ঘ্যাঁঘাসুর – উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়
(উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প অবলম্বনে)
রাজা
মন্ত্রী
ধর্মদাস
নকুল
গোকুল
সদানন্দ
বামন
কিরণমালা
জুড়িদার
জুড়িদারনি
ঘ্যাঁঘা
ঘেঁঘি
জ্যোতিষী
রাজার অনুচর
প্রথম দৃশ্য
[ রাজার বাড়ির ফটকের সম্মুখভাগ। একজন জ্যোতিষী বিরাট ছক কেটে বসেছে। আরও দু-একজন মানুষ আছে তারা জ্যোতিষীর গণনা দেখছে। জুড়িদার ও জুড়িদারনি গান ধরে ]
গান
এ দেশের মজা চমৎকার
বন্ধু হে, মজা চমৎকার
রাজার মেয়ের অসুখ নিয়ে রাজা
নিত্য তপ্ত তেলে ভাজাভাজা
ব্যামোর মেলে না আরাম
সব চিকিৎসে বিফল হল রাজকন্যের সারে না বিকার।
[ জুড়িদার ও জুড়িদারনি পয়সা চায়, কেউ কিছু দেয় না ]
জুড়িদার। কেউ হাত উপুড় করলে নারে। আর দেবেই বা কোথা থেকে! চাষবাস নাই, বিক্রিবাটা নাই-সবাই তো রাজকন্যের ব্যামো নিয়েই অস্থির।
জুড়িদারনি। তা বলে রাজা দেশের দিকে তাকাবে না? কেবল মেয়ের ব্যামো নিয়ে ভাবলে রাজার চলে?
প্রথম ব্যক্তি। কে সেকথা বলবে বল? বলতে গেলেই চাবুক খেয়ে মরবে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি।দেশের মাথা বিকল যদি হয়
দেশের লোকের দুর্দশা অতিশয়-
তৃতীয় ব্যক্তি। অত চেঁচিয়ে বোলো না।
প্রথম ব্যক্তি। একশো বার চেল্লাব। এখুনি রাজা বেরোবে। সে যাবে মন্দিরে পুজো দিতে। তখনি তার কানের কাছে চ্যাঁচাব। বলব তোমার মেয়ের ব্যামোর চিকিৎসের খরচ যোগাতে এমন ধারা খাজনা বসিয়েছ যে, সব চাষিরা ব্যবসায়ীরা কাজকর্ম বন্ধ করে দেশের থেকে পালাচ্ছে!
জ্যোতিষী। আঃ-দিলে তো চেঁচিয়ে! আমার আঁক গেল গুলিয়ে।
জুড়িদার। কী আঁক কষছ এখানে বসে? তোমার তো কোনো খরিদ্দার নেই দেখছি।
জ্যোতিষী। এ হল রাজকুমারী কিরণমালার কুষ্ঠি!
সবাই। বলো কী?
জ্যোতিষী। বহু কষ্টে সংগ্রহ করেছি বুঝলে! এর মধ্যেই আছে রোগের নিদান।
প্রথম ব্যক্তি। তোমার যা হতদরিদ্র চেহারা, রাজা তোমার নিদান মানলে তো?
দ্বিতীয় ব্যক্তি। তা ছাড়া তোমার নিদানে রোগ সারবে প্রমাণ কী?
জ্যোতিষী। গুণী মানুষের কদর নাই গো। আমার কথা প্রমাণ না হওয়া অবদি রাজা আমাকে বেঁধে রাখুক।
দ্বিতীয় ব্যক্তি। যদি প্রমাণ না হয়?
জ্যোতিষী। শূলে চেপে স্বর্গে চলে যাব। ভগমানের হাত দেখব।
[ একটা হইচই শুরু হয়। ফটক থেকে রাজার অনুচর ঘোষণা করে ]
অনুচর। পথ সাফা করো, পথ সাফা করো। পথচারীরা পথের দুইধারে মাথা নুইয়ে দাঁড়াও, মহারাজ আসছেন-
জুড়িদার। চট করে একখানা গান ধরো তো রাজাকে খোশামোদ করে।
জুড়িদারনি। গান
রাজার গুণের কথা কী আর বলি
বরং নিজের কানটা নিজেই মলি
ছোটোমুখে বড়োর নাম
জানি না কী পরিণাম
দোষ করেছি, মহান রাজা করে দেবেন মাপ।
রাজা। বটে! বটে! শুনছ মন্ত্রী, দেশের লোক আমাকে কেমন ভক্তি করে? কিন্তু আমার কিরণমালার কী হবে?
গান
রাজার দুঃখ সবই আমরা জানি
রাজার চোখে ঝরে কেন অশ্রুজল
রাজকুমারীর প্রাণের আশা নাই
দেশের লোকের প্রাণ হল বিকল।
রাজা। মন্দিরে হত্যে দিয়েও যদি না আমার কিরণমালার জীবন বাঁচে, আমি নিজের জীবন বিসর্জন দেব।
প্রথম ব্যক্তি। চমৎকার! রাজা, চমৎকার! দেশের লোকের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে-বাঃ, বাঃ-
মন্ত্রী। কে রে!
জ্যোতিষী। (আচমকা) ল, ল, ল-প্রথম অক্ষর ল
মন্ত্রী। ল? ল কী? আরে ল ল করছ কেন তুমি!
দ্বিতীয় ব্যক্তি। ইনি একজন জ্যোতিষী। রাজকুমারীর কুষ্ঠি বিচার করছেন।
রাজা। বলো কী?
জ্যোতিষী। ল দিয়ে শুরু, গাছে ফলে।
রাজা। ল দিয়ে কীসের শুরু?
জ্যোতিষী। আর একটু হিসেব কষতে দিন, প্রায় মেরে এনেছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ-হয়েছে। লেবু, ল দিয়ে লেবু। প্রাণ বাঁচবে মেয়ে হাসবে মেয়ে জাগবে লেবু খাবে।
মন্ত্রী। লেবু খেলে প্রাণ বাঁচবে?
প্রথম ব্যক্তি। পাতি না বাতাবি না কমলা?
মন্ত্রী। তাও তো জানতে হবে।
জ্যোতিষী। দেখছি। (ভাবে) পাতিলেবু। অতি সাধারণ লেবু।
রাজা। যত অসম্ভব কথা। লেবু এদেশে অসাধারণ! কেউ চোখে পাতিলেবু দেখেনি। এদিকে মেয়ে আমার ভুল বকছে। জ্বর নেই সর্দি নেই কেবল অস্থিরভাব। সর্বাগ্রে মড়মড়ি ব্যথা।
মন্ত্রী। ঠিক আছে, তুমি নিশ্চিত জ্যোতিষী?
জ্যোতিষী। একশোভাগ মন্ত্রীমশাই।
মন্ত্রী। যে পারবে লেবু এনে রাজকুমারীকে খাওয়াতে-(রাজাকে) কী দেবেন? অর্ধেক রাজত্ব?
রাজা। দেব, দেব অর্ধেক রাজত্ব দেব, রাজকন্যে দেব, প্রাণ তো বাঁচুক।
মন্ত্রী। কে আছিস এই জ্যোতিষীকে বেঁধে রাখ, যদি লেবু খেলেও অসুখ না সারে তবে ওর অসুখের ওষুধ খুঁজতে হবে।
জ্যোতিষী। সে আমি ভীষণ রকম রাজি।
[ অনুচররা জ্যোতিষীকে বাঁধে ]
জ্যোতিষী। (সবাইকে) বুঝলে না কদিন তো খেতে পাব!
[ আলো কমে ]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[ চাষির বাড়ি। নকুল ও গোকুল কথা বলছে ]
নকুল। (প্রচণ্ড হাসছে) আমি চিন্তা করতে পারছি না রে গোকুল-আমাদের কপালে যে লেবু ফলবে তা কে জানত-এবার রাজার কথা যদি রাজা রাখে-ওহো হো হো।
গোকুল। তুই বড্ড বকবক করিস। আর সদানন্দটা একেবারেই বোকা। লেবু নিয়ে যাব আমি।
নকুল। রাজত্ব রাজকন্যা সব তুই নিবি?
গোকুল। তোকে রাজত্বটার আধখানা দেব। এখন শোন, আমাদের জমিতে যে পাতিলেবু ফলেছে তা কাউকে বলা চলবে না। আমিও কাউকে বলব না। যা ঝুড়িটা আন।
[ নকুল লেবুর ঝুড়ি আনে ]
গোকুল। যা এবার মাঠে গোরু চরাতে যা।
নকুল। আমি লেবু নিয়ে যাব।
গোকুল। হয় আমি লেবু নিয়ে যাব তুই গোরুর জাব দিবি, নয় তুই গোরুর জাব দিবি আমি লেবু নিয়ে যাব, কোনটা? প্রথমটা না দ্বিতীয়টা?
নকুল। (বুঝতে পারে না) ওই দ্বিতীয়টা!
গোকুল। তবে আমি চললুম রে! একেবারে বিয়ে করে ফিরব-
[ ছুটে চলে গেল
নকুল। (কাঁদে) আমি কেন গোরুর জাব দেব রে!
[ আলোর পরিবর্তনের মাধ্যমে মঞ্চে কিছু বদল ঘটে। গোকুল চলেছে নাচতে নাচতে ]
গোকুল। রাজার বাড়ির রাজভোগ না জানি কেমন সোয়াদ! মাংস পোলাও রাজভোগ পায়েস দই সরভাজা-
[ একটি বামন এসে পথ আটকায় ]
বামন। কোথায় চললে গো?
গোকুল। কে রে!
বামন। আমি গো, শ্রী বামনদাস চটপটি। ছোট্ট মনিষ্যি। রাজার বাড়ি চলেছ?
গোকুল। (ভাবে) না, না, এই গোরুর জাব দিতে চলেছি।
বামন। বেশ, বেশ, তা ঝুড়িতে কী গো?
গোকুল। অ্যাঁ! ঝুড়িতে? ঝুড়িতে আছে ঝিঙের বিচি।
বামন। অ, ঝিঙের বিচি! ভালো, ভালো-যাও, যাও, সাবধানে যেয়ো। ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো।
গোকুল। এমনভাবে ফিরব যে তোমার চোখ টেরিয়ে যাবে।
বামন। (হাসে) ঝিঙের বিচি দিয়ে মুগের ডাল বেশ খেতে। যদি না ঝিঙের বিচি তেতো হয়-
গোকুল। তাই খাও বসে বসে।
[ চলে গেল
[ বামন বসে বসে নিজের মনে হাসে। হঠাৎ গোকুল এসে বসে পড়ে। সারা গায়ে নোংরা, রাজার অনুচর এসে গোকুলকে পেটায় ]
অনুচর। একঝুড়ি ঝিঙের বিচি এনে বলে লেবু! ব্যাটা বদমাস। রাজা বলেছেন তোর শাস্তি দশ জুতোর বাড়ি।
বামন। সে কী! তুমি তো ঝিঙের বিচি নিয়েই গেলে গোরুর জাব দিতে! এই তো সারা গায়ে গোরুর পটি লেগে।
গোকুল। আরে পেয়াদার লাথি খেয়ে উড়ে এসে পড়লুম একটা গোয়ালঘরে, আর সব গোরুগুলো-(কাঁদে)
বামন। কেন যে পাজি গোরুদের জাব দিতে গেলে!
গোকুল। মেরে পাট করে দেব তোমাকে।
[ কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল
[ জুড়িদার ও জুড়িদারনি আসে ]
গান
বড়ো দাদা একটা গাধা, মিছে কথার ব্যবসায়ী
মিছে কথা সত্যি হল দাদা হল শয্যেশায়ী
আবার যেন আসছে কেডা
মাথার ওপর সঙ্গে ঝুড়ি
সেজ দাদা এলেন এবার এর ভাগ্যে আছে কী?
[ নকুল আসে, মাথায় ঝুড়ি ]
নকুল। দাদাটার যে কী হল? কিছুই বলে না কেবল কাঁদে। সাবধানে থাকতে হবে-
বামন। চললে কোথায়?
নকুল। এই রাজার-অ্যাঁ না, না, দাদা বলল গোরুর জাব দিগে যা।
বামন। জাব দিতে গেলে তো গায়ে গোবর লেগে যাবে।
নকূল। গোবর। না, না, যখন ফিরব দেখবে পরনে জরির জামা, সোনার মুকুট-অ্যাঁ, না, আমি কিছু বলিনি, আমি কিছু জানি না।
বামন। ঝুড়িতে কী গো?
নকুল। অ্যাঁ-ঝুড়ি! কীসের ঝুড়ি? ও আমার এই ঝুড়ি? ওতে আছে কদবেল। টক পচা কদবেল।
বামন। অ। আমি ভাবলুম বুঝি অন্য কিছু। যাও কদবেল নিয়েই যাও।
জুড়ির গান
লোক ঠকিয়ে লাভ কিছু নাই, এমনি এমনি ঠকাই,
এমনি এমনি ঠকাই।
সত্যি বলার কষ্ট অনেক, মিথ্যে এমনি এমনি রটাই,
এমনি এমনি রটাই।
[ গানের মাঝেই কান্নার মুকাভিনয় করতে করতে নকুল আসে, দু-হাতে দুটি কদবেল, গায়ে নোংরা, কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় ]
সব লোককে করবে সন্দেহ
কারো কথায় ভুলবে না কেহ
আমায় যদি ঠকিয়ে দাও, তাই নিজেকে নিজেই আমি ঠকাই।
[ সদানন্দ ঝুড়ি মাথায় নাচতে নাচতে আসে ]
বামন। কে গো! পেরজাপতির মতো নেচে নেচে চলেছ?
সদানন্দ। আমি সদানন্দ গো! সদাই আনন্দ, হাসিখানা দেখছনি?
বামন। চমৎকার। চললে কোথায়?
সদানন্দ। এই রাজার বাড়ি। তোমাকে কী সোন্দর দেখতে গো ছোট্ট মানুষ।
বামন। তোমার চোখে সোন্দর গো-ঝুড়িতে কী?
সদানন্দ। লেবু গো, পাতিলেবু। রাজকুমারী খাবে, ব্যামোর আরাম হবে।
বামন। বাঃ বাঃ! মানে তুমি রাজ্য পাবে, রাজকন্যে পাবে।
সদানন্দ। সে দিলে দেবে, না দিলেও ক্ষতি নেই। অসুখ সারলেই আমি খুশি। রাজত্ব নিয়ে কী করব? আর রাজকন্যের সমান সমান পাত্র কি আমি? ওসব লোভ আমার নাই।
বামন। রাজার কথা রাজা কেন রাখবে না? শোনো সদানন্দ, তুমি রাজত্ব আর রাজকন্যে চেয়ে নেবে। হকের পাওনা। চুরির ধন তো নয়।
সদানন্দ। বলছ?
বামন। বলছি।
সদানন্দ। বেশ, তাই হবে, চলি গো বামনদাদা।
জুড়ির গান
চলো পিছু পিছু যাই
চলো পিছু পিছু যাই
রাজা নিজে ঠকবাজ, সে কথা রাখে না কিছু
চলো যাই পিছু পিছু।
[ আলো কমে ]
তৃতীয় দৃশ্য
[ রাজার সভা। রাজা, মন্ত্রী। জ্যোতিষী এককোণে বাঁধা। স্বর্ণকার ধর্মদাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ]
রাজা। আমার মরে যেতে সাধ হচ্ছে।
মন্ত্রী। আমারও মহারাজ।
রাজা। একজন বলল লেবু। দেখি ঝুড়ি খুলে ঝিঙের বিচি। আর একজন দেখাল কদবেল, এসব কী ঠাট্টা হচ্ছে আমার সঙ্গে! বলো বলো ধর্মদাস, তুমি কী খবর এনেছ?
ধর্মদাস। আমিও একটি দুঃসংবাদ এনেছি মহারাজ।
রাজা। মানে?
ধর্মদাস। মহারাজ, আমি জাতে স্বর্ণকার। চিরকাল রাজবাড়ির সব কাজ করে আসছি। মহারাজের আদেশমতো রাজকুমারীর জন্য যে স্বর্ণহারটি তৈরি করেছি-
মন্ত্রী। এনেছ?
ধর্মদাস। সেটি খুঁজে পাচ্ছি না মহারাজ।
রাজা। মানে? এই জ্যোতিষী, এর অর্থ কিছু জানো?
জ্যোতিষী। ঘোর অমঙ্গল মহারাজ।
রাজা। তুমিও মরবে। লেবুর বদলে যা সব এল!
জ্যোতিষী। লেবু আসুক আগে।
রাজা। শোনো স্যাকরা-ওই হার আমার চাই-
ধর্মদাস। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
রাজা। আমার লোক খুঁজবে। তুমি এখানে বাঁধা থাকবে।
মন্ত্রী। এটা কী ঠিক হবে মহারাজ?
রাজা। চোপ!
[ অনুচর ধর্মদাসকে বাঁধে। জ্যোতিষীর পাশে দাঁড় করায় ]
জ্যোতিষী। ভয় পাবেন না। যে লেবু আনবে সেই আপনাকে বাঁচাবে।
ধর্মদাস। যে জ্যোতিষী নিজেই বন্দি, সে আর কী ভবিষ্যৎবাণী করবে?
জ্যোতিষী। রাজার গ্রহ-নক্ষত্রও সুবিধাজনক নয়। রাজত্ব যাবে, সব যাবে-
ধর্মদাস। চুপ করো দিকিনি।
[ ঝুড়ি মাথায় সদানন্দ আসে, সঙ্গে জুড়ির দল ]
মন্ত্রী। আবার ঝুড়ি। এ হল তিন নম্বর।
সদানন্দ। আগের দুজন ছিল আমার দাদা-তারা কী করেছিল বলুন তো?
রাজা। তোমার দাদা! তোমার দাদা! তোমারও ঝুড়িতে পাতিলেবু, তাই তো?
সদানন্দ। হ্যাঁ মহারাজ।
রাজা। এক ফোঁটা রস মুখে দিলেই আরাম, তাই তো?
সদানন্দ। আপনি এত রেগে রেগে কথা বলছেন কেন রাজামশাই? ওহোহো, আমি পেন্নাম করতে ভুলে গেছি। পেন্নাম রাজামশাই, পেন্নাম মন্ত্রীমশাই (বন্দিদের) আপনাদেরও পেন্নাম।
ধর্মদাস। আমরা বন্দি।
সদানন্দ। মানুষ তো!
জ্যোতিষী। এই-ই সেই লোক বলে মনে হচ্ছে, নইলে আমাদের সম্মান করে!
সদানন্দ। আরে! আমার দুই দাদা আমার মাথার ঝুড়িটা দিয়ে বললে যা, বুঝবি কত ধানে কত চাল, তা ধান-চালের ব্যাপারটা ঠিক কী মন্ত্রীমশাই?
রাজা। এখুনি বুঝবে।
মন্ত্রী। (রাজাকে) আপনি চ্যাঁচাচ্ছেন কেন? আপনি রাজা, নিজের ওজন ঠিক রাখুন।
রাজা। বোকো না, ঝিঙের বিচির ভাই কদবেল, এবার কদবেলের ভাই নিশ্চয় পচাকুমড়ো।
সদানন্দ। ঝুড়িতে লেবুই আছে মহারাজ। লেবুর ঝুড়িতে কি ঝিঙের বিচি থাকে, না কদবেল থাকে? আপনারা দেখছি ভারী বোকা। নিন ঝুড়ি খুলে দেখুন।
মন্ত্রী। এইবার মরবে তুমি।
[ সদানন্দ ঝুড়ি নামায়, ঝুড়ির ডালা খোলে। লেবু বার করে ]
সদানন্দ। দেখুন কী চমৎকার টকমিষ্টি গন্ধ।
রাজা। এ তো সত্যিই লেবু দেখছি!
মন্ত্রী। তাইতো! অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা!
রাজা। মানে।
মন্ত্রী। আপনিই তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
রাজা। মনে নেই! আমার কিছুই মনে নেই!
সদানন্দ। এবার রাজকুমারীকে সভায় আনা করান।
জ্যোতিষী। সেটা বিশেষ প্রয়োজন। লেবু খাবে, অসুখ সারবে, তবে তো আমি মুক্তি পাব।
মন্ত্রী। হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্রমাণ দরকার।
রাজা। রাজকুমারী সভায় আসবে?
মন্ত্রী। নইলে প্রমাণ হবে কী করে?
রাজা। ওরে কে আছিস, কিরণমালাকে এখানে আন।
[ অসুস্থ রাজকন্যা টলতে টলতে সভায় আসে ]
মন্ত্রী। মাটির তৈরি লেবু নয় তো?
সদানন্দ। লেবু মাটির রস থেকেই পেকে ওঠে, কিন্তু তার ভিতরে মাটি নাই, তার ভিতরে আছে মাটির প্রাণ। রাজকুমারী হাঁ করুন তো।
[ রাজকুমারীর মুখে লেবুর রস পড়ে। সে স্বাভাবিক হতে থাকে, মুখ চোখ পালটে যায় ]
কিরণমালা। বাবা!
রাজা। আমাকে আমার মেয়ে বাবা বলে ডাকল! কতদিন বাদে-
জুড়ির গান
রোগ পালাল শান্তি হল হাসল রাজামশাই
পান্তুয়া আর রসবড়া দে মোরা আরাম করে খাই।
এরপরে তো আসছে বিয়ের ভোজ
বিয়ের দিনের রাখতে হবে খোঁজ
(সদাকে) অর্ধেক রাজত্ব পেলে মোদের ফাঁকি দিয়ো না ভাই।
রাজা। না, না, কে কাকে ফাঁকি দেবে! এই কে আছিস, ছেলেটাকে দুটো বাতাসা আর জল দে। অনেক দূর থেকে এসেছে। একটাকা রাহাখরচ দে। অবশ্য এক টাকা নিয়ে ও আর কী করবে? ওকে একটা আটআনি দাও।
মন্ত্রী। ডোবাবেন দেখছি। সবার সামনে আপনি কী বলেছিলেন?
জ্যোতিষী। আমি সাক্ষী আছি।
মন্ত্রী। এই কেউ জ্যোতিষীর বাঁধন খুলে দে। (জ্যোতিষী মুক্তি পায়)
রাজা। এই জ্যোতিষীকেও একটা আটআনি দাও।
জ্যোতিষী। ওটা আপনার জন্যেই থাক মহারাজ।
সদানন্দ। আটআনি? রাজত্ব আর রাজকন্যে?
মন্ত্রী। এবার?
রাজা। আমি যে কিছুই মনে করতে পারছি না। মন্ত্রী চাষার ছেলেকে রাজত্ব দেব, জামাই করব? কিছু একটা করো।
জুড়িদার। (নিচু স্বরে) বলেছিলাম রাজাটা ঠগ।
জুড়িদারনি। (নিচু স্বরে) সদানন্দ! সেই বামনের কথা মনে রেখো।
মন্ত্রী। এই গানের দলটাকে আগে বিদেয় করা দরকার। এই নাও। (পয়সা দেয়)
জুড়িদার। সেই একটা ফুটো পয়সা?
জুড়িদারনি। কী নিচু নজর গো!
সদানন্দ। তোমরা বরং কিছু লেবু নিয়ে যাও। বেশ দাম পাবে বাজারে।
জুড়িদার। দেখো দেখো রাজার জামাই হতে চলেছে, কিন্তু মনখানা কীরকম উদার, দাও চারখানা লেবু।
মন্ত্রী। তোমরা বিদেয় হবে কি না।
জুড়িদারনি। বিয়ের গান গাইব না?
কিরণমালা। হ্যাঁ হ্যাঁ! তোমরা আমার বিয়ের গান গাইবে।
রাজা। তুমি এসবের মধ্যে কথা বোলো না মা। ভেতরে যাও। কোনো রাজপুত্র কি মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব।
কিরণমালা। আমি ভেতরে যাব না বাবা।
রাজা। এই তোমার জেদ শুরু হল, ভারী জেদি মেয়ে তুমি।
কীরণ। (ধর্মদাসকে দেখিয়ে) ইনি বন্দি কেন বাবা?
ধর্মদাস। তোমার সোনার হার গড়তে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি মা।
কিরণ। সে তো আমি কত কিছু হারিয়ে ফেলি। সে কি আমার দোষ? সোনার হারের হয়তো হাত-পা গজাল আর অমনি সে হেঁটে হেঁটে চলে গেল-এ তো আমার কথা নয়, বাবারই কথা, কোনো কিছু হারিয়ে গেলে বাবাই তো এই কথা বলে।
রাজা। তুই ভিতরে যা দেখি!
কিরণ। বাবা বকছে (কাঁদো কাঁদো)।
রাজা। আরে, এই দেখো, বকলাম আবার কখন!
কিরণ। আর আমি তোমার কাছে থাকব না, আমি বরের সঙ্গে শ্বশুরঘর চলে যাব।
মন্ত্রী। অ্যাঁ।
ধর্মদাস। সে তো মা ঠিকই বলেছ। সদানন্দের সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। বর পছন্দ?
[ কিরণমালা মাথা নিচু করে হাসে ]
রাজা। এই ধর্মদাস, বন্দি হয়ে আছ, বন্দি হয়েই থাকবে, এত কথা বলবার সাহস হয় কী করে?
জুড়িদার। রাজামশায়ের কথা আমি স্বচক্ষে শুনেছি।
জুড়িদারনি। আরে কথাটা হবে স্বকর্ণে শুনেছি।
জুড়িদার। ওই হল, চোখ আর কানের তো এইটুকুনি দূরত্ব।
রাজা। মন্ত্রী, তুমিই আমাকে ডোবালে! চাষার ঘরে তুমি যেতে পারবে না কিরণ। আমি তোমার জন্যে ভালো পাত্র-
কিরণ। তাহলে যে তুমি মিথ্যুক হয়ে যাবে বাবা! ও চাষি হোক, জেলে হোক, অসুখ যখন সেরেছে তখন আমাকে তো ওর সঙ্গে যেতেই হবে।
মন্ত্রী। সে তো ঠিকই।
রাজা। মন্ত্রী!
মন্ত্রী। পুরো কথাটা শুনে তারপর ধমকাবেন। হ্যাঁ সে তো ঠিকই তবে কিনা সদানন্দের মতো বাহাদুর ছেলেকে দেখে আমাদের মনে যে সাহস জেগেছে-কী রাজামশাই?
রাজা। আমি ও সঙ্গে বিয়ে দেব না। চাষার ছেলের শ্বশুর হব আমি?
মন্ত্রী। দিতে হবে না। এখন আমার কথাগুলো শুনে শুনে বলুন।
রাজা। বেশ, কী বলব?
মন্ত্রী। আমাদের মনে যে সাহস জেগেছে …
রাজা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, যে সাহস জেগেছে … তারপর মন্ত্রী?
মন্ত্রী। যে আশা ও ভরসা জেগেছে …
রাজা। যে আশা ও ভরসা জেগেছে …
মন্ত্রী। তার জোরে সদানন্দের কাছ থেকে একটি জিনিস চাইব।
সদানন্দ। বিয়ে হবে না?
মন্ত্রী। বিয়ের জন্যই তো!
রাজা। কেন? আবার বিয়ে কেন?
মন্ত্রী। শেষ অবদি শুনবেন দয়া করে আমার কথাগুলো মহারাজা। শোনো সদানন্দ, বিয়ে হবে, রাজত্ব পাবে, মহাধুমধাম হবে-কিন্তু পালক? পালক না আসলে তো বিয়ে হবে না!
জুড়িদার। পালক?
জুড়িদারনি। কীসের পালক?
সদানন্দ। পালকের ব্যাপারটা কী?
রাজা। পালকের ব্যাপারটা মানে….
মন্ত্রী। ঘ্যাঁঘাসুরের লেজের একটি পালক এনে দিতে হবে, এসে দেখবে বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা।
রাজা। অ্যাঁ! পাকা ব্যবস্থা! তুমি কী বলছ?
মন্ত্রী। ঘ্যাঁঘাসুরের লেজের পালক আনবার পর-
[ সবাই সবাইকার দিকে তাকায়। ধর্মদাস জ্যোতিষী জুড়িদার ইত্যাদির মুখ শুকিয়ে যায় ]
ধর্মদাস। ঘ্যাঁঘাসুর!
জ্যোতিষী। সে তো ভয়ানক জীব শুনেছি।
ধর্মদাস। তার কাছে মানুষ যেতে পারে না বলেই শুনেছি।
জ্যোতিষী। মানুষখেকো বুঝি!
ধর্মদাস। সেরকমই শুনেছি।
রাজা। ঘ্যাঁঘাসুর একজন জ্ঞানী ব্যক্তি।
মন্ত্রী। সে না জানে এমন জিনিস নেই।
রাজা। সদানন্দ অনেক কিছু জেনে আসতে পারবে।
সদানন্দ। কীরকমভাবে যেতে হবে একটু বলে দিন।
মন্ত্রী। ছবি এঁকে দেব। তবে রাস্তা খুবই সহজ। বন পেরিয়ে নদী। নদী পেরিয়ে পাহাড়। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় ঘ্যাঁঘার বাড়ি। চলুন রাজামশাই। সদানন্দ পালক আনলেই বিয়ে হবে। এ তোমার পক্ষে কিছুই নয়, তুমি যখন এই মাটিতে লেবু ফলিয়েছ তখন তুমি এই সামান্য কাজটুকু অবশ্যই পারবে।
সদানন্দ। ওই পালক দিয়ে কী হবে মন্ত্রীমশাই?
মন্ত্রী। হাওয়া খাবে রাজকুমারী। ঘ্যাঁঘার এক-একটি পালক নাকি এক-একটি বিরাট পাখার মতো। চলুন রাজামশাই।
[ রাজা ও মন্ত্রী চলে গেল
রাজা। (যেতে যেতে) প্যাঁচখানা ভালোই কষেছ গো মন্ত্রী।
জুড়িদার। সত্যিই যাবে নাকি?
সদানন্দ। রাজকুমারী পাখার বাতাস খাবেন।
জুড়িদারনি। বেঁচে কি ফিরবে?
সদানন্দ। যাই কপাল ঠুকে একবার।
ধর্মদাস। যদি ফিরে আস, জেনে আসবে ভাই সোনার হার কোথায় রেখেছি। আমার সমস্ত ধনরত্ন তোমায় দেব।
সদানন্দ। আমি মনে রাখব আর আপনার আশীর্বাদে ফিরেও আসব।
ধর্মদাস। মনে হচ্ছে তুমি পারবে। তোমার মুখখানা সরলতা আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। ঘ্যাঁঘাসুরের মতো বড়ো জ্যোতিষী কেউ নেই। তুমি আমাকে যদি বাঁচাও তো আমি ফাটক কি ফাঁসির থেকে রক্ষা পাই।
কিরণ। ফিরে এসো গো চাষার ছেলে, কিরণ তোমার পথ চেয়ে রইবে।
[ মন্ত্রী হঠাৎ ভিতর থেকে এসে কিরণকে টেনে নিয়ে চলে যায়। অন্যদিকে জুড়ির গানের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের বদল ঘটতে শুরু করে। সবাই মিলে সদানন্দকে সাজিয়ে দেয়। লাঠির মাথায় পুঁটলি বেঁধে সদানন্দ চলল যেন যুদ্ধ করতে। এককোণে দেখা যায় নকুল আর গোকুল বলছে–মরবি, এবার প্রাণে মরবি’, অন্য দিকে সেই বামন বলছে- -স্বস্তি, স্বস্তি-! ]
জুড়ির গান
বনের ভেতরে বাঘের ভয়
বাঘ কিছু বলবে না, বাঘ মানুষ চেনে।
রাজা যদি এখান দিয়ে যেত
বাঘ গপ করে গিলে নিত, বাঘ মানুষ চেনে।
সাদা সরল চাষির ছেলে সদা
নেই ঢাল তরোয়াল বর্শা কিংবা ভীমের গদা।
ঘ্যাঁঘার ঘরে গিয়ে কী যে হবে
ঘ্যাঁঘা বুঝি কড়মড়িয়ে খাবে
ঘ্যাঁঘা মানুষ খেতে ভালোবাসে।
এই নদীর পারে এসে গেলুম বাছা
নিলাম বিদায় রইল শুভ আশা
তোমাকে ভুলে যাব না
তোমাকে ভুলে যাব না।
[ মঞ্চে নদীতীরের আভাস জেগে ওঠে। একজন বৃদ্ধ নদীর ধারে বসে ]
সদানন্দ। ও কত্তা, নদী পার করার মাঝি কই?
বৃদ্ধ। (দেখে) আমি।
সদানন্দ। তুমি? তা নৌকো কই?
বৃদ্ধ। আমি।
সদানন্দ। এ কি সব বেমক্কা কথা বলছ গো? তুমি নয় মাঝি হলে, কিন্তু নৌকো হলে কী করে?
বৃদ্ধ। সে এক ভারী দুঃখের কথা গো ছেলে। সে আমার দুর্ভাগ্য।
সদানন্দ। তোমার কোনো কথাই আমার মগজে সেঁধোচ্ছে না বাপু। যাকগে, শোনো, আমার জরুরি দরকার ওই পারে যাওয়ার। তোমার নৌকো আনো। ফেরির জন্য কত দিতে হবে বলো। আমি দু-পয়সার বেশি কিন্তু দিতে পারব না।
বৃদ্ধ। তাই দিয়ো। এসো। (জলের দিকে যেন নেমে গেল)
সদানন্দ। আরে নিজে নদীতে নেমে গেলে যে! তোমার নৌকো নেই?
বৃদ্ধ। ভারী মর্কট তো হে তুমি! তখন থেকে বলছি, আমিই হলাম নৌকা। নাও আমার কাঁধে চড়ে পড়ো।
সদানন্দ। তোমার কাঁধে চাপব? না, না, সে আমার পাপ হবে।
বৃদ্ধ। তাহলে পাপ না করেই বসে থাকো। ওপারে যেতে গেলে এইভাবেই যেতে হবে। সবাইকে তো এইভাবেই পার করে চলেছি। এর থেকে কবে যে মুক্তি পাব! এসো-
[ সদানন্দ ইতস্তত করে বৃদ্ধের ঘাড়ে চাপে। বৃদ্ধ যেন জলের মধ্য দিয়ে চলেছে সদানন্দকে ঘাড়ে করে ]
সদানন্দ। তোমার ব্যথা লাগছে না তো?
বৃদ্ধ। কবে থেকে ঘাড়ে করছি। আর কষ্ট হয় না গো ছেলে, মনেও পড়ে না কবে থেকে এইভাবে পারাপার করে চলেছি, দিন নেই, রাত্রি নেই আমি ঠায় বসে আছি নদীর ধারে। কবে যে নতুন লোক আসবে, তাকে কাজ বুঝিয়ে ছুটি পাব। তা তুমি ওপারে কেন যাবে গো?
সদানন্দ। ওই পাহাড়ের টঙে চড়ব।
বৃদ্ধ। কেন?
সদানন্দ। ওইখানে থাকেন ঘ্যাঁঘাসুর মহাশয়। তাঁর সঙ্গে দেখা করব। আরে, আরে, ফেলে দেবে নাকি?
বৃদ্ধ। যার নাম করলে আমি টলমল করে পড়ে যাচ্ছিলুম! সে তো শুনেছি দশটা হাতি দিয়ে জলখাবার খায়-
সদানন্দ। তা হতে পারে, আবার তার মতো জ্ঞানী নাকি পৃথিবীতে নেই।
বৃদ্ধ। সেকথা আমিও শুনেছি।
সদানন্দ। জ্ঞানী যদি হয় তবে দশটা হাতি খায় কী করে? অত খেলে জ্ঞান ছিরকুটে যাবে না?
বৃদ্ধ। কী জানি বাবা! শুনেছি সে মানুষের নাম শুনলেই তেড়ে আসে।
সদানন্দ। আমার-তোমার মতো চমৎকার মানুষ হয়তো কোনোদিন দেখেনি!
বৃদ্ধ। অ্যাঁ? বলেছ ভালো। এই যুক্তিটা তো ভেবে দেখবার মতো। তা তুমি কীজন্যে যাবে?
সদানন্দ। তেমন কিছু না। ঘ্যাঁঘাসুরের লেজের একখানি পালক নেব।
[ বৃদ্ধ যেন নদী পেরিয়ে ঘাড় থেকে নামাল সদানন্দকে ]
বৃদ্ধ। দাও পয়সা দাও। তা লেজের পালক চাইবে সে অমনি দিয়ে দেবে? শুনেছি তার লেজের ঝাপটে এমনি ধুলো ওড়ে যে একমাস অন্ধকার থাকে।
সদানন্দ। শোনো মাঝিভাই, আমার একূল নাই ওকূল নাই। দাদাদের অত্যাচারে প্রাণ যায়। ভাগ্যে যদি শিকে ছিঁড়ল তাও আবার রাজার নতুন আবদার। না খেয়ে মরার চেয়ে লড়ে মরা ভালো।
বৃদ্ধ। (ভাবে) তোমার ওপর মায়া পড়ে গেল হে। তুমি ফিরবে এ আশা করব না, তুমি যদি ফেরো তো জেনে এসো দিকিনি আমার এ ভূতের বেগার কবে শেষ হবে? সে তো জ্ঞানীর জ্ঞানী!
সদানন্দ। নিশ্চয় জেনে আসব খুড়ো। চললাম-
বৃদ্ধ। ওই পায়ে চলা পথ বেয়ে চলে যাও। দেখতে পারে ঝরনা। ঝরনার জলের ধারা কোনদিক থেকে আসছে তা খুঁজতে খুঁজতে গেলেই পাহাড়ের ওপরে উঠে যাবে। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। আমার কথাটা ভুলো না-
সদানন্দ। (যেতে যেতে) ভুলব না। (হাসে) কিরণমালা আমাকে ফিরে যেতে বলেছে!
[ আলো কমে ]
চতুর্থ দৃশ্য
[ পাহাড়ের চূড়ায় ঘ্যাঁঘার গুহা। গুহার সামনে বসে ঘেঁঘি। এলো চুলে পা ছড়িয়ে বসে চাল বাছছে। ভিতরে যায়। হামান-দিস্তে এনে ঠকঠক করে চাল গুঁড়োতে থাকে ]
ঘেঁঘি। আমার কত্তার জ্বালায় আমি গেলুম বাবা! আজ এই খাব। কাল ওই খাব। আজকে খাবেন সরুচাকলি। চাল-ডাল গুঁড়ো করো। দুধে গোলো, চাটুতে ছড়াও, ভেজে তোলো। সঙ্গে থাকবে পাতলা সুজির হালুয়া।
[ আস্তে আস্তে পাহাড়ের খাঁজের থেকে সদানন্দ মুখ বাড়ায়, আবার লুকিয়ে পড়ে ]
ঘেঁঘি। কে রে? কে ওখানে? কেমন খসর খসর শব্দ হল! এই ভয়ানক জায়গায় আসার সাহস কারই বা হবে। এবার দুধের সঙ্গে চালডালের গুঁড়ো গুলে নিই। কেমন যেন একটা গন্ধ আসছে। কেমন একটা মানুষ মানুষ গন্ধ! কে এসেছে? কে? যে এসেছে তার কি মরনের ভয় নেই? শোনো, আমি ঘ্যাঁঘার গিন্নি ঘেঁঘি বলছি। আমাকে ভয় পেয়ো না। বেরিয়ে এসো বলছি। কী হল? ঘ্যাঁঘার সঙ্গে থেকে থেকে কিন্তু আমি খুব রাগি হয়ে গেছি। আমার কথা না শুনলে মাথা পাথরে ঠুকে দেব।
সদানন্দ। (আড়াল থেকে) আমি এসেছি।
ঘেঁঘি। বেরিয়ে এসো।
সদানন্দ। তোমার বর কোথায়?
ঘেঁঘি। প্রাতঃভ্রমণে গেছেন তিনি। কোনো ভয় নেই।
[ সদানন্দ পাহাড়ের খাঁজ থেকে বেরোয়। মুখে ভয় তার সঙ্গে হাসি। ঘেঁঘি সদানন্দকে দেখে ]
ঘেঁঘি। এই পুঁচকে ছেলে! কোন সাহসে এলিরে এখানে?
সদানন্দ। সে আমার জীবন-মরণ সমস্যা গো দিদি, আগে একটু জল… পাহাড়ে চড়ে… একেবারে…
ঘেঁঘি। এইসব দিদি-টিদি বলেই তো সব গোল বাঁধাল! দেখছি ঘরে কী আছে। (গুহার ভিতরে যায়)
সদানন্দ। মোটেই ভয়ংকর কিছু নয়। দিদি তো মাটির মানুষ।
[ ঘেঁঘি আসে, হাতে কলাপাতায় খাবার ]
ঘেঁঘি। কিছু ফল আর বাতাসা আছে, খাও।
[ সদানন্দ খায়, ঘেঁঘি দেখে ]
সদানন্দ। জলের ঘটিটা-
ঘেঁঘি। এই নাও, আহা গো তেষ্টা পেয়েছিল।
সদানন্দ। ঘ্যাঁঘাসুর হল রাক্ষস, তার বাড়িতে ফল আর বাতাসা? কেমন করে হল? খুব চিন্তার ব্যাপার। সে কি আমাকে পেলে ধরে খাবে?
ঘেঁঘি। মানুষের ওপর তার বড্ড রাগ। বলে, মানুষের মতো কুচুক্কুরে, অকৃতজ্ঞ, নিষ্ঠুর প্রাণী আর নেই। মানুষ এসেছে জানলে যে সে কী করবে তা আমি জানি না। সময় থাকতে পালাও।
সদানন্দ। পালালে হবে না গো দিদি, নিয়ে যেতে হবে একখানা পালক। তোমার কর্তার লেজ আছে না?
ঘেঁঘি। ও বাবা! তার লেজের জন্যেই তো তার শোভা-
সদানন্দ। সেই লেজের পালক একখানা আমার চাই।
ঘেঁঘি। (অবাক) তোমার সাহস তো কম নয়। লোকে আমার কর্তার নাম করতে ভয় পায়, আর তুমি লেজের পালক নিয়ে যাবে বলছ?
সদানন্দ। আমার দিদি যখন সেই ভয়ানক প্রাণীর সঙ্গে ঘর করতে পারে, তখন আমি সেই দিদির ভাই হয়ে সামান্য একটা পালকের জন্যে আবদার করতে পারি না?
ঘেঁঘি। (হেসে ফেলে) তুমি অতিশয় পাজি।
সদানন্দ। না গো দিদি, আমার সরল মন।
ঘেঁঘি। সেই ভয়ানক প্রাণীর কিন্তু ফেরার সময় হয়েছে। তুমি এইখানে লুকিয়ে থাকো এই আসনের নীচে।
সদানন্দ। দিদি, জামাইবাবু কি সত্যিই ভয়ানক? সত্যিই মানুষ খায়? আমার কেমন বিশ্বাস হচ্ছে না।
[ একটা অদ্ভুত শব্দ হতে থাকে। ভারী কোনো প্রাণীর পা ফেলবার শব্দ, সদানন্দ ভয় পায় ]
ঘেঁঘি। ওই আসছেন।
সদানন্দ। এখানে লুকোব?
ঘেঁঘি। এইখানেই উনি বসেন। এর নীচে বসে থাকো চুপ করে।
[ সদানন্দ লুকোয়, বিশাল চেহারার বিচিত্রদর্শন ঘ্যাঁঘাসুর আসে ]
ঘ্যাঁঘা। ঘেঁঘি গো, ঘেঁঘি।
ঘেঁঘি। বলুন প্রভু।
ঘ্যাঁঘা। এই লাঠিটা ধরো দেখি। আচ্ছা, ঘেঁঘি তুমি আমাকে কেন সহজভাবে নিতে পার না? কেবল আমাকে প্রভু বলে ডাক কেন?
ঘেঁঘি। তোমার মতো জ্ঞানী আর কেউ নেই বলে।
ঘ্যাঁঘা। বেশ বেশ। তা সরুচাকলি করেছ?
ঘেঁঘা। এই হল বলে।
ঘ্যাঁঘা। বড্ড খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিয়েই লেখাপড়া করতে বসব।
ঘেঁঘি। সারাদিন নিরামিষ খাও আর শাস্ত্রচর্চা করো, অথচ লোকে জানে তুমি মানুষখেকো।
ঘ্যাঁঘা। ওইসব রটিয়েই তো বেঁচে আছি। নইলে সবাই নানারকম প্রশ্ন নিয়ে ছুটে আসবে। জ্ঞানের প্রতি তো কারো আগ্রহ নেই। সবাই বলবে, ভবিষ্যৎ বলে দাও, কী করে টাকা হবে বলে দাও। যদি বলি, শোনো কীরকমভাবে চললে ভালো মানুষ হতে পারবে, কম স্বার্থপর হতে পারবে-অমনি সব পালাবে। মানুষ হল বর্বর। ওরা আমাকে ভয় পেলেই ভালো। (হঠাৎ) কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছি!
ঘেঁঘি। কী! কীসের গন্ধ!
ঘ্যাঁঘা। মানুষ-মানুষ গন্ধ (সদানন্দ ঘ্যাঁঘার লেজ ধরে টানে) কে? কে আমার লেজ ধরে টানল?
ঘেঁঘি। উফ। কী অস্থির ছেলেটা! পালকটা দেখেই অমনি-
ঘ্যাঁঘা। কী বলছ বিড়বিড় করে?
ঘেঁঘি। না, না, কিছু না-শোনো, ও তোমার মনের ভুল।
[ সদানন্দ আবার টানে ]
ঘ্যাঁঘা। এইখানে কিছু আছে একটা।
ঘেঁঘি। কতবার বলছি ওরে পালক টানিস না, পালকের ব্যবস্থা আমি তোকে করে দেব।
ঘ্যাঁঘা। কাকে বলছ?
ঘেঁঘি। অ্যাঁ-কাকে! মানে-
[ ঘ্যাঁঘা আসনের নীচ থেকে সদানন্দকে চুলের মুঠি ধরে বার করে আনে ]
সদানন্দ। ওরে বাবারে! ওরে বাবারে!
ঘ্যাঁঘা। একটা মানুষ! ঘেঁঘি একী কাণ্ড! এখানে মানুষ এল কী করে?
ঘেঁঘি। এ আমার ভাই।
সদানন্দ। জামাইবাবুর লেজের একটি পালক চাই।
ঘেঁঘি। সে তো আমি তুলে নিতাম উনি ঘুমোলে। তুই কেন টানতে গেলি রে।
ঘ্যাঁঘা। চুপ, চুপ, কোন সাহসে তুমি এখানে মানুষের ছাকে ঢুকতে দিলে? আর মানুষের ছা, তোর কি প্রাণে ভয়ডর নেই?
সদানন্দ। কোনো ভয় নেই। দেখলাম তো তুমি নিরামিষ খাও। শুনলাম আড়াল থেকে যে তুমি মানুষকে ভয় দেখিয়ে দূরে রেখেছ।
আমাকে দেখে ভয় হচ্ছে না।
ঘ্যাঁঘা। আমাকে দেখে ভয় হচ্ছে না।
সদানন্দ। ভয়? কই, না তো!
ঘ্যাঁঘা। (হাসে) বেশ বেশ। তা বাপু আমার পালক নিয়ে কী করবে?
সদানন্দ। তোমার পালক নিয়ে যাব, হাতপাখা বানানো হবে, রাজার মেয়ে বাতাস খাবে, তারপর রাজকুমারীর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে।
ঘ্যাঁঘা। বটে! এরকম ব্যাপার। তাহলে তো চিন্তা করে দেখতে হবে। আচ্ছা ঘেঁঘি, এ তোমার ভাই?
সদানন্দ। দিদির পাতানো ভাই, আপনার পাতানো শালা। আমার নাম সদানন্দ। আমার দুটি উপকার চাই। এক পালক, আর দুই হল দুটি প্রশ্নের উত্তর।
ঘেঁঘি। যাই এবার পায়েস রাঁধিগে।
[ চলে গেল
ঘ্যাঁঘা। বলো কী প্রশ্ন?
সদানন্দ। ধর্মদাস স্যাকরা রাজার মেয়ের সোনার হার কোথায় হারিয়েছে?
ঘ্যাঁঘা। (ভাবে) ঘরের কোণে ব্যাঙের গর্ত। তার ভিতরে আছে। আর?
সদানন্দ। খেয়ার মাঝি যে ঘাড়ে করে মানুষকে পার করে তার কি মুক্তি মিলবে না?
ঘ্যাঁঘা। ও, সে ব্যাটা নিজেই আহাম্মক। একটা লোককে মাঝনদীতে এনে নামিয়ে দেবে। ব্যস সেই লোকটাই পারাপার করাতে থাকবে। এই সোজা কথাটা তার মনে হল না!
[ ঘেঁঘি খাবার আনে ]
ঘেঁঘি। সব খাও এবার।
সদানন্দ। খেয়েই উঠে পড়ব দিদি। কী ধন্যবাদ জানাব জামাইবাবুকে-
ঘেঁঘি। আমরা তোমার নিজের লোক সদানন্দ, নিজের জামাইবাবুকে কি কেউ ধন্যবাদ জানায়?
[ ঘ্যাঁঘা নিজের পালক দেয় সদানন্দকে। আলো কমে ]
পঞ্চম দৃশ্য
[ খেয়াঘাটের এপারে এনে নামাল সদানন্দকে সেই মাঝি। ঘাম মুছল ]
বৃদ্ধ। ঘ্যাঁঘা কী বললে বলো! আমার কী উপায়?
সদানন্দ। এবার বলা যায়। শোনো। (কানে কানে)
বৃদ্ধ। অ্যাঁ! ঠিকই তো! এটা তো সহজ রাস্তা। চলো না সদানন্দ, আর একবার তোমাকে ওপারে নিয়ে যাই।
[ সদানন্দ মাঝির মতলব বুঝতে পেরে দৌড় লাগায় ]
বৃদ্ধ। আরে ও সদানন্দ, হল কী?
সদানন্দ। আমার মেলা কাজ গো। আমার সময় নাই।
[ সদানন্দ দৌড়োতে দৌড়োতে জুড়ির দলের দেখা পায়। জুড়িদার ও জুড়িদারনির হাত ধরে সদানন্দ যেন রাজার সভায় এসে হাজির হয়। রাজার সভায় একইভাবে বন্দি ধর্মদাস। ধর্মদাস সদানন্দকে দেখে হইচই করে ওঠে ]
ধর্মদাস। বেঁচে আছে, এ বেঁচে আছে, এ ফিরে এসেছে।
সদানন্দ। (হাততালি দিয়ে ঘুরপাক খায়) শোনো স্যাকরা কাকা, তোমার বাঁচবার নিদান এনেছি। ঘ্যাঁঘা বলেছেন যে তোমার ঘরের কোণে ব্যাঙের গর্ত, সেই গর্তে আছে রাজকন্যের গলার হার।
ধর্মদাস। (চ্যাঁচায়) জয় বাবা ঘ্যাঁঘাসুরের জয়।
[ মন্ত্রী আসে ]
মন্ত্রী। কে চেল্লায়? (সদানন্দকে) একী!
সদানন্দ। ভূত দেখছেন বলে মনে হচ্ছে। এই যে পালক।
মন্ত্রী। (আমতা আমতা) পা…পালক…মানে…
ধর্মদাস। আমাকে মুক্তি দিন, আমি বাড়ি যাব, আমি রাজকন্যার হার আনব।
[ মন্ত্রী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ধর্মদাসের বাঁধন খোলে। ধর্মদাস ছোটে। অন্যদিক থেকে রাজা আসেন ]
সদানন্দ। নমস্কার রাজামশাই। এবার বিয়ের দিন দেখতে হয়।
রাজা। অ্যাঁ! তুমি!
সদানন্দ। সিংহাসনে বসুন, আমি এই পালকের হাতপাখা দিয়ে বাতাস করব।
রাজা। মন্ত্রী-ই-ই!
জুড়িদার। এবার বিয়ের গান ধরো জুড়িদারনি।
[ ধর্মদাস ছুটে আসে ]
ধর্মদাস। বাঁচালে বাবা সদানন্দ। ঘরের কোনে ব্যাঙের গর্তের ভেতরেই ছিল এই হার। আর সদানন্দ এই নাও এক থলি সোনার মুদ্রা, দু-থলি মুক্তা। তিন থলি হিরে। তোমার পুরস্কার!
রাজা। এত ধন তো আমারও নেই মন্ত্রী।
মন্ত্রী। ঘ্যাঁঘার কাছ থেকে কোনো রহস্যের উত্তর জেনে আসতে পারলে আপনিও পাবেন।
রাজা। আমিও যাব। অনেক কিছু জেনে আসব-এত সোনা, এত মুক্তো-মন্ত্রী কিরণকে এনে বিয়ের পিঁড়িতে বসাও, আমি চললাম-
ধর্মদাস। কোথায় চললেন মহারাজ?
রাজা। ঘ্যাঁঘাসুরের বাড়ি। সব দায়িত্ব এখন তোমার।
[ রাজা ছোটে। কিরণ আসে ]
জুড়িদারনি। এসো রাজকন্যে। বরকে এই হাতপাখার বাতাস দাও, আমরা দেখি-
জুড়ির গান
ভগবান ভালো লোকের ভালো করেন বলে
আকাশে এখনও ঠিক চন্দ্র সুয্যি জ্বলে।
পাপীর শেষ অবদি কী হয়
জানার সাধ আছে নিশ্চয়
যাই তবে যাই রাজার পিছু পিছু চলে।
জুড়িদার। সদানন্দ আনন্দে থাকো, আমরা এলাম।
কিরণ। গানের দাম নেবে না?
জুড়িদারনি। গান এমনি এমনি গাই গো, এমনি এমনি।
[ চলে গেল
[ সদানন্দ ও কিরণের বিবাহের মূকাভিনয়। আলো কমে আসে। পট পরিবর্তন হয়। আমরা সেই খেয়াঘাটের বৃদ্ধ আর রাজাকে দেখি, দূর থেকে জুড়ির দল তাদের নজর করছে ]
বৃদ্ধ। তাহলে তুমি বলছ ওই পারে যাবে?
রাজা। একশোবার!
বৃদ্ধ। একশোবার যাবার দরকার কী, একবার গেলেই আমার চলবে।
রাজা। আরে ও কথার কথা বলেছি। ভাড়া কত?
বৃদ্ধ। দু-পয়সা।
রাজা। এক পয়সায় হয় না?
বৃদ্ধ। ভিখিরিদের মাগনাই পার করে দিই আমি।
রাজা। অ্যাঁ! ব্যাট্যা তুই আমাকে অপমান করিস!
বৃদ্ধ। মেলা না বকে কাঁধে চাপো।
রাজা। নৌকো নেই?
বৃদ্ধ। আমিই নৌকো।
রাজা। অগত্যা!
[ রাজা বৃদ্ধের কাঁধে চাপবার মূকাভিনয় করে। যেন জলের মধ্য দিয়ে যাবার ভঙ্গি। হঠাৎ বৃদ্ধ রাজাকে জলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে পালায় ]
রাজা। একী! ও মাঝি-বুড়ো-
বৃদ্ধ। এবার থেকে তুমিই লোকজনকে ঘাড়ে করে পারাপার করাবে। আমার ছুটি-ই-ই।
[ বৃদ্ধ মিলিয়ে যায়
রাজা। অ্যাঁ! এ কী হল? এ কী বিপদে পড়লাম রে বাবা!
[ জুড়ির দল প্রচণ্ড হাসে, রাজা কোনোক্রমে যেন পারে ওঠে। তখনি জুড়িদার এসে রাজার কাঁধে চাপে ]
জুড়িদার। আমি ওপারে যাব।
রাজা। আমি রাজামশাইরে, জুড়িদার।
জুড়িদার। কে রাজা? তুমি এখন খেয়ার মাঝি-ওই দেখো, ওপারে মেলা লোক দাঁড়িয়ে এপারে আসবার জন্য। চলো, চলো-
রাজা। (কেঁদে ফেলে) চাষার ব্যাটা রাজার জামাই হল আর রাজা হল খেয়ানৌকো-ওহোহো-কী কুক্ষণে ঘ্যাঁঘার বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছিলুম…
[ আলো কমে। রাজা জুড়িদারকে নিয়ে জলে নামে। এপারে জুড়িদারনি হেসে খুন। পরদা নেমে আসে ]