সতের
আগরতলা থেকে চিঠি লিখেছিল হেরম্ব চট্টোপাধ্যায়।
কলিকাতায় তোমা ভিন্ন আমার আত্মীয় বলিতে আর কে আছে? চিকিৎসার প্রয়োজনে নিতান্ত দিনকয়েক কলিকাতায় থাকিতে হইবে…
হেরম্বর চিঠি পেলেন বহুদিন পর। জগদীশের মৃত্যুর খবর শুনে একটা লিখেছিল। আর এই।
হেরম্ব যে আসছে এই কথাটা এখনো অঞ্জলিকে জানাননি অনঙ্গমোহন। হেরম্ব নীলকমলেরই ছাত্র। একইসঙ্গে পড়াশোনা করেছে। অনঙ্গমোহনের সঙ্গেই ব্যাকরণ পড়েছে, একইসঙ্গে সাঁতার কেটে শাপলা তুলেছে, নোনাফল পেড়েছে। ছ’বছর ছিল অনঙ্গমোহনের বাড়িতে, দেশের বাড়িতে।
ছটা বছর, কৈশোর আর প্রথম যৌবনের ছ-টা বছর তো সোনার বছর। ঐ সুবর্ণকাল, হেরম্বর সঙ্গেই কেটেছে। সেই হেরম্ব আসবে। নীলকমল গ্রীষ্মকালে বেলের শরবৎ পছন্দ করতেন। কণ্টকময় বিল্ববৃক্ষ থেকে কে বেল পেড়ে আনবে তার প্রতিযোগিতা চলত। বেলকাঁটায় শরীর বিদ্ধ হত। ‘কে বেল পাড়ল আইজ’? নীলকমলের ঐ প্রশ্নে অধিকাংশ দিন হেরম্ব বলত—আঁই হাড়ছি আচাইয্যাদ্যাব। হেরম্ব আসবে। শেষ এসেছিল বছর দশেক আগে। শ্রীক্ষেত্র থেকে তীর্থ করে আসার পর তিন দিন ছিল একসঙ্গে। ভালই কেটেছিল তিনটে দিন। এখন ওর বড় বেশি পঞ্জিকা-সর্বস্বতা। দাড়ি কামানোটাও পঞ্জিকা মেনে করছিল হেরম্ব। বসনটাও গৈরিক।
দেশ ভাগ হবার পর বেশ কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তানেই ছিল হেরম্ব। তারপর ত্রিপুরার আগরতলায় যায়। ত্রিপুরার একটি ইস্কুলে পণ্ডিতের চাকরিও জুটিয়েছিল হেরম্ব। হেরম্ব আসবে।
অঞ্জলিকে কী করে বলবেন এখন? রেশনে যা চাল দেয় দুই দিন মাত্ৰ চলে। বাইরে চালের দাম দুই টাকা বারো আনা—তিন টাকা। ঘরে চাল নাই গমের দামও বেড়েছে। যবের আটা কিঞ্চিৎ সস্তা। অতিথিকে তো আটা খাওয়ানো যায় না। অনেকটা শ্বাসগ্রহণ করলেন অনঙ্গমোহন। প্রাণায়ামে এর নাম পূরক। বেশ কিছুক্ষণ শ্বাসবায়ু আটকে রাখলেন। কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না। কুম্ভক। হঠাৎ হড়হড় করে বলে দিলেন বৌমা, হেরম্ব আসবে হেরম্ব, আমার বাইল্যবন্ধু। কালই আসবে, থাকবে ক’দিন। বলেই সরসর করে সরীসৃপের মতো বারান্দা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে গেলেন। চললেন হরি ঘোষ স্ট্রিট।
বিলু ছিল ঘরে। অঞ্জলি হঠাৎ ছুটে এসে ওর বইপত্র বন্ধ করেছিল। ঠোঙাই বানা বিলু, রিকশা চালা, মোট ব’ তুই। আর আমি রাস্তায় নাইম্যা যাই—তোর দাদুর শখ মিটাইতে গেলে এইসব ছাড়া উপায় নেই। অসীম গেছে, আবার হেরম্ব না কে যেন আসবে। আমার আর ভাল্লাগে না। আমি ঐ মাড়োয়ারি বাড়ি কাজ নেব। আজই যশবাবুর কাছে চললাম।
