চতুর্থ খণ্ড – প্রতিহিংসা—মূর্তিমতী

চতুর্থ খণ্ড – প্রতিহিংসা—মূর্তিমতী

Sacha. He catches her-
Melissa. And now he lets her go-
Again She’s in his grasp-
Psyche. And now he is not!
He seizes her back hair-
Blanche. and it comes off?
Gilbert-”The Princes” Scene III

প্রথম পরিচ্ছেদ – প্রতারিত

যখন দেবেন্দ্রবিজয়ের জ্ঞান হইল; দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে মুক্ত পৃথিবীর চারিদিক্ প্রভাতরবির হিরণ্য-প্রবাহে পুলকিত এবং প্রদ্যোতিত; তিনি নিস্তরঙ্গ নদীবক্ষে, নৌকার উপরে। দাঁড়িরা অদূরে বাসায় সশব্দে, দ্রুতহস্তে দাঁড় নিক্ষেপ করিয়া নৌকাখানাকে অত্যন্ত দ্রুতবেগে একদিক্ হইতে অপরদিকে লইয়া যাইতেছিল। নদীর দুই পার্শ্ব নীরব; কেবল দূর পল্লীমধ্য হইতে ক্রীড়াপরায়ণ বালকদিগের হাস্যকল্লোল এবং কোন নিদ্রোত্থিত দুগ্ধপোষ্যের রোদনধ্বনি এক একবার অস্ফুট শোনা যাইতেছিল। অনতিদূরস্থ একটি দেবদারুর শীর্ষদেশ হইতে করুণকণ্ঠ ‘বউ-কথা-কও’ পাখী, আলোকম্বরা ধরণীর নগ্ন বক্ষ শব্দ-তরঙ্গ প্লাবিত করিয়া অভিমানমৌন প্রিয়াকে অবিশ্রাম সপ্রেম-সম্ভাষণ করিতেছিল। তাহার সেই বেদনাগীতি, সেই শোভন স্তব্ধ, সুন্দর কিরোণোজ্জ্বল প্রভাতের অখণ্ড প্রশান্তির মধ্যে নিরতিশয় মধুর শুনাইতেছিল। এবং তটস্থ সঙ্গীহীন দীর্ঘ গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘতর হইয়া নদীবক্ষে অনেকদূর অবধি প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছিল।

দেবেন্দ্রবিজয় মুগ্ধ নেত্রে ও অতি বিস্ময়ের সহিত সেই সকল দেখিতেছিলেন ও শুনিতেছিলেন। কতক্ষণ পরে, কিরূপে তাঁহার চেতনা সঞ্চার হইল, তাহা কিছুতেই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলেন না; এমনকি তখনও তিনি যে সসংজ্ঞ হইয়াছেন, সে বিষয়েও তাঁহার মনে একটা দারুণ সন্দেহ হইতেছিল। মনে হইতেছিল, ইহাও একটা স্বপ্নের খেয়াল ব্যতীত আর কিছুই নহে।

তিনি কিছুতেই তাঁহার সেই ভয়ানক বিপদের কথা আগাগোড়া মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। অতিকষ্টে তিনি সেইসকল একটু একটু স্মরণ করিতেছিলেন; তথাপি তখন সেই দস্যু-রমণী ও আশ্চর্য্য রোগীর মুখ ভাল রকমে তাঁহার মনে আসিতেছিল না; তাঁহার অবসন্ন দেহ, যে দীর্ঘাকৃতি অপরিচিত ব্যক্তি গৃহতল হইতে আপনার বুকে তুলিয়া লইয়াছিলেন, তাঁহার মুখ যদিও এক একবার মনে পড়িতেছিল, কিন্তু কিছুতেই তাহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না; একটা প্রহেলিকাম অপূৰ্ব্ব দৃশ্য যে, তখন হইতে এখন পর্যন্ত তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখে অভিনীত হইতেছে, ইহাই যেন তাঁহার একান্ত বিশ্বাসের সহিত হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল। এখনও যেন সেই ধূম, সেই উগ্রগন্ধ তাঁহার শ্বাসরোধ করিতেছে। তিনি অতিকষ্টে নিঃশ্বাস ফেলিতেছিলেন। মাথা ও বুক অত্যন্ত ভারী বোধ হওয়ায় তিনি চেষ্টা করিয়াও সোজা হইয়া বসিতে পারিতেছিলেন না;একটা দুবির্ষহ উন্মাদক নেশা তাঁহার মস্তিষ্ক পূর্ণরূপে অধিকার করিয়াছিল। তিনি সেই নেশার ঝোঁকে অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “একি ভয়ানক জটিল রহস্য! স্বামী-স্ত্রীতে মিলিয়া এরূপ প্রবঞ্চনা করিয়াই কি তাহারা দিনতিপাত করে! সেই স্ত্রীলোকটি—কত সুন্দর দেখিতে সে! কে তাহাকে দেখিয়া বুঝিবে, তাহার হৃদয় এইরূপ কালকূটে ভরা; নিশ্চয় তাহারা দুইজনে মিলিয়া, আমাকে খুন করিয়া আমার নিকটে যা কিছু আছে, সমস্তই কাড়িয়া লইবে মনে করিয়াছিল;কিন্তু আশ্চর্য্য! কে আমায় সেই ভয়ানক মৃত্যু হইতে, আরও সেই ভয়ানক খুনীদের হাত হইতে উদ্ধার করিল? এখন আমি কোথায়? কোথায় যাইতেছি? এ নৌকার উপরেই বা আমাকে কে লইয়া আসিল?”

নৌকা দ্রুতগতিতে চলিতেছিল বলিয়া, নদীবক্ষের শীকরসিক্ত স্নিগ্ধ প্রতিকূল বায়ু দেবেন্দ্রবিজয়ের সর্বাঙ্গে প্রবলবেগে সঞ্চালিত হইয়া ক্ষণে ক্ষণে স্পষ্টরূপে তাঁহার দুর্বল মস্তিষ্কের বলিদান করিতেছিল। দেবেন্দ্রবিজয় একজন দাঁড়িকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছ, এ নৌকার উপরেই বা কে আমাকে লইয়া আসিল?”

নৌজীবীদের দল তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিল না–ঝপ্ ঝপ্ শব্দে দাঁড় বাহিয়া সেইরূপ দ্রুততরবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল।

দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বাপেক্ষা উচ্চকণ্ঠে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কোথায় আমাকে লইয়া যাইতেছ?”

নৌ-বাহকদের মধ্যে একজন বলিল, “আমরা আপনাকে ঠিক নিয়ে যাব, সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই। আপনি একটু চুপ করে বসুন।”

দেবেন্দ্রবিজয় বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন, কোথায়? যমপুরীতে না কি? সেই ভয়ানক মৃত্যুর পর কি এ-যমপুরী যাত্রা না কি; প্রকাশ্যে বলিলেন, “আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছ, না বলিলে আমি কিছুতেই তোমাদের সঙ্গে যাইব না। আমাকে এখানে নামাইয়া দাও।”

এরূপ গোলযোগ দেখিয়া মাঝি সেইখানে উপস্থিত হইল। এবং দেবেন্দ্রবিজয়কে বিনীতভাবে বলিল, “আপনার বাড়ীতেই আপনাকে নিয়ে যাব, আমরা আপনার ঠিকানা জানি, আপনি এখন ব্যস্ত হবেন না—একটু স্থির হ’য়ে বসুন। আপনার এখনও নেশা আছে।”

মাঝি যদিও কথাগুলি যতদূর সম্ভব মিষ্ট করিয়া বলিল, কিন্তু দূরদৃষ্টবশতঃ তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের নিতান্ত নীরস ও অস্থিদাহকারীবৎ বোধ হইল। তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া সবেগে উঠিয়া মাঝিকে বলিলেন,

তোমার মাথা! মূর্খ, আমি কোথায় থাকি, তুমি কি তা’ জান যে, আমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবে?” এই বলিয়া উঠিতে চেষ্টা করিলেন; চেষ্টা করিলেন মাত্র, উঠিতে পারিলেন না; অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় বসিয়া পড়িলেন। তখন তাঁহার মনে হইল, মাঝি যে তখনও তাঁহার নেশা আছে বলিয়া ক্রোধোদ্ৰেক করিয়াছিল, সেটা নিতান্ত মিথ্যাপবাদ নহে;নিঃসন্দেহ সত্য। তখনও তাঁহার মাথাটা বেশ ঘুরিতেছিল এবং পা দুখানি তাঁহার দেহভার বহনে অক্ষমতা প্রকাশ করিয়া অত্যন্ত টলিতেছিল। মাঝির মূর্খতা হইতে তাঁহার মূর্খতা যে বহুপরিমাণে অধিক, বুঝিতে পারিয়া সর্ব্বতোভাবে দুঃখিত হইলেন। হতাশভাবে একপার্শ্বে বসিলেন।

মাঝি দেবেন্দ্রবিজয়ের সেইরূপ ভাব দেখিয়া সেজন্য কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ না করিয়া বলিল, “আপনার বাড়ী ওপারে কামদেবপুরে; আপনার নাম ত অরিন্দমবাবু?”

দেবেন্দ্রবিজয় উত্তেজিত স্বরে উত্তর করিলেন, “আমার নাম অরিন্দমবাবু নয়—বাড়ীও কামদেবপুরে নয়।”

মাঝি বলিল, “তবে কি সেই ভদ্রলোকটি আমাকে মিথ্যা বলিলেন?” মাঝি মনে ভাবিল, “বাবুর এখনও বেশ নেশা আছে।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কে সে ভদ্রলোক? কে আমাকে নৌকায় তুলিয়া দিল? আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না; তুমি এখনই আমাকে সব কথা খুলিয়া বল।”

মাঝি বলিতে লাগিল, “বাবু, আপনি কাল রাতে বড় মাতাল হ’য়ে পড়েছিলেন।’ এত মদ খেয়েছিলেন যে, আপনার একটুও জ্ঞান ছিল না। একটা বটগাছের তলায় মড়ার মত প’ড়েছিলেন। সে যাই হ’ক, তাতে আর হয়েছে কি, আজ-কাল অনেক ভদ্রলোকেরই এমন হ’য়ে থাকে। সেখানকার একটি ভদ্রলোক সেইরূপ অবস্থায় আপনাকে দেখতে পেয়ে আমাকে ডাকলেন। ডেকে বলেন, “মথুর, একটা কাজ কর্ দেখি, এই ভদ্রলোকটিকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আয়। যদি কোন লোক দেখিতে পায়, তাহা হইলে এখনি ফাঁড়িতে টেনে নিয়ে যাবে। এ লোকটি কোথায় থাকে, আমি জানি এই চিঠিখানা জামার পকেটে পাওয়া গেছে, এই চিঠিতে ঠিকানা লেখা আছে।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কে সে ভদ্রলোক, তুমি তাকে চেন?”

মাঝি উত্তর করিল, “না বাবু, আমি চিনি না।“

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তবে সে কেমন করিয়া তোমার নাম ধরিয়া ডাকিল?”

মাঝি একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “তা’ কি ক’রে জান্ত, বাবু—তার আগে সেই ভদ্রলোকটিকে আর কখনও কোথায় দেখেছি, আমার ত বাবু, ভাল মনে পড়ে না। কিন্তু তিনি আমাকে নিশ্চয়ই চিনেন, তা’ না হ’লে, কেমন ক’রে আমার নাম জানতে পারলেন। যাই হ’ক্, লোকটি নিতান্ত ভদ্রলোক, খুব দয়ার শরীরও বলতে হবে; নইলে আজ-কালকার বাজারে কে কাকে দেখে, বলুন দেখি? আপনার বাপ-ভাইকে কেউ দেখে না, তা’ পর। আপ্‌নার জন্য অনেক করেছেন! আপনাকে নিয়ে যাবার ভাড়টি পর্য্যন্ত তিনি নিজের কাছ থেকে আমাদের আগে চুকিয়ে দিয়েছেন।”

দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে ভদ্রলোকটির বয়স কত, কিরকম দেখতে—লম্বা না বেঁটে, মোটা না রোগা, দাড়ি গোঁফ আছে, না নাই ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। মাঝি সেইসকল প্রশ্নের যেরূপ উত্তর করিল, তাহাতে সর্ব্বতোভাবে গতরাত্রে সেই অদ্ভুত অদৃষ্টপূর্ব্ব রোগীকেই বুঝায়। দেবেন্দ্রবিজয় মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি যে চিঠির কথা বলিতেছিলে, সে চিঠিখানা কোথায়? আমি সেখানা একবার দেখিতে চাই। আমাকে সেখানা দাও।”

মাঝি বলিল, “সে-চিঠি আপনার জামার পকেটে আছে, তিনি ঠিকানাটা আমাদের একবার প’ড়ে শুনিয়ে দিয়ে, তখনই আবার আপনার জামার পকেটে রেখে দিয়েছেন।”

পকেটে হাত দিয়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “মাঝি, সর্বনাশ হয়েছে! তা’রা চোর তা’রা ডাকাত—তা’রা অতি ভয়ানক লোক—ঘোর বিশ্বাসঘাতক! তোমরাও সেই খুনীদের লোক দেখিতেছি। আমার হাতে কেহই নিস্তার পাবে না, এর ফল তোমরা কেহই নিস্তার পাবে না, এর ফল তোমরা নিশ্চয়ই পাবে।”

মাঝি সেকথার কোন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া অত্যধিক বিস্মিত এবং কতক বা কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া বলিল, “কি হয়েছে, বাবু? আমরা কিছুই জানি না।”

“সব জান তোমরা”, বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মাঝির মুখ হইতে কথাটা যেন লুফিয়া লইলেন। ক্রোধভরে বলিলেন, “আমার ঘড়ি, চেন, হীরার আংটি, পকেটে নগদ তিনশতের অধিক টাকা ছিল, সব চুরি ক’রে নিয়েছে—তা’রা সহজ লোক নয়। এখানে যদি কোন থানা থাকে, আমাকে সেইখানে নিয়ে চল। এখনই ইহার একটা প্রতিকার করা চাই।”

দেবেন্দ্রবিজয় এ পকেট, সে পকেট করিয়া তিনখানি অদৃষ্টপূর্ব্ব পত্র বাহির করিলেন। তন্মধ্যে দুইখানি তাঁহার নামে লিখিত এবং বিভিন্ন হস্তাক্ষরে লিখিত। আর একখানির উপরে কামদেবপুরের ঠিকানা দিয়া অরিন্দমের নাম লিখিত ছিল। দেবেন্দ্রবিজয় অটল মনোযোগের সহিত তিনখানি পত্ৰই পাঠ করিলেন। পাঠশেষে তিনি মাঝিকে বলিলেন, “হাঁ, আমারই নাম অরিন্দম–আমার বাড়ী কামদেবপুর, যত শীঘ্র পার, সেইখানে নৌকা লইয়া চল।”

তাহাতে মাঝি কিছুমাত্র বিস্মিত হইল না;কারণ তখন্য তাহার একান্ত বিশ্বাসের সহিত বেশ মনে হইতেছিল, নেশাটা এখনও বাবুর মায়া একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই।

নৌকা সেইরূপ সবেগে চলিতে লাগিল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পত্রাবলী

নৌকা যথাসময়ে হুগলির ঘোলঘাটে আসিয়া লাগিলে, দেবেন্দ্রবিজয় তন্মধ্য হইতে অবতরণ করিলেন। মাঝির মুখেই শুনিয়াছিলেন, নৌকার ভাড়া পূর্ব্বেই তাহারা পাইয়াছে, সেজন্য এক্ষণে তাঁহাকে উৎকণ্ঠিত হইতে হইল না। নো-বাহকদিগের নির্দোষতার প্রমাণ সেই পত্র-ত্রয়ের একখানির মধ্যে লিপিবদ্ধ ছিল; দেবেন্দ্রবিজয় তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিলেন।

অরিন্দমের বাটীর অনুসন্ধান করিতে দেবেন্দ্রবিজয়কে কিছুমাত্র আয়াস স্বীকার করিতে হইল না। সেখানকার সকলেই অরিন্দমকে চিনিত। যখন দেবেন্দ্রবিজয় অরিন্দমের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি বাহিরের ঘরে বসিয়া একান্ত মনঃসংযোগপূর্বক একখানি সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন। সহজেই সাক্ষাৎ হইল। অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে বসিতে বলিয়া, সংবাদপত্রখানা টেবিলের উপর রাখিয়া-দিয়া নিজে ভাল হইয়া বসিলেন।

দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আপনার নাম কি অরিন্দমবাবু?”

অরিন্দম ঘাড় নাড়িয়া স্বীকার করিলেন।

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার নামে একখানি পত্র আছে।”

এই বলিয়া তিনি সেই তিনখানি পত্রের ভিতর হইতে অরিন্দমের পত্রখানি বাছিয়া বাহির করিলেন।

অরিন্দম পত্রখানি পাঠ করিলেন, পত্রখানি এইরূপ—

“সুহৃদ্বরেষু-

বহুদিন হইতে তোমার কোন সংবাদ না পাইয়া অত্যন্ত চিন্তিত আছি; আপাততঃ আমার কুশল জানিয়া নিশ্চিন্ত হইয়ো। তুমি অযাচিতভাবে আমার যে কত উপকার করিয়াছ, তাহা আমি যতদিন তোমার মৃত্যু না হয়, ততদিন কিছুতেই বিস্মৃত হইতে পারিব না।

কিন্তু যতদিন না বিস্মৃত হইতে পারিব, ততদিন আমি কিছুতেই সুস্থ হইতে পারিব না; সেজন্য যাহাতে তোমার মৃত্যুটি অপেক্ষাকৃত নিকটবর্ত্তী হয়, সেজন্য যত্নের ত্রুটি করিব না।

বুঝিয়াছি, তুমি কোনরকমে আমার সন্ধান করিতে পারিতেছ না; সেজন্য এখনও যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছ; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছ না দেখিয়া, অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। পত্রবাহক শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রবিজয় মিত্রের নিকটে আমার সন্ধান পাইবে। উক্ত ভদ্রলোকটি আমার চিকিৎসা করিতে আসিয়াছিলেন।

—”ফুলসাহেব।”

পত্রখানি পড়িয়া অরিন্দম বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার জন্য ফুলসাহেব কর্তৃক আবার এক অভিনব রহস্যের সুচারু আয়োজন হইতেছে। তিনি দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এ-পত্ৰ কোথায় পাইলেন?”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পত্র আমি কোথায় পাইয়াছি, কখন পাইয়াছি, কে দিয়াছে আমি তাহার কিছুই জানি না। আমার কথা শুনিয়া আপনি বিস্মিত হইবেন না—আপনাকে সকল কথা ভাল করিয়া বুঝাইয়া না বলিলে, আপনি ইহার কিছুই বুঝিতে পারিবেন না; ইহার ভিতরে অনেক কথা আছে।”

অরিন্দম বলিলেন, “কোন বাধা না থাকিলে আপনি সেসকল কথা আমাকে বলিতে পারেন।” দেবেন্দ্রবিজয় গতরাত্রের সমুদয় বৃত্তান্ত বলিতে আরম্ভ করিলেন। বিন্দু-বিসর্গ গোপন না করিয়া অকপটে সমুদয় বলিয়া গেলেন। সেসকলের পুনরুল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়োজন। শুনিয়া অরিন্দম কিছুমাত্র বিস্মিত হইলেন না; তিনি জানিতেন, ফুলসাহেবের নিকট সকলই সম্ভব। দেবেন্দ্রবিজয় যে তাঁহার হাত হইতে প্রাণসমেত ফিরিতে পারিয়াছেন, এত বড় দীর্ঘ কাহিনীর মধ্যে ঐটুকু কিছু বিস্ময়জনক।

অরিন্দম বলিলেন, “আপনি যে আরও দুইখানি পত্রের কথা বলিলেন, সেই দুইখানি বোধহয়, আপনি নষ্ট করেন নাই?”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার কাছেই আছে, আপনি পড়িতে পারেন।”

এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় নিজের সেই পত্রখানি অরিন্দমের হাতে দিলেন। অরিন্দম ব্যগ্রচিত্তে পড়িতে লাগিলেন—

“দেবেন্দ্রবিজয়!

তুমি আমাকে চেন না, কিন্তু তোমাকে আমি খুব চিনি। তোমার বাড়ী ভবানীপুর, এবং তুমি কিজন্য বেণীমাধবপুরে গিয়েছিলে, তাহাও আমি জানি, এবং সেখানে গোপালচন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া রেবতীর উদ্ধারের জন্য কোন একজন সুদক্ষ গোয়েন্দা নিযুক্ত করিতে কলিকাতায় ফিরিতেছিলে, তাহাও জানি। যদি বাপু, আমার পরামর্শ শুনিতে চাও—যদি গোয়েন্দার মত গোয়েন্দার হাতে কাজটি দিতে চাও তাহা হইলে হুগলি জেলার অরিন্দম বসুকে যাহাতে ঠিক করিতে পার, আগে সে চেষ্টা দেখ। আমি জানি, তুমি রেবতীকে অত্যন্ত ভালবাস, এবং তোমারই সহিত তাহার বিবাহ হইবার কথা ছিল। তোমার মামা মহাশয় সেজন্য যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু বিধাতার অভিপ্রায় অন্যরূপ। অত্যন্ত অর্থাভাব হইয়াছিল বলিয়া তোমাকে একটু কষ্ট দিলাম। বেণীমাধবপুরের যে কেশববাবুর নাম শুনিয়াছ, আমি সেই কেশববাবু।” অপর পত্রখানি স্ত্রীলোকের হাতের লেখা, এইরূপ—

“দেবেন্দ্রবিজয়!

তোমাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল বলিয়া মনে করিয়ো না, তুমি আমার হাত হইতে মুক্তি পাইলে মনে করিয়ো না, আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম। ছিপে মাছ ধরা পড়িলে, যেমন সেটাকে খেলাইয়া শেষে উপরে তুলিতে বেশী আনন্দ হয়, তোমার মৃত্যুতে আমার সেই রকমের একটু আনন্দ উপভোগ করিবার ইচ্ছা আছে বলিয়াই, তোমাকে আপাততঃ ছাড়িয়া দিলাম। তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই, তুমি কাহার ক্রোধে পড়িয়াছ; যেদিন তোমার বুকের রক্তে জুমেলিয়া তাহার উভয় করতল ধৌত করিবে, সেইদিন হইতে সেই অপমান, সেই লাঞ্ছনা এবং সেই ঘৃণার ঠিক প্রতিশোধ হইবে, এবং সেইদিন বুঝিতে পারিবে, উপেক্ষিতা রমণী সর্পিণী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী।

-সর্পিণী জুমেলিয়া।”

অরিন্দম পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, কেশব আর ফুলসাহেব সংক্রান্ত লীলাখেলা একজনেরই। ইহাতে নূতনত্ব কিংবা আশ্চর্য্যের কিছুই নাই। পত্রপাঠ শেষে অরিন্দম মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “দেবেন্দ্রবাবু, আপনার পূর্ব্বজন্মের খুব একটা সুকৃতি ছিল, তাই আপনি এমন খুনীদের হাত থেকে নিজের দেহটাকে সচেতন অবস্থায় বাহির করিয়া আনিতে পারিয়াছেন।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনি কি ওদের চিনেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “ঐরকম দুই-একজন মহাত্মাকে না চিনিলে আমাদের পেশা চলে কই? আপনি রেবতীর কাকা গোপালবাবুর স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে কোন বিশেষ সংবাদ রাখেন কি?”

দেবেন্দ্র। তিনি মহৎ লোক, সেখানকার সকলেই তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাকে।

অরিন্দম। আপনি যদি আমার সহিত দুই-চারি দিন থাকিয়া আমার কিছু সহায়তা করেন, আমি রেবতীর উদ্ধারের উপায় করিয়া দিতে পারি। সম্মত আছেন?

দেবেন্দ্র। আমার আপত্তি কিছুই নাই, তবে আমার দ্বারা আপনার এমন কি বিশেষ সাহায্য হবে, বলিতে পারি না।

অরি। (সপরিহাসে) যে বাড়ীতে কাল আপনি শুভ নিশিযাপন করেছিলেন, সেখানে আমাকে একবার নিয়ে যেতে হবে। পথ মনে আছে কি?

দেবে। না, বনের ভিতর দিয়ে রাত্রে গিয়েছিলাম; এখন সে পথ ঠিক করা কঠিন; তবে চেষ্টা করিলে সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।

অরি। বেশ চলুন, আজ আহারাদির পর যাত্রা করা যাক্। যেরূপে হউক, আজ সেখানে পৌঁছিতেই হইবে।

তখন তাঁহাদের মধ্যে ফুলসাহেব ও রেবতী সম্বন্ধে অনেক কথা হইল। সেসকলের উল্লেখ এখানে বাহুল্য বোধ করিলাম। অরিন্দমের মুখে ফুলসাহেবের অশ্রুতপূর্ব্ব অলৌকিক গুণগ্রাম শ্রবণে দেবেন্দ্রবিজয় অসম্ভবরূপে বিস্মিত ও চমকিত হইলেন। এবং ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া মানবমূর্ত্তি তাঁহার ধারণা-পটে ভীষণ আসুরিক বিভীষিকায় অবিকল চিত্রিত হইয়া গেল। অরিন্দম রেবতীর সম্বন্ধে কোন কথাই তখন দেবেন্দবিজয়ের নিকটে প্রকাশ করিলেন না; বরং তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকট হইতে রেবতীর অপহরণ সম্বন্ধে অনেক কথা জানিয়া লইলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – অত্যাশ্চর্য্য অন্তর্দ্ধান

সেদিন দেবেন্দ্রবিজয় অনুরুদ্ধ হইয়া অরিন্দমের বাসায় আহারাদি শেষ করিলেন। আহারাদির পর অনতিবিশ্রামে উভয়ে ফুলসাহেব-সন্দর্শনে বাহির হইলেন। তাঁহারা যত শীঘ্র ফুলসাহেবের সহিত দেখা করিবেন, মনে করিয়াছিলেন, কাজে তাহা ঘটিয়া উঠিল না। দেবেন্দ্রবিজয় অনেকবার পথ ভুল করিয়া ফেলিলেন। যখন বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, তখন তাঁহারা ফুলসাহেবের বাগান-বাটীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। একজন কৃষক সেখান দিয়া যাইতেছিল, অরিন্দম তাহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ- বাগান কার?”

কৃষক বলিল, “জানকী বোসেদের।”

অরিন্দম একটু চিন্তিত হইলেন। বলিলেন, “কোন্ জানকী বসু? তিনি কোথায় থাকেন?” কৃষক বলিল, “তিনি মারা গেছেন, তেনার বাড়ী বেণীমাধবপুর, আমাদের জমিদার।” কৃষক চলিয়া গেল।

অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন, “রেবতীর পিতার নাম জানকীনাথ বসু না? দেবেন্দ্ৰবাবু, রেবতীর অপহরণ সম্বন্ধে অনেক রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে, বোধ করি। আপনিও এখন তাহা কিছু বুঝতে পারছেন। রেবতীর কাকা গোপাল বসুকে আপনি যতদূর সদাশয় মনে করেন, সন্দেহ হয়, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তিনি ঠিক তেমনটি নন্। একদিন অরিন্দমের হাতে পড়লে তিনি রাং কি সোনা সহজেই জানা যাবে।”

তখনই দুজনে বাগানের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। অযত্নে বাগান বনের মত ভীষণ হইয়াছে, এবং বন্য আগাছায়, লতাপাতায় কণ্টকাকীর্ণতায় মানুষ্যের দুরতিক্রম্য। কিছুদূর অগ্রসর হইলেই গাছের আড়ালের ফাঁক দিয়া সেই বাগান বাড়ীর ছাদের কিয়দংশ তাঁহাদের দৃষ্টিগোচর হইল। উভয়ে দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন। কিছুদূর গিয়া তাঁহারা দেখিলেন, বাড়ীটির পশ্চিমপার্শ্বের দ্বিতলস্থ একটি গবাক্ষ উন্মুক্ত রহিয়াছে; সেখানে দাঁড়াইয়া রূপলাবণ্যময়ী মুক্তকেশী কোন নারীমূর্ত্তি। দূর হইতে দেখিয়াই অরিন্দম তাহাকে চিনিতে পারিলেন। এ সেই মতিবিবি—স্বামীহন্ত্রী, মানবী-মূৰ্ত্তিতে দানবী, বিধাতার একটি অনাগত সৃষ্টি। দেবেন্দ্রবিজয়ও তাহাকে চিনিতে পারিলেন, চিনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি অরিন্দমকে বলিলেন, “মহাশয়, এই সেই ডাকিনী, আমি ইহারই কথায় ভুলিয়াছিলাম।”

অরিন্দম মৃদুস্বরে বলিলেন, “হাঁ, আমি উহাকে খুব জানি; তবে এখন এক কাজ করুন, এখন আমরা এদিক্ দিয়া না গিয়া ঐ উত্তর দিকের পথ ধরিয়া যাই, তাহা হইলে জুমেলিয়া আমাদের দেখিতে পাইবে না; অথচ আমরা ঐদিক্ দিয়া অলক্ষ্যে বাড়ীর ভিতরে যাইতে পারিব।”

অরিন্দমের কথামত কাজ হইল। যাহাতে জুমেলিয়া তাঁহাদের দেখিতে না পায়, এরূপভাবে তাঁহারা অন্যদিক্ দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এবং সরাসরি উপরে উঠিয়া—যে-ঘরে জুমেলিয়া দাঁড়াইয়াছিল—সেই ঘরের ভিতরে ঢুকিলেন। অরিন্দম যেমন জুমেলিয়াকে ধরিতে যাইবেন, জুমেলিয়া ছুটিয়া গিয়া পাশ্ববর্ত্তী ঘরে এবং সে-ঘর হইতে বাহির হইয়া, বাহিরের বারান্দায় পড়িয়া কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে পলাইতে লাগিল। অরিন্দমও তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটিতে লাগিলেন। অবশেষে জুমেলিয়া একটি ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া ভিতর হইতে দ্বার অর্গলাবদ্ধ করিয়া দিল। সেই মুহূর্ত্তেই অরিন্দম এমনি জোরে সেই কবাটের উপর পদাঘাত করিলেন যে, সেই একটি আঘাতই কবাট জোড়ার একান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল, এবং বিকট শব্দ করিয়া ভাঙিয়া পড়িয়া গেল। একলম্ফে অরিন্দম গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। কি আশ্চর্য্য! সেখানে কেহই নাই—না জুমেলিয়া, না তাহার কোন চিহ্ন। সেই ঘর হইতে বাহির হইবার আর কোনও দরজা ছিল না, যে দুই-একটা জানালা ছিল, তাহাও লৌহের গরাদ দেওয়া; এবং গরাদগুলি যেরূপ সুদৃঢ়ভাবে গ্রথিত, নাড়িয়া ভাল রকম করিয়া পরীক্ষা করিতে হতভম্ব, বিস্মিত অরিন্দমের আর সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ রহিল না। তন্ন তন্ন করিয়া তিনি ঘরের চারিদিক্ দেখিতে লাগিলেন; জুমেলিয়ার সন্ধান হইল না। ঘরের ভিতরে এমন কিছু ছিল না, এক পার্শ্বেই একটি আলমারী ও একটি ছোট খাটে ছোট বিছানা। আলমারীটি খোলা ছিল, সেটাকে তিনি আরও ভাল করিয়া খুলিয়া দেখিলেন, সেখানেও জুমেলিয়ার অস্তিত্বের সম্পূর্ণ অভাব; এবং জুমেলিয়ার মানবীত্বের উপরে তাঁহার ঘন ঘন সন্দেহ হইতে লাগিল।

এদিকে যেমন একটা অপূর্ব্বদৃষ্ট রহস্যপূর্ণ অদ্ভুত নাটকের একটা অলৌকিক দৃশ্য অভিনীত হইয়া গেল, ঠিক এই সময়ে অপর স্থানে এই রকমের আর একটা অভিনয় চলিতেছিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – পাতাল প্রবেশ

অরিন্দম যখন জুমেলিয়াকে ধরিতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন, তখন দেবেন্দ্রবিজয় একটা স্ত্রীলোককে ধরিতে তাঁহার মতন দুইজন বীরপুরুষের অগ্রসর হওয়া অতিশয় লজ্জাজনক ও অনাবশ্যক মনে করিয়া, সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলেন। হতভাগ্য দেবেন্দ্রবিজয় সেই ‘একটা স্ত্রীলোকের’ নিকটে তেমন উচ্চশিক্ষা পাইয়াও শিখিতে পারিলেন না যে, সে ঠিক ‘একটা স্ত্রীলোকের’ মতন নহে; সে মানবী মূর্ত্তিতে রাক্ষসী—রাক্ষসী অপেক্ষা ভয়ঙ্করী। দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, অরিন্দম জুমেলিয়াকে নিশ্চয় ধরিবেন, এই সময়ের মধ্যে তিনি যদি সেই ফুলসাহেবকে ধরিতে পারেন, তাহা হইলে একটা কাজের মতন কাজ হয় এবং অরিন্দম যেমন তাঁহার কিঞ্চিৎ সহায়তা ও কিঞ্চিৎ উপকার হইবে বলিয়া তাঁহাকে সঙ্গে আনিয়াছেন, তাহা হইলে সেই সাহায্যপ্রার্থী অরিন্দমেরও এই সময়ে যথেষ্ট উপকার এবং সাহায্য করা হইবে;এই মনে করিয়া তিনি ফুলসাহেবের সন্ধানে মনোনিবেশ করিলেন। এমন সময়ে নিম্নতলে কাহার পদশব্দ হইল, তখনই অনুসন্ধিৎসু দেবেন্দ্রবিজয় অনুসন্ধেয় ফুলসাহেবকে সমুচিত শিক্ষা দিতে দ্রুতপদে নীচে নামিয়া আসিলেন। সেখানে দেখিলেন, তাঁহার সেই গত রাত্রির অদ্ভুত রোগী মহাশয় তাঁহার দিকে না চাহিয়া একটি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিল। দেবেন্দ্রবিজয় তখন ছুটিয়া গিয়া সেই ঘরের দ্বার সম্মুখে দাঁড়াইলেন।

ফুলসাহেব দেবেন্দ্রবিজয়ের সহসা সম্মুখীন দেখিয়া কিছুমাত্র বিস্মিত হইল না। দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, “কি গো, দেবেন্দ্রবাবু যে, কি মনে ক’রে আবার?”

দেবেন্দ্রবিজয় বজ্ররবে বলিলেন, “কি মনে ক’রে—এখনই জানিতে পরিবে;নারকী, আমার হাতে উপযুক্ত শিক্ষা পাইবে।”

ফুলসাহেব পূৰ্ব্ববৎ মৃদুহাস্যের সহিত বলিল, “বটে, তুমি আমাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে আসিয়াছ! বেশ! শুনিয়া সন্তুষ্ট হইলাম। আচ্ছা, শিক্ষাটা তুমি একাকী দিতে আসিয়াছ, না তোমার সঙ্গে আর কেহ আসিয়াছে; অরিন্দম আসে নাই?”

দেবেন্দ্রবিজয় সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিলেন। সেই পিস্তল তিনি অরিন্দমের নিকটে পাইয়াছিলেন। পিস্তল ফুলসাহেবের মস্তক লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “যদি পলাইবার চেষ্টা কর, তাহা হইলে এই পিস্তলের গুলিতে তোমার মাথার খুলি উড়াইয়া দিব।”

ফুলসাহেব কিছুমাত্র ভীত না হইয়া পূৰ্ব্ববৎ স্মিতমুখে বলিল, “না, পলাইব কেন? তোমার ভয়ে? না তোমার ঐ পিস্তলের ভয়ে? আমাকে গ্রেপ্তার করিবে মনে করিয়াছ?

দেবেন্দ্র। হাঁ।

ফুল। কখন্‌?

দেবেন্দ্র। এখনই।

ফুলসাহেব হাসিতে লাগিল—সেইরূপ বিদ্রূপের মৃদুহাসি। বলিল, “তুমি কি মনে করিয়াছ, তুমি আমার হাতে হাতকড়া পরাইতে থাকিবে, আর আমি এমনি ভালমানুষটির মত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া তাহা দেখিতে থাকিব?”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাই তোমাকে করিতে হইবে।”

ফুল। আর তা’ যদি না করি?

দেবেন্দ্র। তোমাকে হত্যা করিব।

ফুল। না, এতটা কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে না। আমি এখান হইতে নড়িব না, তোমার মনের অভিলাষটা পূর্ণ কর; কিন্তু দেবেন্দ্র, আমি ত নড়িব না, কিন্তু তুমি যে আমাকে এখান থেকে এক চুল নড়াতে পারবে, এমন বোধ হয় না।

দেবেন্দ্রবিজয়, “সে বন্দোবস্ত আমি করিতেছি”, বলিয়া যেমন ফুলসাহেবকে ধরিতে দ্রুতপদে অগ্রসর হইলেন, সহসা একটা বিকট শব্দ হইল, এবং সেই সঙ্গে দেবেন্দ্রবিজয়ের সর্ব্বাঙ্গ সেখান হইতে এক নিমিষে ভূগর্ভে অদৃশ্য হইয়া গেল!

ফুলসাহেব হাসিতে হাসিতে ঘরের বাহির হইয়া গেল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – কেশরী ও শার্দুল

দেবেন্দ্রবিজয়ের অকস্মাৎ পাতাল-প্রবেশের এবং নিজের বিজয় বার্তা জুমেলিয়ার শ্রুতিগোচর করিবার জন্য তাড়াতাড়ি ফুলসাহেব দ্বিতলে উঠিয়া, যে-কক্ষে জুমেলিয়া অরিন্দমকে একদম বোকা বানাইয়া অন্তর্হিত হইয়াছিল, সেই কক্ষের দিকে চলিলেন। সেইটি জুমেলিয়ার শয়ন-কক্ষ’। যখন অরিন্দম ও দেবেন্দ্রবিজয় বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করেন তখন ফুলসাহেব বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন না, অতএব তাঁহার পরম শত্রু অরিন্দমের আগমন এবং জুমেলিয়ার অন্তর্দ্ধান সম্বন্ধে ফুলসাহেব কিছুই জানিতে পারেন নাই। ফুলসাহেব জুমেলিয়ার শয়ন-গৃহের সম্মুখে আসিয়া দেখিলেন, সেখানে জুমেলিয়া নাই, কবাট জোড়া ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। ফুলসাহেব বিস্ময়-বিহ্বল হইয়া ঘরের ভিতরে গেলেন। ঘরের ভিতরে সম্মুখদিক্কার কোণে অরিন্দম দাঁড়াইয়া ছিলেন, সুতরাং ফুলসাহেব বাহির হইতে তাঁহাকে দেখিতে পান নাই; কিন্তু ভিতরে গিয়া সহসা অরিন্দমকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। সে-ভাব দমন করিয়া পরিষ্কার স্বরে বলিলেন, “একি—অরিন্দমবাবু যে! হঠাৎ কি মনে করে?”

অরিন্দম সহাস্যে বলিলেন, “অনেকদিন হইতে মহাশয়ের কোন সংবাদাদি পাই নাই—একবার দেখা করিতে আসিলাম।”

ফুলসাহেব একবার হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। তাহার পর বলিলেন, “আমাদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব নামক পদার্থটি যেরূপ ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে পরস্পরের অদর্শনে পরস্পরের যথেষ্ট কষ্ট হইবারই কথা। আমিও তোমার অদর্শনে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ছিলাম। দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকটে আমার স্নেহ-পত্র পাও নাই?”

অরিন্দম বলিলেন, “হাঁ পাইয়াছি বৈ কি।”

ফুলসাহেব। সেই পত্র পাইয়াই তুমি আসিয়াছ। খুব শীঘ্রই আসিয়াছ;এত শীঘ্র তুমি আসিবে, আমি এরূপ আশা করি নাই। তুমি যে-কাজে নিযুক্ত, তাতে সকল বিষয়ে এরূপ তৎপর হওয়া তোমার খুবই আবশ্যক। যাই হ’ক্, তুমি দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে আনিয়া ভাল কর নাই, তাহা হইলে আজ বেচারাকে এমন অকালে প্রাণ হারাতে হইত না। লোকটা এবার অত্যন্ত গরম হইয়া উঠিয়াছিল, তা’ তাহাকে একেবারে ঠাণ্ডা করিয়া দিয়াছি।

ফুলসাহেবের কথা শুনিয়া অরিন্দমের ভয় হইল। বলিলেন, “তুমি কি তাহাকে খুন করিয়াছ?”

ফুল। আমি তাহাকে খুন করিতে যাইব কেন? সে নিজেকে নিজেই খুন করিয়াছে—লোকটা এমনই বুদ্ধিমান্! আমি তাহাকে স্পর্শও করি নাই। সে যা’ হ’ক্, অরিন্দমবাবু, তোমার নিকটে কোন অস্ত্র শস্ত্র আছে কি?

অরিন্দম। আছে। কেন?

ফুল। তা’ত থাকিবারই কথা। আমি যদি এখান থেকে চলে যাই, তা’ হ’লে বোধহয়, তন্মধ্য হইতে কোন-না কোন একটির আস্বাদ আমাকে অনুভব করাইবে, মনে করিয়াছ? এমনকি আমাকে হত্যাও করিতে পার?

অরি। সে ইচ্ছা আমার নাই।

ফু। (উপহাস করিয়া) সহসা এত দয়ালু কবে হইলে, অরিন্দম?

অ। আপাততঃ তোমার নিকটে কোন অস্ত্র আছে?

ফু। দুর্ভাগ্য আমার–আমি এখন নিরস্ত্র; নতুবা সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তোমাকে কষ্ট পাইতে হইত না।

অ। (সহাস্যে) কেন?

ফু। তাহা হইলে যে মুহূর্ত্তে তুমি আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছিলে, সেই মুহূর্তে আমি তোমাকে এ সংসার হইতে বিদায় করিতাম।

অ। (সহাস্যে) কেন?

ফু। আরও জান বোধহয়, তোমার প্রাণ নিতে আমি প্রাণপণ করিয়াছি–হয় আমি মরিব, নয় তুমি মরিবে। আর তুমি মনেও স্থান দিয়ো না যে, জীবিত ফুলসাহেবকে তখন তুমি ধরিতে পারিবে।

অ। এখন যদি আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করি, তুমি কি করিবে মনে করিয়াছ?

ফু। অরিন্দমবাবু, সকল সময়েই আমি নিজেকে নিজে রক্ষা করিতে পারি।

অ। আমি এখনই তোমায় গ্রেপ্তার করিব।

ফু। মুখের কথা নয়, মনে করিলেই ফুলসাহেবকে ধরিতে পারা যায় না। অনেকেই সে চেষ্টা করেছে।

অ। সে অনেকের মধ্যে আমি সে চেষ্টা সফল করিতে পারিব। তুমি আমার কয়েকটা পরিচয় পূৰ্ব্বে পাইয়াছ।

ফু। আমি তোমাকে খুব জানি; তোমার বুদ্ধি, কৌশল, কুখ্যাতি, নৈপুণ্য, শক্তি, সাহস, ক্ষমতা কিছুই আমার অপরিচিত নহে। আমি তোমাকে যতদূর জানি, তাতে তুমি যে আমার একজন যোগ্য প্রতিযোগী, সে সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই।

এই বলিয়া ফুলসাহেব কেথাও কিছুই নাই, একেবারে লাফাইয়া আচম্বিতে অরিন্দমের ঘাড়ে পড়িল। ফুলসাহেব সহসা যে তাঁহাকে এমনভাবে আক্রমণ করিবে, এ কথা আগে অরিন্দম মনে করেন নাই। তিনি এক হাতে ফুলসাহেবের গলাটা টিপিয়া ধরিয়া অপর হাতে তাহার ললাটে সজোরে একটি মুষ্ট্যাঘাত করিলেন। কপাল কাটিয়া রক্ত বহিতে লাগিল।

তাহার পর পরস্পরের প্রতি পরস্পরের মুষ্ট্যাঘাত বর্ষণটা প্রচুর পরিমাণেই হইতে লাগিল। এবং দুম্ দাম্, ঠক্ ঠকাস্ শব্দে ঘরটা ক্ষণে ক্ষণে প্রতিধ্বনিত এবং উত্থান-পতনের ও পদক্ষেপের দুপ দাপ ধপ্ ধপাস্ শব্দে ঘন ঘন কম্পিত হইতে লাগিল। এত চেষ্টা করিয়াও দুঃখের বিষয় কেহ কাহাকে সহজে বশে আনিতে পারিলেন না। প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা এইরূপে কাটিল। তথাপি মল্লযুদ্ধটা সমানভাবেই চলিতে লাগিল।

এমন সময়ে সহসা ফুলসাহেব বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একটা তীক্ষ্ণমুখ লৌহ শলাকা বাহির করিল। সেটা দেখিতে অনেকটা দীর্ঘ সূচীর মতন, কেবল অগ্রভাগ একটু বাঁকা। দেখিয়াই অরিন্দমের বুঝতে বাকী রহিল না, সেই লৌহ-শলাকা বিষাক্ত, এবং তাহার এমন একটা শক্তি আছে যে, একটু আঘাতেই দেহ হইতে প্রাণটাকে অতি সহজে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিতে পারে।

ফুলসাহেব যেমন সেই বিষাক্ত শলাকা অরিন্দমের দেহে বিদ্ধ করিতে যাইবে, অমনই অরিন্দম দুইহাতে ফুলসাহেবের হাত ধরিয়া ফেলিলেন। ফুলসাহেব অপর হস্তে অরিন্দমের মুখের উপরে, নাকের উপরে, যেখানে-সেখানে অবিশ্রান্ত ঘুসি চালাইতে লাগিল। সেইসকল ঘুসির মধ্যে একটা লক্ষ্যভ্রষ্ট ঘুসি নিজের সেই লৌহ শলাকার উপর পড়িয়া ফুলসাহেবের এত উদ্যম—এত আগ্রহ সমুদয় নিষ্ফল করিয়া দিল—সেই বিষ-শলাকা ফুলসাহেবেরই মণিবন্ধে বিদ্ধ হইল।

যেমন বিদ্ধ হওয়া, অরিন্দমকে আর কোনরূপ কষ্ট স্বীকার করিতে হইল না। ফুলসাহেব তখনই গৃহতলে পড়িয়া গেল এবং সেই মুহূর্ত্তেই তাহার সবল ও সচল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একেবারে অসাড় ও অচল হইয়া আসিল।

বিস্মিত হইয়া, স্তম্ভিত হইয়া, শিহরিত হইয়া অরিন্দম সরিয়া দাঁড়াইলেন। এবং তাঁহার নিজের হৃষ্টপুষ্ট দেহের সমস্ত শক্তির অপেক্ষা, সুদীর্ঘ শাণিত ছুরি অপেক্ষা, অগ্নিগর্ভ সাক্ষাৎ মৃত্যুতুল্য রিভল্ভারের অপেক্ষা সেই একখণ্ড অতি ক্ষুদ্র নগণ্য লৌহ শলাকার কত বেশী শক্তি, মনে মনে তাহারই সমালোচনা করিতে লাগিলেন। ফুলসাহেবের গায়ে হাত দিয়া দেখিলেন, তাহার সেই নিস্পন্দ দেহ তখন অত্যন্ত শীতল এবং অত্যন্ত কঠিন। এবং তন্মধ্যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে; তথাপি অরিন্দম ফুলসাহেবকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। হাতকড়া ও বেড়ি বাহির করিয়া ফুলসাহেবের হাতে পায়ে সুদৃঢ়রূপে সংলগ্ন করিলেন, এবং খাটখানা টানিয় আনিয়া তাহার একদিক্‌কার পায়া ফুলসাহেবের পিঠের উপরে চাপাইয়া দিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – যথাসময়ে অরিন্দম

ফুলসাহেবকে সেইরূপ অবস্থায় রাখিয়া অরিন্দম বাহিরে আসিলেন। এবং দেবেন্দ্রবিজয়ের অনুসন্ধান করিয়া উৎকণ্ঠিতচিত্তে বাড়ীর চারিদিকে ফিরিতে লাগিলেন। ফুলসাহেবের মুখে দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন। কারণ, ভীষণপ্রকৃতি খুনী ফুলসাহেবের অসাধ্য কৰ্ম্ম কিছুই নাই।

উপরের সকল স্থান যখন তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের অথবা তাঁহার মৃতদেহের কোন সন্ধানই হইল না, তখন অরিন্দম নীচে নামিয়া আসিয়া নীচের ঘরগুলিতে সন্ধান করিতে লাগিলেন। যে ঘরে দেবেন্দ্রবিজয়ের পাতাল প্রবেশ হইয়াছিল, অরিন্দম অবশেষে সেই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

তখন একটা অস্ফুট গোঙানির শব্দ অতি মৃদুভাবে তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল;কিন্তু কোথা হইতে সেই শব্দটা আসিতেছে, তিনি অনেকক্ষণ স্থিরকর্ণে থাকিয়াও তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। এক একবার জলের ছপাৎ ছপাৎ শব্দও শুনা যাইতে লাগিল। বোধ হইতে লাগিল, অতি দূর হইতে সেইসকল শব্দ আসিতেছে; কিন্তু ঘরের বাহিরে আসিলে আর কিছুই শুনা যায় না। ভীতিবিহ্বল অরিন্দম ঘরের ভিতরে চারিদিকে ঘুরিতে লাগিলেন। এক স্থানে দেখিলেন, গৃহতলে একটি লৌহনিৰ্ম্মিত গুপ্তদ্বার রহিয়াছে; সেটি মাপে দুই হাতের অধিক নহে, সমচতুষ্কোণ। সেই গুপ্তদ্বার উন্মুক্ত করিবার জন্য অরিন্দম শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করিয়া, যতদূর সাধ্য চেষ্টা করিয়া কিছুতেই সেটা টানিয়া তুলিতে পারিলেন না;কিন্তু পরক্ষণে উপর হইতে একটু চাপ দিতেই নীচের দিকে একটু ফাঁক হইয়া গেল। আর কিছু বেশী জোর দিতে একেবারে উন্মুক্ত হইয়া গেল। সেই সঙ্গে কি একটা ভয়ানক দুর্গন্ধ অরিন্দমের নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে অন্নপ্রাশনের অন্ন অবধি উঠাইয়া ফেলিতে চেষ্টা করিল।

অরিন্দম অতি কষ্টে সেই দুর্গন্ধ সহ্য করিয়া অবনতমস্তকে, তীব্রদৃষ্টিতে নীচের দিকে চাহিতে লাগিলেন; কিছুই দেখিতে পাইলেন না, কেবল সেই গোঙানি শব্দটা এখন বেশ স্পষ্ট শুনা যাইতে লাগিল। অরিন্দম পকেট হইতে লণ্ঠন বাহির করিয়া জ্বালিলেন, এবং সেই আলোকরশ্মি অন্ধকূপ মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেখিলেন, নীচে—অনেক নীচে অস্পষ্ট এক মনুষ্য-মূৰ্ত্তি, পঙ্কিল জলে আবক্ষ নিমজ্জিত হইয়া রহিয়াছে। তন্মধ্য হইতে উপরে উঠিয়া আসিবার কোন উপায় নাই। অরিন্দম উচ্চকণ্ঠে ডাকিলেন, “দেবেন্দ্রবাবু—”

ভিতর হইতে মৃদুকণ্ঠে উত্তর হইল, “আপনি আসিয়াছেন। আমি মরিতে বসিয়াছি—আমাকে রক্ষা করুন—ওঃ! প্রাণ যায়—উঃ! কী ভয়ানক—”

অরিন্দম বলিলেন, “ভয় নাই—দেবেন্দ্রবাবু আমার পরম সৌভাগ্য আপনি এখনও জীবিত আছেন—আমি নিজের প্রাণ দিয়া আপনার প্রাণ রক্ষা করিব।”

এই বলিয়া অরিন্দম গুপ্তদ্বার ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বোধকরি, ভিতরে স্প্রীং ছিল, তখনই ঝনাৎ করিয়া গুপ্তগৃহের কবাট আপনি রুদ্ধ হইয়া গেল।

অরিন্দম ছুটিয়া বাহিরে আসিলেন। উঠানের একপার্শ্বে একখানা লম্বা মই ছিল, সেই মইখানা দুই হাতে তুলিয়া আনিলেন, এবং সেই অন্ধকূপের মধ্যে সেটা নামাইয়া দিলেন। সেটা যে তখন তাঁহার এত বড় একটা উপকারে আসিবে, অরিন্দম প্রথমে তাহা ভাবেন নাই।

অরিন্দম প্রজ্জলিত লণ্ঠন লইয়া সেই মই অবলম্বনে নীচে নামিয়া গেলেন; মধ্যে ম‍ই থাকায়, গুপ্তদ্বার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না হইয়া অৰ্দ্ধোন্মুক্ত রহিল।

ভিতরে নামিয়া অরিন্দম দেখিলেন, দেবেন্দ্রবিজয় ক্রমশই সেই কূপের গভীর পঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়া যাইতেছেন। তাঁহার মস্তকের এক স্থান কাটিয়া রক্ত ঝরিতেছে; সে-আঘাত তেমন সাঙ্ঘাতিক না হইলেও অবস্থাটা অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক। সেই ভয়ানক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য অরিন্দম দুই হাতে দেবেন্দ্রবিজয়কে ধরিয়া প্রাণপণে টানিতে লাগিলনে। সেই আকণ্ঠ পঙ্কের মধ্য হইতে একটা লোককে টানিয়া তোলা কি সহজ কথা!

সপ্তম পরিচ্ছেদ – যথাসময়ে জুমেলিয়া

ভিতরে যেমন দেবেন্দ্রবিজয়কে লইয়া এইরূপ যমে-মানুষে টানাটানি চলিতেছিল, ঠিক সেই সময়ে একটি স্ত্রীলোক সেই গৃহমধ্যে নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে প্রবেশ করিয়া, অন্ধকূপের গুপ্তদ্বার-সম্মুখে একবার ঝুঁকিয়া দাঁড়াইল, এবং নীরব হাস্যের সহিত ক্ষণেক সেই অপূর্ব্ব লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিয়া সংযতপদে চুপি চুপি বাহির হইয়া গেল—সে জুমেলিয়া।

জুমেলিয়া বাহিরে আসিয়া অতি মৃদুস্বরে একবার আপন মনে বলিল, “আচ্ছা!” সেই “আচ্ছা’ শব্দটা স্পষ্ট ধ্বনিত না হইয়া অনেকটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাসের মত শুনাইল।

অরিন্দম অনেক কষ্টে দেবেন্দ্রবিজয়কে টানিয়া তুলিলেন। তখন দেবেন্দ্রবিজয়ের সংজ্ঞা নাই, অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়ের মৃতকল্প দেহ একহস্তে বুকে চাপিয়া ধরিয়া যেমন উপরের দিকে এক পা উঠিতে যাইবেন, শাণিত ছুরিকার ন্যায় তীক্ষ্ণকণ্ঠে কে বলিল, “আমার হাতে দুইজনকেই আজ মরিতে হইবে। অরিন্দম, চাহিয়া দেখ, আমায় চিনিতে পার কি?”

অরিন্দম চকিতহৃদয়ে উপরের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কে তুমি?”

“বাঃ! তুমি আমায় চেন না?”

“না। কে তুমি?”

“আমি জুমেলিয়া। সেই তোমার পরিচিত মতিবিবি।”

সহসা সম্মুখে সর্প দেখিলেও লোকে এত চমকিত হয় না, অথবা সেই কক্ষমধ্যে সহসা বজ্রপাত হইলেও অরিন্দম বোধ করি এতদূর চমকিত হইতেন না, জুমেলিয়াকে দেখিয়া তিনি সেরূপ চমকিত হইলেন। দেখিলেন, সাক্ষাৎ মূৰ্ত্তিমতী শত বিভীষিকার ন্যায় জুমেলিয়া অবনতমস্তকে উপরে দাঁড়াইয়া, এবং তাহার প্রচুরায়ত কৃষ্ণনয়নে প্রদীপ্ত নরকাগ্নি জ্বলিতেছে—কি ভীষণ! অধিক, উন্মুক্ত কেশদামকৃষ্ণ, কুঞ্চিত, প্রচুর, সুদীর্ঘ, তেমনি ভীষণভাবে মুখের চারিপাশে ঝুলিতেছে। জুমেলিয়ার একহাতে একটা লণ্ঠন এবং অপর হাতে একটা ছোট শিশি; তন্মধ্যে লোহিত বর্ণের কি একটা তরল পদার্থ টল্ করিতেছে। কে জানে, পিশাচীর কি সঙ্কল্প!

নিজের অবস্থা স্মরণ করিয়া সত্যসত্যই অরিন্দম নিরতিশয় ভীত হইলেন। যদি দেবেন্দ্রবিজয় সে সময়ে মূর্ছিত না হইতেন, তাহা হইলেও সেই প্রলয়ঙ্করী পিশাচীর হাত হইতে পরিত্রাণ পাইবার একটু সম্ভাবনা থাকিত, এখন তিনি কি করিবেন? দেবেন্দ্রবিজয়কে সেরূপ অবস্থায় পরিত্যাগ করিতে পারেন না;ভাবিয়া অস্থির হইতে লাগিলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “যদি দেবেন্দ্রবিজয় মরেন, তাঁহার সঙ্গে আমাকেও মরিতে হইবে।”

ঝটিকান্দোলিতজলোচ্ছাসকল্লোলতুল্য তরঙ্গায়িত হাস্যের সহিত জুমেলিয়া বলিল, “অরিন্দম, এখন আর তোমার ন্যায় বুদ্ধিমাকে বেশী করিয়া বুঝাইয়া বলিতে হইবে না যে, এখন একমাত্র আমার অনুগ্রহের উপর, করুণার উপর, ইচ্ছার উপর তোমাদের ন্যায় দুই-দুইটি বীরপুরুষের জীবন নির্ভর করিতেছে।”

যেরূপ স্বরে কথাগুলি জুমেলিয়ার মুখ হইতে বাহির হইল, তাহাতে সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, জুমেলিয়া অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত কথাগুলি বলিতেছিল।

অরিন্দম বলিলেন, “হাঁ, তাহাই বটে।”

জুমেলিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিতে লাগিল, “তবে অরিন্দম, আমার কাছে দয়া ভিক্ষা কর, প্রাণ ভিক্ষা কর—ক্ষমা চাও; যদি দয়া হয়—ক্ষমা করিলেও করিতে পারি।”

অরিন্দম বলিলেন, “পিশাচীর নিকটে দয়া-ভিক্ষা। জুমেলিয়া, এমন নির্ব্বোধ কে?”

তীব্রস্বরে জুমেলিয়া বলিল, “তবে মজাটা দেখ।”

অরি। কি করিবে তুমি? মনের কথাটা কি?

জুমে। মনের কথাটা তোমাকে হত্যা করিব—এখনই—এই মুহূর্ত্তে।

অ। কিরূপে?

জুমেলিয়া হাতের সেই শিশিটা উপরে তুলিয়া ধরিল! তাহার পর খলখল, অট্টহাসি হাসিয়া বলিল, “ইহার ভিতরে কি আছে জান? না, জান না। ইহার ভিতরে যা’ আছে, তাই তোমার গায়ে ঢালিয়া দিব, অগ্নিশিখার ন্যায় তোমাকে পোড়াইতে থাকিবে, গলিত সীসা অপেক্ষাও ইহা ভয়ঙ্কর, তুলনায় ইহার নিকটে তাহা বরফ বলিলেও চলে।”

অরিন্দম বলিলেন, “তোমার চিত্তবৃত্তিতে—তোমার কল্পনায়—তোমার নৃশংসতায় ও কুটিলতায় তুমি দানবী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী; তোমার যাহা ইচ্ছা হয় কর—আমি মরিতে প্রস্তুত।”

জুমেলিয়া বলিল, “শোনো অরিন্দম, মরণটা মুখে বলা যত সহজ, কাজে ঠিক তেমন সহজ হয় না। এ যে-সে মরণ নয়—জ্বলিয়া পুড়িয়া দন্ধিয়া মরণ। মর তবে, অরিন্দম। তুমি যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, ডাক্‌ ছাড়িয়া চীৎকার করিতে থাকিবে, আর তেমনই উচ্চকণ্ঠে আমি হাসিতে থাকিব– হো—হো—হো। কি মজা! তোমার চোখে দুই বিন্দু ঢালিয়া দিব, অন্ধ হইবে–চক্ষু উৎপাটন করিয়া ফেলিলেও সে যন্ত্রণা যাইবে না; তাহার পর মরিবে—ধীরে-ধীরে-ধীরে—ভয়ানক যন্ত্রণায় ভয়ানক মরণ!”

আবার জুমেলিয়া হাসিতে লাগিল। কি ভয়ানক অমঙ্গলজনক সেই তীব্র হাসি! সে-হাসি শুনিয়া অতি সাহসীরও বুক ভয়ে কাঁপিয়া উঠে।

অরিন্দমও ভয় পাইলেন। বুঝিলেন, জুমেলিয়া মুখে শুধু ভয়-প্রদর্শন করিতেছে না, কাজে সে ঠিক তাহাই করিবে। এ বিপদ্ হইতে পরিত্রাণের উপায় কি?

“এই দেখ, অরিন্দম” বলিয়া জুমেলিয়া অল্পে অল্পে শিশিটা কাৎ করিতে লাগিল। শিশির মুখের কাছে সেই তরল পদার্থ টল্ করিতে লাগিল। জুমেলিয়ার অলক্ষ্যে অরন্দিমের হাতে একবিন্দু পতিত হইল। গলিত সীসকের ন্যায় সেই একবিন্দু সেই স্থান দগ্ধ করিতে লাগিল। অরিন্দম নিজের অধরোষ্ঠ দংশন করিয়া, নীরবে নিঃশ্বাস রোধ করিয়া অতি কষ্টে সে যন্ত্রণা সহ্য করিতে লাগিলেন। যন্ত্রণাসূচক একটি মাত্র শব্দও তাঁহার মুখ হইতে তখন বাহির হইল না।

জুমেলিয়া বলিল, “দেখ অরিন্দম, আর বিলম্ব নাই, এই দেখ, ছিপি খুলিয়াছি, এখনই তোমার সৰ্ব্বাঙ্গে ঢালিয়া দিব; এখনও সময় আছে, প্রাণ ভিক্ষা চাও!”

অরিন্দম দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “প্রাণ থাকিতে নহে। “

জুমেলিয়া বলিল, “আমি তোমাকে মুক্তি দিলেও দিতে পারি প্রাণ ভিক্ষা চাও।”

অরিন্দম বলিলেন, “তুমি পিশাচী।”

জুমেলিয়া মৃদুহাস্যের সহিত বলিল, “ছিঃ, অরিন্দম! চোখের মাথা একেবারে খাইয়াছ; এমন সুন্দরী আমি, এত রূপ আমার, আর আমি হ’লেম কি না পিশাচী!”

অরিন্দম কোন কথা কহিলেন না।

জুমেলিয়া বলিল, “আর বলিব না, এই শেষ বার; এখনও প্রাণ ভিক্ষা চাও

তোমার ন্যায় সুপ্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠ ডিটেটিভ যদি আমার কাছে প্রাণ-ভিক্ষা করিয়া লয়, আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া সম্মত হইব, তা’তে আমার যথেষ্ট সম্মান আছে, তাই বলিতেছি।”

তথাপি অরিন্দম নীরব।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – বিপৎকালে

জুমেলিয়া যখন দেখিল অরিন্দম কিছুতেই তাহার নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাহিল না, দেখিয়া রাগিয়া যখন শিশি হইতে তরল অগ্নিবৎ ভিট্রয়েল ঢালিবার উপক্রম করিল, এমন সময়ে তাহার পশ্চাৎ হইতে একব্যক্তি সেই শিশিটা জোর করিয়া তাহার হাত হইতে ছিনাইয়া লইল। সেই সময়ে শিশি লইয়া কাড়াকাড়ি করিতে খানিকটা সেই তরলাগ্নি জুমেলিয়ার হাতে লাগিয়া গেল। যন্ত্রণায় চীৎকার করিয়া জুমেলিয়া ছুটিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

অরিন্দম কূপের ভিতর হইতে সেই অপ্রত্যশিতপূৰ্ব্ব ঘটনা দেখিয়া মনে মনে ঈশ্বরকে শতসহস্র ধন্যবাদ দিলেন। এত বড় একটা বিপদ্ যে, এত শীঘ্র এমন অল্পে অল্পে কাটিয়া যাইবে, এ কথা তিনি আগে মনেও স্থান দেন নাই। তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের মূর্ছিত দেহ বুকে লইয়া তাড়াতাড়ি উপরে উঠিয়া আসিলেন, এবং সেই বিপঞ্জন অপরিচিত লোকটির নিকটে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন।

সেই অপরিচিত লোকটির বয়স সাতাশ বৎসর হইবে। তাঁহার দেহ সুগঠিত, দীর্ঘ ও প্রশস্ত। তাঁহার ভাবভঙ্গিতে মুখাকৃতি সকরুণদৃষ্টিতে, যে ভদ্রভাব লক্ষিত হয়, তাঁহার পরিহিত সেই মলিন বস্ত্র, মাথার উপর রুক্ষ শুষ্ক অতি দীর্ঘ চুলগুলো, চোখের পার্শ্ববর্তী কালিমা ও হস্তপদদ্বয়ের বড় বড় নখের সে ভাবটুকু অনতিবিলম্বে মন হইতে মুছিয়া যায়। আরও গায়ে স্থানে স্থানে শুষ্ক ময়লা জন্মিয়াছে; কানের নীচে, গলার চারি ধারে এবং কপালে এত ময়লা পড়িয়াছে যে, চিমটি কাটিলে খানিকটা উঠিয়া আসে। তাঁহার মুখ-চোখের ভাব দেখিয়া তাঁহাকে জাতিতে মুসলমান বলিয়া অরিন্দমের বোধ হইল। কে জানে, তবে কি ইনি ফুলসাহেবের কেহ?

যাহা হউক, উভয়ে মিলিয়া নিঃসংজ্ঞ দেবেন্দ্রবিজয়কে সসংজ্ঞ করিয়া তুলিবার জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অনেক বিলম্বে তাঁহাদিগের চেষ্টা সফল হইল। দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া বসিলেন।

অরিন্দম সেই অপরিচিত লোকটির পরিচয় লইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন। সেই লোকটাকে দেখিয়া অবধি তাঁহার মাথার ভিতরে একটা ঘোরতর সন্দেহ অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। সেই সন্দেহটি যদি দৈবক্রমে সত্য হয়, তাহা হইলে তিনি জুমেলিয়া ও ফুলসাহেবকে ধরিবার জন্য যে কষ্টটা স্বীকার করিয়াছেন, তাহা কতক পরিমাণে বৃথা হয় না। তিনি আশান্বিত হৃদয়ে নাম জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে যে নামটি শুনিলেন, তাহাতে বাজীকরের ভোজদণ্ডপৃষ্ট এক গ্লাস মসীর, সহসা এক গ্লাস দুগ্ধমূর্তি ধারণের ন্যায় তাঁহার সমস্ত চক্ষু পালটিতে একেবারে অটল সত্যে পরিণত হইতে দেখিয়া, অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া সবিস্ময়- দৃষ্টিতে তিনি তাঁহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার নাম সিরাজউদ্দীন; যাঁহার উদ্ধারের জন্য একদিন অরিন্দম কুলসমের নিকটে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন।

সিরাজউদ্দীন বলিলেন, “আমি আপনাকে কখনও দেখি নাই; কিন্তু (দেবেন্দ্রবিজয়কে নির্দেশ করিয়া) এই ভদ্রলোকটিকে গত রাত্রে এখানে আর একবার দেখিয়াছিলাম। ধূমময় একটা রুদ্ধ গৃহের মধ্যে ইনি মৃত্যু-যন্ত্রণায় ডাক ছাড়িয়া চীৎকার করিতেছিলেন। সেই সময়ে আমি জানালা ভাঙিয়া ইঁহাকে উদ্ধার করি। আমি সেদিন সেই ঘরের পাশের ঘরেই বন্দী ছিলাম; নতুবা সেইদিন জুমেলিয়ার হাতে ইঁহার জীবন শেষ হইত।”

অরিন্দম সিরাজউদ্দীনকে বলিলেন, “আপনি বলিলেন, সেই সময়ে আপনি পাশের ঘরে বন্দী ছিলেন। কে আপনাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল?”

সিরাজ। ফুলসাহেব

অরি। কোন্ অভিপ্রায়ে ফুলসাহেব আপনাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল, সে সম্বন্ধে কিছু জানেন?

সিরাজ। না, তা’ জানি না, তবে ফুলসাহেব যেরূপ ভীষণ প্রকৃতির লোক তাতে বোধ হয় তার সেই রকমের একটা কোন ভীষণ অভিপ্রায় অবশ্যই ছিল।

অরি। আজ আপনি কিরূপে মুক্তি পাইলেন?

সিরাজ। আজও আমি দ্বিতলের একটা রুদ্ধগৃহে আবদ্ধ ছিলাম, একখানা ভাঙা খাটিয়ায় শুয়ে নিজের অদৃষ্ট চিন্তা করিতেছিলাম, এমন সময়ে ঘরের বাহিরের কোণে কাহার পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম; সেই কোণে একটি ছোট দরজা ছিল, সেটা সহসা খুলিয়া গেল এবং জুমেলিয়া ঘরের মাঝ প্রবেশ করিল, আমি সেই পিশাচীকে দেখিয়া নিদ্রার ভান করিয়া পড়িয়া রহিলাম। সে অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া আমার ঘরে বসিয়া রহিল। তাহার পর একবার সেই ছোট দ্বার দিয়া ঘরের বাহিরে গেল, আবার ফিরিয়া আসিল; আবার গেল, আবার ফিরিয়া অসিল, তিন-চারিবার এইরূপ করিয়া সে আর আসিল না। জুমেলিয়াকে এরূপ ব্যস্ত-সমস্ত-ভীত অবস্থায় আর কখনও দেখি নাই। মনে একটু সন্দেহ হইল অবশ্যই আজ আবার একটা নূতন রকমের একটা -না-একটা -কিছু ঘটিয়াছে, অথবা ঘটিবার সূচনা হইতেছে। যখন দেখিলাম, জুমেলিয়া আর ফিরিল না; তখন আমি ধীরে ধীরে উঠিলাম, দেখিলাম জুমেলিয়া চলিয়া যাইবার সময়ে ঘরের কোণের সেই ছোট দরজাটি বন্ধ করিয়া যাইতে ভুল করিয়াছে;জুমেলিয়ার সেই ভুলে আমার অনেকটা আশা হইল, মনে হইল, এই সুযোগে যদি দুৰ্ম্মদ ফুলসাহেব এবং দানবী জুমেলিয়ার অসাক্ষাতে পলাইতে পারি। এই মনে করিয়া আমি সেই দরজা দিয়া, ঘর হইতে বাহির হইয়া অত্যন্ত অন্ধকারে পড়িলাম। সেখানে এমন অন্ধকার যে, নিজেকে নিজেই সেই অন্ধকারের ভিতরে হারাইয়া ফেলিলাম। তখন জুমেলিয়ার সেই ভুলটাকে আর ভুল মনে না করিয়া আপনার কর্তব্য ভাবিতে লাগিলাম। অনুভবে ঠিক করিলাম, জুমেলিয়া আমাকে সে ঘর হইতে এই অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ করিবার জন্য এরূপ করিয়া থাকিবে; তথাপি সাহসে ভর করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিতে লাগিলাম। খুব সঙ্কীর্ণ পথ, ঠিক মাঝখানে দাঁড়াইয়া, দুই হাত বাড়াইয়া, দুই পার্শ্বের দেয়াল এক সঙ্গে সহজে স্পর্শ করা যায়। মাথার উপরে ছাদ কিংবা একটা কিছু ছিদ্রশূন্য আবরণ ছিল। আমি কিছুদূরে আসিয়া সম্মুখে বাধা পাইলাম। ধীরে ধীরে তাহার উপরে আঘাত করিয়া দেখিলাম, সেটা দেওয়াল নহে, একটা কাঠের কবাট; কিছুতেই ধাক্কা দিয়া, ঠেলিয়া সেটি খুলিতে পারিলাম না; কিন্তু সম্মুখের দিকে একটু জোর দিয়া টানিতেই সেটা খুলিয়া গেল, এবং দিনশেষের ম্লান আলো আসিয়া চোখে লাগিল। আমি তখন তন্মধ্য হইতে বাহির হইয়া আর একটা ঘরে পড়িলাম; তখনই সেই কবাট আপনি বন্ধ হইয়া গেল। তেমন আশ্চর্য ধরনের কবাট আমি আর কখনও দেখি নাই; বাহিরে আসিয়া ফিরিয়া দেখি, যে-দরজা দিয়া বাহির হইলাম, সেটি একটি আলমারীতে পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে। যাই হ’ক্, সেই ঘরে কেহই ছিল না। আমি তখনই নীচে নামিয়া আসিলাম। বাহির হইতে এই ঘরের সমুদয় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া স্তম্ভিত হইলাম। ছুটিয়া আসিয়া জুমেলিয়ার হাত হইতে শিশিটা কাড়িয়া লইলাম।

অরিন্দম বলিলেন, “আপনি আমাদের যে উপকার করিলেন, তাহা আজীবন স্মরম থাকিবে। আপনি না আসিলে জুমেলিয়া নিশ্চয়ই ভিট্রয়েল দিয়া আমাদের দুইজনকেই পুড়াইয়া মারিত আপনি কুলসমকে চিনেন?”

অরন্দিমের মুখে সহসা কুলসমের নাম শুনিয়া সিরাজউদ্দীন যেন কেমন একরকম হইয়া গেলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “কে কুলসম?”

অরি। কেন, তমীজউদ্দীনের কন্যা।

সিরা। জানি;কিন্তু এই ফুলসাহেবের হাত হইতে তাঁহাদের কেহ যে রক্ষা পাইয়াছেন, এমন বোধ হয় না।

অ। কুলসম রক্ষা পাইয়াছে। কুলসমের পিতা আর জীবিত নাই।

সিরা। এ কথা আমি এখানে ইহাদের মুখে কিছু-কিছু শুনিয়াছিলাম। আরও শুনিয়াছি, অরিন্দম নামে কোন্ ডিটেক্‌টিভ না কি এদের সকল ষড়যন্ত্র ভাঙিয়া দিয়াছেন; আর তাঁহারই ভয়ে ইঁহারা এখানে লুকাইয়া রহিয়াছে। যাই হ’ক্, কুলসমের সংবাদ আপনি আর কিছু জানেন? কুলসমের সংবাদ আপনি কোথায় পাইলেন? শুনিলাম, সেই ডিটেক্‌টিভ না কি কুলসমকে রক্ষা করিয়াছেন। সত্য কি?

অ। আমারই নাম অরিন্দম। কুলসম নিরাপদে আছে, সেজন্য আপনি উদ্বিগ্ন হইবেন না।

তাহার পর কুলসম ও ফুলসাহেব সম্বন্ধে অরিন্দম যাহা জানিতেন, সংক্ষেপে সমুদয় বলিলেন।

সিরাউদ্দীন বলিলেন, “এখন ফুলসাহেব ও জুমেলিয়াকে গ্রেপ্তার করিবার কোন উপায় ঠিক করিয়াছেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “জুমেলিয়াকে যে আজ আর ধরিতে পারিব, এমন বোধ হয় না। ফুলসাহেবকে গ্রেপ্তার করিয়া উপরের ঘরে রাখিয়া আসিয়াছি। যখন তাঁহাকে গ্রেপ্তার করি, সে নিজের বিষ-কাঁটা নিজের হাতে বিদ্ধ করিয়াছিল, এতক্ষণে তাহার মৃত্যু হইয়াছে, বোধ করি। চলুন, তিনজনে উপরে যাই।”

.

তিনজনে ফুলসাহেবকে দেখিতে চলিলেন। অরিন্দম ফুলসাহেবকে যে ঘরে হাতকড়ি ও বেড়ি লাগাইয়া ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন, এখন সেই ঘরে তিনজনে প্রবেশ করিলেন।

সকলেই অতিশয় বিস্ময়ের সহিত দেখিলেন, ফুলসাহেব নাই। দেখিয়া শুনিয়া—বিশেষতঃ অরিন্দম যেন একেবারে বোকা-বনিয়া গেলেন।

নবম পরিচ্ছেদ – গুপ্তদ্বার

অনেকক্ষণ পরে সিরাজউদ্দীন বলিলেন, “আপনি কি এইখানে ফুলসাহেবকে বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন? আমি ত মধ্যে এই ঘরে একবার আসিয়াছিলাম, কই, তখন এ ঘরে কাহাকেও দেখি নাই।”

অরিন্দম বলিলেন, “এই ঘরটাই ঠিক। দেখিতেছেন না, কবাট ভাঙা রহিয়াছে। এই ঘরটার মহৎ গুণ আছে, এই ঘরে ঢুকিয়া ছায়াবাজীর ন্যায় জুমেলিয়া অন্তর্হিত হইয়াছিল; এখন আবার এই এক অসম্ভব ব্যাপার দেখিতেছি।”

সিরাজ বলিলেন, “এ ঘরের একটা গুণ আছে বৈকি। আমি সেই অন্ধকারময় সুঁড়িপথ দিয়া এই ঘরেই উঠিয়াছিলাম। এ যে আমারিটা দেখিতেছেন, উহার ভিতর দিয়া একটা পথ আছে। আমি আপনাকে যে গুপ্তদ্বারের কথা বলিয়াছিলাম, সেই গুপ্তদ্বার এই আলমারির ভিতরে আছে। এই দেখুন,” এই বলিয়া আলমারিটা টানিয়া খুলিয়া ফেলিলেন এবং ভিতরকার কাঠখানায় একটু ধাক্কা দিতেই সেটা ভিতরদিকে খানিকটা সরিয়া গেল; এবং ভিতরকার সেই অন্ধকার পথ দৃষ্টিগোচর হইল। সিরাজউদ্দীন বলিলেন, “এই পথ দিয়াই জুমেলিয়া তখন আপনার নিকট হইতে অন্তর্হিত হইয়া আমার ঘরে গিয়া উঠিয়াছিল।”

অরিন্দম বলিলেন, “হ্যাঁ, এখন তা বেশ বুঝিতে পারিতেছি।”

এই বলিয়া অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয় ও সিরাজউদ্দীনকে সঙ্গে লইয়া সেই আলমারির গুপ্তদ্বার দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। নিজে যে ঘরে বন্দী ছিলেন, সিরাজউদ্দীন অরিন্দমকে সেই রুদ্ধ গৃহে লইয়া গেলেন। সে- রুদ্ধ গৃহ হইতে বাহির হইবার কোন উপায় না থাকায় সেই গুপ্তপথ অবলম্বনে সকলে বাহিরে আসিলেন।

তাহার পর তিনজনে মিলিয়া, পাতি পাতি করিয়া বাড়ীখানার সমুদয় অংশ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইলেন। ফুলসাহেব কিংবা জুমেলিয়াকে কোথাও দেখিতে পাইলেন না।

এদিকে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে দেখিয়া, রাত্রির অন্ধকার নিবিড়তর হইয়া সমগ্র বনভূমি আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। এবং দূরগ্রামের কলরব ক্রমশঃ মন্দীভূত হইয়া আসিল। তখন সকলে নিরুদ্যমচিত্তে সেই বাগানবাটী ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন।

সেদিনকার অনুসন্ধানের সেখানে সমাপ্ত। সকলে হুগলী যাত্রা করিলেন।

দশম পরিচ্ছেদ – ভূগর্ভে

এখানে ফুলসাহেব ও জুমেলিয়ার সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলা বোধ করি, অসঙ্গত হইবে না। যখন জুমেলিয়াকে বাহির করিবার জন্য অরিন্দম, দেবেন্দ্রবিজয় ও সিরাজউদ্দীন তিনজনে মিলিয়া এ-ঘর ও-ঘর করিয়া ঘুরিতেছিলেন, তখন পাতালপুরীর মধ্যে একটি কক্ষে জুমেলিয়া বিষণ্ণ মুখে দাঁড়াইয়া নত-নেত্রে ফুলসাহেবের মূৰ্চ্ছাপন্ন অচেতন দেহ অতি মনোযোগের সহিত পৰ্য্যবেক্ষণ করিতেছিল। সেই পাতাল-পুরীর একপাশে একটি ছোট দীপ তথাকার গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্যে অত্যন্ত নিস্তেজভাবে জ্বলিতেছিল। এবং তাহার ক্ষীণ শিখাটা প্রচুর অন্ধকারের মধ্যে সিন্দুরের ন্যায় ঘোর আরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। সেই পাতাল-পুরীর চারিদিক্ বন্ধ, কোন্ পথে যে তন্মধ্যে প্রবেশ করা যায়, তাহা জুমেলিয়াই জানে। আমাদের সেটা জানিবার তেমন কোন আবশ্যকতা নাই।

দুই-তিনবার জুমেলিয়া শিশি হইতে ঢালিয়া দুই-তিন রকমের ঔষধ ফুলসাহেবের মুখে দিল। মুখের দুই পাশ দিয়া ঔষধ গড়াইয়া মাটিতে পড়িল।

যখন কিছুতেই কিছু হইল না, তখন জুমেলিয়া একখানি বড় আকারের শাণিত ছুরি বাহির করিল। এবং সেই ছুরিকা দিয়া ফুলসাহেবের দক্ষিণ হস্তে আঘাত করিল। প্রবলবেগে রক্তধারা বহিতে লাগিল। ক্রমে যখন রক্তপাত বন্ধ হইয়া আসিল, তখন জুমেলিয়া সেই ক্ষতস্থানে মুখ দিয়া রক্তশোষণ করিয়া বাহিরে ফেলিতে লাগিল। অনেকক্ষণ ধরিয়া এইরূপ করিলে ফুলসাহেবের একটু জ্ঞান হইল। সে আসন্নমৃত্যু রোগীর ন্যায় উঠিবার জন্য বারংবার ব্যর্থ বলপ্রয়োগ করিতে লাগিল। অবশেষে নিশ্চেষ্ট অবস্থায় পড়িয়া, জুমেলিয়ার দিকে তীব্রদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, “পিশাচী, তুই কে? তুই আমাকে এ কোন্ নরকে এনেছিস্? সর্—সর্—সর্, এখান হতে তুই দূর হ’য়ে যা;নরকে এসেছি এখানেও আমাকে সুখী হ’তে দিবিনে?”

এই বলিয়া, ফুলসাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ঘন ঘন নিঃশ্বাস টানিতে লাগিল।

জুমেলিয়া সেই ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিয়া ফুলসাহেবকে আবার একটা কি ঔষধ খাওয়াইয়া দিল। তাহাতে অনতিবিলম্বে ফুলসাহেবের দুর্ব্বল দেহের অবসন্নতা অনেকটা কাটিয়া গেল। ফুলসাহেব ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল।

জুমেলিয়া বলিল, “এখন কেমন আছ? আর কোন কষ্ট হইতেছে?”

ফুলসাহেব ক্ষীণস্বরে বলিল, “মাথার ভিতরে বড় যন্ত্রণা হইতেছে। জুমেলিয়া, তুমি আমাকে এখানে আনিয়াছ কেন?”

জুমেলিয়া বলিতে লাগিল, “অরিন্দমের কথা কি ভুলিয়া গিয়াছ? আগে অরিন্দম আমাকে ধরিবার জন্য চেষ্টা করে, তখন তুমি এখানে ছিলে না। এমনকি, সে আমার শোবার ঘর পর্য্যন্ত তাড়া করিয়া আসে। আমি সেই ঘরে সেই আলমারীর গুপ্তদ্বার দিয়া সিরাউদ্দীনের ঘরে পালিয়ে যাই তখন সিরাউদ্দীন ঘুমাইতেছিল। কিছুক্ষণ পরে আমি আবার সেই গুপ্তদ্বারের পশ্চাতে থাকিয়া শুনিলাম, অরিন্দম আর তোমার কি কথাবার্তা হইতেছে। তখনই তোমাদের দুইজনে হাতাহাতি আরম্ভ হইল; আমি অন্তরাল হ’তে দেখিতে লাগিলাম। শেষে তুমি নিজের বিষ-কাঁটা নিজের হাতে বিঁধে অজ্ঞান হ’য়ে পড়লে। অরিন্দম তোমার হাতে-পায়ে হাতকড়ি ও বেড়ি লাগিয়ে তোমাকে ফেলে রেখে গেল। সে চ’লে গেলে আমি তোমাকে একা বুকে করিয়া এই ঘরে লইয়া আসিলাম। এখানে আসিয়া এই ঘরের পাশেই অন্ধকূপের ভিতরে একটা মানুষের গোঙানির শব্দ শুনিতে পাইলাম;কিন্তু এখান হইতে কিছুই দেখা যায় না; সেই গোঙানির কারণটাও ঠিক বুঝিতে না পারিয়া এখান হইতে উপরে গিয়া দেখিলাম, ইহার উপরের ঘরটার অন্ধকূপের দ্বারের ভিতরে একটা ম‍ই লাগান রহিয়াছে। ভিতরে উঁকি মারিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে সমুদয় বুঝিতে পারিলাম। তখন সেই ভিকট্রয়েল দিয়া অরিন্দম ও দেবেন্দ্রবিজয়কে পুড়াইয়া মারিতে গেলাম; কিন্তু কাজে কিছুই হল না। সিরাজউদ্দীনের ঘর থেকে যখন বাহিরে আসি, তখন সে গুপ্তদ্বারটা বন্ধ করিয়া আসিতে ভুল হইয়াছিল। সিরাজউদ্দীন এমন সময়ে আসিয়া শিশিটা আমার হাত থেকে ছিনাইয়া লইল। তখন প্রতিশোধ নেওয়াটা সহজ হইবে না মনে করিয়া, এখানে আসিয়া তোমার শুশ্রূষা করিতে লাগিলাম। অনেক রকম চেষ্টা করিয়া, কিছুতেই তোমার জ্ঞান হয় না দেখিয়া বড়ই ভাবনা হইল। শেষে তোমার হাতের যে শিরায় সেই কাঁটা ফুটিয়াছিল, সেই শিরাটা ছুরি দিয়া কাটিয়া দিলাম; সেই ক্ষতস্থানে মুখ লাগাইয়া রক্ত শুষিয়া ফেলিতে লাগিলাম। রক্তের সঙ্গে বিষের অনেকটা তেজ বাহির হইয়া গেল, তোমার জ্ঞান হইল।”

ফুলসাহেব বলিল, “তবে সিরাজউদ্দীনও হাত-ছাড়া হইয়া গেল। মনে করিয়াছিলাম, ঐ সিরাজউদ্দীনকে মাঝে ফেলিয়া কুলসমের কাছ থেকে পাঁচ-সাত হাজার টাকা আদায় করিব; সেটা আর হইল না;” ·

জুমেলিয়া বলিল, “অরিন্দম বাঁচিয়া থাকিতে আমাদের কোন আশাই সফল হইবে না।”

ফুলসাহেব বলিল, “সেটা এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছি; অরিন্দমকে খুন করিতে না পারিলে আমাদের অদৃষ্ট কিছুতেই সুপ্রসন্ন হইবে না। অরিন্দম যাহাতে শীঘ্র মরে, এখন আমি প্রাণপণ করিয়া সৰ্ব্বাগ্রে সেই চেষ্টাই করিব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *