কলকাতার নৈশ নাট্যের প্রধান পাত্রী হচ্ছে বারবনিতারা। কলকাতায় এমন শ্রেণির লোক নেই বললেই হয় বারবনিতার গৃহে যাদের আনাগোনা নেই। কলকাতার বারবনিতার সংখ্যা ধরা যায় না। কারণ এমন বারবনিতা এখানে অগুনতি আছে, যারা নানান রকম জীবিকার আড়ালে আত্মগোপন করে, আদম সুমারিতে তাদের নাম ওঠে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বাবুদের ঘরের দাসীদের কথাই ধরুন। অনেক নীতিবাগীশ বাংলা থিয়েটার দেখতে যান না এই অজুহাতে যে, বারবনিতার সংস্পর্শে আমাদের রঙ্গালয় কলঙ্কিত। কিন্তু তাঁরা দিন-রাত যাদের সংস্পর্শে আছেন, সেই দাসীরা কী? অধিকাংশই বারবনিতা! অনেক বাবু ঘরে বসেই তাদের উপভোগ করেন এবং কলকাতার প্রত্যেক পাড়াতেই এমন বাবুর সংখ্যা অল্প নয়!
কলকাতা শহরে বারবনিতার প্রধান আড্ডা হচ্ছে এইগুলি— সোনাগাছি, রুপোগাছি, জয়মিত্রের গলি, আপার চিৎপুর রোড, বউবাজার, কড়েয়া, হাড়কাটা গলি, হরি-পদ্মিনীর গলি, শেটবাগান, নতুন বাজার, মহেন্দ্র গোস্বামীর লেন, সিমলা, ফুলবাগান, কেরানিবাগান, শশিভূষণ সুরের গলি, বেনেটোলা, গরাণহাটা, ঢাকাপটি, জোড়াবাগান ও মালাপাড়া গলি প্রভৃতি।৪.১ এ ছাড়া কলকাতার অধিকাংশ পল্লিতেই কম বা বেশি সংখ্যায় বারবনিতা আছে— অর্থাৎ আমাদের এই শহরটি অবিদ্যার দ্বারা প্রায় আচ্ছন্ন বললেই চলে। নিশ্চয়ই কলকাতার বেশিরভাগ লোকই এদের বাড়িতে প্রায়ই আসে-যায়, নইলে দিনে দিনে এরা দলে এত ভারী হয়ে উঠছে কেন? চরিত্র সম্বন্ধে বাঙালির ধারণা খুব উচ্চ বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য বাঙালির নীতিজ্ঞান এদিকে কোনো কালেই বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেনি। প্রাচীন গ্রিসের মতো৪.২, দেড়-শো বৎসর আগে পর্যন্ত বাংলার পল্লিতে পল্লিতে বারবনিতার গৃহই ছিল গ্রামবাসীদের সাধারণ মিলন স্থান। পাড়ার বৃদ্ধেরা হরিনামের ঝুলি হাতে করে অবিদ্যার গৃহে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়মিতভাবে এসে হাজিরা দিতেন এবং তাঁদের সঙ্গে আসত যুবকগণও। এর মধ্যে কিছুমাত্র লজ্জা বা লুকোচুরি ছিল না, কারণ সেকালে এই ব্যাপারটা নির্দোষ বলেই গণ্য করা হত। নানা আলোচনায় সন্ধ্যার খানিকটা কাটিয়ে, সকলে আবার যে যার বাড়িতে ফিরে যেত। অর্থাৎ অবিদ্যার আলয় ছিল সেকালে পল্লির প্রধান বৈঠকখানা। কিন্তু সেকালের কথা এখন থাক।
কলকাতার দেশি বারবনিতার মধ্যেও শ্রেণিবিভাগ আছে। রাস্তা বা গলির ওপরে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তারা হচ্ছে সবচেয়ে নিম্ন স্তরের বারবনিতা। তারা প্রায়ই একতলা খোলার ঘরে বাস করে, অন্ধকার ও আবর্জনার মধ্যে। চাকর, মুটে ও গরিব ছোটোলোকরাই তাদের রূপের উপাসক। তার ওপরের স্তরের বারবনিতারা থাকে দোতলা মাঠকোটায়৪.৩। মালাপাড়া গলি, ঢাকাপটি ও জোড়াবাগান প্রভৃতি পল্লিতেই এদের বাস। সাধারণত গদিওয়ালা, দোকানি ও ধনীদের নিম্নপদস্থ কর্মচারীরাই এখানে আমোদের খোঁজ নেয়। তারপর কোঠাবাড়ির একতলা ঘরের বারবনিতা। তারা কিছু ভদ্র। তার ওপরের স্তরে চিৎপুর রোড, হাড়কাটা গলি ও হরিপদ্মিনী গলির বারবনিতা— যাদের বাস কোঠাবাড়ির দোতলায় বা তেতলায়। সাধারণত কেরানি প্রভৃতি দ্বারাই তাদের রূপের ব্যবসা চলে যায়। তার ওপরের স্তরই হচ্ছে সর্বপ্রধান স্তর। এ স্তরের মধ্যে আবার দুই দল— যারা বাঁধা, আর যারা ছুটো। বাঁধারাই সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত। এদের অনেকে দেড়-শো থেকে তিন-চার-শো টাকা পর্যন্ত মাসিক মাহিনা পায়। অনেকে আবার পাঁচ-শো, সাত-শো— এমনকী হাজার টাকা পর্যন্ত বৃত্তি ভোগ করে। ছুটোদের দৈনিক দর্শনী আট-দশ টাকা থেকে বিশ-পঁচিশ টাকা পর্যন্ত। যারা ভালো নাচ-গান জানে, তাদের দৈনিক রোজগার আরও বেশি— সময়ে সময়ে এক-শো দেড়-শো টাকা পর্যন্ত। এই স্তরে আর এক দল বারবনিতা আছে, যারা কতক ‘বাঁধা’ কতক ‘ছুটো’। তাদের কারোর বা বাবু আসে হপ্তায় নির্দিষ্ট কয়েক দিন, বাকি দিনে সে স্বাধীন। কারোর বাবু আসে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য— বাকি সময়ে সে যাকে খুশি তাকেই অভ্যর্থনা করতে পারে। এই নির্দিষ্ট কালের বাবুরা ‘টাইমের বাবু’ নামে বিখ্যাত। উচ্চস্তরের বারবনিতাদের প্রধান আস্তানা সোনাগাছি, রুপোগাছি ও সিমলার মধ্যে। এ স্তরের বারবনিতারা প্রায়ই নৃত্য ও সংগীত কলায় বিশেষজ্ঞ। অনেকে বেশ লেখাপড়া জানে এবং রবীন্দ্রনাথের কাব্যের ভক্ত পাঠিকা। এরা শরীরের ওপর তেমন অত্যাচার করে না বলে, এদের মধ্যে পরমা সুন্দরীরও অভাব নেই। এদের আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তা প্রায়ই বেশ শিষ্ট ও অশ্লীলতা বর্জিত। এই শ্রেণির বারবনিতারা বেশি বয়সে বড়ো একটা অর্থকষ্টেও পড়ে না— কারণ অনেক হতভাগ্যই এদের টাকার পাহাড়ের উপরে বসিয়ে, নিজেরা কাঙাল হয়ে পথের ধুলোয় গিয়ে বসে। তার ওপরে, প্রাচীন বয়সে এদের গর্ভজাত বা পালিত কন্যারাও টাকা রোজগার করে। মেয়ের টাকায় মায়ের দিন নিশ্চিন্তভাবে চলে যায়। বৃদ্ধ বারবনিতারা প্রায়ই বাড়িওয়ালি হয়!
সকল স্তরের প্রায় প্রত্যেক বারবনিতারই এক একটি নিজস্ব মানুষ পোষা থাকে। এই অবিদ্যার প্রেমপাত্র ঘৃণিত জীবগুলোর মধ্যে ভদ্রলোকের সন্তানেরও অভাব নেই। অবিদ্যারা রোজগার করে নিজেদের পয়সায় এদের খাওয়ায় ও জামাকাপড় পরায়। এই নর-কুকুরগুলো ‘নাই’ পেয়ে প্রায়ই মাথায় চড়ে বসে এবং যার পয়সায় বেঁচে আছে নির্দয়ভাবে তাকেই মারধর করে। কিন্তু হতভাগিনীরা তবু তাদের ছাড়তে পারে না— রূপোপজীবিনীর ভালোবাসাও এমন গভীর। এত সুখে থেকেও তাদের মনের মানুষরা প্রায়ই অন্য কোথাও উধাও হয়, তখন অনেক বারবনিতা শোকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে! এমন আত্মহত্যা এদের মধ্যে হামেশাই হচ্ছে। এইসব ব্যাপারে বোঝা যায়, বারবনিতার হৃদয়কে আমরা যেরকম শুষ্ক মরু বলে মনে করি, আসলে তার অবস্থা ততটা ভয়ানক নয়। হাজার হোক তারাও যে মানুষ! দয়া-মায়া স্নেহ-প্রেমে তারাই বা বঞ্চিত থাকবে কেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পতিতা’ কবিতায় এই কথাটি সুন্দররূপে বুঝিয়েছেন—
হৃদয় বলিয়া কিছু কি নেই?
ছেড়েছি ধরম, তা বলে ধরম
ছেড়েছে কি মোরে একেবারেই?
নাহিক করম, লজ্জা-সরম,
জানিনে জনমে সতীর প্রথা,
তা বলে নারীর নারীত্বটুকু
ভুলে যাওয়া, সে কি সহজ কথা?
আমি শুধু নহি সেবার রমণী
মিটাতে তোমার লালসা-ক্ষুধা!
তুমি যদি দিতে পূজার অর্ঘ্য
আমি সঁপিতাম স্বর্গ-সুধা!
দেবতারে মোর কেহ তা চাহেনি,
নিয়ে গেল সবে মাটির ঢেলা,
দূর দুর্গম মনোবনবাসে
পাঠাইল তাঁরে করিয়া হেলা!
‘পাপীকে ঘৃণা না করে পাপকে ঘৃণা করো’ —খ্রিস্টের এ বাণী সকলেরই মনে রাখা উচিত। এই যে পাপিনীর দল, ‘ধরার নরক সিংহদুয়ারে’ এরা কেবল সন্ধ্যাবাতিই জ্বালায় না। খোঁজ রাখলে দেখবেন, দেহদানের পাপ বাদ দিলে এদের অনেকেই ‘মানুষ’ হিসেবে কারোর চেয়েই খাটো হয়ে পড়বে না। কিন্তু তাদের এক পাপেই সমাজের যে যথেষ্ট অপকার হচ্ছে, তাতেও আর কোনো সন্দেহ নেই। সেইজন্যেই আমাদের সহানুভূতি এখানে অন্ধ না হয়ে পারে না। এদের রূপ-মোহে সমাজে যে নিত্য নব কত পাপের সৃষ্টি— চুরি, জুয়াচুরি, খুনখারাপি— হচ্ছে, পুলিশ-কোর্টে প্রতিদিন হাজিরা দিলে সেটা জানতে আর বাকি থাকে না। মন তখন স্বভাবতই এদের প্রতি নির্দয় হয়ে ওঠে।
সন্ধ্যা না হতেই চিৎপুর রোডের বারান্দায় রূপ বা কুরূপের প্রদীপগুলি সারি সারি বাহার দিয়ে বসে এবং রাস্তাতে গৃহাভিমুখী কেরানিবৃন্দ ঊর্ধ্ব-মুণ্ড ব্রত গ্রহণ করে। এই ব্রত পালন করতে গিয়ে অনেকেই মাঝে মাঝে গাড়ি চাপা পড়বার মতো হয়, কিন্তু সে ধাক্কা কোনোক্রমে সামলে নিয়েই ব্রত পালকেরা আবার একনিষ্ঠ ভক্তের মতো বারান্দার ওপরে ক্ষুধিত দৃষ্টি স্থাপিত করে। ধন্য সে অধ্যাবসায়, যার মধ্যে প্রাণের ভয় নেই! কে বলে বাঙালি ভীরু? …এই সময়েই অনেক পুরুষ পুঙ্গব রাত্রের ‘খাদ্য’ পছন্দ করে ফেলেন এবং তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে গা-মুখ ধুয়ে সাজপোশাক বদলে, একটু ঠান্ডা হয়েই নির্বাচিত খাদ্যে ছোঁ মারতে ছোটেন! চিৎপুর রোডের বারান্দা-বিপণিতে সাজানো দেহ-পণ্যের প্রধান খরিদ্দার যে মাছি মারা কেরানির৪.৪ দল তার জ্বলন্ত প্রমাণ, মাসকাবারের পরের প্রথম শনিবারে প্রায় কোনো পণ্যই ক্রেতার অভাবে পড়ে থাকে না! যত বড়ো কুৎসিত স্ত্রীলোকই হোক না, অন্তত সে-রাত্রের জন্যও তার একজন না একজন উপাসক মিলবেই মিলবে!
চিৎপুর রোডে রাত্রিতে এই বারান্দা-বিলাসিনীদের মুখ সুশ্রী কী কুশ্রী পথ থেকে দেখে তা চেনা যায় না। পুরুষরা অদৃষ্টের উপর নির্ভর করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে এবং ‘রূপসিরা’ও বাইরের বারান্দা ছেড়ে বাড়ির ভিতরের বারান্দায় এসে আপন আপন ঘরের দরজা জুড়ে দাঁড়ায়। তারপর দরদস্তুর। কিন্তু মাল না দেখে তো দর চলতে পারে না, কারণ অধিকাংশ বাড়ির ভেতরেই পূর্ণিমাতেও অমাবস্যা হয়ে থাকে। এক রাত্রের বহু বাবুরা প্রায়ই তখন এমন এক সুন্দর উপায় অবলম্বন করেন, যাতে করে শ্যামও থাকে, কুলও বাঁচে— অর্থাৎ মালও দেখা হয়, চক্ষুলজ্জাও অক্ষত থাকে! তাঁরা মুখে ধাঁ করে একটা সিগারেট গুঁজে, সেটা ধরাবার অছিলায় দেশলাই জ্বালেন এবং তারই অস্থায়ী আলোতে সামনের রমণীটিকে যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখে নেন!
সাধারণত দরদস্তুরের বাঁধা-ধরা নিয়ম এই—
বাবু। কিগো, লোক বসাবে?
বিবি। কতক্ষণ বসবেন?
কেউ বলে, এক বা দুই ঘণ্টা। কেউ বলে, সারা রাত। এক ঘণ্টার দর্শনী চার টাকা শুনলে বাবুরা হাঁকেন, দু-টাকা। সারা রাতের দর্শনী আট টাকা শুনলে বাবুরা বলেন, চার টাকা। তারপর মাঝামাঝি একটা রফা হয়। বেশি কম দর হাঁকলে, ‘না মশাই, এখানে হবে না, খোলার ঘরে যান’ —এমনই ধরনের একটা অযাচিত উপদেশ দিয়ে, আঁচল ঘুরিয়ে ও কোমর দুলিয়ে বিবিরা আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান।
সোনা ও রুপোগাছির ছুটো অবিদ্যারা নিতান্ত দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো অবস্থা না হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করে না। প্রায়ই চেনাশুনো বন্ধুর দয়াতেই তাদের ঘর খালি যায় না। বাইরের অচেনা লোক যারা আসে, তারাও দালালের মধ্যস্থতাতেই আনীত হয়। দর যা ঠিক হয়, তার চার আনা অংশ পায় দালালরা। মাঝে দালাল থাকলে বাবুদের টাকাও দিতে হয় বেশি, কারণ যার দাম আট টাকা, দালালের মধ্যস্থতায় এলে তারই দাম হয় দশ টাকা। বিবির দাম বেশি হলে নিজের পাওনাও বেশি হবে, তাই দাম চড়াবার জন্যে দালালরাও যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি করে না! বিবির দেহের দামের ওপরে বাবুর আর দুটি বাঁধা খরচ আছে। চার বা আট আনার পান এবং বিবির বেয়ারাকে আট আনা বা এক টাকার বখশিশ! তার ওপরে কোনো কোনো সুচতুরা বাবুর কাছ থেকে আজ্ঞার স্বরে আবদাব ধরে সে-রাতের জন্য নিজের ও মায়ের খাইখরচটাও আদায় করে নেয়। গ্রীষ্মের সময়ে রাস্তা দিয়ে ফুলওয়ালা গেলে আট আনা এক টাকার বেলের গোড়ের ফরমাশ হওয়াও খুব স্বাভাবিক। তার ওপরে ট্যাক্সিতে চড়ে গড়ের মাঠ পর্যন্ত বেরিয়ে আসবার বায়নাও আছে— তারও খরচ তিন-চার টাকার কম নয়। অধিকাংশ বাবুই বাড়িতে কিপটে হলেও এখানে এসে একেবারে দাতা কর্ণের নব্য সংস্করণে পরিণত হন এবং যেসব রাতের পাখি সবে উড়তে শিখেছে, তাদের হাতই দরাজ হয় সবচেয়ে বেশি। এ পথে যারা চেনা পথিক, অর্থাৎ যাদের হাড়ে ঘুণ ধরে গেছে, তাদের কাছ থেকে বিবিরা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন না। অবশ্য পুরাতন পাপীরা অচেনা হলেও, ভাবভঙ্গি দেখেই তাদের চিনে ফেলতে বিবিদের বেশি দেরি লাগে না। তবু সে ক্ষেত্রেও সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি হয় যথেষ্ট, অর্থাৎ বিবিরা চান পকেট ছ্যাঁদা করতে, আর বাবুরা চান সন্তর্পণে তা সামলাতে। বিবিরাই কিন্তু জেতেন বেশি। বাবুর ট্যাঁক গড়ের মাঠে পরিণত করবার বিবিধ উপায় তাঁদের নখদর্পণে আছে। যথা, বাবুর জন্য মদের বোতল এল। বোতল যখন এল, তখন পান করতেই হবে। কিন্তু বাবু পান করেন কীসে? বিবির ইশারায় বেয়ারা ঘরের চারিদিকে খানিকক্ষণ মিছে খোঁজাখুঁজি করে বলে দিলে— ‘গেলাস সব ভেঙে গেছে!’ অগত্যা বাবু নাচার হয়ে একটা বা দুটো নতুন গেলাস কিনে আনবার জন্য পকেটে হাত দিতে বাধ্য হলেন। ফলে আর কিছু না হোক, বিবির ঘরে অন্তত গেলাসের সংখ্যা তো বাড়ল বটে। পুরোনো পাপীদের কাহিল করবার জন্য এমনই আরও ঢের ছোটো বড়ো উপায় আছে।
অনেকের বিশ্বাস, টাকা দিলেই অবিদ্যার ঘরে গিয়ে অনায়াসে বসতে পারা যায়, তার কোনো পছন্দ নেই। এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ মিথ্যা না হলেও সম্পূর্ণ সত্যও নয়। অধিকাংশ বারবনিতাই যাকে তাকে ঘরে বসতে দেয় না এবং বেশি টাকা কবলালেও অচেনা লোকের সঙ্গে সহজে সারা রাত কাটাতে রাজি হয় না— অবশ্য খুব সম্ভব, ভয়েই। তাদের মতো অসহায় জীবনের তুলনা কোথায়? প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অবিদ্যারা চেহারা পছন্দ না হলে দ্বিগুণ মূল্যেও যে আত্মদানে রাজি হয় না, এ একেবারে খাঁটি কথা। তারা ইতর ও ভদ্রের বিচার করে লোক বসায় বা বিদায় করে দেয়, ছোটোলোকের ট্যাঁক ভরা টাকা থাকলেও তাদের চৌকাঠ মাড়াতে দেয় না।
আগেই বলেছি, অবিদ্যার চরিত্রের মনুষ্যত্বের অভাব নেই। তার একটি প্রমাণ দিচ্ছি। অভিভাবকেরা খবর রাখেন না যে, কত ইস্কুলের বালক পনেরো-ষোলো বৎসর বয়সেই কুস্থানে আনাগোনা করে। এসব জায়গায় বালকদের উপযোগী বালিকারও অভাব নেই, তবু অনেক এঁচোড়ে পাকা বালক আবার তাতেও তুষ্ট না হয়ে, তাদের চেয়ে সাত-আট-নয়-দশ বৎসরের বয়সে বড়ো যুবতীদের প্রতি লোভ প্রকাশ করে। কিন্তু প্রায়ই তাদের চেষ্টা বিফল হয়। বেশি টাকা দিলেও তাদের বিকৃত মনের বাসনা চরিতার্থ হয় না, বরং বকুনির চোটে তারা চটপট সরে পড়তেই বাধ্য হয়।
সন্ধ্যা হচ্ছে রূপের দোকান সাজানো এবং দরদস্তুরের সময়। তখন অবিদ্যা পল্লির বিশেষত্ব বড়ো ধরা পড়ে না। বাবুরাও তখন সবে এসে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসেছেন, আলাপ তখন জমে ওঠেনি এবং নেশা মাথায় চড়েনি— কাজেই চারিদিক তখনও অনেকটা শান্ত।
কিন্তু রাত ন-টার পরেই এখানকার আবহাওয়া যায় একেবারে বদলে। গেলাসে একের পরে দুই পেগ ঢালতে ঢালতেই বাবুদের চোখে দুনিয়ার রং গোলাপি হয়ে ওঠে, তিন পেগের সঙ্গে সঙ্গেই সকলের দেহে যেন নবজীবনের সঞ্চার হয়। পথের দু-ধারে ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম, গান ও বিকট স্বরে বাহবার আওয়াজ উঠে পাড়া একেবারে সরগরম করে তোলে। কোথাও বিবি ঘুঙুর পরে, মাথায় মদের গেলাস বসিয়ে, চোখ, ভুরু, ঠোঁট ও হাত লীলায়িত করে তনু দুলিয়ে নাচ শুরু করেন, বাবু হারমোনিয়াম ধরেন, ভাড়াটে তবলচি বা বাবুর মোসাহেব ঘন ঘন মাথা নেড়ে তবলা বাজায়, এবং জানলা বা দরজা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে পথের ওপরে কাতারে কাতারে কৌতূহলী লোক দাঁড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে নেশার খেয়ালে বাবুরও হঠাৎ নাচের শখ হয়, হারমোনিয়াম ঠেলে ফেলে এক লাফে তিনি বিবির পাশে গিয়ে দাঁড়ান, কোঁচার খুঁট ঘোমটার মতো করে মাথায় দিয়ে তাণ্ডব নৃত্যের সঙ্গে হেঁড়ে গলায় গান ধরেন। তার পরেই অত্যধিক ভাবের আবেগে বিবিকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করবার চেষ্টা এবং তার ফলে সঙ্গে সঙ্গে বিবির মাথার উপর থেকে মদ-ভরা গেলাসের সশব্দ পতন।
‘ওই যাঃ! আমার গেলাস ভেঙে গেল!’
‘যাক গে, তুই নাচ!’
‘হায় হায়, আমার নতুন গেলাস!’
‘তোর নতুন গেলাসের নিকুচি করেচে— আমাকে কি তেমনি বাবু পেয়েচিস? একটা গেল— দশটা হবে! এই বেয়ারা! বেয়ারা!’
‘হুজুর’ বলে বেয়ারার প্রবেশ।
‘নিয়ে আয় এক ডজন গেলাস— এই নেঃ!’ একখানা দশ টাকার নোট নিক্ষেপ ও মুখ টিপে হেসে বেয়ারার প্রস্থান!
‘এইবার আমার কাছে আয়, একটা …!’ বিবির মুখের কাছে বাবুর মুখ এগোল।
‘আঃ কী করো!’
‘না মাইরি, নইলে মরে যাব!’
‘আচ্ছা মাতালের পাল্লায় পড়লুম তো! ঘরে যে লোক রয়েছে।’
‘ড্যাম ইট— লোক? এই সবাই চোখ বোজ! কি এখনও বুজলি নে? মারব এই সোডার বোতাল ছুড়ে!’
তবলচি, মোসাহেব ও বন্ধুরা চট করে চক্ষু মুদে ফেললে। গোটাকতক অস্পষ্ট শব্দ শুনে যখন বুঝলে চুম্বন-পর্ব নিরাপদে সমাপ্ত, সবাই তখন আবার ধীরে ধীরে চোখ খুললে।
‘আর একখানা গান গা ভাই।’
‘যা চ্যাঁচাচ্ছে, এই গোলমালে গান?’
‘না না, এই চুপ করে বসলুম, আর একটা কথা কইব না।’
আবার গান শুরু—
কেটে দিয়ে প্রেমের ঘুড়ি, আবার কেন লটকে ধর!
একটানেতে বোঝা গেছে, তোমার সুতোর মাঞ্জা খর!
রাস্তায় হাঁকলে, ‘কুলপি মালাই কা বরফ।’
‘এই বরফ! বরফ!’
ফের গান থেমে গেল।
বাড়ির ভেতর অন্য অন্য ঘরে তখন হয়তো একদল মাতাল বাবুর সঙ্গে আর কোনো বিবি ও তাঁর মায়ের বিষম ঝগড়া বেধে গেছে। আর এক ঘরে ‘টাইমে’র বাবু হয়তো যথাসময়ে এসে দেখেন, তাঁর ঘরে অন্য লোক দিব্যি তাঁকিয়া ঠেস দিয়ে জাঁকিয়ে বসে আছে। তিনি অমনি বিবির উপরে কিল-চড় বর্ষণ আরম্ভ করলেন এবং অপর বাবুটি ফ্যাসাদ দেখে তিরবেগে পলাতক হলেন, বাবুর গর্জন ও বিবির আর্তনাদে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল। তারই সঙ্গে এসে মিলল বাড়ির অন্যান্য ঘর থেকে নানা নারী কণ্ঠের গীতধ্বনি আর হাসির হররা আর বাহবার হইচই।
সাধারণত এ-একটি অবিদ্যার আলয়ে রাত্রিকালে প্রায় এই ধরনের দৃশ্যেরই পুনরাভিনয় হয়। এরই নাম আমোদ! এরই জন্যে বাবুরা পাগল। অবশ্য এর ব্যত্যয় আছে। অনেক অবিদ্যার বাড়িতে সত্যসত্যই উচ্চশ্রেণির নাচ-গান বাজনার চর্চা হয়, গোলমাল সেখানে নেই বা খুব কম এবং বাবুরাও শান্ত ও ভদ্র!
রাত যত গভীর হয়, বিবি ও বাবুরা নেশায় কাবু হয়ে পড়েন ততই। তবলচি তখন দক্ষিণা নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে, তবলা ও বাঁয়া দুটো বিছানার ওপরে কাত বা উপুড় হয়ে পড়ে নীরবে গড়াগড়ি দিচ্ছে— তবু বিবির গান আর কিছুতেই থামতে চাইছে না। কিন্তু সুরাবিকৃত কণ্ঠের সেই ধ্বনি, গান না কান্না, না প্যাঁচার চেয়েও বেশি কর্কশ কোনো জীবের চিৎকার— তা বোঝা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। বাবুও বসে বসে মাঝে মাঝে ঘোরতর নেশায় চোখ মুদে ঢুলে পড়ছেন এবং মাঝে মাঝে চমকে প্রাণপণে চোখ চেয়ে চেঁচিয়ে উঠছেন— ‘কেয়াবাত’! …’তোফা’… ‘আ মরে যাই!’ ‘বা বা বা বা— বহুৎ আচ্ছা!’
এসব বাড়ির প্রধান বিশেষত্ব— সারি সারি তাকিয়াগুলো স্বস্থানচ্যুত হয়ে বিছানার কোণে, মাঝে, আশেপাশে বা ঘরের মেঝেতে কে কোথায় বিশৃঙ্খলভাবে ঠিকরে পড়েছে, শয্যার দুগ্ধ-ধবল পরিষ্কার চাদর পানের পিকে, মাংসের ঝোলে, আধ কামড়ানো হাঁসের ডিমে ও চলকে পড়া মদে বিচিত্র হয়ে অতি-বৃদ্ধের লোলচর্মের মতো কুঁকড়ে গেছে, তারই এখানে-ওখানে বাবুর কোনো বন্ধু নেশায় বেহুঁশ হয়ে নাক ডাকিয়ে নিদ্রা দিচ্ছে, এবং মেঝের ওপরে খালি ডিস, পাউরুটির টুকরো, মাংসের হাড়, পানের দোনা৪.৫ ও কলাপাতা এবং উপুড় হয়ে পড়া পিকদানি বা ডাবর সব একসঙ্গে জড়িয়ে বা ছড়িয়ে আছে। তার ওপরে বাবুর এক ঘুমন্ত বন্ধু বিছানায় শুয়ে শুয়েই— তরল ও নিরেট যা-কিছু গলা দিয়ে গলিয়েছিলেন— পেটের ভিতর থেকে হুড়হুড় করে অত্যন্ত হঠাৎ সে সমস্তই আবার বদন-পথে বার করে দিলেন।
এ ভূতুরে উপভোগ দৃশ্যের উপরে এইখানেই পর্দা ফেলে দেওয়া সংগত মনে করছি।
অভাগিনী বারবনিতা! কী অস্বাভাবিক জীবনই তাদের যাপন করতে হয়। নিত্যই তাদের ঘরে যেসব দুর্দান্ত অতিথি আসে, তাদের অধিকাংশেরই প্রাণে দয়া বা সহানুভূতির লেশমাত্র নেই, তাদের উৎকট আনন্দের প্রবাহ বন্যার চেয়েও নিষ্ঠুর! কিন্তু সমস্ত নীচতা ও জঘন্যতা অবিদ্যারা মৌনমুখে, মাথা পেতে সহ্য করে— বাসুকীর৪.৬ চেয়েও তারা সহিষ্ণু! যে টাকার জন্যে তারা এত করে, এই আশ্চর্য সহিষ্ণুতার তুলনায় তার মূল্য তো নগণ্য। মানুষ হয়ে এই পশু জীবনযাপন আমার কাছে কল্পনাতীত। এর উপরে আবার আছে প্রতি রাত্রেই প্রাণের ভয়। প্রায়ই ভোরবেলায় ঘরের দরজা খুলে দেখা যায়, কোনো অভাগিনী বিষে বা অস্ত্রে নিহত হয়ে বিছানার উপর পড়ে আছে —গত রাত্রের বাবুদের সঙ্গে তার অর্থ ও অলংকার সমস্ত অন্তর্হিত! এদের খুন করতে যাদের মায়া হয় না, তাদের বিশেষণ কী, কে জানে? আমি তাদের হত্যাকারী বলতে পারি না, তারা ঢের গুরুতর পাপে পাপী— যে পাপের ধারণা করা অসম্ভব।
গণিকার মেয়ের গণিকা হওয়া ছাড়া উপায় নেই— কাজেই তারা এমনতর অভিশপ্ত জীবনের ভার বহন করতে বাধ্য। কিন্তু যারা কুলে কালি দিয়ে বেরিয়ে আসে, মুহূর্তের জন্যেও তারা যদি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়, তবে তাদের ইন্দ্রিয় লালসার স্বপ্ন এক নিমেষেই ছুটে যাবে। প্রথম দু-চার দিন এমন জীবন হয়তো কোনো কোনো বিকৃত রুচিতে সহ্য হতে পারে, কিন্তু তারপরেই উপভোগের বদলে আসে শুধু জীবনব্যাপী হাহাকার ও দিবারাত্র নরকদাহ। এমন অত্যাচারে জড় যে, সেও কেঁদে ওঠে— মানুষ তো কোন ছাড়! আমি শপথ করে বলতে পারি, সর্বোচ্চ স্তরের সর্বপ্রধান গণিকাও সুখী নয় এবং তার আত্মদানেও উপভোগ নেই। তার মুখে হাসি দেখেচেন? হ্যাঁ, হাসিই বটে! কিন্তু ও-হাসির চেয়ে কান্নাও ভালো! হাসি যে এখানে দুঃখের ঘোমটা।
গণিকারা প্রায়ই যে কুৎসিত হয়, তার কারণ এই অস্বাভাবিক জীবন। এখানকার বিষাক্ত হাওয়ায় তিলোত্তমার রূপের ফুলও দু-দিনে শুকিয়ে যায়। আমার চোখের সামনে কয়েকটা গৃহস্থের মেয়ে গণিকা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ পরমা সুন্দরী ছিল। এখনও মাঝে মাঝে তাদের কারুকে কারুকে দেখতে পাই। কিন্তু এখন চেহারা দেখলে ঘৃণায় মুখ ফেরাতে হয়। সবচেয়ে সুশ্রীর রূপের পরমায়ুও এখানে এলে ফুরিয়ে যায় দু-দিনে।
এরকম আবহাওয়াতে পশুত্বের জন্মই স্বাভাবিক। কলকাতা গণিকাপল্লিতে এক একটি বাড়ি আছে, যাদের নাম রাখা চলে পৃথিবীর নরক। সেখানে এক এক দল পুরুষ ও নারী নির্মম এক ব্যবসা চালায়। কলকাতার পথে পথে, বাংলার পল্লিতে পল্লিতে তাদের চর ঘুরছে। তাদের কাজ চারিদিক থেকে মেয়ে ভুলিয়ে আনা। কলকাতার পথে প্রায়ই ছোটো ছোটো মেয়ে হারায়। ওই সব বাড়িতেই তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়। যুবতীরা কিছুদিন এখানে থেকেও যদি এদের কুপ্রস্তাবে মত না দেয়, তবে তাদের নানারকমে শায়েস্তা করা হয়। কেউ অনাহারে বন্দিনির মতো থাকে, কেউ মার খায়। তা ছাড়া আরও ঢের যন্ত্রণা আছে। অনেকের ওপরেই বলপ্রকাশ করা হয়। সুরবালা ও গায়ত্রীর বিখ্যাত বিচারে এখানকার অনেক গুপ্তকথাই সকলের কাছে জাহির হয়ে গেছে। তার ওপরে আর কিছু না বললেও চলে।
এই গণিকা পল্লিগুলো যত চোর, ডাকাত, খুনে ও গুন্ডার বিচরণক্ষেত্র। তার কারণ, এখানে যেসব রাতের পাখি স্থায়ী বা অস্থায়ী বাসা বাঁধে, তারা ভরা জেবেই আসে— খালি-পকেটের আবির্ভাব এখানে নিষিদ্ধ। এই পকেটের ভেতরে হাত চালাবার জন্যেই বদমায়েশরা রাত্রিবেলায় এখানে আড্ডা গেড়ে বসে। কলকাতার কোনো না কোনো গণিকা পল্লিতে একাধিক মারপিট, হত্যা বা রাহাজানি হয়নি, এমন রাত্রি দুর্লভ। এখানে ভাড়াটে গুন্ডার সংখ্যাও অগুনতি। রমনী সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁরা একপক্ষে নিযুক্ত হয়ে অন্য পক্ষকে আক্রমণ করে।
মধ্যে রুপোগাছিতে হামেশাই খুনখারাপি হত। কাজেই সেখানে পুলিশ পাহারার কড়াকড়ি হয় এবং এ-পাড়ার শিষ্ট ও অশিষ্ট পথিকদের যার ওপরেই সন্দেহ পড়ে, তাকেই নির্বিচারে বন্দি করা হয়। গুন্ডার ভয়েও বাবুদের ফুর্তি মাটি হয়নি, কিন্তু পুলিশের সুনজরে পড়বার ভয়ে তাঁরা এমন দমে গিয়েছিলেন, যার ফল হয়েছিল অত্যন্ত আশ্চর্য। এই পুলিশ-প্রভাবের যুগে একদিন রাত্রি সাড়ে এগারোটার সময়ে রুপোগাছির অবস্থা দেখতে গেলুম। …বিকালে আপিস ভাঙবার সময়ে লালদীঘির রাস্তায় যেরকম জনতা ও নানাজাতীয় গাড়ির ভিড় হয়, রাত সাড়ে-এগারোটার সময়ে রুপোগাছির ভেতরটাও দেখতে হয় সেইরকম। কিন্তু সে-রাত্রে গিয়ে দেখলুম, অবাক ব্যাপার। সমস্ত পথ অভিশপ্ত মরুর মতো শূন্যতায় ধূ ধূ করছে— একখানা গাড়ি নেই, একজনও পথিক নেই, চারিদিক মৃত্যুর মতো স্তব্ধ! কোথায় সেই পরিচিত নাচ-গান-বাজনার আওয়াজ, কোথায় সেই দশআনা-ছয়আনা চুল-ছাঁটা, পা-অবধি ঝোলানো চুড়িদার পাঞ্জাবি পরা, সুরা-রঙিন-চক্ষু কাপ্তেনবাবুর দল, কোথায় সেই হরেক রকমের চিৎকারে রত ফিরিওয়ালা এবং পথিকদের গায়ে পড়া দালালের দল! সব যেন কার মন্ত্রগুণে অদৃশ্য হয়েছে! …পথের মাঝে মাঝে খালি দাঁড়িয়ে আছে বড়ো বড়ো লাঠির উপরে ভর দিয়ে লালপাগড়ির দল— পাথরের মূর্তির মতো। একমাত্র তারা ছাড়া আর কোনো জীবনের লক্ষণ নেই। পাছে আমাদেরও ধরে আবার একরাত্রি ফাঁড়িতে বাস করবার জন্য নিয়ে যায়, তাই আগেই সাবধান হয়ে আমরা এক জমাদারকে ডেকে, আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য খুলে বললুম। পাহারাওয়ালারা আমাদের কথা বিশ্বাস করলে কিনা জানি না, কিন্তু আমাদেরকে গ্রেপ্তারও করলে না, কেবল নির্বাক বিস্ময়ে আমাদের মুখের পানে হাঁ করে চেয়ে রইল বোধ করি এই ভেবেই যে— এরা আবার কেমন সাহসী লোক, হাতকড়ির ভয় না রেখেই এ তল্লাটে এত রাত্রে অকারণে বেড়াতে এসেছে!…
বড়ো রাস্তা ছেড়ে, আশপাশের সরু গলিতে অর্থাৎ গণিকাদের প্রধান আস্তানায় ঢুকলুম। সেখানকার নির্জনতা আরও গম্ভীর, কারণ সেখানে আবার পাহারাওয়ালারাও নেই। দু-ধারের উঁচু বাড়িগুলো একান্ত স্তব্ধভাবে খাড়া হয়ে যেন স্তম্ভিতের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে, কোনো বাড়ি থেকে একটিমাত্র আলোকরেখা বাইরে এসে পড়েনি, প্রত্যেক জানলা দরজা খুব সাবধানে বন্ধ করা। রুপোগাছির এমন শ্মশানের চেয়ে শোচনীয় দৃশ্য জীবনে আর কখনো দেখিনি— এ যেন এক পরিত্যক্ত পল্লি, কিংবা হঠাৎ এক ভীষণ মড়কে এখানকার সমস্ত মানুষই যেন মরে গেছে, আর তাদের মড়াগুলো এখনও যেন প্রতি বাড়ির ভেতরেই ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আছে। একটা বুকচাপা বোবা আতঙ্ক যেন চারিদিক থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে এবং থমথমে রাত করছে যেন ঝিম ঝিম ঝিম! আমার বুকটা ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করতে লাগল। মাথার ওপরে আচম্বিতে একটা অদৃশ্য প্যাঁচা চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠল— ঠিক যেন প্রেতের আর্তনাদ! ওঃ! সে চিৎকার সেদিন কী অস্বাভাবিকই শোনাল— আমার দেহের রক্ত যেন জল করে দিয়ে গেল… রুদ্ধশ্বাসে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। পাশের বাড়ির ভেতর থেকে গলার আওয়াজ পেলুম— কারা খুব চুপিচুপি কথা কইছে। সাড়া পেয়ে মনটা তবু কিছু আশ্বস্ত হল, কিন্তু পথের ওপরে আমাদের জুতোর শব্দ শুনেই জীবনের সেই ক্ষীণ আভাসটুকুও অন্তিমের শেষ অস্পষ্ট কথার মতো এক মুহূর্তে থেমে গেল! …আর পারলুম না, তাড়াতাড়ি গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলুম… পাহারাওয়ালাদের কঠিন দৃষ্টির সামনে। এই প্রেত পল্লির মধ্যে তখন পাহারাওয়ালাদেরও দেখে আমার মনে হল বন্ধুর মতো।
সোনাগাছিতেও পুলিশ ধরপাকড় করতে ছাড়েনি। ফলে সেখানকার জনতাও খুব পাতলা হয়ে গেলেও, সে পাড়ার অবস্থা কিন্তু রুপোগাছির মতো এতটা শোচনীয় হয়নি। পুলিশ যদি দীর্ঘকাল এমনি সতর্ক থাকে, তবে কলকাতার একটা মস্ত উপকার হবে— অর্থাৎ রূপের ব্যবসা এখান থেকে একেবারে উঠে যাবে।
গণিকা পল্লিতে কেবল বদমায়েশদের জন্য নয়, আরও নানা কারণে অনেক সময়ে নির্দোষ লোকরাও সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়ে। আর এইটেই তো স্বাভাবিক। এক পাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলে অন্য পাপেরও সংস্পর্শে আসতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নীচে একটি ঘটনা দিলুম! ঘটনার যিনি নায়ক, এখন তিনি পরলোকে এবং সাহিত্য ক্ষেত্রেও তাঁর নাম অজানা নয়। অবশ্য তাঁর আসল নাম আমি করব না।
দুই বন্ধুর সঙ্গে হোটেলে খেতে বসে সতীনবাবু মনের খুশিতে সুরা দেবীর প্রসাদের মাত্রাটা সেদিন কিছু অতিরিক্ত করে ফেললেন। রাতও তখন অনেক— একটার কম নয়। এই রাত্রে এই অবস্থায় বাড়ি ফেরা অসম্ভব— বাড়ির লোক বলবে কী! অতএব ঠিক হল সে রাতটা বাইরে বাইরেই কাটিয়ে দিতে হবে।
তিন বন্ধুতে টলতে টলতে পথে বেরিয়ে পড়লেন, গন্তব্যস্থান— কোনো রূপসির বাড়ি।
কিন্তু অত রাত্রে অধিকাংশ দেবীর ঘরেই পূজারি এসে হাজির তো হয়েছেনই, তা ছাড়া যাদের তখনও সে সৌভাগ্য লাভ হয়নি, তারাও সতীনবাবুর কাতর প্রার্থনায় কর্ণপাত করলে না। রাত বারোটার পরে গণিকারা অচেনা লোককে বড়ো একটা ঘরে ঠাঁই দেয় না— বিশেষত এমন মাতাল অবস্থায়। কারণ, প্রাণের ভয়।
সতীনবাবু মহাবিপদে পড়লেন ঘর ও বাহির দুই-ই তাঁর সামনে বন্ধ। তবু তিনি আশা ছাড়লেন না। পথের দু-ধারের বাড়িতেই খোঁজ নিতে নিতে চিৎপুর রোডের উত্তরমুখে ক্রমশ এগিয়ে চললেন।
শোভাবাজারের কাছ-বরাবর এসে হঠাৎ দেখা গেল, একটা বাড়ির ছাদের ওপরে একটি নারী মূর্তি একাকী স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সতীনবাবু পথের ওপর থেকেই ইশারায় জানালেন, তাঁদের জন্যে ভেতরে একটা জায়গা চাই।
নারী মূর্তি হাতছানি দিয়ে সকলকে আহ্বান করলে।
সতীনবাবুরা আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন। এত কষ্টের পর আশ্রয় পেয়ে তাঁদের প্রাণ ভারি খুশি হয়ে উঠল। তেতলায় সেই নারীটির ঘর। এক কথায় দরদস্তুর হয়ে গেল। সকলে ঘরের ভেতরে গিয়ে মেঝের বিছানার ওপরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন।
তারপরে সুন্দরীর সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা চলল। আলাপ কিন্তু জমল না। সুন্দরী যেন কী এক ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আনমনার মতো দু-একটা কথার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এই বলে সে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে গেল— ‘একটু বসুন, এখনি আসচি।’
সতীনবাবু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, কিন্তু সুন্দরী তবু ফিরল না। দু-একবার চেঁচিয়ে ডাকলেন— কোনো সাড়া নেই। তখন তিনি উঠে বাইরে বেরোতে গেলেন, কিন্তু দরজা টানতেও খুলল না। বাহির থেকে দরজায় শিকল দেওয়া!
একটু আশ্চর্য হয়ে সতীনবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল ঘরের খাটের ওপরে! পা-থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে খাটের ওপর কে শুয়ে রয়েছে! আর, চাদরেও কীসের দাগ? সামনে ঝুঁকে পড়ে সতীনবাবু দেখলেন …রক্ত!…
তাঁর বুক যেন হিম হয়ে গেল। বন্ধু দু-জনকেও ডেকে ব্যাপারটা দেখালেন। একজন চাদরের খানিকটা তুলেই ছেড়ে দিয়ে অস্ফুট চিৎকার করে উঠলেন।
সতীনবাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দেখলে?’
প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বন্ধু বললেন, ‘মড়া! গলা কাটা!’
সকলেরই দেহে কাঁপুনি ধরল! …এক লহমায় সব নেশার ঘোর উবে গেল!
অনেক কষ্টে আপনাকে সামলে নিয়ে সতীনবাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুরুষ, না স্ত্রীলোক!’
‘পুরুষ!’
এখন উপায়? ঘরের ভিতর মড়া, আর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। নিশ্চয়ই তাঁদের বিপদে ফেলবার চেষ্টা হয়েছে। এখানে এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়, অথচ পালাবার পথ নেই।
সতীনবাবু বারান্দায় ছুটে গেলেন। উঁকি মেরে দেখলেন, ঠিক পাশেই আর একটা বাড়ির ছাদ। বন্ধুদের ডেকে, বারান্দা টপকে কোনোরকমে তিনি পাশের বাড়ির ছাদে গিয়ে পড়লেন। বন্ধুরাও তাঁর অনুসরণ করতে বিলম্ব করলেন না। পর পর কয়েকটা ছাদ পার হয়ে, তাঁরা একটা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেন। সেটাও গণিকালয়। অচেনা লোক দেখেও কেউ কোনো সন্দেহ করল না।
পথে বেরিয়েই সকলে দেখলেন, একদল পাহারাওয়ালা ব্যস্তভাবে তাঁদের সম্মুখ দিয়েই সেই ভয়ানক বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সেখানে আর একটু থাকলেই সকলকে এদেরই কবলে পড়তে হত।
খুব সম্ভব, খুন করে খুনি সরে পড়েছে, আর নিজের গলা বাঁচাবার জন্যই স্ত্রীলোকটা এই নির্দোষ তিনটির ঘাড়েই সব দোষ চাপাবার ফিকিরে ছিল। পুলিশে খবর পাঠিয়েছিল সে ছাড়া আর কেউ নয়।
***
টীকা
৪.১ সোনাগাছি….. মালাপাড়া গলি— এই অংশে সরাসরি তারাপদ সাঁতরাকে উদ্ধৃত করি, “নন্দরাম সেন স্ট্রিট পেরিয়ে একটু এগুলেই শোভাবাজার মোড়। দোকান-বাজারে জনাকীর্ণ এই স্থানটিতে অসংখ্য অটো রিকশা যেন হাট বসিয়ে দিয়েছে। একদা হুতোম চিৎপুর রোডে সেকালের নানাবিধ ‘গাড়ির হররা’ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘…বিনা ব্যাঘাতে রাস্তায় চলা সোজা কর্ম নয়।’ হালের শোভাবাজারের এই মোড়ে দেখা গেল, অটো রিকশা ও মিনি বাস যেন সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।
শোভাবাজার স্ট্রিট, পশ্চিমে গঙ্গার ঘাট অবধি প্রসারিত। এ রাস্তায় বাঁ-হাতি পড়বে বিখ্যাত ঔষধবিক্রেতা বটকৃষ্ণ পালের তিনতলা বাড়ি, যেটিকে দেশি ও বিদেশি স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে গঠিত এক অভিনব অট্টালিকা বলা চলে। পালমশায়ের নির্মিত অনুরূপ স্থাপত্যের আর একটি দোকান বাড়ি দেখা যায় বনফিল্ডস লেনে। আরও একটু এগিয়ে গেলে বাঁ-হাতি পড়বে সুর পরিবারের প্রতিষ্ঠিত উনিশ শতকের এক নবরত্ন মন্দির। শোভাবাজার মোড় থেকে রবীন্দ্র সরণি ধরে দক্ষিণে সামান্য এগিয়ে গেলে কথিত বটকৃষ্ণ পালের নামাঙ্কিত বি. কে. পাল অ্যাভেনিউ রবীন্দ্র সরণির উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে প্রসারিত। বলতে গেলে, এখান থেকেই বাঁ-হাতি দক্ষিণ-পুবে শুরু হল সেকালের ‘বটতলা’ এলাকা। সরণি দিয়ে সামান্য এগিয়ে গেলে সামনেই পড়বে চারদিক বাড়ি ঘেরা একফালি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে জয় মিত্র পার্ক। তারপরেই বাঁ ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে গেলে আয়রন চেস্ট, মাটিতে গেঁথে রাখার প্রয়োজনে সাবেকি লোহার ছোট-বড় সিন্দুক আর লোহার আলমারি তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানা সেকালের তস্কররোধক বিত্ত সঞ্চয়ের স্মৃতিকে আজও টিকিয়ে রেখেছে। এ সব পেরিয়ে বাঁ-হাতি এবার সোনাগাজি পীরের গলি; দূরে পীর সাহেবের মাজার ইত্যাদি ধর্মস্থানটির স্থাপত্যটিকে দেখা যাচ্ছে। তবে সোনাগাজির গলি আজ দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট নামাঙ্কিত হলেও, কলকাতার সুবৃহৎ রূপবিলাসিনীদের আখড়া হিসেবে চিৎপুরের ‘সোনাগাছি’ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। সেকালের বটতলা এলাকার শুরু থেকে চলে আসা গেল বটতলার বইপাড়ায়। আঠারো শতকের শেষ দিকে এই এলাকাতেই ছোটখাটো ছাপাখানা গজিয়ে ওঠার সুবাদে ছাপা শুরু হয়েছিল নানাবিধ ধর্মীয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সমাজধর্মী প্রহসন এবং আদিরসাত্মক পু্স্তকাদি। তাই ছাপাখানা যখন এল তখন ওই সব বিষয়ে বিবিধ পুস্তক পাইকারি ও খুচরো বিক্রির কেন্দ্র হিসাবে এই বটতলাই ছিল কলকাতার আদি বইপাড়া। আজ হয়তো সেকালের মতো অত বইয়ের দোকান আর নেই, তবুও যে’কটি দোকান আজও আছে তার মধ্যে নাম করা যেতে পারে, ‘নৃত্যলাল শীলস লাইব্রেরী’, ‘মহেন্দ্র লাইব্রেরী’, ‘কলকাতা টাউন লাইব্রেরী’, ‘ডায়মন্ড লাইব্রেরী’, ‘তারাচাঁদ দাস অ্যান্ড সন্স’, ‘অক্ষয় লাইব্রেরী’, ‘তারা লাইব্রেরী’, ‘ক্রাউন লাইব্রেরী’ প্রভৃতি। হুতোম তাঁর নকশায় এই এলাকাকে কেন্দ্র করে একদা লিখেছিলেন, ‘হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্লে….’ ইত্যাদি। যদিও আজ হাফ বা ফুল আখড়াই, তরজা, কবিগান ও পাঁচালীর দলেরা তেমন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত নেই, কিন্তু যাত্রাপালার সদর দফতর আজও চিৎপুরে রয়ে গেছে। বটতলার বইপাড়ার ডানহাতি নিমু গোস্বামীর গলি। যাঁর নামে এই রাস্তা সেই নিমাইচরণ গোস্বামীর বৃহৎ বসতবাটিতে একসময়ে বলরামের রাস হত চৈত্র মাসে। সেজন্যই লোকেরা গান বেঁধেছিল, ‘জন্ম মধ্যে কর্ম নিমুর চৈত্র মাসে রাস/ আলোর সঙ্গে খোঁজ নেইকো, বোঝা বোঝা বাঁশ।’ এ গলি পেরিয়ে আর একটু এগোলেই ডানদিকে বৃন্দাবন বসাক স্ট্রিট। একসময় এখানেই ছিল এক বিখ্যাত টাইপ ফাউন্ড্রির কার্যালয়। কাছেই নিমতলার কাঠগোলার দৌলতে ছাপাখানার প্রয়োজনে কাঠের অক্ষর ডালা ও গ্যালি তৈরির কারুশালা এখনও এখানে দেখা যেতে পারে। তা ছাড়া এই বৃন্দাবন বসাক স্ট্রিটের সঙ্গে নিমু গোস্বামী লেনও গরাণহাটার মেয়ে বউদের দিয়ে বটতলার বইয়ের ফর্মা ভাঁজাইয়ে দফতরির কাজ করানোর এক বড় কেন্দ্র। এ রাস্তার ১৯/এ নম্বরে শোভারাম বসাকের পৌত্রবধূ হরসুন্দরী দাসীর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত রাধাকান্তের সাবেক মন্দিরটি ভগ্ন হওয়ায়, শিল্পী সুনীল পালের পরিকল্পনায় সেখানে আধুনিক স্থাপত্যের একটি নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এবারে গরাণহাটায় পৌঁছে যাওয়া গেল। একসময়ে নদীপথে সুন্দরবন থেকে আসত সরু ও লম্বা ধরনের লালচে রঙের গরানকাঠ— যা সেকালের অল্পবিত্তদের ছিটেবেড়ার দেওয়ালযুক্ত ঘর নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হত। এই মজবুত কাঠের প্রয়োজনে এখানে একটি হাট ও আড়ত গড়ে ওঠার কারণে এলাকার সেই গরাণহাটা নামটি আজও থেকে গেছে। রবীন্দ্র সরণির বাঁ পাশের ফুটপাত থেকে শুরু হয়েছে গরাণহাটা স্ট্রিট, যা সোজা চলে গেছে দক্ষিণ-পুবে। খানিক এগুলে এ রাস্তার বাঁ পাশের বাঁকে দেখা যাবে দত্ত পরিবারের ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জোড়া আটচালা শিবমন্দির, যা পুরাকীর্তি হিসাবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তবে গরাণহাটা এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিন্তু বহুধাবিস্তৃত। এই এলাকার একটি বিখ্যাত শিল্পকর্মের ট্র্যাডিশন এখনও এখানে অব্যাহত রয়েছে। বটতলার প্রকাশকদের উদ্যোগে বাংলায় সচিত্র গ্রন্থ প্রকাশের তাগিদে যে কাঠখোদাই করা ছবির ব্লক প্রস্তুত করা হত, সে সব শিল্পীদের একটা কেন্দ্রীভূত বসতিও গড়ে উঠেছিল এই এলাকার আশেপাশে। কালীঘাটের পটের ছবি যেমন তুলিতে আঁকা, বটতলার ছাপাই ছবি তেমন কাঠের উপর লোহার বুলি দিয়ে এচিং করে আঁকা। বহু ক্ষেত্রে আবার কালীঘাটের দেশি পাটের ছবির ঢং-এ এখানের শিল্পীরা কাঠে খোদাই করেছেন, এবং তা ছাপার পরে প্রয়োজনীয় রং লাগিয়েছেন সস্তায় বেশি কাটতির আশায়। সেকালের বটতলার বইতে ছাপা এমন অসংখ্য ছবির নমুনা এখানকার ছাপাই ছবির কারিগরদের মুনশিয়ানার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। গরাণহাটা ও জোড়াসাঁকো এলাকার কাঠখোদাই কাজের সে ঐতিহ্য বেশ কিছুটা ম্লান হলেও, পুরোপুরি তা কিন্তু লুপ্ত হয়নি। আজও ছাপাখানার চাহিদা মেটানোর তাগিদে ছোট-বড় কাঠের অক্ষর, ভারতীয় মনীষীদের মূর্তির লাইন ব্লক বা বিশেষ করে স্বাক্ষরের অবিকল প্রতিরূপযুক্ত রবার স্ট্যাম্প তৈরির প্রয়োজনে কাঠের ফ্যাকসিমিলি ছাঁচ বা ডিজাইন অনুযায়ী হরেক রকম কাঠের ব্লক সরবরাহে চিৎপুরের গরাণহাটা ও জোড়াসাঁকোর ছোট-বড় কাঠের ব্লক নির্মাণের দোকান স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।” সঙ্গের ছবিতে সেকালের গরাণহাটা।
৪.২ প্রাচীন গ্রিসের মত— ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হেরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ – খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)- এর লেখায় এই পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র মূল্যে যৌনসংগম করতে হত। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। প্রাচীন গ্রিস, এথেন্স ও রোমে বহু বছর আগেই পতিতাবৃত্তি চালু হয়েছিল। এমনকি সেসময় অনেককে বাধ্য করা হত পতিতাবৃত্তি করতে। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমকসম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে বেশ্যা ছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তিতে কোনও পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই।
৪.৩ মাঠকোঠা— মাটির তৈরি একতলা বা দোতলা, একচালা বা দোচালা বাড়ি। সুবল চন্দ্র মিত্র তাঁর অভিধানে লিখছেন, “বাঁশ, কাঠ, খড় ও মৃত্তিকাসহায়ে নির্মিত দ্বিতল বাটীকে পল্লীগ্রামে ‘মাঠকোঠা’ বলে। ইহাতে ইষ্টকের সম্পর্ক থাকে না।”
৪.৪ মাছি মারা কেরানি— এমন এক লোক, যার কাজ হল অন্ধ অনুকরণ করা। কোম্পানির শাসন আমল, মানে ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে কোনও একটি সময়ের কথা। সেসময় মাত্র অফিস-আদালতের ধারণাটা গড়ে উঠছিল। প্রযুক্তিও এখনকার মতো এত সমৃদ্ধশালী ছিল না। তাই এখনকার মতো স্ক্যানার বা ফটোকপি মেশিনও ছিল না, তাই কিছু লোকের কাজ ছিল কপি করা। মানে হয়তো একটা ছাপানো বই আছে, সেটি দেখে দেখে হুবহু বইটি বা এর কিছু অংশ লিখতে হত। এভাবে একবার একজন বই লেখা শুরু করলেন। নিজে তো আর বুদ্ধি করে লেখেননি, আর-একজনের লেখাটা হুবহু তুলছিলেন। প্রথম পাতার পর দ্বিতীয় পাতা, দ্বিতীয় পাতার পর তৃতীয় পাতা, এভাবে লিখেই যাচ্ছেন। শব্দের জায়গায় শব্দ, অক্ষরের জায়গায় অক্ষর, দাঁড়ি কমা সেমিকোলন থাকলে তাই, একটার পর একটা কপি করেই যাচ্ছিলেন।
ঝামেলা লাগল একটু পরেই, কিছুদূর এভাবে কপি করার পর একটা লাইনে এসে দেখেন একটা মাছি মরে পরে আছে। এখন এটা কি আদৌ কোনও সমস্যা হওয়ার কথা? ওই কেরানি লোকটি কিন্তু এটাকে বিরাট সমস্যা বানিয়ে দিলেন। তিনি মনে করলেন, মূল বইয়ে যেহেতু একটা মাছি পড়ে আছে, তার কপিতেও থাকতে হবে, না হলে কপি কীভাবে হবে! একবারও তাঁর মাথায় এল না, আরে মাছিটা কি আর বইয়ের অংশ! সেটা তো পরে এসেছে। সেই কেরানি ব্যক্তি যা করলেন, তিনি তারপর মাছি সন্ধানে বের হলেন, কোথায় তিনি একটি মাছি পান? অবশেষে তিনি একটি মাছির সন্ধান পেলেন, তাকে মারলেন। কিন্তু এই মাছিটা দেখা যাচ্ছে সাইজে অনেক বড়ো। তারপর তিনি অনেকগুলো মাছি মারলেন। পছন্দমতো একটা সাইজ নিলেন, সেটা তিনি তাঁর কপি করা বইয়ের ওই অংশে জুড়ে দিলেন। এভাবেই নাকি একটা বই হুবহু কপি হয়ে গেল।
মূল বিষয়টা হল, ভালো মন্দ বিচার না করে অন্যের নির্দেশ মানাটা আসলে ঠিক নয়। অবস্থা বুঝে তোমাকে নিজেকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটা করবে আর কোনটা বাদ দেবে। মাছি মারা কেরানি এই প্রবাদটি লোকমুখে চলতে চলতে এতই জনপ্রিয়টা পেয়ে গেছে যে, যে-কোনো কাজের ক্ষেত্রে অনুরূপ ঘটনা ঘটলেই এটা বলা হয়। কাছাকাছি অর্থের এরকম আর-একটি প্রবাদ আছে। প্রবাদটি হল, ‘গড্ডল প্রবাহ’। এখানেও একটা মজার ব্যাখ্যা আছে। ভেড়ারা নাকি সামনের জনকে দেখে এগিয়ে যায়। একজন যেদিকে যায়, বাকিরাও কোনও কিছু না ভেবে পুরো পাল ধরে আগে পিছে না দেখে সামনে এগিয়ে যায়।
৪.৫ পানের দোনা— পানের খিলি রাখবার ঠোঙা
৪.৬ বাসুকী— মহাভারতে উল্লিখিত সর্পকুলের রাজা অর্থাৎ নাগরাজ বাসুকি। বাসুকি শিবের সর্প, মনসা তাঁর বোন। শিবের গলায় তাঁর অবস্থান। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী দেবতারা সমুদ্র মন্থনের জন্য বাসুকিকে রজ্জু হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। বৌদ্ধ পুরাণেও ধর্মীয় আসরে শ্রোতা হিসেবে বাসুকির উল্লেখ দেখা যায়।
কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী কদ্রুর জ্যেষ্ঠ নাগ-পুত্র (অনন্তনাগ, শেষনাগ ও বাসুকি- তিন নামেই ইনি পরিচিত)। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল তুষ্টি। ইন্দ্রের অশ্ব উচ্চৈঃশ্রবার লেজের বর্ণ নিয়ে কশ্যপের দুই স্ত্রী কদ্রু ও বিনতার তর্ক হলে, কদ্রু অশ্বের লেজ কালো বলেন। তাঁর কথা সত্য প্রমাণিত করার জন্য, কদ্রু তাঁর সর্পপুত্রদের উচ্চৈঃশ্রবার সাদা লেজে অবস্থান করতে বলেন। অনন্ত ও আরও কয়েকজন মায়ের এই আদেশ অগ্রাহ্য করায় কদ্রু নাগদের শাপ দেন যে, তারা জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে দগ্ধ হয়ে মারা যাবে। এরপর তিনি কঠোর তপস্যায় প্রাণ ত্যাগ করতে চান, যাতে এই দুর্জন ভাইরা পরলোকে তাঁর সঙ্গে না থাকে। তাঁর এই কঠোর তপস্যার কারণ জেনে ব্রহ্মা তাঁকে বলেন পাতালে গিয়ে পৃথিবীকে নিশ্চলভাবে ধারণ করতে। সেই আদেশ অনুসারে তিনি পাতালে গিয়ে পৃথিবী ধারণ করেন। এই সময় পাতালের নাগগণ তাঁকে নাগরাজ বাসুকিরূপে বরণ করলেন। ব্রহ্মা নাগদের শত্রু গরুড়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ঘটিয়ে দেন। মায়ের অভিশাপ থেকে তাঁর অন্যান্য ভাইদের রক্ষা করার জন্য তিনি উপায় অন্বেষণ করতে থাকেন। এই সময় এলাপত্র নামক এক নাগ অনন্তকে বলেন যে, অভিশাপদানকালে তিনি মায়ের কোল থেকে শুনেছিলেন— জরত্কারুর সন্তান আস্তিক মুনি সাপদের রক্ষা করবেন। এরপর অনন্ত জরত্কারু মুনিকে খুঁজে বের করেন এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর নিজের বোনের বিবাহ দেন। অনন্তের এই বোনের নামও ছিল জরত্কারু।
অনন্ত শব্দটির আর-এক অর্থ- অন্তহীন [অ (ন) অন্ত], অর্থে― ব্রহ্ম, বিষ্ণু। এঁর ফণার সংখ্যা মোট ছয়টি এবং তা পদ্মফুলের মতো বিস্তৃত। পুরাণ মতে― নাগদের মধ্যে ইনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। ইনি পৃথিবীকে তাঁর স্কন্ধে ধারণ করে আছেন। ইনি যখন পৃথিবীকে তাঁর এক স্কন্ধ থেকে অন্য স্কন্ধে ধারণ করেন তখন সমস্ত পৃথিবী কম্পিত হয়।
অমর হওয়ার জন্য দেবতা ও অসুররা যখন সমুদ্র মন্থন করেন, তখন রজ্জু হিসাবে অনন্তকে ব্যবহার করা হয়েছিল। সমুদ্র মন্থনে অমৃত উত্থিত হওয়ার পরও তাঁরা আবার সমুদ্র মন্থন করতে থাকেন। কিন্তু সহস্র বৎসর ক্রমাগত মন্থনের পর অনন্ত হলাহল নামক তীব্র বিষ উদগিরণ করতে লাগলেন। এই বিষের প্রভাবে জীবজগৎ বিপন্ন হলে, দেবতাদের অনুরোধে মহাদেব সমস্ত হলাহল পান করে ফেলেন। কালিকাপুরাণ মতে― প্রলয় শেষে বিষ্ণু লক্ষ্মীর সঙ্গে এই সাপের মধ্যম ফণায় শয়ন করেন এবং এর ফণাগুলো বিষ্ণুকে ছাতার মতো আচ্ছাদিত করে রাখে। এঁর দক্ষিণ ফণায় বিষ্ণুর উপাধান ও উত্তর ফণায় পাদপীঠ। বিষ্ণুপুরাণের মতে- ইনি বলরামের অবতার।