ক’দিন আগে অঞ্জলি বলেছিল বিলুকে, একটা অঙ্কের মাস্টার দ্যাখ। ক্লাস নাইনে উইঠ্যা, সাইনস্ পড়বি। সব ভাল ছেলেরা সাইনস্ পড়ে। সাইনস্ পইড়া চাকরি পায়। চাকরি কইরা তুই সোনা, আমারে সুখ দিবি। বিলু বলেছিল, তিরিশ টাকার কম তো প্রাইভেট হয় না মা। অঞ্জলি বলেছিল, সেই ভার আমার। আমি দিমু তোরে মাস্টারের ব্যাতন। তুই পড়। শিখাদের ঘরে অঞ্জলি যে ক’মাস রান্না করেছে তিরিশ টাকা করে পেত। এখন সে কাজটাও নেই। যশবাবু এসেছিলেন মাঝে দু’দিন। বলেছেন-ঐ টিন কারখানার মালিক অঞ্জলিকে একটা কাজ দেবেন। মালিকের বাড়িতে। অঞ্জলি যখন টিন কারখানায় কাজ করতো, বিলু দু’একদিন গিয়েছিল ওখানে। দেখেছে, ওর মা ওখানে টেবিলে টেবিলে জল দেয়, চা দেয়। চিঠিতে আঠা মারে। স্ট্যাম্প লাগায়।
এখন মালিকের বাড়িতে কী কাজ করবে মা? বিলু জিজ্ঞাসা করল। রান্নার?
—রান্নার ক্যান? মালিকের বাড়িতেই তো প্লাস্টিকের কারখানা হইছে শোনলাম। যশবাবু কইল। যশবাবু ঐখানে কাজ করে।
থাক। তোমায় যেতে হবে না মা। বিলু বলল। অঞ্জলি বলল যাইতে কি চাই আমি? সাধ কইরা যাই? তোর দাদু যা লাগাইছে। তোর মামার বাড়িই যাওন ভাল ছিল আমার। তোর বাপ মরার পর যখন চাকরি পাইলাম, তোর মামা কতবার কইছিল দিদি, বিলু-স্বপ্নারে লইয়া চইল্যা আয় আমার কাছে, শুধু ঐ বুড়ার মুখের দিকে চাইয়া আমি যাই নাই তখন।
বিলু কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। বিলু শুনল ট্রাংক খোলার শব্দ। ট্রাংক বন্ধ করার ঝনাৎ। ন্যাপথলিনের গন্ধ। ছাপা শাড়িটা পড়ল মা।
—আমি মাড়োয়ারি বাড়ি যাই।
—তুমি যেও না মা।
—আমি ঠিক কইরা ফালাইছি।
অঞ্জলি চলে যাবার পর আবার ট্রাংকটা খোলে বিলু। ট্রাংকের মধ্যে বাবার খাকি জামা, ধুতি, মায়ের কাপড়, কাঁসার থালা…। ডুবুরি হয়ে যায় বিলু। সারা গায়ে মাখে গঙ্গামাটির মতো স্মৃতি। তারপর ট্রাংকের গভীরে ডুব দিয়ে বার করে আনে ছোট্ট বাক্সটা।
আংটি।
আংটিতে খোদাই করা ‘বিপ্লব’। বিক্রি করে দিয়ে পঁচাশি টাকা পায়। ঊনচল্লিশ টাকা দিয়ে পনের কিলো চাল কিনল বিলু। ঐ চাল নিয়ে যখন ফিরছিল, তখন বিলুর মনে হচ্ছিল—চাল নয়, গিরিগোবর্ধন ধারণ করেছে ও।
সন্ধে হল। অঞ্জলি ফিরল না তখনো। স্বপ্না ঠাকুর প্রদীপ জ্বালিয়েছে, দুয়ারে জলের ছিটে দিচ্ছে। অনঙ্গমোহন ফিরলেন। বিলু ছুটে গিয়ে অনঙ্গমোহনের হাত ধরে। বলে দেখবে এসো…দেয়াল ঘেঁষে লাগানো চাল রাখার টিনের মুখটা কটাস্ করে খুলে দেয়। অনঙ্গমোহন দেখেন, টইটুম্বুর টিন। দেখেন বর্ষার বেত্রবতী নদী। কনককান্তিমদালস্য। পীনস্তনী। টিনের ভিতরে দু’হাত ঢুকিয়ে দেন সম্ভোগ। সম্ভোগের পর অনঙ্গমোহনের চোখ উৎসুক। কে আনল চাউল? বিলু বলল ‘চুপ’। মাকে বোলো, তুমিই এনেছ।
—অর্থাৎ?
—মানে চালটা আমি এনেছি। কিন্তু মাকে বোলো তুমিই এনেছ।
—তুই কী কইরা আনলি?
—ধারে। তুমি ঐ সরকারি বৃত্তি পেলে শোধ দেবে।
—আমি মিথ্যা কমু?
—বিলু অনঙ্গমোহনের কাছে মুখ নিয়ে বলে, কও না একটু।
অনঙ্গমোহন বললেন, পারুম না।
বিলু বলল—প্লিজ-দাদু।
উঁহু।
তাহলে আমি যা বলার বলব। তুমি শুধু চুপ করে থেকো।
হে ঈশ্বর। কী বিচিত্র তোমার লীলা। তুমি রৌদ্রের দাবদাহ দাও, ছায়াও তোমার দান, ব্যাধি-রোগ সবই দিছ তুমি সঙ্গে সঙ্গে দিছ গুল্ম ও ওষধি। কী নরম তালশাঁস দিছ গরমের বিকালে। বিলুকে মনে মনে জড়িয়ে ধরেন অনঙ্গমোহন।
সেই রাতে বেশ গুমোট ছিল। দক্ষিণের ঐ জানালা ছিল হাওয়াহীন। অসীম চলে যাবার পর বিলু অনঙ্গমোহনের সঙ্গে শোয়। বিলুর বার বার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল বাতাসের আরামে। কারণ, অনঙ্গমোহন হাওয়া করছিলেন তালপাতার পাখায়। বিলু বার বার বলছিল-থাক দাদু থাক। কিন্তু অনঙ্গমোহন বার বার হাওয়া করছিলেন। তখন বিলু ভাবছিল, পাখাটা কেড়ে নেবে। তারপর এক সময় পাখা থেমে গেলে বিলু চুপি চুপি পাখাটা সরিয়ে নিল। তারপর ঘুমোল। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে গেলে বিলু পাখাটা হাতড়ে নেয়। অনঙ্গমোহনের দিকে পাখাটা হেলিয়ে বাতাস করতে গিয়ে টের পায়, বিছানা শূন্য। কলঘরে গেছে বোধহয়। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন এল না, বিলু উঠল। দেখল, সিঁড়ির দরজা খোলা। সদর খোলা।
.
অনঙ্গমোহনের ঘুম হচ্ছিল না। ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলেন। শেষ রাত্রেই ওঠেন তিনি রোজ। গঙ্গায় যান। স্নান-আহ্নিক করেন। কিন্তু আজ অনেক আগেই উঠে চটের ব্যাগটা টেনে নিলেন। রাস্তায় বেরুলেন। চাঁদ তখন পশ্চিমে অনেকটা হেলেছে। অনঙ্গমোহন চটের ব্যাগটা নিয়ে এগোতে লাগলেন। ব্যাগের মধ্যে একটা লোহার শলাকা।
গতকাল বাইরে থেকে ফিরে অঞ্জলি বড় মনমরা ছিল। টিন ভর্তি চাল দেখেও উচ্ছ্বাস দেখায়নি। রাত্রে অঞ্জলি শুনল-চাল যেভাবে ধারে জোগাড় হয়েছে ঐভাবে কিছু কয়লা জোগাড় হয় না? আমি চাকরি নিয়েছি, শোধ করে দেব।
কয়লা? অনঙ্গমোহনের তখনই ঐ পোড়া কয়লার পাহাড়টার কথা মনে হয়। ভোরবেলা ভিড় হবার আগেই কিছু কয়লার টুকরো কি জোগাড় হয় না? চিৎপুর ইয়ার্ডে যাবার সময় ব্যোমকালীতলা পড়ে। কালীমন্দিরের কোলাপসি গেট বন্ধ। ঐ বন্ধ দরজায় অনঙ্গমোহন মাথা ঠেকান, ঝং শব্দ হয়।
মা কালী। তুমি নাকি চোরদের সহায়, ডাকাতদের সহায়?…আমার ও সহায় হও। তারপর ঐ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আরও কিছুক্ষণ। বলেন, হে ভগবন্—তুমি রূপ-বিবর্জিত, কিন্তু আমি তোমার রূপ কল্পনা করছি। তুমি বাক্যের অতীত, কিন্তু আমি স্তুতি দ্বারা তোমার অনির্বচনীয়তা নষ্ট করি। তুমি সর্বব্যাপী। তবু আমি মন্দিরের সামনে দাঁড়াই। আমার এই বিকলতা ক্ষমা কর। ক্ষন্তব্যো জগদীশ তদ্বিকলতা দোষম্। চললেন অনঙ্গমোহন পোড়া কয়লার পাহাড়ে। হাতে ব্যাগ, শিক, চৌর্যবৃত্তি? ক্ষন্তব্যো জগদীশ তদ্বিকলতা দোষম।
হেরম্ব এসে গেল। সঙ্গে ওর বড় ছেলে। হেরম্ব লাল রঙের বসন পরেছে, তান্ত্রিকদের মতো। মুখে দাড়ি। অনঙ্গমোহনকে জড়িয়ে ধরল। হেরম্বর গায়ে জ্বর।
হেরম্বকে অনেকদিন পর পেয়ে অনঙ্গমোহন খুশি। এরোপ্লেনে এসেছে হেরম্ব।
হেরম্ব তোমার কী অসুখ?
হেরম্ব ঠোঁট উল্টে হাতটা উপরে তুলে ধরে। ভীষণ ভগ্নগলায় বলেন—ঈশ্বর জানেন। ওর ছেলে বলল, বাবার কথা বলতে কষ্ট। অথচ কত গল্প করবেন ভেবেছিলেন অনঙ্গমোহন। পুরনো দিনের গল্প। সেই জল-ঝাঁপ? খেজুররস পাড়া, নতুন বৌকে ভূতের ভয় দেখানো…মনে আছে হেরম্ব ভাই, টোলের ছাত্ররা কিরকম খেলাইত তোরে? কলাপের ঐ সূত্রটা মিলাইয়া মিলাইয়া তোরে কী কইত?
হেড়ম্বের বৌ হিড়িম্বা।
পঞ্চমে পঞ্চমাংস্তুতীয়ান্নবা।
অনঙ্গমোহন জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী কষ্ট হেরম্ব? কী অসুখ?
হেরম্ব গলায় হাত দিয়ে দেখালেন। দেখালেন-সাদা দাড়ির ভিতরে, গলা থেকে ঝুলে পড়েছে আতার মতো একটা মাংসপিণ্ড। ভাঙা, কর্কশ গলায় হেরম্ব বললেন—বাঁচুম না…
হেরম্বের ছেলে বলল—খায় না, জ্বর, বমি। ত্রিপুরায় সব কিছু হয়ে গেছে। তারপর অনঙ্গমোহনকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল—এবারে খুড়ামশয়, শেষ চেষ্টা। হাসপাতালে ভর্তি করামু। ক্যানসার হাসপাতালে।
হেরম্ব স্বপাকি। ওর জন্য আলাদা উনুন ধরাতে হল। আলাদা একটা হাঁড়ি।
হেরম্বর ছেলে বলল—আমি এখানে খামু না। আমি আমার মামাশ্বশুরের বাড়ি যাই। বাবা দুই দিন এখানেই থাক। এই সামান্য দুটা ভাত খায়। একসিদ্ধ ভাত। তবে আজ পটলটা বাদ। তৃতীয়া কিনা। দু’মুঠো ভাত ও খেতে পারল না হেরম্ব। বমি বমি পাচ্ছিল। দুটো দিন কেটে গেল। হেরম্বের ছেলে একবার করে এসে খোঁজ নিয়ে যেত শুধু। সারাদিন বাইরে বাইরে—ওর বাবাকে ভর্তির চেষ্টায় ব্যস্ত।
হেরম্বর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাও হল না অনঙ্গমোহনের। শুধু জানলেন— এখন তিন ছেলেই চাকরি করে। দুই ছেলে বিবাহিত। নিজের বাড়ি। বাড়িতে ছোটখাটো একটা কালীমন্দির রয়েছে। রেডিও আছে। গ্রামাফোনও। গ্রামাফোনে শ্যামাসঙ্গীত বাজে। তবে তো সুখের সংসার—অনঙ্গমোহন বলেছিল। কারণ ‘সুখী গৃহকোণে শোভে গ্রামোফোন’ ঠোঙার কাগজে প্রায়ই দেখেন তিনি।
হেরম্ব বলেছিল, হ। সুখেরই সংসার, সুখেরই দিন। সেইজন্যই তো আরও কটা দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে অনঙ্গভাই।
একটু কথা বললেই হেরম্বর হাঁপ ধরে। শুয়েই থাকেন সারাদিন। জেগে থাকলে মালা জপ করেন। গায়ত্রী জপ করেন। গায়ত্রী জীবন বর্ধন করে। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যান অনঙ্গমোহন। গরম জল, বাতাস করা, এটা ওটা রুগী সেবা তো কম নয়। স্বপ্নাও অনেক করে। মাঝে মাঝে বিলুও হাতের থেকে টেনে নেয় পাখা।
অঞ্জলি বেরুচ্ছে। অঞ্জলি কারুর দিকে না তাকিয়ে বলল—যাচ্ছি। চাকরি। আজ থিকা। অনঙ্গমোহন কারুর দিকে না তাকিয়ে মিনমিন করে বলল, দুর্গা দুর্গা।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করেছিল, কামদেবপুর কোথায়? ওখানে নাকি দৈব ওষুধ পাওয়া যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না। একবার বলল, হরিদ্বার যেতে পারলে হয়তো অসুখ ভাল হয়ে যেত। ওখানে নাকি একজন সাধু আছেন…
অনঙ্গমোহন কয়েকদিন সুমিতার সঙ্গে দেখা করেননি। দু’দিন রোগী-সঙ্গ করে একটু মুক্ত বায়ুর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তিনি স্বপ্নাকে বললেন, তুই এই দাদুটাকে দেখ। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছি।
ভীষণ সুখবর শুনলেন অনঙ্গমোহন। ললিত মিত্র কথা দিয়েছেন। দিনও প্রায় স্থির। পাকা কথাটা দেওয়া হয়নি শুধু অনঙ্গমোহনের অপেক্ষায়
ললিত মিত্র যেদিন স-স্ত্রীক দেখতে এসেছিলেন, অনঙ্গমোহনও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। দু’একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন ললিতমোহন। যেমন মৃচ্ছকটিক কার রচনা কিংবা শিশুপাল বধ সিলেবাসে আছে কি না, বলেছিলেন অভিনয় পারবে তো? রেডিওতে সংস্কৃত নাটক করি আমরা।
ওঁর স্ত্রী বলেছিলেন, কী আর বলব। সদ্বংশের মেয়ে। ছেলেকে দেখো। ওটাই প্রায় কথা দিয়ে দেওয়া। তবু ললিতবাবু বলেছিলেন, ছেলে আসার কথা আছে। ও একবার দেখুক।
তা ঐ নাবিক ছেলেটি এসে পড়েছে। পাত্রী দেখতে আসেনি। বাবা-মা’র পছন্দ, আর কিছু বলার নেই। সুতরাং বিবাহ স্থির। অত্যন্ত আনন্দ হচ্ছিল অনঙ্গমোহনের। যেন একশো ছাত্র টোলে ভর্তি হল। অনঙ্গমোহন বাড়ির দিকে ছুটলেন। ট্রামের ঘণ্টায় ঝুমঝুমি বাজে, কলকাতার ভিড়ে করতালি, রিকশাওয়ালার ঘণ্টাধ্বনিতে আনন্দ সমারোহ, মোটর হর্নে শুভ শঙ্খধ্বনি। আনন্দ আনন্দোব্রহ্ম।
আনন্দদ্ধোব খল্বিমনি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দের জাতানি জীবন্তি… চু কিত কিত চু কিত। বাড়ি আসেন। শুভ সংবাদ।
ঘরের দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। দরজা খুলতেই বজ্ৰাহত হন অনঙ্গমোহন। স্বপ্নাকে আঁকড়ে ধরে আছে হেরম্ব। স্বপ্না বিমূঢ়া-বালা। হেরম্বের গলায় রুদ্রাক্ষ মালা দোলে, মুখে লালা। হাতির তাবিজ-মাদুলি কাঁপে। স্বপ্নাকে লেপ্টে ধরে আছে হেরম্ব। স্বপ্নার একটা হাত খামছে ধরছে হাওয়া।
অনঙ্গমোহন নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারলেন।
হেরম্ব বলে ঐ সব কিছু নয়, শুন অনঙ্গ, ঐসব কিছু নয়, আমি শুধুমাত্র বাঁচার জন্য…
অনঙ্গমোহন বললেন, গর্ভস্রাব…
হেরম্ব মিন মিন করে—শুন অনঙ্গ, ষোড়শী সান্নিধ্যে দেহ নীরোগ হয়। তন্ত্রামৃত সুধায় আছে। চরক সংহিতায় আছে। অষ্টাবক্র সংহিতাতেও আছে, নবযৌবনা প্রাণকরাণি। চাণক্যশ্লোকে আছে, সদ্যোমাংস নবান্নঞ্চ বালা স্ত্রী ক্ষীর ভোজনম…
আবার সংস্কৃত মারাও, অনঙ্গমোহন জ্বলে ওঠেন।
হেরম্ব বলে, শুধু বাঁচার লাইগ্যা…আর কিছু নয়। শাস্ত্রে আছে…
—তোমার শাস্ত্রের পায়ুমেহন করি আমি…এই বলেই দেয়ালের পাশে বইয়ের তাকে লাথি মারলেন তিনি। ছিটকে পড়ল কাব্য চন্দ্রসুধা—নৈষধ চরিত—কাদম্বরী। তক্ষুণি আবার গিয়ে তুলে নিলেন। চাদরে মুছলেন। ছিঁড়ে যাওয়া পাতাটিকে শুশ্রূষা করলেন অনঙ্গমোহন। হাত বুলোলেন। বাছা, সংস্কৃত ভাষা। তোর দোষ কী। আমরাই অধম। ভাষার সঙ্গে আচার আমরাই যুক্ত করেছি। এটা আমাদেরই বিফলতা। সংস্কৃত বইগুলির গায়ে হাত বুলান অনঙ্গমোহন। আসলে স্বপ্নার গায়েই হাত বুলোচ্ছিলেন। স্বপ্না কাঁদছিল। যৌবন বড় অরক্ষিত এই সংসারে। শাস্ত্রও রেহাই দেয় না।