চতুর্থ পাণ্ডবের জন্য

চতুর্থ পাণ্ডবের জন্য

গলফ ক্লাবে যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছি, এমন সময় পাগলা তনুর ফোন, ”এই কালকেতু, তুই আসছিস তো?” নীচে ফিরোজ আলি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ টালিগঞ্জে ওর সঙ্গে আমার গলফ খেলতে যাওয়ার কথা। তিনদিন আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। ফিরোজ খুব নামী গলফার। প্রায় সারা বছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গলফ খেলে বেড়ায়।

কলকাতায় ওকে পাওয়া যায় না। কয়েকদিন আগে ও কাঠমান্ডু থেকে ফিরেছে। টাইগার উডসের সঙ্গে কোনও একটা টুর্নামেন্ট খেলে। সকালে গলফ খেলতে খেলতে ওর কাছ থেকে টাইগার উডসের গল্প শুনব। বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি। এমন সময় বাধা।

পাগলা তনু…মানে তনুময় কী বলছে, বুঝতে পারলাম না। ওর এই এক দোষ। কথা এমন একটা জায়গা থেকে শুরু করবে বোঝা মুশকিল। তাই বললাম, ”কোথায় যাওয়ার কথা বলছিস তুই?”

”বাঃ তোর মনে নেই? জানি, তুই ভুলে মেরে দিবি। সেজন্যই সাতসকালে তোকে ফোনটা করলাম। বড় জার্নালিস্ট হয়ে গেছিস তো। এখন আর আমাদের মতো ছোটখাটো লোকের কথা তোর মনে থাকবে কেন?”

অন্য কেউ হলে কথাটা শুনে বিরক্তই হতাম। কিন্তু তনুময় আমার ছোটবেলার বন্ধু। একটু পাগলা টাইপের। বেশি পড়াশুনো করে ওর মাথাটা গেছে। অদ্ভুত—অদ্ভুত সব ব্যাপারে ওর আগ্রহ। এখন সাউথ ক্যালকাটার দিকে কোনও একটা স্কুলে নাকি বাংলা পড়ায়। আড়ালে ওকে আমরা পাগলা তনু বলে ডাকি। ওর সঙ্গে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। বললাম, ”ভ্যানত্যাড়ামি না করে আসল কথাটা বল তো?”

”আরে, আমাদের প্রেস কনফারেন্সে। এই তো গেল পরশু তোর বাড়িতে গিয়ে তোকে কার্ড দিয়ে এলাম।”

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। ওদের মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের কী একটা প্রেস কনফারেন্স আছে আজ আশুতোষ মিউজিয়ামে। বেলা একটায়। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল তনুময়। ওদের ক্লাবের নামটা আমার মনে পড়ল না। পশ্চিমবাংলায় এখন কয়েকশো মাউন্টেনিয়ারিং আর ট্রেকিং ক্লাব। রোজই একটা করে গজাচ্ছে। অত মনে রাখা যায়? দুর্গাপুজোর আগে আর পরে এইসব ক্লাবের চিঠি আসতে শুরু করে আমাদের অফিসে। লোকজনের কাছ থেকে এরা টাকাপয়সা তুলে হিমালয়ের অমুক শৃঙ্গ, তমুক শৃঙ্গ জয় করতে বেরোয়। ফিরে এসে বলে, ক্লাইম্ব করেছে। মাউন্টেনিয়ারিং এখন কিছু চালাক লোকের কাছে ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের খবর ছেপে অনেকবার ঠকেছি। আজকাল এই ধরনের চিঠি পেলেই আমি ফেলে দিই।

তনুময় সেদিন বলেছিল, প্রেস কনফারেন্সের পর লাঞ্চের ব্যবস্থাও আছে। সেদিন হ্যাঁ, হুঁ করে ওকে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ ওদের প্রেস কনফারেন্সে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। বেলা বারোটায় আমার যাওয়ার কথা সল্ট লেক স্টেডিয়ামে। পুরনো প্রেস বক্স ভেঙে নতুনভাবে তৈরি করা হবে। স্টেডিয়ামের চিফ এক্সিকিউটিভ কর্নেল সৌমিত্র রায়। আমার সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক। উনি বিশেষভাবে আমাকে অনুরোধ করেছেন। ”কালকেতুবাবু, আপনি দেশ—বিদেশের অনেক নামীদামি স্টেডিয়ামে গেছেন। আপনার ভাল আইডিয়া আছে প্রেস বক্স সম্পর্কে। আপনি যদি এসে আমাদের সাহায্য করেন, তা হলে ভাল হয়।”

স্টেডিয়ামে না গেলে আমার চলবে না। তনুময়কে বললাম, ”সরি ভাই। তোদের প্রেস কনফারেন্সে আমি যেতে পারব না। আমি কৌশিককে বলে দিচ্ছি। ওর ডে ডিউটি। তোদের খবরটা ও আমাদের কাগজে করে দেবে।”

কথাটা শুনেই আঁতকে উঠল তনুময়, ‘প্লিজ, কালকেতু, আমাকে তুই ডোবাস না। ক্লাবের সবাই জানে, প্রেস কনফারেন্সে তুই থাকবি। তুই যে আমার বন্ধু সেটা মেম্বারদের অনেকেই বিশ্বাস করে না। তুই আজ না এলে আমার প্রেস্টিজ একেবারে পাংচার হয়ে যাবে।”

”প্রেস কনফারেন্সটা কী নিয়ে?”

”মহাভারত নিয়ে। খুব ইন্টারেস্টিং একটা সাবজেক্ট। তুই আয়, তা হলেই সব জানতে পারবি।”

মহাভারত নিয়ে? শুনে হেসে ফেললাম. তনুময়ের কি মাথা খারাপ? মনে পড়ল ও যেদিন আমার বাড়িতে এসেছিল, সেদিন বলেছিল, ওদের ক্লাবের তিনটে ছেলে অমরনাথের দিকে গিয়েছিল। তারা সদ্য ফিরেছে। ছেলেগুলো অভিজ্ঞতার কথা বলবে। আর ওদের তোলা কিছু ছবির স্লাইডও প্রেস কনফারেন্সে দেখাবে। কলকাতা থেকে প্রতি বছর অনেকেই ওদিকে তীর্থ করতে যায়। অমরনাথ যাওয়া এখন আর তেমন কঠিন না। অভিজ্ঞতার কথা নতুন কী আর বলবে? এইসব প্রেস কনফারেন্সে যাওয়া মানে সময় নষ্ট।

আমার আগ্রহ বাড়ানোর জন্যই তনুময় মহাভারতের কথা বলল কিনা বুঝতে পারলাম না। বললাম, ”মহাভারতের সঙ্গে তোদের ট্রেকিংয়ের সম্পর্ক কী? আমি তো খেলার খবর ছাড়া আর কিছু ছাপতে পারব না ভাই।”

”তোকে কিচ্ছু ছাপতে হবে না। তোকে আসতে বলার অন্য কারণ আছে। খেলার রিপোর্ট করার বাইরে অন্য ব্যাপারেও তোর ইন্টারেস্ট আছে। তাই তোকে ডাকছি। না এলে পরে কিন্তু আফসোস করবি।”

নীচ থেকে ফিরোজ আলি গাড়ির হর্ন দিচ্ছে। তনুময়ের সঙ্গে আর বেশি কথা বলা যাবে না। তাড়াতাড়ি বললাম, ”কী এমন ব্যাপার যে, আফসোস করব?”

”ফোনে অত বলতে পারব না ভাই। খুব বিপদের মধ্যে আছি। তাও তুই জানতে চাইছিস বলে বলছি। নকুলের বডি আমরা আবিষ্কার করেছি।”

”কে নকুল?”

”পাণ্ডবদের চতুর্থ ভাই। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন…নকুল। সেই নকুলের কথা বলছি। কেন, নকুলের উপর লেখা আমার বইটা তুই পড়িসনি? তুই কী রে কালকেতু? বইটা সেদিন যে তোর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এলাম!”

তনুময়ের গলায় অভিমান। সেটা লক্ষ করে আমার খারাপই লাগল। কয়েকদিন আগে আমার বাড়িতে এসে বইটা ও আমার স্ত্রী ফুল্লরাকে দিয়ে গিয়েছিল। আজকাল রামায়ণ—মহাভারতের চরিত্রগুলো নিয়ে অনেকেই বই লিখছেন। এক—একজন এক—একরকম ব্যাখ্যা করে। এরকম একজন লেখকের সঙ্গে কোনও একটা অনুষ্ঠানে যেন আমার আলাপও হয়েছিল। নামটা মনে আছে। ডঃ দীপক চন্দ্র। তখন উনি পূর্ব সিঁথির দিকে থাকতেন। পণ্ডিত ব্যক্তি। মনে আছে, সেদিন উনি মহাভারতের গল্প শোনাতে শোনাতে আমাকে বলেছিলেন, ”কুন্তীকে আপনারা যতই মহীয়সী বলে মনে করুন না কেন, আসলে উনি খুব স্বার্থান্বেষী মহিলা ছিলেন।”

নকুল বইটাতে তনুময়ও নাকি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, পাণ্ডবদের মধ্যে নকুলই ছিলেন সেরা। ওর বইটা পড়ার সময় আমি পাইনি। বইটা পড়ে ফুল্লরা আমায় বলেছিল। তনুময় যাতে দুঃখ না পায়, তাই তাড়াতাড়ি বললাম, ”তোর বইটা ফুল্লরার খুব ভাল লেগেছে রে।”

তনুময় উৎসাহ পেয়ে বলল, ”বইতে আমি যা লিখেছিলাম, তাই সত্যি হল। যাকগে, তুই এলেই সব জানতে পারবি। কখন আসছিস বল।”

ওকে এড়ানো যাবে না। বললাম, ”আমি একটু দেরিতে যাব। এই ধর, বেলা দেড়টা নাগাদ। তার আগে, পারব না।”

”তাই আয়।” বলেই ফোনটা ছেড়ে দিল তনুময়।

গলফ স্টিকের ব্যাগটা নিয়ে নীচে নামতেই ফিরোজ বলল, ”দাদা, আপনি অনেক দেরি করে ফেললেন। ঠিক আটটার সময় আমার কাছে কপিলদেব আসবে। আপনার সঙ্গে আমি কিন্তু আধঘণ্টার বেশি খেলতে পারব না।”

গাড়িতে উঠতে উঠতে বসলাম, ”কপিল কলকাতায়?”

”হ্যাঁ। কাল রাতের ফ্লাইটে এসেছে। মরিশাসে খেলতে যাচ্ছে। তার আগে আমার কাছ থেকে কিছু টিপস নিয়ে যাবে।”

ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর কপিল আজকাল প্রায়ই গলফ খেলে। কলকাতায় এলে প্রায়ই ও ফিরোজের সঙ্গে দেখা করে। কথায় কথায় ফিরোজ একদিন বলেছিল, কপিল খুব উন্নতি করেছে। ক্রিকেট না খেলে যদি শুরু থেকেই গলফ খেলত, তা হলেও অনেক দূর উঠত। মাঝে—মাঝে মনে হয়, ফিরোজের কথা সত্যি। কপিলের মতো প্লেয়াররা প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। এরা যে খেলাই খেলুক, কেউ এদের আটকাতে পারবে না। কেন জানি না, আমার মনে হয়, শচীন আর সৌরভ—এই দু’জন ভুল খেলায় গেছে। ক্রিকেট না খেলে যদি ওরা ফুটবল খেলত, তা হলে বিশ্বে অনেক বেশি লোক ওদের চিনত। ক্রিকেট আর ক’টা দেশ খেলে?

আমার বাড়ি থেকে গলফ কোর্স খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে মিনিট তিনেকের পথ। মেন গেট দিয়ে ঢোকার পথে দেখি নবারুণ হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওকে সবাই ডঃ নবারুণ ভট্টাচার্য বলে চেনে। অ্যানথ্রোপলজিস্ট। ওর কিছু বই বিদেশেও বিক্রি হয়। থাকে গলফ গার্ডেনে। ওর বাড়ির বারান্দা থেকে গলফ কোর্স দেখা যায়। প্রায়ই বিদেশে বক্তৃতা দিতে যায় নবারুণ। কলকাতায় থাকলে গলফ খেলতে আসে। সমবয়সী বলে ওর সঙ্গে প্রায়ই গলফ খেলি। নবারুণের সঙ্গে আমার আলাপ এই গলফ খেলতে এসেই।

ফিরোজকে গাড়ি থামাতে বলে নেমে পড়লাম। আমাকে দেখে নবারুণ বলল, ”আরে কালকেতু! তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম।”

বললাম, ”মাঝে কিছুদিন তোমায় দেখিনি। বাইরে ছিলে বুঝি?”

”হ্যাঁ, কাল বিকেলে ফিরেছি। বিশ্বকাপের সময় তোমার লেখা পড়তাম। তোমার উপর একটু রাগ হয়েছে ভাই।”

”কেন?”

”তুমি ব্রাজিলের বিরুদ্ধে এত লিখছিলে কেন?”

”বিরুদ্ধে তো লিখিনি। যা সত্যি, তাই লিখেছি। রেফারি না টানলে ব্রাজিল এবার কোয়ার্টার ফাইনালেই পৌঁছতে পারত না। যাক সে কথা। তোমার রাগ হওয়ার তো কোনও কারণ নেই। ব্রাজিল জিতুক বা হারুক, তোমার তাতে কী?”

”কী বলছ তুমি? ব্রাজিল ইজ ব্রাজিল। বেস্ট টিম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ওই টিমকে সাপোর্ট করব না তো কাকে করব?”

কথায় কথা বাড়বে। ফুটবলপ্রেমীরা যে কেন ব্রাজিলের সাপোর্টার, জানি না। সত্যি কথা লেখার জন্য অফিসেও ফোন করে আমার উপর অনেকেই ঝাল ঝেড়েছেন বিশ্বকাপের সময়। মশাই, আপনি ফুটবলের কিছু বোঝেন না। কেন লেখেন? জীবনে কোনওদিন ফুটবল খেলেছেন? ব্রাজিলের সমালোচনা করছেন? গালাগাল শুনতে তখন আমার মন্দ লাগত না। যাক, আমার লোকটা অন্তত ওঁরা পড়েছেন।

নবারুণকে বললাম, ”রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করবে? না কি কোর্সে যাবে?”

”চল, যাচ্ছি। কিন্তু আবার বলছি, তুমি ঠিক করোনি ভাই। আমি তো তোমাদের সম্পাদক সমীপেষুতে চিঠি লিখব ভেবেছিলাম। তোমাদের হাতে কলম আছে বলে, যা খুশি তাই লিখবে?”

প্রসঙ্গ না বদলালে নবারুণ ব্রাজিল নিয়ে বলেই যাবে। বললাম, ”এবার কোত্থেকে ঘুরে এলে, বল?”

”পহেলগাঁও। সে এক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কিন্তু সিক্রেট। তোমাকে বলা যাবে না। তোমরা রিপোর্টার। কী লিখে দেবে। আমি মুশকিলে পড়ে যাব।”

নবারুণ বলল বটে, গোপন ব্যাপার। কিন্তু আমি জানি, গলফ খেলতে খেলতে ও সেটা আমাকে বলে ফেলবে। ওর পেটে কোনও কথা থাকে না। ওর জগতের নানা ঘটনা প্রায়ই আমাকে বলে। একবার তো আমার জন্য ও বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছিল। বছরখানেক আগের কথা। এই গলফ কোর্সেই কথা বলতে বলতে নবারুণ আমাকে হঠাৎই জারোয়াদের কথা বলে। আন্দামানের প্রাচীন অধিবাসী এই জারোয়া। ওরা সেই আগেকার আমলের মতোই আছে। এখনও উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ওদের সভ্য করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু করা যায়নি। বিলুপ্ত প্রজাতির মানুষ বলে সরকারের তরফে ওদের প্রতি খুব নজর দেওয়া হয়।

নবারুণ বলেছিল, মাঝে—মাঝে ওরা জঙ্গল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। টুরিস্টদের কাছে খাবার চায়। না পেলে কোনও কোনও সময় কেড়েও নেয়। সেই সময় টুরিস্টদের সঙ্গে বোধ হয় কোনও ঝামেলা হয়েছিল। তাতে একজন জারোয়া ছেলে মারাত্মক আহত হয়। আন্দামান সরকারের লোকজন তাকে লুকিয়ে কলকাতায় এনে একটা ছোট নার্সিংহোমে ভর্তি করেছিল। নবারুণের মতো পাঁচ—ছ’জন অ্যানথ্রোপলজিস্ট পালা করে সারাক্ষণ সেই জারোয়া ছেলেটিকে নজরে রাখত। গবেষণা করার জন্য।

নবারুণের মুখে জারোয়া ছেলেটির কথা শুনে একদিন আমি নার্সিংহোমে চলে যাই। পরদিন ওকে নিয়ে আমাদের কাগজে একটা লেখা লিখেছিলাম। তারপর বিরাট হইচই। নবারুণ খুব মুশকিলে পড়েছিল আমার জন্য। কেন কাগজের লোককে খবরটা দিল? তারপর থেকে নবারুণ মুখে বলে বটে, তোমাকে কিছু বলব না। কিন্তু বলে ফেলে। শুনতে আমার বেশ ভাল লাগে। একবার ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম থেকে গুপ্তযুগের একটা অস্ত্র চুরি গিয়েছিল। ওর মুখ থেকে সেই খবরটা পাওয়ার পরও আমি খবরটা করিনি। সপ্তাহখানেক পর নবারুণ কী একটা কাজে দ্বারকায় গেল। তখন আমি খবরটা আমাদের কাগজে লিখেছিলাম। সন্দেহটা নবারুণের উপর পড়েনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোর ধরা পড়েছিল।

হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে কোর্সে পৌঁছে দেখি ফিরোজ গাড়ি পার্ক করে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, দু’জন ক্যাডির সঙ্গে। আসলাম আর ইজাজ। আমাদের চেনা ছেলে। ওরা দু’জনই খুব এক্সপার্ট। গলফ ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিয়ে আসলাম বলল, ”আজ কিন্তু দুটো হোল খেলতে হবে সাব। ফোর্থ হোল—এর দিকে একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে। ওদিকে পুলিশের ভিড়।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”কার ডেডবডি?”

”কে জানে? অল্পবয়সী একটা ছেলে। কেউ বোধহয় খুন করে ফেলে গেছে।”

গলফ খেলা আমার মাথায় উঠল। আমাদের পেশায় একটা কথা আছে, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ কে বলতে পারে গলফ কোর্সের এই খুন পরে বিরাট খবর হয়ে দাঁড়াবে না? আসলামকে বললাম, ”চল তো দেখি, কে খুন হল।”

শুনে ফিরোজ হাসল। তারপর বলল, ”তোমাকে নিয়ে এই প্রবলেম। খেলতে এসেও তুমি ভুলতে পারো না তুমি জার্নালিস্ট।”

ওকে বললাম, ”কিছু মনে কোরো না ভাই। তুমি আজ নবারুণকে নিয়ে খেল। আমি পরে তোমার কাছে আসছি। আমার দেরি হলেও কপিলকে তুমি কোনওরকমে বসিয়ে রেখো। আজ ওর ইন্টারভিউ নিতে হবে।”

চার নম্বর হোল—এর কাছে যখন পৌঁছলাম, তখন স্ট্রেচারে করে পুলিশের লোক ডেডবডি বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। একজন এস আই কথা বলছে গলফ কোর্সের কর্মীদের সঙ্গে। ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। আমাকে দেখেই এস আই বলল, ”কালকেতুদা, আপনি! রোজ খেলতে আসেন নাকি এখানে?”

ছেলেটা তা হলে আমাকে চেনে। আমার বন্ধু পুলিশ অফিসার সুদীশ নাগের কল্যাণে পুলিশের অনেকেই আমাকে চেনে। বললাম, ”রোজ নয়। মাঝে—মাঝে। ক্যাডিদের মুখে শুনলাম, ডেডবডি পড়ে আছে। কী ব্যাপার?”

”বুঝতে পারছি না। তেইশ—চব্বিশ বছর বয়সী একটা ছেলে। মনে হয়, মার্ডার বাইরে কোথাও হয়েছে। এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।”

গলফ কোর্সের চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে ডেডবডি ভিতরে রেখে যাবে কী করে, বুঝতে পারলাম না। বললাম, ”সেটা কী করে বুঝলে?”

”ওই তো দেখুন, পাঁচিলের মাঝে কত বড় একটা ফোকর। ওখান দিয়েই ডেডবডিটা নিয়ে ওরা ঢুকেছিল। মাসখানেক আগেও একটা ডেডবডি এখানে আমরা পেয়েছি। জায়গাটা নির্জন তো। রাতের দিকে এই অপকর্মটা করা সম্ভব। মনে হয়, গাড়িতে করে ওরা ডেডবডিটা এনেছিল। আশপাশের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে দেখি। কাল রাতে কেউ গাড়ির আওয়াজ শুনেছেন কিনা, তা জানতে হবে।”

”ছেলেটা খুন হয়েছে কীভাবে?”

”পিস্তলের গুলিতে।”

”ওর সম্পর্কে কোনও খোঁজ পাওয়া গেল?”

”পার্সে একটা কার্ড পেলাম। নাম, রজত চক্রবর্তী। ঠিকানা, যাদবপুরের বাঘা যতীন কলোনির। মনে হয় ভিডিও ফটোগ্রাফির কাজ করে। থানায় ফিরেই আমি লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেব।”

না, তেমন কোনও বড় খবর হবে না। পকেট থেকে আমার একটা নেম কার্ড বের করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ”এতে আমার সব কন্ট্যাক্ট নম্বর দেওয়া আছে। আমাকে খবরটা দিও তো ভাই।”

”শিওর। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনাকে আমি সুদীশদার সঙ্গে দেখেছি। তখন আমি ডি ডি—তে ছিলাম। আনন্দমেলায় আপনার রহস্য গল্পগুলো প্রায়ই পড়ি। ভাল লাগে।”

”সুদীশের সঙ্গে তোমার দেখা হয়?”

”প্রায়ই। উনি যখন পুলিশ ক্লাবে আসেন। আমি যাই কালকেতুদা। বডিটা বোধ হয় ভ্যানে তুলে ফেলেছে। পরে আপনাকে ফোন করব।”

এস আই ছেলেটা গেটের দিকে এগোতেই আমি ক্লাব হাউসের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এই যাঃ, ছেলেটার নামটাই জানা হল না। পরে যাদবপুর থানায় ফোন করে জেনে নিতে হবে। হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। এর মধ্যেই চড়া রোদ্দুর উঠে গেছে। টালিগঞ্জের এই গলফ কোর্সটা খুব সুন্দর। কতরকমের সবুজ ঘাস। সকালের দিকে নানারকমের পাখির ডাক শুনতে পাই। আশপাশের অনেকেই এখানে হাঁটতে আসেন। বিভিন্ন পেশার লোক। অনেকের সঙ্গে আলাপও হয়ে গেছে। দেখা হলে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দু’চার মিনিট কথা বলেন। আজ দেখলাম, গলফ কোর্সের মাঠ একদম ফাঁকা। তার মানে, ডেডবডি পড়ে থাকার খবরটা চাউর হয়ে গেছে। কেউ আর এদিকে মাড়াননি।

ক্লাব হাউসে পৌঁছনোর পর আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, ফিরোজ কোথাও নেই। তার মানে ও আর নবারুণ এখনও খেলছে। ইস, ফিরোজের সঙ্গে খেলতে গেলেই ভাল করতাম। শুধুমুধু আধঘণ্টা বসে থাকতে হবে। বাইরের লাউঞ্জে অনেক চেয়ার—টেবল। খেলে এসে অনেকেই এখানে বিশ্রাম নেন। চা, কফি, সফট ড্রিঙ্কস আর স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়। খেতে খেতে অনেকে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নেন। এঁরা বেশিরভাগ কর্পোরেট জগতের মানুষ। কোনও কোম্পানির চেয়ারম্যান অথবা এক্সিকিউটিভ। আজও অনেকে বসে আছেন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। গলফ খেলার ফাঁকে ফাঁকে অনেকেই ব্যবসার কথা সেরে নেন।

কফির অর্ডার দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। এদিক—এদিক তাকিয়ে পাশের টেবলে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজটা পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী কাগজ। একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। প্রথম পাতায় গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কাশ্মীরে উগ্রপন্থী হানা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এইসব খবর পড়ায় আমি আগ্রহ বোধ করি না। খেলার পাতাতেও বড় কোনও খবর নেই। ভেতরের পাতায় নজর বোলাতে বোলাতে হঠাৎই একটা খবরে আমার কৌতূহল হল।

খবরটা লন্ডনের। মদ্যে আফ্রিকায় চাদ বলে একটা দেশ আছে। সেখানে একদল বিজ্ঞানী পৃথিবীর আদিতম মানুষের মাথার খুলি আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের ধারণা, মাথার খুলিটা পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগেকার। ওই সময় সম্পর্কে বলতে গেলে বিজ্ঞানীদের কোনও ধারণাই নেই। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী বলেছেন, এটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। মানব শরীরের বিবর্তন সম্পর্কে এতদিন আমাদের যা ধ্যানধারণা, তা সব বদলে দেবে এই ফসিল। খবরটা বেরিয়েছে ‘দ্য নেচার’ পত্রিকায়।

পুরো খবরটা দু’—তিনবার পড়লাম। পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগেকার মানুষের মাথার খুলি! এখনও অবিকৃত আছে? ভাবা যায়? অতদিন আগে মানুষ বলে পৃথিবীতে কিছু ছিল নাকি? ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের পূর্বপুরুষ হল গোরিলা, ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি। যদিও এখন অনেকে বলেন, পূর্বপুরুষ বলাটা ঠিক না। বলা উচিত কাজিন বা তুতো ভাই। কিন্তু কত সময় লেগেছিল ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষ হতে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে। আর এক—একজন বিজ্ঞানী এক—একরকম ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, বাড়িতে ফিরেই ইন্টারনেট খুলে বসব। মাথার এই খুলিটা সম্পর্কে আরও জানতে হবে।

খবরটা পড়তে গিয়ে দেখলাম, এই আবিষ্কারের পুরো খরচ দিয়েছে নেচার পত্রিকা। ওরাই সারা বিশ্বের কুড়িজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে গিয়েছে চাদে। দীর্ঘ ছ’মাস ধরে ওখানে রেখেছে। প্রায় দশ কোটি টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। বিদেশি পত্রিকাগুলো পারেও বটে, একটা খবরের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতে! আমাদের এখানকার কোনও কাগজ এই উদ্যোগ নেবে? মনে হয় না।

হঠাৎই আমার পাগলা তনুর কথা মনে পড়ল। সকালে ও বলছিল, অমরনাথে ট্রেকিং করতে গিয়ে মহাভারতের নকুলের বডি ওরা নাকি আবিষ্কার করেছে। ওর দাবি কতটা ঠিক, সে সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। কিন্তু কোনও কাগজ ইচ্ছে করলে এ নিয়ে হইচই ফেলে দিতে পারত। মহাভারত নিয়ে সাধারণ লোকের মনে এখনও প্রচুর কৌতূহল আছে। বিশেষ করে টিভিতে মহাভারত সিরিয়াল হওয়ার পর থেকে। পাগলা তনুদের প্রেস কনফারেন্সে যাব না ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যাওয়া উচিত। গিয়ে দেখতে চাই, ব্যাপার কী?

গলফ খেলে একে একে অনেকেই ফিরে আসছেন। হঠাৎ দেখি, নবারুণ আমার উলটো দিকের চেয়ারে বসে রয়েছে। চোখাচোখি হতে আমায় বলল, ”এত মন দিয়ে কী পড়ছ কালকেতু?”

বললাম, ”তোমাদের লাইনের খবর। ফিরোজ গেল কোথায়?”

”টয়লেটের দিকে গেছে। আসছে। কপিল ওকে এখুনি মোবাইলে ফোন করেছিল। বলল, এখন আসতে পারবে না। কী একটা কাজে ফেঁসে গেছে। বেলা বারোটার পর ফ্রি হবে। ফিরোজ তোমাকে কথাটা বলে দিতে বলল।”

বললাম, ”তা হলে আমার বসে থেকে লাভ নেই। আমি উঠি।”

”মাত্র আটটা বাজে। এত সকালে বাড়ি গিয়ে কী করবে?”

”কাজ আছে ভাই।”

”রাখো তোমার কাজ। আমার বাড়িতে চল। তোমাকে একটা নতুন জিনিস দেখাব। পাঁচ থেকে আট হাজার বছর আগেকার পুরনো মানুষের মাথার চুল। দেখলে তুমি তাজ্জব হয়ে যাবে।”

”তোমার আবিষ্কার নাকি?”

”বলতে পারো। হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলেছি।”

”কোথায় করলে?”

”বলছি। বাড়িতে চল। কিছু স্যাম্পল আমি নিয়ে এসেছি। সেগুলো তোমাকে দেখাতে পারি। তবে তোমায় কথা দিতে হবে, তুমি সেটা নিয়ে খবর করবে না।”

”বেশ, করব না। চল তা হলে। তোমার বাড়িতে বসেই না হয় এক কাপ কফি খেতে খেতে তোমার আবিষ্কারের গল্প শোনা যাবে।”

দু’জনে উঠে পড়লাম। আমার বাড়ি যাওয়ার পথেই নবারুণের বাড়ি। অদ্ভুত নাম বাড়িটার। রামাপিটাকাস। বোধ হয় কোনও অ্যানথ্রোপলজিক্যাল টার্ম হবে। নবারুণকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এর আগে মাত্র একবারই ওর বাড়িতে গিয়েছি। একতলা, কিন্তু সামনে—পিছনে অনেকটা জায়গা। পুরো বাড়িটাই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনে লোহার ফটক। সবসময় একজন নেপালি দরোয়ান পাহারায় থাকে। প্রথমদিন গিয়ে মনে হয়েছিল, বাড়িটা খাঁচার মতো। তবুও দারুণ সাজানো—গোছানো।

পোর্টিকোর নীচে একটা ছ’ফুটের মতো যক্ষের মূর্তি। সেটা দেখলেই মনে হবে ছোটখাটো কোনও জাদুঘরে ঢুকেছি। দরজা পেরিয়েই সামনে ড্রয়িংরুম। সেখানে নানা ধরনের মূর্তি। কোনওটা ব্রোঞ্জের, কোনওটা পাথরের। বিভিন্ন সাইজের। নবারুণ নিশ্চয়ই বহুদিন ধরে এসব সংগ্রহ করেছে। ছেলেটার রুচি আছে। চারদিকে চোখ বোলালে মনে হবে, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানী নয়, কোনও প্রত্নতত্ত্ববিদের বাড়িতে ঢুকেছি।

নবারুণ বিয়ে—থা করেনি। পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই চায় না বাড়িতে কেউ এসে যখন—তখন বিরক্ত করুক। দরোয়ান ছাড়া ওর বাড়িতে আছে একজন রাঁধুনে। আর ফাইফরমাশ খাটার জন্য একটা অল্পবয়সী ছেলে। নবারুণকে দেখে মনে হয়, ওর প্রচুর টাকা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো ছাড়া, দেশ—বিদেশের বিভিন্ন কাগজে ও লেখে। কিন্তু তাতে কত টাকা পেতে পারে? নিশ্চয়ই ওর পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছে। না হলে শুধু পড়িয়ে এমন বাড়ি আর দুটো গাড়ি—করা সম্ভব না।

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে রামাপিটাকাসে পৌঁছলাম। আমাকে দেখেই নেপালি দরোয়ান উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে আমাদের কাছ থেকে গলফ ব্যাগ দুটো নিয়ে একটা শেড—এর তলায় রেখে দিল। দেখে আমার বেশ ভাল লাগল। এরা জানে কখন কী করতে হবে। লোহার ফটকের পাশে বেশ বড় লন। সেখানে একটা রঙিন ছাতা। তার নীচে ছোট একটা টেবল আর তিনটে চেয়ার। ড্রয়িংরুমে ঢোকার আগে নবারুণ বলল, ”কালকেতু, তুমি এখানে বোসো। অদ্ভুত জিনিসটা তোমাকে আমি এনে দেখাচ্ছি।”

নবারুণ বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। আমি চেয়ারে বসলাম। লনের উত্তরদিকে হঠাৎ একটা গুহামানব চোখে পড়ল। কিসের তৈরি, দূর থেকে বুঝতে পারলাম না। একটা সুন্দর ফোয়ারা। তার পাশে মূর্তিটা রাখা। হাতে পাথরের ডাণ্ডাজাতীয় কিছু। দু’তিন মিনিট মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ”নাহ, নবারুণ, তোমার বাড়িটা এখন একজন অ্যানথ্রোপলজিস্টের বলেই মনে হচ্ছে।”

টেবলের উপর নবারুণ মোবাইল ফোনটা ফেলে রেখে গেছে। সেটা বাজছে। একবার বেজে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার বেজে উঠতেই আমি সেটটা তুলে নিয়ে বললাম, ”হ্যাঁ, বলুন।”

”সার, জিনিসটা কখন পাওয়া যাবে?”

”কে বলছেন?”

”আমার গলা বুঝতে পারছেন না? আমি মতিয়া বলছি। হংকং থেকে স্কিবারম্যান সাহেব ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, কাল দুপুরের ফ্লাইটেই মালগুলো নিয়ে যাতে আমি বেরিয়ে পড়ি। এদিকে সব ব্যবস্থা করা আছে।”

বললাম, ”নবারুণ কাছাকাছি নেই। আপনি পরে ফোন করুন।”

লোকটা এতক্ষণ আমাকে নবারুণ ভেবে কথা বলে যাচ্ছিল। ভুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দিল। নবারুণ কি কোনও ব্যবসা করে? না হলে লোকটা কেন মাল…পাঠানোর কথা বলছিল? ব্যবসা না করলে কোনও মানুষের এত টাকাপয়সা থাকতে পারে না। শুধু ছাত্র পড়িয়ে আর বিদেশের ম্যাগাজিনে লিখে কত টাকা রোজগার করা সম্ভব?

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটা ছোট বাক্স হাতে নিয়ে নবারুণ বেরিয়ে এসে আমায় বলল, ”এই দ্যাখো, সেই চুল। পাঁচ থেকে আট হাজার বছরের পুরনো।”

বাক্স খুলে নবারুণ একটা পলিথিনের প্যাকেট বের করল। তার ভেতর বাদামি রঙের একগোছা চুল। দেখে তাজ্জব হওয়া তো দূরের কথা, আমার তেমন কিছুই মনে হল না। বললাম, ”এই চুল যে অত হাজার বছরের পুরনো, কী করে তুমি জানলে?”

”কেন, কার্বন টেস্ট করিয়ে।”

”পেলে কোথায়?”

”অমরনাথের নাম তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ। যেখানে লোকে তীর্থ করতে যায়। ওখানেই এক গুহাতে বরফ চাপা পড়ে ছিল এই মানুষটা। এ—বছর জুলাই মাসে ওখান থেকে তীর্থযাত্রীদের একটা দল ফিরে আসার পর দিল্লির একটা কাগজে ইন্টারভিউ দেয়, মহাগুনাস পাস—এর এক গুহায় রাত্তির কাটানোর সময় নাকি ওরা একটা মানুষের ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছে। আমি তখন দিল্লিতে। খবরটা পড়ে আমার খুব কৌতূহল হয়েছিল। আমি আমার কয়েকজন ছাত্রকে খোঁজ নিতে বললাম। ওরা সেই তীর্থযাত্রীদের একজনকে ধরে নিয়ে এল।”

”তারপর?”

”দু’—তিনদিন লোকটার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, হ্যাঁ, ওরা সত্যি—সত্যিই একটা ডেডবডি দেখেছে।”

”কিন্তু সেটা যে পাঁচ থেকে আট হাজার বছরের পুরনো, তা কী করে বুঝলে?”

”ওর কাছ থেকে বর্ণনা শুনে। বরফে চাপা পড়া লোকটার পরনে শুকনো ঘাসের তৈরি জামা ছিল। ওই জামার ভেতরের দিকটায় নাকি হরিণের চামড়া লাগানো। শরীরের নীচের অংশে বল্কল। ডেডবডির পাশে একটা বড় ধনুক পড়ে ছিল। সেটা নাকি এত ভারী যে, কেউ তুলতে পারেনি। ধনুকটা কোন ধাতুর তৈরি, তীর্থযাত্রী লোকটা আমাকে তাও বলতে পারল না। ডেডবডির শরীরে নানা গয়না দেখেছিল ওরা। সেই গয়না নাকি অনেক পুরনো আমলের। যাই হোক, এইসব শুনে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল ব্রোঞ্জযুগের আগেকার মানুষ।”

আরে, পাগলা তনুর কথার সঙ্গে তো নবারুণের কথা একদম মিলে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ”এটাই কি সেই নকুলের বডি?”

”তুমি কী করে জানলে?” নবারুণ প্রচণ্ড অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ”কেউ কেউ বলছে বটে ওটা চতুর্থ পাণ্ডবের বডি। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। মহাগুনাসের ওই অঞ্চলের কাছাকাছি ওই সময় যাঁরা বসবাস করতেন, ডেডবডিটা তাঁদের কারও হবে। যাক গে, তুমি তো তা হলে সবই জানো। আমার বলে আর লাভ নেই।”

নবারুণ সেই যে চুপ করে গেল, ওর মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বের করতে পারলাম না।

আশুতোষ মিউজিয়ামে পৌঁছতেই আমাকে দেখে পাগলা তনু এগিয়ে এসে বলল, ”কালকেতু, তুই এসে গেছিস। ভালই হয়েছে। আমি এতক্ষণ তোকেই মোবাইলে ধরার চেষ্টা করছিলাম।”

”কেন?”

”এদিকে আমাদের একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে। আজ প্রেস কনফারেন্স করা যাচ্ছে না। ক্যানসেলড।”

শুনেই বিরক্তি এসে গেল। এখানে আসব বলে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে যাওয়া হল না। এখন পাগলা বলছে, প্রেস কনফারেন্স হবে না। তনুময়ের মুখ— চোখ শুকিয়ে গেছে। চুল উসকোখুসকো। ভাল করে ওর দিকে একবার তাকাতেই বিরক্তি কেটে গেল। খারাপ কিছু একটা হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”কী হয়েছে রে?”

পাগলা তনু বলল, ”আরে, আমাদের ক্লাবের একটা ছেলে কাল রাতে মার্ডার হয়েছে। ওই ছেলেটার কাছেই আমাদের এক্সপিডিশনের সব ছবি আর স্লাইড ছিল।”

ফট করে গলফ ক্লাবের কথা আমার মনে পড়ে গেল। থানার এস আই কী নাম বলেছিল যেন? নামটা মনে পড়তেই বললাম, ”ছেলেটার নাম কি রজত চক্রবর্তী?”

শুনে চমকে উঠল পাগলা তনু, ”তুই কী করে জানলি?”

”ওর ডেডবডি তো গলফ ক্লাবের ভেতর পাওয়া গেছে।”

”ঠিক তাই। আরে, আমি জানতে পারলাম, বেলা এগারোটা নাগাদ। ওদের পাড়ার কাছেই থাকে আমাদের ক্লাবের আরেকটা ছেলে। ও এসে আমাকে বলল। আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে গেল জানিস। আমরা যে এত বড় একটা আবিষ্কার করলাম, তার কোনও চিহ্নই আর আমাদের কাছে রইল না।”

”তার মানে?”

”আমাদের পুরো এক্সপিডিশনটা ও ভিডিও ক্যামেরায় তুলেছিল। সব চুরি হয়ে গেছে কাল রাতে।”

”কোথায় রেখেছিল সে সব?”

”বাঘা যতীনের মোড়ে ওর একটা স্টুডিও ছিল। সেখানেই আমাদের ক্লাবের অফিস। রজত ওই স্টুডিওতেই থাকত। শুনলাম, সেই স্টুডিও কাল রাতে কারা যেন তছনছ করে দিয়েছে।”

”ছেলেটার আর কে কে আছে?”

”এখানে কেউ না। নর্থ বেঙ্গলের ছেলে। কলকাতায় এসেছিল পড়াশুনো করতে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে ওর পাহাড়ে যাওয়ার নেশা বাড়ে। গত তিন বছরে ছোট ছোট অনেকগুলো পিক ক্লাইম্ব করেছে। এ বার ট্রেকিং করে ফিরে আসার পর আমাকে স্লাইড দেখিয়েছিল। কী ঝুঁকি নিয়ে তুলেছিল সে সব ছবি, তুই চিন্তাও করতে পারবি না। সব গেল।”

”তোদের এক্সপিডিশনে ক’জন গেছিল?”

”তিনজন। রজত, পিন্টু আর টুবলু। আসলে কী জানিস, আমাদের তো টাকা—পয়সার খুব অভাব। সবাইকে সব এক্সপিডিশনে পাঠানো সম্ভব হয় না। অমরনাথে ওদের পাঠানোর পিছনে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে সব বলা যাবে না। চল, কোথাও বসি। আমার খুব খারাপ লাগছে জানিস। তুই এত ব্যস্ত মানুষ। তোর অনেকটা সময় আমি নষ্ট করে দিলাম।”

বললাম, ”ছাড় ও সব কথা। ছেলেটা হঠাৎ মার্ডার হল কেন, আগে শুনি।”

পাগলা তনু আর আমি বড় রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। অফিসে গিয়ে বসে কথা বলাই ভাল। রজত ছেলেটা সম্পর্কে আমার কৌতূহল হচ্ছে। ওর মার্ডার হওয়ার সঙ্গে ট্রেকিংয়ের যোগাযোগ আছে। না হলে এক্সপিডিশনের ছবি আর স্লাইডগুলোও চুরি হত না। পুলিশের এস আইয়ের সঙ্গেও একবার কথা বলে নিতে হবে। ওরা কোন লাইনে ভাবছে, সেটা জানা দরকার।

মেট্রো সিনেমার কাছে এসে পাগলা তনু বলল, ”এই কালকেতু, আয়কর ভবনের সামনে একটু দাঁড়াবি। পিন্টু এখানেই চাকরি করে। ওকে ডেকে আনি। তা হলে তুই আরও ভাল করে জানতে পারবি, অমরনাথে কী হয়েছিল।”

প্যারাডাইস সিনেমার পাশে ট্যাক্সিটা দাঁড় করালাম। তনুময় তাড়াতাড়ি আয়কর ভবনে ঢুকে গেল। মিনিট তিনেক পরেই পঁচিশ—ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে ও বেরিয়ে এল। ছেলেটার নাকের গোড়া কালো হয়ে গেছে। দু’পাশের গালও। বাঁ হাতের একটা আঙুলে ব্যান্ডেজ। ওকে দেখেই বুঝতে পারলাম, সদ্য পাহাড় থেকে ফিরেছে। হয়তো ফ্রস্ট বাইট হয়েছিল। তাই ব্যান্ডেজ। পাগলা তনু ট্যাক্সিতে ঢুকে বলল, ”এ পিন্টু দেবনাথ। আমাদের ক্লাবের বেস্ট মাউন্টেনিয়ার।”

পিন্টু মৃদু হেসে বলল, ”আপনাকে আমি চিনি। টিভিতে অনেকবার দেখেছি।”

ট্যাক্সি আমাদের অফিসের দিকে এগোতেই পাগলা তনু বলল, ”আমাদের কপাল ভাল রে কালকেতু। পিন্টু বলছে, কাল সন্ধেবেলায় ও রজতের কাছে গিয়েছিল। কিছু স্টিল ছবি ওর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিল। সেগুলো ওর কাছে আছে।”

বললাম, ”তোমার সঙ্গে আছে?”

”হ্যাঁ। আমি আজ অফিসে নিয়ে এসেছিলাম আমার কলিগদের দেখানোর জন্য। আপনি কি এখনই দেখবেন?”

”আমার অফিসে চল। তখন না হয় দেখা যাবে। রজতের মার্ডার হওয়ার খবরটা তুমি কখন পেয়েছ পিন্টু?”

”এই এখন। তনুময়দার কাছে। ভাবতেই পারছি না, ওর মতো একটা ডেয়ার ডেভিল টাইপের ছেলের এই পরিণতি হতে পারে।”

”ওকে কে মার্ডার করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?”

”জানি না। তবে কাল সন্ধেবেলায় যখন বাঘা যতীনে ওর স্টুডিওতে গেছিলাম, তখন ও একবার বলেছিল, কে যেন ওকে প্রেস কনফারেন্সে যেতে মানা করেছে। আর গেলেও যেন ও ছবিগুলো নিয়ে না যায়।”

”তাই নাকি? ওকে আর কী বলেছিল?”

”বলেছিল, অমরনাথে তোলা সব ছবি, স্লাইড আর ভিডিও ক্যাসেট যেন একটা বাক্সে ও রেডি করে রাখে। সেটা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, পরে ওকে জানিয়ে দেওয়া হবে।”

”আর তা না করলে?”

”হুমকি দিয়েছিল, ওর স্টুডিও জ্বালিয়ে দেবে। ওকে মার্ডার করবে।”

”তোমরা পুলিশে জানালে না কেন?”

”আসলে আমরা ভেবেছিলাম, কেউ চ্যাংড়ামি করছে। কালকেতুদা, এটা নিশ্চয়ই পুলিশ কেস হবে, তাই না?”

”হ্যাঁ। তোমার কাছেও পুলিশ আসতে পারে। তুমি যা জানো, সব বলে দিও। কোনও কিছু গোপন করতে যেও না।”

কথাগুলো শুনে পিন্টু কেমন যেন মুষড়ে পড়ল। পাগলা তনুকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”হ্যাঁ রে তনুময়, টুবলু ছেলেটা কোথায় থাকে রে?”

”শ্যামনগরের দিকে। তবে এখন হায়দরাবাদে গেছে। অফিসের কাজে। ও বড় চাকরি করে। টিনপ্লেটের মার্কেটিংয়ে। ফিরবে সামনের সপ্তাহে।”

ট্যাক্সি আমাদের অফিসের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমরা তিনজনে নেমে পড়লাম। দুপুরের দিকে এই সময় ক্যান্টিনে খুব বেশি ভিড় থাকে না। নিরিবিলিতে ওখানে বসে কথা বলা যাবে। তাই পাগলা তনু আর পিন্টুকে নিয়ে পাঁচতলায় উঠে গেলাম। সকালে সেই ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। প্রেস কনফারেন্সের পর লাঞ্চ ছিল বলে আর কিছু খাওয়ার কথা ভাবিইনি। ক্যান্টিনে বসতেই খিদে পেয়ে গেল। তিনজনের জন্য অর্ডার দিয়ে পাগলা তনুকে আমি বললাম, ”হ্যাঁ, এবার পুরো ব্যাপারটা আমায় খুলে বল তো? দেখি তোদের কিছু করা যায় কি না?”

”বলছি। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলে নিই। লাঞ্চের খরচা আমি দেব।”

পাগলা তনুকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। তাই বললাম, ”ঠিক আছে, তাই দিস।”

”শোন তা হলে। আমরা এই এক্সপিডিশনটা করেছিলাম, একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। মহাভারতের মহাপ্রস্থান পর্বের কথা তোর মনে আছে?”

”খানিকটা। ওই তো…কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কিছুদিন পর অর্জুনের নাতি পরীক্ষিতের হাতে রাজ্যের ভার দিয়ে পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে গেছিলেন।”

”বাঃ, এই তো তোর কিছুটা মনে আছে। তুই তো জানিস, মহাভারত নিয়ে আমি প্রচুর পড়াশুনোও করেছি। বেশ কিছুদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল, এই মহাপ্রস্থান বলে পাণ্ডবরা ঠিক কোথায় গেছিলেন। তা, সেটা জানার জন্যই লাইব্রেরিতে যাতায়াত শুরু করলাম। পড়ে আমার মনে হল, হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়ে পাণ্ডবরা প্রথমে গুজরাতের দ্বারকার দিকে যান। তারপর খানিকটা ফিরে এসে উত্তরে হিমালয়ের দিকে এগোন। তখনই মনে প্রশ্ন জাগল, হিমালয় তো বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। ঠিক কোন পথ দিয়ে ওঁরা স্বর্গে গিয়েছিলেন?”

পাগলা তনুর কথা শুনে মনে মনে হাসছি। জগতে কত রকম পাগলাই না আছে। এই মহাপ্রস্থান, স্বর্গ, নরক…এসব নিয়ে কার মাথাব্যথা আছে এখনকার যুগে? মহাভারতের অর্ধেকই গল্প। অতিরঞ্জিত কাহিনি। পাগলা খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। হেসে ফেললে মনে দুঃখ পেতে পারে। তাই চুপচাপ ওর কথা শুনতে লাগলাম। শুনতেই হবে। কেননা, রজত ছেলেটার মার্ডার হওয়ার সঙ্গে এই এক্সপিডিশন জুড়ে আছে। একটা না একটা ক্লু পেয়েও যেতে পারি।

”প্রথমে পড়াশুনো করে আমার মনে হয়েছিল, পাণ্ডবরা কেদারনাথের দিকে গেছিলেন। ওপরে ওঠার পথে একে একে মারা যান। শেষ পর্যন্ত একমাত্র যুধিষ্ঠিরই বেঁচেছিলেন। সেটা তুই নিশ্চয়ই জানিস। তা, কেদারনাথের ম্যাপ রুট এনে অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম, না, ওই পথে ওঁরা যাননি। মহাপ্রস্থানের পথে ধর্ম একবার পাগলা মহিষ সেজে আক্রমণ করেন ভীমকে। তখন ভীম দু’হাত দিয়ে সেই মহিষকে জাপটে ধরে জব্দ করেন। এই ঘটনাটা সম্ভব হতে পারে অমরনাথে। ভৈরবঘাটের চড়াইতে। ওখানে অমরনাথের ক্ষেত্রপাল ভৈরবনাথ প্রতিষ্ঠিত। তার অনুমতি ছাড়া কেউ অমরনাথের দর্শন পান না। ওই ভৈরবনাথের মূর্তিকেই মহিষ বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অবশ্য এটা আমার ধারণা।”

বললাম, ”পাণ্ডবরা যে রুটে অমরনাথে গেছিলেন, সেই রুটেই তা হলে তুই পিন্টুদের পাঠিয়েছিলি?”

”ঠিক ধরেছিস। তবে যে সময়ে তীর্থযাত্রীরা অমরনাথে যান, সে সময়ে না।”

”তার মানে?”

”দ্যাখ, অমরনাথে সারা বছর যাওয়া যায় না। শীতকালে তো নয়ই। তখন বরফে ঢাকা থাকে রাস্তা। ওখানে যাওয়ার সময় হল আষাঢ় পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা পর্যন্ত। অর্থাৎ জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে অগস্টের শেষ সপ্তাহ। শ্রাবণী পূর্ণিমাতেই নাকি অমরনাথ মন্দিরে বরফের শিবলিঙ্গ সব থেকে বড় অবস্থায় দেখা যায়। তাই এই একটা মাসে ওখানে তীর্থযাত্রীদের খুব ভিড়। সেই সময় আমাদের এক্সপিডিশন করলে কোনও লাভ হত না। তাই আমি পিন্টুদের পাঠিয়েছিলাম, একটু পরে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। আমার আন্দাজটা ব্যর্থ হয়নি।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”নকুলের দেহ কোথায় পাওয়া গেল?”

”আমি যে জায়গাটায় অনুমান করেছিলাম। মহাগুনাস গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে পঞ্চতরণীর দিকে কোনও একটা জায়গায়। মহাগুনাস পাস—এর হাইট প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার। সেপ্টেম্বরে ওই অঞ্চলটা দুর্গম। আমার ধারণা, ওই জায়গাতেই প্রথম দ্রৌপদী আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পড়ে যান। তখন ভীম তা দেখে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করেন, ”দ্রৌপদী তো কোনওদিন কোনও অধর্ম করেনি। তা হলে সে কেন মারা যাচ্ছে?” তখন যুধিষ্ঠির উত্তর দেন, ”দ্রৌপদী আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত অর্জুনকে। সেজন্য ওকে ফল ভোগ করতে হচ্ছে। তুমি আর পিছনে তাকিও না। চল, আমরা এগিয়ে যাই।”

যুধিষ্ঠিরকে সব সময় ধর্মরাজ বলে জেনে এসেছি। মহাভারতের সিরিয়ালে দেখেছি, তিনি কোনও অন্যায় কাজ করতে পারেন না। সেই লোক অসুস্থ স্ত্রীকে নির্জন পর্বতে ফেলে যেতেও দ্বিধা করেননি জেনে একটু অবাক হলাম। পাগলা তনুকে বললাম, ”তুই এসব জানলি কী করে?”

”কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মহাভারত থেকে। তারপর শোন, পাণ্ডবরা অমরনাথের দিকে আরও কিছুটা এগনোর পর হঠাৎ পড়ে গেলেন পঞ্চম পাণ্ডব সহদেব। ভীম ফের যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করলেন, ”সহদেব তো সব সময় আমাদের সেবা করত। তা হলে ও কেন স্বর্গে যেতে পারবে না?” তখন যুধিষ্ঠির বললেন, ”ও নিজেকে সব থেকে বেশি বিজ্ঞ মনে করত। সেই পাপে মারা গেল। তুমি আর পিছনে তাকিও না। সামনের দিকে এগিয়ে চল।”

বললাম, ”এর পর নিশ্চয়ই মারা যান নকুল?”

”ঠিক। ভীম ফের একই প্রশ্ন করলেন। তখন যুধিষ্ঠির তাঁকে বলেন, নকুল নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবান মানুষ বলে মনে করত। সেই পাপে মরল। এই নকুলের চরিত্রটাই আমাকে সবথেকে বেশি আকৃষ্ট করত বুঝলি। পিন্টুরা ওরই বডিটা আবিষ্কার করেছে। এবার তুই বল পিন্টু কী করে বডিটা তোরা পেলি।”

পিন্টু এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এ বার বলল, ”মহাগুনাস পাস পেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা তিনজন ওপরে ওঠার সময় তন্নতন্ন করে খুঁজতাম। অসংখ্য গুহা। একেকটা গুহায় বরফ জমে কঠিন পাথরের মতো হয়ে রয়েছে। তেরোদিন পর হঠাৎ একদিন সকালে একটা গুহার খাঁজে বডিটা আমাদের চোখে পড়ে। একটা স্বচ্ছ বরফের চাঁইয়ের মধ্যে ডেডবডিটা ছিল। প্রথম দেখেই আমাদের মনে হয়েছিল বরফের ভেতরে কেউ ঘুমিয়ে আছেন। দুপুরবেলায় যখন রোদ্দুর উঠল, তখন বরফ গলে যেতেই বুঝলাম, আমরা যাঁদের খুঁজতে এসেছি, তাঁদেরই কেউ হবেন। রজত ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলেছিল। আমি এমনি কিছু স্টিল ছবি। সেগুলো আপনাকে দেখাচ্ছি।”

”তারপর তোমরা কী করলে?”

”আমি আর রজত ওই বডিটা পাহারা দিতে লাগলাম। শেষনাগ বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে একটা ছোট মিলিটারি ছাউনি আছে। টুবলু সেখানে গিয়ে খবর দিতেই ওঁরা হেলিকপ্টার পাঠালেন। ওই হেলিকপ্টার করেই নকুলের ডেডবডি নিয়ে আসা হল পহেলগাঁওতে।”

”বরফ থেকে তোলার সময় বডি অবিকৃত ছিল?”

”না। কাজটা করেছিল আর্মির লোকেরা। তাই খানিকটা ড্যামেজ হয়েছিল। তবে ওরা পুরো বডিটা কী একটা কেমিক্যাল দিয়ে পুরো ধুয়ে দিয়েছিল। তারপর স্টেরিলাইজড পেপার মুড়ে হেলিকপ্টারে তুলে দেয়।”

তনুময়কে এবার জিজ্ঞেস করলাম, ”তোরা কী করে বুঝলি, ওটা নকুলের বডি? অর্জুন বা সহদেবের নয়? বা পরবর্তী কালে অন্য কারও। কোনও মুনি—ঋষি? হয়তো এমন কেউ, অমরনাথে গিয়ে আর ফেরেননি। গুহায় থেকে গিয়েছিলেন?”

”বডিটা না দেখলে তুই বিশ্বাস করবি না। নকুলকে নিয়ে আমি বিস্তর পড়াশুনো করেছি। উনি অনিন্দ্যসুন্দর ছিলেন। বাঁ হাতে সূর্যের উল্কি। ওটা সূর্যবংশের প্রতীক। ওই বডি পাণ্ডবদের ছাড়া আর কারও হতেই পারে না।”

”নকুলের দেহটা তুই দেখলি কী করে?”

”রাতের ক্যাসেটে। ডেডবডিটা এখন দিল্লিতে। মিউজিয়মের বিশেষ ঘরে রাখা আছে। মাইনাস সিক্স ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড টেম্পারেচারে। দ্যাখ কালকেতু, আমি আর কিছু চাই না। শুধু চাই, নকুলের বডি আবিষ্কারের সঙ্গে আমাদের ক্লাবের নামটা যেন থাকে। সেজন্যই প্রেস কনফারেন্সটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পিন্টুর কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে, কেউ বোধহয় চান না ক্রেডিটটা আমরা নিই। তুই তো, শুনেছি, নানা ধরনের রহস্যভেদ করিস। এই কেসটা একটু দ্যাখ না।”

কথা বলার ফাঁকেই খাবার এসে গেল। খেতে খেতে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে লাগলাম। পাগলা তনুর আবিষ্কার নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমার চিন্তা রজত বলে ছেলেটাকে নিয়ে। বেচারি খুন হয়ে গেল। কে ওর খুনের পিছনে, সেটা বের করা দরকার। খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর পাগলা তনুকে বললাম, ”তোদের কেসটা আমি নিচ্ছি। কয়েকটা জিনিস আমার চাই। এক, তোদের ক্লাবের মেম্বারদের নামের লিস্ট। দুই, পিন্টুর তোলা সব ছবি। তিন, যারা তোদের এক্সপিডিশনের স্পনসর তাদের নাম। আর তুই রাত ন’টার সময় আমাকে একবার ফোন করবি। মনে থাকে যেন।”

কাল অফিসে নানা কাজের চাপে পিন্টুর দেওয়া ছবিগুলো ভাল করে দেখার সময় পাইনি। আজ সকালে বাড়িতে সেগুলো নিয়ে বসলাম। বেশিরভাগই প্রাকৃতিক দৃশ্য। চারদিকে বরফঢাকা পাহাড়। সূর্যোদয়, সূর্যাস্তের সেই দৃশ্য দেখে মনে হল, কোনও শিল্পী যেন আপন খেয়ালে রং ছড়িয়ে দিয়েছেন ক্যানভাসে। এরকম প্রায় ছবিতেই পিন্টু, রজত আর টুবলু রয়েছে। তবে ওদের কাউকেই ভাল করে চেনা যাচ্ছে না। পরনে ট্রেকিংয়ের পোশাক। প্রত্যেকের চোখেই সানগ্লাস। সূর্যের আলো বরফে ঠিকরে চোখ ঝলসে দেয়। আমি জানি সেজন্য ওইসব অঞ্চলে দিনের বেলায় সানগ্লাস পরা বাধ্যতামূলক।

কাল দুপুরে ক্যান্টিনে বসে ছবিগুলো দেখানোর সময় পিন্টু একবার বলেছিল, ”আমরা চার রোল ছবি তুলেছিলাম। তার মধ্যে প্রথম রোলটার ছবি রজত আমাকে দিয়েছে। নকুলের মাত্র তিন—চারটে ছবি এর মধ্যে আছে। বেশিরভাগ ছবিই বাকি ওই তিনটে রোলে। তখন ভাবিনি, এরকম একটা মিসহ্যাপ হয়ে যাবে। জানলে ওর কাছ থেকে সব ছবি নিয়ে চলে আসতাম।”

ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুঁটিয়ে নকুলের ছবি দেখতে লাগলাম। বরফের উপর পড়ে থাকা টানটান একটা শরীর। পাগলা তনুর কথামতো লোকটা নকুল হোক বা অন্য কেউ, বেশ দীর্ঘদেহী ছিল। প্রায় ছ’ফুট তিন—চার ইঞ্চি তো হবেই। ডান হাতটা বুকের উপর রাখা। বাঁ হাত বরফের উপর আড়াআড়ি পড়ে আছে। লোকটা দেখতে অনিন্দ্যসুন্দর ছিল। দেখলেই বোঝা যায়, সাধারণ না। রাজপরিবারের। কোনও মৃতদেহ বরফ চাপা রেখে দিলে তা সাদা হয়ে যায়। কিন্তু এই মৃতদেহের রং বাদামি। চামড়া অবিকৃত আছে। প্রকৃতির কী রহস্য! এত হাজার বছর পড়ে থাকা সত্ত্বেও শরীরের কোথাও পচন ধরেনি।

লোকটার কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুল দেখে মনে হল, সে লোকালয় থেকে অনেকদিন বাইরে ছিল। মুখে গোঁফদাড়ি। তাতে বরফের কুচি জমাট বেঁধে আছে। মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি। কাল ক্যান্টিনে ছবিটা একপলক দেখার সময় পাগলা তনু আমায় বলেছিল, ”দ্যাখ কালকেতু, নকুলের বাঁ হাতের কবজিতে উল্কি। সূর্যচিহ্ন। ওঠাই কৌরব আর পাণ্ডবদের বংশপরিচয়। মহাভারতে পড়েছি, কুরুবংশীয়দের হাতের কবজি আর হাঁটুর পিছনে উল্কি আঁকা থাকত। আমি ডেফিনিট, এই ডেডবডিটার হাঁটুর পিছনেও উল্কি আছে।”

ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মধ্যে দিয়ে অনেকক্ষণ দেখেও ঠিক বুঝতে পারলাম না, ওটা উল্কি কিনা। উলটে আমার মনে হতে লাগল, ওটা পুরনো কোনও চোট—আঘাতের চিহ্ন। ছবিগুলো দেখে আমি কয়েকটা পয়েন্ট লিখে রাখলাম। মৃতদেহটা নকুলের কিনা তা নিয়ে আমার অবশ্য কোনও মাথাব্যথা নেই। আমার চিন্তা, রজতকে নিয়ে। ছেলেটা হঠাৎ কেন খুন হল, সেটা আগে বের করা দরকার। কেননা কাল পিন্টু আর পাগলা তনুকে আমি কথা দিয়েছি, এই রহস্য ভেদ করবই।

ছবিগুলো ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে আমি উঠে পড়লাম। কেন জানি না, আমার মনে হল, খুনের পিছনে ব্যক্তিগত রেষারেষি থাকলেও থাকতে পারে। ট্রেকিংয়ে গিয়েছিল মাত্র তিনজন। এদের তিনজনের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন ছিল, তা জানতে হবে। কথাটা মনে হওয়া মাত্রই পিন্টুকে ফোন করলাম। নম্বরটা কাল ও নিজে থেকেই আমায় দিয়ে গিয়েছিল।

ও প্রান্তে অনেকক্ষণ রিং হচ্ছে। অথচ কেউ তুলছে না। পিন্টুর বাড়িতে কেউ নেই নাকি? তা তো হতে পারে না। ক্যান্টিনে বসে কাল পিন্টু কী একটা কথায় আমায় বলেছিল, অফিসে ওকে পাওয়া কঠিন। কোনও দরকার থাকলে বাড়িতে ওর স্ত্রী বা মা—কে ফোন করে দিলেই ও খবর পেয়ে যাবে। তিন—চারবার ডায়াল করার পর ও—প্রান্তে রিসিভার তুলে এক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, ”কে বলছেন?”

”বলুন কালকেতু নন্দী।”

”আপনি কি লালবাজার থেকে বলছেন?”

”না। আমি ওর পরিচিত।”

”ধরুন, দেখছি আছে কিনা।”

কয়েক সেকেন্ড পর পিন্টুর গলা শুনতে পেলাম, ”কী ব্যাপার, কালকেতুদা?”

”ফোনটা কে ধরেছিলেন পিন্টু?”

”আমার মা। কেন বলুন তো?”

”লালবাজারের কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?”

”কাল রাতে রজতের খুনের ব্যাপারে কথা বলতে লালবাজার থেকে আমার কাছে একজন এসেছিলেন। খুব ভয় দেখিয়ে গেছেন। সেজন্য মা ঘাবড়ে গেছে।”

”যিনি এসেছিলেন, তাঁর নাম জানো?”

”জানি। সুদীশ নাগ। আপনি চেনেন নাকি?”

”তুমি কো—অপারেট করেছ তো?”

”অবশ্যই। কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে উলটোপালটা কথা বলে গেলেন। যেন আমিই খুনটা করেছি।”

”কেন, ওঁর এই ধারণা হল কেন?”

”আরে…এবার এক্সপিডিশনে রজতের সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়েছিল। কেউ বোধ হয় সে—কথা পুলিশকে লাগিয়েছে। সেজন্যই আমার উপর সন্দেহ।”

”কী হয়েছিল তোমার সঙ্গে রজতের?”

”খুব সামান্য ব্যাপার। এবার অমরনাথে রওনা হওয়ার আগে ইকুইপমেন্টস নিয়ে ওর সঙ্গে আমার তর্কাতর্কি হয়। সেটা তনুময়দা জানেন। আমাদের মধ্যে একটা বদভ্যাস আছে, নিজের ইকুইপমেন্ট থাকা সত্ত্বেও সবসময় চেষ্টা করি অন্যের ঘাড় ভাঙতে। সেদিন ওর সঙ্গে একটা জুমার নিয়ে ঝামেলা। আগেরবারের এক্সপিডিশন থেকে ও ক্লাবের বেশ কয়েকটা জুমার নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। আমি সেটা জানতাম। এবার বললাম, তুই ওগুলো বের করে দে। শুনে ও চটে গেল। বলল, তুই আমাকে চুরির বদনাম দিচ্ছিস?”

”তারপর কী হল?”

‘এক্সপিডিশনের শুরু থেকেই রজত কীরকম যেন পালটে গেল। আমি আর টুবলু দু’জনেই একটু অবাক হয়েছিলাম। পাহাড়ে গেলে মানুষের ব্যবহার খানিকটা পালটে যায়। উপরে ওঠার পর কেউ একদম চুপচাপ হয়ে যায়। কেউ বেশি চনমন করে। অন্যবার ও—ই আমাদের চাগিয়ে রাখত। এবার দেখলাম, অনেক অলস হয়ে গেছে। একটু অন্যমনস্কও। মহাগুনাসে যখন আমরা ক্যাম্প করে আছি, সেই সময় একদিন টুবলুর সঙ্গে ওর প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়।”

”কেন?”

”সেদিন রান্না করার ভার ছিল রজতের উপর। বেলা বারোটার সময়ও দেখছি ও কোনও উদ্যোগই নিচ্ছে না। টুবলু কী যেন বলতে গিয়েছিল। রজত মহাখাপ্পা। শেষ পর্যন্ত দু’জনকে আমি থামাই। তার পর কী হল জানেন?”

”কী?”

”ক্যাম্প করার বোধ হয় সেটা দশম দিন। হ্যাঁ তার তিনদিন পরই নকুলের ডেডবডি আমরা ডিসকভার করি। সকালে একটা গুহার ভেতর ঢুকে আমাদের তিনজনেরই সার্চ করার কথা। হঠাৎ টুবলু আমায় বলল, এই আমার সানগ্লাসটা পাচ্ছি না। তুই কোথাও সরিয়ে রেখেছিস? আমি বললাম, না। দু’জনে মিলে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করলাম। না, পেলাম না। সানগ্লাস খুব সামান্য একটা জিনিস। কিন্তু পাহাড়ে খুবই দরকারি। ওটা না পরে বেরোলে টেম্পোরারিলি অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। টুবলুর হলও তাই। ওর ধারণা, হিংসে করে সানগ্লাসটা রজত লুকিয়ে রেখেছিল।”

”হিংসে করে…মানে?”

”বুঝতে পারলেন না? ও তো এক্সপিডিশনে আর অ্যাকটিভ থাকতে পারল না। দু’দিন পর ওর চোখে মারাত্মক ব্যথা। আমি তো ভাবছিলাম, ওকে নিয়ে ফিরে আসব। ঠিক পরদিন নকুলের বডিটা আমরা পেয়ে গেলাম বলে দু—তিনদিনের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে চলে আসতে পারলাম। না হলে টুবলুকে নিয়ে মুশকিল হত।”

”টুবলুর চোখের অবস্থাটা এখন কেমন?”

”ভাল না। চোখ দেখাতে ও হায়দরাবাদে গেছে। অ্যাপোলো হসপিটালে। কাল তনুময়দা আপনাকে মিথ্যে কথা বলল কেন, আমি বুঝতে পারলাম না।”

”একটা কথা বল তো পিন্টু। রজতকে খুন করার পিছনে কার কী মোটিভ থাকতে পারে?”

”আমি সত্যিই জানি না কালকেতুদা। আমি পাহাড়ে যাই, নেশা বলে। বাড়ি থেকে প্রবল আপত্তি। কেউ জানেন না। এবার দু’আঙুলে ফ্রস্ট বাইট নিয়ে ফিরেছি। আঙুল পচে প্রায় বাদই চলে যাচ্ছিল। নার্সিংহোমে তিনদিন থেকে আঙুল বাঁচিয়েছি। বউয়ের রাছে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে। আর পাহাড়ে যাব না। এই সময় পুলিশের উৎপাত। ফালতু অ্যারেস্ট—ফ্যারেস্ট হয়ে গেলে চাকরি রাখা কষ্ট হয়ে যাবে।”

বললাম, ”তুমি ভয় পেও না। পুলিশ তোমায় হ্যারাস করলে সঙ্গে—সঙ্গে আমাকে ফোন কোরো। ছাড়ি তা হলে?”

ফোনটা রেখেই ভাবলাম, সুদীশের সঙ্গে একবার যোগাযোগ করি। কিন্তু কী ভেবে হাত সরিয়ে নিলাম। বিশ্বকাপ ফুটবলের পর থেকে ও আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। আমার উপর একটু রেগে রয়েছে। আসলে বিশ্বকাপের শুরুতে কথায় কথায় একদিন ওকে বলেছিলাম, এবার আর্জেন্তিনা চ্যাম্পিয়ন হবে। আমার কথায় বিশ্বাস করে ও চারদিকে বলে বেড়িয়েছিল, বাজিল—ফ্রাজিল কেউ পারবে না। বিশ্বকাপ নিয়ে যাবে আর্জেন্তিনা। কিন্তু আর্জেন্তিনা যেদিন বিদায় নিল, সেদিন ফোন করে আমার উপর খুব চোটপাট করেছিল। তুই কিচ্ছু জানিস না। তারপর থেকে আর কোনও পাত্তা নেই সুদীশের।

সুদীশকে পরে ফোন করব ভেবে উঠে পড়লাম। বাড়িতে কেউ নেই। আমার স্ত্রী ফুল্লরা কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছে। হাতে এখন অখণ্ড সময়। রাস্তায় একটু হেঁটে আসার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথাটা খুব খোলে। এই সময় গলফ গ্রিনের রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা থাকে। যেদিন গলফ কোর্সে যাই না, সেদিন রাস্তা ধরে মাইলদেড়েক হাঁটি। লোকে বলে, মর্নিং ওয়াকের সবচেয়ে ভাল সময় হল ভোরবেলা। কিন্তু কিছুদিন আগে স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। ওঁরা বললেন, ভোরবেলায় হাঁটা উচিত না। হাঁটার সবচেয়ে ভাল সময় সন্ধেবেলা।

গোলাম মহম্মদ শা রোড ধরে দূরদর্শনের দিকে হাঁটার সময় রজতের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। ওর স্টুডিও বাঘা যতীনের মোড়ে। একবার ওখানে গিয়ে আশপাশে খোঁজ নিলে হয়। পিন্টু বলল, খুন হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে ও বদলে গিয়েছিল। কারণটা কী, তার হদিশ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। বাঘা যতীন হল, ইস্টবেঙ্গল পাড়া। কেউ—না—কেউ আমাকে চিনতে পারবেই। আমার রিপোর্ট পড়ে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা নাকি নিশ্চিত, আমি মনেপ্রাণে ইস্টবেঙ্গল।

ট্যাক্সিতে গেলে মিনিটদশেক লাগার কথা। বিজয়গড়ের পাশ দিয়ে লায়েলকার উপর দিয়ে বাঘা যতীন চলে যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে কতক্ষণ লাগবে জানি না। তবুও হাঁটতে লাগলাম, পিন্টুর কথাগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে। খট করে একটা কথা কানে বাজল, ”তনুময়দা কেন আপনাকে মিথ্যে বলল, বুঝতে পারলাম না।”

সত্যিই, পাগলা তনু আমায় মিথ্যে বলল কেন? ওর ক্লাবের মেম্বারদের মধ্যে ঝগড়া। বোধ হয় সেটা আমি জেনে ফেলি, ও তা চায়নি। ইস, পিন্টুর কাছে জেনে নিলে ভাল হত, টুবলু কবে হায়দরাবাদ গেছে? ফিরবেই বা কবে?

বিজয়গড়ের মোড়ে হঠাৎই একটা মারুতি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। চমকে তাকিয়ে দেখি, সুদীশ। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভারের উলটোদিকের দরজা খুলে আমায় ও ডাকল, ”এই কালকেতু, উঠে আয়।”

সুদীশ থাকে উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের দিকে। এই সাত সকালে একেবারে উলটো প্রান্তে? বললাম, ”তুই চললি কোথায়?”

”পরে বলছি। আগে তুই ভেতরে আয়।”

ভেতরে ঢুকে বললাম, ”আমার বাড়ির পাশ দিয়ে এলি। অথচ একবার নামতে পারলি না?”

”আজ খুব ব্যস্ত রে! ভাবতেই পারিনি, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। একটা মার্ডার কেস নিয়ে কাল বিকেল থেকে মাথা ঘামাচ্ছি।”

মুচকি হেসে বললাম, ”মাউন্টেনিয়ার রজত চক্রবর্তীর মার্ডার কেস?”

সুদীশ চমকে উঠল, ”তুই জানলি কী করে?”

”তোর এক চ্যালার সঙ্গে কাল গলফ কোর্সে দেখা হয়েছিল। কী বুঝছিস রে?”

”সিম্পল কেস। ওর ক্লাবের কোনও একজন ছেলে এ কাজটা করেছে। আমি ডেফিনিট। আমি দু’জনকে সাসপেক্ট করছি।”

শুনে মনে মনে হাসলাম। ঠিক করে নিলাম, আমি নিজে থেকে কিছু বলব না। ও যা বলবে, শুধু শুনে যাব। ”তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস?”

”বাঘা যতীন। ওই ছেলেটার এক মেয়ে—বন্ধুর বাড়িতে। তুই আমার সঙ্গে যেতে পারিস। তোদের স্পোর্টস জগতের মেয়ে। তোকে চিনলেও চিনতে পারে। কী রে যাবি, আমার সঙ্গে? তোর সাহায্যের দরকার হতে পারে।”

একটু অনিচ্ছার ভঙ্গি করেই বললাম, ”ঠিক আছে। চল তো হলে।”

এর পরই সুদীশ বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে চলে গেল। পারে বটে! কথায় কথায় আমাকে হঠাৎ বলল, ”কাগজে দেখলাম রোনাল্ডোকে নাকি ইন্টার মিলান ক্লাব ছেড়ে দিচ্ছে? কোন ক্লাবে যাবে, তুই জানিস?”

”মনে হয় রিয়াল মাদ্রিদ।”

”কত নেবে রে?”

”সাড়ে সাত কোটি ডলার। দামটা ও নিজেই ঠিক করেছে। জিদানের চেয়ে সাড়ে তিন কোটি ডলার বেশি।”

”নাঃ, এবারও তা হলে হবে না। খুব ইচ্ছে ছিল, ওকে আমাদের ইস্টবেঙ্গলে খেলানোর। কিন্তু এত টাকা আমরা পাব কোথায়?”

সুদীশের আক্ষেপ শুনে ফের আমার হাসি পেয়ে গেল। যাচ্ছে একটা খুনের তদন্ত করতে। ওর মাথায় এখন ইস্টবেঙ্গল আর রোনাল্ডো! হাসি চাপার জন্যই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। আর তখনই চোখে পড়ল, লায়েলকা মাঠের পাশে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে নবারুণ। ও এখানে? ভাল করে ওকে দেখার আগেই গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গেল।

বাঘা যতীনের ভেতর ঢুকে একটা পুকুরের পাশে গাড়ি দাঁড় করাল সুদীশ। তারপর বলল, ”কাল বিকেলে একবার এসেছিলাম। মেয়েটা তখন ছিল না। তাই সাতসকালে চলে এসেছি। যাবে কোথায়?”

উলটোদিকের একটা একতলা বাড়িতে ডোর—বেল টিপল সুদীশ। সঙ্গে সঙ্গে যে মেয়েটি দরজা খুলে দিল, তাকে চিনতে পারলাম। অনেকবার দেখেছি। রুমা দাস। লং জাম্পার। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করে। ন্যাশনাল অ্যাথলেটিকসে ব্রোঞ্জ পেয়েছে গতবার। আমাকে দেখেই বলল, ”স্যার আপনি!”

বললাম, ”রুমা, এ আমার বন্ধু সুদীশ নাগ। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছে। রজত বলে কাউকে তুমি চেনো? তার ব্যাপারে।”

সুদীশের দিকে তাকিয়ে রুমা শুকনো গলায় বলল, ”কাল আপনি এসেছিলেন শুনলাম। আসুন, ভেতরে আসুন। রজতের ব্যাপারে কী জানতে চান, বলুন?”

বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায় না। কিন্তু রুমাদের বাড়ির ভেতরটা খুব সাজানো গোছানো। দেখেই মনে হয় উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সাধারণত অ্যাথলেটিকসের ছেলেমেয়েরা গরিব ঘর থেকে আসে। এই মেয়েটা ব্যতিক্রম। সোফায় বসে সুদীশ সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ”ছেলেটা মার্ডার হল কেন বল তো? পরশুদিন সন্ধেবেলায় তুমি অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে ছিলে। ইন ফ্যাক্ট, তুমি বেরিয়ে আসার পরই ও স্টুডিওর শাটার নামিয়ে দিয়েছিল।”

খেলাধুলোর জগতের মেয়ে। রুমা বলল, ”ঠিক বলেছেন। তা হলে আমি বেরিয়ে আসার পর ও জীবিত ছিল।”

মেয়েটার কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু সুদীশ কেমন যেন ঘাবড়ে গেল বলে আমার মনে হল। ও একটু ডিফেন্স করার ভঙ্গিতে বলল, ”তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি।”

”উত্তরটা জানি না বলে দিইনি। ও আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। ইদানীং খুব আর্থিক কষ্টে পড়েছিল।”

”জানি। তুমি নাকি ওর স্টুডিওটা কিনে নিতে চেয়েছিল, ওখানে বিউটি পার্লার খুলবে বলে?”

”হ্যাঁ, সেরকম একটা কথা চলছিল আমাদের মধ্যে। প্রস্তাবটা ও—ই আমাকে দিয়েছিল। কিন্তু আমি ঠেকিয়ে যাচ্ছিলাম।”

”কেন, বলবে?”

”দেখুন সুদীশবাবু, রজত খুব ধনী পরিবারের ছেলে। ওর বাবা টি গার্ডেনের মালিক। ওর বাবা অনেকবার ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু ও যেতে চায়নি। ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। ফোটোগ্রাফার হিসেবে যথেষ্ট নাম করেছিল। স্টুডিও থেকে ও যা রোজগার করত, তা সব ঢালত ওদের মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে। ওকে আমি অনেকবার বারণ করেছি, শোনেনি। আগেরবার এক্সপিডিশন করতে গিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। সেই টাকা ও শোধ করতে পারেনি। এবার অমরনাথে যাওয়ার আগে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম, কার কাছ থেকে নাকি প্রায় লাখ টাকা ধার নিয়েছে। ও ট্রেকিংয়ে যাওয়ার আগেই আমি জানতে পেরে ওকে খুব বকাবকি করি। ফোন করে ওর বাবাকেও সব জানিয়ে দিই। কিন্তু ভদ্রলোক উলটে আমাকেই দোষারোপ করেন।”

”তারপর?”

”আমি যে ওর বাবাকে সব জানিয়ে দিয়েছি, সেটা শুনে রজত আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়। তারপর থেকে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমাদের বাড়িতে ও আর আসেনি। কিন্তু আমি মনে করি, বন্ধু হিসেবে আমার ওকে সতর্ক করা উচিত ছিল। আমি সেটাই করেছি। আপনি কী বলেন?”

সুদীশ বলল, ”অমরনাথ থেকে ফিরে আসার পর ওই ছেলেটার সঙ্গে তোমার কতদিন দেখা হয়েছে?”

”মাত্র একবার। প্রতিবারই এক্সপিডিশন থেকে ফিরে ও আমাকে স্লাইড দেখাতে আসত। এবার এল না দেখে আমি ওই পরশুদিনই ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই। ও আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছিল। বলেছিল, ধারদেনা মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা ও নিজেই করে ফেলেছে। অমরনাথে ও নকুলের ডেডবডি খুঁজে বের করার পর পহেলগাঁওতে নাকি এক ভদ্রলোক ওকে একটা প্রস্তাব দেন। তিনি ওর সব ছবি আর ভিডিও ক্যাসেট কিনে নিতে চান এক লাখ টাকা দিয়ে। রজত তখনই আমার বাবার টাকাটা ফেরত দিতে চাইছিল। কিন্তু আমি বলি, আমাদের টাকা এখন দেওয়ার দরকার নেই। বরং ও অন্য যেসব জায়গা থেকে ধার নিয়েছে, সেখানে শোধ দিক। কথাটা ওকে বুঝিয়ে আমি চলে আসি।”

আমি চুপচাপ শুনছিলাম। আর থাকতে না পেরে বললাম, ”মার্ডার হওয়ার খবরটা তোমরা কখন পেয়েছিলে রুমা?”

”পরদিন সকালে। রোজ আমি স্টেডিয়ামে দৌড়তে যাই। তখনই বাঘা যতীনের মুখে দেখি ভিড়। একজনের মুখে শুনলাম, মাঝরাতে কালো রঙের একটা গাড়িতে করে দু’জন লোক রজতকে তুলে নিয়ে গেছে। আমিই যাদবপুর থানায় প্রথম খবরটা দিই। পরে প্র্যাকটিস থেকে ফিরে শুনি ও মার্ডার হয়েছে।”

”তোমার কী মনে হয় রুমা? কেন মার্ডার হল?”

”আমার তো মনে হয়, এর পিছনে ওদের ক্লাবেরই কেউ আছে। পাহাড়ে চড়ার নেশাটাই ওর খুব ক্ষতি করে দিল।” এতক্ষণ খুব শক্ত ছিল। কিন্তু এই কথাগুলো বলার সময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রুমা।

বাঘা যতীন থেকে ফেরার পথে আমার বাড়ির দিকে আসার সময় সুদীশ বলল, ”সব শুনে তোর কী মনে হচ্ছে বল তো কালকেতু?”

বললাম, ”তোদের কাছে আর কী ইনফরমেশন আছে আগে বল।”

”মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সব ছেলেদের সঙ্গে কাল কথা বলেছি। ছেলেগুলো সব যন্তর। এক—একজন এক—একরকম কথা বলে। ক্লাবের সেক্রেটারিটা তো একদম পাগলা। আমায় নকুল—সহদেব কী সব বোঝাতে এসেছিল। এমন ধমক দিয়েছি, একদম চুপ করে গেছে। বললাম, বাংলার মাস্টার আপনি, ব্যাকরণ—ট্যাকরণ নিয়ে থাকুন। এমন কথা বলছেন, যেন আপনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস। ফের যদি আবিষ্কার করার কথা তোলেন তা হলে লকআপে পুরে দেব।”

সুদীশের পাল্লায় পড়ে পাগলা তনুর কী হেনস্থা হয়েছে, ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল। বললাম, ”তা হলে তোর সন্দেহভাজনদের তালিকায় এই লোকটা নেই।”

”মনে হয় না। ওদের ক্লাবের একটা ছেলেকে আমার সন্দেহ হচ্ছে জানিস। পিন্টু দেবনাথ। চালু পুরিয়া। ওকে থানায় এনে রগড়ালেই সব উগরে দেবে।”

পরামর্শটা দিতাম না। তবুও বলে ফেললাম, ”সুদীশ, হুট করে কোনও কাজ করতে যাস না। একটু ভেবেচিন্তে এগোস। পিন্টু ছেলেটাকে আমি চিনি। ওর সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হয়েছিল বটে রজতের। কিন্তু সেটা মার্ডার পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে মনে হয় না।”

”তোর এ—কথা মনে হল কেন?”

”দ্যাখ, রুমার কথা যদি আমরা সত্যি বলে মেনে নিই, তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? মাঝরাতে গাড়িতে করে রজতকে কেউ জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর গুলি করে ওকে মেরেছে। পিন্টুরা খেলাধুলোর জগতের ছেলে। তোর কি মনে হয়, এই ধরনের কোনও অপরাধ করার গাটস ওর আছে? আরও একটা পয়েন্ট আছে…”

”কী, বলে?”

”পিন্টুর হাত দুটো দেখেছিস। যে আঙুল দিয়ে পিস্তল বা রিভলভারের ট্রিগার টিপতে হয়, সেই দুটো আঙুলেই ওর ফ্রস্ট বাইট হয়েছিল। এখনও ব্যান্ডেজ। ওর পক্ষে রজতকে মার্ডার করা সম্ভব?”

”কোনও প্রফেশনাল লোককে দিয়েও তো ও এই কাজটা করাতে পারে।”

”পারে। তবে কেন করবে?” মোটিভটা কী? রজতকে খুন করে ওর কী লাভ, সেটা তোকে আগে বের করতে হবে। তারপর ওকে রগড়াস। তুই—বা এই কেসটা সলভ করার জন্য এত হড়বড় করছিস কেন, বুঝতে পারছি না।”

”সাধে হড়বড় করছি? কে একজন নামী অ্যানথ্রোপলজিস্ট আছে…কী নাম যেন লোকটার…নবারুণ ভটচায। সে গিয়ে আমাদের বড়কর্তাদের কাছে নালিশ করেছে, পুলিশ কিছুই করছে না। ডি জি আমাকে ডেকে বললেন, যে করেই হোক তোমাকে এই কেসটা সলভ করতে হবে। এই কেসটার জন্য আজ ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ম্যাচটাই দেখতে পারব না। ভাবতে পারিস?”

এটা আমার কাছে একটা খবর। রজতের খুনের ব্যাপারে নবারুণ পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”নবারুণ ভট্টাচার্যের এত আগ্রহ কেন?”

”কে জানে?” বলেই হাতঘড়ির দিকে তাকাল সুদীশ। তারপর বলল, ”এই রে, প্রায় দশটা বাজে। আমাকে এখুনি ল্যান্সডাউনে যেতে হবে। এই কেসটা নিয়ে তুইও একটু চিন্তাভাবনা কর তো ভাই। তোর সঙ্গে পরে যোগাযোগ করব।”

এটাই আমি চাইছিলাম। সুদীশ আমাকে অনুরোধ করুক। ওর সঙ্গে আমার একটু ইগোর লড়াই আছে। ও না বলা পর্যন্ত কোনও কেস—এ আমি মাথাই ঘামাই না। এবার বললাম, ”একটা জায়গায় যাবি? এই কাছেই। দশ—পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। একজনের সঙ্গে কথা বলে যা। এই কেস—এর ব্যাপারেই।”

”চল তা হলে।”

সুদীশকে নিয়ে নবারুণের বাড়িতে এলাম। ডোর—বেল টিপতেই লোহার দরজাটা খুলে গেল। নেপালি দরোয়ানটা আমায় স্যালুট ঠুকে বলল, ”সাব ড্রয়িংরুমমে বৈঠা হ্যায়। আপ যাইয়ে।”

লন পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখি নবারুণ বসে খবরের কাগজ পড়ছে। আমাকে দেখে ও অবাক হয়ে বলল, ”কালকেতু, তুমি?”

বললাম, ”আমার এক বন্ধুকে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। নামী গোয়েন্দা, সুদীশ নাগ। আর সুদীশ, এই ভদ্রলোকই ডঃ নবারুণ ভট্টাচার্য।”

সোফায় বসে সুদীশ বলল, ”মশাই, আপনার কমপ্লেনের জন্য তো আমি মুশকিলে পড়ে গেছি।”

নবারুণ কিছু বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছে। সেটা দেখে আমি বললাম, ”রজত ছেলেটাকে তুমি চিনলে কী করে নবারুণ?”

”ও তো আমার বন্ধু মণিময়ের ছেলে। আগে ওকে আমি চিনতাম না। মাসখানেক আগে হঠাৎ ওর সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। স্যাড, ভেরি স্যাড কেস। সুদীশবাবু কি ওর ব্যাপারেই আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন?”

সুদীশ বলল, ”হ্যাঁ, সেটা বলতে পারেন। ওর সঙ্গে পরিচয়টা কীভাবে হল, একটু বলবেন?”

”নিশ্চয়ই। কালকেতুকে কালই আমি বলছিলাম। আমার আগ্রহ ছিল অমরনাথে পাওয়া ডেডবডিটা নিয়ে। আমাদের দেশে পাঁচ থেকে আট হাজার বছর আগেকার কোনও মানুষের মৃতদেহ এর আগে পাওয়া যায়নি। অমরনাথে যাওয়ার পথে এক গুহায় তীর্থযাত্রীরা খুব পুরনো একটা মৃতদেহ দেখেছেন, দিল্লির কাগজে এই খবরটা দেখার পরই আমি ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে গভর্নমেন্টকে চিঠি লিখি, একটা রিসার্চ টিম এখুনি ওখানে পাঠানো উচিত। আপনারা যদি চান, তা হলে সেই টিমের সঙ্গে আমিও অমরনাথে যেতে রাজি।”

সুদীশ বলল, ”আপনি ওখানে গিয়েছিলেন নাকি?”

”না মশাই। এক সপ্তাহ পর আমার কাছে উত্তর এল, এখনই কিছু করা যাচ্ছে না। অগস্টের পর ওখানে যাওয়া নিরাপদ না। রিসার্চ টিম আগামী বছরের জুলাই মাসে পাঠানো যেতে পারে।”

”নিরাপদ নয় কেন?”

”উগ্রপন্থীদের জন্য। পহেলগাঁও পর্যন্ত ঠিক আছে। তার পরের অংশটা রিস্কি। ওখান থেকে নাকি লাহোর যাওয়া যায়। উগ্রপন্থীরা যখন—তখন আক্রমণ করতে পারে। এজন্য সরকারের পক্ষে এখন অনুমতি দেওয়া সম্ভব না। উত্তরটা পেয়ে তো আমি খুব মুষড়ে পড়লাম। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না দেখে আমি তখন অন্য একটা উপায় বের করলাম। হংকংয়ে আমাদের একটা সোসাইটি আছে, যারা এরকম রিসার্চ করার কাজে প্রচুর টাকাপয়সা দেয়। মার্ক স্কিবারম্যান হলেন সেই সোসাইটির চেয়ারম্যান। সোসাইটির ম্যাগাজিনে আমি নিয়মিত লিখি। ওদের লিখলাম, তোমরা ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টকে লেখো, অমরনাথে তোমরা রিসার্চ টিম পাঠাতে চাও। তোমাদের কথায় আমাদের সরকার গুরুত্ব দেবে। ওরা খুব উৎসাহিত হয়ে চিঠি লিখল দিল্লিতে। শুনলে অবাক হবে, সঙ্গে সঙ্গে অনুমতিও পেয়ে গেল। ভাবো, আমাদের দেশের কী অবস্থা।”

”কিন্তু রজতের সঙ্গে তোমার পরিচয় হল কী করে?”

”সে—প্রসঙ্গেই তো আসছি। অমরনাথে যাওয়ার জন্য যখন আমরা তৈরি হচ্ছি, সেই সময় মতিয়া বলে আমার এক পরিচিত ছেলে এসে আমাকে বলল, বাঘা যতীনের একটা মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব অমরনাথে একটা ট্রেকিং টিম পাঠাচ্ছে। মতিয়া এই অঞ্চলেই থাকে। ওকে বললাম, ক্লাবের যে—কোনও একটা ছেলেকে ডেকে আনো। পরদিন ও রজতকে নিয়ে এল। ওর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, একই মিশন নিয়ে ওরা অমরনাথে যাচ্ছে। আমি বলালাম, তোমাদের এক্সপিডিশনের খরচ কে জোগাচ্ছে? ও বলল, আমরা ধারদেনা করে যাচ্ছি। তখন আমি বললাম, হংকং থেকে তোমাদের আমি কিছু টাকা জোগাড় করে দিতে পারি। কিন্তু কয়েকটা শর্তে।”

”শর্তগুলো কী?”

”এক নম্বর, ডেডবডিটা খুঁজে পেলে প্রথমেই আমাকে খবর দিতে হবে। দু’নম্বর, সব ছবি আর ক্যাসেট আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আমার লেখা বেরোনোর আগে তোমরা এই খবর প্রচার করতে পারবে না। তোমাদের কৃতিত্ব আমি অবশ্য অস্বীকার করব না। আমার লেখায় তোমাদের নাম উল্লেখ থাকবে।”

”তারপর কী হল?”

”রজত বলল, ও ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানাবে। সেদিন যখন ও উঠে যাচ্ছে, তখনই কথায় কথায় আমি জানতে পারলাম, ও আমার ছোটবেলার বন্ধু মণিময়ের ছেলে। কালকেতু তুমি জানো কিনা জানি না, আমার ছোটবেলাটা নর্থ বেঙ্গলে কেটেছে। এই তথ্যটা জানার পরই ছেলেটার সম্পর্কে আমি একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। কিন্তু তখন আর কিছু বললাম না। পরে খোঁজখবর করে মণিময়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ও বলল, নবারুণ, তুই যদি ছেলেটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারিস, তা হলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।”

”কেন? বাবার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভাল ছিল না?”

”হবে হয়তো। তারপর শোনো। তখন মতিয়াকে ডেকে বললাম, রজত সম্পর্কে ডিটেলে খোঁজ নিয়ে এসো। দু’দিন পর মতিয়া এসে বলল, ছেলেটা ভাল বলে ক্লাবের সবাই ওর ঘাড় ভেঙে খাচ্ছে। বেচারি ধারদেনায় ডুবে আছে।”

সকালে রুমা মেয়েটা যা বলেছিল, তার সঙ্গে নবারুণের কথা মিলে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”রজত তোমার শর্তে রাজি হয়েছিল?”

”না। কয়েকদিন পর রজত এসে আমাকে বলল, ক্লাবের ছেলেরা আপনার শর্তে রাজি হচ্ছে না। বিশেষ করে আমাদের সেক্রেটারি তনুময়দা। ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে। সরি, আমি আপনার কোনও উপকারে লাগছি না। তখন আমি বললাম, তোমাকে আমি জোর করছি না। কোনও সময় যদি তোমার মন বদলায়, তা হলে আমার কাছে এসো।”

”রজত ফিরে আসার পর তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল?”

”ও একটা শর্ত আমার মেনেছিল। ডেডবডিটা আবিষ্কার করার পরই আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে আমায় একটা ফোন করেছিল। তারপর আমিই নানা জায়গায় ফোনটোন করে ওখানে হেলিকপ্টার পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আমার সঙ্গে রজতের দেখা হয় পহেলগাঁওয়ে। ওখানে ও আমাকে বলে, আপনি টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কত টাকা দেবেন? বললাম, কত টাকা তোমার ধার আছে? ও বলল, এক লাখ টাকার মতো। বললাম, কলকাতায় গিয়ে টাকাটা তুমি নিয়ে নিও। কিন্তু আমাকে সব ছবি আর ক্যাসেট দিয়ে দিতে হবে। এই দিনতিনেক আগে ও ছবি আর ক্যাসেট দিয়ে যায়। আমি ওকে টাকা দিয়ে দিই। তারপরই মতিয়া এসে কাল জানায়, ছেলেটা মার্ডার হয়েছে। ওর বাবা এখন কলকাতায়। আমার মুখ দেখানোর জো নেই।”

শেষের দিকটায় গলা খুব ভারী হয়ে গেল নবারুণের। আমি বললাম, ”কাল তোমার সঙ্গে যখন এ নিয়ে কথা হচ্ছিল, তখন আমাকে সব বললে না কেন নবারুণ?”

”তখন জানতাম না, ছেলেটা মার্ডার হয়েছে। তোমায় বলতে চাইনি, তার কারণ তুমি খবরের কাগজের লোক। তোমার কাগজে খবরটা বেরিয়ে গেলে আমার লেখাটা মার খেয়ে যেত। আমার একটু অনুরোধ রাখবে ভাই। যে লোকটা খুনি, তাকে খুঁজে বের করো। এর জন্য যত পয়সা খরচ হোক, আমি দিতে রাজি।”

নবারুণের কাছ থেকে আর কিছু জানার নেই। সুদীশকে নিয়ে আমি উঠে পড়লাম।

ফের গাড়িতে উঠে সুদীশ বলল, ”কেসটা আরও জটিল হয়ে গেল কালকেতু। আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না।”

বললাম, ”তোর হাতে মিনিট পনেরো সময় থাকলে বল। কেসটা আমি সহজ করে দিচ্ছি।”

সুদীশ অবাক হয়ে বলল, ”অন্য কোথাও যাবি নাকি?”

”হ্যাঁ, কাছেই। সাদার্ন অ্যাভেনিউর উপরই একটা স্কুলে।”

”চল তা হলে।”

পাগলা তনুর স্কুলে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন ও ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে আসছে। আমাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, ”কালকেতু, তুই!”

”তোর কাছে এলাম। তুই একটু বেরোতে পারবি আমাদের সঙ্গে?”

সুদীশকে আমার সঙ্গে দেখেই এড়ানোর চেষ্টা করল পাগলা তনু, ”না রে, এখন আমার আরও ক্লাস আছে।”

বললাম, ”মিনিট পাঁচেকের জন্যও বেরোতে পারবি না? চল না! খুব দরকার।”

”কোথায় যেতে হবে?”

”এই কাছেই।”

সুদীশ কোমরে হাত দিয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে পাগলা তনু বলল, ”চল তা হলে।”

সুদীশের গাড়িতেই আমরা উঠে বসলাম। কাছেই লেক। নিরিবিলিতে কথা বলার জন্য লেকের চেয়ে ভাল জায়গা আর হয় না। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আমরা লেকে ঢুকলাম। একটা গাছের নীচে পাগলা তনুকে বসিয়ে বললাম, ”রজত ছেলেটা মার্ডার হল কেন রে তনুময়?”

”কী করে বলব বল। ছেলেটা ইদানীং খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের কাছ থেকে ধারদেনা করেছিল। মনে হয়, তাদেরই কেউ হয়তো ওকে মার্ডার করেছে।”

”তোর সঙ্গে লাস্ট কবে দেখা হয়েছিল?”

”চার—পাঁচদিন আগে। কেন রে?”

”কেন মিথ্যে বলছিস আমাকে? তুই শেষবার ওর দোকানে গিয়েছিলি, ও মার্ডার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে।”

চমকে উঠে পাগলা তনু বলল, ”পিন্টু বলেছে বুঝি?”

”না। ও বলেনি। আমার কাছে আরও অনেক খবর আছে। তোর ক্লাবের জন্য ছেলেটা এত করত, তাও ওকে মার্ডার করলি? কী লাভ হল তোর?”

”তুই কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস?”

”তোর তাই মনে হচ্ছে বুঝি! সত্যি কথাটা বল তনুময়। না হলে সুদীশ লালবাজারে নিয়ে গিয়ে তোকে এমন পেটান পেটাবে, তখন টের পাবি। তুই না বললেও আমি সব ধরে ফেলেছি। তুই কী করেছিলি, সব বলব নাকি?”

”বল তা হলে।”

”ডঃ নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রস্তাবটা যেদিন রজত তোর কাছে নিয়ে যায়, সেদিন থেকেই তুই ওকে অপছন্দ করতিস। একবার চেষ্টাও করেছিলি, যাতে ও এক্সপিডিশন থেকে বাদ যায়। তুই ওকে বলেছিলি, পিন্টুদের আপত্তি আছে। ফলে রজত পিন্টুর উপর চটে যায়। অমরনাথে গিয়ে তুচ্ছ কারণে ওদের মধ্যে ঝগড়াও হয়। এর কারণ তুই। এক্সপিডিশন থেকে ওরা ফিরে আসার পর যখন তুই শুনতে পেলি, নবারুণ ভট্টাচার্যকে রজত সব ছবি আর ক্যাসেট দিয়ে দিচ্ছে, তখনই তুই তোর ভাইকে নিয়ে ওর দোকানে চড়াও হোস। রজতকে তার আগে তুই বা তোর ভাই ফোনে হুমকি দিয়েছিলি, চরম শিক্ষা দিবি। তুই জানতিস না, সে—সময় পিন্টু ওর স্টুডিওতে হাজির ছিল।”

পাগলা তনু হাঁ করে আমার কথা শুনে যাচ্ছে। ওর মুখের রং ঘন ঘন বদলাচ্ছে। সেটা লক্ষ করে আমি বললাম, ”ওইদিন বেশ রাতে যখন তুই রজতের স্টুডিওতে যাস, তখন সেখানে রুমা ছিল। রুমাকে দেখে তখনকার মতো তুই সরে যাস। রুমা বেরিয়ে যাওয়ার পরই রজত স্টুডিওর শাটার নামিয়ে দেয়। তুই গিয়ে ফের সেটা খুলতে বাধ্য করিস। রজত জানায়, এক্সপিডিশনের সব ছবি আর ক্যাসেট ও নবারুণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে দিয়েছে। এটা শুনে তোরা দুই ভাই মিলে ওকে পেটাতে শুরু করিস। নকুলের ডেডবডি আবিষ্কারের কৃতিত্বটা তুই একাই নিতে চেয়েছিলি। তাই রজতের উপর রাগে তুই অন্ধ হয়ে যাস। কী, আমি ঠিক বলছি কিনা বল?”

পাগলা তনু চুপ করে আছে দেখে ফের আমি বললাম, ”তোর ভাই আজকাল গড়িয়ার উঠতি মস্তান। সবসময় পিস্তল নিয়ে ঘোরে। ও—ই ধৈর্য হারিয়ে রজতকে গুলি করে ফেলে। পিস্তলে সম্ভবত সাইলেন্সার লাগানো ছিল। তাই গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। মাঝরাতে রজতের ডেডবডিটা বের করে একটা গাড়িতে তুলে তোরা গলফ ক্লাবে ফেলে দিয়ে আসিস। কেন এসব করতে গেলি তনুময়? ভেবেছিলি ছেলেটা একা থাকে। কেউ খোঁজও নেবে না। তাই না? কিন্তু এখানেই তোরা মারাত্মক ভুলটা করেছিলি।”

সুদীশ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, ”চল বাবা, এবার লালবাজারে। জেলের ঘানি পিষবে দু’ ভাই একসঙ্গে। তোমার ভাইকেও আনার ব্যবস্থা করছি। ওখানে নকুল নিয়ে গবেষণা করার অনেক সময় পাবে।”

পাগলা তনুকে বিরাশি সিক্কার একটা চড় মেরে গাড়িতে তোলার পর সুদীশ আমায় বলল, ”থ্যাঙ্কস। বিকেলে ইস্টবেঙ্গল মাঠে দেখা হবে।”

বললাম, ”বেশি মারধর করিস না।” কথাটা বলেই আর আমি দাঁড়ালাম না। একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, ভাগ্যিস, রুমার সঙ্গে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিল। না হলে ভেতরের খবর কিছুই পেতাম না। পাগলা তনু আর ওর ভাই সম্পর্কে আমায় সব খবর দিয়েছিল রুমাই, ওদের বাড়ি থেকে উঠে আসার সময়। সুদীশ তখন বাইরে, রাগ করে গাড়িতে গিয়ে বসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *