চতুর্থ পুস্তক [১৭৩১-১৭৩২]

চতুর্থ পুস্তক [১৭৩১-১৭৩২]

আমি এ্যানেসিতে এলাম বটে, কিন্তু সেখানে মাদাম দ্য ওয়ারেন্স-এর সাক্ষাৎ পেলাম না। আমি এরকম আশঙ্কা করিনি। ফলে আমার বিস্ময় আর দুঃখের অন্ত ছিল না। এবার আমি বুঝতে পারলাম লা-মাইতারকে ওভাবে ফেলে রেখে আমার চলে আসা উচিত হয়নি। পরে আমি যখন জানতে পারলাম বেচারি কী সাংঘাতিক দুর্ভোগে পড়েছিল তখন আমার পরিতাপের সীমা রইল না। তার যে গানের বাক্সটি ছিল তার মধ্যেই তার কাপড়-চোপড়, জিনিসপত্র ছিল, সেটাও তার লিয়নস-এ আসার পরে সে দেখল যে সেটিও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এর মূলে কোতে দরতান থেকে পাঠানো একটা পত্র যার মধ্যে তার সব কিছু বাজেয়াপ্ত হওয়ার কারণ বর্ণিত ছিল। লা’ মাইতার বহু চেষ্টা করেও তার জিনিসপত্র আর উদ্ধার করতে পারেনি। তার জীবনধারণের উপায়, তার সমগ্র জীবনের উপার্জন সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সেই গানের বাক্সের মালিকানার ব্যাপারে একটা গণ্ডগোল ছিল। কিন্তু সেটার কারণে তার সবকিছু খোয়া গিয়েছিল, এমন কথা কেউ বলেনি। বেচারির কোনও অপরাধের উল্লেখ পর্যন্ত না করে জবরদস্তিভাবে লা মাইতারকে দণ্ডিত করা হলো। বেচারি লা মাইতার এভাবেই তার দক্ষতার সব অর্জনকে হারিয়ে তার বার্ধক্যেরও বাঁচার সব সম্বল হারিয়ে নিঃস্বতে পরিণত হয়েছিল। এই ঘটনা আমার জীবনে একটা বিরাট আঘাত হিসেবে এসেছিল। কিন্তু আমারও তখন এমন বয়স, যে কোনও আঘাতেই আমি পরাজিত বোধ করতে পারতাম না। মাইতারের ক্ষতি সইতে আমার তেমন কোনও সময় লাগল না। আমার প্রত্যাশা ছিল মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর একটা খবর আমি পেয়ে যাব। কিন্তু আমি তার কোনও ঠিকানা জানতাম না এবং তিনিও জানতেন না যে আমি ফিরে এসেছি। আর সব মিলিয়ে আমি মনে করলাম, লা মাইতারের দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে আমার কোনও অপরাধ ছিল না। ও যখন মাদাম ওয়ারেনস-এর কাছে থেকে পালায় আমি ওকে তখন সাহায্যই করেছিলাম। আর এর বেশি সাহায্য করার কোনও ক্ষমতাও আমার ছিল না। আমি যদি ওর সঙ্গে ফ্রান্সে থেকেও যেতাম তবু তাতে ওর মৃগীরোগের কোনও উপশম ঘটতো না। ওর গানের বাক্সও আমি বাঁচাতে পারতাম না। ওকে কোনও রকমে সাহায্য করতে পারার বদলে আমার নিজের বোঝ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে ওর কষ্টই কেবল বৃদ্ধি করতে পারতাম। আমার তখনকার মনের অবস্থায় সমস্ত ব্যাপারটার মীমাংসা এভাবেই করেছিলাম। আমি আমার তখনকার মনের অবস্থার কথা বলছি। এখন অবশ্য আমি ব্যাপারটাকে ওভাবে দেখিনে। একটা নিন্দনীয় কাজ আমরা যখন করি ঠিক তখনি আমরা তার লজ্জাটাকে উপলব্ধি করতে পারিনে। অনুশোচনা বা লজ্জা যদি আমাদের আসে তবে তা আসে ঘটনার বহু পরে, একমাত্র · এবং এটাও ঠিক, নিজের জীবনের এমন লজ্জাজনক আচরণের স্মৃতিতে সেই লজ্জাটা সহজে দূরও হয় না। লজ্জাটা আমাদের কুড়ে কুড়ে খায়।

.

[রুশো বাহাদুরির সঙ্গেই একদিন যাকে বিরাটভাবে প্রশংসা করেছিল, তাকে নির্মমভাবেই পরিত্যাগ করল এবং তাকে বিস্মৃত হলো।]
.

মাদাম দ্য ওয়ারেনস তাঁর সঙ্গে কেবল এ্যানেতকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মারসারেতকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন। এটি তার পরিচারিকা ছিল। এর কথা আমি আগে বলেছি। আমি ফিরে এসে দেখলাম, সে মাদাম ওয়ারেনস-এর সেই ঘরেই থাকছে। এই মারসারেত বয়সে আমার চেয়ে একটু বেশি ছিল। খুব যে সুন্দরী তা নয়। তবু অপছন্দের নয়। একটু বুর্জোয়া ধরনের। কিন্তু অপাপবিদ্ধ তরুণী। ওর মধ্যে আমি ওর চরিত্রগত দোষ কিছু দেখিনি। তবু এটা সত্য যে মারসারেত মাঝে মধ্যে বড় অবাধ্য হয়ে উঠত। তার কত্রীকেও সে মানতে চাইত না। আমি প্রায়শই ওকে দেখতে যেতাম। ওতো আমার পুরনো পরিচিত লোক। আর ওকে দেখলে আমার আর একজনের কথা মনে পড়ত যাকে আমি ওর চেয়েও অধিক ভালবাসতাম। বলা চলে তার জন্যই আমি মারসারেতকে ভালবাসতাম। এ মেয়েটার অনেক বন্ধু ছিল। এদের মধ্যে মাদামসেল জিরদও ছিল। এ এসেছিল জেনেভা থেকে। ও আমার কিছু পাপ কামনার জন্যই আমাকে পছন্দ করেছিল। সে মারসারেতকে চাপ দিত যেন ও আমাকে তার কাছে নিয়ে যায়। আমার তাতে বাধা দানের কিছু ছিল না। কারণ, আমি তো মেয়েটাকে যথার্থই পছন্দ করতাম। সে পরিবারে পছন্দের পুরুষ আরও ছিল। জিরদ মাঝে মাঝেই আমার কাছে আসত। তার প্রতি আমার কোনও অনিচ্ছা ছিল না। তবু তার কিছু কিছু আচরণ আমাকে বিতৃষ্ণা করে তুলত। বিশেষ করে যখন ওর শুকনো শূয়োরের মতো কালো লম্বা নস্য ভরা নাকটা আমার মুখে ঘষতে চাইত তখন আমার মনে হতো ওর মুখে আমি থু থু ছিটিয়ে দিই। কিন্তু আমি তা করতাম না। আমি ওকে সহ্য করতাম। আর তাছাড়া যে মেয়েগুলো ছিল তাদের আমি পছন্দই করতাম। ওরা একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করত যে, মাদাম সেল জিরদকে তুষ্ট করতে কিংবা আমার কাছে ঘেঁষার জন্য। আমি তখন এর মধ্যে খারাপ কিছু বোধ করিনি। এর মধ্যে বন্ধুত্ব বৈ আর কিছু ছিল? তখন থেকে আমি ভেবেছি এর মধ্যে এর অধিক কিছু থাকার কথা ভাবার থাকলে সে তো আমাকেই ভাবতে হবে। ওদের কী দোষ? কিন্তু আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। আমি কখনও এ নিয়ে চিন্তাও করিনি।

তাছাড়া, জামা-কাপড়ের দাসী, শোবার ঘরের পরিচারিকা বা বাজার করার মেয়ে : এদের প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ ছিল না। আমার আকর্ষণ ছিল তরুণী, যুবতী মেয়েদের জন্য। সবার স্বভাব তো এক নয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই। তাই এ ব্যাপারে হেরেস(৭)-এর সঙ্গে আমার চিন্তার যে মিল হবে এমন তো কোনও কথা নেই।

মোটকথা মেয়েটার জাত কী, তার বংশের মর্যাদা ইত্যাদি আমার আকর্ষণের কারণের মধ্যে পড়ত না। হ্যাঁ, রঙটা ফর্সা হলে, ওর হাত দুটি যদি সুন্দর হতো, চুলগুলো লম্বা, স্বভাবে একটা সুচারুতা এবং পরিচ্ছন্নতা থাকত, কাপড় চোপড়ে বাহারি তবে সেটি আমার আকর্ষণের বিন্দু হয়েই দাঁড়াত। পোশাক-পরিচ্ছদে মনোমুগ্ধকর হলে তার দেহের সৌন্দর্যের চাইতেও আমার মনকে অধিক ভোলাত। আমি বুঝি আমার এমন পছন্দের কথা খুলে বলা উচিত নয়। তবু একথা আমি স্বীকার করি এসব ক্ষেত্রে যা আমি বললাম, তাকেই আমি গুরুত্ব দিতাম।

হ্যাঁ, এবার মনে পড়ছে। আর একবার একটা সুযোগ জুটে গিয়েছিল। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে তাকে নিয়ে আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। আমার কৈশোরের সেই দিনগুলোতে আমার বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এগুলো আমার জীবনে এমন মধুর স্মৃতি ছিল এবং সেগুলো এত ক্ষণকালের ছিল : অথচ আমি তাদের একেবারে একটা সহজ প্রাপ্তি বলে মনে করতাম। এখন সেদিনের দিকে তাকালেই আমার মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং বাকি জীবন যেন তাকে এমনি করে স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারি, তার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি।

একদিনের একটা সকাল : কী চমৎকার আমার মনে হয়েছিল যে ঘুম থেকে উঠে আমার কাপড়-চোপড়ের পরোয়া না করে সূর্য ওঠার দৃশ্যটা দেখার জন্য আমি ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মন ভরে, আমার বুক ভরে সে দৃশ্যটা আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম। দিনটা ছিল ‘সেন্ট জন’ উৎসবের পরের দিন। চার দিকের পৃথিবীটা যেন বিচিত্র রঙে আর ফুলের বাহারে ভরে গিয়েছিল। কোকিলগুলো যেন ওদের কণ্ঠের শেষ ডাকটি শোনাচ্ছিল। এ যেন বসন্তের বিদায়ের মুহূর্তে প্রকৃতির সকল চরিত্রের মিলিত সঙ্গীত। গ্রীষ্মের আগমনে সকলেই সমস্বরে কণ্ঠ মেলাচ্ছিল। এমন শীতের দেশে এমন দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়।

এসব খেয়াল ছিল না। আমি শহর থেকে তখন বেশ কিছু দূরেই চলে গিয়েছিলাম। গরম ক্রমে বাড়ছিল। একটি পাহাড়ি ঝরনার পাশ দিয়ে আমি তখন হাঁটছিলাম। আমার পেছনে আমি ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলাম। মেয়েদের গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল। আমার পেছনে তাকালে আমি দেখলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। ডাকটা শুনে একটু এগুতে দুটি পরিচিত মেয়ে আমার নজরে পড়লো। অল্প বয়সের মেয়ে। এদের একটির নাম ছিল মাদামসেল গ্রাফেনরিড, অপরটির নাম মাদামসেল দা গ্যালি। এরা ওদের অশ্বের পরিচারিকা ছিল। কিন্তু ওরা ওদের ঘোড়াকে ঝরনাটা পার করাতে পারছিল না। মাদাম গ্রাফেনরিডের স্বভাবটি বেশ ভাল ছিল। ওর বাড়ি ছিল বোধ হয় বারনস-এ। কী এক ঘটনায় ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই মেয়েটাও মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করেছিল। আর মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর বাড়িতেই মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখি। কিন্তু ওর নিজের কোনও বেতনাদি না থাকতে ও মাদাম গ্যালের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। এই মাদাম গ্যালে তার মাকে বলে বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করে। গ্যালের সাথী হিসেবে মেয়েটা তাদের বাড়িতে থাকতে শুরু করে। গ্যালে এই মেয়েটার চাইতে বছর দুই ছোট ছিল। দেখতেও বেশি সুন্দর ছিল। ওর দৈহিক গঠনটাও বেশ বাড়-বাড়ন্ত ছিল। আসলে একটা মেয়ের শরীরের গঠনটাই আসল। ওরা পরস্পরকে ভালবাসত। ঝরনার ধারের ঘটনার সময়েই ওরা আমাকে এ কাহিনী শুনিয়েছিল। ওরা বলল : ওরা তুনের দিকে যাচ্ছে। গ্যালেরই সেখানে নাকি একটা বাড়ি ছিল। ওরা আমাকে ঘোড়াটা পার করে দিতে অনুরোধ করল। ওদের দুটো ঘোড়া ছিল। আমি ভাবলাম ঘোড়া দুটোকে চাবুক দিয়ে মারলে ওদের ঝরনা পার করানো যাবে। কিন্তু মেয়ে দুটো ভয় পেল। পাছে ঘোড়া দুটো লাফ দেয় এবং ওদের পিঠ থেকে ফেলে দেয়। আমি ভাবলাম, বরং আর একটা কাজ করি। গ্যালের ঘোড়াটার লাগাম ধরে টান দিই। তাহলে ঘোড়াটা নিশ্চয়ই ঝরনার স্রোতটা পার হয়ে যাবে। এই বুদ্ধিতে কাজ দিল। ঘোড়াটা আমার পেছনে পেছনে এসে ঝরনাটা পার হলো। অন্য ঘোড়াটাও প্রথমটার পেছনে এল। আমার একাজ সেরে আমি মেয়ে দুটোর কাছে আর কিছু দাবি না করে চলে আসাই ঠিক করেছিলাম। ওরা একটা আর একটার কানে ফিস ফিস করে কী যেন বলল। তখন মাদামসেল গ্রাকেনরিড আমার দিকে তাকিয়ে বলল : না, ছেলে তুমি এমন করে আমাদের ফাঁকি দিয়ে যেতে পার না। আমাদের সাহায্য করতে এসে তোমার কাপড়-চোপড় তো ভিজে একাকার হয়ে গেছে। আমাদের কিছু করার নেই নাকি? তোমার কাপড় চোপড় শুকাতে হবে না? তুমি আমাদের সঙ্গে এসো, বাছা। এখন তুমি আমাদের হাতে বন্দি। ওদের এমন কথাতে আমার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল। আমি মাদামসেল গ্যালের দিকে তাকালাম। সেও বলল : ঠিকই তো। তুমি এমন করে আমাদের ছেড়ে যেতে পারো না। তুমি ঐ ঘোড়াটার পেছনে ওর সঙ্গে চেপে বস। কিন্তু আমার ভয়কাতুরে ভাব দেখে ওরা দুজনে আমোদ পেল এবং হাসতে লাগল। আমি প্রথমে আপত্তি করলাম। আমি তোমাদের মাকে চিনিনে। তিনি আমাকে দেখে কী মনে করবেন? এর জবাবে গ্রাকেনরিড বলল; ওর মা তো এখন তুনের বাড়িতে নেই। আমরা আজ রাতেই ফিরে আসব। তুমিও তো তখন আমাদের সঙ্গে ফিরতে পারবে।

ওদের এমন কথায় আমার মধ্যে যেন একটা বিদ্যুৎ বয়ে গেল। আমি আনন্দে গলে গেলাম। আমি লাফ দিয়ে ওই মেয়েটার ঘোড়ার পেছনে চড়ে বসলাম। ঘোড়ার পিঠে উঠে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি যখন ওর দুপাশ দিয়ে হাত বাড়ালাম আমার হৃদস্পন্দন তখন এমনভাবে আরো বেড়ে গেল যে মেয়েটাও তা টের পেল। সে বলল, আরে আমার বুকও তো কাঁপছে। আমি যদি পড়ে যাই। তার এমন কথায় আমি ভাবলাম ওকে আমার সাহায্য করা দরকার, আর ওর বুক যেন না কাপে তার জন্য ওকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরা দরকার। মনে হলো ও যেন আমাকে তাই করতে বলছে। কিন্তু আমার কিছুতে সাহস হচ্ছিল না। তবু সমস্ত পথটা আমি ওকে আমার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম। একটা বেল্টের মতো আমি ওকে বেঁধে রাখলাম। আমার এ কাহিনী যে মেয়েরা পাঠ করবে, তারা আমাকে বিশ্বাসই করবে না। বিশ্বাস করবে না। সে কথা আমিও মনে করি। কিন্তু তবু আমি এর চাইতে বেশি তো সেদিন করিনি। করতে পারিনি।

আমাদের অভিযানটা সেদিন ভালই জমেছিল। সারাটা ফেরার পথ আমরা তিনজনে কথায়, আলাপে একেবারে টইটুম্বুর ছিলাম। মেয়ে দুটো তো বটেই। আমারও কথা আর হাসি ঠাট্টার কোনও অভাব ঘটেনি। এক মুহূর্তও আমরা নিঃশব্দ ছিলাম না। আমাকে ওরা এমন স্বচ্ছন্দ করে তুলল যে আমার কথার উজ্জ্বলতার যেমন কোনও বিরাম ছিল না, তেমনি চোখের দৃষ্টিতে কোনও পলক ছিল না। অবশ্য মুখ আর চোখের ক্রিয়া অভিন্ন ছিল না। কেবল যখন আমি দুটার একটার সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে ছিলাম তখনই মাত্র আমাদের পারস্পরিক আলাপের কিছুটা ভিন্নতা ঘটছিল। কোনও সময়ে হয়তো একটা নেমে যাচ্ছিল, আর একটা আমার সঙ্গেই ছিল। কথার বিরতি তখনি মাত্র। কিন্তু ও ফিরে এলেই আবার শুরু হতো। এবং তখন আমরা এতক্ষণ কে কতটুকু বিব্রত বোধ করেছি তার কারণ অনুসন্ধানের কোনও ব্যাপার ঘটেনি।

যখন আমরা তুনে পৌঁছলাম তখনি আমি একবার মাত্র কিছুটা প্রাকৃতিক কার্য সাধন করলাম। তুনে পৌঁছে আমরা সকালের নাশতা সম্পন্ন করলাম। পরের দিকে রাত্রির ভোজ বা ডিনারের আয়োজন হলো। তরুণী দুটি দু’এক সময়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে কৃষকটির বাচ্চা ক’টিকে আদর করছিল। আমাদের আচার আচরণ যে সেখানকার ভুত্যের চোখে খুব উপাদেয় ঠেকছে না, তা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। কিন্তু বেচারীর কিছু করার ছিল না। শহর থেকে খাবারের সবকিছুই আনা হয়েছিল। কেবল ভুলক্রমে মদ্য আনা হয়নি। এতে আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। মেয়ে দুটো মদ খায়নি। কিন্তু আমার বড় পিপাসা পাচ্ছিল। কারণ ওই বস্তুটি বাদে আমি আমার আচরণে সাহস যোগাড় করতে পারছিলাম না। আমার সাহসের জন্য ওটারই তখন বিশেষ প্রয়োজন পড়ছিল। মেয়ে দুটোরও মনে যে এ বস্তুর একটা অভাববোধ জাগছিল, তাও আমার মনে হয়নি। তবে ওদের আচরণ যেমন মনোহর, তেমনি নিষ্পাপ ধরনের ছিল। তাছাড়া ওরা দুটো আমাকে নিয়ে কী-বা করতে পারত? ওরা দেখলাম, গ্রামটির চারদিকেই খুঁজে বেড়াল কিছু মদ্য সংগ্রহ করা যায় কিনা। কিন্তু তেমন কিছুই জুটল না। চারপাশের লোকজনের দারিদ্র ছিল এমনি ভয়ানক। এই ক্যানটনটির চাষীরা এতই দরিদ্র ছিল। গ্রামের লোক নিজেদের মনের দুঃখ প্রকাশ করল। আমি বললাম; আপনারা এত দুঃখ করবেন না। আমাদের উত্তেজনার জন্য ওই বস্তুর তেমন দরকার নেই। আমি এভাবেই সেদিন তাদের প্রশংসা করার একটু সাহস দেখিয়েছিলাম। তবে গ্রামের লোকজনরা আমার প্রশংসাকে আমার আন্তরিকতারই প্রকাশ হিসেবে নিয়েছিল।

কৃষকদের রান্নাঘরেই আমাদের সন্ধ্যার আহারের ব্যবস্থা করা হলো। একটি লম্বা টেবিলের দু’পাশে আমরা বসলাম। বাড়ির আর যে অতিথি ছিল তারা ভিন্ন টুলে বসল। কিন্তু তবু সেদিনের সেই ভোজটি আমার মনের মধ্যে আটকে আছে। এটি আমার মনের একটি মধুর স্মৃতি। একটি লোক যখন এত সহজে এমন সুন্দর আনন্দ লাভ করে, তখন তার ভিন্নতর আনন্দের কী প্রয়োজন? প্যারিসের কোনও অভিজাত ভোজনালয়েই সেদিনের সেই গ্রামের এমন আপ্যায়ন আমি লাভ করতে পারতাম না। শুধু সাধারণ আনন্দের জন্য নয়। এমনকি ইন্দ্রিয়জ আনন্দও আমি সেদিন কম পাইনি।

রাতের এই ভোজের পরে আমরা একটু বিরাম নিলাম। কফি না খেয়ে একটু পরে আমরা চা খেলাম। চায়ের সঙ্গে আমরা ক্রিম আর কেকেরও ভাগ পেলাম। আমি আমার ক্ষিধেটাকে বাড়াবার জন্য একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। ফল-ফলারির বাগানের মধ্যে ঘুরলাম। আমি তো একটা চেরী গাছের ওপর উঠে পড়লাম। বেশ কিছু চেরী ফলও আমি পাড়লাম। আমি গাছ থেকে নিচে ওদের দিকে জাম ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম। ওরা আবার জামের আঁটিগুলো আমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। একবার দেখলাম মাদামসেল গ্যালী নিজের গায়ের এ্যাপ্রন ধরে মাথাটি পেছনে ঠেলে একটি সুন্দর মূর্তিতে আমার গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। আমিও মজা করতে এক গুচ্ছ চেরী এমনভাবে তাকে তাক করে ছুঁড়ে মারলাম যে চেরীগুলো যথার্থই তার বুকে গিয়ে আছড়ে পড়ল। এমন ঘটনায় আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আমি তখন নিজের মনেই বললাম : আমার ঠোঁট দুটি যদি যথার্থ চেরী হতো তাহলে সে দুটোকেও আমি এমনি করে তার বুকের ঠিক জায়গাটি তাক করে ছুঁড়ে মারতাম। দিনটা এভাবেই কাটল ভারী মজায় এবং আনন্দে। আমরা পরস্পর যেমন ইচ্ছা তেমন আচরণে রত হলাম। কিন্তু কোনও সময়েই আমরা শালীনতাকে অতিক্রম করিনি। আমাদের শালীনতাতে কোনও কৃত্রিমতা ছিল না। যেমন স্বত:স্ফূর্ত, তেমন সারল্যপূর্ণ। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছি, যেমন মন চাইছে তেমনভাবে কথা বলেছি। মোটকথা আমার এমন শালীনতা এবং সারল্যকে অপর কেউ হয়তো নির্বুদ্ধিতা বলেই আখ্যায়িত করবে। তবু আমি বলব, আমাদের সেদিনকার ব্যাপারটা যথার্থ এরকমই ছিল। এর মধ্যে যে ঘটনাটিতে আমি একটু সাহসের পরিচয় দিয়েছিলাম, সে কেবল তখন যখন আমি মাদামসেল গ্যালের একটি হাতকে চুম্বন করেছিলাম। এ কথা সত্য যে আবহাওয়াটা এমনি হয়ে উঠেছিল যে আমার এমন আচরণে কোনও আধিক্য ঘটেনি। আমরা দুজনে : গ্যালে এবং আমি একটু আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। ওর চোখ দুটিও আমার হাতের দিকে নত হয়ে পড়েছিল। আমার ঠোঁটে কোনও শব্দ ছিল না। কেবল ঠোঁট দুটি ওর হাতের ওপর নেমে এসেছিল। সে হাতটি টেনে নেয়নি। আমার চুম্বনটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্যালে তার হাতটি আমার ঠোঁটের ওপর ধরেই রেখেছিল। আমার চুম্বনটি শেষ হলেই মাত্র গ্যালে তার হাতটি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। তার দৃষ্টিতে কোনও অনিচ্ছার ভাব ছিল না। ওকে আর একটু পেলে আমি ওকে কি বলতাম জানিনে। কিন্তু অপর মেয়েটা তখনি ঘরের মধ্যে ঢুকল। আমার মনটা অবশ্য তখন ওর প্রতি ঘৃণায় বিষিয়ে উঠেছিল।

এমনভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গিয়েছিল। শেষে ওরাই বলল শহরে ফিরে যেতে হবে। আর আমাদের অপেক্ষা করা উচিত নয়। তাহলে বেশি রাত হয়ে যাবে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। তাই আমরা একটু তাড়া করে যেমন এসেছিলাম তেমন। করেই আবার শহরে ফিরে গেলাম। আমার যদি সাহস থাকত তাহলে ফেরার পথে আমি গ্যালের ঘোড়াটাতেই উঠে বসতে পারতাম। মাদামসেল গ্যালের আচরণটি আমার মনকে সেদিন অভিভূত করে ফেলেছিল। কিন্তু আমি যেমন কিছু বলতে সাহস পেলাম না, তেমনি ওর পক্ষেও কোনও কথা বলার ছিল না। ফিরে আসার পথে অবশ্য আমরা সকলেই বললাম : আহা! দিনটা এত দ্রুত শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাতে আমাদের কোনও খেদ ছিল না। বরং আমরা যে সময়টাকে নষ্ট করিনি। সময়টাকে আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি, তাতেই আমাদের মন আনন্দে ভরা ছিল।

যে জায়গাটিতে ওরা আমায় পেয়েছিল, ফেরার পথে সেই জায়গাটিতেই ওদের ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম। আমাদের বিদায়ের মধ্যে একটা বেদনাবোধ ছিল। যে বারটা ঘণ্টা আমরা এক সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গভাবে কাটিয়েছিলাম, সে কয়েকটা ঘণ্টা আমাদের কাছে শতবর্ষের মতোই দীর্ঘ বলে বোধ হয়েছিল। সেই দিনটির মধুর স্মৃতি মেয়ে দুটির কিংবা আমার কোনও ক্ষতিই সাধন করেনি। আমাদের তিন জনেরই অন্তরঙ্গতা অনন্ত আনন্দেরই ব্যাপার ছিল। আমরা তিনজনেই সেদিন পরস্পরকে যথার্থই ভালবেসেছিলাম। সে ভালবাসাতে কোনও লুকোচুরি ছিল না। তাতে আমাদের কারুরই লজ্জাবোধের কোনও কারণ ছিল না। আমাদের মনে এমন ইচ্ছাই ছিল যেন আমাদের এই অন্তরঙ্গতা অনন্তকালই স্থায়ী হয়ে থাকে।

চরিত্রের এমন নিষ্কলঙ্ক আচরণের আনন্দটা অপর কিছুর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। আমার দিক থেকে বললে আমিও বলব এমন আনন্দের স্মৃতি আমার জীবনে খুব কমই ঘটেছে। আমি এখনও বুঝিনে মেয়ে দুটিকে একান্তে পেয়ে আমি কী করতে পারতাম। কী আমি করতে চেয়েছিলাম। আমি দু’জনকেই ভালবেসেছিলাম। অবশ্য দুটিকে যদি বাছাই করতে হতো তাহলে একটি যে অপরটির চাইতে আমার কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে বোধ হতো না, এমন কথাও আমি বলতে পারিনে। দুয়ের মধ্যে একটির প্রতি আমার একটু অধিকতর আকর্ষণের ব্যাপার অবশ্যই ছিল। মাদামসেল গ্রাফেনরিডকে কাছে পেলে আমি অবশ্যই অধিকতর খুশি হতাম। আমার হাতে আমার ভাগ্যকে সেদিন স্থির করার ক্ষমতা যদি থাকত তাহলে আমি অবশ্যই গ্রাফেনরিডকেই আমার জীবন সঙ্গিনী করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতাম। তাকে আমি একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবেই গ্রহণ করতাম। সে যাই হোক আমাদের বিদায়ের মুহূর্তে আমার মনে হলো, এ দুটির কাউকে আমি ছাড়তে পারিনে। দুটিই আমার জীবনকে ভরে থাকুক, এটিই আমার ইচ্ছা ছিল। এদের কাউকে আমি আর জীবনে দেখতে পাবো না, এ কথা আমি সেদিন ভাবতে পারিনি। সেই একদিনের ভালবাসা একদিনেই শেষ হয়ে যাবে, এমন আমি কল্পনা করতে পারিনি। আমি জানি আমার এই কাহিনীর পাঠকরা আমার প্রেমের এমন কাহিনী শুনে না হেসে পারবেন না। তারা বলবেন : যার জন্য এত প্রস্তুতি তার পরিণতি কিনা শেষ পর্যন্ত একটি মাত্র চুম্বনে! আমি আমার পাঠকদের বিনীতভাবে বলব : এ মহাশয়গণ, একটু ভুল করছেন। আমার যে-প্রেম সেদিন একটি হাতের চুম্বনে শেষ হয়েছে সেই চুম্বনটি থেকে আমি যে আনন্দ লাভ করেছিলাম, আপনারা চুম্বন দিয়ে শুরু করে যা দিয়ে শেষ করেন তাতে আপনারা আমার আনন্দের ভগ্নাংশটুকুও লাভ করতে পারেন না।

.

[পরবর্তীতে রুশো নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকারের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় লাভ করেন। তার নাম ছিল মশিয়ে সাইমন।]

.

সেই মশিয়ে সাইমনের কথা বলছিলাম। তিনি তার ক্ষমতাবোধে গর্ববোধ করতেন। তবু তার চেহারার একটু বর্ণনা না দিলে তার চরিত্রটিকে আপনারা ধরতে পারবেন না। তিনি উচ্চতায় খাটো ছিলেন। কিন্তু তা বলে মাত্র তিন ফুট নন। তাঁর পা দুটি শীর্ণকায় এবং সরু ছিল। সে দুটিকে যদি তার ৯০ ডিগ্রীর সমকোণ তৈরিকারী বিস্তারে বিস্তারিত না করে আর একটু ভেতরে আনা যেত তাহলে তিনি আর একটু দীর্ঘ বলেই দৃষ্ট হতেন। কিন্তু বেচারার কী দুর্ভাগ্য! তা সম্ভব ছিল না। তিনি দাঁড়ালে তার শীর্ণ সেই পা দুটি বিস্তারে একটি জ্যামিতিক অবটুন বা সমকৌণিক ক্ষেত্রই তৈরি হতো। কম্পাসের দু’টি কাটার বিস্তারে যেমন তৈরি হয়। তার দেহটি কেবল যে ক্ষুদ্র ছিল তাই নয়। সেটি বর্ণনাতীতভাবে খর্বকায় ছিল। বস্ত্রবিহীন অবস্থায় তাকে নিশ্চয়ই একটি ফড়িং-এর মতো মনে হতো। তার মাথাটিতে কোনও অসাধারণত্ব ছিল না। সেটি বেশ সুগঠিতই ছিল। তার মুখটি সুন্দর ছিল, তার চোখ দু’টি আকর্ষণীয় ছিল। তবু মাথাটির দিকে চাইলে মনে হতো যেন একটি নাতিদীর্ঘ। কাঠির ওপর বসানো মাথা নয়, একটি বস্তু। তার নিজের দেহটি আবৃত করতে পোশাকাদিতে তেমন কিছু তাকে খরচই করতে হতো না। তার লম্বা আলখাল্লাটিতেই তার দেহের আপাদমস্তক ঢাকা পড়ে যেত। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরটি আশ্চর্য ছিল। তার কণ্ঠ থেকে একটি নয় দুটি স্বর বেরিয়ে আসত। এবং উচ্চারিত হওয়ার পরে একটি জায়গাতে এসে দুটি স্বর যেন অভিন্ন হয়ে উঠত। তার এমন কণ্ঠস্বর শুনতে প্রথমে মজাই লাগত। কিন্তু একটু বিলম্বিত হলেই সেটি অসহনীয় বলে বোধ হতো। স্বরের একটি ছিল ভারী, গম্ভীর প্রকৃতির। অপরটি উচ্চ ধ্বনিশীল। আমি এখনও বলতে পারি যে সেই স্বরের একটি ছিল মস্তিষ্কের স্বর। অপরটি স্পষ্ট তীক্ষ্ণ দেহভেদী। এটি ছিল তার দেহের স্বর। তবে তিনি যখন চিন্তা করে কথা বলতেন এবং তার শ্বাস-প্রশ্বাস তার নিয়ন্ত্রণে থাকত তখন তিনি ভালভাবেই কথা বলতে পারতেন। কিন্তু একটু উত্তেজিত হলেই এবং একটু উচ্চস্বরে শব্দ উচ্চারণের চেষ্টা করতেন তখন তার কণ্ঠ থেকে একটি যেন বাঁশির আওয়াজ বের হতো এবং তখন আবার সেই স্বরকে একটি স্থিরতায় আনতে তাকে বিষম বেগ পেতে হতো।

যথার্থই কোনও অতিরঞ্জন বাদে মশিয়ে সাইমনের আকার-আকৃতির যে বিবরণ আমি দিলাম তা সত্ত্বেও মশিয়ে সাইমন একজন ভদ্র এবং পদস্থ অমাত্য ছিলেন। তার বেশভূষায় তিনি সচেতন এবং ফিটফাট ছিলেন। তাতে কিছুটা আধিক্য থাকলেও তা কোনও অন্যায্য ব্যাপার ছিল না। তার নিজের গুণসম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন এবং তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন। একজন দর্শনার্থীকে তার শয্যায় শায়িত অবস্থাতেই দর্শন দিতেন। ফলে কারোর পক্ষে তার মাথাটি দেখে তার বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে আন্দাজ করা আদৌ সম্ভব হতো না। ফলে কোনও কোনও সময়ে এতে অবাঞ্ছিত অবস্থারও সৃষ্টি হতো। এ্যানেসি পরিবারের সকলেই ব্যাপারটিকে বুঝতে পারতেন এবং তাদের স্মৃতিতে যে ব্যাপারটি এখন বিরাজ করছে, তাও আমি বিশ্বাস করি। এক সকালে এমন হলো যে মশিয়ে সাইমন যখন তার শয্যায় একটি সুন্দর টুপি পরিহিত অবস্থায় দর্শন প্রার্থীদের দর্শনদানের জন্য অবস্থান করছিলেন তখন গ্রাম থেকে একজন দেশোয়ালী দরজায় এসে শব্দ করল। ঘরের দাসীটি তখন ঘরে ছিল না, বাইরে গিয়েছিল। দরজায় আবার শব্দ হতে মশিয়ে সাইমন চিৎকার করে উঠলেন : ভেতরে আসতে বলছি না? তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত সে শব্দ এমন কর্কশ ছিল যে আগন্তুক মনে করল এ বুঝি ঘরের দাসীটির গলা। কিন্তু সে অবাক হচ্ছিল এই ভেবে কোনও মেয়েলোকের গলা কি এমন কর্কশ হতে পারে? লোকটি ভেতরে ঢুকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল যে মেয়েলোকটি শব্দ করল সে মেয়েলোকটি কোথায়? কিন্তু কোনও মেয়েলোককে না দেখতে পেয়ে সে নিজের সঙ্কোচ থেকে আবার ঘরের বাইরে চেলে গেল। এতে মশিয়ে সাইমনের ক্রোধ আরও বেড়ে গেল এবং আগের চাইতেও কর্কশ কণ্ঠে তিনি হুকুমটি আবার উচ্চারণ করলেন : কী হলো? ভেতরে আস। গ্রাম থেকে আগত লোকটি বুঝল এই লোকটিই আসল লোক। সে এই লোকটির আচরণে যথার্থই রাগান্বিত হলো এবং সেও চিৎকার করে বলল : আসলেই তুই একটা বেশ্যা। মশিয়ে সাইমনের ক্রোধের সীমা রইল না। তার হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে টেবিলের ভারী ফুলদানিটা তার দিকে ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছিল : এমন সময়ে তার ঘরে দাসীটি এসে ঘরে ঢুকল।

.

[মাদামসেল মারসিরেট ফ্রি ভোর্জে তার পরিবারের নিকট ফিরে যাওয়ার ঠিক করলেন এবং তিনি রুশোকে তার নিজের পরিচর্যাকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন।]

.

আমার এতগুলো মেয়েপ্রেমিক সম্পর্কে এমন বিস্তারিতভাবে কথা বলতে আমার সংকোচই হচ্ছে। তবে এসব প্রেমোপাখ্যান থেকে আমি যা লাভ করেছি তা নিয়ে গর্ব করছিনে। আর সে জন্যই সত্যই যা ঘটেছিল তাকে স্মরণ করতে আমার কোনও বাধা নেই। মারসারেত যে বয়সে একটু যুবতী ছিল সে জিরদের ন্যায় চালাক ছিল না। কিন্তু সে আমাকে তেমন অধিক প্রেম নিবেদনও করেনি। তবে ও যেরূপ নিখুঁতভাবে আমার গলার স্বর, কথার উচ্চারণ সব কিছু নকল করতে পারত, তাতে এখন আমার মনে হচ্ছে ওর প্রতি আমার আর একটু নজর দেয়া উচিত ছিল। আমার চরিত্রে একটা সংকোচ ছিল। তাই রাতে আমরা দুজনে এক ঘরেই ঘুমাতে যেতাম। কিন্তু একটি বিশ বছরের আমার মতো যুবক আর আমার চাইতে একটু বড়, একজন ২৫ বছরের যুবতী এদের রাত যাপন কি ঘটনাবিহীন থাকে?

কিন্তু যখনকার কথা বলছি তখন কিন্তু ব্যাপারটা এমনিই ছিল। ঘটনাবিহীন। আমার সারল্য এমনিই ছিল যে, মারসারেত দেখতে শুনতে তেমন আকর্ষণীয় না হলেও, কোনও সময়ই আমি ওর প্রতি কোনও পুরুষত্বের ভাব দেখাইনি। সে ছিল আমাদের দুজনের একটা ভ্রমণের ঘটনা। তবু দীর্ঘ যাত্রার সেই পথে আমার মনে দেহজ কোনও অনুভূতি আদৌ জাগ্রত হয়নি। আর যদি বা কখনও এমন কোনও অনুভূতির উদয়ও হতো, তবু আমি তো জানতাম না, কী দিয়ে কী করতে হয়। আমার নিজের কল্পনায়ও আসেনি একটি যুবক যদি একটি যুবতীর সঙ্গে দীর্ঘপথ পাড়িও দেয়, তবু আবার কল্পনায় এমন ভাব আমার কখনওই আসেনি যে তাহলে আমাদের দুজনার কী করা আবশ্যক। এক সাথে দু’জনার শয্যা গ্রহণের কথাটা আমি ভাবতেই পারতাম না। আসলে আমার এখনও মনে হয় একটি যুবক-যুবতীর এমন অন্তরঙ্গের জন্য তাদের উভয়কে যুগ যুগ ধরে তৈরি হতে হয়। মারসারেতটা গরিবই ছিল। ও যদি আমার জন্য কিছু খরচ করত তখন যদি ও কোনও প্রতিদানের আশা করত, তখন তাকে আশাহতই হতে হতো। শেষ পর্যন্ত আমরা দু’জনেই ক্রাইবোরগ পৌঁছলাম : একেবারে যেমনভাবে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, এ্যানেসি থেকে। ঠিক সেভাবেই।

জেনেভা পৌঁছার পর আমি কারও সঙ্গে দেখা করিনি। কিন্তু জেনেভা সেতু অতিক্রমকালে আমি যেন ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এই সুখি সুন্দর নগরটির প্রকারগুলো আমি কোনওদিন দেখিনি, বেদনায় বিদ্ধ না হয়ে কোনওদিন এর দ্বারগুলো পার হইনি। তখন আমি গভীর আবেগে অভিভূত হয়েছি। এই নগরীর মুক্ত দরোজায় দাঁড়িয়ে আমি এই নগরীর মহৎ স্বাধীনতার বোধ দ্বারা আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছি : আহা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মানুষের একের প্রতি অপরের আচরণের সৌজন্যের দৃশ্যে আমার চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমার অনুতাপ হয়েছে এই দেখে : হায়, আমি তো এসবই হারিয়েছি। আমার দুঃখ এ জন্য যে আমি ভেবেছি আমার হৃদয়ে অন্তর্গত এই সম্পদ তো আমি বহন করছি এবং তাতেই যেন আমার দর্শন ঘটে গেছে। না আমি দেখিনি, এই বোধটাই ছিল আমার ভ্রান্ত।

নিয়ন পার হয়ে আমাদের এগুতে হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে আমার পিতাকে না দেখে আমি এগুব? যদি আমি সত্যই এমনটা করতাম, তাহলে তা আমার মৃত্যুরও বাড়া হতো। আমি পান্থশালাতে মারসারেতকে রেখে, যা হয় হোক ভেবে আমি আমার পিতার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন যে অবস্থা হলো তা একেবারেই অবর্ণনীয়। কী মূর্খ আমি ছিলাম। এই বাবার কাছে আসতে আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমাকে দর্শন মাত্র তিনি তার বুকে রক্ষিত সমস্ত স্নেহের স্বর্গ আমার জন্য মুক্ত করে দিলেন। তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। আমরা দু’জন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলাম। তিনি প্রথমে ভাবলেন আমি বোধ হয় তার বুকে সত্যই ফিরে এসেছি। আর তাকে ছেড়ে যাবো না। কিন্তু আমি তাকে আমার সব কাহিনীর কথা বললাম। আমার স্থির সিদ্ধান্তের কথাও তাকে জানালাম। তিনি আমার সিদ্ধান্তে বিস্মিত হলেন না। এর বিরুদ্ধে তার বাধা তেমন কিছু প্রবল ছিল না। তিনি অবশ্য আমাকে বললেন, এমন সিদ্ধান্তের মারাত্মক বিপদ কী হতে পারে। তবু তিনি আমাকে বাধা দিলেন না। বললেন ক্ষণিকের ভুলও পরিণামে মহৎ বলে দৃষ্ট হতে পারে। আর তাই আমাকে জোর করে আটকে রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা তিনি করলেন না। এখন সে স্মৃতিতে আমি মনে করছি, তার বোধটিই সঠিক ছিল। আবার একথাও ঠিক যে আমাকে আমার পথ থেকে ফেরাবার যে চেষ্টা তিনি করতে পারতেন। তা তিনি করেননি। আমি জানিনে তিনি একথা ভেবেছিলেন কিনা, আমি যে রাস্তায় নেমেছি তা থেকে আমার যথার্থই ফেরা উচিত কিনা! অথবা আমার সেই বয়সে আমাকে নিয়ে তিনি কী করবেন তা তিনি যথার্থই বুঝতে পারছিলেন না। তবে আমার মনে হচ্ছে আমার পথের সঙ্গী সম্পর্কে যে ধারণা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা তার পক্ষে স্বাভাবিক হলেও, সে ধারণা তার ভুল ছিল।…

কোনও দুর্ঘটনা বাদেই আমরা ফ্রিবুর্গ পৌঁছে গেলাম। এই ভ্রমণের শেষের দিকে আমার প্রতি আমার সঙ্গিনীর প্রতি প্রকাশে কিছুটা ভাটা পড়ল। এখানে পৌঁছার পর আমার প্রতি আচরণ, বলা চলে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তার বাবাও যে টাকায় গড়াগড়ি দিচ্ছিল, এমন নয়। এবং আমার প্রতিও তার আচরণে তেমন কোনও সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেনি। রাতে ঘুমাবার জন্য আমি একটা সরাইতে গেলাম। পরের দিন তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গেলে তারা আমাকে মধ্যাহ্ন ভোজেরও আমন্ত্রণ জানাল। আমন্ত্রণটি আমি গ্রহণ করলাম। তারপরেই আমরা শুকনো চোখেই পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিকেলে আমার পরিচিত শারাবের দোকানটাতে গেলাম এবং এখানে পৌঁছার দুদিনের মাথায় আমার গন্তব্য কোথায় তা না জেনেই আমি অজানার উদ্দেশ্যে জায়গাটা পরিত্যাগ করলাম।

আবার এই সময়েই আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যার ফলে আমি যেন যা চাচ্ছিলাম ভাগ্য আমাকে তাই দিয়ে দিল। আমি সুখের মুখ দেখতে পেলাম। মারসারেত মেয়েটা বেশ ভাল মেয়েই ছিল। খুব যে সুন্দরী তা অবশ্য নয়। ওর কাছ থেকে উত্তেজনা পাওয়ার মতো কিছু ছিল না। ওর আচরণ মাঝে মাঝে খারাপ হতে লাগল। দুজনের মধ্যে রাগারাগির প্রকাশ ঘটত : কান্নাকাটিরও ব্যাপার ঘটত। তবে এর বেশি মারাত্মক কিছু নয়। এদিক থেকে বলতে হয় মেয়েটার বুদ্ধি ছিল। আমার প্রতি ওর একটা আকর্ষণও ছিল। আমি চাইলে ওকে বিয়ে করে ওর বাবার ব্যবসাতে যোগ দিতেও পারতাম। সঙ্গীতের প্রতি আমার আকর্ষণ আমার জীবনটাকে সুখি করেই তুলত। ফ্রিবুর্গ একটা ছোট শহর ছিল। তেমন সুন্দর নয়। কিন্তু শহরের লোকজন বেশ সরল স্বভাবের ছিল। আনন্দফুর্তির জায়গা তেমন ছিল না। তবু সেখানে থাকলে জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত আমি শান্তিতেই কাটাতে পারতাম।

আর এমন ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার তা আমার চাইতে ভাল আর কে জানত। তবু আমার মনের প্রশ্ন যে আমি আমার কৈশোরে এমন সব সুন্দর মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, সে কেন তার উত্তর জীবনে মহৎ মানুষের এমন অভাবের মধ্যে পড়লাম? তাহলে কি উত্তম মানুষ জাতিগতভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল? না, কথাটা তা নয়। আসলে এখন আমার জীবন যে শ্রেণীটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল, সে আমার কৈশোরের সেই শ্রেণী নয়। উচ্চতর যে শ্রেণীর সঙ্গে আমার কৈশোরের সেই যোগ ঘটল তাদের মধ্যে আবেগ আর মায়া-মমতার প্রকাশ কালে-ভদ্রেই মাত্র ঘটে। নিম্নতর শ্রেণীর মানুষের মায়াই আসল মায়া। উচ্চতর শ্রেণীর মুখোশধারী মানুষের মধ্যে তার প্রকাশ একেবারেই দুর্লভ। এখানে কেবলই স্বার্থ, অহঙ্কার আর ঔদ্ধত্তের প্রকাশ। …

এবার আমি এক সঙ্গীত শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম। অথচ সঙ্গীতের রাগ রাগিনীর আমি কিছুই জানিনে। লা মাইতারের সঙ্গে আমি যে ছ’টা মাস কাটিয়েছিলাম তার অভিজ্ঞতাও এ ব্যাপারে আমার খুব উপকারে আসেনি। তাছাড়া আমি যে শিক্ষকের কাছ থেকে সঙ্গীত শিখেছিলাম সে আমাকে প্রায় সঙ্গীতের মুখতেই পর্যবসিত করে দিয়েছিল। সে ছিল জেনেভা থেকে আগত এক প্যারিসীয় এবং বিশ্বাসে একটা প্রটেস্ট্যান্ট দেশে এক ক্যাথলিক। আমি নিজের কথা বলছি। আমি ভাবলাম, এবার আমার নিজস্ব বলতে যা বুঝায়, তার সবই আমাকে পরিবর্তন করতে হবে। আমার নামকে বদলাতে হবে। আমার ধর্মীয় বিশ্বাসকে এবং আমার দেশকে পরিত্যাগ করতে হবে। আমার যেটি আদর্শ ব্যক্তি ছিল, আমি তাকে যথাসাধ্য অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। তার নাম বলতে পারি ডেনচার। সে গান বাঁধতে জানত, একথা ঠিক। তবে একথা সে আমাকে কখনো বলেনি। আর আমি গানের কিছুই না জেনে নিজেকে এক সঙ্গীত বিশারদ বলে চালাতে শুরু করলাম।

.

[রুশো এবার একটি যাত্রাদলের জন্য গান বাঁধতে শুরু করল।]

.

দলটি একটা জায়গায় আমার বাঁধা গানের প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিল। আমি কোরাস দলের প্রত্যেককে বলতে লাগলাম, কোথায় কী রাগের ওঠা-নামা করতে হবে। ড্রামগুলোর বাদন কেমন হবে। রিহার্সাল হলো। আহা মূর্খ রুশোর কী করুণ। অবস্থা। কপালে আমার ঘাম জমছে। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠছে : একি পাগলামী, পাগলের গান : অসহ্য! আহা বেচারি রুশো : কেবল তুমি যদি জানতে একদিন এই রুশোই ফ্রান্সের সম্রাটের রাজ দরবারে সঙ্গীত পেশ করবে এবং দরবারের নামীদামি সবাই তাকে বাহবা দানে ফেটে পড়বে। চারপাশে উপবিষ্ট সুন্দরীগণ রুশোর সঙ্গীতের দক্ষতায় একেবারে বিমোহিত হয়ে বলবে; আহা কী মহৎ সঙ্গীত। কী রাগ, কী রাগিনী! একেবারে মর্মের ভেতরে প্রবেশ করে যায়। কী অদ্ভুত!

কিন্তু যেটা সকলকে আমোদিত করে তুলল সে হচ্ছে “মিনুরেটের কার্য। কয়েকটি রাগ বাজাতেই আমি চারপাশে হাসির হল্লা শুনতে লাগলাম। সবাই আমার অভিনন্দনে কেটে পড়ল। আমার সুরের জ্ঞানের গভীরতায় তারা একেবারে বিমোহিত হয়ে গেল। তারা সবাই চলতে লাগল ‘সিনুয়েটে’ আমার এই দক্ষতা আমাকে খ্যাতির চূড়ায় অবশ্যই নিয়ে যাবে। আমার গানের পালা সবখানেই অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার বলে তারা সবাই উচ্চেস্বরে মত প্রকাশ করতে লাগল। এ সম্পর্কে আর বেশি না বলাই ভাল। আমার মনে দুঃখেরও শেষ ছিল না। আর এটাই যে আমার প্রাপ্য তাকে বুঝতেও আমার কোন অসুবিধা হয়নি।

.

[সঙ্গীত শিক্ষাদানের এমন প্রচেষ্টায় রুশোর জীবনে নেমে এল এক চরম দুরবস্থা।]

.

রুশোর যে অভিজাত মাদামের আশ্রয়ে থাকার সময়ে তাকে মামা বলে সম্বোধন করত, তাকে সে জীবনে আর বিস্মৃত হতে পারেনি।

হ্যাঁ, একথা ঠিক যে বেশ কদিন যাবৎ আমি আমার মনের স্মৃতিতেও মামার কথা উচ্চারণ করিনি। তবু একথা ঠিক নয় যে, আমি তাকে বিস্মৃত হয়ে গেছি। না, আমি তাকে কখনও বিস্মৃত হইনি। আমার সর্বক্ষণের কামনা আহা, আমি যদি আবার তার কাছে ফিরে যেতে পারতাম। তার কাছে আমার প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা আমার অস্তিত্বরক্ষার কারণে নয়। তা আমার অন্তরের তৃষ্ণার কারণে। আমি তার মমতার কাছে চিরবন্দি। কিন্তু সে বন্দিত্ব আমার এমন নয় যে তা আমাকে আমার জীবনে অপর কাউকে ভালবাসা থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। কিন্তু অপরকে ভালবাসা আর আমার সেই মামাকে ভালবাসা এক কথা নয়। হ্যাঁ, অপর কাউকে ভালবেসেছি তাদের আপন আপন সৌন্দর্যের কারণে। আর তাই এমন সুন্দরীদের বিদায়ে আমার কোনও বেদনা ছিল না। কিন্তু মামার প্রতি আমার ভালবাসা কেবল তার সৌন্দর্যের কারণে নয়। তিনি বৃদ্ধ হতেন এবং অসুন্দরও হতেন তবু আমি আমার সেই কৈশোরের ভালবাসা দিয়ে জীবনভর ভালবাসতাম। তিনি আমার কৃতজ্ঞতার উৎস তা আমি জানি। তবু তিনি আমার জন্য যাই-ই করে থাকুন বা না থাকুন, তাঁর প্রতি আমার ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটত না। আমি তাকে ভালবেসেছি কোন স্বার্থ বা কর্তব্যবোধ থেকে নয়। আমি তাকে ভালবেসেছি, কারণ এই আমার যে আমার জন্মই ঘটেছে তাকে ভালবাসার জন্য। অন্য কোনও মেয়েকে যখন আমি ভালবেসেছি তখন আমার আকর্ষণের কেন্দ্র থেকে তিনি হয়ত ক্ষণিকের জন্য সরে গেছেন। তবু আবার যখন আমার চিন্তায় মনে ফিরে এসেছেন তখন আমিও তার ভালবাসায় অবগাহন করেছি। আমিও প্রত্যাবর্তন করেছি তার ভালবাসার প্রতিমূর্তির কাছে। এবং তাতেই আমার ঘটেছে জীবনের যথার্থ সুখ। তাই তার অস্তিত্ব থেকে আমার জীবনে কখনও বিচ্ছেদ ঘটেনি।

.

[এর পরবর্তীতে আমরা দেখি, রুশোর ‘ভেভে’ নামের ক্যান্টনে চারদিনের পদযাত্রার শেষে এসে পৌঁছেছে।]

.

যখনি আমি এই ক্যান্টন ভেভের কথা স্মরণ করি তখনি আমি যেমন মাদার ওয়ারেনসকে স্মরণ করি। কারণ তার জন্মও এখানে, তেমনি আমি স্মরণ করি আমার পিতাকে। তিনিও তো এক সময় এখানে ছিলেন। আমি স্মরণ করি মাদামসেল দা ভালসনকে। আমার কৈশোরের অন্যতম পাত্রী ছিলেন মাদামসেল দা ভালসন। ভেভে ক্যান্টনের স্মৃতি নানা কারণে আমার মনে স্থায়ী দাগ কেটে রেখেছে। তার কোনওটি থেকে অন্য কোনওটিকে আজ আমি বিচ্ছিন্ন করতে পারিনে। সেই বিগত মুখ আর শান্তিময় জীবনের কথা ভাবি তখন আমি আর নিজেকে স্মৃতির টানে সেই ক্যান্টন ভেভেতে প্রত্যাবর্তনের আকর্ষণকে রোধ করতে পারিনে। চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে অপার সুন্দর সেই হ্রদটি আমার স্মৃতির পুকুরে ভেসে ওঠে। আর এই হ্রদের পাড়ে যদি আমার একটি বাগান থাকত। এবং সেখানে যদি আমার একটি ভালবাসার পাত্র থাকত, একজন বন্ধু থাকত। আর আমার যদি একটি বউ থাকত। এবং একটি গরু এবং হ্রদের জলে ভেসে বেড়াবার জন্য একটি ছোট নৌকো থাকত।

আর যথার্থই কতবার যে আমি স্থানটিতে এসেছি : কেবল আমার কল্পনার সেই জীবনটিকে বাস্তবে অস্তিতৃময় হিসেবে দেখতে। পুরো সুখ কাকে বলে আমি জানিনে। তবু যতদিন না আমি তাকে পাব ততদিন এই স্থানটিতে বারংবার আমাকে প্রত্যাবর্তন করতেই হবে। এখানে এলেই এই জনপদের মানুষদের, বিশেষ করে এখানকার মেয়েদের আচরণে বিস্ময় বোধ না করে আমি পারিনি। না, প্রকৃতির দৃশ্য আর তাদের আচরণে অভিন্নতা ছিল না। আর তাই তারা উভয়েই যেন আমার কাছে বিপরীত অস্তিত্ব বলে বোধ হয়েছে। এর পরিবেশ এবং এর মানুষ : এরা উভয়ই যেন পরস্পরের প্রতিরোধী এক অস্তিত্ব।

.

এবার যখন ভেভেতে এলাম তখন হ্রদের পাড়ে বেদনার্ত মনে পদচারণা করতে করতে আবার আমি ফিরে গেলাম আমার সেই আনন্দ আর বেদনার স্মৃতিতে। মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে ভেসে উঠতে লাগল সহস্র আনন্দের স্মৃতিময় নিষ্পাপ ঘটনা। আমার চোখে জল জমে উঠল। আমি শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লাম। কতবার যে আমার স্বপ্নে, স্মৃতিতে এই স্থানটিতে বারবার এসেছি। এরই তীরে একটি পাথর খণ্ডের উপর উপবিষ্ট হয়েছি আর আমার স্মৃতির আনন্দের জলের ফোঁটাকে এই হ্রদের বুকে আমি পড়তে দেখেছি!

ভেভেতে আমি অবস্থান করেছিলাম ‘লা ক্লেকে। যে দু’দিন আমি এখানে ছিলাম, সেদিন আমার সঙ্গে কারুর সাক্ষাৎ ঘটেনি। কিন্তু আমি এই শহরটির প্রতি আমার একটা মায়া জন্মে যায়। এর কথা আমি আর জীবনে বিস্মৃত হতে পারিনি। আমার রোমান্সের সকল নায়ক-নায়িকার তাই অবস্থান ঘটেছে এই শহরেই। আমি তাই এখনও বলব। যার একটু রুচিবোধ আছে, যার একটু আবেগ আছে, যাও ভেভেতে যাও, ভেড়ভকে ভালবাস, তাকে আবিষ্কার কর, তার দৃশ্য দিয়ে তোমার মনকে ভরে তোল, তার হ্রদের বুকে নৌবিহারে বিহার কর। তার পরে আমাকে বল প্রকৃতি কি ভেভেকে একজন জুলি, একজন ফ্রেয়ার এবং সেইন্ট প্রুকস-এর জন্যই তৈরি করেনি? তাই বলে এদেরকে তুমি ভেভেতে চাইলেই চোখের সামনে দেখতে পাবে, এমন কথা আমিও বলিনে। তবু আমার স্বপ্নের আর কামনার আবাসভূমিই হচ্ছে এই ভেভে।

সঙ্গীত আমি রপ্ত করেছি। যত না সচেতনভাবে তার অধিক চেতনার বাইরে, একটা স্বতস্ফূর্ততায়।

এই পর্যায়ে আমার নিজের জীবন মোটামুটি বহনযোগ্য ছিল। বুদ্ধিমান কোন ব্যক্তির পক্ষে এর চাইতে অধিক চাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু আমার অস্থিরচিত্র হৃদয়ে যেন আরও কোনও কিছুর আকুতিতে পূর্ণ ছিল। রবি কিংবা অপর কোনও বারে আমি যত্রতত্র ঘুরে বেরিয়েছি। বনের গভীরে গমন করেছি। কেবল ঘুরেছি। নিজে গুঞ্জন করেছি। দীর্ঘশ্বাসে আমার হৃদয় ভরে উঠেছে। এমনি করে সূর্য ডুবে রাত নেমেছে। একদিনের সেই বোদ্রির ব্যাপারটা মনে পড়ছে। আমি সেদিন সরাইখানায় ভোজনে বসেছিলাম আমার নজরে পড়ল সামনে রয়েছেন গ্রীক রীতিতে একটি দীর্ঘ কোট পরিহিত, শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত এক পুরুষ। তার উচ্চারিত কথা প্রায় দুর্বোধ্য থাকত। কারণ তার উচ্চারণ এবং শব্দগুচ্ছের মধ্যে একটি বৈদেশিকতার ভাবছিল। তার ভাষাকে মাঝে মাঝে মনে হতে ল্যাটিন তথা ইতালীয় বলে। তবুও আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে তার কথা কিছুটা বুঝতে পারতাম। কেবল তাই না, শব্দ ছাড়া আকারে ইঙ্গিতে সে যা বলত চাইত তার অর্থ বুঝতে আমার কোনও অসুবিধা হতো না। এই আকার-ইঙ্গিতেই সে ভূ-স্বামী এবং দেশীয় সাধারণের সঙ্গে তার ভাব বিনিময় করত। একবার আমি তাকে ইতালীয় ভাষায় কিছু বললাম। দেখলাম, কথাটি সে বেশ ধরতে পেরেছে। আমার কথা শুনে সে এগিয়ে এসে আমাকে আনন্দের সঙ্গে আলিঙ্গন করল। আমাদের মধ্যে অচিরে একটা পরিচয়ের বন্ধন সৃষ্টি হলো। তখন থেকে আমি তার আলাপের ব্যাখ্যাতা হয়ে দাঁড়ালাম। আমার আহার যেখানে সাধারণ প্রকারের ছিল, তার ভোজন সেখানে বেশ সমৃদ্ধ ধরনেরই ছিল। অনেক সময়ে সে আমাকে তার টেবিলে খাওয়ার জন্য ডেকে নিত। আমি নিঃসঙ্কোচে তার টেবিলে গিয়ে আসন নিতাম। সারাব পান আর গাল-গল্পে আমরা দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। খাওয়া শেষে আমরা যেন অচ্ছেদ্য এক প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়লাম। তার কথায় বুঝলাম সে একজন গ্রীক যাজক এবং সন্ন্যাসী। সে এসেছে জেরুসালেম থেকে। ইউরোপে সে এসেছে। জেরুসালেমের একটি সমাধি তৈরির জন্য অর্থসগ্রহের দায়িত্ব নিয়ে। সে বেশ কিছু সুন্দর নকশাকেও দেখাল। এগুলো নাকি রুশ সম্রাজ্ঞীর নিকট থেকে প্রাপ্ত হয়েছে। এছাড়াও অন্য দেশ থেকে প্রাপ্ত অনেক মূল্যবান দ্রব্যও তার নিকটে আছে বলে সে আমাকে বলল। কিন্তু সে বলল, এ কাজে তার বড় অসুবিধা হচ্ছে, তার ভাষার অসুবিধা। সে জার্মান ভাষার একটা শব্দও জানে না। ল্যাটিন বা ফরাসিও জানে না। কেবল জানে গ্রীক। কিছুটা তার্কিশ। যা একটু সাধারণ ভাষা বা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা সে জানে তাতে তার সুবিধা হচ্ছে না। সে বলল, আমি তার সঙ্গী হয়ে তার অনুবাদক এবং ব্যাখ্যাতা হিসেবে কাজ করলে, সে খুব খুশি হবে। আমার পোশাক পরিচ্ছদ তখনও একেবারে সাধারণ। একটা হলুদ বর্ণের কোর্ট আমি জোগাড় করেছিলাম। তাতে অবশ্য তার সেক্রেটারিগিরি করতে আমার তেমন অসুবিধা হবার কথা নয়। লোকটি দেখল, আমি সরল বোকা জাতীয় একটি বালক। তাই আমাকে ব্যবহার করতে তার তেমন অসুবিধা হবে না। আমি বলব, তার এ বোধটি ঠিকই ছিল। এ নিয়ে আমাদের দুজনের মধ্যে একটা রফাই হয়ে গেল। আমি নিজের থেকে অনেক কিছু চাইলাম না। কিন্তু নিজ থেকেই আমাকে অনেক কিছু দেবার কথাই বলল। কোনও নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তা বাদেই আমি নিজেকে তার হাতে ধরা দিলাম। আর তারপর দিনই আমরা দু’জন জেরুসালেমের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। ব্যাপারটা এমন ত্বরিত গতিতেই ঘটেছিল।

.

[ব্যাপারটা এখানে একটু সহজ করে বলা যায় যে সেই গ্রীক পাদ্রীর সঙ্গে কিছু অর্থসগ্রহের বেপরোয়া চেষ্টায় ফরাসি দূতাবাসের কর্তৃপক্ষ তাদের দুজনকে ধরে ফেলে গ্রেপ্তার করল। রুশো অবশ্য ফরাসি রাষ্ট্রদূতের হস্তক্ষেপে মুক্তি পেল। এবং সে তাকে প্যারিসে পাঠিয়ে দিল। সেখানে সে মশিয়ে গো দারদের ভাগ্নের সঙ্গী হওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত হলো।]

.

পথে গাড়িতে যদি কেউ আমাকে একটা বসার আসন দিতে চাইত বা রাস্তায় কোনও সম্বোধন করত আমি মহারাজার মতো ঘাড় বাঁকাতাম। আমি নিজের মনে নিজেকে সাহসী বোধ করতে লাগলাম। ভাবটা এমন দাঁড়াল : দেখা যাক, ভাগ্য আমার কোথায় টেনে নেয়। আমার ভাবটাই দাঁড়াল যুদ্ধংদেহী। আমি বুঝলাম, এক সামরিক অফিসারের সঙ্গে আমি যুক্ত হতে যাচ্ছি এবং আমি নিজেই একজন বড় সৈনিক হয়ে দাঁড়াব। কারণ আমার পৃষ্ঠপোষক এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে আমি গোড়াতেই ক্যাডেট হতে পারি। আমি যেন নিজেকে সামরিক এক অফিসারের পোশাকে ভূষিত দেখলাম। আমার এমন চিন্তায় আমার নিজের বুক উদ্বেল হয়ে উঠল। আমি একটু জ্যামিতিতে দক্ষ ছিলাম। আমার একজন ইঞ্জিনিয়ার আত্মীয় ছিলেন। আর আমার মনে হলো আমি সামরিক কিছু হবার জন্যই জন্ম নিয়েছি। আমার একটু অসুবিধা ছিল আমার চোখের দৃষ্টির সমস্যা। তবে এ নিয়ে আমার খুব উদ্বেগ হলো না। আমি শুনেছি এক মার্শাল শেমবার্গ চোখে তেমন দেখতে পেতেন না। তাই যদি হয়, তাহলে একজন মার্শাল রুশোরই বা দৃষ্টিশক্তির একটু অসুবিধাতে কী আসবে যাবে। হ্যাঁ, আমি মূর্খ রুশো তো বটেই। তাই আমার চারদিক নিজেকে সর্বক্ষণ সেনা পরিবেষ্টিত বলে ভাবতে লাগলাম। আমি চার দিকে কামান আর যুদ্ধের সব দৃশ্য দেখতে লাগলাম। যেন কামানের গোলা ছুটে যাচ্ছে। চারদিক ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আমি দেখলাম দুরবীণ হাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু একটু অগ্রসর হতে যেন আমি পাহাড়ি ঝর্নার দেখা পেলাম, একটি মনোহর দৃশ্যের সাক্ষাৎ পেলাম, অমনি আমার বুকে সামরিক পোশাকের বদলে প্রকৃতির সৌন্দর্যের ডাকের শব্দ বেজে উঠল। আমি বুঝলাম কামানের গর্জন শোনার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আর আমি যেন আমার চারদিক মেষ চারণের মাঠে আমার প্রিয় মেষপালকে দেখতে পেলাম। আর মুহূর্তে আমার সমর অধিনায়কের স্বপ্ন বিলাসিতা কোথায় যে শূন্যে মিলিয়ে গেল।

আহা আমার প্যারি বা প্যারিস। তার দুর্গ দিয়ে আমি রুশো অবশেষে প্রবেশ করলাম। কিন্তু হাহতোস্মি!

 কী আমার ভাগ্য! এই কি আমার স্বপ্নের প্যারিস! তুরিনের সেই বাহার আর প্যারিসের এই দুর্গন্ধভরা বস্তি! তুরিনের রাস্তার কী সৌন্দর্য, লম্বা লাইন বাঁধা সড়ক, সড়কের পাশে সৌন্দর্যময় গৃহসমূহ। তাই দেখে দেখে ভেবেছিলাম প্যারিস হবে তুরিনের চাইতেও বাহারী, সুন্দর। আমাকে উদ্বুদ্ধ করে দেবে আমার স্বপ্নের প্যারি। কিন্তু একি আমি দেখলাম। কোথায় আমার কল্পনার প্যারিস, বৃহৎ আকাশছোঁয়া প্যারিস, সৌন্দর্যের রানী। সুন্দর বাদে যার কুৎসিত হওয়ার উপায় নেই। সুন্দর হবে তার সড়ক। মার্বেল পাথরে বাঁধাই করা। স্বর্ণের মন্দিরবৎ গৃহরাজি!

.

সেন্ট মার্সের শহরতলী দিয়ে এই প্যারিসে ঢুকে যেন আমি অদৃষ্ট পাতালের এক নরকের মধ্যে আমার প্রবেশ দেখলাম। দুর্গন্ধে ভরা ক্ষুদে সব গলি। ক্লান্তদেহী বিত্রস্ত সব মানুষ। হাঁটছে না যেন ঝিমুচ্ছে? দারিদ্র্যের শেষ নেই। ভিখারির দল তোমার পথ আগলাচ্ছে। ঠেলাগাড়িগুলো যত্রতত্র পড়ে আছে। পুরনো কাপড়ের হকারগুলো হাঁক ছাড়ছে! ধেনো মদের সরাই। পুরনো হ্যাট মাথায় সড়কভর্তি মানুষ!

আহা! এই আমার প্যারি প্রবেশ! শুরুতেই এমন! এই শুরুটাই আমাকে শেষ করেছে? যা কিছু মহৎ আমি আবিষ্কার করেছি প্যারিসে, আমার পরবর্তী জীবনে তার কোনও কিছুই আমার প্যারিস প্রবেশের এই দৃশ্য থেকে আমাকে মুক্তি দিতে পারেনি। আমি বলব এরপরে যতটা কাল আমি প্যারিসে কাটিয়েছি তার সবটাই যেন আমি ব্যয় করেছি সেই প্রথম দিনের দুঃসহ দৃশ্যের স্মৃতির থেকে মুক্তির অন্বেষণে!

আসলে অবাস্তব স্বাপ্লিকের কপালে শেষকালে এটাই জোটে! প্যারির আমি এত স্তুতি, এত প্রশংসা শুনেছি যে আমার মনে হয়েছে যেন আমি প্রাচীন ব্যাবিলনকে সাক্ষাৎ দেখতে পাব। সেই ব্যাবিলনের স্বপ্নময় দৃশ্য থেকে আমি আহরণ করতে পারব আমার জীবনের বিস্ময় আর আনন্দকে। এই একই অভিজ্ঞতা ঘটেছে আমার প্যারিতে। পৌঁছার দিনই আমি প্যারির একটা অপেরাতে গেলাম। পরবর্তী সময়ে ভারসাইতেও আমার একই অভিজ্ঞতা ঘটেছে। তারপরে আমার যখন সমুদ্র দর্শন ঘটলো তার স্মৃতিও মনের মুকুরে স্থির হয়ে আছে। আসলে যার সম্পর্কে তুমি প্রথমে খুব শোন, পরিণামে তাতে তোমার পরিতাপের ব্যাপার ঘটবেই। আমার কল্পনার যে বিস্তার তাকে অতিক্রম করার সাধ্য না আছে প্রকৃতির, না কোনও মানুষের।

.

[এ কথা বলা আবশ্যক, প্যারিতে রুশোর খুব ভাল সংবর্ধনা ঘটেনি। প্যারিসে এসে রুশো যখন শুনলো যে মাদাম দা ওয়ারেনস সুইজারল্যান্ড ফিরে গেছেন, তখনি রুশো আবার মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ে। এপথেও প্রকৃতির দৃশ্য তাকে মোহিত করে তোলে। তার কল্পনারও আর সীমা থাকে না।]

.

একদিনের ঘটনার কথা বলি। একটা জায়গা দূর থেকে দেখতে আমার খুব মনোহর লাগলো। জায়গাটি দেখে আমার এত ভাল লাগলো যে জায়গাটিকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে আমি কেবল ঘুরতে লাগলাম। এমনিভাবে চক্কর দিতে দিতে আমি যেন নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেললাম। তারপরে কয়েকটা ঘণ্টা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় আমি প্রায় মরে যাচ্ছিলাম। তখন কাছেই একটি কৃষকের ঘর পেলাম। আমি তাতে ঢুকে পড়লাম। তার ভেতরে যে দেখার কিছু ছিল, এমন নয়। কিন্তু আশপাশে আর ঘর পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হলো জেনেভা বা সুইজারল্যান্ডে একটু সচ্ছল মানুষ যেখানে অতিথিপরায়ণ, এই প্যারিসেও আমি তেমন মানুষের সাক্ষাৎ পাব। যে ঘরে আমি ঢুকলাম তার মধ্যে যে লোকটির আমি সাক্ষাৎ পেলাম তার কাছে কিছু খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। বললাম, কিছু যদি ফ্রাংকের দরকার হয়, তাও আমি তাকে দিতে পারব। সে অবশ্য আমাকে কিছু দিল। দইটানা দুধ এবং মোটা বার্লির একটা রুটি। এই দিয়ে সে বলল, তার ঘরে আর কিছু নেই। আমার তাতে দুঃখ হলো না। দুধটুকু দিয়ে আমি বার্লির রুটিটা তার খোসাশুদ্ধই খেয়ে ফেললাম। তবে আমি যেভাবে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাতে আমার ক্ষুধা মিটলো না। ঘরের কৃষকটি দু’চোখ ভরে আমার খাওয়া দেখছিল। আমার খাওয়ার মধ্যেই যেন সে আমার কাহিনীর সত্যাসত্যকে পরীক্ষা করার চেষ্টা করছিল। আর দেখলাম পরমুহূর্তেই লোকটির মুখ খুশিতে ভরে উঠলো এবং বলেই ফেলল, না, বাছা তোমার দুঃখ আমি বুঝি। তুমি নিশ্চয়ই ভাল ঘরের একটি সন্তান। তুমি আমার কাছে টাকার লোভে আসোনি, একথা আমি জানি। এই বলে সে রান্নাঘরের একটা দুয়ার খুলে নিচে নেমে গিয়ে একটু পরে সুন্দর একটি গমের রুটি আমার জন্য নিয়ে এল। অল্প হলেও একটু মাংসও এনে দিল। সাথে একটু শারাবও। এমন দৃশ্যে আমার মনের উফুল্লতার আর সীমা রইল না। শুধু তাই নয় এবার সে আমার জন্য একটি অমলেটও নিয়ে এল।

.

এসব দিয়ে আমি আহার শেষ করলাম। কোনও পথের ভিখারির ভাগ্যে এমন আহার জোটার কথা নয়। এরপরে যখন এমন আপ্যায়নের দাম দেয়ার কথা উঠলো তার মধ্যে আমি যেন একটা ভয়ের লক্ষণ টের পেলাম। সে আমার দেয়া কোনও ফ্রাংকই নিতে অস্বীকার করল। সে যেমন কোনও অর্থ নিতে অস্বীকার করল, তেমনি তার মধ্যে আমি একটা উদ্বেগকেও লক্ষ করলাম। শেষে সে যেন আমার কাছ থেকে কোনও কিছু গ্রহণ করতে একটা ভীতি বোধ করছে। তারপরে হঠাৎ বলে উঠল : বাবা, তুমি ট্যাক্স অফিসার! দেখ বাবা, আমার কিছু নেই। এই মদটুকু আমি অফিসারদের ভয়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম। রুটিও যা রেখেছিলাম, তাও তোমার মতো অফিসারের ভয়ে। তার অবস্থা বা চরিত্রের এই দিকটা একেবারেই আমি কল্পনা করতে পারিনি। জীবনে এই ঘটনার কথাটা আমি কখনও ভুলতে পারিনি। সেদিনই আমি বুঝলাম মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার কাকে বলে। মানুষের অত্যাচারের ভয়ে মানুষ কোন পর্যায়ে যেতে পারে। এই চাষীটি নিজের রাখা রুটির টুকরা খেতে পারল না, পাছে কখন্ কোন অফিসার এসে হাজির হয় আর চীৎকার করে ওঠে; দে আমার খাবার দে। কোনও অত্যাচারী অফিসারকে নিবৃত্ত করার তার আর কী উপায় ছিল তার দারিদ্রের প্রদর্শন বাদে। আমি তার ঘর থেকে ভারী মন নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এবার এই জায়গার চারিপাশের সুন্দর দৃশ্য আমার কাছে বিষময় মনে হলো। প্রকৃতি যেন এমন সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে এই অসহায় চাষীকুলকে অত্যাচারী ট্যাক্স তহসিলদারের চরম নির্যাতনের উপায়হীন শিকারে পরিণত করার জন্য।

.

[লিয়নসে রুশোর অবস্থা হয়ে দাঁড়াল একেবারে কপর্দকহীন।]

.

এক সন্ধ্যায় বেলেকোরে বসে ভাবছিলাম এখন কি করি। এমন সময় দেখলাম মাথায় টুপি পরা একটি লোক আমার পাশে এসে বসল। তাকে মনে হলো যেন সে সিল্ক পোশাকের কোনও ব্যবসায়ী। এদেরকে এ অঞ্চলে বলা হয় ‘চটফেকাটিয়ের। সে আমাকে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। আমি তার প্রশ্নের স্বাভাবিক জবাব দিলাম। প্রায় পনের মিনিট এভাবে কাটল। হঠাৎ সে বলল : এসো, আমরা একটু ফুর্তি করি। কী ধরনের ফুর্তি জিজ্ঞেস করতে না করতে সে দস্তুর মতো দেখাতে লাগল ফুর্তি করা কাকে বলে। আমরা দুজনে প্রায় এক দেহতে পরিণত হয়ে গেলাম। সন্ধ্যায় অন্ধকার তখনও লাগেনি। আর এ দৃশ্য কারোর চোখের আড়ালে পড়ারও উপায় ছিল না। লোকটি যে আমার ওপর বলাঙ্কার করতে চাচ্ছে এমনও মনে হলো না। আর জায়গাটাও এমন নয় যে ব্যাপারটা ও লোকচক্ষুর আড়ালে করতে পারে। মনে হল লোকটা বরং চাচ্ছে ও ওর অঙ্গাদি নিয়ে যা করছে, আমিও যেন তা করি। লোকটার মনে হলো ব্যাপারটা কিছুই না। ও নিজের অঙ্গ নিয়ে যা করবে, আমিই বা তা নিয়ে কেন করব না, এটা যেন লোকটা বুঝতে পারছিল না। এমন অবস্থায় আমার ভয় ধরে গেল। আমি ওর কাছ থেকে উল্টা দিকে ছুটতে লাগলাম। আমি পেছন ফিরে তাকালাম না। তবু মনে হলো লোকটা যেন আমার পেছনে ছুটে আসছে। আমি এমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে আমার নিজের বাসার দিকে না ছুটে তার বিপরীতে জাহাজঘাটের দিকে দৌড়াচ্ছিলাম। ছুটতে ছুটতে জেটির ব্রিজটাও আমি পার হয়ে তবে থামলাম। আমি হাঁপাতে লাগলাম যেন আমি মারাত্মক কিছু করে ফেলেছি। আমার মনে হলো এই কুকর্মে আমি নিজেও যেন আসক্ত হয়ে পড়েছি। এমন মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। এই সময়ে এই পথে এরকম, বরং আরও ভয়ঙ্কর একটা বিপদে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার হাতে তখন টাকা পয়সা প্রায় কিছুই ছিল না। যা ছিল তার ব্যয়ে আমাকে ভয়ানক সতর্ক হতে হচ্ছিল। এখন থেকে দিনের খাওয়া আমি কমিয়ে দিলাম। দু’বেলার বদলে একবেলা। এতে পাঁচ বা ছ’মাসের বেশি লাগতো না। এতে পান্থশালা যা সবাই এর পঁচিশ সোর পরিমাণ খাবার হয়ে যেত। আর ঘুমের ব্যাপারটারও পরিবর্তন ঘটালাম। সরাইতে নয়। কারণ যে ভদ্রমহিলার বাড়িতে আমি ঘুমাব আর তার তাতে কিছু অর্থাগম ঘটবে না, সেটা আমার ভাবতে ভাল লাগল না। কিন্তু তখন আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর লাগছিল। আমি ভাবলাম, পার্কেই বা আমি ঘুমাতে পারব না কেন। একদিন, যখন এক রাতে পার্কের একটা বেঞ্চে আমি বেশ গুছিয়ে বসেছিলাম, তখন দেখলাম কোনও একটি মঠের মঠাধ্যক্ষের মতো জোব্বাপরা একটি লোক আমাকে লক্ষ করছে। সে দেখছে, আমি বেঞ্চটিতে শুয়ে পড়ছি। সে আমার কাছে এসে বলল; কী বাছা, তোমার কি শোবার কোনও জায়গা নেই? আমি তাকে আমার সত্যিকার অবস্থার কথা বললাম। দেখলাম ভুদ্রলোক আমার কথা শুনে বেশ বেদনার্ত হলেন। তিনি আমার পাশে এসে বসলেন এবং আমার সঙ্গে আলাপ করতে শুরু করলেন। তার আলাপে আমার আনন্দ হলো। তার কথা শুনে তাকে আমার খুবই ভাল লাগল। তিনি যখন দেখলেন আমি তাকে খারাপ ভাবছিনে, তখন তিনি বললেন দেখ আমার বাসাও তেমন ভাল নয়। তিনি বললেন, আমারও একমাত্র ঘর। তবু এই রাতে আর কোনও জায়গা যখন তুমি জোগাড় করতে পারবে না তখন তুমি আমার সঙ্গে আমার ঘরে চল। এই পার্কে শোবার চাইতে সেটা খারাপ হবে না। তোমাকে আমি এই পার্কে রেখে যেতে পারিনে। এবং সত্যি তাই, তিনি আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন এবং তার সঙ্গে তার শয্যাতেই আমার শোবার ব্যবস্থা করলেন। আমি তাতে আপত্তি করলাম না। লোকটিকে আমার ইতোমধ্যে ভাল লাগছিল। তার কাছ থেকে আমি উপকারও তো পেতে পারি। এই ছিল আমার মনের ভাব। ঘরে ঢুকে তিনি একটা বাতি জ্বালালেন। ঘরটি কিন্তু আমার বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হলো। আমার সঙ্গে তার সহৃদয় বিনয়ের প্রকাশ দেখলাম। তিনি আমাকে শারাবে ভেজা কিছু চেরী বাদাম খেতে দিলেন। আমরা দুজনেই তা খেলাম এবং তার পরে দুজনে একই শয্যায় শয়ন করলাম।

কিন্তু ক্রমে আমি বুঝতে পারলাম, এই লোকটাও বিশেষ সুবিধার নয়। আর একটা ধর্মশালায় একটা ইহুদি আমাকে নিয়ে যে ব্যবহার করেছিল, এর চরিত্রও প্রায় সেই পদের। তবে লোকটা একচোটে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না। আমাকে সে আস্তে আস্তে উত্তেজিত করে তুলতে চাইল। আমার ওপর কোনও জোর খাটাল না। এসব ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা তো আমার ইতিপূর্বে ঘটেই ছিল। তাই লোকটা কী চায় তা আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু ওর কোনও আচরণে বাধা দিতে বা চীৎকার করতেও আমি ভয় পেলাম। কারণ কোনখানে আমি এসে পড়েছি তারও কোন ধারণা আমার ছিল না। আর বাধা দিলে বা চীৎকার করলে লোকটাতো আমাকে খুন করতেও পারে। কিন্তু তার আদরে আমি উদ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম। আমি তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি লোকটাকে আমার জীবনের কাহিনী বলতে লাগলাম। আর এমন দুর্ভোগে যে আমি আগেও পড়েছি তাও আমি তাকে বললাম। আমি যে এসব পছন্দ করি না, তা আমি তাকে এমনভাবে বললাম যে দেখলাম লোকটি শেষপর্যন্ত তার চেষ্টা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হলো। ফলে ওর বিছানায় সে রাতটা কাটাতে আমার আর তেমন অসুবিধা হলো না। লোকটা অবশ্যই একটা নীতিহীন খারাপ লোক ছিল। তবু এসব বিষয়ে ও যা আমাকে সে রাত্রে বলল তাতে বুঝলাম লোকটা বুদ্ধিহীন নয়। এবং নানা অভিজ্ঞতায়ও লোকটা অভিজ্ঞ।

সকালে মনে হলো মঠের অধ্যক্ষটা আমার ব্যাপারে তেমন অসন্তুষ্ট নয়। সে আমাকে তার সকালের নাশতায় আমন্ত্রণ জানাল। সে বাড়ির গিন্নীর একটি সুন্দর মেয়েকে কিছু নাশতা এনে দিতে বলল! কিন্তু মেয়েটা বলল, তার সময় হবে না। একথা বলে সে তার নিজের বোনের কাছে চলে গেল। লোকটা ওই মেয়েটাকেও বলল। এ মেয়েটাও তাকে পরোয়া করল না। অপেক্ষা করতে লাগলাম। নাশতা আর তেমন কিছু এল না। শেষপর্যন্ত আমরা দুজনই মেয়ে দুটোর ঘরে গেলাম। মেয়ে দুটো মঠাধ্যক্ষকে তেমন কোনও সমাদর দেখাল না। আর ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে ভিন্নতর কোনও ব্যবহার পাওয়ার তো কোনও কথাই ওঠে না। বোন দুটোর বড়টা হঠাৎ আমার জুতোর মাথায় এমন এক চাপ দিল যে সে চাপে আমার জুতোয় একটা ফুটো হয়ে গেল। অপর মেয়েটা আমি যে চেয়ারটাতে বসতে যাচ্ছিলাম, সে চেয়ারটা হঠাৎ সরিয়ে নিয়ে গেল। ওদের মা ওপর থেকে জল ঢেলে আমাদের বসার সব জায়গাটাই ভিজিয়ে দিল। ওরা ভাব দেখাচ্ছিল এমন যেন ওরা সারা ঘরটায় কী যেন খুঁজছে। আমার জীবনে এমন পরিস্থিতিতে আর কখনও পড়িনি। ওদের হাসি ঠাট্টা মশকরায় আমার প্রতি ওদের রাগের চিহ্ন আদৌ অপ্রকাশিত ছিল না। আসলে বোকা ছিলাম আমি। ওদের রাগের কারণটা আমার বোঝা উচিত ছিল। এদের কারোর ভাবগতিক আমার ভাল লাগল না। ব্যাটা মঠাধ্যক্ষও, এমন ভাব দেখল যেন সে কিছু বুঝছে না। আর নাশতা খাওয়ার তত কথাই এল না। আমি প্রায় ভয় পেয়ে গেলাম। মঠাধ্যক্ষটাও আমার সঙ্গে ছিল। আমরা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলাম। আমি লোকটার পেছনে বেরিয়ে এলাম। ভাগ্য ভাল যে এই তিনটা শয়তানের থাবা থেকে আমি যেন কোনও প্রকারে বেঁচে গেলাম।

আমরা একটু এগুতে লোকটা বলল, এসো আমরা একটা ক্যাফে থেকে কিছু নাশতা খেয়ে নিই। আমার ক্ষিধে লেগেছিল ঠিকই। কিন্তু এই লোকটার সঙ্গে আমি আর বসতে চাইলাম না। আমি তার প্রস্তাবে না করলাম। সেও আর পীড়াপীড়ি করল না। আমি লোকটার কাছ থেকে সরে পড়লাম। অভিশপ্ত এই বাড়িটার বাইরে আসতে পেরে চারদিকের সব কিছুই আমার ভাল লাগতে লাগল। লোকটাও যেন আমাকে বাদ দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমি যেন ওকে আর চিনতে পারবো না, এটিও ও বুঝলো। এরকম আর কোনও ঘটনা আমার জীবনে প্যারিসে বা অপর কোথাও ঘটেনি। লিয়নস-এর এই ঘটনায় লিয়নস-এর সকল লোকের ওপরই আমার মন বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল। আমার মনে হলো সমস্ত ইউরোপেই এই লিয়নস এর মতো খারাপ জায়গা আর কোথাও নেই।

.

[রুশো তার হাতের টাকা খরচ করে একটা কাফেতে নাশতা করল। আর কয়েকদিন কিছু সঙ্গীতের কোনও রকম চর্চা করল। বিশেষ করে একটা মঠে সময় কাটাল। এবং তারপরে আবার সে চাম্বেরীর দিকে এবং মাদাম দা ওয়ারেনসকে খোঁজ করে বার করার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল।]

.

এমন যাত্রার শুরুতে আমার আনন্দের আর অবধি রইল না। আমার পদক্ষেপে কোনও দ্রুততার ব্যাপার ছিল না। আমি জানতাম আনন্দ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি যা চাচ্ছি তাই আমি পাচ্ছি, তাই আমি পাব। কোনও সমান মাঠ নয়। আমি চাচ্ছি উঁচু-নীচু পাহাড় ঘেরা বন, বনানী। যেখানে যেমন ইচ্ছা তেমন, আমি উঠতে পারব, আর নামতে পারব। আমার কোনও তাড়া নেই। আমি নিশ্চিত, আমি জানি যাত্রার শেষে আনন্দ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কেমন দেশকে আমি ভালবাসি, তাতো আমি জানি। দিগন্তবিস্তারী কোনও মাঠের আমি কামনা করিনে। পাহাড় আর প্রস্রবণ। আর বৃক্ষ। অন্ধকারাচ্ছন্ন বন, খাড়া পাহাড়, খাড়া সড়ক, যে খাড়া পাহাড় থেকে নিচে তাকাতে আমার ভয় হবে। এই হচ্ছে আমার আনন্দলোক। আমি তো তা পেয়েছি। চাম্বেরী পৌঁছতে পৌঁছতে এ সবই আমি পেয়েছি। এখানে একটা উঁচু পাহাড়ের নাম ছিল লা পাস দা, লা একেলি। বেশ একটু উঁচু জায়গাতে প্রস্রবণ নেমে আসছিল। চায়লিসে দেখলাম, একটা ছোট নদী যেন সেই উঁচু থেকে মাথায় ফেনা বেঁধে নিচে অঝোর ধারায় নেমে আসছে। যেন সে হাজার যুগ ধরে এমনি করে নেমে আসছে। সড়কের দু’পাশে বাঁধও ছিল যেন কেউ না পড়ে যেতে পারে। এমন বাধ থাকতে বাঁধের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমার মাথা ঘুরে গেলেও কোনও কষ্ট হয়নি। সেই অভয়ে বাঁধের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগলাম। মাঝে মাঝে আমি জলের ধারার মাথায় আমি ফেনাপুঞ্জকে দেখছিলাম, চারদিকে উড়ন্ত পাখিকুলের আওয়াজ শুনছিলাম। নিচে তাকাতে বুঝলাম নিচ থেকে কত ফ্যাদম উপরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে ঢালু এবং সমান জায়গাও আমি পাচ্ছিলাম এবং জলের সঙ্গে পাথরকুচিগুলো পেরিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা ঘটছিল না। এমন অনেক পাথর কুচিকে তুলে তুলে নিজের ইচ্ছেমতো বাঁধের ওপর জমাতেও শুরু করছিলাম। তার পরে আর সেই পাথর কুচির একটা দুটোকে নিচে জলের স্রোতের মধ্যে ফেলে মজা দেখছিলাম। টুকরোগুলো পড়ছিল এবং আরও হাজার টুকরোয় যেন ভেঙে যাচ্ছিল। এবং পড়তে পড়তে একেবারে নিচের গভীরে গিয়ে জমছিল। ..

শেষপর্যন্ত আমি তার কাছে পৌঁছে গেলাম : বলা চলে আমার অন্তরের দিগন্তে : এবার ওই আবার আমি দেখলাম। তিনি যে একা ছিলেন তা নয়। নয়া পরিচারক দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত ছিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেন না। কাছে এসে আমার একটি হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন। তারপর তিনি সামনের সকলের নিকট এমনভাবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন যেন আমি এক অপূর্ব রাজকুমার। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে বাহবা দিয়ে উঠল। এই তাহলে আমাদের সেই রাজপুত্র। যিনি রাজপুত্র হওয়ার জন্যই জনছিলেন। মাদাম দা ওয়ারেনস বললেন, যাক এবার আমার চিন্তা গেল। আমার দিকে তাকিয়ে এবার তিনি বললেন : প্রিয় পুত্র আমার, তুমি রাজপুত্র হওয়ারই যোগ্য। যে মশিয়ে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে, সে অবশ্যই তোমার একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।

আমি দু’চোখ মেলে সবাইকে দেখলাম। কোনও শব্দই আমি উচ্চারণ করতে পারলাম না। আমি কী করব তাও আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার অন্তরের কামনা আমাকে যেন কোনও উঙ্গে নিয়ে চলল। অবশ্য এমন উচ্চাশার পূরণ যে পরবর্তী সব ঘটনায় ঘটেছিল তা আমি বলতে পারিনে। কিন্তু সে তো পরের কথা। এই মুহূর্তে আমি যা পেলাম তার আর কোনও তুলনা হয় না।

.

[যা হোক ঘটনায় দেখা গেল রুশোকে ট্যাক্স আদায়ের একজন তহসিলদারের দায়িত্ব দেয়া হলো।।]

.

আমি জানি আমার জীবনের এই পর্যায়ের এমন বিস্তারিত বর্ণনা আমাকে বালসুলভ বলেই সবার কাছে তুলে ধরবে। একদিক দিয়ে এতে এখন আমার একটা দুঃখবোধ হচ্ছে। কিন্তু যেভাবে আমার জন্ম এবং জীবনের এ ঘাট থেকে ওঘাটে উৎক্ষিপ্ত হওয়া তাতে আমার এমন অবস্থার কোনও গত্যন্তর ছিল না। কোনওকালেই আমি একটি শিশু বৈ আর কিছু ছিলাম না। একটি জীবনের শিশু। আর দেখতে গেলে আজ এই বয়সেও আমি সেই শিশুটিই রয়ে গেছি। জনসমাজে আমি বড় কেউকেটা হব, এমন চিন্তা আমি কখনও করিনি। আমি কেবল চেয়েছি আমি যেমন আছি তেমনি যেন থাকি। আর সে জন্যই কেউ যদি আমার বয়সের পর্যায়ে আমাকে বুঝতে চায় তবে তাকে আমার শৈশবেই ফিরে যেতে হবে। ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভেবেছি। আসলে কোনও ঘটনা যদি আমার জীবনে ঘটে থাকে তাতে আমার স্মৃতিতে ঘটনাটার চাইতে ঘটনাটা আমার মনকে যেভাবে আলোড়িত করেছে, সেই ভাবটাই আমার মনের মধ্যে আটকে রয়েছে। ঘটনাটা নয়। মানুষের মনের অস্তিতেও ঘটনার পরে ঘটনার সৃষ্টি হয়। সে ঘটনা একটা লোকের মনকে কীভাবে আলোড়িত করে, ঘটনাটার চাইতে সেটার দিকেই আমাদের দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। আমার তো তেমনই মনে হয়। আমি চাই যে কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে মনের ওপর ঘটনার আঘাতটাকে বড় করে দেখি, ঘটনাটার চাইতে। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই আমি একটি লোককে চেষ্টা করি যেন সে নিজেকে এভাবে দেখাতে চেষ্টা করে। আমি নিজে চেষ্টা করি পাঠকের দৃষ্টিকে আমার মনের দিকে আকৃষ্ট করতে। মূল ঘটনাটার চাইতে মনের ওপর তার প্রতিক্রিয়াটিকেই আমি অধিক মূল্যবান বলে মনে করি। তাই তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক থেকে তার চরিত্রের মূলের দিকে তার দৃষ্টিকে আমি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি। আমি তার কাছে তার চরিত্রের সবদিককেই তুলে ধরতে চাই। যেন সে নিজেই নানান দিক থেকে নিজেকে বিচার করতে সক্ষম হয়।

.

আমার এমন চেষ্টায় ফল যাই হোক না কেন, সে যদি আমার প্রতি বিশ্বাস না রাখে তাহলে অন্তত আমি তাকে বলতে পারব, আসলে সে নয়, আমিই খারাপ। এর চাইতে কোনও ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণই আমি বর্ণনা করতে থাকি তাতে আমি যতই তার কাছে তাকে খারাপ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করি না কেন তাতে সে নিজে স্বীকার করবে না যে সে ঘৃণার পাত্র বা খারাপ। আসলে তাকে সাহায্য করতে হবে যেন সে নিজেকে চিনে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে। আমার কথায় নয়, আমার চোখ দিয়ে নয়; তার নিজের চোখ দিয়ে। হ্যাঁ সে যেন নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পায়। অন্যের চোখ দিয়ে নয়। তার নিজের সিদ্ধান্তে যদি ভুল হয় তাহলেও সে নিজেকেই ভুল বলে স্বীকার করবে। আমাকে নয়। কারণ আমি তো তাকে খারাপ বলিনি। অবশ্য এমন উদ্দেশ্যে আমাকে যে ঘটনার প্রতিটি ব্যাপারে সত্য বলতে হবে, এমনও নয়। তবু আমি যা বলব, তা মিথ্যা নয়। সে সত্যকে দেখুক নিজের চোখ দিয়ে। আমার চোখ দিয়ে নয়।

আমি এ পর্যন্ত আমার উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে এভাবেই এগুবার চেষ্টা করেছি। আর ভবিষ্যতেও আমার জীবনে এটিই হবে আমার চেষ্টা। মানুষ নিজের চোখে নিজেকে দেখুক। অপরের চোখে নয়।

কিন্তু এর একটা মুশকিলকে আমি স্বীকার করি। সেটি হচ্ছে আমাদের নিজেদের কৈশোরের স্মৃতি যত উজ্জ্বল হয়ে আমার মনে ভেসে ওঠে, আমার অধিকতর বয়সের ঘটনার স্মৃতির ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। কৈশোরের স্মৃতির উজ্জ্বলতা মধ্য বয়সের চাইতে অনেক বেশি। আমি তাই যে কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে আমার কৈশোরকে নিয়ে শুরু করতে চেয়েছি। অধিকতর বয়সের ঘটনা নিয়ে নয়। আমার কৈশোরের কথার পুনরাবৃত্তিতে আমার পাঠকরা অধৈর্য হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু আমি নিজে আমার নিজের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই একটি লোককে চেষ্টা করি যেন সে নিজেকে এভাবে দেখতে চেষ্টা করে। আমি নিজে চেষ্টা করি পাঠকের দৃষ্টিকে আমার মনের দিকে আকৃষ্ট করতে। মূল ঘটনাটার চাইতে মনের ওপর তার প্রতিক্রিয়াটিকেই আমি অধিক মূল্যবান বলে মনে করি। তাই তার চরিত্রের বিভিন্ন দিক থেকে তার চরিত্রের মূলের দিকে তার দৃষ্টিকে আমি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি। আমি তার কাছে তার চরিত্রের সবদিককেই তুলে ধরতে চাই। যেন সে নিজেই নানান দিক থেকে সে নিজেকে বিচার করতে সক্ষম হয়।

আমার এমন চেষ্টায় ফল যাই হোক না কেন, সে যদি আমার প্রতি বিশ্বাস না রাখে তাহলে অন্তত আমি তাকে বলতে পারব, আসলে সে নয়, আমিই খারাপ। এর চাইতে কোনও ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণই আমি বর্ণনা করতে থাকি তাতে আমি যতই তার কাছে তাকে খারাপ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করি না কেন তাতে সে নিজে স্বীকার করবে না যে সে ঘৃণার পাত্র বা খারাপ। আসলে তাকে সাহায্য করতে হবে যেন সে নিজেকে চিনে; নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে। আমার কথায় নয়, আমার চোখ দিয়ে নয়; তার নিজের চোখ দিয়ে। হ্যাঁ সে যেন নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পায়। অন্যের চোখ দিয়ে নয়। তার নিজের সিদ্ধান্তে যদি ভুল হয় তাহলেও সে নিজেকেই ভুল বলে স্বীকার করবে। আমাকে নয়। কারণ আমি তো তাকে খারাপ বলিনি। অবশ্য এমন উদ্দেশ্যে আমাকে যে ঘটনার প্রতিটি ব্যাপারে সত্য বলতে হবে, এমনও নয়। তবু আমি যা বলব, তা মিথ্যা নয়। সে সত্যকে দেখুক নিজের চোখ দিয়ে। আমার চোখ দিয়ে নয়।

আমি এ পর্যন্ত আমার উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে এভাবেই এগুবার চেষ্টা করেছি। আর ভবিষ্যতেও আমার জীবনে এটিই হবে আমার চেষ্টা। মানুষ নিজের চোখে নিজেকে দেখুক। অপরের চোখে নয়।

কিন্তু এর একটা মুশকিলকে আমি স্বীকার করি। সেটি হচ্ছে আমাদের নিজেদের কৈশোরের স্মৃতি যুত উজ্জ্বল হয়ে আমার মনে ভেসে ওঠে, আমার অধিকতর বয়সের ঘটনার স্মৃতির ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। কৈশোরের স্মৃতির উজ্জ্বলতা মধ্য বয়সের চাইতে অনেক বেশি। আমি তাই যে কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে আমার কৈশোরকে নিয়ে শুরু করতে চেয়েছি। অধিকতর বয়সের ঘটনা নিয়ে নয়। আমার কৈশোরের কথার পুনরাবৃত্তিতে আমার পাঠকরা অধৈর্য হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু আমি নিজে আমার নিজের কৈশোরের খারাপ কিংবা ভাল, কোনও কিছুর স্মৃতিতেই কখনও ক্লান্ত বোধ করিনে। এ ব্যাপারে আমার একটামাত্র ভয় : ভয় এই নয় যে, যে আমার স্মৃতির অধিক পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছি, আবার যা সত্য নয় তাই বলছি। তার চাইতে আমার ভয় পাছে না আমি কিছু গোপন করি এবং সেই গোপন করায় আমার জীবনের কোনও সত্যকে আমি গোপন করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *