চতুর্থ অধ্যায় – রাজবংশ
রাজবংশ :- প্রাচীন রাজমালা গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাজবংশের উৎপত্তি বৃত্তান্ত এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে :-
শুন শুন মহারাজ হইয়া সাবধান।
তোমার বংশের কথা করিছি বাখান।।
চন্দ্রবংশে মহারাজ যযাতি নৃপতি।
নিজ বাহুবলে শাসে সপ্তদ্বীপ ক্ষিতি।।
তান পঞ্চপুত্র হৈল যেন কল্পতরু।
যদু তুর্বসু আর দ্রুহ্যু অনুপুরু।।
শুক্র কন্যা দেবযানীর দুই হইল পুত।
রাজ কন্যা শর্ম্মিষ্ঠার হৈল তিন সুত॥(৩১)
বৃষপর্বার কন্যা শর্ম্মিষ্ঠা তনয়।
দ্রুহ্যু নামে রাজা হৈল ইন্দ্রের আলয়।।
ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্য্যগণ পঞ্চনদ পরিত্যাগ পূর্বক দুই এক পদ অগ্রসর হইয়াছিলেন কিনা তৎপক্ষে বিষম সন্দেহ রহিয়াছে। ঋগ্বেদ রচনায় দীর্ঘকাল পরে কৃষ্ণযজুর্বেদ প্রণীত হয়। তদনন্তর শুক্ল যজু রচিত হইয়াছে। উক্ত শুক্ল যজুর্বেদান্তর্গত শতপথব্রাহ্মণে লিখিত আছে যে, “সদানীরা (গণ্ডকি) নদীর পূর্বদিকে জলপ্লাবিত স্থান।”[১] বোধ হয় ঋগ্বেদ রচনা কালে বঙ্গভূমি সমুদ্র গর্ভে শায়িত কিম্বা শ্বাপদ জন্তুর বাসস্থল ছিল। ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্র লিখিয়াছেন, বাঙ্গালা দেশ “পাণ্ডব বর্জ্জিত” অর্থাৎ পাণ্ডবদিগের সময়ে আর্য্য বর্জ্জিত। তদানীন্তন ত্রিপুরার অবস্থা চিন্তা করিলে ইতিহাস স্তম্ভিত হয়।
ঋগ্বেদ সংহিতার চতুর্থ, সপ্তম ও অষ্টম মণ্ডলে বারংবার যযাতির পঞ্চ পুত্রের নাম উল্লেখ রহিয়াছে। সুতরাং তাঁহারা তদপেক্ষা প্রাচীন হইতেছেন। সপ্তম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তের দ্বাদশ ঋকে লিখিত আছে, “দ্রুহ্যুকে ইন্দ্র জলমধ্যে নিমগ্ন করিয়াছিলেন।” চতুৰ্দ্দশ ঋকে লিখিত আছে, “অনু ও দ্রুহ্যুর পুত্রগণকে ইন্দ্র বধ করেন।” জগতের আদি গ্রন্থ ঋগ্বেদ অপেক্ষা প্রাচীন দ্রুহ্যু ও তাঁহার পুত্র কিরূপে ত্রিপুরার উপনিবিষ্ট হইয়াছিলেন তাহা অসাধারণ করা মানব বুদ্ধির অগম্য।
সেই দিবস লর্ড ডেলহাউসি কর্তৃক ব্রহ্মার যে রাজবংশ হৃতরাজ্য হইয়াছেন। আলংফ্রা এই বংশের স্থাপনকর্তা। তিনি খ্রিষ্টাব্দের অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে জন্মগ্রহণ করেন। সেই আলংফ্লার বংশধরগণও সূর্য্যবংশজ বলিয়া আত্ম পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। এবপ্রকার অবস্থায় ভারতীয় রাজন্যবর্গ মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রাজবংশজাত ত্রিপুরেশ্বরগণ চন্দ্রবংশজ বলিয়া পরিচিত হওয়া বিচিত্র নহে। রাজমালা অনুযায়ী ত্রিপুরেশ্বরদিগের বংশাবলী প্রকাশ করা যাইবে।
আমরা বারংবার বলিয়াছি, ত্রিপুর রাজবংশ অতি প্রাচীন। এরূপ প্রাচীন বংশ ভারতে দ্বিতীয় নাই। স্মরণাতীত কাল হইতে তাঁহারা হিন্দু সমাজে স্থান প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের অধিকাংশ ক্রিয়াকলাপ হিন্দুশাস্ত্রানুসারে সম্পাদিত হইতেছে; কিন্তু ত্রিপুরাদিগের জাতীয় ব্যবহার তাঁহারা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন নাই।
বিবাহ :- রাজবংশে তিন প্রকার বিবাহ প্রথা দৃষ্ট হয়। যথা ব্রাহ্ম, শান্তিগৃহীতা ও ১৫ কাছুয়া। ব্রাহ্ম বিবাহ বাঙ্গালিদিগের অনুরূপ। ইহাতে অভিভাবকের কন্যা সম্প্রদান ও (৩৩) যথারীতি পুরোহিতের মন্ত্রপাট ইত্যাদি সকল কাৰ্য্যই হইয়া থাকে। শান্তিগৃহীতা বিবাহে সম্প্রদানের প্রয়োজন নাই। বর কন্যা একত্রে বসিয়া পুস্পমালা পরিবর্তন করে, ও পুরোহিত তৎকালে মন্ত্রপুত শান্তিজলে উভয়কে অভিষেক করিয়া থাকেন।[২] কাছুয়া `বিবাহ ত্রিপুরাদিগের হিকনানানী বা প্রাচীন গন্ধর্ব মতানুযায়ী। “ত্বংমে পতি ত্বংমে ভাৰ্য্যা” ইত্যাকার জ্ঞান দ্বারা এই বিবাহ সম্পন্ন হইয়া থাকে। ব্রাহ্ম ও শান্তিগৃহীতা রাজপত্নীগণ বিবাহ কাল হইতেই “মহারাণী” “মহাদেবী” বা “ঈশ্বরী” উপাধি প্রাপ্ত হন। কিন্তু কাছুয়া পত্নীগণ নরপতি কর্তৃক এই সকল উপাধি প্রাপ্ত না হইলে তাহা ধারণ করিতে (৩৪) পারেন না। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ও বিচারপতিগণ রাজপরিবারের আচার ব্যবহারের গূঢ়তত্ত্ব অবগত না হইয়া স্থানে স্থানে নানারূপ অপ্রকৃত বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। এই কাছুয়া রাণীর গর্ভজাত মহারাজ রাজধর মাণিক্যকে রেসিডেন্ট মুলার সাহেব “জারজ” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।” এই কাছুয়ার গর্ভজাত মহারাজ রামগঙ্গাকে কলিকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি নরমেন ও কেম্প সাহেব দাসীপুত্র বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[৪] মহারাজ ঈশানচন্দ্র ও বীরচন্দ্র মাণিক্যের জননী কাছুয়া ছিলেন। ঈশানচন্দ্র যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইলে পর, তাঁহার জননী মহারাণী উপাধি প্রাপ্ত হন। এই গূঢ়মর্ম বুঝিতে না পারিয়া হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ, (চক্রধ্বজের মস্তকে কুঠারঘাত করিয়া) সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, “রাজা ইচ্ছা করিলে সন্তানের জন্মের পর তাহাকে বিধিসিদ্ধ করিতে পারে।”[৫] যে কাছুয়াগণ অন্যান্য পত্নীর ন্যায় স্বীয় পতির সহিত অনুমৃতা[৬] (৩৫) হইয়াছেন :- যাঁহাদের গর্ভজাত পুত্রগণ ব্রাহ্ম ও শান্তি গৃহীতা মহিষিগণের গর্ভজাত পুত্রগণকে অতিক্রম করতে পৈত্রিক সিংহাসন লাভ করিয়াছেন।[৬] সই কাছুয়াগণকে পত্নীপদ হইতে বিচ্যুৎ করা নিতান্ত গর্হিত কার্য্য। ঠিক হিন্দুভাবে ইহাদের বিচার করিলে চলিবে না। ত্রিপুরা জাতির বিবাহ প্রথা এরূপ সরল যে তাঁহাদের মধ্যে জারজপুত্র উৎপন্ন হওয়া এক প্রকার অসম্ভব।[৭] ত্রিপুরা রাজপরিবারের অধিকাংশ বিবাহ প্রাপ্ত বয়স্ক বর কন্যার মধ্যে সম্পাদিত হয়। বিধবা বিবাহ কদাচিত হইয়া থাকে।
ধর্ম :- প্রাচীন ত্রিপুরা পতিগণ শৈব ও শাক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম হইতে কাছাড় পৰ্য্যন্ত শিব ও কালী মন্দিরসমূহ তাঁহাদের অক্ষয়কীর্তি ঘোষণা করিতেছে। দেবতামুড়ার পর্বত গাত্রে শিব দুর্গা ও কালী প্রভৃতি দেবমূৰ্ত্তি সমূহ (৩৬) খোদিত রহিয়াছে। তাঁহাদের স্থাপিত চট্টলাচলের চন্দ্রনাথ ও উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী উল্লেখযোগ্য। উভয়ই তন্ত্রোক্ত পীঠস্থান ও শৈব, শাক্তের প্রসিদ্ধ তীর্থ। রাজধর মাণিক্যের সময়ে নিত্যানন্দ বংশজ গোস্বামিগণ রাজপরিবারে কৃষ্ণমন্ত্রের বীজ বপন করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাদের শাক্তভাব বিদূরিত হয় নাই। ত্রিপুরাজাতির আদিম দেবতাগণও রাজপরিবারের আধিপত্য পরিত্যাগ করেন নাই।
উত্তরাধিকারীত্বের নিয়ম :- মহারাজ কল্যাণ মাণিক্যের রাজ্যাভিষেকের পূর্বে জগতের সাধারণ বিধি অনুসারে জ্যেষ্ঠপুত্র পৈত্রিক রাজদণ্ড ধারণ করিতেন। কল্যাণ মাণিক্য স্বীয়, জ্যেষ্ঠ পুত্রকে হিন্দুশাস্ত্রানুসারে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন। তদবধি ত্রিপুর রাজবংশে যুবরাজ নিযুক্তের প্রথা প্রবর্তিত হয়। তদনন্তর ক্রমে ক্রমে অন্যান্য নরপতি দ্বারা আরও দুইটি পদ সৃষ্ট হইয়াছে, যথা “বড় ঠাকুর” ও “কর্ত্তা”। এই দুইটি পদ সৃষ্টি দ্বারা রাজপরিবারে অনন্ত কলহের বীজ সংরোপিত হইয়াছে। বৰ্ত্তমান মহারাজ যেরূপ “কর্ত্তা” পদটি ফুৎকার দ্বারা উড়াইতে চেষ্টা করিয়াছেন, বিশেষ উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হইয়া, তদ্রুপ বড়ঠাকুরের পদটিকে সুদৃঢ় করিতে যত্নবান হইয়াছেন। প্রকৃত পক্ষে আমাদের বিবেচনায় উভয় পদের গুরুত্ব সমতুল্য বটে[৮] (৩৭) ফলত যুবরাজ ব্যতীত অন্য দুইটি পদ হিন্দু শাস্ত্রানুমোদিত নহে। ঐ দুইটি পদের উন্নতি সম্পূর্ণ কুলাচারানুমোদিত বলিয়া বোধ হয় না।
রাজচিহ্ন :- ত্রিপুরার রাজসিংহাসনটি অতি প্রাচীন। যদিচ বারংবার ইহার সংস্কার হইয়াছে, তত্রাচ তাহার আকৃতি পরিবর্তিত হয় নাই। এই সিংহাসন অষ্টকোণ এবং ষোড়শ সিংহ ধৃত। ৮টি সিংহ উপলক্ষ মাত্র, অপর ৮টি সিংহের মস্তকোপরে সিংহাসন রক্ষিত হইয়াছে। ১) হনুমানধবজ, ২) দণ্ড, ৩) ধবলছত্র, ৪) আরঙ্গি, ৫) চন্দ্রবাণ, ৬) সূৰ্য্যবান, ৭) মীন মনুষ্য, ৮) মানবহস্ত (পাঁজা), ৯) তাম্বুলপত্র, এই ৯টি রাজকীয় প্রধান চিহ্ন। তদ্ব্যতীত কতকগুলি উপচিহ্ন আছে।
মুদ্রা (তঙ্কা) :- দুইটি অতি প্রাচীন মুদ্রা আমরা দর্শন করিয়াছি, তাহা অপাঠ্য। তদ্ব্যতীত যে সকল মুদ্রার অক্ষর পাঠ করা যায়, তন্মধ্যে কল্যাণমাণিক্যের দ্বিতীয় পুত্র ছত্রমাণিক্যের মুদ্রা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।
তদপেক্ষা প্রাচীন কোন সুপাঠ্য মুদ্রা আমাদের হস্তগত হয় নাই। পার্শ্বে মহারাজ ছত্রমাণিক্যের (৩৮) মুদ্রার প্রতিকৃতি উদ্ধৃত হইল। ইহার প্রথম পৃষ্ঠে “শ্রীহরগৌরীপাদপদ্মমধুপ শ্রীশ্রীযুত ছত্রমাণিক্য দেবস্য” এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠে একটি সিংহ ও তাহার পদ চতুষ্টয়ের নিম্ন ভাগে “শকাব্দ ১ ৫৮২” খোদিত রহিয়াছে।
মহারাজ ছত্রমাণিক্যের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যের মুদ্রা আমরা দর্শন করি নাই; কিন্তু রাজমালায় লিখিত আছে যে, গোবিন্দ মাণিক্যের মুদ্রায় শিব নামের সহিত নরপতি ও তাঁহার পত্নীর নাম খোদিত হইয়াছিল। অদ্যাপি প্রত্যেক নরপতির অভিষেক কালে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রস্তুত হইয়া থাকে। তাহা গোবিন্দ মাণিক্যের মুদ্রার অনুকরণ মাত্র। রাজপরিবারের ধর্ম্ম পরিবর্তনের সহিত “হরগৌরী” শব্দের পরিবর্তে “রাধাকৃষ্ণ” শব্দ সংযোজিত হইয়াছে।
উপরে মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের একটি মুদ্রার প্রতিকৃতি উদ্ধৃত হইল। ইহার প্রথম পৃষ্ঠায় “রাধাকৃষ্ণ পদে শ্রীশ্রীযুত ঈশানচন্দ্র মাণিক্য দেব শ্রীশ্রীমতী রাজলক্ষ্মী (৩৯) মহাদেব্যৌ” এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠে একটি সিংহ ও তাহার পদতলে “শকাব্দ ১৭৭১” লিখিত আছে।
ঈশ্বরী বা মহারাণী উপাধিধারিণী সমস্ত রাজপত্নীগণের নামে পৃথক পৃথক মুদ্ৰা প্ৰস্তুত হইয়া থাকে। নৃপতির নাম এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠা সকল মুদ্রাতেই একরূপ উৎকীর্ণ হয়।
মুদ্রা (মোহর বা সিল) :- ত্রিপুরেশ্বরগণ প্রাচীন কাল হইতে তিন প্রকার মুদ্রা (মোহর) ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন। ১) পদ্মা মোহর, ২) দেবাজ্ঞা মোহর, ৩) খাস মোহর।
১) পদ্মা মোহর : এই মোহর সনন্দাদিতে ব্যবহার হইয়া থাকে। এই মোহরের মধ্যস্থলে নরপতির নাম খোদিত হয়, তাহার চতুষ্পার্শ্বে চক্রাকারে পূর্ববর্ত্তী নরপতিগণের নাম উৎকীর্ণ হইয়া থাকে। পার্শ্বে মহারাজ রাজধর “মাণিক্যের পদ্ম মোহরের প্রতিকৃতি উদ্ধৃত হইল। এই মোহরের মধ্য স্থলে শ্রীশ্রীযুত রাজধর মাণিক্য দেব” এবং চতুৰ্দ্দিকে চক্রাকারে “কল্যাণ মাণিক্য, গোবিন্দ (৪০) মাণিক্য, রামমাণিক্য, মুকুন্দ মাণিক্য, কৃষ্ণ মাণিক্য” খোদিত রহিয়াছে।
প্রাচীন হিন্দু নরপতিগণ এরূপ সনন্দসমূহে পিতৃপুরুষগণের নাম সংযুক্ত মোহর ব্যবহার করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহারা পিতা পিতামহ, প্রপিতামহ প্রভৃতির নামের সহিত মাতা, পিতামতী,প্রপিতামহী প্রভৃতির নাম সংযুক্ত করিতেন। তাঁহাদের মোহরগুলি প্রায়ই ডিম্বাকৃতি (বাদামী) ইহার উপরার্দ্ধে রাজবংশের ধর্মের পরিচায়ক কোনরূপ মূর্ত্তি উৎকীর্ণ হইত। গুপ্তবংশীয় সম্রাট মহারাজাধিরাজ কুমার গুপ্তের মুদ্রার শিরোভাগে ভগবান বিষ্ণুর বাহন “গরুর” মূর্ত্তি উৎকীর্ণ হইয়াছে।৮ বর্দ্ধন বংশীয় সম্রাট মহারাজাধিরাজ হর্ষবর্দ্ধন শিলাদিত্যের মুদ্রার শিরোভাগে ভগবান শশাঙ্কশেখরের বাহন “বৃষভ” মূৰ্ত্তি খোদিত রহিয়াছে।[১০] মৌখরী বংশীয় মহারাজাধিরাজ সর্ববর্মণের মুদ্রায় বৃষভারূঢ় ভগবান পিনাকপাণির মূর্ত্তি উৎকীর্ণ দৃষ্ট হইতেছে।[১১] কোন কোন মুসলমান সম্রাট একপ্রকার মুদ্রা প্রচার করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের পিতৃপুরুষের নাম সংযুক্ত দৃষ্ট হয়। মোগল সম্রাট সাহজাহানের একটি মুদ্রার (৪১) আশ্চর্য্য প্রতিলিপি আমরা দর্শন করিয়াছি। এই মুদ্রার মধ্যস্থলে “সাহাবুদ্দিন মাহাম্মদ সাহজাহান পাদশা” এবং তাহার চতুর্দিকে মালাকারে ১) তিমুর সাহেব, ২) মির্জ্জাসা, ৩) মির্জা সুলতান মাহাম্মদ, ৪) সুলতান আবু সৈয়দ, ৫) মির্জ্জা অমর শেখ, ৬) বাবর পাদস, ৭) হুমাউন পাদসা, ৮) আকবর পাদসা, ৯) জাহাঙ্গীর পাদসা, খোদিত রহিয়াছে। ১২ ত্রিপুরেশ্বরদিগের পদ্ম মোহরগুলি মোগল সম্রাটদিগের একম্প্রকার মুদ্রার পূর্ণ অনুকরণ বলিয়া অনুভূত হইতেছে।
২) দেবাজ্ঞা মোহর :- কোন দেব নামের সহিত “আজ্ঞা” শব্দ সংযুক্ত বলিয়া ইহাকে “দেবাজ্ঞা” মোহর বলা হয়। রোষকারী, কর্ম্মচারী ও প্রজা বর্গের নামীয় চিঠিতে প্ৰধানত এই মোহর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কৃষ্ণমাণিক্যের পূর্ববর্তী কোন নরপতির দেবাজ্ঞা মোহরাঙ্কিত চিঠি আমরা দর্শন করিয়াছি বলিয়া স্মরণ হইতেছে না। কৃষ্ণমাণিক্য, রাজধর মাণিক্য, রামগঙ্গা মাণিক্য এবং কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য প্রভৃতি ৪ জন নরপতির মোহরে “শ্রীরামাজ্ঞা” ক্ষোদিত রহিয়াছে। কৃষ্ণমাণিক্য ও রাজধর মাণিক্যের মোহরের অক্ষরগুলি কিঞ্চিৎ প্রাচীন আকৃতি বিশিষ্ট। রামগঙ্গা মাণিক্যের মোহরের মোহরাঙ্কিত শ্রীরামাজ্ঞা, “শ্রীরামাঙ্গা” বৎ দৃষ্ট হইয়া থাকে। ঞ অক্ষরের (৪২) ভগ্নাংশজ অক্ষরের মস্তকে আরোহণ পূর্বক এরূপ বিকৃতি আকার ধারণ করিয়াছে। নিম্নে তিনটি দেবাজ্ঞা মোহরের প্রতিকৃতি প্রদত্ত হইল*। ১নং রাজধর মাণিক্য, ২নং রামগঙ্গা মাণিক্য, ৩নং কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের মোহার।
[* সমস্ত প্রকার মোহর ও মুদ্রার প্রতিকৃতি গ্রন্থের শুরুতে মুদ্রিত হয়েছে।]
মহারাজ দুর্গামাণিক্যের মোহরে “কালীংভজ” ক্ষোদিত হইয়াছিল। মহারাজ কাশীচন্দ্র মাণিক্যের মোহরে “শিবাজ্ঞা”; মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের (৪৩) মোহরে “শ্রীগোবিন্দ আজ্ঞা” লিখিত আছে।
৩) খাস মোহর :- এই মোহরে পারসি অক্ষরে মহারাজের সম্পূর্ণ নাম লিখিত আছে। জমিদারী সংক্রান্ত কবুলিয়ত, দরখাস্ত, নোটীশ প্রভৃতিতে এই মোহর ব্যবহৃত হয়।
যুবরাজের মোহর :- যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার সময় হইতে সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্য্যন্ত নরপতিগণ এই মোহর ব্যবহার করিয়া থাকেন। রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হইলেও রীতিমত অভিষেক না হইলে, মোহর পরিবর্তিত হয় না। মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তিনি যে মোহর শিব দুর্গা পদাজে শ্রীল ব্যবহার করিতেন, তাহার আদর্শ মাত্র পার্শ্বে শ্রীযুত কৃষ্ণমণিজুবরাজস্য প্রদত্ত হইল। ইহাতে যুবরাজ শব্দের “য” এর পবিরর্ত্তে বর্গীয় “জ” ব্যবহৃত হইয়াছে। রাজধর মাণিক্যের অভিষেকের পূর্বে, তিনি যে মোহর ব্যবহার করিতেন, তাহাতে লিখিত আছেঃ- “শ্রীলশ্রীযুত রাজধর ঠাকুর”। কাশীচন্দ্র মাণিক্যের অভিষেকের পূর্ববর্ত্তী কালের মোহরে লিখিত আছে “দুর্গাপদে শ্রীলশ্ৰীযুত কাশীচন্দ্র যুবরাজ”। বর্তমান মহারাজের অভিষেকের পূর্বে তিনি যে মোহর ব্যবহার করিতেন তাহাতে কেবল “শ্রীলশ্রীযুত বীরচন্দ্র যুবরাজ” লিখিত আছে। বৰ্ত্তমান যুবরাজের (৪৪) মোহরে “রাধাকৃষ্ণ পদে শ্রীলশ্ৰীযুত রাধাকিশোর যুবরাজ” লিখিত আছে।
উপাধি ও রাজকর্মচারী :-ত্রিপুররাজ্যবাসিদিগের ও রাজকর্মচারিদিগের চারি প্রকার উপাধি দৃষ্ট হয়। ১) অনাৰ্য্য উপাধি, ২) হিন্দু উপাধি, ৩) মুসলমানী উপাধি, ৪) ইংরেজি উপাধি।
চন্তাই, গালিম, পোয়াং, কপরা (কবর), বরুয়া, চাপিয়া, গাবুর, দইরা, মইরা ও সেলামবারী[১৩] প্রভৃতি উপাধিগুলি খাটি অনাৰ্য্য জাতীয়।
বাঙ্গালী হিন্দুগণের সংসর্গে “নারায়ণ” উপাধি প্রচলিত হয়। সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি রাজকর্মচারী এবং মহারাজের সম্পর্কিত ব্যক্তিগণ প্রাচীন কালে এই উপাধি প্রাপ্ত হইতেন। আবুল ফজল স্বীয় আইন আকবরী গ্রন্থে ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। মুসলমানদিগের সহিত সংস্রবের পূর্বে ত্রিপুরার শাসন কার্য্য কিরূপে নির্বাহ হইত, তাহা লিপিবদ্ধ করা সুকঠিন। মহারাজ (আদি) রত্নমাণিক্য, মুসলমানদিগের অনুকরণ করিয়াছিলেন। ক্রমে সুবা, উজির, নাজির ও দেওয়ান এই চারিটি প্রধান পদ সৃষ্ট হয়।
সুবাঃ- প্রধান সেনাপতি। রাজপরিবারস্থ ও রাজসম্পর্কিত (৪৫) ব্যক্তিগণকে এই পদে নিযুক্ত করা হইত। প্রাচীনকাল হইতে ধারাবাহিক রূপে সুবাদিগের নাম কিম্বা বংশাবলী নিম্নে প্রকাশ করা গেল।[১৪] অধুনা ইঁহাদের সহিত সৈন্যবিভাগের কোন সম্পর্ক নাই।
উজিরঃ- সর্বকর্মাধ্যক্ষ বা প্রধানমন্ত্রী। কৃষ্ণমাণিক্যের অভ্যুদয়ের পূর্বে এই পদটি বাঙ্গালিদিগের একচেটিয়া ছিল। রত্নমাণিক্যের সময় যে তিন জন বাঙ্গালিকে তিনি গৌড় হইতে আনিয়াছিলেন, তাঁহাদের বিবরণ যথাস্থানে প্রকাশ করা যাইবে। ইহাদের উত্তরপুরুষগণ ও তাঁহাদের সম্পর্কিত ব্যক্তিগণই প্রায় উজিরের কার্য নির্বাহ করিয়াছেন। বড় খাণ্ডব ঘোষ ও তাঁহার পুত্র পৌত্রগণ ক্রমে ৫ পুরুষ “ওয়াদাদার” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। খাণ্ডব ঘোষের ষষ্ঠ উত্তর পুরুষ প্রথমত উজিরী পদ প্রাপ্ত হন। তাঁহার উত্তর পুরুষগণ দীর্ঘখাল ধারাবাহিকরূপে উজিরী, দেওয়ানী ও অন্যান্য প্রধান কার্য্য নির্বাহ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের বংশাবলী নিম্নে প্রকাশ করা গেল।[১৫] এই বংশাবলী তাম্রশাসন ও (৪৬) কাগজের সনন্দসমূহ দ্বারা সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। ছত্রমাণিক্যের শাসনকালে সেন বংশীয় মধুসূদন বিশ্বাস উজির ছিলেন। জয়মাণিক্যের সময় ঘোষ বংশের দৌহিত্র রামধন দত্ত উজির ছিলেন। তদ্ব্যতীত উদয়াদিত্যনারায়ণ, সত্যজিত নারায়ণ ও উত্তরসিংহ প্রভৃতি উজির (৪৭) গণের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে না।
কৃষ্ণমাণিক্যের সময়ে তিনি স্বজাতীয় জয়দেবকে উজিরী পদ প্রদান করেন। ক্রমে তিনপুরুষ তাঁহার বংশধরগণ উজিরী কার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন। তাঁহাদের বংশাবলী নিম্নে প্রকাশ করা গেল।[১৬] কৃষ্ণজয় উজিরের লোকান্তরের পর মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য উজিরী পদ লোপ করেন। তদনন্তর ত্রিপুরার সর্বকার্য্যাধ্যক্ষ “মোক্তার” আখ্যা দ্বারা পরিচিত হইতেন। বর্ত্তমান মহারাজ “উজির” বা “মোক্তারের” পরিবর্ত্তে “মন্ত্রী” বা “প্রধানমন্ত্রী” উপাধি সৃষ্টি করিয়াছেন। নাজির বংশধর দীনবন্ধু প্রথম এই উপাধি প্রাপ্ত হন। ঠাকুর ধনঞ্জয় দ্বিতীয় মন্ত্রী, তৎপর যথাক্রমে (৪৮) বাবু দীননাথ সেন, বাবু মোহি- নী মোহন বর্দ্ধন এবং রায় উমাকান্ত দাস বাহাদুর মন্ত্রীত্ব করিয়া গিয়াছেন।
নাজিরঃ- গবর্ণমেন্টের পুলিশ পদাতিগণের ন্যায় “বিনন্দীয়া” আখ্যা বিশিষ্ট ত্রিপুরাপতির এক প্রকার সৈন্য বা পেয়াদা ছিল। ইহাদের সরদার নাজির উপাধি প্রাপ্ত হইতেন। মহারাজের সম্পর্কিত ব্যক্তিগণ এই নাজিরী পদ লাভ করিয়াছেন। শেষ নাজির বংশের বংশাবলী নিম্নে প্রকাশ করা গেল।[১৭]
দেওয়ানঃ- এই পদটি বাঙ্গালিদিগের একচাটিয়া ছিল। মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য জমিদারির দেওয়ানী পদে দুর্গাপুরের সিংহ বংশীয়দিগকে নিযুক্ত করিয়া, পার্বত্য রাজ্যের জন্য জনৈক স্বজাতীয় দেওয়ান নিযুক্ত করেন। ক্রমে তিনপুরুষ ইহারা নাম মাত্র দেওয়ানের কার্য্য নির্বাহ করিয়াছিলেন। তদনন্তর রাজ্য ও জমিদারির উভয় দেওয়ানের পদ বাঙ্গালিগণ অধিকার করিয়াছেন। সিংহ বংশের পর যে সকল বাঙ্গালি জমিদারির দেওয়ানের কার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন, তন্মধ্যে রায় রামদুলাল নন্দী মহাশয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ইনি শ্যামাবিষয়ক পদাবলী রচনা দ্বারা চিরস্মরণীয় হইয়াছেন। মহারাজের স্বজাতীয় দেওয়ানগণের কার্য্যকালে “সেরেস্তাদার” উপাধিধারী কর্মচারীগণই (৪৯) প্রকৃত পক্ষে রাজস্ব ও আয়ব্যয় বিভাগের কার্য্য নির্বাহ করিতেন। দেওয়ানগণ সাক্ষীগোপাল স্বরূপ ছিলেন।
ত্রিপুরা রাজ্যের বিচার কার্য্য নির্বাহ জন্য অধুনা কতকগুলি বিচার আদালত সংস্থাপিত হইয়াছে। তন্মধ্যে খাস আপীল আদালত সর্বপ্রধান। ইহার অধীনে জজ, মেজিষ্ট্রেট, কালেক্টর প্রভৃতি রহিয়াছেন। এই সকল বিচারকগণ রাজধানীতে থাকিয়া বিচার কার্য নির্বাহ করেন। সোনামুড়া, বিলোনীয়া ও কৈলাসহর সবডিবিসনে তিনজন ডেপুটী মেজিষ্ট্রেট আছে। তাঁহারা সেই সেই সবডিবিসনের সর্বপ্রকার কার্য্য নির্বাহ করিয়া থাকেন।
সৈন্য বিভাগ পূর্বে মুসলমানদিগকে অনুকরণে গঠিত হইয়াছিল। সুবার অধীনে হাজারি, জমাদার, দফাদার প্রভৃতি উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সৈন্য পরিচালন করিতেন। অধুনা ইংরেজ অনুকরণে কর্ণেল, কাপ্তান কুমেদান, (কমেন্ডার) সুবাদার প্রভৃতি উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দ্বারা সৈন্য বিভাগ পরিচালিত হইতেছে। ত্রিপুরার সৈন্য সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস হইতেছে। একশতাব্দী মধ্যে ত্রিপুরার সৈন্য চারি সহস্র হইতে ২৯৪ জনে পরিণত হইয়াছে।
প্রাচীন কালে মুসলমানদিগের অনুকরণে প্রত্যেক পরগণায় এক একজন চৌধুরী নিযুক্ত করা হইত।[১৮] অধুনা (৫০) ত্রিপুরেশ্বরগণ, তাঁহাদের পার্বত্য রাজ্যে গ্রামে গ্রামে এক একজন চৌধুরী নিযুক্ত করিতেছেন। প্রাচীন কাল হিন্দু নিয়মে সেনানায়কগণ “সেনাপতি” উপাধি প্রাপ্ত হইতেন। অধুনা সেই উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দ্বারা ত্রিপুরারাজ্য পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
১৩০০ ত্রিপুরাব্দের (১৮৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দের) ত্রিপুরারাজ্যের আয়ের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হইল।
ভূমির রাজস্ব – ৫৭৭৮৮
ঘরচুক্তি (পার্বত্য প্রজাদিগের কর) – ৩২২২৩
বনকর (পর্বতজাত দ্রব্যের শুল্ক) – ১০২৬৮৬
ফেণীনদীর বনকর ঘাটের শুল্ক – ৭২৫৪
কার্পাস ও তিলের শুল্ক – ৬৯২৫৪
শালবৃক্ষ বিক্রয় – ৯৯৯৩
হস্তীর শুল্ক – ৯৯৩৬
মহিষের ঘাসকর – ৩৭৮২
খোট গারি – ৪১০১
কাজাই মহাল – ৯২৯
বাজারের কর – ১৯৯৬
আদালতের আয় – ৪২৪২
ষ্টাম্প ও কোর্টফি – ৯৯৫৪
প্রফেশ ফি -৩৫৬১
খোয়াড়ের ঘর – ২২০৯
আবকারী (মাদক দ্রব্যের শুল্ক) – ৩৯৪৫
বিবিধ প্রকার নজর – ৩১৫৩
বাসকর – ৮৪০৬
আড্ডা মহান – ৫৩২০
রেজেষ্টারি বিভাগের আয় – ২১৪৩
জেইলের আয় – ২২৮৩
বিবিধ প্রকার – ২১২৫
—————————-
মোট – ৩৪৭২৮৩
জমিদারির আয় – ৬০৩৬১৫
—————————-
সৰ্বশুদ্ধ : ৯৫০৮৯৮
ত্রিপুরারাজ্য হইতে অধুনা প্রায় চারিলক্ষ ও জমিদারী হইতে ছয় লক্ষ সর্বশুদ্ধ মোট ১০ লক্ষ টাকা মহারাজ প্রাপ্ত হইতেছেন। অরণ্যজাত কাষ্ঠ, বাঁশ, বেত এবং জুমক্ষেত্র সমুৎপন্ন কার্পাস ও তিল ত্রিপুরারাজ্যের প্রধান পণ্যদ্রব্য। ইহার শুল্ক হইতে মহারাজ বার্ষিক দুইলক্ষ টাকা প্রাপ্ত হন। ত্রিপুরেশ্বরের সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের তালুক ও ইজারা সমূহ দ্বারা ভূমির রাজস্বের প্রচুর পরিমাণ ক্ষতি হইতেছে। নচেৎ ইহার রাজস্ব আশাতীতরূপে বর্দ্ধিত হইতে পারে।
পূর্বে মহারাজের জমিদারীর শাসনকার্য্য দেওয়ান দ্বারা (৫২) নির্বাহ হইত। মহারাজ কাশীচন্দ্র মাণিক্য প্রথমত ফরাসী এফ্ ফোরজন সাহেবকে জমিদারীর মেনেজার নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তদনন্তর জে, পি ওয়াইজ, কেম্বল, স্মিৎ, লারমেনী, সেন্স ও মেকমিন সাহেব চাকলে রোসনাবাদের মেনেজারের কার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন। উল্লিখিত ওয়াইজ সাহেব ঢাকার নামজাদা জমিদার ও নীলকুঠির অধিকারী ছিলেন। তিনি কদাচিৎ কুমিল্লায় পদার্পণ করিতেন। তাঁহার নিযুক্ত জনৈক এসিষ্টান্ট সাহেব তাঁহার পক্ষে উক্ত কার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন। এই সকল সাহেবগণ ধারাবাহিক রূপে নিযুক্ত হন নাই। কোন কোন সময় সাহেব মেনেজারের পরিবর্ত্তে বাঙ্গালি দেওয়ান কিম্বা সুপারিন্টেডেন্ট দ্বারা জমিদারি শাসিত হইয়াছে।
ত্রিপুরায় বাঙ্গালাসাহিত্য :- প্রাচীন কাল হইতে ত্রিপুরার রাজকার্য্য বাঙ্গালা ভাষায় সম্পাদিত হইতেছে। তদ্বারা সাহিত্যের উন্নতি সাধিত হইয়াছে। ত্রিপুরাবাসী বাঙ্গালিগণ জাতীয় ভাষার উন্নতির জন্য বিশেষ যত্ন ও চেষ্টা করিয়াছেন। ত্রিপুরেশ্বরগণ তাঁহাদের আশ্রয় ও উৎসাহ দাতা ছিলেন।
রাজমালাঃ- ১৩২৯ শকাব্দে (১৪০৭ খ্রিস্টাব্দে) ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস “রাজমালা” পণ্ডিত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর দ্বারা রচিত হইয়াছিল। সেই রাজমালা অধুনা দুষ্প্রাপ্য। মহারাজ অমর মাণিক্যের শাসন কালে রাজমালা পরিবর্দ্ধিত (৫৩) হইয়াছিল। ইহাই অধুনা প্রাচীন রাজমালা বলিয়া আখ্যাত। এই প্রাচীন রাজমালা হইতে কিয়দংশ এস্থলে উদ্ধৃত হইল :
শ্রীধর্মমাণিক্য দেব ত্রৈপুর সন্ততি।
রাজবংশ বিস্তারিছে রাজমালা পুথী।।
পুস্তক শুনিলে ভূপে পূর্ব রাজকথা।
ততঃপর নৃপচার্য্য না হইছে গাথা।।
অতএব কহি আমি শুন সেনাপতি।
পয়ারে লিখায় তুমি রাজমালা পুথী।।
শুনি শুনি বলি বল চতুর নারায়ণ।
রাজবংশের কথা কিছু কহত অখন।।
প্রজাকে পালন করে পুত্রের সমান।
ভেদ দণ্ড সাম দান নীতিতে প্রধান।।
সভাসদ আছে যত ব্রাহ্মণ কুমার।
বাণেশ্বর শুক্রেশ্বর বিদ্যাতে অপার।।
ইন্দ্রের সভাতে যেন বৃহস্পতি গণি।
সেইমত দ্বিজগণ হয় মহামানী॥
দুর্লভেন্দ্র নামে ছিল চন্তাই প্ৰধান।
পূর্বকথা জানে সেই অতি সাবধান।।
রাজার সভাতে হয় শাস্ত্রের কথন।
নানা শাস্ত্র আলাপন করে দ্বিজগণ।।
সিংহাসনে একদিন বসিয়া নৃপতি। (৫৪)
বংশ কথা জিজ্ঞাসিল সভাসদ প্ৰতি॥
শুক্রেশ্বর বাণেশ্বর দুই দ্বিজবর।
চন্তাই সহিত করি দিলেন উত্তরা।।
নানা তন্ত্র প্রমাণ করিয়া তিন জন।
রাজাতে কহিল তিনে বংশের কথন।
রাজমালিকা[১৯] আর যোগিনী মালিকা।
বারুণ্য কালির্ণয় আর লক্ষণ মালিকা॥
হরগৌরী সম্বাদ আছিল ভস্মাচলে।
নবখণ্ড পৃথিবী কহিছে কুতুহলে।।
এ চারি তন্ত্রেতে আছে রাজার নির্ণয়।
রাজাতে কহিল কথা তিন মহাশয়।।
ইতি দ্রুহ্যু খণ্ড প্রথম অধ্যায়।
ত্রিপুরার প্রাচীন কবিদিগের কতকগুলি প্রিয় শব্দ ছিল, সেইগুলি তাহারা কোন রূপে পরিত্যাগ করিতে পারিতেন না। রাজমালা গ্রন্থে “ভেদ দণ্ড সাম দান” নীতির বারংবার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর পরবর্ত্তী কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী তাঁহাদের মহাভারতে বারংবার এই কয়টি শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন। (৫৫)
ত্রিপুরেশ্বরদিগের আশ্রয় থাকিয়া প্রাচীন কবিগণ অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। এস্থলে তাহারা ধারাবাহিক বিবরণ লেখা নিষ্প্রয়োজন। দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্যের আদেশানুসারে মহাভারতের বাঙ্গালা অনুবাদ রচিত হইয়াছিল।
যে সময় এই সকল প্রাচীন পণ্ডিত ও কবিগণ পয়ারাদি ছন্দে গ্রন্থ রচনা করিতেছিলেন, সেই সময় কায়স্থ কর্মচারিগণ গদ্য রচনা দ্বারা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে উন্নতি সাধনে রত ছিলেন। তাম্রশাসনগুলির ভাষা ইহার প্রত্যক্ষ প্ৰমাণ।
সঙ্গীতের আলোচনা :- প্রাচীন কাল হইতে ত্রিপুরেশ্বরগণ সঙ্গীত শাস্ত্রের আলোচনা ও উন্নতি সাধনের পক্ষপাতী। মহারাজ ধন্যমাণিক্য স্বীয় প্রজাবৰ্গকে গীত বাদ্য শিক্ষা প্রদান জন্য মিথিলা হইতে সংগীতধ্যাপক আনয়ন করেন। তদবধি অবিচ্ছিন্ন ভাবে ত্রিপুরায় সঙ্গীতের আলোচনা হইয়া আসিতেছে। ত্রিপুরায় গীত কবিতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, ইহা তাহারই ফল।(৫৬)
.
টীকা
১. Muir’s Sanskrit Text Part II, P. 400
২. সাধারণ ত্রিপুরাদিগের ন্যায় রাজবংশে ও পূর্ব্বে দুই প্রকার বিবাহ প্রচলিত ছিল; ত্রিপুরেশ্বরগণ যৎকালে বাঙ্গালি কন্যা বিবাহের জন্য লালায়িত হইয়াছিলেন, তৎকালে, তাহারা কাইজগ্ননানী বিবাহকে হিন্দু ভাবাপন্ন করিয়া তুলেন। প্রাচীন ত্রিপুরেশ্বরগণ অনেকে বাঙ্গালি কন্যা বিবাহ করিয়াছেন, তন্মধ্যে মহারাজ রামমানিক্যের পট্টমহিষী মহারাজ ধর্ম্ম মাণিক্যের জননী এবং মহারাজ রামগঙ্গা মানিক্যের পট্টমহিষী মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মানিক্যের জননী বাঙ্গালি ভদ্রলোকের কন্যা ছিলেন। এইরূপে কাইজানী বিবাহটি ব্রাহ্ম ভাব প্রাপ্ত হয়। হিনানানী বিবাহটি ঠিক রহিয়াছে। অল্পকাল মধ্যে মনিপুরীদিগের সংসর্গে এই শান্তিগৃহীতা বিবাহ সৃষ্টি হইয়াছে। ইহাতে হিন্দু, মনিপুরী ও ত্রিপুরা ব্যবহারের সংমিশ্রণ দৃষ্ট হয়।
৩. Rajdhar Manick the Present Zamindar is the illigitimate son of Harry Money the brother of the late Raja Kishen Manick. Letter from the resident of Tipperah to the Collector of Chittagong 12th August, 1788.
৪. Weekly Reporter Vol. I page 179.
৫. Weekly Reporter Vol. I page 194.
৬. কল্যাণ মাণিক্যের পর হইতে কাছুয়া গর্ভজাত যে সকল নরপতি ত্রিপুরসি- ংহাসনে আরোহণ করিয়াছেন, আমরা এ স্থলে তাহার তালিকা প্রদান করিলাম। মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য, রাম মাণিক্য, মহেন্দ্র মাণিক্য, মুকুন্দ মাণিক্য, রাজধর মাণিক্য, রামগঙ্গা মাণিক্য, কাশীচন্দ্র মাণিক্য, ঈশানচন্দ্ৰ মাণিক্য এবং বর্তমান মহারাজা শ্রীশ্রীযুক্ত বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর।
৭. কাপ্তান লেউইন ও ইহা স্বীকার করিয়াছেন। Lewin’s Hill Tracts of chit- tagong page 80.
৮. O Donel’s Report. 1863-64.
৯. J. A. S. B. vol. LVIII part I. p 89.
১০. Corpus Inscriptionum Indicarum. vol. III
১১. Ibid vol. III page 219.
১২. Tavernieres Travales in India p. 107. h page 231.
১৩. দইরা, মইরা ও সেলাম বারী, ইহারা ত্রিপুরাদিগের জাতীয় যন্ত্রবাদক।
১৪. সুবা বংশাবলী। ১ যোগীরাম সুবা, ২ আছুমনী সুবা, ৩ ধনঞ্জয় সুবা, ৪ কালীকৃষ্ণ সুবা, ৫ জগমোহন সুবা ৬ মহেশ চন্দ্ৰ সুবা।
১৫. খাণ্ডব ঘোষের বংশাবলী। ১ বড় খাণ্ডব ঘোষ ওয়াদাদার, ২ তরনী ওয়াদাদার ৩ নাগর ওয়াদাদার ৪ শ্রীহরি ওয়াদাদার ৫ বনমালী ওয়াদাদার ৬ প্রজাপতি উজির ৭ দেবানন্দ শুভঙ্কর ৮ যাদবানন্দ উজির ৯ পদ্মলোচন উজির ইহার তিন পুত্র জ্যেষ্ঠ ১০ কবিবল্লভ উজির দ্বিতীয় কবিচন্দ্র বড়নারায়ণ সেনাপতি ইনি মনিপুরী দিগের সহিত যুদ্ধে তথায় অবরুদ্ধ হন। তৃতীয় কবিরত্ন সেনাপতি, ইহার পুত্র মাধবচন্দ্র উজির ছিলেন। কবিবল্লভের পুত্র ১১ রাজ ছত্র নারায়ণ উজির, ১২ রামকান্ত বিশ্বাস ১৩ অনন্তরাম উজির ১৪ নয়ণ বিশ্বাস ১৫ বিশ্বাস নারায়ণ (গোবিন্দ মাণিক্যের) উজির ১৬ বাঙ্কারাম দেওয়ান ১৭ কমলনারায়ণ (ধর্ম মাণিক্যের) উজির ইহার দুই পুত্র ১৮ বলরাম বিশ্বাস ও মায়ারাম বিশ্বাস। বলরামের দুই পুত্র ১৯ রামহরি ও রামদুলাল। রামহরি বিশ্বাস রামগঙ্গা মাণিক্যের শাসনকালে বাঙ্গালি কর্মচারীদিগের মধ্যে সবর্বপ্রধান ছিলেন। ইহা যথাস্থানে প্রদর্শিত হইবে। রামহরির পুত্র ২০ দুর্গাশঙ্কর বিশ্বাস, ইহার একমাত্র কন্যা এক্ষণ জীবিত আছেন্ রামদুলালের পুত্র শিবশঙ্কর, গৌরীশঙ্কর ও চন্দ্রনাথ বিশ্বাস। মহারাজ কৃষ্ণকিশোর ও ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের সময় এই শিবশঙ্কর চাকলে রোশনাবাদের সবর্বপ্রধান তহশীলদার ছিলেন। গৌরীশঙ্করের পুত্র ২১ গগণচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্র বিশ্বাস। এই গগণচন্দ্ৰ খাস আপীল আদালতের পেস্কারের কার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন। এই রূপ ধারাবাহিকরূপে ক্রমে ২১ পুরুষ অন্য কোন বাঙ্গালি ত্রিপুরার রাজকার্য্যে নির্বাহ করেন নাই।
১৬. কল্যাণ মাণিক্যের দৌহিত্র বংশে পীতাম্বর ও নীলাম্বর নামে দুই ভ্রাতা ছিলেন। পীতাম্বরের পুত্র (১) জয়দেব প্রথমমুজিরের পদ লাভ করেন। তাহার দুই পুত্র (২) দুর্গামনি উজির ও রাজমনি উজির। দুর্গামনির পুত্র (৩) কৃষ্ণজয় উজির, তৎপুত্র (৪) শিবজয় ঠাকুর, তাঁহার দুইপুত্র (৫) গোপীকৃষ্ণ ঠাকুর ও কিশোর মোহন ঠাকুর। ইহারা উভয়েই বর্তমান মহারাজার কন্যা বিবাহ করিয়াছেন। নীলাম্বরের পৌত্র মদনমোহন কিছুকাল উজিরের কার্য্য নির্বাহ করিয়াছিলেন।
১৭. ১ অভিমণ্য নাজির ২ জয়মঙ্গল নাজির ৩ রাজমঙ্গল নাজির ৪ জগদ্বন্ধু নাজির ৫ দীনবন্ধু নাজির ৬ কুমুদবন্ধু ঠাকুর।
১৮. নুরনগরের ধর চৌধুরী, ধলেশ্বরের দাস চৌধুরী, বিশালগড়ের দেব চৌধুরী লৌহগড়ের দাস চৌধুরী মেহেরকুলের দেব চৌধুরী বগসাইরের কুণ্ড চৌধুরী ইত্যাদি।
১৯. ‘রাজমালিকা’ নামে বোধহয় পূর্বে একখানা সংস্কৃত গ্রন্থ ছিল। তদনুসারে বাঙ্গালা গ্রন্থ রাজমালা আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে।