ঘোড়ার মনমেজাজ
মফঃস্বল শহরে বাবাকে দেখেছি মােটরে চড়তে। দু-তিন বছরে একদিন। তাও একবার। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের গাড়ি। মােটরে গিয়ে অনেকের সঙ্গে বাবা ভােট দিত। ডাব খেয়ে হেঁটে ফিরে আসত। সেদিন বাজারে ডাব পাওয়া যেত না।
কোনাে শহরেই তেমন মােটর ছিল না। দু-একখানা গাড়ি কদাচিৎ দেখা যেত। তাদের হর্নের আওয়াজ যেন ঘােড়ার গলাখাঁকারি। সেসব গাড়িকে দাঁড়ানাে অবস্থায় কোথাও পেলে তার গায়ের মিহি ধুলােয় আঙুল বুলিয়ে নিজের নাম লিখে দিতাম।
এর বহু বছর পরে একদিন দেখি পার্ক স্ট্রিটে একটা গাড়ির পেছনের সিটে আমি গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছি। আমারই ড্রাইভার আমারই গাড়িতে আমাকে নিয়ে অফিসে চলেছে। দরজা আটকে কাচ তুলে দিলে নিজেরই চলন্ত কোনাে ঘরে যেন বসে থাকি। দুপাশ দিয়ে রাস্তা পিছলে যায় শুধু।
ততদিনে আমি ডেট্রয়টে মােটর গাড়ির কারখানা দেখেছি। হিন্দমােটরে অ্যাসেমব্লি লাইন দেখেছি। নিউইয়র্কে অফ-বিট থিয়েটার দেখে বেরিয়েই হাডসন নদীর অন্ধকার পােড়াে তীরে উঁই করে ফেলে রাখা মােটর গাড়ির কবরখানাও দেখেছি। টোকিওতে টয়ােটা গাড়ির দুই সেলসম্যানকেও দেখেছি যারা আমার বাঙালি বন্ধুর নেহাত বাঙালি বউকে ভজিয়ে একখানা টয়ােটা গছাবার চেষ্টা করছে। তখন আনকোরা টয়ােটার দাম ছিল ভারতীয় টাকায় সতেরাে হাজার। দু-হাজার মার্কিন ডলারের কিছু বেশি। তিনশাে ইয়েনে তখন এক ডলার। যে হনডার কারবন কপি এই মারুতি—তার ওভারঅল পরা চেয়ারম্যান মিস্টার হনডার সঙ্গেও লাঞ্চ খেয়েছি।
ভুলেও ভাবার দরকার নেই—আমি মােটর গাড়ির ডিস্ট্রিবিউটর বা অটোমােবিল ইনজিনিয়ার। সাইকেল চড়া শিখেছিলাম বিজয় মােদকের সাইকেল রিপেয়ারিং শপ থেকে ঘণ্টায় চার আনা ভাড়ার সাইকেল নিয়ে, যে সাইকেলের চেন ক্লিপ করত ঘণ্টায় দশবার। হাঁটু ছড়ে গেলে গােড়ায় গােড়ায় দিতাম দুর্বা ঘেঁতাে করে তার রস। আসলে সেটা ছিল টালখাওয়া হ্যান্ডেলের সাইকেল। কিংবা আছাড় খাবার সাইকেল।
আসলে আমার সবচেয়ে পুরােনাে গাড়ি আমারই নিজের দুখানা পা। পরাধীন আমলে ইংরেজ ডি. এম হাফপ্যান্ট পরে হপ করে করে লাফিয়ে সাইকেলে উঠত। ওটাই ছিল ওদের সরেজমিন তদন্তে যাওয়ার কায়দা।
আমার বাবা ভােরবেলা বেরিয়ে যেতেন কয়েকটা চাল আর এক গ্লাস জল মুখে দিয়ে। ফিরতেন সাত-আট মাইল ঘুরে বেলা দুটো-তিনটেয়। ভােরবেলাকার চরে পাখি মেরে। কাঁধে দিশি বন্দুক। মালকোচা মেরে ধুতি পরে কোমরের ভেতর শার্ট খুঁজে নিতেন – অনেকটা আগেকার মাদ্রাজি তিলককাটা আই.সি.এস দের মতাে। যাঁরা সেক্রেটারিয়েটে যাবার আগে আভূমি নত হয়ে মা-বাবাকে প্রণাম করে তবে কাজে বেরােতেন।
বাবা আই.সি.এস ছিলেন না। ছিলেন আই.সি.এস জজদের পেশকার। শেষ বয়সে বােধহয় সেরেস্তাদার হন। তা সে পদে বেশিদিন থাকতে পারেননি। দেশ বিভাগ হয়ে যাওয়ায় কলকাতায় রাইটার্সে চাকরি জীবনের শেষ বছরটি তিনি বিশাল কেরানিকুলের ভেতর একাকার হয়ে যান।
এ কাহিনিতে আমি কিংবা আমার বাবা, প্রধান চরিত্র নয়। তবু বলতে হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর সব কথা-কাহিনিই খুব গােপনে মহাভারতের সঙ্গে যুক্ত। তাই বলা দরকার—আমার বাবা ছিলেন মাংসাশী, ভাবুক কিন্তু দার্শনিক নয়—সাহসী, পরিশ্রমী আর অনেক সন্তানের জনক।
আমি তার শেষদিককার ছেলে। ফলে আমরা শেষদিককার ভাইয়েরা হিসেবের মধ্যে পড়তাম না। তিনিও জানতেন না ভালাে করে—আমরা কে কী পড়ি—কী খাই—কোথায় ঘুমােই। আমরা ছিলাম আমাদের বড়দা, মেজদার ছেলে। ওঁরাই ছিলেন যযাতির যমজ পুরু। আমাদের ভারে বড়দা, মেজদা যৌবনে মাথা তুলতে পারেনি।
ফলে সাত-আট বছর বয়সেই জানতাম সাপ তাড়া করলে কীভাবে এঁকেবেঁকে দৌড়তে হয়। ডুব দিয়ে দিঘির মাটি তুলতে হলে কীভাবে দম ধরে রাখতে হয়। আমাদের অসুখ করা বারণ ছিল। কারণ অসুখ করলে তাে পয়সা লাগে। সে জিনিসটা কম ছিল। কিন্তু বাড়িতে আনন্দ ছিল প্রচুর।
মা টেনিসনের কবিতার সেই বিখ্যাত বাংলা—দুধারে সরিষা খেত—সুর করে মুখস্থ বলতেন। আমরা শেষদিককার ভাইয়েরা বিকেলে ফুটবল খেলে খুব খিদের মুখে শনি-সত্যনারায়ণের পুজো কোন বাড়ি হচ্ছে খুঁজে বের করতাম। বিচেকলা, গুড় আর আটার সিন্নিই ছিল তখনকার টিফিন।
ফলে আমাদের ভেতর খানিকটা আলেকজান্ডার, খানিকটা ভাসকো-দা-গামা আর সামান্য রামদুলাল সরকার মিশে গিয়েছিল। পার্টিশানের পর কলকাতায় এসে লিখতে গিয়ে যখন শুনলাম—ফ্রাসট্রেশন, অবক্ষয়, যুগযন্ত্রণা নাকি আমাদের কুরে খাচ্ছে—তখন মাইক্রোস্কোপ কিংবা দূরবিন চোখে দিয়েও ওসব কিছু খুঁজে পাইনি। জানতাম—শরীরটা মেশিন, জিভটা খাবার চেখে দেখার জিনিস, মনটা কল্পনা করার অটোমেটিক রাইফেল, চোখজোড়া সবকিছু নয়নভরে দেখে রাখার দিঘি। এমনকি এই ষাটের দিকে রওনা দিয়ে এখনাে আমি কোথাও কম্যুনিকেশন গ্যাপ খুঁজে পাইনি। আমার অনেক বন্ধুর বয়স। এখনাে তিরিশের নীচে। আমার বড়াে ছেলে আমার একজন জিগরি দোস্ত। তার ছেলেও আমার বুজম ফ্রেন্ড।
আবারও বলা দরকার এ-গল্পে আমি কেউ না। আমাদের বাবা তো কেউ নয়ই। দেশ বিভাগ না হলে খুলনায় উল্লাসিনী সিনেমা হলে গেটকিপার হতে পারতাম। টর্চের ফোকাস মেরে দর্শকদের ঠিক ঠিক সিটে বসাতাম। কিংবা ভৈরবের তীরে চিটেগুড় গস্ত করে ছােটো ছােটো নদীপথে দেশের ভেতরেই গুড়ের কারবার করতাম হয়তো।
পার্টিশান আমাদের হাতে একটা মােয়া দিল। তার নাম কলকাতা। অভাব আর ময়লা দিয়ে পাকানাে সেই মােয়া। তার ভেতর আমাদের এক ভাই করবি তাে কর সুইসাইড করে ফেলল। স্টক অব ওয়ার্ডে আত্মঘাতী কথাটা জমা পড়ল।
কাননদেবীর বাড়ির জায়গাটা তখনাে ধানখেত। বেহালার ট্রামডিপাে পেরােলে পল্লিগ্রাম। উঠতি হিরােইন ভারতীদেবী। আমি গলফ ক্লাবের মাঠের কিনারে সাহেবদের বল কুড়িয়ে কুড়িয়ে সারাদিনে একটা টাকা পাই। আশুতােষে পড়ি। প্যারাডাইস রেস্তোরাঁয় দুটি লম্বা যুবক ভাড়ে চা খায় আর সিনেমার কথা বলে। অনেক পরে দেখলাম তারা একজন ঋত্বিক ঘটক—অন্যজন মৃণাল সেন। নেহরু আর তার গােলাপ—দুজনই তখন টাটকা। তবে তিনি তখন ধুতিপরা ছেড়ে দিয়েছেন। ব্রিগেডের মিটিংয়ে জনতা উত্তাল হয়ে উঠলে তিনি হাতের ব্যাটন উঁচিয়ে মাইকে বলেন—বই। বইঠ। আর সবাই অমনি বসে পড়ে। পাশেই ফুলহাতা শার্ট গায়ে বিধান রায়। দু হাতেই বােতাম আটকানাে। হেমন্তও ফুলশার্ট। তবে হাতা গােটানাে।
প্লেন লিভিং হাই থিঙ্কিংয়ের বাড়ি। বছরের আলু আর ফিনাইল একসঙ্গে কিনে রাখা হয়। বালি বিছিয়ে খাটের নীচে আলু। ফিনাইল ফুরােলে সেই টিন রং করে ঢাকনা দিয়ে ডাল রাখা হয়। টিনের গায়ে সাদা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানাে। তাতে লেখা—মুসুরির ডাইল। সের তখন ছ-আনা। দশমিক
আসে আরাে প্রায় দশ বছর পরে। লাইকরা পাঁচ আনা।
ততদিনে আমি তােগাতা খেয়ে অনার্স গ্রাজুয়েট। শেক্সপিয়ারের রিচার্ড দি থার্ড আর টেমপেস্ট দেব সাহিত্য কুটীরের বাংলা গল্প থেকে পড়ে লিখে দিলাম। খুলনা জেলা স্কুল থেকে শেখা ইংরাজিতে। সেই ইংরাজিতে পরে—কিংবা সেই ভুল ইংরাজিতে পরে মার্কিন সেনেটের করিডরে সেনেটর কেনেডির সঙ্গে কথা বলেছি—তাঁর তাে বুঝতে অসুবিধে হয়নি ? ম্যাগসেসে ট্রাস্টিবাের্ডের ঘনিষ্ঠ লাঞ্চে ভারতের দার্শনিক ঐতিহ্য নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছি ম্যানিলায়—তাঁরাও তাে বুঝতে পেরেছেন —বুদ্ধদেবের সঙ্গে গান্ধীজির ডিফারেন্স কোথায় ? গান্ধীজির সঙ্গে চৈতন্যদেবের। আসলে বুদ্ধদেব, শঙ্করাচার্য, চৈতন্যদেব, গান্ধীজি—এঁরা চারজনই খুবই পায়ে হাঁটতে পারতেন। মেলা আর হাটের দেশ এই ভারতবর্ষে এঁরা খুব হাঁটিয়ে মানুষ ছিলেন। আমাদের মহাপুরুষরা ছিলেন আসলে ম্যারাথনের মহাপদাতিক। শুধু হিথরাে এয়ারপাের্টে ইংরেজ কেরানি আমার পাসপাের্টে সিল দেবার সময় ইংরাজিতে একটা খারাপ গালাগাল দিয়েছিল। আর এক্সচেঞ্জ কর্নার ডলারের সঙ্গে কিছু কঁচা টাকা গছিয়ে দিল।
আসলে আমার ইচ্ছে ছিল বড়াে একজন জুয়াচোর হই। নয়তাে বড়াে সাধু। যে ইচ্ছা করলেই নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে। কিংবা যে জুয়াচোর লােহাকে সােনা করে—কিংবা নােট ডবল করে।
আপশােশ! কোনােটাই হওয়া হল না। না ভালাে চিটিংবাজ। না ভালাে সাধু। বিবেকের মাকু হয়ে একবার এদিক—আরেকবার ওদিক। আরাবল্লির গুহা-গলতায় গিয়ে দেখলাম, ছাইমাখা ল্যাংটা সাধু প্রচণ্ড শীতে উপনিষদ পড়ছে। সামনে গােল্ডফ্লেকের টিন। পূর্বাশ্রমের অভ্যেস। মাঝে মাঝে বই বন্ধ করে হিমেল নীল আকাশে তাকাচ্ছে। যেদিকটায় ভগবানের ঠিকানা।
এমন মুশকিল—ভগবান নেই বলার মতাে সাহস নেই আমার। ভগবান আছেন—একথা বলার মতাে বিশ্বাসও নেই আমার। একেই কি বলে নিরঙ্করী? , ব্রহ্মবাদী? যাক! যা হয় একটা কিছু হবে। আসলে আমি ছিলাম অকুতােজ্ঞানী। বা মূখ। গলফ ক্লাবে সাহেবদের বল কুড়ােই। এক সাহেবের নজরে পড়ে গেলাম। সে আবার তুখােড় জকি। ড্যানিয়েল সাহেব। সে নিজেই আমায় এক শনিবার বলল, দু নম্বর আর সাত নম্বর ঘােড়ায় লাগাও। খবরদার ন-নম্বরে লাগাবে | পেটে কথা রাখতে পারি না। পাড়ায় দু-এক দাদাকে বলে ফেললাম। ড্যানিয়েল বলেছিল, জিতলে একটা স্কচ দিয়াে। দাদাদের বলে রেখেছিলাম। এক দাদা ন-নম্বর অব্দি খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। আরেক দাদা সাত নম্বর অব্দি খেলে সিধে অলিম্পিয়া। ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম। পেঁৗছে শুনলাম, শ-পাঁচেক টাকা উড়িয়ে দিয়ে এই মাত্তর পাখি উড়ে গেছে।
ক-দিনের ভেতর তিনি কুদঘাটে বাড়ি কিনলেন। সত্তর হাজার টাকা পেয়েছিলেন। একটা স্কচ দিলেন না। দেখাও করলেন না। আমি ট্রামডিপাের ড্রাইভারদের কাছ থেকে তিনশাে টাকা ধার করেছিলাম—দিনে তিন টাকা সুদে। তাতে পাই—নাড়াচাড়া করে—সাত নম্বর অব্দি খেলে—সাড়ে তিন হাজার টাকা। ড্যানিয়েলের জন্যে এক বােতল স্কচ নিয়ে দেখা করলাম। গফের মাঠে।
সে তাে অবাক। আরে সত্যি সত্যিই এনেছ? কী একটা ইংরেজির এরকমই বাংলা মানে হয়।
ড্যানিয়েল আরাে টিপ্স দিয়েছিল। আমি খেলিনি। তখন ঘােড়ার বাংলা বই বেরােত। তাই নিয়ে একদম বাজে লােকদের হইহল্লা আমায় আর ঘােড়ামুখাে হতে দেয়নি। তবে আমি পরে আসল ঘােড়ার নেশায় পড়েছিলাম। সেকথায় এলেই এ-কাহিনির প্রধান চরিত্র চলে আসবে।
তা এখনাে আসছে না কেন?
ঝড়ের কথা বলতে গেলে উড়ে-যাওয়া পাখির কথা বলতে হয়। বৃষ্টির কথা বলতে গেলে পিপড়েদের সঞ্চয়ের আগাম আয়ােজনের কথা বলতে হয়। তাই এ-কাহিনিতে আমার কথা। তাই এই দেরি।
ড্যানিয়েলকে ছেড়ে আমি মিস্টার কাসাগির হাতে পড়লাম। খাস জাপানি। দুর্গাপুরে কী একটা কারখানা বসাবার অর্ডার পাবার আশায় গ্র্যান্ড হােটেলে এসে উঠেছিল। আমার গায়ে তখন ঘােড়ার টাকায় তৈরি স্যুট। ওয়ালেটে ভাজ করা সব একশাে টাকার নােট। কাসাগি আমায় তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিল। যখন মাসে আড়াইশাে টাকা মাইনে হলে প্রেম করে বিয়ে করা যায়—তখনই সাড়ে সাতশাে টাকা মাস মাইনে হল।
জাপানি গাড়ি বাড়ি এসে অফিসে নিয়ে যায়। সন্ধেবেলা ফেরত দিয়ে যায়। অ্যাংলাে মেয়ে স্টেনাে! মা গাড়ি নিয়ে একদিন দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে এল। গ্র্যান্ডের গাড়ি-বারান্দায় কাসাগির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই কাসাগি দেখি অফিসে বসে ফুটপাথ থেকে বেগুনি আনিয়ে খাচ্ছে। আমি সাবধান হলাম। ছ-মাস পরেই ওরা অফিস তুলে দিল। কারখানা বসাবার অর্ডার পায়নি। অনেক পরে জাপানে গিয়ে জানতে পারি—এদেশে ওরা যাদের পাঠায় তারা একদম রােখে জাপানি। ওরা অনেকটা বুনাে প্যান্ট-শার্ট পরা সাহেব সাঁওতাল। ওদের কবিত্ব দেখেছি। টোকিওর আকাশে মােনাে রেল, পাতালে মেট্রো, চাতালে ইলেকট্রিক ট্রেন, রাস্তায় সাঁই সাঁই লিমুজিন-হানেদা, এয়ারপাের্ট থেকে শহরে ঢুকেই ফ্লাইওভারের ছড়াছড়ি। দেখি এক ফ্লাইওভারের নীচে খোঁড়া গর্তে নীল জমা জলে এক জাপানি ছিপ ফেলে বসে আছে। চারদিকে হাজারাে যন্ত্রের দাপাদাপি। একে ছাড়া কাকে কবি বলব!
ছোটোবেলায় একটা মফসলি নেশা ছিল—দুধভর্তি বাটিতে তুলাের মতো পাউরুটি চুবিয়ে তুলে নেব। তারপর প্লেট ভর্তি বড়দানার চিনিতে সেই পাউরুটি চেপে ধরেই মুখে দেব। ড্যানিয়েল থেকে কাসাগি—কাসাগি থেকে প্রেমজি, ভীমজি—তারপর ‘কিত্না ভাও’–এইসব করে-টরে একদিন দেখি চিরকেলে হাটুরে লােক আমি আমারই গাড়ির পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি। পার্ক স্ট্রিটে। ড্রাইভার বিধানসভার কাছাকাছি এসে সামনের দিকে তাকানাে অবস্থাতেই বলল, একটা ভালাে গাড়ি আছে সাহেব—|
তখন আমার নেশা—গাড়ি। বরােদার মহারাজার মতাে রেসিং কারের পর রেসিং কারের নেশার মতাে নয়। রিভিয়েরা নয়। ক্যাসিনাে নয়। হাটুরে লােকের নেশা যেমন হয়—তেমন নেশা। যেমন—একদিন দেখলাম—রিপেয়ারিং গ্যারেজওয়ালা এক ভদ্রলােক আদ্যিকালের এক হিলম্যান চালিয়ে চলেছেন। পায়ের কাছে টিনে অর্ধেক কেরােসিন—আর অর্ধেক পেট্রল মেশানাে। সেখান থেকে রবারের পাইপে এক মিকশ্চার ইঞ্জিনে যাচ্ছে। আমি তাে অবাক।
বললাম, করছেন কী মশাই? | কেন ? বেশি কারবন পুড়বে তাে। ছ-মাস পরে ইঞ্জিন খুলে পরিষ্কার করে নেব। তবু তাে খরচা কম পড়ছে। আর গাড়িও দিব্যি চলছে—
অবশ্য এরকম গাড়ি আর আমি দেখিনি। জল বা কেরােসিন দিয়ে মােটর চড়বার ইচ্ছেও আমার নেই। তখন পেট্রলের লিটার দেড় টাকা থেকে চার আনা বাড়ায় ইন্দিরা একদিন আট ঘােড়ায় টানা ব্রুহামে অফিস গেলেন।
কিন্তু কোনাে একটা গাড়িকে আগাপাশতলা সারিয়ে তার মাল মেটিরিয়াল খুঁজে পেতে কিনে—লেদে বানিয়ে গাড়িটাকে শাে-রুম পিস করে তুলতে আমার ভালাে লাগত।
আরাে ভালাে লাগত যে গাড়িতে লােকজন নিয়ে ওয়ালটেয়ার থার্টিসিক্স মাইলস মাের’ লেখা পাথরের পি ডবল ডি ফলক অবধি চলে যেতে। তখন বিকেলে ছােটো ছােটো পাহাড়ের ছায়া মাঠ জুড়ে। আমরা ওয়ালটেয়ার না গিয়ে বালুগাঁও, রম্ভা, চিল্কা চলে গেলাম।
এর ভেতর কোথায় যেন বাতিলকে ভেঙেচুরে বানিয়ে তােলার—দাঁড় করিয়ে ফেলার আনন্দ ছিল। ছিল কেন ? পেতাম। ইঞ্জিনের কোর—পিস্টনের সাইজ—এসব ঠিক ঠিক মিলে গেলে আমি যেন বাতাসের ভেতর থেকে লুপ্ত অশ্বকে ফিরিয়ে আনতাম। আমিই যেন ঘুমন্ত অশ্বশক্তিকে জাগিয়ে চড়ে বেড়ানাের রাখাল।
এই করে করে আমি সব পার্টসেরই মিস্ত্রিপাড়া চিনি। কোথায় ভালাে টিউনিংয়ের লােক—তাও আমার জানা। কোথায় ডেট্রয়েট, কোথায় টয়ােটা, কার বা ভলভাে ক্লাচে কেমন স্লিপ মারে—তাও আমি জানি। সেই সময় শশী কানােড়িয়া কালাহাণ্ডির মহারাজার উললে কিনছে, রামপুরের নবাবের হাম্বার—সবাই ভিনটেজ। ওতে আমার স্বাদ ছিল না। টাকাও ছিল না।
ড্রাইভারের কথায় রবিবার সকালে বেরিয়ে পড়তাম। স্যার বীরেনের গ্যারাজে গিয়ে একদিন দেখি তিনখানা ঝকঝকে তেলখাের আলিসান মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে। আরেকদিন আলিপুরের পাইন রােডে বিশাল এক গাড়িশালায় গিয়ে দেখি ওপেল, মার্সিডিজ, লিনকন থরে থরে সাজানাে। ওপেলের বনেট তুলতেই তার ভেতর থেকে একটি বন্দি আমপাতা বেরিয়ে এল। গাড়িটা অনেকদিন ব্যবহার হয়নি। মাথার ওপর আমগাছের ছায়া। এদের গায়ে হাত বুলিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। সবাই সিক্স সিলিন্ডার, কেউ কেউ আবার আট সিলিন্ডার। মানে যাকে বলে সাদা হাতি। বর-বউ আনার গাড়ি। এদের জন্যে উড়ে বেড়াবার উপযুক্ত রাস্তাই নেই কলকাতায়। পরে জেনেছিলাম—বাড়িটা বিড়লাদের জামাই—কোঠারির। কোথায় গিয়েছি!
ড্রাইভারের কথামতাে গাড়িটা দেখতে গেলাম। গাড়িটাও আমায় দেখল। সাদা। ছসিলিন্ডারের ভক্সহল। আই.সি.আই না কীসের চেয়ারম্যান চড়ত। পরে তার আইবুড়াে মেয়ে চালাতে গিয়ে গাড়ি জখম করেছে। এয়ারকন্ডিশনারটা বেচলেও টাকা পাবেন অনেক। বক বক করে যাচ্ছিল ড্রাইভার। গাড়িটা আমার দিকে তাকিয়ে। গাড়ির কুলুজি গাইছে দেখে বুঝলাম—ড্রাইভারের কমিশন আছে। তা থাক। দেখছিলাম—গাড়িটার খুঁত থাকলে সারিয়ে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নিয়ে বেড়াতে বেরােলে ওদের ঠাকুমা আরামে বসতে পারবে কি না। পারবে। ড্রাইভারকে—চুপ করাে। দাম ঠিক করে মদন মিস্ত্রিকে দেখাও।
দাম এমন কিছু না। তিরিশ হর্স পাওয়ার। অ্যাম্বাসাডারের ডবলের কিছু বেশি। মদন তাে শশী সাহেবের একটা গাড়ি নিয়ে পড়ে আছে।
কী গাড়ি? নাম জানি না সাহেব। কে এক লর্ড ওয়াভেলের গাড়ি। ওরে বাবা! ওয়াভেলের গাড়ি? তাহলে অন্য মিস্ত্রি দ্যাখো। পিস্টনে একটু গােলমাল আছে সাহেব। এখনাে ছ-মাস কিছু না করলেও দিব্যি চলে যাবে।
ওভাবে তাে গাড়ি চড়া যায় না। কাল সকালে চালিয়ে নিয়ে আসবে। মদন ছাড়া কি মিস্ত্রি নেই দুনিয়ায় ?
শশী সাহেব তাে ওকে কিনে রেখেছে সাহেব।
শশী তাে গাড়ি চড়ে না। কালাহাণ্ডি, মাইসাের, পাকুড়, পাতিয়ালা, ত্রিবাঙ্কুর—বরােদার ভিনটেজ কার কিনে সারায়—রেসে চালায়—তারপর আমেরিকার মােটর গাড়ির মিউজিয়ামদের মােটা ডলারে দেয়। আমি কিনি। আমি চড়ি। চেখে দেখি। তারপর দরকার হলে মুখ বদলাই।
হ্যা সাহেব। সে তাে একশােবার। আপনি সাহেব দাঁড় করান। অন রােড করে তবে চড়েন। তারপর মর্জি হল তাে আরেক গাড়িতে চলে যান। আপনি তাে সাচ্চা জহুরি।
আমি তখন মােটা। খােসামােদ ভালােবাসি। গালে মশা বসে কামড়ালে টের পাই না। এত চর্বি।
মুখে বললাম, কাল সকালে গাড়িটা চালিয়ে আনবে। মনে মনে তখন ভাবছি—তিরিশটা ঘােড়া কতকাল গ্যারেজে পড়ে ঘুমােচ্ছে? একটা খোঁড়া ভক্সহলের ভেতর? ভক্সহল তুমি চাঙ্গা হও। তােমার জন্ম তাে মােটে উনিশশাে বাহাত্তরে !
পরদিন ভােরে গাড়ি চালিয়ে ড্রাইভার এল। গরজ বড়াে বালাই। সিক্স সিলিন্ডার জখম গাড়ির খদ্দের তাে আমার মতাে রসিক, পেটুক ছাড়া বিশেষ নেই। ড্রাইভার বলল, ঠিকঠাক টিউনিং হলে লিটারে সাড়ে-ছ কিলােমিটার ঠিক পাবেন।
এখানে পাঠক এবং জনসাধারণকে বলা দরকার—আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের লােকের পক্ষে গাড়ি কিন্তু একরকমের ঘােড়া রােগ। তার ওপর সিক্স সিলিন্ডার। এবং জখমি ইঞ্জিন। আর আমি না হতে পেরেছি ভালাে জুয়াচোর, কিংবা সাধু। আসলে আমি বিবেকের মাকু খটাখট করে মরছি শুধু। ভিতু—উপরন্তু ছাপােষা।
তবে পাড়ার ভেতর গাড়িটা যখন থেমে যাচ্ছিল—আমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম। একবার থামল লােকাল এম.পি-র বাড়ির সামনে। সে প্রধানমন্ত্রীকে দিদি ডাকে। আরেকবার থামল নিলামদার এক বাঙালির বাড়ির সামনে। লজ্জা পেলাম না। তিনি জমজমাট মামলাও ওজন বুঝে কিনে নেন। এদের সামনে। আমি ল্যাংটা হতেও লজ্জা পাই না। তাঁর বাড়ির সামনে এসে তিরিশ ঘােড়া একদম ঘুমিয়ে পড়ল।
ড্রাইভার বলল, দুটো ভাম্ভ ওভার-ফ্লো করছে—
যারা গাড়ি কিনে কোথাও যাবার জন্যে চড়ে বসে—তারা সেখানে পৌঁছেই নেমে যায়। গাড়ির কথা মনেও রাখে না। গাড়ি এমন কী জিনিস—যা কিনা—কিনে, ভেঙেচুরে সারিয়ে দাঁড় করাতে হবে! এ তাে ছেলে-মেয়ে নয় যে মানুষ করে দাঁড় করাতে হবে ?
আমি তাদের শুধু একটা কথাই বলতে চাই—মানুষের পা আছে একথা মানুষ ভুলে থাকে। এই পা প্রথম হাঁটতে শিখে মানুষকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। সেই পায়ের কথা না ভাঙা অব্দি আমরা একবারও মনে রাখি না। যারা ঝড়ের পাখিকে শুশ্রুষা করে কোনােদিন আকাশে ওড়ায়নি—তারা কোনােদিন পাখি দেখেনি—ওড়া জিনিসটা যে কী—তাও নিজের বুকের ভেতর টের পায়নি কোনােদিন। কথাগুলাে খুব সরল আর প্রাচীন—কিন্তু খুব সত্যি।
নিলামদারের বারান্দায় একটি তিরিশ-পঁয়ত্রিশের পেটানাে মানুষ বসেছিল। সে উঠে এসে ড্রাইভারকে বলল, বনেটটা খােলা।
তারপর ইঞ্জিনে ঝুঁকে পড়ে কী যেন খুটখাট করল। অমনি ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল।
আমি ইশারায় লােকটাকে উঠে এসে ড্রাইভারের পাশে বসতে বললাম। তােমার নাম কী ?
কানু ডাকবেন আমায়—
তুমি গাড়ি বােঝাে?
আমি তাে ইঞ্জিনের লােক।
গাড়িটার কী গােলমাল বলাে তাে?
দেখতে হবে।
ড্রাইভার আমার প্রিয় রাস্তা চেনে। গাড়ি গড়গড়িয়ে বড়দার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার বলল, মদনকে একবার আমি বললাম, কানু দেখবে। গলফ গ্রিনের সাজানাে রাস্তা দিয়ে বড়দা বাজার করে ফিরছে। কী রে? আবার একটা কিনলি নাকি?
হুঁ। বলে দেখলাম—বড়দা থেমে গেছে। এখন সত্তর। ড্রাইভার ছুটে এসে বাজার নিয়ে ওপরে দিয়ে আসতে গেল। ছেলের কিনে দেওয়া ফ্ল্যাটে বড়দা বড়ােবউদি থাকেন। ছেলে হায়দ্রাবাদে।
গাড়ি কেন? হাঁটবি। চান্স পেলেই হাঁটবি। আমি তাে ডালহৌসিতে নেমে আমড়াতলা রােড দিয়ে হেঁটে গদিতে যাই—
সেই মাড়ােয়ারির ওখানেই যাচ্ছ? তােমার তাে আর চাকরির দরকার নেই বড়দা। পেনশন পাও ভালাে।
চাকরিতে আমি ভালাে থাকি। লােকটা রাতে বে-আইনি বাড়ি বানায়। দিনে পুলিশ এসে ওর মিস্ত্রি মজুর অ্যারেস্ট করে। দুপুরে আমি লালবাজারে গিয়ে জামিনে ছাড়িয়ে আনি।
বাঃ!
ছাড়া পেয়েই ওরা আবার রাতে বাড়ি বানায়।
আবার ধরা পড়ে?
পড়ে। এই করেই তাে আমড়াতলায় এখন পােপটােল ম্যানশন আটতলা। উঠেছে। আরও তিনটে তলা তুলবে।
তাহলে তােমার ওখানে চাকরি এখনাে অনেকদিন আছে বড়দা।
এ-বাড়ি শেষ হলে আরেক জায়গায় হয়তাে আরেকটা বাড়ি করবে। আমি এখন দোতলায় আলাদা ঘরে বসি। যত পারবি হাঁটবি। তাের তাে এখন হাঁটার সময়। চল্লিশ হয়ে গেল তাে।
পঞ্চাশ হয়ে গেল! তাও তাে কয়েক বছর।
খেয়াল থাকে না। তখন খুব ছােটো। মেদনিপুরে সেটেলমেন্ট হচ্ছে। শহরে মেসে থাকি। গােদা পিয়াসালে ক্যাম্প। রােজ শেষরাতে চাঁদ থাকতে বাইকে চলে যেতাম। গােদা পিয়াসালে।
কত মাইল বড়দা ?
বত্রিশ মাইল। আবার সন্ধে সন্ধে বাইকে ফিরে আসতাম। নয়তাে ট্রেনে যাতায়াত করলে পাঁচসিকে—নগদ আড়াই টাকা গচ্চা দিতে হত। তখন আমাদের বেসিক তাে বেশি ছিল না। ডি.এ জিনিসটা তখনাে আসেনি। যুদ্ধের ভেতর পিয়ারডােবায় যখন মিলিটারি এয়ারড্রোম হবে বলে মাপতে গেলাম—তখনই তাে প্রথম ডি.এ চালু হল।
আড়াই টাকা বাঁচাতে রােজ চৌষট্টি মাইল বাইক করেছ?
হুঁ। সাইকেলে আর কতক্ষণ ! ভােররাতে আর সন্ধেরাতে চালাতাম। গরম লাগত না। তা মাসে এমন দশ-বারােদিন চালিয়েছি। শরীরও ভালাে থাকত। টি.এ-র পয়সাটা পেতাম।
আমার মাথা ঘুরছিল। বললাম, আজ আসি বড়দা। ওপরে যাবি না? ভালাে ট্যাংরা এনেছিলাম। জ্যান্ত—
আরেকদিন আসব। বড়ােবউদি কেমন আছে? ভালাে না। মােটেই হাঁটে না তাে। হাঁটবে কী? চোখে ক্যাটার্যাক্ট হয়েছে তাে বউদির। তা ঠিক। এখনাে পাকেনি। তাই—আবার আসিস
আমি গাড়িতে বসলাম। এবার ড্রাইভারকে সরিয়ে কানু গাড়ি চালাতে লাগল। ফাকা সুন্দর রাস্তা। জখম গাড়ি। কিন্তু ছুটল আশ্চর্য। ডালহৌসি থেকে বড়বাজারের আমড়াতলা তাে অনেকটা রাস্তা। সত্তর বছর বয়সে বড়দা গাড়ি-ঘােড়ার ভেতর দিয়ে রােজ এতটা যাতায়াত করে! পায়ে হেঁটে! তার ওপর লালবাজারেও নিশ্চয় হেঁটে যায়। অসম্ভব হ্যাজার্ডাস! বিশেষ করে এই বয়সে। অথচ কোনাে দরকার নেই।
এর পরদিন থেকেই আমি আর কানু গাড়িটা নিয়ে পড়লাম। পাড়ার হরিদা একসময় রইস আদমি ছিলেন। পেট্রল যখন জলের দরবাজার যখন রূপকথা—তিনি ঢাউস গাড়ি হাঁকাতেন। বললেন, এটা তােমার ‘দি সেকেন্ড কার!’
না-না। সেরকম কিছু না। এমনি দেখছি—গাড়িটা দাঁড় করানাে যায় কি না বনেট খুললে অবাক লাগে। এর ভেতর তিরিশটা ঘােড়ার দাপানি চোখ বুজে পড়ে আছে! একুশ প্লেটের ব্যাটারি। কানু টকাটক প্লাগগুলাে খুলে ফেলল। খুলে বলল, সারাবার পর নাইলন টায়ার পরিয়ে যখন অ্যাকসেলারেটরে চাপ দেব—দেখবেন কী ছুটবে।
কানুকে দেখে বয়স বুঝি না। আটাশ হতে পারে। সাতচল্লিশও হতে পারে। পেটানাে ছিমছাম চেহারা। রােদেপােড়া রং। ঝকঝকে দাঁতের হাসি। মাথায় কালাে চুল—ভালাে করে ছাঁটা। হাসলে ওর পাথরকুচি চোখ আর দেখতে পাই না। ভেতরে ভেতরে আমার তখন আর তর সয় না। কবে আমি এই গাড়িটার ভেতরে বসব যখন ও ছুটন্ত অবস্থায় এই পৃথিবীর বাতাস কেটে এগােবে। তিরিশটা ঘােড়ার গ্যালপ তখন একই তালে।
কানুর সঙ্গে গেলাম হাওড়া মােটরস-এ। ঠিক ওই সাইজের পিস্টন পাওয়া যায় না। ম্যাঙ্গো লেন, সুতারকিন—সব চষে ফেললাম। কলকাতা তখন ভাদ্রের গরমে আর খামখেয়ালি বর্ষায় ভ্যাপসা—প্যাচপেচে। আমরা দুজন পার্টস খুঁজি, কারবােরেটর পাল্টাই—দরজার ভেতরকার ভেলভেট ঠিক করি—বডি মিস্ত্রিকে চাতাল দেখাই। কত গেজের চাদর দিতে হবে তাও ঠিক করি।
এই ভাবেই কানুর সঙ্গে মল্লিকবাজারে যাই। উল্টোদিকের দেওয়ালের ভেতর মাইকেলের কবর। হেনরিয়েটার কবর। কানুর সঙ্গে বাজারের ভেতরে ঢুকলাম। এক জায়গায় শুধু রিং পট্টি। আরেক জায়গায় পিস্টন পাড়া। সরু গলি। তার গায়েই রােগা রােগা দোতলা-তেতলা বাড়ি। কোথাও বা শুধু রকমারি হর্ন। এক জায়গায় স্রেফ হেডলাইট—একদম এখনকার—আবার ১৯২৯-এর ডাব মার্কা সেই ভােমা আলাে।
এই ভাবেই আমরা ইঞ্জিন পাড়ায় গিয়ে পড়ি। এখানটায় গলি কিছু চওড়া। এরকম গলি—আর তার গায়ে বিস্কুটের বাক্স মার্কা সব বাড়ি কলকাতার রামবাগান, ঢাকার কান্দুপট্টি আর বেনারসের ডালমণ্ডিকেই মনে পড়িয়ে দেবে। সেসব গলিতে মেয়েমানুষের বডি পার্টস। এখানে মােটর গাড়ির বডি পার্টস। সেখানে পান, মদ, গানের কলি। এখানে পান দেখতে পাচ্ছি। মদ নিশ্চয়ই আছে। গানও পেয়ে গেলাম।
ইঞ্জিন পাড়ার গলির গায়ে এক বড়াে ব্যবসায়ীর গদি। সাত্ত্বিক চেহারার ইঞ্জিনওয়ালা চোংদার পুরােনাে কলের গানে কালাে রেকর্ড বাজাচ্ছিল। মধ্যবয়সি কাঁচাপাকা গোঁফ। পাশে বছর বারাের একটা স্বাস্থ্যবান উদোম ল্যাংটো ছেলে বসে রেকর্ড বাজাচ্ছে। বুঝলাম—পুরােনাে গাড়ির পার্টসের মতােই লট ধরে পুরােনাে রেকর্ডও কেনা হয়েছে। কিংবা বাপ দাদার ব্যবসার মতাে ইঞ্জিনের সঙ্গে এই রেকর্ডগুলােও পেয়ে গেছে। গান হচ্ছিল মল্লিকবাজার কাঁপিয়ে মন বলে তুমি আছাে ভগােবান—আমি বলি তুমি নাই-ই-ই মাডগার্ড, ড্যাশবাের্ড, হেডলাইট, রেডিয়েটর, রিং, পিস্টন, অ্যাকসেল, গিয়ার বক্স, স্টিয়ারিং মহল্লার মতােই ইঞ্জিন পাড়াও পরিষ্কার সীমানা টেনে আলাদা করা। এদের জিনিসটা বড়াে—গস্তে টাকাও লাগে অনেক বেশি—নানান ঘােড়া আর সাইজের ইঞ্জিন সাফসুতরাে করে রাখতে জায়গাও লাগে অনেক বেশি। এমনি মেলে রাখা যায় না আকাশের নীচে। মার্ডগার্ড কিংবা অ্যাকসেল রডের মতাে। তাই শেড চাই। ইঞ্জিন ব্যাপারীরা তাই এদের ভেতর যেমন রইস—তেমনি ইজ্জতদার। কাজ-কারবার ধীরে-সুস্থে। হাট্টাকাট্টা চেহারা শরীর-মােচড়ানাে গোঁফ, মাজা লােটাতে ভাঙের ভারি শরবত। তার সঙ্গে এই গান। ভগবান আছে? কি নেই?
শেডের নীচে ঢুকে দেখি—অন্তত শ-দেড়েক ইঞ্জিন ঘুমিয়ে আছে। তেল মবিল দিয়ে ভালাে করে মােছা। সেই কোন সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে কানুর সঙ্গে ঘুরছি। আমরা এখন ভক্সহলকে শাে-রুম পিস করে দাঁড় করিয়ে ফেলার মাঝামাঝি জায়গায়। সিট, গদি, ফোম, রুফ—সব অর্ডার দেওয়া সারা। বডি মিস্ত্রি চাতাল রাংঝাল করে এখন ডিকির দিকে কাজ করছে। তবে সবই এখনাে ছত্রখান। অগােছালাে।
তিন চারদিন হল কানু একটা নতুন থিওরি খাড়া করেছে। ও বলছে—রিং চেঞ্জ না করে একদম যখন বের করে ইঞ্জিন নতুন করাচ্ছেন—তাহলে গাড়ির বডিতে খাপ খেয়ে যায়—এমন রেডি ইঞ্জিন বসাতে দোষ কী? বাের করার ঝামেলায় যেতে হবে না। সময়ও বাঁচবে। পয়সাও কম লাগবে। চাই কি আরও দু-চার ঘােড়া বেশি পাওয়ারের ইঞ্জিনও তাে সাইজমতাে পেয়ে যেতে পারি। তাহলে গাড়িও ছুটবে আরও তুখােড়—
আরও বেশি ঘােড়ার ইঞ্জিন এ-বড়ি সামলাতে পারবে কানু ?
সাইজে যদি মেলে—ভাইব্রেশন যদি সামলে যায় বডিটায়ারের রােড গ্রিপ যদি থাকে তাহলে তাে কোনাে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আমি শুনছি আর উৎসাহে ফুটছি। আরও ঘােড়া। আরও ঘােড়া। তিরিশের জায়গায় হয়তাে ছত্রিশ ঘােড়া। পন্থনগর থেকে গাজিয়াবাদ চলেছি। ভােরবেলা। ভক্সহল দাঁড় করালাম। হাপুর যাবার রাস্তার গায়ে বনের সীমানা ! সেখানে গাছতলায় ময়ূর পেখম মেলে ধরে নির্জনে এই মাত্র একটা সাপ ধরল। এক্ষুনি কঠিন ঠোটে কুচি কুচি করে ফেলছে। খাবে। আমি বললাম, কানু চালাও। গাজিয়াবাদে খানিকক্ষণ কাটিয়ে দিল্লি যাব।
সে চিন্তা করবেন না। সামনেই ফয়জাবাদ। তারপর রাস্তা ভালাে। আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাব। এ হল গিয়ে ছত্রিশ ঘােড়ার ভক্সহল। দুনিয়ায় এই একখানাই এমন ভক্সহল আছে।
শেডের ভেতর বেলা ফুরােবার আলাে। আমার পায়ে পাম্পসু। গায়ে বউমার কিনে দেওয়া ফিকে গােলাপি টেরিভয়েলের পাঞ্জাবি সামান্য ঘামে ভিজে উঠছিল। একবার মনে হল—এইসব কি আমারই মতাে মােটা লােকদের স্বপ্ন ? না, সত্যি সত্যিই আরও অনেকগুলাে বেশি ঘােড়ার সই সই সাইজের ইঞ্জিন এখানে পেয়ে যাব ? যাতে কিনা বাের করার ঝামেলায় যেতে হবে
—আবার বডির সঙ্গেও জুতসই হবে।
ক্রাইসলার, স্টুডিবেকার, মিনার্ভা, বি.এম.ডবলু—কত যে নিহত গাড়ির ঘুমন্ত কলজে এখানে নিথর হয়ে পড়ে আছে। উপযুক্ত জ্বালানি, সঠিক সারথি পেলেই এসব কলজের বাম অলিন্দ, দক্ষিণ অলিন্দ দিয়ে ঘােড়াগুলাে দাপাতে দাপাতে বেরিয়ে আসবে।
গদিতে বসে দাম-দস্তুরি করে সেটেল হল। পান খেতে দিল ব্যাপারী। বললাম, বাংলা গান শুনছ? বােঝ?
বাঃ! হামরা চার পুরুষ এ গদিতে। কলকাত্তায় জনম করম সব। দাদি শাদিতে এ গান-বাজনার মেশিন পেয়েছিল।
গান শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রেকর্ডখানা হাতে নিলাম। লেখা পড়া যায় না। সবই প্রায় মুছে গেছে—মন বলে তুমি আছাে ভগােবান আমি বলি তুমি নাই তাল—দাদরা। রাগ-ভৈরবী। এখন প্রায় সন্ধে। নােট গুনে দিয়ে টেম্পােয় ইঞ্জিন তুলে গাড়িতে বসলাম। ড্রাইভার গজগজ করছিল। কানু তাকে এক দাবড়ি দিয়ে বসাল। নিজে স্টিয়ারিংয়ে।
আমরা তিনজন যেন উড়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এ মিনিবাস কাটিয়ে—সে সিগনাল বেমালুম না দেখে, সে বাসকে পেছনে ফেলে কানু গাড়ি চালিয়ে চলে এল।
নামার সময় জানতে চাইলাম, তােমার লাইসেন্স আছে কানু ?
আমার ড্রাইভার চুপ। আমি চুপ। আমার স্ত্রী আমাদের চা দিয়ে বলল, খরচা কিন্তু দশ হাজার ছাড়িয়ে গেল।
আমি হেসে বললাম, তার সঙ্গে আজকের ইঞ্জিনের তিন হাজার জুড়তে
হবে।
ড্রাইভার বলল, আউর দু-হাজার ধরে রাখুন মাইজি!
কানু এক চুমুকে চা শেষ করে ঠক করে কাপটা রাখল। গাড়ির মতাে গাড়ি চড়তে হলে টাকার দিকে তাকালে চলে?
আমার কোথায় লাগল। হেসে বললাম, বটেই তো ও পিয়ানােটা কার ? আমার মেয়ে বাজাত। কানু সিধে ঘরে ঢুকে গেল। পেছন পেছন আমি। গ্র্যান্ড পিয়ানাে দেখছি। ভাড়ায় আনা। ফোন করে দিয়েছি। চিঠি দিয়েছি। এখনাে নিয়ে যায়নি। দিদি আর বাজান না? আমার স্ত্রী বলল, মেয়ে তো বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি।
আপনি বাজাতে পারেন বউদি—বলতে বলতে কানু সামনের টুলে বসল—ডালাও তুলে দিল পিয়ানাের।
আমার বউয়ের তাে কপালে চোখ উঠে গেছে। আমার আরও কিছু বেশি। বিশেষ করে খানিক আগে যেমন র্যাশ ড্রাইভ করে আমাদের বাড়ি নিয়ে
এসেছে। হাজার হােক মিস্ত্রি। শেষে পরের পিয়ানােটা না ভাঙে।
মুহূর্তে ঘর ভরে গেল কানুর বাজনায়। ওর হাতের আঙুলগুলাে জলে মাছ হয়ে খেলছে। রীতিমতাে সুরেলা। অনেকে পিয়ানােকে অরগান করে বাজিয়ে বসে। কানুর তা নয়। আমার মেয়ে বাজাত বলেই জানি। কানুর ডান হাতকে বাঁ হাত অ্যাকমপ্যানি করছে।
অনেকদিন অভ্যেস নেই।
মনে মনে ভাবি—মােটরের মিস্ত্রিগিরি করার পরও অনেকদিনের অনভ্যাসেই এই? আমাদের অবাক হওয়ার ছিল। অবাক হলাম। আমার ড্রাইভার গাড়ি তুলে চাবি দিতে এসে এই কাণ্ড দেখে তাে থ। সে দরজায় হাত রেখে অনুতপ্ত গলায় এই প্রথম খুব সম্মান দিয়ে বলল, কাহুদা—একটা গানা বাজান।
কানু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদরা শুনুন।
আমি চেয়ারে বসে পড়ে বললাম, কানু—আমি দাদরা কাহারবা ফারাক বুঝি না। শুনতে ভালােবাসি। আমার বউকে চেয়ার দেখিয়ে বললাম, বােসাে বউ বসল। কানু বলল, আজ মল্লিকবাজারে যে গানটা শুনছিলেন— লাইন মনে থাকে না আমার কানু। খুব সােজা গান। সেই যে—মন বলে তুমি আছাে ভগগাবান—আমি বলি তুমি নাই-ই— বলেই ঠিক তুলে ফেলল পিয়ানােয়। হঠাৎ থামিয়ে বলল, এই থ্রি-ফোর্থ মাত্রাতেই বরং বউদিদের জানা-চেনা একটা গান তুলছি—
এবার স্পষ্ট শুনলাম—পিয়ানাে গাইছে—আমি চিনি গাে চিনি তােমারে, ওগাে বিদেশিনী।
এ ঘটনার পর কিনে আনা ইঞ্জিন বসল। কানু প্রায়ই পিয়ানাে বাজায়। কোন এক মেম নাকি তাকে শিখিয়েছিল। ঠিক পরিষ্কার বুঝি না। তবে আমি, আমার বউ আর ড্রাইভার এই বাজনা শােনার পর থেকে কানুর দিকে এমন করে তাকাই—যেন ও কোনাে শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব। নেহাত কর্মদোষে মােটরমিস্ত্রি।
একেবারে শেষে আটদিন ধরে গাড়িটা সাদা রঙ হল। গাড়ির নাক, দরজার হ্যান্ডেল, গায়ের পটি সব ঘষেমেজে ঝকঝকে নতুন হয়ে এল।
তারপর স্টার্ট দিল ড্রাইভার।
গাড়ি তিরিশ হাত গিয়ে থেমে যায়। ঠেলতে হয়। কানু বলে, ইঞ্জিনকে জল খাওয়াতে হবে।
ড্রাইভার বলে, তা কেন কাহুদা? আপনি তাে ইঞ্জিন বের করেন নাই।
কানু ধমক দিয়ে কী যেন বলে। আমি বুঝি না। তখন কেনা আর সারাই। নিয়ে বত্রিশ হাজার বেরিয়ে গেছে। আমার ভেতরকার সেই অনাদিকালের হাটুরে লােকটা তখন উঁকি দিচ্ছে। আমার বড়ােভাই ডালহৌসি থেকে বড়ােবাজারের আমড়াতলায় হেঁটে যাতায়াত করে। সেখান থেকে আবার লালবাজারে যায় হেঁটে। এক সময় আড়াইটে টাকা বাঁচাতে দিনে এ-বেলা
ও-বেলা মােট চৌষট্টি মাইল বাইক করত। বাবার কথা না হয় থাকলই। ওহাে! এক-নয়—দুই নয়, বত্রিশ হাজার টাকা স্রেফ জলে ?
আমার ছেলে বলল, কানুটা একটা আস্ত চিট।
আমি বললাম, কানু, কী হবে? এখন তাে ঠেলাঠেলি করেই বিকেল হয়ে গেল।
কিছু ভাববেন না। কাল সকালে এসেই সব ঠিক করে গাড়িতে আপনাদের চড়িয়ে ঘুরিয়ে আনব। এখন একটু উকিলের কাছে যাব। কটা বাজে দেখুন
স’-পাঁচটা— ওরে বাব্বা! আমি চলি—বলেই কানু হনহন করে চলে গেল।
আমার বউ, আমি, আমার বউমা, নাতি, ড্রাইভার সবাই থ হয়ে তাকিয়ে আছি। কানাই মােড়ের মাথায় মিলিয়ে গেল। বাড়ির সামনে অচল সাদা হাতি। ওকে এখন ঠেলে গ্যারেজে তুলতে হবে।
আমার মনে হল, এত জায়গা থাকতে হঠাৎ উকিল বাড়ি কেন? ও কি কোনাে শাপভ্রষ্ট ব্যারিস্টার? ও যে আসলে কে এবং কী—তার বিন্দুবিসর্গও আমরা জানি না।
রাতে মদন এল। ড্রাইভার ডেকে আনল। সব শুনে-দেখে পান খাওয়া ঠোটে একগাল হেসে বলল, আমরা কি নেই? এ গাড়িতে আপনাকে আমরা চড়াবই।
বুঝলাম আরও কয়েক হাজার যাবে। এ লাইনে অস্থির হতে নেই। তাই রেওয়াজ। একবার দাঁড় করিয়ে নিয়ে ক-দিন চড়ে খদ্দের পেলে ফ্যানসি প্রাইসে ঝেড়ে দেওয়া যাবে। তাতে টাকাও উঠে আসবে। চাই কি বেশিও পাওয়া যেতে পারে। গাড়িটার তাে একটা শাে আছে। ছিরি ছাঁদে কেউ না কেউ মজবেই।।
কিন্তু কানুকে তাে মজুরিই দিয়ে বসে আছি হাজার চারেক—খেপে খেপে। পরদিন কানু এসেই বলল, দেড়শাে টাকা দিন। একজনকে দিতে হবে। আগে গাড়ি চালু করাে। তারপর সব হবে। আজ পারব না। কাল সব ঠিক করে দেব। দেড়শােটা টাকা দিন তাড়াতাড়ি। দিলাম আমার ভারি হাতের বিরাশি সিক্কার এক চড়।
কানু ঘুরে পড়তে পড়তে সিধে হয়ে দাঁড়াল। ঠান্ডা গলা। আমায় মারবেন—
আচমকা। আমি পালটা মারতে গিয়ে খুন করে ফেলি। টাকাটা দিন। উকিলবাবুকে দিতেই হবে আজ। আমি খুনের মামলার আসামী। জামিনে খালাস আছি।
আমি আরেকটা চড় দিতে যাচ্ছিলাম। হাত উঠল না। এসব কথা সত্যি কানু ?
আপনি আমার সঙ্গে উকিলবাড়ি চলুন। সতীশ উকিলের মুখে সব শুনবেন, সত্যি না মিথ্যে বলছি।
তাহলে তুমি খুন করেছ?
তা আজ্ঞে। অবস্থা বিপাকে করতে তাে হয়ই। সতীশবাবুকে সব বলেছি। তিনি সব জানেন।
তার মানে—আগেও খুন করেছ? তা কয়েকটা তাে হয়ে গেছে। টাকাটা দিন। কাল ঠিক আসবে তাে? নিশ্চয়। সকালেই চলে আসব।।
আমার গাড়ির কী হবে? এমন ঠিক করে দেব—ও ঠিক পক্ষীরাজের স্টাইলে ছুটবে।। যদি ঠিক করতে না পার? আমার তাে গুচ্ছের টাকা জলে গেল। ঠিক আমি করতে পারবই। জলে যাবে না।
মদনের কথা আর বললাম না। কানুকে টাকাটা দিলাম। আমার ছেলে বলল, কানু আর এদিকে আসবে না। শেষ চোট দিল ওই দেড়শাে টাকা পরদিন সকালে কানু এল না। এল দুপুরে। ওদিকে মদন তখন কাজে নেমে গাড়ি খুলে ফেলেছে।
কানুকে বসালাম। আসলে তুমি কে কানু ? একগাল হেসে বলল, আমি কানু।। পিয়ানাে শিখলে কোথায় ?
এক মেমসাহেব হাতে ধরে শেখালেন। আমি সাহেবের লঞ্চের মিস্ত্রি ছিলাম। আবার চা-ও করে দিতাম সাহেব-মেমকে। পরে বাজনা শিখে মেমকেও বাজিয়ে শােনাতাম পিয়ানাে।
তাহলে তুমি লঞ্চের মিস্ত্রি ?
সাহেবের কাছে থেকে শিখেছিলাম। আশি ঘােড়ার ইঞ্জিন। এই এত মােটা পিস্টন। মার্টিন আইল্যান্ড থেকে সাহেবকে নিয়ে আমি, সারেং আর টিন্ডেল ভাের ভাের বেরিয়ে পড়তাম সমুদ্রে। মাছ ধরা হত। সাহেব জলের স্যাম্পেল নিয়ে বলতেন—নেট বিছাও। অমনি আমরা গড় গড় করে গােটানাে জাল কালাে সমুদ্রে ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যেতাম।
মার্টিন আইল্যান্ডটা কোথায়? ভােলা-সন্দীপের নাম তাে শুনেছেন। হুঁ। সে তাে বাংলাদেশে। সেখানে লােক গিজগিজ করছে। মার্টিন আরও গহীন সমুদ্রে। সেখানে সরকার তেল খোঁজে। ডাকাতরা মাল নামায়, ওঠায়, ভাগ করে। সাহেব সরকারি পারমিশন নিয়ে ওখানে থাকতেন।
থাকতেন মানে? তিনি তাে আর নেই। বড়াে ভালােবাসতেন আমায়। তিনিই তাে আমার পয়লা খুন। ঠিক আপনার মতাে রেগে আমায় মারতে আসেন। আমারও কম বয়স ছিল। নিজেকে সামলাতে পারিনি।
এসব কথা শুনছি। বাড়ির আধ মাইলের ভেতর থানা। আমার বউ, বউমা ঘুমােচ্ছে। নাতি স্কুলে। তার বাবা অফিসে। কানুর চোখে জল।
তাহলে তুমি লঞ্চেরই মিস্ত্রি। আজ্ঞে হ্যা। সাহেব নিজের হাতে কাজ শেখান আমায়। আগে কখনাে মােটর গাড়ি সারাওনি তাহলে
সারাইনি। তাহলে আমার গাড়িতে হাত দিলে কেন? সিস্টেম তাে একই। সেই পিস্টন। রিং। বাের। দেখবেন ঠিক করে দেব গাড়ি। লঞ্চ জল কেটে এগােয়। আর এ রাস্তা গিলতে গিলতে ছােটে। এই তাে সামান্য ফারাক। গাড়ি আপনার ঠিক হয়ে যাবে।
দুপুরের ভাতঘুমের পর আমার বউ পেছনে এসে মােড়ায় বসেছে। কানুকে বললাম, রেগে একদম খুন করে ফেল?
আজ্ঞে, সেই ম্যাকফারলান সাহেবকে খুন করেই আমার হাতেখড়ি। তারপর তাে আর থামতে পারছি না। এখন ইন্ডিয়ায় এসে আরাে বেড়ে গেল। আমরা আর অবাক হচ্ছিলাম না। কানু যেন পিয়ানাের দাদরা তুলছে। বউমা সবাইকে চা দিয়ে নিজেও একটু দূরে বসল।
আমরা তখন ঢাকার সদরঘাটে। কানুর বয়স বেশি নয়। ওর জবানিই যতটা পারছি—রাখছি।
কানু শঙ্কর বাের্ডিংয়ের মালিকের টয়ােটা চালায়। বাংলাদেশ তখনাে পূর্ব পাকিস্তান। সদরঘাটের ওপারেই জিঞ্জিরা। যেখানে নাকি দুনিয়ার সবকিছু জাল হয়। কানুর ভাষায়—যেমন আপনাদের লুধিয়ানা আর কী।
সেই সময় কানু দিনে গাড়ি চালায় শঙ্কর বাের্ডিংয়ের মালিকের। সন্ধে সন্ধে সদরঘাটের ওপারে জিঞ্জিরায় গিয়ে নানান জিনিস জাল করার আড্ডায় জড়িয়ে যায়। যেমন—ব্লেড, ধানকল—এইসব আর কী। কানু আর খুনি নয়। শাপভ্রষ্ট গন্ধবও নয়। ব্যারিস্টার বা মােটরমিস্ত্রিও নয়। স্রেফ কথক। কানহুচরিতমানস নামে খােলা স্লেটের তুলসীদাস।
একদিন সদরঘাটে ফেরার জন্যে একটা মাঝারি লঞ্চে উঠে বসল। মাঝরাতে। সব লঞ্চই তাে সদরঘাটে ফেরে জিঞ্জিরা থেকে। সকালে নিশ্চয় ফিরে যাবে। ঘুম ভাঙল বেশি বেলায়। উঠে বসল কানু। সামনে দেখে টোকা মাথায় এক লালমুখাে সাহেব ফোসকাপড়া গায়ের চামড়া নিয়ে খালি গায়ে ওর সামনে কেদারায় বসে। কানুর ভাষায়—সাহেবদের গায়ের চামড়াই অমন। গরমকালে সারা গায়ে ঘামাচি পেকে উঠত। মেমের চুলের কাঁটা দিয়ে সাহেব লঞ্চের পাটাতনে বসে সেগুলাে গালত। আমিও গেলে দিইছি। আমার বাবার মতাে ছিলেন।
তােমার বাবা কোথায় ? জানি না। মা কোথায়?
জানি না। আমি নাকি যুদ্ধের ভেতর সদরঘাটের কাছাকাছি জন্মাই। শােনা কথা। তা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় উঠে বসে দেখি—চাদ্দিকে কালাে জল। কোথায় সদরঘাট। আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
সাহেবের কথাগুলাে এখনাে মনে আছে আমার। ডােন্ট জাম্প। দিস ইজ ডিপ সি। ইউ হ্যাভ সেভেন আওয়ার্স সেইলিং অলরেডি।
ঘুরে ঘুরে লঞ্চটা দেখলাম। এ তাে অর্ডিনারি প্যাসেঞ্জার লঞ্চ নয়। আর কী তেজি ইঞ্জিন। কত যন্ত্রপাতি। মাছ ধরার জাল। বিশাল সার্চলাইট। মার্টিন দ্বীপে পৌছলাম পরদিন সকালে। ঘাটে দাঁড়িয়ে সাহেবের মেম। আমাদের মাসিমাদের মতােই। অবিশ্যি আমার কোনাে মা-মাসি নেই। থাকলেও কোথায় আছে জানি না।
আমার মনে হল— কথক কাহুর এই জায়গাটাই বােধহয়—আমার বউ, বউমার জন্যে—দাদরার কাজে ভর্তি।
মেম তাে আমায় দেখে হেসে-কেঁদে অস্থির। সাহেবকে খাস বাংলায় বলল, এই হর্স কোঠায় কুড়িয়ে পেলে?
সাহেবও পরিষ্কার বলল, অ্যাট ডেড নাইট! ইন দি ডিপ সি! আগে দেখি নাই। লঞ্চ যখন সাগরে পড়িল তখন দেখি এই ছেলেটা ঘুমাইতেছে। ডিপলি স্লিপিং।
লঞ্চের সারেং, শুখানি ওদের কাছে পরে শুনেছি—মেম আগে চাটগাঁয়ে এক খাঁ সাহেবের বেগম ছিলেন। সেখানেই ঘরগেরস্থালি করতেন। খাঁ সাহেব মারা যেতে ম্যাকফারলান তাকে চার্চে গিয়ে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাই সাহেবের বাংলা তত সড়গড় ছিল না।
মেমের কোনাে ছানাপােনা ছিল না। দশ-বারাে বছর ছেলের মতােই ছিলাম। অনেক ইংরাজি শিখেছিলাম। কিন্তু কর্নফ্লেকস আর রিফ্লেকস-এ গুলিয়ে ফেলতাম। মার্টিন দ্বীপে শেষ তিনটে বছর মেমকে আমিই দেখাশােনা করেছি। ওনাকেও কবর দিলাম—আমিও মার্টিন দ্বীপ ছাড়লাম। পিয়ানাের হাতটা বড়াে ভালাে ছিল মেমসাহেবের। সাহেব ওঁকে ডাকত—মার্থা ।
কী হয়েছিল? সাহেবের সঙ্গে মাছ ধরতে বেরােতাম। নাইলন নেট। আমরা সমুদ্রের ভেতর সাত-আট মাইল চলে যেতাম। সাহেব জল বুঝে, গন্ধ শুকে বলে দিতেন—নেট বিছাও। নানারকম মাছ পড়ত। মহাশােল, ইলিশ, হালুয়া, পায়রাচঁাদা—কত কী। ব্যাপারীরা টাকা আর পেট্রলের বড়াে বড়াে পিপে দিয়ে বদলিতে মাছ নিয়ে যেত—চার-পাঁচ দিন অন্তর। ওরা বড়াে বড়াে বরফের চাইও দিয়ে যেত। কোনাে কোনাে সময় এক বস্তা মুড়ি। সাহেব মেম দুজনেই মুড়ি খেত।
একবার বরফের চাই নিয়ে আমরা সমুদ্রে ঢুকে পড়েছি। মাছের সঙ্গে কচ্ছপও ধরা পড়ল কিছু। ম্যাকফারলান বাবা—আমি ওঁকে বাবা—আর মার্থা মেমকে বাংলায় মা বলে ডাকতাম—তা ম্যাকফারলান বাবা বলল—কাহু কখনাে ক্যানু বলেও ডাকত আমায়—মেম মা তাে ক্যানি—কেনি—এইসব আদরের ডাক ডাকত—মন ভালাে থাকলে।
কান্থ। টরটয়েজের কান্না আমি দেখিটে পারি না। ছাড়িয়া দাও। রিলিজ দেম। সব কথা এখনাে আমি ভুলতে পারিনি। তখন আমি তাগড়া জোয়ান। ইঞ্জিন খারাপ হলে সব খুলে ফেলে সাহেবের কাছ থেকে সারাতে শিখেছি। গােলমরিচ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ দিয়ে তেলওয়ালা কচ্ছপ রাঁধি, খাই। খুব ভালাে লাগে। বাকি সেদ্ধ করে মেম মাকে ডিনারে দিই। খেলে ওর বাতের ব্যথা কমে।
আমি বললাম, মােটে তাে তিনটে কচ্ছপ। আমার আর মায়ের জন্য নিচ্ছি।
উহারা বড়ই কঁাদে। ধরা পড়িলে ভীষণ কঁদিতে থাকে—আমি দেখিতে পারি না।
কানু আমাদের দিকে সােজা তাকিয়ে বলল, সত্যিই তাই। ধরা পড়ে বাকেটের ভেতর শুয়ে ওরা গলা বের করে কাঁদে। চোখ দিয়ে জল পড়ে। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার ভয়ঙ্কর শব্দের সঙ্গে ওদের কান্নাও মিশে যায়। আমি শুনতে পেতাম।
সাহেব বাবার কথা শুনলাম না। এটা দুপুরবেলার কথা। বিকেলের দিকে ফিরছি। আর মাইল দুয়েক। আইল্যান্ডে সাহেবের কাঠের বাংলােয় এবার। জেনারেটরের আলাে জ্বলে উঠবে। বাংলাে মুছে যাবে সন্ধের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু আলাে দেখা যাবে।
ইঞ্জিন বিগড়াল। ঢেউ ভেঙে এগােনাে যায় না। রাত কাবার হয়ে গেল। সকালে দেখি মাছ পচতে শুরু করেছে। চড়া রােদ। এক পশলা বৃষ্টি চলে গেল আমাদের ওপর দিয়ে। কচ্ছপ ক-টা তখনাে কঁদছে। চোখের জল, না বৃষ্টির জল? বুঝতে পারছি না। সেদিন সারাদিনেও ইঞ্জিন ঠিক হল না। আমরা তখন তীর থেকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে অনেক দূরে চলে গেছি। কোথায় মার্টিন আইল্যান্ড! কিছু দেখা যায় না। দুলে দুলে ভেসে চলেছি শুধু। আর বড়াে বড়াে ঢেউয়ের থাপ্পড়। জল গায়ে পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। থাকছে নুন। গা ডললেই নুন।
সেই অবস্থাতেই তিনদিনের দিন শুখানিকে নিয়ে সাহেব বাবা ইঞ্জিন ঠিক করল। ঘাটে ফিরে আসতে আসতে বেলা তিনটে। মার্থা মা কাঠের তক্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এর ভেতর মাছের পচা গন্ধে তিষ্ঠোতে না পেরে সব মাছ। জলে ফেলে দিতে হয়েছে।
আমি দুটো কচ্ছপ দু’হাতে ঝুলিয়ে লঞ্চ থেকে নামছি। ম্যাকফারলান আমায় একটি চড় কষাল। রাসকাল! বাট ফর ইউ ওনলি—
মার্থা মা দাঁড়িয়ে। শুখানি জাল গােটাচ্ছে। আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে কচ্ছপের শক্ত পিঠ দিয়ে মারলাম সাহেবের মাথায়। তা আধ মণ ওজন হবে কচ্ছপটার—সেই আমার পয়লা খুন। সাহেব পাটাতনে গড়িয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে নাক দিয়ে একটু রক্ত। সারেং, শুখানি—সব ছুটে এল। মার্থা মা বাবার বুকের ওপর।
আমি কচ্ছপ দুটো জলে ছুড়ে বাবার বুকে কান পাতলাম। কোনাে শব্দ নেই। সব শেষ।
সন্ধেবেলা বাংলাের কাঠের বারান্দায় ম্যাকফারলানের বডি এনে শুইয়ে দিলাম।
সমুদ্র সেদিন সন্ধে থেকেই খুব অস্থির হয়ে উঠল। মেমসাহেব মােমবাতি জ্বেলে দিয়েছিল। তা বার বার নিভে যাচ্ছিল! আমি বার বার ধরিয়ে দিচ্ছিলাম। বড়াে হয়ে যাও একটা বাবা পেলাম তাও নিজের দোষে হারালাম। ভােরে দেখি সমুদ্র একদম ঠান্ডা।
সকালের দিকে শুখানি, সারেং মাঠে যাবার নাম করে সেই যে কাটল–বােধহয় কোনাে ব্যাপারী লঞ্চ পেয়ে যায়। আর ফেরেনি তারা।
মেমসাহেব পিয়ানাে খুলে কী যেন বাজাচ্ছিল। আমি কোদাল দিয়ে বড়াে করে গর্ত খুঁড়ছি। ঘাটে শান্ত, ফাকা লঞ্চ সামান্য দুলছে।
হঠাৎ খেয়াল হল—পুলিশ তাে আসবে। আমি খোঁড়া বন্ধ করে দিলাম।
মার্থা মা বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলল, বন্ধ করিস না কাহু। বড়াে করে কবর কর।
পুলিশ আসুক। আমি ধরা দেব। কোথাও পালাবাে না।
সে তাের ভাবতে হবে না কাহু। আমি সব বলিব। তুই তাে মাথায় মারিস নাই। আমি সাক্ষী দেব। নে—বড়াে করে কবর বানা—
ম্যাকফারলান লম্বা-চওড়া ছিল। বেলা তিনটে নাগাদ ধরাধরি করে সাহেব বাবাকে উঠোনের ভেতরেই কবর দিলাম।
পুলিশ এল না?
কোনােদিন আসেনি। হয়তাে শুখানি আর সারেং ভেবেছিল—খবর দিয়ে কী দরকার। নিজেরাও যদি জড়িয়ে যাই।
তারপর মার্টিন আইল্যান্ডে তিন বছর ছিলাম। লঞ্চটা একদিন রাতে ঝড়ে শেকল ছিড়ে ভেসে গেল। মেমসাহেব রান্না করত। পিয়ানাে বাজাত। আমি ঘাটের কাছ থেকে মাছ ধরতাম—কোচ দিয়ে—জাল ফেলে। উঠোনে লাউমাচা দিলাম। তেঁড়স করলাম। ধানও করেছি।
আমাদের জামা-কাপড় ছিড়ে ছিড়ে শতখান। আমি শেষে সাহেব বাবার শার্ট গায়ে দিয়ে থাকতাম। মেমসাহেবের জামা, গাউন তাে ছিড়ে একাকার। হাতে পয়সা নেই। পেট্রল ফুরিয়ে এসেছে। আমি কাঠ কেটে আনি। জল তুলি টিউবওয়েল থেকে। নােনা হয়ে গেলে বৈশাখ-জষ্ঠিতে কাটানাে পুকুরে ধরা বৃষ্টির জমানাে জল এনে ফোটাই। কোনাে ব্যাপারী বজরা এলে আমাদের জিনিসপত্তর বলতে সাহেবের টেবিল চেয়ার দিয়ে বদলিতে মশলা, তেল, দুটো কম্বল জোগাড় করি।
এভাবে তাে আর চলে না। মেমসাহেব বলল, কী করব? আর এই নােটেশানটা তুলে নে। তুলতে তুলতে সব ভুলে যাবি।
শেষ দিকে সাহেব বাবার প্রিয় কয়েকটা গৎ আমি দিব্যি বাজাতাম। মেমসাহেব শতচ্ছিন্ন গাউন গায়ে সােফায় বসে চোখ বুজে শুনত। এটা ছিল আমার শাস্তি। আর এটা শােনাই ছিল মেমসাহেবের তৃপ্তি।
এরকম চোখ বােজা অবস্থাতেই একদিন দুপুরে দেখি মেমসাহেব আর নড়ছে।
গায়ে হাত দিতেই হাতলে ঢলে পড়ল।
আবার খোড়াে। আবার কোদাল। ম্যাকফারলানের পাশেই মার্থা মাকে কবর দিলাম। তখন কি জানতাম—ঢাকায় ফিরে পূবালী হােটেলের ব্যান্ডে আমি একদিন পিয়ানাে বাজাব! তখন জানি না—আমাকে আরও অনেকগুলাে খুন করতে হবে।
কলকাতার ভাড়া বাড়ির বারান্দায় তখন ছাই ছাই চাঁদের আলাে! সারা এলাকায় লােডশেডিং। আমরা কেউ কথা বলতে পারছি না। আলাে কখন গেছে টের পাইনি।
কানু উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকার ঘরে গেল। আমি কিছু বলতে যাব। এখানে এখন কাউকে খুন করাে না কানু।
কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।
ততক্ষণে অন্ধকার ঘর-বারান্দা পিয়ানাের একটা বিলিতি গৎ ভাসিয়ে দিল। কানু অন্ধকারে বসেই ঠিক ঠিক ডালা খুলেছে। ওর হাতের আঙুল একটা রিডও মিস করছে না। সেই বাজনার ভেতর সমুদ্র শুধুই দাপাচ্ছিল—ভয়ঙ্কর, উচ্ছ্বসিত সব ঢেউ—আর ঢেউ ভাঙার শব্দ। তাদের এগিয়ে আসা। ফিরে যাওয়া। কানুর হাতের আঙুল সেইসব ঢেউয়ের ফেনা ফিরে ফিরে খামছে ধরছে।