চকমকি

চকমকি

সন্ধ্যাদির সঙ্গে আমার পরিচয় হবার কোনো কারণ ছিল না। একই অফিসে চাকরি করতাম। কিন্তু আমি বসতাম নীচের তলায়, সন্ধ্যাদি ছিলেন অনেক উপরে—এগারো তলায়। লম্বা অফিসঘরের একপাশে দরজা ঘেঁষে বসতেন ছোটো টেবিলের সামনে বিশাল চেহারা। তাঁর কাজ ছিল সারাদিন ধরে রাজ্যের চিঠি ইত্যাদি রিসিভ করা। তারপর মোড়ক খুলে খুলে সেই সমস্ত চিঠি ‘ডাক’ লেখা বিভিন্ন কভারে ভরে অফিসারদের ঘরে পাঠানো। এই প্রচন্ড একঘেয়ে কাজ তিনি এমন নিষ্ঠা এবং আগ্রহের সঙ্গে করতেন মনে হত সারা অফিসে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বুঝি আর দ্বিতীয় নেই। উপরের ওই লম্বা অফিসে আমি কালেভদ্রে যেতাম। নীচের তলায় গাদা ভিজিটারের সঙ্গে গালগল্প করে কিংবা ঝগড়াঝাঁটি করে আমার দিন বেশ মজায় কেটে যেত। জনসংযোগ মানেই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে লোক হঠানো। ধুলো পায়েই বিদায় করে দাও। নেহাত নাছোড়বান্দা না হলে উপরে কোনো লোককে তুলো না। বড়কর্তা ভীষণ ব্যস্ত, সারাদিন কনফারেন্স ফাইলবাজি, প্ল্যানিং, এর মাঝে উটকো লোক এসে বারে বারে বিরক্ত করলে মেজাজ রাখা যায় না। সারাদিন বকবক করার পর আর উপরে যাবার সময় থাকত না। দেউড়ির পাশে বসে সারাদিন দেউড়ি আগলে, দিনের শেষে টুপ করে কেটে পড়তাম। কে সন্ধ্যা, কে আরতি, এ সব খবর রাখবার আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অবশ্য আসা ও যাওয়ার পথের ধারে বসে হঠাৎ কোনো চটকদার মহিলা নজরে পড়লে একটু খোঁজখবর করার প্রয়োজন হত, কোন ফ্লোরে কাজ করেন কার সঙ্গে ঘোরেন ইত্যাদি। এ কৌতূহল আর কিছুই নয়, বয়সের দোষ।

সন্ধ্যাদি সম্বন্ধে কারুর কোনো কৌতূহল ছিল না। ভগবান পৃথিবীতে এক ধরনের মহিলা পাঠান যাঁদের দিকে তাকালেই সন্ন্যাসী হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। সন্ধ্যাদি ছিলেন সেই জাতের মহিলা। অনেকটা ফোল্ডিং জাপানি ছাতার মতো দেখতে। বেঁটেখাটো চৌকো চেহারা, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় সমান। প্রায় টেলিফোন-রিসিভারের মতো রং। অসম্ভব গম্ভীর একটি মুখ, সবসময়েই অপ্রসন্ন চোখে মোটা লেন্সের চশমা। সব মিলিয়ে এমন একটা এফেক্ট, মনে হয় একটু বেচাল হলেই বুঝি নিলডাউন করিয়ে দেবেন। কী দরকার বাবা অমন মহিলার কাছাকাছি গিয়ে বিপদ ডেকে আনার। নেহাত বিপদে না পড়লে না যাওয়াই ভালো।

হাতদশেক দূরে রবিবাবু বসতেন। তাঁর কাজ ছিল চিঠি ডেসপ্যাচ করা। সন্ধ্যাদির দাপটে রবিবাবুও নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন। পৃথিবীর কোনও অফিসে এমন পালোয়ান, খিস্তিবাজ, পত্র ভেজনেবালে আর একটি আছেন কিনা সন্দেহ। আমরা মাঝে মাঝে রবিদার পাঠশালায় খিস্তি শিখতে আসতুম। রবিদা ছিলেন মহিলা-বিশেষজ্ঞ, যদিও নিজে ছিলেন অবিবাহিত। অমন চেহারার মানুষ কেন যে বিয়ে করেননি, অবাক কান্ড। আসলে উনি একটা হারেম রাখতেও পারতেন। অন্তত আমরা তাই বলাবলি করতুম। তার বদলে রবিদা যা করেছিলেন তা একটা মিনমিনে, ঘিনঘিনে ব্যাপারের পর্যায়ে পড়ে। অনেকটা দূরে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে একটি ডাঁসা মেয়ে টাইপিস্ট বসত, সেই মাধুরীর সঙ্গে রবিদার একটা অ্যাফেয়ার ছিল। মেয়ের বয়সী মেয়ে, রেলে কাজ করে এমন একটি ছেলেকে বিয়ে করে বসে আছে, তার সঙ্গে রবিদার যে কি করে নটঘট হল! ব্যাপারটা ইনটারেস্টিং। অফিসে ভদ্রমহিলার নিদারুণ গম্ভীর মুখ দেখে মনে হত ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না। অথচ রবিদা এই কোণে বসে রসিয়ে রসিয়ে আমাদের মাধুরীর অ্যানাটমি বোঝাতেন। পরে আমাদের কে যেন বলেছিল পৃথিবীর তাবৎ মহিলার রবিদার কাছ থেকে কোনো ভয় ছিল না। বাজির মধ্যে যেমন ফুলঝুরি একেবারে ইনোসেন্ট যে কেউ জ্বালাতে পারে, পুরুষের মধ্যে তেমনি রবিদা, যে কোনো মহিলার ট্যাঁকে ঘুরতে পারেন। ব্যাপারটার সত্যি মিথ্যে জানি না তবে জনশ্রুতি কবে কোন যৌবনকালে রবিদা নাকি পালোয়ানী করে কোমরে বারবেলের চাকা বেঁধে ওয়েট লিফট করতে গিয়ে ঢোঁড়া সাপ হয়ে গেছেন। সমস্ত শক্তি এখন জিভের ডগায়। কত রকমভাবে খিস্তি করা যায় তা রবিদার ঢালাও টেবিলের ধারে না বসলে অজানাই থেকে যাবে। সেই রবিদা পর্যন্ত সন্ধ্যাদি আসায় প্রায় বোবা। এমন কোনো মহিলা ছিলেন না যিনি রবিদার পাশ দিয়ে চলে গেলে কোনো না কোনো মন্তব্য বের করে আনতেন। একমাত্র সন্ধ্যাদিই ব্যতিক্রম। ওই মহিলা সম্পর্কে রবিদার কোনো কৌতূহল ছিল না। ছিল প্রচন্ড বিরক্তি। কথায় কথায় মার শালাকে বলতে পারতেন না। হঠাৎ মুখ ফসকে অশ্রাব্য কিছু বেরোলেই সন্ধ্যাদি খুব গম্ভীরভাবে বলতেন—এটা অফিস। রবিদা চুপসে যেতেন।

সেই সন্ধ্যাদির সঙ্গেও আমার পরিচয় হল। প্রথমত রবিদার চেলা হিসেবে সন্ধ্যাদির এলাকা আমাদের নিষিদ্ধ হওয়াই উচিত ছিল। আসলে প্রচন্ড একটা ঝগড়া করতে গিয়ে দুর্বল একটা জায়গায় ধাক্কা খেয়ে সন্ধ্যাদির সামনে বসে পড়েছিলাম। শুধু বসিনি ভবিষ্যতের পরামর্শ নিয়েছি, উঠে আসার সময় দিদি পাতিয়ে ফেলেছি। ভদ্রমহিলার চেহারা যেমনই হোক, তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছি। ঝগড়া করতে গিয়েছিলাম খুবই একটা সামান্য কারণে। ওই সময়ে একটি মেয়ে আমাকে অফিসের ঠিকানায় নিয়মিত চিঠি লিখত। ব্যক্তিগত চিঠি রিসিভিং ক্লার্কের খুলে দেখার কথা নয়। আগে কখন কোনো চিঠি খোলা অবস্থায় পাইনি। সেইদিনই প্রথম চিঠি পেলাম শুধু খোলা অবস্থায় নয় বিশেষ বিশেষ কয়েকটি লাইন লাল পেনসিলে আন্ডারলাইন করা। স্বভাবতই অগ্নিশর্মা হবার কথা। সন্ধ্যাদিকেই দোষী সাব্যস্ত করে ফাটাফাটি করতে এসেছিলাম। করা গেল না। পাকা কেরানির মতো সন্ধ্যাদি ব্যাপারটাকে এমনভাবে খেলিয়ে দিলেন আমার আর কিছুই করার রইল না। আসলে চিঠিটা রিসিভিং সেকসানে আসেনি। অন্য কোনো হাতে পড়েছিল। চলেই আসছিলাম সন্ধ্যাদি হঠাৎ বললেন—আপনার খুব ভালো সময় আসছে। গায়ে পড়া এই কথা শুনে নতুন করে ঝগড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম—জ্যোতিষী জানেন নাকি, এখানে না বসে অন্য কোথাও বসলে ভালো করতেন। তবে ওসব বুজরুকি আমি বিশ্বাস করি না। ধন্যবাদ।

সন্ধ্যাদি ঠোঁটের কাছে জলের গেলাসটা ধরেছিলেন। এক চুমুকে খানিকটা খেয়ে বললেন—তবে একটু সাবধানে থাকবেন, ভালো সময় এলেও হঠাৎ কোনো কারণে বদনাম হতে পারে। বিবাহিত লোকের পক্ষে অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে গলাগলি না করাই ভালো। বিশেষত যে-সমস্ত মেয়েরা আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে তাদের চেহারা হবে—ছিপছিপে, ফর্সা, ঠোঁট পাতলা, লম্বা, সামনের একটা দাঁত একটু ভাঙা, চুল অল্প কটা।

চমকে উঠতে হল, কী আশ্চর্য, যে মেয়েটির চিঠি হাতে ধরেছিলাম তার চেহারা অবিকল ওই রকম। আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যাদি বললেন—বসুন না, অত ভয় পাবার কী আছে? আপনার বৃহস্পতি খুব স্ট্রং, শেষ মুহূর্তে, ঠিক পা ফসকাবার আগে আপনি সামলে নেবেন।

বসে পড়লাম সন্ধ্যাদির সামনে। বিশাল মুখে কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে দুটো উজ্জ্বল চোখে কেমন একটা মাতৃসুলভ দৃষ্টি। পিয়োন অতুল দু কাপ চা সসম্ভ্রমে আমাদের সামনে নামিয়ে রেখে গেল। এই সব পিওনের আমাদের সামনে কী দাপট। এখানে একেবারে অন্যরকম চালচন। তটস্থ, ভয়ে যেন কেঁচো কিংবা শ্রদ্ধায় গদগদ।

—নিন চা খান।

—এর মধ্যে কখন চা বললেন? চায়ের প্রয়োজন ছিল। কথা না বাড়িয়ে চুমুক দিলাম। আরও প্রয়োজন ছিল, ভবিষ্যৎ যতটুকু উন্মোচিত হয়েছে সেই পথে আরও দূর ভবিষ্যৎকে জেনে নেওয়া। সন্ধ্যাদি বললেন—আপনার বউ তো বেশ ভালোই। বিয়ের পর আপনার উন্নতি হয়েছে, আরও হবে। ওইসব বাজে মেয়েকে পাত্তা দেন কেন? আসলে সঙ্গদোষ। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার অত কীসের ঘনিষ্ঠতা—বলে চোখের ইশারায় রবিদাকে দেখালেন। আপনার ও লাইন নয়। আসলে বাহাদুরি করতে গিয়ে কিংবা ছেলেমানুষী খেয়ালে বিপদ ডেকে আনবেন। আনকোরা সাদা কাগজেই হঠাৎ চোট লাগে।

এককথায় সন্ধ্যাদি যেন আমার মরাল গার্জেন হয়ে গেলেন। বর্তমানের ঘোলা জলের মধ্যে দিয়ে আমি যে পরিষ্কার ভবিষ্যতের চকচকে মুদ্রাটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, সেই ভবিষ্যৎকে তিনি ডুবুরীর মতো জীবন-নদীর তলা থেকে তুলে এনে টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন। মহিলা পুলিস কিংবা কুস্তিগীর অথবা উকিল যেমন আমার কাছে বিস্ময়ের বস্তু ছিল এই মহিলা জোতিষীও আমার কাছে তেমনি বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সামুদ্রিক বিদ্যায় যে তাঁর অগাধ দখল ছিল, সে শুধু ওই দিনই নয়, পরেও আমি বারবার নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝেছিলাম।

সন্ধ্যাদির সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে পরে অনেকেই আমাকে ঠাট্টা করেছে। কেউ কেউ এমন কথাও বলেছিলেন ভদ্রমহিলা ক্ষুধার্ত, যেকোনো সময় আমাকে গিলে ছিবড়ে করে ফেলে দেবে। লক্ষ করেছি অফিসের যে-সমস্ত লোক ওই ভদ্রমহিলার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকার পেয়েছেন তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, কুৎসা রটিয়েছেন, কাল্পনিক সমস্ত কাহিনি একের পর এক রসিয়ে রসিয়ে বলেছেন।

সন্ধ্যাদির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমার কোনো কৌতূহল ছিল না। একই অফিসে চাকরি করি। মাঝে মাঝে স্বার্থের খাতিরে আসি। সারা অফিসে যে কজন তাঁর কাছে আসতেন, সকলেরই কোনো না কোনো ধান্দা থাকত। কারুর মেয়ের বিয়ে, টাকা ধার চাই কী সাহায্য চাই। ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, বই কিনতে হবে, টাকা চাই। বউয়ের টিবি. হয়েছে চিকিৎসা করাতে হবে। অন্য কিছু না থাক হাত অথবা কোষ্ঠী দেখে বলে দিতে হবে সময়টা কেমন যাবে। হঠাৎ ভাগ্যলক্ষ্মী ঝলসে উঠবে কিনা? সন্ধ্যাদির অফিসের সারাটা দিন এমনি অজস্র চিঠি আর অজস্র উমেদারে ভরা ছিল। অফিসের অন্যান্য মহিলারা তাঁর ধারে কাছে বড়ো একটা ঘেঁষত না। মাঝে মাঝে মনে হত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও হয়তো অজস্র কর্তব্যের সুতোর টানে পুতুল খেলায় পুতুলের মতোই সর্বদা নেচে বেড়ায়। হয়তো বুড়ো বাপ, বেকার ভাই, পড়ুয়া বোন, রুগ্ন মা প্রভৃতির মধ্যে জীবনকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিয়ে সন্ধ্যাদির নিজের জন্যে আর কিছুই ছিল না।

আমি মাঝে মাঝে তাঁর কাছে এসে বসলে মনে হত তিনি খুশি হয়েছেন। এটা ওটা কথা বলতে তাঁর ভালোই লাগত। আসলে তিনি যে চাকরি করতেন তাতে কোনো স্ট্যাটাস ছিল না, আমি তাঁকে কিছু গুরুত্ব দিলে হয়তো ভাবতেন—যাক সারা অফিসে অন্তত এমন একজন আছে যে তাঁর মতামতের দাম দেয়। সন্ধ্যাদি অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। জীবনের অনেক হতাশার দিনে যখন কোথাও কোনো আলোর সন্ধান পাইনি তখন এই নি:সঙ্গ মহিলা আমাকে সাহস দিয়েছেন। কখনো আমাকে ভগবৎমুখী করতে চেয়েছেন। বলেছেন শনিবার বিকেলে কিংবা রবিবার সকালে সোজা দক্ষিণেশ্বরে চলে যাবেন, মা-ই একমাত্র ভরসা। কখনো গ্রহ-নক্ষত্রদের চক্রান্ত ফাঁস করে দিয়ে বলেছেন—ভয় কি, ষষ্ঠে যার মঙ্গল একাদশে যার শনি আর রাহু, ধর্মগুরু বৃহস্পতি যার স্ব-ক্ষেত্রে, চাঁদ যার তুঙ্গে তার কীসের পরোয়া। অফিসে সাধারণত কারুর কোনো বন্ধু থাকে না। সন্ধ্যাদির মধ্যে কিন্তু প্রকৃতই আমি একজন বন্ধুকে পেয়েছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হত একটি মায়ের মুখও বোধহয় উঁকি মারছে।

মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশায় নদীর জলের মতোই জোয়ার-ভাঁটা খেলে। প্রয়োজন না থাকলে আধুনিক মানুষ পরস্পরের খবর রাখতে চায় না। সামুদ্রিক কৌতূহল মিটে যাবার পর এগারো তলার সন্ধ্যাদির খবর আর তেমন রাখতাম না। রবিদার খিস্তির আখড়া তছনছ হয়ে গিয়েছিল। আখড়ার অনেক পাখি উড়ে গিয়েছিল। তারপর অফিসে অফিসে উগ্র রাজনীতি ঢুকে আমাদের পরস্পরের আপাত-সহজ সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা এনে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে রবিদার মাধুরী রেলে ভালো চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল। নন্দার সঙ্গে গোস্বামীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। নন্দা ছিল বেশ লম্বা এবং সুশ্রী। বেশি লম্বা হবার ফলে বোধহয় একটু কোল-কুঁজো হয়ে গিয়েছিল। এই কুঁজো হওয়ার জন্যেই রবিদার গবেষণার অন্ত ছিল না। আর সেই আসরে প্রাক-বিবাহিত জীবনে গোস্বামীও হাজির থাকত। এখন ভাবলে যেন বিশ্রী লাগে—গোস্বামীর ভাবী স্ত্রীকে নিয়ে আমরা কি যা-তা কথাই না বলতাম। গোস্বামী পরে ট্রান্সফার নিয়ে অন্য অফিসে চলে গিয়েছিল। রবিদার জগৎ আস্তে আস্তে প্রমীলাশূন্য হয়ে গেল। কেবল সন্ধ্যাদি রয়ে গেলেন মুখোমুখি, যাঁকে দেখলেই রবিদার এলার্জি হত।

আমার জগৎ তখন অন্য আবর্তে পাক খাচ্ছে। সারাদিন অজস্র লোককে নানা ধরনের জ্ঞান দিতে দিতে সক্রেটিস হয়ে পড়েছি। বহু মানুষের ভিড়ে সন্ধ্যাদি ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছেন। জীবনের সাময়িক ক্রাইসিস কেটে গেছে। সন্ধ্যাদি ছিলেন দুঃসময়ের গাইড, ফিলসফার, ফেণ্ড। সুসময়ে তাঁকে কে মনে রাখবে। মনে রাখার মতো তাঁর কিছু ছিল কি! জীবনে তিনি ছিলেন ছায়া, আলো নয়। এর মধ্যে একদিন আমার দপ্তরে বাণী রায় বলে এক ভদ্রমহিলা এলেন, বিবাহিতা, টুকটুকে রং, পান-খাওয়া লাল টুকটুকে ঠোঁট, কপালে লাল টিপ, মাথায় অল্প ঘোমটা। বেশ ইন্টারেস্টিং চরিত্র। প্রথম দিনেই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন। বেশ খেলোয়াড় মেয়েছেলে। ইন্সিয়োরেন্সের কাজ করেন আবার মেয়েদের তৈরি জামা-কাপড়ের কারবারও করেন। বেশ ভাই-ভাই করে কথা বলেন। অফিসে বসে কাজের কথা বলার চেয়ে বাইরে কোনো রেস্তরাঁ কিংবা নিজের বাড়িতে বসে বেশ অন্তরঙ্গভাবে কথা বলার পক্ষপাতী। রবিদার চেলা হিসেবে টোপটা সঙ্গেসঙ্গেই গেলা উচিত ছিল কিন্তু সন্ধ্যাদির সতর্কবাণী স্মরণ করে সাবধান হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।

প্রথম দিন বাণী রায়ের আসার উদ্দেশ্য আমার কাছে খুব পরিষ্কার ছিল না। ভেবেছিলাম হয়তো একটা ইন্সিয়োরেন্স করতে বলবেন। না, তা নয়। আসলে ভদ্রমহিলা ছিলেন টাউট। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক-টম্পর্ক বোধহয় ভালো ছিল না। ভালো চেহারার ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খাওয়াই বাণী রায়ের স্বভাব ছিল। বারে-টারেও বোধ হয় যেতেন। একদিন আমি তাঁর মুখে মদের গন্ধও যেন পেয়েছিলাম। একটু পয়সাওলা ঘরের ছেলেদের মাথায় উদ্ভট সমস্ত ব্যবসার পোকা নাড়িয়ে দিয়ে এ অফিস সে অফিস ঘুরে ঘুরে কিছু অর্থ দোহন করে নিয়ে ছেলেটিকে পথে বসিয়ে দিতেন। এইভাবেই বাণী রাযের দিন চলত। আমার কাছে যখন এসেছিলেন তখন বিশ্বাসনামক একটি ছেলের উপর ভর করেছিলেন। বিশ্বাসকে দিয়ে একটি ইনডাস্ট্রি করাবেন। এক লাখ তেত্রিশ হাজার টাকার ধান্দা। রোজ এসে বলতেন, চলুন না একদিন গ্র্যান্ডে। গ্র্যান্ডে যেতে হবে না, ভোলার চায়ের দোকানে গেলাসে চা খাই, এখানেই বলুন কী চান। বাণী রায় সামনে ঝুঁকে, ব্লাউজে লাগানো ইন্টিমিটের গন্ধের ঝটকা আমার নাকের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, লাখখানেক টাকা ধার বের করে দিন না, আপনারও কিছু থাকবে।

ব্রাহ্মণের ছেলে। বাপ-ঠাকুরদা যজমানি করতেন। নেহাত দায়ে পড়ে চাকরি করছি। অত দেনা-পাওনা মাথায় আসে না। বাণী রায়কে খুশি করতে পারলাম না। এক লাখ তেত্রিশ হাজারের স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বাস একদিন কলকাতার জনারণ্যে হারিয়ে গেলেন, বাণী রায়ের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কিছু বাড়ল। পৃথিবীতে অনেক নেশার মধ্যে পরস্ত্রী-র নেশা কিছু কমতি যায় না। বিশ্বাসমশাই সেই নেশায় কিছুদিন বুঁদ হয়েছিলেন। খোয়ারি ভাঙার পর কী অবস্থা হল বাণী রায়ের তা দেখার অবকাশ ছিল না। তিনি তখন আর এক কারবারের অংশীদার।

একদিন অফিসে এসে হাতব্যাগ খুলে একের পর এক ব্লাউজ, পেটিকোট, ব্রেসিয়ার ইত্যাদি বের করে টেবিলে ছড়িয়ে দিলেন। একগাল হেসে বললেন—ছোটোখাটো দিয়েই শুরু করলাম। আপনার মিসেসের—চোখ দুটো অল্প একটু ছোটো করে বললেন—চৌত্রিশ হলে এই একটা আছে, আটত্রিশ হলে এই একটা প্লেন আছে। প্রথম প্রোডাকশন আপনাকে উপহার দিতে এলাম।

শয়তান একেবারে। কোথায় একলাখ তেত্রিশ হাজারের শেয়ার আর কোথায় আধ ছটাক কাপড়ের দুটো বক্ষবন্ধনী, হা ঈশ্বর! আজ্ঞে না, আমি কোনো উপহার চাই না। আপনি বরং এগারো তলায় আমাদের বড়ো অফিসে যান, বহু মহিলা আছেন, আপনার এই সব সূক্ষ্ম জিনিসের কাটতি হবে।

বাণী রায় কেটে গেলেন। আমি জানতাম ওই চালু মহিলার পক্ষে ওপরে গিয়ে জমিয়ে নিতে মোটেই অসুবিধে হবে না। তা ছাড়া আজকাল যেকোন অফিসেই ইন্সটলমেন্টের কারবার চট করেই জমে যায়, বিশেষত সেই কারবারের মালিক যদি কোনো সুন্দরী গায়ে পড়া মহিলা হন। বাণী রায়ের সাকসেস সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম কিন্তু তখন আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি শ্রীমতী রায় সন্ধ্যাদিকেই ভর করে বসবেন।

সন্ধ্যাদি এর আগে কখনো আমার নীচের অফিসে আসেননি। সেদিন তাঁকে আসতে দেখে অবাক হলাম। একটু ইতস্তত করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন—বাণীদির কোনো খবর জানি নাকি। আমি একটু অবাক হয়েছি দেখে বললেন বাণীদির কাছ থেকে আমি কিছু জামা-কাপড় কিনেছি দাম নিতে আসছে না দেখে আপনার কাছে খবর নিতে এলাম।

সেদিন ওই কথা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু এরপর সন্ধ্যাদির সঙ্গে দেখা হলেই যখন জিজ্ঞেস করতে আরম্ভ করলেন—বাণীর কোন খবর নেই?—তখন বেশ অবাক হলাম। সন্ধ্যাদির সঙ্গে বাণীর সম্পর্ক শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার নয়। এর পিছনে অন্য কোনো গভীর ব্যাপার আছে বলে মনে হল। কী যে ব্যাপার! শুনেছি আফিম কিংবা মরফিন অথবা কোকেনের একটা মারাত্মক অ্যাডিকসান আছে। বাণী রায়কে পর পর দুদিন না দেখতে পেলে সন্ধ্যাদি যেরকম ছটফট করেন তাতে আমার প্রথমে যে সন্দেহ হল—হয়তো বাণী রায় ওই নি:সঙ্গ, কিছুটা ফ্রাসট্রেটেড মহিলাকে ওইরকম কোনো একটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছে! বিশ্বাস নেই বাণী রায়ের পক্ষে সবই সম্ভব। অতি সাংঘাতিক মহিলা বলেই আমার মনে হয়েছে। এদিকে বাণী রায় দীর্ঘদিন আর আমার দপ্তরে আসেনি। সন্ধ্যাদির প্রশ্নের উত্তরে করুণ একটু হেসে বলতে হত—আজ্ঞে না, বাণী রায়ের কোনো খবর নেই। জবাব শুনে সন্ধ্যাদির মুখে যেন ছায়া ঘনাত। মনে হত তিনি যেন বিশেষ কিছু একটা জিনিসের নাগাল পেতে গিয়েও পাচ্ছেন না; কি যেন একটা ধরতে চাইছেন কেবলি ফসকে যাচ্ছে। একমাত্র বাণী রায়ের সাহায্যেই সেই পলাতক জিনিস ধরা যায়। পুরো ব্যাপারটা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে একটু গোয়েন্দাগিরি করতে ইচ্ছে করে। নানা সন্দেহ মনে উঁকি দিয়ে যায়। দু-জন মহিলার মধ্যে এই অস্বাভাবিক আকর্ষণের কি অর্থ?

ব্যাপারটা সম্পর্কে ততক্ষণই কৌতূহল যতক্ষণ সন্ধ্যাদির সামনে থাকতাম। তারপর আর কিছু মনে থাকত না। হঠাৎ একদিন ফ্যান্সি লেনের কাছাকাছি বাণী রায় একেবারে আমার মুখোমুখি পড়ে গেলেন। বললাম তাঁকে—কী ব্যাপার আপনার। সন্ধ্যাদি আপনাকে পাগলের মতো খুঁজছেন অথচ আপনার কোনো পাত্তাই নেই। বাণী রায় একগাল হেসে বললেন—যান, যাব দু-এক-দিনের মধ্যেই দেখা করব। আমার তাড়া ছিল, কথা না বাড়িয়ে সরে পড়লাম। আর ঠিক সেই দিনই সন্ধ্যাদি আমার ঘরে এসে চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন—বাণীর কোনো খবর আছে? আজ আর তাঁকে নিরাশ করতে হবে না ভেবে খুশি হলাম। বললাম—বসুন।

সন্ধ্যাদি বসলেন। বেশ গুছিয়ে বসলেন। আমি দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।—বাণী রায়ের সঙ্গে আজ সকালেই দেখা হয়েছিল অফিসে আসার পথে। সন্ধ্যাদি আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। —আসবে বলেছে, আজকালের মধ্যেই আসবে।

সন্ধ্যাদির মুখ থেকে উৎকন্ঠার ছায়া যেন সরে গেল—আর কিছু বলেছে? আমি বললাম—না, আর কোনো কথা হয়নি। সন্ধ্যাদি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন—আপনি আমার ভায়ের মতো। প্রথম দিন থেকেই আপনার মুখ দেখে আমার কীরকম মায়া হত। আপনাকে আমি সব কথা বলতে পারি।

ঠিক ওই সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি বহিরাগতকে বিদেয় করে সন্ধ্যাদির দিকে মনোযোগ দিলাম। বাণী-রহস্য আজ উন্মোচিত হবে বলে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যাদি বললেন, খুব আস্তে আস্তে—বাণী আমার বিয়ে দিয়ে দেবে বলেছে। ওর সন্ধানে একটি পাত্র আছে। বাণী বলেছে যেমন করেই হোক মাস দুয়েকের মধ্যে ও আমার বিয়ে দেবেই। বিয়ের কথা বলতে গিয়ে অমন জাঁদরেল সন্ধ্যাদির মুখও গোলাপি হল। চা ছলকে ডিশে পড়ল। একটু বিষম খেলেন।

আমিও কিছু কম অবাক হইনি। সন্ধ্যাদির বিয়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। আমি একজন পুরুষ সেইদিক থেকে ব্যাপারটাকে দেখবার চেষ্টা করে আশান্বিত হতে পারলাম না। আরও একটা ব্যাপারে খটকা লাগল হঠাৎ বাণী রায় সব ছেড়ে সন্ধ্যাদির বিয়ের ঘটকালি নিয়ে পড়ল কেন? সন্ধ্যাদি না চিনুন বাণীকে আমি যতদূর চিনেছি এর মধ্যেও তার বড়ো রকমের চাল থাকা অস্বাভাবিক নয়।

আমি একটু সাহস করে জিগ্যেস করেই ফেললাম—এর জন্যে আপনার কিছু খরচ-খরচা হবে নাকি? সন্ধ্যাদি একটু ইতস্তত করে বললেন—তেমন কিছু নয়! যা খরচ হবে তা আমার জন্যেই হবে। আমাকে দুটো জিনিস করতে হবে প্রথমত একটু রোগা হতে হবে, আর একটু ফর্সা হতে হবে।

বেশ অবাক হতে হল। রোগা না হয় ডায়েটিং করে হবেন, কিন্তু ফর্সা হবেন কী করে? রক্তশূন্য হয়ে। শেষকালে ওইসব করতে গিয়ে অকালে মারা যাবেন না তো? সন্ধ্যাদি বললেন—বাণীর একজন জানা ডাক্তার আছে। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। পাঁচ-শো টাকা দিয়েছি পরে আরও পাঁচ-শো দিতে হবে। ফর্সা হবার জন্যে ছ-টা ইনজেকসান এর মধ্যে নেওয়া হয়ে গেছে। সন্ধ্যাদি একটু হাসলেন তারপর লাজুক লাজুক গলায় জিগ্যেস করলেন—আগের চেয়ে একটু ফর্সা লাগছে না। সন্ধ্যাদির এই ভাবটি আগে আমি কখনো দেখিনি। সেই চিরন্তনী বাঙালি নারী সমস্ত রুক্ষতার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে গেল। সেই দিনই লক্ষ করলাম সন্ধ্যাদির সাজপোশাকে পরিবর্তন এসেছে। আগে পরতেন সাদা চওড়া পাড় শাড়ি সাদা ব্লাউজ। আজই প্রথম দেখলাম শাড়িতে রং, জামায় রং।

একটা ব্যাপারে আমি নিজেকে সর্বদাই অপরাধী বোধ করতে লাগলাম—আমার জন্যেই বোধ হয় সন্ধ্যাদি এক ধূর্ত মহিলার খপ্পরে পড়লেন। সন্ধ্যাদির দুর্বলতাকে দোহন করে সেই মহিলা জোঁকের মতো পুষ্ট হবেন। এখন আর ফেরাবার কোনো উপায় ছিল না। এক মহিলা আর এক মহিলার কাছে মনের দরজা খুলেছেন সমস্ত গোপনীয়তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। এই অবস্থায় আমার ভূমিকা নিস্পৃহ দর্শকের।

ইতিমধ্যে বাণী রায় একের পর এক শাড়ি, জামা, রাজ্যের জিনিস সন্ধ্যাদিকে গছাতে লাগল। একটু একটু করে সন্ধ্যাদির সামনে তাঁর ভবিষ্যৎ সংসারের ছবি আঁকতে লাগল। স্বামী, পুত্র, কলকাতার বিশিষ্ট এলাকায় ফ্ল্যাট, ভালো চাকরি, সহৃদয় একটি মানুষের সর্বসময় উপস্থিতি, সন্ধ্যাদিকে স্বপ্নে স্বপ্নে বিভোর করে রেখেছিল বাণী রায়। আর কটা দিন, এই তো এসে গেল সেই শুভক্ষণ। বাণী রায় আমার ত্রিসীমানা মাড়াত না। পাছে আমি ভন্ডুল করে দি।

মাঝে মাঝে উপরে গেলে দেখতাম সন্ধ্যাদির চেহারায় বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ, গায়ের রঙ কেমন ফ্যাকাসে খসখসে। বদান্যতাও বেড়ে গেছে। প্যারাসাইটরা তাঁর সেই বিচিত্র মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে যা খুশি তাই করে চলেছে। পৃথিবীতে এমন একটা লোক নেই যে সন্ধ্যাদিকে তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরিয়ে দিতে পারে। সন্ধ্যাদির হ্যাংলামি সম্পর্কে এক সময় আমার নিজেরই কীরকম বিতৃষ্ণা এসে গেল। এ যেন অস্বাভাবিক বিয়ে পাগলামি। এত ভগবৎভক্তি, শক্তিসাধনা, জ্যোতিষচর্চা সব ভেসে গেল। সংসার না করলে কী হয়? একটা পঞ্চাশ কি ষাট বছরের জীবন নানা কাজে কাটিয়ে দেওয়া যায় না? লোকে কুকুর বেড়াল পুষেও তো চালিয়ে দেয়। ভদ্রমহিলার ব্যক্তিত্ব জীবনদর্শন সম্পর্কে যেটুকু শ্রদ্ধা ছিল চলে গেল। বেশ হয়েছে, এসব মহিলার একটু শিক্ষা হওয়াই উচিত। বাড়িতে তো আরশি আছে। তার সামনে একবার দাঁড়ালেই তো বোঝা উচিত, কোনো বাজারেই এ জিনিস কাটতে পারে না। ওই সব পুরোনো মেয়েলি প্রবাদের কি কোনো অর্থ হয়—সব হাঁড়িরই সরা জোটে।

সন্ধ্যাদি, বাণী রায়, সকলকেই আমি ভুলতে চাই। ওই বিচিত্র জগতের জটিলতায় আমি দিশেহারা হয়ে যাই। প্রায় ভুলেই এসেছিলাম। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাদি এসে হাজির। ভয়ানক ব্যস্ত ছিলাম। তাই কিছু প্রশ্ন করার আগেই আমি বললাম—না কোনো খবর নেই। আপনার বাণী আজ ছ’-সাত মাস হল আমার সঙ্গে দেখা করেনি। সে কোথায় তাও জানি না। সন্ধ্যাদি একটা জড়পদার্থের মতো আমার সামনের চোয়ারে বসে পড়লেন। কয়েক মাস আগে তাঁর মুখে যে আলো দেখেছিলাম, সে আলো আর নেই। সুন্দরী ছিলেন না কিন্তু আগে একটা স্বাস্থ্যের দীপ্তি ছিল, এখন যেন বয়স আরো বেড়ে গেছে। আমাকে আস্তে আস্তে বললেন—আমি জানি, বাণী আপনার কাছে আসে না। আজ তিন মাস হল আমার সঙ্গেও দেখা করেনি। শুনেছি বলে বেড়াচ্ছে বুড়ী মাগির বোঝা উচিত ছিল কোনো ছেলেই ওকে বিয়ে করবে না। যা হয়েছে হয়েছে, আমার কিছু বলার নেই, আপনি শুধু দয়া করে একটা কাজ করবেন? সন্ধ্যাদি এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন—এই হল বাণীর ঠিকানা, আপনি তার সঙ্গে দেখা করে আমার নাম করে বলবেন, আমার কিছু গয়না তার কাছে আছে, প্রায় হাজার তিনেক টাকার, সেগুলো যেন আমাকে ফেরত দেয়। বলবেন সন্ধ্যার ভায়ের বিয়েতে লাগবে।

সন্ধ্যাদির অবস্থা দেখে আমি রূঢ় হতে পারলাম না। কাগজটা নিলাম। উত্তর কলকাতার ঠিকানা। ঠিকানা মিলিয়ে গেলাম। ফ্ল্যাট বাড়ি। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা একজন চালিয়াৎ ছেলে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—বাণী রায়। হ্যাঁ এখানেই থাকে, তবে এখন নেই, কলকাতার বাইরে গেছে, কবে ফিরবে জানি না।

জানতাম এইরকম একটা কিছু ঘটবে। খালিফা মেয়েছেলে। কটা গায়ের রং, পানের রস লাগা পাতলা ঠোঁট, আঁটসাট চেহারা, ভাই-ভাই করে কথা। সব মিলিয়ে যেন কেউটে সাপ। সন্ধ্যাদির কত টাকা গাপ করেছে কে জানে! সন্ধ্যাদি খবরটা খুব শান্তভাবে নিলেন। টেবিলের উপর ডাঁই করা চিঠির স্তূপ থেকে একটা লম্বা খাম তুলে আমার হাতে দিলেন। ব্যক্তিগত চিঠি। খামটা হাতে নিয়েই বুঝলাম—সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত চিঠি। ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিদেশে রিসার্চ করতে যাবার অনুমতি পত্র। সন্ধ্যাদি হেসে বললেন—জানি ভালো খবর। দেখবেন জীবনে অনেক উন্নতি করবেন।

সন্ধ্যাদির সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। বাইরে যাবার জোর প্রস্তুতি চলেছে। সেদিন সকাল বারোটা নাগাদ পিয়োন এল নোটিশ সই করাতে। এই ধরনের নোটিশ না পড়েই সই করে দি। মুখে শুধু জিগ্যেস করে নিই—কী ব্যাপার। আজও তাই করতাম, হঠাৎ চোখ পড়ে গেল, আজ দুটোর সময় অফিস ছুটি। কী কারণ? কারণ দেখেই চমকে উঠলাম—সকালে রিসিভিং ক্লার্ক সন্ধ্যা মিত্র হার্ট স্ট্রোকে মারা গেছেন।

মারা গেছেন অফিসের চেয়ারে। রোজ যেমন ঠিক সময়ে অফিসে আসেন তেমনি এসেছেন। ঠাকুর প্রণাম করেছেন। পিয়োন অতুলের ছেলের চিকিৎসার জন্যে টাকা তুলে দিয়েছেন। ক্যান্টিনের গোবিন্দবাবুর বকেয়া টাকা মিটিয়েছেন, বলেছেন এখন থেকে নগদ পয়সা দিয়েই রোজ খাবেন। ‘জরুরি’ লেখা একটা বড়ো খাম ছুরি দিয়ে খুলেছেন, তারপর পিয়োন জল এনে দিয়েছে। এক চুমুক জল খেয়েছেন, তারপর অর্থহীন চোখে খোলা নীল আকাশের দিকে একবার চেয়েছেন, টেবিলের কাচের তলায় রাখা রামকৃষ্ণের মূর্তির দিকে তাকিয়েছেন। ঠোঁট কেঁপেছে, কিছু বলতে চেয়েছেন, চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে। তারপর হাত থেকে জলের গেলাস কোলের উপর খসে পড়েছে। নিমেষেই মৃত্যু।

সবার আগে যিনি ছুটে এসেছেন তিনি আমাদের রবিদা। ফাইল কভার দিয়ে হাওয়া করেছেন। সামনে ঝুঁকে পড়া মাথা আস্তে সোজা করে দিয়েছেন। তারপর অসহায়ের মতো চারিদিকে তাকিয়ে বলেছেন—‘যা: শালা’। তারপর বলেছেন তাঁর সেই ফেমাস কথা—‘মার শালাকে’। কাকে মারার কথা কে জানে—ঈশ্বরকে, না সমাজকে, না জগৎ সংসারকে—বলতে পারব না।

কাঁটায় কাঁটায় দুটোর সময় অফিসে শাটার নেমেছ, কেউ ছুটেছে ট্রেন ধরতে, কেউ ছুটেছে সিনেমায়, রবিদা ছুটেছেন মেট্রোর গলিতে গলা ভেজাতে। যাবার সময় বললেন যাবি নাকি শালা—আমার একটা কাউন্টারপার্ট আগেই সরে গেল, এবার আমার পালা, চল, শালা সেলিব্রেট করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *