চতুর চোর (অর্থাৎ প্রচুর পাহারার ভিতরেও চুরি করার রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
শ্রীযুক্ত বাবু****, আলিপুরস্থ পশু উদ্যানের বড়বাবু এবং এই দারোগার দপ্তরের একজন নিয়মিত পাঠক। তাঁহার বাড়ী সহরের ভিতর; কিন্তু সেই উদ্যানের সমস্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধানের ভার তাঁহার উপর; সুতরাং ঐ স্থান পরিত্যাগ করিলে, সরকারী কার্য্যের ক্ষতি হয় বলিয়া, স্ত্রী পুত্র লইয়া তাঁহাকে সেইস্থানেই থাকিতে হয়। গত বৎসর জ্যৈষ্ঠমাসের প্রথমেই একদিবস তিনি থানায় গিয়া সংবাদ প্রদান করেন যে, তাঁহার আফিসের আলমারির ভিতর হইতে প্রায় চারি সহস্র টাকা অপহৃত হইয়াছে।
প্রথমে এই সংবাদ আমার নিকট আইসে নাই বা আমি ইহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই নাই। পরে যখন আমি ইহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হই, তখন যেরূপ অবস্থা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, প্রথমে তাহাই পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি। পরিশেষে আমি নিজে যতদূর অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহাও পাঠকগণকে পরে নিবেদন করিব। অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, যে রাত্রিতে চুরি হয়, সেইদিবস বড়বাবু হাজার টাকার হিসাবে তিনখানি তিন হাজার টাকার নোট, কতকগুলি দশ বিশ টাকার নোট ও কিছু নগদ টাকা, মোট প্রায় চারি সহস্র টাকা একটি টিনের ক্যাশবাক্সের ভিতর রাখিয়া দেন। আফিসের কার্য্য সাঙ্গ হইয়া গেলে, উক্ত বাক্স আফিসের ভিতরস্থিত একটি আলমারির ভিতর বন্ধ করিয়া, আমারি ও বাক্সের চাবি সঙ্গে লইয়া, আপনার থাকিবার স্থানে গমন করেন। প্রাতঃকালে জনৈক দ্বারবানের মুখে অবগত হয়েন যে, তাঁহার আফিসের আলমারির চাবি ভগ্নাবস্থায় রহিয়াছে।
উক্ত সংবাদ পাইবামাত্র আর কালবিলম্ব না করিয়া বড়বাবু আফিসের ভিতর গমন করেন, ও দেখিতে পান যে, তাঁহার আলমারির তালা প্রকৃতই ভগ্নাবস্থায় রহিয়াছে, ও আমারির মধ্যস্থিত টাকার সহিত ক্যাশবাক্স নাই।
এই চুরির অবস্থা দেখিয়া তিনি নিতান্ত বিস্ময়ান্বিত হইলেন। কারণ, সেই আফিসের ভিতর একে প্রজ্বলিত গ্যাসের আলোকে সমস্ত রাত্রি আলোকিত থাকে, তাহাতে আবার প্রাগুক্ত আলমারির উপর, সমস্ত রাত্রি পুলিস—প্রহরীর পাহারা পড়ে। এরূপ প্রজ্বলিত গ্যাসালোকের মধ্যে ও পুলিস প্রহরীর পাহারার ভিতর কি প্রকার চোরে চুরি করিতে সমর্থ হইল, তাহা তিনি কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করেন।
সংবাদ পাইবামাত্র নিকটবর্ত্তী থানা হইতে পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ তৎক্ষণাৎ সদল বলে গিয়া উপস্থিত হন। ঘটনাস্থানের সমস্ত অবস্থা অবলোকন করিয়া, পরিশেষে তাঁহারা সকলেই, যে পুলিস-প্রহরীর উপর আলমারির পাহারার ভার ছিল, তাহার উপর সন্দেহ না করিয়া থাকিতে পারেন নাই। কারণ—যে আমারির উপর সে পাহারায় নিযুক্ত ছিল, প্রজ্বলিত গ্যাসালোকের উপর সেই আলমারি হইতে, সেই প্রহরীর অজ্ঞাতে এ চুরি অপর কাহারও কর্তৃক সম্পন্ন হওয়া একেবারেই সম্ভবে না। বিশেষতঃ সে যেরূপভাবে কথার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল, তাহাতে সকলেই বুঝিলেন যে, সেই রাত্রিকালে, সেই প্রহরী আপন কর্তব্য কর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক শয়ন করে নাই, বা নিদ্রিত হইয়া পড়ে নাই। এরূপ অবস্থায় তাহার উপর সন্দেহই বা না হইবে কেন? সুতরাং এ সম্বন্ধে তাহার উপরই সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল।
এখন অন্য অনুসন্ধান পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল সেই পাহারাওয়ালার বিপক্ষে অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। তাহার বাক্স, পেট্রা প্রভৃতির উত্তমরূপে খানা-তল্লাসি লওয়া হইল, কিন্তু অপহৃত দ্রব্যের কিছুই পাওয়া গেল না। তাহার পরিধেয় বস্ত্রাদি উত্তমরূপে পরীক্ষা করায়, কেবল এইমাত্র দেখা গেল যে, তাহার গামোছায় একরূপ দাগ রহিয়াছে। গামোছাদ্বারা আমারি কি অন্য কোন দ্রব্যের হাতল ধরিয়া বলপূর্ব্বক উহা ভাঙ্গিবার চেষ্টা করিলে, যেরূপ দাগ হওয়ার সম্ভাবনা, ইহাও সেই প্রকারের দাগ। এইরূপ নানাকারণে উক্ত পুলিস-প্রহরীর উপর বিশেষরূপ সন্দেহ হওয়ায়, তাহার বিপক্ষে নানা প্রকার অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। তাহার আত্মীয় বন্ধু বা দেশস্থ লোক যেখানে যেখানে ছিল, সেই সকল স্থানেও অনুসন্ধান হইতে বাকি থাকিল না। কিন্তু কোনস্থানেই অপহৃত দ্রব্যের কিছুই পাওয়া গেল না।
প্রথমে সকলেই মনে করিয়াছিলেন যে, এই চুরি সেই প্রহরীর দ্বারাই সম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু যখন তাহার নিকট হইতে অপহৃত দ্রব্যের কণামাত্রও বাহির হইল না, তখন ক্রমেই সকলের মনের গতি পরিবর্তিত হইল। তখন সকলেই ভাবিলেন যে, সেই বাগানের দ্বারবানেরই এই কার্য্য। প্রহরী তাহার পাহারার সময় নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিল, দ্বারবান সেই সময়ে সুযোগ পাইয়া, এই দুঃসাহসিক কাৰ্য্য সমাপন করিয়াছে। প্রহরী এই চুরি মোকদ্দমায় যে লিপ্ত আছে, সে সন্দেহ যদিও অনেকের মন হইতে অন্তর্হিত হইল সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া সেই প্রহরী যে একেবারে নিষ্কৃতিলাভ করিল, তাহা নহে। কর্তব্য কর্ম্মের ত্রুটী করা অপরাধে সে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে প্রেরিত হইল। মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহাকে কঠিন পরিশ্রমের সহিত তিন মাসের নিমিত্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করিলেন।
পুলিস-প্রহরী কারাগারে প্রেরিত হইলে, দ্বারবানকে লইয়াই এই অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। দ্বারবানের উপর পূর্ব্ব হইতেই কাহারও সন্দেহ তত না থাকিলেও, এক্ষণে নিম্নলিখিত কয়েকটি কারণেই ক্রমে সকলেরই সন্দেহ জন্মিতে লাগিল।
১ম। সেই রাত্রিতে এই দ্বারবান্ যে স্থানে শয়ন করিয়াছিল, সেইস্থানে সে পূৰ্ব্বে কখনও শয়ন করে নাই, বা সেইস্থানে, সেই রাত্রিতে তাহার শয়ন করিবার সন্তোষজনক কারণ প্রদর্শন করিতে সে সমর্থ হইল না।
২য়। বিনাকারণে সে সেইদিবস সৰ্ব্বাগ্রে আফিসের ভিতর গমন করে। সেই সময়ে তাহার আফিসের ভিতর গমন করিবার কোন কারণ দেখিতে পাওয়া যায় না।
৩য়। তাহা কর্তৃকই এই চুরির অবস্থা প্রথমে দৃষ্ট হয় ও সেই প্রথমে দ্রুতপদে গমন করিয়া বড়বাবুকে সংবাদ দেয়।
৪র্থ। পুলিস এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলে, পুলিসকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত সে-ই বিনা-আহ্বানে অগ্রসর হয়, এবং তাহা কর্তৃকই পূর্ব্বোক্ত প্রহরীর গামোছায় দাগ বাহির হয়।
৫ম। অনেক দিবস হইতে সে এইস্থানে কর্ম্ম করিতেছে। বেতন কিন্তু এখন দশ টাকা অতিক্রম করে নাই। সে যেরূপভাবে দিনপাত করে, দশ টাকার উপর নির্ভর করিয়া কেহই তাহার মত খরচ-পত্র করিতে সমর্থ হয় না। উক্ত দশ টাকাতেই চারি পাঁচজন পরিবারের প্রতিপালন করিয়া মধ্যে মধ্যে ৫০।৬০ টাকা করিয়া দেশে পাঠান, কাহারও পক্ষেই সম্ভবপর নহে; বিশেষতঃ সে গরিব চাল-চলনে চলিতে জানে না:—গরিবের মত আহার-বিহার করিতে, পোষাক পরিচ্ছদ ধারণ করিতে তাহাকে কেহই কখনও দেখেও নাই।
এইরূপ সামান্য সামান্য কয়েকটি কারণে তাহার উপর ক্রমে সবিশেষ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। সম্প্রতি সে কোনরূপে অধিক অর্থব্যয় করিয়াছে কি না? কোন সুযোগে তাহার দেশে সে কোন চোরাদ্রব্য প্রেরণ করিয়াছে কি না?—এই বিষয়েই অতঃপর সবিশেষরূপ অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। কিন্তু সে সম্বন্ধে কোন কথাই সেই সময়ে বাহির হইল না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
যে সময়ে এই চুরি হয়, সেই সময়ে অপর কোন কার্য্য উপলক্ষে আমি স্থানান্তরে ছিলাম। এই ঘটনার প্রায় এক মাস পরে আমি কলিকাতায় প্রত্যাগমন করি। কলিকাতায় প্রত্যাগমনের প্রায় দুই তিনদিবস পরেই, জানি না—কি কারণে পূর্ব্বকথিত অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে পতিত হইল। আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর সহিত বড়বাবুর বিশেষ পরিচয় আছে, তাহা কিন্তু আমি অবগত ছিলাম। কিন্তু একথা আমি বলিতে পারি না যে, বড়বাবুর অনুরোধ অনুসারে আমি এই কার্য্যে আমার সাহেব কর্তৃক নিয়োজিত হইয়াছিলাম, কি না। যাহা হউক, এতদিবসের পর আমাকে এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতে হইল।
আমি সেই বাগানের ভিতর একেবারে প্রবেশ না করিয়া, পূর্ব্ব অনুসন্ধানকারী পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণের নিকট হইতে বর্তমান মোকদ্দমার অবস্থা যতদূর পারিলাম, জানিয়া লইলাম। আমি উক্ত বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলাম না; –কারণ আমার ইচ্ছা ছিল যে, সেই বাগানের ভিতর যে সকল লোক বাস করে, তাহাদের কাহারও নিকট আমি পরিচিত হইব না।
আমার ইচ্ছানুযায়ী কার্য্যও সেইরূপ হইল। এমন কি এখন পর্যন্তও কথিত উদ্যানের প্রধান কয়েকজন কর্ম্মচারি ব্যতীত আমি অপর কাহারও নিকট পরিচিত নহি।
যাহা হউক, এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইয়া কোন্ পন্থা অবলম্বন করিব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। কারণ, ক্রমাগত একমাস ধরিয়া, বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ পুলিস-কৰ্ম্মচারীদিগের দ্বারা যে মোকদ্দমার অনুসন্ধান করান হইয়াছে, তাহার ভিতর এরূপ কোন সূত্রই পরিত্যক্ত হয় নাই যে, আমি সেই সূত্র অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হই।
কোন্ পন্থা অবলম্বন করিলে, কোন প্রকারে এই মোকদ্দমার সূত্র ধরিতে পারিব, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে আরও দুই একদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। কিন্তু কোন প্রকারে আশাপ্রদ কোনরূপ উপায় স্থির করিতে না পারিয়া, কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিবার পর একটি সামান্য পথ অবলম্বন করিয়া চলিতে লাগিলাম।
যে সময়ে চুরি হইয়াছিল, সেই সময়ে উক্ত বাগানে যে সকল চাকর ছিল, তাহার একটি তালিকা প্রস্তুত করাইলাম। গুপ্তভাবে সেই তালিকার সহিত এখন মিলাইয়া দেখিতে লাগিলাম যে, সেই সকল চাকর এখনও সেইস্থানে চাকরী করিতেছে কি না। জানিলাম, এখনও সকলে সেইস্থানে কৰ্ম্মে নিযুক্ত আছে, কেবল গোকুল নামক এক ব্যক্তি সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে। উক্ত বাগানে গোকুল একটি অস্থায়ী চাকরী পাইয়া, কেবল তিন মাসমাত্র কৰ্ম্ম করে; এক ব্যক্তি ছুটি লইয়া দেশে গমন করায়, সেই ব্যক্তির কার্য্যে গোকুল নিযুক্ত হইয়াছিল। দশ পনরদিবস হইল, সে ছুটি হইতে ফিরিয়া আসিয়া আপন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে; সুতরাং গোকুলের কর্ম্ম ফুরাইয়া গিয়াছে। গোকুল এখন কোথায়, তাহা আমাদিগের জানা আবশ্যক বলিয়া বিবেচনা করিয়া, তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। দুই দিবস অনুসন্ধানের পর আমি জানিতে পারিলাম যে, সে এখন পাগ্লা হাসপাতালে আর একটি অস্থায়ী কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছে।
রবিবার পাগলা হাসপাতালে গমন করিতে কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। সেইদিবস পাগলগণের আত্মীয়স্বজন আসিয়া তাহাদিগের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করে। সুযোগ বুঝিয়া আমিও সেইদিবস উক্ত পাগ্লা হাসপাতালের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং অনুসন্ধান করিয়া গোকুলকে দেখিতে পাইলাম। তাহাকে দেখিয়া এবং তাহার সহিত বাক্যালাপ করিয়া আমার মনে বিশ্বাস হইল যে, সে বেশ চালাক ও চতুর লোক। তাহার সাহায্য গ্রহণ করিতে পারিলে, বোধ হয়, আমার উদ্দেশ্যের কতক অংশ সিদ্ধ হইলেও হইতে পারে।
বাগানের বড়বাবুর সহিত পাগলা হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সবিশেষ বন্ধুত্ব আছে, জানিতে পারিলাম। আরও জানিলাম,—ডাক্তারবাবু কিরূপ চরিত্রের লোক, বিনাস্বার্থে তিনি অপর কাহারও অনুরোধ রক্ষা করেন কি না। এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমি পূৰ্ব্বকথিত বড়বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, এবং আমার মনে যে অভিসন্ধি ছিল, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। বড়বাবু আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; ও আমাকে সঙ্গে লইয়া, ডাক্তারবাবুর নিকট গমন পূর্ব্বক তাঁহার সহিত আমার পরিচয় করিয়া দিলেন। ডাক্তারবাবুটি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আমি তাঁহার নিকট যে প্রস্তাব করিলাম, তিনি তাহাতে সম্মত হইলেন ও গোকুলকে ডাকিয়া কহিলেন, “গোকুল! তুমি যখন আলিপুরের উদ্যানে কর্ম্ম করিতে, সেই সময় সেইস্থানে যে চুরি হয়, তাহা তুমি নিশ্চয়ই শুনিয়াছ। তুমি সেইস্থানের সকল লোককে চেন। এখন যদি তুমি সেই চুরির কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া দিতে পার, তাহা হইলে তুমি এখন এখানে যে কৰ্ম্মে নিযুক্ত আছ, সেই কৰ্ম্মে আমি তোমাকে পাকা করিব। তদ্ব্যতীত সরকার হইতে যাহাতে তুমি বিশিষ্টরূপ পারিতোষিক প্রাপ্ত হও, তাহারও চেষ্টা করিব।”
ডাক্তারবাবুর কথা শুনিয়া গোকুল কহিল, “যখন আপনি আমাকে আদেশ করিতেছেন, তখন আমি বিশিষ্টরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিব, ও যদি কিছু অবগত হইতে পারি, তখনই তাহা আপনাকে কহিব।”
গোকুলের কথায় আমরা সবিশেষরূপ সন্তুষ্ট হইলাম। গোকুল সেইস্থান পরিত্যাগ করিল, আমিও সেইদিবস আপনার স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম।
দুইদিবস পরে আমি গোকুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। আমাকে দেখিবামাত্র গোকুল কহিল, “মহাশয়! বোধ হইতেছে, আমি আপনার কার্য্যের কিছু সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিব। যে সকল লোকের উপর সন্দেহ করিয়া আপনারা এত দিবস অনুসন্ধান করিয়া আসিতেছেন, একার্য্য তাহাদিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই। বাহিরের দুইজন লোক আসিয়া এই কাৰ্য্য শেষ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। বাগানে যে সকল লোক কৰ্ম্ম করে, তাহার মধ্যে পশ্চিম দেশবাসী একজন গোয়ালা আছে। যে দুই ব্যক্তি আগমন করিয়াছিল, তাহারা আসিয়া সেই গোয়ালার নিকটেই অবস্থান করে, ও আপন কার্য্য শেষ করিয়া, পরিশেষে সেই উদ্যান পরিত্যাগ করে।”
গোকুলের কথা শুনিয়া, আমার হৃদয়ে কতক আশার সঞ্চার হইল। ভাবিলাম, গোকুল যে সংবাদ প্রদান করিতেছে তাহা অসম্ভব নহে। কারণ, আমি নিজে বিশেষরূপে অবগত আছি, লৌহবর্ম্ম নির্মাণের পর হইতেই দূরদেশ হইতে অনেক চোর এইরূপে চুরি করিয়া প্রথমে সহর পরিত্যাগ করে; কিন্তু পরিশেষে অনেকেই ধৃত হইতেও প্রায় বাকি থাকে না। যাহা হউক, গোকুল কিরূপে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইল, তাহা জানিতে পারিলেই অনেকটা বুঝিতে পারিব গোকুলের সংবাদ ঠিক কি না। এই ভাবিয়া গোকুলকে কহিলাম, “গোকুল! তুমি আমাকে যে সকল কথা বলিলে, তাহা আমি শ্রবণ করিলাম, এবং বুঝিলাম যে, বাহিরের দুইজন লোক আসিয়া এই চুরি করিয়াছে। কিন্তু এই সংবাদ তুমি কিরূপে, এবং কাহার নিকট হইতে অবগত হইলে, তাহা জানিতে ইচ্ছা করি।”
আমার কথা শুনিয়া, গোকুল কহিল, “আমি যাহার নিকট হইতে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছি, আমার বিশ্বাস—সে আমার নিকট মিথ্যা কথা কহে নাই। চোর দুই ব্যক্তিকর্তৃক বিশেষরূপে বঞ্চিত হইয়াই, মনের দুঃখে সে তাহার মনের কথা আমার নিকট বলিয়াছে। এই ব্যক্তি সেই বাগানের ফরাস। আফিস প্রভৃতি পরিষ্কার করা ইহার কার্য্য।
আফিসের ভিতর কোনস্থানে টাকা পয়সা থাকে, তাহা সে বিশেষরূপ অবগত আছে। যে দুই ব্যক্তি কর্তৃক এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহারা প্রথমে এই ফরাসকে হস্তগত করে, ও ইহার নিকট হইতে সন্ধানাদি সংগ্রহ করিয়া রাত্রিকালে যখন প্রহরী পাহারার সময় সেইস্থানে নিদ্রিত হইয়া পড়ে, সেই সময়ে নিজ উদ্দেশ্য সাধন পূৰ্ব্বক প্রস্থান করে। কার্য্য সাঙ্গ হইলে উহাকে কপদকমাত্রও প্রদান না করিয়া প্রস্থান করিয়াছে বলিয়াই, সে উহাদিগের উপর বিরক্ত হইয়াছে, ও তাহার মনের কপাট আমার নিকট খুলিয়া দিয়াছে।”
“এই ফরাস যখন উহাদিগের উপর এতদূর অসন্তুষ্ট হইয়াছে, তখন বোধ হয়, সে আমার নিকট আসিয়াও সমস্ত কথা বলিতে পারে?”
“না মহাশয়! সে তাহা বলিবে না। তাহার মনে কি ভয় নাই? সে বেশ জানে—একথা প্রকাশ হইয়া পড়িলে তাহারও সমূহ বিপদ উপস্থিত হইবে।”
“সেই দুই ব্যক্তির নাম তুমি অবগত হইতে পারিয়াছ?”
“একজনের নাম আমি জানিতে পারিয়াছি। তাহার নাম আজায়েব গোয়ালা, বাসস্থান বিরনু থানার এলাকাস্থিত একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। বিরনু থানা গাজিপুর জেলার মধ্যস্থিত। অপরের নাম আমি অবগত নহি, অথচ জানিবারও কোন উপায় নাই। যাহার নিকট আসিয়া উহারা অবস্থান করিয়া ছিল, সেই গোয়ালা জানিতে পারে; কিন্তু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে যে উহার নাম বলিয়া দিবে, তাহা আমার বোধ হয় না; বরং উহাদিগকে সংবাদ দিয়া সতর্ক করিয়া দিবারই সম্ভাবনা।”
গোকুলের কথা সবিশেষ যুক্তি-সঙ্গত বিবেচনা করিয়া সেই গোয়ালাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করা অকর্ত্তব্যই স্থির করিলাম। ফরাস যখন আমার নিকট কোন কথা বলিবে না, তখন আমি কি প্রকারে বিশ্বাস করিতে পারি যে, গোকুলই প্রকৃত কথা কহিতেছে? এরূপ অবস্থায় কি প্রকারে অবগত হইতে পারিব যে, গোকুলের সমস্ত কথাই প্রকৃত? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া, গোকুল আমার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছে, তাহা প্রকৃত কি না, ইহা জানিয়া লইবার এক উপায় মনে মনে স্থির করিয়া, সেদিবস সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সেইদিবস বড়বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। গোকুলের কথা প্রকৃত কি না জানিয়া লইবার নিমিত্ত, যে উপায় আমি মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম, তাহা তাঁহার নিকট কহিলাম। দেখিলাম, তিনিও আমার মতে মত দিলেন।
পরদিবস প্রাতঃকালে বড়বাবুর সহিত পুনরায় আমি পাগ্লা হাসপাতালের ভিতর গমন করিলাম। সেইস্থানে ডাক্তারবাবুর সহিত দেখা হইল। আমরা উভয়ে ডাক্তারবাবুর গৃহের ভিতর গিয়া উপবেশন করিলাম ও আমাদিগের অভিপ্রায় তাঁহাকে কহিলাম। প্রথমে তিনি আমাদিগের প্রস্তাবে অসম্মত হইয়াও অনেক অনুরোধের পর, সম্মত হইলেন। অতঃপর বড়বাবু আমাদিগকে সেইস্থানে ছাড়িয়া নিজ স্থানে গমন করিলেন। তাঁহার সহিত এইরূপ বন্দোবস্ত হইল, তিনি সেই স্থান হইতে একখানি পত্র লিখিয়া শীঘ্র পাগ্লা হাসপাতালে ডাক্তারবাবুর নিকট পাঠাইয়া দিবেন। আলিপুর উদ্যানের সেই ফরাস উক্ত পত্র লইয়া আসিবে।
এদিকে গোকুলকে ডাকিয়া আমাদিগের মনের কথা তাহাকে কহিলাম। সে আমাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, আফিসের বাহিরে দক্ষিণদিকের বারান্দায় বসিয়া একখানি ছিন্ন বস্ত্র সেলাই করিতে আরম্ভ করিল।
সেই সময়ে আমি যে কি করিলাম, তাহাও পাঠকগণকে বলিয়া দেওয়া উচিত। আমি আমার ধুতি, পিরাণ, জুতা প্রভৃতি সমস্তই একে একে খুলিয়া ফেলিলাম। যে প্রকার জাঙ্গিয়া পাগলেরা পরিধান করে, ধুতি চাদরের পরিবর্তে তাহাই পরিলাম। কামিজের পরিবর্তে, পাগলগণের নিমিত্ত প্রস্তুত সবুজ ডোরাসংযুক্ত মোটা কাপড়ের পিরাণের দ্বারা অঙ্গ আবৃত করিলাম। হাতে ও পায়ে লোহার বালা পরিলাম, মস্তকোপরিও একটি পাগলের টুপি পরিলাম। এক কথায় সেই পাগলা হাসপাতালের ভিতর পাগল সকল যেরূপ পরিচ্ছদ পরিধান করে, আমিও সেইরূপ পরিচ্ছদ ধারণ করিয়া একটি বিলক্ষণ পাগল সাজিয়া বসিলাম। আমার কলেবর একটু স্থূল হইলেও, পাগল সাজিতে আমার সবিশেষ কোনরূপ প্রতিবন্ধক ঘটিল না। কারণ দেখিলাম, আমা অপেক্ষাও অনেক স্থূল—কলেবর পাগল, সেই পাগলা হাসপাতালের ভিতর ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে।
ডাক্তারবাবু আমার পাগলের বেশ দেখিয়া একটু হাসিলেন, ও কহিলেন, “আপনাকে দেখিয়া পাগল বলিয়া এখন আর কে না বিশ্বাস করিবে?”
পাগল সাজিয়া আমি আফিসের বাহিরে গেলাম। আমার বস্ত্রাদি সমস্তই আফিসের ভিতর রহিল। আমি হাসিতে হাসিতে আফিসের দক্ষিণদিকের সেই বারান্দায় গিয়া গোকুলের কিছুদূরে উপবেশন করিলাম ও আফিসের টানাপাখা সংলগ্ন দড়ি ধরিয়া আস্তে আস্তে সেই পাখা টানিতে লাগিলাম।
আমি সেই পাখা টানিতে টানিতে, কখন হাসিতে লাগিলাম, কখন কাঁদিতে লাগিলাম, কখন বকিতে লাগিলাম, কখনও বা কোন অনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উপলক্ষ করিয়া গালি দিতে লাগিলাম, এবং কখন যে আপন মনে অস্পষ্টভাবে যাহা ইচ্ছা, তাহা বলিতে লাগিলাম। এক কথায় আমার আকার ইঙ্গিত হাব ভাব সমস্ত দেখিয়া কেহই সাজা পাগল বলিয়া আমাকে ধরিতে পারিল না; যে দেখিল, সেই আমাকে অন্যান্য পাগলের মধ্যে গণ্য করিল।
এমন সময় পূর্ব্বোক্ত ফরাস একখানি পত্রহস্তে আফিসের ভিতর প্রবেশ করিল। ডাক্তারবাবু সেইপত্র লইয়া খুলিয়া ফেলিলেন, এবং সেই ফরাসকে কহিলেন, “তুমি ঐ বারান্দায় গিয়া ব’স। একটু পরে আমি ইহার উত্তর লিখিয়া দিতেছি।”
ফরাস বারান্দায় আসিয়া সম্মুখেই গোকুলকে দেখিতে পাইল। গোকুল উহাকে ডাকিয়া যে চটের উপর কাপড় সেলাই করিতেছিল সেই চটের কতক অংশ উহাকে বসিবার নিমিত্ত প্রদান করিল; ফরাস সেইস্থানে উপবেশন করিল। একথা ওকথা নানাকথার পর, ক্রমে গোকুল উহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সেই কার্য্য করার পর তাহারা কয়দিবস এখানে ছিল?”
গোকুলের এই কথা শুনিয়া সে আমার দিকে কটাক্ষ করিয়া গোকুলকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কে?”
গোকুল। ও একটা পাগল! দেখ না, কখনও হাচে, কখনও বক্চে, আর বসে বসে পাখা টানছে।
ফরাস। চুরি করিয়া উহারা দুইদিবস কলিকাতায় ছিল, কিন্তু আমাদের বাগানের ভিতর ছিল না। পরে আমাকে ফাঁকি দিয়া চলিয়া গিয়াছে।
গোকুল। তোমাকে কি কিছুই দেয় নাই?
ফরাস। একটি পয়সামাত্রও না। আমি তাহাদের জন্য এত করিলাম, আর তাহারা আমাকে একেবারে ফাঁকি দিয়া চলিয়া গেল!
গোকুল। উহারা যেরূপ কার্য্য করিয়াছে, তাহাতে উহাদিগকে ধরাইয়া দিলে হয় না?
ফরাস। ধরাইয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু ধরাই বা কি প্রকারে? একে ত ফাকি পড়িয়াছি, তাহাতে আবার ধরাইতে গিয়া শেষে জেলে বা যাই!
গোকুল। তাই ত, তা’ হলে উহাদিগকে ধরানই বা কি প্রকারে হ’তে পারে? তোমাকে কিছু না দিয়া গিয়াছে সত্য; কিন্তু তোমার কপাল ত আর লইয়া যাইতে পারে নাই। পরমেশ্বর তোমার কপালে যদি লোকসান লিখে থাকেন, তা’ হ’লে কে উহার খণ্ডন করিবে? আর যদি তোমার অদৃষ্টে লাভ থাকে, তাহা হইলে ঘুরিয়া ফিরিয়া তোমার অংশ আসিবেই আসিবে।
ফরাস। হাঁ ভাই; আমার অদৃষ্টে থাকে, আমি কোন না কোন প্রকারে পাইব। না পাই, পরমেশ্বরই ইহার বিচার করিবেন; কোনরূপে না কোনরূপে তিনিই উহাদিগকে ধরাইয়া দিবেন।
গোকুল। তা’ ত বটেই; কিন্তু ভাই! উহারা চুরি করিল কি প্রকারে? যে আমারির ভিতর টাকা ছিল, সেইস্থানে পুলিসের পাহারাও ত ছিল; কিন্তু সেই পাহারার ভিতর কিরূপে পুলিসের চক্ষে ধুলি প্রদান করিল?
ফরাস। পাহারা ত নামে, কিন্তু কাজে কিছুই নয়। প্রহরী যদি নিয়মিতরূপে পাহারা দিত, তাহা হইলে কি এই চুরি হইতে পারিত? আমি ত কখন প্রহরীকে সজাগ দেখি নাই। যখনই সেইস্থানে গিয়াছি, তখনই তাহাকে নিদ্রিত দেখিয়াছি। যে প্রহরী রাত্রিকালে শয়ন করিয়া নিদ্রা যায়, তাহার পাহারায় চুরি করিতে কিসের ভয়?
এই কয়েকটি কথার পর অন্য কথা পড়িল; সুতরাং আমাদিগের আবশ্যক কথা বন্ধ হইয়া গেল। যে কার্য্যের নিমিত্ত আজ আমাকে পাগল না হইয়াও পাগলের বেশ করিতে হইয়াছে, সে কার্য্য সমাহিত হইল। বুঝিলাম, গোকুল যাহা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই সত্য, বিন্দুমাত্রও মিথ্যা নহে।
ডাক্তারবাবু তখন ফরাসকে ডাকিয়া তাহার আনীত পত্রের উত্তর উহার হস্তে প্রদান করিলেন। ফরাস সেই পত্রহস্তে সেই উন্মাদ-মণ্ডলীর মধ্য হইতে বহির্গত হইয়া গেল।
আমিও পাখার দড়ি পরিত্যাগ পূর্ব্বক আফিসের ভিতর প্রবেশ করিয়া আমার বেশ পরিবর্তন করিলাম। পাগলের পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিয়া নিজের বস্ত্র পরিধান-পূর্ব্বক সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। গোকুলও কাপড়সেলাই পরিত্যাগ করিয়া আপন কার্য্যে গমন করিল।
যে দুই ব্যক্তি আলিপুরের বাগান হইতে বড়বাবুর নোট প্রভৃতি অপহরণ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহাদিগের একজনের নাম পূর্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছিলাম; উহার নাম আজায়েব গোয়ালা, বাসস্থান গাজিপুর জেলার মধ্যস্থিত বিরনু থানার এলাকাধীন একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। অপর ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা কিছুই মিলিল না।
সেই সময়ে একবার ভাবিলাম, গাজিপুরে গমন করিয়া আজায়েবের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল—সেই ব্যক্তি দেশে যে গমন করিয়াছে, তাহারই বা স্থিরতা কি? আর যদি সে নিজের দেশেই গমন করিয়া থাকে, ও আমি সেইস্থানে গমন করিয়া যদি তাহাকে দেখিতে পাই, তাহা হইলেও বা কোন্ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া তাহাকে ধৃত করিতে সমর্থ হইব? তাহার গৃহ প্রভৃতি অনুসন্ধান করিয়া যদি কোন চোরাদ্রব্য প্রাপ্ত না হই, তাহা হইলে তাহাকে তখনই মুক্তি প্রদান করিতে হইবে। অপর ব্যক্তি সেই সুযোগে অপহৃত সমস্ত দ্রব্য লইয়া প্রস্থান করিবে। আজায়েব ও অপর এক ব্যক্তির দ্বারা যে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা দর্পণে প্রতিবিম্বের মত স্পষ্টই দেখিতে পাইতেছি; কিন্তু, ধরিবার সাধ্য নাই। আদালতে আজায়েবের বিপক্ষে এই মোকদ্দমা দাঁড়াইবে না। গোকুল নিজচক্ষে কোন বিষয়ই দর্শন করে নাই; সুতরাং তাহার সাক্ষ্য আইনানুযায়ী গ্রহণ করা যাইতে পারে না। ফরাসও প্রকাশ্যে কোন কথা বলিবে না। এরূপ অবস্থায় কি করার প্রয়োজন, তাহাই ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিতে লাগিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বড়বাবুর বাক্স হইতে যে সকল নোট অপহৃত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে হাজার টাকার নোট কয়েকখানির নম্বর তাঁহার নিকট ছিল। তাঁহার নিকট হইতে সেই নম্বর গ্রহণপূর্ব্বক প্রথম অনুসন্ধানকারী পুলিস-কৰ্ম্মচারী করেসী আফিসে সংবাদ প্রদান করিয়া রাখিয়াছিলেন।
এই অনুসন্ধানের নিমিত্ত গাজিপুরে গমন করা উচিত কি না, যে দিবস এই বিষয় মনে মনে ভাবিতেছিলাম, সেই দিবস অপরাহ্ণ তিনটার সময় করেনসী আফিস হইতে সংবাদ আসিল যে, কথিত অপহৃত নোটগুলির মধ্যে একখানি নোট বেঙ্গল ব্যাঙ্ক, করেসী আফিসে প্রদানপূর্ব্বক তাহার বিনিময়ে সহস্রমুদ্রা লইয়া গিয়াছে। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না। গাজিপুর গমনের চিন্তা পরিত্যাগ পূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ বেঙ্গল ব্যাঙ্কে গিয়া উপনীত হইলাম। সেইস্থানের কাগজপত্র দৃষ্টি করিয়া অবগত হইতে পারিলাম যে, কথিত নোট, ডি সাসন কোম্পানির নিকট হইতে ব্যাঙ্ক প্রাপ্ত হইয়াছে।
ডিঃ সাসন কোম্পানির আফিসে তৎক্ষণাৎ গমন করিলাম। সেইস্থানে অবগত হইতে পারিলাম যে, তাঁহারা উক্ত নোট বড়বাজারের মহাজন ওমরাও সিং কাল্কাপ্রসাদের নিকট হইতে পাইয়াছেন।
ওমরাও সিং কাল্কাপ্রসাদ নামে সোণাপটীতে একটি ফারম আছে। সেইস্থানে গমন করিয়া অবগত হইতে পারিলাম যে, তাঁহারা উক্ত নোট প্রাপ্ত হইয়াছেন—গেয়ানিরাম গিরিধারীরামের নিকট হইতে।
গেয়ানিরাম গিরিধারীরাম তুলাপটীর একজন মহাজন। তাঁহার নিকট গমন করিবামাত্র খাতাপত্র দেখিয়া তিনি কহিলেন যে, উক্ত নোট তাঁহারা কালুরায় হীরালালের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন।
কালুরায় হীরালালেরও কারবারস্থল তুলাপটীতে। ঐস্থানে গমন করিলে তাঁহারা কহিলেন যে, উক্ত স্থানে তাঁহারা কানুরাম গঙ্গাবক্সের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন। আরও কহিলেন যে, কানুরাম গঙ্গাবক্সের কারবার-স্থল আজিম গড়ের বাজারে। সেইস্থানে উহারা সবিশেষ পরিচিত।
এই পৰ্য্যও অনুসন্ধান করিয়াই কলিকাতার অনুসন্ধান সাঙ্গ হইল। এখন আজিমগড়ে গিয়া অনুসন্ধান করা আবশ্যক হইয়া পড়িল। আজিমগড় ও গাজিপুর উভয় জেলাই পরস্পর সংলগ্ন। এইরূপস্থানে গাজিপুর হইতে অনায়াসেই আজিমগড়ে গিয়া, আজায়েব বা তাহার সহচর যে কথিত নোট ভাঙ্গাইতে না পারে, তাহা নহে। বিশেষতঃ উক্ত নোটক্রমে যদি অপরাধীদিগের কাহারও নিকট হইতে কোন ব্যক্তি প্রাপ্ত হইয়াছে, এরূপ জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া উহাদিগকে অনায়াসেই ধৃত করিতে সমর্থ হইব। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া সেইস্থানে গমন করিয়া অনুসন্ধান করাই কর্তব্য, ইহাই মনে মনে স্থির করিয়া লইলাম, ও সেই দিবসেই মেলগাড়িতে সহর পরিত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়া বিদেশ গমনোপযোগী দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করিতে লাগিলাম।
একটিমাত্র “আরদালি” সমভিব্যাহারে রাত্রি নয়টার সময় মেলট্রেণে কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। সময়মত গাড়ি দিলদার নগরে গিয়া উপস্থিত হইল। সেইস্থানে সেই গাড়ি পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাড়িঘাট ব্রাঞ্চের গাড়ীতে গিয়া আরোহণ করিলাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি তাড়িঘাটে পৌঁছিল। আমরা সেইস্থানে অবতরণ করিয়া ভাগীরথী—তীরে অবতরণ করিলাম। সেইস্থানে একখানি ছোট ষ্টীমার প্রস্তুত রহিয়াছে। তাহাতে আরোহণ করিয়া ভাগীরথীর অপর পারে উত্তীর্ণ হইলাম। যে স্থানে আমরা উপস্থিত হইলাম, উহাই গাজিপুর সহর। সেইস্থানের কোতয়ালিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে একখানি এক্কা আরোহণ করিয়া গাজিপুর হইতে বহির্গত হইলাম। এক্কা আজিমগড়—অভিমুখে চলিল। গাজিপুর হইতে আজিমগড় ৪৪ মাইলের কম নহে। আমাদিগের এক্কায় যে ঘোটক যোজিত হইয়াছিল, তাহা নিতান্ত শীর্ণ ও ক্ষুদ্র হইলেও, সন্ধ্যার সময়েই সে আমাদিগকে আজিমগড়ের কোতয়ালিতে পৌঁছিয়া দিল। স্নান ও আহার-বিনা সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। রাত্রিকালে কোতয়ালিতেই বিশ্রাম করিলাম। পরদিবস প্রাতঃকালে কানুরাম গঙ্গাবক্সের সন্ধান করিলাম, কোতয়ালির সন্নিকটেই উহার কাপড়ের দোকান আছে; সুতরাং তাহাকে পাইতে কোন কষ্টই হইল না। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, সে নোটের কথা স্বীকার করিল, এবং কহিল যে, উক্ত নোট সে সেইস্থানের অপর আর একজন দোকানদার প্রয়াগদাস গোপীকিষণের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। প্রয়াগদাস গোপীকিষণের কারবার-স্থলও সেইস্থানে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সেও উক্ত নোটের কথা স্বীকার করিল, এবং খাতা দেখিয়া বলিয়া দিল যে, সে সেই নোট শিশুপাল গোয়ালার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে।
শিশুপালের বাসস্থান মহম্মদাবাদ থানার এলাকাস্থিত জগরীগ্রামে, ও আজিমগড় হইতে প্রায় ২২ মাইলের ব্যবধানে।
যখন এই সংবাদ অবগত হইলাম, তখন দিবা কেবলমাত্র আটা। সুতরাং আর কালবিলম্ব না করিয়া, তখনই একখানি এক্কা আনাইয়া জগরী যাইবার অভিপ্রায়ে আজিমগড় সহর পরিত্যাগ করিলাম।
এই প্রদেশে যাতায়াতের নিমিত্ত গাড়ি ঘোড়া প্রভৃতি কিছুই পাওয়া যায় না। ভরসার মধ্যে কেবল এক্কা। জগরী গমন করিবার নিমিত্ত আমরা যে এক্কা ভাড়া করিলাম তাহার ঘোড়া আমাদিগকে লইয়া দ্রুতপদে প্রায় দুই তিন মাইল পথ গমন করিল। ভাবিলাম, এই ঘোড়া যেমন দ্রুতগামী, তাহাতে অতি শীঘ্রই সে আমাদিগকে জগরী গ্রামে পৌঁছিয়া দিবে। কিন্তু কার্য্যে দেখিলাম, পরিশেষে আমাদিগের আশার বিপরীত ফল ফলিতে লাগিল। গমন করিতে করিতে সেই ঘোড়া ক্রমে তাহার স্বভাবের পরিচয় দিতে আরম্ভ করিল। প্রথম প্রথম পথ ছাড়িয়া এদিক ওদিক গমন করিতে প্রবৃত্ত হইল, পরিশেষে লম্ফ ঝম্প আরম্ভ করিল তাহার সেইরূপ ভাবগতি দেখিয়া, আমরা এক্কা হইতে অবতরণ করিলাম। কিছুদূর পদব্রজে চলিলাম, ঘোড়াও স্থিরভাবে খালি এক্কা লইয়া যাইতে লাগিল। যখন দেখিলাম ঘোটকরাজ বেশ শান্তমূর্তি ধারণ করিয়াছে, তখন পুনরায় আমরা সেই এক্কাতে আরোহণ করিলাম।
আমরা পুনরায় যেমন উহাতে আরোহণ করিলাম, অমনি দেখিলাম,—উক্ত ঘোটক পুনরায় দুষ্টামি আরম্ভ করিয়া আমাদিগকে লাথি মারিতে প্রবৃত্ত হইল। পুনরায় আমরা নামিলাম, পুনরায় ঘোটক শান্তমূর্তি ধারণ করিল। আমরা আবার যেমন উঠিলাম, ঘোটকের অবস্থাও আবার পূর্ব্ববৎ হইল। সুতরাং সেই এক্কায় আমরা আর না উঠিয়া পদব্রজেই চলিতে লাগিলাম। অন্য এক্কা যদি পাওয়া যায়, তাহা হইলে ইহাকে ছাড়িয়া দিতে পারি, এই ভাবিয়া নিকটবর্তী স্থানে, এবং সেই পথের উপর অন্য এক্কার চেষ্টা করিলাম; কিন্তু আমাদিগের দূরদৃষ্ট-বশতঃ অন্য একখানি এক্কাও আমাদিগের নয়নগোচর হইল না। অনন্যোপায় হইয়া অগত্যা আমাদিগকে চলিতে হইল। আমাদিগের শয্যাদি এবং পরিধেয় বস্ত্রসম্বলিত একটি বাক্স সেই এক্কার উপর রহিল। উক্ত দ্রব্যাদি সহিত এক্কা টানিয়া ঘোটক আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল।
মহম্মদাবাদে পৌঁছিবার কেবল দুই ক্রোশমাত্র বাকি আছে, এমন সময় আকাশের চারিদিক ঘন ঘটায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল, এবং দেখিতে দেখিতে মূষলধারায় বৃষ্টি আসিল। আমার সহিত একখানি কম্বল ছিল, উহাদ্বারা পূর্ব্বোক্ত বাক্সটি এবং বিছানা-পত্রগুলি উত্তমরূপে আবৃত করিয়া দিলাম। আমাদিগের পরিহিত বস্ত্র সমস্তই একেবারে ভিজিয়া গেল। আমাদিগের সহিত এক একটি বস্ত্রের ছত্র থাকিলেও, সেই মূষলধারায় পতিত বৃষ্টির হস্ত হইতে আমাদিগের পরিহিত বস্ত্রাদি কোন ক্রমেই রক্ষা করিতে সমর্থ হইলাম না।
যে সময় বৃষ্টি আসিল, সেই সময় আমরা এরূপ স্থানে উপস্থিত যে, চতুঃপার্শ্বে কেবল ময়দান ভিন্ন আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না, লোকালয় ত পরের কথা। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টাকাল এরূপ তেজে বৃষ্টি হইল যে, পথের দুই পার্শ্বের ময়দান সকল জলে পরিপূরিত হইয়া সেই মৃত্তিকা নির্ম্মিত পথের উপর হাঁটু-পরিমিত জল জমিয়া গেল। অৰ্দ্ধঘণ্টা প্রবল বৃষ্টির পর তেজ কিছু কম পড়িল সত্য, কিন্তু সেই-দিবস সেই বৃষ্টি যে একেবারে ছাড়িবে, তাহা বোধ হইল না। ক্রমে দেখিতে দেখিতে ঘোর অন্ধকার সমভিব্যাহারে সন্ধ্যা আসিয়া উপস্থিত হইল।
আমাদিগের এই বিপদের সময় ঘোটকরাজ তাহার স্বভাব প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। এবার লম্ফ ঝম্প পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই জলের ভিতর শয়ন করিবার ইচ্ছা করিতে লাগিল। সেইস্থানে পথপার্শ্বে একটি পুষ্করিণী ছিল, উহা জলে পরিপূর্ণ। পক্ষীরাজ আমাদিগের শয্যাদি-সমন্বিত সেই এক্কা লইয়া সেই পুষ্করিণীর জলে নামিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আমরা সকলে একত্র হইয়া উহাকে বলপূর্ব্বক ধারণ করিয়া এক্কা হইতে খুলিয়া দিলাম। যেমন সে ছাড়া পাইল, তাহার দুষ্টামিও তৎক্ষণাৎ দূর হইল, সে স্থিরভাবে একস্থানে দাঁড়াইল। সেইস্থান হইতেএকা একটু দূরে আনিয়া পুনরায় তাহাকে উহাতে যোজিত করিলাম। সেও পুনরায় পূর্ব্ববৎ ব্যবহার আরম্ভ করিয়া এক্কা সহিত জলের ভিতর শয়ন করিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে সেই বৃষ্টি জলে ভিজিতে ভিজিতে সেই ঘোটকের জ্বালায় বিশেষরূপে জ্বালাতন হইলাম। তখন উহার উপর অতিশয় রাগ হইল। এক্কা ওয়ালাও এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত বিশেষ ক্রুদ্ধ ছিল, কিন্তু আর সহ্য করিতে না পারিয়া সেই ঘোটককে উত্তমরূপে প্রহার করিল। প্রহার খাইয়া ঘোটক আরও দুষ্টামি করিতে লাগিল।
সেই সময় আমরা বিশেষ বিপদে পড়িলাম। বৃষ্টির জলে সমস্ত শরীর ভিজিয়া যাইতেছিল, তাহার উপর বিছানাপত্রও যদি সেই কম্বলের ভিতর হইতে বাহির করিয়া আমরাই লইয়া যাই, তাহা হইলে উহাও আর্দ্র হইয়া যাইবে। পরিহিত বস্তু পরিবর্তন করিবার আর উপায় রহিবে না। এইরূপ ভাবিয়া এক্কাওয়ালাকে কহিলাম, যে, সে তাহার ঘোটক লইয়া যাউক। আমি ও আমার আরদালির অদৃষ্টে যে কি ঘটিল, তাহা বলিতে লজ্জা হইতেছে; কিন্তু যখন আত্মকাহিনী কহিতে বসিয়াছি, তখন লজ্জা করিয়াই বা আর কি করিব? আর পাঠকগণ যখন শুনিতে বসিয়াছেন, তখন না শুনিয়াই বা তাঁহারা ছাড়িবেন কেন? সুতরাং আমাকে বলিতে হইল। আমি ও আমার আরদালি উভয়েই তখন ঘোটকের কার্য্যে নিযুক্ত হইলাম, সেই জল ও কদম পরিপূর্ণ পথ দিয়া সেই এক্কা টানিয়া চারিমাইল পথ বাহিয়া গেলাম। চারিমাইল গমন করিলে, পথের উপরেই মহম্মদাবাদের থানা পাইলাম, সেই থানাতেই রাত্রিযাপন করিতে হইল। সেইস্থান হইতে সেই এক্কা বিদায় করিয়া দিলাম। থানার কর্মচারীগণের মধ্যে যিনি আমাদিগের দুরবস্থা দেখিলেন, এবং অপরের মুখে শ্রবণ করিলেন, তিনি আর কোনরূপেই হাস্যসম্বরণ করিতে পারিলেন না। রাত্রি সেইস্থানেই অতিবাহিত হইয়া গেল; কিন্তু সমস্ত রাত্রির মধ্যে ক্ষণকালের নিমিত্তই সেই বৃষ্টির নিবৃত্তি হইল না।
পরদিবস প্রত্যূষে উঠিয়া জগরী গমন করিলাম, সেইস্থানে শিশুপালের সহিত সাক্ষাৎ হইল। সে কহিল, সেই থানার নিকটবর্ত্তী আষাঢ় গ্রামনিবাসী দধিবল গোয়ালার নিকট হইতে সে কথিত নোট প্রাপ্ত হইয়াছে; সুতরাং সেই স্থানে গমন করিবার প্রয়োজন হইল। সেইদিবস জগরীতে অতিবাহিত পূর্ব্বক একখানি এক্কা ভাড়া করিয়া রাত্রিকালে তথায় গমন করিবার নিমিত্ত বহির্গত হইলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আমরা যখন মৌগ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন সূর্য্যদেব পূৰ্ব্বগগনে উদিত হইয়াছেন। আজিমগড় জেলার ভিতর “মৌ” যদিও একটি প্রসিদ্ধ নগর নহে, তথাপি ইহাকে সামান্য গণ্ডগ্রামও কহা যায় না। পরে আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, এই গ্রামে প্রায় দ্বাদশ সহস্র লোকের বসবাস। হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান হইবে।
আমাদিগের এক্কা “মৌ” গ্রামের ভিতর দিয়া ক্রমে বাজারের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল। বাজারের অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল, উহাতে অনেক লোকের সমাগম হয়। আজ কিন্তু বাজারের অবস্থা দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। দেখিলাম, সমস্ত দোকানই বন্ধ, এবং বাজারের ভিতর প্রাণীমাত্রেরও সমাগম নাই। বাজারের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া এবং সেই প্রশস্ত রাজবর্ষের উপর একটিমাত্র লোককেও দেখিতে না পাইয়া, আমার হৃদয়ে একরূপ অপূর্ব্বভাবের উদয় হইল, ও এইরূপ অস্বাভাবিক অবস্থার কারণ কি, জানিবার নিমিত্ত মন নিতান্ত অস্থির হইল। সমভিব্যাহারী আরদালিকে আমার মনের কথা বলিবার উদযোগ করিলাম; কিন্তু দেখিলাম, সেও আমারই মত বিস্ময়সাগরে ভাসিতেছে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বেই সে-ই আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু! এই গ্রামে রাস্তাঘাট হাটবাজারে একটি প্রাণীও দেখিতে পাইতেছি না কেন?” তাহার কথায় আমি আর কি উত্তর দিব? যে ব্যক্তি এক্কা চালাইতেছিল, যদি সেই আমাদিগের সংশয় দূর করিতে পারে, এই ভাবিয়া তাহাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। দেখিলাম, সেও আমাদিগের মত গাঢ় তিমিরাচ্ছন্ন হইয়া অনির্দিষ্ট পথে বিচরণ করিতেছে; সুতরাং আমাদিগের মনের সংশয় মনেই রহিল। ভাবিতে ভাবিতে সেই এক্কা আরোহণে ধীরে ধীরে সেই বাজার অতিক্রম করিয়া চলিলাম। যখন আমাদিগের এক্কা “মৌ” গ্রামের থানার সম্মুখে উপস্থিত হইল, তখন আটটা বাজিতেও কিছু বিলম্ব আছে। আমরা এক্কা হইতে অবতরণ করিয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিলাম। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! দ্বারের একমাত্র প্রহরী ব্যতিরেকে সেইস্থানে জনপ্রাণীকেও দেখিতে পাইলাম না।
সরকারী কার্য-উপলক্ষে ভারতবর্ষের নানাস্থানে, নানাথানায় আমাকে অনেকবার গমন করিতে হইয়াছে, কিন্তু এইরূপ জনশূন্য থানা অদ্যাবধি আমার নয়নগোচর হয় নাই। যেখানে যখন গিয়াছি, সেইখানেই দেখিয়াছি, কর্মচারী, কনষ্টেবল, চৌকীদার প্রভৃতি সরকারী লোক এবং বাদী, প্রতিবাদী, সাক্ষী ও দর্শক প্রভৃতির কেহ না কেহ সর্ব্বদাই সেইস্থানে উপস্থিত থাকে। কিন্তু এই থানার অবস্থা দেখিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইয়া সেই প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখানে আর কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না কেন? এইস্থান পরিত্যাগ করিয়া সকলে কোথায় গমন করিয়াছে?” উত্তরে প্রহরী কহিল, “সকলে যে স্থানে গমন করিয়াছে, তাহা কি জানেন না এইস্থানে যে কিরূপ সৰ্ব্বনেশে প্রলয়কাণ্ড উপস্থিত হইয়াছে, তাহা কি আপনি শুনেন নাই? যদি আপনি ইহার কিছুই অবগত হইতে না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই থানার দক্ষিণ ঐ ময়দানের দিকে একবার দৃষ্টি করিয়া দেখুন। তাহা হইলেই বুঝিতে পারিবেন যে, থানা পরিত্যাগ করিয়া সকলে কোথায় গমন করিয়াছে?” এই বলিয়া প্রহরী তাহার অঙ্গুলি-নির্দেশদ্বারা থানার দক্ষিণস্থিত একটি প্রকাণ্ড ময়দান আমাকে দেখাইয়া দিল। আমি সেইদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম; কিন্তু সম্মুখবর্তী কতকগুলি বৃক্ষ আমার দৃষ্টিরোধ করিল, সেইস্থান হইতে ময়দানের অবস্থা কিছুই দেখিতে সমর্থ হইলাম না।
পূর্ব্বোক্ত এক্কার ভিতর আমার যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা আমার সমভিব্যাহারী আরদালিকে থানার ভিতর রাখিতে কহিলাম। বিছানা-পত্র ও বাক্সাদি যাহা ছিল, তাহা লইয়া আরদালি থানার ভিতর গমন করিল। আমি এক্কার ভাড়া চুকাইয়া দিলাম। এক্কা-চালক ভাড়া পাইয়া যে দিক্ হইতে আগমন করিয়াছিল, সেইদিকেই প্রত্যাবর্তন করিল। মানবহৃদয় সৰ্ব্বদা কৌতূহলে পরিপূর্ণ; সুতরাং সেই ময়দানের অবস্থা জানিবার নিমিত্ত আমারও নিতান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইল। আমি আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে একাকী সেই ময়দান-অভিমুখে চলিলাম। সম্মুখবর্তী সেই বৃক্ষরাজি অতিক্রম করিয়া সেই ময়দানের ভিতর উপস্থিত হইলাম। সম্মুখে যতদূর দৃষ্টি চলে, দেখিলাম, কেবল ময়দান ধূ ধূ করিতেছে। আরও দেখিলাম, এই প্রকাণ্ড ময়দান কেবল সারি সারি অসংখ্য শ্বেতপাগড়িদ্বারা আবৃত। সেই অসীম ও অনন্ত পাগড়ি রাশিতে আমার দূরদৃষ্টির লোপ হইল। দূরের আর কিছুই দেখিতে সমর্থ না হইয়া কি করিব, তাহাই সেইস্থানে ক্ষণকালমাত্র দাঁড়াইয়া ভাবিলাম। দেখিলাম, নিকটে একটি প্রকাণ্ড আম্রবৃক্ষ রহিয়াছে, সেই বৃক্ষে আরোহণ করিতে বিশেষ কোন কষ্ট হয় না, এবং উহার উপর হইতে অনেক দূর পর্য্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয়। আমার কৌতূহল পরিতৃপ্ত করিবার মানসে, তখন সেই বৃক্ষোপরি আরোহণ করিলাম।
দেখিলাম, সেই প্রান্তর নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। উহার মধ্যস্থলে একটিমাত্র পুষ্করিণী, একটি আম্রবাগান ও দুইখানি খোলার বাড়ী ভিন্ন অপর আর কিছুই নাই, এমন কি সম্মুখে ও বামপার্শ্বে দুই মাইলের মধ্যে একটি বৃক্ষ পর্য্যন্তও দৃষ্টিগোচর হয় না। এই ময়দানের পশ্চিম হইতেই মৌ গ্রাম আরম্ভ। নিম্নের সীমা-চিত্র দেখিলেই পাঠকগণ সেইস্থানের অবস্থা কয়েক পরিমাণে বুঝিয়া লইতে সমর্থ হইবেন।
wwwwwwww
উক্ত বৃক্ষোপরি আরোহণ করিয়া দুই মাইল পরিমিত ময়দানের ভিতরাস্থিত সমস্ত অবস্থা স্পষ্টরূপে দেখিতে সমর্থ হইলাম। দেখিলাম,—সেই আম্রবাগানের নিকট হইতে পূর্ব্বদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে, ততদূর কেবল শ্বেতপাগড়ি মনুষ্যদ্বারা পরিপূর্ণ। দেখিলে বোধ হয়, কোন ব্যক্তি এরূপভাবে উহাদিগকে স্থাপিত করিয়াছে যে, উহার ভিতর অপর কোন ব্যক্তির দাঁড়াইবার স্থান হয়, কি না সন্দেহ। সেই ময়দানে সমাগত শ্বেতপাগড়ি-বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ পশ্চিম-দেশবাসী হিন্দু। ইহাদিগের পরিধানে কেবলমাত্র এক একখানি মলিন বস্ত্র, বদন অনাবৃত; কিন্তু মস্তক বৃহৎ পাগড়ি দ্বারা সংরক্ষিত, কোন কোনস্থানে ক্বচিৎ কাহারও অবয়ব মিরজাই বা পিরান দ্বারা আবৃত। প্রত্যেকেরই হস্তে পাঁচহস্ত পরিমিত লম্বা, ঈষৎ লাল-আভাযুক্ত এক একগাছি বাঁশের লাঠী। বহুদূর বিস্তৃত এবং বহুদিবস হইতে সংরক্ষিত শালবনের ভিতর প্রবেশ করিলে, যেমন একেবারে অসংখ্য ছোট, বড় এবং কৃশ ও স্থূল শালবৃক্ষ নয়নপথে পতিত হইয়া দৃষ্টির গতি রোধ করে, এই ময়দানের ভিতর সেইরূপ অসংখ্য বংশদণ্ড নয়নের গতি রোধ করিতে লাগিল।
১। মুসলমান জনতার পূর্ব্ব সীমা।
২। হিন্দু জনতার পশ্চিম সীমা।
৩। পুষ্করিণী।
৪। মুসলমানদিগের একখানি খোলার বাড়ী।
৫। আম্রবাগান।
৬। আম্র বৃক্ষ যাহাতে আমি উঠিয়াছিলাম।
৭। মৌ গ্রামের থানা।
৮। হিন্দুদিগের একখানি খোলার বাড়ী।
৯। ১০।১১।১২। যে যে স্থানের কোরবানের গরু হিন্দুদিগকে প্রদান করে।
১৩। যে স্থানের গরু প্রদান করে নাই।
১৪। হিন্দু জনতার পূর্ব্ব সীমা।
১৫। হিন্দু জনতার দক্ষিণ সীমা
১৬। গোরকপুরের পাকা রাস্তা।
১৭। মহম্মদাবাদের কাঁচা রাস্তা।
১৮। তমসা নদী।
১৯। বৃক্ষশ্রেণী, যাহা দ্বারা প্রথমে আমার দৃষ্টি রুদ্ধ হইয়াছিল।
২০। পাকা রাস্তার তেইশ চিহ্নিত মাইল।
২১। পাকা রাস্তার চব্বিশ চিহ্নিত মাইল।
২২। পাকা রাস্তার পঁচিশ চিহ্নিত মাইল।
এই পাগড়ি রাশির সম্মুখে অর্থাৎ সেই আম্রবাগানের পশ্চিমে অসংখ্য মুসলমান সমবেত। ইহার ভিতর অষ্টমবর্ষীয় হইতে অশীতিবর্ষ বয়স্ক পর্য্যন্ত অনেকেই আছে, ইহাদিগের কাহারও হস্তে লাঠী, কাহারও হস্তে বর্ষা; বালসূর্যকিরণ পতিত হইয়া কাহারও হস্তস্থিত চাক্চিক্যশালী তরবারীর সৌন্দর্য্য আরও বৃদ্ধি করিতেছে; কেহ বা ভীষণ আগ্নেয়াস্ত্রধারণ করিয়া সর্ব্বাগ্রে যাইতে চেষ্টা করিতেছে।
যে স্থানে হিন্দু ও মুসলমান সমবেত হইয়াছে, তাহার নাম “পরধা-কা ময়দান”। পরধা-কা-ময়দানকে আজ কুরুক্ষেত্র বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কৌরব ও পাণ্ডবগণ কুরুক্ষেত্রে সমাগত হইয়া, অসংখ্য বীরগণের সহিত যেরূপ ধৰ্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, আজ এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও সেইরূপ ধৰ্ম্মমদে মত্ত হইয়া হিন্দু ও মুসলমানগণ আপন আপন ধর্ম রক্ষা করিবার নিমিত্ত এই পরধা-কা ময়দানে সমবেত হইয়াছে। উহার একদিকে হিন্দু, অপরদিকে মুসলমান, এই উভয় শ্রেণীর মধ্যে অশ্বারোহণে একটি শ্বেতকায় পুরুষ।
এই ময়দানের ভিতর পরিশেষে যে এইরূপ ভীষণকাণ্ড উপস্থিত হইয়াছিল, নর-রুধিরে এই পরধা-কা ময়দান যেরূপ রঞ্জিতা হইয়াছিল, তাহার বিশেষ বিবরণ জানিবার পূর্ব্বে পাঠকগণের জানা উচিত যে, কি নিমিত্ত এইস্থানে এই বহু লোকের সমাগম।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আজ মুসলমানদিগের একটি প্রধান পর্ব্ব বকরা ইদের দিন। ইহাদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রানুসারে আজ প্রত্যেক মুসলমানই কোরবানি বা পশু জবাই করিয়া থাকেন। দেশ কাল ও পাত্র বিবেচনায় ইহাদের মধ্যে কেহ বা ছাগ, কেহ বা মেষ, কেহ বা মহিষ এবং কেহ বা গাভি কোরবানি দিয়া থাকে।
আজিমগড় জেলার ভিতর মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যা অপেক্ষা হিন্দুর সংখ্যা অনেক অধিক, কিন্তু সেইস্থানের মুসলমানবর্গ প্রায় কোরবানির সময় গরুর আদরই অধিক করিয়া থাকেন! হিন্দুপ্রদেশে হিন্দুর আরাধ্য গোধন-বধ হিন্দুর চক্ষে একে বড়ই কষ্টকর, তাহাতে অন্যান্য বৎসরে যেরূপভাবে কোরবানি হইয়া থাকে,–কি কারণে বলা যায় না,—এবার তাহার ভাবাত্তর উপস্থিত, অর্থাৎ যে সকল প্রকাশ্যস্থানে হিন্দুর চক্ষুর উপর পূর্ব্বে কখন এরূপ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে কেহ দেখেন নাই, এবার সেই সকল স্থানে গোহত্যা হইবে! ইহা জানিতে পারিয়া, হিন্দুগণ গোহত্যা নিবারণের নিমিত্ত আজ প্রাণ দিতে প্রস্তুত; অথচ মুসলমানগণও আপন ধর্ম্ম বজায় রাখিতে কোনক্রমেই পরাঙ্গুখ নহেন। এই নিমিত্তই আজ পরধা-কা-ময়দানে এই প্রলয় উপস্থিত।
মৌগ্রামের ভিতর এইরূপ পাঁচস্থানে গোহত্যা হইবার উদ্যোগ শ্রবণ করিয়া আজ নিকটবর্তী কয়েক জেলা হইতে এই সকল হিন্দুর সমাগম হইয়াছে। বহুসংখ্যক হিন্দুর জনতা দেখিয়া মুসলমানদিগের মধ্যে অনেকেই ভাবিল, গোহত্যা করিলে নিশ্চয়ই মহাপ্রলয় উপস্থিত হইবে; সুতরাং গাভী কয়েকটি উহাদিগকে প্রদান করিয়া, তাহার পরিবর্তে শাস্ত্রানুমোদিত অন্য জন্তুর কোরবানি দেওয়া মঙ্গল। এই ভাবিয়া চারি স্থানের চারিটি গরু মুসলমানগণ হিন্দুদিগকে অর্পণ করিল, এবং এইরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইল যে, সেইস্থানে তাহারা আর কখন গোহত্যা করিবে না।
সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই ভাল-মন্দ লোক দেখিতে পাওয়া যায়। পঞ্চম স্থানের গরুটি কোরবানি দিবার যাহার ইচ্ছা ছিল, সে জোলা জাতীয় একটি নীচ মুসলমান। সে হিন্দুদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইল না, বা অপরাপর মুসলমানদিগের দৃষ্টান্তও দেখিল না। সে কহিল, “প্রাণ যায় যাউক, ধর্ম্মের নিমিত্ত যে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, কোনরূপেই তাহা পরিত্যাগ করিব না। যদি আপন কার্য্য উদ্ধার করিতে পারি, ভালই; নতুবা ধৰ্ম্ম-কর্ম্মোপলক্ষে প্রাণবিসর্জ্জন করিয়া স্বর্গে গমন করিব।”
হিন্দুদিগের কর্ণে যেমন এই কথা প্রবেশ করিল, অমনি মার্ মার্ শব্দে দিঙমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া গেল। আপন ধর্ম্মরক্ষা করিবার নিমিত্ত সহস্ৰ সহস্ৰ হিন্দু একত্র মিলিত হইয়া, সম্মুখ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল।
ওদিকে সকল মুসলমানই ক্রমে এক হইয়া হিন্দুদিগের সম্মুখীন হইল। হিন্দুদিগের সম্বল—বংশযষ্টি, কিন্তু মুসলমানদিগের অস্ত্র—তরবারি ও বন্দুক। মুসলমানদিগের হস্তে এই সকল সৰ্ব্বধ্বংশকারী অস্ত্র সকল দেখিয়াও হিন্দুগণ কিছুমাত্র ভীত হইল না। বরং “গৌ মাতাকি জয়” শব্দে চারিদিক্ ধ্বনিত করিয়া সেই ভীষণ আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মুখে আপন আপন বুক পাতিয়া দিয়া সম্মুখসংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। সেই সময়ে কতকগুলি সুসজ্জিত হস্তী ও অশ্ব আরোহণ করিয়া আরও অনেক হিন্দু আসিয়া হিন্দু-জনতা বৃদ্ধি করিল।
এই উভয়দলের মধ্যে যে শ্বেতকায় অশ্বারোহীর কথা বলিয়াছি, তিনি সেইস্থানের পুলিসের বড়সাহেব। যে সময় উভয় দলই পরস্পর সম্মুখীন হইয়া, সম্মুখযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতেছে, সেই সময় সেই অশ্বারোহী বীরের ন্যায় উভয়দলের মধ্যে বিচরণ করিতেছেন, ও উভয়দলকেই সান্ত্বনা করিতে চেষ্টা করিতেছেন; কিছুতেই কৃতকাৰ্য্য হইতেছেন না। হিন্দুদিগকে সেই গরু পরিত্যাগ পূর্ব্বক চলিয়া যাইবার নিমিত্ত অনুরোধ করিতেছেন, এবং মুসলমানগণকে সেই গরু প্রত্যর্পণ করিতে পরামর্শ দিতেছেন, কিন্তু কেহই তাঁহার কথা শুনিতেছে না। হিন্দুগণ যখন দেখিল, মুসলমানেরা সহজে সেই গরু প্রত্যর্পণ করিবে না, তখন সতেজে একেবারে তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। অশ্বারোহী তখন অনন্যোপায় হইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন, কিন্তু তাঁহার ঘোটকটী সেই জনতার ভিতর দৌড়াদৌড়ি করিয়া এতদূর ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল যে, থানার সম্মুখে আসিতে না আসিতেই পড়িয়া গেল, ও দেখিতে দেখিতে ইহজীবন পরিত্যাগ করিল। সেই ময়দানে যত পুলিস-কৰ্ম্মচারী উপস্থিত হইয়াছিল, তাহারাও সেই সময় দ্রুতপদে থানার ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল।
পরধা-কা ময়দানের অবস্থা যতদূর বিবৃত হইল, ইহা আমি উত্তমরূপে দেখিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। কিন্তু ইহার পর যাহা ঘটিল, তাহাও উত্তমরূপে দেখিতে পাইলেও, সে দৃশ্য বর্ণনা করা আমার ক্ষমতাতীত। সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আমি কি দেখিলাম? দেখিলাম,—বীরের হস্তে লাঠী পড়িয়া, সে লাঠী কিরূপ ভীষণভাব, ধারণ করিয়াছে! দেখিলাম, সে লাঠী শত শত মস্তক চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া ধূলারাশিকে কিরূপে লোহিত কদমে পরিণত করিতেছে! আরও দেখিলাম, সে লাঠী সুশাণিত তরবারিকে শতখণ্ডে বিভক্ত করিয়া কিরূপে সুদূরে প্রক্ষেপ করিতেছে! ধন্য বংশখণ্ড! ধন্য তোমাকে!
হিন্দুগণ ভীষণযষ্টি আঘাতে যেমন শত শত লোককে আহত করিতে লাগিল, মুসলমানগণও সেই জনতার ভিতর আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করিয়া, সে কত লোককে ধরাশায়ী করিতে লাগিল, তাহার সংখ্যা কে করে?
সম্মুখে অনেক লোক হত ও আহত হইয়া ধরাশায়ী হইল সত্য; কিন্তু, পরিশেষে ছয় সাতটি মুসলমানের মৃতদেহ ভিন্ন অপর দেহ কেহই দেখিতে পাইল না। আহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন উহাদিগকে অশ্ব ও হস্তীপৃষ্ঠে বহন করিয়া কোথায় লইয়া গেল। আর রাশি রাশি মৃতদেহ তমসার নির্ম্মলজলে প্রক্ষিপ্ত হইয়া প্রবলস্রোতের সহিত মিশিয়া চলিল।
এই ভীষণ সংগ্রাম কি অল্পক্ষণে নিবৃত্ত হইল? দিবা আটটা হইতে আরম্ভ করিয়া, বেলা তিনটা পৰ্য্যন্ত এই ভয়ানক ব্যাপার চলিতে লাগিল। আরও কতক্ষণ পরে এই ভীষণ ব্যাপারের যে শেষ হইত, তাহা বলা যায় না; কিন্তু জগদীশ্বর এ দৃশ্য অধিকক্ষণ আর দেখিতে পারিলেন না। সেই সময় হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি আসিয়া উপস্থিত হইল।
বৃষ্টির প্রবলতেজে মুসলমানদিগের গুলি বারুদ ভিজিয়া গেল; সুতরাং তাহাদিগের প্রধান সাহায্যকারী আগ্নেয়অস্ত্র সকল অনন্যোপায় হইয়া বিশ্রামলাভ করিল। এদিকে হিন্দুদিগের বংশযষ্টি প্রবলরূপ ধারণ করিয়া মুসলমানদিগকে সুদূরে তাড়িত করিয়া দিল। এই সুযোগে হিন্দুগণ তাহাদিগের অভিলষিত গাভিটি প্রাপ্ত হইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। পুলিসের বীরপুরুষগণ এতক্ষণ থানায় থাকিয়া, আপন আপন বীরত্বের পরিচয় প্রদান করিতেছিলেন, অর্থাৎ সেইস্থান হইতে ভীষণ আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে মধ্যে মধ্যে কোন কোন হিন্দুকে ধরাশায়ী করিতেছিলেন।
যে স্থানে হিন্দু ও মুসলমান দিগের মধ্যে এই ভয়ানক যুদ্ধ হইতেছিল, সেইস্থান হইতে উভয় পক্ষীয় সমস্ত লোক প্রস্থান করিলে দেখা গেল—সেইস্থানে মুসলমানদিগের যে একখানি খোলার ঘর ছিল, তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। এমন কি তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানের মধ্যে একটি ঘরও দৃষ্টিগোচর হইল না। এদিকে জনৈক হিন্দুর একখানি ঘর সেইস্থানে ছিল, তাহা সমভূম হওয়া দূরে থাকুক, তাহার একখানিমাত্র খোলাও স্থানান্তরিত হয় নাই।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
উপরি উক্ত হৃদয়বিদারক ও লোমহর্ষণকর ব্যাপার সকল স্বচক্ষে দৃষ্টি করিয়া সেই সময় আমার মনের গতি যেরূপ হইয়াছিল, তাহা বাঙ্গালি পাঠকগণ! আপনারা অনায়াসেই অনুভব করিতে পারিবেন। জগতের সমস্ত জাতির মধ্যে যে জাতি সকলের নিকট ভীরু বলিয়া পরিচিত, এই প্রবন্ধলেখক আমিও যখন সেই জাতির অন্তর্ভূত, তখন এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমার মন বিলোড়িত না হইবে কেন? কিন্তু বাল্যকাল হইতেই এই প্রকার নানারূপ গোলযোগে আমাকে সময়ে সময়ে পড়িতে হইয়াছে বলিয়াই বোধ হয়, এই ঘটনার আদ্যোপান্ত দেখিতে আমি সমর্থ হইয়াছিলাম; নতুবা, সংগ্রাম স্থল হইতে হিন্দু ও মুসলমানগণ প্রস্থান করিলে, স্থানীয় পুলিস যেরূপে আপন আপন কর্তব্য পালন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন, তাহা এইস্থানে বর্ণন করিবার আমার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেইদিবস কিন্তু সেই কার্য্যের কিছুই করিতে পারিলাম নাই। পূর্ব্বোক্ত সকল অবস্থা দেখিয়া আমার মন এতদূর অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল যে, কোন কাৰ্য্যেই আমি আমার মনকে স্থির করিতে পারিলাম না।
মৌগ্রাম হইতে আষাড় গ্রাম প্রায় তিনক্রোশ ব্যবধান। পরদিবস প্রত্যূষে উঠিয়া দধিবলের অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম। যে দিক্ দিয়া গমন করিতে লাগিলাম, সে সকল গ্রাম অতিক্রম করিতে লগিলাম, সেই সকল স্থানে পুরুষের চিহ্নমাত্রও দেখিতে পাইলাম না। মধ্যে মধ্যে দুই একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেখা হইতে লাগিল সত্য; কিন্তু সে সকল প্রদেশে যে কোন পুরুষের বসবাস আছে, তাহা যেন বোধই হইল না। বুঝিলাম,—এই ভীষণ দাঙ্গার পর পুলিসের ভয়ে হিন্দু ও মুসলমান পুরুষবর্গ গ্রাম পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে। এই সকল অবস্থা দেখিয়া ভাবিলাম, এ সময়ে আষাড় গ্রামে গমন করিলে সফলকাম হইব না, কোন কাৰ্য্যই হইবে না; দধিবলকে নিশ্চয়ই দেখিতে পাইব না।
ভাবিলাম, আষাড় গ্রামে এ সময়ে আর গমন করিব না, কার্য্যে কিন্তু তাহা পারিলাম না। কার্য্যের অনুরোধে আমাকে সেইস্থানে গমন করিতেই হইল।
আমার সৌভাগ্যবশতঃ গ্রামের ভিতর গমন করিবামাত্রই দধিবলকে দেখিতে পাইলাম। তাহার বৃদ্ধপিতা ও পরিবারবর্গ সমভিব্যাহারে দধিবল সেই সময় গ্রাম পরিত্যাগের উদযোগ করিতেছিল।
দধিবলকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, দধিবল সেই নোট আজায়েব গোয়ালা ও ভূরা গোয়ালার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। উভয়েই একত্র আসিয়া দধিবলকে সেই নোট প্রদান করে, ও তাহার পরিবর্তে নগদ টাকা লইয়া প্রস্থান করে। উভয়েই দধিবলের নিকট পরিচিত। ভুরা গোয়ালার বাসস্থান সেইস্থান হইতে প্রায় দশক্রোশ অন্তর, কিন্তু গাজিপুর জেলার অন্তর্গত। আজায়েবের বাসস্থান, দধিবলের বাড়ী হইতে প্রায় তিন মাইল ব্যবধান দধিবল বহুদিবস ট্রিনিদাদ নামক স্থানে অবস্থিতি করিয়া চাষ আবাদ করিয়াছিল; সুতরাং, দেশের লোকজনের মধ্যে এখন কোন্ ব্যক্তির কিরূপ চরিত্র দাঁড়াইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণরূপে জানিত না বলিয়াই, উহাদিগের নিকট হইতে বিনাআপত্তিতে সেই নোট গ্রহণ করিয়াছিল।
পাগলা হাসপাতালে যে সংবাদ প্রথমে অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, নোটসম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ফলও তাহাই দাঁড়াইল। সুতরাং আর কালবিলম্ব না করিয়া দধিবলকে সঙ্গে লইয়া আজায়েবের গ্রামে গমন করিলাম। দেখিলাম, এক অদ্ভুতস্থানে বাসস্থান নিৰ্ম্মাণ করিয়া আর্জায়েব বাস করে। একটি প্রকাণ্ড ময়দানের মধ্যস্থিত একখণ্ড উচ্চ জমির মধ্যে দুইখানি ঘর নির্ম্মাণ করিয়া সে বাস করে, সেইস্থানে অপর কোন লোকের বসবাস নাই। সেই উচ্চ জমির চতুঃপার্শ্ব বিলের দ্বারা বেষ্টিত, এই বিল সকল সময়েই জলে পূর্ণ থাকে। কোন ব্যক্তি দিবাভাগে তাহার বাড়ীতে গমন করিবার চেষ্টা করিলে, প্রায় এক মাইল দূর হইতে আজায়েব তাহাকে দেখিতে পায়; সুতরাং তাহার দ্বারা কোনরূপ অসৎকাৰ্য্য সম্পন্ন হইলে, তদপরাধে তাহাকে ধৃত করা নিতান্ত সহজ হয় না। যাহা হউক, সেই জলা পার হইয়া আমরা আজায়েবের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বাড়ীতে জন-প্রাণীমাত্র নাই; ঘর দুইখানিই তালাবদ্ধ। এই অবস্থা দৃষ্টি করিয়া অগত্যা আমাকে সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে হইল। কিন্তু অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, আজায়েব গোয়ালার মত প্রসিদ্ধ চোর সেই প্রদেশে অতি অল্পই আছে। চুরি মোকদ্দমায় ধৃত হইয়া সে তিন চারিবার কারাবাসও সহ্য করিয়াছে, তথাপি সেই নিকৃষ্টবৃত্তি, সে পরিত্যাগ করে নাই। তাহার নিয়ম—সে একস্থানে চুরি করিবে, অপরস্থানে গিয়া সেই চোরাদ্রব্য বিক্রয় করিবে। কলিকাতা, বোম্বাই প্রভৃতি স্থান হইতে যাহা চুরি করিয়া আনে, তাহা লক্ষ্ণৌ, গোরকপুর প্রভৃতি স্থানে গিয়া বিক্রয় করে। বস্তুতঃ ভারতবর্ষের ভিতর এমন অতি অল্প নগরই আছে, যে স্থানে গমন করিয়া আজায়েব কিছু চুরি করে নাই, বা কোন অপহৃত দ্রব্য বিক্রয় করে নাই। এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিয়া আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। অতঃপর ভূরার বাড়ীতে গিয়া দেখিলাম, সেও সেইস্থানে নাই। জানিতে পারিলাম, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সেই ভয়ানক দাঙ্গার উপলক্ষে আপন আপন বাসস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাহারা সকলেই প্রস্থান করিয়াছে।
উহাদিগের নিমিত্ত আর কোনরূপ অনুসন্ধান না করিয়া কিছুদিবস আমি অপরাপর স্থানে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। আমি হিন্দু—এই হিন্দু-মুসলমানের বিবাদে আমি হিন্দুর পক্ষসমর্থন করিয়া বেড়াইতেছি; এই বিপদ হইতে যাহাতে হিন্দুগণ উত্তীর্ণ হইতে পারে, আমি তাহারই চেষ্টা করিয়া বেড়াইতেছি; ক্রমে ইহাই সকলে জানিতে পারিল। যে গ্রামে ইচ্ছা—সেই গ্রামে আমি অবলীলাক্রমে গমনাগমন করিতে লাগিলাম। হিন্দুপল্লীর ভিতর প্রবেশ করিতে, হিন্দুগণের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করিতে, আমার আর কোনরূপ কষ্টই হইল না। হিন্দুমাত্রই আমার কথায় বিশ্বাস করিতে লাগিল। এইরূপ সুযোগ প্রাপ্ত হইয়া আমি সৰ্ব্বদাই আজায়েবের বাসস্থানে গমন করিতে লাগিলাম, ভূরারও সংবাদ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলাম। পরিশেষে দেখিলাম,—ক্রমে উহারাও আমার সম্মুখীন হইল, তখন আমার মনস্কামনা পূর্ণ হইল। কৌশলে এক এক করিয়া আমি উভয়কেই ধৃত করিলাম। যেরূপভাবে আমি উহাদিগকে ধৃত করিলাম, তাহাতে আমারও বিশেষ কোন কষ্ট অনুভব করিতে হইল না। যে পর্য্যন্ত থানার ভিতর আনিয়া উহাদিগকে বন্দী না করিলাম, সেই পর্যন্ত উহারাও বুঝিতে পারিল না যে, তাহারা আমার হস্তে আসামীরূপে পতিত হইয়াছে।
উহাদিগকে ধৃত করিয়া আমি কলিকাতায় আনিলাম। আলিপুরের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রথম বিচার আরম্ভ হইয়া, দায়রায় গিয়া সেই বিচার শেষ হইল। উভয়েই এখন পাঁচ বৎসরের নিমিত্ত জেলে বাস করিতেছে।
[অগ্রহায়ণ, ১৩০১]