ধর্মপ্রচারে বিরোধিতা
১. ধর্মপ্রচারে বিরোধিতার সূত্রপাত : তথাকথিত শয়তানের বাণী (স্যাটানিক ভার্সেস)
মক্কায় গোপনীয়ভাবে অথবা প্রকাশ্যে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচার মোটামুটিভাবে সফল হয়েছিল। কিন্তু পৌত্তলিকতার প্রতি ইসলামের চরম আঘাতের ফলে স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মক্কাবাসী, প্রধানত কুরাইশগণ, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারে প্রচণ্ড বাধা-বিঘ্ন, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। এই বিরোধিতা এক সময় নিপীড়ন, নির্যাতন ও উৎপীড়নের পর্যায়ে পড়ে। বিরোধী কুরাইশ বিরোধিতার আলোচনা করতে হলে দুটি বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমত, কখন এবং কিভাবে বিধর্মীদের এই উৎপীড়ন শুরু হলো? তা বিচার বিশ্লেষণ করা; দ্বিতীয়, এই প্রতিবন্ধকতার মূল কারণসমূহ যাচাই করা।
(ক) উরওয়ার চিঠি : আত-তাবারী তাঁর গ্রন্থে একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ চিঠির উল্লেখ করেছেন, যাতে জাহেলিয়া যুগের পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা যায়।
উরওয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে হিশাম-বিন-উরওয়া বর্ণনা করেন যে তিনি উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের (হি. ৬৫-৮৬/৬৮৫-৭০৫ খ্রি.) নিকট পত্র দেন। এই পত্রে উল্লেখ আছে, “আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবী (স) যখন তাঁর গোত্রের সদস্যদের একশ্বেরবাদে বিশ্বাসের জন্য প্রথম আকুল আহ্বান জানান, যা ছিল তাঁর জীবনের আরাদ্ধ কাজ, তখন তারা (গোত্রীয় সদস্যগণ) তাঁর [হযরত মুহাম্মদ (স)] প্রতি বিমুখ ছিল না (অর্থাৎ বিরোধিতা করে নি)। কিন্তু যখন তিনি তাদের পৌত্তলিকতাকে (তাওয়াগিত) নিন্দা করলেন তখন তারা তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকে। আত-তায়েফে, যেখানে দেব-দেবীর মন্দির ছিল, বসবাসকারী কয়েকজন বিত্তশালী কুরাইশ মক্কায় এসে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরোধিতা করতে শুরু করে। তারা তাওহীদের বাণীকে বর্জন করে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করে। এভাবে বিধর্মী কুরাইশদের প্ররোচনায় এবং প্রতিবন্ধকতায় অধিকাংশ মক্কাবাসী নবীকে উপেক্ষা এবং উৎপীড়ন করতে থাকে। এর ফলে আল্লাহর কৃপায় এই কয়েকজন মুষ্টিমেয় মুসলমান মক্কায় বসবাস করছিলেন তাঁরা নির্যাতনের শিকার হন। আল্লাহর উপর নির্ভর করে নব-দীক্ষিত স্বল্প সংখ্যক মুসলমান অমানুষিক নির্যাতন ও দৈহিক অত্যচার সহ্য করে যান। এরপর বিধর্মীগণ পরামর্শ করতে থাকে কিভাবে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের পুনরায় তাদের পৌত্তলিকতার বিশ্বাসে ফিরিয়ে আনা যায়। এই ঘৃণ্য কাজ হচ্ছে প্ররোচনা (ইয়াফতিনু) ও প্রলোভনের মাধ্যমে তাঁদের (নব-দীক্ষিত মুসলমান) পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরিয়ে আনা। এই নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ বিধর্মী মক্কাবাসীদের ভাই, ছেলে এবং গোত্রীয় সদস্য ছিল। যারা আল্লাহ এবং রাসূলের ওপর বিশ্বাস এনেছিল (‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’), তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে বিধর্মী কুরাইশগণ, যা ‘ফিতনাহ’ নাম অভিহিত। এর ফলে অনেক দীক্ষিত মুসলমান বিভ্রান্ত হয়ে বিধর্মীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বিপথগামী হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান অত্যাচার সহ্য করেও তাঁদের ঈমান নষ্ট করেন নি। মুসলমানগণ এভাবে নির্যাতিত হতে থাকলে হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে নির্দেশ দেন। আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান রাজা নাজ্জাসী খুবই সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাঁর রাজ্যে কোন অধর্ম ও অমানবিক কাজ হতো না। তিনি সুবিবেচক ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। কুরাইশগণ বহু যুগ ধরে আবিসিনিয়ার (রাণী সেবার সময়) সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ছিল। আবিসিনিয়ায় পর্যাপ্ত রসদ-পণ্য পাওয়া যেত, সেখানে নিরাপত্তা ছিল এবং এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়। কুরাইশদের অত্যাচার (‘ফিতনাহ’) থেকে রক্ষা পাবার জন্য রাসূল (স) মুসলমানদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বললে তাঁরা দলে দলে সেখানে চলে যান। হযরত মুহাম্মদ (স) তাদের নির্যাতন, অত্যাচার ও বর্বরোচিত আচরণ উপেক্ষা করে ধর্ম প্রচার অব্যাহত গতিতে করতে থাকেন। এর ফলে অমানুষিক নির্যাতন সত্ত্বেও বিধর্মী কুরাইশগণ ইসলামে দীক্ষা লাভ করতে থাকেন। এদের মধ্যে মক্কার ধনাঢ্য ও অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকও ছিলেন।”
উরওয়ার চিঠিতে বর্ণিত ঘটনাবলি থেকে তিনটি বিষয় অনুধাবন করা যায় : (ক) পৌত্তলিকতা বিরোধী বাণী নাজিল এবং একেশ্বরবাদী মতবাদ প্রচারের আত্মপ্রত্যয়, (খ) আত-তায়েফে সম্পত্তি অধিকারী কতিপয় কুরাইশ মক্কায় এসে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধে ইসলাম প্রচারে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, (গ) উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে নবী করিম (স) তাঁর সাহাবীদের আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণের নির্দেশ দেন। শেষের দুটি মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হলেও প্রথমটি সম্বন্ধে মতানৈক্য রয়েছে। নলডেকে এবং রিচার্ড বেল, এমন অনেক সূরার উল্লেখ করেন যাতে অবতীর্ণের তারিখ অনুযায়ী পৌত্তলিকতা বিরোধী মন্তব্য, যা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনের ব্রত ছিল, কুরাইশদের উৎপীড়নের পূর্বে পাওয়া যায়। বস্তুত মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোতে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। উরওয়া প্রকৃত অত্যাচার-উৎপীড়নের (৬১০-২২ খ্রি.) ঘটনার সত্তর বছর পরে পত্র লিখেন এবং বলেন যে, বিধর্মী কুরাইশসহ আরবদের পৌত্তলিকতা বিরোধী আন্দোলনের ফলেই পৌত্তলিকগণ নব-দীক্ষিত মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে শুরু করে এবং শারীরিক নির্যাতনেও তারা দ্বিধা করে নি। তারা নবীকে (স) প্রলোভন দেখিয়েছে এবং মক্কার তৎকালীন শাসনকর্তা আবু তালিবের কাছে প্রতিবাদ করে এ কথা বলে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) যেন তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে হস্তক্ষেপ না করেন। কিন্তু নবী করিম (স) দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে বলেন ‘হে তাতঃ। এরা (বিধর্মী কুরাইশগণ) যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তা হলেও আমি মহাসত্যের (একশ্বরবাদ) সে প্রচার এবং আল্লাহর আদিষ্ট কর্তব্য থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হব না।” ধারণা করা হয় (যা সত্য নাও হতে পারে) যে, সূরা নাজমে তথাকথিত শয়তানের বাণীতে (স্যাটনিক ভার্সেস) মূর্তির কথা (আল-লাত, আল-মানাত এবং উজ্জা) বলা হয়েছে (পরে আলোচিত হয়েছে)। তাহলে মনে করা যেতে পারে মক্কায় বিধর্মী কুরাইশদের আত-তায়েফের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আল-লাতকে অন্যান্য দেব-দেবীর অপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আত- তায়েফের অধিবাসীদের মক্কাবাসীর সমতুল্য সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হলে তারা (বিধর্মী মক্কাবাসীগণ) ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। যাহোক, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কুরআনে মূর্তিপূজা বিরোধী সূরা অবতীর্ণ হবার পর বিধর্মী ও বর্বর কুরাইশগণ নব–দীক্ষিত মুসলমানদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করতে শুরু করে। উরওয়ার চিঠি থেকে জানা যায় যে, আত-তায়েফে ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে অথবা অবসর বিনোদনের জন্য মক্কার কতিপয় কুরাইশ বসবাস করত।
(খ) শয়তানের ‘তথাকথিত বাণী’ : সত্য ঘটনা : মক্কায় অবতীর্ণ সূরা নাজমের (৫৩) ১৯ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে তিনটি দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়- আল-লাত, আল- উজ্জা এবং আল-মানাত। এ প্রসঙ্গে আত-তাবারী, যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাজিল হয়েছিল তা বর্ণনা দেন। আত-তাবারী বলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স) যখন দেখলেন যে, বিধর্মী কুরাইশগণ তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলামে বিশ্বাস স্থাপন করছে না, তখন তিনি কিভাবে তাঁর একেশ্বরবাদের বাণী গ্রহণযোগ্য করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। এমন সময় সূরা নাজম অবতীর্ণ হয়। সূরা নাজমের (৫৩) ১৯ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
“তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল-লাত ও আল-উজ্জা সম্বন্ধে, এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?
তোমরা কি মনে কর যে, পুত্র সন্তান তোমাদের জন্য এবং কন্যা সন্তান আল্লাহর জন্য?”
হযরত মুহাম্মদ (স) যখন “তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল-লাত ও আল-উজ্জা সম্বন্ধে এবং তৃতীয় একটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে” উচ্চারণ করলেন তখন হাদিস ও আত- তাবারীর মতে শয়তান তার ওপর প্রভাব ফেলে তার মুখ দিয়ে “এগুলো মহান রাজহাঁসের মতো যাদের মধ্যস্থতা বিশেষভাবে কাম্য।” এ কথা শুনে বিধর্মী পৌত্তলিক মক্কাবাসী খুবই খুশী হল। এ সূরা অবতীর্ণ হবার পর হযরত মুহাম্মদ (স) কা’বা শরীফে যখন সিজদা করলেন তখন তাঁর সাথে পৌত্তলিক কুরাইশগণও সিজদা করে। এই ঘটনার কথা আবিসিনিয়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী মুসলমানগণ শূনতে পেলেন। এ সূরা নাজিলের কিছুক্ষণ পর ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে আসেন এবং তাঁর ভুল সংশোধন করে দেন। এর ফলে হযরত মুহাম্মদ (স) স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। মহান আল্লাহ সূরা হাজ্জের (২২) ৫২ নম্বর আয়াতে ভুল সংশোধন করেন-
“আমি তোমার পূর্বে যে সমস্ত রাসূল কিংবা নবী প্রেরণ করেছি তাঁদের কেউ যখনই কিছু আকাঙ্ক্ষা করেছে তখনই শয়তান তার আকাঙ্ক্ষাতে কিছু প্রক্ষিপ্ত করেছে। কিন্তু শয়তান যা প্রক্ষিপ্ত করে আল্লাহ তা দূর করেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
এ ধরনের যখন পরিবর্তন সাধিত হলো তখন বিধর্মী কুরাইশগণ বলল যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মতিভ্রম হয়েছে। যাহোক, শয়তানের তথাকথিত বাণী বিধর্মী পৌত্তলিক কুরাইশদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সূরা হাজ্জের (২২ : ৫২ নম্বর আয়াতের পূর্বে যা উদ্ধৃত হয়েছে, ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আত-তাবারী কয়েকটি হাদিসের উল্লেখ করেন। যে দুটি হাদিস আবুল আলীয়া বর্ণনা করেন তার একটি হচ্ছে : “কুরাইশগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বলল, ‘আপনার সাথে যারা বসে আছে তারা তো আপনার দাস এবং মক্কেল। আপনি যদি আমাদের দেবদেবীর কথা বলতেন তাহলে আরব বংশোদ্ভুত অভিজাত শ্রেণী (যাযাবর রেদুঈন এবং শহরবাসী ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ) আপনার উম্মত হতো; আমরাও আপনার সাথে বসতাম। এর ফলে আপনার জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ত। এমন সময় শয়তান ইবলিশ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উচ্চারিত আল্লাহর বাণীতে কিছু প্রক্ষিপ্ত করে। নবী যখন বললেন, “তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল-লাত এবং আল-উজ্জা সম্বন্ধে এবং তৃতীয় একটি মানাত সম্বন্ধে”? এ সময়ে শয়তান তার [হযরত মুহাম্মদ (স)] জিহ্বা দিয়ে তার বিকৃত বাণী প্রচার করল। “এগুলো মহান রাজহাঁসের মতো যাদের মধ্যস্থতা কাম্য এবং যাদের কথা কখনোই ভুলা যায় না।” এক আয়াত পড়া শেষ হলে নবী করিম (স) মুসলমান ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সিজদা দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, শয়তান চালাকি করে তার উচ্চারিত আয়াতের মধ্যে তার বাণী প্রক্ষিপ্ত করেছে তখনই আল্লাহর কাছ থেকে সংশোধন বাণী নাজিল হয়, যা সূরা হাজ্জের ৫২ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
আবুল আলীয়ার আর একটি বর্ণিত হাদিসে একই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ হাদিসে “তৃতীয় একটি মানাত সম্বন্ধে” বাক্যটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ হাদিসে বলা হয়েছে যে, বার্ধক্য হেতু কোন কোন অভিজাত কুরাইশ সিজদা দেন নি বরং মাটি থেকে ধুলো নিয়ে কপালে দেন। অপর একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে, আবু উহায়া সাঈদ বিন আল-আস হযরত মুহাম্মদ (স) সম্বন্ধে কটুক্তি করেন। তিনি বলেন, “অবশেষে ইবনে-আবি কাবশাহ [হযরত মুহাম্মদ (স)] আমাদের উপাস্য দেবীদের সম্বন্ধে ভাল মন্তব্য করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সম্বন্ধে এ ধরনের রূঢ় ও তীর্যক মন্তব্য আরও অনেক হাদিসে রয়েছে। সুতরাং আবু উহায়ার মন্তব্য সঠিক বলা যায়।
প্রাক-ইসলামী বা জাহেলিয়া যুগের পৌত্তলিক আরবদের উপাস্য দেবী আল-লাত, আল-মানাত ও আল-উজ্জাকে ভুলবশতঃ “আল্লাহর কন্যা” (Daughters of Allah) বলে অভিহিত করা হয়েছে। সূরা নাজমে (৫৩-১৯-২১) বলা হয়েছে :
“তোমরা কি মনে কর পুত্র সন্তান তোমাদের জন্য এবং কন্যা সন্তান আল্লাহর?” এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন হাদিসে সে বর্ণনা পাওয়া যায় তার পটভূমি, উদ্দেশ্য ও প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করার পর দুটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। প্রথম হযরত মুহাম্মদ (স) অসাবধানবশত শয়তানের প্ররোচনায় কিছু শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন যা তিনি মনে করেছিলেন ঐশীবাণী। অন্যথায় সূরা হাজ্জের (২২) ৫৩ আয়াতে সংশোধনীর কথা বলা হত না। একথা বলা যথার্থ হবে না যে, পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমান হাদিসবেত্তাগণ আরোপিত বলে মনে করেন। অথবা বিদ্বেষী অমুসলমানগণ রাসূলের ওপর এই শয়তানের বাণী চাপিয়ে দেন। দ্বিতীয়ত, সম্ভবত ভূল বুঝতে পেরে হযরত মুহাম্মদ (স) পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষণা দেন যে, শয়তান প্ররোচিত বাণীগুলো প্রকৃতপক্ষে কুরআনের বাণী নয় এবং এগুলো প্রকৃত, মৌলিক ও অকৃত্রিম বাণী দিয়ে পরিবর্তিত করার প্রয়োজন বোধ করেন। সূরা নাজমে শয়তানের প্ররোচনায় যে শব্দগুলো উচ্চারিত হয়েছিল তা কতদিন, সপ্তাহ বা মাস পরে সূরা হাজ্জের আয়াত দ্বারা সংশোধিত বা বর্জিত হয়েছিল। তা সঠিকভাবে বলা যায় না।
উপরোল্লিখিত দুটি মন্তব্য ছাড়াও তৃতীয় যে মন্তব্য করা যায় তা হচ্ছে যে, সূরা নাজমের (৫৩) ১৯ থেকে ২০ আয়াতে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর মক্কায় বসবাসকারী উম্মতদের তিনটি অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল আত-তায়েফের পৌত্তলিকদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আল-লাত; দ্বিতীয়টি মক্কার অদূরে নাখলার মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী দেবী আল-উজ্জা। তৃতীয় দেবীর নাম মানাত, যার মন্দির মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। মদিনার পৌত্তলিকগণ মানাতের উপাসনা করত। আল-উজ্জা কুরাইশ বংশের ধর্মীয় সম্প্রদায় বনু সুলাইমা কিনানাহ, হাওয়াজিন, তাকিফ এবং খুজার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিল। আল-কালবী তার ‘কিতাব-আল আসনামে’ বলেন যে, মদিনার পৌত্তলিক অভিজাত সম্প্রদায়ের ঘরে মানাতের কাঠের মূর্তি থাকত। ধারণা করা যায় যে, সামগ্রিকভাবে জাহেলিয়া যুগে পৌত্তলিক আরবেরা নিয়মিতভাবে তাদের দেব দেবীর মূর্তির পূজা করত না; ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সময় বছরের নির্দিষ্ট দিনে এ সমস্ত দেবীর মন্দিরে পূজা-অর্চনা করত। Blessed Virgin Mary-র যে ভাবে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে উপাসনা প্রচলিত ছিল প্রাক-ইসলামী যুগে দেব-দেবীর আরাধনা সেভাবে হতো বলে মনে হয় না। উপরন্তু, আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাতের মন্দির থাকায় কেবলমাত্র দেবলায়েই উপাসনা করা হত। এ কারণে শয়তানের ‘তথাকথিত বাণী’ অনুযায়ী এ সমস্ত অধিষ্ঠাত্রী দেবী মধ্যস্থতা করতে পারে। ওয়াট এখানে বলেন যে, সূরা হাজ্জের (২২ : ৫২) যে আয়াতে সূরা নাজমের আয়াতের (৫৩ : ১৯-২০) সংশোধন করা হয়েছে (শয়তান যা প্রক্ষিপ্ত করে আল্লাহ তা দূর করেন) এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় না, আবরদেশ থেকে পৌত্তলিকতা দূরীভূত হয়েছে। উপরন্তু ওয়াট বলেন যে, মক্কার বাইরে অবস্থিত (আত-তায়েফ, নাখলা এবং মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থান) মন্দিরের উপাসনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। কা’বার দেব-দেবীর (৩৬০টি) কথা বলা হয়নি। অবশ্য জানার উপায় নেই যে, কাবার দেব-দেবীর উপাসনাকে ধিক্কার দিয়ে কোন আয়াত নাজিল হয়েছিল কিনা অথবা হলেও তা খণ্ডন বা বর্জন (abrogate) বলা হয়েছিল কি না। সুতরাং সূরা নাজমে যেহেতু মক্কার উপাসনালয় ( Sanctuary) সম্বন্ধে কিছু বলা হয় নি। সেহেতু ধরা যায় যে, এই সূরায় অন্যান্য মন্দিরের দেবীদের ধিক্কার দিলেও কা’বার দেবালয় সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করা হয়নি। কা’বাঘরের পবিত্রতা সম্বন্ধে সূরা হাজ্জের (২২) ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
এবং স্মরণ কর যখন আমি (আল্লাহ) ইব্রাহিমের জন্য স্থির করে দিয়েছিলাম কাবাঘরের স্থান, তখন বলেছিলাম আমার সাথে কোন শরীক স্থির কর না এবং আমাদের পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাতে দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে।”
(গ) শয়তানের ‘তথাকথিত বাণী’ : উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যা : পাশ্চাত্যে পণ্ডিত বা ঐতিহাসিকদের বিবর্তবাদ বা ক্রমবিকাশের ওপর কোন প্রকার আস্থা না থাকায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রথম থেকেই গোঁড়া ইসলামী ধর্মতত্ত্বে গভীর জ্ঞান ছিল। কিন্তু তারা পরবর্তী পর্যায়ে ইসলাম বিরোধী মতবাদ বিশেষ করে শয়তানের তথাকথিত বাণী’ উচ্চারণের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে নি সত্য কথা হচ্ছে, প্রথম দিকে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন ঐশীবাণী লাভ করেন তখন এক অদ্বিতীয় ও মহান আল্লাহর ওপর ভিত্তি করে একেশ্বরবাদী মতবাদ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা ছিল না- এই ধারণা আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মাধ্যমে হয়েছিল এবং পৌত্তলিকতা বিরোধী মতবাদ যখন দানা বাঁধে তখনই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে পৌত্তলিক কুরাইশদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। এই পর্যায়ে সম্ভবত মহান সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পাশাপাশি অন্যান্য দেবদেবীদের স্থান দেন (যা শিরকের পর্যায়ে পড়ে) একথা ভেবে যে, তারা ফেরেশতা বা জ্বীন। অবশ্য তাদের স্থান ছিল মহান আল্লাহর অনেক নিচে। ইহুদী ও খ্রিস্টানগণ যেমন ফেরেশতার (angel) অস্তিত্ব স্বীকার করেন তেমনি হয়ত হযরত মুহাম্মদ (স) আল-লাত, আল-উজ্জা এবং মানাতকে এক প্রকার ফেরেশতা বা জ্বীন মনে করতেন। সূরা আন’আমের (৬) ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
“তারা জ্বীনকে আল্লাহর শরীক করে। অথচ তিনিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারা অজ্ঞানতাবশত আল্লাহর প্রতি পুত্র-কন্যা (আল-লাত, আল-উজ্জা, আল-মানাত) আরোপ করে। তিনি মহিমান্বিত ও পবিত্র; তারা যা বলে তিনি তার ঊর্ধ্বে।”
মক্কায় শেষ পর্বে অবতীর্ণ সূরা আন’আমে তাদের জ্বীন বললেও মদিনায় অবতীর্ণ সূরা নাজমের (৫৩) ২২ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
“এ প্রকার বণ্টন তো (পুত্র-কন্যা) অসংগত বণ্টন। এগুলো (আল-লাত, আল- উজ্জা ও মানাত) কতক নামমাত্র, যা তোমাদের পূর্বপুরুষগণ ও তোমরা রেখেছ, যার সমর্থনে আল্লাহ কোন দলিল প্রেরণ করেন নি। তারা তো অনুমান এবং নিজদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে যদিও তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের পথনির্দেশ এসেছে।”
সুতরাং আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাত প্রসঙ্গে শয়তান ধোঁকা দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মুখ থেকে ঐশীবাণী হিসেবে প্রকাশের চেষ্টা করা অবাস্তব ও নিরর্থক। কারণ, তারা (আল্লাহর তথাকথিত কন্যা) আল্লাহর সমকক্ষ হতে পারে না। তাদেরকে অহেতুক ‘পাখি’ ‘রাজহাঁস’ বলা হয়েছে, যাদের মধ্যস্থতা করার কোন ক্ষমতাই নেই, তাদেরকে জ্বীন-ফেরেশতা বলে অভিহিত করা হয়, যদিও তারা তা নয়। কারণ কুরআনে যাদেরকে ফেরেশতা বা জ্বীন বলা হয়েছে (জীবরাঈল, মিকাঈল, ইসরাফিল, আযরাঈল ফেরেশতা অথবা জ্বীন হিসেবে পরিচিত ‘হুদহুদ’, ‘ইফরিত’) তাদের তালিকায় আল্লাহর তথাকথিত কন্যাদের নাম নেই। শয়তানের তথাকথিত বাণী” ঐশ্বরিক বা ঐশীবাণী নয় এবং এ কারণে একেশ্বরবাদী বিশ্বাসে (তাওহীদ) তা কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে নি। হযরত মুহাম্মদ (স) যদি অবচেতন মনে এ ধরনের কোন বাক্য উচ্চারণ করেই থাকেন তা পরবর্তীকালে সংশোধিত হয়েছে, যা পূর্বে বলা হয়েছে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে “শয়তানের তথাকথিত বাণী” ফলপ্রসূ না হলেও, রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। প্রশ্ন থাকে, তিনি কি সচেতনভাবে আল-লাত, আল-মানাত, আল-উজ্জার এবং তাদের উপসনালয়ের উল্লেখ করেছেন? তিনি কি তায়েফ এবং মদিনার পৌত্তলিকদের মধ্য থেকে নব-দীক্ষিত মুসলমান পেতে চেয়েছিলেন? তিনি কি কা’বা মনিদএরর সেবায়েতদের প্রভাব ক্ষুণ্ন করে মক্কার বাইরের পৌত্তলিকদের দৃষ্টি আকর্ষণেল চেষ্টা করেন? এ কথা সত্য যে, মক্কার বিধর্মীগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারে প্রচণ্ড বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
আবু আলীয়া বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায় যে, পৌত্তলিক কুরাইশগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-কে তাঁর ধর্মপ্রচার থেকে নিবৃত্ত করার জন্য নানা ধরনের প্রলোভন দেয়। তারা বলে যে, যদি তিনি তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীদের স্বীকার করেন তাহলে তাকে মক্কার অভিজাত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করবে। অন্যান্য হাদিস থেকে জানা যায় যে, পৌত্তলিকগণ তাকে ধন-সম্পদ, সুন্দরী নারী, সমাজে উচ্চস্থান দিতে চেয়েছিল। তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে তাদের ধর্মীয় ও বীণজ্যিক কর্মকাণ্ডেও সামিল করার প্রলোভন দেখায়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে বিশদ আলোচনা না করে এই মন্তব্য করা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স)- এর কৃতিত্বকে সমুজ্জ্বল করার জন্য এ সমস্ত ঘটনা বানিয়ে বলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠে, তখন কি হযরত মুহাম্মদ (স) এমন ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়েছিলেন যে, বিধর্মী ও কুচক্রী কুরাইশগণ তাঁকে এমন সব প্রস্তাব দিবে? মোটামুটিভাবে বিচার করলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, হাদিসে বর্ণিত ঘটনাবলি সত্য। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মৃত্যুর (৬৩২ খ্রি.) সত্তর বছর পরে (৭০২ খ্রি.) আবুল আলিয়ার হাদিসে এ সমস্ত ঘটনা বর্ণিত হলেও নবীর সম-সাময়িক ইতিহাস না থাকায় সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাহাবীদের বংশধররা যদি নবীর কাহিনী লিপিবদ্ধ করতেন তাহলে নবী (স) সম্বন্ধে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেত। যাহোক, আবুল আলিয়ার তথ্য থেকে, যা তাবারী উদ্ধৃত করেন, জানা যায় যে, তিনি ধর্মপ্রবর্তক হিসেবে সাফল্য অর্জন করেন এবং মক্কার পৌত্তলিকরা তাকে যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা ও সমীহ করত (আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসেবে)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, যদি শয়তানের তথাকথিত বাণী সত্য হতো তাহলে তা শিরক হতো এবং হযরত মুহাম্মদ (স) যদি পৌত্তলিকতার প্রতি সহানুভূতিশীল হতেন তাহলে বিধর্মী মক্কাবাসীরা দলে দলে ইসলাম কবুল করত। এর ফলে হিজরতের প্রয়োজন হতো না এবং বছর, উহুদ, খন্দকসহ বিভিন্ন যুদ্ধ মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতো না। মক্কীবাসীদের প্রলোভনে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হন নি। তিনি কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভ করেন নি; বরং তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ নির্যাতন ভোগ করেছেন। দেব-দেবীর প্রতি কোন প্রকার দুর্বলতা হযরত মুহাম্মদ (স) কখনো প্রদর্শন করেন নি এবং যদি তিনি তাদের প্রসঙ্গে শয়তানের প্ররোচনায় কিছু বলে থাকেন তা বর্জিত হয়েছে ঐশীবাণীর মাধ্যমে।
সূরা নাজমের আয়াত শয়তান প্ররোচিত বলে মনে হয় সে আয়াত বাতিল হয়েছে এবং বাতিলের ফলে প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে পৌত্তলিকদের কোন সমঝোতা হয়নি। অবশ্য মক্কার পৌত্তলিকগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে যে ধোঁকাবাজী করেছিল তাও প্রমাণিত হয়নি। এটি ছিল শয়তান ইবলিসের কারসাজি। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন যে, আল্লাহর তথাকথিত কন্যাত্রয় আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাত, যাদের এক কথায় ‘বানাতে-আল্লাহ’ বলা হয়ে থাকে, ওদের স্বীকৃতি দিলে মহান, মহিমাণ্ডিত, প্রতিপালক, সর্বশক্তিমান, সর্বজনীন, সর্বত্র বিরাজমান ও অন্তঃযামী আল্লাহ্র মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। পৌত্তলিকদের নিয়ে মক্কার কা’বায় মুহাম্মদের ইবাদত গুরুত্বপূর্ণ হলেও অন্যান্য মন্দিরে যেমন তায়েফ, নাখলা এবং কুদায়েদ, পৌত্তলিকদের উপাসনার সাথে কোন প্রভেদ নেই। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের সাথে মন্দিরের পুরোহিতদের কোন প্রভেদ নেই। উপরন্তু, এ সমস্ত পুরোহিতদের অপেক্ষা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রভাবও তেমন কিছু বেশি নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে মহানবীর ধর্মপ্রচার বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। মক্কায় পৌত্তলিকদের সাথে একত্রে ইবাদত করায় নানারকম জটিলতা ও সমস্যা দেখা দিল। এ জন্য কোন রাজনৈতিক ও জাগতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং নিছক মৌলিক ধর্মীয় কারণে হযরত মুহাম্মদ (স) পৌত্তলিক কুরাইশদের সমস্ত প্রস্তাব ও প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যান এ কারণে ছিল না যে, তিনি তাদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না, বা তাদের উপর বিশ্বাস ছিল না; অথবা রাসূলের কোন ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। এর প্রধান কারণ যে ‘বানাতে-আল্লাহ’কে স্বীকার করলে, তা হবে শিরক এবং তার ফলে তার ধর্মপ্রচার সফল হবে না। উপরন্তু, মহান আল্লাহ তাঁকে যে উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন তা ব্যর্থ হবে। মক্কায় যে ঘটনা ঘটেছিল সে প্রসঙ্গে মক্কায় অবতীর্ণ সূরা নামে (৫৩) উল্লেখ আছে এবং শয়তানের প্ররোচনায় যে বাক্য উচ্চারিত হয় তা মদিনায় অবতীর্ণ সূরা হাজ্জের (২২) অন্য আয়াতে পরিত্যাজ্য হয়। কিন্তু এই দুই সূরার মধ্যে সময়ের কত ব্যবধান ছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না।
যদি মক্কায় অনুষ্ঠিত ইবাদতের ঘটনা নিরপেক্ষভাবে বিচার করা যায় তাহলে প্রতীয়মান হবে যে, ঈশ্বরিক জ্বীন বা ফেরেশতা হিসেবে আল-লাতকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ফেরেশতা হতে পারে না। কারণ ফেরেশতা বা জ্বীন আলো, নূর অথবা ‘নার’ বা আগুন থেকে তৈরি; অন্যদিকে আল-লাত চতুষ্কোণাকৃতি প্রস্তর খণ্ড। উপরন্তু, সূরা আন-নাজমে পূর্বে উল্লিখিত আল্লাহর সাথে জ্বীনের তুলনা করা যাবে না-ওয়াটের এই মন্তব্য সঠিক নয়। হিব্রু, খ্রিস্টান এবং ইসলামে ফেরেশতা সম্বন্ধে সুষ্ঠুভাবে উল্লেখ আছে এবং এই ধ্যান-ধারণা মোটেই কার্যকরী হয় নি। এর মূলে দুটি কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, মক্কার পবিত্র কা’বাঘরে, যা প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে হাজ্জ পালনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়, ৩৬০টি বিগ্রহ থাকলেও ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পরে পৌত্তলিকদের অবসান ঘটে এবং ৩৬০টি বিগ্রহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কা’বাকে পবিত্রকরণ করে আল্লাহর ঘরে রূপান্তরিত করা হয়। সুতরাং পৌত্তলিকদের নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কা’বাঘরে একত্রে ইবাদতের প্রশ্নই আসে না। মক্কায় একত্রে ইবাদতের মত অন্যান্য মন্দিরে-তায়েফ, নাখলা এবং কুদায়েদ-যদি ইবাদত হতো তাহলে হিজাজের আভিজাত্যে আঘাত আসত। মক্কার কা’বার পৌরহিত্যকারী আবু সুফিয়ান ও তার গোষ্ঠী এতে অপমান বোধ করত এ কথা ভেবে যে, তাদের ৩৬০টি বিগ্রহ আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাতের দেবীর সমতুল্য। দ্বিতীয়ত, আল- লাতকে ফেরেশতা হিসেবে গণ্য না করার অনেক কারণ আছে। যদিও আক্ষরিক অর্থে গ্রহণযোগ্য নয় (যেহেতু তিনি সৃষ্টি করেন কিন্তু জাত নন) তবুও ‘বানাত-আল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর কন্যা’ বলতে রূপক অর্থে অনেক কিছু বুঝায়, যদিও সূরা নামে বলা হয়েছে : “তোমরা কি মনে কর, পুত্র সন্তান তোমাদের জন্য এবং কন্যা সন্তান আল্লাহর জন্য?” ‘বানাত’ অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে : ‘যেমন ‘বানাত-আস-সাফা’ অর্থাৎ ‘কন্যার ঠোঁট’, ‘বানাত আল-আইন’ অর্থাৎ ‘কন্যার চোখ’, ‘বানাত আত-দোহাক’ অর্থাৎ ‘কন্যার ভাগ্য’ ইত্যাদি। শেষের অর্থ অনুধাবন করলে আল-লাতকে আলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে হবে। তাছাড়া, ‘লাত-আল-লাহ’ যার অর্থ ঈশ্বর থেকে উদ্ভূত। অনেকে মনে করেন যে, ‘আল-লাহ’ থেকে ‘আল্লাহ’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। এর মূল শব্দ হচ্ছে আল-ইলাহ। হেরোডোটাস লাতকে ‘আলি-লাত’ বলেছেন। তবে প্রাক-ইসলামী যুগে ব্যবহৃত আল-লাহ বা আল-ইলাহা দ্বারা কোন অঞ্চলের দেবতাকে বুঝাতো। কিন্তু কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, যার কোন শরিক নেই, যা একেশ্বরবাদী বিশ্বাসের মূল স্তম্ভ।
মক্কায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের (পৌত্তলিক) সাথে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর যে সম্পর্কচ্ছেদ হয় কা’বায় ইবাদতের ঘটনার পর তার সাথে শয়তান প্ররোচিত তথাকথিত বাণীর বাতিল ঘোষণার যোগসূত্র রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উরওয়ার পত্রে উল্লেখ আছে, মক্কার ধনাঢ্য পরিবারদের তায়েফে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার হলে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড হ্রাস পেতে থাকে। নবী করিম (স) ধর্মপ্রচারে তায়েফ গিয়ে অপমানিত হন এবং পাথরের আঘাতে শহর থেকে বিতাড়িত হন। কুরাইশদের স্বার্থপরতা ও অর্থলিপ্সা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরোধিতা করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে জড়িত ছিল। তায়েফে আল-লাতের মন্দিরের প্রাধান্য লোপ পেতে থাকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারের ফলে। এ কারণে কুরাইশদের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়।
উরওয়ার পত্রে ‘বানাত-আল্লাহ’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল যে, তাদের স্বীকৃতি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিধর্মী কুরাইশ গোত্রের নেতাদের মধ্যে বেশ টানাপোড়েন হয়। অর্থাৎ শয়তানের প্ররোচনায় হযরত মুহাম্মদ (স) তাদের উল্লেখ করলেও কুরআনের বাণী দিয়ে তা খণ্ডন করা হয় (পূর্বে বলা হয়েছে)। শয়তানের তথাকথিত বাণী প্রসঙ্গে কুরআনের দুটি সূরায় উল্লেখ আছে, যাতে বলা হয়েছে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) শয়তানের প্ররোচনার সম্মুখীন হন। প্রথমটি সূরা বাণী ইসরাঈলের (১৭) ৭৫ থেকে ৭৭ আয়াতে বলা হয়েছে—
“তুমি ঝুঁকে পড়লে (প্রলুব্ধ হলে) অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে দ্বিগুণ ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি আস্বাদন করাতাম। তখন আমার বিরুদ্ধে তোমার জন্য কোন সাহায্যকারী পেতে না।”
“তারা তোমাকে দেশ থেকে উৎখাত করবার চূড়ান্ত চেষ্টা করেছিল, তোমাকে সেখান থেকে বহিষ্কার করার জন্য। তাহলে তোমার পর তারাও সেথায় স্বল্পকালই টিকে থাকত।”
“আল্লাহ বলেন, রাসূলগণের মধ্যে তোমার পূর্বে যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রেও ছিল এরূপ নিয়ম এবং তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না।”
এই সূরার আয়াতে স্পষ্টভাবে ঘটনা সম্বন্ধে কিছু বলা হয় নি, কিন্তু ‘ঝুঁকে পড়া’র উল্লেখ ধারণা করা হয় যে, কোন এক পর্যায়ে নবী শয়তানের প্ররোচনায় পড়েছিলেন। পয়গম্বর যে বহুবার শয়তান ইবলিসের দ্বারা প্রভাবিত ও মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন তার উল্লেখ কুরআনের বুহু সূরায় পাওয়া যাবে। হযরত ইব্রাহিম (আ) যখন স্বীয়পুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী দিতে যাচ্ছিলেন তখন শয়তান তাঁকে বাধা দেয় এবং যে যে স্থানে তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন সেখানে মক্কার অদূরে জামারাতে প্রস্তরখণ্ড রয়েছে। এই তিনটি প্রস্তরখণ্ডে হাজীদের কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। কুরআনের সূরা জুমার (৩৯) ৬৪ থেকে ৬৬ আয়াতে উল্লেখ আছে :
“বল, “হে অজ্ঞ ব্যক্তিরা!’ তোমরা কি আমাকে [(হযরত মুহাম্মদ (স)] আল্লাহ ব্যতীত অন্যের (দেবী-লাত, মানাত, উজ্জা) ইবাদত করতে বলছ?”
“তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী হয়েছে, তুমি আল্লাহর শরিক স্থির করলে তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্য তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।”
“অতএব, তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এবং কৃতজ্ঞ হও।”
উপরোক্ত সূরায় আল্লাহর ইবাদতের অংশীদারিত্ব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মক্কার ঘটনার যদি ইঙ্গিত করা হয় তাহলে ‘বানাত-আল্লাহ’র কথা বলাই প্রাসঙ্গিক। এ দুটি সূরায় রাসূলকে আল্লাহর সাথে অন্য কোন বস্তুকে শরিক করলে তার পরিণতি হবে ইহকাল ও পরকালে ভয়াবহ। এ দুটি সূরা মদিনায় প্রথম দিকে অবতীর্ণ হয়েছিল। যদিও অবতীর্ণ হওয়ার তারিখ সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না তবে একথা নিশ্চিত যে, এ দুটি সূরার আয়াতসমূহ শয়তানের তথাকথিত বাণীর (স্যাটানিক ভার্সেস) প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। এগুলো যে অন্য সূরা দ্বারা বাতিল হয়েছিল, তা পূর্বেই বলা হয়েছে। আর একটি সূরায়, আন-আম (৬) ১৩৭ আয়াতে বলা হয়েছে :
“এরূপে তাদের (বিধর্মী) দেবতাগণ বহু অংশীবাদীর দৃষ্টিতে তাদের সন্তান হত্যাকে শোভন করেছে, তাদেরকে ধ্বংস সাধনের জন্য এবং তাদের ধর্মসম্বন্ধে তাদের বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা এ ধরনের কাজ করত না। সুতরাং তাদেরকে তাদের মিথ্যা নিয়ে থাকতে দাও।”
উপরোক্ত সূরায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে আল্লাহর অংশীদারিত্ব একেশ্বরবাদের পরিপন্থী, যদিও ওয়াট বলেন যে, পৌত্তলিকগণ আল্লাহর সাথে তাদের দেবদেবীকে শরিক করে; ‘যা আল্লাহর দৃষ্টিতে কবিরা গুনাহ’ এরূপ অন্য একটি আয়াতে শয়তান মানুষ ও নবীদের যে প্রতারক-তা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে :
“এরূপে মানব ও জ্বীনের মধ্যে শয়তানকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে; যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন তবে তারা তা করতো না। সুতরাং তুমি (মুহাম্মদ) তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা রচনাকে বর্জন কর।”
মদিনায় হিজরতের পূর্বেই হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন যে, আল্লাহ এক, অনমনীয় ও আপোষবিহীন একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে পাঠিয়েছেন, যেখানে অংশীদারিত্বের কোন স্থান নেই। মক্কায় অবতীর্ণ সূরা কাফিরূনে (১০৯) নবী করিম (স) অংশীবাদ পৌত্তলিক কুরাইশদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় এবং তাঁর কোন শরিক নেই। সূরা কাফিরূনের ১ থেকে ৬ নম্বর আয়াতে তাওহীদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে :
“বল, ‘হে সত্য প্রত্যাখানকারীগণ!’ আমি তার ইবাদত করি না যার (দেবদেবী) ইবাদত তোমরা কর এবং তোমরাও তাঁর (আল্লাহর) ইবাদতকারী নও যার ইবাদত আমি করি এবং আমি ইবাদতকারী হব না তার যার (দেবদেবী) ইবাদত তোমরা করে আসছ এবং তোমরাও ইবাদতকারী হবে না তার (আল্লাহ) যার ইবাদত আমি করি। তোমাদের দ্বীন (ধর্ম, ন্যায়বিচার ও কর্মফল) তোমাদের, আমার দ্বীন আমার।”
এই সূরা নাজিলের ফলে হযরত মুহাম্মদ (স) পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড হুমকি দিয়ে এর মূলোৎপাটনে আত্মনিয়োগ করেন। পূর্বের যে সমস্ত সূরায় ধারণা করা হয়েছিল যে, তিনি বিধর্মীদের সাথে সমঝোতা করবেন, সূরা কাফিরূন তার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয় এবং আল্লাহর একত্বকে (‘লা শারিকা লাহু’) সমগ্র আরব দেশে প্রচারে তিনি ব্রতী হন। আর দুটি সূরাতে এ প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে তা সূরা কাফিরূনের মতো ততটা কঠোর নয়। সূরা আন’আমের (৬) ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে—
“বল, “তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের (দেবদেবী) আহ্বান কর তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। বল, আমি তোমাদের (বিধর্মী) খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করি না; করলে আমি বিপথগামী হব এবং সৎপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকব না।”
সূরা আন’আমের (৬) ৭০ আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহ প্রমাণ করে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর প্রচারকালে অন্যান্য নবীদের মত শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন, যার উল্লেখ সূরা আন’আমে পাওয়া যায়!
কুরআনের যে সমস্ত সূরায়-মক্কা পর্বে-পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে উল্লেখ আছে তা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ সমস্ত সূরার আয়াতে বারংবার পৌত্তলিকতার অসারতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, প্রতিমা-বিগ্রহগুলো শক্তিহীন, যা মানুষের কোন উপকার অথবা অপকার করতে পারে না। এমন কি তাদের মধ্যস্থতা করার ক্ষমতাও নেই। সূরা আন’আমের (৬) ৭০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে :
“যারা (পৌত্তলিকগণ) তাদের দ্বীনকে ক্রীড়াকৌতুকরূপে গ্রহণ করে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে তুমি তাদের সঙ্গ বর্জন কর এবং এদ্বারা তাদের উপদেশ দাও; যাতে কেউ নিজ কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস না হয়- যখন আল্লাহ ব্যতীত তার কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী থাকবে না এবং বিনিময়ে সবকিছু দিলেও তা গৃহীত হবে না। তারাই (পৌত্তলিকগণ) তাদের কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস হবে। সত্যপ্রত্যাখ্যান হেতু এদের জন্য রয়েছে অতৃষ্ণ পানীয় ও মর্মন্তুদ শাস্তি।”
সূরা ইউনুসের (১০) ১৮ নম্বর আয়াতে উদ্ধৃত আছে—
“তারা (বিধর্মী) আল্লাহ ব্যতীত যার (দেব-দেবী) ইবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও করে না, উপকারও করে না। তারা বলে “এগুলো আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী। বল, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছু সংবাদ দিবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র।’ এবং তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি ঊর্ধ্বে।”
সূরা বানী ইসরাঈলের (১৭) ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
“তারা (বিধর্মী) যাদের আহ্বান করে তাদের মধ্যে যারা নিকটতর তারাই তো তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।”
সূরা আম্বিয়ার (২১) ৪৩ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে :
“তবে কি আমি (আল্লাহ) ব্যতীত তাদের (বিধর্মী) এমন কতকগুলো দেব-দেবী আছে যারা তাদের রক্ষা করতে পারে? তারা তো নিজেদেরকেই সাহায্য করতে পারে না এবং আমার বিরুদ্ধে তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না।”
মহান আল্লাহর সন্তান ছেলে অথবা মেয়ে (বানাত আল্লাহ) বলা মোটেই সমীচীন ও শোভনীয় নয়।
সূরা মারয়ামের (১৯) ৯০ থেকে ৯২ আয়াতে বলা হয়েছে :
“হয় তো আকাশ-মণ্ডলী বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী বিদীর্ণ হবে ও পবর্তমালা চূর্ণ- বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে, তারা (পৌত্তলিকগণ) দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্য শোভন নয়।“
সূরা রূমের (৩০) ১২ থেকে ১৩ আয়াতে পৌত্তলিকতার অসারতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে :
“যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন অপরাধীগণ হতাশ হয়ে পড়বে।
“তাদের দেব-দেবীগুলো তাদের সুপারিশ করবে না এবং তারাই তাদের দেব- দেবীগুলোকে অস্বীকার করবে।”
সুপারিশ প্রসঙ্গে সূরা যুখরুফের (৪৩) ৮৬ আয়াতে উল্লেখ আছে :
“আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে ডাকে তাদের সুপারিশের ক্ষমতা নেই; তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে তার সাক্ষ্য দেয়, তাদের কথা স্বতন্ত্র।”
দেবদেবী পৌত্তলিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং আপোষহীন একেশ্বরবাদের পরিপন্থী। দেবদেবী ভঙ্গুর, অসার, নিষ্প্রাণ, ক্ষমতাহীন, যা সূরা মারইয়ামের (১৯) ৮৭ থেকে ৮৯ আয়াতে বলা হয়েছে-
“যে দয়াময়ের নিকট প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে সে (হযরত মুহাম্মদ (স)) ব্যতীত অন্য কারও সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবে না।”
“তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। তোমরা তো এক অদ্ভুত কথা সৃষ্টি করেছ।”
পৌত্তলিকদের বহুমূর্তি পূজার বিরুদ্ধে কুরআনে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। সূরা কাসাসের (২৮) ৬৩ থেকে ৬৪ আয়াতে স্পষ্টভাবে দেবতাদের অসারতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে-
“যাদের জন্য শাস্তি অবধারিত হয়েছে তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! এদেরকে আমরা বিভ্রান্ত করেছিলাম যেমন আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম; আপনার নিকট আমাদের নিবেদন এই যে, এদের (দেব-দেবী) জন্য আমরা দায়ী নই। এরা তো আমাদের ইবাদত করত না।”
“তাদেরকে বলা হবে; ‘তোমাদের দেবতাদেরকে আহ্বান কর।’ তখন তারা তাদেরকে ডাকবে। কিন্তু তারা তাদের ডাকে সাড়া দিবে না। এরা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। হায়, এরা যদি সৎপথ অনুসরণ করত।”
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঐসব পৌত্তলিকদের প্রতি এগুলো উচ্চারিত হয়েছে, যাদের ধর্মীয় মতবাদ বিবর্তনের মধ্যে ছিল অর্থাৎ পৌত্তলিকতা থেকে একেশ্বরবাদে উত্তরণ হয়েছে। একারণে একদিকে যেমন পৌত্তলিকতার অসারতা, যেহেতু মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা না থাকায়, অন্যদিকে তাদের কোন উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা নেই, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে। শুধু তাই না, অংশীবাদী বিশ্বাস সত্য প্রত্যখ্যানকারী (তাওহীদে বিশ্বাসী) বিধর্মীদের জন্য শেষ বিচারের দিনে যে কি পরিণতি হবে? তাও পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। ওয়াট বলেন যে, মধ্যস্থতাকারীর (৫৩ : ১৯ উল্লেখে প্রতীয়মান হয় যে, বিধর্মীগণ কোন প্রকার মহান সৃষ্টিকর্তা বা প্রতিপালকের সম্বন্ধে ধারণা-পোষণ করছে, যিনি রোজ কিয়ামতে মানুষের পাপ-পূণ্যের বিচার করবেন। কিন্তু বিধর্মীদের আখেরাত সম্বন্ধে যে মোটেই ধারণা ছিল না তা সুস্পষ্ট। পৌত্তলিকেরা তাদের দেব-দেবীকে জ্বীন হিসেবে মনে করলেও কোনক্রমেই জ্বীনদের, যারা মহান আল্লাহর সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। উপরন্তু, প্রস্তরের দেব- দেবী যে জ্বীন-ফেরেশতা; সে ক্ষেত্রেও বিধর্মীগণ নিশ্চিত ছিল না। মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে-অনেকটা সাবধান বাণীর মতো। কিন্তু মক্কায় সূরা কাফিরূন অবতীর্ণ হবার পর পৌত্তলিকতার প্রতি চরম আঘাত হানা হয় এবং তাওহীদের বাণী প্রাধান্য লাভ করে (“লাইলাহা ইল্লাল্লাহ” বা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই।”)
কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত আল্লাহ বা “আল্লাহর কন্যা” প্রসঙ্গে বহুবার বলা হয়েছে, যা উদ্ধৃত হয়েছে। শয়তানের তথাকথিত বাণী প্রত্যাহারের সাথে সূরা নাজমের ১৯-২১ আয়াতের সম্পর্ক রয়েছে-তা পূর্বেই বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড, সকল প্রকার প্রাণী, মানুষ, জীব-জন্তু, পাখি, উভচর, জলচর সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তিনি তও না এবং নিজের কোন সন্তান-সন্তুতি নেই। একারণেই সূরা নাজমে বলা হয়েছে, “তোমরা কি মনে কর, পুত্র সন্তান তোমাদের জন্য এবং কন্যা সন্তান আমাদের জন্য? একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে সূরা সাফফাতের (৩৭) ১৪৯ নম্বর আয়াতে-
অতএব তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, তোমার প্রতিপালকের জন্য কি রয়েছে কন্যা সন্তান এবং তাদের নিজেদের জন্য রয়েছে পুত্র সন্তান?
একই কথা সূরা যুখরূফের (৪৩) ১৬ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর নিজের কোন সন্তান-সন্তুতি থাকার প্রশ্নই আসে না, কারণ তাঁর কোন স্ত্রী নেই। সূরা আন-আমের (৬) ১০০ থেকে ১০১ আয়াতে বর্ণিত আছে।
“তারা জ্বিনকে আল্লাহর সাথে শরীক করে, অথচ তিনিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর প্রতি পুত্র-কন্যা আরোপ করে। তিনি পবিত্র-মহিমান্বিত এবং তারা যা বলে তিনি তার ঊর্ধ্বে
“তিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা, তার সন্তান হবে কিভাবে? তাঁর তো কোন ভাষা নেই। তিনি তো সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্বন্ধে তিনিই সবিশেষ অবহিত।
একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে সূরা বানী ইসরাঈল (১৭)-এর ১১১ নম্বর আয়াতে। সূরা আম্বিয়ার (২১) ২৬ থেকে ২৮ আয়াতে আল্লাহর তথাকথিত সন্তান এবং দাসদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে।
“তারা (বিধর্মী) বলে, ‘দয়াময় আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি (আল্লাহ) পবিত্র ও মহান। তারা (তথাকথিত সন্তান) তো তাঁর (আল্লাহ) সম্মানিত দাস (বান্দা)।”
“তারা আগে বেড়ে (অহেতুক) কথা বলে না, তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে।
তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্য যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।”
উপরোক্ত বিভিন্ন আয়াতে “বানাত-আল্লাহ”র ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়েছে। ঐশীবাণী দ্বারা নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে হযরত মুহাম্মদ (স) জাহেলিয়া যুগের অবিশ্বাস, ধর্মীয় অনাচার এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যে ধর্ম প্রচার করেন তা মদিনায় হিজরতের পূর্বে মোটামুটিভাবে সফল বলা যায়। (এ কারণেই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে যথার্থই বলা হয়েছে, বিশ্বের সমস্ত ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স) সর্বাপেক্ষা কৃতী বা সার্থক ছিলেন।) ক্রেমারের ভাষায়, নিকৃষ্ট ভক্তিযোগ্য বস্তুপূজা থেকে কঠিন এবং অনমনীয় একেশ্বরবাদ-এটিই ছিল ইসলামের ধর্মীয় সংস্কার। একজন অপেক্ষাকৃত অপরিচিত, অবহেলিত পয়গম্বর, স্বীয় আত্মপ্রত্যয়ে, সঙ্কল্পে ও দৃঢ় একেশ্বরবাদী বিশ্বাস দিয়ে মক্কায় পৌত্তলিকতার অবসান ঘটিয়ে তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, যদিও তাঁর ধর্মপ্রচার মক্কায় বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি সহজেই উপলব্ধি করেন যে, বানাত আল্লাহ বা তাওহীদের পরিপন্থী এবং এ কারণে তিনি মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং তাদের সাথে সকল প্রকারের সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে দেন। কোন প্রলোভনই যখন হযরত মুহাম্মদ স)-কে মোহগ্রস্ত করতে পারল না তখন তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে গ্রহণ করল, যদিও তারা পৌত্তলিকই রয়ে গেল। মুষ্টিমেয় কতিপয় আরব গোত্রের সদস্য যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং তাদের অধিকাংশই যে বিধর্মী রয়ে গেল। মক্কায় তিনি ঐশীবাণী লাভ করে নবী-পয়গম্বর হয়েছিলেন, তাওহীদ প্রচার শুরু করে সতর্ককারীর ভূমিকা পালন করেন। মদিনায় হিজরতের পূর্বে তিনি অবিসংবাদী ধর্মীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পাপাচারে লিপ্ত কুরাইশদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মর্যাদায় আঘাত হানেন এবং এ কারণে তাঁর এবং তাঁর সাহাবীদের বিরুদ্ধে বিধর্মীদের বিরোধিতার ফলেই তাঁকে মদিনায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করতে হয়। সূরা কাফিরূণে পৌত্তলিকতার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় তার ফলেই ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হন।
২. আবিসিনিয়ায় হিজরত
সকল প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে নবী করিম (স) নিবিষ্টচিত্তে একেশ্বরবাদ প্রচারে সঙ্কল্প করলে স্বার্থান্বেষী বিধর্মী কুরাইশগণ নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। ৬১৩ থেকে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার করলে প্রচণ্ড বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হন। শুধু তাই নয়, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও ভয়ানক হুমকির সম্মুখীন হয়। এ কারণে মুসলমানগণ নবীর নির্দেশে আবিসিনিয়ায় দু’বার হিজরত করেন।
(ক) ঐতিহ্যবাহী বিবরণ : ইবন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবন হিশাম বলেন,
“আল্লাহর রাসূল [হযরত মুহাম্মদ (স)], ধর্ম প্রচারের ফলে, তাঁর উম্মতদের যে অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তা উপলব্ধি করলেন এবং তিনি যখন তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে পারলেন না, যদিও আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং গোত্র প্রধান আবুতালিব তাঁর রক্ষণাবেক্ষণকারী ছিলেন, তখন তিনি তাঁর সাহাবীদের বললেন, “তোমরা আবিসিনিয়া নামে এক দেশে হিজরত করছো না কেন? সেখানে যে রাজা নাজ্জাশী) আছেন তিনি সদাশয় ও প্রজাবৎসল; তাঁর রাজ্যে উৎপীড়ন হয় না। আল্লাহ নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে হিজরত করে অবস্থান কর।” নির্দেশ লাভ করে মুসলমানগণ (সাহাবীগণ) অত্যাচার (ফিতনাহ) থেকে বাঁচার জন্য এবং একেশ্বরবাদী ধর্ম পালনের জন্য আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটিই ছিল ইসলামের প্রথম হিজরত। এই দলে দশজন সাহাবী এবং তাঁদের পরিবারবর্গ সামিল ছিল। এই দলে ওসমান বিন মায়ুন যোগ দেন। এছাড়া, আবু তালিবের ছেলে ও হযরত আলীর ভাই জাফরও আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এরপর ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে যখন দ্বিতীয় দলটি আবিসিনিয়ায় যায় তখন মোহাজেরদের সংখ্যা ছিল তিরাশি এবং এর নেতৃত্ব দেন হযরত ওসমান (রা)।
ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশাম প্রদত্ত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আবিসিনিয়ায় দুবার হিজরত করেন সাহাবীগণ। প্রথমবার যখন ফিরে আসেন তাঁরা, তখন দেখা গেল অনেকে সেখানে থেকে গেছেন। আবার যারা ফিরে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকে দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। আবিসিনিয়া থেকে ফিরে এসে অনেক সাহাবী ৬২২ খ্রিস্টাব্দে নবী করিম (স)-এর সাথে মদিনায় হিজরত করেন। কোন কোন সাহাবী আবিসিনিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। তবে ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, হিজরী ৭/৬২৮ খ্রি. খায়বার যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বেশ কয়েকজন সাহাবী মদিনায় ফিরে আসেন।
(খ) আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের তালিকা : হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পরামর্শ ও নির্দেশে কুরাইশদের অমানুষিক অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্য নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ খ্রিস্টান রাজা নাজ্জাশীর রাজ্য আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেন এবং নাজ্জাশী তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু মুসলিম ঐতিহাসিকগণ পরপর দুবার হিজরতের কথা বলেন, প্রথমবার ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে দশটি পরিবার এবং সম্ভবত পরের বছর তিরিশটি পরিবার। কিন্তু খ্রিস্টান ঐতিহাসিক ইতালীয় ক্যাটানী এই মতবাদের বিরোধিতা করেন। তার যুক্তি হচ্ছে যে, ইবনে ইসহাক, যিনি নবী করিম (স) ) এর ওপর প্রথম প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন, এ প্রসঙ্গে সুষ্ঠুভাবে কিছু বলেন নি। ইবনে হিশাম ও তাবারীও এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেন নি। ইবনে ইসহাক বলেন যে, কতিপয় মুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন এবং তারপর বলেন যে, জাফর বিন আবু তালিবের সাথে আরও অনেক মুসলমান হিজরত করেন। প্রথম তালিকায় যাদের নাম ছিল তারা মক্কায় ফিরে এসে দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় গিয়েছে এমনও কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া তালিকাও অসম্পূর্ণ। সুতরাং একবার, না দুবার মুসলমানগণ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন- তা সঠিকভাবে জানা যায় না। নামের তালিকাও অস্পষ্ট। যাহোক একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আবু সাবরা প্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন (তাবারীর মতে)। এর পর তালিকায় যার নাম পাওয়া যায় তিনি হচ্ছেন আমর বিন সাঈদ আল-আস এবং তার ভাই খালিদ। দলবদ্ধভাবে হিজরত হয়েছিল, না ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে-তা সঠিকভাবে বলা যায় না। ইবনে ইসহাক দুটি পৃথক তালিকার উল্লেখ করেছেন মোহাজেরদের, তবে তিনি নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না যে, এ দুটি তালিকা পৃথকভাবে প্রণীত হয়েছিল কিনা। ধারণা করে বলা হয় যে, ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে সারা বছর ধরে মক্কা থেকে মোহাজের পরিবার আবিসিনিয়ায় যেতে থাকে এবং তাঁরা যখন যাচ্ছেন তখন তাঁদের তালিকাভুক্ত করা হয়। সম্ভবত এটিই দুটি পৃথক তালিকার কারণ হতে পারে। যদি তাই হয় তবে একবারই হিজরত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
হিজরী ১৫ অর্থাৎ ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা) বায়তুল মাল থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানদের বাৎসরিক ভাতা প্রদানের যে নীতি প্রণয়ন করেন তার সুবিধার্থে একটি তালিকা প্রণীত হয়। এই তালিকায় যে সমস্ত বিশিষ্ট মুসলিম যুদ্ধ অথবা প্রশাসনে অসামান্য অবদান রাখেন তাদের নাম ছিল। এই তালিকায় যারা সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের নাম অগ্রভাগে ছিল। এই তালিকায় নবী করিম (স)-এর পরিবারবর্গ ও নিকট আত্মীয়-স্বজনের পর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নাম ছিল। এই তালিকায় মোহাজেরদের নামও ছিল। যারা একাধিকবার হিজরত করেন তাদের অধিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়-তাঁরা ইসলামের নতুন অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই পর্যায়ে নিশ্চিত করে বলা খুবই কঠিন যে, মুসলমানগণ একবার না দুবার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন।
হিজরী ৭ অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে খায়বারের যুদ্ধের পর হযরত মুহাম্মদ (স) মদিনায় অবস্থানকালে তিনি আবিসিনিয়ায় অবস্থানকারী মোহাজেরদের দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেন যাতে তাঁর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। নবী (স) আবিসিনিয়ায় একজন দূত পাঠিয়ে তাঁদের ফিরে আসার নির্দেশ দেন এবং দূতের সাথে মোহাজেরদের অনেকে ফিরে আসলে নবী তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানান। তাঁদেরকে খায়বারের রণক্ষেত্র থেকে মাল-ই-গণিমতের কিছু অংশ দেন। যারা আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন তাঁদের মোহাজেরীন বলা হয় এবং তাদের এই দেশত্যাগকে হিজরত বলা হয়েছে; ঠিক যেভাবে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মুসলমানগণ মোহাজেরীন উপাধি লাভ করেন। জাফর বিন আবু তালেব প্রথমে আবিসিনিয়ায় এবং পরে মক্কায় ফিরে এসে রাসূলের সাথে মদিনায় দ্বিতীয়বার হিজরত করেন। এর ফলে তাঁর সামাজিক মর্যাদা ছিল বেশি উঁচুতে। হযরত মুহাম্মদ (স)-কে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দেন, “হ্যাঁ, এ ধরনের অনেকেই দুবার হিজরত করেছে; একবার আবিসিনিয়ায় এবং আর একবার আবিসিনিয়া থেকে আমার কাছে মদিনায়-খায়বার যুদ্ধের সময় ইবনে ইসহাক বর্ণিত তালিকায় এ ধরনের অনেক মোহাজেরের নাম পাওয়া যাবে, যারা দুবার হিজরত করেছে। একবার মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় এবং দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়া থেকে মদিনায়।
হযরত ওমরের সময় বাৎসরিক ভাতা প্রাপ্তদের যে তালিকা প্রণীত হয় তাতে অগ্রাধিকার ছিল নবীর পরিবার-পরিজন ও নিকট আত্মীয়। এরপর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের। তার তালিকায় আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মোহাজেরদের, যারা মদিনায় ফিরে এসেছিল, নাম পাওয়া যাবে। এখানে একবার বা দুবার হিজরতের কোন উল্লেখ নেই। হিজরত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে-এরূপ ধ্যান-ধারণা ওমরের ছিল না। এ কারণে তিনি আবিসিনিয়ায় থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তনকারী জাফর বিন আবু তালেবের স্ত্রীকে রাসূলের সময়ে অধিক সুবিধা প্রদানের বিরোধিতা করেন। এক্ষেত্রে অবশ্য রাসূল হস্তক্ষেপ করলে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়।
আবিসিনিয়ায় হিজরত প্রসঙ্গে ওয়াট যা বলেছেন তা মুসলিম ঐতিহাসিকেরা গ্রহণ করেন নি। তার কারণ, সূরা নাজম নাজিল হলে মুসলমান এবং পৌত্তলিকদের ধারণা হলো যে, হযরত মুহাম্মদ (স) শয়তানের প্ররোচিত তথাকথিত বাণীর প্রভাবে লাত, মানাত ও উজ্জার সাথে সমঝোতা করতে যাচ্ছেন। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে এই সূরা সংশোধিত হয়। তবুও সংবাদ পেয়ে প্রথম বারের মত যে সমস্ত মুসলমান আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন তাদের অনেকে মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু সূরা কাফিরূনের মর্মবাণী অনুযায়ী পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলে, বিধর্মী, পাপিষ্ঠ, কুচক্রী ও উৎপীড়ক মক্কার কুরাইশগণ যখন অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু করে তখন সম্ভবত দ্বিতীয় বারের মত আবিসিনিয়ায় মুসলমানগণ হিজরত করেন। দ্বিতীয় মোহাজের গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন হযরত ওসমান (রা)। এ কথাও ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হযরত ওসমানের সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও নবী করিম (স)-এর কন্যা রোকেয়া। ওয়াট নিজেই বলেন, “এই ঘটনার (আবিসিনিয়ায় হিজরত) মূলে ছিল প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের অন্তর্নিহিত দলীয় বিসংবাদ।”
(গ) আবিসিনিয়ায় হিজরতের কারণ : নব-দীক্ষিত মুসলমানদের মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের মূল কারণ হিসেবে বলা হয়েছে কুরাইশদের অমানুষিক নির্যাতন। ইবনে ইসহাক এবং উরওয়ার চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। এছাড়া গবেষক-ঐতিহাসিকগণ অন্যান্য যে সমস্ত তাৎপর্যের কারণ উল্লেখ করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। কেবলমাত্র নির্যাতনের শিকার হয়েই যে নবদীক্ষিত মুসলমানগণ মক্কা থেকে সুদূর আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন তা বলা যায় না। ইবনে ইসহাকের প্রণীত তালিকা দেখে বলা যায় যে, মক্কার প্রভাবশালী গোত্রসমূহ, যারা মূলত হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারে প্রচণ্ড বিঘ্ন সৃষ্টি করে তাদের দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোন সদস্যই, আবিসিনিয়ায় হিজরত করে নি। এই গোত্রগুলো হচ্ছে হাশিম, আল মুত্তালিব, জুহুরা, তায়েম এবং আদি। এই গোত্রসমূহ এক সময়ে হিলফুল ফুযূলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই গোত্রের কট্টরপন্থী সদস্যগণ মাখযুম ও আবদুস শামস গোত্রের সাথে সংঘবদ্ধভাবে বিরোধিতা শুরু করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এদের হাতেই মক্কার অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিহিত ছিল। হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর নব-দীক্ষিত মুসলমানদের উৎপীড়ন ও বর্বরোচিত নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে মাখযুম ও আবদুস শামসের সদস্যগণ। হিজরতে অংশগ্রহণকারী ব্যতিক্রমধর্মী সদস্য ছিলেন মাখযুম গোত্রের আল-আরাকাম এবং আবদুস শামস গোত্রের আবু আহমদ বিন জাহাস। আল-আরকাম মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং কোন এক পর্যায়ে মক্কায় তাঁর বাসস্থানে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের সভা-অনুষ্ঠানের সুযোগ দেন। আবু আহমদ বিন জাহাস একজন অন্ধ কবি ছিলেন। তার আবিসিনিয়ায় হিজরত প্রসঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে ইসহাক বলেন যে, তিনি আবিসিনিয়ায় যান নি। অন্য দিকে ইবনে সা’দ বলেন যে, তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।
নিরপেক্ষ বিচারে মুসলমানদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের কারণসমূহ ছিল বিবিধ। প্রথমত, কুরাইশদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়া। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা থেকে মদিনায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করার পরেও অনেক মুসলমান আবিসিনিয়ায় কেন থাকলেন? ধারণা করা হয় যে, হিজরী ৭ অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে খায়বার যুদ্ধের পূর্বে বা পরে অবিশিষ্ট মুসলমানগণ রাসূলের নির্দেশে মদিনায় ফিরে আসেন। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, সাত বছর (৬২২-৬২৯ খ্রি.) তাদের অনেকে সেখানে কেন ছিলেন? এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, নবী তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত না করে মদিনায় আসতে বলেন নি? দ্বিতীয়ত, মুসলমানগণ সেখানে ব্যবসা- বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। তৃতীয় কারণ পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর উম্মতদের শারীরিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেয়ে তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনায় উৎকণ্ঠিত ছিলেন। সেক্ষেত্রে মুসলমানগণ স্বধর্মত্যাগী (apostasy) হয়ে যেত এবং এর ফলে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা কমতে থাকত। পারিবারিক চাপে নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ পুনরায় পৌত্তলিকতায় ফিরে যেত। একই পরিবারের বহু সদস্য বিধর্মী ও নব-দীক্ষিত মুসলমান হিসেবে বসবাস করতেন (বস্তুত নবীর ইন্তেকালে খলিফা আবু বকরের শাসনামলে স্বধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় War of Apostasy এবং এদের মধ্যে মুসাইলামা, আসাদ ও তোলায়হা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। স্বধর্মত্যাগের আশঙ্কা নবীর ধর্ম প্রচারকালে কতটুকু ছিল? তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এর স্বপক্ষে বলা যায় যে, কেবল ‘কালিমা’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) পাঠ করে দীক্ষা লাভ করা যায় কিন্তু প্রকৃত মুসলমান হতে অনেক আকিদা পালন করতে হয়। সেজন্য নবীর ভয় ছিল যে, মক্কায় বিধর্মীদের মধ্যে অবস্থান করলে তাদের অনেকে তাদের পৌত্তলিক পরিবারে ফিরে যেতে পারে। বিপক্ষে বলা যায় যে, এই যুক্তি খুব জোরালো নয়। যারা প্রথম পর্যায়ে মুসলমান হয়েছিলেন-যেমন আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, যায়েদ, বেলাল প্রমুখ, তাঁরা ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান। সুতরাং তাঁদেরকে প্রলোভন বা প্ররোচনা দ্বারা তাঁদের পিতা-মাতার ধর্মে ফিরানো সম্ভব ছিল না।
আবিসিনিয়ায় হিজরতের কারণ প্রসঙ্গে তৃতীয় মন্তব্য হচ্ছে, যে সমস্ত মুসলমান মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন তারা সেখানে জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন না কোন প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। তাঁদের অনেকে ৬১৫ থেকে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ চৌদ্দ বছর আবিসিনিয়ায় বসবাস করেন। উল্লেখ্য যে, প্রাক-ইসলামী যুগে মক্কার সাথে আবিসিনিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সুতরাং মক্কাবাসী বা আবিসিনিয়ায় ব্যবসায় অভ্যস্ত ছিল। উরওয়ার চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণও খুব জোরালো নয়। কারণ মোহাজেরগণ জানতেন যে, তারা স্থায়ীভাবে আবিসিনিয়ায় ব্যবসায় অভ্যস্ত ছিল। উরওয়ার চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। ব্যবসা- বাণিজ্যের কারণও খুব জোরালো নয়। কারণ মোহাজেরগণ জানতেন যে, তারা স্থায়ীভাবে আবিসিনিয়ায় বসবাস করতে আসেন নি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাময়িকভাবে নাজ্জাশীর রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করা। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে রাসূল (স)-এর নির্দেশে তাদের আবিসিনিয়া ছেড়ে মদিনায় যেতে হয়। চতুর্থ কারণ হিসেবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ যে মন্তব্য করেছেন তা হচ্ছে, সম্ভাব্য সামরিক সাহায্য। সম্ভবত কোন মুসলিম ঐতিহাসিক এ ধরনের চিন্তাভাবনা করেন নি। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের মত আবিসিনিয়ানদের সাথে সরাসরি অথবা তাদের কোন প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে ক্ষমতাশীল মক্কার পৌত্তলিক অভিজাত শ্রেণীকে (Meccan aristocracy) ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন বলে পাশ্চাত্য গবেষকগণ মন্তব্য করেন। কিন্তু এই মন্তব্য কতটুকু সত্য তা বলা যায় না। কারণ আবিসিনিয়ায় হিজরত ছিল মদিনায় হিজরতের পূর্বাভাষ। হযরত মুহাম্মদ (স) কি আবিসিনিয়াকে ব্যবসা বাণিজ্যের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মক্কার পৌত্তলিকদের গড়া অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন? যাহোক, আবিসিনিয়ায় মুসলমানদের হিজরতে পৌত্তলিক মক্কাবাসী খুব বিচলিত হয়ে পড়ে এবং আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশীর নিকট দুজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে অনুরোধ করে যে, আবিসিনিয়া থেকে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের বিতাড়িত করা হোক। কিন্তু মহান রাজা নাজ্জাসী মুসলমানদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি কুরাইশ প্রতিনিধিদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ওয়াট আবিসিনিয়ায় হিজরত প্রসঙ্গে পঞ্চম কারণের অবতারণা করেন। তিনি বলেন যে, নব-দীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও কোন্দল হিজরতের অন্যতম কারণ। ইবনে ইসহাক প্রদত্ত তালিকার উল্লেখ করে ইবনে সাদ বলেন যে, মোহাজেরদের নেতা ছিলেন ওসমান বিন-মা’য়ুন। তিনি তাঁর তিনজন সাথী নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে দীক্ষা নিতে আসেন। ইবনে সা’দ বলেন যে, খালিদ বিন মা’য়ুন প্রভাবশালী হলেও আবু বকরের নেতৃত্বে উম্মতদের যে গোষ্ঠী ছিল তা অধিক তৎপর ছিল। এছাড়া, আর একটি দলের নেতৃত্ব দেন খালিদ বিন সাঈদ। সম্ভবত তিনিই প্রথম মুসলমান যিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তিনি ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে, খায়বারের যুদ্ধের পূর্বে বা পরে মদিনায় ফিরে আসেন। অপর প্রভাবশালী ব্যক্তি যিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন তিনি হচ্ছেন আল-হারিস বিন-কায়েস। তিনি বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বন্দী হন এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে রাসূলের নির্দেশে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। প্রথম দলে যারা আবিসিনিয়ায় যান তাদের মধ্যে আবু বকর এবং আদি গোত্রের প্রভাবশালী সদস্য নু’য়াযেম বিন আবদুল্লাহ আল-হাজাস উল্লেখযোগ্য।
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পূর্বে নবী করিম (স)-এর জ্ঞাতসারে মুসলমানদের মধ্যে দুটি বিরোধী দলের সৃষ্টি হয়। একটি দলের নেতৃত্ব দেন ওসমান বিন মা’যুন এবং উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাস। তাঁরা দুজনেই আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। উবায়দুল্লাহ সেখানে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। (মক্কায় অবস্থানকালে ইসলাম ধর্মত্যাগের যে আশঙ্কা ছিল আবিসিনিয়ায় গিয়া উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাস খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে তাই প্রমাণ করেন।) তাঁর স্ত্রী উন্মে হাবিবা (রামলা) বিনতে আবু সুফিয়ান স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দত পালনপূর্বক রাসূলে করিমকে বিয়ে করেন। ওসমান বিন মা’য়ুন আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফিরে আসলেও হিজরী ৬ অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে মদিনায় হিজরত করেন নি। আবুবকর নবী করিম (স)-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং এই ঘনিষ্ঠতা উবায়দুল্লাহ এবং ওসমান বিন মা’যুনকে ঈর্ষান্বিত করে। মক্কায় অবস্থানকালে মুসলমানদের মধ্যে দুটি পৃথক প্রতিদ্বন্দ্বী দল গঠিত হয়। একটির নেতৃত্ব দেন আবু বকর এবং অপরটির উবায়দুল্লাহ ও ওসমান। উবায়দুল্লাহ এবং ওসমান আবু বকরের বিরোধিতা করতে থাকেন। আবু বকরের (রা) কোন নীতির তারা প্রতিবন্ধকতা করেন- তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে সামাজিক, রাজনৈতকি, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামের প্রভাব বৃদ্ধিতে হযরত মুহাম্মদ (স)- এর পাশাপাশি হযরত আবুবকরের (রা) যে অবদান ছিল তা অনস্বীকার্য। হযরত মুহাম্মদ (স) আবু বকরের কন্যা হযরত আয়েশাকে বিয়ে করেন। মদিনায় হিজরতের পূর্বেই মক্কায় আবু বকরের প্রভাব লক্ষ করা যায় এবং তাঁর বয়জ্যেষ্ঠতা, ইসলামে তাঁর অকুণ্ঠ অবদান এবং নবীর শ্বশুর হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পরেই যে তাঁর স্থান (second in command) তা নিশ্চিত হয়ে যায়। আবু বকরের (রা) সাথে ওসমানের দ্বন্দ্ব হযরত মুহাম্মদ (স) জানতেন। এই বিরোধ দূর করার জন্যই সম্ভবত নবী নব- দীক্ষিত মুসলমানদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দেন। আবুবকর আবিসিনিয়ায় যান নি; ওসমান গিয়েছিলেন। এর ফলে বিরোধের অবসান হয়। যাহোক, মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের (৬২২ খ্রি.) পূর্বে ওসমান মক্কায় ফিরে আসলে প্রমাণিত হয় যে, আবু বকরের সাথে তাঁর চরম কোন বিরোধ ছিল না এবং তাঁরা উভয়েই রাসূলের উম্মত হিসেবে ইসলামের সেবা করেন। তাঁরা উভয়েই বদরের যুদ্ধে বিধর্মীদের ধ্বংস করার জন্য অংশ নেন।
৩. বিরোধিতার ষড়যন্ত্র
৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুওয়াত লাভ করে হযরত মুহাম্মদ (স) ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ৬১০ থেকে ৬১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোপনে এবং আল্লাহর নির্দেশে ৬১৩ থেকে প্রকাশ্যে তাওহীদ প্রচার করতে থাকলে বিধর্মী কুরাইশগণ হযরত মুহাম্মদ (স) এবং নব- দীক্ষিত মুসলমানদের ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করে। ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সা’দ এবং তাবারীর বর্ণনা অনুযায়ী অত্যাচার ও নিপীড়নের যে চিত্র পাওয়া যায় তা ভয়াবহ। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় এর উল্লেখ আছে এবং পাপিষ্ঠ পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা দেখা দেয়, যেটা তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই স্বাভাবিক, অবশ্য নির্যাতনের মাত্রা প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদগণ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
(ক) নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ওপর নির্যাতন : ইবনে ইসহাক তাঁর “সিরাতুন নবী’ গ্রন্থে মাখযুম গোত্রের পাষণ্ড আবু জেহেলের অত্যাচারের কথা বলেছেন।
তার মন্তব্য থেকে ধারণা হয় যে, আবু জেহেলের প্রভাবশালী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন মৌখিক আক্রমণ ছাড়া তেমন অসহনীয় ছিল না। সাধারণ লোকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি এবং কখনো কখনো শারীরিক উৎপীড়ন অবশ্য করা হতো। যেহেতু কুরাইশ গোত্রগুলো খুবই শক্তিশালী ছিল সেহেতু তাদের সদস্যগণ নির্যাতনের শিকার হতো না। এ কারণে যারা নির্যাতিত হতেন তাদের সংখ্যা ছিল কম এবং তারা গোত্রের বাইরের দাস এবং গোত্রহীন ব্যক্তি হতেন। যেমন- কাব্বাব বিন আল-আবাত। কখনো কখনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ অথবা গোত্রের স্বার্থবিরোধী (ইসলাম ধর্ম গ্রহণ) কার্যকলাপ করলে গোত্রপ্রধান যে কোন সদস্যকে গোত্র থেকে বহিষ্কার করতে পারতেন। অবশ্য এর ফলে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই গোত্র হেয় প্রতিপন্ন হতো। আবু বকর (রা) যিনি তায়েম গোত্রের সদস্য ছিলেন, ইসলাম গ্রহণের পর গোত্র থেকে বহিষ্কৃত হলে তিনি ইবনে আদ-দুগুণাহের তত্ত্বাবধানে চলে যান। একই গোত্রের তালহা ইবনে ওবাদুল্লাহ তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকেও গোত্রচ্যূত করা হয়। এর মূল কারণ এই যে, তাইম গোত্র খুব শক্তিশালী বা প্রভাবশালী ছিল না। একই ভাবে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন ধর্মপ্রচারের জন্য তায়েফে যান তখন তাঁর গোত্র (হাশিম) তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। এ কারণে তিনি সেখানে লাঞ্ছিত হন এবং তাঁকে পাথর ছুঁড়ে শহর থেকে বিতাড়িত করা হয়। উল্লেখ্য, আবু তালিবের মৃত্যুর পর হাশিম গোত্রের প্রধান হয়েছিলেন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা বিধর্মী আবু লাহাব, যিনি তার ভ্রাতুষ্পুত্রের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা করেন নি। এর ফলে নির্যাতিত হয়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে মক্কায় ফিরে আসতে হয়। এ সময় তিনি ক্ষুদ্র নওফেল গোত্রের তত্ত্বাবধানে থাকেন।
ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সা’দ এবং তাবারী বর্ণিত তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, এ ধরনের নির্যাতন বা ‘ফিতনাহ’ খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। কিন্তু এ সমস্ত কতটুকু কঠোর উৎপীড়ন বা বর্বরোচিত আচরণ ছিল- তা বলা যায় না। তবে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- তপ্ত বালির ওপর বিলালকে চিত করে শুইয়ে তার বুকে পাথর চাপিয়ে তাকে ইসলাম ধর্মত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা, যা সফল হয় নি। ওয়াট বলেন যে, নির্যাতন তেমন কঠোর ছিল না। এ মন্তব্য ঠিক নয়। পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকগণ মন্তব্য করেন যে, মাত্রাধিক নির্যাতনের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা অতিরঞ্জিত। কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য বাস্তবতাবর্জিত। অবশ্য এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পূর্বপুরুষের ধর্ম পৌত্তলিকতার স্থলে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস স্থাপন কৌলিন্য প্রথায় বিশ্বাসী বিধর্মী কুরাইশগণ সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, নব-দীক্ষিত মুসলমানসহ হযরত মুহাম্মদ (স)-কে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। হযরত মুহাম্মদ (স)-কে অনেক গালাগালি, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ঘরের দরজায় পাশ্ববর্তী প্রতিবেশীদের আবর্জনা স্তূপ করে রাখা হতো। (আবু লাহাবের স্ত্রী জমিলা এবং আবু জেহেলের স্ত্রী হিন্দা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পবিত্র মাথায় আবর্জনা ফেলত, তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একবার আবু জেহেল নবীর মাথা লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে আঘাত করে। কথিত আছে যে, এ ঘটনায় হযরতের চাচা বীর কেশরী আমীর হামজা কা’বাঘরে গিয়ে হৃদয়হীন আবু জেহেলকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেন এবং প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিধর্মী কুরাইশগণ মুসলমানদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রিতে বাধা দিতে থাকে। এর ফলে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবু বকরের (রা) মূলধন ৪০,০০০ থেকে মাত্র ৫,০০০ দিরহামে নেমে আসে। এ অবস্থা হয় আবু বকরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে হিজরতের মধ্যবর্তী সময়ে এবং এর জন্য আবু জেহেলের মত পাষণ্ডের অপপ্রচার ও ইসলাম বিরোধী আচরণ দায়ী। ইবনে সা’দ বলেন যে, আবু বকরের (রা) আর্থিক সঙ্কটের মূলে দাস ব্যবসার অবনতি; কিন্তু ওয়াট মনে করেন যে এই তথ্য সঠিক নয়। কারণ একজন দাসকে মাত্র ৪০০ দিরহাম দিয়ে কেনা যেত। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হাবশী বেলাল এবং আমির বিন ফুহায়হা। অর্থনৈতিক নিপীড়নও মুসলমানদের ওপর চালানো হয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় বিধর্মী আল-আস বিন ওয়াইল ঋণের টাকা কাব্বার বিন আল- আবাতকে ফেরৎ দেন নি। এছাড়া আর এক ধরনের নির্যাতন মক্কায় নব-দীক্ষিত মুসলমানদের সহ্য করতে হত। তা হচ্ছে পারিবারিক সদস্যদের দ্বারা নিপীড়ন; পিতা, চাচা এবং ভাই—একই পরিবারের কোন সদস্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলে তার ওপর নির্যাতন করত। যারা এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন তারা হচ্ছেন আল- ওয়ালিদ বিন আল-ওয়ালিদ; সালাম-বিন হিশাম, আয়াশ বিন-আবি রাবিয়া। এঁদের ওপর আবু জেহেল নিপীড়ন শুরু করে। ইবনে সা’দ এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের অনেক ঘটনার উল্লেখ করেন। যেমন- বনু মাখযুম কর্তৃক গোত্রীয় সদস্য আম্মার বিন ইয়াসির ও তাঁর পরিবারের ওপর নির্যাতন।
এ সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিধর্মী কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা গ্রহণশীলতার পর্যায় ছিল। অবশ্য ওয়াটের এই মন্তব্য ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম ও ইবনে সা’দের বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত নয়। প্রাক-ইসলামী যুগের কৌলিন্যভিত্তিক গোত্রপ্রথা গোত্রীয় সদস্যদের নিরাপত্তা বিধান করত এবং এ কারণে কোন গোত্রের কোন সদস্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে নির্যাতন করা যেত না। (যতদিন আবু তালিব জীবিত ছিলেন ততদিন হযরত মুহাম্মদ (স) হাশিম গোত্রের নিরাপত্তা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার চাচা বিধর্মী আবু লাহাব, যার প্রসঙ্গে সূরা লাহাব (১১১) অবতীর্ণ হয়েছে, গোত্র প্রধান হলে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।) এক গোত্রের সদস্য অন্য গোত্রের দ্বারা উৎপীড়িত হওয়ার পর তার প্রতিকার না করলে গোত্রীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতো। যাহোক, একথা বলা যায় যে, নির্যাতন দুই রকম ছিল; (ক) গোত্রবিহীন লোকদের ওপর নির্যাতন যেখানে গোত্রীয় সম্পর্ক নষ্ট হতো না; (খ) শারীরিক নির্যাতনের স্থলে অর্থনৈতিক অবরোধ। কখনো কখনো মৌখিকভাবে গালিগালাজ এবং অন্য ধরনের ব্যক্তিগত উৎপীড়ন, যেমন যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, পাথর নিক্ষেপ বা মাথায় আবর্জনা ফেলা। এ সমস্ত অমানুষিক কাজ গোত্র মর্যাদার হানি করত না। এ ধরনের নির্যাতন ইসলামের জন্য ছিল মহান শিক্ষা-এর ফলে ধর্ম আরও সুদৃঢ় হয়, নতুন দিক নির্দেশনা লাভ করে, হিজরতের পথ সুগম করে। নির্যাতনের ফলে কোন মুসলমান রাসূলের জীবনে পূর্বপুরুষদের ধর্মে (apostasy) ফিরে যায় নি। তাঁর নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এবং আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস বিধর্মীদের হতবাক করে এবং তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম-পৌত্তলিকতা বর্জন করে ইসলামের ছায়াতলে আসে।
(খ) বনু হাশিমের ওপর চাপ প্রয়োগ : বিধর্মী কুরাইশদের অমানুষিক অত্যাচারে অতিষ্ঠি হয়েও নব-দীক্ষিত মুসলমান তাদের ঈমানের আদর্শে বলীয়ান হয়ে ওঠে। ৬১০ থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উৎপীড়ন ও নির্যাতন সহ্য করেও হযরত মুহাম্মদ (স) কিভাবে ধর্ম প্রচার করলেন তা বিবেচনা করলে অবাক লাগে। এর মূলে যে কারণ ছিল তা হচ্ছে গোত্রপ্রথার এবং গোত্রীয় সদস্যদের নিরাপত্তা বিধান। যে সময় হযরত মুহাম্মদ (স) ধর্ম প্রচার শুরু করেন তখন হাশিম গোত্রের প্রধান ছিলেন তার চাচা আবু তালিব। ইসলাম কবুল না করলেও আবু তালিব তাঁর জীবদ্দশায় তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে সকল প্রকার নিরাপত্তা দান করেন। এটি ছিল তৎকালীন গোত্রপ্রথার একটি অমোঘ বিধান। মখযুম গোত্রের প্রধান বিধর্মী উৎপীড়ক কুচক্রী ইসলামের চীরশত্রু আবু জেহেল বহুবার আবু তালিবকে বলেছিলেন যে, তিনি যেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ধর্মপ্রচার করতে নিষেধ করেন। আবু জেহেল কুরাইশদের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন। তিনি প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আবু তালেবের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং বলেন, তিনি হয় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ইসলাম প্রচার করতে বারণ করবেন, নতুবা তার গোত্রীয় নিরাপত্তা দানে বিরত থাকবেন। আবু তালিব আবু জেহেল প্রদত্ত দুটি শর্তই নাকচ করেন। পক্ষান্তরে হাশিম গোত্রের নিরাপত্তা বিধান সুনিশ্চিত করেন। হাশিম গোত্রের সাথে আল-মুত্তালিব গোত্র একত্রিত হয়ে নবীকে নিরাপত্তা দান করে।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কেবল নিরাপত্তা বিধানের জন্যই আবু তালিব আবু জেহেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন নি। আবু জেহেলের প্রস্তাব ছিল ঘৃণ্য ও স্বার্থপর। সে ইসলাম বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়; এ কারণে আবু তালিব তার গোত্রীয় মর্যাদা রক্ষার জন্য এ ঘৃণ্য প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। তুলনামূলকভাবে হাশিম গোত্র অন্যান্য গোত্র অপেক্ষা দুর্বল ও ক্ষমতাহীন হতে থাকে এবং তাদের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারণ, তিনি আল্লাহর রাসূল ও নবী। নির্যাতন যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখন নবীকে নিরাপত্তা বিধান প্রদান না করলে একদিকে যেমন ধর্মপ্রচার বিঘ্নিত হতো, অন্যদিকে হাশিম গোত্রের অপমান হতো। তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে অমর্যাদা হবার সম্ভাবনায় হাশিম গোত্রপতি আবু তালিব আবু জেহেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ওয়াট, আবু তালেবের এহেন পদক্ষেপকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে বলেন যে, যদি আবু জেহেলের প্রস্তাব আবু তালিব মেনে নিতেন তাহলে শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রেই বিপর্যয় হতো না, অর্থনৈতিক দিক থেকে মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত থাকত। এই পদক্ষেপ ইসলামী সম্প্রসারণের পরিপন্থী হতো। এটি হিলফুল ফুযূলের আদর্শকে প্রতিফলিত করেছে। এভাবে শুধু হযরত মুহাম্মদ (স)-ই হাশিম গোত্রের নিরাপত্তা লাভ করলেন না, আবু তালিব তার ভাগ্নে নব-দীক্ষিত মুসলিম আবু সালামা বিন আবদ আল আসাদকেও নিরাপত্তা দান করেন। তিনি মাখযুম গোত্রের লোক ছিলেন এবং এক্ষেত্রে আবু তালিব হাশিম গোত্রের আবু লাহাবের সমর্থন লাভ করেন।
নবী করিম (স)-এর চাচা আবু লাহাব আবদুল মুত্তালিবের পুত্র এবং আবু তালিবের ভাই ছিলেন। মক্কায় হাশিম, তথা কুরাইশ গোত্রে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি হাশিম গোত্রের হলেও আবদ শামস গোত্রের প্রধান আবু সুফিয়ানের এক ভগ্নীকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় হিজরীতে আবু সুফিয়ান বিধর্মী কুরাইশ গোত্রের প্রধান ছিলেন এবং তৃতীয় হিজরীতে (৬২৪ খ্রি.) বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধে বিরোধিতা যখন চরম আকার ধারণ করল তখন আবু লাহাব চাচা হওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রীর গোত্র আবদ শামসকে সমর্থন দেন। আবু লাহাবের বিরুদ্ধাচরণের ফলে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দুই কন্যার সাথে পূর্বে লাহাবের দুই পুত্রের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের যে চুক্তি বা বাগদান হয়েছিল তা ভেঙে যায়। আবু লাহাবের বৈরী মনোভাবের কারণ ছিল আবদ শামস গোত্রের সাথে অর্থনৈতিক (বাণিজ্যিক) সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর শত্রুরা তাকে তাঁর গোত্র (হাশিম ও আল-মুত্তালিব) থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হলে কুরাইশদের সমস্ত উপদল একতাবদ্ধ হয়ে নবীর বিরুদ্ধে একটি সংঘ তৈরি করে। একদিকে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং নব-দীক্ষিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, অন্যদিকে মাখযুম ও সহযোগী গোত্রসমূহের হিলফুল ফুযূলের ক্ষমতা হ্রাস করে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস। আবু তালিবের কবিতায়, যাতে ইবনে ইসহাকের পাদটীকা ছিল, এই দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ আছে। আবু তালিবের কবিতায় যাদের নাম উল্লেখ আছে তারা যে সকলেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিপক্ষে ছিল, তা নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তারা হাশিম পরিবারের বিরুদ্ধাচারণ করেছিল, তারা হিলফুল ফুযূলের অন্তর্ভুক্ত গোত্রসমূহের সদস্য ছিল। ইবনে ইসহাক প্রদত্ত তালিকা থেকে জানা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিপক্ষে যারা ছিল তারা হচ্ছে আবদ শামস গোত্রের আবু সুফিয়ান বিন হারব, এবং আল-ওয়ালিদ বিন উতবা; তাইম গোত্রের ওসমান বিন মালিক বিন উবায়দুল্লাহ এবং কুনফুদ বিন উমার বিন জুদান; জুহুরা গোত্রের আবদুল্লাহ আল-আখনাস-বিন শারিক এবং আল-আসওয়াদ বিন আবদ-ইয়াগুত; আল হারিস বিন ফিহরী গোত্রের উতবা বিন আমর; আসাদ গোত্র থেকে নওফেল বিন খোয়ায়লিদ; নওফেল গোত্রের আবু আমর এবং মুর্তিম। এ সমস্ত সদস্যগণ হিলফুল ফুযূলের সাথে, যারা পূর্বে শত্রুভাবাপন্ন ছিল, যোগসাজস করায় অন্যান্য গোত্র দ্বারা ধিকৃত হয়। যেমন-বনু শাহম, বনু খালাফ অথবা বনু জুমাহ এবং বনু মখযুম।
কুরাইশদের প্রধান প্রধান গোত্রগুলো বনু হাশিম এবং বনু আল-মুত্তালিবের বিরুদ্ধে এক জোট সৃষ্টি করে। এরপর তারা প্রকাশ্যে বনু হাশিম এবং বনু আল-মুত্তালিবের বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ঘোষণা দেয়। এই সমাজচ্যুতির ফলে কুরাইশদের কোন গোত্র বা উপ-গোত্র বনু হাশিম এবং আল-মুত্তালিবের সাথে কোন প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। ৬১৬ থেকে ৬১৯, দু’বছরের অধিককাল ধরে কুরাইশদের বর্জননীতির ফলে মুসলমানদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। (এ সময় নবী করিম (স) তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীদের নিয়ে মক্কার প্রান্তদেশে ‘আবু তালিবের উপত্যকা’ নামক স্থানে বসবাস করেন। যাহোক, কয়েকজন প্রভাবশালী মক্কাবাসীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের ফলে তারা পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হলেও নবী করিম (স) আল্লাহর একত্ব ও মহত্ব প্রচারে কুণ্ঠিত হন নি।) সমাজচ্যুতি কতটুকু সফর হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কারণ এ সময়ে নিয়মিত খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা হয়। এই শিথিলতার কারণ ছিল এই যে, সমস্ত গোত্ৰ সমাজচ্যুত করে তাদের অনেক সদস্য বনু হাশিমের সাথে বৈবাহিক সূত্রে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই সমাজচ্যুতির ফলে হাশেম গোত্রের সিরিয়ায় বাণিজ্য ব্যাহত হয় নি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরাইশদের বর্জননীতি বিশেষ সফল হয় নি।
হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীদের সমাজচ্যুতি ছিল সাময়িক ঘটনা। এটি দু বছরের বেশি স্থায়ী হয় নি এবং এটি ছিল নব-দীক্ষিত মুসলমানদের জন্য কঠিন ঈমানের পরীক্ষা। ইসহাকের ভাষ্য অনুযায়ী, এই দুর্বিসহ অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য হিসাম বিন আমর বা আমির প্রথম উদ্যোগ নেন। তাকে সমর্থন দেন যুহাইর বিন আবি উমাইয়া (মখযুম গোত্রের), আল-মুতিম বিন-আদি (নওফল গোত্রের) এবং আবুল বুখারী এবং সামা বিন আল-আসওয়াদ (আসাদ গোত্রের)। কুরাইশদের বৈঠকে সর্বপ্রথম যুহাইর তার বক্তব্য পেশ করেন। তার মাতা ছিলেন আতিকা-বিনতে আবাদ-আল-মুত্তালিব এবং আবু তালিব ছিলেন তার মামা। এ কারণে হাশিম-পরিবারের সাথে তিনি সম্পৃক্ত। আবু তালিবের কবিতায় যুহাইরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। এর মূল কারণ, তিনি হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীদের নির্বাসন থেকে মুক্ত করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
যে পাঁচজন অবরোধ নিরসনের বিরোধিতা করেন, তারা বিভিন্ন গোত্রের সদস্য ছিলেন, যা পূর্বে বলা হয়েছে। যুহাইর মাখযুম গোত্রের, যার নেতা ছিলেন আবু জেহেল, সদস্য হয়েও তিনি তাঁর গোত্রের সমালোচনা করেন। উল্লেখ্য, কুচক্রী আবু জেহেল কুরাইশদের এই অবরোধ-নির্বাসন নীতির উদ্যোক্তা ছিলেন। অন্যান্য সব কুরাইশদের অবরোধ নীতির সমালোচনা করেন। তারা নওফেল, আসাদ এবং আমির উপ-গোত্রের ছিলেন এবং তারা কুরাইশদের আভ্যন্তরীণ যে শক্তিবলয় বা ‘আহলাফ’ ছিল, তার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। পূর্বে বলা হয়েছে যে, হিলফুল ফুযূলের অন্তর্গত গোত্রসমূহই ইসলামের পরম শত্রুতে পরিণত হয়। যেমন- আবদ শামস। পরবর্তীকালে এই গোত্ৰ মাখযুমের সাথে একত্রিত হয়ে ইসলামের চরম বিরোধিতা করেন (বদর, ওহুদ, খন্দকের যুদ্ধে)। যারা অবরোধ-নির্বাসনের বিরোধিতা করেন তাদের মূল উদ্দেশ্য, হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সঙ্গীদের পুনরায় মক্কায় ফিরিয়ে আনা নয়, বরং মক্কার বৃহত্তর ও শক্তিশালী গোষ্ঠীদের সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক প্রভাব খর্ব করে ক্ষুদ্র ও স্বল্প প্রভাবসম্পন্ন গোষ্ঠীদের প্রাধান্য বিস্তার করা।
আবু তালিবের মৃত্যু হলে (৬১৯ খ্রি.) আবু লাহাব হাশিম পরিবারের নেতা হলেন। এই সাথে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে তিনি তাঁর চাচার মৃত্যুতে মহাসঙ্কটের মধ্যে পড়েন। কারণ, তিনি গোত্রীয় নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হলেন।
(গ) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে সমঝোতার প্রস্তাব : ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে বিধর্মী কুরাইশদের আরোপিত অবরোধ ও নির্বাসন শুরু হবার পূর্বে পৌত্তলিক আবরদের কয়েকজন মুহাম্মদের কাছে একটি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে আসে। এ ধরনের ঘটনা ইবনে ইসহাক ও তাবারী উল্লেখ করলেও, ইবনে হিশামের ‘সিরাতে’ তা বলা হয় নি | যাহোক, বিভিন্ন গোত্রের চারজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে এক সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে বিরোধ মিটাবার জন্য যান। তারা হচ্ছেন আল-ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা (মাখযুম), আল-আসাদ-বিন ওয়াইল (সহম), আল-আসওয়াদ বিন আল- মুত্তালিব (আসাদ), উমাইয়া বিন খালফ (জুমা)। এঁদের মধ্যে তিনজন আহলাফের সদস্য ছিলেন, যারা ‘হিলফুল ফুযূল’ ও হিশাম পরিবারের চিরশত্রু ছিলেন। তাদের প্রস্তাব ছিল যে, বিধর্মীগণ আল্লাহর ইবাদত করবেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স) দেব- দেবীকে স্বীকৃতি দিবেন। এই ঘৃণ্য প্রস্তাব হযরত মুহাম্মদ (স) সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেন। আলওয়ালিদের প্রতিনিধিত্ব থেকে ধারণা করা যায় যে, আবু জেহেল তখনও মাখযুম গোত্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি (অর্থাৎ অবরোধ ও নির্বাসনের পূর্বের ৬১৬ খ্রি. ঘটনা) এবং তখনও হিশাম পরিবারের প্রধান আবু তালিব জীবিত ছিলেন। কারণ, অবরোধ তুলে নিবার পর ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) হিশাম ও আল-মুত্তালিব পরিবারের নিরাপত্তায় রয়েছেন। যদি এই মধ্যস্থতা বা সমঝোতা-অবরোধের আগে হয় তাহলে বলতে হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) এই ঘৃণ্য প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। এমনও বলা হয়েছে যে, প্রতিনিধিগণ সরাসরি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে এ ধরনের প্রস্তাব রাখেন নি। তাঁরা চাচা আবু তালিবের, যিনি পরিবার প্রধান, তার কাছে রেখেছিল। হযরত মুহাম্মদ (স) যখন এই চক্রান্তমূলক প্রস্তাব জানতে পারলেন তখন বলেন, “হে তাতঃ (চাচা)! এরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাঁ হাতে চাঁদ এনে দেয় তাহলেও আমি মহাসত্যের সেবা ও নিজের মহান কর্তব্য থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হব না।” অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, যেহেতু অবরোধ ভাঙ্গার জন্য চারজন এই ঘৃণ্য প্রস্তাব দেয়, সেহেতু অবরোধ চলাকালীন এই প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই চারজন তাদের নিজ গোত্রীয় স্বার্থে অবরোধের বিরোধিতা করে। অবরোধ তুলে নিলে মুসলমানদের জয় হবে ন্যায় ও সত্যের পথে এবং হযরত মুহাম্মদ (স) একজন অবিসংবাদী ধর্মীয় নেতার মর্যাদা লাভ করবেন। শুধু ধর্মীয় সংস্কারেই নয়, রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলি দ্বারা তিনি ভূষিত হবেন।
৫. বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ এবং তাদের উদ্দেশ্যাবলি
বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্ম প্রচারে কারা বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল এবং কি উদ্দেশ্যে করেছিল, তা জানা যায়। একথা সর্বজনবিদিত যে, মক্কার প্রভাবশালী পৌত্তলিক কুরাইশ গোত্র ধর্মপ্রচারে প্রধান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারের প্রধান বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের নাম সঠিকভাবে জানা যায় না। মদিনায় হিজরতের (৬২২ খ্রি.) দুই বছর পর ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদরের যুদ্ধে নিহত ও বন্দী মক্কাবাসীদের যে তালিকা পাওয়া যায় তা থেকে ধারণা করা যায় যে, কারা প্রকৃতপক্ষে রাসূলের বিরোধিতা করেছিল? এছাড়া আবু তালিবের কবিতায় যাদের নাম পাওয়া যায় তারা যে সকলেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধাচারণ করেছিল তাও বলা যায় না। তাছাড়া, বদরের যুদ্ধের পূর্বে বিধর্মী শত্রুদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তাতের আল-মুতিম বিন আদি এবং অন্যান্যদের যে নাম রয়েছে, তাও সঠিক নয়। এতদসত্ত্বেও ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সা’দ এবং তাবারী ইসলামের শত্রুদের যে তালিকা প্রণয়ন করেন, তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
বদরের যুদ্ধে নিহত হবার পূর্বে ইসলামের চরম শত্রু ছিল আবু জেহেল, যিনি মাখযুম গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার পূর্বে মক্কার সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল আল-ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা। বনু হাশিম ও বনু আল-মুত্তালিব গোত্রের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিরোধিতা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল আবু জেহেল। তিনি ইসলাম বিরোধী সংঘে নেতৃত্ব দেন।
কোন কোন ঐতিহাসিক ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের কারণ নির্ণয় করে বলেছেন যে, যদি মক্কাবাসীগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং পৌত্তলিকতা বর্জন করে। তাহলে আবর বেদুঈনগণ মক্কায় কারো ঘরে আসবে না এবং মক্কার ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। এই মন্তব্য খুব সন্তোষজনক নয়। লক্ষণীয় যে, কুরআনের কোন সূরায় মক্কার কা’বাঘরে উপাসনার বিরুদ্ধে কিছু বলা হয় নি। মক্কা বিজয়ের পর মূর্তিগুলো ধ্বংস করে কা’বাঘর পবিত্র করা হয়। মক্কী সূরাগুলোতে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যে আয়াতসমূহ নাজিল হয়েছিল তা মক্কার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দেব-দেবীর মন্দিরের পূজা অর্চনার বিরুদ্ধে। কুরআনে বলা হয়েছে “মক্কাবাসী আরবগণ অবিশ্বাস ও ভণ্ডামিতে আত্মনিয়োগ করেছে।” সূরা তাওবা (৯), ৯৭ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমগ্র আরবদেশে পৌত্তলিকতার ভয়াবহতা সম্বন্ধে সতর্ক করা হয়।) মক্কার কা’বাগৃহ আদমের সময় থেকে নূহ এবং তারপর ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের সময় থেকে আল্লাহর ঘর বা ‘বায়তুল্লাহ’ নামে পরিচিত ছিল। কা’বার মূর্তি স্থাপিত হয় অনেক পরে। বানু খোবাইজার পৌরহিত্যে সর্বপ্রথম মক্কার উপাসনালয়ে, যা প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে হজ্জের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়, দেব-দেবী স্থাপিত হয়। ইবনে হিশাম বলেন যে, আমর ইবন লুহাই সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়া থেকে আরব দেশে দেব-দেবীর মূর্তি আমদানি করেন। মক্কার উপাসনালয়ে সর্বপ্রধান বিগ্রহের নাম ছিল হোবাল এবং এর আশেপাশে ভবিষ্যৎ গণনার জন্য কতকগুলো তীর রাখা হত। এটি আরবদের প্রধান মন্দির ছিল এবং এখানে বলিদানের অনুষ্ঠান হত।
ওয়াট মনে করেন যে, মন্দির ধ্বংস হলেই যে বাণিজ্য পথ বন্ধ হয়ে যাবে এমন কোন সম্ভাবনা ছিল না। তাছাড়া ধারণা করা হয় যে, মক্কার বহির্বাণিজ্যের সাথে মরুবাসী বেদুঈনদের মক্কায় কা’বাঘরে হাজ্জ পালনের কোন সম্পর্ক ছিল না। সুতরাং ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণ সম্পূর্ণ পৃথক ছিল।
কুরাইশ বংশের কট্টরপন্থী পৌত্তলিকগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারে শঙ্কিত হয়ে পড়েন একথা ভেবে যে, ধর্মীয় আধিপত্যের আড়ালে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব পড়তে থাকবে। প্রাচীন আরব শেখ-তন্ত্রের মূলমন্ত্র ছিল যে, গোত্রের সর্বাপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠ, বিচক্ষণ, ন্যায়নিষ্ঠ, সুবিচারক ব্যক্তি গোত্রপ্রধান হবে। মক্কাবাসী যদি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সতর্কবাণীতে বিশ্বাসী হয়, তাহলে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ আল্লাহর প্রেরিত আসমানী গ্রন্থ কুরআনের ভিত্তিতে এবং সাফল্যজনক ধর্মপ্রচারের ফলে নব- দীক্ষিত মুসলমানদের সমর্থন লাভ করে মক্কায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিতে পরিণত হন। পৌত্তলিক মক্কাবাসী উসমান বিন আল-হুয়াইরিহের খ্রিস্টধর্মের দীক্ষার সাথে বায়জানটাইন খ্রিস্টান রাজার সমর্থনে মক্কার খ্রিস্টান শাসক’ হবার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল তা মোটেই ভুলে যায় নি। তাদের ধারণা হল যে, সতর্ককারী ধর্মীয় নেতা হযরত মুহাম্মদ (স) সময় ও সুযোগ মতো হয়ত একদিন মক্কার সর্বময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন। এ কারণে পাপিষ্ঠ পৌত্তলিকগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্ম প্রচারে প্রচণ্ড বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এই রাজনৈতিক আধিপত্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি লাভ করলে মক্কাবাসী বিধর্মী কুরাইশগণ ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে কপর্দকহীন হয়ে যেতে পারে এমন ভয় তাদের ছিল। আরব ব্যবসায়ীরা কুশিদ প্রথায় ধনাঢ্য হতে থাকে। কারণ হিজরতের (৬২২ খ্রি.) বহু পরে আল্লাহর নির্দেশে কুশিদ (‘রিবা’) নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। মক্কাবাসী স্বার্থান্বেষী ছিল এবং নিজস্ব সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিল। সাম্যবাদী ইসলাম ব্যক্তিগত সম্পদ কুক্ষিগত করার পরিপন্থী ছিল, যা মক্কার বিধর্মী অর্থলগ্নীকারকদের অপছন্দ ছিল। অর্থের সমবণ্টন সমাজের অগ্রগতি সাধিত করে এবং পুঁজিবাদ বন্ধ করে। ধর্মপ্রচারে সাফল্য ও সামাজিক সংস্কার হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে পারে, এই আশঙ্কাই ছিল পৌত্তলিক কুরাইশদের বিরোধিতার মূল কারণ। অনেকের কাছে এ ধরনের সাফল্য একচেটিয়া মাখযুম গোত্রের প্রতি হিলফুল ফুযূলের প্রচণ্ড আঘাত।
ইসলাম ধর্ম প্রচারে পৌত্তলিক কুরাইশদের প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতার মূল কারণ এই যে, কুরআনের বিভিন্ন সূরায় পৌত্তলিকতাকে ধিক্কার দেয়া হয়েছে এবং অংশীদারীত্বের স্থলে একেশ্বরবাদী ধর্ম গ্রহণের জন্য বারংবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। স্বভাবগত দিক থেকে আরবগণ রক্ষণশীল এবং তাদের রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থেকে। ঐতিহ্যগতভাবে তারা মন্দিরে দেব- দেবীর পূজা করতো, বলি দিত এবং তীরের (‘আযলাম’) সাহায্যে ভাগ্য নির্ধারণ করতো। ইসলাম প্রচার এই পৌত্তলিকতায় কুঠারাঘাত করে কিন্তু তাওহীদ প্রচারিত হলে, আরব গোত্রদের অনেকে ধর্মান্তরিত হল এবং অনেকে পূর্বপুরুষের ধর্ম পালন করতে লাগল। এর ফলে পরিবার ও সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হল। ইসলাম প্রতিষ্টিত হবার পরেও যারা তাওহীদের প্রতি অবজ্ঞা করে তারা শেরেকের কাজ করে এবং শরিয়ত অনুযায়ী তা ‘বিদাত’ বা পদঙ্খলন (ধর্মদ্রোহিতা)। একবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পুনরায় পূর্বপুরুষের পৌত্তলিকতায় ফিরে যাওয়া ‘বিদাত’ এবং এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। খলিফা আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে ভণ্ড নবীদের আবির্ভাব হয় এবং তারা স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। যেমন- আসাদ, তোলায়হা ও মুসাইলিমা। পৌত্তলিকতার কোন নৈতিক ভিত্তি ছিল না; গতানুগতিকভাবে তারা আল- লাত, মানাত ও উজ্জার মন্দিরে উপাসনা করত, যদিও তারা জানত না যে, পাথরের এসব বিগ্রহ তাদের কি উপকার করতে পারে? কুরআনে পৌত্তলিকদের পূর্বপুরুষেরা তাদের অবিশ্বাস, ভণ্ডামি ও অংশীদারীত্বের জন্য জাহান্নামে শাস্তি পাবে বলা হয়েছে। এ কারণে উত্তরসূরীরা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধাচারণ করে। এই বিরোধিতা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে হয়েছিল।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারে বাধা প্রদানের অনেক কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। স্বার্থপরতা ছাড়াও রক্ষণশীলতা, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি ধর্মীয় প্রাধান্য ও আধিপত্য বিস্তারের সমূহ সম্ভাবনায় পৌত্তলিক আরবগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বিরাজ করেছিল তা একেশ্বরবাদী মতবাদে পূরণ হয়। কিন্তু তৎকালীন প্রাক-ইসলামী যুগের বিরাজমান নৈরাজ্য সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করায় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মতো নির্ভীক ধর্মপ্রচারক ও সংস্কারকের প্রয়োজন ছিল।