রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

চতুর্থ অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা : (পূর্বের অনুবৃত্তি)

চতুর্থ অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা : (পূর্বের অনুবৃত্তি)

কৃষি :- ব্রিটিশাধিকারের প্রারম্ভে ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ যাহাকে “নিবিড় অরণ্য পূর্ণ ও বিরল মনুষ্য বসতি” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন,-শতাধিক বৎসর পূর্বে বন্য মহিষ ও বরাহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুগণ যে সমতল ক্ষেত্রে নির্ভয়ে বিচরণ করিত,- অধুনা সেই ত্রিপুরা শ্যামল শস্যশালী একটি সুন্দর কৃষিক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। এই ক্ষেত্রে নানা প্রকার শস্য উৎপন্ন হইতেছে, তন্মধ্যে ধান্য, পাট ও গুবাক প্রধান।

ধান্য :- ত্রিপুরায় নানা প্রকার উৎকৃষ্ট ধান্য উৎপন্ন হইয়া থাকে। এই জেলা হইতে প্রতিবৎসর প্রায় ৪০ লক্ষ মন তণ্ডুল অন্যান্য স্থানে প্রেরিত হয়।

ত্রিপুরায় উৎপন্ন ধানকে চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে;

১- আউশ, ২- শালী, ৩-বর্ষাল, ৪- বরো। আউস :- উপযুক্ত সময়ে বপন করিতে পারিলে ৬০ দিবস মধ্যে ॥৪৯৫॥ এই ধান্য উৎপন্ন হয়, এ জন্য ইহাকে “ষাইট্টা” বলে। প্রকৃত পক্ষে চৈত্র মাসের শেষ ভাগে আউশ ক্ষেত্রে বীজ বপন করিলে আষাঢ় মাসের শেষ ভাগে ইহা সুপক্ক হইয়া থাকে। আউশের মধ্যে কাঁচালনী চূইচাশাইল ও বোয়ালধারা প্রভৃতি উৎকৃষ্ট

শালী :- প্রথমত উচ্চ ক্ষেত্রে এই ধান্যের বীজ বপন করিয়া তৎপর তাহা উঠাইয়া লইয়া শ্রাবণ ভাদ্র মাসে কদমাক্ত ক্ষেত্রে রোপন করিতে হয়। অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে এই ধান্য সুপক্ক হইয়া থাকে। শালীধান্যের মধ্যে চাপলাইস, খইয়াপাকরী গোবিন্দভোগ, কালিজিরা, কুটিচিকন প্রভৃতি উৎকৃষ্ট।

বর্ষাল :- ফাল্গুণ চৈত্র মাসে নিম্ন ভূমিতে এই ধান্য বপন করিতে হয়। বর্ষার জল ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি হইলে এই ধান্য নষ্ট হয় না। ২০/২৫ হস্ত নিম্ন হইতে মস্তকোত্তোলন পূবর্বক জলের উপর ভাসিতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ অতিরিক্ত পরিমাণ জলপ্লাবন হইলে ধানের গাছগুলি মরিয়া যায়। অগ্রহায়ণ মাসে এই ধান্য সুপক্ক হইয়া থাকে। সরাইল ও নুরনগরের বিল সমূহে এই ধান্য প্রচুর পরিমাণ উৎপন্ন হয়। আউশ কিম্বা শালিধান্য এক বিঘা ভূমিতে যে পরিমাণ উৎপন্ন হয়, বর্ষাল ধান্য প্রায় তাহার দ্বিগুণ হইয়া থাকে। বর্ষাল ধান্যের মধ্যে, আমন, পরচুম, ভইসাখীর, কালামাণিক দিঘা প্রভৃতি সুপরিচিত।

বরো :- পৌষ মাঘ মাসে বিল ও নদীর চরে এই ধান্য বপন করা হয়। চৈত্র বৈশাখ মাসে ইহা সুপক্ক হইয়া থাকে। কিন্তু॥৪৯৬। শিলাবৃষ্টি এই ধান্যের বিষম শত্রু। বরো ধান্যের তণ্ডুল কেবলমাত্র নিম্নশ্রেণীর মানবদিগের খাদ্যোপযোগী।

বার্ষিক জলপ্লাবনই ত্রিপুরাকে শস্যশালিনী করিয়াছে, কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় জলপ্লাবন হইলে ত্রিপুরার সমস্ত শস্য বিনষ্ট হইয়া যায়। বিগত অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে দুইবার এইরূপ সবর্বসংহারক ভীষণ জলপ্লাবন হইয়াছে। ১২৬০ এবং ১৩০০ বঙ্গাব্দের বর্ষা আমরা ভুলিতে পারিব না।

২৫। ৩০ বৎসর পূর্বে ত্রিপুরার কৃষকগণ শস্যক্ষেত্রে সার দেওয়া নিষ্প্রয়োজনীয় বিবেচনা করিত। কিন্তু অল্পকাল মধ্য কোন কোন স্থানের উর্বরতা শক্তি এরূপ হ্রাস হইয়াছে যে, গোময়, ছাই, পুষ্করিণী ও খাল সমূহের পলিমাটি না দিলে উপযুক্তরূপ শস্য জন্মে না।

পাট :- ইহা নালিতা গুল্মের ত্বক। ৩০। ৩৫ বৎসর পূর্বে আমরা দর্শন করিয়াছি যে, ত্রিপুরাবাসী কৃষকগণ কেবল নিজ প্রয়োজনীয় কাৰ্য্য নির্বাহ জন্য অল্প পরিমাণ নালিতার চাষ করিত। কিন্তু অল্পকাল মধ্যে নালিতার চাষ ধান্যের উৎকৃষ্ট ভূমি অধিকার করিয়া বসিয়াছে। প্রতি বৎসর দুই লক্ষ মণেরও অধিক পাট ত্রিপুরা হইতে বিদেশে প্রেরিত হইয়া থাকে। নালিতার চাষ দ্বারা এ দেশের অনিষ্ট সাধিত হইতেছে, ইহা নির্বোধ কৃষক গণ বুঝিতে পারিতেছে না। প্রথমত দুফসলী জমিতে নালিতার চাষ হইয়া থাকে; সুতরাং ॥৪৯৭॥ একটি একটি ফসলের জন্য দুইটি ফসল নষ্ট করা হয়। দ্বিতীয় নালিতা ক্ষেত্রে যে রূপ সার দেওয়া হইয়া থাকে এবং তাহাতে যে রূপ অধিক পরিমাণ পরিশ্রম ও যত্ন করিতে হয়, সেই রূপ সার প্রদান করত সেই পরিমাণ পরিশ্রম ও যত্ন করিলে যে কোন ক্ষেত্রে সেই মূল্যের ধান্য উৎপন্ন হইতে পারে। তৃতীয়ত নালিতা দ্বারা নানা প্রকার রোগ ত্রিপুরায় উপস্থিত হইয়াছে। কারণ শ্রাবণ ভাদ্র মাসে যখন জলে দেশ প্লাবিত হয়, তখন নালিতা গুল্ম ছেদন করত স্রোত বিহীন জলে ভিজাইয়া রাখিতে হয়। ২০।২৫ দিন পরে যখন সে গুলি পঁচিয়া তাহার ত্বক (পাট) গ্রহণের উপযুক্ত হয় তখন জল দুষিত ও দুর্গন্ধ যুক্ত হইয়া পড়ে। অল্প সংখ্যক বাঁধা পুষ্করিণী ব্যতীত সমস্ত খাল, বিল, নদী ও পুষ্করিণীর জল তদ্বারা দূষিত হইয়া পড়ে। সেই জল পান করিয়া রোগের যন্ত্রনায় ত্রিপুরাবাসী ছটফট করিতে থাকে। তদ্বারা কত লোক অকালে কাল গ্রাসে পতিত হয় কে তাহার ইয়ত্তা করিবে। বাঙ্গালা দেশ মধ্যে জেলা ত্রিপুরা একটি স্বাস্থ্যকর স্থান। কিন্তু নালিতার চাষ দ্বারা সেই স্বাস্থ্যের নানা প্রকার বিঘ্ন উৎপাদিত হইতেছে।

প্রধানত চৈত্র, বৈশাখ মাসে নালিতার বীজ বপন করা হয় তৎপর চারা উঠিলে বারংবার তাহা বাছিয়া পরিস্কার করিয়া দিতে হয়। ভালরূপ বাছিয়া দিলে ও উপযুক্ত ॥৪৯৮॥ রূপ বৃষ্টির জল পাইলে নালিতা গুল্ম গুলি কাটিয়া জলে ভিজাতে হয়। ভাদ্র আশ্বিন মাসে তাহা হইতে পাট গ্রহণ করিয়া, আশ্বিন কার্তিক মাসে সেই পাট বিক্রয় করত একবারে কতকগুলি টাকা প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইহাই কৃষক গণ সুবিধাজনক বিবেচনা করে।

ত্রিপুরা জেলার মধ্যে নালিতার চাষে বলদাখাল পরগণা সর্বশ্রেষ্ঠ; তদনন্তর নরাইল ও নুরনগরের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। মেঘনাদের তীরবর্ত্তী অন্যান্য পরগণায় ও নালিতার চাষ হইতেছে। কিন্তু ত্রিপুরা জেলার দক্ষিণ পুর্বাশে অতি অল্প পরিমাণ নালিতার চাষ হইয়া থাকে।

গুবাক :- ধান্য ও পাটের পরেই গুবাকের উল্লেখ করা যাইতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার উপবিভাগে সুপারি বৃক্ষ নিতান্ত বিরল। সদর উপবিভাগের অন্তর্গত কোন কোন স্থানে সুপারি বাগান দৃষ্ট হইয়া থাকে। চাঁদপুর উপবিভাগ সুপারি বৃক্ষে অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে, বলিলে নিতান্ত অত্যুক্তি হয় না। এক বিঘা ভূমিতে এক সহস্র বৃক্ষ উৎপন্ন হইতে পারে এবং সেই এক সহস্র বৃক্ষের গুবাক বিক্রয় করিয়া বৎসর ২৫০ হইতে ৪ কিম্বা ৫শত টাকা লাভ হইতে পারে। সম্প্রতি সুপারি বৃক্ষের যে রূপ মড়ক উপস্থিত হইয়াছে, তদ্বারা অনেক কৃষক ও ভূম্যধিকারীকে পথের ভিখারি হইতে হইবে। প্ৰায় ৪০ বৎসর পূর্ব্বে আরও একবার একপ্রকার সুপারিমড়ক উপস্থিত হইয়াছিল। তৎকালে অনেকগুলি জমিদারী বাকী রাজস্বের জন্য নিলাম হইলে গর্বমেন্ট তাহা নিতান্ত অল্প মূল্যে ক্রয় করেন।

তদ্ব্যতীত আরও নানা প্রকার শস্য ত্রিপুরায় উৎপন্ন হইয়া থাকে।

১৩০০ বঙ্গাব্দের জলপ্লাবনে সমস্ত ধান্য বিনষ্ট হইলে চীনা ও কাওন নামক শস্য বপন করিয়া দরিদ্র কৃষকগণ প্রায় দুই তিন মাস হই িভক্ষণে জীবন যাপন করিয়াছিল। অল্প পরিমাণ গম, যব, ভুট্টা ত্রিপুরায় উৎপন্ন হইয়া থাকে। ত্রিপুরায় খেসারি, মুগ,সমুরি, মটর, বুট, কলাই ও অরহর প্রভৃতি দাইল জন্মে। ত্রিপুরার অরহর অতি উৎকৃষ্ট। কিন্তু তাহা নিতান্ত অল্প পরিমাণে জন্মিয়া থাকে। প্রচুর পরিমাণ অড়হরের চাষ করিয়া তাহা বিদেশে প্রেরণ করত ত্রিপুরার কৃষকগণ বিশেষ রূপ অর্থ লাভ করিতে পারে। কারণ এরূপ উৎকৃষ্ট অরহর অণ্য কোন জেলায় জন্মে না।

নানা প্রকার তিল, সর্ষপ প্রভৃতি তৈলাক্ত শস্য ত্রিপুরায় উৎপন্ন হইয়া থাকে।

ফল : ত্রিপুরায় প্রচুর পরিমাণে আম্র জন্মিয়া থাকে। কিন্তু তাহার অধিকাংশ পোকায় অখাদ্য করিয়া ফেলে। অল্প পরিমাণ উৎকৃষ্ট কমলালেবু ত্রিপুরায় উৎপন্ন হয়, কিন্তু॥৫০০॥ তাহার ব্যবসায় চলিতে পারে না। প্রচুর পরিমাণ উৎকৃষ্ট কাঁঠাল এই জেলায় উৎপন্ন হইয়া থাকে। চীনা পরিব্রাজক হিয়ানসাঙ অদ্য জীবিত থাকিলে কামরূপবাসীর ন্যায় তিনি ত্রিপুরাবাসীকে “কাঠাল ও নারিকেল” ভূক্ মনুষ্য বলিয়া বর্ণনা করিতেন। তদ্ব্যতীত আরও নানা প্রকার ফল ত্রিপুরায় উৎপন্ন হইয়া থাকে।

নীলের চাষ :- জিঃ পিঃ ওয়াইজ সাহেব মেঘনাদের তীরবর্ত্তী শ্রীমদ্দে, দুলালপুর, ব্রাহ্মণচর, মাছিমপুর, ভাঙ্গারচর এবং আকানগর নামক স্থানে কুঠি সংস্থাপন করিয়া নীলের চাষ আরম্ভ করিন। ক্রমে নীলকুঠির আয় ও অত্যাচার বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। অত্যাচারের মাত্রা ভীষণ ভাব ধারণ করিলে পার্শ্ব বর্ত্তী জমিদার ও কৃষকগণ দলবদ্ধ হইয়া আত্মরক্ষার জন্য দণ্ডায়মান হইল।[২২] তাহাদের দৃঢ়একতার বলে অত্যাচারী নীলকর পরাজিত হইল। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরায় নীলকরের পূর্ণ উন্নতি; ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তাহার বিনাশ সাধিত হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ ত্রিপুরায় নীলের চাষ বন্ধ হইয়া ॥৫০১ গিয়াছে। নীলকরের অত্যাচার কালে ত্রিপুরাবাসীগণ যে রূপ একতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করিয়াছে, বাঙ্গালার অন্য কোন জেলার লোক তাহা দেখাইতে পারে নাই।[২৩] নীলকরের দেশীয় কর্মচারিগণও তাহাদের বিনাশ সাধন জন্য বিশেষ যত্ন করিয়াছেন। ওয়াইজ সাহেবের জমিদারির প্রজাগণ ও তাঁহার প্রতিকূলে দণ্ডায়মান হইয়াছিল।

শিল্প :- বিগত শতাব্দীর প্রথম ভাগে ডি, ফো বলিয়াছিলেন, “ভারতের শিল্পীগণ আমাদের সর্বনাশ করিল।”এক্ষণ আমরাও বলিতে পারি যে, ইংরেজ শিল্পীগণ আমাদের সর্বনাশ করিতেছে। কার্পাস বস্ত্র বয়ন ত্রিপুরার প্রধান শিল্পকার্য্য ছিল। আমরা পূর্বে বলিয়াছি বিদ্যালোচনায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগবাসিগণ ত্রিপুরার শীর্ষ স্থানে বিরাজ করিতেছেন। তদ্রুপ শিল্প কার্য্যের জন্যও তাহারই শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিয়াছিল। সরাইলের তন্তু বায়গণ কার্পাস সূত্রদ্বারা উৎকৃষ্ট তঞ্জেব ধুতি, চাদর ও শাড়ি প্রস্তুত করিত। ২০। ২৫ বৎসর পূর্বে আমরা যাহা দর্শন করিয়াছি এক্ষণ তাহাও লোপ পাইতেছে। প্রাচীন”ঢাকাই মসলিন”॥৫০২॥ জগতে অতুলনীয় বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। সেই মসলীনেরই স্থানীয় নাম তঞ্জেব। যে তঞ্জেবের পোষাক পরিধান করত আঔরংজেব বাদসাহের এক কন্যা তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে সম্রাট তাহাকে” উলঙ্গ” বলিয়া ভৎসনা করিয়াছিলেন, সেই তঞ্জের প্রচুর পরিমাণে সরাইলে প্রস্তুত হইত;[২৪] কিন্তু তাহা ঢাকাই তঞ্জেবের সহিত বিদেশে প্রেরিত হইত বলিয়া বিদেশবাসীগণ সরাইলের নাম জ্ঞাত ছিলেন না।[২৫] সরাইলের তন্তুবায়গণের প্রস্তুতি ২০।২৫ টাকা মূল্যের ধুতির জোড়া আমরা দর্শন করিয়াছি। পাইরের সুক্ষ্ম কার্য্যের জন্য এই সকল বস্ত্রের মূল্য বৃদ্ধি হইত না,॥৫০৩॥ কারণ সরাইরের তন্তুবায়গণ পাইরের কার্য্যর জন্য অতি তুচ্ছ বিবেচনা করিত। সূক্ষ্ম সূত্রদ্বারা তাহারা অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় প্রদান করিত।

ত্রিপুরায় যুগীগণ নানা প্রকার মোটা কাপড় প্রস্তুত করিত। বিলাতী শিল্পগণ ক্রমে ক্রমে তাহাদেরও সর্বনাশ করিয়াছে। বাপ্তা বস্ত্রের কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। বলদাখাল পরগণার অন্তর্গত বাঁসকাইট নামক স্থানে মধ্যবিধ ও গৃহস্থ স্ত্রীলোকদিগের পরিধেয় শাড়ী ও ধুতি প্রস্তুত হইত। এক্ষণ তাহাও বিলুপ্ত হইয়াছে। তন্তুবায় ও যুগীগণ অন্যান্য ব্যবসায় অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছে। অল্পকাল মধ্যে ময়নামতী পবর্বতের নিকটবর্ত্তী স্থানবাসী যুগীগণ এক প্রকার ছিট বস্ত্র বয়ন করিয়া অল্প হইলেও কিঞ্চিৎ খ্যাতি লাভ করিয়াছে। এই ছিটদ্বারা পিরণ, সার্ট, কোঠ ও পেন্টুলন প্রস্তুত করা যাইতে পারে। লেপ, তুষক, বালিশ ও পর্দা প্রস্তুত উপযোগী নানা প্রকার ছিট তাহারা প্রস্তুত করিতেছে। এই ছিটের মধ্যে কতকগুলি বিলাতী” এঙ্গোলোর”ন্যায় পরিলক্ষিত হয়।

ত্রিপুরাবাসী সূত্রধরগণ যে শিল্পকাৰ্য্যে বিশেষ উন্নতি লাভ করিয়াছিল তাহার প্রমাণ গজদন্তের কারুকার্য্যের দ্বারা অদ্যাপি প্রাপ্ত হওয়া যায়। প্রাচীনকালে গজদন্ত দ্বারা নানা প্রকার অলঙ্কার প্রস্তুত হইত, দেশীয় মহিলাগণ স্বর্ণ॥৫০৭॥ রৌপ্যের পরিবর্ত্তে সেই সকল অলঙ্কার পরিধান করিতেন। প্রস্তরের শিল্পকার্য্য ত্রিপুরায় লুপ্ত হইয়াছে। লোহার শিল্পকার্য্যের নিতান্ত অবনতি হইয়াছে। সরাইল পরগণায় পূর্বকালে নানা প্রকার কাগজ প্রস্তুত হইত। বিলাতী কাগজের আমদানী দ্বারা দেশীয় “কাগজি” গণ কৃষিকার্য্যে করিতে বাধ্য হইয়াছে।

সরাইল পরগণার অন্তর্গত হর্ষপুর নিবাসী কুম্ভকারগণ মাটীর কার্য্যে বিশেষ উন্নতি লাভ করিয়াছিল। অদ্যাপি তাহার চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে।

দেশীয় সর্বপ্রকার শিল্পকার্য্যের ক্রমেই বিনাশ সাধিত হইতেছে।২৬ বিলাতী শিল্পীগণ দেশীয় শিল্পীদিগের ভীষণ শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। বিলাতী শিল্পীদিগকে জয় করিতে না পারিলে এদেশের মঙ্গলের আশা সুদূরপরাহত।

বাণিজ্য :- বিবার্লি সাহেব বলিয়াছেন:-”পৃথিবীর॥৫০৫॥ ব্যবহার শাস্ত্রানুসারে, আদত দ্রব্য উৎপন্ন করিয়া তাহা বিলাতের কারখানায় প্রেরণ করাই ভারতের একমাত্র বৈধকাৰ্য্য হইয়াছে।

এই বাক্যগুলি সম্পূর্ণ সত্য। যে দেশের কার্য্য বিলুপ্ত হইয়াছে, সে দেশের বাণিজ্যের আশা দুরাশা মাত্র। বৌদ্ধধর্মের উন্নতির সময়ে এদেশের বাণিজ্যের যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছিল। বৌদ্ধদ্রোহী ব্রাহ্মণগণ বাণিজ্যের শিরে কুঠারাঘাত করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা “বণিক বৃত্তি ও “সমুদ্রযাত্রা” কে পাপময় ঘৃণিতকার্য্য বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।

তাঁহাদের অন্যায় শাসনে হিন্দু গণবিলাতী শিল্পী ও বণিকদিগের “নগদামুটে” হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

ত্রিপুরা জেলাবাসীর খাঁটি বাণিজ্য এই দেখা যাইতেছে যে, তাহারা কতকগুলি তণ্ডুল ও পাট বিদেশী বণিকদিগের নিকট বিক্রয় করিয়া যৎকিঞ্চিৎ অর্থলাভ করিয়া থাকে। চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব কমিসনর হেঙ্কি সাহেব লিখিয়াছেন “চট্টগ্রাম হইতে প্রতি বৎসর প্রায় ৩০ লক্ষ মণ তণ্ডুল সমুদ্র পথে বিদেশে প্রেরিত হয়, তৎসমস্তই ত্রিপুরা ও নওয়াখালী হইতে আইসে” “ত্রিপুরা ও নাওয়াখালীর কৃষকগণ চট্টগ্রামে তণ্ডুল প্রেরণ না করিলে তাহার বহির্বাণিজ্য এককালে বন্ধ হইয়া যাইবে। উত্তর ও মধ্য ত্রিপুরা হইতে অধিক পরিমাণ তণ্ডুল নারায়ণগঞ্জে প্রেরিত হইয়া থাকে।॥৫০৬॥

ত্রিপুরার সমস্ত পাট নারায়াণগঞ্জের দেশী ও বিলাতী আড়তদারগণ ক্রয় করিয়া কলিকাতা প্রেরণ করেন।

অন্যান্য বস্তু অল্প পরিমাণ অন্যান্য জেলায় প্রেরিত হয়। ত্রিপুরা হইতে মাছরাঙ্গা পক্ষীর পালক চট্টগ্রামে প্রেরিত হয়, তথা হইতে এ সকল দ্রব্য সমুদ্রপথে ব্রহ্মা ও চীন দেশে প্রেরিত হইয়া থাকে। ত্রিপুরা হইতে শুকনা মৎস্য চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রেরিত হয়। ত্রিপুরা হইতে প্রায় দুই লক্ষ মণ সুপারী অন্যত্র প্রেরিত হইয়া থাকে। তিন লক্ষ অধিক নারিকেল এই জেলা হইতে অন্যত্র প্রেরিত হয়।

অন্যান্য স্থান হইতে ত্রিপুরায় যে সকল দ্রব্য আমদানী হয়, তাহার অধিকাংশই প্রায় বিলাতি। তন্মধ্যে কার্পাসবস্ত্র, লবণ ও কেরোসিন তৈল প্রধান। কার্পাসবস্ত্র দ্বারা বিলাতি বণিকগণ ত্রিপুরা জেলা হইতে প্রায় ৩। ৪লক্ষ টাকা বার্ষিক আদায় করিয়া লইতেছেন।

আচার ব্যবহার :- ত্রিপুরাবাসী উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদিগের সামাজিক ব্যবহার সম্বন্ধে দুই একটি কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি যে বল্লাল ও দেবীবর ত্রিপুরাবাসী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে পারেন নাই। এ জন্যই কৌলিণ্যের বিষময় ফলে তাঁহারা জর্জরিত হয়েন নাই, ১০। ১৫ কিম্বা ২০। ৫০ টি বিবাহ করিয়াছেন এরূপ লোক কদা কস্মিনকালে ত্রিপুরায়॥৫০৭॥ জন্ম গ্রহণ করেন নাই; কিম্বা একটি বালক বরের সহিত অশীতি বর্ষীয়া বৃদ্ধার বিবাহ ও জেলায় হয় নাই। যাহারা অর্থলোভে বৃদ্ধ বরে বালিকা কন্যা সম্প্রদান করেন, তাঁহাদের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু সামাজিক বন্ধনের বীভৎস অভিনয় ত্রিপুরায় ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে কখনও অভিনীত হয় নাই। কায়স্থ জাতির”আদিরস”ত্রিপুরায় অপরিজ্ঞাত। এই সকল জঘন্য সামাজিক অত্যাচার হইতে ত্রিপুরা চিরকাল মুক্ত রহিয়াছে। আর ও সুখের বিষয় যে, ত্রিপুরায় উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণ “সম্মতি বিধির” জন্য ভয়ে ম্রিয়মান নহেন। অর্থলোভী কন্যা বিক্রেতা ব্যতীত প্রায় কেহই দ্বাদশ বৎসরের পূর্বে কন্যা দান করেন না। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদিগের মধ্যে ক্রমে ক্রমে শিশু বিবাহ বন্ধ হইয়া যাইতেছে২৭। কেবল নিম্ন বাল্য বিবাহের প্রতি কিঞ্চিৎ আগ্রহ দৃষ্ট হয়, কিন্তু তাহারাও ১০। ১১ বৎসরের পূর্বে কোন বালিকাকে পাত্রস্থ করেন। তাহাদের মধ্যে ১৩। ১৪ বৎসরের অবিবাহিতা বালিকা নিতান্ত দুস্প্রাপ্য নহে। চণ্ডাল মালী প্রভৃতি নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুর মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। কিন্তু বিধবা বিবাহকারী ব্যক্তি ও তাহার সন্তানগণ সমাজে কিঞ্চিৎ হেয় বলিয়া বিবেচিত হয়।।৫০৮।

.

টীকা

২২. ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ উভয় পক্ষের প্রতি দোষারোপ করিয়াছেন, কিন্তু নীলকর প্রপীড়িত কৃষকগণের হৃদয় বিদারক করুণ সঙ্গীত স্মরণ করিলে অদ্যাপি পাষাণ হৃদয় দ্রবীভূত হয়।

২৩. The opposition to the on the part both of the neigbouring zamindars and of the planters’ tenants was so desperate, that none of the facto- ries could hold out against it. Statistical Account of Bengal Vol VI. p 425.

২৪. In the North of the District, in the Fiscal Division of Sarail, a very fine description of Muslin in made, called Tanjib, which is said to be nearly as good in texure and quality as the Shabnam Muslins of Dacca, The thread is spun by hand, and the muslin is not usually made by the weavers unless they have a special order. Statistical Account of Bengal Vol. VIp 418.

২৫. সরাইলের পনির “ঢাকাই” বলিয়া সর্বত্র পরিচিত হইয়াছিল; কিন্তু ঢাকা জেলায় বোধহয় এক তোলা পনিরও কদা কস্মিন কালে প্রস্তুত হয় নাই। সাউদারলেন্ড সাহেব লিখিয়াছেনঃ- Some of our readers may not perhaps know the so-called Dacca cheeses, are really all made at Sorail, When made to particular order they are very good. Calcutta Review, Vol XXXV p 326.

২৬. All the old indigenous industries of this provinces are deeaying. Such as the muslins and other of the finest cotton fabrics, the coars- er cotton cloths, the brass wars, the wicker work and others. Bengal Administration Report 1874-75.

২৭. বিগত দশ বৎসর যাবৎ সমাজের গতি আমরা বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি। এই কাল মধ্যে আমাদের পরিচিত যে সকল বালক বালিকা বিবাহ কালে দ্বাদশ বৎসরের ন্যূন বয়স্কা ছিলেন। ১৩।১৪ বৎসরের বালিকার সংখ্যা অধিক, ১৫। ১৮ বৎসরের বালিকা বোধ হয় মোট সংখ্যার চতুর্থাংশে হইবে। ১৭। ১৮ বৎসরের বালিকার সংখ্যা ৩। ৪ টি মাত্র হইতে পারে।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *