চতুরঙ্গ

চতুরঙ্গ

পুব বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশরূপে স্বাধীন হল তখন ওই অঞ্চলের লোক সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারেননি, তাঁহাদের সাহিত্য সৃষ্টি কৃষ্টি গবেষণা কোন পথে চলবে। অখণ্ড পাকিস্তান নির্মাণের সহায়তা করার জন্য তারা উর্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হবেন, না, যে বাংলা ঐতিহ্য উভয় বাংলা অনুকরণ করছে সেই পন্থা অবলম্বন করবেন? একটু সময় লাগল।

(১) ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বর্ধমান হাউসে–বাংলা অ্যাকাডেমি। কিছুদিন পরেই তাঁদের প্রথম ত্রৈমাসিক বেরুল। দুই বাংলাতে তখনও পুস্তকাদি অনায়াসে গমনাগমন করত। প্রথম সংখ্যা এ-বাংলায় পৌঁছনোমাত্রই তার আলোচনা দেশ পত্রিকায় বেরোয়। এ-বাংলা তাকে সানন্দ অভিনন্দন জানায়। আজ যদি দুষ্টজন বলে, পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিকরা বাংলা দেশের লোকজনকে অখণ্ড পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য যাবতীয় কারসাজি করছে, তবে অকুণ্ঠ ভাষায় বলব, যখন আমরা দেশ মারফত ওই ত্রৈমাসিককে স্বাগত জানাই তখন আমাদের ভিতর কেউই রাজনৈতিক ছিলেন না। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তাঁদের পেটুয়া কিছু কিছু বাঙালি মোল্লা মুন্‌সিকে অ্যাকাডেমিতে ছলে-বলে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলা ভাষায় ইসলামের উত্তম উত্তম আরবি ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ নেই। অতএব আমাদের প্রথম কর্ম কুরান-শরিফের বাংলা অনুবাদ করা। সভাপতি বললেন, সে কী? আমারই জানা-মতে অন্তত পাঁচখানা বাংলা অনুবাদ রয়েছে। মোল্লারা : তা হলে হদিসের (কুরান-শরিফের পরেই হদিস আসে) অনুবাদ করা যাক। আসলে মোল্লারা চান ওই মোকায় বেশ দু পয়সা কামাতে। আর এদিকে বেচারি অ্যাকাডেমি সবে জন্ম নিয়েছে। অজাতশত্রু হতে চায়। স্বীকার করে নিল। সে কর্ম এখনও সমাপ্ত হয়নি। কারণ সমাপ্ত হলেই তো কড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। (এ টেকনিক আমাদের এ দেশের ডাঙর ডাঙর আপিসাররাও জানেন।) বাঙলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান আমাকে বললেন, এ যাবৎ তেনারা আশি হাজার টাকা গ্যাটস্থ করেছেন। এই মোল্লাদের অনেকেই এখন খানকে সাহায্য করছেন– মীরজাফররূপে।

(২) কেন্দ্র বাংলা উন্নয়ন বোর্ড।

আপনারা বাঙালদের যত মূর্খ ভাবেন তারা অতখানি মূর্খ নয়। তারা তখন অন্য প্যাঁচ কষল। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাল, আমাদের পাঠশালা স্কুলে যেসব টেকস্ট বই পড়ানো হচ্ছে সেগুলো বড়ই অনৈসলামিক ভাবাপন্ন। অতএব সেগুলো নাকচ করে দিয়ে নয়া নয়া কেতাব লেখা হোক। গাড়োল রাওলপিণ্ডি সে ফাঁদে পা দিল। তখন সৃষ্ট হল কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু ইয়া আল্লা ইয়া রাসুল! কোথায় না তারা প্রস্তাবিত কর্মে লিপ্ত হবে, না তারা লেগে গেল বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পরিপূর্ণ পদ্য-গদ্য রচনা সম্পূর্ণাকারে প্রকাশ করতে। আমার মনে হয়, তখনই তারা ভিতরে ভিতরে আপন অজান্তে জেনে গেছে, ঝঞ্ঝা আসন্ন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একটা দফারফা করতেই হবে। অতএব বিদ্রোহী কবি কাজীই আমাদের ভরসা। কী সুন্দর তিন ভলুম এ্যাবৎ বেরিয়েছে। যিনি সম্পাদনা করেছেন তার নাম বলব না। পাছে না টিক্কা খানের লোক তাকে গুলি করে মারে। (টিক্কা অর্থ টুকরো–ফারসিতে বলে টিক্কা টিক্কা মি কুন –তোকে টুকরো টুকরো করব। আমরা যেরকম তিনকড়ি, এককড়ি, ফকির নফর নাম দিই যাতে করে যম তাকে না নেয়।)

 (৩) এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ ইস্ট পাকিস্তান স্থাপিত হল। (ঠিক কী নাম বলতে পারছিনে।) এতেও পশ্চিম পাকের খানরা চটে গেলেন। কারণ বাঙালরা তখন বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাই (এই ময়নামতি অঞ্চলেই এখন লড়াই চলছে) যেসব স্থলে বৌদ্ধবিহার স্থাপিত ছিল, যে সবের বর্ণনা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং দিয়েছেন, সেই নিয়ে তারা লেকচর দিচ্ছে, সেমিনার করছে। তোবা, তোবা।

(৪) এবং এসবের বহু পূর্বেই আবদুল হাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতের প্রধানতম অধ্যাপক, তাঁর সাংস্কৃতিক ত্রৈমাসিক বের করে যাচ্ছেন। এবং তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর ওই পত্রিকায় আমাদের পশ্চিম বাংলার হরেন পাল মহাশয়ের অভিধান।

এই চতুরঙ্গে বাঙাল দেশ তার আপন পথে এগিয়ে যাচ্ছিল রাজনীতিকে উপেক্ষা করে। এমন সময় ইয়াহিয়া খান মারলেন ওই প্রগতির উপর থাপ্পড়। এর উত্তরে আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি।

বাহুর দম্ভ, রাহুর মতো,
একটু সময় পেলে
 নিত্যকালের সূর্যকে
সে এক-গরাসে গেলে।
নিমেষ পরেই উগরে দিয়ে
মেলায় ছায়ার মতো,
সূর্যদেবের গায়ে কোথাও
রয় না কোনও ক্ষত।
 বারে বারে সহস্রবার হয়েছে এই খেলা,
 নতুন বাহু ভাবে
তবু হবে না মোর বেলা
 কাণ্ড দেখে পশুপক্ষী।
ফুকরে ওঠে ভয়ে,
 অনন্তদেব শান্ত থাকেন
ক্ষণিক অপচয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *