চক্ষে আমার মায়ার ছায়া টুটবে গো

চক্ষে আমার মায়ার ছায়া টুটবে গো

ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা—এই দর্শন বহু বছর ধরে ভারতবাসীর সমবেত চেতনায় গেঁথে থাকার ফলে আমরা ক্রমশ কাজের জগৎ থেকে পিছিয়ে পড়েছি। আগেও বলেছি ছেলেবেলা থেকেই আমরা গুরুজনদের কাছে যেসব উপদেশ পাই, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হল, এই জগৎ মিথ্যা, এই জগৎ মায়া, এই জগৎকে ত্যাগ করাই জীবনের পরম ব্রত।

এই ভুল উপদেশ বহু বছর ধরে আমাদের ক্ষতি করেছে। আমরা এই ভুল ধারণার ফলেই ভিতরে ভিতরে কর্মবিমুখ হয়ে উঠেছি। আমরা ভাবতে শিখেছি, জগৎ যখন মায়া ও মিথ্যা, তখন আর কাজ করে কী হবে। কাজের মধ্যে দিয়ে জীবনে যে সাফল্য আসে, তাকে আমরা ভাবি তুচ্ছ পার্থিব সাফল্য। এই তুচ্ছ পার্থিব সাফল্যের কোনও আধ্যাত্মিক মূল্য নেই। কাজের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার সন্ধান আমরা জাতি হিসেবে প্রায় ভুলেই গেছি। ত্যাগের দর্শন যেন আমাদের কর্মবিমুখ এবং অলস করেছে।

এই ভুল জীবনদর্শন থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের ডাক দিয়েছিলেন ফিরে আসার। তাঁর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ‘মুক্তি’ কবিতায়, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।’ সেই আহ্বান বৈপ্লবিক। আমি এ-কথা বলতে এতটুকু কুণ্ঠা করব না যে রবীন্দ্রনাথের সেই সাহসী ঘোষণাই ঘটাল ভারতীয় চেতনার নবজাগরণ। সেই আহ্বান চেষ্টা করেছিল ত্যাগের জগৎ থেকে আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বার খুলে ভোগের মাধ্যমে শুদ্ধ আনন্দের জগতে ফিরিয়ে আনতে। শুদ্ধ আনন্দ মানে নিরাসক্তির সঙ্গে, আসক্তির দ্বারা আবদ্ধ না হয়ে, জড়িয়ে না পড়ে ভোগ। ভোগের বস্তুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে সর্বনাশ হবে। রবীন্দ্রনাথ ‘এ-জগৎ সত্য নয়’— এই দর্শনের বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন উপনিষদের অন্তরবার্তা থেকে আহৃত তাঁর নিজস্ব জীবনপ্রত্যয়।

তিনি উপনিষদের সঠিক ব্যাখ্যা করে বারবার অনেকভাবে বললেন, ভারতবর্ষ আমাদের শেখায় না এ-জগৎকে মায়া ও মিথ্যা বলে পরিত্যাগ করতে। তিনি বললেন না, জগতের বন্ধন শুধুমাত্র মিথ্যা মায়ার বন্ধন। তিনি ঘোষণা করলেন প্রাচীন ঋষির অন্তরের গভীর বার্তা আধুনিক ভাষায়:

অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়

লভিব মুক্তির স্বাদ!

রবীন্দ্রনাথই প্রথম যিনি আমাদের শেখালেন জগতের অজস্র বন্ধনকে ত্যাগ না করে মেনে নেওয়ার মন্ত্র। শুধু ত্যাগ-ত্যাগ-ত্যাগের মধ্যে পাওয়া যায় না মুক্তির স্বাদ। জগতের অসংখ্য বন্ধনের মধ্যেও পাওয়া যায় মুক্তির উচ্ছ্বাস। সেই মুক্তি মহানন্দময়, বললেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নতুনভাবে বুঝলেন, ব্যাখ্যা করলেন উপনিষদের ঋষিবাক্য। প্রাচীন উপনিষদ তাঁরই মাধ্যমে যুক্ত হল আধুনিক কালের চেতনা ও মর্মবাণীর সঙ্গে।

উপনিষদ বলছে, রসের আস্বাদনের জন্যেই ব্রহ্মের বা আদিসত্তার বহুরূপে প্রকাশ এবং জগতের সৃষ্টি। ব্রহ্ম হচ্ছেন সেই নৈর্ব্যক্তিক সত্তা, যিনি রস অনুভব করে আনন্দ পান। উপনিষদের ভাষায় ব্রহ্ম ‘রসস্বরূপ’। সেই আনন্দরস সারা বিশ্বজুড়ে প্রবাহিত। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের কথাই নতুনভাবে বললেন, জানালেন এই আনন্দরসই অমৃত, জগৎকে ত্যাগ করা মানে সেই অমৃতকে ত্যাগ করা। অসামান্য সাহসের সঙ্গে তিনি প্রকাশ করলেন উপনিষদের আধুনিক ব্যাখ্যা এই ভাষায়—

এই বসুধার

মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার

তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত

নানাবর্ণগন্ধময়।

(মুক্তি)

ইন্দ্রিয়ের দ্বার বন্ধ করে জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করলে এই মহাবিশ্বের অন্তরসত্যকেই তো ত্যাগ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

ইন্দ্রিয়ের দ্বার

রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার।

যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে

তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।

আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়, ইন্দ্রিয়ের দ্বার খুলে যা কিছুই আমরা ভোগ করি, তা মোহ, মায়া, মিথ্যা। তাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ত্যাগ করতে হবে— তবেই পাব আধ্যাত্মিক মুক্তি।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের নবজাগরণের পরম পুরুষ হয়ে আমাদের এই ভুল ধারণা ও জীবনদর্শনের ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিয়েছেন। দৃপ্ত সাহসে তিনি ঘোষণা করলেন, মোহের মধ্যেই, জগতের অজস্র বন্ধনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মুক্তির শিখা। অনন্য ভাষায় বীজমন্ত্রের মতো সংক্ষেপে তিনি লিখলেন সে-কথা—

মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া

(মুক্তি)

শংকরাচার্যের মায়াবাদ যে-জগৎ থেকে হাজার বছর ধরে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিল আমাদের, রবীন্দ্রনাথ ঘটালেন এক আশ্চর্য অবিশ্বাস্য নবজাগরণ সেই জগৎকেই আমাদের কাছে নতুন মহিমায় ফিরিয়ে এনে। জগৎ যেন নতুনভাবে উদযাপিত হল তাঁর ‘দেহলীলা’ কবিতায়—

একি জ্যোতি, একি ব্যোম দীপ্তদীপ-জ্বালা—

দিবা আর রজনীর চিরনাট্যশালা!

একি শ্যাম বসুন্ধরা, সমুদ্রে চঞ্চল,

পর্বতে কঠিন, তরুপল্লবে কোমল,

অরণ্যে আঁধার! একি বিচিত্র বিশাল

অবিশ্রাম রচিতেছে সৃজনের জাল

আমার ইন্দ্রিয়যন্ত্রে ইন্দ্রজালবৎ!

প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে প্রকাণ্ড জগৎ॥

এ-জগৎ তো সৃষ্টিই হয়েছে নিরাসক্ত ভোগের জন্যে। এ-জগতের প্রতি কণায় কণায় বিরাজমান সেই আদি উৎস, বা ব্রহ্ম,— সেই জগৎকে ত্যাগ করব কেন? কেন আমরা এই ভুল দর্শন অন্তত হাজার বছর বিশ্বাস করে চললাম? এবার যে বেরোতেই হবে ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’-র প্রচণ্ড ভ্রান্ত ধারণা থেকে, এবার যে বুঝতেই হবে মহাজগতের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। উপনিষদের গূঢ় মন্ত্র এই কথাই জানিয়েছে। সেই কথা সহজ করে বললেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘প্রাণ’ কবিতায়। বললেন, আমাদের শরীরের শিরায় শিরায় যে প্রাণতরঙ্গমালা, তার যে গভীর সম্পর্ক সারা বিশ্বজোড়া প্রাণতরঙ্গের সঙ্গে। জগতের সঙ্গে আমাদের প্রাণের বন্ধনকে ত্যাগ করব কেন? বা কেমন করে?

এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়

যে প্রাণ-তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়

সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে,

এই প্রাণের সম্পর্ককে কি ‘মায়া’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়? ‘মিথ্যা’ বলে ত্যাগ করা যায়? জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এলেন নতুন মাত্রা, নবচেতনা। হাজার বছরের ভ্রান্ত ধারণা নস্যাৎ হল। আমরা বুঝতে পারলাম সত্যের নতুন আলোয় ওই জগতের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ককে উপলব্ধি করার মধ্যেই আমাদের আধ্যাত্মিক উত্তরণ—

সেই যুগযুগান্তের বিরাট স্পন্দন

আমার নাড়ীতে আজি করিছে নর্তন।

বোঝা গেল, জগৎ থেকে আমরা আলাদা নই। জগতের সঙ্গে আমাদের অন্তরের সংযোগ, নাড়ির সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, যুগযুগান্তের জগৎস্পন্দন যেন নাচছে আমাদের নাড়ির মধ্যে! এই জগৎকে উপনিষদ কোনও দিনই মায়া বলে দূরে সরিয়ে দেয়নি, মিথ্যা বলে ত্যাগ করতে শেখায়নি। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের এই মূল সুরটি নতুনভাবে আমাদের শোনালেন— বললেন যে উৎস থেকে এই জগৎ উৎসারিত, তার থেকে এ-জগতের কোনও কিছুই কখনও বিচ্ছিন্ন নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

‘তোমার থেকে কিছুই বিচ্ছিন্ন নেই, সমস্তই তোমার এক অমোঘ শক্তিতে বিধৃত এবং এক মঙ্গলসংকল্পের বিশ্বব্যাপী আকর্ষণে চালিত।’

(নবযুগের উৎসব)

এইভাবে, উপনিষদের এক আধুনিক ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নবযুগের উৎসব’ প্রবন্ধে সত্যিই উদ্ঘাটিত করলেন নতুন জগৎ-চেতনার, কেন জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করা আমাদের হাজার বছরের ভুল তা আমরা এই প্রথম বুঝতে পারলাম। যে-সত্য একদিন প্রাচীন তপোবনের ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন সেই সত্য জগৎকে মায়া বলে ত্যাগ করার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নয়, সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্বলোকের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে জগৎকে ভোগ করার মধ্যে। এ-জগৎ আর তাঁদের কাছে মিথ্যা নয়, মায়া নয়। উপনিষদের এ-কথা নতুনভাবে তুলে ধরলেন রবীন্দ্রনাথ:

‘সারা বিশ্বজুড়ে ‘দিব্যধামকে তাঁরা তাঁদের চারিদিকেই প্রসারিত দেখেন; আর যে মানুষের মুখেই দৃষ্টিপাত করেন, …অমৃতের পুত্র বলে তার পরিচয় প্রাপ্ত হন।’

তিনি আরও জানালেন:

‘মহৎ সত্যকে যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা আর তো দরজা বন্ধ করে থাকতে পারেন না; এক মুহূর্তেই তাঁরা বিশ্বলোকের মাঝখানে এসে দাঁড়ান; নিত্যকাল তাঁদের কণ্ঠকে আশ্রয় করে আপন মহাবাণী ঘোষণা করেন।’

রবীন্দ্রনাথ আবার লিখেছেন,

‘ভারতবর্ষের তপোবনে অনন্তের বার্তা এসে পৌঁচেছিল।’

সেই অমৃতের বার্তা কী? সেই অমৃতের বার্তাই উপনিষদের বাণী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সেই বাণী ফিরে এল এইভাবে—

‘যিনি সর্বভূতকেই পরমাত্মার মধ্যে এবং পরমাত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন তিনি কাউকেই আর ঘৃণা করেন না।’

অর্থাৎ তাঁর পক্ষে এ-জগৎকে মিথ্যা বলে ঘৃণা করা, মায়া বলে দূরে সরিয়ে দেওয়া আর সম্ভব হয় না।

উপনিষদের ধ্যানলব্ধ সত্যের আলোয় এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যার বিভায় যখন এই জগৎ তার স্বমহিমায় উদ্ঘাটিত হয় আমাদের সামনে, তখন উপনিষদের ঋষির মতোই আমরা বলতে পারি— ‘বেদাহং’। অর্থাৎ আমি জেনেছি, আমি পেয়েছি।

কী পেয়েছি? কী জেনেছি? পেয়েছি এই সত্যকে যে ব্রহ্ম সত্য। আর জেনেছি এই সত্যকে যে, জগৎও সত্য, জেনেছি এই জগৎকে মায়া বলে মিথ্যা বলে ত্যাগ করার কথা প্রাচীন ভারতের ঋষি কোনও ভাবেই কোনওদিন বলেননি।

উপনিষদের বিশ্ববোধকে রবীন্দ্রনাথ সহজ ভাষায়, আধুনিকতার আলোয়, এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—

‘…বেদাহমেতং, আমি এঁকে জেনেছি। কাকে জেনেছ? আদিত্যবর্ণং— জ্যোতির্ময়কে জেনেছি যাঁকে কেউ গোপন করতে পারে না।… তাঁকে দেখছি ‘তমসঃ পরস্তাৎ’— তোমাদের সমস্ত রুদ্ধ অন্ধকারের পরপার হতে।… ‘আমাদের পরিচয় এই যে, আমরা তারা যারা বলে না যে, ঈশ্বর বিশেষ স্থানে বিশেষ স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত। আমরা তারা যারা বলে; একোবশী সর্বভূতান্তরাত্মা। সেই এক প্রভুই সর্বভূতের অন্তরাত্মা।… আমরা তারা যারা এই বাণী ঘোষণার ভার নিয়েছি— এক! এক! অদ্বিতীয় এক!’

যে-জগৎ ব্রহ্মে বা আদিসত্তাতে বিধৃত, যে-জগতের সর্বত্র বিরাজমান জগতের উৎস বা ব্রহ্ম, সেই জগৎকে মিথ্যা বলব কোন যুক্তিতে? তা হলে তো ব্রহ্মকেও মিথ্যা বা মায়া বলতে হয়।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিশ্ববোধের পুনরায় নবজাগৃতি ঘটালেন তাঁর ‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে। তিনি নবচেতনার আলোয় তুলে ধরলেন উপনিষদের প্রাণবার্তা। তিনি আমাদের উদ্ধার করলেন মায়াবাদের ফাঁদ থেকে। তিনি লিখছেন উপনিষদেরই কথা তাঁর নিজস্ব বোধ থেকে এ-যুগের ভাষায়:

‘…যে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ সর্বানুভূ হয়ে আছেন তিনিই ব্রহ্ম। সর্বানুভূ, অর্থাৎ সমস্তই তিনিই অনুভব করছেন এই তাঁর ভাব। তিনি যে কেবল সমস্তর মধ্যে ব্যাপ্ত তা নয়, সমস্তই তাঁর অনুভূতির মধ্যে।’

কেমন করে ব্রহ্ম তাঁর অনুভূতি দিয়ে এই জগতের সমস্তর মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন? একটি সহজ অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময় উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন রবীন্দ্রনাথ:

‘…শিশুকে মা যে বেষ্টন করে থাকেন সে কেবল তাঁর বাহু দিয়ে তাঁর শরীর দিয়ে নয়, তাঁর অনুভূতি দিয়ে। সেইটেই হচ্ছে মাতার ভাব, সেই তাঁর মাতৃত্ব। শিশুকে মা আদ্যোপান্ত অত্যন্ত প্রগাঢ়রূপে অনুভব করেন। তেমনি সেই অমৃতময় পুরুষের অনুভূতি সমস্ত আকাশকে পূর্ণ করে সমস্ত জগৎকে সর্বত্র নিরতিশয় আচ্ছন্ন করে আছে। সমস্ত শরীরে মনে আমরা তাঁর অনুভূতির মধ্যে মগ্ন হয়ে রয়েছি।…

…গায়ত্রীমন্ত্রে এই বোধকেই ভারতবর্ষ প্রত্যহ ধ্যানের দ্বারা চর্চা করেছে; এই বোধের উদ্‌বোধনের জন্যই উপনিষৎ সর্বভূতকে আত্মায় ও আত্মাকে সর্বভূতে উপলব্ধি করে ঘৃণা পরিহারের উপদেশ দিয়েছেন;’

এই জগৎকে ঘৃণা করেও ত্যাগ করা যাবে না।

উপনিষদ বলছে, আমাদের ভালবেসেই, আমাদের জন্যেই জগৎ ‘রসো বৈ সঃ’— এত রূপে রসে ভরা। আমরা সমস্ত জগৎ জুড়ে, সর্বত্র প্রতি কণায় কণায় পাচ্ছি অখণ্ড পরমানন্দ রসকেই। এই রসেরই বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে বিরাজমান সৃষ্টির আদি উৎস, যাকে উপনিষদ বলছে ব্রহ্ম। রবীন্দ্রনাথ তাই এই জগৎকে উপভোগ করতে চান— ভোগ করতে চান জগতের সমস্ত রস-রূপ-গন্ধ-বর্ণ। এ জগৎ যে মিথ্যা নয়, মায়া নয়, তাকে যে ত্যাগ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সেই সত্যদর্শন আবার ধ্বনিত হয়ে উঠেছে তাঁর নব বিশ্ববোধের প্রার্থনায়। এই প্রার্থনা হয়ে উঠুক বিশ্বজগতের কাছে আমাদের সকলের সমবেত প্রার্থনা। এই প্রার্থনার মধ্যেই যেন ভেঙে যায় আমাদের হাজার বছরের ভুল। আমরা যেন জীবন ও জগৎকে নতুনভাবে ফিরে পাই। উপনিষদের মূল বার্তা যেন আমাদের জীবনকে প্রাণিত করে। আমরা যেন মায়াবাদের মিথ্যা থেকে মুক্তি পাই। রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা ধ্বনিত হোক আমাদের হৃদয়েও—

‘…দাও আমাকে রসে ভরে দাও; চাই না ধন, চাই না মান, চাই না কারো চেয়ে কিছুমাত্র বড় হতে। তোমার যে রস হাটবাজারে কেনবার নয়, রাজভাণ্ডারে কুলুপ দিয়ে রাখবার নয়, যা আপনার অন্তহীন প্রাচুর্যে আপনাকে আর ধরে রাখতে পারছে না, চার দিকে ছড়াছড়ি যাচ্ছে… সেই তোমার নিখিল রসের নিবিড় সমষ্টিরূপ যে অমৃত তারই একটু কণা আমার হৃদয়ের মাঝখানটিতে একবার ছুঁইয়ে দাও।… রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লবধ্বানন্দী ভবতি: তিনিই রস, যা কিছু আনন্দ সে এই রসকে পেয়েই।’

অথচ এই ‘রস’-ই নাকি মায়া!

তা কি হয়?

উপনিষদ যে হাজার হাজার বছর আগে বলেছিল, এই রসের মধ্যেই ব্রহ্মের বা আদিশক্তির প্রকাশ ঘটেছে।

সারা জগৎ জুড়ে এই রসের প্লাবন।

সেই জগৎকে মিথ্যা বলছে না উপনিষদ। মিথ্যা বলছে না বিজ্ঞান। মিথ্যা বলছেন না রবীন্দ্রনাথ।

আমরা কেন সেই জগৎকে মিথ্যা বলার ভুল আজও করব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *