চতুর্থ অধ্যায় – প্রথম মারওয়ান ও আবদুল মালিক [৬৮৪-৭০৫ খ্রি.]
প্রথম মারওয়ান (৬৮৪–৬৮৫ খ্রি.)
প্রথম জীবন : উমাইয়া রাজবংশের মারওয়ানী শাখার প্রতিষ্ঠাতা মারওয়ান ইবন- হাকাম হযরত ওসমান (রা) ও প্রথম মুয়াবিয়ার চাচাত ভাই ছিলেন। তিনি হযরত ওসমানের উপদেষ্টা এবং মুয়াবিয়ার আমলে হেজাজের শাসনকর্তা ছিলেন। মিসরীয় বাহিনীকে প্রদত্ত খলিফার চিঠি জাল করে তিনি হযরত ওসমানের খিলাফতে অরাজকতা সৃষ্টি করেন। তাঁর পরামর্শে মুয়াবিয়া ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এর ফলে প্রজাতন্ত্রের অবসান হয়। মদিনা আক্রমণের কুপরামর্শও তিনি ইয়াজিদকে প্রদান করেন।
খিলাফত লাভ : নিঃসন্তান দ্বিতীয় মুয়াবিয়ার খালিদ নামে এক কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিল। পরিবারবর্গ খালিদকে সমর্থন করলেও এই সময় একজন বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রতিভাবান ও কৌশলী লোকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সকলে ৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে মারওয়ানকে খলিফা মনোনীত করেন। অবশ্য শর্ত থাকে যে, খালিদ বড় হলে মারওয়ান তাঁর অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করবেন। মারওয়ান খালিদের বিধবা মাতাকে বিবাহ করেন। এই সময়ে আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর নিজেকে হেজাজের খলিফা বলে ঘোষণা করেন। কুফা, বসরা, মিসর ও পারস্যের কিয়দংশও তাঁর কর্তৃত্বাধীনে আসে। শঠতা, চক্রান্তমূলক অভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের কৌশলে স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে মারওয়ান আবদুল্লাহর সেনাপতি জাহাক-ইবন-কাসেম আল-ফিহরীকে ৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে মারজরাহিতের যুদ্ধে (Battle of Marj Rahit) পরাজিত ও নিহত করেন। এর ফলে সিরিয়া ও মিসরে উমাইয়া প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কারবালার প্রান্তর ত্যাগকারী একদল কুফার অনুশোচনাকারী (Penitents) কৃতকর্মের অনুশোচনার জন্য উমাইয়া বিরোধী তৎপরতা ও নিধনযজ্ঞের সূচনা করে। প্রথমে সুলায়মান ও পরে মুখতারের নেতৃত্বে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মারওয়ান তাদের দমনের জন্য একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন।
মারওয়ান স্বীয় বংশের স্থায়িত্বের জন্য পুত্রদ্বয় আবদুল মালিক এবং আবদুল আজীজকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। দ্বিতীয় মুয়াবিয়ার ভ্রাতা খালিদকে সিংহাসন হতে বঞ্চিত করায় তাঁর মাতা ও মারওয়ানের স্ত্রী ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাসরোধ করে মারওয়ানকে হত্যা করেন। আমীর আলী বলেন, “বাধ্যক্য তাঁর ষড়যন্ত্রের প্রতিভাকে কিছুমাত্র ম্লান করতে পারে নি।”
আবদুল মালিক (৬৮৫-৭০৫ খ্রি.)
সিংহাসনারোহণ
প্রথম মারওয়ানের মৃত্যুর পর তদীয় জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুল মালিক ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা হলেন। সিংহাসনে আরোহণ করেই তাঁকে সঙ্কটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বিশ বছরের রাজত্বকালে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান তিনটি দিকে পরিলক্ষিত হয়; প্রথমত, বিদ্রোহ দমন দ্বারা রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; দ্বিতীয়ত, হৃতরাজ্য পুনর্দখলের জন্য সামরিক অভিযান এবং তৃতীয়ত, শাসন-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন দ্বারা উমাইয়া প্রভুত্বকে দুঢ়ীকরণ।
খিলাফত লাভ করেই আবদুল মালিককে একটি চরম বিপজ্জনক এবং সঙ্কটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী খালিদ-ইবন-ইয়াজিদ ও আমর-বিন-সাঈদ ব্যতীত শত্রু, বিদ্রোহী, উচ্চাভিলাসী ব্যক্তিদের দ্বন্দ্ব, কোন্দল, অসন্তোষ, অরাজকতা আবদুল মালিকের বিশ বছরের রাজত্বকালকে বিপদসঙ্কুল করে। প্রতিদ্বন্দ্বী খলিফা আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর হেজাজ ও ইরাকে স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে, উক্ত প্রদেশ দুটি উমাইয়াদের হস্তচ্যুত হয়। আবদুল্লাহর অধীনস্থ খোরাসানের গভর্নর ইবন- খাজিম উত্তর আরবদের পক্ষে যুদ্ধ করে প্রায় ৮০০০ শত্রুকে নিহত করেন। মদিনা, ইরাক ও পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চলে খারিজিগণ ও আলীর সমর্থকগণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে। কুফায় মুখতার কারবালার নৃশংসতার প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য “অনুশোচনাকারী” (Penitents) দল গঠন করে বিদ্রোহ শুরু করে। ইরাকে মুসাব ও ইব্রাহিম ইবন-আল- আসতার উমাইয়া খিলাফতের বিরোধিতা করতে থাকেন। এমনকি সিরিয়াবাসীদের মধ্যে ও বিদ্রোহীভাবাপন্ন লোকের অভাব ছিল না। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার সুযোগে ইসলামের চিরশত্রু বায়জানটাইন সম্রাট উত্তর আফ্রিকায় উস্কানিমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন। সিংহাসনে আরোহণ করে এরূপ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও আবদুল মালিক বিচলিত হলেন না। বরং শত্রুকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, সংহতি, ঐক্য, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় তিনি অসাধারণ কর্মদক্ষতা এবং সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দেন।
সাংগঠনিক কার্যক্রম
মুখতারের বিদ্রোহ দমন : সফীক গোত্রের আবু উবাইদার পুত্র মুখতার শিয়া মতাবলম্বী একজন প্রখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন। ধূর্ত, সুযোগ-সন্ধানী ও অস্থিরমতি মুখতার ইমাম হাসান (রা)-এর একজন বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন এবং তাঁর সাথে কুফা থেকে মাদাইনে গমন করেন। পরবর্তীকালে তিনি কুফায় প্রেরিত ইমাম হুসাইন (রা)-এর দূত মুসলিমের বিরোধিতা করেন এবং শাসনকর্তা ওবায়দুল্লাহ কর্তৃক ধৃত হয়ে একটি চক্ষু হারান। অতপর মুখতার হেজাজে পলায়ন করে ওবায়দুল্লাহর দেহকে টুকরা টুকরা করবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। মক্কায় তিনি আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইরের সঙ্গে হৃদ্যতা স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং ইয়াজিদের মক্কা অবরোধ প্রতিহত করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু অস্থিরমতিত্ব ও ধূর্ততার জন্য আবদুল্লাহ তার উপর আস্থা রাখতে পারেন নি। অবশেষে ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভগ্নহৃদয়ে কুফায় গমন করে ইমাম হুসাইনের কারবালার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অনুশোচনাকারী দলে যোগদান করেন।
কুফাবাসীদের দ্বারা অনুশোচনাকারী দল গঠিত হয়। এরাই কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইনকে বিপদের সম্মুখে ফেলে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে রণক্ষেত্র ত্যাগ করে। ক্রমে ক্রমে অসংখ্য অনুশোচনাকারী মুখতারের দলভুক্ত হয়। দুরভিসন্ধিমূলক আচরণে সন্ধিগ্ধ হয়ে আবদুল্লাহ কুফার শাসনকর্তাকে তায়েফে কারারুদ্ধ করেন। কিছুদিন পর কারাগার হতে মুক্তি লাভ করে তিনি অনুশোচনাকারীদের সাহায্যে কুফা হতে আবদুল্লাহর শাসনকর্তাকে বিতাড়িত করে স্বীয় প্রভুত্ব কায়েম করেন। তিনি নিজেকে মুহাম্মদ-আল-হানাফিয়া- ইবন-আলীর প্রতিনিধি দাবি করে একটি শক্তিশালী বিদ্রোহী দল গঠন করেন। তিনি কৌশলে ইব্রাহিম-ইবন আল-আসতারের সাহচর্য লাভ করতে সক্ষম হন। ক্রমে ইরাক, পারস্য ও আরবের কিয়দংশে তাঁর প্রভুত্ব বিস্তার লাভ করে।
মুখতার স্বীয় ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করে আল-আসতারের নেতৃত্বে কারবালার হত্যাকাণ্ডের অধিনায়ক ওবায়দুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ সৈন্যদল গঠন করেন। নগর ত্যাগ করবার পূর্বেই কপট ও বিশ্বাসঘাতক কুফাবাসী মুখতারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তৎক্ষণাৎ তিনি আত্মরক্ষার জন্য আল-আসতারকে ডেকে পাঠান। ফলে, কুফার রাস্তায় গোত্রে গোত্রে বহু খণ্ড যুদ্ধ বেধে যায়। একদিকে ইমাম হুসাইন হত্যার প্রতিশোধ ধ্বনি অন্যদিকে ওসমান হত্যার প্রতিশোধ ধ্বনিতে কুফার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। এই সংঘর্ষে মুখতার জয়লাভ করেন এবং ৮০০ লোক প্ৰাণ হারায়। নিহতদের মধ্যে ছিল সীমার, উমর ও ঘাতকদলের অপর ২৮৪ জন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আবদুল মালিক ওবায়দুল্লাহ-বিন-জিয়াদকে মুখতারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে মুখতারের প্রধান সেনাপতি আল-আসতারের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী ওবায়দুল্লাহর উমাইয়া বাহিনীর মোকাবিলা করেন। টাইগ্রীসের শাখা নদী জাবের তীরে উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় এবং জাবের যুদ্ধে (Baltle of the Zab) বহু সিরীয় সৈন্য নিহত হয়। কারবালার কসাই (The butcher) ওবায়দুল্লাহ মুখতারের সেনাপতি আল-আসতারের হস্তে নিহত হন। ইমাম হুসাইনের ছিন্ন মস্তক যেভাবে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট প্রেরিত হয়েছিল, অনুরূপভাবে তার খণ্ডিত মস্তক কুফায় মুখতারের নিকট প্রেরিত হয়। এভাবে মুখতার কারবালার হত্যাকাণ্ডের অধিনায়ককে হত্যা করে ইমাম হুসাইনকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।
উমাইয়া সৈন্যবাহিনীকে জাবের যুদ্ধে পরাস্ত করে মুখতার ইরাকে তাঁর প্রভাব- প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। ওবায়দুল্লাহর হত্যার পর তিনি আবদুল্লাহর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে আগ্রহী হন; কিন্তু তাঁর কপটতা ও ধূর্ততায় আস্থাহীন হয়ে আবদুল্লাহ তাঁর ভ্রাতা বসরার শাসনকর্তা মুসাবকে মুখতারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মেসোপটেমিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিপতির ক্রমবর্ধমান ক্ষমতায় বিচলিত হয়ে ৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে মুসাব তাঁর সুদক্ষ যোদ্ধা মুহাল্লাবকে সঙ্গে নিয়ে মুখতারের বিরুদ্ধে কুফার উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা করেন। পথিমধ্যে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ বাধলে মুখতার পরাজিত হন এবং ৮০০০ সৈন্যসহ একটি দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অবরুদ্ধ অবস্থায় পানি ও খাদ্যের অভাবে অতিষ্ট হয়ে উঠলে মুখতার পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং অসংখ্য অনুচরসহ রণক্ষেত্রে নিহত হলে উমাইয়া খিলাফতের প্রথম ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ ধুলিসাৎ হয়।
আমরের বিদ্রোহ দমন : দ্বিতীয় মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর মারওয়ান যখন খিলাফত লাভ করেন তখন তাঁর চাচাত ভাই আমর ইবন-সাঈদ খলিফা হবার বাসনা করেন। মারওয়ানের মৃত্যুর পর তার ধারণা ছিল যে, খালিদ বিন-ইয়াজিদ অথবা তিনি খিলাফত লাভ করবেন। কিন্তু আবদুল মালিকের মনোনয়নে তিনি দামেস্কের শাসনকর্তার পদে সন্তুষ্ট না থেকে ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। কয়েকটি সংঘর্ষে আবদুল মালিক আমরকে পরাজিত করে ক্ষমা প্রদর্শন করেন। কিন্তু ভবিষ্যতে শান্তি ভঙ্গের আশংকায় এবং তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিষ্কণ্টক করবার জন্য তিনি আমরকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজদরবারে আমন্ত্রণ করেন এবং তাকে সেখানে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
মুসাবের বিদ্রোহ দমন : সিরিয়ার বিদ্রোহ দমন করে আবদুল মালিক ইরাকের শত্রুভাবাপন্ন শাসনকর্তা মুসাবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। আবদুল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মুসাব মুখতারকে পরাজিত ও নিহত করে ক্ষমতাশালী হলে ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মালিক তাঁর বিরুদ্ধে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। প্রলোভন, ক্ষমা প্রদর্শন, পুরস্কার প্রভৃতিতে আকৃষ্ট করে আবদুল মালিক নীতিজ্ঞানশূন্য কুফাবাসীদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। খলিফার স্বয়ং যুদ্ধাভিযানে ভীত ও শঙ্কিত হয়ে মুসাব তার সেনাপতি মুহাল্লাবের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু প্রচণ্ড যুদ্ধে মুসাবের পুত্র ইয়াহিয়া এবং সহকারী ইব্রাহিম ইবন-আল-আসতার পরাজিত ও নিহত হন। মুসাবের ছিন্ন মস্তক দামেস্কে প্রেরণ করা হয়। মুসাবের মৃত্যুর পর ইরাকে উমাইয়া আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ইমাম হুসাইনের কন্যা সখিনাকে বিবাহ করেন এবং সখিনা শৌর্য-বীর্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
আবদুল্লাহ-ইবন-যুবাইরের সঙ্গে সংঘর্ষ : মুখতার ও মুসাবের হত্যার পর উমাইয়া বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিরোধী দলের অধিপতি ও প্রতিদ্বন্দ্বী খলিফা আবদুল্লাহ-ইবন- যুবাইরের বিরুদ্ধে আবদুল মালিক সৈন্য প্রেরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। হেজাজে আবদুল্লাহ নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে আরবের একটি বিরাট অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। কা’বাগৃহ পুনঃনির্মাণ করে মক্কা ও মদিনার রক্ষক হিসেবে তিনি স্বীয় ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। খলিফা আবদুল মালিক হেজাজকে উমাইয়া শাসনের অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের নেতৃত্বে একটি বিশাল সৈন্যদল আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। হাজ্জাজ ৬৯২ খ্রিস্টাব্দে কুফা হতে তায়েফে উপস্থিত হন। আবদুল্লাহ বশ্যতা স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করবার অভিপ্রায় সম্বলিত খলিফা আবদুল মালিকের লিখিত একটি চিঠি হাজ্জাজ আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইরের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করলে হাজ্জাজ মক্কা অবরোধ করেন। দীর্ঘ সাত মাস অবরোধ চলতে থাকায় মক্কাবাসিগণ নিদারুণ খাদ্য-সংকটের সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় আবদুল্লাহর অনুচরগণ দলত্যাগ করতে থাকে। অসহায় ও দ্বিধাগ্রস্ত আবদুল্লাহর মাতা আসমা-বিন-আবুবকর তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে বীরত্বের পরাকাষ্ঠা দেখান। ৬৯২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে দীর্ঘ অবরোধের পর বাধ্য হয়ে আবদুল্লাহ আরাফাতের যুদ্ধে (Battle of Arafat) হাজ্জাজের সৈন্যবাহিনীর মোকাবিলা করেন। যুদ্ধে তিনি নিহত হলে তাঁর শিরশ্ছেদ করে প্রথমে মদিনা ও পরে দামেস্কে প্রেরিত হয়। নিষ্ঠুর ও বর্বর হাজ্জাজ আবদুল্লাহর দেহকে লাঞ্ছিত করে শূলবিদ্ধ অবস্থায় তাঁর মাতার নিকট প্রেরণ করে একটি পৈশাচিক দৃশ্যের অবতারণা করেন।
নয় বছর খলিফা উপাধি ধারণ করে আবদুল্লাহ ইসলামের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ৭২ বছর বয়সে আত্মাহুতি দেন। হিট্টি যথার্থই বলেন, “ইবনে-যুবাইরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সর্বশেষ যোগসূত্র ছিন্ন হল। মুসলিম কর্তৃক না হলেও হাজ্জাজ কর্তৃক ওসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা হল।” সুন্নী সম্প্রদায় তাঁকে ন্যায়সঙ্গত খলিফা বলে স্বীকার করতেন এবং মক্কা ও মদিনার মসজিদের মিম্বর হতে তাঁর নামে খোৎবা পঠিত হত। কর্তব্যনিষ্ঠ, উচ্চাভিলাসী এবং ধর্মভীরু হলেও আবদুল্লাহ কৃপণ এবং অনুদার ছিলেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে তাঁর পতন ত্বরান্বিত হয়। তাঁর মক্কা ও মদিনার লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। কারণ, শক্তিশালী উমাইয়া বংশ দামেস্কে প্রভুত্ব করতে থাকে এবং সর্বপ্রকার বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ দমনে নৃশংসতার পরিচয় প্রদান করে। ওয়েলহাউসেন বলেন, ওসমানের মৃত্যুর পর হতে হেজাজ (মক্কা ও মদিনা) প্রাণহীন প্রদেশে পরিণত হয় এবং এটিকে পুনরায় রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত করা সম্ভবপর হয় নি। কূটনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য আবদুল্লাহ হাজ্জাজের নিকট পরাস্ত ও নিহত হন। ইমাম হুসাইনের সাথে তার মতবিরোধ, কারবালার যুদ্ধের পর উমাইয়া খিলাফতের সার্বভৌমত্বে আঘাত স্বরূপ একটি প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত প্রতিষ্ঠা, ইয়াজিদ কর্তৃক মক্কার অবরোধে তাঁর নিষ্ক্রিয়তা, দ্বিতীয় মুয়াবিয়ার সময় মিসর ও সিরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, মারওয়ান ও উমাইয়াদের অপর সদস্যবৃন্দকে মদিনা হতে বহিষ্কার, মুখতারের সাথে সম্ভাব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, স্বীয় ভ্রাতা মুসাব খলিফা আবদুল মালিক কর্তৃক আক্রান্ত হলে সাহায্যদানে অনীহা প্রভৃতি কারণেই তাঁর পতন হয়। আবদুল্লাহ ইবন- যুবাইরের মৃত্যুতে আবদুল মালিক মুসলিম সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে স্বীকৃত হন। আবদুল্লাহর বিশ্বস্ত গভর্নর ইবন-খাজিম খোরাসানে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন; কিন্তু আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর আবদুল মালিক সৈন্য প্রেরণ করে ত৭াকে পরাস্ত করেন এবং খোরাসানকে উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন।
গোত্রকলহ : আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর মুসলিম সাম্রাজ্যে উমাইয়া আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের সমস্ত মসজিদে তাঁর নামে খোৎবা পাঠ হতে থাকে। তাঁর খিলাফতে আরব প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কায়েস এবং কালব গোত্রের সংঘর্ষ বন্ধ হয় নি এবং এর ফলে বানু তাঘলীব, সুলাইম ও ফেজারা প্রভৃতি খ্রিস্টান গোত্রের মধ্যেও কলহ দেখা দেয়। এই গোত্রকলহ ভয়াবহ আকারে প্রকাশ পায় মেসোপটেমিয়াতে। বসরার রাবিয়া, আজদ, তামীম, কায়েস প্রভৃতি গোত্রের মধ্যে বিদ্যমান কলহ ক্ৰমে খোরাসানে বিস্তৃতি লাভ করে। খলিফা আবদুল মালিক কঠোর হস্তে গোত্রীয় কলহ ও বিদ্বেষ দমন করেন এবং রাজ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানে সমর্থন হন।
খারিজি বিদ্রোহ : আবদুল মালিকের সঙ্গে আবদুল্লাহর সংঘর্ষ শুরু হবার সুযোগে ইরাক ও দক্ষিণ পারস্যে খারিজিগণ কারবালার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মুখতারের মৃত্যুতে খলিফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন; কিন্তু ইস্পাহান, কিরমান প্রভৃতি অঞ্চল খারিজিগণ অবরোধ করে এবং উমাইয়াদের অত্যাচার ও হাজ্জাজের নৃশংসতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কুফার অনুশোচনাকারিগণ তাদের দলে যোগদান করলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। বহুবার খলিফার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করলেও খারিজিগণ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যর জন্য সংঘবদ্ধভাবে অভিযান করতে সক্ষম হয় নি।
আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইরের পতনের পর মুসাবের সেনাপতি মুহাল্লাব খলিফার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। খলিফা মুহাল্লাবকে ক্ষমা করেন এবং তাঁকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। সাহাসী এবং রণোন্মত্ত খারিজিদের দমন করবার জন্য আবদুল মালিক মুহাল্লাবকে প্রেরণ করেন। খারিজিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে মুহাল্লাব বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন এবং শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করে ছত্রভঙ্গ করে দেন। ৬৯৫-৯৭ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় খারিজিগণ নাফি-বিন-আফতাবের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ কঠোর হস্তে তা দমন করেন। আফতাবসহ বহু খারিজি হাজ্জাজের হস্তে প্ৰাণ হারায় এবং অনেকেই আল-আহসার মরুভূমিতে গিয়ে আত্মগোপন করে।
ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ
হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ উমাইয়া খিলাফতে একজন প্রভাবশালী শাসক ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি তায়েফের অধিবাসী ছিলেন এবং প্রথম জীবনে মক্কায় শিক্ষকতা করতেন। স্বীয় যোগ্যতা এবং প্রতিভা বলে তিনি শাসনকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হন।
হাজ্জাজ- -বিন-ইউসুফ যখন পূর্বদেশীয় অঞ্চলের শাসনকর্তা তখন তিনি টাইগ্রীস নদীর পশ্চিম তীরে ওয়াসিত নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও প্রেরণায় ইয়াজিদ-বিন-মোহাম্মদ, কুতাইবা-বিন-মুসলিম মধ্য-এশিয়া এবং মুহাম্মদ- বিন-কাসিম ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে উমাইয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।
ইসলামে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের অবদান ছিল অসামান্য। তিনি রাজস্ব ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তাঁর পরামর্শে আবদুল মালিক নব-দীক্ষিত মুসলমানদের খারাজ ও জিজিয়া কর প্রদানে বাদ্য করেন। এর কারণ অসংখ্য অমুসলমান ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করলে রাজ্যের আয় বহুলাংশে কমে যায়। কৃষিকার্যের যাতে ব্যাঘাত না হয় সেই কারণে তিনি কৃষকদের গরু ও মহিষ জবেহ করতে নিষেধ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বহু খাল খনন করা হয় এবং সেচ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি হয়। কৃষি ঋণের ব্যবস্থাও প্রচলিত হয়।
প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হাজ্জাজের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ওয়েলহাউসেন বলেন, “মুদ্রা, ওজন, কর এবং কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত সরকারি নিয়মাবলি যুগান্তকারী বলে পরিগণিত হয়। তিনি সংস্কৃতিবান ছিলেন এবং স্থাপত্য, শিল্পকলা, লিপি ও আরবি হরফের সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ওয়াসিতে একটি দুর্গপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। সর্বপ্রথম তিনি আরবি অক্ষরে জের, জবর, পেশ-এর প্রচলন করেন এবং নোকতা আবিষ্কার করেন। যার ফলে অক্ষরের অর্থ স্পষ্ট হয়।
হাজ্জাজকে ‘আরবদের নিরো’ (Nero of the Arabs) বলা হয়। তাঁর নৃশংসতা ও বর্বরতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি অত্যাচারী ছিলেন। এমনকি মদিনাবাসী ও সাহাবীদের প্রতি তিনি কঠোর ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি দেড় লক্ষ লোক হত্যা করেন। এই পাশবিক অত্যাচারের মূলে ছিল উমাইয়া রাজত্বে বিদ্রোহ দমন করে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এতদসত্ত্বেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উমাইয়া খিলাফতের স্থায়িত্ব ও সংহতি রক্ষায় তাঁর দান ছিল অসামান্য
খলিফা আবদুল মালিকের শাসনামলে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ একটি প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। প্রথম জীবনে তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মক্কা অবরোধের পর তিনি হেজ্জাজের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং ধর্ম-বিরোধিগণকে অত্যাচার ও নৃশংসতা প্রদর্শন করে নির্মূল করেন। ইরাক ও পারস্যে আজরাকী নামে শক্তিশালী খারিজি সম্প্রদায় গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করলে ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মালিক হাজাজকে হেজাজ থেকে ইরাকের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। তিনি প্রথমে কুফা ও পরে বসরায় গমন করে ঘোষণা করেন যে, যারা মুহাল্লাবের বাহিনীতে যোগদান করবে না তাদেরকে হত্যা করা হবে। এর ফলে ইরাকবাসীরা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে খারিজিদের বিরুদ্ধে মুহাল্লাবের দলে যোগদান করে। এভাবে হাজ্জাজ নৃশংসতা এবং ভীতি প্রদর্শন দ্বারা সমগ্র ইরাকে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন।
হাজ্জাজ খারিজি বিদ্রোহ দমনের জন্য মুহাল্লাবের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী গঠন করলেও উমাইয়া বাহিনী বেপরোয়া এবং রণোন্মত্ত খারিজিদের সঙ্গে যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। কিন্তু আজরাকী সম্প্রদায় দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়লে খারিজিদের শক্তি হ্রাস পায়। কাতবীর নেতত্বে একদল তাবারিস্তানে চলে যায় এবং অবশিষ্ট সম্প্রদায়টি আবদারাবার নেতৃত্বে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুহাল্লাব তাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। খারিজিগণ প্রাণভয়ে কিরমানে পলায়ন করলে তাদের অনেকেই ধৃত ও নিহত হয়। হাজ্জাজ মুহাল্লাবের কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
দক্ষিণ পারস্যে মুহাল্লাব খারিজিদের দমনে ব্যস্ত থাকাকালীন উমাইয়াদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দমননীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে একদল খারজী শাবীব-ইবন-ইয়াজিদের নেতৃত্বে মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে। রণদক্ষতা ও ধর্মান্ধতায় খারিজিদের প্রথম অভিযানগুলো সফল হয় এবং তারা উত্তর ইরাকের কুফা ও মসুল প্রভৃতি শহর আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে থাকে। তিন বছর (৬৯৫-৯৭ খ্রিস্টাব্দ) যুদ্ধ করেও হাজ্জাজ শাবীবকে পরাজিত করতে পারেন নি। অগত্যা তিনি খলিফার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। সিরীয়-বাহিনীর প্রচেষ্টায় শাবীবের বিদ্রোহ দমন করা সম্ভবপর হয় এবং তিনি উত্তর ইরাক থেকে বিতাড়িত হয়ে আহওয়াজের দিকে পলায়নকালে নদীতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে তাবারিস্তানে কাতবীর দলে বিভেদ সৃষ্টি হলে উমাইয়া বাহিনী কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবে ইরাক ও পারস্যে খারিজি বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করা হয়। খারিজিদের অনেকেই উত্তর আফ্রিকায় পলায়ন করে এবং সেখানে বার্বারদের মধ্যে বিদ্রোহের ইন্ধন যোগাতে থাকে।
জানবিলের বিরুদ্ধে অভিযান : সিজিস্তানের রাজা জানবিল কাবুল হতে কান্দাহার পর্যন্ত একটি বিস্তৃত অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেছিলেন। এটি মুসলিম সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকীস্বরূপ ছিল। তাই হাজ্জাজ একটি বিশাল বাহিনী জানবিলের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু জানবিল উমাইয়া বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করবার প্রয়াস পান। পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য হাজ্জাজ ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ময়ুর বাহিনী’ নামে একটি সুসজ্জিত বিশাল সৈন্যবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কুফা ও বসরার অধিবাসীদের দ্বারা গঠিত এই ‘ময়ূর বাহিনীকে’ নেতৃত্ব দান করেন কুফার আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ-বিন-আল-আসাথ। ‘ময়ূর বাহিনী’ জানবিলকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে হৃতরাজ্য পুনরাধিকার করে। হাজ্জাজ শত্রু- বাহিনীর উপর অত্যাচার করবার আদেশ দিলে ‘ময়ূর বাহিনীর’ সেনাধ্যক্ষ তা অমান্য করে ইরাকের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এতে হাজ্জাজ বিচলিত হয়ে তাকে কঠোর ভাষায় একটি পত্র লিখেন। হাজ্জাজের কঠোরতা ও জিঘাংসামূলক প্রবৃত্তির জন্য আল- আসাদের সৈন্যদল বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
ইবন-আল-আসাথের বিদ্রোহ : হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ হৃদয়হীন শাসনকর্তারূপে ইসলামের ইতিহাসে সুপরিচিত। তিনি আল-আসাথকে শত্রুদের নিধনের আদেশ দিলে সেনাপতি তা অমান্য করে ইরাকের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। খলিফা এতে প্ৰমাদ গুনলেন এবং হাজ্জাজের সাহায্যে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। আল-আসাথ খলিফার বাহিনীকে বিতাড়িত করে টাইগ্রীস নদী পার হয়ে বসরা দখল করে কুফার দিকে অগ্রসর হন। উমাইয়া খিলাফতের এই সময়টি ছিল খুবই সঙ্কটপূর্ণ। হাজ্জাজের বর্বরতায় অতিষ্ঠ হয়ে বহু লোক ‘ময়ূর বাহিনীতে’ যোগদান করলে এর সংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০ তে দাঁড়ায়। আবদুল মালিক আল-আসাথের সাথে বিরোধ মিটারবার প্রচেষ্টায় হাজ্জাজকে অপসারণ, ভাতার ব্যাপারে সিরিয়া ও ইরাকীদের মধ্যে সমতা বিধান এবং ময়ূর বাহিনীর সেনাপতি আসাথের উচ্চপদে নিয়োগ প্রভৃতি প্রস্তাব প্রেরণ করেন। আল-আসাথ এই . সমস্ত প্রস্তাব মেনে নিতে রাজী হলেন সৈন্যগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অতঃপর খলিফা আবদুল মালিক হাজ্জাজের সাহায্যে সিরীয় সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। আকীফ এবং কুরাইশ গোত্রসহ সিরীয় সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ৭০১ খ্রিস্টাব্দে কুফার নিকটবর্তী মাসকিন নামক স্থানে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হাজ্জাজ আল-আসাথের “ময়ূর বাহিনীকে” পরাজিত করেন।” হাজ্জাজের সিরীয় বাহিনী বসরা দখল করে ১১,০০০ অধিবাসীকে হত্যা করে। আল-আসাথ কুফা হতে বসরায় পলায়ন করলে হাজ্জাজ তাকে অনুসরণ করেন এবং পরিশেষে তাকে সিজিস্তানের অধিপতি জানবিলের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। কিছুদিন পরেই তিনি নিহত হন। আল-আসাথের মৃত্যুতে উমাইয়া খিলাফতে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। অধিকাংশ বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করে। বসরা ও কুফায় উমাইয়া আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। জানবিল আবদুল মালিকের পক্ষ অবলম্বন করলে হাজ্জাজ কাবুল পর্যন্ত উমাইয়া-রাজত্ব বিস্তারে সক্ষম হন। তিনি স্বীয় দূরদর্শিতা, পরাক্রম ও কর্মদক্ষতার দ্বারা উমাইয়া রাজত্বকে বিপদমুক্ত করেন। আবদুল মালিক ও আল-ওয়ালিদের রাজত্বকালে হাজ্জাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিদ্রোহ দমন, শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন, রাজ্য বিস্তার ও সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। ওয়েলহাউসেন যথার্থই বলেছেন, ‘হাজ্জাজ আবদুল মালিকের সৃষ্টি’ অর্থাৎ আবদুল মালিকের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি উন্নতির সর্বোচ্চ সোপানে আরোহণ করেন।
হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার
উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়ার মৃত্যু অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বৈদেশিক আক্রমণের সুচনা করে। মুয়াবিয়ার উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়; অপরদিকে বায়জানটাইন ও বার্বারগণ সংঘবদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে উমাইয়া আধিপত্য খর্ব করবার প্রয়াস পায়।
বায়জানটাইনদের সঙ্গে যুদ্ধ : গৃহযুদ্ধের সুযোগে বায়জানটাইনের রাজা মুসলিম রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করেন। ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মালিক তাঁর সেনাপতিদের নিয়ে এশিয়া মাইনর, আর্মেনিয়া এবং আফ্রিকার উপকূলে বাৎসরিক অভিযান চালাতে থাকেন। মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলনকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের সাথে বায়জানটাইনদের সংঘর্ষ বাধে। বায়জানটাইনগণ এন্টিওক (Antioch) দখল করলে মুসলমানগণ তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে ইরজিরোম পর্যন্ত বিতাড়িত করেন। অনেক দুর্গ মুসলিম সেনাপতিদের দখলে আসে। সিরিয়া এবং আর্মেনিয়ার সীমান্তে বসবাসকারীরা এই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমীর আলী বলেন, “পূর্ব দিকে কাবুল অঞ্চলে রাটবিল (Ratbil) নামে যে হিন্দু যুবরাজ রাজত্ব করতেন তার রাজ্য মুসলমানদের করতলগত হল।”
উত্তর আফ্রিকা পুনরুদ্ধার : মুয়াবিয়ার খিলাফতে ওকবা ইবন-নাফীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিম আধিপত্য উত্তর আফ্রিকায় বিস্তৃতি লাভ করে এবং নব-অধিকৃত প্রদেশের রাজধানী কায়রোয়ানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওকবার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী কায়রোয়ান হতে আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হয়। কাউন্ট জুলিয়ানের স্পেন জয়ের প্রস্তাবকে তিনি সময়োচিত মনে না করায় প্রত্যাখ্যান করেন। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে বার্বার নেতা কুসাইলা বায়জানটাইনদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে আলজিরিয়ার তাহুজা নামক স্থানে ওকবাকে পরাজিত ও নিহত করেন। এর ফলে উত্তর আফ্রিকা মুসলমানদের হস্তচ্যুত হলে আবদুল মালিক ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে জুহাইরের নেতৃত্বে একটি বিরাট সৈন্যদল প্রেরণ করে হৃতরাজ্য পুনর্দখলের চেষ্টা করেন। তিনি বার্বার ও বায়জানটাইনদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাস্ত করে কুসাইলাকে হত্যা করেন। কিন্তু জুহাইর যখন বার্কায় একটি ক্ষুদ্র দল রেখে আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চল জয়ের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন তখন বার্বার ও বায়জানটাইনদের সম্মিলিত বাহিনী তাঁকে আক্রমন করে। এক ভয়াবহ যুদ্ধে জুহাইর পরাজিত ও নিহত হলে তাঁর সৈন্যদল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
সুদক্ষ যোদ্ধা জুহাইরের মৃত্যুতে খলিফা আবদুল মালিক খুবই মর্মাহত হন এবং শত্রুদের সমুচিত শিক্ষা দানের জন্য হাসান-বিন-নোমানের নেতৃত্বে ৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। মুসলমানগণ কায়রোয়ান থেকে কার্থেজ নগরীর দিকে অগ্রসর হয়ে শত্রুবাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে কার্থেজ, বার্কা প্রভৃতি স্থান অধিকার করে। ফলে, উমাইয়া আধিপত্য বার্কার প্রাচীর থেকে আটলান্টিকের উপকুল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
পরাজিত বার্বারগণ ‘আফ্রিকান পায়থন’ বলে পরিচিত কাহিনা নামক এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহিলার নেতৃত্বে নিজেদের সুসংঘবদ্ধ করে মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়। কাহিনার অলৌকিক ক্ষমতার প্রভাবে বার্বারগণ নতুন উৎসাহে উদ্দীপিত হয়ে মুসলিম সেনাপতি হাসানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড অভিযান পরিচালিত করে। তার প্রেরণা ও নেতৃত্বে প্রাণপণ যুদ্ধ করে বার্বারগণ হাসানকে পরাজিত করে এবং দীর্ঘ পাঁচ বছর কাহিনাকে তাদের একচ্ছত্র রাণী ও অধিপতিরূপে মর্যাদা দান করে। ৭০৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদুল মালিক শক্তিশালী বার্বার বিদ্রোহকে ধূলিসাৎ করবার জন্য হাসানের সাহায্যার্থে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। বিপদসঙ্কুল এক পার্বত্য অঞ্চলে কাহিনা হাসান কর্তৃক নিহত হন। বার্বার রানীর মৃত্যু হলে উত্তর আফ্রিকায় বিদ্রোহ প্রশমিত হয় এবং মুসলমানগণ হৃদরাজ্য পুনরায় অধিকার করতে সমর্থ হয়। বার্বারগণ নিরুৎসাহ হয়ে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করলে তাদের শক্তি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মুসলমানগণ কায়রোয়ান পুনরুদ্ধার করে। প্রায় ১২,০০০ বার্বার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করে। ফলে উত্তর আফ্রিকায় ইসলাম বিস্তারের পথ সুগম হয়। উত্তর আফ্রিকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে হাসান সিরিয়ায় আগমন করলে গ্রীক সম্রাট লিওন্টিয়াস এক নৌবাহিনী প্রেরণ করে কার্থেজ দখল করেন এবং মুসলমানদের বার্কায় বিতাড়িত করেন। আবদুল মালিক মুসা ইবন-মুসায়েবকে উত্তর আফ্রিকায় প্রেরণ করে গ্রীকদের কার্থেজ হতে বিতাড়িত করে পুনরায় মুসলিম আধিপত্য আটলান্টিক পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। উত্তরাধিকারী মনোনয়ন : মৃত্যুর পূর্বে পিতা মারওয়ান তাঁর দুই পুত্র আবদুল মালিক এবং আবদুল আজিজকে পর্যায়ক্রমে খলিফা মনোনীত করলেও উমাইয়া বংশের স্বার্থে আবদুল মালিক তদীয় পুত্র ওয়ালিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে আবদুল আজীজের মৃত্যু হলে ৭০৪ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মালিক ওয়ালিদকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। সমগ্র রাজ্যের জনসাধারণ ওয়ালিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু মদিনাবাসিগণ মনোনয়ন পদ্ধতির প্রতি তাদের অনাস্থা জ্ঞান করলে খলিফা আবদুল মালিক কঠোর হস্তে তাদের বিরোধিতা দমন করে তাদের আনুগত্য আদায় করেন। ৭০৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ই সেপ্টেম্বর ৬২ বছর বয়সে বিশ বছর রাজত্ব করবার পর আবদুল মালিক ইন্তেকাল করেন।
আবদুল মালিকের শাসন সংস্কারসমূহ
স্পুলার বলেন, “আবদুল মালিকের রাজত্বকাল ইসলামের ইতিহাসে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগ ছিল।” রাজনৈতিক অসন্তোষ, মারাত্মক কলহ, আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অরাজকতা, ত্রাসের রাজ্য এবং অচলাবস্থা দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করে আবদুল মালিক শুধু উমাইয়া বংশের ভিত্তিই সুপ্রতিষ্ঠিত করেন নি; বরং খিলাফতকে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা কায়েম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারোপযোগী পরিবেশের সৃষ্টি করেন। হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার দ্বারা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং মুসলিম প্রভুত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলেই তদীয় পুত্র প্রথম ওয়ালিদের রাজত্বে পূর্বে আমুর দরিয়া থেকে পশ্চিমে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ পর্যন্ত ইসলামের সম্প্রসারণ সম্ভবপর হয়। গৃহযুদ্ধ দমন, শান্তি প্রতিষ্ঠা, একীকরণ এবং সংগঠন দ্বারা উমাইয়া রাজ্যের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি সংস্কার সাধন করে আবদুল মালিক অক্ষয় কীর্তি রেখে গিয়েছেন। বস্তুত শাসন-ব্যবস্থায় জাতীয়করণ, অকৃত্রিম আরবি মুদ্রার প্রচলন, ডাক বিভাগীয় সংস্কার, আরবিকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দান, রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দ্বারা তিনি ইসলামের ইতিহাসে একটি গৌরবদীপ্ত অধ্যায়ের সুচনা করেন। উল্লেখযোগ্য যে, হযরত ওমরের শাসন-ব্যবস্থার পর আবদুল মালিকের মত অপর কেহ এরূপ বিপ্লবাত্মক সংস্কার প্রবর্তন করতে পারেন নাই।
শাসন-ব্যবস্থা আরবিকরণ : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবদ্দশায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র শুধু আরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় সরকারি কাগজপত্র আরবি ভাষায় রক্ষিত হত। ধর্মপ্রাণ খলিফাদের আমলে পারস্য, মিসর, সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে শাসন-ব্যবস্থার সুবিধার্থে আঞ্চলিক ভাষায় ঐ সমস্ত প্রদেশে রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র সংরক্ষিত হত। ইরাক ও পারস্যে পাহলভী, মিসরে কপটিক, সিরিয়ায় সিরিয়াক (Syriac), বায়জানটাইন অধ্যুষিত অঞ্চলে গ্রীক ভাষা প্রচলিত ছিল। বলা বাহুল্য যে, নব-অধিকৃত অঞ্চলে শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব অমুসলমানদের উপর ন্যস্ত করা হয়। খলিফা মুয়াবিয়ার রাজত্বে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত ইবন-উথাল (Ibn-Uthal) রাজস্ব-সচিব ছিলেন। রাজস্ব ও অর্থ দফতর গ্রীক ও সিরীয় ভাষায় অভিজ্ঞ খ্রিস্টান ও পারসিকদের দ্বারা পরিচালিত হত। কিন্তু আবদুল মালিক শাসন-ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু এবং সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিচালিত করবার জন্য একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শাসন-ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয়করণ করবার জন্য আরবি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করা হয়। ৬৯৬-৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা একটি আদেশ জারি করে আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে সরকারি দলিল-পত্রাদি আরবি ভাষায় সংরক্ষণের প্রথা চালু করেন। আরবি ভাষা প্রচলনের কতকগুলো বিশেষ কারণ ছিল। প্রথমত, সমগ্র রাজ্যে একই ধরনের শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তন, দ্বিতীয়ত, এটি করতে হবে কেবল বিজিতদের জন্য; আরবি ভাষায় সরকারি রেজিস্ট্রি লিখনের প্রথা চালু করা হয়। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক ভাষা খলিফার বোধগম্য না হওয়ায় তিনি বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। আবদুল মালিক শাসনকার্য নিজ হস্তে পরিচালনা করতেন এবং সে কারণে তিনি একই ভাষায় লিখিত দলিল-পত্র লিখনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। চতুর্থত, আরবি ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করে বিশুদ্ধ আরব শাসন প্রচলন করাই ছিল আবদুল মালিকের প্রধান উদ্দেশ্য।
আরবি ভাষা জাতীয়করণের ফলে মিসর, উত্তর আফ্রিকা, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে অমুসলমান অনারব কর্মচারিগণ কর্মচ্যুত হয়; অবশ্য যারা আরবি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে তাদের চাকরিতে বহাল রাখা হয়। আরব মুসলিমগণ বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত হলে। তাদের প্রশাসনিক প্রতিভা বিকাশের পথ সুগম হয়। আরবি ভাষা চর্চার ফলে আরবি মুদ্রা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়। দামেস্কে ‘দিওয়ানুল রাসাইল’ (Public Registry) নামে একটি নতুন দফতর স্থাপন করা হয়। আরবি ভাষা প্রচলনের গুরুত্ব নির্ণয় করে বার্নার্ড লুইস বলেন, “আবদুল মালিকের রাজত্বকালে আরব ঐতিহাসিকদের নিকট পরিচিত ‘সংগঠন এবং সুবিন্যস্ত’ নামে একটি পন্থা প্রচলিত হয়। বিভিন্ন প্রদেশে প্রবর্তিত পুরানত বায়জানটাইন এবং পারস্য শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে আরবিকে শাসনকার্য এবং হিসাবরক্ষণে সরকারি ভাষার মর্যাদা দান করে একটি নতুন আরব রাজকীয় ব্যবস্থা প্রচলিত হল।
আরবি-লিপির উৎকর্ষ সাধন : খলিফা আবদুল মালিকের শাসন সংস্কারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল— আরবি বর্ণমালার লিখন ও উচ্চারণ পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন। আরবি লিপির প্রধান দুটি ত্রুটি ছিল : প্রথম স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে প্রভেদের অভাব, যার ফলে একই শব্দের বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণ হত; দ্বিতীয়ত, ‘নোকতার’ অভাবে একই ধরনের হরফগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা যেত না। বিশেষ করে অনারব মুসলমানগণ এই হরফের দ্বারা আরবি ভাষা পাঠ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। আবদুল মালিকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন ইউসুফ সর্বপ্রথম আরবি বর্ণে নোকতা ও হরকতের প্রচলন করেন এবং এর ফলে একই আকৃতির বর্ণকে বিভিন্ন ধরনে এবং অর্থে ব্যবহার করা সম্ভবপর হয়; যেমন বে, তে, সে, নুন অথবা জিম, হে, খে। নোকতা (Diacritical marks) প্রবর্তনের ফলে আরবি ভাষা পাঠের অসুবিধা দূরীভূত হয়। উপরন্তু, স্বরবর্ণ প্রবর্তন করে আরবি লিপির ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে পার্থক্য করা হয় এবং এর ফলে ভাষাগত দিক হতে আরবি উৎকর্ষ সাধিত হয়; যেমন জের, জবর এবং পেশ ব্যবহার করে অর্থের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ব্দ ঞ্জ ঞ্জ শু। এরূপে আরবি ভাষার সহজতর লিখন ও পঠন সম্ভবপর হয় এবং এটি ব্যাপক প্রসার ও উন্নতি লাভ করে।
আরবি মুদ্রার প্রচলন : ঐতিহাসিক গিলমান বলেন, “আবদুল মালিকের রাজত্ব খুবই উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, এই সময়ে সারাসিনগণ সর্বপ্রথম নিজেদের জন্য মুদ্রা তৈরি করেন।” আবদুল মালিকের সিংহাসনারোহণের পূর্বে আরবদের কোন নিজস্ব মুদ্রা এবং টাকশাল ছিল না। রাসূলে করীম (স) এবং আবুবকর (রা)-এর আমলে রোমান ও পাবলিক মুদ্রা প্রচলিত ছিল, এমনকি পেঁচক খোদিত হিমারী রৌপ্যমুদ্রারও প্রচলন ছিল। হযরত খিলাফতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিস্তার লাভ করলে অমুসলমানদের মুদ্রা যেমন রোমীয় স্বর্ণমুদ্রা এবং সাসানীয় রৌপ্যমুদ্রা ব্যবহৃত হত। প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ নিজস্ব স্বাধীন টাকশালে প্রাচীন মুদ্রার অনুকরণে অথবা প্রাচীন মুদ্রায় কুরআন শরীফের উদ্ধৃতি খোদাই করে মুদ্রা তৈরি করেন। মুদ্রার ছাপ, ওজন, আকৃতি এবং মুল্য (Intrinsic value) সমগ্র রাষ্ট্রব্যাপী ছিল অনির্ধারিত। মুয়াবিয়া উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করে মুদ্রা- ব্যবস্থার সংস্কারে মনোনিবেশ করেন নি। কারণ, তিনিও প্রাচীন রোমীয় স্বর্ণমুদ্রা দিনারিয়াস (Denarius) এবং সাসানীয় রৌপ্যমুদ্রা ড্রাকমা (Drachma) চালু করেন। অবশ্য কখনও কখনও কিছু রদবদলও করা হত।
খলিফা আবদুল মালিকের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ছিল জাতীয় টাকশাল নির্মাণ এবং আরবি মুদ্রা প্রচলন। ৬৯৬-৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দামেস্কে একটি জাতীয় টাকশাল স্থাপন করে সম্পূর্ণ আরবি অক্ষরযুক্ত নির্দিষ্ট এবং সর্বজনস্বীকৃত একক মুদ্রামানের দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা, দিরহাম বা রৌপ্যমুদ্রা ও ফালুস বা তাম্রমুদ্রা সমগ্র রাজ্যে প্রচলন করেন। কুফা অধিকৃত হলে হাজ্জাজ সেখান থেকে রৌপ্যমুদ্রা ছাপান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, দিনার শব্দটি বায়জানটাইন ‘দিনারিয়াম’ এবং দিরহাম সাসানীয় ‘ড্রাকমা’ শব্দ হতে উদ্ভূত এবং বলাই বাহুল্য যে, মুসলিম মুদ্রা প্রচলনে বায়জানটাইন এবং সাসানীয় প্রভাব ছিল। সমগ্র দেশে একটি নির্দিষ্ট সর্বজনস্বীকৃত একক মুদ্রামানের দিনার, দিরহাম ও ফালুস মুদ্রিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়। কেন্দ্রীয় সরকার মুদ্রা তৈরি ও নির্বাহের ক্ষমতা লাভ করে। মুদ্রাঙ্কন ব্যাপারটি ত্রুটিমুক্ত হলে অবাধে জাল মুদ্রা তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রতিটি মুদ্রায় কলেমা, মুদ্রাঙ্কনের তারিখ, টাকশালের নাম লিখা থাকত। জাতীয় টাকশাল স্থাপন এবং বিশুদ্ধ আরবি মুদ্রা প্রচলন দ্বারা শাসন-ব্যবস্থা আরবিকরণে সহজতর হয়।
ডাক বিভাগের সংস্কার : মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম দিওয়ানুল বারিদ নামে একটি পৃথক ডাক বিভাগের সৃষ্টি করেন। খলিফা আবদুল মালিকের রাজত্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ও অসন্তোষ দেখা দিলে দূরবর্তী অঞ্চল হতে দ্রুত সংবাদ সরবরাহের জন্য ডাক বিভাগের প্রভূত উন্নতি ও সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। রাজধানী দামেস্ক এবং প্রাদেশিক শহরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য ঘোড়ায় ডাকের ব্যবস্থা করা হয়। পারস্য শাসনব্যবস্থার প্রভাব মুসলিম ডাক বিভাগে পরিলক্ষিত হয়। যোগাযোগকারী সড়কের স্থানে স্থানে বদলী ঘোড়া (Relay of horses) নিয়োগ করে আবদুল মালিক সত্বর সংবাদ আহরণ এবং দ্রুত বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হন। মফস্বলের ডাক কর্মচারিগণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সংবাদ দামেস্কের কেন্দ্রীয় ডাক বিভাগে প্রেরণ করতেন এবং কেন্দ্রীয় ডাক বহনকারী পোস্ট মাস্টার বা সাহিব-উল-বারিদ এই ডাক বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। ঘোড়ার গাড়িগুলো কখনও কখনও রাজকর্মচারী বা সৈন্য-সামন্তের যাতায়াতের জন্যও ব্যবহৃত হত। ডাক বিভাগরে অন্যতম কর্তব্য ছিল গুপ্ত খবরাখবর সরবরাহ করে গোয়েন্দা বিভাগের কার্য সম্পাদন করা।
রাজস্ব সংস্কার : বার্নার্ড লুইস বলেন, “আবদুল মালিক এবং তাঁর উপদেষ্টাগণ রাজস্ব-ব্যবস্থার সুষ্ঠু পুনর্গঠনের এমন একটি পন্থা উদ্ভাবন করেন যা তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে একটি অভিনব এবং বিশেষভাবে ইসলামী কর ব্যবস্থায় পরিণত হয়।” খিলাফত লাভ করে আবদুল মালিক এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হন। তিনি এই বিপর্যয় হতে রাজ্যকে উদ্ধার করবার জন্য তাঁর সুযোগ্য শাসনকর্তা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফের পরামর্শ ও সক্রিয় সহায়তায় রাজস্ব-ব্যবহার আমূল পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে দৃঢ়তর করেন। সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম বিস্তার লাভ করে এবং নব-দীক্ষিত মুসলমান বা মাওয়ালীদের ইসলামের বিধান অনুসারে কেবল যাকাত প্রদান করতে হত। আরব মুসলিমগণ অনারব অঞ্চলে জমি ক্রয় করত এবং তারা কোন প্রকার ভূমি-রাজস্ব দিত না। উপরন্তু, আরব মুসলমানদের মত সমান সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের আশায় অনারব মুসলমানগণ গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এর ফলে শুধু কৃষিকার্যেরই সমূহ ক্ষতি সাধিত হল না; বরং তারা সৈন্যদলে যোগদান করে নিয়মিত ভাতাও পেতে থাকে। এভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম রাজ্যেও অর্থনৈতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।
আবদুল মালিক খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে উপলব্ধি করেন যে কর প্রথার অব্যবস্থার দরুন রাজ্যে একটি তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট বিদ্যমান। রাজকোষ প্রধানত দুটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার জন্য শূন্য হতে থাকে; প্রথমত, অমুসলমানদের ‘জিজিয়া (Jizya) এবং ভূমি- রাজস্ব বা খারাজ (Kharaj) দিতে হত। বিধর্মিগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলে তারা জিজিয়া ও খারাজ প্রদান হতে অব্যাহতি পায় এবং অপরদিকে তাদেরকে কেবল ‘যাকাত’ দিতে হত। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হ্রাস পায়, উপরন্তু তাঁরা সৈন্যদলে যোগদান করে কর প্রদানের স্থলে নিয়মিত ভাতা পেতে থাকে। দ্বিতীয়ত, হযরত ওসমান (রা) সর্বপ্রথম আরব মুসলমানদের অনারব অঞ্চলে জমি ক্রয়ের অনুমতি প্রদান করেন। যেহেতু অমুসলমানদের খারাজ দিতে হত সেহেতু অপর মুসলমানগণ অনারব মুসলমান অথবা অনারব অমুসলমানদের জমি ক্রয় করলে সরকারকে ভূমি-রাজস্ব বা খারাজ দিতে হত না। এরূপ অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর রাজস্ব-ব্যবস্থার সংস্কার করে আবদুল মালিক কৃতিত্বের পরিচয় দেন। প্রথমত, হাজ্জাজের পরামর্শে তিনি আদেশ দেন যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও নব-দীক্ষিত অনারব মুসলমানদের বা মাওয়ালীদের ভূমি-কর বা খারাজ দিতে হবে; দ্বিতীয়ত, ভূমি কর যাতে হ্রাস না পায় তার জন্য তিনি আরবিয় মুসলমানগণ কর্তৃক মাওয়ালীদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন; তৃতীযত, যে সমস্ত মাওয়ালী জমিজমা পরিত্যাগ করে চলে গেয়েছিল হাজ্জাজ তাদেরকে খামারে ফিরে যেতে এবং জমিজমা চাষ করতে বাধ্য করেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির পন্থাও অবলম্বন করা হয়। হাজ্জাজ অনুর্বর ও পতিত জমি তিন বছরের মেয়াদে কৃষকদের মধ্যে বিনা রাজস্বে বিতরণ করে কৃষিকার্যে উন্নতি সাধনের ব্যবস্থা করেন; এমনকি কৃষকদের কৃষিঋণ প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়। তিন বছর পর উক্ত জমির উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক ভূমি রাজস্বরূপে ধার্য করা হত। রাজস্ব-ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন দ্বারা আবদুল মালেক উমাইয়া খিলাফতকে সমূহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত হতে রক্ষা করেন।
আবদুল মালিকের চরিত্র
খলিফা আবদুল মালিক উমাইয়া বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা লাভ করলেও ঐতিহাসিকগণ তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন। বিশেষ করে আব্বাসীয় যুগের ঐতিহাসিকগণ তাঁকে বিশ্বাসঘাতক ও রক্তলোলুপ হিসেবে চিত্রিত করেন। তাঁর ঝটিকাপূর্ণ জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রভাবান্বিত করে। বাল্যকাল হতে হযরত ওসমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে অরাজকতা, যৌবনে ইয়াজিদের সময় মক্কা অবরোধ ও মদিনা লুণ্ঠন এবং পরিণত বয়সে পিতা মারওয়ান ও ইবন-যুবাইরের সঙ্গে সংঘর্ষ প্রভৃতি উত্তেজনাপূর্ণ ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। ঐতিহাসিক মাসুদীর মতে, “আবদুল মালিকই সর্বপ্রথম খলিফা যিনি বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেন।” তিনি তাঁর চাচাত ভাই এবং দামেস্কের এককালীন শাসনকর্তা আমর- ইবন-সাঈদকে প্রলোভন দেখিয়ে রাজপ্রাসাদে অভ্যর্থনা করেন এবং নিজ হস্তে তাকে হত্যা করেন। হাজ্জাজ বিন-ইউসুফের বর্বরোচিত কার্যকলাপ, নিধনযজ্ঞ এবং হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতাকে আবদুল মালিকের রাজত্বে এক বিরাট কলঙ্ক বলে অভিহিত করা হয়। বস্তুত, মূইর-এর মতে, “আমর ইবন-সাঈদ ব্যতীত অপর কোন ব্যক্তির প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের কোন ব্যবস্থা আবদুল মালিক গ্রহণ করেন নি। অবশ্য অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম করতে যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালনাকালে অসংখ্য বিদ্রোহী রণক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন।” ঐতিহাসিকদের মতে, ‘আরব নিরো’ বলে পরিচিত হাজ্জাজ ১.১২,০০০ হতে ১,৫০,০০০ লোককে হত্যা করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ৫০,০০০ স্ত্রী-পুরুষ কারারুদ্ধ ছিল। আবদুল মালিকের নিষ্ঠুরতার কথা উল্লেখ করে আমীর আলী বলেন, “তিনি নিশ্চয়ই শার্লিমেন অপেক্ষা কম নিষ্ঠুর ছিলেন” (“He was certainly less cruel than Charlemagne”)। মূইর বলেন, “কোন বিদ্রোহী শত্রুর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে তিনি বারংবার আত্মসমর্পণ করে সমঝোতা সৃষ্টি এবং অনুকম্পা গ্রহণের প্রস্তাব দিতেন। “
আবদুল মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি যৌবনে গোঁড়া ও ধর্মভীরু মুসলমান থাকলেও সিংহাসন লাভ করে ইসলামের প্রতি তিনি চরম উদাসীনতা প্ৰদৰ্শন করেন। ক্ষমতা লাভ করে তিনি কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে বলেন, “তোমার সাথ আমার এই শেষ দেখা” (“This is my last time with you”)। ঐতিহাসিকগণ আরও বলেন যে, “তিনি ইসলামের অবমাননা করেন এবং তাঁর সম্মুখে কথা বলা নিষিদ্ধ করে দেন।“ একথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মীয় কার্যকলাপে অনুদার হলেও উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা, বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁর চরিত্রের ভূষণ ছিল।
ঐতিহাসিকগণ আবদুল মালিকের চরিত্রে কালিমা লেপন করলেও তিনি উমাইয়া খিলাফতের একজন সুসংগঠক হিসেবে সর্বজনবিদিত ছিলেন। তিনি বংশগত স্বার্থরক্ষার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাঁকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তিনি সত্যই সাহসী, উদ্যমী, সংযমী ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রভৃতি রাজোচিত গুণের অধিকারী ছিলেন। আমীর আলী বলেন, “বংশের স্বার্থের প্রতিকূল না হলেও তিনি সুবিবেচক ছিলেন।” কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁর সম্বন্ধে বলেন “লোভ এবং নিষ্ঠুরতা ছিল খলিফা আবদুল মালিকের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।” প্রকৃতপক্ষে কৃপণতা এবং লোভ সম্বন্ধে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয় তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। উপরন্তু, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তিনি সকল সম্প্রদায়কে উদারতা প্রদর্শন করতেন। শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিসম্মত, সাহিত্যানুরাগী, আরব জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ আবদুল মালিকের চারিত্রিক দোষ-গুণ বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হবে যে, তিনি উমাইয়া বংশকে অধঃপতনের হাত হতে রক্ষা করেন। মূইর-এর ভাষায়, “আবদুল মালিকের রাজত্বের সর্বদিক বিচার করলে রায় অবশ্যই তাঁর অনুকূলে যাবে।”
আবদুল মালিকের কৃতিত্ব
আবদুল মালিক ৬৮৫ হতে ৭০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে উমাইয়া বংশের ইতিহাসে তথা ইসলামের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। বার্নার্ড লুইস বলেন, “আবদুল মালিকের খিলাফতে প্রাচীন প্রাচ্য ধরনের স্বৈরতন্ত্র ছিল না; বরং আরব ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ভাবধারা পুষ্ট একটি কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্র ছিল।” আবদুল মালিক মুয়াবিয়ার প্রতিষ্ঠিত বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় করেন। মুয়াবিয়া যেভাবে ইমাম হুসাইনকে বঞ্চিত করে ইয়াজিদকে, মারওয়ান যেভাবে ইয়াজিদ পুত্র খালিদকে বঞ্চিত করে আবদুল মালিক এবং আবদুল আজীজকে মনোনীত করেন, তেমনি আবদুল মালিক স্বীয় ভ্রাতা আবদুল আজীজকে বঞ্চিত করে তদীয় পুত্র ওয়ালিদকে খিলাফতের জন্য মনোনীত করেন। অবশ্য রাজতন্ত্র সুদৃঢ়করণের মূলে ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতিষ্ঠা
আবদুল মালিকের সিংহাসনারোহণ রাজ্যব্যাপী গৃহযুদ্ধের সুচনা করে। অনারব-আরব দ্বন্দ্ব, গোত্রীয় কলহ, মুসলমান-অমুসলমানে সংঘর্ষ, চক্রান্তকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ষড়যন্ত্র ও উস্কানিমূলক কার্যকলাপে উমাইয়া খিলাফত যখন ধ্বংসের উপক্রম হয় তখনই আবদুল মালিক রাজদণ্ড ধারণ করে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতে থাকেন। আমীর আলী বলেন, “আবদুল মালিক ছিলেন একজন আদর্শস্থানীয় উমাইয়া বংশীয় ব্যক্তি, তিনি কর্মঠ, ষড়যন্ত্রকারী ও অধার্মিক ছিলেন এবং অসাধারণ দক্ষতার সাথে স্বীয় ক্ষমতা সুদৃঢ় করবার প্রয়াস পান।” রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহ দেখা দিলে উমাইয়া বংশ সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে মুখতারের নেতৃত্বে একদিকে ‘অনুশোচনাকারী’ (Penitents) অথবা, ‘প্রতিশোধ গ্রহণকারীরা’ (Avengers) কুফা, ইরাক ও পারস্যে উমাইয়া প্রভুত্ব খর্ব করে; কিন্তু খলিফার পরম শত্রু আবদুল্লাহর সেনাপতি মুসাব কতুক মুখতার নিহত হলে এক শত্রু কর্তৃক তার অপর এক শত্রু ধ্বংস হয়। আবদুল্লাহ ইবন-যুবাইর কর্তৃক হেজাজ ও ইরাকে প্রতিদ্বন্দ্বী খিলাফত প্রতিষ্ঠায় উমাইয়া খিলাফত চরম অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। খলিফার সুযোগ্য এবং নিষ্ঠুর শাসনকর্তা হাজ্জাজের সহায়তায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত ও নিহত হলে সিংহাসন কণ্টকমুক্ত হয়। আবদুল্লাহর মৃত্যুতে তাঁর যোগসূত্র চিরতরে ছিন্ন হয়। বলা বাহুল্য যে, আবদুল্লাহর মৃত্যুকে আবদুল মালিক মুসলিম রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে পরিগণিত হলেন। খারিজি বিদ্রোহ উমাইয়া খিলাফতের ভিত্তিকে প্রকম্পিত করে সত্য কিন্তু খলিফা অসাধারণ কর্মদক্ষতা অদম্য সংকল্প এবং অপরিসীম নির্ভীকতার সাথে তা দমন করতে সক্ষম হন। ইরাক ও পারস্য অঞ্চলে খারিজির প্রথম শক্তি সঞ্চয় করে বিদ্রোহী হয় কিন্তু তাদের দলপতি আযয়াকসহ বিদ্রোহী খারিজিগণ হাজ্জাজের হস্তে ধৃত ও নিহত হন। খারিজিদের অনুরূপ উত্তর আফ্রিকার বার্বার বিদ্রোহ আবদুল মালিকের শাসনকালকে সংকটাপন্ন করে তোলে। বায়জানটাইনদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে বার্বারগণ একটি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে খলিফা হাসান বিন-নোমানকে প্রেরণ করে উত্তর আফ্রিকা পুনর্দখল করেন এবং এতে কায়রোয়ানে উমাইয়া প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আফ্রিকান পায়থন’ (African Pythoness) অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কাহিনাও খলিফার সৈন্যবাহিনীর নিকট পরাজিত ও নিহত হলে বার্বার বিদ্রোহ ধুলিসাৎ হয়। এভাবে সমগ্র রাজ্যে যখন বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্বলিত হয়ে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনকে গ্রাস করবার উপক্রম করে তখন আবদুল মালিকের বলিষ্ঠ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে সাম্রাজ্য ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা পায়। ত্রাসের রাজ্যে আইনের শাসন এবং অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার স্থলে শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম করে আবদুল মালিক অসাধারণ দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন।
সংগঠক এবং সংস্কারক হিসেবে আবদুল মালিক অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন। শাসন-সংস্কারে তাঁর প্রধান অবদান ছিল আরবি ভাষাকে জাতীয় ভাষায় মর্যাদা দান। শাসন-ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করবার উদ্দেশ্যে আরবি ভাষা ব্যবহার ও আরবদের শাসনকার্যে নিয়োগ করা হয়। সরকারি কাগজ-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ, রোমান, পাহলবী, সিরিয়াক, হিমারী প্রভৃতি ভাষার পরিবর্তে সমগ্র রাজ্যে আরবি ভাষার প্রচলন করে শাসন-ব্যবস্থা সুসংঘবদ্ধ, সুসংহত ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়। আবদুল মালিকের অপর একটি অবাদন ছিল আরবি লিপির সংস্কার দ্বারা আরবি ভাষার উৎকর্ষ সাধন। তাঁর সুযোগ্য শাসনকর্তা ও সুপণ্ডিত হাজ্জাজ সর্বপ্রথম নোকতার সাহায্যে একই ধরনের আরবি বর্ণের মধ্যে আকৃতি, উচ্চারণ ও অর্থের পার্থক্য করতে সক্ষম হন। উপরন্তু, স্বরবর্ণ ব্যবহার দ্বারা আরবি বর্ণমালার উৎকর্ষ সাধিত হয়। আবদুল মালিককে বিশুদ্ধ আরবি মুদ্রা প্রচলনের পুরোধা বলে মনে করা হয়। তিনি সর্বপ্রথম বায়জানটাইন ও সাসানীয় মুদ্রার পরিবর্তে কলেমা, খলিফার নাম, টাকশাল ও মুদ্রাঙ্কনের তারিখ সম্বলিত স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা প্রচলিত করেন। ডাক বিভাগের উন্নতি সাধন এবং হাজ্জাজ- বিন-ইউসুফের পরামর্শে রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দ্বারা অর্থনৈতিক কাঠামো সুদৃঢ়করণ, আবদুল মালিকের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কর্মকুশলতার পরিচায়ক। শূন্য রাজকোষ পূর্ণ করবার জন্য হাজ্জাজ মাওয়ালীদের খারাজ প্রদানে এবং সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পরিবর্তে কৃষিকাজ করতে বাধ্য করেন। তিনি আরবদের অনারব অঞ্চলে জমি ক্রয়ে বাধা প্রদান করেন এবং অনাবাদী জমি বণ্টন করে শস্য উৎপাদনে প্রেরণা দান করেন। এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কায়েম হয়, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিপায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়।
আবদুল মালিক শিল্প-সাহিত্যের প্রভূত পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি নিজে কবিতা যেমন ভালবাসতেন তেমনি তাঁর দরবারেও কবিদের সমাগম হত। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তিনি জ্ঞানী ও গুণীদের সমাদর করতেন। তায়াযুক (Tayadhuq) নামক আবদুল মালিকের একজন খ্রিস্টান চিকিৎসক ছিলেন। খলিফার প্রধান উপদেষ্টাও ছিলেন সারজিয়াস (Sergius) নামে অপর একজন খ্রিস্টান। কবি সাহিত্যিক জারির (Jarir) আল-আখতাল (Al-Akhtal) এবং আল-ফারাজদাক (Al-Farazdak) খলিফার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং তাঁর রাজদরবার অলংকৃত করেন।
আবদুল মালিক কেবল সুযোগ্য শাসক ও দক্ষ সংগঠকই ছিলেন না, স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন। ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে এসে যে প্রস্তর খণ্ডের উপর পদচিহ্ন রেখে মেরাজে গমন করেন, তিনি সেই পাথরকে কেন্দ্ৰ করে গম্বুজবিশিষ্ট অষ্টকোণাকার একটি অতুলনীয় স্মৃতি-সৌধ নির্মাণ করেন। বায়জানটাইন খ্রিস্টানদের গীর্জাগুলোর আকর্ষণ ও নির্মাণ কৌশলকে ছেড়ে যাবার জন্য এবং মক্কার পরিবর্তে জেরুজালেমে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে তিনি ডোম-অব-দি-রক অথবা ‘কুব্বাত আস-সাখরা’ নামে এই সৌধ প্রতিষ্ঠা করেন। বায়জানটাইন স্থাপত্য এবং কারুকার্যের প্রভাব এতেও পরিলক্ষিত হয়। মক্কাকে জেরুজালেম দ্বারা এবং কা’বা শরীফকে ‘ডোম-অব-দি-রকের’ দ্বারা রূপান্তরিত করবার প্রচেষ্টায় খলিফা ব্যর্থ হলেও নবী করিমের অপূর্ব স্মৃতি-সৌধ মুসলিম স্থাপত্য-কীর্তির স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে। এছাড়া তিনি ‘ডোম-অব-দি-রকের’ সন্নিকটে মসজিদ-উল আকসা নির্মাণ করেন। তাঁর রাজত্বকালে কয়েকটি শহরও প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের মধ্যে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ কর্তৃক নির্মিত ওয়াসিত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উমাইয়া বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
আবদুল মালিককে নিঃসন্দেহে উমাইয়া খিলাফতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। গৃহযুদ্ধ দমন করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়, কেন্দ্রীয় শাসনের প্রবর্তনে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের অবসান, শাসনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দ্বারা সংগঠন, সংহতি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা দ্বারা তিনি উমাইয়া বংশের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। মুয়াবিয়া উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, অসীম কর্মদক্ষতা, ধৈর্য, জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আবদুল মালিক উমাইয়া বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফার মর্যাদা লাভ করেন। জাতীয়তাবাদী আদর্শ স্থাপন করেন হযরত ওমর। কিন্তু খালিফা আবদুল মালিক আরবি ভাষাকে রাষ্ট্রীয়করণ করে আরব জাতীয়তাবাদকে সুদূরপ্রসারী করেন। এর ফলে আরবি কৃষ্টি ও সভ্যতার উন্মেষ হয়। জাতীয় টাকশাল স্থাপনে স্বতন্ত্র মুসলিম মুদ্রা প্রবর্তনের পথ সুগম হয়। স্থাপত্য শিল্পে তাঁর অবদান অবিস্মরনীয় হয়ে রয়েছে। উপরন্তু, আবদুল মালিককে ‘রাজেন্দ্র’ (Father of Kings) বলা হয়। কারণ তাঁর চার জন সুযোগ্য পুত্র প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫ খ্রি.), সুলায়মান (৭১৫-৭১৭ খ্রি.), দ্বিতীয় ইয়াজিদ (৭২০-৭২৪ খ্রি.) এবং হাশিম (৭২৭-৭৪৩ খ্রি.) পরবর্তীকালে উমাইয়া খলিফা হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। হিট্টি বলেন, “আবদুল মালিক এবং তাঁর উত্তরাধিকারী চার পুত্রের শাসনকালে দামেস্কের রাজবংশ শৌর্যবীর্য এবং গৌরবের চরম শিখরে পৌঁছায়।”