চকিত জানালা

চকিত জানালা

জীবনে মাত্র এই তিনটি মাসই আমি গ্রামে ছিলাম। এই মাসগুলোর কাছে আমি গভীরভাবে ঋণী। দুর্ভাগ্যের দিনে সেখানে গিয়েছিলাম বলে গ্রামের বাস্তবতা ও দুঃখী মানুষের বেদনাকে জানার অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছিলাম।

ইবনে বতুতা ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী। প্রথম যৌবনে পৃথিবী ভ্রমণে বের হয়ে তিনি গোটা মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন পর্যটন করে পরিণত বয়সে নিজ দেশে ফিরে যান। এর পর আবার বেরিয়ে যান মধ্য আফ্রিকার নরখাদকদের দেশগুলো পরিভ্রমণ করতে। সব শেষ করে তিনি ফিরে আসেন মরক্কোতে। আজ থেকে আটশো বছর আগে তিনি ভ্রমণ করেছিলেন পঁচাত্তর হাজার মাইল। এত অসংখ্য দেশ পর্যটনের পর জীবনের শেষে লেখা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তের সমাপ্তিতে তিনি লিখেছেন :

‘অসংখ্য সুন্দর, নয়নাভিরাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ দেশ আমি দেখেছি। কিন্তু আমার জন্মভূমির চেয়ে শ্রেষ্ঠ দেশ দেখিনি। এখানে ফলের সম্ভার অপর্যাপ্ত এবং বহমান পানির স্রোত এবং অফুরন্ত খাদ্যদ্রব্য কখনো নিঃশেষ হয় না।’ আমি পর্যটক নই। কিন্তু আমি বাংলাদেশের প্রতিটা জেলার আনাচে-কানাচে ঘুরেছি। সব ঘোরার পর আজ আমার বলতে লোভ হয় বাংলাদেশের গোটা সমতল এলাকার মধ্যে বাগেরহাটের চেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আমি হয়ত আর দেখিনি। কেবল বাগেরহাট নয়, দক্ষিণবঙ্গের গোটা সামুদ্রিক উপকূল এলাকা সম্বন্ধে একথা কমবেশি প্রযোজ্য। হাজার হাজার সুপারি, নারকেল, তাল আর কাঠবাদাম গাছের বাগানে ভরা এর প্রকৃতির অনাবিল রূপ সত্যিসত্যি চোখ জুড়িয়ে দেয়। গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা অজস্র ছোট ছোট নদী আর খালগুলো আবিশ্রাম জোয়ার-ভাটায় একবার উপচে উঠছে, একবার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সে এক অপূর্ব লুকোচুরির খেলা। গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল লিখেছিলেন :

একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী,
ফুলে ও ফসলে কাদামাটি জলে ঝলমল করে লাবনী।

পল্লী বাংলার এই ঝলমল করা লাবনী বাগেরহাটে আমি দেখেছি। আমাদের পাশের বর্ধিষ্ণু গ্রামের নাম ধোপাখালি। সেখানকার স্কুলের সামনে বটগাছের ছায়ায় বাঁশের ফ্রেমের ওপর অসমান তক্তা দিয়ে তৈরি বেঞ্চির ওপর বসে সবুজ সতেজ ক্ষেতের ওপাশের ছবির মতো গ্রামগুলোর স্নিগ্ধ শ্যামল রূপের দিকে আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হত সেই বিপুল সবুজের হরিৎ রসে আমার শরীরের রক্তধারা যেন সবুজ হয়ে উঠছে।

জীবনে মাত্র এই তিনটি মাসই আমি গ্রামে ছিলাম। এই মাসগুলোর কাছে আমি গভীরভাবে ঋণী। দুর্ভাগ্যের দিনে সেখানে গিয়েছিলাম বলে গ্রামের বাস্তবতা ও দুঃখী মানুষের বেদনাকে জানার অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছিলাম।

গ্রামে গিয়েই আমাদের বিরাট পরিবারটির আর্থিক দুঃখকষ্টের যে করুণ চেহারা দেখলাম তা আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেল। মামা এবং তাঁর শ্বশুর বাড়ির সচ্ছল পরিবেশে থাকায় এতদিন আমি আমাদের আসল দুরবস্থার চেহারাটা ভাবতেও পারিনি। সবকিছু দেখে চোখে পানি এসে গেল। আব্বার হাতে একেবারেই কোনো জমানো টাকা ছিল না। (আব্বা যে টাকা পয়সার ব্যাপারে কতটা নিস্পৃহ ছিলেন তার একটা প্রমাণ দিই। এই সময়ের বছর দশেক পরে চাকরি থেকে যখন তিনি অবসর নেন তখন তাঁর হাতে ছিল মাত্র দু-হাজার টাকা)। সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার পর আব্বাকে তাঁর বেতনের মাত্র চারভাগের একভাগ দেওয়া হচ্ছিল। এতে আব্বা পাচ্ছিলেন পৌনে দুশো থেকে দুশো টাকার মতো। এর মধ্যে থেকে আব্বা নিজের আর আমাদের জন্যে কিছু রেখে একশো থেকে সোয়াশো টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। আব্বার জমিজমা কিছুই ছিল না। বহুদিন আগে বাসার বাজার-খরচ থেকে বাঁচানো টাকায় আমার মা একটা বাড়ি কিনে রেখে গিয়েছিলেন, ওটাই তখন আমাদের গোটা পরিবারটির একমাত্র আশ্রয়। ঐ বাড়ির একদিকে ছিল একটা ছোট্ট পুকুর, তাতে কিছু রুই মাছের পোনা ছাড়া হয়েছিল। আমি যখন সেখানে যাই তখন সেগুলোর আকার আধসের তিনপোয়ার মতো হয়েছে। মাছ ছাড়া আর একটা মাত্র খাদ্যের উৎস ছিল আমাদের। বাসার সামনের বেগুনের ক্ষেতটার অফুরন্ত বেগুন। প্রতিদিনই সেখান থেকে বিশ-পঁচিশটা করে বেগুন পাওয়া যেত। পুকুর থেকে মাছ ধরা হত ক্বচিৎ-কদাচিৎ, সপ্তাহে একটা বা দুটোর মতো। এতে সারা সপ্তাহে এক বা দুই বেলা আমাদের মাছ জুটত। বেগুন ছিল বাকি সব বেলার বাধ্যতামূলক খাবার। সকাল বিকেল রাত এই তিনবেলা শুধু বেগুন দিয়ে ভাত খেয়েই মাসের পর মাস আমাদের কাটাতে হয়েছে। দিনের পর দিন বেগুন খেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বেগুনের ওপর আমার ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে দিল, পরের বেলা আবার বেগুন খেতে হবে ভাবলে মনটা বিবমিষায় ঘুলিয়ে উঠত। ক্ষোভে চোখে পানি এসে যেত। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। এর বিকল্প একটাই। পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়া। ব্যাপারটা এমনিতে কিছুই নয়। মাঝে মাঝে খেতে ভালোই লাগে। কিন্তু আর কিছু নেই, চোখের পানিতে একসার হয়ে গেলেও অন্য কিছু পাওয়া যাবে না, কেবল পেঁয়াজ মরিচ দিয়েই খেতে হবে এ বড় মর্মান্তিক। চারদিক যেন মরুভূমির মতো খাঁ-খাঁ করত। কিন্তু কষ্টের চূড়ান্ত মুহূর্তে যখন ভাবতাম বাসার বাকিরা এই খেয়েই গত একবছর ধরে বেঁচে আছে তখন মন কিছুটা শান্ত হত। পাবনায় আমাদের মাসে খরচ ছিল সাত-আটশ টাকা। এখন চলতে হচ্ছে একশো-সোয়াশো টাকা দিয়ে। এ দিয়ে এর চেয়ে ভালো খাবার কী পাওয়া যেতে পারে কেউ বুঝতে পারত না। মার কাছে অনুযোগ করলে তিনি অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকতেন। পৃথিবীতে টাকার যে এত দাম, বেঁচে থাকার যে এত কষ্ট, এর আগে কখনও বুঝিনি। জীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। এর জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। এ যে এত কষ্টের এ আমি চিন্তাও করতে পারিনি। খাওয়া পড়া কাপড়-চোপড় সবই তো আমাদের কমবেশি ছিল। তবু খাদ্যের ঐ অসহ্য কষ্টে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। আমার ভেতর মৃত্যুর অনুভূতি হত। এরমধ্যে বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছিল। কাদায় পানিতে রাস্তাঘাট প্যাঁচপ্যাঁচ করছে। ঘিনঘিনে বৃষ্টির ভেতর দিনরাত বাসায় আটকা পড়ে বিছানায় শুয়ে কাটাতে আমার মন বিশ্রীভাবে বিমর্ষ হয়ে যেত। মনে হত হয়ত চিরদিন বাগেরহাটের এই দূর অজগ্রামের ভেতরে এভাবে থেকে থেকেই একদিন শেষ হয়ে যাব। আমি সেই ক্ষুধার্ত গ্রাম থেকে শুধু পালাতে চাইতাম। আমাদের বাড়ি থেকে বাগেরহাট যাবার মাটির রাস্তা থাকলেও তা ছিল খুবই ভাঙাচোরা। সে রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলত না। হাঁটাও যেত না। বর্ষা আসায় তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। অথচ বাগেরহাট তখন আমাকে সারাক্ষণ হাতছানি দিচ্ছে। যেন ওখানেই সব দুর্ভাগ্যের উদ্ধার, সব দুঃস্বপ্নের মুক্তি। গ্রাম নয়, বাগেরহাটকে মনে হত আমার নিজের জায়গা। আমার মনও ছুটে যেতে চাইত বাগেরহাটের দিকে। ওখানে গেলেই আমি স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতাম। কিন্তু থাকার জায়গা না থাকায় আব্বার সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরে আসতে হত। (আব্বা তখন ওখানকার এক প্রকাশকের বাড়িতে মাসখানেকের জন্যে থেকে তার জন্যে একটা পাঠ্যবই লিখে দিচ্ছেন।) তাই আশা নিয়ে বাগেরহাট গেলেও শহরটাকে আমার কাছে আশ্রয়হীন এক শূন্য নিষ্ঠুর মরুভূমির মতো লাগত। বাগেরহাটে আমাকে যেতে হত ছোট্ট নৌকায় করে। এর জন্যও মাঝিকে দিতে হত পৌনে দু’ টাকা। এই টানাটানির ভেতর ঐ টাকা পাওয়ারও উপায় ছিল না। তবু মা কষ্ট করে আমাকে দুবার যাতায়াতের ভাড়া দেওয়ায় বার-দুয়েক নৌকায় করে বাগেরহাট ঘুরে এসেছি। জোয়ার উজিয়ে প্রায়ই নৌকা এগোতে চাইত না। সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে একটানা চলার পর একসময়ে নৌকা গ্রাম ছেড়ে অন্তহীন ধানক্ষেতের ভেতর এসে পড়ত। এর পরই ভৈরব নদী। এই সাড়ে তিন ঘণ্টাকে আমার কাছে অনন্তকালের সমান দীর্ঘ ও নির্দয় মনে হত। যেন সেই নিরন্ন নিঃস্ব গ্রাম থেকে কিছুতেই আমার নিষ্কৃতি নেই। ভৈরব নদীর ওপারেই বাগেরহাট শহরের সারবাঁধা উঁচু উঁচু দালানকোঠা, রাস্তাঘাট। অন্নহীন আলোহীন অজগ্রাম থেকে আসায় শহরটাকে আমার চোখে মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ বৈভব আর ঐশ্বর্যের প্রতীক বলে মনে হত। এর দালানকোঠাগুলোকে আরও বিশাল আর অভ্রভেদী লাগত। এই বৈভবের সামনে তুচ্ছ কামারগাতি গ্রামের আমার বিমর্ষ নিরন্ন অসহায় অস্তিত্বটা যেন আরও করুণ হয়ে আমাকে করুণা করতে থাকত। দীর্ঘশ্বাসের মতো মনে হত সভ্যতার এই সুউচ্চ সৌধে হয়ত কোনোদিন আর ফিরে যেতে পারব না। বাগেরহাট শহর আমার কাছে হয়ে উঠত পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ বস্তু ও আকাঙ্ক্ষিত ‘নগরী’। তখন মন ছিল অপরিণত। খুব অল্পতেই উদ্দীপ্ত হতাম, অল্পতেই ভেঙে পড়তাম।

গ্রামে যা দেখে আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম তা হল কাইজা। মুসলমান আর নমশূদ্রদের মধ্যে কাইজা আমাদের এলাকার যুগ-যুগের ঐতিহ্য। ফরিদপুর, বরিশাল, যশোহর, খুলনা এলাকায় মুসলমান আর নমশূদ্রদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। মর্যাদার প্রশ্ন ধরে প্রায়ই তারা রক্তাক্ত কাইজায় লিপ্ত হত। অনেক সময় একেক পক্ষে দশ-বিশ হাজার মানুষ বল্লম, সড়কি, রামদা, ট্যাটা, লাঠি, ঢাল নিয়ে জীবনমরণ লড়াইয়ে নেমে যেত। জন্ম হত বড় বড় রক্তক্ষয়ী মহাকাইজার। এগুলো ছিল একধরনের জাতিগত গৌরবের যুদ্ধ। জসীমউদ্দীনের কবিতায় এমনি এক ভয়াবহ কাইজার বর্ণনা আছে। ছোটখাটো কাইজা হত অহরহ। চরের ধানকাটা নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রামের মানুষের, তুচ্ছ প্রেমের ঘটনা নিয়ে নমু-মুসলমানের, সামান্য অপমানের উছিলা ধরে দুই গোত্রের মানুষ জড়িয়ে পড়ত কাইজায়। রণোন্মত্ত কাইজার পর শ্মশানে পরিণত হত গোটা এলাকা। খুন হওয়া মানুষদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে, ভিটেমাটি ছাড়া বা সর্বস্বহারানো মানুষদের দুঃখে, পুলিশি অত্যাচারে, মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে যেত বহু মানুষ। তবু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকত এই ধারা। জসীমউদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ আর ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটে’ দুটো আলাদা ধরনের কাইজার জীবন্ত চিত্র আছে।

আমাদের অঞ্চলেই একটা কাইজা দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার ঐ সময়। প্রত্যেক দলে তিন-চারশো করে লোক অংশ নিয়েছিল কাইজাটাতে। দুই দলের লোকেরাই ছিল রক্ত-সম্পর্কীয়। তাছাড়া স্থানীয় পরিচিত কিছু কাইজাবাজ, ভাড়া করে আনা কিছু নির্দয় চেহারার লোকও ছিল দু’দলে। বীরত্বের বা খ্যাতির জন্যেও এসেছিল অনেকে। সবাই ঢাল, শড়কি, বল্লম, কোচ, রামদা হাতে নিয়ে যখন খোলা মাঠের ওপর দিয়ে দুর্বোধ্য চিৎকার করতে করতে সার-বেঁধে বিপক্ষ দলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন চোখের সামনে এক টুকরো অকর্ষিত ও রক্তস্নাত মধ্যযুগকেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই প্রাচীন গোত্রীয় লড়াই, গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর, রক্তসম্পর্কীয়দের সঙ্গে রক্তসম্পর্কীয়দের সনাতন বিরোধ! ঘটনাটা বছর পঞ্চাশেক আগের। এ থেকেই বোঝা যায়, তখনও মধ্যযুগ আমাদের এলাকার জনমানসে কীভাবে জেঁকে আছে। এরকম পরিবেশে জন্মে এরও চল্লিশ বছর আগে আব্বা যে কী করে উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং তারও বছর দশেক আগে তাঁর চাচা গয়েজউদ্দীন ‘এন্ট্রান্স ফেল’-এর মতো দুর্ধর্ষ ডিগ্রি নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন সেটা সত্যি আশ্চর্যের।

আমাদের এলাকার কাইজাগুলো মূলত ছিল গোষ্ঠীগত। এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর হাতে মর্যাদা হারিয়েছে অনুভব করলে, ইয়োরোপের ডুয়েলের আদলে, দিনক্ষণ দিয়ে সেই গোষ্ঠীকে কাইজায় আহ্বান করত। এছাড়াও নানান কারণে কাইজা হওয়ার রেওয়াজ ছিল। আমার দেখা সেদিনের কাইজাটা ছিল মর্যাদাভিত্তিক। এটি হচ্ছিল দুই বংশের লোকের মধ্যে। এ ধরনের কাইজায় বড় ধরনের রক্তারক্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। সেদিনও তাই ছিল। কিন্তু এলাকার ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট (এখনকার চেয়ারম্যান) জীবন বাজি রেখে নিরস্ত্র অবস্থায় দুই দলের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে এবং মর্যাদা হারানোর দলের এক রগচটা যুবক, কাইজায় বাধা দেওয়ায়, ক্ষেপে গিয়ে শড়কি দিয়ে তাঁকে মারাত্মকভাবে গেঁথে ফেললে দুদলই ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

কাইজার ভয়ঙ্কর চেহারার লোকগুলোর চেয়েও আমার কাছে যাদের অনেক বেশি জীবন্ত ও আকর্ষণীয় লেগেছিল তারা হল এর অগণিত দর্শক। কাইজার মাঠের চারধারের সবুজ গ্রামগুলোর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাইজা দেখছিল তারা। আমি ছিলাম তাদের দলেই। তাদের কারো কারো আত্মীয়স্বজনও যোগ দিয়েছে কাইজায়। আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় তারা বিবর্ণ। সাধারণ দর্শকদের মধ্যেও টান টান উত্তেজনা। দুই পক্ষে কজন খুন হয় তা দেখার জন্যে তারা উৎসুক। তাদের মূল আগ্রহই যেন সেটা। এরকম কিছু হলে সেইসব রোমহর্ষক ঘটনা নিয়ে গল্প করে অনেকগুলো রাতকে বাসযোগ্য করে তুলতে পারবে তারা। মিথ্যা মামলায় পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ত হবে তাদেরও কেউ কেউ। অনেকে গাঁ-ছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়াবে। তবু তাদের নিস্তরঙ্গ নিস্পৃহ জীবনে কিছু উত্তেজনা আসবে। উষ্ণতার আঁচে জীবন গমগম করবে কিছুদিন। না হলে এই নিরীহ নিষ্প্রাণ একঘেয়ে জীবনে কী নিয়ে বাঁচবে তারা?

যারা কাইজায়, যোগ দিয়েছিল তারা একই এলাকার মানুষ। সবাই সবার পরিচিত। দেপাড়া হাটে সপ্তাহান্তে তাদের দেখা হয়। অনেকেই অনেকের বন্ধু এমনকি নিকট আত্মীয়। গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠানে তারা একসঙ্গে আনন্দ করে। আমার খালি মনে হচ্ছিল, এত কাছের মানুষেরা এভাবে কাইজা করে কী করে নিকট আত্মীয়-বন্ধুকে খুন করে? আমার ধারণা, এ হচ্ছে মানুষের ভেতরকার সেই চিরকালের অবদমিত আদিম আগ্রাসী প্রবৃত্তি—গ্রামের বৈচিত্র্যহীন, গতানুগতিক জীবনস্রোতের ভেতর তা কোনোভাবে নিজেকে চরিতার্থ করতে না পেরে তুচ্ছ সব ব্যাপারকে উছিলা করে এমনি রক্তের খেলায় মেতে ওঠে। কিংবা কে জানে এ তাদের জীবনের একধরনের জমকালো সামাজিক উৎসব কি না বা নিস্তরঙ্গ নিরুত্তাপ গ্রামীণ জীবনের ভেতর দিন-কয়েকের রোমাঞ্চকর উত্তেজনা ছড়িয়ে জীবনকে বাসযোগ্য করার প্রয়াস কি না। যে-কারণে এককালে গ্রামে জমকালো কবির লড়াই আয়োজিত হত, কীর্তন জমত, জমিদারেরা বাড়িতে নামকরা যাত্রাদল এনে গ্রামের জীবনে চাঞ্চল্য ছড়াত, এও হয়ত কিছুটা তাই।

একটা সত্যিকার ভয়ের অভিজ্ঞতা ঘটেছিল এই তিন মাসের মধ্যে। এই ছোট্ট গল্পটি বলেই গ্রামের পর্ব শেষ করব। আগেই বলেছি, বাগেরহাটে আমাদের এলাকা অজস্র খালে-নালায় ভর্তি। হয়ত নিয়মিত জোয়ার-ভাটার পানি চলাচলের প্রয়োজনেই ওগুলো বহুকালের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে। হাতের আঙুলের মতো গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে সেগুলো ছড়ানো। আমাদের এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে তাই নৌকা থাকে। ও ছাড়া চলাফেরা অসম্ভব। গ্রামে গিয়ে সেইসব খালে তখন সবে নৌকা চালানো শিখেছি। ফুরসৎ পেলেই ডিঙি নিয়ে ছোট ছোট খালে একা একা ঘুরে বেড়াই।

আগেই বলেছি আমার স্বভাবের মধ্যে উৎসাহের একটা অন্ধ নেশা আছে। কোনো স্বপ্ন একবার মাথায় চেপে বসলে সামনের বিপদ-আপদগুলোকে একেবারেই দেখতে পাই না। সেদিনও হল তাই। আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে চওড়া নদী বলেশ্বর। নদীটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা বলে বর্ষাকালে ওতে বিরাট বিরাট ঢেউ ওঠে। হঠাৎ মনে হল নৌকা নিয়ে বলেশ্বর পাড়ি দেব। আমি যে সবে নৌকা চালাতে শিখেছি, কিছুতেই বলেশ্বরের মতো ঢেউবহুল নদীতে যাওয়া উচিত নয়, তা আমার মাথা থেকে পুরো উবে গেল। আমার চোখের সামনে তখন বলেশ্বরের উত্তাল ঢেউয়ের ওপর দিয়ে আমার নৌকা চালিয়ে যাবার গর্বিত উধাও দৃশ্য। তবু বিপদ হতে পারে ভেবে আমারই বয়সের এক ফুপাত ভাইকে সঙ্গে নিলাম। সে নৌকা চালানোয় খুবই অভিজ্ঞ। নৌকা চালাতে চালাতে একটা মাঝারি খাল থেকে একসময় আস্তে করে ঢুকে গেলাম বলেশ্বরে। খালের মোহনার কাছে পানি শান্ত, প্রথমে কিছুই টের পাইনি। কিন্তু নদীতে ঢুকতেই ঠিক যেন ডাকাতের হাতে পড়লাম। ছোট নদীতে নৌকা চালাই বলে বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে কী করে খেলতে খেলতে এগোতে হয় জানি না। তবু কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ জোর দমকা হাওয়া ওঠায় নদীর ঢেউ আর ও উত্তাল হয়ে উঠল। সেই বিশাল ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে ভয়ে সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। আমার ফুপাত ভাই বুঝে ফেলল এক্ষুণি আমি নৌকা ডুবিয়ে ফেলব। সে হালটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে হুড়মুড় করে এগোতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে গেল নৌকার এক পাশে। নৌকা কাত হয়ে ডুবুডুবু হতেই একটা বিরাট ঢেউ আমাদের ওপর আছড়ে পড়ে চোখের পলকে নৌকাটাকে তলিয়ে দিল। আমি ভালো সাঁতারু, এমন নদী সাঁতরে পাড়ে ওঠা আমার পক্ষে ডালভাত। কিন্তু অসম্ভব ভয় ঘিরে ধরল আমাকে। এর কারণ নদী নয়, কামোট। কামোট ছোট আকারের হাঙর। সাধারণত সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে ঘুরে বেড়ায় এরা। কিন্তু সেবার আমাদের এলাকায় এরা এসে পড়েছিল বিপুলসংখ্যায়। প্রতিটি ছোট বড় খাল আর নদী তখন কামোটে ভরা। এরই মধ্যে আমাদের আশেপাশের বেশকিছু নদীতে বহু মানুষের হাত, পা কেটে নিয়েছে তারা। ভয়ে গোটা এলাকায় নদীতে নামছে না কেউ। বলেশ্বরে এদের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। প্রায় সবখানে এরা ঘুরছে। অথচ কী আশ্চর্য বলেশ্বরে যাবার উত্তেজনায় এদের কথা আমার মনেও আসেনি। কিন্তু নৌকা তলিয়ে যেতেই এদের আতঙ্কে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল। সাঁতরানোর প্রতিমুহূর্তে ভয়ার্তভাবে আমার মনে হতে লাগল পানির নিচে এদের শাণিত হিম দাঁত আমাকে কুচিকুচি করে ফেলছে আর আমি মৃত্যুর শীতল অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। নদীর ঘুটঘুটে কালো পানির মধ্যে আমি কেবল কামোটের চোখ আর মৃত্যুর বিভীষিকা দেখতে লাগলাম। হঠাৎ-ভয়ের এই অনুভূতি সত্যি খুবই আতঙ্কজনক। মিনিট পনেরো সাঁতরানোর পর আমরা পাড়ে গিয়ে পৌঁছলাম। কিন্তু তখনও মৃত্যুর গভীর ভীতি আমার রক্তে রক্তে জল্লাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। ভয়ে ক্লান্তিতে শরীর শুধু থরথর করছে।

আমার ভাইটিও খুবই ভয় পেয়েছিল। এই ভয় থেকে সারিয়ে তোলার জন্যে সবাই আমাদের ধরাধরি করে কাছাকাছি একজন পীরের কাছে নিয়ে গেল। পীর অশীতিপর বৃদ্ধ। তাঁর শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, চোখ জ্যোতিহীন, ঠোঁট ঝুলে পড়া, ফোকলা মুখের ধার ঘেঁষে অল্প অল্প লালা ঝরছে। আমাকে তাঁর সামনে বসিয়ে দিতেই তিনি খুব কাছে এসে নিষ্প্রভ জ্যোতিহীন চাউনি দিয়ে আমার মুখটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। তারপর ডান হাতের আঙুল দিয়ে অর্থপূর্ণভাবে কী একটা যেন ইশারা করলেন। একজন দৌড়ে গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে এল। উনি তার কদাকার মুখ-গহ্বরের ভেতর অনেকখানি পানি ঢুকিয়ে কুলকুচি করতে করতে, হঠাৎ, আমি বোঝার আগেই, প্রচণ্ড বেগে তা দিয়ে আমার মুখের ওপর বিভৎসভাবে কুলি করে দিলেন। তাঁর বৃদ্ধ কুৎসিত মুখের লালা সমেত সেই বিপুল জলীয় পদার্থ সশব্দে আমার মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ে নাক- মুখের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে গেল। ঘৃণায় আমার বমি হবার উপক্রম হল। এমন প্রচণ্ড বিবমিষার অনুভূতি আমার কমই হয়েছে। সেই লালা সমেত ক্লেদের জঘন্য অনুভূতিতে আমার সারা অস্তিত্ব ঘিনঘিনে হয়ে উঠল। গোটা মগজ আবিল হয়ে রইল। এর ফলে খারাপ যা হবার সবই হল। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম কিছুক্ষণ আগে ভয়ের যে অতিকায় ভীতিটা আমার বুকের ওপর দৈত্যের মতো চেপে বসেছিল আমার ভেতর তার চিহ্নটুকুও নেই। চিকিৎসাশাস্ত্রে একেই হয়ত বলে শক ট্রিটমেন্ট—কাউকে একটা মানসিক বা শারীরিক আঘাত দিয়ে প্রবলতর কোনো মানসিক বা শারীরিক আঘাত সারিয়ে তোলা।

আগেই বলেছি, শৈশব মানুষের জীবনে একটা নির্জলা অনুভূতির কাল। এই সময় মানুষ অবোধভাবে অনেক কিছু নিয়ে উদ্বেলিত হয় কিন্তু সজাগভাবে কোনো ব্যাপারেই নিশ্চিত হয় না। নানা অস্ফুট প্রবল উন্মাদনা তার হৃদয়টাকে কেবলি মাতালের মতো এদিক ওদিক ছুটিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু জানে না, তার আকুতি শেষ পর্যন্ত তাকে দিয়ে এই জগতে কী করাবে। এই সময় তারা যা বলে তার অধিকাংশ তাকে নিয়ে তার বাবা, মা বা আশেপাশের গুরুজনেরা কী স্বপ্ন দেখছেন, তাকে কী হতে উদ্বুদ্ধ করছেন তারই নির্বোধ প্রতিধ্বনি শুধু; তার নিজের আকুতির কথা নয়।

আগেই বলেছি ভাগনেদের মধ্যে বড় মামা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। মা মারা যাবার পর তিনি যেন ধরেই রেখেছিলেন যে, আমাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। তিনি ঠিক করেছিলেন আমাকে তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বানাবেন। বিলেতে থাকার সময় মামা ওখানে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের খুব কদর দেখেছিলেন। মোটা অঙ্কের রোজগারে, সামাজিক মর্যাদায় লন্ডনের সমাজে তারা তখন প্রায় শীর্ষে। হয়ত এজন্যেই আমাকে নিয়েও তাঁর এই স্বপ্ন জেগেছিল। ঢাকায় মামার কাছে থাকার সময় তিনি আমাকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেসি পড়ার ব্যাপারে জোরেশোরে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। পড়াশোনা করে বি.এ., এম.এ. পাস করার সঙ্গে যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বা প্রাপ্তি-রোজগারের কোনো সম্পর্ক আছে তা তখন পর্যন্ত আমার মাথায় আসেনি। আব্বা আমাকে কোনোদিন এসব কিছুই বলেননি। আমি জানতাম পড়াশোনা এমন একটা কাজ যা একজন ছাত্রকে নিয়মিত ও কষ্টকরভাবে বছরের পর বছর করে যেতে হয়। ব্যস। কিন্তু মামা হিশেব করে দেখালেন একবার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে পারলে মাসে মাসে কী পরিমাণ টাকা আমি রোজগার করব, কী আলিশান বিলাসবৈভবের মধ্যে আমার জীবন কাটবে। যে বিরাট অঙ্কের কথা মামা বললেন তা যে এই দীনহীন আমিই রোজগার করব ভাবতেও মনটা ফূর্তিতে লাফিয়ে উঠল। মামাকে আমি সবসময়েই খুব বড় মানুষ ভাবতাম। তাঁর মতন একজন মানুষ যে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে ভাবছেন এতেই আমি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। তার ওপরে টাকা-পয়সার এমন বিপুল ঝনৎকার। আমি উদ্ভাসিত হয়ে উঠলাম। ঠিক করলাম চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টই হব। এখন এর জন্যে প্রথমেই যা করা দরকার তা হল আইকম পাস করা। ঠিক করলাম ম্যাট্রিক পাসের পর সোজা আইকমে ভর্তি হব। টাকা-পয়সার স্বপ্নে এমনিতেই মনটা বিভোর হয়ে ছিল। তার ওপর এমন এক খবর পাওয়া গেল যে মাস কয়েকের জন্যে ঘুম হারাম হবার জোগাড় হল। এক গণক হঠাৎ আমার হাত দেখে একদিন বলে বসল, “তুমি তো দেখছি সারাজীবন টাকার ওপর গড়াগড়ি খাবে হে!” তার কথায় আশ্বাসে মন ফূর্তিতে আরও টগবগিয়ে উঠল। আমি আমার দিনরাতের স্বপ্নে সারাক্ষণ পিঠের নিচে বিপুল টাকার খসখস গজগজ শব্দ শুনতে লাগলাম।

এদিকে ঢাকা থেকে পাবনায় ফিরে আসার পর আবার এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে আমার মনটার পুরো অন্যখাতে বয়ে যাবার জোগাড় হল। ঘটনাটা ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাস-দুতিন আগের। একদিন বিকেলে আমি আর খায়রুল স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে গল্প করছি, হঠাৎ আমার দেখা একটা চমৎকার সকালের কথা এসে পড়ল। আমি যতটা সম্ভব সুন্দর শব্দ আর উপমা দিয়ে সকালটার একটা রমণীয় ছবি খায়রুলের চোখের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম বর্ণনাটা শুনতে শুনতে খায়রুলের চোখে একটা মুগ্ধ সপ্রশংস ভাব ছড়িয়ে পড়ছে। আমার কথা শেষ হতেই বলল : ‘বাহ্ চমৎকার বর্ণনা দিলে তো! একদম কবিদের মতো। তোমার মধ্যে একটা কবি আছে দেখছি।’

অদ্ভুত শিহরণে আমার বুকের ভেতরটা ঝনঝন করে উঠল। আমার বর্ণনা ওর ভালো লেগেছে? আমার কথা কবিদের মতো? আমার ভেতর কবি আছে? কবি? আমি কবি? সেই অবিশ্বাস্য অপার্থিব মানুষদের দলের? আমার সারা অস্তিত্ব শিউরে উঠল। এক মুহূর্তে আমি যেন বদলে গেলাম। কবিতা আমার কাছে পৃথিবীর অপরূপতম জিনিশ হয়ে উঠল। যে কবিতাকে আমি মনের ভেতর প্রায় প্রেমিকার মতো ভালোবাসতাম, অথচ জানতাম না যে ভালোবাসি, সেই কবিতাকে যেন নতুন করে খুঁজে পেলাম। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম আমার ভেতরকার খেলাধুলা নিয়ে বিভোর হয়ে থাকা আশৈশবের সেই ছেলেটি যেন এক মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল। তার জায়গায় জন্ম নিল একটা নতুন ছেলে—ভাবুক, বিষণ্ণ, অনুভূতিময়।

এই বইয়ের গল্প এই অর্ধবন্য অর্ধসভ্য, বিষয় বুদ্ধিহীন, বিস্ময়ভরা এক অবোধ শিশুর গল্প। তার স্বপ্নাবিষ্ট উদ্ভট কল্পনার যেন লাগাম নেই। একেকবার তার মন একেকদিকে ছুটেছে। একবার গুণ্ডা, একবার শিক্ষক, একবার দার্শনিক, একবার ট্রেনের ড্রাইভার, একবার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, একবার কবি হবার অবাস্তব স্বপ্নে তার হৃদয় উতলা হয়েছে। ক্লাস নাইনে ওঠার পর হয়ত জিলা স্কুলের মার্জিত পরিবেশের প্রভাবে গুণ্ডা হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষাটা মাথা থেকে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু বাকিগুলোর কোনোটাই যেন ছাড়তে চাচ্ছে না। কিন্তু একসঙ্গে কী করে এতকিছু হওয়া যায়? বুঝতে অসুবিধা নেই যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়েও কবি বা দার্শনিক হওয়া যেতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে শিক্ষক বা ট্রেনের ড্রাইভার হওয়া কী করে সম্ভব? কিন্তু কেন যেন মনে হল, হয়ে যাবে। কীভাবে হবে জানা নেই, তবু বিশ্বাস হয় : হবে। ঠিক যেভাবে বলেশ্বরের ঢেউয়ের ভেতর যাবার আগে মনে হয়েছিল হবে—সেভাবে। এটাই মানুষের সেই বহুকথিত অন্ধত্ব। যখন সবকিছু পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, উদ্ধারের কোনো পথই নেই, তখনও মানুষ বিশ্বাস করে : হবে। অন্ধের মতো এভাবে ভাবতে পারে বলেই শেষপর্যন্ত হয়েও যায়। মানুষ শেষপর্যন্ত সবকিছু পারে না, কিন্তু সবকিছুই সে আরম্ভ করে। অনেক অবোধ স্বপ্ন সারা শৈশবজুড়ে আমার মনকে উথাল-পাতাল করেছে। কিন্তু জীবন কি সেই পথ ধরে এগিয়েছে? নাকি এদের কিছু নিয়েছ, কিছু ফেলে দিয়েছ? নাকি এসে গেছে নতুন কোনো আকুতি, নতুন স্বপ্ন—যা ছেলেবেলায় ছিল একেবারেই অপরিচিত বা অবিশ্বাস্য? আগামীতে তা বলার ইচ্ছা রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *