চতুষ্পাঠী – ১০

দশ

কাপড়ের থলিতে গুছিয়ে নিলেন কাপড়, উত্তরীয়, গামছা, নামাবলী। একটি যত্নে রাখা আতস কাচ রাখলেন কাগজ মুড়ে। ছোট অক্ষর পড়তে সুবিধা হয় এতে। রুমালে বাঁধলেন পাঁচটা টাকা। দুর্গাপূজা বলে কথা, পাঁচ দিন থাকতে হবে। একবার জীবন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। ক’দিন বেশ কাশি কাশতে গেলে মন্ত্রের উচ্চারণ ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। আবার টাকার জন্য হাতড়াতে থাকেন।

জীবন গর্ভস্রাব। টোলেও আসে না। আসবেও না। ওর কাছে যাবার দরকার কী? হাতিবাগানে গেলে হয় না? কবিরাজরা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছ থেকে অর্থগ্রহণ করেন না। কবিরাজি ওষুধের তো আবার অনুপান লাগে। কে বানাবে অনুপান? দরকার নাই। আর্দ্রক চর্বণ করবেন বরং। চললেন অনঙ্গমোহন। অসীমকে সঙ্গে নেবার কথা ভেবেছিলেন একবার। শেষ পর্যন্ত কিছু বলেননি। কিশোর বালক, প্রতিমা দেখুক। মণ্ডপের আলোকনৃত্য দেখুক, কুড়মুড় ভাজা খাক।

কামাখ্যা পুরোহিতের বাড়ির উঠানে এখন আর শুধু জবা-তুলসী নয়, রজনীগন্ধা জুঁই। জুঁইলতা দেয়াল বেয়ে উপরে উঠেছে। ছাত আর টালির নয়। পাকা। বারান্দায় কয়েকটি চেয়ার এবং লম্বা বেঞ্চি।

মানিক এসে নমস্কার করল। কামাখ্যাচরণের ছেলে। ধুতি আর শার্ট পরা। হাতে ঘড়ি। ভাল আছেন তো জ্যাঠা? সিগারেটের গন্ধ পেলেন অনঙ্গমোহন।

কামাখ্যা কই?

বাবা তো মন্দিরে। আসুন।

কালীর মাথায় লাল ঝালর। পাথরের বেদি। দেয়ালে ঘড়ি। বেলা একটা। দেয়ালে ওঁ-এর মধ্যে কামাখ্যাচরণের বাঁধানো ছবি। গর্ভগৃহের সামনে একটু বারান্দা মতন। সেখানে ভক্ত পরিবৃত কামাখ্যাচরণ।

—বিশ্বাস রাখ। বলছি তো হবে।

—ঠিক হবে তো ঠাকুরমশাই।

-মাকে বল। ভক্তি ভাবে বল, হবে। মায়ের নির্মাল্য কবচে ভরে ধারণ কর।

—আমার কন্যার বিবাহের ব্যাপারে আপনি একটি কবচ ধারণের কথা বলেছিলেন সেটা…

—হবে। সেটা হবে। পরে হবে। একজন বিখ্যাত পণ্ডিত এখন আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী। আস, আস অনঙ্গমোহন।

অনঙ্গমোহন জরদগব। এগিয়ে যান। এগিয়ে যান। কামাখ্যাচরণ উঠে দাঁড়ান। কামাখ্যাচরণের নামাবলীটি সিল্কের। কাঁধের দু’পাশ সমানভাবে ঝুলে পড়েছে। চৈতন্যদেবের ছবিতে যেমন ঝোলে। দু’হাত দু’পাশে ছড়ালেন। আলিঙ্গন মুদ্রা। যেন শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে রায় রামানন্দের মিলন। অনঙ্গমোহন একটু কুঞ্চিত হলেন।

কামাখ্যাচরণের সঙ্গে ঘরে গেলেন অনঙ্গমোহন। একটা পাতা-পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলেন অনঙ্গমোহন। ঐ পোড়া গন্ধটা হৃদয় নিংড়ে নিল অনঙ্গমোহনের। ঐ পোড়া গন্ধে হা হা করে উঠল বুক। খা খা মাঠের মধ্যে যেন একাকী অনাথ বালকের কল্পদ্রুম ছায়া। জলের মধ্যে কমলে কামিনী। অনঙ্গমোহন কামাখ্যাচরণের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, পাতুড়ির গন্ধ না? কামাখ্যাচরণ ঠোঁট উল্টে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তিনি জানেন না। পাতুড়ি সম্পর্কে তিনি নৈর্ব্যক্তিক। পাতুড়ি মায়া মাত্র। কিছু না।

সিমেন্টের মেঝেতে গোবর ছোঁয়ানো হল। কামাখ্যা খেতে বসলেন। ধোঁয়া ওঠা ভাতের পাশে অনঙ্গমোহন দেখলেন, পাতুড়ির শরীর। বোয়াল মাছের পাতুড়ি। কতদিন খাননি। কতদিন। তুমি খাইয়া আইলা ক্যান অনঙ্গ? এখানেই খাইতে পারতা।

কামাখ্যা কেন বলল না আগে দ্বিপ্রহর ভোজনের কথা?

অনঙ্গমোহন দেখল, বোয়ালের রুপোলি চামড়া সর্ষেবাটায় কেমন মাখামাখি হয়ে বলছে যে, এ পৃথিবী মায়া নয়। মোহময়। হাল্কা ধোঁয়া। ধোঁয়ার গন্ধ আসে, পাতুড়ির।

অর্ধভোজনই হোক তবে।

আশালতা বলল—মাছপাতুড়ি রাত্রের জন্য রাইখ্যা দিতেছি কিছুটা। অনঙ্গমোহনের দিকে তাকিয়ে বলল, রাত্রে খাইবেন।

ওরা কি বুঝে ফেলেছে নাকি? পাতুড়ির দিকে দৃষ্টিটা কি লোভীর মতো ছিল? অনঙ্গমোহন দূরে সরে যান। বলল-না, না, রাত্রে তো ফলাহার। আমার বুঝি বোধন করতে হইব না? আশালতা বলেন, বোধন তো মানিকই করব। আপনের অসুবিধা কী? আপনে ভাতই খাইবেন। মাছ তুইল্যা রাখলাম।

কামাখ্যা…

কামাখ্যা তো ভোজন করছেন। ভোজনের সময় বাক্যালাপ নিষেধ। মানিক পূজা করবে। মানিক পূজা করবে আর অনঙ্গমোহন তন্ত্রধারী করবে। মানিক হোতা। অনঙ্গ সহকারী। কামাখ্যা, তুমি কঠিন হিসাব জান কামাখ্যা।

আছিল দেউল এক বিচিত্ৰ গঠন
ক্রোধে জলে তুলে ফেলে পবননন্দন
অর্ধেক পঙ্কেতে আর তেহাই সলিলে
দশম ভাগের ভাগ শেওলার দলে
করহ সুবোধ শিশু দেউল প্ৰমাণ
উপরে এগার হাত দেখ বিদ্যমান।

দেবী দুর্গার আবরণ উন্মোচন করলেন ছবি বিশ্বাস। অসুরের মুখটা ঠিক আয়ুব খাঁর মতো। অতিথি হয়ে এসেছেন নগেনবাবু। বহুদিন পরে নগেনকে দেখলেন অনঙ্গমোহন? নগেন ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন। এখন বিখ্যাত লোক। অনঙ্গমোহনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন…। সঙ্গে উঠে বক্তৃতা করলেন…সুতরাং বন্ধুগণ, এই শক্তিরূপিণী বরাভয়প্রদয়নী দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানাই যে…আমাদের এমন শক্তি দেও যেন পাকিস্তান তেরিবেরি করলে এমন শিক্ষানি দিতে পারি য্যান এ্যাক্কারে…

পরিশেষে সভাপতি, কেশব মিশ্র চণ্ডী থেকে কিছুটা পাঠ করলেন। কামাখ্যাচরণ অনঙ্গমোহনের কানে কানে বললেন—এই যে উনিই এখন টোলের ইনেস্পেক্টার। এ পাড়ায় নতুন বাড়ি করেছেন…

টোল পরিদর্শক? অনঙ্গমোহন বৃক্ষের বিশ্বরূপ দেখছেন।

কামাখ্যাচরণের ঘরে সমবেত হল সব। সামান্য চা-মিষ্টি খেয়ে যাবার অনুরোধ।

বারান্দার শেষ দিকে পার্টিশন করা। ঐখানে দীননাথ চতুষ্পাঠী, ঐ ঘরে বসল সব। দীননাথ চতুষ্পাঠীর অনুমোদন রহস্য পরিষ্কার হল।

কামাখ্যাচরণ অনঙ্গমোহনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

অনঙ্গমোহন বললেন, আমারও একটি চতুষ্পাঠী আছে। কথাটা বলেই অনঙ্গমোহন মনে মনে ঐ বাক্যটির টীকা তৈরি করতে থাকেন। এই বাক্যবন্ধনীর মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন সংকোচ রয়েছে সেটা উপলব্ধি করলেন। একটি ‘আজ্ঞে’ শব্দ এখানে উহ্য আছে, কিন্তু ব্যঞ্জনাটি রয়ে গেছে। ‘আমারও’—এই শব্দটির প্রয়োগে দীননাথ চতুষ্পাঠীকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হল। ব্যঞ্জনার্থে হল দীননাথ চতুষ্পাঠীই, অর্থাৎ কামাখ্যাচরণই হল প্ৰধান এবং অনঙ্গমোহনের চতুষ্পাঠী অপ্রধান।

কোন অঞ্চলে আপনারটি?

বাগবাজার।

চন্দননগরের বাগবাজার-

চতুষ্পাঠীর নাম কি?

পূর্ণচন্দ্ৰ চতুষ্পাঠী…

আগামী সপ্তাহেই যাব ভেবেছিলাম তো। ছাত্র কটি?

ছাত্র তিন আর ছাত্রী দুই।

ছাত্রী? আপনি তো ভাগ্যবান আচার্য। উপাধির ক্যানডিডেট আছে?

আমার ছাত্রীটি উপাধি দেবে।

এমন সময় রসগোল্লার প্লেট আসে। কেশব মিশ্র বলেন, যেনাহ নামৃতাস্যাম্ কিমহং তেন কুৰ্য্যাম্। যাহাতে অমৃত নাই তাহা লইয়া কী করিব? এ স্থলে অমৃত অর্থে চা বুঝতে হবে।

কেশব মিশ্র বললেন, তা আপনার উপাধি পরীক্ষার্থিনীর বয়স কত?

—ত্রিশোর্ধ্ব।

তবে তো পয়সা পয়সা।

পয়সা? পয়সার সঙ্গে কী সম্পর্ক?

কেশব শাস্ত্রী তখন নটের মতো চক্ষু এবং অঙ্গ সঞ্চালন করে বলতে লাগলেন-

বদরী শত মূল্যেন
সহস্র মূল্যেন দাড়িকম্বম
বিল্বফল লক্ষ মূল্যেন
অলাবু পয়সা পয়সা…

এই আদি রস অনঙ্গমোহনের ভাল লাগল না। একশত মুদ্ৰায় কুল ক্রয় করা যায়। সহস্র মুদ্রায় ডালিম ফল। বেল লক্ষ টাকা। কিন্তু লাউ? পয়সা পয়সা। কেশববাবু কুল ডালিম আর বেলের আয়তন দেখাচ্ছিলেন তাঁর হাতের আঙুলে।

—তা আপনার ছাত্রীটি কি বিবাহিতা?

—না। যদি সন্ধানে পাত্র থাকে বড় উপকৃত হই।

—আমার শ্যালক চল্লিশোর্ধ্ব। রাইটার্সে কাজ করে। সম্প্রতি একটি জুয়েলারি দোকানে বসছে। গ্রহশান্তির জন্য পাথর ইত্যাদির ব্যবসা করছে। আয় ভাল। একজন বয়স্কা কুমারীর খোঁজে আছি। সংস্কৃতজ্ঞা হলে তো আরও ভাল।

—কিন্তু আমার ছাত্রী তো ব্রাহ্মণ কন্যা নয়।

—তা অ্যাদ্দিন বে-থা হয়নি কেন? নগেন জিজ্ঞাসা করলেন।

মেয়েটি পিতৃহীনা। উদ্যোগের অভাব। বর্তমানে আমার ছাত্রী যে কালে, অভিভাবকত্বের দায় তো আমারও আছে, না কি কন? নগেন বললেন, আমার ছোটভাইয়ের বৌটা মরে গেছে বছর দুই হল। বাচ্চাকাচ্চা হয়নি তো। কন্ট্রাক্টরি করচে খুচখাচ। আয় মন্দ না। বাঙুর অ্যাভিনিউতে বাড়ি করছে। আর এই যুদ্ধের মওকায় ইস্ট পাকিস্তান বর্ডারে রাস্তা তৈরির একটা কাজ পেয়েছে। ভাল কাজ। দেখুন না, যদি হয়।

বিবাহের পর সংস্কৃত পড়ার অনুমতি দিবেন তো?

সবাই হেসে উঠল। অনঙ্গমোহন বুঝতে পারলেন না, এই বাক্যটির মধ্যে হাস্যরসের অস্তিত্ব কোথায় আছে।

নগেন বললেন—আরে ওসব পরের কথা। বিয়ে তো আগে হোক। একশো কথা না হলে কি বিয়ে হয়? রাশিচক্র নিয়ে যাবেন একদিন।

এদিকে শাস্ত্রীমশাই উঠছেন। তাড়াতাড়ি অনঙ্গমোহন বললেন, টোলের নিয়ম সম্পর্কে দু’একটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল।

আরে ধুর। টোলস্য নিয়ম নাস্তি। কী বলেন? কামাখ্যাচরণ হাসেন।

অনঙ্গমোহন বলেন—যদি এমন হয় যে পাঁচজন ছাত্র হইল না তখন…

আরে মশাই, হইল না তো হইল না। খাতার মধ্যে হলেই হবে। খাতা ঠিক রাখবেন। অ্যাবসেন্ট প্রেজেন্ট রাখবেন। উপস্থিত আর অনুপস্থিত। ভাবটা এই, যে রোজ টোল বসে।

তাইলে, শাস্ত্রীমশয়, কবে নাগাদ আমার চতুষ্পাঠীতে আপনার পদধূলি পড়বে?

হবে খন। গত আট বছর কোনো টোল ইনস্পেকশন হয়নি। এখন গভর্মেন্টের টনক নড়েছে। তা আপনার অসুবিধা হবে না কিছু। পরিচিত লোক যখন…

সাদা চাদর পাতা খাটে পাশাপাশি শুয়েছিলেন কামাখ্যাচরণ আর অনঙ্গমোহন। শেফালিকা ফুল ফুটে আছে উঠানে। সুগন্ধ আসছে। ‘বোল রাধা বোল’ বাজছে বার বার ঐ বারোয়ারি পূজার মাইকে। রাত, তাই আওয়াজটা কমিয়েছে। কামাখ্যাচরণ বললেন, বুঝলা অনঙ্গভাই। আমি তো আছিই। সর্বক্ষণ আছি। তোমার কোনো অসুবিধা হইব না। আর একটা কথা। তোমারে পুরোহিত না কইরা তন্ত্রধার করায় তোমার মনে কোনো ক্ষোভ আছে নাকি? না না, ক্ষোভের কোনো কারণ নাই। তন্ত্রধারেরই তো বেশি সম্মান। তন্ত্রধার হইল গিয়া রেলের গার্ড, আর পুরোহিত তো ড্রাইভার। বুঝলা না? গার্ডই তো আসল। আর আমি তো তোমার পিছে আছিই।

অনঙ্গমোহন কোনো কথা বলেন না। শেফালির গন্ধ ও হিন্দি গান ভেসে আসে। অনঙ্গমোহন ভগ্নদেউলের মতো পড়ে আছেন।

কামাখ্যা, তুমি আর পুরোহিত না এখন। তুমি অধ্যাপক। তোমার চতুষ্পাঠী আছে। তাছাড়া তুমি সাধক। তুমি এক জাগ্রত দেবী কালীর উপাসনা কর। আমার স্ত্রীর ঐ মরণ, ঐ নিষ্ঠুর মরণ, তোমার কালীরে জীবন দিছে এই কি উপলব্ধি কর? এই বোধ তোমাকে কি পীড়া দেয়? তোমার পুরুষকার আহত হয়? আর তুমি বুঝি আমার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়া তোমার ঐ ক্ষতের মধ্যে পুলটিস মার।

কামাখ্যা আবার বলল—মানিক আর চাকরি-বাকরি পাইব না। খাইব কী? অরে কাম শিখাইতে চাই। আমিও দেখাইতে পারতাম। তোমারে ডাকলাম য্যান তুমিও কিছু পাও। তোমারে কম দিমু না কিছু। আধাআধি ভাগ কইরা দিমু।

ব্রাহ্ম মুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করলেন অনঙ্গমোহন। কাপড়ের থলেটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে অনঙ্গমোহন বললেন, আমি চললাম। এইসব পারুম না আমি। তখন উঠান জুড়ে শেফালিকা ফুল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *