চতুর্থ অধ্যায় – মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির বিকাশ ও নগরজীবনের পুনরাবির্ভাব (খ্রীঃ পূঃ ৬০০-৩২৫)
গাঙ্গেয় উপত্যকার উত্তরাংশে অর্থাৎ বর্তমান হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশে কৃষি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা খ্রীঃ পূঃ ১০০০ থেকে খ্রীঃ পূঃ ৬০০ পর্যন্ত সময়ে কিভাবে ঘটেছিল, তা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ঐ আমলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পেয়েছিল, তারই পূর্ণতর পরিণতি দেখা যায় পরবর্তী প্রায় তিন শতক ধরে (খ্রীঃ পূঃ ৬০০-৩২৫)। যে কারণগুলির জন্য আলোচ্য সময়টিকে অর্থনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে একটি স্বতন্ত্র পর্ব বলে বিবেচনা করা চলে, তা হ’ল মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটল এবং হরপ্পা সভ্যতার অবসানের পর প্রায় হাজার বছর বাদে আবার নগরাশ্রয়ী অর্থনৈতিক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করা গেল। গ্রাম ও নগরকে আশ্রয় করে যে প্রাণবন্ত অর্থনৈতিক সক্রিয়তা চোখে পড়ে, তার পীঠস্থান ছিল মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা। আঃ ১০০০ খ্রীঃ পূঃ থেকে কৃষি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা হবার পর জনবসতি ক্রমে পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছড়াতে থাকে। তাই দেখা যায় ১২০০ থেকে ১০০০ খ্রীঃ পূঃ অর্থনৈতিক জীবনের মূল ঘটনা স্রোত সপ্তসিন্ধু এলাকায়, পরে ১০০০ থেকে ৬০০ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশে প্রাচীন ‘ব্রহ্মর্ষি’ দেশে ও ৬০০ খ্রীঃ পূঃ-এর পর থেকে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রবাহিত হচ্ছিল। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব খ্রীঃ পূঃ ৬০০-র আগে কখনও এত বড় মাপে অনুভূত হয়নি। খ্রীঃ পূঃ ৬০০ নাগাদ থেকে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে তা-ই নয়, এই অঞ্চল সমকালীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনেরও পুরোভাগে চলে আসে।
খ্রীঃ পূঃ ৬০০-র আগে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস, ঘটনাপঞ্জী ও রাজনৈতিক সংগঠন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সীমিত ও অত্যন্ত অস্পষ্ট। প্রাক্ ৬০০ খ্রীঃ পূঃ পর্বে বৈদিক সাহিত্য (ঋগ্বেদ ও পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থলি) থেকে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায় রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান পুরুষ ‘রাজা’; কিন্তু এই ‘রাজা’ মূলত বিভিন্ন কৌম বা গোষ্ঠীর দলপতির চেয়ে অধিকতর ক্ষমতা ভোগ করেননি। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে শাসনব্যবস্থা চালু করার ঘটনা ঋগ্বেদে একেবারে বিরল! পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অর্থনৈতিক জীবনে জটিলতার যে আভাস পাওয়া যায়, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজকীয় প্রতাপ বৃদ্ধির লক্ষণও চিহ্নিত করা যায়। তবে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কৌম গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রভাব নিতান্ত কম নয় ও ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা বিশেষ স্পষ্ট নয়; ফলে ঐ আমলে রাজতন্ত্রের মাধ্যমে সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব ও বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র তখনও প্রস্তুত ছিল না।
সেই তুলনায় প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে খ্রীঃ পূঃ ৬০০ নাগাদ অন্তত যোলটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তির তালিকা পাওয়া যায়। এই শক্তিগুলি ‘মহাজনপদ’ নামে অভিহিত। ‘জনপদ’ কথাটির বিশেষ পারিভাষিক অর্থ আছে: সাধারণভাবে ‘জনপদ’ বলতে লোকালয় বোঝায়। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় তাত্ত্বিক গ্রন্থগুলিতে ‘জনপদ’ শব্দটি জনবসতিসম্পন্ন কৃষিপ্রধান এলাকাকেই বোঝায়। জনপদের অস্তিত্ব কৃষিনির্ভর জনবসতি প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেয়; এই জনবসতি যেহেতু একটি নির্দিষ্টসীমার ভিতর অবস্থিত, তাই ‘জনপদ’ কথাটি ক্রমে একটি বিশেষ ভৌগোলিক-রাজনৈতিক মাত্রা পায়। জনপদের উদ্ভব কৃষি অর্থনীতির প্রসারের পরিচয় তো দেয়ই, উপরন্তু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বা এলাকাভিত্তিক একটি রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতিও ঘোষণা করে। জনপদগুলির আয়তন ও ক্ষমতা বাড়লে তারা ‘মহাজনপদ’ অর্থাৎ অধিকতর শক্তিশালী জনপদের মর্যাদা পেত। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে এইরকম যে ষোলটি মহাজনপদ বা প্রধান শক্তির কথা আমাদের জানা আছে, তার বেশীরভাগই রাজতন্ত্রের আওতায় ছিল; অবশ্য অরাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথাও জানা যায়। আগেই বলা হয়েছে রাজতন্ত্রের মতো প্রতাপশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা তখনই দেখা দেয় যখন সমাজের বস্তুগত ভিত্তি সুদৃঢ়, যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক-আর্থিক বৈষম্যও উপস্থিত ও যখন সামাজিক তারতম্যের মধ্যেও সামাজিক সুস্থিতি বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক কর্ত্তৃত্ব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই রাজনৈতিক কর্ত্তৃত্বের অস্তিত্ব ও সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে কি ভাবে ও কতটা সুষ্ঠভাবে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত অংশ আহৃত ও সংগৃহীত হবে তার উপরে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে ‘মহাজনপদ’ তথা ‘জনপদের’ উপস্থিতি নির্দ্বিধায় প্রমাণ করে যে (১) কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসার ঘটছেও (২) উদ্বৃত্ত উৎপাদন যথাযথ আহরণ করে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাজনৈতিক কর্ত্তৃত্ব ক্রমশ সংহত রূপ নিচ্ছে।
বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকায়-তে যে ষোলটি প্রধান জনপদের (‘সোলস মহাজনপদ’) তালিকা পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ: (১) কাশী (বর্তমান বারাণসীর সন্নিহিত অঞ্চল); (২) কোশল (লক্ষ্ণৌ, গোণ্ডা, ফৈজাবাদ অঞ্চল—গঙ্গার উত্তরস্থ বর্তমান উত্তরপ্রদেশের এলাকা—রাজধানী শ্রাবস্তী); (৩) অঙ্গ (ভাগলপুরের সন্নিহিত বিহারের পূর্বাংশ, রাজধানী চম্পা); (৪) মগধ (রাজগীর-গয়া-পাটনা অঞ্চল; প্রাচীন রাজধানী রাজগৃহ, পরে পাটলিপুত্র); (৫) বৃজি বা বজ্জি (গঙ্গার উত্তরে বর্তমান বিহারের এলাকাভুক্ত—মজঃফরপুরের নিকটবর্তী ভূখণ্ড, রাজধানী বৈশালী); (৬) মল্ল (বজ্জির সন্নিহিত ভূখণ্ড, কুশীনারা ও পাবা দুই প্রাচীন রাজধানী); (৭) চেদী (বুন্দেলখণ্ডের পূর্বদিকে অবস্থিত, রাজধানী শুক্তিমতী); (৮) বৎস/বংশ (এলাহাবাদ ও সন্নিহিত অঞ্চল; রাজধানী কৌশাম্বী); (৯) কুরু (দিল্লী ও সংলগ্ন এলাকা; রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ), (১০) পঞ্চাল (কুরুর প্রতিবেশী রাজ্য—রোহিলাখণ্ড ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের মধ্যবর্তী ভূভাগ; রাজধানী কাম্পিল্য); (১২) শূরসেন (মথুরার নিকটবর্তী এলাকা, রাজধানী মথুরা); (১৩) অশ্নক বা অস্সক (গোদাবরী নদী তীরস্থ অঞ্চল, রাজধানী পোতলী বা পোতলা—যা সাধারণত বর্তমান মহারাষ্ট্রের বোধন-এর সঙ্গে শনাক্ত করা হয়); (১৪) অবন্তী (প্রাচীন মালবের পশ্চিমখণ্ড: বর্তমান মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশ; দুই প্রাচীন রাজধানী উজ্জয়িনী ও মাহিষ্মতী); (১৫) গন্ধার (পাকিস্তানের পেশোয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি অঞ্চল; রাজধানী তক্ষশীলা) ও (১৬) কাম্বোজ (গন্ধারের প্রতিবেশী ভূখণ্ড, বর্তমানে পাকিস্তানের হাজারা জেলার অন্তর্গত)। এক বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে যে জনপদগুলি অবস্থিত ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না: মহাজনপদগুলির সম্মিলিত এলাকা উত্তরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদীর তীর পর্যন্ত ও পশ্চিমে উজ্জয়িনী থেকে পূর্বে ভাগলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের দীর্ঘ লড়াই এর কথা সুপরিচিত। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য থেকে চারটি শক্তি অন্য বারোটির তুলনায় বিশেষভাবে পরাক্রান্ত হয়ে ওঠে: (১) কোশল (রাজা প্রসেনজিতের নেতৃত্বে); (2) বৎস (রাজা উদয়নের নেতৃত্বে), (৩) অবন্তী (রাজা ‘চণ্ড’ প্রদ্যোতের নেতৃত্বে) ও (৪) মগধ (রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর নেতৃত্বে)। এছাড়া যে পঞ্চম এলাকাটিও রাজনৈতিক গুরুত্ব লাভ করে তা হ’ল অরাজতান্ত্রিক ‘বজ্জি’ মহাজনপদ। প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলির বর্ণনা অনুযায়ী এই মহাজনপদগুলি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক (খ্রীঃ পূঃ ৫৬৬-৪৮৬), বুদ্ধের সঙ্গে তাদের নিয়মিত সংযোগ ছিল। এই তথ্যের সারবত্তা সাধারণত সব ঐতিহাসিকই মেনে নেন। অধিকাংশ মহাজনপদই যেমন মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত, তেমনই পরাক্রান্ত চারটি বা পাঁচটি মহাজনপদের এলাকাও মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকারই অন্তর্গত (অবশ্য এ ক্ষেত্রে অবন্তী মহাজনপদ একটি ব্যতিক্রম)। এর থেকে স্পষ্টই অনুধাবন করা সম্ভব যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিচারে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা পাদপ্রদীপের আলোতে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে দাঁড়াল। পূর্বভারতে মগধ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাকে কেন্দ্র করে বৈদিক ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির গোঁড়ামি ও আচার সর্বস্বতার ব্যাপক বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যে নতুন ধর্মমতগুলি আত্মপ্রকাশ করে, তার মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও জৈন ধর্ম সবাগ্রগণ্য। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার এই উত্থান সম্ভব হয়েছিল তৎকালীন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে নানা পরিবর্তনের ফলে, যে অর্থনৈতিক অবস্থা এই অধ্যায়ে প্রধান আলোচ্য বিষয়।
আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির চর্চা করতে গেলে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য হবে প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি; সমকালীন ইতিহাসের কিছু কিছু ঘটনা পুরাণ ও অন্যান্য পরবর্তীগ্রন্থে থাকলেও তার নির্ভরযোগ্যতা সন্দেহাতীত নয়। দ্বিতীয়োক্ত উপাদানগুলি তো খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠশতকের সমকালীন নয়ই। উপরন্তু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছিল সাধারণ মানুষের ভিতর এই ধর্মমতের জনপ্রিয়তার কারণে: এই দুই ধর্মমতের প্রসারের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সমকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের আলেখ্য ব্রাহ্মণ্য উপাদানের তুলনায় অনেক বিশ্বস্ত ও বাস্তবানুগভাবে জৈন ও বৌদ্ধ (বিশেষত বৌদ্ধ) ধর্মগ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়। তবে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার যে বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির কোনওটিই বুদ্ধের জীবৎকালে লিপিবদ্ধ হয়নি; বুদ্ধের সব উপদেশই ছিল মৌখিক, যা অনেক পরে গ্রন্থাকারে লিখিত রূপ পায়। সেই কারণে জাতকের কাহিনীগুলির (এই গল্পগুলিতে গৌতম বুদ্ধের প্রাক্তন জন্মের নানা ঘটনা উপদেশ ও উদাহরণ দেবার জন্য বলা হয়েছিল) জনপ্রিয়তা স্বীকার করেও এগুলিকে সমকালীন তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। বর্তমানে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে জাতকের কাহিনীগুলিতে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিফলন থাকলেও, তাদের বর্তমান রূপ খ্রীঃ দ্বিতীয় শতকের আগে নয়। প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চার গোড়ার দিকে রিচার্ড ফিক ও রিস ডেভিড্স সহ অনেক অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে নিদ্বির্ধায় জাতকের গল্পগুলি বহুল ব্যবহার করেছিলেন; এই পদ্ধতি এখন পরিত্যক্ত। তার বদলে যে বৌদ্ধগ্রন্থগুলিকে নিঃসন্দেহে অন্তত প্রাক-মৌর্য (অর্থাৎ প্রাক্ ৩২৫ খ্রীঃ পূঃ) বলে চিহ্নিত করা যায়, আলোচ্য সময়ের অর্থনৈতিক ইতিহাসে চর্চার জন্য সেইগুলি বেশী বিশ্বস্ত উপাদান বলে গ্রহণীয়। এই জাতীয় বৌদ্ধগ্রন্থগুলির মধ্যে। বিনয়পিটক, নিকায় গ্রন্থ (‘দঘী’ ‘অঙ্গুত্তর’ ও ‘মাজাঝম’) ও সুত্তনিপাত অন্তর্ভুত্ত। পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ শাস্ত্রের পাশাপাশি আর একটি যে তথ্যসূত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হল প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও উৎখনন থেকে পাওয়া পুরাকীর্তি। গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকা ও বিশেষত মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় বহু প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে সমকালীন জীবনযাত্রার চাক্ষুষ প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হয়েছে। সাহিত্যগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে যে সাযুজ্য এই যুগে দেখা যায়, তা নিঃসন্দেহে প্রাক ৬০০ খ্রীঃ পূঃ পর্বে পাওয়া ঐ দুই জাতীয় নিদর্শনের সাযুজ্যের তুলনায় বেশী।
বিশাল গাঙ্গেয় অববাহিকার উওর তথা উপরিভাগ ও পূর্বপ্রান্তে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চল—এই দুই সীমানার ভিতর মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার অবস্থান। পশ্চিমে এলাহাবাদ ও সন্নিহিত এলাকা থেকে পূর্বে ভাগলপুর পর্যন্ত ভূভাগ (যা গঙ্গার উত্তরে ও দক্ষিণে অবস্থিত) ভৌগোলিকের বিচারে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা বলে অভিহিত। আধুনিক উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ ও বিহারের প্রধান অংশ মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার অন্তর্গত; এই ভূখণ্ডের আয়তন প্রায় ৬২,০০০ বর্গমাইল। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭০” (পূর্ব দিকে) থেকে ৪০” (পশ্চিম দিকে)-র মধ্যে: মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকাংশ এলাকাতেই বছরে গড়ে ৪৫”-৫৫” র কম বৃষ্টিপাত হয় না। বৃষ্টিপাত পর্যাপ্ত হওয়ায় কৃষি-বিশেষত ধান চাষ-সহজসাধ্য। হিমালয়ের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন নদীগুলিতে সম্বৎসর অন্তত কিছু পরিমাণ জল থাকার সম্ভাবনা থাকে। এই ঘটনাও মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে। গঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি নদী পুরোটা বা খানিকটা নাব্য হওয়ায় এই অঞ্চলে জলপথে যাতায়াত ও পরিবহন সহজ ও সুলভ। বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে বিশেষ কোনও প্রাকৃতিক দুর্লঙ্ঘতা না থাকার দরুন এই অঞ্চলে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলাও অপেক্ষাকৃত সহজ। এইসব পরিবেশগত ও ভৌগোলিক কারণের সমাহার যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার দ্রুত উত্থানের পথ সুগম করে দিয়েছিল, সে বিষয়ে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ও দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী সঠিক মন্তব্য করেছিলেন।
॥ ২ ॥
মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রাকৃতিক পরিবেশ স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের বিকাশের পক্ষে আদর্শ ছিল। আগের অধ্যায়েই বলা হয়েছে, স্থায়ী কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার পত্তন ঘটেছিল পাঞ্জাব-হরিয়ানা অঞ্চলে (খ্রীঃ পূঃ ১০০০-৬০০)। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় স্থায়ী কৃষিজীবী জনবসতির উদ্ভব পাঞ্জাব থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে কৃষি অর্থনীতি প্রসারের অত্যন্ত স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় যেহেতু বৃষ্টিপাত পাঞ্জাব-হরিয়ানার চেয়ে বেশী, এই এলাকায় সেইজন্য অত্যন্ত ঘন অরণ্য থাকার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। বিশেষত এই এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠার আগে যে নিবিড় অরণ্য ছিল, এ অনুমান কষ্টকল্পিত নয়। এই ঘন জঙ্গল পরিষ্কার না করলে স্থায়ী কৃষিজীবী মানুষের পক্ষে আবাদী ও বাস্তুজমি লাভ করা প্রায় অসম্ভব। বন কেটে বসত বানাবার ইঙ্গিত পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে মিলবে; মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকাতেও জনপদের উদ্ভবের জন্য অন্যতম আবশ্যিক শর্ত ছিল বনাঞ্চল পরিষ্কার করা। যেহেতু মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় অরণ্য আয়তনে বড় ও গভীরতর হবার সম্ভাবনা, তাই ঐ অরণ্য পরিষ্কার করার জন্য উপযুক্ত ও মজবুত হাতিয়ারের প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট। প্রাক ৬০০ খ্রীঃ পূঃ পর্বে উৎখনন থেকে লোহার তৈরী জিনিস যা পাওয়া গিয়েছে, তা প্রধানত যুদ্ধাস্ত্র। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ যষ্ঠ শতক থেকে কৃষিপ্রধান বসতি নির্মাণ করতে গেলে বিস্তৃত অরণ্য পরিষ্কার করার জন্য তামার হাতিয়ার আর যথেষ্ট ছিল না। লোহার কুড়ুল ও কুঠারের উপযোগিতা নিঃসন্দেহে বেড়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে উদ্ধার করা এই আমলের প্রত্নবস্তুর মধ্যে লোহার কুড়ুল ও কুঠারের সংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ্য করার মত। বিহারের সোনপুরে প্রাক্ ৪০০ খ্রীঃ পূঃ-এর স্তর থেকে যে লোহার কুঠারের ফলা পাওয়া গিয়েছে, তার মাঝখানে গর্ত দেখা যায়; মনে হয় কাঠের হাতল ঐ গর্তে লাগানো থাকত। একই ধরনের কুড়ুল ও কুঠার কৌশাম্বীর উৎখনন থেকেও জানা গিয়েছে। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে বনাঞ্চল পরিষ্কার করার জন্য তামার চেয়ে লোহাই বেশী উপযোগী ধাতু বলে বিবেচিত হতে থাকে। তবে বনাঞ্চল পরিষ্কার করতে গেলে লৌহ উপকরণাদির ব্যবহার কতটা নিয়মিত ও ব্যাপক ছিল, এ বিষয়ে পণ্ডিতমহলে মতৈক্য নেই। কিছু পণ্ডিতের মতে লোহার অস্ত্র ও উপকরণের বহুল ব্যবহারই মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকাকে অরণ্যমুক্ত করে কৃষির উপযুক্ত করে তোলে। ঐতিহাসিকদের অন্য এক মহল অবশ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে আগুনের সাহায্যে বন পুড়িয়ে বসতি স্থাপনের চিরাচরিত ও সহজতর পদ্ধতি এই আমলেও বহু ব্যবহৃত। দ্বিতীয় ধারণার তাৎপর্য এই, লোহার ব্যবহার ছাড়াই বন পুড়িয়ে কৃষির উপযুক্ত জমি পাওয়া কঠিন ছিল না। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা প্রসঙ্গান্তরে করা হবে।
লোহার হাতিয়ার দিয়ে গাছ কেটে না আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এই এলাকা যে দ্রুত কৃষিকর্মের আওতায় আসছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত নেই। কৃষিকর্মের বিশ্বস্ত বর্ণনা পাওয়া যাবে এই আমলের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক উপাদান পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী-তে (খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দী)। ব্যাকরণশাস্ত্রের এই প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বিভিন্ন সূত্রের উদাহরণ হিসাবে যখন দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ থাকে না। পাণিনি জানিয়েছেন যে চাষের জন্য জমিকে তৈরী করতে গেলে দুই বা তিনবার লাঙ্গল চালাতে হত। বৌদ্ধ গ্রন্থ সংযুক্তনিকায় ও বিনয়পিটকে বৃত্তি হিসেবে ‘কসি’ বা কৃষিকে উচ্চমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রধান খাদ্যশস্য অবশ্যই ধান। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ধানের সমার্থক কথা হিসেবে ‘ব্রীহি’-র ব্যবহার দেখা যায়। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে ‘ব্রীহি’ ছাড়াও আর এক ধরনের ধানের আবির্ভাব ঘটল। এই ধান ‘শালি’ নামে পরিচিত, এবং এখনও ঐ নামেই অভিহিত। শালি ধান চাষের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ছিল চারা রোপণ করা। অর্থাৎ বীজ বপনের পর বীজতলায় আলাদাভাবে ধানের অঙ্কুরোদগম ঘটলে চারাগাছগুলিকে মূল কৃষিক্ষেত্রে রোপণ করা হত। সমকালীন সাহিত্যে শালি ধানের চাষের উল্লেখ থেকে রামশরণ শর্মা যুক্তিসঙ্গত ভাবেই অনুমান করেছেন যে, ধান রোপণের পদ্ধতি খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে উদ্ভুত হল। এর আগে ধান চাষের জন্য রোপণ পদ্ধতি প্রযুক্ত হবার নিশ্চিত তথ্য নেই। অতএব ‘শালি’ কেবলমাত্র এক নতুন ধরনের ধান নয়, তা ধান চাষের নতুন এক পদ্ধতিরও পরিচায়ক। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে বীজতলায় অঙ্কুরিত ধানের চারা মূল ক্ষেতে রোপণ করলে ধানের ফলনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। অনুরূপ ঘটনা খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে ঘটে থাকলে, কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি হয়েছিল এই জাতীয় কল্পনা করা অবাস্তব হবে না। পালি অঙ্গুত্তর নিকায়তে দেখা যায় কৃষক জমিকে ‘সুকট্ঠম্ (=সুকৃষ্টম্, অর্থাৎ ভালোভাবে যে জমিতে হাল চালনা করা হয়েছে) ও ‘সুমত্তিকম্’ (=সুমৃত্তিকাযুক্ত অর্থাৎ জমিকে ধান ফলাবার পক্ষে উপযুক্ত) করে তুলছে। তারপর বীজ বপন ও রোপণের কাজ চলেছে (‘বিজানি পটিট্ঠাপেতি’)। বিহারের সোনপুরে উৎখনন চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে পোড়া ধান, যা কার্বন-১৪ পরীক্ষায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতাব্দীর ফসল বলে নির্দ্ধারিত হয়েছে। ধানচাষ যে গাঙ্গেয় উপত্যকার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষত তার পূর্বাংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, এই বিষয়ে সাহিত্যগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মোটামুটি একই রকম তথ্য জানায়। ধান উৎপাদনের অপর একটি তাৎপর্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ট্রেভর লিং। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে ট্রেভর লিং দেখিয়েছেন যে ধানচাষের ফলে শুধুমাত্র প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্যই সুলভ হয় না, অন্যান্য ফসলের তুলনায় ধান অধিক ফলনশীলও বটে। প্রতি একরে গমের তুলনায় ধান বেশী উৎপাদন করা যায় ২ গুণ ও যবের তুলনায় গুণ। এ ছাড়া যে সমাজে ভাত খাবার প্রবণতা বেশী, সেই সমাজে প্রজননক্ষমতাও অধিকতর, এই মতও ট্রেভর লিং জানিয়েছেন। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় ধান উৎপাদনের তাৎপর্য তাই বহুমুখী। উন্নততর পদ্ধতিতে (অর্থাৎ রোপণের দ্বারা) চাষ করার ফলে উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা, অন্যান্য ফসলের তুলনায় প্রতি একরে ধানের ফলন বেশী হবার সম্ভাবনা ও চাল/ভাত প্রধান খাদ্য হলে সমাজে জনসম্পদ বাড়ার সুযোগ থাকে—অতএব ধানের উৎপাদন মধ্যগাঙ্গেয় নিয়মিত ও ব্যাপক হওয়ায় অন্তত তিন রকম অর্থনৈতিক সুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল।
কৃষিজাত উৎপাদনের ক্ষেত্রে ধানই ছিল নিঃসন্দেহে প্রধান ফসল; তবে অন্যান্য ফসল অজানা ছিল না। পাণিনি ইক্ষুরস ও আখ থেকে গুড় তৈরীর কথা জানিয়েছেন। পালি সাহিত্যের বর্ণনাতেও ধরা পড়বে যে গুড় নিয়মিত ব্যবহার করা হত। ফলে আখের চাষ সম্বন্ধে বিশেষ সংশয় নেই। এছাড়া পালি সাহিত্যে গম, যব, বাজরা ও তুলোর উল্লেখ আছে। এই ফসলগুলি চাষের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খাদ্যশস্যের পাশাপাশি পণ্য হিসাবে আখ ও তুলোর চাষ আমাদের নজর এড়ায় না।
মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ ছিল, এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কৃষির সাফল্যের জন্য আরও একটি উপাদান বিশেষ জরুরী ছিল; তা হল গোসম্পদ। গোসম্পদের উপর ঋগ্বেদে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়, তা মূলত যাযাবর ও পশুচারণকারীর দৃষ্টিভঙ্গীজাত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কৃষির গুরুত্ব স্বীকৃত হলেও তার ব্যাপ্তি তখনও উল্লেখযোগ্য নয়। ফলে ঐ আমলে গবাদি পশুর প্রয়োজন যথেষ্টই ছিল। অপর দিকে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে যে বহুরকম আচারসর্বস্ব যাগযজ্ঞের বিধিবিধান দেখা যায়, সেই যাগযজ্ঞতে পশুবলি ছিল অপরিহার্য। তাই পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞানুষ্ঠানে পশুহত্যার নিয়মিত উল্লেখ দেখা যাবে। ফলে ১০০০-৬০০ খ্রীঃ পূঃ-এ ধর্মাচরণের উদ্দেশ্যে বহু পশু হত্যা করার দরুন গোসম্পদ হ্রাস পেয়ে থাকবে। নির্বিচার পশুহত্যা শুধু গবাদি পশুর সংখ্যা কমায় না, তা কৃষির পক্ষে অত্যন্ত জরুরী একটি উপাদানকে আপেক্ষিকভাবে দুর্লভ করে তোলে। এই সব কারণে কৃষির প্রসার হলেও তা ছিল অনেকটাই সীমাবদ্ধ। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে রীতিমত বদল ঘটে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে। প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে—বিশেষত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে—যাগযজ্ঞ, আচার অনুষ্ঠান ও পশুবলির প্রতি অনীহার কথা সুবিদিত। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধর্মের ক্ষেত্রেই জীবহিংসার প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা অন্যতম প্রধান দৃষ্টিভঙ্গী। ধর্মীয় ও দার্শনিক তত্ত্বে জীবহিংসার বিরোধিতা নিতান্ত অকারণ ছিল না; বা এই দৃষ্টিভঙ্গী নিছক তাত্ত্বিক ছিল না—তার বস্তুগত যাথার্থ্য অনস্বীকার্য। ব্রাহ্মণ্যধর্মের আচার সর্বস্বতা ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদ্ভব ও উত্থান। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির সাফল্য ও গুরুত্ব স্বীকৃত হওয়ায় পশুসম্পদ ও বিশেষত গবাদি পশুর তাৎপর্য সমাজে অনুভূত হয়েছিল। তাই নির্বিচারে পশুহত্যার বদলে পশু তথা গবাদি পশুর সংরক্ষণ ও পরিচর্যা অপরিসীম গুরুত্ব লাভ করে। এই কারণে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে অহিংসার আদর্শ অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসার প্রতি আস্থা ও পশুহত্যার প্রতি তীব্র বিরাগকে সমকালীন অর্থনৈতিক প্রয়োজনে পশু-তথা-গোসম্পদ সংরক্ষণের অগিদের পটভূমিকায় বিচার করা দরকার। তাই বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে অগ্রগণ্য জীবিকার মধ্যে ‘কসি’ (কৃষি) ও ‘গো-রক্খা’ (গোরক্ষা বা গবাদি পশুর লালন পালন) একসঙ্গে উল্লিখিত হয়। গোরক্ষা শব্দটিই তাৎপর্যপূর্ণ; গোচারণ বা গোপালন বা পশুচারণ জাতীয় শব্দের বদলে ‘রক্ষা’ কথার ব্যবহার হয়েছে পালি সাহিত্যে। ব্যাপক বলিদান থেকে গোসম্পদকে সংরক্ষণ করার চেতনা থেকেই বোধহয় ‘গোরক্ষা’ কথার প্রচলন ঘটেছিল। উত্তরপ্রদেশে অত্রঞ্জিখেড়ার পুরাবস্তুর প্রতি এই প্রসঙ্গে নজর দেওয়া যেতে পারে। অত্রঞ্জিখেড়ায় প্রচুর পরিমাণে মৃত পশুর (গবাদি পশু সহ) দেহাস্থি পাওয়া গিয়েছে; দেহাস্থিতে আঘাতের চিহ্নও স্পষ্ট। পশুহত্যার নজীর সহজেই চোখে পড়ে। লক্ষ্য করার বিষয়, দেহাস্থিগুলি সবই খ্রীঃ পুঃ ৫০০-র পূর্ববর্তী আমলের। ৫০০ খ্রীঃ পূঃ-এর পরবর্তী স্তর থেকে নিহত পশুর অস্থি অত্রঞ্জিখেড়ায় বিরল। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ সম্ভবত নির্দেশ করে যে খ্রীঃ পূঃ ৫০০-র পর থেকে পশুহত্যার প্রবণতা কমছিল। এই দিক দিয়ে বিচার করলে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায়: ৫০০ খ্রীঃ পূঃ নাগাদ থেকে গোসম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছিল বলে মনে হয়। কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে গোসম্পদের ভূমিকা যথাযথভাবে অনুভূত হওয়ায় নির্বিচার বলিদানের মানসিকতার স্থানে ‘গোরক্ষা’র ধারণাই জয়যুক্ত হতে থাকে। পশুপালন ও গোসম্পদের যথাযথ পরিচর্যার প্রতি ধর্মীয় আন্দোলনগুলির যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দেখা দেয়, তা সামগ্রিকভাবে কৃষি অর্থনীতিকে দৃঢ়ভিত্তিক করে তুলতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।
সাধারণত চাষের জমির আয়তন কতটা ছিল, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য নেই। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, একটি পরিবারের খাদ্যসংস্থানের জন্য ছয় নিবর্ত্তন পরিমাণ জমিই যথেষ্ট। আবার অন্য দিকে অনেক বড় মাপের কৃষিজমির অস্তিত্বও অজানা ছিল না। সংযুক্ত নিকায়তে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ পাঁচশ লাঙ্গলের সাহায্যে তাঁর জমি চাষ করতেন। যে জমি পাঁচশ লাঙ্গলের সাহায্যে চাষ করতে হয়, তার আয়তন নিঃসন্দেহে ছয় নিবর্ত্তন পরিমাণ ক্ষেতের চেয়ে অনেক বড়। এরই সঙ্গে এই প্রশ্নটি উঠে আসে যে এত বড় জমি কি জমির মালিকের পক্ষে একা চাষ করা সম্ভব ছিল? একান্নবর্তী পরিবার যে সমাজের ভিত্তি, সেই সমাজে একটি বৃহদায়তন পরিবারের বেশীর ভাগ সদস্যের (অন্তত পুরুষ সদস্যের) কৃষিকাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে জৈন গ্রন্থ জ্ঞাতধর্মকথা-তে বড় জমি চাষ করার জন্য কৃষিশ্রমিক (‘কুলঘর পুরিসে’) নিয়োগের নজীর আছে। তাই ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের বিশাল কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের কাজে কৃষিশ্রমিক ব্যবহারের সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না, যদিও এই ব্যাপারে আমাদের তথ্যসূত্রে নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। বৌধায়ন ধর্মসূত্র ও সংযুক্ত নিকায়তে পাওয়া তথ্য থেকে মনে হয় যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা ক্রমে উদ্ভূত হচ্ছিল। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অপর দৃষ্টান্তটি শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিকের কাহিনীতেও উপস্থিত। শ্রাবস্তীর প্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক বুদ্ধকে জেতবন নামক এক রমণীয় বাগিচা দান করতে চেয়েছিলেন। যেহেতু জেতবন তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ছিল না, তাই প্রথমে বাগানটি আদত মালিকের কাছ থেকে বহু অর্থে কিনে তারপর তা তিনি বুদ্ধকে দান করেন। বস্তুর হস্তান্তরযোগ্যতা যদি ঐ বস্তুর মালিকানার ইঙ্গিত দেয়, তাহলে জেতবনের জমি একবার নয়, দুই দুই বার হাতবদল হয়েছিল। প্রথমে বিক্রী ও পরে দানের মাধ্যমে দুই দফায় জমি হস্তান্তর হওয়ার ঘটনাটি হয়তো জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্বকেই সমর্থন করে। তবে জমি লেনদেন (বিশেষত জমি বিক্রী) সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল; ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া জমি কেনা বেচার ঘটনা সমাজে খুব সুনজরে দেখা হত বলে মনে হয় না। অর্থাৎ জমি তখনও পণ্য বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হত না। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার যতটুকু ধারণা ছিল, তা বোধহয় রাজতান্ত্রিক মহাজনপদগুলিতেই বিরাজ করত; কারণ লিচ্ছবি, বৃজি, মল্ল প্রভৃতি ‘গণ্যরাজ্য’গুলিতে (অরাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা) জমির ওপর কৌম গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানার ধারণাই সক্রিয় ছিল; পালি সাহিত্যের তথ্যও সেই পরিচয়ই বহন করে।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত উপকরণাদির কথাও সমকালীন সাহিত্যে বলা হয়েছে। কৃষিতে লাঙ্গলের ব্যবহার খ্রীঃ পূঃ ৬০০-র পূর্বেই জানা হয়ে গিয়েছিল। পাণিনি ‘হল’ বলতে লাঙ্গলকে বুঝিয়েছেন। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে ‘কুদ্দাল’, কুদ্দলিকা (=কোদাল)-র উল্লেখ আছে। উৎখনন থেকে আবিষ্কৃত বেশীরভাগ কুড়ল ও কোদাল লোহার তৈরী। কৌশাম্বী থেকে লোহার কাস্তেও পাওয়া গিয়েছে, যা অবশ্যই ফসল কাটতে ব্যবহার করা হত। কিন্তু লাঙ্গলের ফলাটি লৌহনির্মিত ছিল কি না, এবং থাকলে তার ব্যবহার কতটা নিয়মিত ও ব্যাপক ছিল, এটি তর্কসাপেক্ষ বিষয়। সুত্তনিপাত গ্রন্থে বর্ণনা আছে লোহার তৈরী লাঙ্গলের ফলাটিকে সারা দিন রৌদ্রে তাতানো হ’ল; পরে দিনের শেষে তা ঠাণ্ডা জলে ডুবিয়ে রাখা হ’ল। এই প্রক্রিয়াটি বোধহয় লোহার দৃঢ়তা আনতে সাহায্য করত। তপ্ত লোহা ঠাণ্ডা জলে ডোবালে যে শব্দ হয়, তার বাস্তবানুগ ও বিশ্বস্ত বর্ণনাও সুত্তনিপাতে আছে। উত্তরপ্রদেশের জাখেড়া, পাঞ্জাবের রোপার, এলাহাবাদের নিকটস্থ কৌশাম্বী ও বিহারের বৈশালী থেকে পুরাতাত্ত্বিকরা সমকালীন লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গল উদ্ধার করেছেন। সাহিত্যগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক এই দুই প্রকারের সাক্ষ্য প্রমাণের দ্বারা রামশরণ শর্মা এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে কৃষির উপকরণগুলি বিশেষত লাঙ্গলের ফলা নিয়মিতভাবেই লোহা দিয়ে তৈরী হত। রামশরণ শর্মার আগে দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী মূলত সাহিত্যগত সাক্ষ্যের সাহায্যে অনুরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কোসাম্বী ও শর্মার মতে লোহার ব্যাপক ব্যবহার জানা না থাকলে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার আদিম অরণ্য পরিষ্কার করা ও গাঙ্গেয় উপত্যকার অপেক্ষাকৃত ঘন ও আঠালো পলিমাটীতে লাঙ্গল চালানো অসম্ভব ব্যাপার। ঐ অঞ্চলে কৃষির সাফল্য ও প্রসারের পিছনে লোহা অপরিহার্য ভূমিকা নিয়েছিল বলেই কোসাম্বী ও শর্মার অনুমান, তবে তাঁদের এই মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। অমলানন্দ ঘোষ মনে করেন যে লাঙ্গলের ফলা লৌহনির্মিত কি না, এ বিষয়ে সাহিত্যগত তথ্য অপ্রতুল না হলেও সমকালীন পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ মুষ্টিমেয়। তাঁর বিচারে, বিশাল গাঙ্গেয় উপত্যকায় ইতস্তত ছড়ানো মাত্র চারটি লাঙ্গলের ফলার নজীরের সাহায্যে সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে লৌহনির্মিত ফলার ব্যাপক প্রচলন প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। অমলানন্দ ঘোষের অনুমান যে গাঙ্গেয় উপত্যকায় তামার ফলাযুক্ত এমনকি কাঠের ফলা লাগানো লাঙ্গল ব্যবহার করেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ফসল ফলানো সম্ভব ছিল। অতএব খ্রীঃ পূঃ ৬০০ নাগাদ আরও বেশী সংখ্যায় লোহার ফলা না পাওয়া যাওয়া পর্যন্ত কৃষির সাফল্যে লোহার লাঙ্গলের ফলার ভূমিকা নিয়ে নিঃসংশয় হওয়া যাচ্ছে না। শৰ্মা অবশ্য এই যুক্তি দিয়েছেন যে আর্দ্র জলবায়ুর কারণে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় বহু প্রাচীন লৌহ উপকরণই মরচে ধরে বা ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে; এই কারণেই লোহার ফলার সংখ্যাল্পতা দেখা যায়। অবশ্য শর্মা একথাও স্বীকার করেছেন যে লোহার তৈরী। লাঙ্গলের ফলার ব্যবহার প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশী দেখা যেতে থাকে খ্রীঃ পূঃ ৩০০ নাগাদ থেকে।
লোহার ব্যবহার কৃষি অর্থনীতিতে কতটা ছিল ও তার উপর কৃষির প্রসার কতটা নির্ভর করত, এ নিয়ে বিতর্কের এখনও অবসান হয়নি। কিন্তু মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির লক্ষণীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে ঐতিহাসিকমহলে দ্বিমত নেই। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণও এ ব্যাপারে নিতান্ত কম নয়। খ্রীঃ পৃ: ৬০০ থেকে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের জায়গায় এক নতুন মৃৎপাত্রের আবির্ভাব ঘটল: এই মৃৎপাত্র উত্তর ভারতের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র (‘নদার্ণ ব্ল্যাক পলিশড্ ওয়্যার’) নামে অভিহিত। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় যে সময় থেকে কৃষি অর্থনীতির সমৃদ্ধ অবস্থা দেখা গেল, মৃৎপাত্রগুলি তারই সমকালীন। এ পর্যন্ত ৫৮৪টি প্রত্নক্ষেত্র থেকে কৃষ্ণবর্ণ উজ্জ্বল মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নক্ষেত্রগুলি বেশীরভাগই মধ্যগঙ্গা উপত্যকায় অবস্থিত। যেহেতু এই এলাকায় খ্রীঃ পূঃ ৬০০ থেকে ৪০০ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত কৃষির উল্লেখযোগ্য প্রসার দেখা যায়, তাই সমকালীন মৃৎপাত্রগুলিকেও একই বস্তুগত সংস্কৃতির পটভূমিতে বিচার করা দরকার। মৃৎপাত্রগুলি যাঁরা তৈরী ও ব্যবহার করতেন, তাঁদেরকে কৃষিজীবী অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গেই যুক্ত করা শ্রেয়। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের বেশীরভাগ প্রাপ্তিস্থান যেহেতু মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার অন্তর্গত, অতএব মানতে দ্বিধা নেই যে কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশ ও বিহারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহুল পরিমাণে বেড়েছিল।
॥ ৩ ॥
খ্রীঃ পূঃ ৬০০ থেকে কৃষির মত কারিগরী শিল্প ও বিবিধ বৃত্তির অগ্রগতিও আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। পালি সাহিত্য ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাহায্যে কারিগরী শিল্পের অবস্থা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। পালি গ্রন্থগুলিতে নিয়মিতভাবে কারিগর ও অন্যান্য বৃত্তিজীবীদের উল্লেখ আছে। বিনয়পিটকে ‘নলকার’ বলে যে কারিগরের কথা জানা যায়, তিনি সম্ভবত কঞ্চি দিয়ে শিল্প সামগ্রী তৈরী করতেন। নলকার অধ্যুষিত গ্রাম বিনয়পিটকে ‘নলকারগাম’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ একটি বিশেষ কারিগর গোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাঁদের কাজ ও বসবাসের জায়গা ঠিক করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে শিল্পে যে স্থানীয়করণের প্রবণতা দেখা যায়, তার কিছুটা আদি রূপ ‘নলকারগাম’-এর উল্লেখ থেকে আন্দাজ করা যায়।
দৈনন্দিন জীবনের জন্য অন্যতম প্রধান উপকরণ মাটীর তৈজসপত্র তৈরি করতেন কুম্ভকার। কুম্ভকার কি ভাবে নদীতীরে বা পুকুর পাড়ে রাখা কাদা দিয়ে মাটীর পাত্র গড়তেন, তার বর্ণনা আছে মজ্ঝিম নিকায় গ্রন্থে। মৃৎপাত্র তৈরির অবশ্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন মারফৎ। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের যেমন প্রায় সমসাময়িক ছিল চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র, সেইরকম প্রাচীন পালি সাহিত্যের সমসাময়িক ছিল উত্তর ভারতের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র। কারিগরী কলাকৌশলের দিক দিয়ে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের চেয়ে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র উন্নততর ছিল। রেমণ্ড অলচিনের মতে উৎকৃষ্ট মাটি ছাড়া এই মৃৎপাত্র গড়া যেত না। কুমোরের চাকার ব্যাপক ব্যবহারও উন্নতমানের মৃৎপাত্র তৈরী করতে সহায়তা করেছিল। মাটির পাত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রিত আঁচে পুড়িয়ে কালো করার বিশেষ কারিগরী দক্ষতার প্রতি অলচিন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। অলচিন মনে করো যে ধরনের চুল্লীতে এই পাত্রগুলি পোড়ানো হত, তা আগের যুগের চুল্লীর তুলনায় উন্নত ছিল। পোড়ানোর পর পাত্রগুলির ওপর এক অতি উজ্জ্বল মসৃণ পালিশ লাগানো হত; উজ্জ্বল, মসৃণ গাত্রবর্ণই এই জাতীয় মৃৎপাত্রগুলিকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এই পাত্রগুলির মধ্যে কয়েকটির গড়ন, পালিশ ও কারিগরী ঔৎকর্ষ এত চমৎকার যে, অলচিন সহ বহু পুরাতাত্ত্বিক মনে করেন যে এক বিশেষ ধরনের কৃষ্ণবর্ণ পাত্র কেবল বিলাসব্যসনের উপকরণ হিসেবেই ব্যবহৃত হত। বিলাসব্যসনের পাত্রগুলির দামও সাধারণ বাসনের তুলনায় বেশী হওয়ারই সম্ভাবনা। থালা, বিভিন্ন আকারের বাটী ও কানা উঁচু বা কানা নীচু নানা গড়নের কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই পাত্রের উদ্ভব ও ব্যবহার প্রথমে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় শুরু হলেও খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতকের পর তা গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকা, এমনকি তারও বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। উজ্জল কৃষ্ণবর্ণ পাত্রগুলির সঙ্গে আরও এক জাতীয় পাত্রের কথা বলা দরকার—এগুলি কৃষ্ণ-লেহিত মৃৎপাত্র (ব্ল্যাক অ্যাণ্ড বেড ওয়্যার)। বারানসী নিকটস্থ রাজঘাট ও প্রহ্লাদপুর এবং বিহারের চিরান্দ ও সোনপুর উৎখনন থেকে এই জাতীয় মৃৎপাত্রের অস্তিত্ব জানা যায়। কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের সঙ্গে যেহেতু লোহার উপকরণও একই স্তরে আছে, অতএব মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় লৌহ উপকরণের প্রসার ও দুই প্রকার মৃৎপাত্রের উদ্ভব এক অভিন্ন বস্তুগত পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত।
কারিগরী শিল্পের মধ্যে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল কর্মকারের বৃওিতে। কর্মকার বা পালি সাহিত্যের ‘কম্মকার’ লোহার তৈজস তৈরী করতেন। লোহার ব্যবহার যে সমাজে উত্তরোত্তর বাড়ছে, সেই সমাজে কর্মকারের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। কর্মকারের কারখানায় যে হাপর থাকত পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। পাণিনি আরও জানাচ্ছেন যে লাঙ্গলের ফলা ধারালো করার জন্য কৃষক কর্মকারের কাছে আসতেন। কর্মকার হাপরের দ্বারা উত্তাপ বাড়িয়ে তপ্ত লোহার ফলাকে তীক্ষ্ণতর করে তুলতেন। কর্মকার যে কেবলমাত্র কারিগরী শিল্পের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, তাঁর সঙ্গে কৃষকের নিত্য যোগাযোগও আমাদের নজরে পড়ে। মজ্ঝিম নিকায়ে বলা হয়েছে ‘কম্মার’-এর কারখানায় কাঁসার জিনিস তৈরী হত। এই সাক্ষ্য মেনে নিলে অনুমান করতে বাধা নেই যে কর্মকার লোহা ছাড়াও অন্য ধাতু ব্যবহারেও দক্ষ ছিলেন। অনুরূপ ইঙ্গিত অঙ্গত্তর নিকায়তেও উপস্থিত। এই গ্রন্থে কর্মকার ও সুবর্ণকার অভিন্ন বলে বর্ণিত। তবে সুবর্ণকারের স্বতন্ত্র পেশার অনেকগুলি নির্ভরযোগ্য নজীর থাকায় মানা কঠিন যে একই কারিগর লোহা ও সোনা—দুই ধাতুতেই কাজ করতে সমান পারদর্শী ছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে চুন্দ নামক ‘কম্মার’-এর কথা জানা যায়; তিনি বুদ্ধের অন্যতম প্রিয় ভক্ত; আম্রবাটিকায় তাঁরই নিমন্ত্রণে গৌতম বুদ্ধ শেষ আহার গ্রহণ করেছিলেন। দীঘনিকায়তে চুন্দ ‘কম্মারপুত্ত’ বলে আখ্যাত। ‘কম্মারপুত্ত’ বা ‘কর্মকারপুত্র’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ কর্মকারের ছেলে, কিন্তু কথাটি প্রকৃত পক্ষে কর্মকারের সমার্থক (তুলনীয় কলুর পো, শেখের পো, প্রভৃতি শব্দ যা পেশা বোঝাতে ব্যবহৃত)। ‘কস্মার’ ও ‘কস্মারপুত্ত’ কথা দুটি যেখানে প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত, সেখানে কল্পনা করা যুক্তিযুক্ত যে কর্মকারের পেশা ক্রমশ বংশানুক্রমিক হয়ে উঠছিল। কোনও পেশা বংশানুক্রমিক হয়ে উঠল তার ফলে কারিগরী দক্ষতা অনেক সময় বাড়ে ও পেশাটিতে বিশেষীকরণের ঝোঁক দেখা দেয়। বস্তুত খ্রীঃ পূঃ যষ্ঠ শতক থেকে কারিগরী বৃত্তিতে বংশানুক্রমিকতার প্রকাশ অর্থনৈতিক ইতিহাসের দিক দিয়ে তাৎপর্যময় ঘটনা। উত্তর প্রদেশের কৌশাম্বী, প্রহ্লাদপুর, রাজঘাট, ম্যাসন ও বিহারের চিরান্দ, বৈশালী, পাটনা, সোনপুর ও চম্পাতে উৎখননের দ্বারা লোহার নানাবিধ উপকরণ পাওয়া গিয়েছে। এই উপকরণগুলি, আগেই বলা হয়েছে, কৃষ্ণবর্ণ উজ্জ্বল মৃৎপাত্র ও কৃষ্ণলোহিত মৃৎপাত্রের সমসাময়িক। তবে একথা অনস্বীকার্য, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের সমকালীন লৌহ উপকরণ যে পরিমাণে অত্রঞ্জিখেড়া ও নোহ্ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, পরবর্তী কালে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় পাওয়া লৌহ উপকরণের সংখ্যা তার চেয়ে কম। এর থেকে অবশ্য মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় লোহার ব্যবহারে আপেক্ষিক হ্রাস প্রমাণিত হয় না; কারণ আর্দ্র জলবায়ুর প্রকোপে লৌহ উপকরণ নষ্ট হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। রামশরণ শর্মা মনে করেন উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকায় পাওয়া লৌহ উপকরণ মূলত অস্ত্রশস্ত্র; জীবনযাত্রার উপকরণ সেখানে কম। অপরপক্ষে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় আবিষ্কৃত লোহার জিনিসপত্র প্রধানত দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাত। এর থেকে অনুমান করা চলে যে লোহার ব্যবহার গাঙ্গেয় উপত্যকায় পশ্চিম থেকে যতই পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, ক্রমে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় অধিকতর গুরুত্ব লাভ করছিল। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় লোহার অধিকতর ব্যবহারের আরও একটি বড় সুবিধা এই যে দক্ষিণ বিহারের আকরিক লোহার খনিগুলি ব্যবহার করা সহজসাধ্য ছিল। রাজঘাটে পাওয়া লোহার জিনিসপত্র পরীক্ষা করে ধাতুবিদ্যাবিশারদ ও পুরাবিদরা অভিমত দিয়েছেন, ঐ জিনিসগুলিতে ব্যবহৃত লোহা সিংহভূম ও ময়ূরভঞ্জের আকরিক লোহা থেকে তৈরী হয়েছিল। আকরিক লৌহের খনি বিহারে থাকার ফলে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় লোহার ব্যবহারের সুযোগ প্রশস্ত হয়।
প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্প বস্ত্র নির্মাণ এই আমলে অব্যাহত ছিল। বিনয়পিটক, থেকে জানা যায়, তাঁতী ‘পেশকার’ ও ‘তন্তুবায়’ নামে পরিচিত ছিলেন। পোশাক তৈরী কারিগর ‘তুন্নবায়’ ও সূচীশিল্পের কারিগর ‘সূচীকার’ নামে সংযুক্ত নিকায় গ্রন্থে উল্লিখিত। পালি সাহিত্যের বর্ণনা থেকে মনে হয় বারাণসী বস্ত্রশিল্পে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
হাতির দাঁতের কাজ যিনি করতেন, বিনয়পিটকে তিনি ‘দন্তকার’ নামে অভিহিত। স্পষ্টই বোঝা যায়, ‘দন্তকার’-এর তৈরী করা জিনিসগুলি প্রধানত বিত্তবান মানুষের শখশৌখিনতা মেটাত; নিত্যকার জীবনযাত্রায় হস্তিদন্তজত উপকরণের বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। বিলাসের আর একটি উপকরণ হল পুঁতি, যা অলঙ্কার শিল্পে ব্যাপক ব্যবহৃত হত। প্রাচীন কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তীতে উৎখনন চালিয়ে পুরাতাত্ত্বিক কে. কে. সিনহা প্রচুর পরিমাণে দামী ও আধা-দামী পাথরের পুঁতি উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে লাপিস লাজুলির মত দুর্মূল্য পাথরের পুঁতিও পাওয়া গিয়েছে। পুঁতিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারিগররা যে বিশেষ দক্ষ ছিলেন, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কারিগর ছাড়াও পালি সাহিত্যে বিভিন্ন বৃত্তিতে নিযুক্ত মানুষের কথা জানা যায়। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রজক। সমাজে রজকের বৃত্তি অপরিহার্য। সংযুক্ত নিকায়তে চমৎকার বর্ণনা আছে, রজক কিভাবে নানা লোকের কাছ থেকে পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে আসতেন ও সেগুলি পরিষ্কার করার পর যথাযথ ব্যক্তিদের তা ফেরত দিতেন। সংযুক্ত নিকায় থেকে আরও জানা যায় যে কাপড় রং ও চিত্রিত করার কাজও রজকই করতেন। সেবামূলক বৃত্তির মধ্যে যেটি পালি সাহিত্যে সর্বাধিক উল্লিখিত, তা হল নাপিতের বৃত্তি। ‘নহাপিত’ বা নাপিতের বৃত্তি, বিনয়পিটক অনুযায়ী, বংশানুক্রমিক ছিল। তবে নাপিতের বৃত্তির মর্যাদা কতটা ছিল সন্দেহ আছে। বিনয়পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীরাও যখন নহাপিতকে ‘নিহীনজচ্চো’ (হীনজাতি সম্ভূত) ও ‘মলমজ্জনো’ (নোংরা পরিস্কার করার কাজে যুক্ত) বলে বর্ণনা করেন, তখন তাতে নিছক ঘৃণা ও অবহেলাই ফুটে ওঠে। বৌদ্ধ ভিক্ষুণীরাই যেখানে এই ভেদমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা আচ্ছন্ন, তখন সাধারণ মানুষ ‘নহাপিত’-এর বৃত্তির প্রতি যথেষ্ট সম্মান ও সহানুভূতি দেখাতেন কি না বলা কঠিন।
অন্য দিকে বিশেষ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকের বৃত্তিকে। পালি সাহিত্যে চিকিৎসক সাধারণত ‘বেজ্জ’ অর্থাৎ বৈদ্য বা ‘ভিষক’ বলে আখ্যাত। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ছিলেন জীবক কোমারবচ্ছ (=কুমারবৎস)। গন্ধার দেশের রাজধানী তক্ষশিলায় তিনি দীর্ঘ সাত বছর চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেন ও কালে অত্যন্ত সফল চিকিৎসক রূপে স্বীকৃত হন। অঙ্গুত্তর নিকায়, দীঘনিকায় ও বিনয়পিটক থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে জীবক সমকালীন শাসকগোষ্ঠী ও বিত্তশালী মহলে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেন। চিকিৎসকের বৃত্তি ছাড়া বিনয়পিটকে ‘মুড্ডা’ বা মুদ্রা লেনদেনের কাজ, ‘গণনা’ বা হিসাব পরীক্ষার কাজ ও ‘লেখ’ বা করণিকের কাজ উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বৃত্তি বলে উল্লিখিত। পালি সাহিত্যে ‘সিপ্প’ বা শিল্প কথার বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। ‘সিপ্প’ দুই প্রকার—উচ্চ ও হীন। শিল্প বা বৃত্তির সঙ্গে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নটি বৌদ্ধ সাহিত্যে যুক্ত ছিল। তবে কোন ‘সিপ্প’ হীন পর্যায়ভুক্ত হবে, এ বিষয়ে কোনও ধরাবাঁধা ধারণা যে তখনও গড়ে ওঠেনি, নরেন্দ্র ওয়াগলের গবেষণা সেইরকমই ইঙ্গিত দেয়।
খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে কারিগরী শিল্প ও নানা জীবিকায় আরও একটি অভিনবত্ব দেখা গেল। পেশাদারী সংগঠনের আবির্ভাব এই আমলেই ঘটে। বৌধাযণ ধর্মসূত্র, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ও পালি সাহিত্যে এই জাতীয় বৃত্তিমূলক সংগঠন শ্রেণী, গণ, পূগ, সংঘ ইত্যাদি বিবিধ আখ্যায় পরিচিত। সাধারণভাবে এইঁগুলিকে ‘গিল্ড’ বা তদনুরূপ সংগঠনের সমতুল্য বলে মনে করা হয়। কিভাবে এই সংগঠনের উদ্ভব হল, তার চরিত্র ও কর্মপদ্ধতিই বা কি রকম, এই সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান নিতান্ত ক্ষীণ। অবশ্য বৌধায়ন ধর্মসূত্রেই প্রথম জানা যায় যে এই ‘শ্রেণী’ জাতীয় সংগঠনগুলিতে যে নিয়মকানুন ও প্রথা প্রচলিত ছিল, সেইগুলি দেশের আইনের সমমর্যাদা পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হত। এই যৎসামান্য উল্লেখ থেকেও কিন্তু ‘শ্রেণী’ বা ‘সংঘ’-এর সাংগঠনিক দিকের কিছুটা আভাস পাওয়া সম্ভব। অর্থনৈতিক জীবনে তাদের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়েছিল বলেই ‘সংঘ’ বা ‘শ্রেণী’-র নিয়মগুলি আইনের মর্যাদা লাভ করেছিল।
॥ ৪ ॥
খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময়সীমায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাণিজ্যের বিকাশ। কৃষি অর্থনীতির সাফল্য বহুরকমের পেশাদারী শিল্প ও বৃত্তির বিকাশে সাহায্য করেছিল; আবার কৃষিজাত ও শিল্পজাত উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটায় তা বাণিজ্যের প্রসারের পক্ষে বিশেষ অনুকূল হয়ে ওঠে। পালি সাহিত্যে জীবিকা হিসেবে ‘কসি’ (কৃষি) ও ‘বণিজ্জা’ (বাণিজ্য)-এর তুলনাটি চিত্তাকর্ষক: ‘কসি’ (কৃষি)-র সাফল্যের জন্য বহু দায়দায়িত্ব ও পরিচর্যা দরকার; সর্বক্ষণ তার ওপর নজর রাখতে হয়; কিন্তু ফসল ফলাবার সমস্যা অসংখ্য; যথেষ্ট সফল হলে তবেই ‘কসি’ থেকে প্রচুর অর্থাগম ঘটতে পারে। অন্য দিকে ‘বণিজ্জা’-তে ‘কসি’-র তুলনায় দায়দায়িত্ব এবং পরিশ্রম কম সমস্যাও কম অথচ লাভের সম্ভাবনা সুপ্রচুর। বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য সারিপুত্ত বুদ্ধকে বলেছিলেন বাণিজ্যে নিযুক্ত ব্যক্তির (‘বাণিজ্যযুত্ত’) সামনে চার প্রকার ফলের সম্ভাবনা থাকে: কারো কাছে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় (‘ছেদগামিণী হোতি’); কখনও বা যতটা আশা করা গিয়েছিল, ততটা অর্থপ্রাপ্তি ঘটে না (‘ন যথাভিপ্পায়’); কেউ আশানুরূপ লাভই করে (‘যথাভিপ্পায়’); আবার কারও কারও প্রত্যাশার অতিরিক্ত অর্থাগম ঘটে (‘পরাভিপ্পায়’)। বাণিজ্য থেকে যে প্রচুর অর্থ লাভ হওয়া সম্ভব, এ সম্বন্ধে পালি সাহিত্য বেশ সচেতন। বাণিজ্যের এতটা গুরুত্ব পূর্ববর্তী আমলের বৈদিক সাহিত্যে নেই। অত্যন্ত ধনী বণিক পালি সাহিত্যে ‘সেটঠি’ অর্থাৎ ‘শ্রেষ্ঠী’ বলে অভিহিত; তবে তাঁদের উল্লেখ বেশী নেই। তুলনায় ছোট দোকানদার ও ব্যবসায়ী (‘পাপনিকো’)-র কথা পালি সাহিত্যে বেশীবার বলা হয়েছে। অঙ্গুত্তর নিকায় অনুসারে চাতুর্য, দক্ষতা ও ক্রেতার প্রতি আস্থা অর্জনের ক্ষমতার উপর ছোট ব্যবসায়ীর সাফল্য নির্ভর করে। ভ্রাম্যমান বণিকের ক্রিয়াকলাপও সমকালীন তথ্যসূত্রে অজানা ছিল না। এই জাতীয় বণিক বা বণিকদের প্রধান ‘সার্থবাহ’ নামে পরিচিত। বহুশত গো-শকটে পণ্য বোঝাই করে সার্থবাহ ‘পুব্বন্ত’ (পূর্বসীমা) থেকে ‘অপরান্ত’ পাড়ি দিচ্ছেন, পালি সাহিত্যে এটি খুবই পরিচিত দৃশ্য। দীঘনিকায়তে এমনই এক সার্থবাহের হাজার গো-শকট নিয়ে মরু অঞ্চল পার হবার বর্ণনাও পাওয়া যাবে। বর্ষাকালে চলাচল যখন দুরূহ হয়ে পড়ত, তখন সার্থবাহ ও ভিক্ষু যে একই সঙ্গে সময় অতিবাহিত করছেন, এমন কাহিনী দীঘনিকায়তে আছে। বুদ্ধের সঙ্গে বেলট্ঠ কাচ্চানের যখন দেখা হয়, তখন ঐ বণিক পাঁচশ শকটে গুড়ের জালা নিয়ে বাণিজ্যে চলেছিলেন। এখানে লক্ষ্য করা যেতে পারে গুড়ের মত আটপৌরে সামগ্রীর যথেষ্ট পরিমাণে লেনদেন চলছিল। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী-তে ‘গো বণিজ’ ও ‘অশ্ব বণিজ’ (৬. ২. ১৩) এর উল্লেখ করেছেন। এই বর্ণনা থেকে মনে হয়, যে ব্যবসায়ীরা জীবজন্তুর লেনদেনে ব্যাপৃত ছিলেন তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল; এবং তার মধ্যেও পশুর বিচারে তাঁদের মধ্যে উপবিভাগ করা হয়েছিল। পাণিনি এছাড়া ‘গন্ধার বণিজ’ ও ‘মদ্র বণিজ’ (৬. ২. ১৩)-এর কথাও বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বণিকদের চিহ্নিত করছেন তাদের বসতি এবং/বা কর্মস্থান অনুযায়ী। ব্যবসায়ের যে বর্ণনা সমকালীন সূত্রে পাওয়া যায়, তা বেশীরভাগই স্থলবাণিজ্য সংক্রান্ত। গোটা উত্তরভারতে ও গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা থাকায় তা যাতায়াতকে সহজ ও সুগম করে তুলেছিল। এই যুগের দুই সর্বাধিক ভ্রাম্যমাণ ব্যক্তি বুদ্ধ ও জীবক। তাঁদের যাতায়াতের বিবরণ অনুধাবন করলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে গাঙ্গেয় উপত্যকায় স্থলপথে আসা যাওয়ায় বিশেষ অসুবিধা ছিল না।
স্থলবাণিজ্যের তুলনায় সাগর পাড়ি দিয়ে বাণিজ্যের বর্ণনা পালি সাহিত্যে তুলনামূলক ভাবে কম। তবে ‘সমুদ্দবণিজ্জ’ (=সমুদ্রবাণিজ্য) ও ‘সমুদ্দিকায়া নাবা’ (সমুদ্রগামী জলযান) একেবারে অপরিচিত বিষয় ছিল না। ‘দিশাকাক’ নাকি যে পাখীর উল্লেখ পাওয়া যায় তাকে দীর্ঘ জলপথ যাত্রায় জলযান থেকে উছিয়ে দেওয়া হত, এবং নিকটবর্তী তটভূমির দিকে পাখীটি উড়ে গেলে নাবিকরা তাকে অনুসরণ করে অগ্রসর হতেন। তবে স্থলবাণিজ্যের চেয়ে সমুদ্রবাণিজ্যের উল্লেখ পালি সাহিত্যে কম হওয়ায় এই তথ্যগুলিকে সমুদ্র বাণিজ্যের নিশ্চিত সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন।
বাণিজ্যের প্রসার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার পথকে প্রশস্ত করেছিল। সুদের কারবারীর প্রতি বৌদ্ধধর্মে সুনজর নেই বটে; কিন্তু ব্যবসা চালাতে গেলে ঋণব্যবস্থা যে একান্ত আবশ্যক, এই ধারণা পালি সাহিত্যে স্বীকৃত। তাই বলা হয়েছে ব্যবসা শুরু করতে গেলে (কম্মন্তে পয়োজেয্য) অর্থ ও রসদ, দুই-ই ধার করতে হয়। কিন্তু তারই সঙ্গে একথাও পরিষ্কার বলা আছে যে ব্যবসায়ীকে এতটাই সফল হতে হবে, যাতে করে ঋণ শোধ করেও স্ত্রী পুত্র পরিবারকে ভরণপোষণ করার মত পর্যাপ্ত সংস্থান তাঁর থাকে। এই প্রসঙ্গে পালি সাহিত্যের আরও একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: যে কোনও ব্যবসা থেকেই (‘যেন কেনাচি কন্মাথ্থানেন’) যে কোনও ব্যক্তি রোজ অর্দ্ধকাহাপণ (মুদ্রাবিশেষ) আয় করতে পারে; ক্রমে সে দিনে পঞ্চাশ কাহাপণ রোজগার করতে সক্ষম হয়; ধীরে ধীরে দৈনিক একশত কাহাপণ লাভ করলে তার সচ্ছলতা আসে; যখন সে অর্থসঞ্চয় করে ও অধিকতর সাফল্য দ্বারা দৈনিক হাজার কাহাপণ রোজগার করতে সমর্থ হয়, তখন সে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাবে যে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্যও দ্রুত লয়ে বাড়ছিল। বাণিজ্য থেকে প্রভূত অর্থলাভের সম্ভাবনা সম্ভবত বহু সংখ্যক মানুষকে বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকবে। ব্যবসা বাণিজ্য যে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ধাতব মুদ্রার উপস্থিতি। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে যখন একটি নির্দিষ্ট ওজনের ও ধাতবমান বিশিষ্ট একটি ধাতবখণ্ড গৃহীত হয়, তখন বোঝা যায় যে ব্যবসা বাণিজ্য নিছক বিনিময় প্রথার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় মুদ্রার উপস্থিতির চাক্ষুষ প্রমাণ রয়েছে। পালি সাহিত্যে যাকে ‘কাহাপণ’ (=কার্ষাপণ) বলা হয়েছে, সেই জাতীয় মুদ্রা প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলি রূপো বা তামার তৈরী, আকারে ক্ষুদ্র এবং বর্গাকার ও আয়তাকার। লেনদেনের মাধ্যমে হিসেবে বৈদিক সাহিত্যে মুদ্রার ধারণা ছিল কি না, প্রমাণ করা শক্ত। বৈদিক সাহিত্যে ‘কৃষ্ণল’, ‘শতমান’, ‘নিষ্ক’ প্রভৃতি শব্দ যে বিভিন্ন মুদ্রানাম, এমন মত কোনও কোনও ঐতিহাসিক পোষণ করেন; তবে ১০০০-৬০০ খ্রীঃ পূঃ-এ মুদ্রার চাক্ষুষ প্রমাণ আবিষ্কৃত না হওয়ায় ঐ আমলে মুদ্রার অস্তিত্ব প্রমাণ করা কঠিন। তা ছাড়া ১০০০-৬০০ খ্রীঃ পূঃ-তে অর্থনৈতিক বিকাশ এতটা হয় নি বা উৎপাদনও এতটা ছিল না, যার ফলে নিয়মিত ব্যবসায়িক লেনদেন চালানো সম্ভব ছিল। খ্রীঃ পূঃ ৬০০ থেকে যে ধাতব মুদ্রাগুলি আমাদের নজরে আসে, তাতে কোনও রাজা বা রাষ্ট্রশক্তির নাম বা ছাপ নেই। কোসাম্বী যুক্তিসঙ্গত অনুমান করেছিলেন যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গোড়াতে ব্যবসায়ীরা বেসরকারী উদ্যোগে ধাতবখণ্ডগুলির প্রচলন ঘটান। মুদ্রার ওজন ও ধাতুগত বিশুদ্ধি ঠিক আছে কি না, তা পরীক্ষা করে প্রত্যয়ের জন্য ব্যবসায়ীরা মুদ্রার ওপরে বিভিন্ন নকশার ছাপ দিতেন (যেমন চন্দ্র, সূর্য, গাছ, ফুল, হাতী, ঘোড়া প্রভৃতি)। তাই এই মুদ্রাগুলিকে ‘অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা’ বা ‘পাঞ্চ-মার্কড কয়েন’ পরিভাষায় চিহ্নিত করা হয়। সমগ্র ভারতবর্ষে এখন পর্যন্ত ‘অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা’-র পাঁচশটি ভাণ্ডার (‘হোর্ড’) আবিষ্কৃত হয়েছে এবং হাজার হাজার মুদ্রার কথা জানা আছে। বেশীরভাগ মুদ্রাভাণ্ডারই মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত। এর মধ্যে পাইলা, শ্রাবস্তী (=আধুনিক সেট মহেট) ও গোরখপুর থেকে পাওয়া মুদ্রাগুলি বোধহয় প্রাচীনতম। অতএব মনে হয় এই অঞ্চলেই বোধহয় ‘অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রাগুলি’র প্রথম উদ্ভব ঘটে। মুদ্রার নিয়মিত ব্যবহার সম্বন্ধে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে সংশয়াতীত তথ্য পাওয়া যেতে থাকে। সমকালীন সাহিত্যে বাণিজ্যের বহুলতর উল্লেখই কেবল জানা যায় না, বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার উপস্থিতি অবশ্যই প্রমাণ করে বাণিজ্য তৎকালীন যুগের অন্যতম প্রধান জীবিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
॥ ৫ ॥
কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে যে নূতন অর্থনৈতিক অবস্থার উদ্ভব হল, তার অন্যতম ফলশ্রুতি মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরের আবির্ভাব। সাহিত্যগত ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দ্বারা নিঃসন্দেহে দেখানো যায় যে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। এই ঘটনাটির তাৎপর্য অনুধাবন করা দরকার। প্রাচীন ভারতে নগরায়নের প্রথম পর্ব দেখা দিয়েছিল হরপ্পা সভ্যতায় (খ্রীঃ পূঃ ২৩০০-১৭৫০)। হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলি অবলুপ্ত হবার পর এই প্রথম ভারত উপমহাদেশে আবার নগরজীবনের পুনরাবির্ভাব ঘটল। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক ভারত ইতিহাসে নগরায়নের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা করল। কেন ও কিভাবে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় নগর আবির্ভূত হল এই বিষয়ে অনুপুঙ্খসহ আলোচনা হওয়া একান্ত জরুরী।
মনুষ্য সমাজে স্থায়ী বসতির দুইটি মূল প্রকারভেদ দেখা যায়: গ্রাম ও নগর। গ্রাম ও নগরের সংজ্ঞা নিয়ে ঐতিহাসিক সমাজবিদ্যা বিশারদ ও ভৌগোলিকদের মধ্যে ঐকমত্য নেই; বিশেষত ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে গ্রাম ও নগরের চরিত্র ও রূপ ভিন্নতর হতে বাধ্য। তবে গ্রাম ও নগরের তফাৎ অনুধাবন করা সহজ। আকার ও আয়তনের দিক দিয়ে বিচার করলে যে কোনও গ্রামের তুলনায় শহর সাধারণত বড় মাপের হয়। প্রাচীনতম নগরগুলিতে যে ধরনের জনবসতির ঘনত্ব থাকা সম্ভব, তার অনুরূপ ঘনত্ব প্রাক-শহর কোন বসতিতে থাকা নিতান্ত বিরল। গ্রাম থেকে শহরকে আলাদা করে চিনে নেবার অপর লক্ষণ এই দুই এলাকার কর্মজীবন তথা জীবিকার ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য। গ্রাম মূলত কৃষি অর্থনীতির উপর আশ্রয় করে থাকে; গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সরাসরি খাদ্যোৎপাদক। অন্য দিকে শহরে চাষাবাদ হয় না; শহরের বাসিন্দারা সাধারণত বিভিন্ন কারিগরী শিল্প, পেশাদারী বৃত্তি, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থেকে জীবন চালান। যেহেতু নগরবাসী সরাসরি নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করেন না, ফলে খাদ্য সরবরাহের জন্য তাঁরা গ্রামের কৃষিজ উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল থাকেন। অতএব গ্রামের প্রয়োজনীয় খাদ্যসংস্থান মিটিয়ে যদি যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বৃত্ত থাকে, তবে সেই শস্য নগরবাসীর কাছে পৌঁছতে পারে। অন্য দিকে গ্রামে যে শিল্পসামগ্রী উৎপন্ন হয় না সেগুলি ব্যবসায় মারফৎ শহর থেকে গ্রামে পৌঁছয়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও দুই প্রকার জনবসতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক; কার্যত একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। পারস্পরিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য দুই এলাকার উৎপন্ন দ্রব্যের লেনদেনে হয়তো বহু ক্ষেত্রেই সমতা থাকে না, এবং অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাম থেকে শহরে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত শস্য/খাদ্য আসে, সমপরিমাণ সামগ্রী শহর থেকে গ্রামে যায় না। এই বৈষম্য মেনে নিলেও বুঝতে অসুবিধে নেই যে নগরজীবনের সঙ্গে যদিও সরাসরি চাষাবাদের সম্পর্ক নেই, কিন্তু খাদ্য ও শস্যের সরবরাহ নিশ্চিত ও নিয়মিত না হলে শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে শহরের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির ব্যাপক বিকাশ ও শিল্প এবং ব্যবসায়ে যুগপৎ অগ্রগতি নগরায়নের পক্ষে অনুকূল অবস্থার জন্ম দেয়।
বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম পর্বে নগরের প্রতি তীব্র অনীহা হয়তো পরবর্তী পর্যায়ে অনেকটাই কমে এসেছিল, তবুও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে নগরের উল্লেখ বা নগরজীবনের কথা নিতান্ত অল্প। উল্টো দিকে খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতকে পাণিনি গ্রাম ও নগরের পার্থক্য বিষয়ে সচেতন ছিলেন; পাণিনি এ-ও বলেছেন যে নগরগুলি ‘প্রাচ্য’ (পূর্ব) দিকেই বেশী। পাঞ্জাবের শালাতুর গ্রামের (আধুনিক শিয়ালকোটের কাছে) বাসিন্দা পাণিনি পূর্ব দিকের নগর বলতে সম্ভবত মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার শহরগুলির দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নগরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ের সাক্ষ্য অবশ্য পালি সাহিত্যেই বেশী। দীঘনিকায়ের মহাপরিনিব্বান সুত্ত (মহাপরিনির্বাণ সূত্র) অনুসারে বুদ্ধের সমকালীন নগরের সংখ্যা ষাট। এর মধ্যে ছয়টি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বপ্রধান। এগুলির নাম: বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা, রাজগৃহ, শ্রাবস্তী ও কুশীনগর। এর মধ্যে কুশীনগরকে বাদ দিলে বাকী নগরগুলির প্রত্যেকটিই মহাজনপদের রাজধানী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতির অধিকারী (কুশীনগর বিখ্যাত হয় সম্ভবত বুদ্ধের পরিনির্বাণ বা দেহান্ত ঘটার কারণে)। কিন্তু পালি সাহিত্যে নগরের যে বর্ণনা আছে তা নিতান্ত প্রথানুযায়ী; ছোট, বড়, গৌণ, মুখ্য শহর নির্বিশেষে যে কোনও নগরের বর্ণনাই এক রকম। তাই রাজগৃহের মত এক অগ্রগণ্য শহর ও কপিলবস্তুর মত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর নগরের বর্ণনায় বিশেষ পার্থক্য চোখে পড়ে না। যে কোনও নগরের বর্ণনা প্রসঙ্গে পালি সাহিত্যকাররা নগরের বিশাল আয়তন, নগরের চারপাশে তোলা উচ্চ ও দৃঢ় প্রকার অথবা গভীর পরিখা (অথবা দুই-ই), নগরের ভিতরে যাবার জন্য তোরণশোভিত একাধিক প্রবেশদ্বার, বহু অট্টালিকা, হর্ম্য ইত্যাদি দ্বারা রমণীয় নগর এবং বণিক, কারিগর ও পথচারীদের সদাতৎপরতার জন্য ব্যস্ত সরণী ও রাজপথ—এই জাতীয় বর্ণনা দিয়েছেন। এই বাঁধাগতের বর্ণনা থেকে নগরের বাস্তব অবস্থা ও বিন্যাস বোঝা শক্ত; ঐতিহাসিকরা তাই যুক্তিযুক্ত কারণেই পালি সাহিত্যের প্রথাগত বিবরণের উপর পূর্ণ আস্থা রাখেন না।
সাহিত্যগত বর্ণনার এই ত্রুটি নগরায়নের স্বরূপ বোঝার পক্ষে বড় প্রতিবন্ধক সন্দেহ নেই; কিন্তু সাহিত্যিক উপাদানের সীমাবদ্ধতা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাহায্যে অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধান ও উৎখননের ফলে এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে নগরের আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটছিল। পালি সাহিত্যে উল্লিখিত অনেকগুলি নগরে উৎখনন চালিয়ে নগরজীবনের চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। পালি সাহিত্যে প্রথাগত বর্ণনা সত্ত্বেও নগরায়নের যে সার্বিক চিত্রটি ফুটে উঠেছে তাতে বিশেষ সন্দেহের কারণ নেই।
উত্তর প্রদেশে অবস্থিত অত্রঞ্জিখেড়া এক বিশাল ও প্রসিদ্ধ প্রত্নক্ষেএ। এখানে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র যে স্তর থেকে পাওয়া গিয়েছে, তার আয়তন ৬৫০ বর্গমিটার। এর ঠিক পরবর্তী স্তর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে উজ্জ্বল কৃষ্ণুবর্ণ মৃৎপাত্র, যা মোটামুটিভাবে বুদ্ধের সমসাময়িক। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র যে স্তরে আবিষ্কৃত হল তার আয়তন ৫৫০ মিঃ × ৮৫০ মিঃ। অর্থাৎ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক নাগাদ অত্রঞ্জিখেড়ার জনবসতি আয়তনে উল্লেখযোগ্যরকম বেড়েছে। আমরা আগেই বলেছি বস বিস্তার—যা জনবসতি বৃদ্ধি ও ঘনত্বের পরিচায়ক—সাধারণত নগর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের স্তর থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে অত্রঞ্জিখেড়ার প্রাচীনতম নগর প্রাকার। কৌশাম্বী (এলাহাবাদের কাছে) আবিষ্কৃত হয়েছে আর একটি বিশাল প্রাকার, যার পরিসীমা ৬.৫ কি.মি.। এই প্রকার নিঃসন্দেহে কৌশাম্বীর নগরসুলভ চরিত্রকে প্রকট করে। এই প্রত্নক্ষেত্র যিনি উৎখনন করেন সেই গোবর্ধন রাই শর্মা-র মতে প্রাকারটি খ্রীঃ পূঃ ১০০০ নাগাদ তৈরী হয়। এই অভিমতের তাৎপর্য হল, কৌশাম্বীতে খ্রীঃ পূঃ ১০০০ নাগাদ নগরের পত্তন ঘটেছিল, যে ঘটনা সাধারণভাবে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরায়নের সূচনার অন্তত চার শতাব্দী আগে দেখা গেল। কিন্তু অধিকাংশ পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক শর্মা-র কালনির্ণয়ের সম্বন্ধে সন্দিহান। তাঁদের মতে খ্রীঃ পূঃ ৬০০ নাগাদ, কিন্তু উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের আবির্ভাবের আগে, এই প্রকার তৈরী হয়েছিল। অর্থাৎ কৌশাম্বীর নগরায়ন খ্রীঃ পূঃ ৬০০-র সামান্য কিছু পূর্বেই শুরু হয়ে থাকবে। বারাণসী নগরীর প্রাচীনতম অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে বারাণসীর নিকটস্থ রাজঘাট থেকে এখানেও নগরের চারপাশে প্রাকার ছিল; লক্ষ্যণীয় যে কৌশাম্বীর মত বারাণসীতেও নগর প্রাকার গড়া হয়েছিল উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র তৈরী হবার আগেই (অর্থাৎ প্রাক-৬০০ খ্রীঃ পূঃ পর্বে)। মগধ মহাজনপদের রাজধানী রাজগৃহও ছিল প্রাকার দিয়ে সুরক্ষিত। এই প্রকারের অস্তিত্ব এখনও যে কোনও পর্যটকেরই চোখে পড়বে। অন্যান্য নগরকারগুলি অধিকাংশই কাদামাটীর বা কাদামাটীর ইঁটে তৈরী (মনে রাখা দরকার যে খ্রীঃ পূঃ ৬০০ থেকে খ্রীঃ পূঃ ৩০০ পর্যন্ত কালসীমায় চুল্লীতে পোড়ানো ইঁটের ব্যবহার বিরল); কিন্তু রাজগৃহের প্রকারটি পাথর দিয়ে নির্মিত। পাঁচটি পাহাড়ে ঘেরা ও প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত রাজগৃহের নগর প্রাকার এক বিশাল এলাকা জুড়ে পরিসীমা প্রায় ৪০ কি.মি.) অবস্থিত ছিল। এতাবৎ উল্লিখিত নগরগুলির সবকটিই মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত; এর সঙ্গে যুক্ত হবে মালবদেশের অন্তর্গত এরান ও অবন্তী মহাজনপদের রাজধানী উজ্জয়িনীর কথা। এই দুই জায়গাতেই প্রাকারের অস্তিত্ব থাকায় নগরের উদ্ভব বোঝা যায়। প্রাচীরগুলি কেবলমাত্র বৃহৎ নয়, এ-দুটি তৈরী হয় যথাক্রমে খ্রীঃ পূঃ ৭৫০ ও খ্রীঃ পৃঃ ৭০০; এই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের তাৎপর্য অনুধাবন করা জরুরী। নগরের প্রাচীরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরেও নগরায়ন ঘটছিল এবং খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের আগেই প্রাচীন মালব ও অবন্তীতে নগর দেখা দিয়েছিল।
লক্ষ্য করার মত ঘটনা খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে নগরের তালিকায় পাটলিপুত্রের নাম নেই, যে পাটলিপুত্র পরবর্তী কালে (খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতক থেকে) দীর্ঘ দিন ধরে প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগর ও ভারতীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিরাজ করবে। দীঘনিকায়তে এই অঞ্চলের নাম পাটলিগাম অর্থাৎ পাটলিগ্রাম; পাটলিগামকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘পূটভেদন’ বলে। ‘পূটভেদন’ কথার অর্থ এমন এক বাণিজ্যকেন্দ্র যেখানে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পসরা উন্মুক্ত করেন (পূট=ঢাকা, আচ্ছাদন; ভেদন=ভাঙা বা মুক্ত করা)। অর্থাৎ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে পাটলিগাম পুরোপুরি নগর হয়নি; কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রের পরিচিতি লাভ করেছে। তবে দীঘনিকায়তে বুদ্ধ পাটলিগামের আসন্ন গৌরবময় দিনগুলির সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক হয়েছিল। তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই বাণিজ্যকেন্দ্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অবিলম্বে অনুভূত হয় ও খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতকে পাটলিগাম পাটলিপুত্ররূপে ভারতের প্রধানতম নগরের মর্যাদা পায়।
॥ ৬ ॥
এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের যে পরিচয় দেওয়া হল তা একান্তভাবে উত্তর ভারতকে আশ্রয় করে। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কি প্রকার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল তা জানার একমাত্র উপায় প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমান। কারণ এই আমলে উত্তর ভারতের মত দাক্ষিণাত্যে ও দক্ষিণ ভারতে সাহিত্যগত প্রমাণাদি অনুপস্থিত। উৎখনন ও অনুসন্ধান থেকে যে নিদর্শনগুলি পাওয়া গিয়েছে তা সবই সমাধিক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সমাধিক্ষেত্রে মৃতদেহগুলি নানা পদ্ধতিতে কবর দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সমাধিক্ষেত্রগুলি বিশাল প্রস্তরখণ্ড বা অনেকগুলি বিশাল প্রস্তরখণ্ড দিয়ে তৈরী। তাই পুরাতাত্ত্বিক পরিভাষায় এই সংস্কৃতিকে বৃহদশ্মীয় (মেগালিথিক) নামে আখ্যা দেওয়া হয়। সমাধি আশ্রিত এই বৃহদশ্মীয় সংস্কৃতির নজীর ছড়িয়ে আছে এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে; সুদূর দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তটীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের সমগ্র ভূখণ্ড, এমনকি মধ্য ভারতের নাগপুর ও মহারাষ্ট্রের খান্দেশেও এই সংস্কৃতির পরিচয় দেখা যায়। সমাধিগুলিতে দেহাস্থির সঙ্গে বিবিধ জিনিসও প্রোথিত হত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জেল্লাদার কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র (বড় ও ছোট গর্তওয়ালা বাটী, পাত্রের ঢাকা, বড় জলের পাত্র প্রভৃতি), কার্নেলিয়ান জাতীয় পাথরের পুঁতি, সামান্য পরিমাণে হলেও সোনা ও প্রায় ব্যতিক্রমবিহীনভাবে লোহার উপকরণ! লোহার উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় চ্যাপ্টা কুড়ল, কোদাল, নিড়ানি, দা, বর্শা (৭’’ ইঞ্চি লম্বা), নানা আকারের ছুরি, বাটালি, পাত্র বসাবার জন্য তিনপায়া লোহার ‘স্ট্যান্ড’ ও বাতিদান (যা নিতান্তই ঘরোয়া প্রয়োজনে লাগত)। এছাড়াও তরোয়ালা এবং অন্যান্য অস্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। দুটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত মোটামুটি একই রকম লৌহ উপকরণ ছড়িয়ে আছে তামিলনাড়ুর আদিচান্নালুর থেকে মধ্যপ্রদেশের নাগপুর অবধি—দুই জায়গার মধ্যে দূরত্ব ১৪৫০ কি.মি.। এই ঘটনাটি দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে এক অনুরূপ বস্তুগত সাংস্কৃতিক জীবনের ইঙ্গিত দেয়। দ্বিতীয়ত, প্রচুর পরিমাণে লোহার প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল এবং লোহা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ও যুদ্ধের কারণে ব্যবহৃত হয়েছিল। দা, কুড়ুল, নিড়ানি থেকে প্রমাণ করা যায় যে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা সম্ভবত কৃষি উৎপাদনে সক্ষম ছিলেন ও লোহার উপকরণ কৃষিকাজে লাগাতেন (যদিও লোহার তৈরী লাঙ্গলের ফলা ব্যবহারের নজীর এখনও জানা নেই)
॥ ৭ ॥
উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বস্তুগত সংস্কৃতির পরিচয় ও তুলনামূলক আলোচনা থেকে আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় না যে উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক জীবন অনেক প্রাগ্রসর ও জটিলতর রূপ নিয়েছিল। বিশেষত কৃষি অর্থনীতির যে ব্যাপকতা ও নগরায়নের যে বিস্তার উত্তর ভারতে দেখা যায়, সমকালীন দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে তার সমতুল্য ঘটনা অনুপস্থিত। অথচ বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকের ভূখণ্ডে লোহার সম্যক ব্যবহার জানা ছিল। এর থেকেই পরবর্তী প্রশ্নটি ওঠে যে কেন ও কিভাবে উত্তর ভারতে এক জটিলতর ও উন্নততর অর্থনৈতিক অবস্থার উদ্ভব হল, এবং বিশেষত মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রায় হাজার বছরের ব্যবধানে নগরায়নের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাব্য ব্যাখ্যাই বা কি?
নগর যেহেতু প্রধানত শিল্প, বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্র হিসেবে তার ভূমিকা পালন করে, অতএব মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে কারিগরী শিল্প, ব্যবসা ও প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপের যথেষ্ট বৃদ্ধি না হলে নগরায়নের বিকাশ ঘটত কি না সন্দেহ। কিন্তু একথা কখনওই ভুললে চলবে না যে কৃষির ব্যাপক উন্নতি ব্যতিরেকে নগরের বাসিন্দা এবং তাদের উপজীবিকাগুলি টিকতে পারে না। ফলে নগর গড়ে ওঠার পিছনে সমসাময়িক কৃষি অর্থনীতির সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নগর গড়ে ওঠার জন্য গ্রামাঞ্চলের প্রয়োজন মিটিয়ে শহরাঞ্চলের খাদ্য সরবরাহ হবার মত উদ্বৃত্ত উৎপাদন করা যে অপরিহার্য, এ বিষয়ে বিশেষ মতদ্বৈধ নেই। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের উৎপাদন কিভাবে হতে পারে, সেই বিষয়ে গর্ডন চাইল্ড মূল্যবান মন্তব্য করেছিলেন। চাইল্ডের ধারণা অনুযায়ী কলাকৌশল বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাহায্যে কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব; উন্নততর উপকরণ প্রচুর পরিমাণ শস্য উৎপাদনে সহায়তা করে; উৎপন্ন শস্যের একটি বড় অংশ উদ্বৃত্ত হিসেবে নগরে প্রেরিত হয়, যে নগরাঞ্চলে সর্বসময়ের পেশাদারী কারিগর, বণিক ও প্রশাসকদের বাস। নগরবাসী যেহেতু সরাসরি খাদ্যোৎপাদক নয়, তাই নাগরিক জীবিকাগুলির অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে গ্রামের থেকে আসা উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের যথাযথ সরবরাহের উপর। এই উদ্বৃত্ত আহরণের ও নগরবাসীর মধ্যে তা বণ্টনের জন্য আবার দরকার পড়ে একটি শক্তিশালী ও সক্রিয় প্রশাসন যন্ত্রের, যে প্রশাসন যন্ত্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করা দুরূহ। চাইল্ড প্রাচীনতম নগরসভ্যাগুলির (মিশরীয়, মেসোপটেমীয় ও হরপ্পীয়) উদ্ভবের ক্ষেত্রে দশটি সূত্র প্রয়োগ করেছিলেন; কিন্তু তাঁর মতে নগরগড়ার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা প্রধান শর্ত উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার ও গ্রামাঞ্চলে উদ্বৃত্ত কৃষিজ উৎপাদনের সামর্থ্য।
মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকাতেও নগর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎাদন অপরিহার্য ছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকায় লাঙ্গলনির্ভর চাষবাসের উদ্ভব ও গোড়াপত্তন সম্বন্ধে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে স্পষ্ট তথ্য আছে। কোসাম্বী ও রামশরণ শর্মা-র মতে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় লোহার ক্রমবর্দ্ধমান ব্যবহার, বিশেষত লাঙ্গলের ফলায় লোহার ব্যবহার—কৃষিক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত উৎপাদনটি ঘটাতে মুখ্য ভূমিকা নেয়। তাঁদের মতে বিহারের আকরিক লোহার খনির উপর নিয়ন্ত্রণ আসায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় ধাতু ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে; কলাকৌশলগত বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিও ঘটে। এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে লাঙ্গলের ফলাটি লৌহনির্মিত হয়; আর লৌহনির্মিত ফলার সাহায্যে জমি চাষ করে যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সামর্থ্য জন্মায়। যেহেতু লোহার ফলা যুক্ত লাঙ্গলের ব্যবহার খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের আগে জানা ছিল না, তাই গাঙ্গেয় তথা মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের আগে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সামর্থ্যও ছিল না। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকা উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের জন্য এক আদর্শ এলাকা হিসেবে দেখা দিল। কোসাম্বী ও রামশরণ শর্মা নগরের উদ্ভবের পিছনে ব্যবসা, কারিগরী শিল্পের বিকাশ ও রাজতন্ত্রের ক্ষমতাবৃদ্ধির ভূমিকাকে খাটো করে দেখেননি। তবে তাঁদের মতে নগরায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধান কারণ ছিল লৌহ উপকরণের (বিশেষত লোহার ফলাওয়ালা লাঙ্গল) ক্রমবর্দ্ধমান ব্যবহার দ্বারা যথেষ্ট উদ্বৃত্ত উৎপাদন করার ক্ষমতা।
গর্ডন চাইল্ডকে অনুসরণ করে কোসাম্বী ও শর্মা নগরায়নের যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, তাতে সারবত্তা যথেষ্ট আছে। কিন্তু অমলানন্দ ঘোষ এই ব্যাখ্যাকে সন্তোষজনক বলে মনে করেন না। তিনিও কোসাম্বী এবং শর্মার মতই গ্রামাঞ্চলে উদ্বৃত্ত ফসল ফলানোর সামর্থ্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ঐ উদ্বৃত্ত কিভাবে পাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোসাম্বী ও শর্মার গভীর মতপার্থক্য আছে। পুরাতাত্ত্বিক অমলানন্দ ঘোষের মতে লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গলের চাক্ষুষ প্রমাণ মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীতে মুষ্টিমেয়; এত সামান্য পরিমাণ নজীরের ওপর ভিত্তি করে লোহার ফলাওয়ালা লাঙ্গলের নিয়মিত উপযোগ ও তার দরুন উদ্বৃত্ত পরিমাণ ফসল ফলাবার সামর্থ্যের তত্ত্বকে দাঁড় করানো যায় না। অমলানন্দ ঘোষ মনে করেন যে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এত পর্যাপ্ত নয় যা দিয়ে খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে কৃষিকাজে লোহার ফলাওয়ালা লাঙ্গলের ব্যাপক ব্যবহার প্রমাণ করা যাবে। তাঁর ধারণায় মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যার ঘন অরণ্য ধ্বংস করতে হলে তামার হাতিয়ার (যেমন কুড়ল, কুঠার ইত্যাদি) ও বন পুড়িয়ে সাফ করার সাবেক পদ্ধতিই যথেষ্ট ছিল, এই কাজে লোহা অপরিহার্য ছিল না। তামার ফলাযুক্ত লাঙ্গল দিয়েই যে এই এলাকায় উদ্বৃত্ত ফসল ফলানো সম্ভব ছিল, এ বিষয়ে তাঁর সংশয় নেই। অমলানন্দ ঘোষ মনে করেন উদ্বৃত্ত উৎপাদন করার জন্য কারিগরী কুশলতা প্রাথমিক শর্ত নয়; তিনি অনেক বেশী জোর দিয়েছেন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও সংগঠনের ওপর। এই রাজনৈতিক কর্তৃত্বই কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত ফসলের ওপর দাবী জানাবার অধিকারী এবং দাবীমত উদ্বৃত্ত ফসল আদায়ের ক্ষমতাও তারই থাকে। উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও তা সংগ্রহণের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক মাত্রাটিই অমলানন্দ ঘোষের কাছে অধিকতর জরুরী শর্ত; কারণ তিনি মনে করেন যে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের মত জটিল এক সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নতির মাধ্যমে ব্যাখ্য করতে গেলে তা ভুল হবে। অর্থাৎ তাঁর বিচারে রাষ্ট্র সংগঠন ও কেন্দ্রাভিগ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ব্যতীত কৃষিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হওয়া অসম্ভব।
মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে রাজনৈতিক পালাবদলের গুরুত্বপূর্ণ নজীর দেখা যায়। মহাজনপদগুলির উদ্ভব রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিস্তারে সাহায্য করেছিল। তার পাশাপাশি কৌম গোষ্ঠীশাসিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলির গুরুত্ব ও ক্ষমতা ক্রমশ কমছিল। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপ্রতিহত অগ্রগতির উদাহরণ বিশেষত দেখা যায় মগধ মহাজনপদের উত্থানের ভিতর দিয়ে। সমকালীন উত্তর ভারতের মহাজনপদগুলির ভিতর আধিপত্যের লড়াই ও তাতে শেষ পর্যন্ত মগধের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করত স্থায়ী সামরিক বাহিনী ব্যবহার করার উপর। স্থায়ী সামরিক বাহিনীর অস্তিত্ব আবার রাজশক্তিকে উত্তরোত্তর ক্ষমতাশালী করে তুলছিল। রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ও স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর তরফ থেকে রাজস্ব দাবী করা যুক্তিগত কারণেই এক স্বাভাবিক ঘটনা। এই রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমেই গ্রামাঞ্চলে উদ্বৃত্ত শস্য ফলাবার তাগিদ দেখা দেয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত উৎপাদন রাজস্ব রূপে আহৃত হতে থাকে। নগরায়নের ভিত্তি প্রস্তুত করার জন্য উদ্বৃত্ত পাওয়া ক্রমে সুলভ হতে থাকে ও নগরের বিকাশ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। পালি সাহিত্যে জমি পরিমাপকারী রাজপুরুষের (‘রজ্জুগ্গাহক অমচ্চ’=‘রজ্জুগ্রাহক অমাত্য’) নিয়মিত দেখা পাওয়া যায়। এই জাতীয় রাজপুরুষ কৃষি উদ্বৃত্ত আদায় করার কাজে বোধহয় যুক্ত থাকতেন। ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে কাশী ছিল প্রথমে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কাশীর রাজা ছিলেন সর্বাধিক ক্ষমতাবান (‘সব্বরাজুনাম্ অগ্গরাজ’)। তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি তাঁর বিপুল বৈভব, বিশাল সৈন্যবাহিনী ও পরিপূর্ণ কোশ-কোষ্ঠাগারের কথাও জানা যায়। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাজ্য কোশল গোড়ায় ছিল দরিদ্র (‘দলিদ্দো’), অল্পধনবান (‘অপ্পোধন’), অল্প সামরিক শক্তিসম্পন্ন (অপ্পবল) ও তার কোশ ও কোষ্ঠাগার ছিল অপরিপূর্ণ (‘অপলিপুণ্ন কোস কোট্ঠাগার’)। দুই রাজ্যের তুলনামূলক বর্ণনায় যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হল কোন শক্তি কতটা পরিমাণে রাজস্বের মারফৎ কোশ ও কোষ্ঠাগার সমৃদ্ধ করতে সক্ষম তারই সঙ্গে তার রাজনৈতিক ক্ষমতারও তারতম্য ঘটত। কালক্রমে কোশল যখন কাশীকে পর্যুদস্ত করে, তখন কোশলকে বর্ণনা করা হয়েছে সম্পদ ও শক্তিতে সমৃদ্ধ (‘ধনতিবিয়েন সম্পন্ন’) এলাকা হিসেবে। মগধের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রথম পর্যায়ে বিম্বিসারের আমলে বহু সংখ্যক প্রশাসনিক কর্মচারী নিযুক্ত হন। যথেষ্ট উদ্বৃত্ত ব্যতিরেকে এই কর্মচারীদের ভরণপোষণ অসম্ভব ছিল। খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতকের মধ্যভাগে মগধ যখন উত্তর ভারতে তার সার্বিক প্রাধান্য বিস্তার করেছে, তখন নন্দবংশীয় রাজারা তাঁদের বিপুল ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিস্তর উদ্বৃত্ত সম্পদ রাজকোশে সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। নন্দরাজা মহাপদ্মনন্দ ও ধননন্দের বিপুল বিত্ত ও বিত্তবাসনা কিম্বদন্তীর রূপ নিয়েছে। বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস নাটকে (খ্রীঃ পূঃ ৭ম শতক) এই স্মৃতি অমলিন ছিল: নন্দরাজারা ‘অর্থরুচি’ ও ‘নবনবতিশতদ্রব্যকোটীশ্বর’ অভিধায় আখ্যাত। রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে, হয়তো প্রজাপীড়ন করেও (এর কিছু ইঙ্গিত গ্রীক বিবরণীতে পাওয়া যায়) তাঁরা কঠোর রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন ও বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত সম্পদ সংগ্রহ করেন।
উপরের নিদর্শনগুলি উপস্থাপন করার মূল লক্ষ্য এই যে রাষ্ট্রক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত সম্পদ আহরণের ক্ষমতা—এই দুই এর ভিতর নিশ্চিত যোগসূত্র বিরাজ করে। উদ্বৃত্ত আহরণ করার মত প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অবস্থা ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কাঠামোর অস্তিত্ব খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে কেবলমাত্র গাঙ্গেয় তথা মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকাতেই ছিল। তাই এই অঞ্চলে দ্বিতীয় দফার নগরায়নের গোড়াপত্তন ঘটে। অপরপক্ষে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উত্তরের মতই লোহার ব্যবহার জানা ছিল—অর্থাৎ প্রযুক্তিগত দক্ষতা দক্ষিণ ভারতে বিরল ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও লৌহ উপকরণের সাহায্যে ঐ অঞ্চলে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদন ঘটে নি, তার ফলে বিন্ধ্যের দক্ষিণে নগরায়ন অনুপস্থিত। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে ও দক্ষিণ ভারতে সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব নজরে পড়ে না; কৌমগোষ্ঠীর শাসনব্যবস্থাই বোধহয় ঐ এলাকায় প্রচলিত ছিল। কৌমগোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থায় সমানাধিকারের ধারণা অধিকতর জোরালো থাকে; ফলে সে ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ও আহরণের তাগিদ বিশেষ থাকে না। ফলে নগরায়নের মত জটিলতর এক আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রকাশিত হবার পক্ষে উপযুক্ত সুযোগ ও ক্ষেত্র বিন্ধ্য পর্বতমালার দক্ষিণে ছিল না।
মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় তথা উত্তর ভারতের বৃহদংশে কৃষিকর্মে অভিনব রীতিপদ্ধতির প্রয়োগ, কারিগরী শিল্পের অগ্রগতি, বাণিজ্যের বিকাশ ও নগরায়নের উদ্ভবের ফলে যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ থেকে খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতাব্দী অবধি বিরাজ করছিল, তার তুলনায় লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিকর্ম ও পশুপালনের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই সরল। আচার অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ, পশুবলির উপর গড়ে ওঠা ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক জীবন অনেকাংশেই এই সরলতর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিকশিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে প্রাক্তন সামাজিক অবস্থায় আচার অনুষ্ঠানের যে প্রাধান্য ও পুরোহিতদের যে গোঁড়ামি ও দাপট বজায় রাখা সম্ভব ছিল, খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে তার ভিত্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে বেদবিহিত সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রতি ও বিশেষত ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রশ্নশীলতা জাগা স্বাভাবিক ছিল। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনগুলির সাফল্যের পিছনে সমকালীন বস্তুগত সংস্কৃতির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জরুরী। বিশেষত বুদ্ধ (ও তাঁর ধর্মমত) নূতন পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন ছিলেন। ব্রাহ্মণের আধিপত্যের বিরোধীতাই শুধু নয়, বুদ্ধ সমাজের মূল ধনোৎপাদক গোষ্ঠীর গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে যুক্ত ধনোৎপাদক সম্প্রদায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের আগে সামাজিক মর্যাদা বিশেষ পায়নি। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কায়িক শ্রমে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকট। বুদ্ধ ব্রাহ্মণের সামাজিক প্রতিপত্তি সম্বন্ধে প্রশ্ন তো তুলেইছিলেন; তদুপরি সামাজিক ধন উৎপাদনে যাঁদের ভূমিকা অগ্রগণ্য সেই বৈশ্য ও শূদ্রের প্রতি অনেক বেশী সহানুভূতিশীল ছিলেন। বিশেষত বণিক সমাজের সঙ্গে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের ওতপ্রোত যোগ আমাদের নজর এড়ায় না। বুদ্ধ যে তাঁর ক্রিয়াকলাপ বহুক্ষেত্রেই নগরে বজায় রাখতেন, তা-ও নিতান্ত কাকতালীয় নয়। নগরাশ্রয়ী সমাজ ও অর্থনীতিতে নতুনত্বের সম্ভাবনা ছিল; ঐতিহ্য বিরোধী বৌদ্ধ ধর্মের পক্ষে নগরের সাংস্কৃতিক ও আর্থিক পরিমণ্ডলেই তাই বিকশিত হওয়া স্বাভাবিক। গবাদি পশু ও দাসদাসী দিয়ে দক্ষিণা প্রদানের যে ব্যবস্থা বৈদিক যাগযজ্ঞের অপরিহার্য অঙ্গ, তার চেয়ে দানই বৌদ্ধধর্মে শ্রেয়তর বলে বিবেচিত। এই ‘দান’ সাধারণত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি দানের দ্বারা চিহ্নিত। এই ‘দান’ ব্যবস্থা সমাজে উদ্বৃত্ত উৎপাদন, বিনিময় ব্যবস্থার অগ্রগতি ও নগরপ্রধান সমাজ ব্যবস্থায় বিকশিত হয়ে থাকে।
খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতক অবধি যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন দেখা দেয়, তার দ্বারা সমকালীন সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি যথেষ্ট পরিমাণে আলোড়িত হয়। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রাগ্রসর অবস্থা, নগরের উদ্ভব, রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জয়যাত্রা, প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাফল্য—এই ঘটনাগুলি শুধু আলোচ্য যুগটির স্বতন্ত্র পরিচয়কে মূৰ্ত্ত করে তোলে না, ঐ ঘটনাগুলি যে পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, তা-ও নির্দ্ধধায় প্রমাণ করে।