দিকে এমন হচ্ছিল, কোনটা যে মন্ত্র, কোনটা যে অনঙ্গমোহনের স্বগতোক্তি কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, ললিতমোহনও সুমিতার কানে কানে বললেন—প্রলাপ বকছে যে…

এই বিয়েতে লোকজন বিশেষ নিমন্ত্রিত হয়নি। তারানাথ বা কামাখ্যাচরণকেও বলেননি অনঙ্গমোহন। ন্যাড়ার সঙ্গে বরযাত্রী এসেছিল ওর আটজন বন্ধু। ন্যাড়ার দাদা-বৌদিও আসেনি। অনঙ্গমোহনের টোলের কয়েকজন কৃতী প্রাক্তন ছাত্রকেও চিঠিতে জানিয়েছিলেন, একজন এসেছে, সে কলেজের অধ্যাপক। সুমিতাও এসেছে। সুমিতার স্বামী আসেনি। ললিতমোহনই নিয়ে এসেছেন সুমিতাকে।

সুমিতার বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় এক মাস আগে। অনঙ্গমোহন গিয়েছিলেন। বিলুও ছিল। অনঙ্গমোহন সেদিন সারাদিন উপবাসী ছিলেন। বিবাহ সম্পন্ন হলে কিছু মিষ্টি খেয়েছিলেন শুধু। বিলু যখন খাচ্ছিল, অনঙ্গমোহন সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, বিলুর খাওয়া দেখছিলেন, ছোলার ডাল যখন রাধাবল্লভীর মধ্যে মিশে যাচ্ছিল, অনঙ্গমোহন তখন বিলুর মুখের খুশি প্রাণের মধ্যে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন। অন্ন প্রাণময়। অন্ন আনন্দময়। আনন্দই ব্ৰহ্ম।

অনঙ্গমোহন পরদিনই গিয়েছিলেন। সুমিতার স্বামী গৌরবর্ণ, দীর্ঘাঙ্গ, সুপুরুষ। মাথার সামনের দিকটা কিছুটা কেশহীন কিন্তু সহাস্য, সপ্রতিভ। সুমিতা পরিচয় করিয়ে দিল—আমার গুরুদেব। এঁর কাছে সংস্কৃত পড়ি। ছেলেটি দু’হাত তুলে নমস্কার করল। বলল—যাবেন মাঝে মাঝে। অনঙ্গমোহন সুমিতাকে বললেন—তোমার প্রস্থান সময় উপস্থিত হল। বলেই বারোধ হল অনঙ্গমোহনের। ছিটের থলের থেকে বের করলেন কয়েকটা বই। জীবানন্দ বিদ্যাসাগরকৃত টীকা সংবলিত শ্রীহর্ষর নৈষধচরিত। আর বাসবদত্তা। বললেন—কবে এইসব ফুটপাতে বিক্রি কইরা দিই ঠিক নাই, তোমার কাছেই থাক। তারপর দিলেন কাব্যচন্দ্রসুধা। দিলেন আরও চার- পাঁচটি বই। বললেন—আমি দরিদ্র, এর অধিক আর কি দিমু।

সুমিতা অনঙ্গমোহনকে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করল। বলল—আমার শ্বশুরবাড়িতে আসবেন। অনঙ্গমোহন বললেন—তোমার শ্বশুরবাড়িতে আনন্দে থাকো। তোমার শ্বশুর বড় ভাল লোক—তাঁর সেবা-যত্ন কইরো…।

অনঙ্গমোহন যেন মহর্ষি কম্বদেব। শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় বিদায় দিচ্ছেন।…সুমিতা তুমি সবার প্রিয়া হও, স্বামীর প্রিয়া হও…

সুমিতা সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে বড়ই দীর্ঘসূত্রী। যখনই পরীক্ষা হোক, পরীক্ষাটা দিও। ঘরে পড়াশোনা কইরো কিন্তু… সুমিতা বলল—আপনিও যাবেন, অ্যাঁ? সুমিতার স্বামীও বলল-আসবেন, আসবেন।

সুমিতা গাড়িতে ওঠার সময় সুমিতার মা অনঙ্গমোহনকে প্রণাম করে বলেছিলেন, আপনার এ ঋণ জীবনে শুধতে পারব না। আপনি ঠিক করে দিলেন বলেই যা হোক করে বিয়েটা হয়ে গেল। আমার সেজটাকেও আপনার টোলে পাঠিয়ে দেব। তারপর পাঁচ টাকার কয়েকটি নোট বার করে অনঙ্গমোহনের দিকে ধরেছিলেন। এটা ধরুন। আপনার দক্ষিণা। ঘটককে দিলেও তো দিতাম। অনঙ্গমোহন তখন কোনো কটুবাক্য বলেননি, ভ্রূ কুঞ্চনও করেননি। ‘রজত’ শব্দের অর্থ অশ্রুও হয়। এই ভেবে, সামান্য মৃদু হেসে চলে এসেছিলেন।

সুমিতার বৌ-ভাতের দিন ললিতবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল অনঙ্গমোহনের। বৌভাত ব্যাপারটা এধারে এসে দেখতে পাচ্ছেন অনঙ্গমোহন। এখন নববধূ চেয়ারে বসে থাকে, ফুলে ফুলে সাজানো, নিমন্ত্রিতরা এসে এসে উপহার দিয়ে যায়। আগে বিবাহের তৃতীয় দিনে হত পাকস্পর্শ। নববধূ সেদিন রান্নাঘরে ঢুকত। নিমন্ত্রিতদের পাতে সামান্য অন্ন পরিবেশন করত।

অনঙ্গমোহন গিয়েছিলেন। বাড়ির সামনে নহবত আলোর মালা। গাড়ির সারি। কলহাস্য। সুবেশা রমণীদল। যেন সুরলোক। অনঙ্গমোহন পূর্ণকলস ও কলাগাছ লাগানো দরজার সামনে ক্ষণকাল দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর ভিতরে না ঢুকেই পালিয়ে চলে আসছিলেন। এমন সময় হা হা করে ছুটে এলেন ললিতবাবু। আরে পণ্ডিতমশাই আসুন আসুন…

ললিতবাবু উপরে নিয়ে গেলেন। সিংহাসনে রাজরানীর মতো বসে আছে সুমিতা। অনঙ্গমোহন দূর থেকে দেখলেন, কারণ সামনে সুবেশা সমারোহ। অভ্যাগতরা উল্টে অনঙ্গমোহনকেই দেখতে লাগল। যেন কোনো লুপ্ত জীব। শিখা-সূত্র উত্তরীয়ধারী অনঙ্গমোহনের বেশ অস্বস্তি লাগে। ললিতবাবু অন্য ঘরে নিয়ে যান, ঐখানে ললিতবাবুর সংস্কৃতজ্ঞ বন্ধু-বান্ধবরা আছেন। ললিতবাবু পরিচয় করিয়ে দেন—ইনিই অনঙ্গমোহন কাব্যব্যাকরণতীর্থ। অনেকে উঠে দাঁড়ালেন। হাত জোড় করলেন। এঁরা সব অধ্যাপক। সংস্কৃতে এম এ ডক্টরেট। সিল্কের পাঞ্জাবি পরা। কেউ কেউ সিগারেটে ধূম্রপান করছেন। ওদের মাঝখানে সংকুচিত হয়ে বসেছিলেন অনঙ্গমোহন। ফিরিঙ্গিদের মতো ফুলপ্যান্ট ও শার্টপরা একজন অধ্যাপক বললেন, আপনারাই হলেন আসল সংস্কৃতজ্ঞ। দেশ আপনাদের দেখল না। অন্য একজন বললেন, আমিও টোলে ন্যায় পড়েছিলাম কিছুদিন। আপনারই মতো একজন আচার্য ছিলেন। বলা যায়, তিনি বিনা চিকিৎসায়…

ওরা তারপর অনঙ্গমোহনের সঙ্গে বর্তমান সিলেবাস, পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি, শিশুপাল বধ, মেঘদূতম্ আলোচনা করে আবার ডিএ আর ইনকাম ট্যাক্স আলোচনায় নিজেদের মধ্যে ফিরে গেলেন। অনঙ্গমোহন উঠলেন। ললিতবাবু মিষ্টিমুখ করালেন। আর আড়ালে ডেকে নিয়ে দিলেন পঞ্চাশটি টাকা।

অনঙ্গমোহন বললেন—টাকা কিসের, ঘটক বিদায় নাকি? ললিতমোহন জিভ কাটলেন। বললেন, সামান্য পণ্ডিতবিদায়। অনঙ্গমোহন বললেন, পণ্ডিতবিদায়? কোথায় পণ্ডিত? কোথায় বিতর্ক? পূর্ব পক্ষ নাই, উত্তর পক্ষ নাই, শুনলাম তো মহার্ঘ্যভাতা, পরনিন্দা, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু। ললিতমোহন বললেন—এদের রীতিই এই। অনঙ্গমোহন বললেন—ওরা পণ্ডিত বিদায় কি প্রত্যেকরেই দিতেছেন? অ্যামে পাস রা? ললিতমোহন বললেন—না, না, ওরা নেবেন না। আমিও নিমু না ললিতবাবু। অনঙ্গমোহন আঙুলে চাদরের কোণাটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলেছিলেন। তখন ললিতমোহন বলেছিলেন, তবে একটা গাড়িভাড়া… অনঙ্গমোহন টাকাটা নিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন—এটা পণ্ডিত বিদায় নয়। ভিক্ষা। অনুকম্পা অথবা ঘটক বিদায়। এই দান যে অনঙ্গমোহন গ্রহণ করতে পারেন এরূপ অনুমিতি ললিতমোহনের হয়েছিল কীভাবে? পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ। ধূম দেখে অগ্নির সম্ভাবনা প্ৰকাশ পায়, ‘ধূম’ হেতু পদ। অনঙ্গমোহনের কি কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল? যাকে হেতু পদ হিসাবে ভাবা যায়? নাকি এটা সহজ অন্বয়? যেখানে ধূম সেখানেই অগ্নির অস্তিত্ব যেমন, যেখানে দারিদ্র্য সেখানে দুর্বলতা। সরলীকৃত অনুমিতি। অনঙ্গমোহন টাকাটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বললেন—মহাশয়, গাড়িভাড়াও দরকার নাই, আমি তো হাঁইট্যাই আইলাম।

.

আজ এখানে এই বিবাহবাসরে ললিতমোহন নিমন্ত্রিত। একটা দামী শাড়ি তুলে দিয়েছেন স্বপ্নার হাতে। অঞ্জলি ভেবেছিল, শাড়িটা আগে পাওয়া গেলে এটা পরিয়েই বিয়ে দেওয়া যেত।

ললিতমোহন আসাতে অনঙ্গমোহন এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, বিবাহকার্যের ফাঁকে একবার উঠে এসে ললিতমোহনকে জড়িয়ে ধরার উপক্রম করেছিলেন। কিন্তু ললিতমোহনের গিলে করা পাঞ্জাবি, সুগন্ধি, চুনোট করা ধূতি আর সর্বোপরি তাঁর অর্থমহিমার প্রচ্ছন্ন প্রাচীর তাকে বিরত করেছিল।

স্নেহ অতি বিষম বস্তু, অনঙ্গমোহন বহু আগেই বুঝেছিলেন। স্বপ্নার বিয়ের পর দিন এটা বড় বেশি করে অনুভব করছিলেন। নতুন কেনা টিনের ট্রাঙ্কটা ভর্তি হল না। যৌতুক কিছুই প্রায় ছিল না। অনঙ্গমোহন ভাবলেন, ট্রাঙ্কে কয়েকটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে দেবেন, যদি কোনোদিন কাজে লাগে। কিন্তু স্নেহ অতি বিষমবস্তু। অনঙ্গমোহন ঠোঙার জন্য ছ’আনা কিলোয় কেনা শারদীয় উল্টোরথ ট্রাঙ্কের ভিতরে গোপনে ভরে দিলেন।

কম্ব কহিলেন, আর কেন বিলম্ব কর, বেলা হয়, তখন শকুন্তলা কহিলেন, বনতোষিণীকে সম্ভাষণ না করিয়া যাইব না। এই বলিয়া বনতোষিণীর নিকট গিয়া কহিলেন, বনতোষিণী শাখাবাহুদ্বারা আমাকে আলিঙ্গন কর। কালির কল রে কালির কল—তোর ঘটর ঘটর আর শুনতে পাব না। মাসিমা, শিখাকে চিঠি দিয়েছিলাম। এল না। আমি যাই। দাদু, ঠোঙাগুলো কাটা হয়নি। তোমার কষ্ট হবে। দাদু ঠিকমতো খেয়ো, নিজেই খইগুড় নিয়ে নিও দাদু। কম্ব কহিলেন, বৎসে শান্ত হও। অশ্রুবেগের সম্বরণ কর। সিঁড়ি দিয়া পইড়া যাইবা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *