চণ্ডেশ্বরপুরের রহস্য – মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
মাসিমার সাদর নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করিতে না পারিয়া সেবার রণজিৎ দিন সাতেকের জন্য চণ্ডেশ্বরপুর কাটাইয়া আসিবে স্থির করিল । চণ্ডেশ্বরপুর একটি গণ্ডগ্রাম, কলিকাতা হইতে অনেকটা দূরে। বাংলার পল্লী-অঞ্চলের সহিত হুকাকাশির খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় নাই, তাই রণজিতের ইচ্ছা তিনিও তাহার সঙ্গী হন। হুকাকাশি একেবারে অস্বীকার করিলেন না, বলিলেন, ‘আপনি রওনা হয়ে পড়ুন তো, এদিককার ঝঞ্ঝাট যদি মেটাতে পারি, তবে না হয় আপনাদের পল্লীগ্রামের বায়ু খানিকটা ভক্ষণই করে আসা যাবে।’
চণ্ডেশ্বরপুর যিনি গিয়াছেন তিনিই জানেন, সেখানকার সবচেয়ে আকর্ষণের বস্তু হইতেছে প্রসিদ্ধ ‘বাদামতলী’টি । পাড়াগাঁয়ে মানুষের জীবন সাধারণত মন্দাক্রান্তা-তালে চলে। সকালে এক এক করিয়া গ্রামের মাতব্বর গোছের ব্যক্তিরা বাদামতলীতে আসিয়া জোটেন ; দেখিতে দেখিতে মজলিশ পুরু হইয়া উঠে, হাতে হাতে হুঁকা ঘুরিতে থাকে, সেরে সেরে তামাক ভস্ম হয়, আর সেই সঙ্গে নিপাত যান অনেক রাজা, উজির—অর্থাৎ সামাজিক, রাষ্ট্রিক, আধ্যাত্মিক, পারলৌকিক—কোন বিষয়ের আললাচনাই বাদ যায় না। তারপর বেলা অনেকটা গড়াইলে বাদামতলীর সভ্যেরা বাড়ি ফেরেন ; মাধ্যাহ্নিক রুচিকর আহার এবং সুখকর নিদ্রাটি সাঙ্গ করিয়া বিকালে আবার সকলে আসিয়া জোটেন বাদামতলীতে। তারপর সভা ভঙ্গ হয় অনেক রাত্রে । এক কথায় বাদামতলী চণ্ডেশ্বরপুরের সবচেয়ে অ্যারিস্টোক্র্যাটিক ক্লাব । কাজে কাজেই রণজিৎ আসিয়া দু’দিনেই যে এখানে ভিড়িয়া পড়িবে তাহাতে আর আশ্চর্য হইবার কি আছে ?
সেদিন বাদামতলীর আসর বেশ সরগরম হইয়া উঠিয়াছে । হঠাৎ দেখা গেল জীবনলাল নামে গ্রামের একটি যুবক ত্রস্তপদে সেদিকে আসিতেছে। তাহার সঙ্গে তাহারই বয়সী আর এক ছোকরা, তাহারও হাবভাব যেন একটু অস্বাভাবিক রকমের চঞ্চল। অনেকেই যুবকটিকে চিনিতে পারিল । সে জীবনের ভগিনীপতি হৃষীকেশ ; সবে গত বছর তাহার বিবাহ হইয়াছে । এদিকে বিষয়-আশয় সংক্রান্ত কোন কাজে আসিয়াছিল, একদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি ঘুরিয়া যাইবে এই তাহার মতলব।
জীবনলাল নিকটে আসিতেই একজন জিজ্ঞাসা করিল, ‘ব্যাপার কি হে জীবন ! চোখমুখ অমন শুকনো শুকনো কেন ?’
‘এক ভয়ানক কাণ্ড হয়ে গেছে সুধীরদা ! আচ্ছা, মানুষ মরে গেলেও তার প্রেতাত্মা মানুষের শরীর ধরে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারে—এ আপনারা বিশ্বাস করেন ?’ জীবনলালের নাক হইতে ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছিল।
ভারি কঠিন প্রশ্ন, কিন্তু জবাব আসিল অতি চটপট ; কেউ কেউ বলিল, ‘কেন পারবে না ? আলবাৎ পারে!’ কেউ কেউ আবার বলিল, ‘গাঁজা, স্রেফ !’ আমাদের সুধীরদা প্রথম দলভুক্ত।
‘আপনার কি মনে হয় জ্যাঠামশাই ?’
‘জ্যাঠামশাই’ এ আসরের সবচেয়ে মাতব্বর ব্যক্তি, বাদামতলী ক্লাবের তিনিই প্রেসিডেন্ট। গ্রামের ঘটিবাটি চুরির কিনারা করা হইতে আরম্ভ করিয়া ইউনিয়ন বোর্ডের ইলেকশন পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারেই তাঁর মোড়লী অপ্রতিহত ভাবে চলিয়া আসিতেছে। অপর সকলের মত তিনি তো আর হাল্কা হইতে পারেন না, তাই মুরুব্বিয়ানার ভাব দেখাইয়া কহিলেন, ‘ব্যাপারটা কি, খুলেই বল না আগে, তারপর তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে।’
‘এই হৃষীকেশকেই জিজ্ঞাসা করুন, সে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে।’
সুধীরদা, জ্যাঠামশাই, ন’খুড়ো, ফুল ঠাকুরদার দল এইবারে সোজা হইয়া বসিলেন। সকলেরই মুখের ভাব, যেন এইবারে একটি আসল সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। হৃষীকেশ তাঁহাদের দিকে তাকাইয়া তাহার ‘নিজে প্রত্যক্ষ করা’র কাহিনী শুরু করিল :
‘কাল রাত্রে জীবনদার ওখানে যে গানের জলসা বসেছিল, তা আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, আপনাদের অনেককেই তো ওখানে দেখতে পেয়েছিলাম। জলসার আসর ভাঙে রাত প্রায় দশটায় । তারও প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে খাওয়াদাওয়া সেরে আমি শুতে গেলাম। দোতলার সব চাইতে কোণের নিরালা ঘরটাতে আমার বিছানা করা হয়েছিল। ঘরের পরে অনেকখানি খোলা ছাদ, তারপর বাকি ঘরগুলি আরম্ভ হয়েছে—’
জীবন বাধা দিয়া বুঝাইয়া বলিল, ‘মানে, ভাঁড়ার ঘরের ঠিক উপরের ঘরটা ; বাবা মারা যাওয়ার বছর তিনেক আগে ওটি তৈরি হয়। নিরিবিলি বলে ঘরখানা তাঁর ভারি পছন্দসই ছিল, তৈরি হওয়া অবধি বরাবর ওইটাতেই তিনি থাকতেন। ওই ঘরের ছাদেই তিনি সাপের কামড়ে দেহরক্ষা করেন। আজকাল অতিথ-বিতিথ না এলে ও ঘরটা আমরা কেউই ব্যবহার করি না।’
হৃষীকেশ আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ‘বিছানায় শোয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ; মাঝরাতে হঠাৎ খুট করে একটু শব্দ হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। সামনে তাকিয়ে যা দেখতে পেলাম, তাতে আমার অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠল। এক ধবধবে সাদা মূর্তি অপলক চোখে আমার পানে তাকিয়ে আছে। গলা হতে পা অবধি সমস্ত শরীর তার সাদা কাপড়ে মোড়া , শুধু হাত দুটি এবং মুখখানা বাইরে বেরিয়ে আছে। কিন্তু তা স্বাভাবিক মানুষের মুখ-হাত নয়—রক্তের লেশমাত্র তাতে নেই, একেবারে শ্বেতপাথরের মত ধবধবে সাদা। দেখেই তো আমার হাত-পা অসাড় হয়ে এল। কিন্তু এর পরেই যে ঘটনা ঘটল, তাতে মনে হল বুকের ধুকধুকুনিটুকুও বুঝি একদম থেমে যাবে। সেই শ্বেতপাথরের মূর্তি আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে টেনে টেনে, ধীরে ধীরে বলল, ‘এ-টা আ-মা-র ঘ-র, আ-মি-ই থা-ক-ব।’ তারপর আর আমার কিছুই মনে নেই, দাঁত লেগে বিছানার উপরই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম। ভোরবেলা জীবনদারা এসে অনেক ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকির পর আমায় জাগিয়ে তুলেছেন।
ফুল ঠাকুরদার হুঁকার ডাক বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, তিনি সভয়ে বলিলেন, ‘বল কি হে, মাখনের প্রেতাত্মা দুপুর রাত্রে এসে উপস্থিত হয় নাকি ? কি রকম চেহারাটা তার বল তো ?’
জবাব দিল জীবনলাল, কহিল, ‘সে সমস্তই আমরা খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞাসা করেছি ঠাকুরদা, বাস্তবিকই সে যে বাবারই আত্মা—সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই, সেই ডান গালের উপর মস্ত আঁচিল, সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথার চুলে সেই সোজা সিঁথি—সমস্তই হুবহু মিলে গেছে।’
সুধীরদা সোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, ‘ভূত নেই, নাঃ ? লাও এবার !’ তিনি সদর্পে অবিশ্বাসী দলের দিকে তাকাইলেন।
ফুল ঠাকুরদা বলিলেন, ‘হবে না, অপমৃত্যু যে !’
সকলে উদ্বিগ্নমুখে জ্যাঠামশাইয়ের দিকে তাকাইল, কেননা গ্রামের এই সব বড় দরের ব্যাপারে বাদামতলীর প্রেসিডেন্টের মতই সর্বাগ্রে গ্রাহ্য । জ্যাঠামশাই, ওরফে নীলরতনবাবু, ধীরে ধীরে বার দুই মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘না হে জীবনলাল, তোমার বাবার চেহারার সঙ্গে এতখানি মিল রয়েছে শুনেও কথাটা আমার বিশ্বাস হল না। মরা মানুষ কখনো ফিরে আসে না; এ নিশ্চয়ই কোন চোরবাটপাড়ের কর্ম, চুরির মতলবে ওভাবে বাড়িতে এসে ঢুকেছিল।’
‘সে সমস্ত নিয়েও আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়ে গেছে, জ্যাঠামশাই, কিন্তু সমস্ত শুনলে আপনিও নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে এ কোন ‘চোর-চামারের’ কাজ নয়। বাড়ির অন্যান্য ঘর বাদ দিয়ে যে ঘরে চুরি করবার মত কিছুই নেই, বেছে বেছে সেই ঘরটাতেই চোর এসে ঢুকবে কি জন্যে ? তারপর হৃষীকেশকে সে নিজের চোখেই অজ্ঞান হয়ে পড়তে দেখেছে । সত্যিকারের চোর হলে সে কি ওর সোনার বোতাম আর রিস্টওয়াচটা হাতের সামনে পেয়েও ফেলে রেখে যেত ? কিছুতেই না । ইচ্ছা করলে হৃষীকেশের শোওয়ার ঘরের দরজাটি খুলে বাড়ির এদিক পানেও সে এগিয়ে আসতে পারত । অথচ সেসব কোন কিছুর ধার দিয়েই সে যায়নি। আর তাছাড়া, সে যে মানুষ হতে পারে না, তার সব চাইতে বড় যুক্তি হচ্ছে এই যে, বন্ধ ঘরের মধ্যে সে ঢুকল কি ভাবে ? দেওয়াল অথবা ছাদ ফুঁড়ে তো আর মানুষের পক্ষে আসা সম্ভব নয় !’
নীলরতনবাবু একটু বিজ্ঞভাবে বলিলেন, ‘কিভাবে ঢুকল সেইটাই তো হচ্ছে আসল রহস্য, আর সেই রহস্যই তো আমাদের ভেদ করতে হবে । কিন্তু সে তো আর এই বাদামতলীতে বসে বসে সম্ভব নয়, সমস্ত বাড়ির আনাচ-কানাচ তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোথাও কোন ‘ক্লু’ আছে কিনা। এ হল একটা দস্তুরমত ডিটেকটিভি ব্যাপার। কাজেই এখানে আর সময় নষ্ট না করে, চল, আমরা সেই দিকেই মনোযোগ দিই গে যাই।’
নীলরতনবাবু সদলবলে উঠিয়া পড়িলেন। রণজিতের ভারি কৌতূহল হইতেছিল। বহুদিন সে হুকাকাশির ডিটেকটিভি দেখিয়াছে, কাজে কাজেই আজ নীলরতনবাবুর ডিটেকটিভি দেখিতে কৌতূহল হওয়াটা তার স্বাভাবিকই।
জীবনলালের বাড়ি পৌঁছিয়া নীলরতনবাবু চারিদিক তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। ঘরের মেঝে, দেওয়াল, দরজা প্রভৃতি অনেকক্ষণ ধরিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষার পর একটু মৃদু হাসিয়া কহিলেন, ‘আমাদের প্রথম রহস্যটা ছিল কি বল তো ?—চোর কিভাবে ঘরে ঢুকল, তাই না ? তা, সে রহস্যভেদ হয়ে গেছে।’
সকলে সমস্বরে প্রশ্ন করিয়া উঠিল, ‘কি করে ? কি করে ?’
নীলরতনবাবু আঙুল দিয়া সেই ঘরের সংলগ্ন বাথরুমটি দেখাইয়া বলিলেন, ‘আশ্চর্য, এটি তোমাদের কারোই খেয়ালে এল না ! একবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি, বড় বড় গাছে কেমন জঙ্গল হয়ে রয়েছে। অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে নর্দমার পাইপ বেয়ে চোর যদি ওপরে উঠে আসে, আর বাথরুমের জানলা দিয়ে প্রথমে বাথরুমে এবং তারপরে এই ঘরে এসে ঢুকে পড়ে, তবে তাকে কে ঠেকায় বল দেখি ?’
জীবনলাল সাশ্চর্যে বলিয়া উঠিল, ‘তা কি করে হবে জ্যাঠামশাই ? বাথরুমের দরজা যে ভেতর থেকে বন্ধ ! আমরা ভোরে ঘরে ঢুকেও তো ওটাকে ওই রকম বন্ধ অবস্থাতেই দেখেছি !’
নীলরতনবাবু দারুণ থতমত খাইয়া গেলেন। বলিলেন, ‘ওঃ, বন্ধু নাকি ? সেটা তো আমি খেয়াল করিনি! ’
রণজিৎ বহুকষ্টে হাসি দমন করিয়া রাখিল, কিন্তু সুধীর বেচারা তাও পারিল না। মুচকি হাসিয়া ফুল ঠাকুরদার কানে কানে বলিল, ‘উনি বার করবেন ঘেঁচু।’
নীলরতনবাবু রাগতভাবে সুধীরের পানে তাকাইয়া বলিলেন, ‘আমায় কি তুমি উপহাস করছ সুধীর ? জানো, জীবনে আমার অভিজ্ঞতা কম নয়, বয়স পঞ্চাশ পার হতে চলল !’
‘আজ্ঞে তা সত্যি, তবে আজ আর একটা অভিজ্ঞতা বাড়ল। ‘ভূত নেই, ভূত নেই’ বলে এতদিন যে বলে বেড়াতেন, আজ বুঝলেন সেটা একটা ভুল বিশ্বাস।’
নীলরতনবাবু সজোরে মাটিতে পা ঠুকিয়া বলিলেন, ‘ভূত আলবাৎ নেই। আমি বিশ্বাস করি না।’
সুধীরও একটু রগ-চটা লোক, সে কহিল, ‘আপনি আজ একা এ-ঘরে রাত কাটাতে পারেন ?’
‘নিশ্চয়ই পারি। তবে একা নয়, সঙ্গে আমার লাঠিটা থাকবে। আমি একবার দেখব, ভূতের মাথাও লাঠির বাড়িতে ফাটে কিনা, আর সেই ফাটা থেকে রক্ত বেরোয় কিনা!’
‘বেশ, তবে তাই কথা রইল ; সময় কালে পেছুবেন না যেন!’
জবাবে নীলরতনবাবু শুধু একবার রোষকষায়িত নেত্রে সুধীরের দিকে তাকাইলেন মাত্র।
বাড়ি ফিরিয়া রণজিৎ যা দেখিতে পাইল তা সে আদপেই প্রত্যাশা করে নাই—বারান্দায় বসিয়া হুকাকাশি তাহার মেসোমশাইয়ের সঙ্গে গল্প করিতে করিতে চা পান করিতেছেন। সে হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, ‘বড় সুসময়ে এসে পড়েছেন মিস্টার হুকাকাশি, গ্রামে আজ জোর খবর।’ সকালবেলাকার সমস্ত ব্যাপার সে আদ্যোপান্ত হুকাকাশির নিকট খুলিয়া বলিল।
শুনিয়া হুকাকাশি হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, কহিলেন, ‘তাই বটে, সব কাজেই কিছু না কিছু বিদ্যা লাগে, বাদ শুধু ডিটেকটিভগিরিতে। এটা মানুষের একেবারেই বিধিদত্ত সম্পত্তি।’
‘কিন্তু ব্যাপারটাতে আপনার বিদ্যা একটু দেখাতে হচ্ছে তো ! সুধীর ঠিকই বলেছে—নীলরতনবাবু রহস্য ভেদ করবেন ঘেঁচু।’
‘তা কি হয় ? আমি, হাজার হলেও বিদেশী লোক, অযাচিত ভাবে এসব ব্যাপারে আমরাই বা কেন হাত দিতে যাব, আর ওরাই বা কেন তা বরদাস্ত করবে ?’
‘ঠিক অযাচিত ভাবে নয়। ও-বাড়ির জামাই হৃষীকেশ কলকাতার ছেলে, আমায় দেখেই চিনেছে—ফুটবলের মাঠে নাকি অনেক বার দেখেছে ; আপনার পরিচয়ও সে সবিশেষ জানে। আপনার এখানে আসবার সম্ভাবনা আছে শুনে অবধি সে ছটফট করে বেড়াচ্ছে—আপনাকে দিয়ে ব্যাপারটার একটা কিনারা করিয়ে নেবার জন্যে।’
‘তা বেশ তো ; আজকে রাত্রে আবার নতুন কি কাণ্ড ঘটে দেখাই যাক না, এত তাড়াতাড়ি কিসের ?’
পরদিন ভোর হইতে না হইতেই গ্রাম ভাঙিয়া লোক আসিয়া জুটিল জীবনলালের বাড়িতে। রণজিতের আগ্রহাতিশয্যে হুকাকাশিও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নীলরতনবাবু ঘুমাইতেছিলেন—বাস্তবিকই ঘুমাইতেছিলেন, অজ্ঞান হইয়া পড়েন নাই। লোকজনের চেঁচামেচিতে উঠিয়া আসিয়া দরজা খুলিয়া দিলেন, বলিলেন, ‘রাত দেড়টা পর্যন্ত জেগে থেকেও ভূতের দেখা পাওয়া গেল না বলে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কই, সুধীর গেল কোথায় ?’
কিন্তু তাঁহার হর্ষনাদ মিলাইতে না মিলাইতে জীবনলাল সভয়ে বলিয়া উঠিল, ‘এ কি, খাটটাকে এমনিভাবে হাতুড়ি-পেটা করে ভেঙে রাখল কে ? কাল রাতে তো এরকম ছিল না। এ কি, দরজা-জানলাও দেখি বাদ যায়নি ! অ্যাাঁ, দেওয়ালেও!’
নীলরতনবাবু ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া ঘরময় এই ধ্বংসলীলার চিহ্ন দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার মুখে তখন আর রা নাই। সুধীর বিদ্রূপের হাসি হাসিয়া বলিল, ‘কি জ্যাঠামশাই, এবার ভূতে একটু আস্থা হচ্ছে তো ?’ সে কিন্তু দেখিতে পাইল না যে তাহারই ঠিক পিছনে দাঁড়াইয়া হুকাকাশিও কি একটু ছোটমত জিনিস টুক্ করিয়া তুলিয়া নিয়া নিজের জামার পকেটে রাখিয়া দিলেন।
নীলরতনবাবু ভাঙেন তবু মচকান না। বলিলেন, ‘যে ভূত লোক জেগে থাকলে আসতে সাহস পায় না, তাকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমি ফের এই ঘরে রাত কাটাব, এবং চোখ বুজে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকব—দেখি কত বড় ভূত!’
‘নাঃ, বেঘোরে প্রাণটা খোয়ানই আপনার মতলব দেখছি, কেউ আর আপনাকে রক্ষা করতে পারল না!’ সুধীর বলিল।
নীলরতনবাবু আবার রোষকষায়িত নেত্রে সুধীরের দিকে তাকাইলেন। তারপর জীবনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘এ ঘরে অনেক নতুন ‘ক্লু’ আমদানি হয়েছে, সেগুলি ভাল করে পরীক্ষা করতে হবে। সাবধান, কেউ যেন তাতে হস্তক্ষেপ না করে। তুমি এক্ষুণি এ-ঘর তালাবন্ধ করে ফেলবার বন্দোবস্ত কর।’
কিন্তু ‘ক্লু’ লইয়া আস্ফালন করার স্বভাব যাঁর কোন কালেই দেখা যায় নাই, রণজিৎ দেখিল সেই হুকাকাশি সকলের অলক্ষ্যে মেঝে হইতে আবার কি যেন একটা কুড়াইয়া নিয়া পকেটের মধ্যে ফেলিলেন।
সকলে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিবার পর হুকাকাশিকে একা পাইয়াই রণজিৎ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি, কিছু আঁচ করতে পারলেন ব্যাপারটার ?’
‘পেরেছি বৈকি, বারো আনাই তো পরিষ্কার হয়ে গেছে ; এখন শুধু হৃষীকেশবাবুকে গোটা দু’চার কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে। তিনি গেলেন কোথা ?’
হৃষীকেশ সাড়া পাইয়া নিকটে আসিতেই হুকাকাশি তাহাকে সঙ্গে লইয়া বাড়ির বৈঠকখানায় ঢুকিলেন। রণজিৎ বাইরে দাঁড়াইয়া চিন্তা করিতে লাগিল—এ অবস্থায় বৈঠকখানায় গিয়া উপস্থিত হওয়াটা তাহার উচিত হইবে কিনা। কিন্তু সে কিছু মীমাংসা করিবার আগেই দেখিতে পাইল, হুকাকাশি এবং হৃষীকেশ উভয়েই হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া আসিতেছেন।
বাড়ি ফিরিয়া হুকাকাশি ধীরে ধীরে পকেট হইতে দুইটি জিনিস বাহির করিলেন ; এগুলিই আজ তিনি জীবনলালের বাড়িতে কুড়াইয়া পাইয়াছেন। প্রথমটি একতাল শক্ত পুডিং, অর্থাৎ যে জিনিস দিয়া জানালায় এবং আলমারিতে কাচ লাগানো হয়। এ পুডিংয়ের তালটির একটা দিক কিন্তু কে যেন সযত্নে নানা রঙে ছোপাইয়া রাখিয়াছে। দ্বিতীয় দ্রব্যটি হইতেছে খানিকটা সরু অথচ শক্ত সূতা, তাহারও আবার একদিকের মাথায় এবং তার অল্প নিচে দুইটি গিঁট দেখা যাইতেছে । হুকাকাশি একটু মৃদু হাসিয়া সেগুলি দেখাইতে দেখাইতে বলিলেন, ‘এরাই রহস্যের সন্ধান আমায় অনেকখানি বলে দিয়েছে।’
‘ভারি একচোখা তো দেখছি এরা, আমায় যে কিছুতেই বলছে না !’
‘বলবে, বলবে ; ক্রমে সবই বলবে। আপনার ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসটা একবার বার করে রাখবেন তো, খাওয়া-দাওয়ার পর আমি একটু বেরুব। তখন আর আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না, কিন্তু রাত দুপুরে, সজাগ থাকবেন, একবার ভূত-দর্শনে রওনা হতে হবে।’
দুপুর রাত্রে রণজিৎকে সঙ্গে লইয়া হুকাকাশি চুপি চুপি বাহির হইয়া পড়িলেন ; থামিলেন গিয়া তাঁহারা জীবনলালের বাড়িতে আসিয়া। হুকাকাশির উপদেশ মত হৃষীকেশ এবং জীবনলাল পূর্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল, চারিজনে ধীরে ধীরে আসিয়া উপস্থিত হইল ঠিক সেই ঘরটির সামনে, যেখানে আজ দু’দিন ধরিয়া এত বড় ভৌতিক কাণ্ডটা চলিতেছে। চারিজনেই স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইলেন—কেননা, ভিতর হইতে অনবরত খটখট শব্দ আসিতেছে—বেশ জোরে। হুকাকাশি দরজায় করাঘাত করিয়া বলিলেন, ‘নীলরতনবাবু, দোর খুলুন।’
তৎক্ষণাৎ ভিতরের শব্দ একেবারে থামিয়া গেল, কিন্তু নীলরতনবাবুর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। হুকাকাশি এবার আরও জোরে জোরে দরজায় ঘা দিতে লাগিলেন, তবুও নীলরতনবাবু যে জাগিয়া আছেন তাহার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। ব্যাপার কি ? ভূতে সাবাড় করিয়া দেয় নাই তো!
হুকাকাশি এবার এমনই জোরে দরজা ধাক্কাইতে লাগিলেন যে মনে হইল যেন কাঠের দরজা এখনই ভাঙিয়া পড়িরে। সে আওয়াজে অতি বড় কুম্ভকর্ণেরও ঘুমের নেশা টুটিয়া যায়, নীলরতনবাবুরও গেল। চোখ রগড়াইতে রগড়াইতে নিদ্রালু চোখে দরজা খুলিয়া দিয়া তিনি বলিলেন, ‘কে ? অ্যাঁ, ব্যাপার কি ?’
‘চমৎকার অভিনয়ের ক্ষমতা আপনার ! কিন্তু যে কাজটি শুরু করেছিলেন, চটপট আগে সেটা শেষ করে ফেলুন তো !’
নীলরতনবাবু একেবারে যেন কাঠ হইয়া গেলেন, সমস্ত মুখ ভয়ে তাঁহার সাদা হইয়া গেল। হুকাকাশি এইবারে হুঙ্কার ছাড়িলেন, ‘ধরুন শাবল ! দেখছেন আপনি একা, আমরা দলে চার-চারজন।’
জীবনলাল, হৃষীকেশ, রণজিৎ—তিনজনেই একেবারে হতবাক। তাহারা সবিস্ময়ে দেখিল, নীলরতনবাবু ধীরে ধীরে বিছানার উপর হইতে ‘শাবল’ লইয়া আসিলেন। কিন্তু বলিয়া না দিলে, এবং নিচের ধারালো দিকটা লক্ষ্য না করিলে, কে বলিবে এটি লাঠি নয়, শাবল—এমনি সুকৌশলে অস্ত্রটিকে রং করিয়া লওয়া হইয়াছে। শাবলের সাহায্যে নীলরতনবাবু দেওয়ালের একটা বিশেষ জায়গা খুঁড়িতে লাগিলেন। সেখানকার ফাঁপা ইঁট খসিয়া পড়িল, তারপর সে ইঁটের অন্তরালে পাওয়া গেল ছোট্ট একটা কৌটা। হুকাকাশি ত্রস্তহস্তে কৌটাটা খুলিয়া ফেলিলেন—ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল একখানি অত্যুজ্জ্বল আসল মরকত মণি !
নীলরতনবাবু পাণ্ডুর মুখে জীবনলালকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘বাবা জীবনলাল, আমি এবং তোমার বাবা—দুজনার কেউই নিষ্পাপ নই। প্রথম জীবনে আমরা দুজনে একত্র বোম্বাইয়ে কাটিয়েছিলাম, সেখানে আমাদের প্রধান কাজ ছিল লোক ঠকানো ব্যবসা। তোমার বাবা—কোথা থেকে এবং কি করে জানি না—এই মণিখানা বাগিয়েছিলেন, আমায় বখরা দিতে অস্বীকার করে বসলেন ! আমার বখরা মারা গেল। এদিকে মণি খোয়া যাবার সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজ মহলে একেবারে হুলুস্থূল, থানায় থানায় খবর পৌঁছে গেল। তোমার বাবা বুঝলেন, এখন ওখানা বিক্রি করতে গেলেই বিপদ—বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে, যাতে ক্রমশ লোকে যেন ব্যাপারটার কথা ভুলে যায়। এর পরেই কোথায় যে সেটা তিনি লুকিয়ে ফেললেন, আমি আর তার কোন পাত্তাই পেলাম না। তারপর তাঁর মারা যাওয়ার অনেকদিন পরে, সেদিন তোমাদের লাইব্রেরিতে বসে বসে বই ঘাঁটছিলাম, হঠাৎ তোমার বাবার একখানা পুরোন নোটবুক আমার হাতে এল। দেখলাম সব পাতায় লেখা, শুধু মাঝের একখানা পাতা সাদা রয়েছে। আমরা পরস্পর পরস্পরের হালচাল সমস্তই জানতাম, বুঝলাম ওটা আর কিছুই না, অদৃশ্য কালিতে—দুধ দিয়ে—কোন বিশেষ গোপনীয় খবর লেখা হয়েছে। পাতাখানা তখুনি ছিঁড়ে বাড়ি নিয়ে এলাম। অল্প একটু আগুনের আঁচে ধরতেই দুধের লেখা ফুটে বার হল—তাতে এ ঘরের পূব দিকের দেওয়ালের একটা বিশেষ জায়গার কথা লেখা আছে। ছাদ থেকে ছ’ ফুট নিচে, দেওয়ালের বাঁ কোণা থেকে ডানদিক পানে তিন ফুট দূরে। বুঝতে পারলাম মরকত মণি কোথায় লুকোনো আছে তারই বিষয় এটা একটা ‘নোট’ ।’
হুকাকাশি হাসিয়া বলিলেন, ‘তারপর আপনি চালাকিটা খেললেন পাকা ওস্তাদের মত। বাড়িতে বিশিষ্ট অতিথ-বিতিথ এলে তাকে এই ঘরেই শুতে দেওয়া হয় তা আপনার জানা ছিল, জীবনলালবাবুকে গিয়ে বললেন, ‘বোনাই এসেছে একটা জলসা-টলসার আয়োজন কর।’ বাড়ির ছেলে-বুড়ো, মেয়ে-পুরুষ সবাই যখন গানে মশগুল হয়ে আছে, তখন অন্ধকারে চুপিসারে সোজা এই ঘরে চলে এসে ওই বাথরুমটাতে লুকিয়ে রইলেন। জীবনে জোচ্চুরি বিদ্যাটা ভালমতই শিখেছিলেন, ভোল বদলাবার তাই নানান ফন্দি-ফিকিরই জানা আছে। সাজ-সরঞ্জাম লুকিয়ে সঙ্গে আনতে ভোলেননি, সেগুলির দৌলতে মুখের ও হাতের রং ধবধবে সাদা হয়ে গেল, চাঁছা চিবুকের উপর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি গজাল, টাকের উপর সোজা সিঁথিকাটা পরচুলা উঠল—ঠিক যেমনটি মাখনবাবুর ছিল। তারপর খাসা ভূতের অভিনয়। হৃষীকেশবাবু ওঁর শ্বশুরকে দেখেননি, ওঁকে ভাওঁতা দিতে আর কি ! পাড়াগাঁয়ে ভূতের ভয়টা একটু বেশি তা আপনার অজানা নেই, কাজেই সবাই যখন বড্ড-বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠবে তখন আপনি কৌশলে এমনি একটি অবস্থার সৃষ্টি করে আনবেন যাতে ভূত নেই প্রমাণ করবার জন্য সমস্ত রাত্রি এ-ঘরেই আপনার স্থিতি হতে পারে। প্রথম রাত্রিটাতে আপনি আর আসল কাজটিতে হাত দিলেন না, লোক-দেখানো লাঠি, মানে শাবলটির সাহায্যে সমস্ত ঘরটা শুধু বেপরোয়া ঠুকে দিলেন। এতে করে এক ঢিলে দুই পাখিই মারা পড়ল—দেওয়ালের উপর শাবলের ঘা পড়লে বাস্তবিকই কেউ ছুটে আসে কিনা সেটাও পরখ করা হল, আর প্রকারান্তরে সমস্ত গাঁ’কে জানিয়ে দেওয়া হল যে, ওই ঘরটার ওপর ভূতের ভারি আক্রোশ, ভবিষ্যতে যদি দেখ দেয়ালকে দেয়ালই ভূতে ফুঁড়ে দিয়েছে তবুও আশ্চর্য হয়ো না। সমস্ত আটঘাট বেঁধে আজ কাজে নেমেছিলেন। আপনার বিশেষ সুবিধা হয়েছিল এই যে, ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গও কেউ জানত না। জীবনবাবুর বাবা সাপের কামড়ে হঠাৎ মারা পড়েন মরকত মণির কথা ওঁকে বলে যাবার অবসর পাননি। নীলরতনবাবু, আপনার মাথার বাস্তবিকই দাম আছে।’
বাড়ি ফিরিবার পথে হুকাকাশি রণজিৎকে উদ্দেশ করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘লোকটার সমস্ত চালাকি কি করে ধীরে ধীরে আমার চোখে খোলসা হয়ে গেল শুনুন, বলছি । ঘরে ঢুকেই আমার নজরে এল পুডিং-এর মত কি একটা জিনিস মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে। কিন্তু ভারি আশ্চর্য সেটা, কেননা তার একটা দিক সাধারণ পুডিং-এরই মত, কিন্তু অপর দিকটা ঠিক নীলরতনবাবুর লাঠির সঙ্গে রং মিলিয়ে রং করা—হলুদের উপর ঘন ঘন লালের ছিট। আশ্চর্য হয়ে তাড়াতাড়ি লাঠিটার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে খানিকটা জায়গা ভেঙে গেছে, আর ভেতর থেকে একটা শাবলের ধারালো দিক দিব্যি উঁকি মারছে। তার মানে এই যে শাবলের ধারালো দিকটাকে পুডিং দিয়ে ঠিক লাঠির মত গোল করে নেওয়া হয়েছিল। ঠিক সেই সঙ্গে নীলরতনবাবুর চোখও সেদিকে পড়ল। চক্ষের পলকে শাবলের মাথার দিকটা নিচুতে, আর নিচের দিকটা ওপরে এনে এমনি ভাবে ও-জায়গাটাকে উনি হাতে মুঠোর ভেতর চেপে ধরলেন যে কোন ক্রমেই আর কারো দৃষ্টি সেদিকে না পড়তে পায়। লোকটির এই লুকোচুরি দেখে গোড়াতেই যদি তার উপর আমার একটু সন্দেহ জেগে থাকে, তবে সেটা কি খুব অন্যায়?
‘এর পরেই একটা সুতো ঠিক ওঁর বিছানার নিচে দেখতে পাওয়া গেল—কি ধরণের সুতো তা তো আজ সকালেই আপনি দেখেছেন। ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই রকম : লোকটা গোপনে একটি শাবল আমদানি করে এ ঘরে রাত কাটাতে এসেছিল। লোকে শাবল ব্যবহার করে কি জন্যে ? নিশ্চয়ই কোনও কিছু খোঁড়ার জন্যে। ও ঘরে খোঁড়া চলতে পারে এমন কি আছে ? আছে দুটো জিনিস, ঘরের মেঝে আর ঘরের দেয়াল । নিশ্চয়ই এ দুইয়ের একটা কিছু খুঁড়তেই সে এসে থাকবে। যে লোক শাবল হাতে ঘর খুঁড়তে আসে, তার কাছে যদি গিঁট দেওয়া লম্বা একটা সুতো পাওয়া যায় এবং দেখা যায় যে শেষ গাঁটের পর থেকেই সব সুতো সযত্নে কাঁচি দিয়ে কেটে বাদ দিয়ে ফেলা হয়েছে, তবে স্বভাবতই কি সন্দেহ মনে জাগে ? এই সন্দেহ যে, কোন বিশেষ জায়গাটি খুঁড়তে হবে, সেইটি মেপে দেখারই ওটি একটি উপকরণ। হঠাৎ সেই সময়ে দেয়ালে, ঠিক আমার মাথার কাছটাতে নজর পড়তেই দেখতে পেলাম, সেখানে কে যেন রুল পেন্সিল দিয়ে ছোট্ট একটি x এঁকে রেখেছে। এইটাই খোঁড়বার জায়গা নয় তো ? দেখতে হবে তো !
‘কথা বলবার ফাঁকে ফাঁকে নীলরতনবাবুর সতর্ক চোখ যে অনবরত খসে-পড়া পুডিংয়ের টুকরোটা খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তাও লক্ষ্য করতে আমার ভুল হয়নি। তিনি যখন জীবনলালবাবুকে ঘরটা তালাবন্ধ করে রাখতে হুকুম করলেন, তখনও তাঁর আসল উদ্দেশ্য বুঝতে আমার বাকি রইল না। আর একবার ‘ক্লু’ খোঁজবার অজুহাতে এসে ঘরটি তন্নতন্ন করে দেখে যাবেন, ওটা ওখানেই পড়ে আছে কিনা। ইতিমধ্যে ওটা আর কারো হাতে এসে না পড়ে, তাই তালাবন্ধের ব্যবস্থা। প্রথম রাত্রেই নীলরতনবাবু যে দেয়াল খুঁড়তে আরম্ভ করেননি, তাতে আমি একটুও বিস্ময় বোধ করিনি—সে রাত্রে তিনি শুধু ঘরটাকে শাবল-পেটা করে কাজ এগিয়ে রেখে গেছেন—কি উদ্দেশ্যে তা আগেই বলেছি।
‘আজকে দুপুরবেলা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস হাতে আমায় বেরুতে দেখে আপনি বিস্ময় বোধ করেছিলেন, কিন্তু এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন, কেন আমায় ওটা সঙ্গে করে বেরুতে হয়েছিল। নীলরতনবাবু যে আবার শিগগিরই ও ঘরে ফিরে আসবেন, তা আমি জানতাম। যখন দেখবেন পুডিং নিখোঁজ, তখন সতর্ক হবার উদ্দেশ্যে দেয়ালের x চিহ্নটাও তিনি মুছে রেখে যাবেন, কেননা এ অবস্থায় ওটা রেখে যাওয়া ভাল নয় ; রাত্রে আসার পর ফের মেপে নিলেই চলবে। তা তিনি মুছুন, জায়গাটার সম্বন্ধে আমার একটা মোটামুটি ধারণা আছে, ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের সাহায্যে ঘষার দাগ বার করা খুব শক্ত হবে না। কিন্তু সুতোটা সরিয়ে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, নীলরতনবাবুকে তাহলে বড্ড বেশি সাবধান করে দেওয়া হবে। তাই ওখান থেকে বেরিয়ে আসবার আগে হৃষীকেশবাবুকে একটু উপদেশ দিয়ে আসা দরকার হল। সেটা আর কিছু নয়, প্রথমত তাঁকে দিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে গোপনে আর একটি ওই রকম সুতো আনিয়ে, ঠিক প্রথমটার মাপে মাপে দুটো গিঁট দিয়ে নেওয়া গেল ; তারপর হৃষীকেশবাবুর হাতে প্রথম সুতোটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে দেওয়া গেল যে, নীলরতনবাবু ফিরে আসবার আগেই সেটা যেন খাটের পাশে তিনি ফেলে রেখে আসেন।
‘এর পর আর বেশি কিছু বলবার নেই। দুপুরে এসে ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের সাহায্যে ‘ঘষা জায়গাটা’ বার করতে আমার কোন বেগ পেতে হয়নি, এবং সুতোর ওপরের গিঁটটা সেই জায়গায় রেখে যখন দেখা গেল তার অন্য দিকের মাথা ঠিক টাঁয়টোঁয় ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে, আর দ্বিতীয় গিঁটটা রেখে যখন দেখলাম সুতোর অপর দিকে দেয়ালের বাঁ কোণায় এসে থেমে যাচ্ছে, তখন হাতেনাতেই প্রমাণ পাওয়া গেল যে শাবল যেমন লাঠির ‘প্রতিনিধি’, সুতোও তেমনি মাপের ফিতার ‘প্রতিনিধি’। তারপর নীলরতনবাবুও যে ভূতেরও প্রতিনিধি, তা তো আপনারাই স্পষ্ট দেখতে পেলেন।’
এই ঘটনার কিছুদিন পরে বোম্বাইয়ের একটা প্রসিদ্ধ সদনুষ্ঠানে কোন অজ্ঞাত দাতার নিকট হইতে একখানি মরকত মণি উপহার আসিল। সঙ্গের চিঠিতে লেখা ছিল, ওটি ‘বোম্বাইয়েই’ পাওয়া গিয়াছিল—প্রকৃত মালিকের সন্ধান না মিলিলে যেন কোন সৎকার্যে লাগানো হয়। পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয় বুঝিয়াছেন যে এই অজ্ঞাতনামা দাতাটি জীবনলাল ছাড়া আর কেউ নয়।