চট্টগ্রাম – সারোয়ালি ধলঘাট ভাটিকাইন গোমদন্ডী

চট্টগ্রাম

সারোয়ালি

সুদীর্ঘ আট-দশ হাত চওড়া আরাকান রোডের দু-পাশে দেখা যায় আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের এক বিশিষ্ট রূপ। রাস্তার দু-ধারে সারবন্দি বড়ো বড়ো গাছ–অশ্বথ, বট, আম, সোনালু আর গামার। নব কিশলয়ে ফুলে ফুলে তাদের বসন্তশ্রী মনে জাগায় সৃষ্টিকর্তার রসমাধুর্য। কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরি রং ধরায় মানুষের মনে, ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস বকুলফুল কুড়োবার জন্যে ডাকে।

অদূরে ‘করেলডেঙ্গা’ পাহাড়। নিবিড় শ্যামল আস্তরণের ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙের ফুলের সমারোহ। সোনালি রঙের সোনালু ফুল, বেগুনি রঙের গামার, বনকরবী, অজস্র কাঠ-গোলাপ ও কাঠ-মল্লিকা। পাহাড়ের গা-বেয়ে ছোটো ছোটো ঝরনা নেমে এসেছে, তার পাশে কোথাও কোথাও শণখেত। নীচে দিগন্তপ্রসারী মাঠ, বুকে তাদের নানান ফসল। তারপরই আম, জাম, সুপারি, নারকেল আর খেজুর গাছের ঘন অন্তরালে আমার জন্মভূমি কঞ্জুরি মৌজার সারোয়াতলি গ্রাম। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় থেকে বাইরের লোকে জেনেছে ‘সেওড়াতলি’ বলে।

কর্ণফুলির বহু শাখাপ্রশাখা গাঁয়ের ভেতর প্রবেশ করেছে। ছবির মতো তাদের রূপ তাদের প্রায় সবগুলিতেই বারোমাস নৌকা চলে।

আষাঢ়-শ্রাবণের ঘন বর্ষণেও রাস্তাঘাট ডোবে না, চারিদিক অপূর্ব শ্যামশ্রীতে ভরে যায়। পুকুর-দিঘির টলটলে জলের ওপর নানা রঙের শাপলাফুল ও পদ্মের অপরূপ সৌন্দর্যে চোখ জুড়ায়।

ভরা বর্ষায় খালেবিলে ছোটো নেংটি-পরা ছেলে-মেয়েদের মাছ ধরার হিড়িক পড়ে। এক একটি মাছ পলো চাপা পড়ার পর তাদের উচ্ছ্বসিত হাসি ও চিৎকারে প্রকৃতির সজল রূপের মাধুর্য বেড়ে যায়।

শ্রাবণ মাসের আনন্দমা মনসার আগমন। পয়লা শ্রাবণে ঘরে ঘরে মা মনসার ঘট বসে –প্রতিরবিবার ঘটের পল্লব বদলানো হয়। প্রত্যেকদিনই মনসার পুথি পড়া হয়—’বাইশ কবি মনসাপুথি’ অর্থাৎ বাইশজন কবির লেখা মনসামঙ্গল। একজন সুললিত কণ্ঠে পুথি পড়েন –কয়েকজন দোহার ধরেন। মধ্যে মধ্যে চলে গীতবাদ্য। কোনো কোনো বাড়িতে এই উপলক্ষ্যে ভোজ হয়। সংক্রান্তির দিন ঘটা করে মায়ের পুজো। পুজোয় পাঁঠা, হাঁস, কবুতর বলি পড়ে। কেউ কেউ বলি দেন আখ বা চালকুমড়ো৷

আসে শরৎ। শারদলক্ষ্মীর শুভ আগমনে প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে। ভোরবেলার শান্ত বাতাসে ভেসে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ, দারোগাবাড়ির মঙ্গল আরতির ঘণ্টা, কাঁসর-শাঁখের পবিত্র শব্দ আর বড়োপিরের দরগা থেকে আসে সুমধুর আজান ধ্বনি।

দুর্গা পুজোয় নাগ ও মহাজনদের বাড়িতেই ধুমধাম হয় সবচেয়ে বেশি। গ্রামের প্রায় সবাই তাতে যোগ দেয়। তবে বিশেষ করে নাগেদের বাড়ির নবমী পুজোর বলি দেখবার জন্যে সারাগ্রামের লোক ছুটে যায়। বলির মোষের শিং দুটি সিঁদুরে রাঙিয়ে তার গলায় বেলপাতা ও জবা ফুলের মালা পরানো হয়। সাজতে হয় ঘাতককেও। মাথায় জবাফুলের মালার পাগড়ি, হাতে খঙ্গ–সালুপরা, সিঁদুর-রঞ্জিত সেই মূর্তিকে আজও ভুলতে পারিনি! ভুলিনি বলির পর তার ‘ঘাতক নাচ।

মনে পড়ে ছোটোবেলায় একবার বলির আগেই ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। বলির মোষের চোখের কোণে জলের ধারা আমার শিশুমনের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিল–আজও সেই ছবি আমার মন থেকে মিলিয়ে যায়নি।

পুজোর উৎসবের পরই মনে পড়ে ধান কাটার আনন্দের কথা। কোনো কোনো গৃহস্থের ধান কাটার সময় ঢাক-ঢোলের বাদ্য-বাজনা হত। অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আসামি তারকেশ্বরদাদের জমির ধান কাটা দেখতে জড়ো হতাম ছেলেবেলায়। খুব ভোরে বাজনদারেরা এসে সানাইয়ের তান ধরতেই দলে দলে চাষির দল জমায়েত হত। রাঙা গামছা কোমরে বেঁধে, কাঁচির ডগায় সিঁদুর লাগিয়ে সবাই রওনা হত মাঠের দিকে। মাঠজোড়া অনেক জমি, তাতে ধান কাটা চলত দিনরাত। সঙ্গে চলত বাজনা আর চাষিদের খাওয়া।

তারকেশ্বরের মা সবার বড়োমা। তিনি ধান বরণ করতেন দুৰ্বায়, বরণকুলায়, মঙ্গলঘটের জলে আর মঙ্গলপাখার বাতাসে। প্রথম আঁটি ধান এইভাবে ঘরে আনা হত। চাষিরা বিদায় পেত নতুন কাপড় ও গামছা।

চাষিদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সব জাতই থাকত এবং তারা সবাই এইসব অনুষ্ঠান পালন করত।

চৈত্র মাসে হত ‘গৌরীর নাচ’। হিন্দু-মুসলমান সবাই এই উৎসবে যোগ দিতেন। ঢাকি-টুলি চলে মনোজ্ঞ ফুলসাজে সজ্জিত হরগৌরীর পিছু পিছু। গ্রাম হতে গ্রামান্তরে শোভাযাত্রীরা গেয়ে বেড়ায়,

আজুয়া গৌরীর মালা-চন্দন
কালুয়া গৌরীর বিয়া,
ওরে গৌরীরে নিতে আইল শিব
চুয়া-চন্দন দিয়া।…

মূল গায়েন গায় ‘আজুয়া গৌরীর…’ ইত্যাদি। পিছনে সবাই ধুয়া ধরে। বাজনার তালে তালে হরগৌরী নাচে।

ছোটো একখানা পেতলের সরাই থাকে গৌরীর হাতে। নাচের ফাঁকে ফাঁকে গিন্নিমাদের কাছে তাদের পাওনা আদায় করে।

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে বলে ‘ফুলবিষু’। এই নামকরণ অর্থহীন নয়। ফুলের মালায়, নিমপাতায় আর কেয়া কাঁঠালের ফালিতে বাড়ির দরজা-জানালা সাজানো হয়। বাড়ির সব কিছুকেই মালা পরানো হয়, এমনকী আসবাবপত্র এবং গৃহপালিত পশু-পক্ষীও বাদ পড়ে না।

চৈত্র সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে থেকেই ঘরে ঘরে খই, চিড়া, নারকেল, তিল, চালতা, কুল ও গুড় প্রভৃতির মিশ্রণে নাড় তৈরি হয়। এই নাড়কে আমাদের চাটগাঁয় বলে ‘লাওন। সংক্রান্তি বা বিষ্ণুপর্বের দিন চলে এই ‘লাওন’ খাওয়ার উৎসব। এই উৎসবের মধ্য দিয়েই হত বর্ষাবিদায় এবং হিন্দু-মুসলমানের নববর্ষ বরণের আন্তরিক শুভকামনার বিনিময়।

জ্যৈষ্ঠ মাসে চলত আম-নিমন্ত্রণ। চট্টগ্রামের পল্লির এই এক বৈশিষ্ট্য। একে অপরকে আম খেতে নিমন্ত্রণ করবেন। নিমন্ত্রণ রক্ষা না করলে অসুখী হবেন–অনুযোগ করবেন।

মোটামুটি এই হচ্ছে আমার গ্রাম সারোয়াতলির পুজোপার্বণ।

গ্রামটি একেবারে ছোটো নয়। স্কুল, ডাকঘর ও দাঁতব্য চিকিৎসালয় আছে, আর আছে মাইলখানেকের মধ্যে কানুনগোপাড়ায় একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ।

চট্টগ্রামের স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশ তার পাহাড় ও নদীর গাম্ভীর্যের মধ্যে গড়ে-ওঠা যেসব মানুষ দেখেছি, আজ তাদের মধ্যে প্রথম মনে পড়ছে যোগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়কে। ধনীর সন্তান, জমিদারের ছেলে, কিন্তু নির্লিপ্ত এই মানুষটি বিষয়বৈভবের কোনো খবরই রাখতেন না।

এল ভাগ্য বিপর্যয়। তিনি আপনা থেকে কেমন করে জানতে পারলেন যে, তাঁর গৃহদেবতা মা কালীর নিত্যভোগ বন্ধ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আহার বন্ধ করলেন। এরপর যে তিন মাসের মতো বেঁচেছিলেন, তার মধ্যে অন্ন আর গ্রহণ করেননি। একটুখানি হাসি দিয়ে সকলের অনুরোধ এড়িয়ে যেতেন।

তাঁকে দাদুমণি বলে ডাকতাম। কথার ফাঁকে বন্দি করে একদিন দাদুমণিকে অনুগ্রহণের অনুরোধ জানালাম। তাঁর করুণ মুখে মলিন হাসি অশ্রুরাশির মধ্যে ডুবে গেল। চুপি চুপি আমায় সব জানালেন, বললেন–ওই অনুরোধ তুই আর আমায় করিসনি ভাই।

আর আজ মনে পড়ে গ্রামের তারকেশ্বরদা ও রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে–’ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান’। মনে পড়ে–শাসকশক্তির অত্যাচারের করাল রূপ। তারকেশ্বর-রামকৃষ্ণের পরিচয় বাঙালি পাঠককে দিতে হবে না জানি, কিন্তু সেদিন গ্রামের উপর দিয়ে অত্যাচারের যে ঝড় বয়ে গেছে–সে-কথা স্মরণ করলে এখনও শিউরে উঠি।

চোখের উপর ভেসে ওঠে একদিনের নির্মম ছবি। ভোরবেলায় গভীর আতঙ্কে গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙল-ভয়ে কারও মুখে কথা সরে না। জ্বলে উঠল তারকেশ্বর, রামকৃষ্ণ ও বিশিষ্ট কংগ্রেসকর্মী প্রসন্ন সেন মহাশয়ের বাড়ি।

পুলিশ সুপার সুটার সাহেবের কতৃত্বাধীনে সারোয়াতলিকে মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া হল। তারা তারকাঁটা দিয়ে কালাইয়ার হাটের পাশে গ্রামের হাই স্কুলটাকে ঘিরে ফেলল। শুরু হল লাঠি-বৃষ্টি, বেয়নেটের খোঁচা ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাত। তৃতীয় শ্রেণির শিশু থেকে দশম শ্রেণির কিশোর কেউই বাদ পড়ল না– এমনকী শিক্ষকরাও প্রহারে জর্জরিত হলেন।

এই অত্যাচার থেকে বোরলা, কানুনগোপাড়া প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিও রেহাই পায়নি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর জালালাবাদে চলে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের প্রথম সশস্ত্র সম্মুখ সংগ্রাম। এই যুদ্ধের অধিনায়ক ছিলেন লোকনাথ বল। তাঁর ভাই টেগরা এবং আরও কয়েকজন সেখানে শহিদ হয়েছিলেন। তারকেশ্বর, রামকৃষ্ণের বাড়ির মতো লোকনাথদার বাড়িও ভস্মীভূত হয় সেই সময়।

তখন দেখেছি গ্রামের সকলের তাঁদের প্রতি কী সহানুভূতি ও সমবেদনা! বিদেশি শাসকের অত্যাচারে এদের মনেও বেজে উঠত বিদ্রোহের সুর।

অশিক্ষিত চাষাভুষোর দল বিদ্রোহীদের লুকিয়ে রাখতেন–তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান। তাঁদের ঘরের মায়েরাও ‘স্বদেশি ছেলেদের’ কত যত্নই না করতেন। তাঁদের মুখে প্রায়ই শুনতাম—’আহারে দুঃখিনীর পোয়া, তোরা আখেরে রাজা হবি। তোরার দুঃখ খোদার দোয়ায় ঘুচিব।’

শুনছি সেই রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের বাড়ি তাঁদেরই এক প্রজা জোর করে দখল করেছে। তারকেশ্বরদাদের বাড়ি নিয়েও চলেছে সীমাহীন লোভের হানাহানি। আর স্বর্গীয় প্রসন্ন সেন মহাশয়ের পরিবারবর্গ আজ উদবাস্তু, পশ্চিমবঙ্গে সরকারের আশ্রয়প্রার্থী। শুধু ভাবছি নিয়তির এ কী কঠোর পরিহাস!

কিন্তু এমনতর তো ছিল না। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় শহরের বাসা হতে গ্রামে চলেছি মায়ের কাছে। বেঙ্গুরা স্টেশনে পৌঁছে দেখি, চলার পথ অথৈ জলের তলায় আত্মবিলোপ করেছে, চলাচল হচ্ছে ‘সামপানে’। কিছুদূর চলার পর সামপানও আর চলে না। হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই মাইলখানেক পথ। অবর্ণনীয় সেই দুঃখের ইতিহাস। অনভ্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলেছি। সঙ্গে চাকর অমূল্য, তার মাথায় ভারী বোঝা। কজেই তার সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা।

কিছুদূর গিয়েই পড়লাম এক চোরা গর্তে। বুক পর্যন্ত ডুবে গেলাম। কাপড়চোপড় ভিজে জলে কাদায় একাকার হয়ে গেল। ঠিক এমন সময় সহাস্য মুখে এগিয়ে এলেন নুর আহম্মদদা। অতিকষ্ট করে আমায় পার করলেন সযত্নে। মাকে এসে সহাস্যে বললেন—’আখুড়ি, তোয়ার মাইয়া দি গেলাম–আঁয়ার লাই মিঠাই আন।’

মায়ের মুখের মিষ্টি হাসি–তাঁর হাতের সামান্য পুরস্কারই অসামান্য ছিল নুরদার কাছে। কিন্তু সেদিন কোথায় গেল?

কে জানে মহাকালের রথচক্রতলের এই নিষ্পেষণ কবে শেষ হবে? জানি শেষ হবে, হবে এই বিচ্ছিন্ন জাতির মিলন। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ভাষাগত, কৃষ্টিগত ঐক্যের মধ্য দিয়ে সেই শুভদিন আবার আসবে।

.

ধলঘাট

বৈশাখ মাস। গরমের ছুটির দেরি নেই আর। স্কুলে আসার পথে দেখে এসেছি বুড়াকালী বাড়ির ধারে দত্তদের বাগানে পাকা সিঁদুরে আম ঝুলছে। টিফিনের ছুটিতে দল বেঁধে ছুটলাম কিশোর বন্ধুদের নিয়ে। আনন্দে মত্ত হয়ে আম পাড়ছি, এমন সময় আমাদের তেড়ে এল একটি লোক ‘চোর! চোর!’ বলে। যে-যার প্রাণ নিয়ে দৌড়োলাম। কোঁচড়ে বাঁধা আমগুলো রাস্তায়, পুকুরে, ডোবায় পড়ে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুলের দরজায় এসে পৌঁছোলাম। দেখলাম–সেই লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার দুষ্টু হাসি। সে আমায় ইশারায় ডাকলে, ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেলাম। লোকটি স্কুলের ছেলেদের পরিচিত, নাম ‘তারা পাগলা’, রাতদিন কালীবাড়ির সামনে বসে বিড়বিড় করে কী বলে, পুকুরে একগলা জলে নেমে একটির পর একটি ডুব দেয়, তারপর ভিজে কাপড়ে উঠে এসে আবার ঢোকে কালীমন্দিরের ভেতর। কোনো কাজকর্ম নেই তার, খাওয়া-পরার ঠিক নেই, কথাবার্তায় সুস্থ মনের পরিচয় পাওয়া যায় না। স্কুলের ছেলেরা তাকে খ্যাপায়, সে ছুটে আসে তাদের মারতে।

‘তারা পাগলা’ আমায় ডাকল কেন–দূর থেকে জানতে চাইল আমার সহপাঠীরা।

অদূরে গাছতলায় বসে আমার হাতটি দেখে পাগলা বললে, এবার পরীক্ষায় তুই ‘ফাস্ট হবি, ভালো করে পড়াশুনো করিস, বুঝলি?

আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমারই একজন সহপাঠী জিজ্ঞেস করল, আমি?

পাগলা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলে, তুই সপ্তজন্মেও পাশ করতে পারবি না। কারখানার কুলি হবি তুই, তোর পড়ার দরকার কী?

তারা পাগলের কথা সত্যি হয়েছিল, সে-কথা মনে পড়ছে আজ। কিন্তু সেদিন চপল কিশোরচিত্তের হাজার কথার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল এই সাধকের ভবিষ্যদ্বাণী।

এই তারা পাগলাই তারাচরণ পরমহংসদেব হয়েছিলেন উত্তরকালে। তাঁর সাধনার পীঠভূমি বুড়াকালী বাড়ি পরিণত হয়েছিল হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে। সত্যের মহিমায়, সাধনার গরিমায় এই সিদ্ধ মহাপুরুষের সাধনার ক্ষেত্র ‘ধলঘাট’ এমন করে ছেড়ে আসতে হবে তা কী জানতাম!

উত্তরে আর দক্ষিণে হারগেজি খাল টেনে দিয়েছে গ্রামখানির সীমারেখা। পশ্চিমে অবারিত মাঠ মিশে গেছে দিগন্তে, পূর্বে অনুচ্চ করেলডেঙ্গা পাহাড় আকাশের দিকে চেয়ে আছে স্থির নেত্রে। চারদিকে মাঠ আর সবুজের প্রাচুর্য।

একধারে নদী বয়ে চলেছে কুলুকুলু নাদে, আর একধারে পড়ে আছে ধু-ধু মাঠ, তার বুকের উপর দিয়ে এঁকে-বেঁকে অগ্রসর হয়েছে গ্রামের বিস্তৃত পথখানি। ছায়াঘন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ছোট্ট কুটির, মধ্যবিত্তের মাটির দোতলা কোঠা, সানবাঁধানো ঘাট, গোয়াল, গোলা, পুকুর-দিঘি-বাগান, বাঁশঝাড়। যেন তুলি দিয়ে আঁকা। কোথাও এতটুকু আবর্জনা নেই, কোলাহল নেই, গ্রামবাসীরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে–মাঠে চাষ করছে চাষি, জেলে পুকুরে মাছ ধরছে, রাখালেরা বটগাছের তলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে, কেউ বা খেলছে ডান্ডাগুলি, কেউ বা ব্যাটবল দিয়ে খেলছে ক্রিকেট, স্কুলের ছেলে-মেয়েরা বই বগলে করে ছুটছে স্কুলে, ব্যাঙ্কের প্রাঙ্গণে বসেছে সভা, হাসপাতালে রোগীরা দাঁড়িয়ে আছে ভিড় করে, পোষ্ট আপিসে পিয়ানকে ঘিরে বসেছে গ্রামের লোকগুলো–খোঁজ করছে চিঠির, মনিঅর্ডারের, দোকানগুলিতে জমে উঠেছে আলাপ– রাজনৈতিক, সামাজিক, ঘরোয়া। বর্ষায় যখন চারদিক জলে ভরে যায়, তখন ছবির মতো দেখায় গ্রামখানি। শরতে মাঠে মাঠে যেন সবুজের সীমাহীন রেখা, গ্রীষ্মে চোখে পড়ে ফাঁকা মাঠগুলো, বসন্তে গাছে গাছে ফুটে ওঠে নবযৌবনশ্রী।

নিরুপদ্রব একটানা জীবনযাত্রা চলেছে আবহমান কাল ধরে। বর্ধিষ্ণু আমার গ্রামখানি। কিন্তু চিরকাল তো ছিল না তার এমন উন্নত অবস্থা। আমরা যখন ছোটো ছিলাম–তখন দেখেছি আমাদের সামনের দিঘিটি জঙ্গলে আছে ভরে, রাস্তাঘাট অনুন্নত, স্কুলের গোড়াপত্তন হচ্ছে মাত্র, ব্যাঙ্ক হাসপাতালের জন্ম তখনও হয়নি। আমাদের চোখের সম্মুখে গ্রামখানি গড়ে উঠেছে।

গ্রামকে শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে ক-জন নেতৃস্থানীয় লোক এলেন এগিয়ে। তাঁদের চেষ্টায় পল্লিসংস্কার আরম্ভ হল। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সৌন্দর্যে, শিক্ষায়, দীক্ষায় সকল বিষয়ে আমাদের গ্রামখানি হল সেরা। অভাব বলতে ছিল না কিছুরই। শহরের সঙ্গে যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত আছে, রেলপথে মাত্র চল্লিশ মিনিটের রাস্তা, জলপথেও ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। গ্রাম, তবু শহরেরই মতো। তার চেয়ে বরং সুন্দর। গ্রামের মধ্যে অহিন্দুর বসতি নেই, কিন্তু চতুম্পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের মুষ্টিমেয় মুসলমান ও অহিন্দুরা গৌরবের সঙ্গে এই গ্রামেরই অধিবাসী হিসাবে আত্মপরিচয় দেয়।

বঙ্গবাণী, বাণীমন্দির, সাবিত্রী, শৈলসংগীত, সিন্ধুসংগীত, স্বর্গে ও মর্ত্যের রচয়িতা কবি শশাঙ্কমোহন সেনের জন্ম এই ধলঘাট গ্রামে। Star of India জগদ্বন্ধু দত্তের জন্মভূমিও ধলঘাট। দানবীর নিমাই দস্তিদার– চট্টগ্রাম শহরের Outdoor হাসপাতাল যাঁর অক্ষয় কীর্তি তিনিও এখানকারই।

ছিপ দিয়ে মাছ ধরা এ গ্রামের বৈশিষ্ট্য। কানুর দিঘিতে মাগনের দিঘিতে, ক্যাম্পের পুকুরে, পেঙ্কারদের দিঘিতে চারকাঠি বসিয়ে টঙের ওপর বসে শিকারিরা মাছ ধরে। এক একটি মাছ যেন এক-একটি জানোয়ার। ওজন দেড়মন-দু-মন। বিকেলে বঁড়শিতে আটকালে তাকে ডাঙায় তুলতে রাত হয়ে যায়। এত বড় রুই-কাতলা যে পুকুরে থাকতে পারে, এ ধারণা না দেখলে কেউ করতে পারে না।

একটা ঘটনা মনে পড়ে। শীতের দিন। কনকনে শীত পড়েছে। টঙের ওপর বসে আছি ছিপ ধরে। হাটবার ছিল সেদিন। ব্যাপারীরা, ক্রেতারা সব চলেছে দলে দলে। যেতে যেতে তারা মন্তব্য করছে, বাবুদের মাথা খারাপ, এমন শীতে কে কোথায় মাছ ধরেছে? পরিচিত লোক। বললাম, ফিরবার সময় এদিকে এসে দেখে যেয়ো কেমন মাছ ধরেছি।

বিকেলের দিকে সত্য সত্যই একটা মাছ লাগল। মন-খানেক হবে তার ওজন। বিরাট রুই। মাছটি তুলে খেজুর গাছের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখলাম। হাট থেকে ফেরবার পথে লোকগুলো অবাক হয়ে দেখে বাড়ি ফিরল।

জমিদার এখানে নেই, আছে মধ্যবিত্ত। তারা বুকের রক্ত দিয়ে তাদের জন্মভূমিকে পুরুষানুক্রমে করেছে উন্নত। এখানে বাস করে কৃষক-যুগি-তাঁতি-মেথর-হাড়ি-ডোম–যারা শুধু নিজেদের ব্যাবসা নিয়ে পড়ে থাকে না, দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করবার সময়টুকু সকলেই করে নেয়। যারা নিরক্ষর তারাও রাজনীতি সম্বন্ধে দু-কথা বলতে পারে, সকলের এ রাজনীতি সম্বন্ধীয় জ্ঞান এ গ্রামের বৈশিষ্ট্য। বারো মাসে তেরো পার্বণ এখানেও অনুষ্ঠিত হয় এ জেলার আর সব জায়গারই মতো।

গ্রামের এমন পরিবেশের মধ্যে কোথাও উদবেগ নেই, অশান্তি নেই, আছে পরস্পর সহযোগিতা, হিন্দু-মুসলমানে প্রীতি ও পল্লি উন্নয়নের সমবেত প্রচেষ্টা।

আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে যখন গ্রামখানি মাথা তুলে দাঁড়াল সকলের ওপরে, তখন হঠাৎ ব্রিটিশের রোষদৃষ্টি পড়ল গ্রামবাসীর ওপর। শহরের কাছাকাছি, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়-প্রধান গ্রামখানি সন্ত্রাসবাদের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠল।

গভীর রাত্রি, সূচীভেদ্য অন্ধকার। রাত্রের অন্ধকারের বুক চিরে ফুটে উঠল একটি অস্পষ্ট আলোর রেখা। তারপর গুলির আওয়াজ। একটি গুলি আমার কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে চলে গেল। বুঝতে পারলাম না কিছুই। কিছুক্ষণ সব নীরব। তারপর একসঙ্গে শত শত গুলির শব্দ। বাইরে আসা নিরাপদ নয়, তাই ঘরে রইলাম।

সকাল হবার একটু আগে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। সশস্ত্র গুখা চ্যালেঞ্জ’ করল। দারোগা সাহেব এলেন। বললেন, রাত্রিতে নবীন ঠাকুরের বাড়িতে ঘটনা ঘটেছে, ক্যাপ্টেন ক্যামেরন সাহেব নিহত হয়েছে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের একজন (নির্মল সেন) আত্মহত্যা করেছেন পালাতে না পেরে।

সকালে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর সর্বপ্রথম হানা দিলেন আমাদের বাড়িতে। বললেন, আমাদের পরিবার এসব ফেরারি আসামিদের সঙ্গে জড়িত। খানাতল্লাশি হল পাড়ার পর পাড়ায়–সারাগ্রামখানিতে। তাতেও রেহাই পেল না নিরীহ গ্রামবাসীরা। চতুষ্পর্শ্বস্থ গৃহস্থের ওপর ধার্য হল পাঁচ হাজার টাকা পাইকারি জরিমানা। স্থাপিত হল চিরস্থায়ী ক্যাম্প, নির্যাতিত হল গ্রামবাসী। তবু কিন্তু এ গ্রাম ছাড়বার কল্পনা তারা করেনি কোনোদিন। পূর্বপুরুষদের ভিটের মায়া কেউ কি ছাড়তে পারে?

বাংলা বিভাগ হল। দলে দলে লোক ছেড়ে গেল তাদের জন্মভূমি। রেখে এল তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটি। প্রথম উত্তেজনা কমে গেলেই ফিরে আসবে তারা। সবাই চলে যাচ্ছে। একা নই আমি, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার আছে। তারা থাকতে চায় না আর। তাই বাধ্য হয়ে তাদের নিরাপত্তারই জন্যে গ্রাম ছেড়ে আসার সংকল্প করলাম। আপত্তি জানাল হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধ সবাই। আমিন সরিফ, আজিজ মল্ল, ফরোক আহমদ–গ্রামের মধ্যে যারা এখন মাতব্বর, একযোগে বললে, সত্যই আমাদের ছেড়ে চললেন? আমাদের এখানে তো কোনো ভয় নেই।

দুঃখ হয়েছিল তাদের কথায়। তারা তো ছিল আমার আত্মীয়েরই মতো চোদ্দোপুরুষ ধরে, পরিবারের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও প্রীতিসূত্রে আবদ্ধ। তাদের আবার ভয় কীসের? চারদিককার অবস্থা তখন শান্ত। কিন্তু ভিড় খুব। তবু অতিকষ্টে রাত বারোটায় এসে পৌঁছোলাম শিয়ালদা স্টেশনে।

সে আজ প্রায় আট বছর আগেকার কথা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার শেষে যখন অপরাহু হয় তখন মনখানি ছুটে যায় আমার সেই ‘ছেড়ে-আসা গ্রামে। আমি কল্পনার চোখে দেখি আমাদের স্কুলের মাঠে ছেলেরা খেলছে মনের সুখে, বাড়ির সামনে দিঘিতে মাছ ধরতে বসেছে সুরেশ পুরোহিত, কালীবাড়িতে ওঁঙ্কারগিরির আখড়ায় ভিড় জমে আসছে। পুকুরের পোনা মাছগুলো ঘাটে এসে সাঁতার কাটছে, বাগানের মালতীলতায় টুনটুনি পাখিগুলো বসে আছে তাদের নতুন নীড়ে, ঝাউগাছে বাসা বেঁধেছে চিলেরা, গোয়ালের গোরুগুলো উঠানে ছুটোছুটি করছে, পোযা কুকুরটি দরজার সামনে বসে আছে লেজ গুটিয়ে, বিড়ালটি খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে এঘর ওঘর, বাগানের গোলাপ গাছগুলো ভরে আছে মুকুলে, লিচুগাছের ওপর বসে কাক মনের আনন্দে ডাকছে-কা কা। ফল-ভারে অবনত হয়েছে আম গাছের পত্রবহুল শাখা-প্রশাখা, পাকা কালোজাম বাতাসে ঝরে পড়ছে মাটিতে, রাস্তায় লোক নেই, কোথাও কোনো শব্দ নেই, চারদিকে শ্মশানের নীরবতা। সন্ধ্যা হল, কালীবাড়িতে বেজে উঠল কাঁসর-ঘণ্টা, জ্বলে উঠল আচার্যিদের বাড়িতে দু-একটি প্রদীপ, যুগিদের পাড়ায় খোল করতালে হল সন্ধ্যার বন্দনা…।

ফিরে আসতে চাইল না মন এখান থেকে। এখানকার প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে যে আমার পরিচয় নিবিড়, অবিচ্ছেদ্য। এরা আমায় ডাকবে–এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু পারি না তাদের সে ডাকে সাড়া দিতে। বোঝাতে পারি না অবাধ্য মনকে। আশা বলে, তুমি তো ছিলে না গৃহহীন, একটি বিশাল বর্ধিষ্ণু পল্লির সর্বত্রই ছিল তোমার গৃহ, তুমি তো ঘরছাড়া হতে পারো না।

ভাবি, কোনটা সত্য–আমার আশা, না আমার এ নির্মম বর্তমান?

.

ভাটিকাইন

পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনে যে দেশের মাটিকে আপন বলে জেনেছি, যে দেশের আকাশ আর বাতাসের সঙ্গে আমার শৈশবের প্রতিটি দিনের অনুভূতি একাত্ম হয়েছিল একদিন, আজ সেই জন্মভূমির সঙ্গে শেষ যোগটুকু ছিন্ন করে চলে এসেছি। পিতৃপিতামহের ভিটে ছেড়ে দেশান্তরে পাড়ি জমিয়েছিলাম দিনের আলোতে নয়, রাত্রির অন্ধকারে। গোটা দেশটাই যেন রাত্রির তপস্যায় মগ্ন। দেশকে ছেড়েছি, কিন্তু দেশের মাটিকে তো আজও ভুলতে পারিনি। শরণার্থীর বেশে জীবনের প্রতিপদক্ষেপে আজ যে দুর্যোগের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি, এই দুঃসময়ে বড়ো বেশি মনে পড়ছে আমার জননী, আমার জন্মভূমি, আমার ছেড়ে-আসা গ্রামকে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করেছি, দুঃখ বরণকেই জীবনের সহযাত্রী করে নিয়েছি, কিন্তু এই দুঃখের দিনে জন্মদুঃখিনী গ্রামের স্মৃতিকথা লিখতে বসে এখনও আশা জাগে, এখনও মন বলে, ‘সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।

জীবনের এক বিরাট স্থান শূন্য হয়ে গেছে বলে মনে হয়, পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেছে। কোথাও মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। কাউকে বলবারও কিছু নেই, বললেও কেউ যেন শুনবে না। এতগুলো লোক মরেছে কি মরবে বোঝা যাচ্ছে না। বোধ হয় এরা সকলেই মরবে, আজ না হয় কাল। কেবল কৃশাঙ্গি শাখা কর্ণফুলি বেঁচে থাকবে। বর্ষীয়সীর শব্দহীন হাস্যে নিজের নিস্তরঙ্গ স্বল্প জলে কুন্ডলী পাকাবে।

নবীনচন্দ্র ‘পলাশীর যুদ্ধে’ যাদের জন্যে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন, তারা বেঁচে আছে, তবে তারা নিজহাতে কবি ও তাঁর কাব্যকে হত্যা করেছে।

ইতিহাস ক্ষমা করবে না জানি, কিন্তু ইতিহাসের দীর্ঘ ও বিচিত্রপথে বিচরণ করে সে প্রতিঘাত উপভোগ করবার জন্যে আজকের কেউ বেঁচে থাকবে না। যে হাত আঘাত করে, সে-হাত বরাভয় দেয়, এইরূপ অসংগতি ইতিপূর্বে শোনা যায়নি। পৃথিবীর বয়স হয়েছে, বোধহয় অন্তিম দশা ঘনিয়েছে।

কিন্তু কী বলছিলাম। জীবনের এক বিরাট স্থান শূন্য হয়ে গেছে মনে হয়। যে মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম, সে-মাটি আজ আর আমার নয়, তা স্পর্শ করবার অধিকার আমার আর নেই!

চট্টগ্রাম।

একদিকে ঘন সন্নিবিষ্ট পাহাড়শ্রেণি, অন্যদিকে তরঙ্গায়িত বঙ্গোপসাগর, মধ্যে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলে ভরা বিস্তৃত উপত্যকা। আজ যেন সব পুড়ে গেছে।

সীতাকুন্ড থেকে চট্টগ্রামের সে-এক অপূর্ব রূপ, যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়, পাহাড়শীর্ষে শুভ্র দেবালয়ে দেবতা ‘চন্দ্রনাথ’, ক্রোড়ে প্রলয়ের প্রতীক্ষায় ত্রিশূলধারী বিরূপাক্ষ, নিম্নে নিস্তেজ স্বয়ম্ভুনাথ মর্তের মানুষের অতিনিকটে বলে রুদ্ররূপ ত্যাগ করেছেন, আরও নীচে পূতসলিলা মন্দাকিনী, অনাদিকাল হতে কলস্বরে বয়ে যাচ্ছে। পুরাণে এই স্থানটিকে চম্পকারণ্য বলা হত। উত্তরে অনাবিষ্কৃত পাহাড়-চূড়া, সহস্রধারায় জল ঝরে পড়ছে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই এই জল পড়ে পড়ে মাটি পাথর হয়ে গিয়েছে। আবার পাহাড়গাত্রে স্থানে স্থানে অগ্নিশিখা, এর গর্জনকে স্থানীয় হিন্দুরা গুরুধ্বনি বলে। দক্ষিণে বাড়বানল। সীতাকুন্ড থেকে পাঁচ মাইল দূরে ঘন অরণ্যের মধ্যে শিববিগ্রহ ও পাতালস্পর্শী জলকুন্ড টগবগ করে ফুটছে, অথচ ডুব দিলে দেহ শীতল হয়।

চন্দ্রনাথের মন্দির থেকে এক সংকীর্ণ সর্পবহুল গিরিপথ দক্ষিণদিকে নেমে গিয়েছে। তীর্থযাত্রী দল ওই রাস্তা দিয়ে নেমে যায়। যক্ষপুরীর মতো অন্ধকার সে-পথ। পথ হাতড়িয়ে চলতে হয়। মাঝে মাঝে শাবকসহ কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাঘ্র দম্পতিকে চলে যেতে দেখা যায়। এর নাম পাতালপুরী। স্মরণাতীতকালে কোন মহাপ্রাণ হিন্দু রাজা এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন জানা যায়নি। মন্দিরের অধীশ্বরী কালী, মাথা নীচে ও পা ওপরে করে পূজারিদের দিকে পিছন ফিরে আছেন। এ এক অপূর্ব মূর্তি। বহুশতাব্দী পূর্বে আবির্ভূত হয়েছেন এ দেবী, অথচ মর্ত্যের মানুষের মুখ দর্শন করেননি।

কুমিড়া, ভাটিয়ারি ও ফৌজদারির হাটছাড়াবার পর পাহাড় যেন দূরে সরে গিয়েছে। এইখানে কৃষ্ণচূড়া ফুল শোভিত ঢালু জমি। নাম পাহাড়তলি। এ. বি. রেলওয়ের কারখানা, লোকো শেড, মালগুদাম, ইঞ্জিন মেরামতের কারখানা, ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের দফতর। তারপর চট্টগ্রাম স্টেশন। গ্র্যাণ্ড ট্রাংক রোড এখানে ঈষৎ উচ্চে, পাহাড়তলি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রাস্তাটা উঁচু হয়ে গেছে। বাটালি পাহাড়পার্শ্বে সংকীর্ণ গিরিপথের নাম টাইগার পাস। এইখান থেকে বড়ো পল্টন, ইউরোপীয় ক্লাব ও লাটসাহেবের কুঠি পর্যন্তও ছোটোখাটো টিলায় অসংখ্য বাংলো। আগে এখানে সরকারি বড়ো সাহেব, মার্চেন্ট অফিস ও রেলওয়ের সব বড় কর্তারা থাকতেন। আজ তাঁরা সাগর পাড়ি দিয়েছেন। যাবার আগে কার সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করে গেছেন, ইতিহাস একদিন তার বিচার করবে।

সেকালে চরচাকতাই থেকে নৌকাযোগে কর্ণফুলি দিয়ে আমাদের গ্রামে যেতে হত। প্রাচীন পল্লি ভাটিকাইন। বড়ো কর্ণফুলি ও তার নিস্তরঙ্গ শাখা ধরে সেনের পোল, সাইরার পোল, চন্দ্রকলা পোল ও ইন্দ্রপোল হয়ে এসে নুরন্নবী মাঝির নৌকা থামত, দুরন্ত বর্ষায় বড়ো কর্ণফুলির জল যখন দলিত-মথিত হত তখনও বৃদ্ধ নুরন্নবীকে অসীম সাহসে দাঁড় টেনে নৌকা নিয়ে যেতে দেখেছি। আমরা শহরেই থাকতাম, মাঝে মাঝে পাল-পার্বণে বাবার সঙ্গে গ্রামে যেতাম। ইন্দ্র পোল ছাড়িয়ে আরও দূরে নৌকা থামত। নৌকা থেকে নেমে বকাউড়া বিলে গিয়ে উঠতাম। জ্যোৎস্না রাত্রে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি ভিড় করত বকাউড়া বিলে। মাঝে মাঝে দেখা যেত হারগেজা ফুলের ঝাড় আর প্রাচীন মগেদের চিতা।

বিল ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তা ধরতাম। প্রথমেই শ্মশানকালীর হাট, দু-ধারে ঘন বাঁশঝাড়, বাঁশপাতা পড়ে রাস্তার কতকাংশ একেবারে ঢাকা পড়ে গেছে। গ্রামের হাই স্কুল ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ি। গ্রামবাসী এবং নিকটবর্তী গ্রামের বহু লোক আমাদের বাড়িকে সরীর বাপের বাড়ি বলত।

সরী ওরফে সরলা আমার বড়ো পিসিমার নাম। জনশ্রুতি, সাতটি সন্তানের অকালমৃত্যুর পর পিসিমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে এবং তিনি পিতৃগৃহে চলে আসেন। পিতৃগৃহে তখন কেউ ছিলেন না, কর্মসূত্রে সকলেই তখন চট্টগ্রাম শহরে। পিসিমা নাকি একাকী একটা বাতি জ্বেলে ভেতরের দিকের বারান্দায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত সুর করে রামায়ণ, মহাভারত পড়তেন। অন্ধকারে মধ্যরাত্রে সেই গৌরবর্ণ দীর্ঘাঙ্গী সরলাকে চক্রবর্তীদের পোড়ো বাড়িতে একাকী ঘোরাফেরা করতে দেখে পথচারী কেউ চমকে উঠত কি না জানা যায়নি। শনি, মঙ্গলবারের মধ্যরাত্রে সরীর বাপের বাড়ির পানা-পুকুরের অভ্যন্তর থেকে প্রেত পুজার কাঁসর-ঘণ্টাধ্বনি রামায়ণ পাঠরতা সরলাকে আদৌ বিচলিত করত কি না সে সংবাদও জানা যায়নি। সকলই আজ বিস্মৃতির গর্ভে লীন। কেবল তেঁতুল ও দীর্ঘশির ইন্নালুর ডালে ডালে শাখা কর্ণফুলির উদাস বাতাস মৃত চক্রবর্তীদের নাম নিয়ে আজও লুটোপুটি খায়।

ভাটিকাইন অথবা ভট্টিখন্ড, যাই হোক-না-কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের গ্রামের নাম ভাটিকাইন। ভাটিকাইন থানার একমাইলের মধ্যে বহু বর্ধিষ্ণু হিন্দুর বাস ছিল গ্রামে। আমাদের বাড়ি ব্রাহ্মণপাড়ায়, হরদাসবাবুর বাড়ির পাশে। হরদাসবাবু জ্ঞানী ও ধার্মিক লোক ছিলেন। তাঁর বাড়িতে অষ্টপ্রহর কীর্তন হত। যতদূর মনে পড়ে তাঁর বাড়ির ভেতর ও বাইরের উঠোনে সংবৎসর শামিয়ানা খাটানো থাকত। উঠোন জুড়ে শতরঞ্চি পাতা, বাইরের পুকুরপাড় পর্যন্ত লোক বসত। ঝুড়ি ঝুড়ি ভোগ হত ঠাকুরের। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে সুরভিত হয়ে যেত চারদিক।

শুধু হরদাসবাবুরই যে সচ্ছলতা ছিল তা নয়, গ্রামবাসী প্রায় সকলের ঘরেই যেন লক্ষ্মী বাঁধা থাকতেন। চাল কিনে খেত এরকম লোককে লক্ষ্মীছাড়া বলা হত এবং সেরকম কেউ গ্রামে ছিল বলে জানা যায়নি।

মামার সঙ্গে কর্ণফুলিতে মাছ ধরতে যেতাম। সেজন্যে আমাদের ভাইদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। চন্দ্র অস্ত যাবার পূর্বেই তিনি জাল নিয়ে বের হতেন। আমরা জেগে থাকতাম। মামার সঙ্গে গিয়ে ডুলা ধরব। পেছনের বাড়ির সিরাজুদ্দিন ভুঞার ছেলে বসিরও আমাদের সঙ্গে যেত। নগেন্দ্ৰকাকা, মামা, আমি, দাদা, বসির ও ওয়াজ্জারগোলার নূরমহম্মদ রাত থাকতে বাড়ি থেকে বের হতাম। বাবা বাড়ি থাকলে আমরা যেতে পারতাম না। মা কিছু বলতেন না। কেবল দিদি জেগে থাকলে সঙ্গে যাবার জন্যে বায়না ধরতেন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠে মরা শ্ৰীমতীর পোল পার হয়ে বকাউড়া বিলের রাস্তা ধরতাম। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের চালায় গিয়ে দাঁড়াতাম। তারপর বৃষ্টির ঝাঁপটা কমে গেলে স্কুলঘর থেকে বের হয়ে ওয়াঙ্গেদারদের বাড়ি ছাড়িয়ে যেতাম। নগেনকাকা বলতেন, ওই দেখ দু মুখো ‘খাইনি’ সাপ ঘুরছে। বসির বলত ‘জঠিয়া’ সাপ। মামা বলতেন, বিলের মুখে ‘কালন্দর’ সাপ আছে। তাতেও আমরা নিরস্ত হতাম না। মরা শ্ৰীমতীর পোল পার হয়েই বিলে নামতাম। তারপর বৃষ্টির জলে, ঠাণ্ডায়, বিড়বিড় করতে করতে সকলে মিলে খালে জাল ফেলত। বাটা, হরা, পোপা, লোঠিয়া, ইচা, খোরশুলা, বেলে, গলদা ও বাগদায় নিমেষে ডুলা ভরে যেত। সকালে বাড়ি ফিরে মাছ ঢাললে উঠোনের একাংশ সাদা হয়ে যেত।

প্রতিবৎসর কাকার বাড়িতে ভাটিকাইনে যাত্রাদলের গান হত। বিজয়-বসন্ত পালা হবে। এই উপলক্ষ্যে গ্রামে সাড়া পড়ে গেছে। স্টেজ বাঁধা হয়েছে। আবদুল আজিজ মৌলবির বাড়িতে দুইটি বড়ো দেওয়ালগিরি আছে। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেগুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যা থেকেই তিন গাঁয়ের লোক আসতে আরম্ভ করবেন। উঠোন জুড়ে ত্রিপল ও সতরঞ্চি পাতা হয়েছে। দেখতে দেখতে উঠোন ভরে গেল। সদরের বাইরে সাময়িকভাবে পান সিগারেট ও চায়ের দোকান বসেছে। সুদৃশ্য বালকের দল রংচঙে পোশাক পরে সখী সেজে স্টেজের ওপর গান ধরেছে—’শাখে বসি পাখি করে গান।’

বহুদিনের কথা। শঙ্খ ও হালদা নদীকে তবুও ভুলিনি। কর্ণফুলির পাশে পাশে সেগুলি আজও বয়ে চলেছে। সেই হাটহাজারি, ফটিকছড়ি, রাঙামাটির দেশ, শান্ত সমাহিত পাহাড় ক্রোড়ে নাকচ্যাপটা মগ ও চাকমা শিশুর দল। সেই চন্দ্রনাথ পাহাড়, পাতালকালীর সহস্র ধারা। সেই ভাটিকাইন যাত্রাদলের গান, চকমকে পোশাক পরে গ্রামের বড়ো অভিনেতা চন্দ্রকুমার আসরে উঠেছে। সবই মনে আছে। কিছুই ভুলিনি।…

তবে এই কলিকাতায় আমি আজ বাস্তুহারা! রিলিফ ক্যাম্পে বাস করি। ক্যাম্পে কয়েকজনের কলেরা হয়েছে। সকালে একটি বাস্তুহারা শিশু বসন্তে মারা গেছে। সে-সময়েই একমুঠো মোটা চিড়ে পেয়েছি। রিলিফবাবুর কাছে যেতে সাহস হয় না। কিছু বলতে গেলেই তিনি খেপে ওঠেন।

কেন এমন হল, সে প্রশ্ন আমি করি না। মাটির তলা থেকে মৃতের দুর্গন্ধ ওপরে ভেসে আসে কি না জানি না, জানলে হয়তো বেশি করে মাটি চাপা দিয়ে আসতাম। আসবার সময় নূরন্নবীর নাতির নৌকাখানা চেয়েছিলাম; রাতদুপুরে শ্মশানকালীর হাটের কাছে নৌকা ভিড়াতে বলেছিলাম। সেও যে বিগড়ে গেছে, আগে তা বুঝতে পারিনি। অন্ধকারে পা টিপে টিপে পটিয়া পেরিয়ে চক্রদন্ডী আসি। শেষরাত্রে হরিচরণের দিঘির ধার দিয়ে আসবার সময় কয়েকটি কুলবধূকে মরাকান্না কাঁদতে শুনেছিলাম। অদূরেই দাউ দাউ আগুন জ্বলছিল। সেই আলোয় পথ চিনে চিনেই চলে এসেছি। অনেকে আসতে পারেনি।

.

গোমদন্ডী

সৌন্দর্যের প্রতীক চট্টলা। প্রকৃতির লীলানিকেতন শৈলকিরীটিনি, সাগর-কুন্তলা, সরিক্সালিনী, কবিধাত্রী চট্টগ্রাম ভারতের জাতীয় ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে সাক্ষী হয়ে আছে। মাঝে মাঝে জীবনসংগ্রামের তপ্ত ঝড় চট্টলার বুকে উঠলেও সে-ঝড় শান্ত হয়ে একদিন শান্তির নিবাস হয়েই দেখা দিত। সমুদ্র-ঢেউ মানুষকে ইঙ্গিত জানাত এগিয়ে চলার। স্থাণু হয়ে বসে থাকার অর্থই হল মৃত্যু-চট্টগ্রাম তাই কখনো মৃত্যুর সাধনা করেনি, সাধনা করেছে প্রাণের, সাধনা করেছে শির উন্নত করে বাঁচার মতো বাঁচার। সে মন্ত্রের পূজারি ছিল প্রতিটি মানুষ, তাই চট্টগ্রাম বিপ্লবী সৈন্যের জন্মদাত্রী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। এই চট্টগ্রামেরই বিখ্যাত কবি নবীন সেন তাই বলেছিলেন,

ভারতের তপোবন! পাপ ধরাতলে
স্বরগের প্রতিকৃতি।

সত্যিই জায়গাটি ছিল স্বর্গের মতো। ভারতবর্ষের তপোবন বলতে যদি কোনো জায়গাকে বুঝতে হয় তাহলে এই চট্টগ্রাম! আজ তার কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিরাট ঐতিহ্য লুপ্ত হয়েছে, বৃহদারণ্যের মৃত্যু হয়েছে। এই চট্টলারই এক নিভৃত পল্লিতে আমার জন্ম। গোমদন্ডী আমার জন্মভূমি। অখ্যাত অজ্ঞাত গন্ডগ্রাম হলেও গোমদন্ডী ঐতিহাসিক চট্টগ্রামেরই অংশ, অমৃতের উৎস। ইতিহাস থেকে যেটুকু জানা যায় তাতে দেখা যায় বর্গিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের পুর্বপুরুষ মাধবচন্দ্র মজুমদার মহাশয় প্রায় দু-শো বছর আগে বর্ধমান থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে শঙ্খনদীর উত্তরে সুচিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরে সেখানে স্থানাভাব হেতুই হোক বা অন্য কারণেই হোক মাগনদাস চৌধুরি তাঁর খামারবাড়ি গোমদন্ডী গ্রামে চলে আসেন এবং নির্মাণ করেন তাঁর ভদ্রাসন। শিক্ষায় দীক্ষায় উচ্চাঙ্গের না হলেও গ্রামখানি ছিল পল্লিশ্রীর এক অফুরন্ত ভান্ডার, পশ্চিম প্রান্তে কর্ণফুলি নদীর ডাক দক্ষিণে রায়খালি খাল, উত্তরে ছনদন্ডী, খাল গিয়ে মিশেছে সূর্যাস্তের রঙে রাঙা কর্ণফুলিতে। গ্রামখানির চতু:সীমা চারটি প্রকান্ড দিঘি দিয়ে ঘেরা। প্রকৃতিদেবী পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, দিঘি দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চট্টগ্রামকে ঘিরে রেখে শত্রুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে-চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল! ঘরের মধ্যে যে বিভেদ এল, তার আঘাতেই আমরা পড়লাম ছড়িয়ে। কুসুমে কবে কীট প্রবেশ করেছিল তার সংবাদ রাখিনি, ফুলের ঘ্রাণ নিতেই ছিলাম মত্ত! মনে হয় সেই ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়েই বিষাক্ত কীট প্রবেশ করেছে মনে, তারপর কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে অন্তঃকরণকে, সে-সর্বনাশের খবর পেলাম বহু দেরিতে! এত সতর্কতা সত্ত্বেও শত্রুর হাত থেকে আমরা বাঁচলাম কই? যে দুষ্ট কীট আমাদের নীচে নামিয়েছে সে-কীটের সন্ধান কি আজও আমরা পেয়েছি?

আজ গ্রামছাড়া হয়ে গোমদন্ডীকে ভাবতে ইচ্ছে করছে! মনে পড়ছে সেই ছায়াঢাকা, পাখিডাকা গ্রামখানিকে বারবার। অর্ধশতাব্দীর সুখ-দুঃখের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামখানিকে কোনোদিন এমনভাবে ছেড়ে আসতে হবে কল্পনা করিনি, তাই বোধহয় সেই স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমির স্মৃতি ইচ্ছে করেও ভুলতে পারছি না। দিনরাত মনের এক অজ্ঞাত ক্ষতস্থান থেকে যন্ত্রণা উঠছে বুঝতে পারি, কিন্তু করার কিছুই নেই। তাই মাঝে মাঝে নির্জনে অশ্রুবিসর্জন করে মনের বেদনা ভুলতে চেষ্টা করি মাত্র।

জীবনভরা যাদের ছিল হাসি আজ কান্নাই তাদের সম্বল! দুঃখের পাঁচালি গেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চলেছি ছুটে, জানি না এ চলার শেষ কোথায়। একবার বর্গিদের হামলায় দেশত্যাগী হয়েছিলেন আমার পূর্বপুরুষ, আজ ভ্রাতৃবিরোধে আমি হলাম যাযাবর। বর্ধমান থেকে চট্টগ্রামে গেছেন পূর্বপুরুষগণ প্রাণ বাঁচাতে, আমি চট্টগ্রাম থেকে আবার বর্ধমানের কোলে এসেছি আশ্রয় এবং খাদ্যের ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে! কপালের লেখা হয়তো একেই বলে! ভাই ভাই-এর ঝগড়া যে এমন সর্বনাশী প্লাবন আনে জানতাম না। মানুষের দুর্ভাগ্য, মানুষে দীর্ঘশ্বাস শুনে ঈশ্বরকে স্বভাবতই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে,

হে বিধাতঃ! কোন পাপ করিল সে জাতি?
কেন তাহাদের হল এত অবনতি?

প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা আমার গোমদন্ডীর চারিদিকে শুধু সবুজের মেলা। ছুটি উপলক্ষ্যে শহরের কৃত্রিম পরিবেশের মায়া কাটিয়ে যখন গিয়ে পল্লিজননীর শ্যামল কোলে প্রথম আশ্রয় নিতাম তখন ভুলে যেতাম নগর-জীবনের সমস্ত দুঃখকষ্ট। জীবনের সমস্ত দৈন্য গ্লানি যেন এক মুহূর্তে ধুয়ে-মুছে যেত, পল্লিমায়ের সোনার কাঠির স্পর্শে পেতাম জীবনের নতুন সাড়া। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দু-কূল প্লাবিত কর্ণফুলি দিয়ে সাদা পালের নৌকায় চড়ে গ্রামে যাওয়ার সময় দু-পাশের ধানখেতে চোখ পড়লেই প্রবাসীর মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত।

অন্ন-বস্ত্রের জন্যে নগরের যান্ত্রিক সভ্যতার চাপে যখন শরীর মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখনই মন বিদ্রোহ করে দেশে ফিরে যাবার জন্যে। অস্থির হয়ে পড়ি পল্লিমায়ের স্নেহশীতল ছায়ায় নির্বিঘ্ন জীবনযাপন করতে। তখনই মনে বড়ো হয়ে প্রশ্ন জাগে, আর কি ভাগ্যে জন্মভূমি দেখা ঘটে উঠবে না, আর কি কোনোদিন ফিরে যেতে পারব না আমার সেই নিভৃত কুটিরে? ছোটো ছেলেটা দেশে ফেরার বায়না ধরলে আর অশ্রু চেপে রাখতে পারি না। নিজেকে অভিশপ্ত বলে ধিক্কার দিই বার বার। মাঝে মাঝে কোনো কোনো সময় অতীতের চিন্তায় বিহ্বল হয়ে পড়লে কেবলই যেন পল্লিমায়ের স্নেহব্যাকুল আহ্বান শুনতে পাই—’ওরে আয় রে ছুটে আয় রে ত্বরা—’ কিন্তু ছুটে কোথায় যাব? পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে ছুটে ছুটে প্রাণ তো কষ্ঠাগত হয়ে উঠল, তবুও তো কোনো আশ্রয় মিলল না, আমাদের! শ্রমের পর বিশ্রাম না মিললে প্রাণধারণই হয়ে ওঠে অসম্ভব, কিন্তু আমরা তো শুধু শ্রমই করে চলেছি, বিশ্রামের সময় আসবে কখন?

আজ চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে গ্রামখানি উঠেছে ভেসে। মন আমার আজ বেদনাবিধুর হয়ে শুধু স্মৃতিরই রোমন্থন করে চলেছে। আমার গোমদন্ডীর বিস্তৃতি ছিল দৈর্ঘ্যে সাড়ে চার মাইল আর প্রস্থে আড়াই মাইল। বিদেশ থেকে গ্রামে চিঠিপত্রাদিতে দত্তপাড়া-দক্ষিণপাড়া, সুবৰ্ণবণিক পাড়া, বড়য়াপাড়া, বহদ্দারপাড়া ইত্যাদি বলে চিহ্নিত না করলে অনেক সময় প্রাপকের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতে পিয়োনদের হিমসিম খেতে হত। গ্রামটিতে উচ্চ শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, উকিল-মোক্তার, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক, রেলকর্মচারীর সংখ্যা বড়ো কম ছিল না। হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান প্রভৃতি সমস্ত সম্প্রদায়েরই বাস ছিল। সপ্তপুরুষ যেখানে মানুষ সেই সোনার চেয়ে দামি আমার । গ্রামখানি আজ কোথায় গেল হারিয়ে? কোথায় গোমদন্ডী আর কোথায় আজ আমি?

সবুজধানের খেত, আম-কাঁঠালের ও সুপারিকুঞ্জ-ঘেরা বিরাট গ্রামখানির অনবদ্য শ্যামলশোভা মনকে আজও সরস করে তোলে। চারিদিকে থইথই জলে যখন মাঠ যেত ডুবে, জোয়ারের জল নদীর কানায় কানায় যখন উঠত ভরে, তখন সেই দৃশ্য দেখে আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতাম। পুজোর ছুটিতে যখন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বড়ো দিঘির পাড়ে বসে পূর্বদিকের দূরবর্তী পাহাড় শ্রেণির দিকে তাকাতাম, দিঘির কাকচক্ষু স্ফটিক জলের সুদূরপ্রসারী হাওলা বিলের জলে কুমুদকহ্লার শোভিত সবুজ ধানের দোলন দেখে কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েই যেন বলেছি বহুবার,

এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার? কোথায় এমন ধূমপাহাড়?
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্ৰ আকাশতলে মেশে?
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে?

এই স্মৃতির সঙ্গে মিশেছে শৈশবের ভুলে-যাওয়া দুষ্টুমির কথা। মনে পড়ছে ছোটোবেলায় সমবয়সিদের সঙ্গে দল বেঁধে পুকুর থেকে পদ্মফুল তোলা, জেলেদের ভাড়াটে নৌকা করে জলে-ভরা খালবিল অতিক্রম করে বেড়াতে যাওয়ার কথা, বনভোজন, খালের ওপর থেকে কাঠের পুলের রেলিং-এ বসে নানান আজগুবি গল্পগুজব, পুলের নীচে দিয়ে মাঝিদের ছই দেওয়া নৌকায় ছোটো ছোটো ঢিল ছুঁড়ে মারা, পুল থেকে ঝপাং করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়া, এমনি আরও কত কী। ফুটবল খেলার অনুশীলন উপলক্ষ্যে হাতাহাতির কথাগুলি আজও মনের মানচিত্রে জ্বলজ্বল করছে। জানি না কোন অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আমরা সুজলা সুফলা পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, জানি না কোন বিধিবিড়ম্বনায় এমন স্বর্ণপ্রসূ জন্মভূমি ত্যাগ করে আমাদের সর্বহারা হয়ে চলে আসতে হল! কিন্তু তবু মনে হয় এ চলে-আসা আবার দেশে ফিরে যাওয়ার ভূমিকা মাত্র–আমাদের এই আশা চিরতরে আসা নয়।

মনে পড়ে বারোয়ারি পুজোর সময় ছেলে-মেয়েদের উদ্দাম আনন্দের কথা। বৃদ্ধরাও সে আনন্দের অংশীদার হতে দ্বিধাগ্রস্ত বা লজ্জাবোধ করতেন না। পুজো উপলক্ষ্যে গ্রামে থিয়েটার, যাত্রা, কবিগান, গাজীর গান ইত্যাদি শোনার জন্যে গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের অধিবাসীরা উৎসুক হয়ে থাকত। দূরদূরান্তর থেকে পদব্রজে এবং নৌকা করে বহু শ্রোতা আসত গান শুনতে। সে-শ্রোতার জাতিভেদ ছিল না–সেখানে হিন্দুর চেয়ে বেশি উৎসাহী ছিল মুসলমান ভাইয়েরা। সকলে সমান অংশীদার হয়ে তদারক করত আসর–গানের অর্থবোধ করে কাঁদত সকলেই সমানভাবে। সেখানে কে কার দুঃখে কাঁদছে সেটা বড়ো কথা ছিল না, বড়ো ছিল দরদি মন, বড়ো ছিল দুঃখবোধ। আজ সে নিষ্পাপ মন পরিবর্তিত, আজ অন্য সম্প্রদায়ের দুঃখে অশ্রু বিসর্জন করা যেন লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এমনটি হল? কেন মানুষ তার দরদ হারিয়ে অমানুষে পরিণত হয়েছে, কেন গড়ে তোলা হল বিপদের এই বেড়াজাল? এ বিপদের বেড়াজাল কি ছিন্ন করা যায় না সমস্ত দুঃখিত অবহেলিত মানুষের সামগ্রিক চেষ্টায়? মনে পড়ে দক্ষিণপাড়ার সুন্দরবলী, গোলামনকী ওরফে নকীবলী, ফতে আলি, গোপী চৌধুরি, ভৈরব দত্ত, তারিণী দে, কালী সিং, প্যারী সিং, রামগতি সিং ইত্যাদি পালোয়ানদের অদ্ভুত সব গল্পের কথা। সুন্দরবলীর বহু শক্তির কথা আজও লোকের মুখে মুখে শোনা যায়। সে নাকি প্রায় চল্লিশ বছর আগে যৌবনে পথের মধ্যে ঝড়ে নুয়েপড়া দুটি কাঁচা বাঁশ মুচড়িয়ে গ্রন্থি দিয়ে পথের পাশে সরিয়ে রাস্তা চলাচলের বিঘ্ন দূর করে দিয়েছিল। আর একবার বাড়ি থেকে নৌকাযোগে কর্ণফুলি নদী পার হওয়ার সময় মুসলমান মাঝির সঙ্গে দাঁড় টানা নিয়ে বাদানুবাদ হওয়ার পর অগত্যা নিজে দাঁড় টানতে বসে এবং দু-চারটে টান দেবার পরই অমন মজবুত দাঁড় পাটকাঠির মতো ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায়! এর ফল হয় আরও ঘোরালো, মাঝি প্রচন্ড রেগে অকথ্য গালাগালি দিয়ে অন্য দাঁড় টানতে বাধ্য করে তাকে। আস্তে আস্তে সুবোধ বালকের মতো দাঁড় টেনে তীরে পৌঁছে ক্রুদ্ধ সুন্দরবলী মাঝিকে একটু শিক্ষা দেবার অভিপ্রায়ে মাঝিসমেত নৌকাটি দু-হাতে তুলে কূলে উঠে পড়তেই মাঝির অন্তরাত্মা খাঁচা ছাড়ার উপক্রম হয়। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে সে সুন্দরবলীর হাতে-পায়ে ধরে কোনোক্রমে সে-যাত্রা রক্ষা পায়! আর সব মল্লবীরদেরও অনেককে আমি নিজের চোখে দেখেছি, তাদের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল সমান। চেহারা দেখলে চোখ ফেরানো যেত না। হাতের থাবা ছিল বাঘের মতো। বাক্যবলের চেয়ে তারা বাহুবলেরই ছিল পূজারি। গোপী চৌধুরি এত স্বাস্থ্যবান ছিল যে মাইল পঞ্চাশেক সে অনায়াসেই হেঁটে পাড়ি দিত অম্লান বদনে। আজ তারা কোথায় জানি না, কিন্তু সেদিন তারাই ছিল গ্রামের প্রহরী, গ্রামের রক্ষাকর্তা। তারা থাকতেও গ্রামের মধ্যে বিভেদ, বাইরের লোকের চক্রান্ত প্রবেশ করল কী করে? মল্লবীরদের মধ্যে তো কোনোদিন জাতিভেদের কুৎসিত হানাহানি দেখিনি। তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা ছিল এক ওস্তাদের শিষ্য বলে। কোথায় সুন্দরবলী, কোথায় গোপী চৌধুরি? বিপদের দিনে তারা কি ‘গুরুজি কী ফতে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক পশুটার গলা টিপে ধরতে পারত না?

গ্রামের জাগ্রতা দেবী জ্বালাকুমারীর মন্দিরে ভক্তিভরে কতশত ভক্ত হত্যা দিয়েছে প্রাণ নিঙড়ানো অর্ঘ্য দিয়েছে। তিনিও কি জ্বালা নিবারণ করতে পারেন না আজকের মূঢ় মানুষের? কেন সবাই নির্বাক, কেন শান্তির সপক্ষে কারও স্বর উঠছে না আজ?

বছর পঞ্চাশ পূর্বে বহু শ্রমসহকারে ‘সুহৃদ পাঠাগার’ নামে একটি পাঠচক্র স্থাপন করেছিলাম, আজও মন পড়ে আছে সেই পাঠাগারে। এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন বেঁচে, তিনি আজও গ্রামের মাটিতেই আটকে রয়েছেন খবর পেয়েছি। মাটির মায়া তাঁকে অবশ করে রেখেছে, তাঁর মতো দেশপ্রাণের সাক্ষাৎ আজ ক-জনের মধ্যে দেখতে পাই?

রেলস্টেশন থেকে জেলা বোর্ডের রাস্তাটি সোজা চলে গিয়েছে পোপাদিয়া গ্রামের বুক চিরে কালাচাঁদ ঠাকুরবাড়ির কোল ঘেঁষে আশুতোষ কলেজ পর্যন্ত। গ্রামটি দিঘিবেষ্টিত, বড়ো দিঘিতে জেলেরা যখন বড়ো জাল ফেলে মাছ ধরত সে-দৃশ্য দেখতে পুকুরপাড়ে জমত উৎসুক দর্শকের দল। তার ঘাটে সন্ধেবেলায় বসত মজলিশ, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার আড়া। কোথাও দেখা না পেলে শেষে পুকুর ঘাটে জমায়েত হলেই নির্দিষ্ট জনের সাক্ষাৎ অবশ্যই মিলত। দু-পাশে ফুলভারে নত কামিনী ফুলগাছের ডাল এসে গায়ে লাগত, ঘাটের ওপর ঝাঁকড়া চাঁপাফুলের গাছটি গন্ধ বিতরণ করত চতুর্দিকে। বড়ো মনোরম ছিল জায়গাটি। পুকুরের পূর্বপাড়ে পিতৃপুরুষের মহাবিশ্রামের স্থান শ্মশানঘাট। শুভকাজ উপলক্ষ্যে বাড়ির বাইরে গেলে ওই শ্মশানের উদ্দেশে পিতৃপিতামহদের প্রণাম জানিয়েছি কত। তাঁদের মৃত্যুর দিনটিতে স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে ফুলগুচ্ছ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে স্মরণ করেছি বছরের পর বছর। আজ শ্মশান বলতে আলাদা কিছু বোঝায় না, সমস্ত দেশটাই শ্মশানে পরিণত হয়েছে। দূর থেকে তাই প্রণাম জানাচ্ছি শ্মশানেশ্বরকে! কোন ভগীরথ প্রাণগঙ্গা এনে অভিশপ্ত মৃত্যুপথযাত্রীদের জীবিত করে তুলবেন আজ?

পাশের বাড়ির পিসিমার প্রিয় বাঁহাস (লাউয়ের খোসার জলপাত্র) থেকে গ্রীষ্মের দুপুরে কখনো চেয়ে কখনো চুরি করে টকজল খেয়ে কতদিন বকুনি সহ্য করেছি ভেবে হাসি পাচ্ছে। পিসিমা আর বকতে আসবেন না, তিনি চিরনিদ্রায় অভিভূত। আমরা তাঁর বাগান থেকে প্রাণভরে গোটা নির্জন দুপুরে কাঁচা আম, পাকা মিষ্টি আম, আমড়া, কাঁঠাল, কামরাঙা, লিচু, কালোজাম, গোলাপজাম, জামরুল, তরমুজ, ফুটি, নোনা, আতা, শসা ইত্যাদি খেতাম ইচ্ছেমতো। অতীতের স্বাদ আজও ভুলিনি, কিন্তু সেসব ফল এখন আর তেমন করে পাব কোথায়? আজ যেন ‘উত্থায় হৃদিলীয়ন্তে দরিদ্রাণাং মনোরথাঃ’র মতো অবস্থা আমাদের, ভালোমন্দ জিনিস খাবার ইচ্ছে থাকলেও উদাসীনতার ভান করে আত্মদমন করতে হয়!

গ্রামের চারণকবি রূপদাস কৈবর্ত বা প্রসিদ্ধ কবিয়াল রমেশ শীলের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। শ্রাবণ মাস থেকে নাগসংক্রান্তি পর্যন্ত তারা মনসামঙ্গল থেকে গাথা গেয়ে সমস্ত গ্রামটিকে মুখরিত করে রাখত। মেয়েদের মধ্যেও কেউ পুজোর সময় চন্ডীমাহাত্ম্য বা জাগরণ পুথিও সুর করে পড়ত বলে মনে পড়ে। সেদিনের সেই উৎসাহ উদ্দীপনা আজ গেল কোথায়? আর কি ফিরে পাব না গ্রামের জীবন? নগরজীবনকেই কেন্দ্র করে যন্ত্রবৎ বেঁচে থাকতে হবে আজীবন? আর কি কোনোদিন শিবের গাজন, চড়কের মেলা, বারুণী স্নান উপলক্ষ্যে গ্রামে হুটোপুটি করতে পাব না? পাব না কি মুখোশ এঁটে মহিষ, বাঘ, ভাল্লুক সেজে মুখোশ অভিনয় করতে গ্রামের মাঠে? বিশ্বাস আছে মা আবার আমাদের কোলে টেনে নেবেন এবং এ নহে কাহিনি, ‘এ নহে স্বপন, আসিবে সেদিন আসিবে।’ আমরা সেইদিনের প্রতীক্ষাই করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *