চতুষ্পাঠী – ১৫

পনের

অনঙ্গমোহনের মন ভাল নেই। ক’দিন ধরে বড় একটা কথা বলছেন না। অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হইছে বাবা আপনার? মনটন ভাল নাই দেখি? অনঙ্গমোহন বললেন, লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অকস্মাৎ মৃত্যু প্রাণে য্যান শেল বিন্ধাইয়া দিল।

অঞ্জলি জানে, এটাই একমাত্র মন খারাপের কারণ নয়। মন খারাপের আসল কারণ অন্যত্র। অসীম চলে যাবে।

বিলু বলল—দাদু, এরকম চুপচাপ বসে আছ কেন কাল থেকে। অসীম বরং এখানেই থাক। ওর বাবা নিতে এলে বলে দিও, যাবে না।

অনঙ্গমোহন বলেন—খবর শুনছস, সকালের স্থানীয় খবর? আবার রেশনে চালের দাম বাড়তাছে? অষ্টাশি পয়সার চাল একটাকা দশ পয়সা? অসীম অনঙ্গমোহনের ধারে-কাছে আসছে না।

অনঙ্গমোহনও অসীমকে দেখে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছেন চোখ।

অসীম আর বিলু, দুজনেই ক্লাস এইটে উঠেছে এবার। সংস্কৃতে বিলু পেয়েছে ৫৯ আর অসীম ৬৮। ৬৮ নম্বরের দিকে চেয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল অনঙ্গমোহনের। অঙ্ক, ইংরাজি এইসব নম্বরের দিকে দৃকপাত করেননি অনঙ্গমোহন।

এবার স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষা হবার পরই অনঙ্গমোহন হরিদাসকে চিঠি লিখলেন—ভাই হরিদাস, বড় কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করিতেছি। সংসারে আমি এবং আমার চতুষ্পাঠী আবর্জনাস্বরূপ হইয়া পড়িয়াছে, তুমি আসিয়া অসীমকে লইয়া যাও।

আদ্য পরীক্ষা আবার পিছিয়ে গেছে। সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ কখনোই এই পরীক্ষা ঠিক ঠিক সময় নেয় না। কোনো কোনো বছর তো পরীক্ষা হয়ই না। অনঙ্গমোহন লিখেছিলেন—অসীমকে ঐ অঞ্চলের ইস্কুলে ভর্তি করিয়া দিও, আদ্যপরীক্ষা শুরু হইবার কিছুদিন পূর্বে পাঠাইয়া দিও। কবে পরীক্ষা হইবে জানাইয়া দিব। তুমি অসীমকে সংস্কৃত পড়িবার জন্য ক্রমাগত উৎসাহ দিবে। গোবরডাঙায় শ্রী চপলাকান্ত কাব্যতীর্থ বিদ্যাবিনোদ আছেন, আমার সহপাঠী ও বিশেষ বন্ধু। তাঁহার একটি চতুষ্পাঠী আছে। তথায় ‘মধ্য’ পড়িতে সবিশেষ বলিবে। আমার জীবিতকালে যদি শুনিতে পাই, অসীম উপাধি পাইয়াছে, তবে আমার সুখের সীমা থাকিবে না…

বোবাঠাকুর এলেন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। কালচে চাদর। এই শীতে বার করার পর আর কাচা হয়নি। গলায় মাফলার। পায়ের গোড়ালির সামনে যে দাগটা ছিল, কিছুটা বেড়েছে। সঙ্গে এনেছেন একটা লাউ। পাঁচ-ছ’সের ওজন হবে। আর এনেছেন মানকচুর অর্ধেক। হাঁপাচ্ছেন বোবাঠাকুর। লাউটা দেখিয়ে বাঁ-হাত আর ডান হাতের আঙুলগুলো বেকিয়ে ধরলেন, তারপর নাড়ালেন যেন কিলবিল করছে।

ইচা মাছ? অনঙ্গমোহন বললেন।

বোবাঠাকুর ঘাড় নাড়লেন। ঠিক ঠিক। মানে চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ।

মানকচুটা রেখে বোবাঠাকুর মশলা পেশার অভিনয় করে দেখালেন।

অনঙ্গমোহন বুঝলেন, মানকচু বাটা।

এত ভারী জিনিস এতদূর থিক্যা বহন কইর্যা আনলা ক্যান কও তো?

হাসলেন বোবাঠাকুর।

বোবাঠাকুরের বড় ছেলেটা একটু হাবাগোবা ধরনের। এক পানের দোকান করে দিয়েছিলেন কষ্টেসৃষ্টে। চালাতে পারেনি ছেলেটা। এখন গরুটরু পুষে তার দুধ বিক্রি করে কোনোমতে চলছে। বোবাঠাকুরের যজমানির আয় আর নেই। ভেবেছিলেন, অসীমটা এখান থেকে মানুষ হয়ে ফিরবে।

অনঙ্গমোহন বললেন—আছ কেমন? বোবাঠাকুরের গোঁ গোঁ শব্দে অনঙ্গমোহন বুঝলেন বোবাঠাকুর ভাল নেই।

অনঙ্গমোহন বললেন—অসীম এবার তোমাগর কাছেই যাউক। মায়ের পোলা মায়ের কাছে ফিরুক।

বোবাঠাকুর ঘাড়ও নাড়লেন না, মুখ দিয়ে শব্দও করলেন না।

অনঙ্গমোহন বললেন—আর একটা কথা কই হরিদাস, অসীম্যা বড় অবাইধ্য হইছে আইজকাল। খালপাড়ের সাহেবগুলিরে ইট মেলা মারছে। সাহেবরা হইল গিয়া সাহেবের বাইচ্যা। ছাড়ব ক্যান, পুলিশে খবর দিছে। কখন যে ধইরা লয় ঠিক নাই।

বোবাঠাকুর মৃদু মৃদু মাথা নাড়েন। অঞ্জলি এসে পায়ের দাদের খয়েরি দাগে আলতো আঙুল ছুঁইয়ে প্রণাম করল। অঞ্জলি আজ খুব সংক্ষেপে ও-ঘরের কাজ সেরে সকাল সকাল চলে এসেছে। এখন এঘরের রান্না। শিখাকে ওর মামারা নিয়ে গেছে। অঞ্জলি এঘরে আজ কয়েকটা পদ বেশি রান্না করেছে। অসীম যা যা খেতে ভালবাসে। বাজারে যাবার সময় বলে দিয়েছে, বুড়ো দেখে সিম আনবেন। অসীম সিমের বিচি ভালবাসে। বিট আনবেন বিট। অসীম যদিও মাংসের হাড় চিবোতে ভীষণ ভালবাসে, কিন্তু মাংসের কথা বলেনি অঞ্জলি।

ওরা খেতে বসেছিল। বোবাঠাকুর খেতে বসার আগেই বুড়ো আঙুল আর দাঁতমাজার আঙুল দুটো একত্র করে ঘষতে লাগলেন। তখন অনঙ্গমোহন অসীমের দিকে তাকিয়ে বললেন—সৈন্ধবানয়। বিলু বুঝতে পারল এখনও পড়াচ্ছেন দাদু। অমরকোষ হল শব্দ সংকলন গ্রন্থ। শব্দের অর্থ বলা আছে। সৈন্ধব শব্দের নানা অর্থ হয়। অনঙ্গমোহন বলেছিলেন সৈন্ধব শব্দের অর্থ লবণ এবং অশ্ব দুই হয়। যখন কোনো যোদ্ধা বলেন—সৈন্ধব আনয় তখন কি তাহাকে লবণ আইন্যা দিবে? না অশ্ব আইন্যা দিবে? নিশ্চয় অশ্ব আইন্যা দিবে, আবার ভোজনকালে যদি কেহ বলে, সৈন্ধব আনয় তখন কি তাহাকে অশ্ব আইন্যা দিবে? উঁ-হু। লবণ আইন্যা দিবে। স্থান কাল পাত্র অনুসারে একই শব্দের বহু অৰ্থ হয়।

অসীম লবণের পাত্রটা আনতে ওঠে না। অনঙ্গমোহন ভাবলেন, এটা অসীমের অভিমান। বিলুই এনেছিল। আসলে অসীম তো জানে, ওর বাবা এক্ষুণি নুন আর তরকারির খেলা শুরু করে দেবে। আর ঐ খেলা দেখে মুখ টিপে টিপে হাসবে বিলু, বিলুর মা। সেই জন্যই নুনের পাত্রটা আনতে চায়নি।

বোবাঠাকুর ভাত আর তরকারি মাখলেন। এর পরই নুন দিলেন ছিটিয়ে। প্রথম গ্রাস খেয়েই মুখ কুঞ্চন করলেন। নুন বেশি হয়ে গেছে। সুতরাং আর একটু ভাত। ভাত দেওয়া হল। শুকনো শুকনো হয়ে গেছে। সুতরাং আর একটু তরকারি। তরকারির সঙ্গে আবার নুন। এঃ, নুন বেশি। বোবাঠাকুরের মুখ বিকৃত। আর একটু ভাত। এবার আর একটু তরকারি। অনঙ্গমোহন প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন।

ফাল্গুনে বালা আর ভগিনী গৃহে শালা একটু চঞ্চল তো হবেই। অঞ্জলি একসঙ্গে অনেকটা ভাত দিতে চায়। অঞ্জলি যখন হাতা দিয়ে হাঁড়ির থেকে ভাত তুলছিল তখন ঘর্ষণের তীব্র ধাতব শব্দ আসছিল। ঐ ধাতব শব্দের ভর্ৎসনায় বোবাঠাকুর দু’হাতের মুদ্রায় নিষেধ করল, না, আর নয়। অঞ্জলি তবু দিল।

অসীম গুছিয়ে নিয়েছে ওর জিনিসপত্র। লাট্টু, লেত্তি, মার্বেল, চুম্বক, স্প্রিং। অঞ্জলিকে প্রণাম করল। অনঙ্গমোহনকে প্রণাম করল, অনঙ্গমোহন তখন আর স্থির থাকতে পারলেন না। অসীমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অসীম, তুই পড়াশোনা ছাড়িস না। সংস্কৃত না পড়িস-না পড়িস, ইংরাজি পড়িস, অঙ্ক করিস। অঙ্ক, অঙ্ক।

অসীম স্বপ্নার দিকে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, তারপর ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। অনেকক্ষণ কিছুই বলে না। তারপর বিলুকে বলে, খুব রাগ আর অভিমানে বলে—বিলুরে তুই শোন—সাহেবদের ‘মোসিসো ওকে সা-দা’ ভাল কথা নয়। গালাগালি। মা তোলা গালাগালি। ‘পিচকোমা তে’ খুব খারাপ গালাগালি। বুনুল সাহেব খুব বদ। স্বপ্নাকে খুব খারাপ কথা বলেছিল। বুনুল সাহেবকে ইট ছুঁড়েছি বেশ করেছি। স্বপ্নার দিকে তাকাল অসীম। স্বপ্না চোখ নামাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *