ঘ্যাচাং ফু
গল্প লেখা মোটেই কোনও কঠিন কাজ নয়। শুধু একটা চশমা চাই। জীবন দেখার চশমা। একটা বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, গণ্ডার।’
বড়মামা থামলেন। উদাস দৃষ্টি।
মেজোমামা বললেন, ‘এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলে কেন? জন্তু-জানোয়ার আরও আছে, বেশ বড়-বড়। যেমন হাতি, উট, জেব্রা, ক্যাঙারু, বিগ সাইজের হনুমান, কচিকচি বাঁদর। একজায়গায় জড়ো করতে পারলেই বিরাট একটা গল্প। কোণ থেকে একটা ময়াল সাপ ছেড়ে দাও, রোমহর্ষক একটা ব্যাপার। তবে জঙ্গল চাই। A dense forest. গভীর রাত। তুমি পথ হারিয়ে ফেলেছ। তোমার হাতে একটা টর্চ, আলো নেই। কাঁধে রাইফেল গুলি নেই। জঙ্গলের ভেতরে হায়নারা হাহা করে হাসছে। একটা ইনফর্মার বাঘ ঘাঁটিতে গিয়ে তাদের সর্দারকে বলছে, বোকাদা আসছে। ডিনার লাগিয়ে দেব? ফ্রেশ মিট। বেশ রেওয়াজি। মিসেস বাঘিনি বলছে সস দিয়ে কেজিখানেক আমি একাই মেরে দেব। এমন সময় তোমার সামনে হঠাৎ এসে দাঁড়ালেন এক কাপালিক। আগুনের ভাঁটার মতো দুটো চোখ। সঙ্গে একজন অ্যাসিস্টেন্ট। কাপালিক বললেন, ‘ঘাড়ের মেজারমেন্টটা নে।’ টেপ বের করে ঘাড় মাপল। গুরুদেব বললেন, ‘তিন নম্বর খাঁড়া।’
চেলা বললে, ‘তিন নম্বর খাঁড়া কামারশালে। ধার দেওয়ার জন্যে দিয়ে আসা হয়েছিল।’
‘আনা হয়নি কেন?’
‘ধার দেওয়া হয়নি কেন?’
‘সেই ব্যাটাকে জিগ্যেস করো। আমাকে জিগ্যেস করছ কেন? আমি কি কামার? আমি কাপালিক। ক’দিন ধরে দেখছি, তুমি খুব উদ্ধত আচরণ করছ। কারণটা জানতে পারি?’
‘খুব সহজ কারণ। এই অমাবস্যায় আপনি মায়ের চরণে স্থান পাবেন।’
‘তার মানে?’
‘তার মানে, ঘ্যাচাং ফু। হাড়িকাঠে মাথাটা ফিট করে দিয়ে দুনম্বর খাঁড়ায় এক কোপ। মুণ্ডুটা গড়াতে-গড়াতে মায়ের শ্রীচরণে। মায়ের যা ইচ্ছা। আমরা কী করব গুরুদেব! আমাদের হাত-পা বাঁধা। মনে আছে গুরুদেব, আপনিও আপনার গুরুকে ঘ্যাচাং ফু করেছিলেন। আমি তখন তাঁর পা চেপে ধরেছিলুম। এ লাইনটাই এইরকম—চ্যালার কোপে গুরুর মৃত্যু। আপনি কি সারাজীবন গুরুগিরি করবেন! সাত বছর হয়ে গেছে। এইবার মায়ের চরণে মুণ্ডুটা জমা করে দিন।’
‘তা হলে এটাকে কী করব। সামনে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কত কী পরেছে! মাথায় শোলার টুপি। পায়ে অ্যাঙ্কল বুট।’
‘ও তো আমি করব। আপনার মুণ্ডু মায়ের শ্রীচরণে নিবেদন করে ও আমার চেলা হবে, আমি হব গুরু।’
‘তারপর তোমারও তো আমার অবস্থা হবে।’
‘সে দেখা যাবে। আগে সাত বছর গুরুগিরি করেনি।’
‘তুমি তো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছ।’ বললে, ‘কাপালিকত্ব করতে পারব না প্রভু! ভয়ে আমার বড়বাইরে পেয়ে গেছে, একটু অ্যালাউ করুন।’
চেলা বললে, ‘কাপালিক হওয়া খুব সহজ! লাল টকটকে কাপড় পরিয়ে দেবো। আমার গলার হাড়গোড়ের মালা তোমার গলায়, গুরুদেবের মালা আমার গলায়, আর সাতদিন স্রেফ গাঁজা পথ্য। আমার শেয়ালটা তোমাকে দিয়ে দেবো। গুরুদেবের শেয়ালটা আমি নিয়ে নেবো।’
তুমি বললে, ‘শেয়াল কী হবে?’
‘শেয়াল ইজ এ মাস্ট। তোমার কী ভাগ্য! চোদ্দো বছর পরমায়ু পেয়ে গেলে।’
‘আমি কিন্তু নামকরা ডাক্তার।’
‘ভেরি গুড, এখন হবে কাপালিক ডাক্তার, অথবা ডাক্তার কাপালিক।’
গুরুদেব বললেন, ‘তাহলে আমার পাইলসটা ভালো করে দাও।’
চেলা বললে, ‘মেরা হাঁপানি।’
‘তুমি যখন সুযোগ পেয়ে গেলে, বললে, আপনারা দুজনে আমার নার্সিংহোমে চলুন। তোমার এই টোপটা তারা গিললে। চলে এল কলকাতায়।’
বড়মামা কোঁদ করে বাকি চা-টুকু খেয়ে বললেন, ‘বেশ হচ্ছে। স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা যেতে পারে। ক্লাস সেভেন, সেকশান এ।’
‘এখনও শেষ হয়নি। সুরবালা নার্সিংহোমের আয় বেড়ে গেল। অ্যানেসথিসিস্ট-এর দরকার হয় না। একজন মাথার দিকে দাঁড়ায়, আর একজন পায়ের দিকে। পেশেন্ট অজ্ঞান। সেই লাভের টাকায় ডাক্তার কখনও লাভায়, ডাক্তার কখনও লোলেগাঁওয়ে। শেয়াল দুটো কলকাতায় এসে অ্যালসেশিয়ান হয়ে গেল। প্রতি বছর মোটর গাড়ির মডেল চেঞ্জ। ডাক্তার একটা নতুন ক্লিনিক খুলেছেন। গলাকাটা ক্লিনিক—ঘ্যাচাং ফু।’
বড়মামা চায়ের টেবিল থেকে উঠতে-উঠতে বললেন, ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়!’