চতুর্থ অধ্যায় – উন্নয়ন অর্থনীতির অসংগতি
উন্নয়ন অর্থনীতির নিজস্ব কোনো স্বরূপ নেই। তিনটি মূলধঅরার অর্থনীতির (নিউক্লাসিক্যাল, কীনেসীয়ান ও স্যোসালিস্ট) যে কোনো বাড়তি অঙ্গ হিসেবে এটা বেড়ে উঠেছে। অর্থনীতির এ তিন ধারাই পশ্চিমা বিশ্বে জন্ম নিয়েছে। তাই উন্নয়ন অর্থনীতির প্রস্তাবিত কৌশলসমূহ এ পশ্চিমা বিশ্বদৃষ্টির আঙ্গিকে রচিত। যে সময়ে মূলধঅরার অর্থনীরিত জোয়ার বইছিল তারই আবহে বেড়ে উঠেছে তৎকালীন উন্নয়ন অর্থনীতির ধারা। উন্নয়ন অর্থনীতির ধাঁচ তাই কীনেসীয়ান, স্যোসালিস্ট ও নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির উত্থানপতনের দোলাচলে বারবার বাঁক নিয়েছে।
দোদুল্যমান আনুগত্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নয়ন অর্থনীতির জন্ম। এ সময় তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঐসব উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের সমস্যাসমূহ সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকে। Economic Development and Cultural Change নামে উন্নয়ন অর্থনীতির উপর প্রথম জার্নালের প্রথম সংখ্যা ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। এ সময়ে এ বিষয়ের উপর হাতে গোনা গবেষণামূলক কতিপয় লেখা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মহামন্দা এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের সমস্যার কারণে কীনেসীয় অর্থনীতি এবং সমাজবাদ পশ্চিমে গুরুত্বলাভ করেছিল। উন্নয়ন অর্থনীতিও নিওক্লাসিক্যাল ভিত্তি হতে সরে আসছিল এবং বাজার শক্তির উপর কম নির্ভরশীলতা ও অর্থনীতিতে সরকারের অধিকতর ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ করছিল। যাই হোক, ৭০ দশকের প্রথম ভাগে কীনেসীয়ান ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কৌশলের মুঠি শিথিল হয়ে আসলো এবং নিওক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতি আবার মঞ্চে ফিরে আসলো। উন্নয়ন অর্থনীতি প্রবেশ করলো এক সংকট সন্ধিক্ষণে। তাই উন্নয়ন অর্থনীতির উপর সমকালীন লেখাসমূহ আত্মসংশয় ও প্রশ্নবাণে বিদ্ধ।
যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ উন্নয়ন অর্থনীতিবিদগ এখনো উন্নয়ন অর্থনীতির উপযোগিতায় বিশ্বাসী, তবু কেউ কেউ এ একাডিমিক বিষয়টির বৈধতার প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। বিতর্কটি মেরুকরণ লাভ করছে। মনে করা হচ্ছে, উন্নয়শীল দেশসমূহে বাজার শক্তিসমূহের সমস্যার সমাধানের পথ হচ্ছে বাজার শক্তিসমূহকে স্বাধীনভাবে চল দেয়া ও অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা ও হস্তক্ষেপ হ্রাস করা। অন্য দলের চিন্তাবিদদের মত হচ্ছে, বাজারব্যবস্থা ও মূল্যের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতার পথটি সঠিক নয়। তবে বর্তমানে প্রভাবশালী মত হচ্ছে, বাজারমুখী এবং নিয়ন্ত্রণ বিরোধী ব্যবস্থা পশ্চিমা বিশ্বে উদার মতবাদ ও নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির পুনর্জাগরণের নির্দেশক। উন্নয়নশীল দেশসমূহ বর্তমানে সেব সমস্যায় ভুগছে তার অধিকাংশের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে যা তিন দশক যাবত অনুসরণ করা হয়ে আসছে। সীমিত সম্পদের অদক্ষ ব্যবহার, বৃহৎ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও বহির্বাণিজ্যে অন্যায়পরায়নতা, সম্পদ ও আয়ের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বা সামাজিক টানাপোড়েন-এসব কিছুর জন্যই নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনীতিকেই দায়ী হসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
বাজার অর্থনীতি ও রাষ্ট্র অর্থনীতির মধ্যে উন্নয়ন অর্থনীতির দোদুল্যমানতা এক সুদৃঢ় লক্ষ্য পথ হতে বিচ্যুত করেছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে পরস্পর বিরোধী বিশ্লেষণ ও পথনির্দেশ। অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে উদ্ভব হয়েছে অসংগতি ও অনিশ্চয়তা। এসব দেশকে এখন যেসব কাজ করতে হবে তা দ্বিগুণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের অর্থনীতির উন্নয়ন এমনভাবে করতে হবে যাতে সীমিত সম্পদের ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত হয়। উপরন্তু ভুল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইতোমধ্যে যে অসংগতি ও অন্যায়পরায়নতা সৃষ্টি হয়েছে তা অপসারণ করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির আলোকে যে নতুন নীতিমালার ব্যবস্থাপত্র প্রদান করা হচ্ছে তাতে আকাঙ্ক্ষিত দক্ষতা, ন্যায়পরায়নতা ও স্থিতিশীলতা আসবে কিনা? তাই বিশ্বদৃষ্টি উন্নয়ন অর্থনীতির উপর কী ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং কী সমস্যার জন্ম দিয়েছে তা লক্ষ্য করা প্রয়োজন।
নিওক্লাসিক, কীনেসীয়ান এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির শিকড় রয়েছে রেঁনেসা উদ্ভূত বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানব সমস্যার বিশ্লেষণ এবং মানব কল্যাণের উদ্দেশ্য সাধনে উপযুক্ত অর্থনৈতিক চিন্তাধারাসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সেকুলার। মানুষের সুখ ও স্থিতির উৎস হিসেবে এসব চিন্তাধারা বৈষয়িক লাভকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ব্যক্তি ও সমাজ পুনর্গঠনে নৈতিক মূল্যবোধেল ভূমিকা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। বরং আর্থ-সামাজিক সুবিচারের ধারণার সাথে প্রকৃত প্রস্তাবে তাদের কোনো মানসিক সংগতি ছিল না। নৈতিক মূল্যবোধ কীভাবে সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সামাজিক ছাঁকনি প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করতে পারে, সে বিষয়ে তাদের ধারণা ছিল না। সম্পূর্ণভাবে এই বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে স্বভাবতই সামাজিক-ডারউইনবাদ এবং বস্তুবাদের ফসল ব্যতিরেকে অন্য কিছুরই প্রত্যাশা করা যায় না। দৃষ্টিভঙ্গির এরূপ কাঠামোর কারণে নিজেকে সামাজিক প্রয়োজন পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কোনো উদ্দীপনা কাজ করতে পারে না। অপ্রত্যক্ষভাবে সামাজিক স্বার্থরক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের পরোক্ষ ফসল হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারে।
নিরাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদের সামাজিক-ডারউইনীয় এবং উচ্চতর বর্ণ ও জাতিসত্তার তত্ত্বের প্রতি যুক্তিহীন বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা মূলত অশ্বেতাঙ্গ ও অইউরোপীয় দরিদ্র দেশসমূহের দারিদ্র্য, অনুন্নয়ন ও রাজনৈতিক গোলামীর কার্যকারণকে ঐসব দেশ ও জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও জাতিসত্তার তথাকথিত নিম্নমানের ফসল হিসেবে চিহিন্ত করেছে। ফলে উন্নয়ন সম্পর্কে এক ধরনের নিরাশা জন্ম লাভ করেছে। যুক্তি দেখানো হয় যে, এ দেশসমূহ উন্নয়নের পূর্বশর্তগুলো পূরণ করেনি। এ দেশসমূহের সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসমূহকে উন্নয়নের উপর্যৃক্ত পূর্বশর্তসমূহ বিনির্মাণের অনুপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের একটি কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি রিপোর্টেও এ ধরনের যুক্তিহীন উচ্চতর বর্ণ ও জাতিসত্ত্বা কেন্দ্রিক মতবাদেরর প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করা হয়েছে। ধারণা দেয়া হয়েছে যে, পাশ্চাত্যেও পুঁজিবাদী দেশসমূহের অনুসরণে দরিদ্র দেশসমূহের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনগত কাঠামোর সংস্কার সাধন করা না হলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদের মাঝেও একই ধরনের অভিমত প্রচলিত যে, কেবলমাত্র উন্নত দেশসমূহের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন ও কাঠামো অনুসরণর মাধ্যমেই দরিদ্র দেশের পক্ষে পুঁজি গঠন, উৎপাদন ও ভোগের লক্ষ্যমাত্র অর্জন সম্ভব। ‘পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে রচিত বিশ্ব ব্যাংকের ১৩টি রিপোর্ট পড়ে কিন্ডেলবার্জার এবং স্পেঞ্জলার এ ধঅরণাই লাভ করেছেন। এদর মধ্যে সবচেয়ে চাঁচাছোলা বক্তব্য দিয়েছেন ইউজিনি স্টেলের; তিনি বলেছেন যে, কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমেই দরিদ্র দেশসমূহের উন্নয়ন সম্ভব। এসব দেশকে পশ্চিমের মূল্যবোধ ও সমাজ কাঠামো গ্রহণ করতে হবে। এমনকি পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বর্ণবাদী অর্থনীতিবিদ মিরডারও মনে করেন উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য শর্তাবলী, যা ‘আধুনিক ধ্যানধারণা’ নামে অভিহিত, তা দরিদ্র দেশসমূহের নিকট ‘বিজাতীয় ও ভিনদেশী’। তাই দেখা যায় প্রাধান্য বিস্তারকারী ধারণার অনুসৃতি ব্যতিরেকে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এ আধুনিকতা মানে শুধুমাত্র আধুনিক প্রযুক্তি, আধুনিক বাজারজাতকরণ ও ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণই নয়, বরং পশ্চিমা জীবন পদ্ধতি ও বস্তুবাদী মূল্যবোধের আত্মীকরণও।
প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্তসমূহের ‘অনুপস্থিতি তত্ত্বের’ উপর অগ্রহণযোগ্যভাবে অত্যধিক জোর প্রদান উন্নয়ন সাহিত্যে ‘দারিদ্যের দুষ্টচক্র’ ধারণাকে গ্রহণযোগ্যতা দান করেছে। নার্কস একে এভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘বৃত্তাকার শক্তিসমূহ একে অপরের উপর এমনভাবে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে যাতে একটি দরিদ্র দেশ দরিদ্রই থেকে যায়-একটি দেশ দরিদ্র থাকার কারণ এটি দরিদ্র”। ‘দারিদ্যের দুষ্টচক্র’ ধারণাটি এমন সংক্রামক রূপ লাভ করে যে, প্রত্যেক উন্নয়ন অর্থনীতিবিদই এ ধারণার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। অত্যধিক জনসংখ্যা, স্বল্প আয়, স্বল্প সঞ্চয়, স্বল্প বিনিয়োগ, স্বল্প রপ্তানি ও স্বল্প প্রবৃদ্ধির দুষ্টচক্র অতিক্রম করা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সম্ভব হবে না, যেহেতু এদুলো সৃষ্টি হয়েছে ‘আধুনিক ধ্যানধারণা’র অভাবে-এ ধারণাটিই প্রসার লাভ করেছে। তাই এ দেশগুলো নার্কস কথিত ‘অনতিক্রমনীয় নিম্নমাত্রার ইক্যুইলিব্রিয়ামের’ ঘূর্ণবর্তে ঘুরতে থাকবে। এমনকি ভোগকে সংকুচিত করে তারা যেটুকু সঞ্চয় করে, তাকেও তারা পুঁজিতে পরিণত করতে পারে না। কারণ পুঁজিতে পরিণত করার মাধ্যম রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বৃদ্ধিতে তারা অবম। এ দেশগুলো দু’টি ঘাটতি পৌরণে অবম- সঞ্চয়-বিনিয়োগ এবং আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি। ফলে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র হতে পরিত্রাণের আশা এদেশগুলোতে সুদূর পরাহত।
‘প্রবৃদ্ধির ধাপ (Stage of growth) তত্ত্বও অন্তর্নিহিতভাবে ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ তত্ত্বকে স্বীকার করে নেয়। এ তত্ত্বগুলোতে উন্নয়নের জন্য যে মৌলিক উপাদানগুলোকে ধরা হয়, তা উন্নয়নের এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে যেতে বাধা দেয়। বাধা ও অনগগ্রসরতার চক্রটি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। উন্নয়ন অর্থনীতি সম্পর্কিত অধিকাংশ লেখাতেই আমরা দেখতে পাই উন্নয়নশীল দেশসমূহের প্রবৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিরাজ করছে এক ধরনের গভীর হতাশা। যেহেতু পাশ্চাত্য জীবনবোধ ও ধরন ব্যতীত অন্য যে কোনো জীবনব্যবস্থা ও পদ্ধতিকে দরে নেয়া হয়েছে উন্নয়নের পরিপন্থি হিসেবে, তাই দরিদ্র দেশসমূহের সীতিম সম্পদ পরিসীমা ও জীবনবোধের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কোনো প্রকার চিন্তভাবনা করা হয়নি। পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে উইলিয়ামসন এক লেখায় স্বীকার করেছেন যে, ‘স্থির মডেল এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ধারণা দ্বারা অর্থনীতিবিদগণ এতই আচ্ছন্ন যে তাদের পক্ষে পেশাগতভাবে উন্নয়ন অর্থনীতির বিষয়ে সঠিক ভাবনা ও অবদান রাখার প্রত্যাশা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েচে। অভিজ্ঞতা হতে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, উন্নয়ন সম্পর্কে এরূপ হতাশা ভ্রান্তির ফসল। কেননা ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে, অবস্থা ও সম্পদভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দারিদ্র্য রয়ে গেছে এবং প্রবৃদ্ধির ফসল মুষ্টিমেয় কিছু হাতে জমা হয়েছে। উপরন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে দেখা দিয়েছে বিপুল বহির্বাণিজ্য ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা। কেন এমনটি হয়েছে তা পরবর্তী আলোচনা হতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সমাজতান্ত্রিক কৌশল
‘উন্নয়ন অর্থনীতি’ নামক বিষয়টির জন্মের প্রথম দিকে উন্নয়ন সম্পর্কে যে হতাশার সৃষ্টি হয় তাতেই জন্ম নেয় Critical Minimum Effort নামক ধারণাটির। এ ধারণাটির অর্থ হচ্ছে, যদি এসব দেশসমূহকে ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ ভাঙতে হয়, তবে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রভাবক শক্তিসমূহ ঐ মাত্রায় অর্জন করতে হবে যাতে বাধার অচলায়তনটি ভাঙা যায়। এ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো দেশের জনগোষ্ঠী যখন সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাৎপদ এবং সঞ্চয় প্রবণতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ যখন সীমি তখন মীভাবে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় এ Critical Minimum Effort অর্জন করা সম্ভব হবে। এ সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত আছে। একটি মত হলো ‘সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কৌশল’ যেখানে অর্থনীতিতে সরকারি ভূমিকা অগ্রগামী এবং এত রাষ্ট্রযন্ত্র সামগ্রিক পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি খাত ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা করবে। এ ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাত ও বাজার অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল নিওক্লাসিক্যাল চিন্তাধারার বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। অন্য চিন্তধারাটি হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের স্বার্থে আর্থ-সামাজিক সুবিচারের লক্ষ্যটিকে আপাতত কম গুরুত্ব দিতে হবে।
উন্নয়ন সম্পর্কিত লেখাজোখায় সমাজতান্ত্রিক কর্মকৌশলের প্রতি আস্থাশীলতার জোয়ার সৃষ্টি হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনে কমিউনিস্ট আমলে এবং পশ্চিমে কীনেসীয় অর্থনীতির প্রাথমিক সাফল্যে। যুক্তি দেখানো হতে থাকে যে, নিওক্লাসিক্যাল অর্থনৈতিক মডেল যা দ্রব্যমূল্যের সামান্য পরিবর্তরে প্রতক্রিয়ায় বাজারব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সাড়া দেয় তা উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাস্তবসম্মত মডেল হতে পারে না। কেননা শেষোক্ত দেশসমূহ নানাবিধ প্রতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক জড়তা ও অস্থিতিস্থাপকতা দ্বারা স্থবির হয়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের সরকারগুলোকে উন্নয়নের জন্য অগ্রবর্তী ভূমিকা নিয়ে জোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কেবলমাত্র এক ধরনের big push দ্বারাই এর self generating, self sustained growth এবং great leap forward অর্জন করতে পারে।
‘বিগ পুশ’ ধারণাটি আসলে স্টালিনের ‘সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নের রাস্তা’র অপর নাম। স্টালিনের সময় ভারী শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন উচ্চগতির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ভারী শিল্পায়ন কৃষি ও সোভিয়েত অর্থনীতির অন্য সব খাতের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এভাবে পুঁজিবাদী বিশ্ব হতে আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হয়। সোভিয়েত মডেলের লনুসরণে একইভাবে উন্নয়নশীল দেশসমূহে ভারী শিল্পের বিকাশ ও নগর উন্নয়নের উপর অধিক জোর দিয়ে ‘বিগ পুশ’ অর্জন করতে হবে। কতিপয় শিল্পে উপর্যুপরি বিনিয়োগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। রোজেনস্টেইন-রোডান এর মতে এটা সাফল্যের জন্য যথেষ্ট না হলেও প্রয়োজনীয় শর্ত। ‘বিগ পুশ’ তত্ত্বে পুঁজির বৃহৎ প্রকল্পের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহকে শিল্পায়নের পথে নিয়ে যাবার জন্য ভারী শিল্পের উপর অগ্রাধিকার প্রদান অপরিহার্য এ চিন্তাধারাকে জোরদার করে তোলা হয়। এ ধরনের ভারী শিল্পের ক্ষুদ্রতম ইউনিটও এত বিশাল যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে তাতে নাক গলানোর চিন্ত করাও দুঃসাধ্য, তাই এগুলোর বেড়ে ওঠা সম্ভব হবে সরকারি খাতে। ‘বিগ পুশ’ তত্ত্বের ফলাফল দাঁড়ালো অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সরকারি খাতের ভূমিকার উপর মাত্রতিরিক্ত গুরুত্বারোপ। নিওক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতির বদলে আসলো নতুন এক অর্থনৈতিক তত্ত্ব যা পরিকল্পনা, সরকারি হস্তক্ষেপ, শিল্পায়ন, আমদানি-প্রতিস্থাপন, নগরায়ন ও অন্যান্য নীতিমালার মাধ্যমে অর্থনীতিতে সরকারের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করল। উন্নয়ন অর্থনীতি সাধারণভাবে অর্জন করল পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি বিরোধী এক জঙ্গি মনোভঙ্গি।
সার্বিক পরিকল্পনার ধারণা দেশের পর দেশ জয় করে নিল। এ পরিকল্পনা সকল পুঁজি বিনিয়োগ উদ্যোগের ভার ভারী শিল্পায়নের কাঁধে অর্পণ করল। পরিকল্পনা তাই দক্ষতা ও ন্যায়পরতা অর্জনের জন্য শুধুমাত্র দিকনির্দেশনায় সীমাবদ্ধ রইল না, বরং বিনিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের পুরো দায়ভার সরকারের উপর চাপিয়ে দিলো।
ন্যায়পরতা নীতির প্রতি অবহেলা
একটি বিশ্বাস বিস্তৃতি লাভ করল যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক সুবিচার-উভয় লক্ষ্য একসাথে অর্জন সম্ভবত সংগতিপূর্ণ নয়। যদি প্রবৃদ্ধিকে লক্ষ্য স্থির করা হয়, তবে ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনের লক্ষ্যকে পরিত্যাগ করতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবশ্য একথা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার বিবেচনায় সোচ্চারভাবে উচ্চারণ করার অবকাশ নেই। তাই পরিকল্পনাসমূহের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে আর্থ-সামাজিক সুবিচারের কথাটি কাগুজে প্রতিশ্রুতি হিসেবে আওড়ানো হতে থাকে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে ১৯৫২ সালে প্রণীত ভারতের প্রথম পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্র হিসেবে পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান ও সর্বোচ্চ উৎপাদনের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ন্যায্যতা অর্জনের কথা ব্যক্ত করা হয়। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সনের শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মৌলিক দিকনির্দেশনা হিসেবে গণমানুষের স্বার্থের পরিপন্থি কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণকে প্রতিহত করার ঘোষণা ব্যক্ত করা হয়। জাতীয় পরিকল্পনা বোর্ডের কার্যপরিধি ও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্যসমূহ ব্যক্ত হয় ন্যায়ভিত্তিক ধ্যানধারণার পরিভাষায়। পাকিস্তানের দ্বিতীয় পরিকল্পনায়ও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতো ন্যায়ভিত্তিক আদর্শকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে আর্থ-সামাজিক সুবিচারের লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
১৯৫৫ সালে উন্নয়ন সাহিত্যে ন্যায়পরতা বিরোধী তত্ত্বপ্রবাত নিয়ে আসলেন স্যার আর্থার লুইস। পরবর্তী দেড় দশক যাবত তাত্ত্বিক মতবাদ চালু ছিল। তিনি বললেন, প্রথমেই মনে রাখা দরকার আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রবৃদ্ধি অর্জন, বণ্টন-ন্যায়পরতা নিশ্চিত করা নয়। বেয়ার এবং ইয়ামী ১৯৫৭ সালে বলেন, ‘দরিদ্র জনগণের মাঝে আয়ের সমবণ্টনের নীতিমালার মাধ্যমে মাথাপিছু আয়ভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এমনকি জাতিসংঘও বণ্টন ন্যায়পরতাকে তার নীতিমালার লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেনি, বরং জাতিসংঘের দলিলে বলা হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় আয় বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে বৃদ্ধি করা। অধ্যাপক হ্যারি জনসন ১৯৬৪ সালে জোর দিয়ে বলেন, ‘দ্রুত উন্নয়নে আগ্রহী একটি দেশের জন্য আয়ের সমবণ্টনের নীতির উপর জোর দেয়া বিজ্ঞতারর পরিচায়ক হবে না’। ১৯৬৪ সনে প্রকাশিত জেরাল্ড মেয়ার এর বহুল পঠিত Leading Issues in Economic Development এর প্রথম সংস্করণে দারিদ্র্য, অন্যায়পরতা এবং আয়ের বণ্টনের বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। এমনকি মধ্য ষাটের দশকে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত কোনো কনফারেন্সের লক্ষ্য হিসেবে দারিদ্র্য ও অন্যায়পরতা নিরসনের কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। ১৯৬৬ সনের সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের কার্যবিবরণী পড়লে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দ্রুত উন্নয়নের কিছু প্রবক্তা এতদূর অগ্রসর হন যে, তারা বলতে থাকেন, আয়ের বৈষম্য বেড়ে ও্ঠা আরো বেশি জরুরি, কেননা এতে ধনীরা অধিক সঞ্চয়ের সুযোগ পাবে। পুঁজি গঠন তরান্বিত হবে। এ ধারণার অনুকূলে প্রধান বিষয়ে হিসেবে কুজনেটস এর Inverted U-curve কে উপস্থাপন করা হতে থাকে। যদিও কুজনেটসের উক্ত রেখা, লেখা বা পরিসংখ্যান হতে এ রূপ ধারণার কোনো সমর্থন পাওয় যায় না। কুজনেট কার্ভে বরং দেখানো হয়েছে উন্নয়নের প্রথম পর্যায়ে আয়ের বৈষম্য দেখা দেয়, যা পরবর্তীতে ক্রমশ হ্রাস পায়। আয় বৈষম্যের পক্ষাবলম্বনকারী প্রবক্তারা এ কথা ভুলে যান যে, কুজনেটস কার্ভেল প্রদর্শিত প্রবণতা প্রকৃতির অলংঘনীয় কোনো নিয়মের প্রকাশ নয়। এমনটিও তো হতে পারে যে, কুজনেটসের কার্ভের চিত্রটি প্রকৃতির কোনো দৃঢ় আইন নয়, বরং অনুসৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও পদ্ধতির ফসল মাত্র।
উপর্যুক্ত মতবাদের পক্ষে বলা হয় যে, শিল্পবিপ্লবের সময় তীব্র আয় বৈষম্যের কারণে উচ্চতর সঞ্চয় হার অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এডাম স্মিথ হতে শুরু করে অনেক অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ বৈষম্য ও প্রবৃদ্ধির মাঝে যোগসূত্র টানার চেষ্টার করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের শ্রম-আধিক্যপূর্ণ দেশসমূহের জন্য এ সূত্রকে মডেল হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। অবশ্য সাক্ষ্য প্রামণ উপযুক্ত তত্ত্বের অনুকূলে কিছু পরিবেশন করতে পারেনি। আয় বৈষম্যের কারণে বৃটেনে বা আমেরিকায় সঞ্চয়ের উদ্ভব ঘটেনি। সমকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশে সঞ্চয়ের পিছনেও এরূপ বৈষম্যের কোনো অবদান দেখা যায় না।
পরিকল্পিতভাবে মুদ্রাস্ফীতিকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের তত্ত্বও উপস্থাপন করা হয়েছে। কেননা মুদ্রাস্ফীতি সরকারের ঋণ পরিশোধের ভার লাঘব করে এবং জনগণকে সঞ্চয়ে বাধ্য করে। যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, মুদ্রাস্ফিতর ফলে আয় এমন শ্রেণীর অনুকূলে পুনর্বণ্টিত হয় যারা অধিক সঞ্চয়প্রবণ। প্রফেসর হেইস যুক্তি দেখান যে, মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্প ও বণিক শ্রেণীর লাভের হার বৃদ্ধি পেয়ে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ে। এ যুক্তি এক ভুল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, যেন শ্রমিকের বেতন মজুরির প্রতিটি টাকা ভোগের কাজে ব্যয় হয়। আর যে টাকাটি শ্রমিককে দেয়া হয় না তা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের কাজে ব্যবহৃত হয়।
এই চিন্তাধারা উন্নয়নশীল দেশসমূহের নেতা ও নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করে। এমনকি জওহরলাল নেহেরুর মতো সামাজিক সুবিচারে আস্থাশীল ব্যক্তিও ভঅরতে আয় বৈষম্য প্রবণতাকে এ বলে মেনে নেন যে, ‘বর্ধিষ্ণু একটি অর্থনীতিতে কিছু মাত্রায় আয় বৈষম্য অবশ্যম্ভাবী’। কিছু মুসলিম অর্থনীতিবিদ এ কোরাসে যোগ দেন। কিন্তু আর্থ-সামাজিক সুবিচারের প্রশ্নে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট। এসব মুসলিম অথনীতিবিদ সেকুলার সামাজিক-ডারউইনবাদকে তুলে ধরে বলেন আর্থ-সামাজিক সুবিচারের ধারণাটি একটি বিলাস যা কেবলমাত্র ধনী দেশগুলোই বহন করতে পারে। মাহবুবুল হক, যিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের অর্থ ও পরিরকল্পনা মন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি লিখেছেন, ‘অনুন্নত দেশসমূহকে অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রবৃদ্ধির দর্শনকে গ্রহণ করতে হবে এবং ন্যায়সঙ্গতবণ্টন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের ধ্যান ধারণাগুলোকে ভবিষ্যতের সূতিকাগারে জমা রাখতে হবে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এ ধারণগুলো হচ্ছে ধনিক দেশগুলোর উপযোগী বিলাসিতা’। সম্ভবত এ কথাটি বিবেচনায় আনা হয়নি যে, ইসলামী মূল্যবোধে অবিচার করা, তাকে সমর্থন করা বা ক্ষমার চোখে দেখা একটি বড় অপরাধ। উন্নয়নশীল অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা তাই সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণের বিষয়ে কোনো উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেনি। অথচ আমরা জানি পাশ্চাত্য ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় সমাজতন্ত্রের দুনিয়ায় সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ছিল অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, সামাজিক সুবিচার নয়, বরং পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি তরান্বিত করার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। উন্নয়নশীল দেশে সমাজতন্ত্র তাই রূপ নিয়েছে এক ভিন্ন প্রকৃতির যা কমিউনিস্ট বিশ্ব ও পশ্চিমা বিশ্ব হতে ভিন্ন এক তৃতীয় ধারা। তৃতীয় বিশ্বে সমাজতন্ত্র তার অন্য সকল লক্ষ্য ও দর্শন হারিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র অর্থনীতির বৃহৎ অংশের রাষ্ট্র কর্তৃক মালিকানা ও পরিচালনা। সমাজতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যান্ত্রিক পরিকল্পনার অপর নাম। যদিও এ সময়ে কিছু অর্থনীতিবিদ সমাজতন্ত্রের ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন, তারা ছিলেন সংখ্যালঘিষ্ঠ। মূলধারার মতবাদটি ছিল ‘trickle-down’ বা ‘চুঁইয়ে পড়া’ মতবাদ, যাতে বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি তরান্বিত হলে তা পরে ছড়িয়ে পড়ে দারিদ্র্য ও আয় বণ্টনের সমস্যা সমাধান করবে। কিন্তু বাস্তবে ‘চুঁইয়ে পড়া’ পদ্ধতি গুরুতরভাবে অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটাই হবার কথা। কেননা দারিদ্র্য এবং আয় বৈষম্য এত বেশি বিস্তৃত, অতলস্পর্শী ও অমোচনীয় যে, অর্থনীতিতে বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার, অর্থব্যবস্থার পরিবর্তন, উপযুক্ত মূল্যবোধ ও প্রেরণা সৃষ্টি ব্যতিরেকে এর অপনোদন প্রত্যাশা করা অবাস্তব স্বপ্নমাত্র।
অন্তঃসারশূন্য বিতর্ক
সামাজিক ঐকমত্য দ্বারা নির্ণীত মূল্যবোধ ও আর্থ-সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার ছাঁকিনি (filter) ব্যবস্থার দ্বারা উন্নয়ন ও তার ফসল সমগ্র জনগণের মধ্যে বণ্টনের প্রয়োজনীয়তার প্রতি উন্নয়ন অর্থনীতির দর্শনের যে অঙ্গীকারের প্রয়োজন ছিল, তা ছিল দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। ফলে উন্নয়ন সম্পর্কিত এ যাবত সমগ্র আলোচনা পরিণত হয়েছে শূন্যগর্ভ চুলচেরা বিশ্লেষণ ও অর্থহীন বিতর্কে। উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন এবং সমাজে বৈষম্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে উন্নয়ন-এ দুই উন্নয়ন অর্থনীতির দর্শন দেশজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য ও প্রত্যাশিত সেই ছাঁকনি প্রক্রিয়ার আনজাম দিতে পারেনি যা বিভিন্ন খেয়ালখুশি ও ঝোঁক তাদের সমগ্র আলোচনা ও অভিসন্দর্ভকে অন্তহীন ও দিশাহীন এক পথে ঠেলে দিয়েছে। উন্নয়নের সকল বিবেচ্য ক্ষেত্রেই একথা সত্য। কৃষি বনাম শিল্প, গ্রামীণ বনাম নগর উন্নয়ন, ভারসাম্যপূর্ণ বনাম ভারসাম্যহীন উন্নয়ন, আমদানি প্রতিস্থাপন বনাম রপ্তানি উন্নয়ন, বাজার অর্থনীতি বনাম পরিকল্পনা-সকল বিষয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। অর্থনীতিতে দক্ষতা ও ন্যায়পরতা এ দু’টিই যদি আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হয়, তবে দেখা যাবে, এ যাবত উন্নয়ন সম্পর্কিত সমগ্র আলোচনা এ দু’টি বিষয় নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সমগ্র আলোচনাই পরিণত হয়েছে এক অর্থহীন বাকসর্বস্ব আপাত চাকচিক্যময় কথামলায়। উন্নয়ন অর্থনীতির আলোচনাতেই উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতিকে ধরা হয়নি। উন্নয়নশীল দেশসমূহ উন্নয়নের কোন ধাপে অবস্থান করছে, তাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কী, কোন উদ্দীপনাসমূহ মানুষকে সমাজস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থের সাথে সংগতি রেখে কর্মপ্রেরণা দান করে-এসব সম্পর্কে উন্নয়ন অর্থনীতির আলোচনায় পরিষ্কার ধারণার অভাব সুস্পষ্ট। এর ফলে উন্নয়নশীল অর্থনীতির যে সামগ্রিক ক্ষতি হয়েছে তা হচ্ছে, স্বাচ্ছন্দ গতিশীলতার বদলে প্রতিবন্ধকতা, শ্লথ প্রবৃদ্ধি রেখা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, প্রাণশক্তি শুষে নেয়া ঋণ এবং সামাজিক অস্থিরতা। সত্যিকার কর্মচেতনা ও ন্যায়ানুগ বণ্টন নীতিমালার বোধ ও স্পৃতা সম্বলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ধারণা ও কাঠামো গড়ে তোলা যেত, যদি সমগ্র নীতিমালার লক্ষ্য থাকত আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে উন্নয়ন পরিকল্পনার এত বেশি বাধাবিঘ্ন, শ্লথ গতি ও ধসে পড়ার মুখোমুখি হতে হতো না।
কৃষি বনাম শিল্প
উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ জনগণ গ্রামাঞ্চলে বাস করে। তাই পল্লী ও কৃষি উন্নয়ন ছাড়া তাদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। পল্লী উন্নয়ন তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক পথের মাঝে একটি পথ মাত্র নয় বরং পল্লী উন্নয়ন অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য। তবে শিল্পোন্নয়নের সমর্থন ছাড়া পল্লী উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ কথাও সত্য। কৃষকদের আয় বাড়ানো প্রয়োজন যাতে তারা উন্নত বীজ, প্রযুক্তি ও সার ব্যবহার করতে পারে। কৃষক পরিবারের বেকার ও অর্ধবেকার সদস্যদের কর্মসংস্থান ব্যতিরেকে আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। যুগপৎ গ্রামীণ এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ছাড়া কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব হবে না। উন্নয়নশীর দেশের অধিকাংশের জন্য তাই পল্লী উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্পোন্নয়ন অত্যাবশ্যক। এ দ্বৈত উন্নয়ন প্রক্রিয়া হবে মৌলিক চাহিদা পূরণ ও বৈষম্য হ্রাসের জন্য প্রয়োজন তাই দেশের অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন নীতি অনুসরণ। গ্রামীণ উন্নয়ন বা শিল্পোন্নয়ন কোনোটাই এককভাবে উন্নয়নশীল দেশের বঞ্ছিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির সকল খাতের আধুনিকীকরণ ও বহুমুখীকরণ।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তাই কৃষি উন্নয়ন বা শিল্পোন্নয়ন কোনো বিকল্প পন্থা নয় যে তাদেরও মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিলেই হলো। এ উভয় খাত পরস্পর নির্ভরশীল এবং এক অন্যের পরিপূরক। প্রকৃত প্রস্তাবে কৃষি খাত বা শিল্প খাতের উন্নয়ন লক্ষ্য হচ্ছে, কিভাবে এ খাতদ্বয়ের উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায়। যদি নীতি নির্ধারকদের লক্ষ্য হতো আপামর সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধান করা, তবে তারা অবশ্যই কৃষি ও শিল্প উভয় খাতের যুগপৎ উন্নয়নে মনোযোগী হতেন। এসব আলোচনা হতে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোনো অর্থনৈতিক কর্মসূচি যা অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হারের বৈষম্যমূলক প্রবৃদ্ধি বা unbalanced growth এর তত্ত্ব উপস্থাপন করে, তথা কৃষি বা শিল্প কোনো খাতকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে, তা জনগণের জন্য দুর্দশা, কল্যাণ ও সংকট ব্যতিরেকে অন্য কিছু বয়ে আনে না। এ ধরনের একদেশদর্শী নীতি একবার চালু হলে তার কুফল পরিবর্তনের জন্য পরবর্তীতে প্রয়োজন হয় সংশোধনমূলক নীতিমালার প্রবর্তন। এ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ ও প্রয়োগ কখনো সহজ ও সমস্যা মুক্ত হয় না।
আমদানি প্রতিস্থাপন এবং রপ্তানি উন্নয়ন
যদি কৃষি ও শিল্পকে সমভাবে গড়ে তুলতে হয়, তবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আমদানি প্রতিস্থাপন ও রপ্তানি উন্নয়নের গুরুত্বকে সুস্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করতে হবে। একটিকে খাটো করে অন্যটিকে গুরুত্ব প্রদানের কোনো প্রয়োজন নেই। উভয় খাতই অত্যাবশ্যক, যদিও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপে তাদের তুলনামূলক গুরুত্ব হ্রাস-বৃদ্ধি পেতে পারে। অবশ্যই এ কথার অর্থ এই দাঁড়ায় না যে, যে কোনো মূল্যেই আমদানি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, সীমিত প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, সীমিত সম্পদের দক্ষ ও সুসম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করা, তাই আমদানির ক্ষেত্রে ট্যারিফ ও নন- ট্যারিফ দেয়ালগুলো তুলে দেয়া বা না দেয়ার বিষয়টি উক্ত পদক্ষেপ দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ কতটুকু নিশ্চিত হবে সে নিরিখে দেখতে হবে। উৎপাদন উপকরণের বিভিন্ন খাতে বণ্টনের যুক্তিযুক্ত নীতিমালাকে উপেক্ষা করা সংগত হবে না। কেননা সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের মূল্য দিতে হবে জনগণকে, যা কোনোক্রেমই মেনে নেয়া যায় না। এতদসত্ত্বেও দেখা যায়, আমদানি প্রতিস্থাপন কর্মসূচি দ্বারা ধনিক-বণিক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ সংরক্ষিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা হ্রাসের শ্লোগানটি ব্যবহার করা হয় জনগণের দেশপ্রেমিক অনুভূতিকে ব্যবহারের জন্য।
অর্থনৈতিক নীতিমালা হিসেবে আমদানি-প্রতিস্থাপন কর্মসূচিতে কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি হচ্ছে যে অবস্থা ও পদ্ধতিতে তার অপপ্রয়োগ হচ্ছে তাতে। যদি উন্নয়নের লক্ষ্য হয়ে থাকে সমাজে ন্যায়পরতা সৃষ্টি করা, তাহলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন ছিল কৃষি, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের (Small Micro Entreprise-SME) সমর্থনে আমদানি প্রতিস্থাপন কর্মসূচিকে ব্যবহার করা। এর ফলে গ্রামীণ এলাকা এবং ক্ষুদ্র শহর ও নগরীতে কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত হতো। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে তাদের ভিটেমাটি হতে উচ্ছেদ হয়ে নগরমুখী হতে হতো না। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় প্রত্যাশিত কৃষিনির্ভর ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের উন্নয়নের পদক্ষেপ পরিবর্তে গ্রহণ করা হলো শহরাঞ্চলে বৃহৎ শিল্প কারখানা স্থাপনের কর্মসূচি। বৃহৎ শিল্প স্থাপনে সহায়তার লক্ষ্যে সরকার কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক মুদ্রাহার ও উচ্চ ট্যারিফহার নির্ধারণ করল। নিম্নমূল্যে উৎপাদন উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে প্রদান করল বিপুল ভর্তুকি। পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক সহায়তা এগিয়ে আসলো। এসব চোখ ঝলসানো বৃহদায়তন প্রকল্পের প্রতি আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাসমূহের সুদৃষ্টি উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প খাত সরকারের পক্ষ হতে ভর্তুকি বা অন্য কোনো প্রকার সহায়তা পায়নি, তদুপরি উচ্চ মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রাহারের কারণে এ খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব খাতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ছিল প্রাচীনকালের। ক্রমউৎপাদনশীলতার কারণে আয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাত্রা ছিল অনুল্লেখ্য। ফলে বেকারত্ব ও অর্ধবেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। ভারী যন্ত্রপাতির দাম কৃত্রিমবাবে কম রাখায় এবং ট্যারিফহার ও অতিরিক্তভাবে মূল্যায়িত বৈদেশিক মুদ্রার সযোগের কারণে আমদানি প্রতিস্থাপক বৃহৎ শিল্প কারখানা প্রসার লাভ করল। উপরন্তু সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন ও তাদের সার্বিক স্বার্থ দেখা যেহেতু সরকারি নীতিমালার প্রধান লক্ষ্য ছিলনা, তাই আমাদানি প্রতিস্থাপক যে সকল বৃহৎ শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্যে নির্ধারণ করা হলো তা গণমানুষের স্বার্থ ও কল্যাণের অনুকূলে গেল না। যদি তা করা হতো, তাহলে অন্তত সাধারণ মানুষ সুলভ মূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় ভোগ্য সামগ্রী লাভ করতে পারত। যদিও এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি সুরাহা সম্ভব হয়ত হতো না। কিন্তু দেখা গেল ঐসব বৃহদায়তান শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হলো যা সাধারণ মানুষের অত্যাবশ্যক দৈনন্দিন পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের প্রয়োজন পূরণের জন্যে নয়, বরং মুনাফামুখী বিলাস দ্রব্য ও ভারী যন্ত্রপাতি উৎপাদনে নিয়োজিত রইল। দেশীয় বাজার ক্ষুদ্র হবার কারণে এসব শিল্প দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ছিল সীমিত এবং অদক্ষ হবার কারণে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। অপরদিকে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি নির্ভর বিধায় প্রতিস্থাপক শিল্প কারখানা দ্বারা দেশর শিল্পদ্রব্য সামগ্রির ঘাটতি পূরণ ও আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব হলো না। প্রকৃত প্রস্তাবে শুধু এক শ্রেণীর আমদানির বদলে অন্য শ্রেনীর আমাদানি প্রতিস্থাপিত হলো মাত্র।
বিদেশ হতে আমদানি করা কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে বড় শিল্প কারখানা গড়ে তোলার মাদ্যমে প্রত্যাশিত মাত্রার কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি হলো না, যা দিয়ে কৃষি, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শ্পিরৈ দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। কোনো খাতের প্রবৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিকভাবে অর্থনীতিতে যে ‘লিংকেজ’ প্রতিক্রিয়া তথা অন্যখাতগুলোর জন্যে যে সুযোগ সুবিধার সৃষ্টি হবার কথা, তা হলো না। বৃহদায়তন শিল্পসমূহের জন্যে যে আমদানি করতে হয় বাড়তি মুনাফা সে পথে আবার ফিরে গেল। ধনী দেশগুলোতে পুঁজির আধিক্য ও শ্রমের স্বল্পতার কারণে সেখানকার প্রযুক্তিসমূহ স্বাভাবিক কারণেই পুঁজি-নিবিড়। উন্নয়নশীল দেশসমূহের শিল্পকারখানায় উন্নত বিশ্ব হতে আমদানিকৃত এসব পুঁজি নির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে লাগল। ফলে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠলেও সে অনুযায়ী কর্মসংস্থানো সযোগ প্রসারিত হলোনা। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় সম্পদের বৃহৎ ভাগ কৃষি, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্প খাতে সৃষ্টি হলেও এসব খাত ন্যায্য হিস্যা হিসেবে পুঁজি রূপে এ সঞ্চয়ের ভাগ পেল না। বরং ঐ সঞ্চয় প্রবাহ সরকারের পক্ষপাতমূলক নীতি কারণে বৃহত শিল্পখাতে প্রবাহিত হলো। ফলশ্রুতিতে গ্রামীন হস্তশিল্প বিলেতি তাঁতশিল্প দ্বারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশের জন্যে বেকার থাকা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকলনা অথবা তারা শহরাঞ্চলে পাড়ি জমাতে বাধ্য হলো।
এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে, অর্থনীতির উন্নয়নে বৃহদায়তান পুঁজি নির্ভর শিল্পখাতকে খাটো করে দেখা। কথা হচ্ছে যে, যেহেতু আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি যেখানে প্রাধান্য পাওয়া সামাজিকভাবে প্রয়োজন, সেখানে পুঁজি-নিবিড় বৃহৎ শিল্প তখনই গড়ে উঠতে দেয়া উচিত, যখন শ্রমনিবিড় শিল্প সমূহ ঐসব দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনে সমর্থ নয় বলে দেখা যায়। ‘উন্নত চিন্তা কিন্তু সরল জীবনযাপন’ –প্রাচ্যের এ দর্শনের নিজস্বতার সাথে সংগতি রেখে দেশীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শন ও কর্মপদ্ধতি গড়ে তোলার পরিবর্তে পাশ্চাত্য জীবনবোধ ও পদ্ধতির প্রতি যে আসক্তি ও প্রচারণা চালানো হয়েছে, তাতে বর্তমানে যে ধারার দ্রব্যসামগ্রীর শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে সেই প্রবণতাটাই স্বাভাবিক ছিল। এটা আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে পাশ্চাত্যের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল উৎপাদনকারী বেনিয়া ও শিল্পপতি গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থে। তারা তাদের পণ্য ও প্রযুক্তি তৃতীয় বিশ্বে বাজারজাতকরণের লোভনীয় পন্থা অনুসরণ করেছে। ব্যাংক ও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান মারফত ‘ক্রেডিট সেল’ এর মাধ্যমে তার তৃতীয় বিশ্বে তাদের পণ্য সামগ্রীর বাজার সৃষ্টি করে নেয়। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বের রপ্তানির চেয়ে আমদানি বৃদ্ধি পায়। সৃষ্টি হয় আমাদানি ও রপ্তানির মাঝে ভারসাম্যহীনতা ও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সংকট।
যদি শিল্পায়ন ও আমদানি প্রতিস্থাপনের নীতিমালা সমাজে ন্যায়পরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রচিত হতো তাহলে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন দৃষ্টিভংগি ও পদ্ধতি গ্রহণ করা হতো। তাহলে লক্ষ্য হতো মানুষের মৌলিক দ্রব্য সামগ্রীর প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদন, সকল মানুষের জন্যে কর্মসংস্থান এবং সমাজের বৈষম্যহ্রাস। দেশীয় ধনীক শ্রেণী ও বিদেশী বেনিয়াদের স্বার্থ পূরণের হাতিয়ার হিসেবে দেশীয় শিল্পনীতি ব্যবহৃত হতোনা। সব কিছু করা হতো দেশীয় বাজারের জন্যে, ভোগ্য পণ্য ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে গ্রামীণ ও শহরের উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের জন্যে। গ্রামীণ এলাকায় গড়ে তোলা হতো সহজ সরল অথচ দক্ষ ভৌত ও আর্থিক অবকাঠামো। ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের জন্যে দেশীয় লাগসই প্রযুক্তি নির্মাণ করা হতো অথবা আমদানি করা হতো ঐ সব প্রযুক্তি যা উন্নয়নশীল দেশের অবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ। দেশীয় শিল্পকে পরিচর্যার জন্যে দেয়া হতো ট্যারিফ প্রতিরক্ষা। এসব যদি করা হতো, তবে শুধুমাত্র দেশজ উৎপাদনই বৃদ্ধি পেতনা, বিদেশী পণ্যের সাথে এগুলো এক পর্যায়ে এসে মানের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় নামতে পারতো। গ্রামীণ এলাকায় প্রচুর কর্মসংস্থান হতো, গ্রামীণ আয় বৃদ্ধি পেত, শহরের উপর জনসংখ্যার চাপ কমে যেত। গ্রামীন মানুষের অধিক আয়ের ফলে তারা উন্নমানের কৃষি উৎপাদন উপকরণ ব্যবহার করতে পারতো। ফলে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেত।
এভাবে যদি আমাদানি প্রতিস্থাপনের শিল্পনীতি গ্রহণ করা হতো, তবে ক্ষুদ্র ও ব্যাষ্টিক শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে দেশে পণ্যসামগ্রীর চাহিদার সংকুলান করা সম্ভব হতো। এবং পরিশেষে উদ্ধৃত্ত পণ্য রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করতে পারত। প্রথমে অবশ্য দেশীয় বাজারের চাহিদা অনুপাতে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতো। শিল্প কারখানার ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে যখন যখন বাড়তি অর্থনৈতিক সুবিধা (external economic) সৃষ্টি হতো, কখন রপ্তানি বাজার সৃষ্টির সুফল ঘরে তোলা যেত। এ ধরণের শিল্পনীতি হতো উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ের জন্যে। যখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রীর প্রয়োজন মিটে যেত, বেকার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, তখন ভারী যন্ত্রপাতি ও ‘ভোক্তা টেকসই’ উৎপাদন উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্যায়ের নীতিমালা হিসেবে গৃহীত হতে পারতো।
আমদানি প্রতিস্থাপন বা বিদেশ হতে আমাদানি হ্রাসের জন্যে দেশীয় শিল্পকারখানা গড়ে তোলার যে নীতি, তা উন্নয়নশীল দেশসমূহে সঠিক পন্থায় পরিচালিত না হওয়ায় রপ্তানি উন্নয়নের লক্ষ্য তাও অর্জন হয়নি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি সত্ত্বেও গড়ে তোলা পুঁজি-নিবিড় অনেক বৃহদায়তান ভারী শিল্পেরই প্রাথমিক পর্যায়ে তুলনামূলক খরচ সুবিধা ছিলনা। রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার সামনে তারা দাঁড়াতে পারলনা। পক্ষান্তরে কৃষি ও শ্রম নির্ভর ক্ষুদ্র শিল্পসমূহ স্থাপন করে যাদের তুলনামূলকভাবে অধিক দক্ষ ও উৎপাদনশীল করে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল, তারা সরকারি সাহায্য সহযোগিতা হতে বঞ্চিত হলো। বৈদেশিক মুদ্রার হার কৃত্রিমভাবে উচ্চমাত্রায় বেঁধে দেয়ায় কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাত রপ্তানি বাজারে প্রবেশের কার্যকারিতা হারাল। ফলে রপ্তানি যতদূর বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব ছিল তা হলোনা।
আধুনা রপ্তানি উন্নয়নের উপর যে পরিমাণ অথ্যধিক জোর দেয়া হচ্ছে, সতর্কতার সাথে তার মূল্যায়ন করতে হবে। যদি যে কোনো মূল্যে আমদানি প্রতিস্থাপনের নীতি ক্ষতিকর হয়, তবে যে কোনো মূল্যে রপ্তানি উন্নয়নের নীতিও আকাঙ্ক্ষিত হতে পারেনা। যে খাতে ইতোমধ্যে অনেকগুলো অদক্ষ পুঁজি-নির্ভর বৃহৎ শিল্প স্থাপিত হয়ে গেছে, সেখানে যে কোনো নতুন নীতির দু’টি স্তম্ভ হচ্ছে শ্রমের কম মূল্য নির্ধারণ ও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন। এ নীতি দ্বারা দেশীয় ধনীক শ্রেণী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অদক্ষ্য শিল্পগুলোর পক্ষে রপ্তানি সম্ভব হতে পারে, তবে তা প্রকৃত মজুরি হ্রাসের দ্বারা দরিদ্র শ্রেণীকে আরো দরিদ্রতর করবে। তাই রপ্তানি উন্নয়নের এ নীতিমালা হবে আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতি বিরোধী। তাই রপ্তানি উন্নয়নের হুজুগে ট্রেনে চটজলদি উঠে পড়ার আগে নিশ্চিত করতে হবে যেন রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়ার ফসল মেহনতী দরিদ্র শ্রেণীর হাতে আসে।
যেসব প্রবক্তারা আমদানি প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে উন্নয়নের কৌশল হিসেবে শুধুমাত্র রপ্তানি উন্নয়নের উপর জোর দিয়ে থাকেন, তাদের মনে রাখা প্রয়োজন তৃতীয় বিশ্বের রপ্তানি সামগ্রী উন্নত বিশ্বে সব সময় সকল প্রকার ট্যারিফ ও ট্যারিফ দেয়ালের সম্মুখীন হবে। অপরদিকে ‘ডাম্পিং নীতি’ (Dumping Policy) এবং প্রিডেটরি’ (Predatory) মূল্য নির্ধারণীর মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব তাদের মালামাল তৃতীয় বিশ্বে বাজারজাতকরণ অব্যাহত রাখবে। ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার ভাষায়, ইউরোপের ‘কমন এগ্রিকালচারাল পলিসি’ এবং ধনী দেশসমূহের ‘মাল্টি-ফাইবার এগ্রিমেন্ট’ এর মতো জটিল বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতাসমূহের প্রধান ভোক্তভোগী হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো। গত তিন দশকে শিল্পোন্নত বিশ্বে কৃষি ও শিল্পে সরকারি অনুদান উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। একই হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বাহির হতে আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা। বুনক্যাম্প এর মতে, উন্নত দেশের সরকারসমূহ কর্তৃক আরোপিত এসব বাধানিষেধ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিঘ্নিত করে তুলেছে। উন্নত দেশের এসব রক্ষণশীল পদক্ষেপ ও সরকারি নীতির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো হতে কৃষি পণ্য রপ্তানি দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। উদাহারণ স্বরূপ, জাপানে চাল আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশ্ববাজারে দরের ৯গুণ দামে জাপানে দেশি চাল বিক্রি হয়। উন্নত বিশ্বে ট্যারিফ হার কমানো হলেও ঐসব দেশে নন-ট্যারিফ বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা সমূহ দ্বারা বাহির হতে আমাদানি প্রতিহত করে দেশীয় পণ্য সামগ্রীর সংরক্ষণ অব্যাহত থাকে। অধিকন্তু কোনো উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি অগ্রগতি ব্যাহত হয়। আন্কটাড এর হিসাব মতে, উন্নত বিশ্বের সংরক্ষণশীল নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বছরে ৭০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হতে বঞ্চিত হয় যা তাদের বার্ষিক বৈদেশিক ঋণের ৫০ ভাগের বেশি।
অপ্রত্যাশিত সমস্যাবলী
উন্নয়ন অর্থনীতির পণ্ডিতগণ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যে সরকারের বৃহৎ ভূমিকার উপর জোর দিলেও এসব দেশের সম্পদ যেভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে তা রোধের জন্যে কার্যকর কৌশল উদ্ভাবনের দিকে তেমন কোনো নজর দেয়নি। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির একচেটিয়া প্রচারণা চলছে। এমনকি অর্থনীতিবিদ রসটো অর্থনৈতিক উন্নয়নের পঞ্চম ধাপে যে বিলাসী জীবন যাপনের উল্লেখ করেছেন, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপেই সে জীবনযাত্রার দিকে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ফলে বিলাস দ্রব্যের আমাদানী বৃদ্ধি পেয়ে বাণিজ্য ঘাটতিকে প্রকট করে তুলেছে। বিলাস দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ সঞ্চয় প্রবণতাকে হ্রাস করেছে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অপ্রতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাঝে দূরত্ব বেড়ে চলছে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস দ্রব্যের খাতে সম্পদের অপচয়কে রুখতে হলে প্রয়োজন ছিল মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতার ধারা গড়ে তোলা। পশ্চিমা অর্থনৈতিক উন্নয়ন পদ্ধতিতে এ ধরণের কোনো সামাজিক মূল্যবোধের দর্শন নেই। তাদের উন্নয়নের জন্যে কর মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে ভোগ হ্রাসের জন্যে ব্যবহৃত একমাত্র অস্ত্র।
করের ভিত্তি সংকীর্ণ হওয়ায় এবং অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ন কর প্রশাসনের কারণে উন্নয়নশীল দেশে বিপুল হারে কর-রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ নেই। বাটে ঘাটতি তাই তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। এ ঘাটতি পুরণের জন্যে কীনসীয় অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ ও বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধির কথা বলো হয়েছে। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির প্রবক্তারা একথা ভুলে যান যে, উন্নয়নশীল দেশসমূহ কাঠামোগত দুর্বলতা ও সরবরাহ জটিলতার কারণে উন্নত দেশের তুলনায় এসব দেশে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি ও আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি অধিকহারে বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক সাহায্যের প্রসঙ্গে বলা যায় যে, এর ক্ষুদ্রাংশ আসে অনুদান হিসেবে, বৃহদাংশ আসে ঋণ হিসেবে যা সুদে আসলে চক্রবৃদ্ধি হারে পরিশোধ করতে হয়। টাকা ছাপানো এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ- দুই ক্রাচের উপর ভর করে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহকে চলতে হয়। একবার এ দুটির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে আর ফেরার পথ থাকেনা। কেননা উচ্চহারে কর বৃদ্ধি বা উল্লেখযোগ্য সরকারি ব্যয় হ্রাস কোনোটাই রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় নয়।
মুদ্রাস্ফীতি
সম্প্রতি মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করলেও উন্নয়নের প্রথম পর্যায়ে একে যুক্তিসংগত ও প্রয়োজনীয় বলে ধরে নেয়া হয়েছে। ‘ফিলিপস কার্ভ’ এর মাধ্যমে নীতি নির্ধারকগণ যুক্তি খুঁজে পান যে, মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে তারা প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে পারবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে অধিকাংশ কীনসীয় অর্থনীতিবিদ মুদ্রাস্ফীতির বিষয়ে কোনো শংকা অনুভব করেননি; বরং তারা মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির নীতিকে সমর্থন দিয়ে যান। ১৯৬১ সালে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতামালায় প্রফেসর হেনী ব্রুটন বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি দমনকে অর্থনৈতিক নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য না করে বরং উন্নয়নের অস্ত্র হিসেবে একে অর্থনীতিবিদদের মুদ্রাস্ফীতির প্রতি পক্ষপাতিত্বের রাশ টেনে ধরার জন্য যথেষ্ট নয়। মুদ্রাস্ফীতি নীতির আরো ক্ষতিকর প্রক্রিয়া রয়েছে যা উন্নয়নকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং ভবিষ্যতে আরো করতে থাকবে।
মুদ্রাস্ফীতির দরুণ মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যের উপর ভর্তুকি প্রদান করতে হয়। মূল্য এসব দ্রব্যসামগ্রীর দীর্ঘমেয়াদী সরবরাহকে ব্যাহত করে। অপরদিকে ভর্তুকি প্রদান সরকারি বাজেটের উপর ক্রমাগত দুঃসহ বোঝা চাপিয়ে দেয়। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির দরুণ যে মূল্যস্ফীতি ঘটে, তা কমিয়ে আনার জন্য সরকারকে বৈদেশিক বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে উঁচু রাখতে হয়। এর ফলে আবার আমদানি উৎসাহিত হয়। বিপরীতি দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পখাত যা বৃহৎ ভারী শিল্পের মতো সরকারি সহায়তা লাভ করে না। আমদানির উপর নির্ভরতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং বৈদশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সংকুচিত হতে থাকে। ফলে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হয়। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ভার জটিলতর হতে থাকে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকি প্রদান নীতি তুলে দিতে এবং বাস্তবসম্মত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করতে চাইলেও তা পারে না। কেননা সংশোধনমূলক এ ব্যবস্থা জীবনযাত্রা ব্যয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে বিধায় রাজনৈতিকভাবে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্যার আর্থার লুইস তাই আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘উন্নত ও অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে আমরা এ মৌলিক শিক্ষাই পেয়েছি যে, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে এক দুঃসহ ক্লেশকর পন্থা’।
ঋণের বোঝা
ক্রমাগত বড় আকারের ঋণ গ্রহণ করার ফলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের বোঝা তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রথমে এ বিষয়টি তেমন আশংকাজনক মনে করা হয়নি, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের ঋণের বোঝা ক্রমশ দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক অর্থবাজার ব্যবস্থার সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। ফাঁপা ও দুর্বল অভ্যন্তরীণ অর্থবাজার হতে সরকারের বিপুল ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা হতে বঞ্চিত হলো। অর্থবাজার কম সুদ সম্পন্ন সরকারি ঋণের চাপে দুর্বলতর হলো। বহুজাতিক ব্যাংক ও অর্থসংস্থা হতে উন্নয়নশীল দেশসমূহ কর্তৃক বিপুল হারে ঋণ গ্রহণ প্রাথমিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার নিরিখে মন্দ বিবেচনা করা হয়নি। কিন্তু ঋণের বোঝা এমন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, উন্নয়নশীল দেশসমূহ কর্তৃক ঋণ পরিশোধে অপরাগতা এসব ঋণদানকারী সংস্থাসমূহের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক ঋণের ভাব লাঘবের প্রচেষ্টা এ হারকে আরো শ্লথ করে দিতে পারে।
পরিকল্পনা বিষয়ক জটিলতা
উন্নয়নশীল দেশে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে, তা যথাযথ গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করা হয়নি। অপরদিকে উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে অতিরিক্ত ফলাফল আশা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় উপাত্তের অভাব এবং উপাত্তসমূহের অসম্পূর্ণতা ও নির্ভরযোগ্যহীনতা সফল উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনার সুযোগকে সীমিত করে দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন উপাদান যথা মোট সঞ্চয়, পুঁজি, বেকারত্বের পরিমাণ, বিনিয়োগ প্রকল্পের মূল্যমান প্রভৃতি পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের অপর্যাপ্ততার কারণে পরিকল্পনায় সৃষ্ট ভুলের মাত্রা বিরাট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপরন্তু একটি পরিকল্পনা মডেল হতে অতিরিক্ত আশা করার প্রবণতা দেখা দিলো। এটা অনুধাবন করা হলো না যে, বিভিন্ন বিকল্পের মাঝে সঠিক পন্থাটি বাছাই করে নেয়ার যে কঠিন সিদ্ধান্ত নীতি নির্ধারকদের নিতে হয়, নিছক কোনো উন্নয়ন মডেল সে সমস্যাটিকে অপসারণ বা সহজতর করে দিতে পারে না। অগ্রাধিকার নির্ধারণ ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনার বহুবিধ উদ্দেশ্যের মাঝে যে পারস্পরিক সংঘাত আছে তা নিরসন করা সম্ভব নয়। উন্নয়ন দর্শন যা মূল্যবোধ ও বস্তুগত লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা দেয়, তার স্থান কখনো একটি যান্ত্রিক ‘ইকোনমেট্রিক মডেল’, দখল করতে পারে না। ‘প্যারেটো অপটিমালিটি’র ধারণা ও লক্ষ্যও এভাবে অর্জন করা যায় না। সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে দ্বিধাহীন চিত্তে নীতি নির্ধারকদের উন্নয়ন দর্শন গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণকে উৎসাহের সাথে তাতে অংশগ্রহণ করতে হবে। এ ধরণের দর্শন ও অনুপ্রেরণার অভাব ও অনুপস্থিতিই ব্যাখ্যা করে কেন সকল উন্নয়ন পরিকল্পনাই তার উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে ন্যায়পরতা বিধান করছে, অথচ কোনো পরিকল্পনা মডেলই উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোনো কার্যকর পন্থা ও পদ্ধতি বাতলে দিতে পারেনি।
একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে যেসব সমস্যার উদ্ভব হতে পারে, তা নিরসনের দিকে পূর্ব হতে যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয় না। অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সুসংগত ও পরিপক্কতার বিচারে কাগজে কলমে সঠিক বলে দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগাযোগের অভাবে ঐসব পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করে না। পরিকল্পনাগুলো আধুনিক ‘ইকোনমেট্রিক মডেলে’র সহায়তায় প্রণয়ন করা হয় বিধায় তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত পরিকল্পনাগুলো এতো বেশি মার্জিত ও পরিশীলিত যে, তা কাগজে কলমেই সুশোভন, কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য নয়। পাশ্চাত্যের উচ্চ তাত্ত্বিক মডেলগুলো অনুসরণ না করে অর্থনীতির প্রাথমিক ও সরল মূলনীতিগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলো অধিক উপকৃত হতে পারত। ম্যাক্রো-ইকোনমিক মডেলগুলোর পরিমাপযোগ্য উন্নয়ন উপাদানসমূহের প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রবণতা রয়েছে। যদিও অপরিমাপযোগ্য উন্নয়ন উপাদানগুলোরও পরিকল্পনার লক্ষ্য বিশেষত আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটি ‘ইকোনমেট্রিক মডেল’ অঙ্ক শাস্ত্রের নিরিখে যত বেশি সুশৃঙ্খলাবদ্ধ, তার তত বেশি অর্থনীতির বাইরের সামাজিক উপাদানগুলো গ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিকরণের সম্ভাবনা কম থাকে। প্রফেসর গলব্রেথের ভাষায়, ‘উন্নয়ন সমস্যাটির দিকে সাধারণভাবে দৃকপাত করলেই দেখা যায়, কার্যকর সরকার, শিক্ষা এবং সামাজিক সুবিচারের বিষয়গুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এগুলোকে চিহিন্ত করতে না পারাই প্রধান সমস্যা। এ বাধাগুলো যতদিন অপসারণ না করা যাবে, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পুঁজি বিনিয়োগ হতে তত দিন বেশি কিছু আশা করা যায় না। একটি পরিকল্পনা কাগজে কলমে যত বেশি বড় হবে, তা তত বেশি ক্ষুদ্র ফল প্রসব করবে।
নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির পুনারাবির্ভাব
উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন যেসব সমস্যায় ভুগছে, তার ফলেই পুরুত্থান ঘটেছে নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির। তিন দশক যাবত সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির বৃহৎ সরকার এবং সার্বিক পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এসব সমস্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। সরকারি খাতের বিনিয়োগের উপর প্রবল গুরুত্ব প্রদান এবং প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আরোপ করার ফলে শুধুমাত্র উৎপাদন উপাদান বণ্টনের মধ্যে বিকৃতি সৃষ্টি হয়নি, অধিকন্তু বৈদেশিক বাণিজ্য ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পদের অসম বণ্টনের ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যম ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা ব্যাহত হয়েছে। বিপুল পুঁজিনির্ভর বৃহদায়তন ভারী শিল্পের প্রতি অনুৎসাহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন; বিনিময়ে যে শিল্পায়ন ঘটেছে তা হয়েছে অদক্ষ ও অফলপ্রসূ। আইএমএফ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাইকেল ক্যামডিসাস সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘যেসব দেশের অর্থনীতি প্রবল মুদ্রাস্ফীতি, বিশাল বাজেট ঘাটতি, প্রচুর বাণিজ্য প্রতিবন্ধতা, ভারসাম্যহীন বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, বৈদেশিক ঋণের বোঝা এবং ক্রমাগত পুঁজি পাচার দ্বারা উপদ্রুত, তারা দীর্ঘকালীনভাবে উন্নয়নের পথে ধাবিত হতে পারে না। শ্লথ প্রবৃদ্ধি ও ভারসাম্যহীনতার চেয়েও বিষাদময় চিত্র হচ্ছে, এসব গরীব দেশগুলোর বৈষম্য, বেকারত্ব ও অর্ধ-বেকারত্ব ও সর্বগ্রাসী দারিদ্র্যের পরিসীমাকে হ্রাস করতে না পারার ব্যর্থতা। দরিদ্র দেশগুলোর সমস্যা হ্রাস পাবার বদলে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতা এবং জাতীয় সরকার গঠনের ফলে যে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ হয়নি।
সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন কৌশলের ব্যর্থতার পথ ধরে নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির যে পুনর্জাগরণ, তা উন্নয়শীল দেশসমূহকে তারা যে সোপান থেকে শুরু করেছিল সেখানে ফিরিয়ে আনল। তা হলো সীমিত সম্পদের ব্যবহারে দক্ষতা ও ন্যায়পরতা আনয়ন। উন্নয়ন অর্থনীতি এবার দৃশ্যত নতুন চেহারা ধারণ করল। শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি নয়, আর্থ-সামাজিক ন্যায়পরতাও এবার লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ধার্য হলো। সত্তর দশকের শুরু হতে এ ধারা সূচিত হলো। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন শুধুমাত্র মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি নয়, দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাসও।
সবাই উপলদ্ধি করতে শুরু করল যে, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দরিদ্র ও জনসংখ্যাপীড়িত দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সমৃদ্ধির আশার আলো দেখাতে পারে শুধুমাত্র মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে দীর্ঘকালীন ন্যায়পরতাভিত্তিক বণ্টন। আগে উন্নয়ন এবং পরে ন্যায়পরতাভিত্তিক বিতরণ-এ ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উন্নয়ন অর্থনীতি তাই আর শুধুমাত্র জাতীয় আয় বৃদ্ধির বেদীমূলে পূজার নৈবেদ্য হয়ে থাকল না, বরং তা বণ্টন ন্যায়পরতার প্রবক্তা হয়ে উঠল। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ, সামগ্রিক দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাস, ন্যায়পরতার সাথে উন্নয়ন প্রভৃতি আহবান উচ্চারিত হলো। নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতি অর্থনৈতিক কার্যকারণের যৌক্তিকতার অভিভাবক হিসেবে না থেকে ‘গরীবের অভিভাবক’ হিসেবে আবির্ভূত হলো।
১৯৭৩ সালে নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ব্যাংকের বার্ষিক সভায় ব্যাংকের তৎকালীন সভাপতি ম্যকনামারা বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করেন তাদের প্রতি, যারা নিশ্ছিদ্র দারিদ্র্যে মধ্যে বসবাস করছে; যারা ক্ষধা, পুষ্টিহীনতা, ব্যাধি ও অশিক্ষার যাতাকলে চরমভাবে পিষ্ট। ১৯৭৯ সালে নোবেল প্রাইজ গ্রহণকালে থিওডর শুলজ বলেন, ‘পৃথিবীর অধিকাংশ লোক গরীব। তাই গরীব হওয়ার কারণ সম্পর্কিত অর্থনীতিটি যদি আমরা জানতে পারি, তবে অর্থনীতির সত্যিকার জ্ঞান উদয় হবে’। জেরাল্ড মেয়ারের ১৯৮৪ সনে প্রকাশিত ‘Leading Issues in Economic Developmemt’ এর প্রথম সংস্করণে দারিদ্র্য, বৈষম্য, আয় বণ্টন প্রভৃতি বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত চতুর্থ সংস্করণে তিনি উন্নয়নশীল দেশে আয় বণ্টনের ন্যায়পরতার উপর উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব আরোপ করেন। একই সালে প্রকাশিত অন্য একটি বইয়ে তিনি দারিদ্র্য থেকে মুক্তিকেই অর্থনীতির একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন। আয় বণ্টন ন্যায়পরতার প্রতি উদ্বেগ সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ডাডলি সিয়ার্স এর ভাষায়, ‘একটি দেশের উন্নয়ন হচ্ছে কিনা তা জানতে হলে প্রশ্ন করতে হবে, সে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির কি অবস্থা? বেকারত্ব পরিস্থিতির কি রূপ? আয় বৈষম্যের অবস্থা কি? যদি এ তিনটি অবস্থারই উন্নতি হয়ে থাকে তবে নিঃসন্দেহে সে দেশের উন্নয়ন ঘটছে বলা যায়। যদি কেন্দ্রীয় সমস্যাত্রয়ের একটি বা দুটির বিশেষভাবে যদি তিনটিরই অবনতি ঘটে তবে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হলেও সে দেশের উন্নয়ন ঘটছে বলা অসম্ভব হবে’।
মৌলিক প্রশ্ন
আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা যাকে দ্রুত পুঁজিগঠন ও প্রবৃদ্ধির যুপকাষ্ঠে এতদিন বলি দেয়া হয়েছে, তা আবার পুনরায় স্বীকৃতি লাভ করল। এ শুভ পরিবর্তনকে অবশ্যই সুস্বাগতম। দক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা অর্জনের প্রশ্নে উন্নয়ন অর্থনীতি রূপ পরিবর্তন করে নিওক্লাসিক্যাল, কীনেসীয় এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মতো অবয়ব ধারণ করল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল, বিশেষ দর্শন ও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির পক্ষে এ লক্ষ্যদ্বয় অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা? বর্তমানে প্রতিটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এবং প্রতিটি লেখায় নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ যে উন্নয়ন কৌশলের কথা তুলে ধরছেন, তা হলো ‘এডজাস্টমেন্ট’ বা সমন্বয় সাধন। সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। উন্নয়নশীল দেশসমূহই যে প্রকট ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে, তাতে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তা কেবলমাত্র একটি বিকল্প পন্থা নয়, বরং অত্যাব্শ্যকীয় প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রামের উপাদানগুলো সম্পর্কে। সন্দেহ দেখা দিয়েছে, নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতি যে উপাদানগুলো উপস্থাপন করছে, তা একই সাথে দক্ষতা ও ন্যায়পরতার লক্ষ্যদ্বয় অর্জনে সক্ষম হবে কিনা। সঠিক সমন্বয় প্রক্রিয়া হচ্ছে তাই যা অর্থনীতির উন্নয়ন পদ্ধতির চাহিদা ও সরবরাহ উভয় দিককে এমনভাবে মোকাবিলা করে যা প্রবৃদ্ধিকে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত করবে। চাহিদার দিকে অভ্যন্তরীণ সামগ্রিক ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে হবে; এ ব্যয় হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যয়ের সামগ্রিক মাত্রা। তবে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি অবুণ্ণ রাখার জন্য বিনিয়োগ ব্যয় ও ভোগব্যয়ের পরিমাণ অধিকমাত্রায় কমাতে হবে। আর্থ-সামাজিক সুবিচার অবুণ্ণ রাখার জন্য আবার ভোগব্যয় এমনভাবে কমাতে হবে, যাতে কৃচ্ছ্যতাসাধনের ভারটি সমাজের সক্ষম ব্যক্তিদের উপর পড়ে। দরিদ্র মানুষের ভোগের অবস্থার যেখানে উন্নয়ন কাম্য ও প্রত্যাশিত, সেখানে অন্তত যাতে তাদের ভোগের মাত্রা আরো কৃশকায় হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সরবরাহের দিকেও আবার আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার দাবি করে যে, উৎপাদন এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে সমাজের প্রয়োজন পূরণ হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায় এবং বৈষম্য হ্রাস পায়।
পক্ষান্তরে দেখা যায় বিপরীত চিত্রটাই ঘটেছে। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এর আশীর্বাদধন্য নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির সমন্বয় কর্মসূচির ফলে অস্থায়ী বেকারত্ব দেখা দিচ্ছে, জীনযাত্রার মান অন্তত স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কমে যাচ্ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজের দরিদ্র অংশই সবচেয়ে বেশি কষাঘাত লাভ করছে, এ কথা অকপটে স্বীকার করছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বারবার কোনোবল। কিন্তু আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি সমন্বয় প্রক্রিয়ার মূল্য হিসেবে দরিদ্র মানুষের এ ভোগান্তিকে মেনে নিতে পারে না। এ ভোগান্তি সাময়িক ও স্বল্পমেয়াদী বলে যে প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এ ভোগান্তি প্রক্রিয়ায় স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী ও পৌনঃপুনিক মাত্রা গ্রহণ করার সম্ভাবনাই বেশি। সমন্বয়ের ফলাফলের বিষয়ে কোনোবলের মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির প্রস্তাবনার নিরিখেই করা হয়েছে। এখন দেখা প্রয়োজন, মূল্যবোধ নিরপেক্ষ উন্নয়ন অর্থনীতির প্রসারণ পর্যায়ে যে দরিদ্র শ্রেণীকে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে, তাদের কেন আবার নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির সমন্বয় প্রক্রিয়ার পর্যায়ে নতুনভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে?
লিবারেলিজমের উপাদানসমূহ
নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির সমন্বয় প্রোগ্রামের বুনন হয়েছে লিবারেলিজমের সুতোয়। লিবারেলিজম বস্তুত ‘এনলাইটেনমেন্ট’ তত্ত্বের ভিতে গড়া। অর্থনীতিবিদদের ‘গরীবের অভিভাবক’ হবার অনেক বাকবিতণ্ডা সত্ত্বেও তারা এমন কোনো প্রণোদনা ও অনুপ্রেরণা সঞ্চারক ব্যবস্থাপনার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে পারেননি, যাতে শক্তিশালী ও বিত্তশালীদের সমন্বয় প্রক্রিয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া গরীবের উপর না ফেলে নিজেদের হজম করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যায়। কিন্তু দেখা যায়, গরীব মানুষের জীবনযাত্রার উপর তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুধু পরোক্ষভাবে সামান্য লাঘবের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং তা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ভারসাম্য আনয়নের মাধ্যমে যে অধিকতর প্রবৃদ্ধির আবহ সৃষ্টি হবে তারই উচ্ছিষ্ট হিসেবে আসবে।
আইএমএফ-এর সমন্বয় প্রোগ্রামে নিওক্লাসিক্যাল লিবারেলিজমের যেসব উপাদান প্রস্তাব করা হয়েছে তা হচ্ছেঃ (ক) অর্থনীতিতে সরকারি ভূমিকা হ্রাস; (খ) বাজার অর্থনীতিকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া; (গ) বৈদেশিক বাণিজ্যকে বিমুক্তকরণ। এ মূল লক্ষ্য পূরণের জন্য স্থিতি ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনয়ন করতে হবে। সার্বিক অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক দক্ষতা পরিমার্জনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণ করতে হবে। অবশ্য বণ্টন ন্যায়পরতার বিষয়টি মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক এডজাস্টমেন্ট বা সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়ায় যে বিরূপ বণ্টন বিষয়ক সমস্যার সৃষ্টি হয়, তার নিরসন বৈদেশিক বা আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তাপুষ্ট প্রোগামের মূল লক্ষ্য থাকে না, যদিও পরোক্ষভাবে কিছু ইতিবাচক ফল লাভ করা যায়। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সদস্য দেশগুলোর উপর আইএমএফ-এর বার্ষিক কনসাল্টেশন রিপোর্টের কোনোটিতেই দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য দূরীকরণ বা প্রাত্যহিক প্রয়োজন পূরণের উপর কোনো আলোচনা নেই। যদি একটি দেশ অভ্যন্তরীন আয় বৈষম্যকে আরো তীব্রতর করে হলেও বৈদেশিক ভারসাম্যহীনতাকে কমাতে পারে, তবে সেটাই আইএমএফ-এর নিকট অভিনন্দনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, অর্থনীতিতে সরকারি ভূমিকা ও হস্তক্ষেপ হ্রাস করা হলে কর নিয়ন্ত্রণ ও বাজেট খাতটি কমানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ব্যয়ভার হ্রাস করা সম্ভব হবে। বেসরকারি খাত স্ব-স্বার্থ দ্বারা উদ্বুদ্ধ বিধায় তা অধিকতর কার্যকর ও বৃহত্তর ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। ঋণ প্রসারের লাগাম টেনে ধরা হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হ্রাস পাবে। বাজার শক্তিকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়ার ফলে সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারসহ সকল উৎপাদন উপকরণ, পণ্য ও সেবার মূল্য সঠিক হারে সঠিক খাতে প্রবাহিত হবে। বাজার শক্তিসমূহ সঠিক সংকেত পাওয়ার কারণে উৎপাদন উপকরণসমূহ সঠিক খাতে প্রবাহিত হতে থাকবে। অর্থনৈতিক সম্পদের অপচয় হ্রাস পাবে। এ নীতির ফলে অধিকাংশ দ্রব্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেলেও, নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতি প্রকৃত মজুরি হ্রাসের এ ধারাকে সমর্থন করে, যদিও সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর উপর এতে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে উচ্চতর কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির মারফত তা পুষিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ করে সমন্বয় সাধনকারী উন্নয়নশীল দেশ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের সংরক্ষণ নীতিজনিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে। সকল আমদানি বাণিজ্যের বাধা তুলে দিতে হবে। আমদানি ও রপ্তানি উভয়কে উৎসাহিত করতে হবে। বাস্তবসম্মত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আমদানি ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। চলতি বাজেট ঘাটতি এতে হ্রাস পাবে। যদি ট্যারিফ ধার্য করতেই হয়, তা হওয়া উচিত নিম্নমাত্রার ও সুষম। কোনো কিছুর প্রতি পক্ষপাতিত্বের দ্বারা বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ সমীচীন হবে না। কেননা এর ফলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে সম্পদ সঞ্চালনে অস্বাভাবিক ও বিকৃত প্রবাহ সৃষ্টি হবে এবং উৎপাদন দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমদানি প্রতিস্থাপনের জন্য শিল্পায়ন নীতির রয়েছে সীমিত সম্ভাবনা। কেননা এর লক্ষ্য হচ্ছে কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ দেশীয় বাজার। অপরদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা নেই। উদারনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদ সরকারি ব্যয় হ্রাসের আহবান জানালেও বাজেটের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক ন্যায়পরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারি ব্যয়ের বিভিন্ন খাতের মধ্যে বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনয়নের সমস্যাটির দিকে আলোকপাত করে না। দরিদ্র জনগণকে মানব সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন, যোগাযোগ ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয়ের পন্থা নিরূপণের কোনো দিকনির্দেশক আলোচনা এ উদার নৈতিক মতবাদে দেখা যায় না। এমনকি বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট কর্মসূচির সরবরাহের দিক সংক্রান্ত আলোচনাও প্রধানত সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও রপ্তানির বাস্তবসম্মত মূল্য, সুদের হার, বিনিময় হার এবং করের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদানের মাঝে সীমাবদ্ধ। অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনীতির যে পুনর্গঠনের প্রয়োজন, সে বিষয়ে কোনো আলোকপাত নেই। উন্নয়নশীল দেশের সম্পদ বণ্টনের বিশাল সমস্যাটির নিওক্লাসিক্যাল সমাধান দাঁড়ায় এসব দেশের জন্য বস্তুত একটি ক্ষীণ ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রের উপর। তা হলো দ্রব্য ও সেবার সঠিক মূল্যের দিয়ে বাজার শক্তিসমূহকে সঠিক সংকেত প্রদান করা।
ভুল উদাহরণ: শুধুমাত্র উদারনৈতিক মতবাদ নয়
নিওক্লাসিক্যাল ব্যবস্থাপত্রের সমর্থনে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপানের মতো দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর উদাহরণ টানা হয়। এদেশগুলো অর্থনৈতিক দক্ষতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য রপ্তানিমুখী উদারনৈতিক অর্থনীতির পথ বেছে নেয়। বলা হয়, উদারনীতিবাদ এসব দেশের বেসরকারি খাতকে অধিকতর উদ্যোগ গ্রহণ ও নৈপূণ্য অর্জনে উদ্বুদ্ধ এবং এভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছে। বহির্মুখীতা এসব দেশের রপ্তানিযোগ্য উদ্ধৃত্ত বৃদ্ধি করেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত করেছে এবং বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সক্ষম করেছে।
উদারনৈতিক মতবাদ ও রপ্তানিমুখীতা সব দেশের অর্থনৈতিক অগ্রসরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও অর্থনৈতিক সাফল্যের সকল কৃতিত্ব এ নীতির একক ফসল বলা ভুল হবে। সাফল্যের আরো অনেক উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। তার কিছু হচ্ছেঃ প্রত্যক্ষ ও বিপুলভাবে সরকারের হস্তক্ষেপ, ব্যাপক ভূমি সংস্কার ও সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা আনীত সামাজিক সংহতি, স্থিতিশীলতা ও আর্থ-সামাজিক সুবিচার; উচ্চমাত্রার সঞ্চয় ও বিনিয়োগ প্রবণতা এবং রপ্তানি উন্নয়ন ও আমদানি প্রতিস্থাপনভিত্তিক শিল্পায়নের প্রতি সরকারের সক্রিয় সমর্থন। উল্লিখিত সবগুলোই নিওক্লাসিক্যাল মডেলের নিজস্ব উপাদান নয়, বরং এর অনেকগুলোই এ মডেলের সাথে সংঘাতপূর্ণ।
সরকারি ভূমিকা
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এসব দেশের সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালণ করেছে। একমাত্র হংকং কিছুটা ব্যতিক্রম যেখানে লেইজে ফেয়ার বা মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা হয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে সরকার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য হস্তক্ষেপ করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পকারখানা, ভর্তুকি, বিধিবিধান ও অন্যান্য বিভিন্ন পন্থায় সরকারি পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়, বাণিজ্য তথা অর্থনীতির সকল অঙ্গনকে প্রভাবিত করেছে। এসব দেশের সরকারি শিল্প লাইসেন্স, বিদেশী ঋণ ও প্রযুক্তি চুক্তি ইত্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য বাধানিষেধ ও উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে নির্দিষ্ট ধারায় প্রবাহিত করেছে। তাই নিওক্লাসিক্যাল অর্থে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুরকে লিবারেল অর্থনীতি বলা যায় না। জাপান সম্পর্কে ইয়াসুও মাসাই বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সীমিত হলেও অর্থনীতির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও বিস্তৃত। এ নিয়ন্ত্রণ অব্শ্য প্রশাসনিক বা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংগঠিত হয় না, তা হয় এক সূক্ষ্ম, সুনিপুণ পদ্ধতিতে। শিল্প ও বণিক সমিতির সাথে সরকার সার্বক্ষণিক সংলাপের এক সংযোগ বজায় রাখে না, যা একজন বহিরাগতের নিকট বিচিত্র মনে হতে পারে। সরকার পরোক্ষভাবে অথচ নিবিড়ভাবে জড়িত থাকে ব্যাংকের ঋণ দানের সাথে। তাছাড়া অর্থনীতির বিভিন্ন দিক তথা রপ্তানি, আমদানি, বিনিয়োগ, মূল্য এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ও এজেন্সি রয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারের বিপুল অংশ গ্রহণের আর কোনো প্রয়োজন দেখা যায় না। অন্যান্য মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো তাই জাপানী সরকারও অর্থনীতির প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনে অনীহা প্রদর্শনের একটি আবহ বজায় রাখতে পারে। সরকারের সক্রিয় ও শক্তিশালী ভূমিকা ব্যতিরেকে এ দেশগুলো উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে কিনা সে বিষয়ে তাই সন্দেহের অবকাশ আছে। এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এসব দেশের সরকারের ভূমিকা কখনো বেসরকারি খাতে উদ্যোগ ও উদ্যমকে ব্যাহত করেনি; বরং এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হচ্ছে ইতিবাচক। সরকার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে উৎসাহ ও সহায়তা যুগিয়েছে। এ সব দেশের প্রজ্ঞাবান, একনিষ্ঠ ও অগ্রগতিমুখী বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশের সার্বিক স্বার্থে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কার্যকর সহায়তা প্রদান করেছে। সরকারের স্থিতিশীলতার কারণে অর্থনৈতিক নীতিমালা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দূরীভূত হয়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা উজ্জীবিত হয়েছে।
ভূমিসংস্কার এবং সম্পদবণ্টন
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর দখলদার শক্তি যুদ্ধ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত সামন্ত শক্তিকে বস্তুগত ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ধ্বংস করে দেবার লক্ষ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান ব্যাপক ভূমি সংস্কার করে। এ সুদূর প্রসারী সংস্কার কর্মসূচির ফলে এসব দেশে গ্রামীণ আয় বণ্টনের মাঝে ন্যায়পরতা এবং গ্রাম ও নগর জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। এ তিন দেশেই ভূমি সংস্কার এত ব্যাপক ছিল যে, সংস্কার-পূর্ব সমাজের নিয়ামক সামন্ত শক্তির ভিত ধসে পড়ে এবং সামন্ত শক্তির অধিপতি-প্রজা সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটে। ভূমি সংস্কারের ফলে জাপানে পরিবার প্রতি আবাদী জমির মালিকানা দাঁড়ায় ২.২৫ একর। গত ৩০ বছর যাবত আবাদী জমির পরিবার পিছু মালিকানা একই রকম রয়েছে। ১৯৮৫ সালের পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় যে, জাপানে কৃষি খামারের গড় আয়তন ২.৯ একর। মাত্র ৪% কৃষি খামারের ৭.৪১ একরের বেশি জমি রয়েছে। স্যাচস এর মতে ‘আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের ভূমি সংস্কার হয়েছে এসব দেশে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দখলে এবং তাইওয়ান জাতীয়তাবাদী শক্তির অধীনে থাকায় বিশেষ ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিরি কারণে এ সংস্কার সম্ভব হয়েছে। সামন্ত প্রভুগণ বর্ণিত পরিস্থিতির কারণে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ভ্যমি সংস্কার মূলত সমান্ত শ্রেণীকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়নি অথবা যেখানে প্রদান করা হয়েছে তা ছিল যৎসামান্য।
তিনটি দেশেই যুদ্ধের ফলে সম্পদের বিন্যাস এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে বন্ড ও নগদ টাকার বিপুল মূল্যহ্রাস ভূমি সংস্কারজনিত জমির পুনর্বণ্টন ফলাফলকে আরো তীব্রতর করে তোলে। ১৯৪৭ সালে জাপানে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৩৩৪%। ১৯৫০ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০০% এবং তাইওয়ানে ৩৪০০%। এসব সম্মিলিত কারণে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বিপুলভাবে হ্রাস পায় এবং বাজার অর্থনীতি ও সরকারি উদ্যোগের সমন্বয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পটভূমি তৈরি হয়। এ অবস্থার বিকাশ না ঘটলে উদারনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদ সম্ভবত আয় বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তুলত।
একটি ক্ষুদ্র বিত্তশালী জনপ্রিয়তাহীন সামন্তগোষ্ঠীর স্থলে একটি বড় আকারের কৃষক শ্রেণী গড়ে ওঠার ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য কৃষক শ্রেণীর পক্ষে চলে আসে। কৃষক শ্রেণীর নবলদ্ধ ও রাজনৈতিক শক্তির কারণে সমর্থনের প্রয়োজনে সরকারের নীতিও তাদের অনুকূলে চালিত হয়। তাছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য কৃষিকে সমর্থন দেয়া সরকারের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। ভূমি মালিকানা প্রাপ্তি ও গড়ে ওঠা অবকাঠামোর সুযোগ সুবিধা কৃষকদের কৃষিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে। কৃষি খামারের আয়তন ছোট বিধায় কৃষকরা উন্নত বীজ, অধিক পরিমাণ সার, উন্নত পদ্ধতির চাষাবাদ প্রভৃতি শ্রমনির্ভর পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ও আয় বাড়াতে সক্ষম হলো। অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মিটাল, সঞ্চয় বাড়াল এবং শিল্পদ্রব্যের বাজার সৃষ্টি করল।
লিবারেলিজম নব্য ধনীদের তাদের সঞ্চয় পাশ্চাত্য পুঁজি ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে পরিণত হতে সহায়তা করলো। এর ফলে অসংখ্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠল। কৃষি ও শিল্প ভারসাম্যমূলকভাবে বিকশিত হলো। যদি লিবারেলিজম না থাকত, তবে অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো এসব দেশের নব্য ধনীরা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিবর্তে ভোগের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিত এবং বিদেশে পুঁজি পাচারে লিপ্ত হতো।
সামাজিক সাম্য
ভূমি সংস্কার অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি বয়ে আনল, তার ফসল সমাজে সুসমভাবে ছড়িয়ে পড়ায় সামাজিক সাম্যের এক নতুন যুগ শুরু হলো। মিরডালের ভাষায়, ‘সামাজিক বৈষম্য সকল প্রকারেই উৎপাদনশীলতার শত্রু’। সামাজিক সাম্য অপ্রয়োজনীয় ভোগ বিলাসের মাত্রা হ্রাস করল। গরীব মানুষের হাতে সম্পদের সঞ্চালন এবং তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মান উন্নত করল। একটি স্বাস্থ্যবান ও শিক্ষিত জনশক্তি গতিশীল ও নির্ভরযোগ্য প্রবৃদ্ধির ভিত রচনা করল। গরীব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস তাদের ক্ষোভ ও হতাশা দূর করে কর্ম ও দক্ষতার উদ্দীপনা সৃষ্টি করল। ধর্মঘট ও সংঘাতজনিত অপচয় লোপ পেল। স্যাচস এর মতে, ল্যাটিন আমেরিকায় পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় অধিক আয় বৈষম্য এবং তজ্জনিত সামাজিক সংঘাতের কারণে তথাকার অর্থনৈতিক সাফল্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ব্রাজিলে ৫ম ধনীব্যক্তি ৫ম গরীবের চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি ধনী। অথচ তাইওয়ানে একই শ্রেণীর একজন ধনী ব্যক্তি অনুরূপ শ্রেণীর একজন দরিদ্র্য ব্যক্তি হতে মাত্র ৪গুণ ধনী। লাতিন আমেরিকায় গড়ে ২০% ধনাঢ্য ব্যক্তি ২১ গুণ বেশি ধনী যেখানে পূর্ব এশিয়ায় একজনের ধনাঢ্যতার মাত্রা মাত্র ৯ গুণ।
শ্রমনিবিড় পদ্ধতি
শ্রমনিবিড় প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এসব দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। ফলে বৈষম্য আরো হ্রাস পেয়ে ন্যায়পরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যে পথ অনুসরণ করেছে, তাইওয়ান তার চেয়ে একটু ভিন্ন পাথ অনুসরণ করেছে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের ভূমিকাকে তাইওয়ান সবিশেষ গুরুত্ব দেয়। ব্যবসা বাণিজ্যে বৃহৎ কোম্পানীগুলোকে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করতে দেয়নি। এ নীতির ফলে শ্রমনিবিড় উৎপাদন পদ্ধতি আরো বেশি প্রসার লাভ করে। বেকারত্ব ও অর্ধ-বেকারত্বের পরিধি আরে হ্রাস পায়। ক্ষুদ্র কৃষকগণ তাদের গ্রামীণ পটভূমিকায় আয় বৃদ্ধির সুযোগ লাভ করে। শিল্পোন্নত দেশের সার্বক্ষণিক মাথাব্যথা বেকার সমস্যার এদেশগুলোতে এভাবে সমাধান ঘটে। গামীণ কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি গ্রামীণ আয়ের বিপুল স্ফীতি ঘটায়। ১৯৮০ সালের পরিসংখ্যান হতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সর্বমোট আয়ের তিন চতুর্থাংশ অকৃষিজাত গ্রামীণ উৎস বলে দেখা যায়। এভাবে ১৯৫০ এর দশকের শ্রম-আধিক্যপূর্ণ তাইওয়ান ৭০ এর দশকে শ্রমিক সংকটের দেশে পরিণত হয় অর্থাৎ দেশটিতে পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জিত হয়। শহর ও গ্রামে পূর্ণ কর্মসংস্থানের ফলে সকল মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়। ফলে ভূমি সংস্কারের দ্বারা ইতঃপূর্বে যে আয়-ন্যায়পরতা অর্জিত হয়েছিল, সে পরিস্থিতি আরো উন্নতি লাভ করে। পঞ্চাশের দশকে তাইওয়ানে যে ‘গিনি-কোইফিসিয়েন্ট’ (Gini coefficient) এর মাত্রা ছিল ০.৫৬, তা ৮০ এর দশকের প্রথম দিকে ০.৩১ এ নেমে আসে। যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় তাইওয়ান অধিক আয়-ন্যায়পরতা অর্জন করে। দেশের ২০% ধনাঢ্য ব্যক্তি ও দরিদ্রতম ২০% জনগোষ্ঠীর আয়ের হারের পার্থক্য ১৯৫৩ সালের ২০.৫ থেকে ১৯৮০ সালে ৪.২ এ নেমে আসে। এ হার সম্ভবত উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ
এসব দেশের জনগণের সমরূপতা এবং মূল্যবোধ সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সমাজ গঠনে সহায়তা প্রদান করে। ব্যক্তির দায়িত্ববোধের উপর এ মূল্যবোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব, মালিক-শ্রমিকের মধ্যকার পারস্পরিক দায়্ত্ব, বন্ধু ও প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব। কেউ যদি এ দায়িত্বকে অবহেলা বা অস্বীকার করে, সমাজ তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। যে সমাজে দায়িত্বের অবস্থান এত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে সামষ্টিক শৃঙ্খলা অতি শক্তিশালী হয়, মালিক শ্রমিকের প্রতি মানবিক আচরণ করে ও তার কল্যাণের প্রতি খেয়াল রাখে। শ্রমিক সজাগভাবে পরিশ্রম করে এবং শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক হয় অতি ঘনিষ্ট। এ ধরনের যে সামাজিক মূল্যবোধ সামাজিক স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের উপর স্তান দেয়, তা নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির লিবারেলিজমে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যুদ্ধের পূর্বে এ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলো কেন সুপ্ত ছিল তা একটি বিষ্ময়কর প্রশ্ন বটে। উত্তর হচ্ছে, এ ধরনের মূল্যবোধ আচরিত হবার জন্য অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। এসব দেশে পরবর্তীতে এ ধরনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির অন্যতম কারণ হচ্ছে, যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ফল হিসেবে আর্থ-সামাজিক ন্যায়পরতার আবির্ভাব। চরম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যে ভরা দেশে ব্যক্তি ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের কোনো বালাই বা দায়ভার নেই। কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক সমাজে এ দায়ভার কেউ অস্বীকার করতে পারে না। পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধের এ সংস্কৃতির উন্মেষের আরো একটি কারণ হচ্ছে, সবাই জানত যে যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতীয় অর্থনীতির দাবি কী? এ উপলদ্ধির জাগরণ বিলাসিতা পরিহার এবং সহজ সরল জীবনযাপনের এক সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
ফলে এসব দেশে পরিমিত ভোগ-ব্যয় এবং উচ্চহারে সঞ্চয়ের সৃষ্টি হয়। ১৯৮৭ সালে জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, দিক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের জাতীয় সঞ্চয়ের হার ছিল যথাক্রমে আয়ের ৩৩.৪%, ৩০.৭%, ৩৯.৯%, ৩৭.০%। পক্ষান্তরে এ সময়ে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়া অঞ্চলে জাতীয় সঞ্চয়ের হার ছিল আয়ের ১৯.৮%, আফ্রিকার সাহার অঞ্চলে ১৩.০%, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ১৭.০% এবং দক্ষিণ এশিয়ার ১৯.৩%। সঞ্চয়ের এ উচ্চহার পুঁজি গঠন এবং পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদের জোগান দিলো। এসব দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যে সঞ্চয়ের এ উচ্চহারের অবদান কোনোভাবে খাটো করে দেখা যায় না। উচ্চহারের কারণে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি বা বিদেশী ঋণ গ্রহণ ছাড়াই সরকারি ও বেসরকারি খাত তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রমে অর্থ যোগান দিতে পেরেছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল বিধায় বাজারে এ দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বিদেশী ঋণের সুদের ভারে এ দেশগুলো জর্জরিত হলো না এবং দেশীয় চাহিদা পূরণ রপ্তানিমুখী অগ্রগামী এক অর্থনীতির শক্ত ভিত গড়ে উঠল।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি উন্নয়ন
সামাজিক মূল্যবোধগুলো এসব দেশে জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধির সাথে সাথে অপ্রয়োজনীয় আমদানি হ্রাসে সহায়তা করল। পক্ষান্তরে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় এ সঞ্চয় যোগাড় করা হলো উচ্চ আমদানি শুল্ক ও কঠোর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। যার ফলে সৃষ্টি হলো চোরাচালান, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং দুর্নীতি। এসব দেশের মানুষের প্রাত্যতিক প্রয়োজন পূরণে ভোগ ব্যয়ে সংযম ও কৃচ্ছ্রতাসাধন কোনোটাই জোর করে করা হয়নি; বরং সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা তা উজ্জীবিত ছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণের উপর কঠোর কোনো বিধিবিধান না থাকা সত্ত্বেও এসব দেশ আমদানিমুখী না হয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণের স্পৃহার দিকে উদ্বুদ্ধ ও তাড়িত হয়েছিল। জাপানের বিষয়ে লেস্টার থুরোর পর্যবেক্ষণ এখানে প্রণিধানযোগ্য, ‘জাপানে শিল্পফার্মগুলো তাদের নিকটতম সরবরাহকারীরে সাথে শিল্প যন্ত্রাংশের যখন যা প্রয়োজন, তখন তা সঠিক ও সুনির্দিষ্টবাবে সরবরাহের বিষয়ে এমন দীর্ঘকালীন নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখে যে, নতুন কোনো বিদেশী ফার্মের জাপানী বাজারে প্রবেশের কোনো সুযোগই ছিল না’।
তবে এসব দেশের বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকাকে অত্যধিক ফলাও করে তুলে ধরা হয়েছে। বস্তুত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি জাপানে একটি নতুন বিষয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জাপান ছিল একটি বাণিজ্য ঘাটতির দেশ। দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়েই জাপানী কোম্পানীগুলো প্রথমত সফলতা অর্জন করে। অপরদিকে কোম্পানীর আয়তন বৃদ্ধির ফলে তুলনামূলক যে উৎপাদন খরচ কমে আসে, সে সুযোগ গ্রহণ করে জাপান রপ্তানি বাজারে প্রবেশে করে। অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদাই শেষতক রপ্তানিমুখীতা সৃষ্টিতে সফলতা এনে দিয়েছে। উল্টোভাবে নয় অর্থাৎ প্রথমেই রপ্তানির দ্বারা জাপান সাফল্যের মুখ দেখেনি। কোরিয়া, তাইওয়ান ও আরো অনেক দেশ যারা রপ্তানি ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে, তারা সবাই প্রথম পর্যায়ে আমদানি প্রতস্থাপনের পথ অনুসরণ করেছে। এসব দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে দেশীয় শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারা আমদানি প্রতিস্থাপন থেকে রপ্তানি উন্নয়নের দিকে মোড় নেয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথম দিকে উপার্জিত সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার সবটুকু বিদেশী প্রযুক্তি ও যন্তপাতি ক্রয়ে। ব্যয় হতো। অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর আমদানি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হয়।
শিল্পায়নের জন্য সংরক্ষণবাদী নীতির প্রয়োজন নেই মর্মে সম্প্রতি যে মতামত ব্যক্ত করা হচ্ছে তা তথ্য নির্ভর নয়। জার্মান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপান পর্যন্ত সকল ঐতিহাসিক উদাহরণ হতে দেখা যায় যে, এসব দেশে সংরক্ষণবাদী শিল্পনীতির মাধ্যমেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। এমনকি এখনো এসব দেশসমূহ শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংরক্ষণবাদী নীতি প্রয়োগ করছে, যা উন্নত দেশগুলো করেনি এবং এখনো করছে না, তা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে করতে বলা অবাস্তব পরামর্শ মাত্র।
নিম্নমাত্রার প্রতিরক্ষা ব্যয়
জাপানী পাবলিক ফিন্যান্সের তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বল্পমাত্রার প্রতিরক্ষা ব্যয়। জাতীয় আয়ের ১% এরও কম প্রতিরক্ষা ব্যয় হচ্ছে জাতীয় আয়ের ৪% এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জাতীয় আয়ের ৩%। সামরিক খাতে স্বল্প ব্যয়ের কারণে জাপানে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থনৈতিক সম্পদ অবমুক্তি লাভ করে। ফলে সরকারি ব্যয় নিম্ন পর্যায়ে রাখা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়। তাছাড়া অন্যান্য দেশের তুলনায় করহার নিচু পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়। ১৯৭৫ সালে জাপানে সর্বমোট করের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের ২১% এবং ১৯৮৮ সালে ৩১.৩%। পক্ষান্তরে এ সময়কালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে করের মাত্রা ছিল জাতীয় আয়ের ৩.৩% এবং ৪০.৮%। জাপানের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানে প্রতিরক্ষা খাতে তুলনামূলকভাবে অধিক অর্থ বরাদ্দ হলেও বাজেটের এ বাড়তি বোঝা বৈদেশিক সাহায্য, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রাপ্ত, দ্বারা লাঘব হয়।
ভবিষ্যতের ছবি
সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, এসব দেশের দ্রুত অর্থনেতিক উন্নয়ন বিশেষত প্রবৃদ্ধি ও ন্যায়পরতার লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পশ্চাতে অনেকগুলো কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করেছে। তবে এ সমস্ত কারণগুলোর সূতিকাগার হিসেবে একমাত্র উদারনীতিবাদকে কৃতিত্ব দেয়া সঠিক হবে না। এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এ সমস্ত দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে যে ন্যায়পরতা অর্জন করতে পেয়েছে, তা ভবিষ্যতেও ধরে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা। কতিপয় কারণে এসব দেশে আয়-ন্যায্যতা ভারসাম্য সম্প্রতি যেভাবে হ্রাস পেয়েছে তাতে নেতিবাচক উত্তরই পাওয়া যায়।
দক্ষিণ কোরিয়া শিল্প খাতে বৃহদায়তন পরিবার পরিচালিত বিশালাকৃতির কোম্পানী বা কনগ্লোমাটে্স এর পথ ধরেছে। সরকারি সহায়তা ও ব্যাংক ব্যবস্থা হতে ঋণের মাধ্যমে কোরিয়ান কনগ্লোমারেটসমূহ উত্তরোত্তর বৃহদাকৃতি ধারণ করেছে। ১৯৮৪ সালের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, জাতীয় আয়ের ৬৪% এবং রপ্তানির ৭০% নিয়ন্ত্রণ করছে বৃহৎ ১০টি কনগ্লোমারেট। কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শ্রমঘন উৎপাদন পদ্ধতি গ্রামীণ এলাকায় নয়, শুধু শহরাঞ্চলেই লভ্য। ফলে গ্রামাঞ্চল হতে শহরাঞ্চলে বিপুল মানুষের অভিবাসন ঘটেছে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। দক্ষিণ কোরিয়ায় দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ সিউল, পুসান, টায়ীগু এবং ইনচোন নামক চারটি বৃহৎ শহরে ঠাসাঠাসি করে বাস করছে। ফলে শহর কেন্দ্রগুলোর গৃহায়ন ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ সুবিধার উপর সৃষ্টি হয়েছে প্রচণ্ড চাপ। গ্রাম থেকে ছুটে আসা মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ। দক্ষিণ কোরিয়ায় বৃহৎ শিল্প পরিবারের উত্থান আয় বৈষম্যকে তীব্রতর করে তুলছে। ১৯৬৫ সালে নিচের দিকের ৪০% মানুষের আয়ের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের ১৯.৩%, যা ১৯৮৭ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.৯% এ। একই সময় ব্যবধানে উপর দিকের ২০% মানুষের আয় ৪১.৮% হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫.৩% এ দাঁড়িয়েছে।
অন্যান্য উন্নয়নশীর দেশের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় আয়-বণ্টন অনেক বেশি ন্যায়পরতাপূর্ণ হলেও শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে কনগ্লোমারেট পদ্ধতিকে বেছে নেয়ার কারণে আয় বৈষম্য, বিলাস ব্যয় এবং শ্রমিক সংঘাতের বীজ রোপিত হয়েছে। ১৯৮১-৮৫ সময়কালে প্রতি বছর ধর্মঘট হয়েছে গড়ে ১০০টি। ১৯৮৬ সালে ধর্মঘটের সংখ্যা ২৭৬টি। ১৯৮৭ সালে ধর্মঘট সীমা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০৮টিতে। এত প্রমাণিত হয়, ভূমি সংস্কার ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ দ্বারা অর্জিত আর্থ-সামাজিক ন্যায্যতার মাধ্যমে যে সুষম শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তা শহরাঞ্চলে আগত শ্রমিকদের দুর্দশা ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের দ্বারা ভগ্নদশা লাভ করেছে। “সামাজিক সম্পর্কের উপর প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, তার দিকে লক্ষ্য না করে কোরিয়া তিন দশক যাবত কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথেই ধাবিত হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির এখন পরিবর্তন ঘটেছে”। পারভেজ হাসান যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘পশ্চাৎপদ গ্রামীণ অর্থনীতি ও শহরাঞ্চলের দিকে মানুষের অত্যধিক অভিবাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা গ্রামীণ ও নগর উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জাপানের ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্যের একটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাইবাৎসু নামধারী বৃহৎ শিল্প পরিবারগুলোর বিলুপ্ত ও ভুমি সংস্কার সমাজে অর্থনৈতিক শক্তিকে যেভাবে সুষমভাবে বণ্টন করে দিয়েছিল, তাতে মুষ্টিমেয় পরিবারের পক্ষে আর দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করা সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকৃতির অসংখ্য শিল্প ইউনিট গড়ে উঠল এবং তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সৃষ্টি হলো। উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাপানের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে ওঠা সম্ভব হলো। কিন্তু চল্লিশ দশকের শেষের দিকে Elimination of Excessive Concentration of Economic Power Law- এর কার্যকারিতা প্রায় লোপ পায় এবং পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে এ আইন বাতিল করা হয়। ফলশ্রুতিতে মিতসুবিসি, মিতসুই, সুমিতোমা নামে প্রাক্তন জাইবাৎসু পরিবারগুলোর পূর্বতন অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে পুরাবির্ভাব ঘটে। যদিও এ কোম্পানীগুলোর গঠন প্রণালী জাইবাৎসু সময়কাল হতে ভিন্ন; তবু তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করছে। ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চয়কারী জাইবাৎসু ব্যাংকসমূহ এ কোম্পানীগুলোর ধাত্রী হিসেবে কাজ করল। অর্থনীতির উপর এদের ব্যাপক প্রভাব ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত থাকবে। জাপানে ক্ষদ্র ব্যবসা বাণিজ্যের বিপুল প্রসার ঘটলেও মোট বিক্রয়ে তাদের হিস্যা কমে এসেছে। এসব ব্যবসা-ফার্মের অধিকাংশের নিজস্ব মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা নেই। ব্যাংকিং ব্যবসা ছাড়া বড় বড় ব্যবসায়ী ফার্মের আনুকূল্যের বর্তমান বর্তমান ব্যবস্থাপনা কিছু হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ ঘটাচ্ছে। সম্পদের কুক্ষিগতকরণ জাইবাৎসু সময়ের সমমাত্রার না হলেও এর প্রবণতা সেদিকেই যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বড় বড় বিত্তশালীদের অবলুপ্তির মাত্র চার দশকের মধ্যে বর্তমানে বিশ্বের প্রথম দশজন ধনী ব্যক্তির মধ্যে ছয় জন জাপানের। এ রকম বিশাল ধনশালী ব্যক্তিদের পক্ষে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ফেলাই স্বাভাবিক। জাপানে ‘এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড এ্যাক্ট’ সামন্ততন্ত্রের পুনরুজ্জীবনকে এবং ‘লার্জ স্কেল রিটেইল স্টোর ল’ খুচরা ব্যবসা সেক্টরে বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থার অনুপ্রবেশকে রুদ্ধ করেছিল। জাপানের চলমান উদারনীতিকরণ নীতির ফলে, বিশেষত যদি উপযুক্ত এ্যাক্ট দু’টি বাতিল বা তাদের কার্যকারিতা হ্রাস করা হয় তবে, সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ আরো বৃদ্ধি পাবে।
এসব দেশের সঞ্চয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন শেয়ার বাজার ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে। শেয়ার ও জমির মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ বাড়ছে। ১৯৫০ সালে ‘নিক্কেই ইনডেক্স’ ছিল ১০২, যা বেড়ে ১৯৬০ সালে। ১,১১৭; ১৯৭০ সালে ২,১৯৩; ১৯৮০ সালে ৬,৮৭০ এবং ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে ধ্বসের পূর্বে ২৬,৬৪৬। অন্যান্য বড় ষ্টক মার্কেটের তুলনায় জাপানে অবশ্যই দ্রুত বাজার দর ফিরে আসে এবং ডিসেম্বর, ১৯৮৯ সালে ইনডেক্স ৩৮,৯১৬ তে এসে দাঁড়ায়। জাপানে প্রতি চার বছর অন্তর শেয়ার দর দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ হার ১৯৭০ সালে ছিল ১০.৭, যা বেড়ে ১৯৮০ সালে হয়েছে ১৯.১ এবং ১৯৮৮ সালে ৬১.৪। জুলাই ১৯৮৯ সালে এ হার মূলত সুদের হার বৃদ্ধির জন্য ৫০.৪ এ নেমে আসে। জুলাই, ১৯৮৯-এ কতিপয় বৃহৎ দেশের স্টকের তুলনামূলক মূল্য ও আয়ের হার ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ১৩.৩; যুক্তরাজ্যে ১১.৭; পশ্চিম জার্মানীতে ১৫.৭ এবং ফ্রান্সে ১২.৪। জাপানী স্টকের মূল্য ও আয়ের অতি উচ্চহারের মধ্যে সংকটের বীজ লুকায়িত আছে, যা যে কোনো সময়, শুধু জাপানী অর্থনীতিতে নয় বরং বিশ্ব মুদ্রাবাজার ব্যবস্থায় অশনি সংকেত ডেকে আনতে পারে।
জাপানে জমির মূল্য তীব্রভাবে বেড়েছে। ছয়টি বড় শহরে বাণিজ্য, বসতি বা শিল্প স্থাপনে ব্যবহারের জন্য জমির গড় দাম প্রতি চার বছরে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প, বাণিজ্য বা বসতবাড়ি সম্পত্তি জাপানে এত বেশি ব্যয়সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে চলে গেছে। একদিন তাদের বসতবাড়ি বা ব্যবসা বাণিজ্য হবে, সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে। অফিস ও জায়গাজমির উর্ধমূল্যের দরুণ দ্রব্যসামগ্রীর দামও বেড়ে গেছে। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় হ্র্রাস পেয়েছে। জাপান বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ। প্রকৃত প্রস্তাবে ইয়েনের অভ্যন্তরীণ ক্রয় ক্ষমতা তার বৈদেশিক বিনিময় হারের চেয়ে কম।
শেয়ার ও সম্পত্তির ফটকাবাজার তাতে থেমে নেই। যাদের অতিরিক্ত জামানত দেবার সামর্থ্য আছে, তারা ব্যাংক হতে ফটকাবাজারে বিনিয়োগের জন্য প্রচুর ঋণ পাচ্ছে। এ ফটকাবাজার বিস্ফোরণ সম্পদের বৈষম্য বাড়িয়ে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। এখানকার নব্য ধনীদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন ধরনের। তারা ভোগবিলাসে অজস্র খরচ করে সামাজিক বৈষম্যকে আরো দৃশ্যমান ও তীক্ষ্ম করার মাধ্যমে সামাজিক সেই সংযোগ সূত্রকে শিথিল করে দেয়, যা সামাজিক সংহতিকে জোরদার করে রেখেছিল। একই ফটকাবাজার বিস্ফোরণ দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানেও আর্থ-সামাজিক ন্যায়পরতার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে।
তাই দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসব দেশ ন্যায়পরতার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হলেও পুঁজিবাদী অর্থ কাঠামোর মধ্যে থেকে আর্থ-সামাজিক ইনসাফকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব হলেও সমগ্র অর্থনীতিকে ন্যায়পরতার লক্ষ্যে পুনর্গঠন না করা হলে আয় ও সম্পদ বৈষম্য আবার সমাজে জেগে উঠবেই। অর্থনীতির বিশেষ করে অর্থব্যবস্থার এরূপ পুনর্গঠন কিভাবে করা যায় তা পরবর্তী ৮-১০ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।
হারানো সূত্র
দূরপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ন্যায়পরতা পাশাপাশি অর্জন করতে সমর্থ হলেও এর পশ্চাতে উদারনীতিবাদের ভূমিকাকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা ভুল হবে। এমনকি নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণও স্বীকার করেন যে, বাজার অর্থনীতির উপর জোর প্রদানের অর্থ এ নয় যে, বাজার ব্যবস্থার যে কোনো ফলাফলকে সরকার মেনে নেবে; বরং এটাই কাম্য যে, সরকার বাজার মূল্য ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য চেষ্টা চালাবে। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, নিওক্লাসিক্যাল উদারনীতিবাদের প্রয়োগের পাশাপাশি বাজার ও মূল্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ন্যায়পরতার লক্ষ্যকে ধরে রাখা যায়নি।
দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিরাজিত অধিকতর ন্যায়পরতার কারণ উদার নীতিবাদ নয়। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশেষ অবস্থা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও সরকারি নীতি এর কারণ। স্বাভাবিক শান্তিকালীন সময়ে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে ন্যায়পরতা সৃষ্টিকারী অবস্থাসমূহের পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব নয়। ন্যায়পরতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল উদ্ভাবন ব্যতিরেকে শুধুমাত্র নিওক্লাসিক্যাল উদারনীতিবাদের প্রয়োগে আয় বৈষম্যের অবনতি সৃষ্টি করবে। এমনকি যদি অন্যান্য দেশে অনুরূপ সঞ্চয়ধর্মী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিরাজও করে, তবু বর্তমান পাশ্চাত্য ভোগবাদী সভ্যতার আগ্রাসন, ক্রমবর্ধমান নৈতিক অবক্ষয় ও বিপুল আর্থ- সামাজিক বৈষম্য তার কার্যকারিতাকে ভোঁতা করে দিয়েছে। এসব দেশের আজকের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে কিভাবে সামাজিক আয়ের ক্ষেত্রে ন্যায়পরতা অর্জন ও বজায় রাখা যায়।
আয়ের ক্ষেত্রে ন্যায়পরতাকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা সত্ত্বেও এসব দেশ তা অর্জনের কার্যকর কৌশল উদ্ভাবনে ব্যর্থ হয়েছে। পঁচিশ বছরে উন্নয়ন পরিক্রমাকে অধ্যয়ন করে মোরওয়েটজ মন্তব্য করেছেন, ‘কিভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায় এবং এ জন্য কি নীতি অনুসরণ করতে হবে এ বিষয়ে প্রচুর ও অনায়াসলদ্ধ অর্থনৈতিক আলোচনা সমৃদ্ধ লেখা রয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের ফসলকে কিভাবে জনগণের মাঝে সুষমভাবে বণ্টন করতে হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনামূলক কোনো আলোচনা দেখা যায় না’। যদিও এক দশকেরও আগে এ মন্তব্য করা হয়েছে, তবু আজকের জন্যও একথা সত্য। বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য মূলত প্রবৃদ্ধির উপরই নির্ভর করা হচ্ছে। ফিল্ডস যথার্থভাবে বলেছেন, ‘দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধারণভাবে দারিদ্র্য হ্রাস করলেও দারিদ্র্য নিরসনের জন্য প্রবৃদ্ধি অর্জন যথেষ্ট নয়… অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে বৈষম্য হ্রাস পাবে কী বৃদ্ধি পাবে, তা মাথাপিছু গড় আয়ের বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে না, বরং তা নির্ভর করে কী ধরনের উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে তার উপর। বৈষম্য হ্রাসের জন্য কার্যকর কর্মসূচি প্রদানের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে সাম্যের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ আসলে ফ্যাশন নির্ভর সমাজের আরেকটি ফ্যাশন মাত্র। এ অনুভূতিটি আরো তীব্রতার হয়, যখন দেখা যায় নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের একটি বিরাট অংশ ন্যায়পরতা অর্জনকে নীতিমালার মূল লক্ষ্য হিসেবে ধার্য না করে তাকে অনুসৃত নীতির পরোক্ষ লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে। ন্যায়পরতা অর্জনের উপর পর্যাপ্ত আলোচনার অভাব বস্তুত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের এ বিষয়ের আলোচনার প্রতি অনীহার ফসল মাত্র। ন্যায়পরতা অর্জনের জন্য কার্যকর কৌশল দাবি করে সামাজিক উদ্দীপনার জাগরণ, সামাজিক মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে থেকে তা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে ন্যায়পরতা অর্জনের উপযুক্ত পন্থা যদি কেউ বাতলেও দেয় তবুও অন্যরা গ্রহণ করবে কেন? মিয়ারের ভাষায় উন্নয়ন অর্থনীতির সবচেয়ে অসমৃদ্ধ অংশ হচ্ছে, কিভাবে যথাযথ নীতিমালার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে হবে তার দিকনির্দেশ করতে না পারা। পন্থা বাতলানো সহজ হলেও তার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি ও বাস্তবায়ন সত্যি কঠিন। এর কারণ বলতে যেয়ে মিয়ার বলেছেন, ‘এমন একটি নীতিমালা বা কর্মসূচি পাওয়া দুষ্কর যাতে সবাই লাভবান হয়। যে কোনো কর্মসূচি হতে কেউ লাভবান হবে আর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক’। তাই এমন একটি কর্মপদ্ধতি নিরূপণ করা প্রয়োজন, যা কোনো কর্মসূচির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদেরও সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে। নিওক্লাসিক্যাল অর্থনীতি এখানে ব্যর্থ হয়েছে। এ মতবাদ প্রদত্ত কর্মসূচি কার্যকর হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত তা ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের অনুকূলে থেকেছে। ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের জন্য ধাবিত হবে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে সুষম বণ্টন আনয়ন করা যায় না। এ ধরনের অর্থনৈতিক আচরণ বস্তুত বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়। সুষম বণ্টন দাবি করে সামাজিক স্বার্থে নিছক ব্যক্তিস্বার্থের কিছু ছাড় দেবার স্পৃহা। নিওক্লাসিক্যাল মডেলে সামাজিক স্বার্থসিদ্ধি ততদূর পর্যন্ত হবে, তা ব্যক্তিস্বার্থের সাথে সংঘাতপূর্ণ না হয়। মূল্যবোধ নিরপেক্ষ উদারনীতিবাদ আত্মত্যাগ স্বীকার করে, সামাজিক স্বার্থরক্ষার কোনো তাগিদ সৃষ্টি করে না। বিশ্ব ব্যাংকের রির্পোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের মানুষের আয় যদি সুষমভাবে বণ্টন করা হতো, তবে বর্তমান খাদ্যশস্যের পরিমাণ দ্বারাই প্রত্যেক নারী, পুরুষ ও শিশুকে প্রতিদিন ৩০০০ ক্যালরি এবং ৬৫ গ্রাম দেখা গেছে ১৯৬৫ সালে মাথাপিছু যে ক্যালরি ছিল তার তুলনায় ১৯৮৫ সালে মাথাপিছু ক্যালরি অনেক কম।
মানুষের অভাব রয়েছে এর কারণ এ নয় যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে হয়নি; বরং এটাই যে, তার সুষম বণ্টন সৃষ্টি করতে পারেনি। যদি এ মডেলের তা করার সামর্থ্য থাকত,তবে যেসব অধিক সম্পদ ও সমৃদ্ধিশালী উন্নত দেশসমূহে এ মডেলের প্রয়োগ হয়েছে, সেসব দেশে সম্পদের সুষম বণ্টন অর্জিত হতো। তাহলে এসব দেশের উন্নয়ন কমিটিসমূহকে এ কথা স্বীকার করতে হতো না যে, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণে সমস্যাটির নিরসন প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে’। নিওক্লাসিক্যাল মডেলের ন্যায়পরতা অর্জনের ব্যর্থতাই সমাজতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রও অধিকাংশ দেশেই ন্যায়পরতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজতন্ত্রের অধিকতর ব্যর্থতা হচ্ছে, অধিকাংশ দেশে সমাজতন্ত্র উৎপাদন দক্ষতাও অর্জন করতে পারেনি। আয় ন্যায়পরতার লক্ষ্য অর্জন যেহেতু উন্নয়নশীল দেশের জরুরি আর্থ-সামাজিক ম্যান্ডেট, তাই যে নিওক্লাসিক্যাল মডেল অতীতে এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তার পুনরুজ্জীবন দ্বারা নতুন কিছু আশা করা যায় না।
নিওক্লাসিক্যাল মডেলের দিকে পুনরায় ফিরে গেলে উন্নয়নশীল দেশেসমূহে যে আয়-বৈষম্য বিরাজমান, সে অবস্থার কোনো উন্নতি সাধিত হবে না। বরং সংকট ও অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্রতা লাভ করেছে। রাজনৈতিক অসন্তোষ ও সংকট এমন আকার নিতে পারে যাতে উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে এক ক্রুদ্ধ স্রোতধারা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, উদারনীতিবাদ বিরোধী এ স্রোতধারা উন্নয়নশীল দেশসমূহে ন্যায়পরতার লক্ষ্য অর্জনে কী সফল হবে, যখন ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উন্নয়নশীল ও সমাজতান্ত্রিক উভয় শিবিরেই উদারনীতি বিরোধী মতবাদ ন্যায়পরতার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই দুটি মতবাদের মাঝে ফুটবলের মতো ছোটাছুটি করার পরিবর্তে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে নিজের আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনের আলোকে নিজস্ব উন্নয়ন কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে।