চতুর্থ অধ্যায়। রাজকাহিনি
১৯
একটা সংক্ষিপ্ত নোটিস দিয়ে ব্রিটিশ সরকার হস্তিনাপুরকে নিজের অধীনে নিয়ে এল। এটা এতই আকস্মিক যে সবাই চমকে উঠল। প্রথাগত ভাবে ব্যাপারটা হয়নি, একবারও কোনও কাগজের সম্পাদকীয়তে বেরোয়নি যে হস্তিনাপুরের আচরণে ইংরেজ সরকার অসন্তুষ্ট হয়েছেন। সরকারি কাগজপত্র বা নির্দেশিকাগুলিতেও এর কোনও আভাস পাওয়া যায়নি। স্টেটস ডিপার্টমেন্টের পদস্থ কর্মচারী, বিদুরের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়েনি। কোথায় গেল ইংরেজদের সেই ভদ্রতা? জুতো মেরে গরু দানের জন্য যারা বিখ্যাত, তাদের এ কী আচরণ? হস্তিনাপুর তার জয় পতাকা, তার রাজকীয় চিহ্ন আর তার এগারো কামান দাগানো স্যালুট থেকে হঠাৎই একদিন ইংরেজ সরকারের অধীনে চলে গেল। মারোয়ার প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত করে দেওয়া হল হস্তিনাপুরকে। নিজস্ব পতাকার জায়গায় এবার উঠল ইউনিয়ন জ্যাক, কামান গেল স্তব্ধ হয়ে। সীমানায় যে জয়স্তম্ভ ছিল, তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল।
স্যার রিচার্ডের এতদিনে পদোন্নতি হয়েছে। হস্তিনাপুরের প্রাক্তন রেসিডেন্ট এখন ভাইসরয়ের বিশেষ প্রতিনিধি। তাঁর কাজ হল ব্রিটিশ রাজত্বের সীমানা বাড়ানো। মারোয়ারের গভর্নর অবসর নিলেই তিনি সে পদে আসীন হবেন। অনেকদিন পরে ডিম দিয়ে ভরপেট প্রাতঃরাশ সারার পর খুব খুশি দেখাচ্ছিল তাঁকে। সবে দামি ন্যাপকিনে মুখ মুছছেন, এই সময়ে হিসলপ ঝড়ের মতো ঢুকল।
‘এসো, এসো। চা খাও।’ স্যার রিচার্ড আনন্দের আতিশয্যে একটু জোরেই বলে উঠলেন।
‘না, ধন্যবাদ স্যার। দুঃখিত, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু মনে হচ্ছে, গন্ডগোল বাধবার উপক্রম হয়েছে।’
‘কী বলছ? বোসো, বোসো।’ চায়ের পটের দিকে হাত বাড়ালেন স্যার রিচার্ড। তাঁর গোলাপি কপালে ভাঁজ পড়েছে, ‘একটু চা খাবে না?’
‘হস্তিনাপুরের মানুষ খেপে উঠেছে, স্যার। তারা তাদের স্বাধীনতায় আমাদের হস্তক্ষেপ-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। সকালে রেডিওতে এই খবর শুনেই তারা দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক বসিয়ে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। দোকানপাট বন্ধ, বাচ্চারা স্কুলে যায়নি। তাদের বাবা-মায়েরা কাজে যায়নি। শহরের অবস্থা থমথমে।’
স্যার রিচার্ড চায়ে চুমুক দিলেন। কিন্তু তাঁর স্নায়ুর চাপ বোঝা যাচ্ছিল তাঁর থুঁতনির কম্পন দেখে, ‘কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে?’
‘ছোটখাটো কিছু ঘটনা। ইট পাটকেল ছুড়ে কয়েকটা ইংরেজদের ব্যবসায়ীসংস্থার জানলার কাচ ভেঙে দিয়েছে কিছু লোক। হস্তিনাপুরে ইংরেজদের নিজস্ব স্মৃতিসৌধ বা সরকারি সংস্থা তো নেই, যে সেগুলোর ওপর লোকে চড়াও হবে! পাহাড়ের ওপর ব্রিটিশ রেসিডেন্সির দিকে কিছু লোক মিছিল করে যাচ্ছিল। কিন্তু রাস্তার মাঝখানে পুলিশ তাদের আটকেছে।’ তারপর একটু ইতস্তত করে হিসলপ বলল, ‘আমার গাড়িতেও চড়াও হয়েছিল স্যার, ইঁট মেরে আমার গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে দিয়েছে। আমি যখন ভিড় ঠেলে আসছিলাম।’
‘সে কী! তুমি অক্ষত তো?’
‘একটা আঁচড়ও লাগেনি স্যার!’ হিসলপ বুঝতে পারছিল না খুশি হবে না, দুঃখ পাবে, ‘ড্রাইভারটি কিন্তু আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে দিতে হবে।’
‘তাই করো হিসলপ। দেরি কোরো না।’
‘আরও একটা ব্যাপার আছে স্যার। লোকের মুখে শুনলাম, হস্তিনাপুরের প্রাক্তন প্রধান গঙ্গা দত্ত এই অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বিবিগড় বাগে বক্তৃতা দেবেন। শয়ে শয়ে লোক তাঁর ভাষণ শুনবে বলে সেখানে জড়ো হচ্ছে।’
‘গঙ্গা দত্ত? বিবিগড়ে? তুমি ঠিক জানো?’
‘কোনও ভুল নেই স্যার!’
স্যার রিচার্ড এবার বিচলিত হলেন, ‘যে করে হোক ওকে থামাতে হবে হিসলপ।’
‘হ্যাঁ স্যার। সেই জন্যেই আপনাকে খবর দিতে ছুটে এলাম। আমরা হয়তো বিবিগড়ে পৌঁছোবার রাস্তাগুলো বন্ধ করবার আর সময় পাব না। পুলিশ এসব ক্ষেত্রে খুব একটা কাজে আসে না। আমার এইসব সময়ে ওদের সন্দেহজনক মনে হয়।’
‘তুমি কী করতে বলো?’
‘আমার মনে হয় এই জমায়েত আর সভা বন্ধ করতে গেলে আমাদেরই লোকসান হবে।’
‘তাহলে?’
‘আমাদের একটা কৌশল করা উচিত। ওরা র্যালি করুক। নিজেদের ক্ষোভ মেটাক।’
‘তার মানে কিছু করব না?’
‘আমার তো তাই মত। নিজেদের স্লোগান দিক, গরম বক্তৃতা শুনুক। তারপর দেখবেন যে যার নিজেদের কাজে ফিরে যাবে।’
‘বাজে বোকো না। ওরা ওই সব বক্তৃতা শুনে রক্ত গরম করে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাবে। এমনকী রেসিডেন্সি জ্বালিয়েও দিতে পারে। এই মিটিং বন্ধ করতে হবে। তবে তুমি ঠিক-ই বলেছ। পুলিশ এটা করতে পারবে না।’
‘তাই তো বলছিলাম স্যার। আমাদের কোন কিছু করার নেই।’
‘হ্যাঁ আছে।’ স্যার রিচার্ড মরিয়া, ‘যে কাজ পুলিশ পারে না সে কাজ সেনাবাহিনী পারে। কর্নেল রুডিয়ার্ডকে খবর দাও।’
২০
বিবিগড় বাগ দারুণ সুন্দর কোনও বাগান না হলেও হস্তিনাপুরের এটাই ছিল একমাত্র পার্ক, যেখানে জনসাধারণ অবাধে প্রবেশ করতে পারত। অনেক ছোট ছোট বাগান মিলিয়ে বিবিগড় বাগ। কোথাও পাঁচিল আর কোথাও কেয়ারি করা ছোট ছোট বেড়া দিয়ে এগুলি বিভক্ত ছিল। এক-একটা বাগান এক-একরকম ভাবে সাজানো। কোথাও সাজানো জলাশয়, কোথাও আবার ফোয়ারা ঘেরা গোলাপ বাগান, কোনওটাতে বাচ্চাদের খেলার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে।
একটা বাগান আবার শুধু মহিলাদের জন্য—সেখানে পর্দানসীন এবং অন্য মহিলারাও ঘোড়ায় চড়তে পারেন বা শুধু বসে গল্পগুজব করতে পারেন। পুরুষদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। এই অংশের বেড়া বেশ উঁচু আর ঘন যাতে মহিলারা নিরাপদে বিনোদনে মন দিতে পারেন। এইসব ছোট ছোট বাগানকে গেট দিয়ে যোগ করা ছিল। সেগুলো দিয়ে অনায়াসেই আয়ারা বাচ্চাদের প্র্যামে বসিয়ে ঢোকা বেরোনো করতে পারত। কিন্তু সেদিনের মিটিং-এর জন্য এ ব্যবস্থা অপরিসর ছিল।
এর মধ্যে একটা বাগান ছিল, যেটা অন্যদের তুলনায় একটু বড়। তার চারিদিকে উঁচু ইটের দেওয়াল। বেশিরভাগ সময়ে ছেলেরা এখানে ক্রিকেট খেলে। কখনও এখানে থিয়েটার বা ছোটখাটো মিটিং-ও হয়ে থাকে। হস্তিনাপুরের ছোটখাটো জনসভা এখানেই হয়ে থাকে। ময়দান এতই বিশাল যে তা সহজে ভরানো যেত না। হস্তিনাপুরে যত যাত্রা, নাটক, কবি সম্মেলন সব এই বিবিগড়েই হত।
লোকে কেমন করে যেন ধরে নিল, গঙ্গাজি এখানেই তাঁর বক্তৃতা দেবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজারে হাজারে মানুষ পৌঁছে গেল সেখানে। বিবিগড়ে আর তিলধারণের জায়গা রইল না। ঠাসাঠাসি চাপাচাপি করে মানুষ অপেক্ষা করে রইল গঙ্গাজির আবির্ভাবের।
কর্নেল রুডিয়ার্ড নিষ্পৃহ হয়ে বিবিগড়ে পৌঁছোলেন। খুব বেশিক্ষণ লাগল না তাঁর ব্যাপারটা বুঝতে। বাবা-মা-ভাই-বোন-ছেলে-বউ-বুড়ো-বাচ্চা—সবাই মিলে সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তাদের প্রিয় নেতার জন্য। সবার চোখেমুখে আগ্রহ, সবাই আলোচনা করছে। কেউ অশান্ত নয়। রুডিয়ার্ড মুহূর্তের মধ্যে তাঁর পরিকল্পনা ছকে ফেলে তাঁর বাহিনীকে দেওয়ালের চারদিক ঘিরে দাঁড়াতে বললেন।
হতে পারে, রুডিয়ার্ডকে অর্ডার দেওয়ার সময় তাকে ঠিক কী করতে হবে বলে দেওয়া হয়নি। এ-ও হতে পারে যে রুডিয়ার্ড ভেবেছিল যে হস্তিনাপুরে এই ধরনের জমায়েতকে বে-আইনি বলে ধরা হয়। তা সত্বেও এরা এখানে জড়ো হয়েছে।
হয়তো স্যার রিচার্ড তাকে আদেশ দিয়েছিলেন মিটিং বন্ধ করতে। তিনি তাঁর সামরিক বুদ্ধি দিয়ে বাকিটা নিজের মতো করে ছকে নিয়েছিলেন। না কি তিনি ইংরেজ প্রভুত্বের দম্ভ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন? যে প্রভুর কাছে তার সম্প্রদায়ই হল মানুষ এবং বাকিরা ক্লীব। ‘নেটিভ’দের তো তাঁরা সভ্যতা শেখাতে এসেছিলেন। তাদের তো পশুর মতো দখলে রাখতে হয়, মাথা ওঠালেই গুঁড়ো করে দিতে হয়, যাতে অন্যরা শিক্ষা নেয়।
যাক গে গণপতি, এত বছর পরে রুডিয়ার্ডের কথা ভেবে আর কী হবে? তার কীর্তির কথা জেনে রাখো। সে তার বাহিনীকে রাইফেল দিয়ে তাক করতে বলল, ১৫০ গজ দূরে শান্ত হয়ে বসে থাকা জনতাকে।
একবারও কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হল না, মাইকে কেউ ঘোষণা করল না যে এ জমায়েত বে-আইনি, কেউ জনগণকে আদেশ করল না জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। রুডিয়ার্ড একবারও তার লোকেদের বলল না যে শূন্যে বা পা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে হবে। সেনারা বুক, মাথা, মুখ, পেটে অঝোরে গুলি বর্ষণ করতে থাকল, অবাধে।
ঐতিহাসিকরা এর নাম দিয়েছিল বিবিগড় ম্যাসাকার। কতবড় ভুল! ম্যাসাকার মানে তো দু-পক্ষের লড়াই, যেখানে একপক্ষ হেরে গিয়ে তবেই মার খায়। বিবিগড় বাগ-এ সেদিন লড়াই হয়েছিল কই?
রুডিয়ার্ডের বাহিনি লাইন করে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় নিরস্ত্র, অসহায়, শান্ত, আর্ত মানুষের ওপর অতর্কিতে গুলি চালিয়েছিল। তাদের ভাবটা ছিল যেন তারা রোজ যে কাজ করে, তাই করছে, অবিচল, অকরুণ। একের পর-এক তারা গুলি ভরে চলল আর রাইফেল খালি করে চলল মানুষগুলোর ওপর।
রাজা শান্তনুর আমলে তৈরি ইটের পাঁচিলের ওপর রাইফেল রেখে তারা কী সহজে মানুষগুলোকে তাক করেছিল সেদিন। আতঙ্কিত মানুষগুলি উঠে পালাতে অবধি পারল না, গণপতি! তাদের চিৎকার কি ওদের কানে যায়নি? হাঁচড়-পাঁচড় করে অসংখ্য মানুষ গেটের দিকে ছুটতে গিয়ে লুটিয়ে পড়ছিল গুলি খেয়ে। কী করুণ ছিল বাচ্চাদের কান্না! আমি আজও সে আতঙ্কের ছবি সত্যি বলে বিশ্বাস করতে পারি না গণপতি। মনে হয় কোনও নির্বাক চলচ্চিত্রের অংশ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ঠিক পাবলো পিকাসোর আঁকা হত্যালীলা গুয়েরনিকার মতো।
সেনারা সেদিন ১৬০০ বুলেট ফায়ার করেছিল। যেটুকু তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। হবে নাই-বা কেন? অপর পক্ষ তো নিরস্ত্র! কয়েক পলকে ৩৭৯ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ১১৩৭ রক্তাক্ত মানুষ সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। এই পরিসংখ্যান যখন রুডিয়ার্ডকে পরে দেওয়া হয়, তিনি খুশি হন। ‘মাত্র ৮৪টি গুলি নষ্ট হয়েছে। খুব খারাপ নয়।’ তিনি বলেছিলেন।
এই পরিসংখ্যান অবশ্য ব্রিটিশ সরকারের। আমরা কখনওই জানতে পারিনি আসল সংখ্যাটা। কারণ, কত আহত মানুষ রক্তক্ষয় হয়ে মারা গেছিল সেদিন, কেউ জানে না। সরকারি এনকয়ারিতেও ধরা পড়েনি। প্রতিটা গুলি শুধু মানুষ নয়, ইংরেজদের ন্যায় এবং সততার আস্ফালনের ওপর গভীর আঘাত হানল।
২১
গঙ্গাজি এসে পৌঁছোলেন ঠিক সময়ে। তিনি তাঁর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি। কোনওমতে একটা ফোয়ারার কাছে গিয়ে বমি করে ফেললেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মৃতদেহগুলির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন অসহায় আপশোসে।
বিড়বিড় করে ভাঙা গলায় বারবার বললেন, ‘বিনাশ কালে বিকারিত বুদ্ধি।’ মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই গ্রিক প্রবাদের—যাদের সর্বনাশ ঘনিয়ে আসে ভগবান তাদের বুদ্ধি ভ্রষ্ট করে দেয়। গঙ্গাজির সেই মানসিক জোর ছিল, যা দিয়ে তিনি এই বীভৎসতার মধ্যেও দৈব এবং ভবিতব্য দেখতে পান। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সবটাই ঠিক নয়। এই খুনের পিছনে কোনও রাগ বা পাগলামো ছিল না। ছিল ঠান্ডা খুনি মাথার বিচার। কিন্তু আংশিক ভাবে, তিনি যা ভেবেছিলেন তা সত্যি। এই ঘটনা ঘটতে দেওয়া বোকামি হয়েছিল।
যতই আমরা ইংরেজদের আধিপত্য অপছন্দ করি না কেন গণপতি, ওরা তো আর রোজ ভারতীয়দের বন্দি অবস্থায় খুন করত না। রুডিয়ার্ডও যে মানুষবেশী শয়তান, তাও নয়। সেদিন সে এক অদ্ভুত বোধহীন হিংস্র আচরণ করে ফেলেছিল। এই কাজ করার ফলে সে দাগি হয়ে রইল ইতিহাসের চোখে। রুডিয়ার্ড বা তার আচরণকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। কার্যকারণ এবং ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার সার্বিক মূল্যবোধহীনতাই এর প্রধান কারণ। হস্তিনাপুরের এই ভয়ংকর ঘটনা সহজেই ভারতীয়দের সামনে ইংরেজদের মুখোশ খুলে দিল। ভারতীয়দের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। তারা বুঝতে পেরেছিল, সাহেবরা তাদের ওপর শুধু প্রভুত্ব করতে এসেছে। তারা ক্রীতদাস ছাড়া কিছুই নয়।
হস্তিনাপুরে আতঙ্ক নেমে এল গণপতি। যদি ভেবে থাকো এই ঘটনার পরে হিংসাত্মক ঘটনা বেড়ে গেল, তাহলে তুমি ভুল করবে গণপতি। কোনও বাবা কি চায় গুলির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার পরিবারকে অনাথ করে চলে যেতে? চায় না। বিবিগড়ের পর সকলে বুঝতে পারল যে মাথা তুললে কী হতে পারে! ইংরেজদের প্রভুত্ব সবাই মেনে নিল শান্তভাবে।
পরে গঙ্গাজি আমাকে বলেছিলেন, বিবিগড়-এর ঘটনার পরে তিনি আরও ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন, অহিংসাই একমাত্র পথ। ‘এমন কোনও পথে চলা উচিত নয় যাতে অপর পক্ষ তোমাকে হারিয়ে দেয়। আমরা একমাত্র অহিংসা, সত্য আর ন্যায়—এই তিন অস্ত্র দিয়েই ওদের খুন করব। তোমার মনে হতে পারে, এ আবার কী পাগলের প্রলাপ! কিন্তু ভুলে যেও না যে মোতিহারিতে আমাদের জয় হয়েছিল।’
আমরা আবার আশায় বুক বাঁধলাম। কারণ অজেয় ইংরেজ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার অন্য কোনও অস্ত্র সত্যিই চোখে পড়ছিল না। একটা জাতীয় কর্মকাণ্ড চালু হয়ে গেল।
কর্নেল রুডিয়ার্ডের কী হল জানো? তাঁর কর্মদক্ষতায় ইংরেজ সরকার এতই লজ্জিত হল, তাঁকে সময়ের আগেই অবসর নিতে হল, যদিও মোটা পেনশন চালু রইল। এই টাকার তার খুব একটা দরকার ছিল না। যেখানে যত নীলকর সাহেবদের ক্লাব ছিল, যত মেমদের চায়ের আড্ডা ছিল, সব জায়গায় কর্মপরায়ণ রুডিয়ার্ডের জন্য বিশেষভাবে চাঁদা তোলা হল। অসভ্য বর্বর নেটিভদের শিক্ষা দেওয়াটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল বইকি!
সব মিলিয়ে কত টাকা উঠেছিল জানো কি? দু-লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড! আজকে টাকার মূল্য কমে গিয়েও এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় চল্লিশ লক্ষ টাকায়। এবার হিসেব করো, আমাদের রাষ্ট্রপতির কতদিন লাগে এই টাকাটা রোজগার করতে!
রুডিয়ার্ড পঁয়ত্রিশ মিনিট কাজ করে এই টাকাটা রোজগার করেছিলেন। সরকার এই টাকার ওপর কর বসাল না। তার মানে প্রতি মৃত মানুষ পিছু রুডিয়ার্ড ১৬০ পাউন্ড পুরস্কার পেলেন। কেউ কেউ অবশ্য মৃদু আপত্তি তুলে বলেছিল, ‘মরা নেটিভদের এত দাম নাকি?’
সাহেবদের এই আচরণে তাদের মনোভাব স্বষ্ট হয়ে গেল। গঙ্গাজি পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের নির্যাসকেই তাঁর পাথেয় বলে মনে করতেন। তিনি খ্রিস্টধর্ম নিয়েও প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। তাই বুঝতে পারলেন, ইংরেজ শয়তানের মতো আচরণ করেছে।
বিবিগড়ের ঘটনা ভারতীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রামী করে তুলল। নোবেলজয়ী একজন কবি তাঁর ইংরেজ-সরকারের দেওয়া খেতাব ফিরিয়ে দিলেন। গঙ্গাজি বলতেন স্বাধীনতা এবং সত্য অভিন্ন। পণ করেছিলেন ভারতকে এই দুর্বিনীতদের হাত থেকে উদ্ধার করবেন। দুটি কথায় তিনি ইংরেজদের তাঁর বার্তা পাঠালেন—ভারত ছাড়ো! ক্যুইট ইন্ডিয়া।
রুডিয়ার্ড ইংল্যান্ডে তাঁর গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবন কাটাতে ফিরে গেলেন। কোনওদিন কি জানতে পেরেছিলেন এদেশের মানুষ তাঁকে কতটা ঘৃণা করে? শয়ে শয়ে যুবকেরা মন্দির-মসজিদ-গুরদোয়ারায় গিয়ে ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়েছিল রক্তাক্ত প্রতিহিংসার। আমার ভাবতে ভালো লাগে, রুডিয়ার্ড তার শেষ জীবনে প্রতিটা ছায়ার মধ্যে নিজের হন্তাকে দেখতে পেয়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তার শেষ মুহূর্তগুলি কেটেছিল। যারা প্রতিহিংসার কথা বলত, তারাও কি জানত প্রতিশোধ নেওয়ার রাস্তাটা কী? তবে দুজন পেরেছিল সমুদ্রপারের সেই দেশে গিয়ে ভারতফেরত এক সাহেবকে হস্তিনাপুরে করে যাওয়া অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিতে।
উল্লসিত হয়ো না গণপতি। একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গিয়েছিল। কারণ ওরা রুডিয়ার্ডকে মারার পরিবর্তে, কেনসিংটন হাইস্ট্রিটের আরেক বাসিন্দা রুডিয়ার্ড কিপলিংকে হত্যা করে। তারও ভারতবর্ষের সঙ্গে যোগ ছিল বই কি! পৃথিবীর সামনে আমাদের মতো প্রাচীন সভ্যতার দেশের মানুষকে প্রফেসর কিপলিং মাংসখেকো বলে পরিচয় দিয়েছিল। লোকটিকে আগেই আমার পাংশু ছেলে পাণ্ডু একবার যথেষ্ট পিটিয়েছিল। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, আমাদের ওই দুই তেজি যুবকের ফাঁসি হয়েছিল, ভুল রুডিয়ার্ডকে হত্যার অপরাধে। হয়তো তোমার মনে হচ্ছে, রুডিয়ার্ড অতগুলো মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেও পার পেয়ে গেল! বিধাতাপুরুষ বোধহয় সেই লোকটাকেই চরম শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন, যে আমাদের গোটা দেশকে পৃথিবীর সামনে বর্বর প্রমাণিত করতে চেয়েছিল। গণপতি, আমরা ন্যায় বিচারই পেয়েছিলাম।
২২
আমার পরিবার এইভাবেই রাজনীতিতে এল। গঙ্গাজি তো অনেক দিন ধরেই ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর অহিংসার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এই বারে কালো চশমা আর ছড়ি হাতে ধৃতরাষ্ট্র আর ব্রহ্মচর্য পালন করে স্ফীত হয়ে যাওয়া পাণ্ডু দুজনেই নেমে পড়ল রাজনীতির ময়দানে।
বিদুরও ইচ্ছা করলেই এদের সঙ্গে যোগ দিতে পারত। কারণ সে তার চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিল বিবিগড়ের ঘটনার প্রতিবাদে।
‘কী? ইস্তফা দিয়েছ!’ ধৃতরাষ্ট্র বলে।
‘ঠিক করেছ! এই বেজন্মাদের চাকরি না করাই ভালো।’ পাণ্ডু বলে।
‘ইস্তফা ফিরিয়ে নাও এই মুহূর্তে।’ গঙ্গাজি আদেশ দেন।
‘কী বলছেন, তাতঃ? তা কী করে হয়?’
‘কেন? ওরা কি তোমার ইস্তফা মঞ্জুর করেছে?’
‘না। ওরা জানে না। আমি চুপচাপ কাগজটা আন্ডার সেক্রেটারির ট্রেতে রেখে এসেছি। সে সোমবার সকালে পাবে।’
‘তুমি এই মুহূর্তে দিল্লি ফিরে গিয়ে ওটা সরিয়ে ফেলো।’
‘কেন? আমি ওই খুনে সরকারের কর্মচারী হতে চাই না।’
‘তুমি সরকারে থেকেই মানুষের মধ্যে কাজ করো। দু-ভাবেই দেশের কাজ করা যায়। ওকে বুঝিয়ে দাও ধৃতরাষ্ট্র।’ গঙ্গাজি বলেন। অন্ধ চোখ দুটি এবার বিদুরের দিকে ফিরল।
‘আমরা সরকারের মধ্যে তোমার মতো লোক চাই, যারা আমাদের লড়াই করতে সাহায্য করবে, বুঝলে? তারপর কোনওদিন যদি স্বাধীন সরকার গড়তে পারি তখন আমাদের অভিজ্ঞ লোক দরকার হবে!’ ধৃতরাষ্ট্রের গলায় সেই মখমলের আভাস পাওয়া গেল, যার ইন্দ্রজাল স্বয়ং ইংল্যান্ডের ব্লুমসবেরির মহিলারাও টের পেয়েছিলেন।
বিদুর অনিচ্ছা সত্বেও ফিরে গেল আইসিএস-এর চাকরিতে। তবে আমারই ছেলে, তাই খুব শিগগির সে স্টেটস ডিপার্টমেন্টে উন্নতি করতে লাগল। রাজপরিবারের রক্ত গায়ে থাকার দরুন সে অন্যান্য রাজ্যগুলির সঙ্গেও নিপুণ যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়। তাদের চাহিদা এবং পাগলামি দুটোই সে বুঝত এবং কৌশলে ইংরেজদের এমন ভাবে বোঝাত যে আখেরে রাজ্যগুলিরই লাভ হত। আস্তে আস্তে গোলাপি সাহেব আর দেশীয় রাজাদের মধ্যে সে সুন্দর সেতুবন্ধন করতে পেরেছিল।
থাক বিদুর-এর কথা। আমরা বরং গঙ্গাজির প্রধান দুই শিষ্যের প্রতি দৃষ্টি ঘোরাই। কারণ ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারাই দুই প্রধান তারকা হিসেবে পরিগণিত হল।
ছেলের জন্ম দিতে না পেরে ধৃতরাষ্ট্র এতই ভেঙে পড়ল, রাজনীতিতে মন দিল নিজেকে ভুলিয়ে রাখবার জন্য। তার ওপর আবার স্ত্রী গান্ধারীর অসুস্থতা সারবার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ধৃতরাষ্ট্রের দক্ষতায় সবাই অবাক হল। অন্ধ বলে পৃথিবীটা নিজের মতো করে দেখতে পেত সে। কিছুদিনের মধ্যেই তার দূরদৃষ্টির পরিচয় পেয়ে সকলে চমৎকৃত হল। কৌরবদের প্রধান হয়ে সে অন্ধত্ব সত্বেও সরকারের সঙ্গে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান, কৌরব পার্টির রণকৌশল ঠিক করা সবই নিজের হাতে তুলে নিল। তার কথা বলা আর বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গি ছিল অনবদ্য। বিলেতে থাকাকালীন সে বহু তর্ক-বিতর্কে নিজেকে ব্যস্ত রাখত। সে-সব অভিজ্ঞতা এখন কাজে লেগে গেল।
গঙ্গাজি, কৌরব পার্টির রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে একহারা আত্মবিশ্বাসী ধৃতরাষ্ট্রকে ভীষণ ভালোবাসতেন। পাণ্ডুর এতে কোনও আপত্তি ছিল না। সে পৃথিবীটাকে অন্য চোখে দেখত। মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরার পর থেকে সে ধর্মগ্রন্থগুলিতে মন দিয়েছিল। তার জন্যেই বোধহয় সে জীবনটাকে একেবারে মাটির কাছাকাছি থেকে দেখতে চেষ্টা করত। ধৃতরাষ্ট্রের মতো আদর্শের ভাবাবেগে সে ভুগত না। হাতের মুঠো শক্ত করে সমস্যার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তাঁকে পরাস্ত করাই ছিল পাণ্ডুর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে মনে হত যে তার মাথার পিছনেও বুঝি দুটো চোখ আছে।
শুধু ধ্যান করেই পাণ্ডুর দিন কাটত না, সে যথেষ্ট শরীরচর্চাও করত। ‘আমি অহিংসায় বিশ্বাস করি। কিন্তু যদি হিংসা আমার দিকে তেড়ে আসে তাহলে নিজেকে তৈরি রাখা ভালো।’
পার্টির মুখ্য সঞ্চালক হিসেবে তার পথ ধৃতরাষ্ট্রের থেকে আলাদা হতে বাধ্য। তার দায়িত্ব ছিল পার্টির কাঠামোকে শক্তপোক্ত করে গঠন করা এমন এক বাহিনী তৈরি করা যা ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রের সামনে কোনওমতেই নুয়ে পড়বে না। পাণ্ডু বিশ্বাস করত, কঠিন অনুশাসন-এর দ্বারা পার্টিকে চালানো উচিত। একবারে কড়া সামরিক রীতিতে। শুধু পড়াশোনা আর ন্যায়ের ভাবমূর্তি হয়ে দেশের জন্য লড়াই করা যায় না।
কোন পথ যে ঠিক, তা নিয়ে আজীবন নানা মতের দ্বন্দ্ব রয়ে গেল। আমাদের প্রিয় নেত্রীর অবধি একদিন বেঘোরে প্রাণটা গেল এই দুই পথের একটিকে বেছে নিতে গিয়ে। লক্ষ্যের চেয়ে কি উদ্দেশ্য বড়? গঙ্গাজি আমার এই দুই ছেলের ভিন্ন পন্থার খোঁজ রাখতেন। চাইতেন দুজনকেই সঠিক চালনা করতে। কিন্তু তাঁর নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে আলগা হতে লাগল।
আবার খেই হারিয়ে ফেলেছি গণপতি। আমি তোমাকে কুন্তির কথা বলতে ভুলে গেছি। পাণ্ডুর অসতী-সতী স্ত্রী। কীভাবে সে স্বামীকে সন্তান উপহার দিল? গান্ধারী একাই এই পরিবারে সন্তান প্রসব করলে তো চলবে না? আরও তো নেতা চাই, যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হয়ে পড়ে!
চোখ জুলজুল করে কী দেখছ গণপতি? তুমি কি ভাবছ যে কুন্তির বিছানার পাশে তোমায় বসিয়ে গল্পটা শোনাব? তুমি কি ইতিহাস লিখতে বসেছ, না উত্তেজক রসালো রচনা?
পাণ্ডু ঠিক করে দিয়েছিল কোন কোন ব্যক্তি কুন্তির শয্যাসঙ্গী হবে, যাতে তাদের গুণাবলি ছেলেদের মধ্যে বর্তায়। প্রথমে কুন্তীর প্রণয়সঙ্গী হলেন হাইকোর্ট-এর সর্ব কনিষ্ঠ ভারতীয় জজ। ধরে নেওয়া যাক তার নাম ধর্ম। আসল নামটা বললে অনেকের গায়ে লাগতে পারে। যদিও অনেকেই জানে নামটা। ধর্ম ছিল উচ্চবংশের সুপুরুষ। শিক্ষিত এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। সে অত্যন্ত আদর্শবাদী ছিল। কুন্তির সঙ্গে এই অবৈধ সম্পর্ক তাকে অস্বস্তিতে ফেলত। কিন্তু কুন্তি একদিন হঠাৎ তাকে ছেড়ে চলে গেল। ততদিনে অবশ্য তার গর্ভসঞ্চার হয়ে গেছে। ধর্ম তা জানত না। কুন্তির হঠাৎ চলে যাওয়াটা সে মানতে পারেনি।
যে ছেলেটি জন্মাল তার চওড়া কপাল হল কোমলস্বভাব দেখে নাম রাখা হল যুধিষ্ঠির। পাণ্ডু বলে যে কুন্তির প্রসব যন্ত্রণা যখন তুঙ্গে, তখন সে দৈববাণী শুনেছিল যে এই শিশু তার সত্যনিষ্ঠা এবং ন্যায়পরায়ণতার জন্য বিখ্যাত হবে একদিন। আমার অবশ্য ধারণা, পাণ্ডু রাত অবধি জর্জ ওয়াশিংটনের জীবনী পড়তে পড়তে ঢুলে পড়ে স্বপ্ন দেখেছিল।
যুধিষ্ঠির জন্মাবার সময়ে হস্তিনাপুর রাজ্য তখনও পরিবারের হস্তচ্যুত হয়নি। পাণ্ডুকে আরও সন্তানের কথা বলা হল। কারণ উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে তো!
প্রয়োজনের চেয়ে বেশিদিন কুন্তি ধর্মের বক্ষলগ্না হয়ে থাকবে, পাণ্ডু তা চায়নি। কুন্তি নিজেও এক সঙ্গীতে বেশিদিন সন্তুষ্ট থাকার পাত্রী ছিল না। আসলে বহু সঙ্গীর দ্বারা যৌন আনন্দ, সন্তান প্রসবের মজা বহু মহিলাই পেতে চায়। সাহস হয় না। এবারের কুন্তির সঙ্গী হল মেজর বায়ু। হস্তিনাপুর প্যালেস গার্ড-এর সামরিক প্রধান। ক’দিন পরেই অবশ্য প্যালেস গার্ড ভেঙে দিয়ে ইংরেজ সরকার রাজ্যটিকে অধিগ্রহণ করে নেয়।
বায়ু বড়সড় চেহারার শক্তপোক্ত মানুষ। কিন্তু বড্ড বদমেজাজি ছিল। সে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কুন্তির জীবনে প্রবেশ এবং প্রস্থান করল। রেখে গেল ভীম-এর বীজ। পাণ্ডুর দ্বিতীয় পুত্র। সেবাদাস মহলে ভীম-এর বীর বলে পরিচয় ছিল। তার পরিচারিকারা তাকে ভারী ভীম বলেই ডাকত। ছোট কপাল, খুদে চোখ আর জোড়া ভুরু দেখেই বোঝা যেত যে, সে তার বড় ভাইয়ের মতো পাণ্ডিত্যের অধিকারী হবে না। তার মায়ের মতো সুন্দরও সে হয়নি।
কিন্তু গায়ের জোরে তার সঙ্গে এঁটে ওঠা দায়। তাকে মায়ের জরায়ু থেকে বার করতে গিয়ে ডাক্তারের কবজি ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। তারপর সিজারিয়ান সেকশন করে ভীমকে বের করেন। কুন্তি কিছুদিনের মধ্যেই ভীমকে বুকের দুধ দেওয়া বন্ধ করল। এক মিনিট দুধ খাওয়াতেই তার হাঁপ ধরে যেত। ভীমের জন্য লোহার খাট আনতে হল, দুবার সে লাথি মেরে তার কাঠের খাট ভেঙে দিয়েছিল। আয়ারা তাকে রাখতে পারত না। পুরুষ পরিচারক মোতায়েন করা হয়েছিল। সে আবার কুস্তিগির। একবার একটি আয়া ভীম-এর ভার রাখতে না পেরে তাকে হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল একটা পাথরের ওপর। পাথরটাই গুঁড়ো হয়ে যায়।
কিন্তু পাণ্ডু দুটি ছেলেতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি এমন একটি ছেলে কামনা করেন যার মধ্যে যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধিসত্তা আর ভীমের বীরত্ব, দুইই থাকবে। পাণ্ডু যোগাসন আর ধ্যান করা শুরু করল আবার। এক পায়ে অনড় হয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থেকে সে ঈশ্বরদের নিজের বশে আনতে সক্ষম হল। কুন্তিকে তার সমস্ত জীবনীশক্তি বাঁচিয়ে রাখতে বলে, পাণ্ডু প্রার্থনা শুরু করল তৃতীয় পুত্রের জন্য।
সেই সময়ে পাণ্ডু এক পবিত্র ব্রাহ্মণ, দেবেন্দ্র যোগীকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এলেন। এই ভগবানতুল্য ব্রাহ্মণের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে কুন্তির অনেকভাবেই লাভ হয়েছিল। অর্জুন জন্মাল শেষে। একহারা চেহারা অথচ শক্ত পেশি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর ছুরির ফলার মতো চোখ, সুপুরুষ চেহারা। হাওয়ার মতো গতি ছিল তার। দৈববাণী হয়েছিল, পাণ্ডুর এই ছেলে বিষ্ণু এবং শিবের, স্রষ্টা এবং ধ্বংসের—দুজনেরই প্রিয় হবে।
অর্জুনের জন্ম দিয়ে পরিশ্রান্ত কুন্তিও এই দৈববাণী শুনেছিল। হিমালয়ে মুনি ঋষিরা এবং কারখানায় কর্মরত মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। আমি দেশদ্রোহী বক্তৃতা দিচ্ছিলাম একটা গ্রামের পঞ্চায়েতকে। আমিও শুনতে পেয়েছিলাম। সবাই আনন্দে মুখর হল।
কুন্তিও স্বর্গলোকের এই মনোভাব দেখে প্রণয়লীলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল। সে অবাক হল পরের ঔরসজাত ছেলে নিয়ে পাণ্ডুর আনন্দ দেখে। কিন্তু আবার ছেলের কথা বলতেই এবার কুন্তি রেগে গেল। ‘তুমি তো বলেই খালাস! তোমাকে তো আর সন্তান ধারণ করার শারীরিক অস্বস্তি ভোগ করতে হয় না। দিনের পর দিন বমি করা, বিরিয়ানি, মদ খেতে না পারা আর দোলনায় চড়তে না পারার কী কষ্ট তুমি কি জানো?’ সুন্দরী কুন্তি একটা সিগারেট হোল্ডারে সিগারেট ঢুকিয়ে পাণ্ডুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
পাণ্ডু কিছু বলার আগেই কুন্তি তার শেষ বাণটা মারল। ‘আমিও কিছু কিছু শাস্ত্র পড়েছি। জেনেছি, যদি কোনও মহিলা পাঁচজন পুরুষসঙ্গ করে, তাহলে সে নোংরা, যদি সে ছয়জন পুরুষ-এর সঙ্গে শোয়, তাহলে সে বেশ্যা। তুমি কি এটা জানো না?’
পাণ্ডু বলল, ‘ঠিক আছে। যা তোমার ইচ্ছা তাই করো।’
পাণ্ডু আরও কিছু বলত। কিন্তু মাদ্রী তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করল, ‘আমি অভিযোগ করছি না। কিন্তু তুমি কুন্তিকে আমার থেকে অনেক বেশি কদর করো। ভুলে যেও না, কুন্তি রাজার দত্তক নেওয়া মেয়ে, আমি কিন্তু সত্যিকারের রাজকন্যা। আমার দ্বারাও তোমার উত্তরাধিকারী পাওয়া উচিত।’
পাণ্ডু শুরুতে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। শুধু শুধু নিজের স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট হতে দিতে চাইত না সে। কিন্তু পাণ্ডু এবার মত পালটাল।
‘ঠিক আছে মাদ্রী, তোমাকে আমি একবার মাত্র অন্য পুরুষের সঙ্গে শোওয়ার অনুমতি দেব। নইলে হস্তিনাপুরে আমি হাসির খোরাক হয়ে যাব।’
আনন্দে মাদ্রীর বিশাল বুক দুটো নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করতে থাকল। পাণ্ডুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে অন্যদিকে তাকাল।
মাদ্রী তার কথা রেখেছিল। সে প্রেম করেছিল এক জোড়া যমজ পুরুষের সঙ্গে। অশ্বিন আর অশ্বিন। তাদের দুজনের নামও এক এবং একসঙ্গেই তারা সব কাজ করত। মাদ্রীর সুখের সীমা রইল না। সে অঙ্গীকার ভঙ্গ না করেও দ্বিগুণ যৌন আনন্দ উপভোগ করল। এর ফলস্বরূপ তার একটি নয়, দুটি সন্তান হল। ছেলে। পাণ্ডুর লব-কুশ নাম পছন্দ হল না, কোনও নতুনত্ব নেই। শেষে মাদ্রীর ছেলেদের নাম হল নকুল ও সহদেব।
‘পাণ্ডু, তুমি খুশি হওনি? একেবারে যমজ! এবারে আর ব্রিটিশরা আমাদের উত্তরাধিকারের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তুমি অবশ্য যদি নিশ্চিন্ত হতে না পারো, আমি আরেকবার চেষ্টা করতে পারি। করব? শুধু আর একটিবার?’
‘ওকে আর অনুমতি দেবে না তুমি।’ কুন্তি স্বামীকে সাবধান করল, ‘এরপর তিনটে বাচ্চার একসঙ্গে জন্ম দেবে! আমি যাব কোথায়? মনে রেখো, আমি তোমার প্রথমা স্ত্রী। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই মাদ্রী আমাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করছে। ঘোড়েল মহিলা।’
বুঝতেই পারছ গণপতি, একটা বড় পারিবারিক নাটক আরম্ভ হতে যাচ্ছিল। যাতে গরমাগরম শরীরী প্রেম থেকে আরম্ভ করে ঈর্ষার আগুন অবধি সব রশদই মজুদ আছে। কিন্তু ইংরেজরা হস্তিনাপুর অধিগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকারের সব গল্প শেষ হয়ে গেল।