ঘোড়ার ডাক্তার
ছেলেটির নাম শালু। ষোলো সতেরো বছর বয়েস। স্বাস্থ্যটি বেশ ভালো। চওড়া কাঁধ, পেটা লোহার মত বুক, বুদ্ধি—শুদ্ধিও আছে। কিন্তু তার কাজকর্মে কোনো মন নেই। তার বাবার একটা কামারশালা আছে, কিন্তু ছেলে সেখানে থাকে না। শালু সারাদিন মাঠে ঘাটে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়।
শালুর মা—বাবা ঠিক করলেন, ছেলের এবার একটা বিয়ে দিতে হবে। তাহলে যদি সংসারের কাজে মন বসে। তা প্রায় এক হাজার বছর আগেকার কথা তো, সেই সময় ছেলেদের ওই বয়সেই বিয়ে হয়ে যেত। কুড়ি বছরের ছেলেরা বেশ গম্ভীর ভাবে বাবা—কাকা শ্রেণির মধ্যে ঢুকে পড়তো।
শালুর ছিল পাঁচটি বোন। তারা শালুর বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে লাগলো। তারপর ওদেরই গ্রামের মাদ্রী নামে একটি মেয়ের সঙ্গে শালুর বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।
শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার দিন বিয়ে। পাঞ্জাবে বিয়ে হয় দিনের বেলায়। তখনকার দিনে তো আলোর ব্যবস্থা বিশেষ ছিল না, কেরোসিন—পেট্রোলিয়ামও আবিষ্কার হয়নি। আর বিদ্যুৎ তো ছিল শুধু আকাশে। সেই জন্য বেশির ভাগ লোকই ঘুমিয়ে পড়তো সন্ধের পর আর জেগে উঠতো খুব ভোরে। দিনের আলোতেই যা কিছু কাজ হতো। অবশ্য সন্ধের পর গান বাজনা হতো অনেক বাড়ির উঠোনে। আর বিয়ের মতন উৎসবে সারাদিন ধরে গান বাজনা তো হতোই, রাত্তিরেও মশাল জ্বেলে খুব হই—চই চলতো।
শালুর বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে আগের দিন থেকে আত্মীয়—স্বজন আসতে শুরু করেছে। বিয়েতে শালুর কোনো আপত্তি নেই। বরং মনটা বেশ খুশী খুশী হয়ে আছে; সেদিন ভোরবেলা উঠেই সে তার প্রিয় ঘোড়াটা নিয়ে একটু পাহাড়ে ছুটে আসতে গেল।
শালুর ঘোড়াটার নাম তুরগ। এই নাম সে নিজেই দিয়েছে। এই ঘোড়াটা একটু বেঁটে মতন, ঘাড়ের কাছে গোছা গোছা কেশর, আর তার পায়েও মোজার মতন সাদা সাদা লোম। কিন্তু সে সাংঘাতিক জোরে ছোটে। এই ঘোড়াটা শালুর প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী।
শালুদের গ্রামের পাশেই শুরু হয়েছে পাহাড়। সেই পাহাড় দিয়ে যখন খটাখট খটাখট শব্দে ঘোড়াটা ওঠে, তখন সেই আওয়াজ শালুর কানে মিষ্টি বাজনার মতন শোনায়! শালু ঠিক করলো, একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সে সূর্যকে প্রণাম করবে, তারপর ফিরে আসবে। কতক্ষণই বা লাগবে!
ভালো করে এখনো আলো ফোটেনি! অন্ধকারের সঙ্গে কুয়াশা মিলে আছে। কিন্তু পাহাড় জঙ্গলের রাস্তা শালুর মুখস্থ। সে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে তুরগকে নিয়ে উঠতে লাগলো পাহাড়ে।
ছোট পাহাড়টার শিখরে এসে সে দেখলো পুব দিকের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে, একটা লাল ফুলের মতন একটু একটু করে ফুটে উঠছে সূর্য। শালু সেদিকে হাত জোড় করে প্রণাম জানালো, তার ঘোড়াটাও মনের আনন্দে চিঁ—হি—হি করে ডেকে উঠলো।
এমন সময় পেছনে শোনা গেল আর একটা ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ।
শালু মুখ ফিরিয়ে দেখলো একটা মস্ত বড়ো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে এক লম্বা—চওড়া জওয়ান। তার নাকের নীচে শিয়ালের ল্যাজের মতন মোটা গোঁফ। লোকটিকে চেনে শালু। এর নাম জয়দত্ত। তার থেকে তিন চার বছরের বড়ো। কিন্তু এর মধ্যেই জয়দত্ত দু’খানা বড় যুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। দেশের রাজা যুদ্ধের সময় এই সব জওয়ানদের ডাকে, অন্য সময় তারা গ্রামে চাষ—বাস করে।
শালু বললো, নমস্কার জয়দত্ত দাদা। তুমিও বুঝি রোজ এই সময় পাহাড়ে সূর্য প্রণাম করতে আসো?
জয়দত্ত বললো, হ্যাঁ, তা মাঝে মাঝে প্রণাম করি বটে। আসলে আমি আমার ঘোড়াটাকে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া খাওয়াতে আসি!
শালু বললো, তোমার ঘোড়াটা অতি চমৎকার। আমাদের গ্রামে এমন ঘোড়া আর কারুর নেই।
জয়দত্ত বললো, এটা কি আর এদেশের ঘোড়া? এটা আবরদেশের। রাজামশাই এই ঘোড়াটা আমাকে দান করেছেন। হ্যাঁ শালু, তোর নাকি আজ বিয়ে?
শালু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললো, হ্যাঁ। জয়দত্ত দাদা, তুমি নেমন্তন্ন খেতে আসবে তো?
জয়দত্ত সে কথার উত্তর না দিয়ে শালুর কাছ ঘেঁষে এসে তার পিঠে একটা জোরে চাপড় মেরে বললো, তুই বিয়ে করছিস, তুই জওয়ান হয়েছিস, তুই আমার সঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে জিততে পারবি?
শালু বললো, তোমার সঙ্গে কী করে পারবো? তোমার ঘোড়াটা কত বড়। তুমিও আমার চেয়ে বয়সে বড়। তোমার সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতাই হয় না!
জয়দত্ত থুঃ করে মাটিতে থুতু ফেলে ঘেন্নার সঙ্গে বললো, ঘোড়া ছোটাবার পাল্লা দিতে যে রাজি হয় না, তাকে আমি পুরুষ মানুষ মনে করি না। সে আবার বিয়ে করবে? ছোঃ! এই তোর নাম করে আমি আবার থুতু ফেললুম!
এখন, কারুর নাম করে থুতু ফেলাটা সাংঘাতিক অপমানের ব্যাপার। কেউ এ রকম অপমান করলে তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতেই হয়। সেই যুদ্ধে প্রাণ গেলেও তাতে সম্মান বাঁচে।
জয়দত্তর কোমরে সবসময় তলোয়ার গোঁজা থাকে। শালুর কাছে কোনো অস্ত্রই নেই। অস্ত্র থাকলেও সে জয়দত্তর সঙ্গে লড়াই করে পারতো না, শালুর তো এখনো কোনো বড় যুদ্ধে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি! কিন্তু ঘোড়া ছোটানোর ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস আছে। সে জানে, জয়দত্ত অল্পবয়সী ছেলেদের খোঁচায়, নানান রকম শাস্তি দিয়ে আনন্দ পায়। আজ জয়দত্ত ইচ্ছে করেই তাকে জ্বালাতে এসেছে।
সে শান্ত গলায় বললো, ঠিক আছে, জয়দত্ত দাদা, হোক তবে প্রতিযোগিতা। তুমি যদি হেরে যাও, সে কথা আমি গ্রামের কারুকে বলবো না!
জয়দত্ত অট্টহাসি করে বলে উঠলো, আমি হারবো? তোর সাহস তো কম নয়? ওই দ্যাখ, ওই যে সামনের পাহাড়টা দেখছিস, ওইটার চূড়ায় উঠতে হবে। ওপরের দেবদারু গাছটার তলায় আমি আগে পৌঁছবো, তুই জিভ দিয়ে একশো বার আমার পা চাটবি। তবে তোকে ছাড়বো। পালাবার চেষ্টা করলে কিন্তু প্রাণে বাঁচবি না!
সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
শালু তার ঘোড়াটার পিঠে চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করলো, কী রে, পারবি তো?
তুরগ ফ—র—র ফ—র—র নিশ্বাস ছেড়ে যেন বললো, হ্যাঁ পারবো।
সামনের পাহাড়টার ওপরে ওঠার একটাই রাস্তা আছে মোটামুটি। জয়দত্তর বড় ঘোড়া সেই রাস্তা ধরেই ছুটবে। শালুর বেঁটে, পাহাড়ী, ঘোড়া বন জঙ্গলের মধ্য দিয়েও যেতে পারে। খাড়া পাহাড় বেয়েও উঠতে পারে।
তুরগকে কিছু বলতে হল না, সে যেন আগেই বুঝে গেছে যে সামনের পাহাড়ের শিখরে তাকে আগে পৌঁছতে হবে। সে বনজঙ্গল ভেদ করে ছুটলো।
যতই ওপরে উঠছে, ততই শালুর মনে হচ্ছে, সত্যিই যদি সে জিতে যায়, তা হলে কি হবে? তা হলে কি জয়দত্ত তাকে ছাড়বে? রাগের চোটে সে আরও কিছু অত্যাচার করবে নিশ্চয়ই। যাই হোক, প্রতিযোগিতায় যখন নেমেছে, তখন তাকে জেতার চেষ্টা করতেই হবে। বিয়ের দিনেই এই উৎপাত। গ্রামে ফিরে গিয়ে দলবল জুটিয়ে এরপর একদিন জয়দত্তকে শাস্তি দিতে হবে।
গাছের ডালপালা ভেঙে লতা—পাতা ছিঁড়ে ছুটতে লাগলো তুরগ। সে—ও আরবী ঘোড়াটাকে হারাতে চায়।
এক জায়গায় একটা বিশাল খাদের পাশ দিয়ে সরু পথ। একটার বেশি ঘোড়া যেতে পারে না। এখান দিয়ে ঘোড়া দৌড়াতেও পারে না, এক পা এক পা করে খুব সাবধানে এগোতে হয়।
শালু পেছনে তাকিয়ে দেখলো একটু দূরে জয়দত্তকে দেখা যাচ্ছে। তাহলে তো শালু নির্ঘাৎ জিতবেই। এই গাছের পথটা পার হলেই চুড়োয় পৌঁছনো যাবে সহজে।
জয়দত্ত একেবারে পেছনে এসে পড়ে বললো, এই শালু, রাস্তা ছাড়!
শালু বললো, রাস্তা ছাড়বো মানে? আমি আগে এসেছি, আমি আগে যাবো!
জয়দত্ত গর্জন করে বললো, না; তুই আগে যাবি না। জয়দত্তকে কেউ হারাতে পারে না!
শালু বললো, আজ তোমার জয়ের আশা নেই, দাদা!
জয়দত্ত তবু জোরে চালিয়ে দিল তার ঘোড়া। শালু চেঁচিয়ে উঠলো, কী করছো, কী করছো!
জয়দত্ত তবু শুনলো না। সে শালুর পাশ ঘেঁষে এসে তুরগের পেটে একটা লাথি কষালো খুব জোরে। ঝোঁক সামলাতে না পেরে শালুকে নিয়ে তুরগ গড়িয়ে পড়ে গেল খাদে।
প্রতিযোগিতায় নেমে কেউ এ রকম অন্যায় করে না। অন্যের ঘোড়ার পেটে লাথি মারে না। শালু এরকম ব্যাপার কল্পনাও করতে পারেনি। তাই সে সাবধানও হয়নি!
খাদটা বিশাল গভীর। শালু তার ঘোড়া সমেত আটকে গেল মাঝখানে। শালু বেশি চোট পায়নি কিন্তু তুরগের একটা পা ভেঙে গেছে, সে তারস্বরে চ্যাঁচাচ্ছে। শালু একটা গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরে রইলো।
এখান থেকে ওপরে ওঠার কোনো উপায় নেই।
ওপর থেকে মুখ ঝুঁকিয়ে হাসতে হাসতে জদত্ত বললো, কী রে, পড়ে গেলি? আমার সঙ্গে পারলি না তো? ওখানে পড়ে থাকলে তোর বিয়ে হবে কী করে? দাঁড়া নড়াচড়া করিস না। আমি কয়েকটা লতা পাকিয়ে নামিয়ে দিচ্ছি।
জয়দত্ত বেশ মোটা কয়েকটা লতা পাকিয়ে নামিয়ে দিল সত্যি সত্যি। সেটা কোমরে বেঁধে শালু উঠে যেতে পারে। কিন্তু তা হলে তুরগের কী হবে? তুরগকে সে এতদিন ধরে পুষেছে, এখন এই বিপদের সময় তাকে ফেলে চলে যাবে? তা হতেই পারে না।
সে ভাবলো, আগে তুরগকে বাঁচানো যাক। তারপর সে উঠবে।
সে তুরগের পেটে জড়িয়ে লতাটা বেঁধে দিয়ে বললো, জয়দত্ত দাদা, আগে আমার ঘোড়াটাকে টেনে তোলো।
জয়দত্ত বললো, তোর আহত ঘোড়া তুলে কী হবে? ওটাকে ঠেলে ফেলে দে! তুই উঠে আয়।
শালু বললো, আমার ঘোড়াকে না তুললে আমি উঠবো না। ওকে বেঁধে দিয়েছি, তুমি টানো।
জয়দত্ত বাধ্য হয়েই প্রাণপণ শক্তিতে টানতে লাগলো। নিচু গাছের পাশের ধারালো পাথরে ঘষা লেগে সেই লতা ছিঁড়ে গেল হঠাৎ। তুরগ আবার হুড়মুড়িয়ে নীচে পড়লো। এবার সে আর খাঁজে আটকালো না। তার ধাক্কায় শালুও গড়াতে লাগলো নীচে। অনেক, নীচে, প্রায় যেন শেষ নেই।
জয়দত্ত চিৎকার করে ডাকলো, শালু! শালু!
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
অত ওপর থেকে পড়লে কোনো মানুষ বাঁচে না। জয়দত্ত আরও কয়েকবার ডেকে ফিরে গেল গ্রামে। সেখানে রটিয়ে দিল যে শালু ঘোড়া শুদ্ধ ওই খাদে পিছলে পড়ে মারা গেছে। বাড়ির লোকজন এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেল না।
মাদ্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল জয়দত্তর।
শালু কিন্তু মরেনি।
ঘোড়া শুদ্ধু সে গিয়ে পড়লো একটা নদীতে। সেই পাহাড়ী নদীর দারুণ স্রোত। সে সাঁতরাবার কোনো সুযোগই পেল না, বরং একটা ডুবো পাথরে মাথা ঠুকে সে অজ্ঞান হয়ে গেল এক সময়ে।
সেই নদীটা পাঞ্জাব ছাড়িয়ে চলে গেছে সিন্ধুদেশে।
শালুর জ্ঞান ফেরার পর সে দেখল সে শুয়ে আছে খুব নরম ঘাসের ওপর। তার পাশেই বসে আছে একজন খুব বুড়ো লোক। তার মাথায় পাটের মত পাকা চুল, তার মুখে শনের মতন পাকা দাড়ি।
বুড়োটি বললে, হুঁ, বেঁচে উঠলে তাহলে!
শালু বললো, আমি কোথায়? আপনি কে?
বুড়োটি বললো, আমি কে তা তো তুমি বুঝবে না। তুমি কোথায় আছো তাও তোমাকে বোঝানো যাবে না। তবে তুমি চলে এসেছো তোমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে! তোমার ঘোড়াটাকে একজন লোক ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দিয়েছিল। তারপরেও তুমি নিজে আগে বাঁচবার চেষ্টা না করে ঘোড়াকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলে, তাই না?
শালু উঠে বসবার চেষ্টা করলো, আপনি এ সব জানলেন কি করে?
এমন সময় একটা চিঁ হি—হি ডাক শোনা গেল। শালু পাস ফিরে দেখলো। একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে তুরগ, আরও চার—পাঁচটা ঘোড়া ঘিরে আছে তাকে।
একটা ঘোড়া তুরগের পা চাটছে।
বুড়ো লোকটি চিঁ হি—হি—ই—য়া বলে চিৎকার করলো, ওদিক থেকে একটা ঘোড়া সেই রকম শব্দ করে উত্তর দিল।
এই বুড়ো লোকটি ঘোড়ার ভাষা বোঝে।
বুড়ো লোকটি শালুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আমার নাম ব্রহ্মদত্ত। আমিও অনেকদিন আগে তোমার মতন ভাসতে ভাসতে এখানে এসে পৌঁছেছিলাম। এই জঙ্গলে আজও কোনো সভ্য মানুষ আসেনি। এখানে অনেক বুনো ঘোড়া থাকে। আমি এখান থেকে আর ফিরে যাবার চেষ্টা করিনি। এই ঘোড়াদের মধ্যে থাকতে ভালো লাগে আমার।
শালু বললো, শ্রাবণ পূর্ণিমায় যে আমার বিয়ে!
ব্রহ্মদত্ত বললো, শ্রাবণ পূর্ণিমা তো পেরিয়ে গেছে তিন দিন আগে। তোমার মাথার যা অবস্থা, তুমি এখন কোথাও যেতে পারবে না। তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো আমার ঘরে।
বুড়োর ঘরটি অদ্ভুত! বনের লতাপাতা দিয়ে একটা চালা তৈরি করেছে বেশ বড়! চারদিকে চারটে গাছের খুঁটি। কোনো দেয়াল টেয়াল নেই। বুনো ঘোড়ারা সেই ঘরের মধ্যে চলে আসে। বুড়োর সঙ্গে তারা কথা বলে। বুড়ো তাদের আদর করে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে কবিরাজ বৈদ্যদের কাছে মানুষেরা যেমন চিকিৎসা করতে আসে, সেই রকম ব্রহ্মদত্তের কাছেও কোনো কোনো অসুস্থ ঘোড়া এসে নিজেদের রোগের কথা বলে। পা তুলে ক্ষতস্থান দেখায়।
বুড়ো ওদের ভাষাতেই সান্ত্বনা দেয়। ওষুধ লাগিয়ে দেয়।
সেই বনে শুধু ঘোড়া নেই, বাঘও আছে। হরিণ আছে। শেয়াল আছে। মাঝে মাঝে বাঘের গর্জন শোনা যায়। বাঘের তাড়া খেয়ে দু’ একটা হরিণ ছিটকে চলে আসে চালা ঘরের দিকে।
একদিন একটা হরিণের পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে একটা বাঘও চলে এলো সেদিকে!
বুড়োটি তখন রান্না করছিল বাঘটাকে আসতে দেখেই সে প্রচণ্ড জোরে আগে চিঁ—হি—হি করে চিৎকার শুরু করে দিল। তারপর দেখা গেল এক আশ্চর্য ব্যাপার। চতুর্দিকে শোনা গেল কপাকপ শব্দ। প্রায় পঞ্চাশটা বুনো ঘোড়া এসে গেল সেখানে।
বাঘের সঙ্গে ঘোড়াদের যে লড়াই হতে পারে তা শালু কোনোদিন কল্পনাই করেনি। ঘোড়ার পিঠে মানুষ চেপে যুদ্ধ করে। এখানে শুধু ঘোড়ারাই যুদ্ধ করছে। ঘোড়াগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে চাঁট মারতে লাগলো বাঘটার গায়ে—মাথায়। অতবড় হিংস্র বাঘও একসঙ্গে এত ঘোড়ার সঙ্গে লড়াই করতে পারলো না। এক সময় রণে ভঙ্গ দিল।
বুড়োটি একগাল হেসে বললো, একদিন একটা পাগলা হাতিও এই ঘোড়াদের কাছে জব্দ হয়েছিল। ঘোড়াকে যদি তুমি ভালোবাসো, তা হলে ঘোড়ার মতন বন্ধু আর হয় না।
শালু সেখানেই থেকে গেল এক বছর।
ব্রহ্মদত্তের কাছে সে ঘোড়াদের ভাষা শিখলো। ঘোড়াদের চিকিৎসা শিখলো। বুনো ঘোড়াদের সঙ্গে সে ঘুরে বেড়ায় বনে বনে। এই জীবনই তার ভালো লাগে, তার আর গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না।
এক বছর বাদে ব্রহ্মদত্ত বললো, দ্যাখো শালু, আমি বুড়ো হয়েছি, আমি এখানে থাকবো। এখানেই মরবো। কিন্তু তোমার বয়েস কম। তুমি, তুমি দেশে ফিরে যাও! সারা দেশে কত ঘোড়া ছড়িয়ে আছে, অনেক সময় মানুষ ঘোড়াদের দিয়ে বেশি খাটায়, ঘোড়া একটু অসুস্থ হলেই মেরে ফেলে। তুমি ফিরে গেলে সেইসব ঘোড়াদের উপকার করতে পারবে!
তুরগের পিঠে চেপে অনেক দেশ, দেশান্তর ঘুরে শালু একদিন ফিরে এলো নিজের গ্রামে।
সবাই ভাবলো, শালু বুঝি যমলোক থেকে ফিরে এসেছে। তাকে নিয়ে সকলেরই খুব আনন্দ! বিরাট উৎসব হলো তাদের বাড়িতে।
সেই সব দেখে জয়দত্তর হিংসে হলো খুব। সে এখনো অল্প বয়েসীদের ওপর অত্যাচার করে বেড়ায়। সে একদিন অনেক লোকের সামনে শালুকে বললো কী করে তুই নাকি দেশ—বিদেশ ঘুরে অনেক কিছু শিখে এসেছিস? আমার সঙ্গে আবার ঘোড়া—ছোটানোর প্রতিযোগিতা লড়ার সাহস আছে?
শালু বললো, না, জয়দত্তদাদা আমি বিনা কারণে ঘোড়াদের দিয়ে দৌড় করিয়ে মুখের ফেনা উঠাতে চাই না।
জয়দত্ত মাটিতে থুঃ করে থুতু ফেলে, কাপুরুষ। তুই এই গ্রামে থাকার যোগ্যই নয়!
তা হলে তো প্রতিযোগিতায় নামতেই হয়। গ্রামের সবাই বললো এটা একটা সম্মানের প্রশ্ন। পুরুষ মানুষ তো ভয় পেলে বাঁচতে পারবে?
তবে এসব প্রতিযোগিতা হবে সকলের সামনে, খোলা মাঠে। পাঁচ জন মাত্র প্রতিযোগী।
সকালবেলা দারুণ ভিড় জমে গেল গ্রামের বাইরের মাঠে। খুব সেজেগুজে এলো জয়দত্ত। ঘোড়াটাকেও সাজিয়েছে। শালু এলো সাধারণ একটা জামা পরে।
দৌড় শুরু হবার ঠিক আগের মুহূর্তে শালু চি—হি—হি—হু—হু করে চেঁচিয়ে উঠলো একবার। অমনি একটা অদ্ভুত কাণ্ড হলো। জয়দত্তর ঘোড়াটা একবার অবাক চোখে তাকালো শালুর দিকে। তারপর সে দু’পা তুলে উঁচু হয়ে পিঠ ঝাড়া দিতে লাগল এমনভাবে যে জয়দত্ত বসে থাকতে পারলো না। মাটিতে পড়ে গেল আছাড় খেয়ে।
জয়দত্ত উঠে আবার চেষ্টা করলো, আবার সেই একই ব্যাপার। এতদিনের পোষা ঘোড়া কিন্তু সে জয়দত্তকে আর পিঠে রাখতে চায় না।
ঘোড়াটা পাগল হয়ে গেলো মনে করে আনা হলো আর একটা ঘোড়া। সেটাও খুব তেজী।
শালু আবার চিঁ—হি—হি—হু—হু বলে ডেকে উঠতে এই ঘোড়াটাও একই রকম ভাবে তাকালো শালুর দিকে। তার পর দু’পা তুলে খাড়া হয়ে এমন জোরে ছিটকে ফেলে দিল জয়দত্তকে যে তার পা ভাঙে গেল। সে আর উঠে দাঁড়াতেই পারছে না।
শালু বললো জয়দত্তদাদা, তুমি আর কোনোদিন কোনো ঘোড়ার পিঠে চাপতে পারবে না। এইটাই তোমার শাস্তি।
চতুর্দিকে রটে গেল যে শালু ঘোড়াদের ভাষা শিখে এসেছে কোনো এক অচেনা দেশ থেকে। ঘোড়ার চিকিৎসক হিসেবেও তার সুনাম হলো খুব। স্বয়ং রাজা তাঁর অশ্বশালায় চিকিৎসা করবার জন্য শালুকে ডেকে পাঠান। শালু যেমন টাকা পয়সা রোজগার করতে লাগলো, তেমনি তার সম্মানও বেড়ে চললো দিন দিন।
এই শালুর ভালো নাম শালিহোত্র। সে পরে ঘোড়াদের বিষয়ে তিনখানা বইও লিখেছিল। তার লেখা শালিহোত্র সংহিতা বইতে ২৮০০ শ্লোক আছে। সবই ঘোড়াদের চিকিৎসা বিষয়ে। এই বই এত বিখ্যাত হয়েছিল যে সেই সময়ে তিব্বতী আর আরবী ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। তার আর দু’খানা বইয়ের নাম অশ্ব প্রশংসা আর অশ্বলক্ষ্মণ—শাস্ত্র। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের শালিহোত্র এই সব বই লিখেছিলেন। সারা পৃথিবীতে বোধহয় তার আগে কেউ শুধু ঘোড়াদের সম্পর্কে কোনো বই লেখেননি।
লোকে বলে শালিহোত্র অশ্ববিদ্যা শিখেছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মার কাছ থেকে। শালুর আসল গল্পটা শুধু আমিই জানি।