চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-১৯৫০

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-১৯৫০ 

১. সূত্রপাত 

পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর একজন সশস্ত্র কনস্টেবলসহ তিনজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে জয়দেব ব্রহ্ম নামক একজন কমিউনিস্ট কর্মীকে গ্রেফতারের উদ্দেশে ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৫০ তারিখে খুলনা জেলায় বাগেরহাট মহকুমার কালশিরা গ্রামে উপস্থিত হয়। জয়দেব ব্রাহ্মর বাড়ীতে খানাতল্লাশীর সময় অন্যান্য নির্যাতনের সাথে তারা মহিলাদেরকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। এই সময় তারা কমিউনিস্ট সমর্থক এক বিরাট জনতার দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই জনতার অধিকাংশই ছিল নমঃশূদ্র। উভয় পক্ষের সংঘর্ষের ফলে সশস্ত্র পুলিশ কনস্টেবল ঘটনা স্থলেই নিহত এবং অফিসারসহ অন্য দুইজন পুলিশ আহত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে স্থানীয় আনসার বাহিনী পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কিছু সংখ্যক মুসলমান গ্রামবাসীকে সাম্প্রদায়িক প্রচারণার দ্বারা উত্তেজিত করে তাদেরকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং তাদের সহায়তায় আহত তিন জন পুলিশ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পলায়ন করে। এর পর এলাকাটিতে পুলিশ বাহিনীর যথারীতি নির্যাতন শুরু হয় এবং কালশিরা, ঝালোরডাঙ্গা ও অন্যান্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অমুসলমান গ্রামবাসীরা তাদের বহনযোগ্য কিছু কিছু মালপত্র সাথে নিয়ে দ্রুতগতিতে এলাকা পরিত্যাগ করতে থাকে। এর পর তাদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ী স্থানীয় কিছু সংখ্যক মুসলমানদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়।[১] কিন্তু এই সংঘর্ষের সময় স্থানীয় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সাময়িকভাবে সৃষ্টি হলেও সে সময়ে অথবা তার পরবর্তী পর্যায়ে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেখানে ঘটেনি।[২] সরকারী সূত্রে প্রাপ্ত এবং ৩০শে ডিসেম্বর খুলনা থেকে প্রেরিত একটি সংবাদে বলা হয় যে, সে পর্যন্ত কালশিরার ঘটনার সাথে সম্পর্কিত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে এবং সশস্ত্র কনস্টেবলটির মৃতদেহের কোন সন্ধান তখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। [৩]

ভারতে ‘সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ কাউন্সিল’ (Council for the Protection of Right of Minorities) ও হিন্দু মহাসভা ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে তাদের সাম্প্রদায়িক প্রচারণা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করে এবং তাদের এই প্রচারণা ভারতীয় সাম্প্রদায়িক সংবাদপত্রসমূহের মাধ্যমে যথেষ্ট ব্যাপকতা লাভ করে।[৪] ১৯৪৯ সালের ২৪- ২৬শে ডিসেম্বর কলকাতায় ভারতীয় হিন্দু মহাসভার একটি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে হিন্দু মহাসভার সভাপতি ডক্টর এমবি খারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয়লাভকারী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি জেলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। এই দাবী আদায়ের জন্যে পাকিস্তানের ওপর বলপ্রয়োগের হুমকীও তিনি প্রদান করেন। এছাড়া মহাসভার একটি প্রস্তাবে পাকিস্তানকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলা হয়।[৫] হিন্দু মহাসভার এই সর্বভারতীয় সম্মেলনের পর মহাসভার নেতারা পাকিস্তান এবং বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যা লঘিষ্ঠদের দুরবস্থা এবং তাঁদের ওপর মুসলমানদের নির্যাতন সম্পর্কে আরও জোরেশোরে প্রচারণা শুরু করেন এবং সেই সব বক্তব্য কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য এলাকায় সাম্প্রদায়িক পত্রিকাগুলির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এই বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচারণার মধ্যে যে জিনিসটি প্রসঙ্গতঃ লক্ষণীয় তা হলো এই যে, তার মধ্যে কালশিরায় “সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার” বিন্দুমাত্র কোন উল্লেখ ছিলো না।[৬] এদিকে পূর্ব বাঙলাতেও ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে কলকাতা এবং পশ্চিম বাংলার অন্যান্য স্থানে হিন্দুদের দ্বারা মসজিদ নষ্ট হওয়ার কাহিনী মর্নিং নিউজ ও দৈনিক আজাদের অসংখ্য মত সাম্প্রদায়িক পত্রিকায় প্রচার এবং বিভিন্ন জায়গায় তার বিরুদ্ধে সভা সমিতি হতে থাকে।[৭] তাছাড়া হিন্দু মহাসভার কলকাতা সম্মেলনের বক্তব্য এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূলক বক্তৃতা বিবৃতি এবং সম্পাদকীয়ও পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই সময় বিশেষ স্থান লাভ করে।[৮] হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে পাকিস্তানের ভারতভুক্তির প্রস্তাব সম্পর্কে উভয় দেশে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে এমন উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যে ১লা জানুয়ারী ১৯৫০ এই প্রস্তাবের উল্লেখ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে বলতে হয় যে, “আজ আমি স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতে চাই যে, ভারতের সহিত পাকিস্তানের সংযুক্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।[৯] পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন ৩রা জানুয়ারী হিন্দু মহাসভার প্রস্তাব উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে বলেন, “আমি দৃঢ় নিশ্চিত যে, পাকিস্তানকে যাহারা আক্রমণ করিবে পূর্ব বঙ্গে তাহারা স্ট্যালিনগ্রাডের সাক্ষাৎ পাইবে। আমাদের রাষ্ট্রের দুশমনদের প্রতি আমার উপদেশ : পাকিস্তান থেকে দূরে থাক।”[১০] ১৯৫০ সালে ১লা জানুয়ারী ভারতের উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বোম্বাইয়ের চৌপট্টি ময়দানে এক দীর্ঘ এবং তীব্র সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা দেন ও ভারতের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ও অসুবিধার জন্যে পাকিস্তানকে দায়ী করেন। তিনি তাঁর এই বক্তৃতায় পাকিস্তানের প্রতি অস্ত্রের হুমকিও প্রদান করেন।[১১] প্যাটেলের এই বক্তৃতার পর পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন মহল ও এলাকায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয় এবং সাম্প্রদায়িক দৈনিক আজাদ ৬ই ও ৭ই জানুয়ারী তারিখে এ সম্পর্কে উপ-সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করে। ১৪ই জানুয়ারী কুমিল্লা বীরচন্দ্র সাধারণ পাঠাগার ও টাউন হলের সদস্যেরা এক বিশেষ সাধারণ সভায় উক্ত ভবন থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিকৃতি অপসারণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং সেই প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ কার্যকর করা হয়। সেই সাথে আনন্দমঠ ও রাজসিংহ উপন্যাস গ্রন্থ দুটিও পাঠাগার হতে অপসারণ করা হয়।[১২] ১৫ই জানুয়ারী সর্দার প্যাটেল কলকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম এবং কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গার উল্লেখ করেন। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই যে দাঙ্গা হয় তারও উল্লেখ তাঁর বক্তৃতায় থাকে এবং এ সব কিছুর জন্যে তিনি মুসলমানদেরকে পুরোপুরিভাবে দায়ী করেন। সর্বোপরি তিনি বলেন যে, পশ্চিম বাঙলা ও পূর্ব বাঙলার সীমানা “কৃত্রিম” এবং সেই সীমানা পূর্ব বাঙলার ভাইদেরকে সাহায্য করার জন্যে পশ্চিম বাঙলা ও ভারতের হিন্দুদের সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে না।[১৩] সর্দার প্যাটেলের এই উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তৃতার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব অথবা পশ্চিম কোন বাঙলাতেই কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু প্যাটেলের বক্তৃতার পর পশ্চিম বাঙলার সাম্প্রদায়িক পত্রপত্রিকাগুলি পূর্ব বাঙলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে উত্তেজনাপূর্ণ মন্তব্য ও কাহিনী প্রকাশ করতে শুরু করে। ঠিক এই সময়েই সাম্প্রদায়িক প্রচারণার সুবিধার জন্যে সর্বপ্রথম কলকাতার সংবাদপত্রে কালশিরায় ২০শে ডিসেম্বরের ঘটনাকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেখানে ব্যাপক হত্যা, লুটতরাজ, মারপিট ও ধর্ষণের কাহিনী বিবৃত করা হয়।[১৪] ১৮ই জানুয়ারী কালশিরার এক মাস পূর্বে সংঘটিত ঘটনাটির ওপর যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রকাশ করে তার মাধ্যমে মুসলমানবিরোধী তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। এইভাবে হিন্দুপ্রধান একটি এলাকায় পূর্ব বাঙলা সরকারের কমিউনিস্ট নির্যাতনের একটি ঘটনাকে সর্দার প্যাটেলের বক্তৃতার পরই তার “আদর্শে” অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতার পত্রপত্রিকাগুলি ‘উপযুক্তভাবে’ ব্যবহার করে পশ্চিম বাঙলায় এক ব্যাপক দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বস্তুতঃপক্ষে ১৯শে জানুয়ারীর পর থেকেই পশ্চিম বাংলার কোন কোন এলাকায় দাঙ্গা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বনগাঁ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ কাউন্সিল ও হিন্দু মহাসভা একক ও যৌথভাবে ২১শে থেকে ২৪শে জানুয়ারী সাম্প্রদয়িক সভা সমাবেশ শুরু করে এবং তার পরপরই বনগাঁ, বহরমপুর, গোরাবাজার, মুর্শিদাবাদ, উল্টোডাঙ্গা এবং কলকাতার মানিকতলা ও বেলেঘাটাতে দাঙ্গা শুরু হয়। ২৯শে জানুয়ারী ‘কাউন্সিল’ বাটানগরে একটি জনসভা করে এবং তার পর সেখানে এক ব্যাপক ও ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। এই সব দাঙ্গার খবর লুফে নিয়ে ঢাকার দৈনিক আজাদ, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা পূর্ব বাঙলায় দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে।[১৫] পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের বিরোধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস দাঙ্গা তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন[১৬] যে, পশ্চিম বঙ্গের সাম্প্রতিক হাঙ্গামা পূর্ব বঙ্গে দাঙ্গা বাধার অন্যতম কারণ। তিনি আরও বলেন যে, ‘পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্য দাঙ্গা বাধার অন্যতম কারণ।’ 

কিন্তু শুধু সংবাদপত্রই নয়, বেতারের মতো সরাসরি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থার ভূমিকাও এক্ষেত্রে কি ছিলো তার একটি উদাহরণ কুমিল্লায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিকৃতি অপসারণকে অবলম্বন করে ‘আল ইণ্ডিয়া রেডিও’র অপপ্রচার। এই অপপ্রচার চালাতে গিয়ে বলা হয় যে, ৪ শত মুসলমান হল আক্রমণ করে এবং মুসলমানরা ২ শত হিন্দু পরিবারের বাড়ী লুণ্ঠন ও বিধ্বস্ত করে। এই মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ করে কুমিল্লার বিখ্যাত উকিল, কংগ্রেস নেতা ও পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য কামিনীকুমার দত্ত এবং পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের কংগ্রেস দলীয় উপনেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবৃতি প্রদান করেন।[১৭] এছাড়া ত্রিপুরা সাংবাদিক সংঘের সভাপতি রজতনাথ নন্দী একটি পৃথক প্রতিবাদমূলক বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে বলেন, “হিন্দুস্থানী বেতারে প্রচারিত এই সংবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ইহার ফলে শুধু উভয় দেশের পারস্পরিক সৌহার্দ্যই বিনষ্ট হইবে না বরং পাকিস্তানে হিন্দুদের অবস্থাও সংকটাপন্ন হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে।”[১৮] 

বস্তুতঃপক্ষে পশ্চিম বাঙলায় ও সমগ্র ভারতে অধিকতর ব্যাপক আকারে দাঙ্গা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ভারতীয় সরকার ও তাঁদের সমর্থক সাম্প্রদায়িক পত্রপত্রিকাসমূহ এই সময় মরীয়া হয়ে ওঠে এবং সেই উদ্দেশ্যে কাল্পনিক দাঙ্গার কাহিনী প্রচারের দ্বারা তাঁরা প্রকৃত দাঙ্গা সৃষ্টির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। 

পূর্ব বাঙলায় সে পর্যন্ত কোন দাঙ্গা সংঘটিত না হলেও পশ্চিম বাঙলা ও ভারতের সরকারী কর্তৃপক্ষ ও প্রচারযন্ত্রগুলির সাম্প্রদায়িক প্রচারণার মধ্যে পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগ সরকার ও আমলাতন্ত্র পূর্ব বাঙলায় দাঙ্গা সৃষ্টির এক অপূর্ব সুযোগ দেখতে পায়। নানা উপায়ে হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গা সৃষ্টির সরকারী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানোত্তরকালে পূর্ব বাঙলায় সে পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি। এবার পূর্ব বাঙলা সরকার সর্দার প্যাটেল প্রদত্ত এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে সতর্ক ও যত্নবান হলো। 

১০ই মার্চ, ১৯৫০ তারিখে নূরুল আমীন দাঙ্গা সম্পর্কিত তাঁর পরিষদ বক্তৃতায়[১৯] বলেন যে, কালশিরার ঘটনাকে যে পশ্চিম বাঙলার সাম্প্রদায়িক সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক মহল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে সেটা তাঁর সরকার জানুয়ারীর শেষের দিকে উপলব্ধি করেন, তার পূর্বে নয়। এবং সেজন্যেই তাঁরা ৩রা ফেব্রুয়ারী কালশিরার প্রকৃত ঘটনা বিকৃত করে ৩রা ফেব্রুয়ারী একটি প্রেস নোট প্রকাশ করেন। যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকার ১৮ই তারিখের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও বিভিন্ন মিথ্যা কাহিনী প্রচারিত হওয়ার পর দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পূর্ব বাঙলা সরকার এ ব্যাপারে কিছুই উপলব্ধি করতে পারেননি, এ কথা যে কোন সাবালক ব্যক্তির পক্ষেই যে বিশ্বাসযোগ্য নয় তা বলাই বাহুল্য। আসল ব্যাপার হলো এই যে, কালশিরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় অপপ্রচারের ফলে পশ্চিম বাঙলায় দাঙ্গা সৃষ্টি হয়ে পূর্ব বাঙলাতেও দাঙ্গা সৃষ্টির যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিলো তা উপলব্ধি করেই পূর্ব বাঙলা সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই সপ্তাহ তাঁদের অর্থপূর্ণ নীরবতা পালন করে। সরকারের এই নীরবতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ৩রা ফেব্রুয়ারী ভারতীয় প্রচারের স্বরূপ’ নামক একটি তীব্র সাম্প্রদায়িক সম্পাদকীয়তে দৈনিক আজাদের মতো একটি পত্রিকাতে পর্যন্ত বলা হয়: 

“বাগেরহাটের ব্যাপার সম্বন্ধে সরকারী নীরবতার আমরা প্রতিবাদ আগেই করিয়াছি, কিন্তু এ পর্যন্ত কোন সাড়া পাওয়া যায় নাই। আজ এই নীরবতার সুযোগ লইয়া সারা ভারতবর্ষে পাকিস্তান বিরোধী প্রচারের প্লাবন দেখা দিয়াছে। যথাসময়ে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ব্যাপারটা পরিষ্কার করিয়া জানাইয়া দেওয়া উচিত ছিলো। যা হোক আমরা পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে এসব প্রচারের স্বরূপ উদঘাটন করিয়া দিতে আশু তৎপর হইতে বলি। যথাসময়ে ব্যবস্থা অবলম্বন না করিলে আমাদের সে ক্ষতি হয়তো পূরণ করাই কঠিন হইবে।” 

এর পর ঐ দিনই অর্থাৎ ৩রা ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাঙলা সরকার কালশিরার ঘটনা সম্পর্কে নিম্নিলিখিত প্রেস নোট প্রকাশ করেন: 

গত ২০শে ডিসেম্বর তারিখে একজন সহকারী পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর এবং ৩ জন কনস্টেবল লইয়া গঠিত একটি পুলিশ দল একজন আসামীর বাড়ী তল্লাশী করিবার জন্য বাগেরহাটের অন্তর্গত কালশিরার গ্রামে গেলে তাহারা অকস্মাৎ কমুনিস্ট প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ সশস্ত্র নমঃশূদ্র কর্তৃক আক্রান্ত হয়। একজন কনস্টেবল ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং পুলিশ দলের অবশিষ্ট লোকগুলি গুরুতর রূপে জখম হয়। নিকটবর্তী অঞ্চল হইতে আনসার দল এবং গ্রামবাসীরা সময় মতো তাহাদিগকে উদ্ধার করিতে আসায় তাহাদের জীবন বাঁচে। ফলে পুলিশের অত্যাচার ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে কালশিরা এবং ঝালডাঙ্গা গ্রামের অধিবাসীরা ঘরবাড়ী ছাড়িয়া পালায়। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা এই সুযোগে গৃহত্যাগীদের পরিত্যক্ত কোন কোন জিনিস চুরি করে। স্থানীয় মুসলমান এবং অমুসলমান অধিবাসীদের সাহায্যে পুলিশ উক্ত জিনিস উদ্ধার করিয়া তাহা মালিক দিগকে ফিরাইয়া দিয়াছে। তদন্ত করিয়া জানা গিয়াছে যে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল কর্তৃক প্রচারিত নারী ধর্ষণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ অথবা প্রতিমা অপবিত্রকরণের সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেবলমাত্র দুটি ক্ষেত্রে নারী নিগ্রহের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে এবং এ সম্পর্কে তদন্ত চলিতেছে। 

এই সকল গ্রাম পরিত্যাগকারী ব্যক্তির এবং পুলিশের ওপর আক্রমণ সংঘটনকারী কম্যুনিস্টরা পশ্চিমবঙ্গে যাইয়া খুলনায় হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী ছড়াইতেছে এবং প্রতিশোধ দাবী করিতেছে। সীমান্তের বাহিরে কমুনিস্টরা অনুরূপভাবে হিন্দুদিগকে পাঁচ মাস পূর্বে বিয়ানীবাজার (সিলেট) থানা এবং ২ মাস পূর্বে রাজশাহী থানা[২০] আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করে।[২১] 

এইভাবে পূর্ব বাঙলা সরকার উপরোক্ত প্রেসনোটটিতে সুন্দরভাবে পশ্চিম ও পূর্ব বাঙলার দাঙ্গা পরিস্থিতির দায়িত্ব কমিউনিস্টদের ওপর আরোপ করে এক ঢিলে দুই পাখী মারার ব্যবস্থা করে। 

ইতিমধ্যে পশ্চিম বাঙলায় কালশিরার ঘটনা পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে মহীরুহের আকার ধারণ করেছিলো। কাজেই পূর্ব বাঙলা সরকারের এই প্রেস নোটে প্রদত্ত বিবরণ সেখানে কেউ গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলো না এবং কেউ যাতে তা গ্রহণ না করে তার জন্যে সরকারী ও বেসরকারী প্রচারণাও সক্রিয় ছিলো। কাজেই প্রেস নোটটি প্রকাশিত হওয়ার পরই পশ্চিম বাঙলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় সেটিকে সম্পূর্ণ বানোয়াট বিবরণ হিসেবে বর্ণনা করে তার সত্যতাকে অস্বীকার করেন।[২২] সেখানকার পত্রপত্রিকাগুলি শোরগোল তুলে তার সাথে সুর মেলায়। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। 

৬ই ফেব্রুয়ারী পশ্চিম বাঙলা সরকার এক প্রেস নোট[২৩] প্রকাশ করে পশ্চিম বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলায় তখনো পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না ঘটা সত্ত্বেও প্রেস নোটটিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলা হয় যে, পূর্ব বাঙলার বরিশাল, যশোর, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ফলেই পশ্চিম বাঙলার দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি ও দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। 

এই ধরনের সরকারী প্রেস নোট সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কলকাতা সফররত মৌলানা আজাদ ১৬ই ফেব্রুয়ারীতে বলেন যে, এই ধরনের বিবৃতির দ্বারা নিজেদের দোষ স্খালন করার চেষ্টা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্ররোচনাই যোগানো হয়, কোন সুফল তার দ্বারা অর্জিত হয় না।[২৪] 

৬ই ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে বিরোধী দলীয় নেতা বসন্তকুমার দাস পূর্ব বাঙলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি, বিশেষতঃ নাচোল ও বাগেরহাটের ঘটনার ওপর বিতর্ক দাবী করেন।[২৫] তিনি বলেন যে, বাগেরহাটের ঘটনার ফলে পূর্ব বাঙলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং নাচোলের ঘটনা পশ্চিম বাঙলায় কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কংগ্রেস দলীয় পরিষদ সদস্য সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস আনসারদের দ্বারা প্রহৃত হয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।[২৬] 

প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন বিতর্ক সম্পর্কিত বসন্ত দাসের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন যে, বাগেরহাট ঘটনার ওপর সরকার ইতিপূর্বে প্রেস নোট প্রকাশ করে সকল তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, কাজেই সে বিষয়ে বিতর্কের কিছু নেই। এর পর তিনি পশ্চিম বাঙলার দাঙ্গা এবং সেখানে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ‘হৃদয় বিদারক ঘটনাবলির উল্লেখ করে বলেন যে, সেই অবস্থায় পূর্ব বাঙলায় শান্তি রক্ষা করা তাদের পক্ষে খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ছে।[২৭] বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে না পারার প্রতিবাদে কংগ্রেস দলীয় সদস্যেরা ঐ দিন পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন। পরদিন অর্থাৎ ৭ই ফেব্রুয়ারী ঢাকার পত্রপত্রিকায় কংগ্রেস দলের পরিষদ কক্ষ ত্যাগ, এবং নূরুল আমীনের ‘হৃদয় বিদারক ঘটনাবলী সংক্রান্ত বক্তব্য মন্তব্যসহ ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। এবং তার ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও উচ্চ মার্গে ওঠে T 

৭ই ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে বসন্ত দাস তাঁদের পরিষদ কক্ষ ত্যাগের ওপর এক বিবৃতি দেন। তাতে তিনি আবার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ওপর বিতর্ক এবং বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর তদন্ত দাবী করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব বাঙলায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন ও বল প্রয়োগের সংবাদ তাঁদের কাছে আসছে। তারিখ অনুযায়ী ঘটনার বিকাশের দিকে সঠিকভাবে লক্ষ্য রাখলে দেখা যাবে যে, তার এই সংবাদ পশ্চিম বাঙলার সাম্প্রদায়িক প্রেস কর্তৃক সরবরাহকৃত সংবাদ ব্যতীত অন্য কিছুই ছিলো না। বসন্ত দাস তাঁর পরিষদ বক্তৃতায় আর একটি দাবী উত্থাপন করে বলেন যে, পূর্ব বাঙলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, তার প্রকৃত তদন্ত একমাত্র সম্ভব একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের মাধ্যমে (!)। এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো এই যে, বিরোধী কংগ্রেস দলীয় নেতা বসন্তকুমার দাস মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের সাথে কমিউনিস্ট বিরোধিতার ক্ষেত্রে একাত্মতা ঘোষণা করে তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে, “তদন্ত দাবী করতে গিয়ে নাচোল ও বাগেরহাটে পুলিশ হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের আচরণের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা আমরা আমাদের কর্তব্য বলে বিবেচনা করি।”[২৮] 

পূর্ব বাংলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষদের বিতর্ক হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে এই যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন বিতর্ক সম্পর্কিত বিরোধী দলীয় প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন।[২৯] এর পর দ্বিতীয়বারের মতো কংগ্রেস দলীয় সদস্যেরা আবার প্রতিবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন।[৩০] বসন্তকুমার দাসের আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের দাবী, কংগ্রেস দলের দ্বিতীয়বার পরিষদ কক্ষ ত্যাগ ও নূরুল আমীনের বক্তৃতা ৮ই ফেব্রুয়ারীর দৈনিক আজাদ, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকায় আবার মন্তব্যসহ ফলাও করে ছাপা হয়। 

পূর্ব বাঙলার সরকার, সংবাদপত্র ও সাম্প্রদায়িক মহলের হাত জোরদার করার জন্যে এবং পূর্ব বাঙলায় দাঙ্গা বাধাবার উদ্দেশ্যে পশ্চিম বাঙলার বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা চলাকালীন অবস্থাতেই ৮ই ফেব্রুয়ারী প্রধামনন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় প্রাদেশিক পরিষদে এক উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন।[৩১] শুধু তাই নয়, ৯ই ফেব্রুয়ারী আবার এক দুরভিসন্ধিমূলক প্রেস নোট জারী করে পশ্চিম বাঙলা সরকার এই মর্মে আশা প্রকাশ করেন যে, শীঘ্রই পূর্ব বাঙলায় সাম্প্রদায়িক শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।[৩২] পশ্চিম বাংলার এই প্রচারণার এবং বিহার, পশ্চিম বাঙলা ও আসাম থেকে বিরাট আকারের উদ্বাস্তুদের পূর্ব বাঙলার প্রবেশের দ্বারা ভীত হয়ে ইতিমধ্যে হাজার হাজার হিন্দু নিজেদের ঘরবাড়ী পরিত্যাগ করে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পশ্চিম বাঙলায় উপস্থিত হতে থাকেন। ইংরেজ আমলে বরদলুইয়ের কংগ্রেসী সরকারের বাঙালী খেদা নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থেকে এবং সাম্প্রদায়িক বিবেচনার দ্বারা বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে আসাম সরকার এই সুযোগে ব্যাপক হারে বাঙালী, অর্থাৎ এক্ষেত্রে মুসলমান বাঙালী খেদানোর পরিকল্পনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করে। এর ফলে ৩রা ফেব্রুয়ারী থেকে আসামের বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গা শুরু হয় এবং ট্রেন বোঝাই হয়ে ও পায়ে হেঁটে হাজার হাজার উদ্বাস্তু পূর্ব বাঙলায় প্রবেশ করতে থাকেন। লুমডিং থেকে মুসলমান উদ্বাস্তু বোঝাই একটি ট্রেনের যাত্রীদেরকে ৩রা ফেব্রুয়ারী ট্রেন থামিয়ে নৃশংসভাবে মারপিট ও হত্যা করা হয়। তাদের মালপত্রও আক্রমণকারীরা লুণ্ঠন করে। 

কলকাতা, বাটানগর ও পশ্চিম বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল, বিহার এবং আসামের বিভিন্ন এলাকায় যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ব্যাপকতম বিস্তৃতি ঘটেছে এবং পূর্ব বাঙলা সরকার যখন পূর্ব বাঙলায় দাঙ্গা পরিস্থিতিকে পরিণত অবস্থায় এনে সমগ্র প্রদেশকে দাঙ্গার চৌকাঠে হাজির করেছে তখন ৯ই ফেব্রুয়ারী ঢাকাতে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার চীফ সেক্রেটারীদের দুই দিন ব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়। দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে চীফ সেক্রেটারী সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহ স্থানীয় সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত হয় ১২ই ফেব্রুয়ারী। 

যৌথ প্রেস নোটটির[৩৩] মূল সিদ্ধান্তগুলি হলো: (ক) জনসভা, শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা (খ) সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধিকর সর্বপ্রকার পুস্তিকা, প্রচারপত্র ইত্যাদির মুদ্রণ ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা এবং (গ) সাম্প্রদায়িক ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে বা আতঙ্কের সৃষ্টি হতে পারে সে রকম কোন গুজব বা সংবাদ প্রকাশ যাতে না করা হয় তার জন্যে উভয় দেশের সংবাদপত্রসমূহের সহযোগিতা প্রার্থনা। যে পর্যায়ে এই সব সিদ্ধান্তের সামান্যতম মূল্য থাকতো সে পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তসমূহের বিপরীত সিদ্ধান্তসমূহকে চক্রান্তমূলকভাবে কার্যকর করার পর দাঙ্গা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এবং দাঙ্গার ব্যাপারে উভয় দেশের জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার ক্ষেত্রে উভয় দেশের পারস্পরিক অলিখিত সহযোগিতা চীফ সেক্রেটারী সম্মেলনের পর এই প্রেস নোটটির মধ্যে একটা পরিণতি লাভ করে।[৩৪] 

২. পূর্ব বাঙলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা 

ঢাকায় চীফ সেক্রেটারী সম্মেলন শুরু হওয়ার দিন অর্থাৎ ৯ই ফেব্রুয়ারী তারিখেই পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী এক চরম উত্তেজনাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা প্রদান করেন। পূর্ব বাঙলায় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি দাঙ্গার প্রান্তসীমায় যখন উপনীত হয়েছে সেই মুহূর্তে এই ধরনের একটি বক্তৃতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ ব্যতীত অন্য কোন হিসেবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তৎকালীন পরিস্থিতিতে এই বক্তৃতার যে স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত পরিণতি তাই ঘটলো। ১০ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে শুরু হলো পাকিস্তানোত্তর পূর্ব বাঙলার সর্ব বৃহৎ এবং সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর ও নাশকতামূলক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ঢাকার এই দাঙ্গা সম্পর্কে ১০/০২/১৯৫০ তারিখে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরীতে নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়: 

দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নবাবপুর, সদরঘাট, পটুয়াটুলী, ইসলামপুর, ডিগবাজার, ইংলিশ রোড, বংশাল, চক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে ঘুরে মুসলমানরা হিন্দুদের যে ক্ষয়ক্ষতি করেছে তা দেখে বেড়ালাম। রাত্রি যাপন করলাম কমরুদ্দীন সাহেবের বাসায়। বিশেষ নোট : স্বাধীনতার পর এই সর্বপ্রথম আজ দুপুর ১২টা থেকে ঢাকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করছে। এর কারণ কলকাতার হাঙ্গামা বিশেষত গত ৩/৪ দিনের। উদ্বাস্তুরা, বিশেষতঃ বিহারীরা, এই গণ্ডগোলের জন্যে দায়ী। স্থানীয় লোকেরা বিরুদ্ধে না থাকলেও উদাসীন ছিলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত লুটতরাজ, হত্যা এবং অগ্নিদাহ অপ্রতিরোধ্যভাবে চললো। এ সব থামাবার জন্যে পুলিশ কিছুই করলো না। অবাঙালী পুলিশেরা উৎসাহ দিলো। সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থা দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করলো। সন্ধ্যা বেলায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ও সান্ধ্য আইন জারী করা হলো কিন্তু কার্যকর করা হলো না। বর্তমান হাঙ্গামার কারণ নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় ইউনিয়ন, বিশেষতঃ পশ্চিম বাঙলার ঘটনাবলীর মধ্যেই নিহিত। এটা নিশ্চিতভাবে কলকাতার মুসলমানদের ওপর যা হয়েছে, বিশেষতঃ গত এক সপ্তাহ ধরে তারই প্রতিক্রিয়া। পূর্ব বাঙলা পরিষদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী এমএলএদের পদক্ষেপ তা অবিবেচনামূলক অথবা পরিকল্পিত যাই হোক, পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করলো। পরিষদের আলোচনায় তাঁদের অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত এবং পূর্ব বাঙলার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্যে জাতিসংঘের কাছে তাদের আবেদনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই প্রদেশে মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিলো। যারা সরল বিশ্বাসে অথবা বিশুদ্ধ নাগরিক চেতনা থেকে যে কারণেই তাঁরা তা করে থাকুন, তার বিরুদ্ধে যারা সব থেকে উদারতাবাদী তাঁরাও বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ভারতীয় হাই কমিশনের সামনে এবং আমাদের চীফ সেক্রেটারীর সাথে আলোচনারত পশ্চিম বাঙলার চীফ সেক্রেটারী মিস্টার এ সেনের সামনে বিক্ষোভ প্রকাশ করার জন্যে ভারতীয় রিপাবলিক থেকে আগত সেক্রেটারিয়টের কেরানীরা যখন মিছিল বের করলো তখন তাঁদের এই অচিন্তিত পদক্ষেপটি পরিপূর্ণ বোঝাই বারুদের ঘরে আগুনের ফুলকার মতই কাজ করলো। যে সমস্ত মোহাজেররা, বিশেষতঃ বিহারীরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে এই ধরনের একটি সুযোগের অপেক্ষা করছিলো তাঁরা এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করলো। দরিদ্র কেরানীরা, যারা শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে একান্তভাবে ইচ্ছুক ছিলো, তাঁরা তাঁদের চারিপাশে মোহাজেরদের দ্বারা গঠিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হলো। তার ফলে প্রথমে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি এবং পরে তাঁদের নিজেদের ওপর জনতার আক্রমণ শুরু হলো। উত্তরোত্তর জোরালোভাবে হত্যা চলতে থাকলো। ইতিমধ্যে দোকান পাট সমস্ত লুট হয়ে যাওয়ায় দুষ্কৃতিকারীদের সমস্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়লো হিন্দুদের জীবনের ওপর। যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে কিছু সংখ্যক পরিবারকে সম্পূর্ণভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিক্ষিপ্ত আক্রমণের ঘটনার সংখ্যা অসংখ্য। চলন্ত ট্রেনের কামরায় হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে। 

কতকগুলি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন হিন্দু পরিবারগুলিকে স্থান দেওয়ার জন্যে সরকার ব্যবস্থা করেছে। প্রধান প্রধান সড়কগুলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বাড়িয়ে সন্ধ্যা ৫টা থেকে সকাল ৮টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বেপরোয়াভাবে হত্যাকাণ্ড চলছে। সরকারী নীতিকে সাহায্য করার জন্যে দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ সাহস করছে না। 

১০/০২/৫০ তারিখ থেকে জীবনের ওপর আক্রমণ চলছে। হ্রাস পাওয়ার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, যদিও বিশৃঙ্খল জনতার গুণ্ডামী কমেছে।[৩৫] 

১৩ই ফেব্রুয়ারী বরিশালে গুজব ছড়ায় যে ফজলুল হককে কলকাতায় হত্যা করা হয়েছে। এই গুজব ছড়ানোর সাথে সাথে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারী থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সদর মহকুমার ঝালকাঠি ও নলছিটি থানার কতকগুলি এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে লুটতরাজ, অগ্নিদাহ এবং হত্যা চলে। ২৩শে ফেব্রুয়ারী নূরুল আমীন শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে গৌরনদীতে দুটি জনসভা করেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা থেকে নোয়াখালী জেলার ফেনীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং ১৬ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৪ই ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে দাঙ্গা শুরু হয়ে তা পরদিন পর্যন্ত চলে। চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে দাঙ্গার কিছুটা বিস্তৃতি ঘটে। ময়মনসিংহের জামালপুরে দাঙ্গা শুরু হয় ১৬ ফেব্রুয়ারী এবং পরে তা কেন্দুয়া ও শেরপুরেও বিস্তৃত হয়। ১৮ তারিখের মধ্যে সেখানকার অবস্থা আয়ত্তে আসে। সিলেটের কয়েকটি এলাকায় দাঙ্গা হাঙ্গামা হয় ১৬ই ফেব্রুয়ারী। ১৩ই ফেব্রুয়ারী ভৈরবে হিন্দু উদ্বাস্তু যাত্রী বোঝাই একটি ট্রেন সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং যাত্রীদের জিনিসপত্র লুণ্ঠিত হয় ও বহু সংখ্যক যাত্রীকে হত্যা করা হয়। সান্তাহারে ট্রেনের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটে ২৮শে ফেব্রুয়ারী।[৩৬] কুমিল্লায় বসবাসকারী ফরাসী জমিদার পিয়ের ডিলানীর[৩৭] সাথে এক সাক্ষাৎকারের পর লণ্ডন ইকনমিস্ট ও ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানের প্রতিনিধি তায়া জিনকিন কুমিল্লার পরিস্থিতি ও ভৈরব সেতুর কাছে উদ্বাস্তু ট্রেন যাত্রীদের হত্যা সম্পর্কে লেখেন: 

এর ফলে কুমিল্লায় কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়নি কিন্তু চারিদিকে এমন ভীতির সঞ্চার হয়েছিলো যে তা তেলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং অনেক হিন্দু ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলো। তিনি (পিয়ের) তাঁদেরকে থেকে যাওয়ার জন্যে অনুনয় বিনয় করেছিলেন কিন্তু তাঁরা শুনতে চায়নি। বোধ হয় তাঁরাই সঠিক ছিলো কারণ তিনি নিজেও তো সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন, কাজেই তাঁরা যখন গাদাগাদি করে ট্রেনে চড়ে ভারতের দিকে রওয়ানা হচ্ছিলো তখন তিনি তাঁদেরকে বিদায় জানালেন। ট্রেনটি নদী পার হয়ে যখন ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে প্রবেশ করলো তখন সেটিকে সেতুর ওপরই ঘেরাও করা হলো। ইঞ্জিনের ড্রাইভার ইচ্ছা করেই ট্রেনটা থামিয়ে দিয়েছিলো। সেতুটির দুই দিক থেকেই খুনীর দল যাত্রীদেরকে আক্রমণ করলো। যারা নিরাপত্তার জন্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং সাঁতরে তীরের দিকে যেতে চেষ্টা করলো তাঁদের মাথায় ইট মেরে তাঁদেরকে ডুবিয়ে দেওয়া হলো। পিয়েরের মতে প্রায় ১০০০ হিন্দু সেইভাবে নিহত হয়েছিলো। তাঁর ধারণা মতে সমগ্র পূর্ব বাঙলায় নিহতের সংখ্যা হলো ৩০০০ এবং ধর্ষণের সংখ্যা ২০০।[৩৮] 

২০শে ফেব্রুয়ারীর দিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো। কিন্তু ২০ তারিখের থেকেই পশ্চিম বাঙলার পত্রপত্রিকাগুলি দুই চীফ সেক্রেটারী চুক্তির শর্তগুলির খেলাফ করে আবার উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ ও বক্তৃতা বিবৃতি প্রকাশ করতে শুরু করে। দিন কলকাতার পত্রিকাগুলি সারা ভারত কংগ্রেসের সম্পাদকের একটি উত্তেজনাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে এমন কথাও বলা হয় যে, ‘কলকাতার মুসলমানরা হিন্দুদেরকে উত্তেজিত করছে। ২১শে ফেব্রুয়ারী অমৃতবাজার পত্রিকায় পশ্চিম বাঙলার মন্ত্রী কালীপদ মুখার্জীর একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক বিবৃতি প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। সর্বোপরি ভারতীয় ‘অসাম্প্রদায়িক জাতীয় রাষ্ট্রের’ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ২৩শে তারিখে ভারতীয় পার্লামেন্টের সর্দার প্যাটেলের ১লা জানুয়ারীর কলকাতা বক্তৃতার সাথে তাল রেখে এক ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন এবং পাকিস্তানকে হুমকী প্রদান করে বলেন যে, পাকিস্তান যদি তার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে তাঁদের নিরাপত্তার জন্যে ভারত “অন্য ব্যবস্থা” গ্রহণ করবে।[৩৯] ভারতও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে তার নিজের সংখ্যালঘুদেরকে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের থেকে যে অধিকতর নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়নি, চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তার কোন উল্লেখ নেহেরু তার বক্তৃতায় করেননি। ভারতীয় এবং পশ্চিম বাঙলা সরকার যে সেখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেই সময়ে কি মনোভাব পোষণ করছিলো তার একটি উদাহরণ হলো ১০ই ফেব্রুয়ারী তারিখে পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের একটি পত্র। এই পত্রে তিনি কলকাতার মানিকতলা এলাকায় আশ্রয় শিবিরে প্রায় পনেরো হাজার মুসলমান উম্মস্তকে পূর্ব বাঙলায় নিয়ে যাওয়ার দাবী জানান কারণ তাঁরা সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঐ এলাকায় থাকলে তা ভবিষ্যতে নোতুন হাঙ্গামার কারণ হতে পারে। নিজের দেশের নাগরিকদেরকে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অন্য একটি দেশের সরকারের প্রতি এই ধরনের এবং এই দৃষ্টিভঙ্গী উদ্ভূত দাবী যে ভারতীয় সরকারের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের মুখোশ সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করেছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

২৮শে ফেব্রুয়ারী করাচীতে এক সাংবিধানিক সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, নেহেরুর ২৩শে তারিখের পার্লামেন্ট বক্তৃতার জবাব দিতে গিয়ে সমগ্র ঘটনার জন্যে হিন্দু মহাসভা ও সর্দার প্যাটেলকে দায়ী করে বলেন, “ভারত যদি যুদ্ধ চায় তাহা হইলে তাহারা আমাদিগকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাইবে”।[৪১] 

উপরোক্ত উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রচারণার ফলে ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে কলকাতায় আবার একবার দাঙ্গা হয় এবং এই সময় থেকে শুরু করে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে আসামের কামরূপ ও গোয়ালপাড়া এবং জলপাইগুড়ি, বর্ধমান, হুগলী ও হাওড়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়।[৪২] পূর্ব বাঙলাতেও, বিশেষতঃ উত্তর বাঙলার দিনাজপুর, সান্তাহার ইত্যাদি এলাকায় মার্চের ২ তারিখ পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু হাঙ্গামা হয়। 

বিহার, আসাম এবং দুই বাঙলার এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে ভারত ও পূর্ব বাঙলায় একটি বিরাট উদ্বাস্তু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাঙলা সরকার ১০ই মার্চ, ১৯৫০ তারিখে পূর্ব বাঙলায় প্রবেশকারী রেজিস্ট্রীকৃত উদ্বাস্তুদের যে তালিকা দেন তা হলো এই : জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বনগাঁ, কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আগতের সংখ্যা ৩৮,৩৪০; কাছাড় জেলা থেকে সিলেটে আগতদের সংখ্যা ২৩,১১৫; গোয়ালপাড়া থেকে রংপুর আগতদের সংখ্যা ৫৪,৫৬৯।[৪৩] এই সংখ্যা যখন দেওয়া হয় তখনও পশ্চিম বাঙলা ও আসামের আশ্রয় শিবিরে অসংখ্য উদ্বাস্তু পূর্ব বাঙলায় প্রবেশের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন এবং ট্রেন, স্টীমার ও প্লেন ভর্তি হয়ে প্রতিদিনই বিরাট সংখ্যায় পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করছিলেন। পূর্ব বাঙলা থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুদের কোন সংখ্যাই পূর্ব বাঙলা সরকারের সূত্র থেকে পাওয়া যায় না। তবে সে সংখ্যা যে কয়েক লক্ষ ছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

৩. দাঙ্গা ও আমলাতন্ত্র 

আমলাতন্ত্রের প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্ব পূর্ব বাঙলায় এই সময় কতখানি ছিলো এবং পর্দার অন্তরালে থেকে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ওপর তাঁদের কি পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ছিলো তার কয়েকটি উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।[৪৪] লন্ডনের ইকনমিস্ট ও ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিনিধি তায়া জিনকিন ১৯৫০ সালের এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে ভারত ও পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে সফর করেন। ঢাকায় চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জাকির হোসেন প্রভৃতির সাথে এই সময় তিনি একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। 

নিজেদের বিভিন্ন অসুবিধা এবং বাঙালী সরকারী অফিসার ও সাধারণভাবে বাঙালীদের সম্পর্কে আজিজ আহমদের বক্তব্য তায়া জিনকিন এইভাবে লিপিবদ্ধ করেন: 

আজিজ আহমদ খুব খেয়াল করে শোনার পর নিজের অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। এ পর্যন্ত ৭,০০,০০০ হিন্দু ভারতে চলে গেছে এবং সমসংখ্যক মুসলমান ভারত থেকে এসেছে। তিনি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করছিলেন যে ইসলাম বিপন্ন। কিন্তু তিনি কী করত পারেন?… তাঁর প্রশাসন ব্যবস্থার, তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, প্রায় কোন অস্তিত্ব নেই এবং স্থানীয়দের মধ্যে যারা আছে, তাঁরা ভয়ানক অযোগ্য। অধিকাংশ কেরানীই ছিলো হিন্দু এবং তারা সকলেই চলে গেছে। একজনই মাত্র উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলো যে বাঙালী, বাকীরা সব অন্যত্র থেকে এসেছে, অধিকাংশই পাঞ্জাব থেকে এবং তাঁরা কেউ বাঙলা বলে না, বলে উর্দু অথবা হিন্দি। সৈন্যবাহিনী ছোট এবং সীমান্ত বরাবর নিয়োজিত। বাঙালীরা পশ্চাৎপদ এবং উচ্ছৃঙ্খল আরবী জানে না বলে বাঙলাতে নামাজ পড়ে। তাঁদের এবং প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যে কোন সাধারণ ভাষা নেই। এমনকি শপথ নেওয়ার সময় তাঁরা কালী ও দুর্গার (বাঙলাদেশের প্রিয় উপাস্য দেবী) নাম নেয়— তিনি বলেন গভীর বিতৃষ্ণার সাথে। যদিও তিনি পূর্ব বাঙলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটা কলোনী হিসাবে আখ্যায়িত করলেন না তবু তার সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিলো একজন ঔপনিবেশিক প্রশাসকের। এ বিষয়ে তিনি একজন পাকা পশ্চিম পাকিস্তানী।[৪৫] 

পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন সম্পর্কে পূর্ব বাঙলার চীফ সেক্রেটারীর ধারণা ও মন্তব্য তায়া জিনকিনের নিম্নলিখিত রিপোর্টটিতে পাওয়া যাবে: 

আমি তার নিজের হিন্দুদের প্রসঙ্গে ফিরে এলাম : ‘আপনাদের এখান থেকে উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যায় দেশত্যাগের সাথে নিশ্চয়ই গোয়ালপাড়ার কোন সম্পর্ক নেই। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের একটা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দিলেন কেন?’ তাঁর প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের উল্লেখমাত্রেই আজিজ ফেটে পড়লেন, ‘তার কাছ থেকে কি আশা করতে পারেন? তিনি একটা গাধা এবং বাঙালী। যাই হোক তিনি যাই বলুন কলকাতার সংবাদপত্র মহল তাঁকে আরও খারাপভাবে দেখিয়েছে এবং ভারতের ডেপুটি কমিশনার তাই নিয়ে শোরগোল ও নাচানাচি করেছেন। এবং তাই যদি হয় তাহলে সর্দার প্যাটেলের হুমকিমূলক বক্তৃতা সম্পর্কে কী বলবেন?[৪৬] 

নূরুল আমিনের ওপর ৯ই ফেব্রুয়ারীর বক্তৃতার সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেও একথা নিতান্তই অবিশ্বাসযোগ্য যে, যে প্রধানমন্ত্রীকে একজন বিদেশী সাংবাদিকের কাছে আজিজ আহমদ ‘গাধা” বলতে ভয়, সঙ্কোচ ও ইতস্তত বোধ করলেন না তাঁর অনুমতি না নিয়ে অথবা তার সাথে পরামর্শ না করে পূর্ব বাঙলার সেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঐ বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য করা এবং সব কিছুর দায়িত্ব অস্বীকার করা আজিজ আহমদের পক্ষে সম্ভব ছিলো, কারণ তৎকালীন আমলারা পর্দার অন্তরালে থেকেই বস্তুতঃপক্ষে সমগ্র প্রশাসনযন্ত্রের ওপর, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব জারী রেখেছিলেন। 

দাঙ্গার কারণ সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত ফরাসী জমিদার পিয়ের ডিলেনীর বক্তব্য হলো: 

তিনি বলেন যে, সমস্ত হাঙ্গামাটাই প্রথমতঃ শুরু হয়েছে নির্বোধভাবে। ‘একজন কমিউনিস্টকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে কয়েকজন পুলিশ খুলনা জেলার একটি হিন্দু গ্রামে গিয়েছিলো। একজন নিহত হয়েছিলো। পুলিশকে মারা সব সময়েই একটা ভুল। পুলিশ ও আনসাররা (মুসলমান ভলান্টিয়ার) গ্রামবাসীদেরকে মারপিট করে এবং গ্রামে লুটতরাজও করে। ঐ গ্রাম থেকে লোকেরা পালিয়ে যায় এবং ভারতের দিকে নিজেদের যাত্রাপথে অন্যান্য গ্রামে লোকদেরকেও জুটিয়ে নেয়। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে, এক মাসেরও কম সময়ে ৩০,০০০ হিন্দু খুলনা থেকে ভারতে পলায়ন করে। তবু নির্বোধ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এটা বুঝতেই পারলো না যে, কিছু একটা ঘটেছে। সে যদি নির্বোধ না হতো তাহলে সে এলাকাটা একবার সফর করলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু না। সে তার অফিসে নিজের নিতম্বের ওপর বসে নিজের মোটা মোটা আঙ্গুলগুলো মোচড়াতে থাকলো। উদ্বাস্তুরা ভারতে কতকগুলো ভীতিপ্রদ কাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলো, যেগুলি সত্যি না হলেও তাঁরা সেগুলি বিশ্বাস করছিলো। তারপর ৫ই ফেব্রুয়ারী ভারতে দাঙ্গা ঘটলো; ৯ তারিখে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সাথে সাথে পেন্ডুলাম ঘুরলো।[৪৭] 

ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জাকির হোসেনের সাথে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তায়া জিনকিন তার রিপোর্টে লেখেন: 

পুলিশের এই ইন্সপেক্টর জেনারেলের সাথে কথা বলতে বলতে আমি আজিজের জন্যে দুঃখ বোধ করতে শুরু করলাম। এই যদি তাঁর সব থেকে সিনিয়র ও সর্বোৎকৃষ্ট বাঙালী হয় তাহলে তিনি বেশ বেকায়দা অবস্থাতেই আছেন বলতে হবে। হঠাৎ আইজি পূর্ব বাঙলায় সব কিছু যারা চালাচ্ছেন এবং বাঙালীদেরকে কোন সুযোগ দিচ্ছে না সেই পাঞ্জাবীদেরকে আক্রমণ করতে শুরু করলেন। আমি হঠাৎ উপলব্ধি করলাম কেন হিন্দুরা পলায়ন করছে। যদি পাঞ্জাবীদের সম্পর্কে এমনকি মুসলমানদের মনোভাব এই হয় তাহলে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থে পরিচালিত একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুদের কি অবস্থা হতে পারে।[৪৮] 

তায়া জিনকিন ফেব্রুয়ারী মাসেই দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরে আসেন। সেবারও তিনি আজিজ আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে তার রিপোর্ট: 

আমি তারপর আজিজ আহমদের সাথে দেখা করলাম এবং যে যোগ্যতার সাথে তিনি কলকাতার প্রতিশোধ গ্রহণকে প্রতিরোধ করেছেন তার জন্য অভিনন্দন জানালাম। — প্ৰথম সাক্ষাতের মতো এবার আজিজ আহমদের ব্যবহার ততখানি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলো না। আমার সফর তাঁর পরিকল্পনা মতো হয়নি। তাছাড়া, ইকনমিস্টে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যাতে আমি পাকিস্তানকে সীজারের স্ত্রীর সাথে তুলনা করে বলেছিলাম যে, ইসলামিক হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াকে তার দেখানো দরকার হচ্ছিলো যে সে হিন্দুদেরকে একটা সম্মানজনক স্থান দিতে পারে। এছাড়া পাঞ্জাবীদের ঔপনিবেশিক মনোভাবের দ্বারা এমন আবহাওয়া সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিলো না যাতে করে হিন্দুরা মনে করতে পারে যে তাঁরা বঞ্চিত। বাঙালী মুসলমানদের ও পাঞ্জাবী শাসকদের তো তবু একই কোরান ছিলো কিন্তু তাঁদের তাও ছিলো না।[৪৯] 

দুইবার পূর্ব বাঙলা সফরের পর তায়া জিনকিন কলকাতায় পশ্চিম বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকার রিপোর্টের নিম্নোদ্ধৃত অংশটি এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক: 

কিভাবে এ সমস্তটা (অর্থাৎ দাঙ্গা – ব.উ.) শুরু হয়েছে সে বিষয়ে আমার বর্ণনা ডক্টর রায় শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেও তিনি পূর্ব বাঙলার আবহাওয়ার জন্যে পাঞ্জাবী অফিসারদেরকে দোষারোপ করতে থাকলেন। গতবার যখন পূর্ব বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বাতের চিকিৎসার জন্যে এসেছিলেন তখন তার কাছে তিনি তিক্তভাবে অভিযোগ করেছিলেন যে, পাঞ্জাবী চীফ সেক্রেটারী আমার বন্ধু আজিজ আহমদ[৫০] তার সাথে এমন ব্যবহার করে যেন তিনি একটি আবর্জনা এবং পূর্ব বাংলার লোকদের সাথে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে যা বৃটিশরা কোনদিন করেনি। ডক্টর রায়ের মতে বাঙালী মুসলমানদের এই বিক্ষোভই ব্যাখ্যা করে কি কারণে দাঙ্গা সৃষ্টির প্রয়োজন হয়েছিলো। দেশ বিভাগ, কাস্টমসের বিধিনিষেধ এবং দুই দেশের মধ্যেকার প্রায় শেষ হয়ে আসা বাণিজ্য তাঁদেরকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুব জোর আঘাত হেনেছিলো, বিশেষতঃ, এজন্যে যে পাট তাঁদের থাকলেও পাট কলগুলি ছিলো কলকাতায়। কেবলমাত্র ভারতীয় আগ্রাসী আক্রমণের ভীতিই 

পাকিস্তানের দুই অংশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। কাজেই বাঙালী মুসলমানরা যাতে করে ভারতকে ভয় করে চলে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার উদ্যোগই পাঞ্জাবীরা নিয়েছে।[৫১] তায়া জিনকিনের রিপোর্টের উপরিউদ্ধৃত অংশগুলির থেকে পূর্ব বাংলায় অবাঙালী উচ্চপদস্থ আমলাদের প্রতি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বাঙালী কর্মচারীদের মনোভাব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। শুধু তাই নয় অবাঙালী এইসব অফিসারদের প্রতি বাঙালীদের বিক্ষোভ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এত স্বল্পকালের মধ্যেই এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো যাতে করে বাঙালী এবং অবাঙালী দুই পক্ষেই বিদেশীদের কাছে এই অভ্যন্তরীণ ব্যাপারের উল্লেখ এবং পরস্পরের প্রতি অভিযোগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা অথবা সংকোচ বোধ করতেন না। এই পরিস্থিতিতে তায়া জিনকিন এবং ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় বাঙালীদের পাঞ্জাবী ভীতিকেই সরকারের প্রতি হিন্দুদের আস্থার অভাব, তাঁদের দেশ ত্যাগ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণ হিসেবে অনেকখানি সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন। ডক্টর রায় কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিষয়ে উল্লেখ প্রসঙ্গতঃ করেননি। সে বিষয়টি হলো : ভারত ও পশ্চিম বাঙলা সরকারের দাঙ্গা বাধাবার প্রয়োজন হয়েছিলো কেন? 

৪. শান্তি আন্দোলন 

১০ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় দাঙ্গা বাধার সাথে সাথেই ঢাকাসহ পূর্ব বাঙলায় সর্বত্র শান্তি আন্দোলন শুরু হয়। ১১ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি সভা আহ্বান করেন। কিছুসংখ্যক ছাত্র সেই সভায় যোগদান করলেও অধিকাংশ ছাত্রের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখা যায় না।[৫২] পরদিন ১২ই ফেব্রুয়ারী বেলা ১.৩০ মিঃ-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি যৌথ সভা হয় এবং তাতে সভাপতিত্ব করেন কাজী মোতাহার হোসেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর নূরুল হুদা, অধ্যাপক নজমুল করিম ও এএনএম মাহমুদ এবং কিবরিয়া, আব্দুল আওয়াল প্রভৃতি বক্তৃতা করেন। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল স্থায়ী হলেও শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এই সভায় গৃহীত হয়নি।[৫৩] 

এর পর ডক্টর শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, পরিষদ সদস্য, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘পূর্ববঙ্গ শান্তি ও পুনর্বসতি কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। ‘পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের নিকট আবেদন’ শীর্ষক একটি ইস্তাহারে দাঙ্গা ও শান্তি সম্পর্কে এই কমিটির বক্তব্য জনগণের সামনে উপস্থিত করা হয়। শক্তিশালী পাকিস্তান গঠনের জন্য শান্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে, ধর্মের নামে এবং ভারতে মুসলমানদের উপর অত্যাচার নির্যাতনকে দাঙ্গার যুক্তি হিসেবে খাড়া করার বিরুদ্ধে এই ইস্তাহারটিতে নানান যুক্তি দিয়ে সর্বস্তরের জনগণকে দলমত ও ধর্ম নির্বিশেষে সরকারের ও শান্তি কমিটির শান্তি প্রচেষ্টায় সহযোগিতার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 

মুসলমানদের প্রতি বিশেষ আবেদন জানিয়ে ইস্তাহারটিতে বলা হয়: 

পাকিস্তানের প্রত্যেক মুসলমানের মনে রাখা উচিত যে, কলকাতা বা হিন্দুস্থানের কোন অংশে হিন্দুদের দ্বারা অনুষ্ঠিত কোন অন্যায়ের জন্য এ দেশের হিন্দুদের কিছুতেই দায়ী করা চলে না। মুসলমানদের ন্যায় তাঁরাও স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক এবং পাকিস্তান সরকার যখন তাঁদের নাগরিক বলিয়া স্বীকার করিয়াছে তখন জান মালের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের ন্যায় তাহাদের রাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণ দাবী আছে। এ কথা প্রত্যেক মুসলমানের স্মরণ রাখা উচিত যে, পাকিস্তানের হিন্দুরা হিন্দুস্থানের মুসলমানদের বিনিময়ে জামানত হিসেবে বাস করিতেছে না। তাহারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারের বলেই বাস করিতেছে। অতএব একজন মুসলমানের যে তারই মতো একজন পাকিস্তানের স্বাধীন নাগরিক এমন একজন হিন্দুর উপর কোন অবস্থাতেই অন্যায় উৎপীড়ন করার অধিকার নাই। প্রত্যেক শিক্ষিত ও বিবেচক মুসলমানের স্মরণ করা উচিত যে, পশ্চিম বাঙলার দাঙ্গার প্রতিবাদে এখানে নিরপরাধ হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার করিলে তাহাতে হিন্দুস্থানের মুসলমানদের কোন উপকার হইবে না। বরং বিহার, উড়িষ্যা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, নাগপুর প্রভৃতি প্রদেশে এখনও যে সব কোটি কোটি মুসলমান হিন্দুদের সঙ্গে সুখে শান্তিতে বাস করিতেছে তাহাদের জীবন বিপন্ন হইয়া পড়িবে। দেশে শান্তি রক্ষার দ্বারা পাকিস্তানের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার দ্বারাই একমাত্র হিন্দুস্থানের মুসলমানদের আপনারা সত্যিকার উপকার করিতে পারেন। হিন্দুদের প্রতি আবেদন জানিয়ে ইস্তাহারটিতে বলা হয়: 

হিন্দু ভাইগণকে আমরা বলিবো, আপনারা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’, সেই জন্মভূমিকে আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া সহসা পরিত্যাগ করিবেন না। আপনারা মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে হিন্দু মুসলমানের মিলনমন্ত্র গ্রহণ করিয়া ক্ষমা দ্বারা ক্রোধকে জয় করুন এবং সাহস সহকারে বিপদ দূর করিবার জন্য চেষ্টা করুন। আপনারা নিশ্চয় জানিবেন রাষ্ট্রের সর্বাধিক সাহায্য ও সহানুভূতি সুখে দুঃখে সম্পদে বিপদে সকল সময়ে আপনারা পাইবেন। পাকিস্তানের দৃঢ় অথচ সদয়বাহু সর্বদা আপনাদিগকে সাহায্য ও রক্ষা করিতে প্রস্তুত আছে এবং রাষ্ট্রের সমস্ত হিতকামী নাগরিক ও ধর্মনিষ্ঠ মুমিন মুসলমান আপনাদের সহিত আছেন। ইহার প্রমাণ আপনারা বর্তমানে পাইয়াছেন ও ভবিষ্যতে পাইবেন। আপনারা লক্ষ্য রাখিবেন; আপনাদের মধ্য হইতে আত্মীয়-স্বজন ফেলিয়া যাহারা পশ্চিম বঙ্গ, আসাম প্রভৃতি ভারতীয় রাজ্যে চলিয়া যাইতেছেন, তাহারা যেন সেখানে যাইয়া অতিরঞ্জিত কোন কথা না বলেন বা উত্তেজনামূলক কোন গুজব না রটান, অথবা এখান হইতে কেহ কোন মিথ্যা সংবাদ সংবাদপত্রে বা চিঠিপত্রের মারফতে কাহারও নিকট না পাঠান। কারণ তাহাতে সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হইলে এখানেও হইতে পারে এবং তার ফলে উভয় রাজ্যেই অশেষ অঘটন ঘটিতে পারে। যদি কেহ তাহা করেন, তবে নিজের আত্মীয় গোষ্ঠিরই অনিষ্ট করিবেন। সকলের মঙ্গলের জন্য শান্তির পথই একমাত্র পথ। 

ইস্তাহারটিতে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এতে দাঙ্গার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই, দাঙ্গাকারীদেরকে প্রত্যক্ষভাবে চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য নেই এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পূর্ব বাঙলা সরকার যে হিন্দুদের পরম বন্ধু একথা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র ও প্রাদেশিক সরকার সম্পর্কে এই ধরনের বক্তব্য যে তৎকালীন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তার মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে না তা বলাই বাহুল্য। 

‘পূর্ববঙ্গ শাস্তি ও পুনর্বসতি কমিটির’ এই ইস্তাহারটিতে নিম্নলিখিত ব্যক্তি স্বাক্ষর দেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ডক্টর এসএন রায়; পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদ সদস্য হামিদুল হক চৌধুরী, আলি আহমদ খান, বসন্তকুমার দাস, ফরিদ আহমদ চৌধুরী, আনোয়ারা খাতুন, আব্দুল খালেক, খয়রাত হোসেন, আব্দুল হাকিম ও শামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী; পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য এব্রাহিম খান ও ভবেশচন্দ্র নন্দী; এডভোকেট আতাউর রহমান, মহম্মদ নূরুল হুদা, কফিল উদ্দীন চৌধুরী, আলী আমজাদ খান; ব্যবসায়ী খান বাহাদুর আরফান খান ও রায়বাহাদুর আরপি সাহা; শিল্পপতি সূর্যকুমার বসু; মীর্জা আব্দুল কাদের, আলমাস আলী, এমএ আউয়াল, এমএ ওয়াদুদ, কেজি মহবুব, তফাজ্জল হোসেন, খালেক নেওয়াজ খান, এমএ আজিজ ও আজিজুল হাকিম; সংবাদপত্র প্রতিনিধি ঊষা রায় (আনন্দ বাজার), আব্দুল ওয়াহাব (স্টেটসম্যান) ও এসকে চ্যাটার্জী (অমৃত বাজার); এনসি সাহা, পিকে ব্যানার্জী, জাফর করিম, ক্ষেত্র মোহন বণিক, রাধাবল্লভ ও সামসুল হক। ‘পূর্ববঙ্গ শান্তি ও পুনর্বসতি কমিটি’ ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রদের সমন্বয়ে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি কমিটি’ নামে অন্য একটি কমিটিও গঠিত হয়। এই কমিটি ২রা মার্চ, ১৯৫০ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা আহ্বান করেন এবং সেই উপলক্ষে ‘২রা মার্চ শান্তি দিবস পালন করুন’ নামে একটি ইস্তাহার তাঁদের দ্বারা প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়: 

দেশ বিভাগের পর ঢাকার তথা পূর্ববঙ্গের ছাত্র সমাজ রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে, দমননীতি বিরোধী দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে, আরবী হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে আরও নানা প্রগতিশীল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন চিন্তাধারা ও বলিষ্ঠ সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দিয়াছে এবং কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত বারবার বানচাল করিয়া দিয়াছে। এই সকল আন্দোলন শুধু ছাত্র আন্দোলন হিসাবে সীমাবদ্ধ থাকে নাই; প্রদেশব্যাপী গণ-আন্দোলনে পর্যবসিত হইয়াছে। 

গণ-আন্দোলনে ভীত কায়েমী স্বার্থ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সম্প্রতি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অতি পুরাতন অস্ত্র হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকে আবার চাঙ্গা করিয়া তুলিয়া জনসাধারণকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করিবার চাল চালিয়াছিলো। কিন্তু সচেতন ছাত্রসমাজ ও শান্তিকামী জনসাধারণ সক্রিয় প্রতিরোধের দ্বারা এই নয়া চক্রান্তকে রুখিয়া দাঁড়ায় এবং শান্তি ও সৌহার্দ্য ফিরাইয়া আনিতে সমর্থ হয়। 

কিন্তু পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে কি? এখনো ১৪৪ ধারা, সান্ধ্য আইন মিলিটারীরাজ যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে তাহাতে কারো মনে পূর্ণ আস্থা ফিরিয়া আসিতে পারে না এবং কোন গণআন্দোলনই দানা বাঁধিয়া উঠিতে পারে না। অধিকাংশ শিক্ষায়তনের দুয়ার এখনো বন্ধ, শিক্ষকের অভাবে শিক্ষাযন্ত্র অচল। 

এই অস্বাভাবিক অবস্থার অবসান ঘটাইয়া পূর্ণ শান্তি ও আস্থা ফিরাইয়া আনিবার জন্য আরো জোরদার সংগ্রাম প্রয়োজন। এই শাস্তির লড়াইয়ে আমাদের হাতিয়ার-সুসংহত ছাত্র ও গণশক্তি। আমাদের এমন অবস্থা প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে যেখানে মেহনতী জনতার ভাত কাপড়ের লড়াই চলিবে, প্রগতিবাদী আন্দোলন চলিবে, এবং ছাত্রদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতি রুদ্ধ হইবে না। তাই জনসাধারণের মধ্যে যে কোন আকারের (তা ধর্মীয় ভিত্তিতেই হোক বা প্রাদেশিক ভিত্তিতেই হোক) সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা তার উস্কানী আমাদের রুখিতে হইবে। 

এই দ্বিতীয় ইস্তাহারটি প্রথমটির থেকে স্পষ্টতই তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। এখানে দাঙ্গার কারণ ও দাঙ্গাকারীদের সম্পর্কে বক্তব্যের চরিত্র এবং হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ছাত্র ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বানের ক্ষেত্রে অনেক প্রভেদ। এই স্বাতন্ত্র ও প্রভেদের কারণ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি কমিটি’ নামে এই কমিটি ছিলো মূলতঃ কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন ছাত্র ফেডারেশনের ছাত্রদের উদ্যোগে গঠিত এবং ইস্তাহারটি ছিলো খুব সম্ভবতঃ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তির দ্বারা রচিত। 

২রা মার্চ, ১৯৫০ দুপুর দুটোর সময় বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সভাটি মহম্মদ তোয়াহার সভাপতিত্বে শুরু হয়। কিন্তু শুরু হওয়ার সাথে সাথেই শান্তি কমিটির বৈধতা ইত্যাদি নিয়ে সভাস্থলে দারুণ গণ্ডগোল ও ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এই গণ্ডগোল বাধানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী মুসলিম লীগের ছাত্র ফ্রন্ট মুসলিম ছাত্র লীগের এমএ ওয়াদুদ, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নওয়াজ খান প্রভৃতি নেতৃত্ব দেন এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ছাত্র ফ্রন্ট নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের দলিল, আহসান উল্লাহ প্রভৃতির সাথে হাত মেলান।[৫৪] শেষোক্ত এই দুই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের উপরোক্ত নেতারা ২রা মার্চের সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সভায় দারুণ হট্টগোল ও মারপিটের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে একটি পাল্টা শান্তি কমিটি গঠন করেন।[৫৫] 

এই সময় ‘Save Bengals From the Clutches of Riot – Mongers’ নামে ইংরেজীতে লিখিত একটি দাঙ্গা বিরোধী ইস্তাহার সরাসরি ‘পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নামে প্রচারিত হয়। সাত পৃষ্ঠার এই নিম্নলিখিত দীর্ঘ ইস্তাহারটিতে তৎকালীন পরিস্থিতিতে দাঙ্গার কারণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে তার বিরুদ্ধে সামগ্রিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে জনগণের কাছে আহ্বান জানানো হয়: 

দুই বাঙলাই সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। প্রথম দফা দাঙ্গা ইতিপূর্বেই সংঘটিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আরও অধিক সংখ্যক হয়েছে গৃহহীন। যারা মৃত্যুকে এড়াতে পেরেছে তাঁরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পলায়ন করেছে। 

দ্বিতীয়টির প্রস্তুতি এখন চলছে উন্মত্ত গতিতে। ‘আন্তর্ডোমিনিয়ন যুদ্ধ’, ‘পিতৃভূমি রক্ষা’ ‘অন্যদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক এলাকা’, ‘লোকবিনিময়’ – দ্বিতীয় দফা দাঙ্গার প্রস্তুতি হিসাবে এগুলি এবং অন্যান্য ধ্বনি ওঠানো হচ্ছে। পাকিস্তানের লীগ নেতারা বলছেন যে, ভারতীয় ইউনিয়নেই সমস্ত রকম নৃশংসতা করা হচ্ছে এবং পূর্ব বাঙলায় যে সামান্য কয়েকটি ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে সেগুলি সবই ভারতে মুসলিম নিধনের ‘অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া’। ভারতের কংগ্রেস নেতারা বলছেন যে, হাঙ্গামা পাকিস্তানেই শুরু হয়েছে ও সেখানে হাজার হাজার হিন্দুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং পশ্চিম বাঙলায় যা ঘটেছে সেটা তারই প্রতিক্রিয়া। কংগ্রেস এবং লীগ উভয় সরকারই বলছে যে পরিস্থিতিকে তাঁরা দৃঢ় হস্তে নিয়ন্ত্রিত করছে। উভয়েই জনগণকে বলছে শান্তি বজায় রাখতে এবং সীমান্তের অপর পারে যা ঘটছে তার দ্বারা উত্তেজিত না হতে। কংগ্রেস ও লীগ সংবাদপত্র-মহল এই একই লাইন অনুসরণ করছে। অন্য ডোমিনিয়নের নৃশংসতার সংবাদ এক তরফাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তার পর জনগণকে বলা হচ্ছে উত্তেজিত না হতে। 

একথা ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে, কংগ্রেস লীগ উভয় সরকারই যদি তাঁদের নিজেদের ডোমিনিয়নে শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে বদ্ধপরিকর হয়, উভয়েই যদি দুষ্কৃতিকারীদেরকে দৃঢ় হস্তে দমন করে তাহলে দাঙ্গা অব্যাহত থাকছে কেন এবং সংখ্যালঘিষ্ঠদেরকে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও উত্তেজনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? এর কারণ কি এই যে, পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলা উভয় সরকারেরই রাষ্ট্রীয় যন্ত্র খুব দুর্বল? এর কারণ কি এই যে, পুলিশ ও সামরিক বাহিনী অযোগ্য? কিন্তু পুলিশ ও সামরিক বাহিনী তো যথেষ্ট যোগ্য। 

বন্যার পানি থেকে নিজেদের ঘরকে রক্ষা করার জন্য যখন তাঁরা একজন জমিদারের জমিতে ‘অনধিকার প্রবেশ’ করেছিলো তখন এই একই পুলিশ ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার মাদ্রাসায় ৪০ জন কৃষককে হত্যা করেছিলো। এই একই বৎসরে ঢাকাতে যখন কনস্টেবলরা ধর্মঘট করেছিলো তখন এই একই সামরিক বাহিনী তাঁদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যককে হত্যা করেছিলো।[৫৬] ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস, ও বুলেট দিয়ে ছাত্র ও জনতার মিছিল ভেঙে দেওয়ার জন্য এই একই পুলিশকে বহু ক্ষেত্রে খুব যোগ্যতার সাথেই ব্যবহার করা হয়েছে। শত শত ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষককে এই একই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনব্যবস্থা বিনা বিচারে আটক রেখেছে। বেয়ারাদের প্রতি সমবেদনা দেখাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন ধর্মঘট করেছিলো তখন ‘নিদারুণ শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদেরকে বহিষ্কার করার জন্য এই একই প্রশাসন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিলো। আবার ইনি হচ্ছেন সেই একই বিসি রায় যার পুলিশ একই দিনে কলকাতায় পাঁচজন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করেছে, যার রাজত্বে প্রতিদিনই ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিকদের ওপর লাঠি চালনা, কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ ও গুলি চালনা করা হচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলায় কি সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র ভেঙে পড়ে গেছে? দুই সরকারই কি রাতারাতি রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের (যাকে মেহনতী মানুষের বিরুদ্ধে খুব তৎপর দেখা গেছে) ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে? যে সমস্ত সভা ও মিছিলের মাধ্যমে দাঙ্গাকারীরা জনগণকে উত্তেজিত করে দাঙ্গা শুরু করেছিলো সেগুলি ভেঙে দেওয়ার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলায় কি কোন পুলিশ ছিলো না? বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাঁদের এজেন্ট টাটা, বিড়লা, ইস্পাহানী ও হারুণরা ভারতীয় ও পাকিস্তানী জনগণের ওপর যে নির্লজ্জ শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে তার চরিত্র উন্মোচন করা ও জনগণকে সত্য কথা বলা হচ্ছিলো সে সাহিত্যের মাধ্যমে সেই মার্কসবাদী ও কমিউনিস্ট সাহিত্যের বিক্রেতা ন্যাশনাল বুক এজেন্সীকে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার সরকার খুবই ক্ষিপ্রতার সাথে বন্ধ করে দিয়েছিলো। শ্রমিক, ছাত্র, কৃষক, কেরানী, শিক্ষক ও অপরাপর মেহনতী মানুষের স্বার্থের জন্যে যে সমস্ত প্রগতিশীল সাময়িকী ও পত্রপত্রিকা সংগ্রাম করছিলো প্রচুর সংখ্যক সেই সব পত্রিকা দুই সরকারই বেআইনী ঘোষণা করেছে। কিন্তু পূর্ব বাঙলায় আজাদ ও মর্নিং নিউজ এবং পশ্চিম বাঙলায় হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, অমৃতবাজার পত্রিকা ইত্যাদি তাঁদের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এগুলো বন্ধ করার ক্ষমতা কি সরকার দুটির নেই? শুধু এই প্রশ্নগুলি উত্থাপন করলেই দুই বাঙলার লীগ ও কংগ্রেস শাসকদের ভণ্ডামীর মুখোশ খসে পড়বে। 

কিন্তু এবারই এই প্রথমবার আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত দখল করার পর থেকেই তাঁদের সুপরিকল্পিত নীতি ছিলো হিন্দু মুসলমানদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া। এই নোংরা খেলায় সামন্ত প্রভুরা, দেশীয় রাজারা এবং বড়ো পুঁজিপতিরা সাম্রাজ্যবাদকে সাহায্য করেছিলো। এই নীতির পরিণতি ঘটেছিলো মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদের মধ্যে যা আমাদের জনগণকে দুটি পরস্পর বিরুদ্ধ রাষ্ট্রে বিভক্ত করে নেহরু ও লিয়াকত আলীকে প্রধানমন্ত্রীর গদীতে বসিয়েছিলো যাতে করে জনগণকে বিশ্বাস করানো চলে যে, প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে এবং সেই সাথে ভারত ও পাকিস্তানে বৃটিশ স্বার্থকে পবিত্র এবং অক্ষুণ্ণ রাখাও চলে। 

১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসের পর কোটি কোটি শোষিত মানুষের ক্রোধের হাত থেকে বৃটিশ পুঁজি, শিল্প, খামার, ব্যাংকগুলিকে এবং প্রতিক্রিয়ার জয়গানকারী ও বৃটিশের বহু পুরাতন হুকুমবরদার পাতিয়ালা ও কাশ্মীরের মহারাজা, হায়দ্রাবাদের নিজাম, জুনাগড় ও পতৌদির নবাব, কালাতের খান ও চিত্রলের মীরদের সামন্তবাদী স্বার্থকে রক্ষার দায়িত্ব বর্তেছে নেহরু ও লিয়াকত আলীর ওপর। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণা এই পর্যায়ে এমন ছিলো যে ভারতীয় শ্রমিক, কৃষক ও অপরাপর মেহনতী মানুষকে বৃটিশ কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা সম্ভব হচ্ছিলো না। এ কারণেই বিড়লা ও ইস্পাহানী প্রতিনিধি নেহরু ও লিয়াকত আলীকে এই নির্লজ্জ কাজের জন্যে ঘুষ দেওয়া হয়েছিলো। এই হচ্ছে ‘স্বাধীনতা’ বলে যাকে দেখানো হচ্ছে সেই মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদের স্বরূপ। এ কারণেই সাম্প্রদায়িক সমস্যাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লীগ ও কংগ্রেস নেতারা সেই একই নীতি অনুসরণ করে চলেছেন, যে নীতি এ পর্যন্ত বৃটিশ ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেলদের দ্বারা অনুসৃত হতো। 

জীবনের কোন একটি সমস্যারও সমাধান করতে না পেরে, জনগণকে বুলেট, লাঠি এবং নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ব্যতীত অন্য কিছু দিতে অক্ষম হয়ে কংগ্রেস ও লীগ নেতারা জনগণের ঘৃণার পাত্র হয়েছেন। এই প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক, ছাত্র এবং অপরাপর মেহনতী মানুষের ক্রোধ ফেটে পড়ছে। গত আড়াই বছরের ইতিহাস হচ্ছে কংগ্রেস ও লীগের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের ইতিহাস। ঢাকা ও কলকাতার রাজপথে এখনো পর্যন্ত ‘নুরুল আমীন মন্ত্রীত্ব ধ্বংস হোক’, ‘রায় মন্ত্রীত্ব ধ্বংস হোক’ এই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ২৪ পরগণা, মেদিনীপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার অপরাপর স্থানের কৃষকরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মুক্তির জন্য এক বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু করেছেন। জনগণের আন্দোলনের হাতুড়ীর আঘাতে শোষক এ বিশ্বাসঘাতকদের শাসনের পরিপূর্ণ পতন ঘটতে চলেছে। 

এবং এই ধ্বংসোন্মুখ ঔপনিবেশিক শাসনকে রক্ষা করার জন্যই কংগ্রেস ও লীগ নেতারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এই রক্তাক্ত খেলা শুরু করেছে। যে জনগণকে তাঁরা নির্লজ্জভাবে শোষণ করছে উদ্বাস্তুদের নাম করে তাঁদেরই সহানুভূতি তাঁরা পুনরায় অর্জন করতে চাইছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে লীগ সরকার উদ্বাস্তু সমস্যার মোকাবেলা করছে তার থেকেই জনগণের এই শত্রুদের প্রকৃত চরিত্র উদ্ঘাটিত হচ্ছে। যে সময়ে সীমান্তের অপর পারে নিজেদের সমস্ত কিছু খুইয়ে হাজারে হাজারে উদ্বাস্তুরা পূর্ব বাঙলায় প্রবেশ করছে সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে লীগ নেতারা ইরানের শাহকে নিয়ে রাজকীয় সংবর্ধনা, মদ্যপানের আসর, খানাপিনা ও শিকারে ব্যস্ত ছিলেন।[৫৭] পশ্চিম বাঙলায় শত শত লোককে তাঁদের চাকরী খোয়াতে হয়েছে কিন্তু তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থার পরিবর্তে লীগ সরকার তৎকালীন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ বিভাগকেই উঠিয়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্র খুব দরিদ্র, উদ্বাস্তুদের খাদ্য এবং কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের জন্য পাকিস্তানের কোষাগারে কোন অর্থ নেই, এই অজুহাত দেখিয়ে এই সব করা হচ্ছে। কিন্তু এই একই ‘দরিদ্র রাষ্ট্র’ বর্মী জনগণের মুক্তি সংগ্রাম দমনের উদ্দেশ্যে বর্মা সরকারকে ৫০০০০০ পাউণ্ড (প্রায় এক কোটি টাকা) দিয়েছে। হ্যাঁ বর্মী জনগণের হাতে থেকে বর্মার বৃটিশ তেল কোম্পানীগুলিকে রক্ষার জন্য আমাদের জনগণকে উলঙ্গ এবং শিশুদেরকে উপোস থাকতে হবে— মুসলিম লীগ নেতাদের নীতিই হচ্ছে তাই। যে পর্যন্ত নেহরু ও লিয়াকাত আলী ক্ষমতায় থাকবে, যে পর্যন্ত কমনওয়েলথ মার্কা স্বাধীনতা থাকবে, সে পর্যন্ত উপোস, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস, বুলেট ও জেল; সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, লুটতরাজ, খুন ও ধর্ষণ আমাদের জনগণের ভাগ্যে এই-ই জুটবে। একমাত্র হিন্দু মুসলমান জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই আমাদের দেশকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের আজ্ঞাবাহী এজেন্টদের থেকে মুক্ত করতে পারে এবং আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিভীষিকা থেকে। জনগণ এই সত্য উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। তাঁরা ১৯৪৬-৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন যে, দাঙ্গা তাদের কোন ভালো করতে পারে না। তা কেবল তাদের দুর্দশাকে বাড়িয়েই তোলে। এজন্যেই প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবর্গ এবং তাঁদের সংবাদপত্রসমূহের সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পূর্ব অথবা পশ্চিম বাঙলার কোথাও ব্যাপক জনগণ দাঙ্গায় অংশ গ্রহণ করেননি। মুসলমানরা যেখানে হিন্দুদের জীবন রক্ষা করেছেন এবং হিন্দুরা মুসলমানদের জীবন রক্ষা করেছেন সে রকম উদাহরণ অসংখ্য–যদিও প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্রসমূহ এই দিকটির ব্যাপারে নিশ্চুপ, বিশেষতঃ অন্য ডোমিনিয়নে সাময়িকভাবে প্রতিক্রিয়াশীলরা সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বহুলাংশে সফল হয়েছে। এবং প্রথম দফায় যদিও তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জনগণকে টেনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে তবু তারা নিজেদের হাতিয়ারকে কোনমতেই বর্জন করেনি। সাম্প্রদায়িক হলাহল ক্রমাগত ছড়ানো হচ্ছে এবং তোলা হচ্ছে যুদ্ধের ধ্বনি। ভারতীয় ইউনিয়নে পূর্ব বাঙলা আক্রমণের কথা হচ্ছে এবং করাচীতে জমিয়াত উল উলেমা কাশ্মীরে জেহাদের আহ্বান জানাচ্ছে (অবশ্য তা বৃটিশ কমান্ডার ইন-চীফের পরিচালনায়)। এবং এই সবের দ্বারা সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। 

সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে কারো উদাসীন থাকা উচিত নয়। আমাদের হিন্দু মুসলমান মা বোনদের ইজ্জত নিয়ে কংগ্রেস লীগ নেতারা খেলা করতে চায়। আসলে এর দ্বারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামকেই আক্রমণ করা হচ্ছে। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, কেরানী, শিক্ষক এবং অপরাপর মেহনতী মানুষের সাধারণ জনগণের স্বার্থই আজ বিপন্ন 

কমরেড, ভাই ও বোনেরা, আসুন আমরা পরিস্থিতির মোকাবেলা করি। সাংগঠনিক আনুগত্যের প্রশ্ন বাদ দিয়ে সকল সৎ ও দেশপ্রেমিক ছাত্রকেই সাম্প্রদায়িক শান্তি রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের মধ্যে থেকে লীগ সরকারের এজেন্ট ও জনগণের শত্রু দাঙ্গাকারীদের তাড়িয়ে দিই। উদ্বাস্তু ছাত্রদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসুন আমরা তাদের অল্প খরচে শিক্ষা, পরীক্ষা দানের অধিকার এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য সংগ্রাম করি। আসুন আমরা প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে সর্বস্তরের শান্তিপ্রিয় ও সৎ ছাত্রদের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি কমিটি গঠন করি। আসুন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের এবং তাদের এজেন্ট ও প্রতিপালিত সংবাদপত্রমহলের বিরুদ্ধে সমগ্র ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করি। 

হিন্দু মুসলিম জনগণের ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক। ছাত্র ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ধ্বংস হোক। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন। 

এই ইস্তাহারটি ছাত্র ফেডারেশনের নামে প্রচারিত হলেও এটি যে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টিরই বেনামী প্রচারপত্র সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এর মাধ্যমে জনগণের সামনে দাঙ্গাসহ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে সেটা ছিলো তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টিরই বক্তব্য। সেই হিসেবে বলা চলে যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি কমিটির’ নামে যে ইস্তাহারটি প্রচার করা হয়েছিলো এই ইস্তাহারটি তারই একটি পরিবর্ধিত এবং অধিকতর পূর্ণ সংস্করণ। এতে দাঙ্গার মূল কারণকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে সঠিকভাবেই ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে, পশ্চিম ও পূর্ব বাঙলা সরকারকে দাঙ্গার জন্য একইভাবে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু বক্তব্য সঠিক হলেও তৎকালীন পরিস্থিতিতে এই বক্তব্যের ভিত্তিতে দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার মতো শক্তি কমিউনিস্ট পার্টির ছিলো না। তাঁদের পক্ষে সাধারণ জনসমর্থনও ছিলো খুবই সামান্য। যে ছাত্র ফ্রন্টের মাধ্যমে তখনো পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের বক্তব্য জনগণের সামনে তুলে ধরছিলেন তারও বিশেষ কোন শক্তি তখন ছিলো না। উপরন্তু ঢাকা এবং অন্যান্য অঞ্চলের ছাত্র সাধারণ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার পক্ষপাতী না হলেও তাঁরা তখনো পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ (আওয়ামী মুসলিম লীগ সমর্থক) এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ (মুসলিম লীগ ও সরকার সমর্থক) এই সাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনের প্রভাবাধীন ছিলো। এ জন্যেই ছাত্র ফেডারেশনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্পর্কিত বক্তব্যের বিরোধিতা করে উপরোক্ত ছাত্র সংগঠন দুটি ২রা মার্চের বিশ্ববিদ্যালয় সভায় যৌথভাবে পাল্টা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি কমিটি গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলো। 

শুধু ঢাকাতেই নয়, দাঙ্গা প্রতিরোধ ও শান্তি আন্দোলন পূর্ব বাঙলার অপরাপর অঞ্চলেও এই সময় হয়েছিলো। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ সম্পর্কে সকলে ঐকমত্য না হলেও দাঙ্গার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণ যে এগিয়ে এসেছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। জেলা ও মহকুমা শহর তো বটেই, এমনকি ছোটখাটো শহর, গঞ্জ ও হাটবাজারে পর্যন্ত এই সময় শান্তি মিছিল ও দাঙ্গা প্রতিরোধ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই পরিস্থিতির চাপে পড়ে ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০ পূর্ব বাঙলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ হতে আকরাম খানের সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি শান্তি কমিটি স্থাপন করে।[৫৮] 

সিলেটের সাংবাদিকরা এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সাংবাদিকদের কাছে যুক্তফ্রন্ট স্থাপন করে দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জ্ঞাপন করেন।[৫৯] সাপ্তাহিক নওবেলাল অফিসে সিলেট শান্তি কমিটির অফিস স্থাপিত হয় এবং মুসলিম লীগের সাধারণ কর্মীরা অন্যান্যদের সাথে একত্রে সিলেটে ব্যাপকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয় হন। এই শান্তি আন্দোলনের সময় সিলেটে সরকারী আমলাদের সাথে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীদের ভয়ানক বিরোধ বাধে। সিলেটে শান্তি আন্দোলন যে ব্যাপক আকার নিয়েছিলো তা স্থানীয় আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের মনঃপূত না হওয়ায় তাঁরা এই আন্দোলনকে আঘাত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৪ই মার্চ বিনা পরোয়ানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের বলে নওবেলাল অফিসে অবস্থিত শান্তি কমিটি অফিস খানাতল্লাশী করে অফিস তালাবদ্ধ করে। তার পরদিনই তাঁরা শান্তি কমিটির বিশিষ্ট সদস্য নওবেলালের সম্পাদক ও স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদ আলীকে গ্রেফতার করে।[৬০] 

শান্তি কমিটির অফিস আক্রমণ ও মাহমুদ আলীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৬ই মার্চ সিলেট শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয় এবং সারা শহরে সরকারী দমননীতি বিরোধী পোস্টার পড়ে। সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের ছাত্রেরা ধর্মঘটের পর মিছিল বের করেন এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও তাঁদের সাথে যোগদান করে। বিরাট সংখ্যক অছাত্র জনগণও সেই মিছিলে শরীক হয়ে সরকারী দমননীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন এবং গোবিন্দ পার্কে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ সভা করেন। এই জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য মতসির আলী তার বক্তৃতায় বলেন, কিভাবে আমলাতন্ত্র গণআন্দোলনের গলা টিপে মারার উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করছে এবং শিক্ষা ও বাঁচার দাবীর কণ্ঠরোধ করার চক্রান্ত করছে। এই জুলুমবাজী বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে তিনি ছাত্র ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। ঐ দিনই জনসভার পর মতসির আলীকে গ্রেফতার এবং সিলেটে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। এইভাবে ১৪৪ ধারা জারীর পর ছাত্র জনসাধারণের একাংশ শহরের একটি মসজিদে সভার আয়োজন করেন এবং আমলাতান্ত্রিক দমন নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আওয়াজ তুলে অবিলম্বে মাহমুদ আলী ও মতসির আলীসহ অন্যান্য জনপ্রিয় নেতাদের মুক্তি দাবী করেন। সভায় ডেপুটি কমিশনার নোমানীর স্বেচ্ছাচারিতামূলক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং তাকে অপসারণ করে তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগের দাবী জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। নওবেলাল অফিস তালাবদ্ধ থাকার জন্যে পত্রিকাটির প্রকাশনা ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকে।[৬১] 

সিলেটে স্থানীয় লীগ ও স্থানীয় আমলাতন্ত্রের সংঘর্ষ কত তীব্র আকার এই সময় ধারণ করেছিলো তা মুসলিম লীগ সমর্থক ও মুসলিম লীগ নেতা মাহমুদ আলী পরিচালিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদকীয়টির নিম্নোদ্ধৃত অংশটি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাবে: 

কিন্তু সিলেটের জেলা কর্তৃপক্ষ কিভাবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুত মৌলিক অধিকার হরণ করে নাগরিক নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলেছেন মাত্র অল্প কয়েকদিনের ভিতরে পরপর সংঘটিত ঘটনাবলীই তার চরম সাক্ষ্য। একনিষ্ঠ লীগ কর্মী কাজী মহিবুর রহমানের বিশেষ ক্ষমতা আইনের বলে গ্রেফতার ও প্রায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বন্দী অবস্থায় শোচনীয় মৃত্যু, শান্তি মিশনের উপর পুলিশী হামলা, চেয়ারম্যানের গ্রেফতারের প্রতিবাদ শোভাযাত্রা হতে জনাব মতসির আলীর গ্রেফতার, শহর ও শহরতলীতে ১৪৪ ধারা জারী করে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার ক্ষমতা অপহরণ প্রতিটি ব্যাপারই পাক-নাগরিকের মৌলিক অধিকারের উপর হেনেছে কাঠার আঘাত – তার অধিকারকে করেছে পদদলিত।  

যে সমস্ত আমলা বিনা কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা পাক-নাগরিককে অযথা আটক ইত্যাদি দ্বারা নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলেছে তদন্তক্রমে তাঁদের সম্বন্ধে কঠার ব্যবস্থা অবলম্বন করে নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষায় পাক সরকারের নিকট আমরা দাবী জানাই। দমন নীতির পথে নয়–গণতন্ত্রের পথেই রয়েছে পাক রাষ্ট্রের উজ্জ্বল-গরিমাময় ভবিষ্যৎ।[৬২]

মুসলিম লীগ কর্মী এবং প্রাদেশিক ও নিম্নস্তরের নেতাদের সাথে আমলাতন্ত্রের এই বিরোধই এই পর্যায়ে মুসলিম লীগের মধ্যেকার ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছিলো। মুসলিম লীগের এই ভাঙনের ফলে ছাত্র যুবকেরা বিরাট সংখ্যায় মুসলিম লীগের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছিলেন। এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্যে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্ভব ছিলো একমাত্র মুসলিম লীগের বিরোধিতার মাধ্যমে। আমলাতন্ত্রের সাথে মুসলিম লীগের সাধারণ কর্মী ও নিম্নস্তরের নেতাদের এই ধরনের সংঘর্ষের মাধ্যমেই মুসলিম লীগ সংগঠনের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের থেকে কর্মীরা এবং নিম্নস্তরের নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। আমলাতন্ত্রের উৎপীড়ন প্রাদেশিক নেতারাও নানাভাবে ভোগ করলেও এবং এই সমস্ত নেতারা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেদের বিক্ষোভ কখনো কখনো ব্যক্ত করলেও আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ অথবা তার সক্রিয় বিরোধিতার ক্ষমতা তাঁদের ছিলো না। কারণ বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব বাঙলায় প্রাদেশিক আমলাতন্ত্রই ছিলো কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের প্রকৃত প্রাদেশিক এজেন্ট, প্রাদেশিক সরকার অথবা মুসলিম লীগ নয়। এজন্যেই প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ও প্রাদেশিক সরকারের প্রধানদেরকে মান্য করা অথবা তাঁদের কোন কথা গ্রাহ্য করার প্রয়োজন তাঁদের ছিলো না। নীতি নির্ণয় ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলো মোটামুটিভাবে স্বাধীন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার তাই প্রকৃতপক্ষে ছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট প্রাদেশিক আমলাতন্ত্রের আজ্ঞাবাহী। মুসলিম লীগের সাথে আমলাতন্ত্রের এই সম্পর্কের ফলেই মুসলিম লীগের মধ্যে ভাঙন খুব দ্রুতগতি হয় এবং অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই বিপুল সংখ্যায় মুসলিম লীগ কর্মী ও নিম্নস্তরের মুসলিম লীগ নেতারা পূর্ব বাঙলার সর্বত্র মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে অন্যান্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেন অথবা রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। 

৫. দাঙ্গার পরবর্তী পর্যায় 

১৯৫০ সালে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রয়োজন ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের শোষক ও শাসক শ্রেণীরই ছিলো এবং সেই প্রয়োজন অনুযায়ী দুই দেশের সরকারই নিজ নিজ দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবেই জারী করে। খুলনা জেলার কালশিরা গ্রামে কমিউনিস্ট বিরোধী পুলিশী অভিযানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক কিছু না থাকলেও এবং গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন গ্রামবাসীদের দ্বারা সংঘটিত না হয়ে পুলিশের দ্বারা হলেও ভারত ও পাকিস্তান উভয় সরকারই এই ঘটনাকে সুবিধামতো ব্যবহার করে শুধু পশ্চিম ও পূর্ব বাঙলাতেই নয়, বিহার এবং আসামেও ব্যাপক দাঙ্গার সৃষ্টি করে। ১৯৫০ সালের এই দাঙ্গা যে প্রক্রিয়া অনুসারে সংঘটিত হয়েছিলো তা কোন অংশেই ব্যতিক্রম ছিলো না। দাঙ্গা সর্বক্ষেত্রেই যেভাবে সৃষ্টি হয় ও ব্যাপকতা লাভ করে এ ক্ষেত্রেও ঠিক সেভাবেই তা সৃষ্টি হয়েছিলো এবং ব্যাপকতা লাভ করেছিলো।[৬৩] 

১৯৪৭-৫০ সালের আড়াই বৎসরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সরকার ভারত ও পাকিস্তানে বিশেষতঃ এই দুই দেশের পূর্বাঞ্চলে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলো এবং যেভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছিলো তাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই ছিলো দুই দেশের শাসক শোষক শ্রেণী ও তাঁদের প্রতিনিধি কংগ্রেস ও লীগ সরকারের আত্মরক্ষার সর্বপ্রধান হাতিয়ার। নিজেদের অবাধ শোষণ ও স্বৈরাচারী শাসনকে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষার জন্যে তাঁরা এই হাতিয়ারকে খুবই পরিকল্পিতভাবে ও যোগ্যতার সাথে ব্যবহার করেছিলো। 

পূর্ব বাঙলায় মুসলিম লীগ সরকার এই সময়ে সিলেট, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যে শুধু কৃষক প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছিলো তাই নয়। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শহুরে মধ্যবিত্ত এবং সর্বস্তরের মেহনতী জনগণের মধ্যে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছিলো। এই আন্দোলনের এবং আরও ব্যাপকভাবে তা সংগঠিত হওয়ার সম্ভবনার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ সৃষ্টি করে ও দাঙ্গা বাধিয়ে তাঁদেরকে বিভ্রান্ত, বিভক্ত ও বিপথগামী করার চক্রান্ত করেছিলো এবং তাঁদের এই চক্রান্ত সাময়িকভাবে সফলও হয়েছিলো। 

১৯৫০ সালের মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে বিহার, পশ্চিম বাঙলা এবং আসাম থেকে লক্ষ লক্ষ মোহাজের পূর্ব বাঙলায় উপস্থিত হয়ে পুনর্বাসনের জন্যে পূর্ব বাঙলা সরকারের দ্বারস্থ হলো। এই পরিস্থিতি সরকারকে একটা আর্থিক সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করলেও তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের সুযোগ তাঁরা পুরোপুরি গ্রহণ করলো। এই উদ্দেশ্যে বিহার ও আসাম থেকে আগত বিপুল সংখ্যক মোহাজেরদেরকে তাঁরা সংগ্রামী পাহাড় সীমান্ত এলাকাতে সমাবেশ করলো এবং আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষকদেরকে উচ্ছেদ করে তাঁদের স্থানে মোহাজের পুনর্বাসনের এক চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করলো। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা আদিবাসী কৃষকদেরকে তাঁদের ভিটাবাড়ী ও জমিজমা থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করতে শুরু করলো। সীমান্তের প্রায় একশো মাইল দৈর্ঘ্য ও চার পাঁচ মাইল প্রস্থ এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও সামরিক বাহিনী মোতায়েন করলো। প্রথমে তাঁরা সুসং-দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা থানার উত্তর সীমান্তের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে স্থানীয় আদিবাসী কৃষকদেরকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে সেখানে বিহারী মোহাজেরদেরকে বসিয়ে দিলো। এর পর হালুয়াঘাট, নলিতাবাড়ী ও শ্রীবর্দি থানার গ্রামে গ্রামে ঐ একইভাবে স্থানীয় কৃষকদের ঘরবাড়ী ও জমিজমা পুলিশ মিলিটারীর সাহায্যে দখল করে সরকার আসামী মোহাজেরদের ‘পুনর্বাসন’ করলো। এই এলাকায় কৃষক উচ্ছেদের জন্যে তাঁরা বন্দুক ও রাইফেল সজ্জিত অসংখ্য পুলিশ ও মিলিটারী এবং জীপ, ঘোড়া ও আট দশটি হাতী পর্যন্ত নামিয়েছিলো। এইভাবে পূর্বে পাঁচগাঁও, খারটন, চৈতন্যনগর ও লেঙ্গুরা থেকে পশ্চিমে রামরামপুর কর্ণঝোরার মধ্যে জিগাতলা, ভেদীকুড়া, মাইজপাড়া, ঘোষগাঁও, গাজীর ভিটা, হালুয়াঘাট, ভুবনকুড়া, যুগলী, কাকড়কান্দি, মণ্ডলীয়াপাড়া, মালপাড়া, বনকুড়া, ঝিনাইগাতী, নল্লি প্রভৃতি ইউনিয়নের প্রায় দেড়শো গ্রাম থেকে আদিবাসী কৃষকদেরকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করা হলো।[৬৪] এইভাবে বিহার ও আসামের মুসলমান উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের নাম করে পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগ সরকার ময়মনসিংহের আদিবাসী অঞ্চলের অগণিত কৃষককে উচ্ছেদ করে, তাঁদেরকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করে, আসামে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলো। এই হলো মুসলিম লীগ সরকারের এবং তাঁদের মোহাজের পুনর্বাসনের স্বরূপ। নারীপুরুষ শিশু নির্বিশেষে আদিবাসীদেরকে তাঁদের ঘরবাড়ী থেকে জোরপূর্বক টেনে বের করে পুলিশ তাঁদেরকে পথে ভাসিয়ে দিলো। এইভাবে কৃষক উচ্ছেদ করতে গিয়ে এই সমস্ত অঞ্চলের শত শত যুবক ও মোড়লদেরকে বেপরোয়াভাবে মারপিট করে নির্বিচারে জেলে নিক্ষেপ করা হলো। হাজতে ও ময়মনসিংহ জেলে অমানুষিক নির্যাতন এবং খাদ্যকষ্টে পঁচিশ জন আদিবাসীর মৃত্যু ঘটলো এবং প্রায় শতাধিক সংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা নানা ধরনের কঠিন ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। এইভাবে সমগ্র অঞ্চলে এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি হলো যে, পুলিশ সরাসরি যাদেরকে উচ্ছেদ করলো না তাঁরাও প্রাণভয়ে ভীত হয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হলো।[৬৫] 

সরকার এইভাবে আদিবাসী ও হিন্দু কৃষক উচ্ছেদ শুরু করার পর স্থানীয় সংগ্রামী কৃষকরা তার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। তাঁরা পাহাড় অঞ্চলের জমিদারী ও টঙ্কবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস মোহাজেরদের কাছে বর্ণনা করেন এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে তাঁদের মধ্যে সভা সমিতি ও ইস্তাহার বিলি করেন। স্থানীয় কৃষকদের জমি, ঘরবাড়ী এবং অস্থাবর সম্পত্তি জবর দখল না করে জমিদারীর খাস পতিত দখল ও খামার জমিতে বসার জন্যে তাঁরা মোহাজেরদের কাছে আবেদন জানান। এ ব্যাপারে তখন বিহারী মোহাজেরদের মধ্যে সাড়া পাওয়া না গেলেও অসমীয়া মোহাজেরদের থেকে কিছু কিছু সাড়া তাঁরা পান। এর ফলে হালুয়াঘাট ও নলিতাবাড়ী থানার কোন কোন এলাকায় জমিদারদের জমি ও খামার জমি তাঁরা দখল করেন। এই পরিস্থিতি সরকারের নজরে পড়ে এবং তাঁরা তখন কিছু সংখ্যক মোহাজেরকে গ্রেফতার করে এবং কিছু সংখ্যককে সেখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র চালান দেয়। এইভাবে মোহাজেরদের মধ্যে যে আন্দোলনের ক্ষীণতম সূত্রপাত হয়েছিলো তাকে 

পূর্ব বাঙলা সরকার প্রাথমিক স্তরেই দমন করে এবং অনগ্রসর অচেতন ও নিরাপত্তাপ্রার্থী কৃষকদেরকে সংগ্রামী কৃষকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সমগ্র এলাকায় নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে।[৬৬] এইভাবে পূর্ব বাঙলার সীমান্তবর্তী পাহাড় অঞ্চলে প্রধানতঃ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাতে বহু বছর ধরে স্থানীয় কৃষকদেরকে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার বহু প্রচেষ্টা বৃটিশ আমল থেকে বিফল হলেও উদ্বাস্তু কৃষকদের সাহায্যে ও মোহাজের পুনর্বাসন ইত্যাদি ভাঁওতা দিয়ে মুসলিম লীগ সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এই সংগ্রামী কৃষক জনগণকে পূর্ব বাঙলার মাটি থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করতে শেষ পর্যন্ত কৃতকার্য হলো। 

শুধু ময়মনসিংহের পাহাড় অঞ্চলেই নয়। নাচোলের সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলেও পূর্ব বাঙলা সরকার ঐ একই নীতি গ্রহণ করলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে যে অগণিত উদ্বাস্তু পূর্ব বাঙলার উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করে তাঁদের পুনর্বাসনের অজুহাতে সরকার সাঁওতাল কৃষকদের জমিজমা ও বাড়ীঘর দখল করে তাঁদেরকে উচ্ছেদ করলো। সাঁওতালরাও ময়মনসিংহের পাহাড় অঞ্চলের আদিবাসীদের মতো পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। 

কিন্তু কৃষক আন্দোলনের এলাকাগুলি প্রধানতঃ আদিবাসী, সাঁওতাল, নমঃশূদ্র প্রভৃতি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এলাকা হওয়ার ফলে সরকারের যে সুবিধা হয়েছিলো পূর্ব বাঙলার অপরাপর অঞ্চলে সে সুবিধা তাঁদের হয়নি। মধ্যশ্রেণীর রাজনীতি ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ সরকারের সর্বমুখী নির্যাতন সারা পূর্ব বাঙলার জনগণকে দেশভাগের মাত্র আড়াই বৎসরের মধ্যেই গ্রাস করেছিলো এবং জনগণ খুব সংগঠিত প্রতিরোধে সমর্থ না হলেও সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যাপকভাবে আস্থা হারাতে শুরু করেছিলেন। সরকারও তাঁদের জুলুমের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিরোধকেও নির্বিচারে সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রদান করে আন্দোলনকারীদের ইসলাম ও পাকিস্তানবিরোধী বলে অহরহ আখ্যায়িত করছিলো। এজন্যে রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতা মুক্তি সে সময়ে মধ্যশ্রেণীর মধ্যে বেশ কিছুটা অর্জিত হয়েছিলো এবং সরকারের অহর্নিশি সাম্প্রদায়িক প্রচারণার সঠিক চরিত্র উপলব্ধি করতে তাঁরা অনেকাংশে সক্ষম হচ্ছিলেন। এর ফলে দেখা যায় যে, ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর কৃষক আন্দোলন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে বস্তুতঃপক্ষে এক যুগ ধরে স্তিমিত অবস্থায় থাকলেও সেই পর্যায়ে মধ্যশ্রেণীর নানান আন্দোলন ক্রমশঃ শক্তি সঞ্চয় করে মুসলিম লীগ সরকারকে উচ্ছেদের পথে দ্রুত অগ্রগতি সাধন করে। 

তথ্যসূত্র 

১ EBL Assemly Proceedings, 10th March, 1950, Vol. IV, No. ৪, P, 1৪3

২ এই অঞ্চলে সে সময় প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় সে রকম কিছু না ঘটার ফলে দাঙ্গার কোন সংবাদ পূর্ব বাঙলা অথবা ভারতের কোন পত্রিকায় প্রায় এক মাস পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। দুই দেশের মধ্যে কোন দেশের কোন সাম্প্রদায়িক নেতারাও তাঁদের অসংখ্য সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা বিবৃতিতে এর কোন উল্লেখ করেননি। এর মূল কারণ এই সংঘর্ষ ছিলো পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযান ও নির্যাতনেরই একটি ঘটনামাত্র। এদিক দিয়ে কালশিরার ঘটনার কোন বিশেষত্ব ছিলো না। বস্তুতঃপক্ষে এই ধরনের কমিউনিস্ট বিরোধী সরকারী অভিযানের সময় সিলেট জেলার সানেশ্বরে ১৯৪৯ সালের অগাস্ট মাসের ঘটনার সময় তুলনায় অনেক বেশী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি আরও অনেক ব্যাপক এলাকায় হয়েছিলো, যদিও সেখানেও কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি। 

৩ দৈনিক আজাদ, ৩১/১২/১৯৪৯। 

৪ এ সম্পর্কে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসের যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা ইত্যাদি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। 

৫ EBA Proceedings, 10th March, 1950, Vol. IV. No. ৪, দৈনিক আজাদ, ৩/১/৫০; নওবেলাল ১২/১/৫০। 

৬ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫০ সালের জানুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পশ্চিম বাঙলার পত্রপত্রিকা দ্রষ্টব্য। 

৭ ১৯৪৯ সালে ডিসেম্বরের শেষার্ধের পত্রিকা দ্রষ্টব্য। 

৮ দৈনিক আজাদ ও Mornings News বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। 

৯ দৈনিক আজাদ, ৪/১/১৯৫০। 

১০ পূর্বোক্ত। 

১১ যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬/১/১৯৫০। 

১২ দৈনিক আজাদ, ১৫/১/১৯৫০। 

১৪ যুগান্তর আনন্দবাজার পত্রিকা; ১৬/১/১৯৫০। 

১৫ EBL Assemly Proceedings, 10th March, 1950, Vol. IV. No. ৪, P. 1৪4.

১৬ ১৯৫০ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে ১০ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আজাদ, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকা দ্রষ্টব্য। 

১৭ নওবেলাল, ৩০/১১/১৯৫০, পৃ ৭। 

১৮ EBL Assembly Proceedings, 7th February, 1950, Vol. IV. No. 6, P. 46

১৯ নওবেলাল, ৯/২/১৯৫০, পৃ ৫। 

২০ EBL Assembly Proceedings, Vol. IV. No. ৪, P. 1৪4. 

২১ অর্থাৎ নাচোল।-ব.উ. 

২২ দৈনিক আজাদ, ৪/২/১৯৫০। 

২৩ EBL Assembly Proceedings, Vol. IV. No. ৪, P. 1৪4. 

২৪ যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭/২/১৯৫০। 

২৫ EBL Assembly Proceedings, Vol. IV. No. ৪, P. 1৪5. 

২৬ EBL Assembly Proceedings, 6th Feb, 1950, Vol. IV. No. 6, P. 20-21. 

২৭ পূর্বোক্ত, পৃ ২১। 

২৮ পূর্বোক্ত, পৃ ২১-২২। 

২৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭-৪১। 

৩০ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৩-৪৭। 

৩১ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৭। 

৩২ যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯/২/১৯৫০। 

৩৩ পূর্বোক্ত, ১০/২/১৯৫০। 

৩৪ দৈনিকা আজাদ, ১২/২/১৯৫০। 

৩৫ ১৯৫০ সালে পশ্চিম ও পূর্ব বাঙলায় দাঙ্গা পরিস্থিতির ক্রমবিকাশ ও দাঙ্গার ঘটনাবলী সম্পর্কিত বিস্তারিত রিপোর্টের জন্য দ্রষ্টব্য : ইংল্যান্ডের Manchester Guardian ও Economist- এর প্রতিনিধি Taya Zinkin এর Reporting India’ (Chatto and Windus)-ব.উ.

৩৬ এই বিশেষ নোটটি ১০-০২-৫০ তারিখের নীচে শুরু হলেও পরবর্তী দুই দিনের অর্থাৎ ১১- ০২-৫০ ও ১২.২-৫০ এর নীচে পর্যন্ত অর্থাৎ পর পর তিন দিনের রোজনামচার নীচে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর থেকে মনে হয় এটি ১২-২-৫০ তারিখে লেখা। নোটটির শেষ প্যারার বক্তব্য থেকেও তাই মনে হয়।-ব.উ.। 

৩৭ EBLA Proceedings, vol. IV, No. ৪, P, 1৪6-1৪7. 

৩৯ পিয়ের ডিলানীর পূর্বপুরুষরা নেপোলিয়ানের সময় কুমিল্লায় জমিদারী ক্রয় করে বসতি স্থাপন করেন। শিক্ষা এবং বিবাহের জন্য তারা বরাবর ফ্রান্সে গেলেও প্রায় দেড়শত বৎসর তাঁরা কুমিল্লারই অধিবাসী (Reporting India. p 45 ) . 

৩৯ Taya Zinking, Reporting India, Chatto and Windus. 

৪০ যুগান্তর, আনন্দবাজার, Hindustan Standard, Amrito Bazar Patrika : ২৪/২/১৯৫০ 

৪৩ EBLA Proceedings, Vol. IV. No. ৪, P. 1৪9. 

৪২ দৈনিক আজাদ ১.৩.৫০; নওবেলাল ২/৩/১৯৫০। 

৪৩ EBLA Proceedings, Vol. IV, No. ৪, P, 1৪9. 

৪৪ পূর্বোক্ত। 

৪৫ আমলাতন্ত্র ও মন্ত্রীদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ের এই বইয়ের অন্যত্র আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। — ব.উ.। 

৪৬ Taya Zinkin – Reporting India, Chatto and Windus P, 40. 

৪৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৪১। 

৪৮ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৭। 

৪৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৩। 

৫০ পূর্বোক্ত, পৃ ৫৩। 

৫১ তায়া জিনকিনের স্বামী মরিস জিনকিন আইসিএস ছিলেন বৃটিশ-ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এই সূত্রেই আজিজ আহমদের সাথে জিনকিনদের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পূর্বেই ছিলো। – ব.উ. 

৫২ পূর্বোক্ত, পৃ ৫৪-৫৫। 

৫৩ তাজউদ্দীন ডায়েরী, ১১/২/৫০। 

৫৪ পূর্বোক্ত, ১২/২/৫০। 

৫৫ এই ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের’ নেতারাই ১৯৪৯ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে হাজং কৃষকদের ওপর সরকারী পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র ফেডারেশন (কর্তৃক) আহূত সভায় আহ্বায়কদেরকে মারপিট করে ও গুণ্ডামীর মাধ্যমে সভা পণ্ড করে। তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। 

৫৬ তাজউদ্দীনের ডায়েরী, ২/৩/৫০। 

৫৭ এই সংখ্যা আসলে ছিলো দশ, চল্লিশ নয়। – ব.উ.। 

৫৮ ইরানের শাহ রেজা শাহ পহলবী ৫ই মার্চ, ১৯৫০, তারিখে – ঢাকা পৌঁছানোর পর ৬ই মার্চ শিকারের উদ্দেশ্যে গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সিলেটের পৃথীমপাশায় গিয়ে জমিদার আলী হায়দার খানের অতিথি হিসেবে অবস্থান করেন এবং তাঁর জমিদারী অঞ্চলেই বাঘ শিকার করতে যান (নওবেলাল, ৯.৩.৫০)। ইস্তাহারটিতে তারিখের কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু ইরানের শাহের বাঘ শিকারের এই উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে, এটি তাঁর পরবর্তী সময়ে প্রচারিত হয়। – ব.উ.। 

৫৯ নওবেলাল, ৯/৩/১৯৫০। ৬০ পূর্বোক্ত। 

৬১ নওবেলাল, ৬/৪/১৯৫০। 

৬২ পূর্বোক্ত। 

৬৩ পূর্বোক্ত। 

৬৪ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রক্রিয়া সম্পর্কে দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর-এর সাম্প্রদায়িকতা নামক বইয়ের ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ শীৰ্ষক প্ৰবন্ধ। 

৬৫ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১৩৯। 

৬৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪০ 

৬৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪০-১৪১। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *