চতুর্থ অধ্যায় – কিশোর বয়সে শাসক

চতুর্থ অধ্যায় – কিশোর বয়সে শাসক 

বাবুর তাঁর আত্মকথা শুরু করতে গিয়ে লিখেছেন—বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। 

অর্থাৎ, সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি অসীম দয়ালু, অতীব কৃপাবান।

হিজরি ৮৯৯, রমজান মাসে (জুন, ১৪৯৪) যখন আমার বয়স বারো বছর ছিল, তখন আমি ফারগানা দেশের শাসক পদ লাভ করি। 

ফারগানা একটি ছোট দেশ। এখানে প্রচুর পরিমাণে আনাজ ও ফলমূল উৎপন্ন হয়। পশ্চিম সীমান্ত বাদে অবশিষ্ট ফারগানা বালুকাময় পার্বত্যভূমি দিয়ে ঘেরা। কোনো শত্রু কেবল শীত ঋতুতেই খুজন্দ ও সমরখন্দের দিক থেকে এখানে প্রবেশ করতে পারে। 

এর উত্তর—পশ্চিম দিক থেকে শাইহুল নদী খুজন্দ হয়ে প্রবাহিত হয়ে আসে। এটি ‘শাহ রুখিয়া’ নামেও সুপরিচিত। এটি উত্তর দিকে তুর্কিস্তানে চলে গেছে। এই নদী কোনো সাগরে গিয়ে পতিত হয়নি; বরং ঢালু ভূমি বেয়ে প্রবাহিত হতে হতে বালুকাময় ভূমিতে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 

ফারগানার মধ্যে সাতটি নগর আছে। পাঁচটি দক্ষিণ দিকে এবং দুটি উত্তরে শাইহুল নদীর তটে অবস্থিত। দক্ষিণের পাঁচটি নগরের অন্যতম হলো আন্দিজান নগর। এটি ফারগানার রাজধানী। এখানে প্রচুর পরিমাণে আনাজপাতি ও ফলমূল জন্মায়। এ নগর আঙুর এবং তরমুজের জন্যও সুপ্রসিদ্ধ। আন্দিজানের নাশপাতির কোনো তুলনা হয় না। সমরখন্দ ও কেশের কেল্লাগুলির পরেই আন্দিজানের কেল্লার নাম আসে। এর তিনটি ফাটক আছে। এই কেল্লা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। কেল্লা থেকে পানির সাতটি স্রোতোধারা বাইরের দিকে প্রবাহিত হয়। এটি অত্যন্ত খরস্রোতা। কেল্লার অধিকাংশই কাঁটাদার ঝোপঝাড় দিয়ে ঢাকা। আন্দিজান পশুপাখিদের একটি উত্তম শিকার—ক্ষেত্রে। এখানকার একজন কৃষক অন্য স্থানের চারজন কৃষকের সমান আহার করে। এরা খুবই স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকে। 

ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বর্ণনা 

আন্দিজানের বাজার ও লোকালয়গুলোতে তুর্কি জাতির লোকেদের আধিক্য দেখা যায়। লোকেদের বলার এবং লেখার শৈলী সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ। সবাই আল্লাহভক্ত। মশহুর সংগীতজ্ঞ খাজা ইউসুফ আন্দিজানে জন্মগ্রহণের জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করেন। এখানকার আবহাওয়া এমনই যে, এখানকার অধিকাংশ লোক শারদ ঋতুতে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত মধুর। এখানে পানির উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে। বসন্ত ঋতুর বাহার তো দেখার মতো। এখানে অনেক রীতি—রেওয়াজ বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এর দক্ষিণ—পূর্বে, চারদিকে উঁচু প্রাচীর ও পর্বত বেষ্টিত বারাকোহ নগর রয়েছে। এখানে বাগ—বাগিচার বিপুল সমারোহ দেখা যায়, তবে এটি উপেক্ষার শিকার হয়েছে। এখানকার স্বচ্ছ দিঘি ও পুকুরগুলোতে নীল ফুল ফুটে আছে। ঘণ্টা আকারের রঙ—বেরঙের ফুল (টিউলিপ) এবং গোলাপেরও এখানে বিপুল সমারোহ দেখা যায়। বারাকোহের এক প্রান্তে জাউরা নামক একটি যমজ মসজিদ রয়েছে যা খুবই সুন্দর। মসজিদের মধ্য দিয়ে শহর অভিমুখে প্রবাহিত নহর পাহাড়ি উপত্যকার দিকে চলে গেছে। মসজিদের অঙ্গন খুবই সুসজ্জিত। সামনে রয়েছে পান্থশালা, যেখানে দেশ—বিদেশের মুসাফিররা বিশ্রাম নিতে পারেন। 

আন্দিজানের পশ্চিমে সড়কের কিনারে—কিনারে আনার ও খুবানি গাছের বাগিচা বড়ই মনোরম দৃশ্যের অবতারণা করে। এখানকার আনার তার বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘দানা-এ-কলা’ নামে সুবিখ্যাত। রসালো ও সুস্বাদু আনার ছাড়াও এখানকার খুবানিও ‘জৰ্দ-জব’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। এক বিশেষ ধরনের খুবানিও এখানে জন্মায়, যা শুকিয়ে যাওয়ার পরেও তার গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখে। এর বীজকে মানুষ পাথর দিয়ে ভাঙে, যাতে তা থেকে শাঁস বেরোয়। এই শাঁস অত্যন্ত সুস্বাদু হয়ে থাকে। 

প্রাকৃতিক—ঐতিহাসিক বৰ্ণনা 

এখানকার লোকেদের প্রিয় সখ হলো পশু—পাখি শিকার করা। কিছু লোক কুস্তি করতেও খুব ভালোবাসেন। সমরখন্দ ও বুখারার অধিকাংশ বহিরাগত লোক মার্খিলং নগরের বাসিন্দা। এদের ‘জাগলার’ বলা হয়। এটিও পর্বত-বেষ্টিত, বাগ-বাগিচায় পূর্ণ শস্য-শ্যামল নগর। এখানকার পাহাড়ি গ্রামেও জনবসতি রয়েছে। প্রাকৃতিক পানি ব্যবস্থার উত্তম স্রোত রয়েছে এখানে। এখানে বিভিন্ন রকমের ফলমূলও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তবে অধিকাংশ বাগিচা বাদামের। এখানকার সমস্ত মানুষ ফার্সি ভাষা ব্যবহার করেন। নগরের দক্ষিণ দিকে দু’ মাইল দূরে পাহাড়ি উপত্যকায় এমন একটি চটান আছে যাকে ‘মিরর স্টোন’ নামে অভিহিত করা হয়। এটি প্রায় দশ হাত লম্বা এবং একটি মানুষ সমান উঁচু। এর উপর সমস্ত বস্তু দর্পণের সমান প্রতিবিম্বিত হয়। 

অসফারা—বখ্ নগরের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এ ছাড়া অন্যান্য জেলা হলো—বরুখ, সুখ ও হুশিয়ার। 

মুহম্মদ শায়বানি খান যখন মাহমুদ খান ও আলাচা খানকে পরাজিত করে তাশখন্দ ও শাহরুখিয়া অধিকার করে নেন তখন আমি সুখ ও হুঁশিয়ারের পাহাড়ি উপত্যকায় চলে যাই। এখানে এক বছর ধরে অত্যন্ত কষ্টদায়ক জীবন যাপনের পর আমি কাবুলের আজিমাত নামক স্থানে চলে যাই। আন্দিজানের পশ্চিমের সড়ক পথ ধরে খুজন্দনগর পঞ্চাশ আলগাচ* দূরে। সমরখন্দ পূর্ব দিক থেকে খুজন্দ ঠিক এতটা দূরে অবস্থিত। এটি প্রাচীন নগরগুলোর একটি। এখানে শেখ মসলাহাত ও খাজা কামাল ফলের চাষ করেন। 

[* লাল ছাল বিশিষ্ট বিশাল বৃক্ষ। ]

এখানকার আনার তার স্বাদের জন্য দূর—দূরান্ত অবধি সুপ্রসিদ্ধ। লোক যে রকম সমরখন্দের আপেলের সুনাম করেন ঠিক তেমনই তারা খুজন্দের আনার সম্পর্কে আলোচনা করেন। খুজন্দের কুরঘান শহর বেশ উঁচুতে অবস্থিত এবং এর চার দিকে দেওয়াল টানা হয়েছে। এর উত্তরে শাইহুন নদী কিছু দূর থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের ন্যায় উড়ে যাওয়ার মতো করে প্রবাহিত হচ্ছে বলে মনে হয়। এই নদী এই নগরীর উত্তর দিকে অবস্থিত মনুঘুল পাহাড়ি উপত্যকা থেকে নেমে আসে। লোকে বলে এখানে পোখরাজ ও অত্যন্ত মূল্যবান পাথরের খনি রয়েছে। এখানে প্রচুর পরিমাণে সাপও রয়েছে। খুজন্দের লোকেরা প্রচুর পরিমাণে পশুপাখি শিকার করেন। কিষান ও খরগোশ সর্বত্রই নজরে পড়ে। এখানকার জলবায়ু দূষিত। পাতাঝরার মৌসুমে সাধারণভাবে এখানকার মানুষ জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়ে। লোকেদের মধ্যে প্রচলিত আছে গৈরিয়া পাখিরা পাহাড়ের উত্তর দিক থেকে এই জ্বর বয়ে নিয়ে আসে। 

খুজন্দ ও কন্দে—বাদামের মধ্যকার বিস্তৃত ক্ষেত্রটি ‘হা—দরবেশ’ নামে পরিচিত। এখানে প্রায়শই খুব জোরে বায়ু প্রবাহিত হয়। এই খরবায়ু মরঘিনামের পূর্ব দিক থেকে আসে এবং পশ্চিমের দিকে চলে যায়। লোকে বলে, এই বায়ু কোনো দরবেশের অনুগ্রহের পাত্র হওয়ার জন্য মরুভূমির ঝড়ের মতোই নিষ্ঠুরভাবে বয়ে যায়। এই প্রবল গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিবাত্যার আওয়াজ শুনলে মনে হয় যেন সে ‘হা—দরবেশ, হা—দরবেশ’ করে ডাকতে ডাকতে প্রবল বেগে ছুটে চলেছে। 

শাইহুন নদীর উত্তরের নগর—শৃঙ্খলার অন্যতম নগর হলো ‘অকশা’। বইপত্রে একে অকশিকা লেখা হয়েছে। এখানকার প্রসিদ্ধ কবি অসিরুদ্দীন ‘অকশিশ’—র নামানুসারে এই শহরের এই নামকরণ হয়েছে। 

আন্দিজান, ফারগানার অকশার চেয়ে বড় নগর। অকশা নগর সড়ক পথে নয় ইয়ালগচ দূরে অবস্থিত। উমর শেখ মির্জা একে রাজধানী বানিয়েছিলেন। এই নগরের নিচে দিয়ে শাইহুন নদী বয়ে গেছে। এই নগর তার উচ্চ মর্যাদার জন্য গর্ব করে। এর নিচে রয়েছে ভয়ংকর উপত্যকা। উমর শেখ মির্জা যখন একে রাজধানী বানিয়েছিলেন তখন তাঁর সুবিধার জন্য দু—একটি উপত্যকাকে কেটে দিয়েছিলেন। এখানে গ্রাম নেই। এখানে সম্পূর্ণ রূপে শহুরে জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানকার তরমুজ অতি উত্তম স্বাদের হয়ে থাকে। এর একটি প্রকারের নাম মীর তিমুর। আমি বলতে পারি না যে, এই প্রকারের তরমুজ দুনিয়ার আর কোথাও জন্মায় কি—না। পুলাবার তরমুজও খুব প্রসিদ্ধ, তবে, যখন আমি সমরখন্দে পৌঁছাই তখন এখানকার তরমুজের প্রশংসা শুনে আমি তা আনিয়ে নিই। দুটিই কেটে যখন তার স্বাদ গ্রহণ করি তখন আমি জানতে পারি যে, অকশার তরমুজের মোকাবিলায় বুখারার তরমুজ কিছুই নয়। অকশার লোকেরাও পশুপাখি শিকার করতে খুব পছন্দ করে। শাইহুন নদীর ওই পারে বড় জঙ্গল রয়েছে, জঙ্গলের পর আন্দিজানের খরখোশ ও কৃষকদের খুব নজরে পড়ে। 

এরা আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল। কাসন, অকশার একটি ছোট্ট লোকালয়। কাসনেও খুব সুন্দর সুন্দর বাগিচা আছে। কাসন ও অকশার মধ্যে মৌসুমের সৌন্দর্য ও আবহাওয়ার মধ্যে যেন হুড় লেগে যায়। এ কথার উপসংহার টানা বেশ সুকঠিন যে, কোন এলাকাটি বেশি সুন্দর আর কোন এলাকাটি কম সুন্দর। 

ফারগানার পরিবেষ্টিত পাহাড়ি উপত্যকার কোনো তুলনা নেই। এখানাকার লাল ছাল বিশিষ্ট গাছ থেকে পটকা তৈরি হয়। এর ডাল খোদাই করে তৃণীর ও ডাল চেঁছে তীর তৈরি করা হয়। এমন সুন্দর কাঠ সর্বসুলভ নয়, অতএব, তাকে দুর্লভ বলাই শ্রেয়। এই ইয়ালগচ পাহাড়ের উপর জন্মায়। এই গাছের দৈর্ঘ্যকে মাপের একক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। এখানকার পাহাড়ি উপক্যতায় পোখরাজ ও লোহার খনি রয়েছে। 

বংশাবলি ও যুদ্ধের বর্ণনা 

উমর শেখ মির্জা অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও মিথ্যাভিমানী শাসক ছিলেন। তিনি সর্বদাই অন্যের রাজ্য জয় করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। সমরখন্দের বিরুদ্ধে তিনি কয়েকবার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেন। কয়েকবার তিনি পরাজিত হন এবং কয়েকবার তাঁকে পিছু হটে আসতে হয়। তাঁর শ্বশুরকে তিনি কয়েকবার তাঁর রাজ্যে আমন্ত্রণ জানান। আমার নানার নাম ছিল ইউনুস খান। মোগল ‘খান’দের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল সর্বশীর্ষে। এ সম্মান তিনি চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খানের কারণে লাভ করেছিলেন। তিনি আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। খান (ইউনুস খান), মির্জা (উমর শেখ মির্জা)—র কয়েকবার আমন্ত্রণের পর ফারগানা আসেন। তাঁকে তিনি জমি দেন। তবে আংশিক রূপে নিজের অসদাচরণের কারণে মোগলদের উচ্চ ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে তিনি সমর্থ হননি। মির্জার কাছে খান যখন শেষ বারের মতো আসেন তখন তিনি (মির্জা) ছয়টি মাত্র নগরীর অধিপতি রয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি (খান) মোগলিস্তানে চলে যান। 

১৪৯৪ ঈসায়ী সন অবধি মোগল খানের পদবি মাহমুদ খান, ইউনুস খানের কাছে রয়ে যায় যাঁরা উমর শেখ মির্জার ভাই ছিলেন। তারপর সমরখন্দের শাসককে তাঁর আচরণ দ্বারা এমন রুষ্ট করা হয় যে, তিনি উমর শেখ মির্জার বিরুদ্ধে মাহমুদ খানকে সামরিক সাহায্য প্রদান করেন। 

ইতোমধ্যে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার উল্লেখ এখানে একান্ত প্রয়োজন। অকশা কেল্লা একটি বিপজ্জনক উপত্যকার উপর অবস্থিত ছিল। এই বিপজ্জনক উপত্যকার সঙ্গে সংলগ্ন ছিল মহলের ইমারত। রমজান মাসের এক সোমবারে, মানে জুন মাসের ৮ তারিখে উমর শেখ মির্জা তাঁর সমস্ত কবুতর উড়িয়ে দিলেন এবং নিজে বাজ হয়ে গেলেন (বলাবাহুল্য, তিনি মৃত্যুবরণ করলেন)। ঐ সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৩৯ বছর। তিনি ১৪৬০ ঈসায়ী সনে সমরখন্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আবু সঈদ মির্জার চতুর্থ পুত্র ছিলেন। তাঁর বড় অন্য তিন ভাই ছিলেন—আহমদ মির্জা, মাহমুদ মির্জা ও মহামিদ মির্জা। আবু সঈদ মির্জার পিতা ছিলেন মুহম্মদ মির্জা, যিনি তাইমুর বেগের তৃতীয় পুত্র ছিলেন। অন্য দুই পুত্র ছিলেন মিশান শাহ মুহম্মদ ও জাহাগীর মুহম্মদ। তাঁদের চেয়ে ছোট ছিলেন শাহরুখ মির্জা।* উমর শেখ মির্জা ফারগানা (আন্দিজান) শাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। 

[* বাবুর তাঁর নিজের বংশাবলির পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেকে তাইমুরের চতুর্থ অধঃস্তন হওয়ার জানকারি দিয়েছেন—অনুবাদক ]

উমর শেখ মির্জা সাধারণ মাঝারি মানুষ ছিলেন। তাঁর চেহারা থাকত ভাবলেশহীন। তিনি গোলাকার করে দাড়ি রাখতেন। পোশাক ও পানাহারের মামলায় তাঁর বিশেষ কোনো রুচি ছিল না। তিনি চার পরত—বিশিষ্ট সাফা পরতেন। সাফার শেষ অংশটি পিছনে ঝুলতে থাকত। তিনি গরমের দিনে এবং দরবারে সাফা পরে থাকতেন, অবশিষ্ট সময়ে মোগল টুপি ধারণ করতেন। 

তিনি আল্লাহর উপর সাচ্চা ইমান রাখতেন। তিনি হানাফি মজহব মেনে চলতেন। পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ পড়তেন। তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি খাজা উবাইদুল্লাহর প্রতি আস্থাবান ছিলেন। তিনি তাঁর কাছে এসেও ছিলেন এবং তাঁকে ‘প্রিয় বৎস’ সম্বোধন করেছিলেন। তিনি কাব্যময় স্বভাবের মানুষ ছিলেন কিন্তু কাব্যভাবময় লেখার চেষ্টা তিনি কখনোই করেননি। 

একবার যখন তিনি শোনেন যে, কাইথাল থেকে ফেরার পথে একটি কাফেলা আন্দিজানের পূর্ব পাহাড়ি উপত্যকায় ফেঁসে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তাঁদের মধ্যে মাত্র দু’জন লোক বেঁচে ফিরতে পেরেছে। তখন তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে যান যে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর নিরীক্ষকদের সেখানে পাঠিয়ে দেন। আদেশ দেন যে, তাদের সমস্ত মালপত্র যেন নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আসা হয়। তিনি খোরাসান ও সমরখন্দে মৃতদের উত্তরাধিকারীদের কাছে খবর পাঠিয়ে দেন। এক—দুই বছর ধরে তিনি সেই কাজে লেগে রইলেন, ফলে মৃতদের মালপত্র তাদের সঠিক উত্তরাধিকারীদের কাছে পৌঁছে গেল। 

তিনি সাহসী, বীর, উত্তম বক্তা, মিশুক এবং চরিত্রবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজের তরবারির উপর ভরসা রাখতেন। তিনি একজন সাধারণ তীরন্দাজ ছিলেন, কিন্তু কুস্তিতে অসাধারণ ছিলেন। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন ঠিকই কিন্তু যুদ্ধ করে তাঁর ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন। 

প্রারম্ভিক দিনগুলোতে তিনি খুব পান-পিয়াসী ছিলেন তবে পরে তিনি জলসা ইত্যাদিতে সপ্তাহে দু-একবার মাত্র পানাসক্তির সখ মিটিয়ে নিতেন। এরকম জলসাগুলোয় তিনি শায়রী শুনে প্রশংসা করতে ভুলতেন না। মাদক বস্তু তিনি নিজে প্রস্তুত করতে জানতেন। শিকারে তিনি আগে-আগে থাকতেন। তিনি প্রাকৃতিক কলা-প্রেমী ছিলেন। সাজসজ্জা পছন্দ করতেন। প্রেম-প্রীতির কথাবার্তায় তিনি খুবই আকর্ষণ অনুভব করতেন। শিকারের সাথে সাথে পাশা খেলাও তিনি খুব পছন্দ করতেন। তিনি পর পর তিনটি যুদ্ধ করেন। প্রথম যুদ্ধ আন্দিজানের উত্তরে, শিহান নদীর তটে, বকরকুদ নামক স্থানে ইউনুস খানের সঙ্গে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে তাঁকে পরাজয়ের স্বাদ চাখতে হয়। তাঁকে বন্দী করা হয়। ইউনুস খান উদারতার পরিচয় দিয়ে তাঁকে মুক্ত করে দেন এবং আন্দিজানে চলে যাওয়ার অধিকার দিয়ে দেন। 

তিনি দ্বিতীয় যুদ্ধ করেন তুর্কিস্তানের উজবেকদের সঙ্গে। উজবেকরা সমরখন্দের কাছে হানা দেয়। তিনি বরফ জমা নদী পেরিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে জোরালো আক্রমণ চালিয়ে দেন। তাদের কবল থেকে লোকেদের তিনি রক্ষা করেন। লুটের মাল ফিরিয়ে আনেন। কোনো প্রকারের লোভ—লালসার নিকটবর্তী না হয়ে তিনি সেই লুটের মাল তাদের মালিকদের হাতে তুলে দেন। 

তিনি তৃতীয় যুদ্ধটি করেন আহমদ মির্জার সঙ্গে শাহরুখিয়া ও খিবার নিকট। এখানে তিনি পরাজিত হন। 

তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে ফারগানা দেশটি লাভ করেন। তাশখন্দ ও সেরম তাঁর বড় ভাই আহমদ মির্জা পেয়েছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে সীমা—বিবাদের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। তিনি এক সময় শাহরুখিয়া অধিকার করে নিয়েছিলেন। পরে সেটি তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। পরে তাঁর অধিকারে শুধুমাত্র খুজন্দ ও ফারগানা মাত্র রয়ে যায়। কিছু লোক খুজন্দকে ফারগানা থেকে পৃথক বলে মানেন না। আফিরুশনাও তাঁর অধিকার রয়ে যায়। কিছু লোক আফেরুশনাকে ঔরিসও বলে থাকেন। 

তাশখন্দের মোগলদের সঙ্গেও আহমদ মির্জার যুদ্ধ হয়। ১৪৮৮ ঈসায়ী সনে তিনি হাফিজ বেগ দিলদারের কাছে পরাজয় বরণ করেন। পরে এটি আহমদ মির্জার হাত থেকে, পরে, পরাজয়ের ফলে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাজ্যের ভূভাগ উমর শেখ মির্জার হাতে চলে আসে। 

উমর শেখ মির্জা তাঁর রাজ্য ও অধিকার ক্ষেত্রকে তাঁর পুত্র কন্যাদের মধ্যে, যখন তাঁরা বড় হন, বণ্টন করে দেন। তাঁর তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা ছিলেন। জহির-উদ-দিন মুহম্মদ বাবুর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। তিনি লেখেন—আমার মায়ের নাম ছিল কুতলুক নিগার খানম। জাহাঙ্গীর মির্জা তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। তিনি আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ফাতিমা সুলতান। নাসির মির্জা তাঁর তৃতীয় পুত্র ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন আন্দিজান নিবাসিনী। তিনি বড় সুশীলা ছিলেন। নামটিও খুব সুন্দর ছিল। 

১৫০০ ঈসায়ী সনে সর-এ-পুলে পরাজয়ের পর আমাকে সমরখন্দ ছাড়তে হয়। ওই দিনটি আমার জন্য ছিল বড়ই কষ্ট ও যন্ত্রণার। আমার হাত থেকে রাজ্য চলে গিয়েছিল। আমার সহোদর বোন খানজাদা বেগম মুহম্মদ শায়বানি খানের হেরেমে চলে যান। তিনি একটি খুব সুন্দর পুত্র—সন্তানের জননী হন। পুত্রের নাম রাখা হয় খুররম শাহ। তাকে বল্‌থ্ দেশের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা হয়। 

১৫০৭ ঈসায়ী সনে শাহ ইসমাঈল আমার জন্য মুহম্মদ শায়বানিকে পরাজিত ও হত্যা করেন। সে সময়টি খানজাদা বেগমের জন্য অতি কঠিন সময় ছিল। তিনি আল্লাহর দয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে রয়ে গেলেন। পরে আমার জন্য শাহ ইসমাঈল তাঁর সঙ্গে অতি উত্তম আচরণ করেন। তাঁর সুরক্ষার জন্য সেখান থেকে তাঁকে কুন্দুজ পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 

তারপর দশ বছর যাবৎ তাঁর সঙ্গে আমার আর সাক্ষাৎ হয়নি। যখন আমি মুহম্মদ কুকুলদশের সাহায্যে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই তখন তিনি না আমাকে চিনতে পারেন আর না আমি তাঁকে। যখন আমি তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলি তখন তিনি কয়েক মুহূর্ত পরেই আমাকে চিনতে পারেন। 

মেহেরবান বেগম আমার সৎ ও নাসির মির্জার সহোদর বোন ছিলেন। তিনি আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট ছিলেন। নাসির মির্জার আরেক বোনের নাম ছিল সহর বেগম, যিনি আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট ছিলেন। ইয়াদগার সুলতান আমার আরেক সৎবোন ছিলেন। তাঁর মা ছিলেন বড়ই সুশীলা। তাঁর নাম ছিল আগা সুলতান। 

রুকাইয়া সুলতান পঞ্চম বোন তথা চতুর্থ সৎবোন ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল মকদুম সুলতান বেগম। 

ইয়াদগার বেগম ও রুকাইয়া সুলতান, উমর শেখ মির্জার চতুর্থ ও পঞ্চম কন্যা ছিলেন, এঁদের জন্মের আগে পিতা মারা যান। 

ইয়াদগার সুলতান বেগম আমার দাদি, আলসান দৌ বেগমের ছত্রছায়ায় লালন-পালনের জন্য নিয়ে যান। এ সময়ে তিনি আবদুল লতিফের পুত্র হামজার কাছে থাকতেন। 

শায়বানি ১৫০৩ ঈসায়ী সনে আন্দিজান ও অকশা অধিকার করে নিয়েছিলেন। তারপর, আমার পুরো পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন এবং পথে পথে ঘুরতে থাকেন। 

১৫১১ ঈসায়ী সনে আমার দাদি খুতলানে এসে আমার সঙ্গে মিলিত হন। এ সময় পর্যন্ত আমি হামজা ও অন্যান্য সুলতানদের হটিয়ে দিয়ে হিসার অধিকার করে নিই। রুকাইয়া সুলতান বেগম ততদিনে উজবেক নিবাসী জানী বেগের পত্নী রূপে এক সন্তানের জননী হয়েছিলেন, যিনি এ সময়ে জীবিত ছিলেন না (বাবুর কর্তৃক এই বিবরণ লেখা হওয়ার সময় অবধি)। 

মাতুলকুলের পরিচয় 

আমার মা কুতলুক নিগার খানম ইউনুস খানের দ্বিতীয় কন্যা ছিলেন। তিনি মাহমুদ খাঁ ও আহমদ খাঁ-র সৎ-বোন ছিলেন। 

ইউনুস খান চুগতল খানের বংশধর ছিলেন। তিনি চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। 

ইউনুস খানের বংশলতিকা এইভাবে অগ্রসর হতে হতে চেঙ্গিস খানের রক্তে গিয়ে মিলে যায়—১. ইউনুস খান পুত্র, ২. ওয়াইস খান পুত্র, ৩. শেরআলী পুত্র, ৪. মুহম্মদ খান পুত্র, ৫. খিজির খাজা খান পুত্র, ৬. তুগলক তাইমুর খান পুত্র, ৭. আসলাম পুগা খান পুত্র, ৮. বাবা খান পুত্র, ৯. বরক খান পুত্র, ১০. সুতওয়া খান পুত্র, ১১. মুতু খান পুত্র, ১২. চুগতল খান পুত্র ১৩. চেঙ্গিস খান। এখানে খানেদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পেশ করার মতো সুঅবসর আমার রয়েছে—

ইউনুস খান (১৪৮৭ ঈ.) ও আলসান বুগা খান (১৪৬২ ঈ.) ওয়েইস খান (১৪২৮ ঈ.)—এর পুত্র ছিলেন। ইউনুস খানের মা শেখ নূরুদ্দীনের দুহিতা অথবা দৌহিত্রী ছিলেন। শেখ নূরুদ্দীন তুর্কি গোত্রের নেতা ছিলেন যাঁর রক্তের সম্পর্ক ছিল তাইমুর বেগের সঙ্গে। ওয়েইস খানের মৃত্যুর পর মোগল সম্প্রদায় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি অংশ ইউনুস খানের অংশে গেল তো দ্বিতীয় বড় অংশটি আলসান বুগা খানের অংশে চলে গেল। 

ঔলংগ বেগের পুত্র আবদুল আজিজ মির্জার সঙ্গে ইউনুস খানের বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

ইউনুস খান নিজের রাজ্যপাট ভালোমতোই সামলান। তিনি রাজ্য বিস্তারের জন্য ইরাক পর্যন্ত যান। সেখানে তিনি এক বছর যাবৎ তবরেজে অবস্থান করেন। ওই সময়ে জাহান শাহ বাইরাম ক্ষমতাসীন ছিলেন। ওখান থেকে তিনি শর্জা চলে যান যেখানে ইব্রাহীম সুলতান মির্জার দ্বিতীয় পুত্র শাহরুখ মির্জা রাজত্ব করছিলেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পাঁচ—ছ মাস পর ৩ মে, ১৪৩৩ ঈসায়ীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ মির্জার সঙ্গে ইউনুস খানের মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইউনুস খানকে তিনি খুবই সম্মান করতেন। সতেরো—আঠারো বছর যাবৎ তাঁদের মধ্যে প্রগাঢ় সম্পর্ক থাকে। 

ঔলংগ বেগ ইউনুস খানের বড় মেয়েকে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে ঠিকমতো সামলাতে পারছিলেন না। তাঁর রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ঔলংগ বেগ মির্জা ও তাঁর পুত্রের অযোগ্যতার সুযোগ নেওয়ার জন্য বুগচা খান ফারগানায় আক্রমণ চালিয়ে দেন। তিনি খান্দ-এ-বাদাম অবধি লুটপাট চালান এবং আন্দিজান পর্যন্ত এগিয়ে চলেন। তিনি সমস্ত মানুষকে যেন সম্মোহনের ডোরে বেঁধে রেখেছিলেন। আবিসালদ মির্জা সমরখন্দের সিংহাসনে বসার পর তাঁর সেনাবাহিনীকে তরাজ অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। তারপর মোগলিস্ত ানের অসপরা নামক স্থানে আলসান বুগাকে পরাজিত করেন। তিনি ইউনুস খানকে খোরাসানে ডেকে দাওয়াত দিলেন। বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়ে তিনি তাঁকে মোগলিস্তানের খান উপাধি দেন। 

ইউনুস খান, আলসান দৌলত বেগমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর তিনটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। কুতলুক নিগার খানম, আমার মা; ইউনুস খানের অন্য মেয়ে ছিলেন। আমার গেরিলা অভিযানের দিনগুলোতে তিনি অধিকাংশ সময় আমাকে সাহায্য করতে থাকেন। ১৫০৫ ঈসায়ী সনের জুন মাসে, আমার কাবুল বিজয়ের পাঁচ-ছ’ মাস পরে তিনি ইন্তেকাল করেন। 

খুব নিগর খানম ইউনুস খানের তৃতীয় কন্যা ছিলেন। খোরাসানের মুহম্মদ হুসাইনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। খুব নিগার একটি কন্যা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। উজবেকের হাবিব খানের সঙ্গে তাঁর কন্যা হাবিবার বিয়ে হয়। ঐ সময়ে আমি সমরখন্দ ও বুখারা (১৫১১ ঈ.) জয় করি। 

খুব নিগার খানমের ছেলের নাম ছিল হায়দার মির্জা। তিনি আমার সেবায় তিন-চার মাস থাকেন। ১৫১২ ঈ. সনে তিনি আমার কাছ থেকে কাশগড় যাওয়ার অনুমতি নেন। লোকে বলত যে, তিনি সেখানে পরম সুখে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি খুব ভালো হাতের কাজ জানতেন। তিনি খুব ভালো রঙের কাজও করতেন। তিনি ভালো তীর এবং তৃণীরও বানাতেন। তাশখন্দের খান মির্জাদের পক্ষ থেকে আমি অনেক সহযোগিতা ও সংরক্ষণ লাভ করেছিলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *