চতুর্থ পরিচ্ছেদ – পলাশীর ষড়যন্ত্র
“দাঁড়ারে! দাঁড়া রে ফিরে! দাঁড়া রে যবন
দাঁড়াও ক্ষত্রিয়গণ!
যদি ভঙ্গ দেও রণ”—
গর্জ্জিলা মোহনলাল—‘‘নিকট-শমন!
আজি এই রণে যদি কর পলায়ন,
মনেতে জানিও স্থির,
কারো না থাকিবে শির,
সবান্ধবে যাবে সবে শমন-ভবন।
ভারতে পাবি না স্থান করিতে বিশ্রাম;
নবাবের মাথা খেয়ে
কেমনে আসিলি ধেয়ে
মরিবি, মরিবি ওরে যবন সন্তান।”
নবীনচন্দ্র সেন, পলাশীর
যুদ্ধ (১৮৭৫)
‘আবদালি আসছে! আবদালি আসছে!’ মঁসিয় ল’ মুর্শিদাবাদ থেকে পাটনা রওনা হওয়ার ঠিক আগেই পাটনায় পাঠান আগমন বার্তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। তখন বর্ষা সমাগত প্রায়। দিল্লী থেকে পাটনার শাহী সড়ক বেয়ে আহমদ শাহ আবদালি আগ্রায় নেমে এসেছেন। সকল পাটনাবাসীর মনে প্রশ্ন—বর্ষা আগে আসবে না আবদালি? বিহারের নায়েব রামনারায়ণকে নাকাল করতে ঠিক এই সময় পাটনার দক্ষিণে নরহত-সিমাই অঞ্চলের লড়াকু জমিদার কামগর খান বিদ্রোহ করে বসলেন। কোন্ দিক ফেলে রামনারায়ণ কোন্ দিক সামলান? প্রভু সিরাজউদ্দৌলাহ্র কাছে তিনি সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। সিরাজের তখন শিরে সংক্রান্তি। চন্দননগর বিজেতা ক্লাইভ নবাবকে মঁসিয় ল’ এবং অন্যান্য পলাতক ফরাসীদের আশ্রয় দেবার জন্য নানা হুমকি দিচ্ছেন আর ভয় দেখাচ্ছেন তাদের ধরবার জন্য কাশিমবাজারে এখনি ফৌজ পাঠাবেন। মুর্শিদাবাদে রাজদূত বেশে জাঁকিয়ে বসে কালকের কুঠিয়াল ওয়াট্স্ বজ্রমুষ্টিতে ‘ক্ষতিপূরণের’ পাই পয়সা আদায় করছেন। দরবারে তাঁর এমন প্রতিপত্তি যে হুগলীতে নন্দকুমার তাঁর মুখ চেয়ে আশায় আশায় বসে আছেন কবে জুবদাৎ-উজ্-জুজার (ওয়াট্সের নতুন দরবারী খেতাব) প্রসাদে স্থায়ীভাবে ফৌজদার হবেন। কিন্তু তিনি দরবার ছেড়ে গেলেই নবাব নিতান্ত অর্বাচীনের মতো জনা পাঁচ ছয় লোকের সামনে—জগৎশেঠ, মানিকচাঁদ, খোজা ওয়াজিদ, মীর আবদুল কাশিম, রণজিৎ রায় এবং আমীরচন্দকে শুনিয়ে শুনিয়ে-দাঁত কড়মড় করে বলতে থাকেন—‘সবুর কর, তোমার গান আমি নিয়ে ছাড়ছি।’ বলা বাহুল্য, এই সুমধুর সংবাদ ওয়াট্সের কানে যেতে বিলম্ব হয় না। কিন্তু নবাব এখন কি করেন? পাটনা থেকে হরকরা এইমাত্র তাজা খবর এনেছে যে বানারসের লোকেরা আবদালির ভয়ে পাটনা পালাচ্ছে। আর পাটনার লোকেরা মুর্শিদাবাদ পালানোর জন্য নৌকা যোগাড় করছে। এদিকে নরহত –সিমাইয়ের বজ্জাত জমিদারটা নায়েব রামনারায়ণকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে—তাঁকে সাহায্য না পাঠালেই নয়। সব ভেবে চিন্তে নবাব ‘মঁসিয় ল’কে টাকা সুদ্ধ পাটনা রওনা করিয়ে দিলেন। ইংরেজদের কানে খবর পৌঁছল মঁসিয় ল’ নবাবী মাইনেতে আপাতত কামগর খানকে শায়েস্তা করতে রামনারায়ণের কাছে যাচ্ছেন। নবাবী মাইনের ব্যাপারটা সত্য কিনা জানতে ওয়াট্স জগৎশেঠের কাছে গেলেন। জগৎশেঠ ইংরাজদের মিত্র বটে কিন্তু তিনি ফরাসীদেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু—খবরটা সত্য হলেও জগৎশেঠ সেটা স্রেফ অস্বীকার করলেন।
যাবার আগে মঁসিয় ল’ নবাবকে বলে গিয়েছিলেন—দরবারে নানা ষড়যন্ত্র চলছে, নবাব যেন সাবধানে থাকেন। সিরাজ কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেও মনে মনে বিলক্ষণ জানতেন যে এ খবর সত্যি না হয়ে যায় না। ষড়যন্ত্র যে শুরু হয়ে গিয়েছিল ল’র চোখে তার একটা লক্ষণ মোহনলালকে অজ্ঞাত আততায়ী কর্তৃক বিষপ্রয়োগ। বস্তুতপক্ষে বড়ো বড়ো ওমরাওদের মধ্যে একমাত্র মোহনলালই সিরাজের বিশ্বস্ত আর অনুগত লোক ছিলেন। এ সম্বন্ধে ল’ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘সিরাজউদ্দৌলার প্রধান দেওয়ান মোহনলালের মতো পাজী লোক আর দুনিয়ায় জন্মায়নি (Le plus grand coquin que la terre ait jumais porte)। যেমন নবাব, তেমন মন্ত্রী! কিন্তু সত্যি বলতে কি, সেই একমাত্র লোক যে তাঁর সত্যিকারের অনুগত ছিল। লোকটার দৃঢ়তা ছিল আর এই বিচারবুদ্ধি ছিল যে সিরাজউদ্দৌলাহ্র সর্বনাশ হলে সেও নষ্ট হবে। লোকে তার মনিবকে যতটা ঘৃণা করত তাকেও ততটাই ঘৃণা করত। লোকটা ছিল শেঠদের জাতশত্রু, তাঁদের বাধা দেবার যোগ্যতা তার ছিল। আমার ধারণা, সে সুস্থ সমর্থ থাকলে এই সাহুকররা এত সহজে তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে পারতেন না। আমাদের দুর্ভাগ্যবশত এই চরম মুহূর্তে সে বেশ কিছু দিন ধরে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারত না। সিরাজউদ্দৌলাহ্র সঙ্গে আমি তাকে দুবার দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তার মুখ থেকে তখন একটা কথাও বের করা সম্ভব নয়। দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ আছে যে তাকে বিষ দেওয়া হয়েছিল। ফলে৩ সিরাজউদ্দৌলাহ্ তাঁর একমাত্র সহায় থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।’
সিরাজউদ্দৌলাহ্র আর একজন বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন মীরমদন, কিন্তু মোহনলালের মতো তিনি উচ্চপদস্থ প্রতিপত্তিশালী আমীর ছিলেন না। আলিবর্দি খানের আমলে তিনি হোসেন কুলী খানের অধীনে ঢাকার নিয়াবতে কাজ করতেন। তাঁর বংশ নীচু ছিল—শোনা যায় তিনি নাকি ধর্মান্তরিত হিন্দু। সিরাজউদ্দৌলাহ্ নবাব হয়ে তাঁকে জরুরী তলব করে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে আনিয়ে নেন। সিয়ার-উল-মুতাখ্খিরীন্ অনুযায়ী গহসেটি বেগম সিরাজের হাতে বন্দী হবার অব্যবহিত পরেই ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে এই ঘটনা ঘটে এবং ঐ সময়ে মীর জাফরকে বকশী পদ থেকে বরখাস্ত করে নতুন নবাব মীরমদনকে বকশী বা প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু শেষের তথ্যটি ভুল। মীর জাফর বকশী পদেই ছিলেন এবং মঁসিয় ল’ পাটনা রওনা হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত তাঁকে সেনাপতি রূপেই দেখে গিয়েছিলেন। মীর জাফরের পদচ্যুতি পরবর্তী সময়ের ঘটনা—আমরা দেখব ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে তা ঘটেছিল। গহসেটি বেগম বন্দী হবার পরে মসনদে নবারূঢ় নবাব দরবারে যে সব অদল বদল করেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ মোহনলালের দেওয়ান সুবাহ্ পদ লাভ। একই সঙ্গে মীরমদনকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসে নতুন নবাব তাঁকে তোপখানার দারোগাহ্ নিযুক্ত করেন। ৪ এবং তাঁর হাতে নিজের খাস রিসালার ভার দেন।৫ সমগ্র সেনাবাহিনীর ভার মীরমদনের উপর কখনোই ছিল না—থাকলে সিরাজ হয়তো রক্ষা পেতে পারতেন। বিশ্বস্ত হলেও দরবারে মীরমদনের এত প্রতিপত্তি ছিল না যে মোহনলালের অসুস্থ থাকাকালীন তিনি রাজকার্য পরিচালনায় নবাবের সহায় হয়ে ষড়যন্ত্রের অগ্রগতি রোধ করতে পারেন। মোহনলাল অসুস্থ থাকায় এবং মীরমদনের হাতে সেনাপতিত্ব না থাকায় ইংরেজরা নবাবের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফরাসীদের চন্দননগর থেকে উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়।
রায় দুর্ল্লভ ঐ সময় ফরাসীদের মিত্র ছিলেন—অন্তত মঁসিয় ল’ তাই মনে করতেন। তাঁকে নবাব ফরাসীদের সাহায্য করতে ফরাসডাঙায় গিয়ে যুদ্ধ করতে হুকুম দিয়েছিলেন। কিন্তু আলিনগরের উপকণ্ঠে কুয়াশার মধ্যে আক্রান্ত হয়ে রায় দুর্ল্লভ ইংরেজদের সম্বন্ধে এতই ভীত হয়েছিলেন যে তিনি এক পাও এগোতে ইচ্ছুক ছিলেন না। সত্যি বলতে কি তাঁর উপর মঁসিয় ল’র কোনো আস্থা ছিল না। তাই তিনি নবাবকে বলেছিলেন, রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে মীরমদনকেও পাঠানো হোক—কারণ মীরমদন একজন উপযুক্ত সেনানী যিনি সাহসের সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবেন। নবাব সেই হুকুমও দিয়েছিলেন,৬ কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরবারের কলকাঠির আবর্তনে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। হুগলীতে বসে নন্দকুমার দেখছিলেন যাতে ফরাসডাঙায় ঠিক সময় নবাবী ফৌজ না পৌঁছোয়; আর জগৎশেঠ ফরাসীদের মিত্র হলেও এটা চাইছিলেন না যে ফরাসীদের সঙ্গে নবাবী ফৌজ এককাট্টা হয়ে গিয়ে সিরাজের নবাবী কায়েমী করে তুলুক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে ইংরেজরা চন্দননগর চড়াও হবার সময় মীর জাফরের মাথায় সুবাহ্দার হবার পরিকল্পনা ঢোকেনি। মঁসিয় ল’ তাঁর কাছেও সাহায্য ভিক্ষা করতে গিয়েছিলেন, এবং মীর জাফর তাঁর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন, এমন কি সাহায্য করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।৭ অবশ্য ল’ এমন আশা রাখতেন না যে সত্যি সত্যি মীর জাফর ফরাসীদের হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বেন, কারণ তিনি দরবারে ইংরেজদের বিরুদ্ধ পক্ষ থেকে দূরে থাকতেন। কিন্তু ল’র বর্ণনা পড়ে বোঝা যায়, তখনো ইংরেজদের সঙ্গে মীর জাফরের গুপ্ত যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। সে ঘটনা ঘটে ল’ বিদায় হবার পরে।
জাঁ ল’র কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ থাকাকালীন দরবারে দলাদলির চেহারাটা ধরতে পারলে তাঁর বিদায়ের পর চক্রান্তের ক্রমবিকাশ আরো ভালো করে অনুধাবন করা যাবে। ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য ইংরেজদের রাজদূত হয়ে মুর্শিদাবাদে এসেই ওয়াট্সের ধারণা হল, তাঁর প্রতিপক্ষ ল’ টাকা দিয়ে দরবারে অনেক লোককে হাত করেছেন। তখন তিনিও সেই খেলায় নামলেন। ইংরেজ ও ফরাসি দু পক্ষই টাকা দিয়ে দরবারে নিজ নিজ দল ভারী করতে লাগল। কিন্তু ইংরেজদের টাকার জোর অনেক বেশি। এ খেলায় ওয়াট্সের সঙ্গে ল’ কায়দা করে উঠতে পারলেন না। এই সময় ঢাকার ইংরেজ কুঠির সাহেব লিউক স্ক্র্যাফটন নবাবী ফৌজ কর্তৃক ঢাকা কুঠী লুঠের ক্ষতিপূরণের হিসেব নিকাশ বুঝে নিতে মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছে দেখলেন, দরবারে যে সব লোককে ল’ টাকা দিয়ে বশ করবার চেষ্টায় ছিলেন, তারা আস্তে আস্তে আরো বেশি টাকার লোভে ইংরেজদের দিকে চলে আসছে, আর তাদের কাছ থেকে ওয়াট্স্ গোপনীয় খবরাখবর সব সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। ৯ স্ক্র্যাফটনের উপর ক্লাইভের গোপন নির্দেশ ছিল, দরবারের চেহারাটা অনুধাবন করে ইংরেজদের পক্ষাবলম্বী কোনো সরকার গঠন করা সম্ভব কি না যাচাই করে দেখতে। স্ক্র্যাফটন গোপনে তাঁর উপরওয়ালা ওয়াল্শ্ সাহেবের কাছে দরবারের খবর দিয়ে চিঠি দিতেন এবং ওয়ালশের হাত থেকে ক্লাইভের হাতে সেই চিঠি পৌঁছত। ওয়াট্স্ ও স্ক্র্যাফটন দুজনে মুর্শিদাবাদে থাকায় আমীরচন্দ ও খোজা পেত্রসের দূতিয়ালির মারফতে দরবারের ওমরাওদের সঙ্গে ইংরেজদের চক্র গড়ে তুলবার সুযোগ হল। ল’র নিজের বর্ণনা অনুযায়ী, দরবারে ফরাসী পক্ষ অবলম্বন করার জন্য ছিলেন একমাত্র অস্থিতমতি নবাব নিজে, তাঁর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত শয্যাশায়ী দেওয়ান মোহনলাল, একান্ত ভীরু সওদাগর খোজা ওয়াজিদ এবং হামবড়া নিজামত দেওয়ান রাজা দুর্ল্লভরাম যিনি জগৎশেঠদের ভারি অপছন্দ করতেন। ল’ নিজেই স্বীকার করেছেন, শেষপর্যন্ত খোজা ওয়াজিদ ও রায় দুর্ল্লভের কাছ থেকে তিনি কোনোও সত্যিকারের সাহায্য পাননি। ১০ অপরপক্ষে তাঁর বর্ণনানুযায়ী ইংরেজদের হয়ে দরবারে কলকাঠি নাড়তেন জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়, মীর জাফর আলি খান, খোদাদাদ খান লেতি (খুদা ইয়ার লতিফ খান), নবাবী ফৌজের অন্যান্য প্রধান প্রধান সেনাপতি যাঁরা ইংরেজদের নজরানা ও জগৎশেঠের অর্থশক্তির বশ ছিলেন। পুরনো দরবারের যে সব মন্ত্রীদের সিরাজউদ্দৌলাহ্ অপমানিত করেছিলেন তাঁদের সকলে এবং সমস্ত মুন্সী, কেরানি এমন কি হারেমের খোজারাও ল’র মতে ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিল।১১
ল’ বিদায় হওয়ার পরেই দরবারে ইংরেজদের দলটা অপ্রতিহত হয়ে উঠল এবং দলাদলির চেহারাও পাল্টে গেল। যাবার আগে ল’ ইংরেজ এবং জগৎ শেঠদের জল্পনাকল্পনায় যে প্রধান সমস্যা লক্ষ্য করে গিয়েছিলেন তা হল এমন একজন উপযুক্ত আমীর খুঁজে বের করা যাঁকে সবাই মানবে এবং যিনি সিরাজের বিকল্প নবাব হতে পারবেন। শওকৎ জঙ্গ মারা যাবার পর বেশ কিছুদিন ধরে কটকের নবাব নামে পরিচিত মারাঠাদের আশ্রিত ওড়িশার নায়েব নাজিম মীর্জা সালেহ্র নাম শোনা যাচ্ছিল—তিনি না কি মারাঠাদের সহায়তায় মুর্শিদাবাদ আসছেন। ১২ তা ছাড়া শওকৎ জঙ্গের একজন ছেলে এবং ভূতপূর্ব নিহত নবাব সরফরাজ খানের পাঁচ ছেলে নিয়েও মুর্শিদাবাদে জল্পনা কল্পনা চলছিল—তাতে সিরাজ এতই ভয় পেয়েছিলেন যে ল’ বিদায় হবার পূর্ব মুহূর্তে তিনি ঢাকা থেকে দুশো বক্সরী ও পিয়নের পাহারায় আগা বাবু, আমীনী খান, মীর্জা মোগল, শুকুরুল্লাহ্ খান এবং সরফরাজ খানের কনিষ্ঠ শিশু পুত্র—এই পাঁচ ভাইকে নৌকোয় চাপিয়ে মুর্শিদাবাদ আনতে হুকুম দেন। ১৩ সর্বশেষে ল’ শেঠদের টাকায় পুষ্ট দোহাজারী মনসবদার খুদা ইয়ার লতিফ খানের সম্বন্ধে কানাঘুষা শুনে পাটনা রওনা দেন১৪ । এঁদের কেউই ঠিক উপযুক্ত পাত্র ছিলেন না—যে কোনো একজনকে নির্বাচিত করলেই অন্যরা ঈর্ষার বশে হানাহানি শুরু করে দিতেন। সিরাজের কপাল ক্রমে ল’ বিদায় হওয়ার এক মাসের মধ্যেই সেনাপতি মীর জাফর এগিয়ে এসে শেঠদের চক্রের সমস্যা পূরণ করে দিলেন। প্রভু আলিবর্দির কাছে কোরান ছুঁয়ে সেনাপতি শপথ করেছিলেন, নবাবের নাতিকে রাফা করবেন। শপথ ভঙ্গ করার কথা তিনি প্রথমে চিন্তা করেননি। তাঁর সাহায্য ছাড়া সিরাজ নবাব হতে পারতেন না। ল’র মতে তিনিই তরুণ নবাবকে এত দিন তখ্তে বজায় রাখছিলেন। শওকৎ জঙ্গের সঙ্গে গোপনে যোগসাজস করলেও, পূর্ণিয়ার নবাব নিহত হবার পর তাঁর মাথায় নিজে নবাব হবার পরিকল্পনা জেগে ওঠেনি। কিন্তু বার বার অপমানিত হয়ে তাঁর সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল। অসুস্থ মোহনলাল শিগগিরই ফিরে আসবেন এই ভয়ে ল’ চলে যাবার পরেই মীর জাফর গোপনে ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে এগিয়ে এলেন। কিছু দিন পরে বিপুল চেষ্টায় বিষের ক্রিয়া কাটিয়ে উঠে মোহনলাল ধুঁকতে ধুঁকতে দরবারে এসে যোগ দিলেন। দেওয়ান সুবাহ্র মাথা তখনো পরিষ্কার নয়। তিনি সেনাপতিকে খামকা অপমান করতে লাগলেন। দরবারে মীর জাফরের অবস্থা অসহ্য হয়ে উঠল। জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয় বেশ কিছুদিন ধরে তার কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছিলেন। এবার মীর জাফর সায় দিলেন।১৫ দরবারের দলগুলির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। নবাবের দিকে এখন তাঁর প্রধান মন্ত্রী মোহনলাল ও খাস রিসালার নায়ক মীরমদন ছাড়া কেউ নেই—সবাই একে একে ইংরেজদের দলে যোগ দিয়েছে।
মঁসিয় ল’ চলে যাবার এক মাসের মধ্যে দরবারে যে চক্র সম্পূর্ণ হয়ে উঠল তার আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক সম্পর্কগুলি এক নজরে দেখে নিয়ে তারপর ঐ চক্র গঠনের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া যাবে। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জগৎশেঠ মহতাব রায় ও তাঁর খুড়তুতো ভাই মহারাজ স্বরূপচন্দ। জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের ভারত-জোড়া প্রভাব অনুভব করে নবাব এই সময় তাঁদের তোয়াজ করে চলছিলেন—কিন্তু দুই ভাই এ কথা ভোলেননি যে কোনো এক অসাবধান মুহূর্তে নবাব তাঁদের হিজড়া বানিয়ে দেবার ভয় দেখিয়েছিলেন।১৬ মনসবদারদের মধ্যে যিনি জগৎশেঠ পরিবারের বিশেষভাবে অনুগত তিনি ইয়ার লতিফ খান—জগৎশেঠ প্রথমে এঁকেই শিখণ্ডী খাড়া করে অগ্রসর হলেন। কিন্তু শিখণ্ডী দিয়ে ভীমার্জুনের কাজ হয় না। নবাবের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর দুই প্রধান সেনাপতি—মীর মহম্মদ জাফর খান এবং রাজা দুর্ল্লভরাম সোম। যথাক্রমে মীর বকশী ও নিজাম দেওয়ান রূপে তাঁদের হাতেই সৈন্যদলের আসল কর্তৃত্ব। রায় দুর্ল্লভ জগৎশেঠকে বিষদৃষ্টিতে দেখলেও মীর জাফরের সঙ্গে জগৎশেঠের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। ইতিপূর্বে পূর্ণিয়া অভিযানের সময় নবাব, যখন জগৎশেঠকে প্রকাশ্য দরবারে চড় মেরে বসেছিলেন তখন মীর জাফরই রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং তাতে নবাবের শিক্ষাও হয়েছিল। জাঁ ল’ ভেবেছিলেন, রায় দুর্ল্লভ ফরাসীদের পক্ষে এবং মীর জাফর ইংরেজদের পক্ষে। কিন্তু ল’ চলে যাবার পরে এসব পক্ষাপক্ষ ঘুচে গেল। রায় দুর্ল্লভ খুব বড়াই করতেন তিনিই আলিনগর অভিযানের বিজয়ী বীর—আর ইংরেজদের তিনি আচ্ছা শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কুয়াশার মধ্যে আক্রান্ত হবার পর তাঁর এই বীর ভাব আর বজায় ছিল না। দেওয়ান সুবাহ্ মোহনলাল দরবারে ফিরে আসা মাত্র নিত্য নতুন অপমানের ধাক্কায় মীর বকশী মীর জাফর ও নিজামত দেওয়ান রায় দুর্ল্লভের প্রাচীন বন্ধুত্ব পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠল। আলিবর্দি খানের আমলে সওয়ার হাজিরা সংক্রান্ত কারচুপি ও তছরূপ ধরা পড়ে যাবার সময় বিপর্যস্ত বকশী রায় দুর্ল্লভের সাহায্য নিয়েছিলেন এবং সেই সুবাদে ঐ বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। ১৭ মোহনলাল উভয়ের শত্রু—দুই পুরাতন বন্ধু এই নতুন বিপদে আবার একজন আর একজনের সহায়তা করতে লাগলেন। এঁরা ছাড়াও দরবারে রহিম খান, বাহাদুর আলি খান ইত্যাদি আলিবর্দি খানের আমলের পুরোনো কয়েকজন মনসবদার ছিলেন। এরাও একে একে মীর জাফর-রায় দুর্ল্লভের দলের সঙ্গে হাত মিলালেন। এ ব্যাপারে গহসেটি বেগম তাঁদের প্ররোচিত করতে লাগলেন। আলিবর্দি খানের কন্যা এবং নওয়াজিশ মহম্মদ খানের স্ত্রী রূপে তিনি স্বভাবতই দরবারের পুরোনো আমীরদের শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন। মোতিঝিল লুঠের সময় তিনি কিছু ধনদৌলত লুকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন—এবার সেই ধন বিতরণ করে তিনি জনে জনে অনুরোধ করতে লাগলেন সকলে রায় দুর্ল্লভ ও মীর জাফরের সহায় হন। এতে ফল হল। ১৮ তাছাড়া মনসবদারদের মধ্যে কেউ কেউ মীর জাফরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে মীর জাফর নবাব হবার পরে খাদেম হোসেন খান নামে এক পাটনা থেকে আগত মনসবদার তাঁকে হঠাৎ কথায় কথায় ‘মামু, মামু’ বলে ডাকতে শুরু করেন। সেই আত্মীয়তার সূত্র এই যে মীর জাফরের বোন যাঁকে বিয়ে করেন তাঁর অপর এক কাশ্মীরী স্ত্রীর গর্ভে এর জন্ম হয়েছিল। সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাবতাবায়ী মামা ভাগ্নের মধ্যে এর চেয়ে ঘনিষ্ঠ আর একটি সম্পর্ক উল্লেখ করেছেন। ‘ইনি প্রায় একই বয়সের ছিলেন। এঁর কামাসক্তি বড়ো প্রবল ছিল। বিশেষ করে এমন এক প্রকার অস্বাভাবিক রমণাভিলাষের প্রতি তাঁর অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক ছিল যা দুই বন্ধুর ছোট বেলা থেকে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল এবং যে ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিলেন। প্রায়শ তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন এবং একসঙ্গে শুতে যেতেন। তবে মামুর চেয়ে তিনি অন্যান্য ব্যাপারে আরো সিদ্ধহস্ত ছিলেন। হিসাব রাখা ও টাকা রোজগারে তাঁর দক্ষতা ছিল, মারামারিতে তাঁর খুব হাত চলত এবং সর্বোপরি সব রকমের গুপ্ত অস্বাভাবিক রতিক্রিয়ায় তাঁর বিশেষ প্রবণতা ছিল। ’১৯ মীর জাফরের নিজের ভাই মীর দাউদ খান ছিলেন রাজমহলের ফৌজদার ও তিনি মঁসিয় ল’র গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন। ২০ মঁসিয় ল’র অনুপস্থিতিতে ফরাসীদের প্রধান মিত্র এবং নবাবের বিশিষ্ট আস্থাভাজন সওদাগর ফকরুত্তুজ্জর খোজা ওয়াজিদও ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়ে নানা গোপনীয় খবর সরবরাহ করছিলেন। এক কথায়, প্রায় গোটা দরবারই নবাব ও মোহনলাল কাশ্মীরীর বিরুদ্ধে এক হয়ে উঠেছিল।
এই মোটামুটি চক্রের অন্তর্গত পারস্পরিক সম্পর্কগুলির চেহারা। এইবার চক্রগঠনের ধারাবাহিক ঘটনাবলী অনুসরণ করা যাক। এই ধারা বিবরণী রচনা করার জন্য কোনো দেশীয় চিঠিপত্র বা দলিল মেলে না। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে চক্রান্ত অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ষড়যন্ত্রের রোজ-নামচা রচনা করতে হলে ইংরেজদের চিঠিপত্র ব্যবহার করা ছাড়া গতি নেই। ওয়াট্স্ ও স্ক্র্যাফটন মুর্শিদাবাদ থেকে ক্লাইভকে প্রায় রোজ চিঠি লিখতেন। এই চিঠিগুলির মাধ্যমে চক্রের দেশীয় অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হওয়া সম্ভব না হলেও ইংরেজ পক্ষের সঙ্গে দরবারী চক্রের সংযোগের ইতিহাস মোটামুটি পুরাপুরি ভাবেই মেলে।
ঢাকার ক্ষতিপূরণ বুঝে নিতে স্ক্র্যাফটন মুর্শিদাবাদ রওনা দেবার সময় ক্লাইভের কাছ থেকে গোপন নির্দেশ পেয়েছিলেন। ক্লাইভ তাঁকে দেখতে বলেছিলেন, নবাবের বিরুদ্ধে দরবারে দল গঠন করা সম্ভব কিনা। মুর্শিদাবাদে পৌঁছে স্ক্র্যাফটন ৮ এপ্রিল ওয়াট্স্কে যা বললেন তাই থেকে ওয়াট্সের বোধ হল, তখ্তে নতুন নবাব বসলে ক্লাইভ অসুখী হবেন না।২১ তখন চন্দননগর জয় করে ক্লাইভ শহরের কিছু উত্তরে ছাউনি ফেলেছেন। দরবারে টাকা ঢেলে ওয়াট্স্ ও ল’ পরস্পরের বিরুদ্ধে দল গঠনের কূটচালে ব্যাপৃত। ক্লাইভ-তখ্ত উলটানোর ব্যাপারে প্রবৃত্ত হননি, তবে সেই চিন্তা তাঁর মনে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। লন্ডনে সিক্রেট কমিটির কাছে তিনি জানালেন—চুক্তি ভঙ্গ করতে আমার ইচ্ছা নেই, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী সব কিছু আদায় না হলে সে ছাড়া উপায় থাকবে না, এবং হয়তো কিছুটা উত্তর দিকে কুচ করে অগ্রসর হলেও ফল ফলবে।২২ স্ক্র্যাফটন ওয়াল্শ্কে লিখলেন—আপনারা ওয়াট্স্কে একটু উৎসাহ দিলে তিনি এখনি দরবারে এমন একটা দল গড়ে তুলবেন যাতে লড়াই বেঁধে গেলে আমরা তখ্তে কোম্পানির অনুগত নবাব বসানোর জন্য তৈরি থাকতে পারি। ২৩ স্ক্র্যাফটন আসার আগেই ওয়াট্স্ এই ব্যাপারে আমীরচন্দের সঙ্গে আভাসে ইঙ্গিতে কথা বলেছিলেন, কিন্তু ক্লাইভের কাছে এ কথা পাড়তে তিনি এত দিন ইতস্তত করছিলেন। স্ক্র্যাফটনের সঙ্গে ওয়াট্সের কথা হবার পর ওয়াট্সের ইঙ্গিতে আমীরচন্দ দরবারে তৎপর হয়ে উঠলেন। আমীরচন্দ রোজই দরবারে যেতেন এবং সন্ধ্যাবেলা জগৎশেঠের কুঠিতে বসে থাকতেন। শেঠরা অবশ্য আমীরচন্দকে আদৌ বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা এও জানতেন নবাবের বিরুদ্ধে চক্র গড়তে তখ্তের উপযুক্ত প্রার্থী যোগাড় করা অত সহজ নয়। এ ব্যাপারে তখনো তাঁরা কিছু স্থির করতে পারেননি। তবে কানাঘুষায় ইয়ার লতিফ খানের নাম শোনা যাচ্ছিল।
দো হজারী মনসবদার মীর খুদা ইয়ার খান লতিফ সম্প্রতি আশাহত হয়েছিলেন। নবাব প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন তাঁকে নন্দকুমারের জায়গায় হুগলীর ফৌজদার করবেন, কিন্তু কোনো কারণে সেটা আটকে গেল। ২৪ লতিফের সঙ্গে (ইংরেজরা এঁকে বলত Latty) ইংরেজদের তখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি—ওয়াট্স্ সবে দরবারে পৌছে ঘুষ দিয়ে তখনো নন্দকুমারকে স্থায়ী ভাবে হুগলীর ফৌজদার বানাবার পরিকল্পনা করছেন (এসব শেখ আমরুল্লাহর ফৌজদার নিযুক্ত হবার আগেকার ঘটনা)। আমীরচন্দের উপর তাঁর অগাধ আস্থা—দরবারে সব কাজ তাঁর পরামর্শ মতো করেন। ২৫ আমীরচন্দের কাছ থেকে কথাবার্তায় তিনি ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন নবাবের বিরুদ্ধে দরবারে কোনো একটা বিপক্ষ দল তৈরি হচ্ছে। তারা তখ্তে অন্য কাউকে বসাতে চায়। ক্লাইভ বা অন্য কারো কাছে তিনি সে কথা ভাঙেননি—কারণ ক্লাইভের মনোভাব সম্বন্ধে তিনি সুনিশ্চিত নন। ক্লাইভ তখন বার বার মাদ্রাজে লিখছেন তিনি বর্ষার পরেই সৈন্য সমেত ফিরে আসছেন। চুক্তির শর্তগুলি আদায় করবার জন্য উত্তর দিকে একটু এগোতে তৈরি থাকলেও তিনি তখনো শান্তিভঙ্গ করতে মোটেই উৎসুক নন। এমতাবস্থায় স্ক্র্যাফটন মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছলেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওয়াট্স্ বুঝলেন, দরবার থেকে যে সব বার্তা আমীরচন্দ বয়ে আনছেন, ইংরেজ শিবিরেও সেই দিকে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। স্ক্র্যাফটনের নিজের অভিমত, মিশরে সীজারের মতো ক্লাইভের উচিত নিজের ছত্রছায়ায় রাজ্য টেনে এনে পুরনো রাজার জায়গায় নতুন রাজা বসিয়ে প্রজাদের সন্তোষ বিধান করা। ২৬ স্ক্র্যাফটনের মাথায় একবার একটা ‘প্ল্যান’ বা ‘স্কীম’ ঢুকলে ঝোঁকের মাথায় তিনি আর সব দিক দেখতে পান না। কিন্তু ওয়াট্স অনেক বেশি সাবধানী লোক। ক্লাইভকে তিনি ১১ এপ্রিল লিখলেন:
Omichund and I have had many conversations on a subject I did not know how to address you about. I opened myself to Scrafton and from him learn that Omichund’s and my endeavours for yours and the Major’s ২৭ service will not be disagrecable.২৮
It is hinted to me as if it would be proposed to the Committee for our army to march this way, but hope no such proposal will be listened to, as it will be violating our treaty with the Nabob, who is complying with his part of it, though not so expeditiously as we could wish; it will be throwing the country again into confusion, and probably prevent the Company’s getting an investment for another year, the consequences of which may be fatal to them; nothing but an open and an apparent breach by the Nabob in his contract ought to induce us to rekindle the war in this province; however if such a measure be thought advantageous, I shall think it would be prudent first to withdraw all our effects from the Subordinates,২৯
ওয়াট্স্ ও ক্লাইভ দুজনেরই ভাবখানা এই—ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ঐ দিনই সন্ধ্যাবেলা ওয়াট্স্ স্ক্র্যাফটনকে নবাবের দরবারে হাজিরা দেবার জন্য নিয়ে গেলেন। বিকেল চারটায় দরবারে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন, নবাব তখনো তৈরি হননি। তখন দুজনে মুর্শিদাবাদের দর্শনীয় লোক শাহ হাসুমকে দেখতে গেলেন। নাদির শাহ্ তাঁর নাক কেটে দেবার পর তিনি দিল্লী থেকে পালিয়েছিলেন। এখন তিনি একটা মাটির নাক পরে থাকেন। ওলন্দাজদের একটা জাহাজ করে তিনি মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আসেন। আলিবর্দি খান সাদর অভ্যর্থনা করে তাঁর জন্য বার্ষিক দশ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই ভাতা সিরাজের আমলেও চলে আসছে। নাক কাটা আমীর দর্শন করে দুজনে নবাবের সমীপে হাজির হলেন। নবাব যখন আলিনগর পুনর্দখল করতে গিয়েছিলেন, তখন শহরের বাইরে আমীরচন্দের বাগিচায় তাঁর সঙ্গে স্ক্র্যাফটনের দেখা হয়েছিল। স্ক্র্যাফটন ও ওয়াল্শ্ দূতিয়ালি করতে গিয়ে বাগান থেকে কোনোমতে পালান। স্ক্র্যাফটনকে দেখেই নবাব হো হো করে হাসতে হাসতে মাথা নাড়তে লাগলেন। স্ক্র্যাফটনকে নবাবের সামনে হাজির করার অনুমতি নেবার সময় দরবারের আর্জ্বেগী যখন কাধ ছুঁয়ে দেখিয়েছিলেন, তখনি নবাবের মনে পড়ে গিয়েছিল স্ক্র্যাফটনকে—‘ও সেই বাগিচার লোকটা, তাকে আসতে দাও।’৩০ স্ক্র্যাফটন মনে মনে বললেন, ‘ভারি হাসির কথা দেখছি, ঠিক আছে, মনে থাকবে।’ দরবারের সারি সারি গম্ভীর মুখগুলির সামনে সার্বজনীন বিস্ময় উদ্রেক করে তিনিও হো হো করে হাসতে লাগলেন। নবাব হেঁকে বললেন,ওঁর জন্য ঘোড়া আর খেলাৎ আনো—না, হাতি আনো।’ স্ক্র্যাফটন খেলাৎ পরতে গেলেন। ইত্যবসরে দরবারের একজন হাতি দেওয়া থেকে নবাবকে নিরস্ত করায় তাঁর কেবল একটা ঘোড়া প্রাপ্তি হল। মূরের পোশাকে দরবারে হাজির হলে নবাব তাঁকে ভারি খুবসুরৎ দেখাচ্ছে বলে প্রশংসা করে তাঁর তবিয়ৎ ঠিক আছে কিনা সেই খবর করলেন। দরবারে এত লোক গিজগিজ করছে যে কাজের কথা বলা সম্ভব নয়, তখনকার মতো স্ক্র্যাফটনকে নবাব বিদায় দিলেন। জানা গেল, আলিনগরের লড়াইয়ের সময় দোস্ত মুহম্মদ খান এমন আঘাত পেয়েছেন যে তিনি বোধহয় বাঁচবেন না, আর মানিকচন্দ কলকাতার ধনরত্ন তছরূপের জন্য রুষ্ট নবাবকে ১০১/২ লক্ষ টাকা সেলামি দিয়ে আবার তুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। দরবার থেকে ফিরে এসে স্ক্র্যাফটন ক্লাইভকে লিখলেন, নবাবের কাছে আপনার চিঠিতে যদি বার বার নন্দকুমারের নাম করেন, তবে নন্দকুমার সম্বন্ধে নবাবের সন্দেহ জন্মে যাবে। আরো জানালেন, বর্ষা শিগগিরই এসে পড়বে বলে নবাব আফগানদের সম্বন্ধে আর তত সন্ত্রস্ত নন।৩১
স্ক্র্যাফটনকে হাতি উপহার দেবার প্রস্তাব থেকেই বোঝা গিয়েছিল, দরবারে ইংরেজদের নসিব খুলে গেছে। জগৎশেঠের প্ররোচনায় এবং ওয়াট্সের উৎকোচে বশীভূত হয়ে দরবারের প্রায় সকলেই ইংরেজদের হাতে মঁসিয় ল’র দলবলকে তুলে দেবার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু করল। এমন সময় হঠাৎ পাটনা থেকে খবর এল বর্ষা কাছাকাছি এসে পড়া সত্ত্বেও আহমদ শাহ আবদালি কুচ করে এগিয়ে আসছেন আর বানারসের লোকেরা পালাতে শুরু করেছে।৩২ নবাব কাকুতি মিনতি করে ক্লাইভকে লিখলেন, ‘পঞ্চাশখানা ভারি কামানের দরকার হয়েছে, আপনি পাঠাতে পারলে বুঝব এ আপনার দোস্তির নিশানা।’৩৩ আফগানদের এগিয়ে আসার খবরটা একেবারে ভুল। কিন্তু দিশাহারা নবাব এরই মধ্যে মঁসিয় ল’কে সুবাহ্ থেকে বের হয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। ১৩ এপ্রিল নবাবের তলবে জাঁ ল’ হীরাঝিলে হাজিরা দিতে গিয়ে দেখলেন ওয়াট্স্ও জগৎশেঠের উকিলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছেন। মিস্টার ওয়াট্স্ ইংরেজীতে মঁসিয় ল’কে বললেন—‘আপনি যদি ফ্যাক্টরী আমার হাতে তুলে দিয়ে আপনার লোকজনদের নিয়ে কলকাতায় চলে যান তাহলে আপনাদের প্রতি সদাচরণ করা হবে। এটাই নবাবের ইচ্ছা।’ মঁসিয় ল’ উত্তর দিলেন—‘কখনোই না, যদি কাশিমবাজার ছেড়ে যেতে হয় তবে নবাব ছাড়া আর কারো হাতে আমি ফ্যাক্টরী ছেড়ে দেবো না।’ নবাবের আর্জ্বেগী ও অন্যান্য লোকেরা ল’ কে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনারা কি করতে পারেন? এখানে আপনারা মোটে একশো ফিরিঙ্গি। নবাব আপনাদের চান না। বেশক আপনাদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তার চেয়ে আপনি ওয়াট্স্ সাহেবের বাত মেনে নিন।’ ল’ রাজি নন দেখে তারা ওয়াট্স্কে নবাব দর্শন করাতে নিয়ে গেল। পাঁচ সাত মিনিট বাদে নবাবের আর্জ্বেগী কয়েকজন সওয়ার বাহিনীর জমাদার এবং শেঠ ও ইংরেজদের উকিলদের সঙ্গে নিয়ে বাইরে এসে ল’কে বললেন, নবাবের হুকুম আপনি ওয়াট্স্ সাহেব যা বলছেন তা মেনে নিন। এমন সময় কয়েকজন ফরাসী বন্দুকধারীকে ল’র পিছনে এগিয়ে আসতে দেখে আর্জ্বেগী শেঠদের উকিলদের দিকে ফিরে বললেন—‘তবে আপনারাই কথা বলুন। মামলা তো আমাদের নয়, মামলা আপনাদের।’ জগৎশেঠের উকিল কিছু বলবার জন্য মুখ খুলতেই ল’ তাঁকে থামিয়ে বললেন, নবাব ছাড়া কারো সঙ্গে তিনি কথা বলবেন না। বাধ্য হয়ে আর্জ্বেগী নবাবের অনুমতি নিয়ে ল’কে দর্শনে নিয়ে গেলেন। নবাব ল’কে বসিয়ে ব্যতিব্যস্তভাবে বললেন, হয় তাঁকে ওয়াট্সের ফয়সালা মেনে নিতে হবে নয় এই মুল্লুক ছেড়ে চলে যেতে হবে। ল’ বললেন, তবে তিনি পাটনার দিকে রওনা হয়ে যাবেন। বলমাত্র নবাব ও খোজা ওয়াজিদ ছাড়া আর সকলে হাঁ হাঁ করে বলে উঠল—নবাব এ হুকুম কিছুতেই দিতে পারেন না, আপনি মেদিনীপুর বা কটক যান। ল’ নবাবের দিকে ফিরে বললেন, আপনি কি চান আমি ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ি? নবাব মুখ নীচু করে সব শুনছিলেন, এবার মুখ খুলে বললেন, ‘না, না, যে রাস্তায় খুশি যান আর আল্লাহ্ আপনার হামরাহী হোন।’ পান দিয়ে ল’কে বিদায় দেবার আগে নবাব বললেন, নতুন কিছু ঘটলে তাঁকে তলব করবেন। ল’ বলে গেলেন, ‘আমাকে তলব করবেন? নবাব সাহেব, আপনি নিশ্চিত জানবেন আপনার আর আমার এই শেষ দেখা। আমার কথাগুলি ইয়াদ রাখবেন। আর আমাদের দেখা হবে না। —বলতে গেলে তা অসম্ভব।’৩৪
১৬ এপ্রিল কুচ করে ল’র দলবল মুর্শিদাবাদ থেকে বের হয়ে গেল। দু তিন দিন ধরে আমীরচন্দের জ্বর যাচ্ছিল। ল’ যাবার পরের দিন রাত্রে স্ক্র্যাফটন তাঁকে দেখতে গেলেন। আমীরচন্দের সঙ্গে এক ঘণ্টা ধরে মন্ত্রণা করে তাঁর মনে হল এমন বিচক্ষণ লোকের সহায়তায় ওয়াট্স্কে ছাড়াই তিনি মুর্শিদাবাদে এক বিষম কাণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারেন। আমীরচন্দ তাঁকে বললেন, আফগানদের আসা’র খবরটা যদি সত্যি হয়, তবে নবাব একেবারে আপনাদের কাছে গিয়ে পড়বেন, হয়তো ধনদৌলত পর্যন্ত আপনাদের জিম্মায় দিয়ে দেবেন। তা যদি না হয়, আর নবাব যদি চুক্তির কোনো শর্ত খেলাপ করেন, তবে তাঁর জায়গায় আর একজন নবাবকে খাড়া করা যুক্তিযুক্ত হবে। লতিফ একজন উপযুক্ত আমীর, জগৎশেঠ তাঁর সহায়। তিনি দু হাজার ভালো ঘোড়া নিয়ে ইংরেজদের দলে যোগ দেবেন। মানিকচন্দ যা পারেন, করবেন। নন্দকুমারও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দরবারের সবাই চাইছে, নবাব মরুক। সুলেনামা অনুযায়ী ইংরেজদের যে ৩৮ খানা গ্রাম পাওয়ার কথা, মানিকচন্দ ও নন্দকুমার তার বদলে ইংরেজদের জন্য আরো বড়ো একটা জমিদারীর ব্যবস্থা করে দেবেন। কর্নেল ক্লাইভ ও মেজর কিলপ্যাট্রিক ক্ষতিপূরণের খাতে অনেক টাকা পাবেন। বৃষ্টি শুরু হবার আগেই পনের দিনের মধ্যে জানা যাবে আফগানরা আসছে কি না, তার মধ্যে এস্পার-ওস্পার হয়ে যাবে।
ইংরেজদের কাছে এই প্রথম খুদা ইয়ার খান লতিফের নাম তোলা হল। স্ক্র্যাফটন কয়েকদিন ধরে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার (‘fixed plan’) জন্য ঝুলোঝুলি করছিলেন। আমীরচন্দের প্রস্তাব শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে তিনি ওয়াল্শ্কে লিখলেন—‘Omichund’s behaviour to us deserves the utmost commendation. I never saw his equal for attention and attendence on business. Watts is a simpleton…Should a second rupture happen, I rely on your interest for my former station. I have hitherto avoided all posts in the service, have even declined any application for the Chiefship of Luckypore, given to one far my junior, till I can see what turn affairs take. Politics and power are my—. I think the Company’s affair’s are like to go on at all events.’৩৫ বেশ বোঝা যায় ওয়াট্স্কে বোকা প্রতিপন্ন করে আমীরচন্দের সহায়তায় ষড়যন্ত্র ফেঁদে স্ক্র্যাফটন আশা করছিলেন নিজের উন্নতির পথ খুলে যাবে আর লখিমপুরের বড়ো কর্তার চেয়েও বড় পদ তাঁর লাভ হবে। একই চিঠিতে স্ক্র্যাফটন ওয়াল্শ্কে সাবধান করে দিলেন, ল’কে পাটনায় পালাতে দেবার জন্য নবাবের উপর আমাদের ক্ষোভ আপাতত গোপন রাখাই যুক্তিযুক্ত হবে। কিন্তু সে চিঠি পৌঁছনর আগেই ল’ পালিয়েছেন শুনে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নবাবকে লিখলেন—‘Let me again repeat to you, I have no further views than that of peace. The gathering together of riches is what I despise; and I call on God, who sees and knows all the spring of all our actions, and to whom you and I must one day answer, to witness the truth of what I now write; therefore if you have me believe that you wish peace as much as I do, no longer let it be the subject of our correspondence for me to ask for the fulfilment of the treaty, and you to promise and not perform it, but immediately fulfil all your engagements: thus let peace flourish and spread through all your country, and make your people happy in the re-establishment of their trade, which has suffered by a ruinous and destructive war. What can I say more?’৩৬
অ্যাডমিরাল ওয়াট্স্ন তখনো ষড়যন্ত্রের কথা কিছু জানতেন না। জানবার পর নবাবকে তিনি আর কোনো চিঠি দেননি। ক্লাইভ ওয়াল্শের কাছে লেখা স্ক্র্যাফটনের চিঠি তখন পর্যন্ত দেখেননি। তিনি নবাবকে লিখলেন, মিস্টার ল’কে ধরবার জন্য তাঁর পেছন পেছন ইংরেজ ফৌজ ধাওয়া করবে। তাঁকে পালাতে দিয়ে নবাব শুধু চুক্তি ভঙ্গ করেননি, নিজের পায়ে কুড়ূল মেরেছেন। মারাঠারা বা আফগানরা এই সুবাহ্ আক্রমণ করলেই ফরাসীরা নবাবের বিরুদ্ধে তাদের সঙ্গে যোগ দেবে।৩৭ ইংরেজদের নিজেদের চিঠিপত্র থেকে দেখা যায় আলিনগর চুক্তির সমস্ত শর্তই নবাব পালন করে যাচ্ছিলেন। ফরাসীদের ধরিয়ে দিতে হবে এমন কোনো শর্ত সে চুক্তিতে ছিল না। এটা ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান দাবিগুলির অন্যতম।
এদিকে বার বার ইংরেজদের কাছে তর্জন গর্জন শুনতে শুনতে নবাব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলেন। তাঁর তরুণ বয়স, দীর্ঘকাল ধরে মনের ভাব গোপন করার বিদ্যা আয়ত্ত হয়নি। ১৯ এপ্রিল (ওয়াটসন ও ক্লাইভের চিঠি পাওয়ার আগেই) হঠাৎ তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ইংরেজদের উকিলকে দরবারে ঢুকতে দেখা মাত্র তিনি তাকে বের করে দিলেন। যেতে যেতে উকিল পিছন থেকে নবাবের গলার স্বর শুনল—‘ওদের জাতটাকে আমি খতম করে ছাড়ব।’ দশ লক্ষ টাকার লোভ দেখিয়ে নবাব মীর জাফরকে কুচ করতে হুকুম দিলেন, আর তিনি নিজেও পিছন পিছন যাবেন বললেন। দরবারের লোকেরা কারণ জিজ্ঞাসা করায় নবাব বললেন—‘হরদম ওরা ফরাসিস্দের ধরিয়ে দেবার জন্য লিখছে। ওদের রোকা আমি আর নেবো না।’ আমীরচন্দ ভারি বিষণ্ণভাবে দরবার থেকে ফিরে এলেন। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করায় স্ক্র্যাফটনকে তিনি বললেন—মানিকচন্দ নবাবকে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। ঐ দিন রাত্রে স্ক্র্যাফটন ‘ল্যাটি’র সঙ্গে গোপনে দেখা করতে যাবেন স্থির করেছিলেন। এমন সময় এত্তালা পেয়ে আমীরচন্দ জগৎশেঠের কুঠি রওনা দিলেন। স্ক্র্যাফটনের আর খুদা ইয়ার খান লতিফের কাছে যাওয়া হল না। তিনি বুঝলেন জগৎশেঠ ল্যাটিকে নবাব বানাবার জন্য উমিচাঁদকে ডেকেছেন।৩৮ পরের দিন সকালেই নবাবের মতি পাল্টে গেল। হঠাৎ ভয় পেয়ে তিনি মীর জাফরের উপর কুচ করার হুকুম প্রত্যাহার করে নিলেন আর ইংরেজদের উকিলকে ডেকে তাকে পান দিলেন। রাত্রে নবাব আমীরচন্দকে ডেকে জানতে চাইলেন—‘কি করলে ইংরেজদের খুশি করতে পারব? ওরা যা চায় জানান আমি দেবো, কারণ আমায় উত্তর দিকে কুচ করতে হবে।’৩৯ মুর্শিদাবাদে তখন সবে খবর এসেছে, নরহত- সিমাইয়ের জমিদার কামগর খান ও পাটনার নায়েব রামনারায়ণের ফৌজ পরস্পরের সাত ক্রোশ তফাতে দাঁড়িয়ে আছে, আর আগ্রার আঠার ক্রোশ এদিকে সকতরাবাদে (?) আহমদ শাহ আবদালি মোগল বাদশাহ্র উজীর গাজিউদ্দিন খান ও দুই শাহজাদাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলার দিকে কুচ করার তোড়জোড় করছেন।৪০
এদিকে ইংরেজদের সম্বন্ধে নবাবের ভয় একটুও কম নয়। পলাশীতে রায় দুর্ল্লভের ফৌজের কাছে তাঁর হুকুম গেছে, দুর্ল্লভরাম যেন বাগানের গাছ নদীতে ফেলে নদীপথে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নওয়ারার আসার মুখ বন্ধ করে দেন। স্ক্র্যাফটন কেন মুর্শিদাবাদে বৃথা কালক্ষেপ করছেন তাই জানতে নবাবের চর নারায়ণ সিংহ দিনে বার বার করে ওয়াট্সের সঙ্গে দেখা করে জেরা করছেন। ইংরেজদের উকিলকে পান দিয়ে তুষ্ট করে নবাব নিজেই জিজ্ঞাসা করে ফেললেন—‘ওই বেটিচুৎ বাগিচার লোকটা (that metichut৪১ of a garden chap) ঢাকা চলে যাচ্ছে না কেন?’ উকিল বলল, ‘নবাব সাহেব, উনি ঢাকার বকেয়ার জন্য ইন্তিজার করছেন।’ নবাব বললেন ‘ওকে এখনি তা মিটিয়ে দাও। আমি তাকে এখানে দেখতে চাই না।’ উকিলকে আর আমীরচন্দকে বহুমূল্য খেলাৎ দিয়ে সম্মান জানানো হল, আর ঢাকা কুঠি বাবদ ক্ষতিপূরণের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার পরওয়ানাও জারী হয়ে গেল।৪২
রাজনীতির চিন্তায় স্ক্র্যাফটনের মনটা সারা দিন তোলপাড় করে, রাত্রে ঘুম হয় না।৪৩ সেই সঙ্গে নিজের উন্নতির চিন্তাটাও জড়িয়ে আছে। ওয়াটস্নকে না জানিয়ে তিনি ওয়ালশের সঙ্গে সংকেতে (সাইফার) চিঠি লেখালেখি করছেন, আর বিশেষ ভাবে বলে রেখেছেন কসিদ যেন কাটোয়ার দিক থেকে না এসে কৃষ্ণনগরের দিক থেকে অন্তত পাঁচ প্রহরের মধ্যে ওয়াল্শের চিঠি নিয়ে আসে। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের বন্ধু, সম্ভবত সেই জন্য কৃষ্ণনগরের প্রতি এই পক্ষপাত। স্ক্র্যাফটনের পরামর্শ, ল্যাটির সঙ্গে উমিচাঁদের সহায়তায় একটা সমঝোতা করে ফেলা যাক। সেটা এত গোপনে করতে হবে যে ওয়াট্স্কে জানানোর দরকার নেই, সিলেক্ট কমিটিকেও বলতে হবে না, শুধু অ্যাডমিরাল সাহেব ও কর্নেল সাহেব যেন এ ব্যাপারে এক মত থাকেন, আর উমিচাঁদকে যেন হুকুম দেওয়া হয় সে সব কাজকর্ম স্ক্র্যাফটনের সঙ্গে পরামর্শ করে চালাক।
আমীরচন্দ ঝানু লোক। জগৎশেঠের সঙ্গে তাঁর যে সব সলাপরামর্শ হল তা প্রথমে স্ক্র্যাফটনকে না জানিয়ে তিনি ওয়াট্সের কাছে ভাঙলেন। তাঁর পরামর্শ, এখন নবাবকে না রাগিয়ে কয়েক দিন অপেক্ষা করা উচিত। ল’র দলবল মুর্শিদাবাদ থেকে বেরিয়ে গেছে, তারা আরো দূরে যাক। পাঠানরা এগিয়ে আসছে তারা আরো কাছে আসুক। নবাবকে যদি আগে থেকে সতর্ক না করে দেওয়া হয় তবে তিনি ফৌজ নিয়ে পাঠানদের মোকাবিলা করতে বেরিয়ে যাবেন। নবাব নিজে না গেলেও ফৌজের বেশির ভাগ উত্তর দিকে রওনা হয়ে গেলে পর ক্লাইভের সুযোগ মিলবে। তিনি যদি এখন থেকে গোপনে বলদ, গাড়ি ইত্যাদি তৈরি করে রাখেন তাহলে এক ঘণ্টার এত্তালায় চন্দননগরের বাইরে ছাউনি থেকে বেরিয়ে পড়ে মুর্শিদাবাদ শহর এবং নবাবের দৌলতখানা দখল করে নিতে পারবেন।৪৪ ব্যাপারটা যে কেবল কল্পনার জাল বোনা নয় তা ২৩ এপ্রিল বোঝা গেল। মীর খুদা ইয়ার খান লতিফ গোপনে ওয়াট্সের পরামর্শ চাইলেন। তাঁর ইচ্ছায় ঐদিন ওয়াট্স্ আমীরচন্দকে তাঁর কাছে পাঠালেন। মীরসাহেব আমীরচন্দের মারফৎ খবর পাঠালেন, নবাব সুযোগ পেলেই ইংরেজদের সঙ্গে আহাদনামা ভঙ্গ করবেন। ইংরেজদের উস্কে দেবার জন্য তিনি আরো জানালেন যে ল’র দলবল নবাবের মাইনে পাচ্ছে, তারা কখনোই পাটনা ছেড়ে আর এগোবে না। ইংরেজদের এখন এমন কিছু করা উচিত না যাতে নবাবের মনে কোনো সন্দেহ জাগে। ক্লাইভ যদি নবাবের সন্দেহ ভঞ্জন করে একটা রোকা দেন তাহলে বড়ো ভালো হয়। এ ব্যাপারে নবাব নিশ্চিন্ত হতে পারলেই তৎক্ষণাৎ পাঠানদের রুখতে উত্তর দিকে যাত্রা করবেন। ইংরেজদের এখন আর কিছু নয়, কেবলমাত্র ভুলিয়ে-ভালিয়ে নবাবকে পাটনার দিকে রওনা করিয়ে দিতে হবে। যে মুহূর্তে নবাবের সঙ্গে তাদের ঝগড়া বেঁধে যাবে, অমনি খুদা ইয়ার খান তাঁর সমস্ত দলবল নিয়ে তাদের দিকে যোগ দেবেন। ইংরেজরা যদি তাঁকে নবাব করে, তাহলে তিনি তাদের কলকাতার কাছে মস্ত বড়ো জমিদারী দেবেন। আর এত টাকা দেবেন যাতে ফৌজ, নওয়ারা আর আলিনগরের সব বাসিন্দার চাহিদা মেটে। হবু নবাব আরো অঙ্গীকার করলেন, তাঁর পক্ষ আর ইংরেজদের পক্ষ মিলে উভয়ের সমস্ত শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক যুক্তপক্ষ (‘a league…offensive and defensive against all enemies whatever’) গড়ে তুলবেন। খুদা ইয়ার খান সর্বোচ্চ স্তরের সেনাপতি না হলেও দুই হাজারী মনসবদার, জগৎশেঠের তন্খা খান। ইংরেজরা বুঝল, জগৎশেঠ নিশ্চয়ই তলে তলে ঘোঁট পাকাচ্ছেন, নইলে একজন মাঝারী দরের সেনাপতি এভাবে এগিয়ে আসতে সাহস পেতেন না। ওয়াট্স্ ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন, খুদা ইয়ার খানের প্রস্তাবে রাজী থাকলে তাঁকে ছয় দিনের মধ্যে জানাতে হবে। ওয়াট্সের পাঁচ জন চর ফরাসীদের সঙ্গে সঙ্গে পাটনা পর্যন্ত যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে তিনি রোজ জানতে পারছেন ল’র দলবল কোথায় পৌঁছেছে। ক্লাইভ নিজেও যেন নবাবকে বিশ্বাস না করে দিকে দিকে চর পাঠিয়ে দেন।৪৫
ওয়াটসের সঙ্গে স্ক্র্যাফটনের রোজই খিটিমিটি চলছিল। স্ক্র্যাফটনের ধারণা, ওয়াট্স্ ভীতু বলে ঝামেলা এড়াতে চান। ওয়াট্স্ স্ক্র্যাফটনকে খামকা ফ্যাসাদ বাধাবার জন্যে ধমকাচ্ছিলেন। তলে তলে ওয়াট্স্ যে আমীরচন্দের মাধ্যমে দরবারে ষড়যন্ত্র করছেন, তার কিছুটা আঁচ পেলেও সব কিছু স্ক্র্যাফটন জানতে পারছিলেন না। আমীরচন্দ তাঁর কাছে এসব কিছু ভাঙছিলেন না। ল্যাটির সঙ্গে উমিচাঁদের কি কি কথাবার্তা হল তা জানতে তিনি বিশেষভাবে উৎসুক। আমীরচন্দ শুধু তাঁকে বললেন, খবর গোপন রাখতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যখন সময় আসবে তখন ক্লাইভকে সবকিছু জানাবেন। আন্দাজে স্ক্র্যাফটন বুঝলেন, জগৎশেঠের সহায়তায় তিনি ল্যাটিকে তখ্তে বসাবার চাল চালছেন। স্ক্র্যাফটন এবার ওয়ালশ্কে না লিখে ক্লাইভকে সরাসরি চিঠি দিয়ে বললেন৪৬ , উমিচাঁদ চান সবকিছু যেন তাঁর মুঠোয় থাকে। কারো হস্তক্ষেপ তাঁর সহ্য হয় না। এত বড়ো ব্যাপারের সব কৃতিত্ব তিনি শুধু নিজের জন্য রাখতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর উপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া চলে না। ক্লাইভ উমিচাঁদকে লিখে দিন, পুরো ফন্দি এখনি স্ক্র্যাফটনকে জানিয়ে দিতে। প্ল্যানখানা হাতে নিয়ে দ্রুতগামী ছিপে তিন দিনের মধ্যে স্ক্র্যাফটন ক্লাইভের কাছে হাজির হবেন। অন্য সব ব্যাপারে ওয়াট্স্ খুবই যোগ্য লোক, কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি এত ভীতু যে তাতে বিশেষ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। স্ক্র্যাফটন যে কত সাহসী লোক, উমিচাঁদের চেয়ে তা আর কেউ বেশি জানে না। এ কথা স্ক্র্যাফটন নিজেই লিখলেন। উমিচাঁদের ফন্দিখানা, কি তাও আন্দাজে স্ক্র্যাফটন ক্লাইভকে লিখে দিলেন। কাশিমবাজারে ইংরেজদের একশো লোক থাকবে। ল্যাটির সঙ্গে যোগ দিয়ে তারা হঠাৎ নবাবের উপর চড়াও হবে। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভও রওনা হয়ে যাবেন। মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি পৌঁছন মাত্র তাঁর দিকে নবাবী ফৌজের কয়েকজন বড়ো বড়ো জমাদার গিয়ে যোগ দেবেন। মোটামুটি এই হল বীরপুরুষ স্ক্র্যাফটনের চিন্তার প্রণালী। আর কিছু নয়, উমিচাঁদকে হাতের মুঠোয় আনতে পারলেই তিনি দুঃসাহসিক অভিযানে ঝাঁপ দিতে পারবেন। কিন্তু এত বড়ো কাজেও লোক বাগড়া দেয়। স্ক্র্যাফটনের চিঠির পুনশ্চ অংশ থেকে ক্লাইভ জানতে পারলেন, গোলাবারুদ সহ তিনি যে এগারখানা নৌকা কাশিমবাজারের দিকে পাঠিয়েছিলেন, রায়দুর্ল্লভ, সেগুলি সব আটক করেছেন।
ক্লাইভ নিজেও মুর্শিদাবাদ থেকে কানাঘুষায় খবরাখবর পাচ্ছিলেন। সওদাগরদের প্রধান খোজা ওয়াজিদ তাঁকে গোপনে সংবাদ সরবরাহ করছিলেন। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় ছিলেন। তাঁকে ক্লাইভ চিঠিতে জানালেন, ‘এককথায় নবাবের দুর্বলতা ও অত্যাচারে মুর্শিদাবাদে এমন গণ্ডগোল আর অসন্তোষ পাকিয়ে উঠেছে যে আমি কয়েকজন বড়ো বড়ো লোকের সম্বন্ধে খবর পেলাম যাঁদের মধ্যে আছেন জগৎশেঠ আর মীর জাফর—তাঁরা নাকি দল করে নবাবকে কেটে ফেলে তখ্তে মীর খুদা ইয়ার খান লতিফকে (Murgodaunyer Cawn Luttee) চাপাবেন। ইনি মস্ত বড়ো পরিবারের লোক, মহাধনী ও প্রতাপশালী, এঁকে জগৎশেঠ আগাগোড়া সমর্থন করেন।’৪৭ অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের কাছে খুদা ইয়ার খানের এত প্রশংসা করলেও লোকটির সম্বন্ধে কর্নেল ক্লাইভের মনে কিছু কিছু প্রশ্ন ছিল। মিস্টার ওয়াট্স্কে তিনি জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন:
If the Nabob is resolved to sacrifice us, we must avoid it by striking the first blow. You should enquire if Luttee be a man of interest. Is he a Moorman? May not all be overset by the Afghans if they come? Has Luttee any interest there? You should consider the honour of the nation, and if possible avoid engaging us in any executions.
I hear Meer Jaffier wants to get rid of the Nabob. I hope it is true.৪৮
ক্লাইভের চিঠি থেকে বোঝা যায় তিনি তখনো হঠকারীর মতো হাঙ্গামায় ঝাঁপ দিতে চাইছিলেন না। বিশেষ করে আফগানরা যদি এসে পড়ে, তবে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। যাতে ভেস্তে না যায় সেই জন্য তিনি জানতে চাইছিলেন আফগানদের উপর এই ল’টি লোকটির কোনো প্রতিপত্তি খাটবে কিনা। সে কি যথেষ্ট বড়ো দরের লোক? তা ছাড়া অন্য সূত্রে তিনি খবর পাচ্ছিলেন, সেনাপতি মীর জাফর না কি নবাবকে মসনদচ্যুত করতে চান। সে কথাটাও ভালো করে জানা দরকার।
নবাব হওয়া খুদা ইয়ার খানের কপালে লেখা ছিল না। যে রাত্রে তিনি আমীরচন্দের কাছে নিজের উচ্চাশার কথা ভাঙলেন, ঠিক তার পরের দিনই অত্যন্ত গোপনে মীর জাফর মিষ্টার ওয়াট্সের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। সে দিন ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল। আমীরচন্দের উপর মীর জাফরের আস্থা ছিল না। তিনি এত্তালা দিলেন পেত্রসকে। দরবারে আরমানী সওদাগর খোজা পেত্রস আনাগোনা করতেন। তিনিও মিস্টার ওয়াট্সের বিশ্বস্ত সহকারী। পেত্রসকে গোপনে ডাকিয়ে মীর জাফর ইংরেজদের উস্কে দেবার জন্য বললেন, নবাব শুধু মোহনলালের সেরে ওঠার অপেক্ষায় আছেন। মোহনলাল কাশ্মীরী দরবারে যোগ দিলেই নবাব ইংরেজদের উপর হামলা করবেন—সেই জন্য পাটনা থেকে কিছু ফৌজ আসছে, তারা আট-নয় দিনের মধ্যে এসে পৌঁছবে। মীর জাফর তখনো বকশী পদে অধিষ্ঠিত। কিন্তু তাঁর মনে কোনোও স্বস্তি নেই। কবে কাশ্মীরীটা দরবারে এসে হাজির হয়—বোঝাই যাচ্ছে নবাবের ইয়ার বিষে মরেনি। সে দরবারে হাজির হলে নবাব যে আবার নিজ মূর্তি প্রকাশ করবেন তাতে সন্দেহ নেই। খোজা পেত্রসকে মীর জাফর চুপিচুপি বললেন—নবাবের উপর সবাই চটা। তিনি প্রত্যেকের সঙ্গে বে-আদবপনা করেছেন।৫০ একথা জানিয়ে মীর জাফর আরো বললেন, আমার নিজের কথা ছেড়েই দিলাম, আমি যখনি দরবারে যাই তখনি খুন হবার ভয় থাকে। তাই আমার বেটাকে৫১ রিসালার সঙ্গে তৈরি রেখে যাই। সাবিৎ জঙ্গ৫২ যদি রাজি থাকেন তবে আমি নিজে, রহিম খান, রায় দুর্ল্লভ, আর বাহাদুর আলি খান এবং আরো কেউ কেউ তৈরি আছি, তাঁর সামিল হয়ে নবাবকে গ্রেফতার করে যাঁকে পছন্দ এমন আর কাউকে তখ্তে বসাবো।
এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো। খোজা পেত্রসের সঙ্গে কথাবার্তায় মীর জাফর একবারও খুদা ইয়ার খানকে গদিতে বসাবার কথা বলেননি। খুদা ইয়ার খানের হয়ে যিনি দূতিয়ালি করছিলেন সেই আমীরচন্দকেও সম্পূর্ণ দূরে রেখে তিনি খোজা পেত্রসকে ওকালতিতে লাগিয়েছিলেন। অতএব শিবিরে বসে নানা উড়ো খবর জোড়া করে ক্লাইভ যা ভাবছিলেন,—জগৎশেঠ আর মীর জাফর মিলে সর্বসম্মত দাবীদার খুদা ইয়ার খানকে গদিতে বসাতে চান,৫৪ —সেটা সত্যি না হওয়াই সম্ভব। যাঁকে পছন্দ এমন একজনকে মসনদে বসাবো, মীর জাফরের এই কথা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে কোনো সর্বসম্মত দাবীদার তখনো সাব্যস্ত হয়নি। অবশ্য মীর জাফর তখন পর্যন্ত নিজের জন্য তখ্তের দাবি তোলেন নি। মুস্কিল হচ্ছে, ওয়াট্স্, স্ক্র্যাফটন ও ক্লাইভের চিঠি থেকে দরবারের চক্রান্তটা ভিতর থেকে দেখা যায় না। ষড়যন্ত্রকারীরা নিজেদের মধ্যে কে কি করছিলেন, ষড়যন্ত্র কোন্ স্তরে পৌঁছেছিল, তা স্পষ্ট নয়। হয়তো তখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক চক্র গড়ে উঠছিল, সেগুলি মিলে একটা সম্মিলিত চক্র হয়নি। অন্তত ওয়াট্সের চিঠি থেকে এটা মনে হয় যে খুদা ইয়ার খান ও মীর জাফর পরস্পরকে না জানিয়ে নিজ নিজ ফিকিরে তাঁর সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে যোগাযোগ স্থাপন করছিলেন। জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয় চক্রের কোনখানে অবস্থান করছিলেন সেটা স্পষ্ট নয়। তাঁদের না জানিয়ে তাঁদের অর্থে পুষ্ট খুদা ইয়ার খান নবাব হবার চাল চেলেছিলেন, এটা হতে পারে না। কিন্তু মীর জাফরের সঙ্গেও তাঁদের বহু দিনের বন্ধুত্ব। মনে হয়, জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচন্দ সব ডিমে তা’ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন কোন ডিমটা ফোটে। মীর জাফর খোজা পেত্রসের কাছে তাঁর পক্ষের যেসব রাজপুরুষদের নাম করেছিলেন তাঁদের মধ্যে জগৎশেঠ নেই, তাঁরা সবাই মনসবদার। রহিম খান, রায় দুর্ল্লভ, বাহাদুর আলি খান, এঁরা সবাই আলিবর্দি খানের পুরনো সেনাপতি, অনেকদিন ধরে এঁরা এবং মীর জাফর একসঙ্গে বর্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যাপৃত ছিলেন। রায় দুর্ল্লভ ও মীর জাফর ছিলেন বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ। জগৎশেঠ ও রায়দুর্ল্লভের মধ্যে কোনো সৌহার্দ্য ছিল না। জগৎশেঠ চুপচাপ দেখছিলেন ষড়যন্ত্র কোন দিকে মোড় নেয়।
যেদিন মীর জাফর চুপিচুপি খোজা পেত্ৰসের মাধ্যমে মিস্টার ওয়াট্সের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন, সেই দিন থেকে হঠাৎ দরবারের পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোরালো হয়ে উঠল। নন্দকুমার ও গোয়েন্দা মারফৎ আশু বিপদের আভাস পেয়ে নবাব সন্দিগ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সন্দেহের খোরাক জোটালেন ক্লাইভ নিজে। যেদিন খুদা ইয়ার খান আমীরচন্দের সঙ্গে রাতের আঁধারে ষড়যন্ত্র শুরু করেন ঠিক তার আগের দিন ভোরবেলা ক্লাইভ এক কাণ্ড করে বসেছিলেন। আগেই বলা হয়েছে নবাব একদিন রুষ্ট হয়ে ইংরেজদের উকিলকে দরবার থেকে বের করে দিয়েছিলেন। চন্দননগরের বাইরের ছাউনিতে সে খবর পাওয়া মাত্র ক্লাইভ স্থির করে ফেললেন এই অপমান হজম করবেন না। ২২ এপ্রিল রাত ১২টার সময় হুগলীর কেল্লায় নন্দকুমার শুতে যাবার তোড়জোড় করছেন এমন সময় ইংরেজদের শিবির থেকে ক্লাইভের মুনশী নবকৃষ্ণ দেব এসে হাজির হলেন। মুনশীর মুখে নন্দকুমার শুনলেন, সাবিৎ জঙ্গ তাঁকে জরুরী তলব করেছেন। নন্দকুমারের অত্যন্ত অপমান বোধ হল। নবকৃষ্ণকে তিনি বললেন, ‘এখন আমার সময় নেই। আমি সরকারী কাজে ব্যস্ত আছি। কাজ শেষ হলে যাবো।’ পরের দিন ভোর হতে না হতেই আর একজন লোক এসে নন্দকুমার ও মথুরা মলকে (এই মথুরা মল হুগলীতে মোতায়েন নবাবের গোয়েন্দা) ডাকাডাকি করতে লাগল। নন্দকুমার ও মথুরা মল বাইরে এসে দেখলেন চন্দননগরের উত্তরের ময়দানে কর্নেল ক্লাইভ, মেজর কিলপ্যাট্রিক, মিস্টার ড্রেক এবং কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যরা জটলা করছেন আর সৈন্যদল কুচকাওয়াজ করছে। ক্লাইভ দুজনকে এইভাবে আড়াই ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখলেন। নন্দকুমারের আর সহ্য হল না। তিনি বিদায় নিতে চাইলে ক্লাইভ তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, নবাবকে জানাবেন আমি কালকেই তাঁর কাছে কুচ করে যাচ্ছি।
অপমানিত নন্দকুমার হুগলীর কেল্লায় ফিরে নবাবকে চিঠি লিখতে বসলেন। ইংরেজরা তাঁকে হুগলীর স্থায়ী ফৌজদার বানাবে এমত আশায় আশায় তিনি অনেক দিন কাটিয়েছিলেন এবং যত রকমে পারেন ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন, তাঁর সাহায্য ছাড়া ইংরেজরা চন্দননগর দখল করতে পারত না। ইংরেজরা তাঁকে ‘গোলাপ ফুল তাজা আছে’ বলে মাঝে মাঝে চাঙ্গা করে রাখছিল। কিন্তু নন্দকুমার দেখলেন, তিনি নায়েব ফৌজদার হয়েই বসে আছেন এতদিনেও যখন কিছু হল না তখন তিনি বুঝলেন নবাব আর কাউকে ফৌজদার বানাবেন। ইংরেজরা তাঁকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে। ক্লাইভ যদি পরের দিন সত্যি সত্যি মুর্শিদাবাদের দিকে কুচ করেন, তাহলে তো ইংরেজদের আর নবাবকে বলে কয়ে তাঁকে ফৌজদার বানাবার কোনো মুখই থাকবে না। নবাবকে সব কথা জানালে বরং কিছু লাভ হতে পারে। নন্দকুমার নবাবের কাছে এতদিন, নানা খবর চেপে রেখেছিলেন। এবার তিনি মরিয়া হয়ে নবাবের কাছে সবকিছুই লিখে ফেললেন:
‘কাল (২২ এপ্রিল) মাঝরাতে কর্নেলের মুনশী আমার ও মথুরা মলের কাছে হাজির হয়ে, খবর দিল, কর্নেল আমাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তলব করেছেন। আমি আন্দাজ করলাম ফরাসীদের ব্যাপারে কথা বলতে ডেকেছেন, তাই মুনশীর মারফৎ খবর পাঠালাম—“আমার এখন ফুরসৎ হবে না, আমি আপনার৫৫ কাজে ব্যস্ত আছি। কাজ শেষ হলে যাবো।” কর্নেল মুনশীর মুখে এই খবর পেয়ে সকালের এক ঘণ্টা আগে আর একজন লোককে পাঠালেন। সে বলল, কর্নেল এবং আরো অনেকে বের হয়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে তাঁর কয়েকটা কথা বলবার আছে, আমি যেন একটুক্ষণের জন্য যাই। আমি আর মথুরা মল দেখলাম না গেলেই নয়, কর্নেল এর খারাপ মানে করতে পারেন, তাই আমরা রওনা হলাম এবং গিয়ে দেখলাম কর্নেল, মেজর, মিস্টার রজার ড্রেক এবং কাউন্সিলের অন্যান্যরা এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে সমস্ত সৈন্যবাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখছেন (তারা চন্দননগরের ময়দানে তলডাঙ্গি বাগানের উত্তরে জমায়েত হয়েছিল)। তাঁরা আড়াই ঘণ্টা ধরে এই খেলা দেখলেন। আমরা যেতে চাইলে তিনি আমাদের একটুক্ষণের জন্য ওঁর সঙ্গে বাগানের ভিতর যেতে বললেন। সেখানে গিয়ে উনি আমাদের আড়ালে ডেকে বললেন, আপনি এতদিন ওঁদের যা যা অনুগ্রহ করেছেন তা সব বাতিল করে মিস্টার ওয়াটস্ ও উকিলকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলেছেন তাঁরা যেন আর হুজুরের সাক্ষাতে না আসেন। এ থেকে ওঁর মনে হচ্ছে নবাব ওঁর শত্রুদের কথা শুনে চলেছেন। তাই উনি কাল কুচ করতে নবাবের কাছে যাবেন—এটা যেন আমি আপনাকে জানাই। হুজুরের সঙ্গে মিস্টার ওয়াট্সের কি হয়েছে মথুরা মল আর আমি কিছুই জানি না। তাই আমি নিজের অল্প বুদ্ধিতে যত দূর বুঝি এই উত্তর দিলাম—আপনার কাছ থেকে আমি যা যা পরোয়ানা পেয়েছি তার প্রত্যেকটিতে দিন দিন ওঁদের প্রতি আপনার অনুগ্রহ বেড়ে চলেছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে উনি কেন এমন হঠকারীর মত কাজ করতে চলেছেন? “ভগবানের কৃপায় নবাব আপনার জন্য যা যা করবেন বলেছেন তার সবই পূরণ হবে দেখবেন।” যদিও আমরা বার বার এই কথা বললাম, তবু তাঁর বিশ্বাস হল বলে মনে হল না।’৫৬
নন্দকুমার যে একটুও বাড়িয়ে বলেননি, মোহনলালের কাছে ক্লাইভের নিজের চিঠিতেই তা প্রমাণ হয়ে গেল। মোহনলাল তখনো দরবারে হাজিরা দেননি। ২৩ এপ্রিল ক্লাইভ অসুস্থ মোহনলালকে লিখলেন, ইংরেজদের উকিলকে তাড়িয়ে দিয়ে এবং মিস্টার ওয়াট্স্কে নানা হুমকি দেখিয়ে নবাব তাঁকে সাবধান করে দিয়েছেন। নবাব যদি সমস্ত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে চুক্তি বাতিল করা মনস্থ করে থাকেন, তবে তিনি এখনি সমস্ত ফৌজ জড়ো করে মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করবেন।৫৭ একই সঙ্গে নন্দকুমার ও ক্লাইভের চিঠি হরকরার হাতে মুর্শিদাবাদের দিকে চালান হয়ে গেল। ঐ দিন নবাবের চর মথুরা মলও মুর্শিদাবাদের গুপ্তচর বিভাগের তাঁর ওপরওয়ালা ‘বাবু সাহেবকে’ গোপনীয় চিঠি দিলেন। কাশিমবাজার থেকে নবাবের উপর আচমকা হানা দেবার জন্য যে সব জল্পনা-কল্পনা হচ্ছিল, সেই খবর কোনো ভাবে মথুরা মলের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। বাবুসাহেবকে মথুরা মল জানালেন:
‘এখানকার খবর আমি আপনাকে আগে দিয়েছি। এইমাত্র জানতে পারলাম কামান, বারুদ আর বন্দুকে বোঝাই এগারোখানা নৌকা কাশিমবাজার রওনা দিয়েছে। স্থলপথে দুজন তেলিঙ্গি যাচ্ছিল। তাদের কাছে জানলাম ৫০০ বাছাই সৈন্য আর ৫০০ তেলিঙ্গি এখান থেকে রাতের বেলা রওনা দেবে। শুনলাম, কাশিমবাজারের ৩০০ সিপাহি জমায়েত হয়েছে। তাই আপনাকে লিখছি, সদা সতর্ক থাকুন, আর সঠিক খবর আনার জন্য গোয়েন্দা লাগান। আপনি বিচক্ষণ লোক, ভরসা রাখি নবাবকে একথা জানাবেন। তিনি যেন দরজায় দিনরাত হাতিয়ার বন্দ পাহারাদার জোরদারভাবে মোতায়েন রাখেন। আমার কাছে কয়েকজন হরকরা পাঠাবেন। আমার কাজ আমি খুব মন দিয়ে করছি। এমন কিছু ঘটে না যার খবর আমি আপনাকে জানাই না। সবচেয়ে বেশি করে কাশিমবাজারের দিকে নজর রাখবেন, কারণ সেখানে রোজ সৈন্য আর সেপাই যাচ্ছে। আপনাকে সবকিছু জানানো আমার কর্তব্য, আমি যা যা ঘটছে সর্বদা আপনাকে লিখছি। আপনি রাজা দুর্ল্লভ রাম বাহাদুরের কাছে হরকরা পাঠাবেন যাতে তিনিও সাবধানে থাকেন; কারণ এখন সকলকে সব দিকে কড়া নজর রেখে তৈরি হয়ে থাকতে হবে, ঢিলে দিলে চলবে না। কড়া নজর রাখা খুবই দরকার। আপনি নবাবকে সাবধান করে দেবেন তিনি যেন নিজেকে খুব নিরাপদ না ভাবেন। আর যা যা হয় আমি আপনাকে জানাবো।’৫৮
ক্লাইভ নবাবের দেওয়া ক্ষতিপূরণের টাকা আনতে কাশিমবাজারে সেপাই ও গোলাবারুদ বোঝাই এগারখানা নৌকো পাঠিয়েছিলেন।
কাটোয়ার কাছে রায় দুর্ল্লভের দলবল এগারখানা নৌকোই আটক করল। নন্দকুমার ও মথুরা মলের চিঠি পেয়ে নবাব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। ঠিক ঐ সময় আহমদ শাহ আবদালি আফগানিস্তান ফিরে যাচ্ছেন শুনে তাঁর ভরসা বেড়ে গেল। ক্লাইভ খবর পেলেন নবাবের লোকেরা টাকা দিয়ে পাঠানদের ঠাণ্ডা করেছে।৫৯ এদিকে পাটনাতেও নরহত-সিমাইয়ের জমিদার কামগর খানের সঙ্গে রামনারায়ণের ঝগড়া অকস্মাৎ মিটে গেল। হাঁপ ছাড়বার ফুরসৎ পেয়ে নবাব এবার ওয়াট্সের ভাষায় ভারি ‘উদ্ধত’ হয়ে উঠলেন (‘upon this the Nabob is very uppish’)।৬০ রাগের মাথায় দরবারের মধ্যে আমীরচন্দকে অজস্র গালিগালাজ করে তিনি মীর জাফরকে হুকুম দিলেন, এই মুহূর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। এমন কি নবাবের নিজের তাঁবুও সারা দিনের জন্য শহরের বাইরে নিয়ে খাটানো হল। মঁসিয় ল’র কাছে জরুরী চিঠি গেল তিনি যেন তুরন্ত মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।৬১ কিন্তু সন্ধ্যার সময় ক্লাইভের একটা মোলায়েম চিঠি এসে পৌঁছল। আগেই বলা হয়েছে, ওয়াট্স্ ও স্ক্র্যাফটন দুজনেই ক্লাইভকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন বন্ধুত্বের ভান করে আপাতত নবাবকে ঠাণ্ডা রাখেন। সেই পরামর্শ পেয়ে ক্লাইভ তড়িঘড়ি সুর পাল্টে নবাবকে লিখলেন:
As I set great value on your friendship, any decrease I perceive in it gives me the highest concern. I can solemnly swear that I bear the best intentions towards you and your Government…
In the colonel’s own hand—Your behaviour to our vaequcel has given me great uneasiness; however that is over and forgotten. Trust me and I will be faithful unto you to the last…৬২
দ্রুতগামী কসিদের হাতে এই চিঠি নবাবের হাতে এসে পৌঁছল। চিঠি পড়ে ঠাণ্ডা হয়ে নবাব মঁসিয় ল’ এবং মীর জাফরের উপর হুকুম ফিরিয়ে নিলেন। ক্লাইভ ঠগ, জালিয়াত এবং মিথ্যাবাদী। কিন্তু আমীরচন্দের মতো ঝানু ব্যবসায়ীর পক্ষে যখন তাঁর চরিত্র তলিয়ে বোঝা সম্ভব হয়নি, তখন ভীতু, রাগী, অস্থিরমতি তরুণ নবাবের পক্ষে সে চরিত্রের মর্মোদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। কুচ করার হুকুম ফিরিয়ে নিয়ে নবাব ওয়াট্সের কাছে একজন লোক পাঠালেন (‘a low rascal to bully Watts’)।৬৩ স্ক্র্যাফটন সেখানে ছিলেন। লোকটি ওয়াট্স্কে বলল, ক্লাইভ যদি শিবির থেকে আর এক পা বেরোন, তাহলে লড়াই বেঁধে যাবে। তিনি তাঁর সৈন্যদের শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে যান, তাহলে নবাবও তাঁর ফৌজ মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনবেন। ওয়াট্স্ কথা দিলেন, নিশ্চয় কর্নেলকে তাই লিখবেন। আপাতদৃষ্টিতে নবাবের সঙ্গে ওয়াট্সের আবার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কিন্তু ওয়াট্স্ সাহেব এরই মধ্যে খোজা পেত্রস মারফৎ মীর জাফরের প্রস্তাব জানতে পেরে নিজের মন স্থির করে ফেলেছিলেন। ক্লাইভকে মীর জাফর—খোজা পেত্ৰস সংবাদ জানিয়ে তিনি লিখলেন—নবাব যদিও চুক্তি অনুযায়ী সব শর্ত পালন করছেন এবং তদনুযায়ী আমরা যা চাই তাই দিয়ে দিচ্ছেন, তবু জগৎশেঠ, রণজিৎ রায়, আমীরচন্দ এবং অন্যান্য সবাই একমত যে আপনার সৈন্যবাহিনী বা অ্যাডমিরালের জাহাজগুলি ফিরে গেলেই অথবা ফরাসীদের সাহায্য পাওয়া মাত্র তিনি আমাদের আক্রমণ করবেন। যদিও নবাব আমাদের তরফ থেকে সন্ধিভঙ্গ করার কোনো যুক্তি অবশিষ্ট রাখেননি, এমন কি ফরাসীদের ধরিয়ে দেওয়াটাও চুক্তি অনুযায়ী তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না, তবু আমাদের সাবধান হওয়া দরকার এবং আমার মতে মীর জাফরের প্রস্তাব অন্য প্রস্তাবটির৬৪ চেয়ে আরো কাজের (‘more feasible than the other I wrote about’)। মীর জাফর অনুরোধ করেছেন তাঁর প্রস্তাবে রাজি থাকলে আপনি যেন জানান আপনি কত টাকা, কত জমি চান এবং আপনারা কি কি শর্তে চুক্তি সম্পাদন করতে তৈরি আছেন। নবাবী ফৌজের প্রধান প্রধান জমাদারদের সঙ্গে সমঝোতা হয়ে যাবার আগে আমাদের বর্তমান কর্তব্য হচ্ছে চুপচাপ থেকে নবাবের সন্দেহ ভঞ্জন করা এবং কাশিমবাজার ও অন্যান্য কুঠি থেকে ধনরত্ন ও লোকজন সরিয়ে নেওয়া। পাঠানরা কাবুল ফিরে যাচ্ছে, নবাবেরও শহর থেকে বেরোবার কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই সেই জন্য আপনাকে আগে যা লিখতে বলেছিলাম তা লিখে আর লাভ নেই।
আমীরচন্দকে মিস্টার ওয়াট্স্ এত বিশ্বাস করতেন যে সব ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতেন। যদিও মীর জাফর খোজা পেত্রস মারফৎ প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, সে সংবাদ আমীরচন্দের কাছে গোপন রইল না। সংবাদ সংগ্রহ করতে স্ক্র্যাফটন আমীরচন্দের কাছে এসে হাজির হলেন। নবাবের ধমক খেয়ে আমীরচন্দের বুক তখন ধুকপুক করছে, তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন, কেউ আমাদের এক সঙ্গে দেখলে মহা বিপদ হবে। নবাব আমায় সন্দেহ করেন। আপনাকে তো আরো বেশি। হাজারী মলের কাছে আমি সব খবর পাঠাবো, আপনি সেখানে গিয়ে তাঁর কাছে সব জানতে পারবেন। স্ক্র্যাফটন তাঁকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, ষড়যন্ত্রের সবকিছু আমায় খুলে বলুন। আমীরচন্দ বললেন
‘না। ভগবান সাক্ষী রেখে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তাঁর কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে। তবে লতি (Luttee—মীর খুদা ইয়ার খান লতিফ) উপযুক্ত লোক নন—জগৎশেঠ যাঁকে পুরো সমর্থন করেন এমন আর একজন আছেন।’
‘এটা যদি সাব্যস্ত হয় তবে কি আপনি এর পিছনে পুরো মজুত থাকবেন?’
‘হ্যাঁ।
‘আমি কি তাহলে সোজা পাড়ি দেবো?’
‘না, তাহলে মহা শোরগোল হবে। কিছুতেই ঢাকা যাবেন না। এক দিন থাকুন, তারপর ডাঙা দিয়ে যান।’
‘জগৎশেঠ ঠিক লেগে থাকবেন তো?’
‘হ্যাঁ। তিনি তাঁর জেনানাদের পাঠিয়ে দেবার যোগাড়যন্ত্র করছেন। আপনি নিশ্চিত থাকুন তাঁর ফৌজের এক অংশ আপনাদের তরফে যোগ দেবে। আপনাদের শর্তগুলি হাজারীমলকে জানান। নবাবের ফৌজে অন্তত আধ লক্ষ লোক।’৬৫
স্ক্র্যাফটন ক্লাইভকে লিখলেন ‘আমার যাবার সময় এসেছে। ওয়াট্স্ আমায় ভারি হিংসা করছেন, ঠিক বিড়াল যেমন ইদুর দেখে আমি সেইরকম নজরবন্দী।’৬৬
ক্লাইভের মোলায়েম চিঠিতে ঠাণ্ডা হয়ে ফৌজ পাঠানো বন্ধ করলেও নবাব ২৩ তারিখে তাঁকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন, মঁসিয় ল’র পেছন পেছন ইংরেজ ফৌজ ধাওয়া করবে এটা তিনি বরদাস্ত করবেন না:
‘যারা দুর্বল বা আশ্রয় ভিক্ষা করেছে তাদের দুশমনের হাতে তুলে দেওয়া হিন্দুস্তানের রেওয়াজ নয়। মঁসিয় ল’-কে আমি সুবাহ্ থেকে বের করে দিয়েছি…তাঁর পিছনে আপনার ফৌজ পাঠানো কোনোমতে যুক্তিযুক্ত হবে না, কারণ বিহার সুবাহ্র জমিদাররা অত্যন্ত ঝগড়াটে আর বদমায়েশ। তাদের সঙ্গে আপনার মোকাবিলা হলে বিলক্ষণ অনিষ্ট হবে আর সারা সুবাহ্ জুড়ে পয়মাল হবে। দোস্ত হিসেবে আপনাকে সব জানালাম। …আল্লাহ্র মেহেরবানিতে আহমদ শাহ আবদালির সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হয়ে গেছে। বারে বারে খবর পাচ্ছি কুচ করতে করতে তিনি দিল্লী থেকে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তিনি পানিপত আর সোনপত পৌঁছে গেছেন। আবদালির ওয়াপস রফ্তান্ আমার পক্ষে যুদ্ধজয়ের সমান বলে আপনাকে এই সুসংবাদ জানালাম। ফরাসিদের পেছনে ফৌজ পাঠানো এক দম ঠিক হবে না। আজই খবর পেলাম মঁসিয় ল’ পাহাড়৬৭ পার হয়ে জোর কদমে কুচ করে চলে যাচ্ছেন। আপনার ফৌজ মুর্শিদাবাদ পৌঁছনর আগেই তারা করমনাশা৬৮ পার হয়ে যাবে। ফৌজ পাঠালে রিয়াগতের মুসীবৎ ছাড়া আপনার কোনো লাভ নেই। আপনি যদি তা করেন তবে সুলেনামার খেলাপ হবে।’৬৯
আবদালির আসার সম্ভাবনায় ক্লাইভ এতদিন উদগ্রীব ও উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিলেন। পাঠানদের ফিরে যাবার খবর শুনে তিনি বিমর্ষ বোধ করলেন। তাঁর মনে আশা জেগেছিল যে পাঠানরা এদেশে এলে নবাবের তখ্ৎ টলে যাবে, কারণ নবাবী ফৌজের তিন চতুর্থাংশই নবাবের বিপক্ষে। এখন সে সম্ভাবনা নির্মূল হয়ে যাওয়ায় তিনি বিষণ্ণচিত্তে পরিস্থিতির পুনর্বিচার করতে বসলেন। ভেবে চিন্তে তিনি স্থির করলেন যে সরকার বদল না হলে এদেশে শান্তিতে ব্যবসা করা যাবে না।৭০ মাদ্রাজে মিস্টার পিগটকে এ সব কথা জানিয়ে ক্লাইভ লিখলেন: ‘এই জন্য আপনাকে বলতে ভরসা পাচ্ছি তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন, যাঁদের পুরোভাগে আছেন জগৎশেঠ নিজে, এবং সেই সঙ্গে খোজা ওয়াজিদ। তাঁরা আমার সহায়তা কামনা করেছেন, এবং কোম্পানির প্রার্থিত সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিতে স্বীকৃত হয়েছেন। কমিটির৭১ মত হল, নবাবকে যদি বাগে আনা যায় তবে তৎক্ষণাৎ প্রার্থিত সাহায্য দেওয়া উচিত। আমার মনে হয় যত দিন এই দানবটা রাজত্ব করবে তত দিন শান্তি থাকবে না এবং নিরাপত্তাও থাকবে না।’
এদিকে নবাব মঁসিয় ল’-কে গোপনে লিখলেন, আপনি চুপচাপ রাজমহলে থাকুন। মঁসিয় বুসি বাহাদুর কটকে পৌঁছলে আপনাকে ডাকবো।৭২ রাজমহলের ফৌজদার মীর দাউদ খান (মীর জাফরের ভাই) নবাবের চিঠি খুলে পড়তেন, তাঁর কৃপায় সে সংবাদ ইংরেজদের গোচর হল।
পয়লা মে মীর জাফরের প্রস্তাব আলোচনা করবার জন্য সিলেক্ট কমিটির বৈঠক বসল। তাঁদের কার্য-বিবরণীতে তাঁরা লিপিবদ্ধ করলেন: ‘The Nabob is so hated by all sorts and degrees of men; the affection of the army is so much alienated by him by his ill usage of the officers, and a revolution so generally wished for, that it is probable that the step will be attempted (and successfully 100) whether we give our assistance or not.’ যেহেতু এমনিতেই বিপ্লব ঘটতে বাধ্য, সেহেতু চক্রান্তকারীদের সাহায্য না করে চুপচাপ দেখে যাওয়া রাজনীতির মস্ত ভুল চাল হবে। সুতরাং সিলেক্ট কমিটি মীর জাফরের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।৭৩
খোজা পেত্রস মারফৎ প্রস্তাব পাঠিয়ে মীর জাফর মুর্শিদাবাদে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। ওয়াট্স্কে তিনি বলে পাঠালেন—কিছুদিন চুপচাপ থাকুন, কাশিমবাজারে কোনো সৈন্যসামন্ত বা গুলি বারুদ আসতে দেবেন না, কারণ সব নৌকো তল্লাস করা হচ্ছে। কোনো নৌকোয় গুলি বারুদ বেরোলেই নবাবের হুকুম সে নৌকার সেপাই আর মাঝিমাল্লার নাক কান কেটে দেওয়া হবে। ক্লাইভ এ সব না জেনে ক্যাপ্টেন গ্রান্টকে কাশিমবাজার থেকে টাকা আনতে পাঠিয়েছিলেন। ওয়াট্স্ তাঁকে তড়িঘড়ি আসতে বারণ করে পাঠালেন, কিন্তু তার আগেই রায় দুর্ল্লভ ক্যাপ্টেন গ্রান্টের পথ আটকালেন।৭৪ সন্দিগ্ধ নবাব লোক পাঠিয়ে কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরী তল্লাস করিয়ে দেখলেন মথুরা মল কথিত পাঁচশ সৈন্য সেখানে নেই, আছে মোটে জনা চল্লিশ ফিরিঙ্গি আর কিছু বক্সরী।৭৫ ওয়াট্স্ বার বার ক্লাইভকে লিখতে লাগলেন সমস্ত ইংরেজ সৈন্য স্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যান, এবং স্ক্র্যাফটন মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দেবার সময় তাঁকেও সে কথা বলতে বলে রাখলেন।
নবাবের সন্দেহ নিরসন হল না। তিনি মীর জাফরকে দলবল নিয়ে পলাশীতে রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে যোগ দিতে হুকুম দিলেন। মীর জাফরের সঙ্গে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কালীপ্রসাদ সিংহের কাছ থেকে প্রাপ্ত খবরে কলকাতার বড়ো সাহেব রজার ড্রেক জানতে পারলেন, মীর জাফর নাকি কুচ করবার হুকুমের বিরুদ্ধে সমস্বরে আপত্তি জানিয়ে বলেছেন—নবাব আমায় একটুও জিরোতে দেন না, রিয়াসতের পয়মাল করে ছেড়েছেন, ব্যবসা বাণিজ্য সব নষ্ট, নবাবের বিরুদ্ধে আমি হাত তুলব, ইত্যাদি। খবর কতটা সত্য ড্রেকের নিজের একটু সন্দেহ ছিল।৭৬ কুচ করতে আপত্তি তুললে নবাব ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে যাবেন বুঝে মীর জাফর বাধ্য হয়ে ২৯ এপ্রিল পলাশীতে রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলেন। এর ফলে চক্রান্তে বাধা পড়ল। পলাশীর ছাউনিতে বসে মুর্শিদাবাদ দরবারে চক্র গঠন করা সম্ভব নয়। সেখান থেকে ফৌজের বড়ো বড়ো মনসবদার ও জমাদারদের কানে মন্ত্রণা দেওয়া যায় না, ইংরেজদের সঙ্গেও সর্বদা পরামর্শ করা যায় না। মীর জাফর অবশ্য কথাবার্তা চালানোর জন্য খোজা পেত্রসকে পেছনে রেখে গেলেন।
দরবারের পরিস্থিতি তখন এত ঘোরালো হয়ে উঠেছে যে বণিকপ্রবর খোজা ওয়াজিদ বেশ কিছু দিন ধরে ভাবছেন হুগলী চলে যাবেন। ৩ মে নন্দকুমারের সব আশায় ছাই নিয়ে নবাব শেখ আম্রুল্লাহ্কে হুগলীর ফৌজদার নিযুক্ত করলেন। ওয়াজিদ স্থির করলেন নতুন ফৌজদারের সঙ্গে হুগলী চলে যাবেন।৭৭ কিন্তু তা হল না। নবাবের কোপদৃষ্টিতে পড়ে ওয়াজিদ মুর্শিদাবাদে নজরবন্দী হয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। এর আগেই আমীরচন্দ নবাবের চোখ রাঙানি দেখে ভয়ে পাংশু হয়ে গিয়েছিলেন। নিজেকে বাঁচাতে তিনি এমন এক কূটচাল চাললেন যে তাতে জগৎশেঠের লোক রণজিৎ রায়ও ঘায়েল হলেন। নিজের প্রতি কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য আমীরচন্দ নবাবকে বলতে লাগলেন, হুজুর রণজিৎ রায় লোকটা আলিনগরে প্রতিশ্রুত ২০ হাজার মোহর আদায়ের জন্য বড়ো বাড়াবাড়ি করছে। ঐ মামলা আমার হাতে তুলে দিয়ে টাকাটা বাঁচান। নবাব মহা খাপ্পা হবার ভান করে রণজিৎ রায়কে চোখের সামনে থেকে দূর করে দিলেন। জগৎশেঠ বুঝলেন, আমীরচন্দ লোকটিকে আদপেই বিশ্বাস করা যাবে না।
৬ মে ওয়াট্সের কাছে খবর এল সিলেক্ট কমিটি মীর জাফরের প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন। মীর জাফর ইংরেজদের কত টাকা দেবেন সে হিসেব আপাতত ওয়াট্স্ ও আমীরচন্দের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। নবাবের চোখে ধুলো দিতে ক্লাইভ দরবারে খবর পাঠালেন, তাঁর সৈন্য তিনি সরিয়ে নিচ্ছেন এবং নবাবও যেন পলাশী থেকে তাঁর ফৌজ ফিরিয়ে নেন। ওয়াট্স্ দেখলেন, মীর জাফর খোজা পেত্রসকে বিশ্বাস করেন, আমীরচন্দকে তেমন নয়। তাই ওয়াট্স্ খোজা পেত্রসের সঙ্গে আলোচনা করে মীর জাফরের কাছ থেকে কত টাকা এবং, আর কি কি চাওয়া হবে, সে সব স্থির করলেন। শহরে বৃষ্টি পড়ছিল বলে ১২ তারিখের আগে খোজা পেত্ৰস পলাশীর ছাউনির দিকে বেরোতে পারলেন না। ১৪ মে তিনি পলাশী থেকে ফিরে এসে জানালেন, মীর জাফর সব শর্তে রাজি আছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, ষড়যন্ত্রের গুপ্তকথা যেন আমীরচন্দের কাছ থেকে একেবারে গোপন রাখা হয়। কারণ সেনাপতি তাঁকে আদপেই বিশ্বাস করেন না। সম্ভবত জগৎশেঠের কাছে খবর পেয়ে মীর জাফর আমীরচন্দ সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন।৭৮
ওয়াট্স্ আগেই বিশ্বাস করে আমীরচন্দকে মীর জাফরের গুপ্ত কথা বলে ফেলেছিলেন। এই চরম মুহূর্তে আমীরচন্দ বেঁকে বসলেন। তাঁর মনোভাব বুঝতে হলে মনে রাখা দরকার যে পলাশীর ষড়যন্ত্র দুই ক্ষেপে উদ্ভূত হয়েছিল। প্রথম ক্ষেপে আমীরচন্দ ছিলেন সর্বেসর্বা, দ্বিতীয় ক্ষেপে তাঁর কোনো হাত ছিল না। খুদাইয়ার খান-আমীরচন্দ-ওয়াট্স্ এবং মীর জাফর-রায় দুর্ল্লভ-খোজা পেত্রস-ওয়াট্স্, এই দুই চক্র আলাদা আলাদা গড়ে উঠেছিল। দুই চক্রের অন্তরালে জগৎশেঠ অদৃশ্য ভাবে অবস্থান করছিলেন। আমীরচন্দ শুধু প্রথম চক্রটিতে জড়িত ছিলেন। আমীরচন্দের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র একটা আনুমানিক ভবিষ্যৎ ঘটনার উপর নির্ভর করছিল। আমীরচন্দ সেই ঘটনা অনুমান করেছিলেন। সেটা হল আফগানদের পাটনা-মুর্শিদাবাদ আক্রমণ। পাঠান ফৌজ পাটনায় এলেই নবাবী ফৌজ মুর্শিদাবাদ থেকে বেরিয়ে যাবে, আর তৎক্ষণাৎ কাশিমবাজারে গোপনে জড়ো করা কিছু ইংরেজ সৈন্য ও তেলেঙ্গীর সহায়তায় মীর খুদা ইয়ার খান লতিফ দৌলতখানা দখল করে নিয়ে তখ্তে চড়ে বসবেন এবং সময়মতো আহমদ শাহ আবদালির সঙ্গে সমঝোতা করে নেবেন।
পাঠানরা না আসায় আমীরচন্দের চাল ভেস্তে গেল। এরই মধ্যে মীর জাফর রায় দুর্ল্লভরা খেলায় নামলেন। নবাবী ফৌজ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাবে না, এবং ইংরেজদের সরাসরি যুদ্ধে নামতে হবে, এটা ধরে নিয়ে তাঁদের নতুন ছক তৈরি করতে হল। কাশিমবাজার থেকে অতর্কিত হানা দেওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠায় ওয়াট্স্ সেখান থেকে সব টাকাকড়ি ও লোকলস্কর কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন যাতে নবাব কুঠি ঘেরাও করে কাউকে না পান। ঘুঁটি এইভাবে সাজানো হল যে ওয়াট্সের চিঠি পাওয়ামাত্র ক্লাইভ ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদ রওনা দেবেন, আর হয় ওয়াট্স্ মীর জাফরের শিবিরে গিয়ে যোগ দেবেন নয় মীর জাফর কাশিমবাজার কুঠি রক্ষা করার জন্য ফৌজ পাঠাবেন।৭৯ ক্লাইভ এই পরিকল্পনায় সায় দিয়ে জানালেন—‘আমি তৈরি আছি, আপনার চিঠি পাওয়ার বারো ঘণ্টার মধ্যে নয়া সরাইয়ে পৌঁছব, সেখানে কলকাতা থেকে মেজর কিলপ্যাট্রিক আমার সঙ্গে এসে যোগ দেবেন। তারপর সদলবলে মুর্শিদাবাদে রওনা দেব। মীর জাফরকে বলবেন কোনো ভয় নেই—এমন পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাবো যারা কখনো লড়াইয়ে পিঠ দেখায়নি। মীর জাফর যদি নবাবকে গ্রেফতার করতে নাও পারেন, আমরা এসে তাঁকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার শক্তি রাখি।’৮০
নতুন ছকে আমীরচন্দ আর মন্ত্রী নন, সামান্য বোড়ে। জগৎশেঠ আর মীর জাফরের ইচ্ছা নয় তাঁর সেই জায়গাটুকুও থাকে। মীর জাফরের সঙ্গে আমীরচন্দের কোনো পরিচয় ছিল না। তাঁকে তিনি যতটুকু জানতেন, তা মিস্টার ওয়াট্সের মাধ্যমে।৮১ আমীরচন্দ দেখলেন, এই বেলা সাবধান না হলে তিনি খেলা থেকে বাদ পড়ে যাবেন। রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে তাঁর একটু জানাশুনা ছিল। তিনি স্থির করলেন নবাবী ধনরত্ন নাড়াচাড়ার সময় মুর্শিদাবাদের দৌলতখানা থেকে যা ধনরত্ন মীর জাফরের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়, তার সিকি ভাগ রায় দুর্ল্লভকে দিয়ে বাকিটুকু নিজে হজম করবেন।৮২ ওয়াট্সের রসনায় এটা কটু ঠেকল। কিন্তু যে ঘটনায় তাঁর ও ক্লাইভের পিত্ত একেবারে উপচে পড়ল তা আরো অপ্রত্যাশিত। ওয়াট্সের কাছে আমীরচন্দ হঠাৎ এক নতুন বায়না করে বসলেন। তা হল এই যে মোট ধনরত্নের শতকরা পাঁচ ভাগ তাঁকে দিতে হবে। যাঁদের নিজেদের বিত্তবাসনা অপরিসীম তাঁরা আর একজনের মধ্যে সেই প্রবৃত্তির আভাস পেয়ে রীতিমতো চমকে গেলেন। ওয়াট্সের চিঠিতে উমিচাঁদ নবাবের মণিমুক্তার সিকি ভাগ এবং নবাবী দৌলতখানার শতকরা পাঁচ ভাগ (ওয়াট্সের হিসেব অনুযায়ী দ্বিতীয় খাতে উমিচাঁদের প্রাপ্তি ২ কোটি টাকার কম নয়)৮৩ নিজের জন্য দাবি করেছেন শুনে অ্যাডমিরাল ওয়াট্স্ন, কর্নেল ক্লাইভ, রজার ড্রেক এবং সিলেক্ট কমিটির অন্যান্য সাহেবরা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তাঁকে ‘স্কাউন্ড্রেল’ ‘ভিলেন’ ইত্যাদি সম্বোধনে ভূষিত করে তৎক্ষণাৎ স্থির করে ফেললেন, এই ‘হাড় পাজীটাকে’ উল্টো চালে ঠকিয়ে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।৮৪
সিলেক্ট কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে ক্লাইভ এক সাদা দলিল আর এক লাল দলিল তৈরি করলেন। লাল দলিলটা জাল, সেটা উমিচাঁদকে দেখাবার জন্য। তাতে উমিচাঁদের জন্য বিশ লক্ষ টাকা লেখা হল,৮৫ আসল চুক্তিতে সে অংক রইল না। সিলেক্ট কমিটির মেম্বাররা—মিস্টার ড্রেক, কর্নেল ক্লাইভ, মেজর কিলপ্যাট্রিক ও রিচার্ড বীচার (অপর সদস্য মিস্টার ওয়াট্স্ তখন মুর্শিদাবাদে)—দুই দলিলে দস্তখৎ করলেন। অ্যাডমিরাল ওয়াট্স্ন সিলেক্ট কমিটির সদস্য হতে রাজি হননি। কাউন্সিলের মেম্বার মিস্টার লাশিংটন অ্যাডমিরাল হিসাবে তাঁর সইয়ের জন্য দুখানা দলিলই নিয়ে গেলেন। সাধুপুরুষ বলে নিজের সম্বন্ধে অ্যাডমিরাল ওয়াট্স্নের অত্যন্ত উচ্চ ধারণা ছিল। এই ধারণা তিনি কদাচ গোপন করতেন না। লাল দলিলে দস্তখত করতে তিনি সদর্পে অসম্মত হলেন। কিন্তু তাঁর কথায় লাশিংটন বুঝলেন, সেখানা নিয়ে তাঁরা যা খুশি করুন না কেন তাতে তাঁর কোনো মাথা ব্যথা নেই। তখন লাশিংটন ক্লাইভের নির্দেশ অনুযায়ী অ্যাডমিরালের জ্ঞাতসারে তাঁর সই লাল দলিলে জাল করলেন, যাতে উমিচাঁদের মনে কোনো সন্দেহ না জাগে।৮৬
ধূর্ত শৃগালকে ধূর্ততর উপায়ে বঞ্চনা করায় উপায় নির্ধারিত হবার পর প্রশ্ন উঠল, সিংহের ভাগে কি পড়বে? ওয়াট্সের কথায় ইংরেজদের মনে ধারণা হয়েছিল, মুর্শিদাবাদের নবাবী দৌলতখানায় চল্লিশ কোটি টাকার ধনরত্ন সঞ্চিত আছে। এই অসম্ভব কল্পিত ধনের প্রভায় তাদের চোখ ঝক্ ঝক্ করে জ্বলতে লাগল। নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্ ইতিমধ্যেই কলকাতা লুঠের ক্ষতিপূরণের খাতে কোম্পানি ও কলকাতার ইংরেজ আরমানী ও হিন্দু বাসিন্দাদের টাকা মিটিয়ে দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ইংরেজরা স্থির করল, নবাব হয়ে মীর জাফরকে ক্ষতিপূরণ করতে হবে। কোম্পানির জন্য বরাদ্দ করা হল এক কোটি টাকা। এটা বড়ো সাহেবদের নিজেদের পকেটে যাবে না, অতএব ঐ অঙ্কের উপর তাঁরা বিশেষভাবে জোর দিলেন না। মীর জাফরের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তির ঐ অংশটুকু ফাঁকা রেখে ক্লাইভ ওয়াট্স্কে জানিয়ে দিলেন, মীর জাফর যদি ওজর আপত্তি তোলেন, তাহলে এক কোটির জায়গায় পঞ্চাশ লক্ষ লিখে দিলেই হবে।৮৭ কলকাতার বাসিন্দাদের সম্বন্ধে ওয়াট্সের প্রস্তাব ছিল, ইংরেজরা পাবে তিরিশ লক্ষ; হিন্দুরাও তিরিশ লক্ষ, আর আরমানীরা দশ লক্ষ। সিলেক্ট কমিটি তার বদলে স্থির করলেন—ইংরেজরা পাবে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দুরা বিশ লক্ষ, আরমানীরা সাত লক্ষ।৮৮ ‘ক্ষতিপূরণ’ ও ‘যুদ্ধের খরচ’ বাবদ এই সংশোধিত অঙ্কগুলি কোম্পানির বরাদ্দ সমেত চুক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। শুধু কোম্পানির বরাদ্দ অঙ্কটি নিতান্ত বিনয়বশে ফাঁকা রাখা হল যাতে মীর জাফর নিজের হাতে সেখানে তাঁর পছন্দমতো অঙ্ক বসাতে পারেন। চুক্তিখানা হাতে পাবার পর মীর জাফর কার্পণ্য না করে সেখানে এক কোটি টাকাই লিখলেন।
এই গেল কোম্পানির সঙ্গে মীর জাফরের লিখিত চুক্তির পাটিগণিত প্রকরণ। সর্বসমেত এক কোটি সাতাত্তর লক্ষ টাকা। কিন্তু লিখিত চুক্তির বাইরেও অঙ্কের গতি অবারিত। চুক্তিতে সই মেরে বড় সাহেবরা আসল কথায় এলেন। মিস্টার ওয়াট্সের প্রেরিত সংবাদ পেয়ে সিলেক্ট কমিটির মেম্বারদের ধারণা হয়েছিল, মীর জাফর উন্মুক্ত হাতে ইংরেজ ফৌজ, ইংরেজ নওয়ারা ও ‘অন্য অন্যদের’ টাকা দেবেন। রিচার্ড বীচার বুঝলেন, ‘অন্য’ ‘অন্য’ মানে উইলিয়াম ওয়াট্স্। মুর্শিদাবাদে বসে তিনি নিজের কোলে ঝোল টানছেন। বীচার সিলেক্ট কমিটির সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। কমিটির অন্যান্য প্রবীণ সদস্যরা মনে মনে যা চাইছিলেন, তিনি সেই প্রশ্ন মিটিং-এ তুললেন। তিনি বললেন, ফৌজ আর নওয়ারার সাহেবরা যদি নতুন নবাবের কাছ থেকে পুরস্কার পান, তবে যে সাহেবরা এই রাজকীয় ব্যাপারের উদ্যোক্তা, তাঁরা কেন বাদ পড়েন? সিলেক্ট কমিটিই গোটা যন্ত্রের চালক। ‘সুযুক্তি’ ও ‘শোভনতা’র খাতিরে (‘reasonableness and propriety’) সিলেক্ট কমিটি সাহেবদেরও মীর জাফরের মনে রাখা উচিত।৮৯ দেখা গেল, এ ব্যাপারে সবাই একমত। তখন ক্লাইভ ওয়াট্স্কে লিখলেন: “The Committee having taken the oath of secrecy upon the Bible, have agreed that Mir Jaffeir’s private engagements be obtained in writing to make them (the Committee, in which you are included) a present of 12 lack of rupees, and a present of 40 lacks to the army and navy over and above what is stipulated in the Agreement. ’৯০
অর্থাৎ চুক্তিতে লিখিত এক কোটি সাতাত্তর লক্ষ টাকা ঢেলেই মীর জাফর খালাস হবেন না। আলাদা করে আরো ৫২ লক্ষ টাকা তাঁকে ঢালতে হবে। বজ্র আঁটুনিতে যাতে কোনো ফস্কা গেরো না থাকে এই জন্য হবু নবাবকে এটা ওয়াট্সের কাছে লিখিত ভাবে অঙ্গীকার করতে বলা হল! এ কাজে ওয়াট্স্ যাতে ঢিলে না দেন তাই তাঁকে তাঁর নিজের অংশের কথা মনে করিয়ে দিতেও ক্লাইভ ভুললেন না। বিস্ময়ের কথা এই যে পরবর্তীকালে পার্লামেন্টের কাছে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ক্লাইভ ও বীচার এই ৫২ লক্ষ টাকার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে পার্লামেন্টকে বুঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে সিলেক্ট কমিটির পুরস্কারের জন্য মীর জাফরের কাছে ওকালতি করতে গিয়ে তাঁরা কোনো বিশেষ অঙ্কের উল্লেখ করেননি। শুধু সিলেক্ট কমিটির ‘যুক্তিবহ ও শোভন’ দাবিটির কথা তাঁরা নাকি মীর জাফরকে মৃদুভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে সরকারী কাগজপত্রে বা সিলেক্ট কমিটির মিনিট বইয়ে ঐ ৫২ লক্ষ টাকার কথা কোথাও লিখিতভাবে থাকবে না বলে স্থির করা হয়েছিল। কারণ এই টাকাটা নিতান্ত ‘বেসরকারী’ নজরানা, সরকারী কাগজে উল্লেখের অনুপযুক্ত। বলা বাহুল্য, টাকাটা কোম্পানির তহবিলে না গিয়ে বড়ো সাহেবদের পকেটে ঢুকবে বলেই এত সাবধানতা আর সূক্ষ্ম বিচার বোধ।
নিজেকে যিনি নির্লোভ সততার মূর্ত অবতার বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই অ্যাডমিরাল ওয়াট্স্ন যখন শুনলেন সিলেক্ট কমিটি নিজেদের বরাদ্দ নির্ধারণ করে নিয়েছেন, তখন তিনি ঐ বরাদ্দের অংশীদার হতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু সিলেক্ট কমিটির সাহেব একবাক্যে বললেন, অ্যাডমিরাল ওয়াট্সন তো সিলেক্ট কমিটির সদস্য নন! তা ছাড়া নওয়ারার খাতে তাঁর জন্য তো আলাদা বরাদ্দ রয়েইছে। ওয়াট্সনের সমান ভাগীদার ক্লাইভও সিলেক্ট কমিটির অন্য সাহেবদের সঙ্গে সায় দিলেন। তবে বালেশ্বরের উপকূলে সমান সমান বখরার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে চক্ষুলজ্জার বশে তিনি প্রস্তাব রাখলেন, সবাই নিজের নিজের ভাগ থেকে ওয়াটসনের জন্য কিছু টাকা যদি তুলে দেন, তবে তিনিও তাঁর উচিত অংশ অনুযায়ী চাঁদা দান করবেন।৯১
আমীরচন্দকে লোভী বদনাম দিয়ে যাঁরা সাধু সাজলেন, তাঁদের নিজেদের লোভের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। এই সব লোক যে সাম্রাজ্য গঠনের কথা চিন্তা না করে নিজ নিজ ধনদৌলত বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি আবদ্ধ রাখবেন, সেটা আশ্চর্য নয়। মীর জাফরকে দিয়ে তাঁরা যে চুক্তি লিখিয়ে নিলেন, তাতে ইংরেজ কোম্পানিকে নবাবী রিয়াসতের অংশীদার বানানোর একটা কথাও রইল না। তা যদি হত, তাহলে মীর জাফর ও অন্যান্য মনসবদাররা ইংরেজদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক পাতাতে অত উদগ্রীব হতেন না। তাঁদের কাছে ইংরেজরা পেশাদার সৈন্য মাত্র, যাদের প্রয়োজন মতো টাকা দিয়ে লড়াই করিয়ে নেওয়া যায়। কোম্পানি বাহাদুর যে কালক্রমে সরকার বাহাদুর বনে যেতে পারে সে ভাবনা তখনো উদয় হয়নি, কারণ কোম্পানির ডিরেক্টররা যুদ্ধবিগ্রহে ও রাজকার্যে জড়িয়ে পড়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং অকুস্থলে ইংরেজরা শাসনযন্ত্র কব্জা করার কথা চিন্তা না করে নিজ নিজ ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। নবাব হবার জন্য তাদের মুক্ত হস্তে টাকা দিতে মীর জাফরের কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু তাদের তখ্তের অংশীদার করতে তিনি উৎসুক ছিলেন না। বস্তুতপক্ষে বাদশাহ ফার্রুকশিয়ারের ফারমান এবং সিরাজের সঙ্গে আলিনগরের সুলেনামা অনুযায়ী কোম্পানির যা যা প্রাপ্য ছিল, তার বাইরে একটা দাবিও ইংরেজরা তোলেনি। মীর জাফরের সঙ্গে ওয়াট্সন, ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটির গোপন চুক্তিতে কোনো অভিনব শর্ত ছিল না। চুক্তির ফারসী বয়ানে মীর জাফর ওয়াট্সের সঙ্গে পরামর্শ করে যা যা লিখেছিলেন তা একবার পড়লেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চুক্তির শিরোভাগে মীর জাফর নিজের হাতে লিখেছিলেন:
‘আল্লাহ্ আর রসুলাল্লাহ্র কসম, জিন্দা থাকতে আমি এই করারের কোনো শর্ত খেলাপ করব না।’
তার নীচে মুনশীর হাতে নিম্নোক্ত শর্তগুলি ফার্সীতে লেখা ছিল:
১। নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্র সঙ্গে আহাদনামার ওক্তে যে যে ওয়াদা করা হয়েছিল সেগুলি মেনে চলবো।
২। ইংরেজদের দুশমনরা আমার দুশমন, তারা ফিরিঙ্গিই হোক বা হিন্দুস্তানীই হোক।
৩। সুবাহ্ জিন্নাত-উল-বিলাদ বাংগালাহ্, বিহার আর ওড়িশার ফরাসিসদের যত কুঠি আর মাল আছে সব ইংরেজদের দখল হবে, এবং এই তিন সুবাহ্য় আমি তাদের আর কখনো আড্ডা গাড়তে দেবো না।
৪। কলকাতা দখল আর লুঠের খাতে ইংরেজ কোম্পানির যত লোকসান হয়েছে আর ফৌজ মোতায়েন করতে যত খরচ হয়েছে সেই খাতে তাদের এক কোটি রূপাইয়া দেওয়া হবে।
৫। কলকাতার ইংরেজ বাসিন্দাদের মাল লুঠের খাতে পঞ্চাশ লাখ রূপাইয়া দেওয়া হবে।
৬। কলকাতার হিন্দু, মুসলমান আর আর বাসিন্দাদের মাল লুঠের খাতে বিশ লাখ রূপাইয়া দেওয়া হবে।
৭। কলকাতার আরমানী বাসিন্দাদের মাল লুঠের খাতে সাত লাখ রূপাইয়া দেওয়া হবে। কলকাতার ইংরেজ, হিন্দু, মুসলিম আর আর বাসিন্দার পাওনা টাকা বাটোয়ারা করবেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, কর্নেল ক্লাইভ, রজার ড্রেক, উইলিয়াম ওয়াট্স্, জেমস কিলপ্যাট্রিক এবং রিচার্ড বীচার—তাঁরা যাকে দুরস্ত মনে করবেন তাকে দেবেন।
৮। কলকাতা ঘিরে যে গড়খাই আছে তার ভিতরে আর আর জমিদারের জমি আর. সে ছাড়া গড়খাইয়ের বাইরে ৬০ গজ পর্যন্ত জমি ইংরেজ কোম্পানিকে দেওয়া হবে।
৯। কলকাতা দক্ষিণে কলপি পর্যন্ত সমস্ত দেশ ইংরেজ কোম্পানির জমিদারীর মতালক হবে, আর এইসব জায়গার মুৎসুদ্দিয়ান কোম্পানির হুকুমতের হুকুম মোতাবেক হবে। আর আর জমিদারের মালগুজারী মোতাবেক ইংরেজ কোম্পানিও মালগুজারী দাখিল করবে।
১০। যখন যখন আমি ইংরেজদের মদত চাইবো, তখন তখন আমি তাদের ফৌজের খরচ বহন করবো।
১১। গঙ্গা নদীর কিনারায় হুগলী বন্দরের উজানে আমি নতুন কোনো কেল্লা বানাবো না।
১২। তিন সুবাহ্ গদিতে বসবামাত্র আমি বিশ্বস্ত ভাবে উপরোক্ত টাকা মিটিয়ে দেবো।৯২
চুক্তি পড়লেই বোঝা যায়, এর পুরো ঝোঁক টাকার উপরে। শুধু মাত্র এই ভিত্তিতে নবাব মীর জাফরের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হলে, কোম্পানির হাতে দেশের কর্তৃত্ব বর্তাত না। মীর জাফর সত্যিকারের নবাব হবার অভিপ্রায়ে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তাঁর এমন উদ্দেশ্য ছিল না যে কোম্পানি কর্তৃত্ব করবে আর তিনি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে মসনদে বসে থাকবেন। ইংরেজদের সঙ্গে তিনি যে গোপন চুক্তি সম্পাদন করেন, তা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাতে নবাবী রিয়াসতের কাঠামোয় কোনো অদলবদলের ইঙ্গিত নেই। সমগ্র রাজকর্তৃত্ব নবাব ও তাঁর মনসবদার, মুৎসুদ্দিয়ান ও আমলাদের হাতে থাকল, কেবল কোম্পানির হাতে এককালীন টাকা এল। কোনো সুবৃহৎ ভূখণ্ড ও তার রাজস্বের উপর কোম্পানির স্থায়ী স্বত্ব জন্মাল না। কলকাতার আশেপাশে যে বাদা ও জঙ্গলের উপর কোম্পানির জমিদারী বর্তাল, তার আয় এমন কিছু বেশি নয় এবং সে টাকায় বড়ো আকারের ফৌজ মোতায়েন রাখাও সম্ভব নয়। আসল কথা এই যে তখন পর্যন্ত দেশের মাটি ও তার শাসনযন্ত্রের উপর কায়েমী স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করা ইংরেজ কোম্পানির পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। কলকাতার আশেপাশের জমিদারী, বিনামাশুলে বাণিজ্য করবার অধিকার, এবং কলকাতায় টাঁকশাল বানাবার অনুমতি—এসব সুযোগ সুবিধার একটিও নতুন নয়। সিরাজউদ্দৌলাহ্র সঙ্গে আলিনগরের সুলেনামায় এই সবকটি সুবিধা কোম্পানি আগেই পেয়ে গিয়েছিল। তাই চুক্তিতে কলকাতার টাঁকশাল আর বিনা মাশুলের উল্লেখ পর্যন্ত প্রয়োজন হল না—শুধু আলিনগরের সুলেনামা মেনে চলার শর্তই যথেষ্ট বিবেচনা করা হল। দু পক্ষ এই ভেবে চুক্তি সম্পাদন করল যে এক নবাবের জায়গায় আর এক নবাব আসার পর নবাবী রাজপুরুষরা পূর্ববৎ দেশ শাসন করবেন আর ইংরেজরা বাদশাহী ফারমান অনুযায়ী অবাধে বাণিজ্য করতে পারবে।
কিছুদিন থেকে আমীরচন্দ আঁচ পাচ্ছিলেন, গতিক সুবিধার নয়। যদি কিছু আদায় করতে হয় তবে এই বেলা সিরাজউদ্দৌলাহ্র কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে, কারণ পরে তাঁর কপালে কি জুটবে কিছুই বলা যায় না। মিস্টার ওয়াট্স্ ও খোজা পেত্ৰসের বারণ না শুনে ১৬ মে তিনি একা নবাবের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে বললেন, হুজুর আমার কাছে এমন একটা গোপনীয় খবর আছে যা জানাজানি হয়ে গেলে আমার জান যাবে। নবাব বললে, কেউ জানবে না, কোনো ভয় নেই। তখন আমীরচন্দ বললেন, ইংরেজরা গঞ্জামে দুজন সাহেব পাঠিয়ে দিয়ে মঁসিয়ে বুসীর সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে ফেলেছে। বুসী দলবল নিয়ে ইংরেজদের মদত দিতে আসছেন। এত বড়ো গুপ্ত সংবাদ শুনে আমীরচন্দের উপর নবাবের আবার আস্থা জন্মাল। তিনি হুকুম দিলেন, কলকাতা লুঠের সময় আমীরচন্দের যা টাকা আর মাল খোয়া গিয়েছিল তা এখনি তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এছাড়া বর্ধমানের রাজার উপর নবাব পরোয়ানা পাঠালেন, আমীরচন্দের কাছে তিনি যে চার লক্ষ টাকা ধার করেছেন, কোনো ওজর আপত্তি না তুলে তা শোধ করে দিতে হবে। নিজেকে সবদিক থেকে বাঁচাবার জন্য আমীরচন্দ সমস্ত ঘটনা ওয়াট্স্কে গিয়ে বলে এলেন। ওয়াট্স্ এর আগে উমিচাঁদের মতলব শুনে তাঁকে বার বার মানা করেছিলেন। মানা না শুনে উমিচাঁদ নিজের স্বার্থ সাধনের জন্য নবাবকে ভারি চমকে দিয়েছেন দেখে ওয়াট্স মনে মনে রাগে জ্বলতে লাগলেন, আর মুখে হাসি এনে ভারি অমায়িক ব্যবহার করতে লাগলেন। আমীরচন্দের কীর্তির ফল হল এই যে, নবাব ইংরেজদের উপর সন্দিহান হয়ে মীর জাফর আর রায় দুর্ল্লভকে পলাশীর ময়দানে মোতায়েন রাখলেন। তাঁরা দরবারে না ফেরায় চক্রান্ত সম্পূর্ণ করতে গিয়ে বাধা পড়ল।৯৩
তখন ক্লাইভ একটা মতলব ঠাউরালেন। কয়েকদিন আগে কলকাতায় পেশোয়া বালাজী বাজী রাওয়ের এক দূত এসে প্রস্তাব রেখেছিল যে ইংরেজরা রাজি থাকলে সত্তর হাজার মারাঠা বাংলায় এসে তাদের সাথে নবাবের বিরুদ্ধে যোগ দিতে তৈরি আছে। তখন বর্ষা এসে পড়েছে। বর্গিদের আসা প্রায় অসম্ভব। ক্লাইভের মনে একটা সন্দেহ হল। এ লোকটা নবাবের ছদ্মবেশী চর নয়তো?৯৪ তিনি ঠিক করলেন স্ক্র্যাফটনের হাতে পেশোয়ার প্রস্তাবখানা সরাসরি নবাবের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন। প্রথমত নবাবের মনে আস্থা জন্মাবে যে ইংরেজদের মনে কোনো বদ মতলব নেই। তখন তিনি পলাশী থেকে ফৌজ সরিয়ে নেবেন। আর দ্বিতীয়ত নবাবের সন্দেহ উদ্রেক না করে স্ক্র্যাফটন মুর্শিদাবাদে যাবার পথে পলাশীর ছাউনিতে মীর জাফরের সঙ্গে গোপনীয় কথাবার্তা চালাতে পারবেন। দু পক্ষের সামরিক পরিকল্পনা সমন্বয় করার এমন এক সুবর্ণ সুযোগ মিলবে যা মুর্শিদাবাদে নজরবন্দী ওয়াট্স্ কখনোই পাবেন না।৯৫
মীর জাফর কবে কোথায় কেমন ভাবে লড়াইয়ে নামবেন তা না জেনে ক্লাইভ এক পাও এগোতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি স্ক্র্যাফটনকে বলে রাখলেন, তিনি যেন অবশ্যই পলাশীর ছাউনিতে থেমে মীর জাফরের সঙ্গে লড়াইয়ের সলা-পরামর্শ করে নেন। স্ক্র্যাফটন ক্লাইভের আদেশ পালন করার সুযোগ পেলেন না। নবাবের চররা তাঁকে ছাউনিতে সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে না দিয়ে সোজা মুর্শিদাবাদ নিয়ে চলল। ২৫ মে সকালে দরবারে পৌঁছে স্ক্র্যাফটন দেখলেন, নবাবের সঙ্গে তাঁর গোয়েন্দা নারায়ণ সিংহ, আলিনগরের পলাতক কেল্লাদার মাণিকচন্দ আর স্বয়ং জগৎশেঠ মহতাব রায় অপেক্ষা করছেন। ক্লাইভের চিঠি পড়ে নবাব ভাব দেখালেন যেন ভারি খুশি হয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগলেন, সাবিৎ জঙ্গ কি সত্যি সত্যি বন্ধুত্ব চান? তখন স্ক্র্যাফটন বিগলিতভাবে নবাবের হাতে বালাজী বাজী রাওয়ের চিঠিখানা তুলে দিলেন। চিঠি পড়ে নবাব যেন বড়ো আশ্বস্ত হয়েছেন এমন ভাবে উচ্চৈঃস্বরে সাবিৎ জঙ্গের ইমানদারীর প্রশংসা করতে লাগলেন। সম্মুখে দণ্ডায়মান ওয়াট্স্ ও স্ক্র্যাফটনকে তিনি ভারি প্রসন্নভাবে বললেন, তাঁর ফৌজ তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনছেন, আর তিনি এই আশাও রাখেন যে বর্ষা শেষ হলেই ইংরেজদের নওয়ারা আর ফৌজ যথা শীঘ্র সম্ভব এই সুবাহ্ ছেড়ে দেবে।
সত্যি সত্যি পলাশী থেকে ফৌজ ফিরিয়ে আনার হুকুম জারী করে নবাব দুই ইংরেজ রাজদূতকে আলিনগরের সুলেনামা মোতাবেক তামাম বকেয়া পাওয়ার জন্য দেওয়ান মোহনলালের (তিনি সম্ভবত তখনো দরবারে হাজিরা দেবার মতো সুস্থ হননি) কাছে যেতে বললেন। মোহনলাল তাদের সব বকেয়া মিটিয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। কিন্তু এক শর্ত রইল, রসিদ না পাওয়া পর্যন্ত সব কিছু মেটানো সম্ভব হবে না। ইংরেজরা আগে রসিদ লিখে দিক যে তাদের প্রাপ্য সব মিটে গেছে। তাঁর এই চালে ইংরেজরা ভারি ফাঁপরে পড়ল।৯৬ ওয়াট্স্ খবর পেলেন, কিছু দিন আগে নবাব অযোধ্যার সুজাউদ্দৌলাহ্র কাছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করে দূত পাঠিয়েছেন, আর সুজাউদ্দৌলাহ্র ফৌজ নাকি শীগগিরই রওনা দেবে। খোজা ওয়াজিদের কাছে ওয়াট্স্ জানতে পারলেন, মঁসিয় বুসী নবাবকে লিখে দিয়েছেন তিনি আসতে পারছেন না।৯৭ মীর জাফরের সঙ্গে গোপন চুক্তি যাতে তাড়াতাড়ি সই হয়, সেইজন্য ওয়াট্স্, স্ক্র্যাফটন ও ক্লাইভ ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এদিকে পলাশীর ছাউনিতে রাজা দুর্ল্লভরাম বাহাদুর, মীর মহম্মদ জাফর খান বাহাদুর ও মীরমদনের কাছে শহরে ফিরবার পরোয়ানা গেল। ৩০ মে মীর জাফর মুর্শিদাবাদ ফিরলেন। এখন আর তাঁকে নবাবের দরকার নেই। সেলাম জানাতে গিয়ে সেনাপতি দেখলেন নবাবের চক্ষু রক্তবর্ণ। তিনি শঙ্কিত হয়ে গৃহে ফিরলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য স্ক্র্যাফটন এতদিন মুর্শিদাবাদে বসেছিলেন। পরের দিন সকালে সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন নিভৃত সাক্ষাৎকারের কোনো সুযোগ নেই। নবাবের ভয়ে মীর জাফর তাঁকে সর্বসমক্ষে অভ্যর্থনা করে দুটো মামুলি কথা বলে বিদায় দিলেন।৯৮ লড়াইয়ের কায়দা আলোচনা না করেই তাঁকে মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দিতে হল। যাবার সময় তিনি আমীরচন্দকে নিয়ে গেলেন। আমীরচন্দের যাবার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ওয়াট্স্ আশঙ্কা করছিলেন, উমিচাঁদ দরবারে থাকলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তাই স্ক্র্যাফটন তাঁকে বোঝালেন, তিনি মোটা মানুষ, যুদ্ধ বেধে গেলে ঘোড়ায় চড়ে চটপট পালাতে পারবেন না। তাঁর পক্ষে এইবেলা মানে মানে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এ যুক্তি অকাট্য। নবাবের পরোয়ানা অনুযায়ী তাঁর সমস্ত প্রাপ্য যদিও তখন পর্যন্ত মেটানো হয়নি, তবু তিনি অনিচ্ছাভরে স্ক্র্যাফটনের সঙ্গে চললেন।
ওয়াট্স্ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তাঁর সন্দেহ হয়েছিল, উমিচাঁদের অনিচ্ছার আসল কারণ লোকটা রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে যোগসাজস করা পর্যন্ত সবুর করে যেতে চায়, যাতে সে গোপনে নবাবী দৌলতখানার ধনরত্ন সরিয়ে ফেলতে পারে। দুর্ল্লভরাম তখনো পলাশীর ছাউনি থেকে ফেরেননি। ওয়াট্স্ এতে ভারি উৎকণ্ঠিত বোধ করছিলেন। স্থির ছিল মীর জাফরের সই সহ চুক্তিপত্র নিয়ে স্ক্যাফটন ক্লাইভের কাছে ফিরবেন। কিন্তু রায় দুর্ল্লভ শহরে না ফেরায় সেটা সম্ভব হল না। রায় দুর্ল্লভ ফৌজের একটা বড়ো অংশের সেনাপতি এবং মীর জাফরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে মীর জাফর চুক্তিপত্রে সই করতে রাজি হলেন না।৯৯
ভর সন্ধ্যায় স্ক্র্যাফটন উমিচাঁদকে বগলদাবা করে শহর থেকে বাইরে এসে পড়লেন। পালকী কাশিমবাজার পৌঁছলে দেখা গেল উমিচাঁদ নেই। শহরে লোক পাঠানো হল। তারা গিয়ে দেখল বুড়োটা বকেয়া পাওনার জন্য নবাবী তোষাখানায় মোহনলালের কাছে ঝুলোঝুলি করছে, আর দেওয়ানজী তাঁকে ফাঁকা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। রাত দুটোর সময় লোকগুলোর সাথে আমীরচন্দ স্ক্র্যাফটনের কাছে ফিরলেন। আবার পালকী চলল। দুলুনিতে স্ক্র্যাফটনের তন্দ্রা এসে গেল। ভোরবেলা চমকে জেগে উঠে তিনি দেখলেন, উমিচাঁদ নেই। বুড়ো কোথায় গেছে বুঝতে না পেরে তিনি রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেলা তিনটের সময় দেখা গেল আমীরচন্দ আসছেন। তিনি পলাশীর ময়দানে গিয়ে রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে চার ঘণ্টা ধরে কি সব কথাবার্তা কয়ে এসেছেন, বার বার জেরা করেও কিছু বোঝা গেল না। বুঝলেন ওয়াট্স্ দুদিন বাদে। যেতে যেতে আমীরচন্দ স্ক্র্যাফটনকে চুক্তির শর্ত সম্বন্ধে সন্দিগ্ধভাবে জেরা করতে লাগলেন। তাঁর প্রশ্ন, রায় দুর্ল্লভ কেন আমীরচন্দের বখরার কথা কিছু জানেন না? স্ক্র্যাফটন সত্যি কথা বলে হতভাগাকে নিরস্ত করলেন: জানবেন কি করে, মীর জাফরের হাতেই সিলেক্ট কমিটির সংশোধিত দলিল পৌঁছয়নি, আর রায় দুর্ল্লভ তো এখনো ছাউনিতে। আমীরচন্দ সময়মতো পৌঁছলে ক্লাইভ তাঁকে বড়ো অমায়িকভাবে অভ্যর্থনা করে এমন ভাব দেখাতে লাগলেন যেন উমিচাঁদের মতো বন্ধু তাঁর কেউ নেই।১০০
২ জুন বিকেল পাঁচটায় রায় দুর্ল্লভ অবশেষে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন, সঙ্গে মীরমদন। মীরমদনের কাছে কোনো কথা ভাঙা হয়নি। মীর জাফরের কাছে রায় দুর্ল্লভ যখন শুনলেন ফিরিঙ্গিরা আড়াই কোটি টাকা চাইছে তখন তাঁর দুই চক্ষু স্থির হয়ে গেল। নবাব হবার আগ্রহে অধীর মীর জাফর অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ইংরেজরা যত টাকা চাইছে তত টাকাই দিতে অঙ্গীকার করে ফেলেছিলেন। কিন্তু রায় দুর্ল্লভ নিজামতের দেওয়ান, তাই তোষাখানায় কত টাকা আছে সে সম্বন্ধে তাঁর একটা মোটামুটি সঠিক আন্দাজ ছিল। তিনি বলতে লাগলেন, দৌলতখানায় অত টাকাই নেই, কোথা থেকে আড়াই কোটি টাকা আসবে?১০১ তার বদলে তিনি প্রস্তাব দিলেন, নবাব মরলে যা টাকা তাঁর ও মীর জাফরের হাতে আসবে, ইংরেজরা তার অর্ধেক নিক।
রায় দুর্ল্লভ বাগড়া দিচ্ছেন দেখে, মিস্টার ওয়াট্স্ ভারি মুষড়ে পড়লেন। ৩ জুন তিনি ক্লাইভকে লিখলেন—‘মীর জাফরের সঙ্গে আমাদের সাজশ (scheme) ভেস্তে গেছে এবং এমন ভাববার কারণ ঘটেছে যে পলাশীতে রায় দুর্ল্লভের সঙ্গে উমিচাঁদের চার ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারই এর জন্য দায়ী।…রায় দুর্ল্লভ যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা উমিচাঁদ কিছুদিন আগে আমার কাছে যে প্রসঙ্গ তুলেছিল তার সঙ্গে প্রায় এক। তাকে যদি আপনি ভালোভাবে জেরা করেন তাহলে মনে হয় দেখতে পাবেন যে এটা তার আর রায় দুর্ল্লভের যোগসাজশে ষড়যন্ত্র। তা যদি হয়, আর রায় দুর্ল্লভ যদি আমাদের জন্য যা যোগাড় করবেন তার উপর কমিশন চান, অথবা আমাদের পাওনার একটা ভাগ দাবি করেন, তাহলে বোধ করি তাতে রাজি হয়ে যাওয়াই কোম্পানির ও সর্বসাধারণের পক্ষে যথেষ্ট সুবিধাজনক হবে, কারণ সব শুনে মনে হয় নবাবের অন্তত চল্লিশ কোটি টাকা আছে। মীর জাফরকে দেখে মনে হয় তিনি রায় দুর্ল্লভের হাতের পুতুল মাত্র, অতএব ওঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারলে এখনো সবকিছু ভালোভাবে সমাধা হতে পারে। মীর জাফর তাঁর দলে যত জমাদার আছে বলে বড়াই করছিলেন, দেখছি তত নেই। কাল তাঁকে বরখাস্ত করা হবে আর খোজা হাদিকে বকশী নিয়োগ করা হবে। আমরা বড়ো জোর এই আশা করতে পারি যে ওঁরা নিরপেক্ষভাবে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের ফলাফল দেখবেন। আমরা জয়ী হলে ওঁরা তার ফল পাবেন, আর নইলে যেন আমাদের সঙ্গে ওঁদের কোনো যোগ নেই এমনভাবে পূর্ববৎ চলবেন। যদি আপনি মনে করেন আপনি যথেষ্ট শক্তিমান, তাহলে আমার মতে আমাদের নিজেদের উপর নির্ভর করাই সবচেয়ে ভালো, এবং এমন কতকগুলি অস্থির, মিথ্যাবাদী, দুর্বলচিত্ত হতভাগার (‘a set of shuffling lying, spineless wretches’) সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সম্পর্কের মধ্যে যাবার দরকার নেই।’
মিস্টার ওয়াট্স্ সহজে দমবার পাত্র নন। তিনি রায় দুর্ল্লভ ও মীর জাফরের কাছে দূত মারফত ঐ দিনই প্রস্তাব দিলেন, তাহলে আধাআধিতেই রফা হোক।১০২ রায় দুর্ল্লভ ও মীর জাফর তখন একত্রে পরামর্শ করতে বসলেন। আধাআধি বখরা হবে না আগে যা স্থির হয়েছিল তাই বলবৎ থাকবে। পরের দিন তাঁরা বলে পাঠালেন, আড়াই কোটি টাকাই সই। রায় দুর্ল্লভ আরো জানালেন, তিনি মীরমদনকে দলে টানতে পেরেছেন।১০৩ মিস্টার ওয়াট্স্ যে রায় দুর্ল্লভকে বশে আনতে পারলেন তার কারণ তিনি তাঁকে আড়াই কোটি টাকার উপর শতকরা পাঁচ ভাগের লোভ দেখিয়েছিলেন।১০৪ মীর জাফরের মাথায় হাত বুলিয়ে এ টাকাটা সরিয়ে ফেলা যাবে বুঝে, আর তাতে আমীরচন্দের কোনো ভাগ থাকবে না দেখে রাজা দুর্ল্লভরাম বাহাদুর প্রফুল্ল হলেন।
পলাশীতে আমীরচন্দের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে যে সব সন্দেহ হয়েছিল, পাঁচ শতাংশের জৌলুষে সে সব সন্দেহের ছায়া কেটে গেল। আমীরচন্দ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, এ ব্যাটা ইংরেজগুলোকে এ দিকে কুচ করতে দিলে হতভাগারা তিন বছরের মধ্যে মুর্শিদাবাদ ছাড়বে না। রায় দুর্ল্লভ এখন একটু সুস্থ বোধ করে নিজের মন্ত্রদাতাদের কাছে আমীরচন্দের গোপন মন্ত্রণার কথা জানালেন। রণজিৎ রায়ের কাছে কথাটা পৌঁছে গেল। আমীরচন্দের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ মিস্টার ওয়াট্স্কে উমিচাঁদের ফুসলানির খবরটা পৌঁছে দিলেন। শুনে ওয়াট্স্ রাগে ফুঁসতে লাগলেন আর কলকাতায় গিয়ে লোকটা ক্লাইভের কানে কি মন্ত্রণা দেবে সে কথা ভেবে আরো অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁর বিলক্ষণ বোধ হল—‘এই খল সাপটা আমাদের ব্যাপারে বাগড়া দেবার জন্য কোনোকিছু বাকি রাখেনি।’১০৫
ওয়াট্স্ যা আশঙ্কা করছিলেন ঠিক তাই হল। স্ক্র্যাফটনের সঙ্গে মীর জাফরের কোনো কাজের কথা হতে পারেনি শুনে ক্লাইভ মহা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে প্রশ্ন উঠল, চুক্তি সই হতে এত বিলম্ব হচ্ছে কেন? আমীরচন্দ তাঁকে বোঝাতে লাগলেন, গতিক সুবিধার নয়।১০৬ দুশ্চিন্তায় লোকের রাগ হয়। ক্লাইভের রাগ গিয়ে পড়ল অকুস্থানে ওয়াট্সের উপর। এই ওয়াট্স্ লোকটাই তো বার বার স্ক্র্যাফটনকে বলেছিল উমিচাঁদকে মুর্শিদাবাদ থেকে কোনোমতে একবার সরাতে পারলে চুক্তি সম্পাদনে আর বিলম্ব হবে না। তবে এত দেরি হচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই ওয়াট্স্কে বোকা পেয়ে মুর্শিদাবাদের লোকরা তাকে ঠকাচ্ছে, কিংবা আসলে উমিচাঁদকে সরাবার তালে বিদ্বেষবশত লোকটা স্ক্র্যাফটনকে ঐ রকম বুঝিয়েছিল। মীর জাফরের সঙ্গে ইংরেজদের গোপন আদান-প্রদানের কথা এতদিনে কলকাতায় জানাজানি হয়ে গেছে, লোকে প্রকাশ্যভাবে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে শুরু করেছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে কিছু না করলে পুরো প্ল্যানটা বরবাদ করে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। চিন্তায় অস্থির হয়ে সিলেক্ট কমিটিকে পরামর্শ না করেই ক্লাইভ ৫ জুন ওয়াট্স্কে নির্দেশ পাঠালেন—‘আপনি আগাগোড়া ঠকে গেছেন। চুক্তির কাগজপত্রগুলি যাদের হাতে আপনি এত অসাবধানের মতো এগিয়ে দিয়েছেন তাদের কাছে থেকে সেগুলি ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া এখন আর আপনার কোনো কর্ম নেই, কারণ এমন কয়েকটা কাপুরুষ রাস্কেলের সঙ্গে আমি কোনো অভিযানে বেরোব না।’১০৭
রাগে আর দুশ্চিন্তায় ক্লাইভ ওয়াট্স্কে এই দোষও দিলেন যে তিনি তাঁকে এতদিন ইচ্ছে করে ঠকিয়ে এসেছেন। পরের দিন ওয়াট্সের কাছ থেকে মীর জাফর বক্শী পদ থেকে বরখাস্ত হবেন শুনে তাঁর চিন্তা আরো বেড়ে গেল। রায় দুর্ল্লভ নানা টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত আড়াই কোটি টাকা দেবার শর্তে চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি হয়েছেন জেনেও সে চিন্তার কিছু মাত্র উপশম হল না। ওয়াট্সের চিঠির উত্তরে তিনি স্পষ্ট জানালেন—‘আপনি বলছেন চুক্তির শর্তগুলিতে ওরা রাজি হয়েছে, আর আমাকে সেগুলি আপনি পাঠাচ্ছেন। কিন্তু অভিযানে আমার সঙ্গে কি কেউ যোগ দেবে? কেমনভাবে? কবে? কে কে? জেনে রাখবেন এই কটা ব্যাপারে ভরসা না পেলে আমি এক পাও এগোব না। মিস্টার স্ক্র্যাফটন বিশেষ করে একটা প্ল্যান অফ অপারেশন্স্ ঠিক করতে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলেন, কিন্তু একটা না একটা কিছুতে মীর জাফরের সঙ্গে মন্ত্রণা করতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। আপনি বলছেন উনি বকশী পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। আমার সন্দেহ নবাব কিছু একটা জেনে ফেলেছেন, আর রায় দুর্ল্লভ আমাদের এবং মীর জাফরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।’১০৮
নানা চিন্তায় চন্দননগরে ক্লাইভ যখন বেসামাল হয়ে পড়েছেন তখন মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের হস্তক্ষেপের ফলে নিপুণভাবে গোপন চক্র সংগঠনের কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। প্রভু পরিবারের ইঙ্গিতে রণজিৎ রায় সক্রিয় হয়ে উঠলেন।১০৯ ৫ জুন রায় দুর্ল্লভের সম্মতিক্রমে মীর জাফর পূর্বোদ্ধৃত চুক্তিপত্রে সই করলেন এবং আলাদা কাগজে ফৌজ, নওয়ারা ও সিলেক্ট কমিটির প্রাপ্য অঙ্কে নিজের সীলমোহর দিলেন। কিন্তু শুধু চুক্তিপত্রে সই যথেষ্ট নয়, ক্লাইভ বলে রেখেছেন মীর জাফরকে কোরান ছুঁইয়ে শপথ করাতে হবে। তাছাড়া ‘প্ল্যান অফ অপারেশন্স্’ নিয়ে তখন পর্যন্ত মীর জাফরের সঙ্গে কোনো সরাসরি আলোচনা হয়নি। চার দিকে নবাবের চর ঘুরছে। ওয়াট্সের সঙ্গে মীর জাফরের সাক্ষাৎকার হয়েছে জানতে পারলে নবাব দু’জনেরই গর্দান নেবেন। সন্ধ্যাবেলায় প্রাণ হাতে করে ওয়াট্স্ খোজা পেত্রসের পরামর্শমতো জেনানাদের পর্দাবৃত ডুলিতে চেপে একেবারে মীর জাফরের গৃহের অন্দরমহলে গিয়ে ঢুকলেন। সেনাপতি নিজের মাথায় কোরান স্পর্শ করে পুত্র মীরণের মাথায় হাত রেখে বললেন চুক্তিপত্রে ও আলাদা কাগজে যা যা স্বীকৃত হয়েছে সমস্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। ‘প্ল্যান অফ অপারেশন্স্’ নিয়ে আলোচনা হল, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় উপনীত হওয়া গেল না। মীরাজাফর বললেন, যুদ্ধ বেধে গেলে তিনি যদি নবাবী ফৌজের সম্মুখভাগে থাকেন, তাহলে ঢাক পিটিয়ে পতাকা তুলে ক্লাইভের ফৌজের ডান দিকে গিয়ে যোগ দেবেন। যদি তিনি নবাবের ডাইনে বা বাঁয়ে বা পেছনে থাকেন, তাহলে ছোঁ মেরে নবাবকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করবেন, আর চেষ্টায় সফল হলে সাদা পতাকা তুলে দেবেন।১১০ কথাবার্তা সেরে ওয়াট্স্ রাতের আঁধারে পর্দা ঘেরা ডুলিতে বাড়ি ফিরলেন। দু দিন বাদে মীর জাফরের বিশ্বস্ত সেনানী মীর্জা আমীর বেগ খান সই করা চুক্তিপত্র ও আলাদা পাওনার কাগজ নিয়ে গোপনে কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন।১১১ ওয়াট্স্ সেই সঙ্গে আর একটা আনন্দের খবর দিলেন। তা হল এই জগৎশেঠের পরামর্শে মীর খুদা ইয়ার খান লতিফ সেনাপতি মীর জাফরের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।১১২ এইভাবে দরবারের দুটো আলাদা আলাদা চক্র নবাবের বিরুদ্ধে মিলিত হয়ে গেল। শেঠ পরিবার এই সম্মিলিত চক্রের উদ্যোক্তা। ওয়াট্স্ এবার ক্লাইভকে বলবার মুখ পেলেন, আমি নিজেও ঠকিনি আর কাউকেও ঠকাইনি।
গোপন চুক্তি সইয়ের কথা নবাব আঁচ করতে পারেননি। পলাশী থেকে ফৌজ সরিয়ে নেবার সময় তাঁর ধারণা হয়েছিল আপাতত লড়াই বাধবে না। যেহেতু লড়াইয়ের সম্ভাবনা নেই, অতএব তিনি স্থির করলেন এবার মীর জাফরকে জব্দ করার সুযোগ এসেছে। এতদিনে মোহনলাল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে দরবারে হাজিরা দিয়েছেন। নব বলে বলীয়ান হয়ে নবাব গোপন চুক্তি সইয়ের দিন কয়েক বাদে মাতামহের ভগ্নীপতিকে বক্শী পদ থেকে বরখাস্ত করলেন। মোহনলালের পরামর্শ মতো ঐ পদে নিযুক্ত হলেন খাজা আবদুল হাদি খান। ইনি সেই অনুসন্ধিৎসু কাবুলী সেনানী যিনি প্রভু আলিবর্দি খানের কাছে সওয়ার হাজিরা ও ঘোড়ার দাগ মারার বাপারে মীর জাফর ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কারচুপি ধরিয়ে দিয়ে সকলকে হেনস্তা করেছিলেন। এমন একটা লোক সেনাপতিকে হটিয়ে দিলে তাঁর তো রাগ হওয়ারই কথা। কিন্তু এতেই মীর জাফরের ভোগান্তি শেষ হল না। নবাবের হুকুম জারী হল অন্যান্য আমীরের সঙ্গে তাঁকেও দেওয়ান সুবাহ্ মোহনলালের কাছে সেলাম ঠুকতে যেতে হবে। এর পরের ঘটনা কাশিমবাজারের ওলন্দাজ কুঠীর বড়ো সাহেব মিস্টার ভারনেট-এর চিঠিতে সবচেয়ে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে:
Diverse troubles which have arisen between the Prince and his cavalry and especially with his great uncle-in-law Jafar Ali Khan (alias Mir Jafar) shortly after the despatch of our respective missive, have made the Nawab so sullen and gloomy, that nobody whatever has been bold enough to speak to him about any other business as yet…
To retum to the dissensions between the Nawab and his cavalry, it must be stated that they have arisen owing to the great ‘superbness’ of Mohan Lal, who now looking upon himself as great as the Nawab, would have all the grandees and chiefs come to him to salute him, which they have also been ordered to do by the Nawab and which has been opposed by Jafar Ali Khan and his supporters, which made the Nawab so angry that he ordered him to be dragged from his house. But the aforementioned Jafar Ali Khan had the chobdars and gorabadars sjambocked and driven away, and has left with his men, which has rather upset the Nawab.১১৪
গঙ্গার যে তীরে নবাবের হীরাঝিল, তার অপর পাড়ে মীর জাফরের প্রাসাদ ছিল। মীর জাফর দরবারে যাওয়া বন্ধ করে মুর্শিদাবাদের যত বেকার সওয়ার আর বরখাস্ত সৈন্যদের মাইনে দিয়ে নিজের প্রাসাদে জড়ো করতে লাগলেন। বহুদিন যাবত হাজিরা ও দাগের কারচুপিতে তাঁর প্রচুর অর্থ সঞ্চয় হয়েছিল। তাছাড়া গহসেটি বেগম তাঁকে লুকানো ধনরত্ন দান করলেন। অতএব অর্থের অভাব হল না। ‘মামু’ মীর জাফরের সঙ্গে গিয়ে জুটলেন ‘ভাগনে’ খাদেম হোসেন খান। সঙ্গে তাঁর নিজের দলবল। নবাব মামা-ভাগনের উপর কাগজ-কলমে দেখানো নিজ নিজ সব সওয়ারকে দাগের সময় হাজির করার হুকুম দেওয়ায় দুজনে গঙ্গার অপর তীরে জমায়েত হয়ে অবাধ্যতা প্রকাশ করতে লাগলেন।১১৫ তাঁদের মদত দিলেন খুদা ইয়ার খান, রায় দুর্ল্লভ, জগৎশেঠ এবং আরো অনেকে। অবশ্য গোপনে। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নবাব ৮ জুন নাগাদ সৈন্যবাহিনী থেকে মামা-ভাগনে দুজনকে বের করে দিলেন। ঐ দিন রাত্রে নিজের জমাদারদের জড়ো করে মীর জাফর পরামর্শ করলেন, হয় ময়দানে বেরিয়ে গিয়ে ইংরেজদের আসার অপেক্ষায় ছাউনি ফেলবেন, নয় এখনি নবাবকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করবেন। পরম্পরকে ভীতি প্রদর্শন করে দুই পারে গালাগালির আদান-প্রদান চলল।
৯ জুন দ্রুতগামী হরকরা মারফত ওয়াট্স ক্লাইভকে জানালেন—‘Whether we interfere or not it appears affairs will be decided in a few days by the destruction of one of the parties.’১১৬ তাঁর শঙ্কা হল, কলকাতায় যখন মীর জাফরের সঙ্গে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কথা জানাজানি হয়ে গেছে, তখন এখানেও শীগগিরই জানাজানি হবে। তিনি বার বার ক্লাইভের কাছে পালাবার অনুমতি চাইতে লাগলেন। অনতিবিলম্বে সত্যি সত্যিই মথুরা মল নবাবকে লিখলেন, মীর জাফরের সঙ্গে ইংরেজদের গুপ্ত সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। নবাবের মুখে একথা শুনে রাজবল্লভ ওয়াট্সের বেনিয়ানকে ডেকে বলে পাঠালেন, শীগগির পালান। মীর জাফর ও গুপ্ত চক্রের অন্যান্য ষড়যন্ত্রীরাও একই পরামর্শ দিলেন। তাঁরা আশ্বাস জানালেন, মিস্টার ওয়াট্স্ পালানোমাত্র মীর জাফর ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করবেন ইংরেজরা তাঁর দলে যোগ দিয়েছে।১১৭ ১১ জুন ওয়াট্স্কে পালাবার অনুমতি দিয়ে পরের দিন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের দিকে কুচ করতে শুরু করলেন। ওয়াট্স, কলেট, সাইক্স্ ও অন্যান্য সাহেবরা কাশিমবাজারের কুঠি থেকে চুপিসারে পালিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে যোগ দিলেন। নবাবের কাছে ক্লাইভ চিঠি দিলেন, তিনি চুক্তি ভঙ্গের দরুন কাশিমবাজার আসছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি বিবাদ মেটানোর জন্য জগৎশেঠ, রাজা মোহনলাল, মীর জাফর খান, রাজা রায় দুর্ল্লভ ও মীরমদানকে (মীরমদন) সালিশ মানবেন! আমাকে বিশ্বাস করলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।১১৮
নবাবের বিশ্বাস হল না। তিনি বিপদে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ইংরেজরা খবর পেয়েছিল, জগৎশেঠের হুণ্ডীতে ভাগলপুরে বসে মঁসিয় ল’র দলবল মাসে মাসে দশ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছে।১১৯ খোজা ওয়াজিদের কৃপায়, তাদের এও জানতে বাকি ছিল না যে নবাবের পরোয়ানা পেয়ে মঁসিয় ল’ ভাগলপুর থেকে মুর্শিদাবাদ রওনা দেবার জন্য তোড়জোড় করছেন, আর তাঁর সহকারী মঁসিয় সাঁফ্রে মুর্শিদাবাদ রওনা হয়ে গেছেন। ভাগলপুরে বসে মঁসিয় ল’র জানবার উপায় ছিল না যে ফরাসীদের ছেড়ে খোজা ওয়াজিদ ইংরেজদের দলে যোগ দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করে ওয়াজিদকে বলে পাঠিয়েছিলেন যে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসছেন। নবাব যদি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতেন, তাহলে এমন একজন বিশ্বস্ত সেনাপতিকে পাশে পেতেন যাঁর দক্ষতা ও সাহসের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা চলে।
মঁসিয় ল’ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, নবাবের যদি একটুও দৃঢ়তা থাকত এবং মনোবল বজায় রেখে তিনি যদি মীর জাফর, রায় দুর্ল্লভ ও শেঠদের গ্রেফতার করতেন, তাহলে ইংরেজরা আর এগোতে সাহস করত না।১২০ কথাটা লেখা যত সহজ, কাজে তত সহজ নয়। মীর জাফর, রায় দুর্ল্লভের অনেক দলবল, সব সেনাপতিরা অসন্তুষ্ট, নবাব কার উপর নির্ভর করে তাঁদের গ্রেপ্তার করবেন? তার উপর গুজব রটেছিল, দিল্লী থেকে বাদশাহের দেওয়ান গাজিউদ্দিন খান নাকি শীগগিরই শাহজাদা আলি গওহরকে (পরবর্তী কালে বাদশাহ শাহ আলম) নিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করতে আসছেন।১২১ র্মঁসিয় ল’র অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকার মতো অবস্থা নবাবের নয়। যদি তা থাকতে পারতেন, তাহলে ইংরেজরাও বিপাকে পড়ত, কারণ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ রাখা সম্ভব নয়, আর নবাব চুপচাপ বসে থেকে আমলা ও জমিদারদের হুকুম দিয়ে ইংরেজদের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে তাদের নাস্তানাবুদ করতে পারতেন। পনের বছর বাদে পার্লামেন্টে ক্লাইভ বলেছিলেন, ‘…there wanted only some intelligent person to advise him [the Nawab] not to fight at all, and they [the English] should have been ruined…’।১২২ কিন্তু নবাব মীর জাফরকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থাও করলেন না, মঁসিয় ল’র জন্য অপেক্ষাও করলেন না।১২৩
কুচ করতে করতে হুগলীর পাশে দিয়ে যাবার সময় নবনিযুক্ত ফৌজদার শেখ আমরুল্লাহ্কে ক্লাইভ ভয় দেখালেন, বিন্দুমাত্র বাধা দিলে তিনি আবার শহর জ্বালিয়ে দেবেন। শেখ আমরুল্লাহ্ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন।১২৪ ভূতপূর্ব ফৌজদার নন্দকুমার নবাবের হয়ে ক্লাইভের কাছে বৃথা অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন, ‘যদি আপনি বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে চান, তবে চন্দননগর ফিরে যান, ভগবানের কৃপায় সন্ধির সব শর্ত পূরণ হবে। আমীরচন্দকে এখানে পাঠান যাতে আপনি যত তাড়াতাড়ি চান তত শীঘ্র সবকিছু মেটানো যায়।’১২৫ বলা বাহুল্য এতে ক্লাইভের অগ্রগতি রুদ্ধ হল না।
ক্লাইভ ও ওয়াট্সনের বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাভাষণ ও শঠতার উপর অভিশাপ বর্ষণ করে নবাব লিখলেন—‘আল্লাহ্র মেহেরবাণী, সুলেনামার খেলাপ আমার তরফ থেকে হয়নি। আল্লাহ্ ও নবী আমাদের মধ্যেকার আহাদনামার জামিন আছেন। যে তা থেকে প্রথম ঝুঁকবে তার কৃতকর্মের সাজা হবে।’১২৬ ভগবান সব সময় বৃহত্তর ব্যাটালিয়নের সপক্ষে থাকেন—তদানীন্তন ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারের এই সহজ দর্শনতত্ত্বের সঙ্গে নবাবের পরিচয় না থাকলেও তিনি মাত্র ৮০০০ আহাদী ছাড়া বাকি সৈন্যদের লড়াইয়ে নিতান্ত বিমুখ দেখে প্রাণপণে সৈন্যসংখ্যা বাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন।১২৭ কাগজেকলমে তাঁর সেনাপতিদের অধীনে ৫০০০০-এর অধিক সৈন্য থাকার কথা, কিন্তু মোগল ঘোড়সওয়ার বাহিনীর গঠনটাই এমন যে এক একজন মনসবদারের দলে যত আহাদী থাকে তারা সেই মনসবদারের হুকুমে লড়াই করে, আর সেই সেই সেনাপতি বেঁকে বসলে তারা লড়াই থেকে সরে যায়। আহাদী জমায়েত করার চেষ্টা করতে গিয়ে নবাবের বোধদয় হল, মীর জাফরের সহযোগিতা ছাড়া এগোন সম্ভব নয়।
ওয়াট্স্ পালাবার আগের দিন দেখে গিয়েছিলেন খুদা ইয়ার খান লতিফ ও গোলন্দাজরা মীর জাফরের দলে গিয়ে যোগ দিয়েছে।১২৮ কাশিমবাজারে বসে ওলন্দাজরাও শুনছিল নবাবের বিরুদ্ধে তলে তলে জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়, রাজা দুর্ল্লভরাম, মীর জাফর, খোদাদাদ খান ল্যাটি ও বুরাবীক (বড়া বেগ?) ইংরেজদের পক্ষে যোগ দিয়েছে। এ অবস্থায় নবাব দেখলেন মীর জাফরকে দলে টানা ছাড়া গতি নেই।১২৯ গঙ্গার দুই পার হতে তর্জন গর্জন ও আস্ফালন স্থগিত হল এবং নবাব নদী বয়ে মীর জাফরের প্রাসাদে এসে কোরান হাতে করে বিবাদ মিটিয়ে ফেললেন। মুর্শিদাবাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতি জানিয়ে মীর জাফর তাঁর প্রিয় পাত্র মীর্জা আমীর বেগকে ক্লাইভের শিবিরে ১৯ জুন এই চিঠি দিলেন:
‘আল্লাহ্র মেহেরবানী আপনি জখম হননি আর জিন্দা আছেন। সব হরকরা আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রোজ আমার কাছে আপনার চাকর আর চিঠি আসছে। চারদিক ঘিরে চৌকী বসেছে—আল্লাহ্র দোহাই আর পাঠাবেন না। সোম মঙ্গলবার আমায় খতম করার শোর উঠেছিল। আমার উপর তাক করে কামান আর আগুন বান সাজানো ছিল, দিন রাত্রি হাতিয়ার বন্দ লোক লস্কর টহল দিচ্ছিল। সোমবার সকালবেলা মিস্টার ওয়াট্সের [পালানোর] খবর এল। নবাব চমকে গেলেন। তাঁর মনে হল আমি ঠাণ্ডা না হলে চলবে না। তিনি নিজেই আমার কাছে এলেন। বৃহস্পতিবার হুগলী থেকে রোকা এল ওরা [ইংরেজরা] কুচ করে রওনা দিয়েছে। আমায় তাঁর শামিল হতে ফরমায়েশ করা হল। তিন শর্তে আমি রাজি হলাম। পয়লা শর্ত, আমি তাঁর চাকুরিতে ঢুকবো না। দ্বিতীয় শর্ত, আমি তাঁর কাছে হাজিরা দেবো না। শেষ শর্ত, আমি ফৌজে মনসব নেবো না। আমি তাঁকে বলে পাঠালাম এইসব শর্তে রাজি থাকলে আমি তৈরি আছি। আমাকে দরকার বলে তিনি রাজি হলেন। কিন্তু আমি সব ফৌজী ও গোলন্দাজী জমাদারদের কাছ থেকে মুচলেকা নিলাম: “ইংরেজদের হারাবার পর তাঁরা দেখবেন যেন আমি আর আমার খানদান নিরাপদে যেখানে চাই চলে যেতে পারি।” আল্লাহ্র মেহেরবানীতে ঈদের দিন কতলী মসজিদে নামাজ করে ফৌজের সাথে শামিল হবো। আর আধ ক্রোশ ডাইনে বা বাঁয়ে থাকবো। তখন জমাদাররা কে কোথায় আছে জানতে পারবো। চটিজুতায় সেলাই করে কর্নেলকে [ক্লাইভ] জবাব দিয়েছি। সেপাইরা বড়ো বদ মেজাজে আছে আর এখন পর্যন্ত একজনও শহর ছেড়ে রওনা দিতে রাজি হয়নি। যত তাড়াতাড়ি করবেন ততই ভালো। আপনি আমার কাছে আসার কথা একদম ভাববেন না। প্রস্তাব হয়েছে মোহনলাল ফৌজের সামনে আর আমি তাঁর পাশে থাকবো, কিন্তু আমি এতে কিছুতেই রাজি হবো না। আপনি মোহর ছেপে রোকা দিয়েছেন। মোহরে কি কাজ দেবে? সম্পূর্ণ গোপনে ছাড়া আপনি একেবারে বাহাদুর আলি খানের১৩০ ব্যাপার উল্লেখ করবেন না। সব কমিদানদের কাছে আমার সেলাম। আমনি গঞ্জে তাঁবু ফেলে নবাব একদিন ছিলেন। এখন তিনি তারকপুরের কাছে পোর্করায়। গোলন্দাজ আর সেপাইরা এ পর্যন্ত রওনা দেয়নি। রসুলাল্লাহ্র দোহাই আপনি রোকা সম্বন্ধে আরো সাবধান হবেন। আমাদের গোপন কথা জানাজানি হয়ে গেলে আমার উপর চোট পড়বে। নবাব আপনাকে খুঁজছেন। উনি বলেছেন, ‘ঐ লোকটা কোনো একটা মতলবে পালিয়েছে।’১৩১
কলকাতা লুঠ করার সময় নবাবী ফৌজ সোৎসাহে বেরিয়েছিল, কিন্তু এবার কোনো লুঠের আশা নেই। বরং বিলক্ষণ বিপদ আছে। অতএব সওয়াররা বাকি মাইনের অজুহাতে জটলা করে চেঁচামেচি করতে লাগল। তিন দিন ধরে এই শোরগোল চলার পর নবাব তাদের অনেক টাকা দিয়ে কোনোমতে শেষ পর্যন্ত শহর থেকে রওনা করালেন।১৩২
এদিকে ইংরেজরা হুগলী ছাড়িয়ে গঙ্গার পশ্চিম পাড় বেয়ে কাটোয়া পর্যন্ত উঠে ১৯ জুন সেখানকার দুর্গ দখল করল। এইখানে ছাউনি ফেলে ক্লাইভ গঙ্গা পার হয়ে পলাশীর দিকে যাবেন কিনা যাবেন ইতস্তত করতে লাগলেন। তিনি আশা করছিলেন রোজ হরকরা মারফত মীর জাফর নবাবী ফৌজের নাড়ি- নক্ষত্র জানবেন। সেনাপতির কাছ থেকে কোনো খবর না পেয়ে তাঁর বুক ভয়ে ধুকপুক করতে লাগল। সেনাপতি কি বেইমানি করবেন? নাকি ভয়ের চোটে সবকিছু বানচাল করে দেবেন?১৩৩
১৯ জুন কাটোয়া থেকে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, সেনাপতি নিজের দলবল সুদ্ধ নবাবী ফৌজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে পলাশীতে তাঁর সঙ্গে যোগ না দিলে তিনি কাটোয়া ছেড়ে একপাও এগোবেন না।১৩৪ ঐ দিনই উত্তরোত্তর উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি সিলেক্ট কমিটিকে জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন, এখন কি করা যায়? ‘আমি এমন সাবধানে চলবো যাতে আমাদের ফৌজ নষ্ট না হয়। আপাতত যদি কিছু সম্ভব নাও হয় তবু যত দিন ফৌজ হাতে আছে তত দিন পছন্দমতো সময়ে তখ্ত উল্টে দেওয়া যাবে। এরা বলছে এখানে আশেপাশে অনেক খাদ্যশস্য আছে। আট দশ হাজার মন যোগাড় করতে পারলে সারা বর্ষা মোতায়েন থেকে নবাবকে কাবু করে ফেলে হয় তাঁকে নির্ভরযোগ্য শর্তে বেঁধে ফেলা যাবে নয় বীরভূম রাজা, বা মারাঠা দল বা গাজুদি খানকে [দিল্লীর উজীর গাজিউদ্দিন খান] টেনে আনা যাবে। মীর জাফর সাহায্য না করলে কি করবো সে সম্বন্ধে খোলাখুলিভাবে আপনাদের মতামত পাবার ইচ্ছা পোষণ করি।’
সিলেক্ট কমিটির মতামত জানার আগেই উস্থুল-মুস্থুল করতে করতে ক্লাইভ বীরভূমের রাজা মহম্মদ আসাদুজ্জামাঁকে ২১ জুন লিখলেন: ‘কলকাতার গভর্নর ও মাহমুদ নেওয়াজের কাছে আপনার চিঠি সযত্নে পাঠ করেছি এবং আপনার মজবুত দোস্তীর কথা শুনে বড়োই প্রীত হয়েছি।…আপনি আমার দলে যোগ দিতে চাইলে আল্লাহ্ এবং আপনার রসুলাল্লাহর নাম করে আপনার বিশ্বস্ততা জ্ঞাপন পূর্বক দু তিনশো ভালো ঘোড়া পাঠাবেন, তারা যেন দিনরাত কুচ করে লড়াইয়ের সময় আমার সঙ্গে যোগ দিতে পারে। আমিও আপনার বিষয়কৰ্ম নিজের বিষয়কৰ্ম জ্ঞান করে আপনার খুশিমতো সবকিছু মিটিয়ে দেবো—আপনার জমিদারীর কোনো ক্ষতি হবে না আর আপনার উপর কোনো আমিল চাপবে না, তাছাড়া আপনার যা খরচ হবে আমি সরকার থেকে মিটিয়ে দেবো। আসলে আমি যা বলতে চাই তা এই যে আপনার লোকলস্কর ঠিক সময় পৌঁছলে আপনাকে খুশি করে দেবো।’১৩৬ পাঠান বীরপ্রবর এত চিত্তাকর্ষক আহ্বানে সাড়া দিলেন না।
ক্লাইভ ভাবতে লাগলেন, নবাব তো সেই কবে থেকে ভয়ে ভয়ে আছেন,—তাঁকে দিয়ে কি এখনো একটা সম্মানজনক সন্ধি করানো যায় না? না কি গাজুদি খান বা মারাঠাদেরই ডেকে আনবার জন্য এই বেলা দূত পাঠিয়ে দেবো?১৩৭ মন তোলপাড় করে ক্লাইভ এইসব ভাবছেন এমন সময় মীর জাফরের চিঠি পেয়ে দেখলেন সেনাপতি তাঁকে তিরস্কার করে লিখেছেন ‘এখন পর্যন্ত আপনি তো খালি বাতেঁ করেছেন, কাম করেননি, কিন্তু এখন আর আরাম করার সময় নয়। আপনি যখন কাছে আসবেন তখন আমি আপনার সাথে যোগ দিতে পারবো।’১৩৮ এদিক থেকে সিলেক্ট কমিটিও মত প্রকাশ করলেন, ক্লাইভ মিছিমিছি ভয় খাচ্ছেন। মীর জাফর যদি বেইমানি করেন, তাহলে তিনি নিজের বলে লড়াই করুন না কেন? তাছাড়া মীর জাফর ছাড়া রায় দুর্ল্লভ জগৎশেঠ ও অন্যান্যদের সঙ্গেও তো ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, তাঁদের না জানিয়েই বা ক্লাইভ কি করে নবাবের সঙ্গে সন্ধি করার কথা বলেন?১৩৯
সিলেক্ট কমিটির কাছ থেকে এমন সব অপমানজনক কথা শোনার আগেই ক্লাইভ পলাশী রওনা দিয়েছিলেন বলে কোনোমতে তাঁর মান বাঁচল। অধস্তন সেনাপতিদের ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—এখন কি করা যায়? গঙ্গা পার হয়ে পলাশীতে উঠবো, না কাটোয়ায় বর্ষা কাটিয়ে মারাঠাদের ডেকে আনবো? মেজর আয়ার কূট বললেন, অপেক্ষা করতে গেলে নবাবের কাছে মঁসিয় ল’র দলবল’ এসে পড়বে, তাতে কাজ নেই। কিন্তু বেশির ভাগ সেনাপতি বুঝলেন মনে মনে ক্লাইভ অপেক্ষা করতে চান—তাঁরা সেই মর্মে রায় দিলেন। এক ঘণ্টা বাদে ক্লাইভ মেজর কূটকে ডেকে বললেন, না, বেরিয়ে পড়াই সাব্যস্ত করলাম।১৪০ গভীর রাতে গঙ্গা পার হয়ে সৈন্যরা অন্য পাড়ে উঠে পলাশীর আমবাগানে ছাউনি ফেলল। এখান থেকে মীর্জা আমীর বেগ মারফত তিনি মীর জাফরকে বলে পাঠালেন—‘আমার যা করার আমি করেছি, আর কিছু করার নেই। আপনি যদি দাউদপুর পর্যন্ত আসেন, তাহলে আমি পলাশী ছেড়ে এগিয়ে আপনার সঙ্গে মোলাকাত করবো, কিন্তু আপনি যদি তাও না করেন তবে মাপ করবেন আমি নবাবের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলবো।’১৪১ কিন্তু তখন আর পিছপা হবার জো নেই। সৈন্যসামন্ত নিয়ে সুবিস্তীর্ণ গঙ্গা বক্ষ পার হতে রাত একটা বেজে গেল। গোরা ও তেলেঙ্গী সেপাইরা আমবাগানে ছাউনি ফেলতে গিয়ে সচকিত হয়ে দেখল এক মাইল দূরে নবাবের তাঁবু থেকে ঢাক আর শিঙার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ২২ জুন ভোর হতে না হতেই নবাবের ঘোড় সওয়ার, পদাতিক ও গোলন্দাজ সৈন্যরা পায়ে পায়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমবাগানের পেছনে গঙ্গা নদী। ইংরেজদের দলে গোলন্দাজ পদাতিক সমেত ৯০০ গোরা, ১০০ দেশী তোপচী আর ২১০০ তেলেঙ্গা। ঘোড়া নেই কিন্তু সারিবদ্ধ বন্দুকবাজের দল খুব মজবুত। নবাবের দলে কত সৈন্য তা ঠিক করে বলা মুশকিল। ইংরেজ সেনাবাহিনীর রোজনামচা অনুযায়ী ৩৫০০০ পদাতিক ও ১৫০০০ ঘোড় সওয়ার সম্বলিত মোগল ফৌজ সংখ্যার ইংরেজদের বহু গুণ।১৪২ কিন্তু এ হিসাব নেহাত কাগজে কলমে। বর্গিযুদ্ধের সময়েই আমরা দেখেছি কেমনভাবে কাবুলী সেনাপতি খবাজা আবদুল হাদি খান নবাব আলিবর্দি খানের কাছে হাজিরা ও দাগের কারচুপি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তখনি দেখা গিয়েছিল, মীরজাফরের বকশীপনায় এক একজন সেনাপতি এক শো সওয়ার রেখে এক হাজার সওয়ারের মাইনে টানছেন। এ প্রসঙ্গে সিয়ার গ্রন্থের টীকাকার হাজি মুস্তাফা যা বলেছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি টীকা দিয়েছিলেন, এই অঙ্ক অনুযায়ী হিসেব কষতে গেলে পলাশীর যুদ্ধে যে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য যুদ্ধ করতে এসেছিল তা থেকে অবিশ্বাস্য রকম সংখ্যা বিয়োগ করতে হবে।১৪৩ নবাবী পক্ষের সৈন্য দলে কত লোক পলাশীতে উপস্থিত হয়েছিল, তার একটাই নির্ভরযোগ্য ভগ্নাংশ মেলে। মীর জাফর তাঁর নিজের রিসালায় কত সৈন্য আছে তা যুদ্ধের পরের দিন ক্লাইভের কাছে জানিয়েছিলেন।১৪৪ তাতে জানা যায় তাঁর অধীনে মাত্র তিন হাজার সৈন্য সেদিন পলাশীর ময়দানে হাজির ছিল। তারা অবশ্য যুদ্ধ করেনি। যারা যুদ্ধ করেছিল সেই খাস রিসালার সৈন্যদল সংখ্যায় আরো বেশি ছিল নিশ্চয়, কিন্তু কত বেশি? ধরা চলে, সাত আট হাজার। মীরমদনের নেতৃত্বে এরাই যুদ্ধ করেছিল। ওলন্দাজদের হিসেব অনুযায়ী মীরমদন, মোহনলাল, মাণিকচন্দ, নবে সিংহ হাজারী ও নতুন নিযুক্ত বকশী খবাজা আবদুল হাদি খানের সঙ্গে ১৫০০০ লোক ছিল।১৪৫ এরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু এদের লোকজন ১৫০০০ পর্যন্ত কিনা তা নিশ্চয় করে বলা যায় না। যুদ্ধের দুই দিন আগে ক্লাইভ যে সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন, তাতে দেখা যায় নবাবের শিবিরে ৮০০০ সৈন্যের বেশি নেই।১৪৬ ক্লাইভ আশঙ্কা করছিলেন, সৈন্যদের সব দাবি মেনে নিলে নবাবের দল আরো ভারি হবে। কিন্তু পরের দু দিনে তা আর ঘটে ওঠেনি। ২৩ জুন নবাবের পক্ষে সাত আট হাজার সৈন্য লড়াইয়ে নেমেছিল ধরলে অন্যায় হবে না। পলাশীর যুদ্ধ কোনো বড়ো যুদ্ধ নয়। বলতে গেলে, সেটা যুদ্ধই নয়—ইংরেজীতে যাকে বলে skirmish তাই। অর্থাৎ হাতাহাতি।
ভোর ছটার সময় নবাবের সৈন্যদল দাউদপুরের শিবির থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সম্মুখভাগে সেই কাবুলী সেনাপতি খাজা আবদুল হাদি খান যিনি এখন বকশী, তাঁর সঙ্গে নবাবের খাস রিসালার নায়ক মীরমদন, বীর যোদ্ধা নবে সিংহ হাজারী, আলিনগরের পলাতক নায়ক মানিকচন্দ, নবাবের দেওয়ান মোহনলাল, এবং মোহনলালের জামাই বাহাদুর আলি খান যিনি গোপনে ষড়যন্ত্রীদের সঙ্গে যুক্ত থেকেও শেষক্ষণে শ্বশুরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেনাবাহিনীর বাঁ ধারে ষড়যন্ত্রীদল মীর জাফর, রায় দুর্ল্লভ, খাদেম হোসেন খান, মীর খুদা ইয়ার খান লতিফ, মীর জাফর পুত্র মীরন, মীর জাফর জামাই মীরকাশিম, ইত্যাদি। সম্মুখ থেকে ইংরেজদের প্রচণ্ড গুলি বৃষ্টির মুখে মীরমদন ঘোড় সওয়ার ও সাফ্রেঁর অধীনস্থ একদল ফরাসী গোলন্দাজ নিয়ে এগোতে লাগলেন। তাঁর বাঁ পাশে মীর জাফর, রায় দুর্ল্লভ ও খুদা ইয়ার খান দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।১৪৭ তাঁরাও যদি এগিয়ে যেতেন তাহলে আমবাগানের ডান ধার থেকে ইংরেজদের ঘিরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু মীর জাফর ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা যুদ্ধও করলেন না, ইংরেজদের দলেও যোগ দিলেন না। মীর জাফরকে দিয়ে নবাব কোরান হাতে শপথ করিয়েছিলেন, ইংরেজদের সাথে তিনি যোগ দেবেন না।১৪৮ বুদ্ধিমান সেনাপতি সেই শপথ ভঙ্গ করা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলেন না। মীরমদনের আগুয়ান হওয়ার মুহূর্তে মীর জাফরের দলের মধ্যে একটু নড়াচড়া দেখে সন্দিগ্ধ ইংরেজরা সে দিকেও একপশলা গুলি বৃষ্টি করে দিল। অগত্যা মীর জাফর ও তাঁর সঙ্গীরা বুদ্ধিমানের মতো দূরত্ব বজায় রেখে চললেন আর ইংরেজরা নিশ্চিতভাবে জেতা না পর্যন্ত তাদের দিকে কোনো নিশান তুললেন না।১৪৯
মীরমদনের আক্রমণ সইতে না পেরে ইংরেজরা পিছু হটে আমবাগানের মধ্যে আশ্রয় নিল। সেনাপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্লাইভ স্থির করলেন, দিনমানে সেখান থেকে বেরোন ঠিক হবে না।১৫০ সারা দিন বাগানের ভিতর থেকে কামান দেগে রাত্রে নবাবের শিবির আক্রমণ করা যাবে। এই সময় হঠাৎ গোলা লেগে মীরমদন পড়ে যাওয়ায় ইংরেজদের কপাল খুলে গেল। মীরমদনের সঙ্গে ছিলেন নবে সিংহ হাজারী, তিনিও নিহত হলেন।১৫১ বিশ্বস্ত সেনাপতির মৃত্যুতে ভয়ে বিহ্বল হয়ে নবাব মীর জাফরকে ডেকে পাঠালেন। মীর জাফরের যাওয়ার আদৌ ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু নবাব বার বার ডেকে পাঠানোয় শেষ পর্যন্ত মীরন ও খাদেম হোসেন খানের সঙ্গে একদল সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে তিনি নবাবের তাঁবুতে হাজির হলেন।১৫২ নবাব মাথা থেকে উষ্ণীষ খুলে সেনাপতির সামনে ফেলে সকাতরে অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন।১৫৩ মীর জাফর অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন—দিন আর বাকি নেই, আজ লড়াই করার ফুরসত কই? হরকরা পাঠিয়ে লড়িয়ে ফৌজদের ফিরিয়ে নিন। কাল আল্লাহ্র মেহেরবাণীতে সব ফৌজ জড়ো করে লড়াইয়ে নামব। নবাব সকাতরে বললেন, কিন্তু রাত্রে যদি ওরা হামলা করে? সেনাপতি জবাব দিলেন, রাত্রে যাতে হামলা না হয় তিনি তার বন্দোবস্ত করবেন।১৫৪
মীরমদনের সঙ্গে মোহনলালও এগিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে খ্বাজা হাদি খান ও মাণিকচন্দ। মীরমদন মারা যাবার পর এঁরা প্রাণপণে লড়াই করে যাচ্ছিলেন, এমন সময় হরকরা এসে বলল, নবাব লড়াইয়ে ক্ষান্ত দিয়ে ফিরে আসতে ডাকছেন। মোহনলাল বলে পাঠালেন—এখন পিছু হঠবার সময় নয়। লড়াই এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এস্পার-ওস্পার যা হবার এখনি হবে। এখন মুখ ঘুরিয়ে তাঁবুতে ফিরতে গেলে ফৌজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে, হয়তো সামনাসামনি পালাতে শুরু করবে। একথা শুনে নবাব কাতর হয়ে মীর জাফরের দিকে চাইলেন। সেনাপতি কঠিন সুরে বললেন—আমার সাধ্যমতো সলা আমি দিয়েছি। এর পর, যা কিছু ঠিক করার মালিক নবাব বাহাদুর নিজে। সেনাপতির মুখ দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে নবাব বার বার লোক পাঠিয়ে মোহনলালকে ডাকতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত মোহনলাল ফিরে আসলেন।১৫৫ মোহনলাল যা ভয় করেছিলেন তাই হল। ছত্রভঙ্গ হয়ে নবাবের দল পালাতে লাগল। খাজা আবদুল হাদি খান, মাণিকচন্দ ও মোহনলাল নিজে জখম হলেন।১৫৬ বাহাদুর আলি খানের প্রাণ গেল।
এ দিকে মীর জাফর যুদ্ধের ফলাফল আর অনিশ্চিত নয় দেখে সাহস সঞ্চয় করে ক্লাইভের কাছে হরকরা চিঠি পাঠালেন, রাত তিনটের সময় নবাবের শিবিরে হামলা করুন। আমি, রায় দুর্ল্লভরাম ও লতিফ খোদা ইয়ার খান নবাবের বাঁ দিকে থাকব, আমরা আমাদের কাজ করব। আমি, কর্নেল সাহেব, রাজা বাহাদুর ও খান সাহেব এই চারজন মিলে সলা করে ঠিক করতে হবে কি করা যায়। খ্বাজা হাদি নবাবের দিকে থাকবেন। কর্নেল সাহেব ও অন্যান্য রইসদের কাছে খাদেম হোসেন, মীরন, মীর কাশিম, লতিফ খান ও রাজা দুর্ল্লভরামের সেলাম।১৫৭
বিকেল পাঁচটায় এই চিঠি যখন ক্লাইভের হাতে পৌঁছল তখন আর নবাবের শিবিরে নৈশ হামলার দরকার নেই। শিবির ছেড়ে নবাব তাঁর ছত্রভঙ্গ সৈন্যদলের পেছন পেছন মুর্শিদাবাদ ছুটলেন। সেখান থেকে প্রিয়তমা উপপত্নী লুৎফুন্নেসার সঙ্গে পাটনার দিকে বেরিয়ে পড়লেন। পথে রাজমহলে ধৃত নবাব বন্দী অবস্থায় মুর্শিদাবাদে ফিরলেন। মীরনের হুকুমে জল্লাদ তাঁকে কোতল করল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন—‘হয়েছে—আর নয়—খতম হলাম—হোসেন কুলী খাঁর খুনের বদলা।’১৫৯ তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর রক্তাক্ত দেহখানা যখন শহরের পথে পথে হাতির পিঠে চাপিয়ে আমিনা বেগমের গৃহের সামনে আনা হয়েছে, তখন পুত্রহীনা মা বোরখা ফেলে খালি পায়ে রাস্তায় ছুটে এসে উম্মত্তের মতো সে দেহে বারম্বার চুম্বন করতে করতে কপালে বুকে করাঘাত করতে লাগলেন। নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছিলেন খাদেম হোসেন খান। রাস্তার উপরে বসে পড়া নবাবনন্দিনীর চার পাশে সমব্যথী লোকজন জমায়েত হয়ে যাচ্ছে দেখে ত্বরিৎগতিতে নেমে এসে চোপদারদের দিয়ে মার দিতে দিতে বেগমকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন। মসনদে বসলেন সুবাহ্ বাংলা বিহার ওড়িশার নতুন নবাব সুজা-উল-মুলক্ হিসামুদ্দৌলাহ্ মীর জাফর আলি খান বাহাদুর মহাবৎ জঙ্গ। মহাবৎ জঙ্গ তাঁর প্রভু আলিবর্দি খানের উপাধি—মানে যুদ্ধে প্রচণ্ড। কিন্তু মসনদে উঠতে তাঁর সাহস হচ্ছিল না। ক্লাইভ নিজের হাতে তাঁকে তখ্তে তুলে দিলে তবে তিনি নির্ভয় হয়ে সেখানে বসলেন।
মোগল শাসক, অবাঙালি বণিক ও হিন্দু জমিদার শ্রেণীর মধ্যে থেকে উদ্ভূত ষড়যন্ত্রের কলকাঠিতে যে রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটে গেল, রাষ্ট্রশক্তির বহির্ভূত সাধারণ লোকে তা নিতান্ত নিরুৎসুকভাবে তাকিয়ে দেখে আবার নিজের নিজের কাজে মন দিল—চাষা লাঙ্গল ধরতে গেল, ফড়িয়া ফিরি করতে বেরোল, পোতদার কড়ি বিছিয়ে বসল, বোকা জোলাকে নিয়ে হাটের লোকে তাদের অভ্যস্ত রসিকতা করতে লাগল। এ সমস্ত কাজের ভিত্তি যে নড়ে গিয়ে জনজীবনে বিপুল বিপর্যয় দোরে এসে হাজির হয়েছে, সে বোধশক্তি মনসবদার জমিদার সওদাগরের ছিল না, জনতার কোথা থেকে আসবে? জনতা নিশ্চয় নবাবী রাষ্ট্রশক্তির সপক্ষে ছিল না, কিন্তু ফিরিঙ্গিদের প্রতিও সাধারণ লোকের মনোভাব এক প্রকারের বিতৃষ্ণতায় ভরা ছিল। কলকাতা থেকে ইংরেজদের খেদিয়ে দিয়ে চুঁচুড়া চন্দননগরের ওলন্দাজ ফরাসীদের ভয়কম্পিত শিথিল হাত থেকে যথাক্রমে ৪ লক্ষ ও ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে এক বছর আগে নবাব যখন বিপুল দর্পে মেদিনী কাঁপিয়ে মুর্শিদাবাদ ফিরছিলেন, তখন চন্দননগরের ফরাসীরা গাঁয়ের লোকেদের বলাবলি করতে শুনেছিল—এই ফিরিঙ্গিরা বানচোত।১৬০ সে সময় তাদের মনে সাহেবদের প্রতি কৃপামিশ্রিত অবজ্ঞা ছাড়া কিছু ছিল না।
আবার যখন দৃশ্যপট পাল্টে গেল, বিপর্যস্ত ফিরিঙ্গিরা ফিরে এসে নবাবের জান খতম করে দিল, তখন মুর্শিদাবাদের আশেপাশের মুসলমান গ্রামগুলিতে লোকের মনে ভারি কষ্ট হল। এ নিয়ে তারা গান বাঁধল। তারপর সে ঘটনা চিরাভ্যস্ত প্রথায় মেনে নিল। সতের বছর আগে আর এক তরুণ নবাব সরফরাজ খান দরবারের ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছিলেন। তখনো লোকে দুঃখ পেয়ে গান বেঁধেছিল। এ ষড়যন্ত্রের পরিণাম যে সে ষড়যন্ত্রের পরিণাম থেকে আলাদা হবে, সেই বোধশক্তি তাদের ছিল না। সেও দরবারের ষড়যন্ত্র, এও দরবারের ষড়যন্ত্র। দরবারের বাইরের লোক তাতে কোনো দিক দিয়ে জড়িত নয়। গোটা বাংলার উপর কি বিপর্যয় নেমে আসছে তা কে বুঝবে? ঘটনার তিন বছর পরে দরবারের ইংরেজ ষড়যন্ত্রী লিউক স্ক্র্যাফটন এ সম্বন্ধে তাঁর এই ভাবনা লিপিবদ্ধ করলেন: Yet an Englishman cannot but wonder to see how little the subjects in general are affected by any revolution in Government; it is not felt beyond the small circle of the court. To the rest it is a matter of the utmost indifference, whether their tyrant was a Persian or a Tartar; for they feel all the curses of power, without any of the benefits but that of being exempt from anarchy, which is alone the only state worse than they endure.’১৬১
পলাশীর ষড়যন্ত্র সমাপন হল। এবার সুবাহ্ বাংলাএ যা শুরু হল তদানীন্তন ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাব্তাবায়ীর ভাষায় তার নাম ‘ইনকিলাব’, অথাৎ উলট-পালট—আক্ষরিক এবং অনিষ্টকর অর্থে ‘revolution’। সেই উলট-পালটে সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকেরা যাঁরা ষড়যন্ত্র করেছিলেন বা ষড়যন্ত্র করেননি তাঁরা একে একে ভূপাতিত হলেন। ইনকিলাবের অর্থই এই যে উপরের স্তর তলায় তলিয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা তলায় তলিয়ে যাবার জন্য ষড়যন্ত্র করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই হল।
.
টীকা
১। Walls to Walsh, 14 Apnl 1757, Bengal in 1756-57, p. 330 : Swafton to Walsh, 18 April 1757, ibid, p. 42
২। Walls to Clive, 18 April (1757, ibid, p. 344 : Watts to Walsh, 14 Apnl, ibid.
৩। Jean Law de Lauriston, Memoire Sur Quelque Affaines de L’Empire Mogol, ed. Alfred Martinean (Paris 1913), P. 118, p. 118. মূল ফরাসীর ইংরেজী অনুবাদ; Bengal in 1756-57, III. p. 190.
৪। Riyar-us-Salatin, p 374
৫। Bengal in 1756-57, I, XL, VII
৬। Benga in 1756-67, III, p. 198.
৭। Mirdjafar qui n’avoit pas encore l’idee de se faire soubadar, m’avoit paru tres sense, asses porte, a nous rendre service et nous plaignoit beaucoup d’avoir faire a un homme aussi lache aussi indecis que l’doit Souradjotdola. Law de Lauriston, Memoir, p. 175.
৮। Law de Lauriston, Memoir, pp. 116-117.
৯। Serafton to Walsh, 9 April 1757, Bengal in 1756-57, iii, p. 342.
১০। ফরাসীদের হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ল’ রায়দুর্ল্লভের হাতে পঁচিশ লক্ষ টাকার উপর গুঁজে দিয়েছিলেন, কিন্তু ফল হয়নি। Ibid, pp. 197-8.
১১। Law de Lauriston, Memoir, pp. 116-122.
১২। Bengal in 1756-57, II p. 20, মীর্জা সালেহ্ বিদ্রোহী মোগল আমীর মীর হবীব সঙ্গে বর্গিদের দলে যোগ দেন এবং আলিবর্দির সঙ্গে বর্গিদের চুক্তি সম্পাদনে সহায়তা করেন। চুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার নায়েব নাজিম হন।
১৩। From Dacca factory to Roger Drake, 14 April 1757, Bengal in 1756-57, II, p. 331
১৪। Law de Lauriston, Memoir, pp. 163-164.
১৫। Ibid, p. 164-165.
১৬। Seir (English Trans.). II. p. 225.
১৭। Ibid, p. 252
১৮। Ibid, p. 228.
১৯। Sair II, p. 253.
২০। Bangal in 1756-57. pp. 210-212.
২১। Wats to Clive, 11 Aprl 1757. এই চিঠি এবং এর পরবর্তী যে সব চিঠি উল্লিখিত হবে তা সমস্তই Bengal in 1756-57 গ্রহে মুদ্রিত হয়েছে।
২২। Clive to Secret Committee, London, 16 April 1757.
২৩। How glorious it would be for the Company to have a Nabob devoted to them, Scrafton to Walsh, 9 April 1757.
২৪। Watts to Clive 11 April 1757.
২৫। “As Omichund has a superior understanding and as I am persuaded it is greatly for his interest that we should be successful, I therefore consult him on al occasions, which I hope you will approve of”—Watts to Clive 11 April 1757.
২৬। Scrafton to Walsh, 9 April 1757.
২৭। Major Kilpatrick.
২৮। এইটিই চক্রান্তের প্রথম ইঙ্গিত বলে ধরা যেতে পারে।
২৯। অধস্তন মফস্বলের কুঠিগুলির বিষয় ও টাকাকড়ি।
৩০। কাঁধ ছুঁয়ে কোনো ঘটনার ইঙ্গিত করে নবাবকে স্ক্র্যাফটনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা জানা যায় না।
৩১। Scrafton to Clive, 12 April 1757.
৩২। Scrafton to Walsh, 18 April 1757.
৩৩। Nawab to Clive, 15 April 1757. 08
৩৪। Law de Lauriston, Memoir, pp. 148-153; Seir II, p. 227
৩৫। Scrafton to Walsh, 18 April 1757.
৩৬। Admiral Watson to the Nawab, 19 April 1757.
৩৭। Clive to Nawab, 20 April 1757.
৩৮। Scrafton to Walsh, 20 April 1757.
৩৯। Scafton to Walsh, 21 April 1757.
৪০। Watts to Clive.23 April 1757.
৪১। ‘Mexichut’ কথার অর্থ হয় না, ওটা ভুল। বেটিচ্যুৎ হবে।
৪২। Scrafton to Walsh, 21 April 1757.
৪৩। ‘My mind is continually on the stretch. Politicks interrupt my sleep and give me a downright fever of thought’. Ibid.
৪৪। Watts to Clive, 23 April 1757.
৪৫। Watts to Clive, 23 April 1757.
৪৬। Scrafton to Clive, 24 April 1757.
৪৭। Clive to Watson, 26 April 1757.
৪৮। Clive to Watts, 28 April 1757.
৪৯। এটা মীরজাফরের বানানো কথা বা ভুল খবর। পাটনায় রামনারায়ণ তখন আহমদ শাহ আবদালি ও কামর খানের ভয়ে তটস্থ—মুর্শিদাবাদে ফৌজ পাঠাবার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না।
৫০। যে-আদবপনার ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন আগেকার ঘটনা। এই সময়ে সন্ত্রস্ত নবাব দরবারে সবাইকে সমঝে চলছিলেন। অবশ্য তাতে কারো বিশ্বাস উৎপাদন হয়নি। সকলেরই মনে ছিল মোতিঝিল লুঠের পর নতুন নবাব দরবারে কি সব কাণ্ড করেছিলেন।
৫১। মীরন।
৫২। ক্লাইভ।
৫৩। Watts to Clive, 26 April 1757.
৫৪। Clive to Watson, 26 April 1757
৫৫। অর্থাৎ নবাবের।
৫৬। Extract from a letter from Nandkumar to the Nawab (enclosed in Mr. Waus’s letter of 26 April, 1757).
৫৭। Colonel Clive to Mohanlal, 23 April 1757.
৫৮। Letter from Mathura Mal to Babu Sahib (enclosed in Mr. Watts’s later of 26 April)
৫৯। Clive to Pigot, 30 April 1757.
৬০। Wats to dive, 28 April 1757.
৬১। Scrafton to Clive, 28 April 1757.
৬২। Clive to the Nawab,24April 1757
৬৩। Scafton to Clive, 28 April 1757. Bengal in 1756-57, Vol III, pp. 344-6.
৬৪। খুদা ইয়ার খান লতিফের প্রস্তাব।
৬৫। I Scrafton to Clive, 28 April 1757.
৬৬। Ibid.
৬৭। রাজমহল।
৬৮। বিহার ও বানারসের সীমানা।
৬৯। Nawab to Clive 26 April 1757.
৭০। ‘Had they approached near, everything would have been overset in this country, for three fourths of the Nabob’s any are against him. It is a most disagreeable circumstance to find that the troubles are likely to commence agains; but the opinion here is universal, that there can be neither peace nor trade without a change of Government’. Clive to Pigot, 30 April 1757.
৭১। সিলেক্ট কমিটি।
৭২। Letter from the Nawab to Monsieur Law supposed to be watten at the end of April 1757.
৭৩। Extract from the Fort William Select Committee Proceedings of 1 May, 1757.
৭৪। Watts to Clive, 28 April, 30 April.
৭৫। বন্দুকবাজ, বরকন্দাজ। Watts to Clive, 29 April 1757.
৭৬। Drake to Clive 3 May 1757; মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং, ৫১-৫৩ পৃঃ
৭৭। Watts to Clive, 3 May. 961
৭৮। Orme, Military Transactions in Indostan, Vol II pp. 150-151.
৭৯। ‘… When you receive my letter then be ready to march, when I shall proceed to Meir Jaffier’s, or he will send a thousand men to defend our Factory’. Watts to Clive, 28 April 1757.
৮০। Clive to Watts, 2 May 1757.
৮১। Evidence of Lord Clive to Parliamentary Committee of 1772. Extract in Bengal in 1756-57, Vol III., p. 316.
৮২। Watts to Clive, 14 May 1757
৮৩। Ibid.
৮৪। Proceedings of Select Committee, 17 May 1757; Clive to Watts, 19 May 1757.
৮৫। এই প্রসঙ্গে ক্লাইভ ওয়াট্সকে লিখলেন (১৯ মে): ‘Flatter Omichund greatly, tell him the Admiral, Committee and self are infinitely obliged 10 him for the pains he has taken to aggrandize the Company’s affairs, and that his name will be greater in England than even it was in India. If this can be brought to bear to give him no room for suspicion, we taken off 10 lack from the 30 Demanded for himself, and 5 percent upon the whole sum received which will turn out the same thing.’ শেষের কথা থেকে জানা যায়, উমিচাঁদের বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য ক্লাইভ ৩০ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা কেটে নেন্, কারণ এক কথায় সব দিয়ে দিলে উমিচাঁদের সন্দেহ হবে। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে পার্লামেন্টারী কমিটির কাছে ক্লাইভ বলেন: Omichund had insisted upon five percent on all the Nobob’s treasurer, and thirty lack in money.’
৮৬। Clive’s evidence to Parliamentary Committee 1772, Bengal in 1756-57, III, p. 316.
৮৭। Clive to Select Committee, 18 May 1757, Clive to Watts, 19 May 1757.
৮৮। Orme Indostan, II, pp. 153-4.
৮৯। Richard Becher’s evidence to Parliamentory Committee 1772, Bengal in 1756-57, II p. 304. Also Clive’s evidence, p. 312.
৯০। Clive to Watts, 19 May 1757.
৯১। Clive’s evidence to Parliamentary Committee 1772, Bengal in 1756-57, II pp. 312-313
৯২। Orme, Indostan II pp. 161-162
৯৩। Watts to Clive, 17 May 1757, 20 May 1757.
৯৪। Clive to Watts, 11 May 1757.
৯৫। Clive to Watts, 19 May 1757.
৯৬। Scrafton, History of Bengal, pp. 85-86. Scrafton to Clive, 25 May 1757.
৯৭। Watts to Clive, 23 May, 1757.
৯৮। Orme, lindostan, II, p. 158: Scrafton to Clive, 31 May 1757.
৯৯। ‘He commands a large part of the army and is closely connected with Meir Jaffeir, who does not chuse to finish so important an affair without consalting the fomer, lest he should take umbrage at it; though I am sure Omichund would invent a thousand lies to endcavour to alam your fears and suspicions’. Watts to Clive, 31 May 1757.
১০০। Orms, Indostan, II, pp. 158-159.
১০১। Watts to Clive, 3 June 1757.
১০২। Watts tw Clivc, 3 June 1757
১০৩। Watts to Clive, 4 June 1757, একথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তা পরে পলাশীতে প্রমাণ হয়েছিল।
১০৪। Orme, Indastan, 11, p. 160.
১০৫। Watts to Clive, 6 June 1757,6 p.m.
১০৬। Clive’s evidence to Parliamentary Committee 1772, Bengal in 1756-57, III p. 316.
১০৭। Two letters dated 5 June from Clive to Watts.
১০৮। Clive to Watts, 6 June 1757.
১০৯। Watts to Clive, 6 June 1757.
১১০। Watts to Clive 6 June, 9am, 1757.
১১১। Watts to Clive, 7 June 1757.
১১২। Watts to Clive, 6, June 1757.6 p.m.
১১৩। Watts to Clive, two letters dated 8 June 1757.
১১৪। From Mr Vernet and Council. Cossimbazar, to Mr Bisdom, 14 June 1757.
১১৫। Karam Ali, Muzaffarnama, in Bengal Nawabs, pp. 72-74.
১১৬। Watts to Clive, 9 June 1757.
১১৭। Watts to Clive, II June 1757.
১১৮। Clive to Nawab, 13 June 1757.
১১৯। Ibid.
১২০। Law, Memoir, p. 167.
১২১। Watts to Clive, 6 June 1757.
১২২। Bengal in 1756-57, II, p. 311.
১২৩। M. Renault from Chandernagore to M. Dupleix, 4 September 1757.
১২৪। Clive to Sheikh Amrullah, 12 June 1757.
১২৫। Nanda Kumar to Clive, 19 June 1757.
১২৬। Nawab to Watson 13 June 1757. also Nawab to Clive, 15 June 1767.
১২৭। Clive to Select Committee, 21 June 1757.
১২৮। Clive to Select committee, 15 June, 1757.
১২৯। Vemet to Bisdom, 16 June 1757.
১৩০। বাহাদুর আলি খান রাজা মোহনলালের জামাই ছিলেন, কিন্তু মীরজাফরের সঙ্গেও তাঁর গোপনে যোগাযোগ ছিল। শেষ পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে লড়াই করে তিনি নিহত হন। Clive to Select Committee, 24 June 1757.
১৩১। Jafar Ali Khan to Miza Omar Bcg, 19 June 1757.
১৩২। Orme, Indostan II p. 169.
১৩৩। Clive to Select Committee, 19 June 1757.
১৩৪। Clive to Jafar Ali Khan, 19 June 1757.
১৩৫। Clive to Select Committee, 19 June 1757.
১৩৬। Clive to Assaduzama Muhammed, 20 June 1757. বলা বাহুল্য আকারে ইঙ্গিতে ক্লাইভ মুহম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে লুঠের লোভ দেখাচ্ছিলেন।
১৩৭। Clive to Select Committes, 21 June 1757.
১৩৮। Mir Jafar to Clive, No date, received 22 June 1757, 3 p.m.
১৩৯। Fort William Select Committee Proceedings, 23 June 1757.
১৪০। Joumal of Eyre Coote, 21 June 1757, Bengal in 1756-57. III. p. 54.
১৪১। Message from Clive to Jafar Ali Khan, dated Placis 23 June 1757.
১৪২। Journal of Military Proceedings on the Expedition of Murshidabad, 23 June 1757, Bengal in 1756-57, Vol III, p. 66.
১৪৩। Seir II, p.89 n.
১৪৪। Clive to Select Committee, 24 June 1757, Bangal in 1756-57, II, p. 428.
১৪৫। Mr. Vernet to Dutch Director, 24 June 1757, ibid. p. 426.
১৪৬। Clive to Select Committee 21 June 1757.
১৪৭। Mr. Verriet to Dutch Director, 24 lune 1757: Elive to Select Committee 24. June 1757; Mir Jafar to Clive, 23 June 1757.
১৪৮। Mir Jafar to Clive, 23 June 1757.
১৪৯। Clive to Select Committee, 24 June 1757.
১৫০। Orme, Indostan II p. 175. ৩। Mir Jafar to Clive, 23 June 1757.
১৫১। Seir II, p.232.
১৫২। Mir Jafar to Clive, 23 June 1757.
১৫৩। Seir II p. 232-233.
১৫৪। Vernet to Dutch Director, 24 June 1757.
১৫৫। Seir II p 233.
১৫৬। Vemet to Dutch Director, 24 June 1757.
১৫৭। Mir Jafar to Clive, 23 June 1757.
১৫৯। Seir II, p. 242.
১৬০। ‘The country people about, call Europeon Banchots, i. e., cowards and poltrooms.’ M. Durand, of French Factory at Chandemagore, to M. Pieot de la Motte at Matey, 2 July 756, Bengal in 1756-57, Vol II, p. 81.
১৬১। Scrafton, Reflections, pp. 30-31.