ঘোড়ামারায় একটি রাত – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
নার্ভাস মুখে এদিক—ওদিক তাকাচ্ছিল সুমন। বিকেলবেলাতেও স্টেশনটাকে এমন পাণ্ডববর্জিত মনে হয়নি, এখন চারদিকটা কেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। স্টেশনের আশপাশে একটা—দুটো যা দোকানপাট ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে বহুক্ষণ। কোথাও কোনো জনমনিষ্যির চিহ্নটি নেই। কানে আসে শুধু ঝিঁঝিপোকার গা—শিরশির করা আওয়াজ।
পার্থ প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে পড়েছে। কম্ফর্টারে কান—মাথা ঢাকতে—ঢাকতে গজগজ করে উঠল, ‘তোর জন্য…..তোর জন্যই লাস্ট ট্রেনটা মিস করলাম।’
সুমন কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘বা রে, আমার কী দোষ? পথে যদি রিকশআলার সাতবার চেন খুলে যায়…!’
‘তুই দেরি করে খেতে বসলি কেন?’ পার্থ খেঁকিয়ে উঠল, ‘বরযাত্রীদের জন্য কেন অপেক্ষা করলি? আগের ব্যাচে বসা যেত না? রজত তো কতবার বলেছিল, তোরা কলকাতা ফিরবি, কেন মিছিমিছি দেরি করছিস….!’
‘ইল্লি রে, কেন আগে বসব? বরযাত্রীদের ব্যাচটা সবসময়ে স্পেশ্যাল হয়। ওদের জন্য কত কী আলাদা করে তোলা ছিল দেখেছিস? সলিড—সলিড মাংসের পিস, গোবদা—গোবদা ফিশফ্রাই, জলভরা তালশাঁস—সন্দেশ….’
‘তুই কী হ্যাংলা রে! খাওয়াটাই কি জীবনের মোক্ষ?’
‘ফ্যাচফ্যাচ করিস না। তুইও কিছু কম টানিসনি। চেয়েচেয়ে পাঁচখানা ফিশফ্রাই খেলি, একডজন সন্দেশ সাবাড় করলি, ভাবছিস আমি কিছুই লক্ষ করিনি?’
‘আহা, চটে যাচ্ছিস কেন?’ ঝপ করে আহারের প্রসঙ্গটা চেপে গেল পার্থ। হাতমুখ নেড়ে বলল, ‘এখন কী করা যায় তাই বল। সারারাত এভাবেই কি ভ্যাবলার মতো বসে থাকব?’
এই চিন্তাতেই তো গায়ের লোম পর্যন্ত খাড়া হয়ে যাচ্ছে সুমনের। হাওড়া থেকে ঘোড়ামারা স্টেশন ট্রেনে পাক্কা এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। অর্থাৎ কমপক্ষে পঞ্চাশ কিলোমিটার। এই রাতদুপুরে কীভাবেই বা ফেরা যাবে এতটা পথ?
মাইলখানেকের মধ্যে হাইওয়ে আছে বটে, কিন্তু সেখানেও কি বাসটাস পাওয়া যাবে এখন? তা ছাড়া হাইওয়েতে নাকি চোর—ছ্যাঁচোড়ের বেজায় উপদ্রব। রজতই গল্প করছিল, এদিককার চোররা নাকি ভারি নচ্ছার, কিছু না পেলে তারা নাকি জামাকাপড় খুলে নিয়ে চলে যায়। এই হাড়কাঁপানো মাঘের রাতে তেমন কারও পাল্লায় যদি পড়ে…..!
রজতদের বাড়িই ফিরে যাবে কি? কিন্তু সেও তো মেলা দূর। স্টেশন থেকে না হোক দু—আড়াই মাইল। রিকশাঅলা তো তাদের নামিয়ে দিয়েই উলটোমুখে ছুট মারল, স্ট্যান্ডেও আর গাড়ি নেই, শীতে কাঁপতে—কাঁপতে অতটা রাস্তা হাঁটা কি এখন সম্ভব?
ইস, কী কুক্ষণে যে রজতের দিদির বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল আজ? বাড়িতে পইপই করে বলে দিয়েছিল, সুমনরা যেন অবশ্যই রাতে ফিরে আসে। কাল কী ঝাড় যে কপালে আছে!
হতাশ মুখে সুমন বলল, ‘চোখকান বুজে কয়েকটা ঘণ্টা কাটাতেই হবে রে! উপায় নেই।’
‘খোলা প্ল্যাটফর্মে? ঠান্ডায় জমে কুলপি হয়ে যাব যে!’
‘একটা কাজ অবশ্য করা যায়। ওপারে টিকিট কাউন্টারের সামনে ঢাকামতন জায়গা আছে একটা। বেঞ্চিটেঞ্চিও আছে। বিকেলে ট্রেন থেকে নেমে দেখেছিলাম। ওখানেই যাই চল। অন্তত ঠান্ডাটা তো কম লাগবে।’
‘চল তবে।’
উঠে পড়ল পার্থ। ওভারব্রিজের দিকে এগোচ্ছে দুই বন্ধু। চাপ—চাপ কুয়াশায় ছেয়ে আছে চরাচর। প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো কেমন ঝাপসা—ঝাপসা। আকাশে চাঁদ উঠেছে আধখানা, কুয়াশার দাপটে তারও বেশ নিষ্প্রভ দশা। জ্যোৎস্না যেন পৌঁছেও পৌঁছতে পারছে না পৃথিবীতে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে—উঠতে সুমন বলল, ‘জায়গাটা বড় নিঝুম রে! মনে হচ্ছে যেন ভৌতিক স্টেশন। তাই না?’
পার্থ টেরচা চোখে তাকাল, ‘তুই বুঝি ভুতে বিশ্বাস করিস?’
‘তা নয়। তবে….এত শুনলাম, কেমন একটা আলো—আঁধারের খেলা চলছে… তোর গা ছমছম করছে না?’
‘ধুস, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না।’
‘না রে, এসব জায়গায় কিন্তু ভূত থাকার খুব চান্স।”
কথায়—কথায় দুই বন্ধু পৌঁছে গেল ওভারব্রিজের মাথায়। ঠিক তখনই কোথায় যেন একটা কুকুর ডেকে উঠল করুণ সুরে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক বাজখাঁই হুঙ্কার, ‘টিকিট?’
বেজায় চমকেছে দুই বন্ধু। ওদিকের সিঁড়ির মুখে এক দশাসই চেহারার লোক দাঁড়িয়ে। পরনে সাদা প্যান্ট, কালো কোট। গায়ের রং গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ।
লোকটা আবার হাঁক পাড়ল, ‘টিকিট? টিকিট? এই খোকারা, জলদি টিকিট দেখাও।’
খোকা সম্বোধনটা ঠং করে কানে লেগেছে দু—জনেরই। হোক না ফার্স্ট ইয়ার, কলেজে তো পড়ছে, একটা অজানা লোক তাদের খোকা বলে কোন আক্কেলে?
অসন্তুষ্ট গলায় সুমন বলল, ‘আমরা হাওড়া থেকে রিটার্ন কেটেই উঠেছি।’
‘অ। কিন্তু রাত বারোটার পর তো ওই টিকিট আর চলবে না।’
‘রাত বারোটার পর তো আপনাদের ট্রেনও নেই।’ পার্থর স্বরে বিরক্তি, ‘কাল সকালে আমরা নতুন টিকিট কেটে নেব।’
‘ঠিক আছে।’ লোকটা যেন সামান্য নরম হয়েছে, তা এখন চললে কোথায়?’
‘ওই ঢাকা জায়গাটায় গিয়ে বসব।’
‘ওখানে?’ লোকটার স্বরে যেন একটু চিন্তান্বিত ভাব, ‘ওখানে বসাটা কি ঠিক হবে?’
‘বেঠিক কী আছে? ওটাই তো ঘোড়ামারার ওয়েটিংরুম, না কি?’
‘তা বটে! তবে ওখানে একটু গন্ডগোল আছে। তিনি কিন্তু যখন তখন এসে পড়তে পারেন।’
‘তিনি?’ সুমন আর পার্থ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, ‘কে তিনি?’
‘যিনি মাঝেমাঝেই রাতবিরেতে হানা দেন।’ গলা নামাল লোকটা, ‘আর একবার যদি তোমাদের ওখানে দেখতে পান, তো হয়ে গেল!’
সুমনের বুকটা ধুকধুক করে উঠল। খপ করে চেপে ধরেছে পার্থর হাত। পার্থ গলাখাঁকারি দিল, ‘আপনি কি আমাদের ভয় দেখাতে চাইছেন?’
‘বালাই ষাট। তোমরা ভয় পাবে কেন? তিনি কখনো কারও অনিষ্ট করেন না। ওখানে বসে থাকলে টানাহ্যাঁচড়া করে ধরে নিয়ে যাবেন এই যা। যেসব প্যাসেঞ্জার ট্রেন না পেয়ে আটকে যায়, তাদের উপর ভীষণ মায়া ওঁর।’
সুমন ফের আঁকড়ে ধরেছে পার্থর হাত। ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই চল, যেখানে ছিলাম সেখানেই ব্যাক করি। কী দরকার ভূতটুতের খপ্পরে পড়ার!’
‘ছাড় তো!’ পার্থ হ্যাঁচকা টান দিল সুমনকে, ‘আমরা ওখানেই যাব। কিছু হবে না।’ বলেই তরতরিয়ে সিঁড়ি ধরে নামছে। একদম নীচের ধাপিতে এসে ঘুরে তাকাল। লোকটা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে।
পার্থ চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনার ভূতবাবাজি আজ এদিকের ছায়া মাড়াবেন না। বুঝেছেন? এই শর্মাকে ভূতেরাও ডরায়।’
লোকটা হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসিটা ছড়িয়ে যাচ্ছে নির্জন প্ল্যাটফর্মে। হাসতে হাসতে লোকটা চলে গেল ওভারব্রিজ বেয়ে। ক্রমশ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
‘বিশ্রামাগার’ লেখা জায়গাটায় আলোটালোর বালাই নেই। প্ল্যাটফর্মের টিমটিমে বাতিরাই যা দু—এক কুচি আলো ছিটিয়ে দিচ্ছে। আবছা আঁধার—মাখা বেঞ্চিতে সুমনকে নিয়ে বসেছে পার্থ। বন্ধুর পিঠে জোরসে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘কী রে খুব ঘাবড়েছিস?’
সুমন ঢোক গিলল, ‘না মানে… লোকটা যা বলল, তাতে মনে হয়…’
‘ধুৎ, পাত্তা দিস না তো। বুঝলি না লোকটার ধান্দা? রাতদুপুরেও ঘাপটি মেরে ছিল, যদি কোনো বিনা টিকিটের প্যাসেঞ্জার পায়! আমাদের কবজা করতে পারল না তো, তাই একটু ফিচলেমি করে গেল।’
”বলছিস? আমার কিন্তু….’
‘ভয়কে জয় করতে শেখ।… দেব তোকে একটা ভয় তাড়ানোর দাওয়াই?’
‘কী দাওয়াই?’
‘আছে। গান। আয়, দু—জনে মিলে গলা ছেড়ে গান গাই।’
‘এখন? গান? এখানে?’
‘ইয়েস। শীত জব্দ চানে, ভয় জব্দ গানে। চান তো এক্ষুনি করা যাবে না, এক গানেই এখন ডবল এফেক্ট আনব।’
সুমন বুঝি সাহস পেল খানিকটা। বলল, ‘কী গান গাইবি?’
‘আছে একখানা জব্বর কালোয়াতি। কাফি ইমন দরবারি মালকোষ সব পাঞ্চ করা। আমি শুরু করছি, তুই সঙ্গে—সঙ্গে সুরটা ধরে যা।’
উরুতে তাল বাজাতে—বাজাতে গলা ছাড়ল পার্থ। প্রথমে একটুক্ষণ আ—আ করে আলাপ। তারপর ঢুকেছে গানে, ‘—কচুবনে কেঁদে গেল কালো কুকুরে… তাই না দেখে বেড়ালছানা ঝিমোয় দুপুরে….’
নানান কায়দায় খেলিয়ে—খেলিয়ে গেয়ে চলেছে পার্থ। ওই দু—লাইনই। শুনে—শুনে সমুনও কণ্ঠ মেলাল। যৌথ স্বর কখনো সপ্তমে চড়ে, কখনো নেমে আসে খাদে। গিটকিরির দাপটে ছিঁড়ে—ছিঁড়ে যাচ্ছে ভয়। তানের কসরতে শীত বেচারার পালাই—পালাই হাল।
হঠাৎই কোত্থেকে খোনা—খোনা গলার ডাক, ‘এই যেঁ শুঁনছঁ? শুঁনছঁ?’
সুরের আবেশে চোখ বুজে গিয়েছিল দুই বন্ধুর। দু—জোড়া চোখ পটাং করে খুলে গেল। কই, কেউ তো নেই ধারেকাছে? কী রে বাবা, মনের ভুল নাকি?
ফের উৎসাহ নিয়ে দুই বন্ধু শুরু করেছে যুগলবন্দি, তখনই পার্থর ঘাড়ে একটা হিমশীতল ছোঁয়া, ‘এই যেঁ তোঁমরাঁ কাঁরাঁ?’
পার্থ যেন ইলেকট্রিক শক খেল। ধড়মড়িয়ে সামনে হুড়মুড়িয়ে পড়েছে। কোনোক্রমে ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেল এক ছায়ামূর্তি। কে ওটা?
পার্থ নয়, সুমন কাঁপতে—কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, ‘আ—আ…. আপনি কে?’
‘আঁমি এঁখানকার টিঁকিটচেঁকাঁর।’
ঘোড়ামারা স্টেশনে রাতে কোনো মানুষ নামে না, সেখানে কিনা একজোড়া টিকিটচেকার? এ কি সম্ভব? ঝিঁঝিপোকার ডাকটাই বা বন্ধ হয়ে গেল কেন হঠাৎ?
বেঞ্চিতে ভর দিয়ে পার্থ উঠে দাঁড়াল। তোতলাতে—তোতলাতে বলল, ‘আ—আ…. আমাদের টি—টি…. টিকিট আছে। বি বি…. বিশ্বাস করুন।’
বেঞ্চির পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে ছায়ামূর্তি। হাতে একখানা মিটমিটে লণ্ঠন। বাতিটা উঁচু করে ধরতেই মুখখানা স্পষ্ট হল খানিক। ঘোমটার মতো করে আষ্টেপৃষ্ঠে মাফলার জড়িয়ে আছে, গায়ে লতপতে কালো কোট। মুখের মধ্যে চোখ আর দাঁতই আগে নজরে আসে। ভ্যাবাচ্যাকা দুই চোখ কেমন ঠেলে বেরিয়ে আসছে, গজাল—গজাল দাঁত ঝুলছে ঠোঁট বেয়ে।
খুনখুনে গলায় ছায়ামূর্তি বলল, ‘তাঁ তোঁ বুঁঝলাঁম। কিঁন্তু এঁই ঠাঁন্ডায় এঁখানে বঁসে—বঁসে চিঁল্লাচ্ছঁ কেঁন? আঁমার কাঁচা ঘুঁমটা ভেঁঙে গেঁল ।’
‘চেঁচাইনি তো স্যার। গান গাইছিলাম।’
‘খুব শীত করছিল যে। গাড়ি ফেল করলাম, বাড়ি ফেরা হল না…’
‘আঁ। তাঁর মাঁনে খুঁব আঁতাঁন্তরেঁ পঁড়েঁছ?’ ভূতুড়ে নাকিসুরে মমতা ঝরে পড়ল, ‘যাঁক গেঁ, আঁমি যঁখন এঁসেঁ গেঁছি, আঁর কোঁনও ভঁয় নেঁই। ওঁঠোঁ। উঁঠে পঁড়োঁ।’
কোরাসে ককিয়ে উঠল দুই বন্ধু, ‘কেন স্যার?’
‘এঁসোঁ আঁমাঁর কোঁয়ার্টারেঁ। এঁই তোঁ, সাঁমনেই।’
এবার পার্থ খামচে ধরল সুমনের সোয়েটার। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। জিভে তালু ভিজিয়ে বলল, ‘না, না, আমরা এখানেই বেশ আছি।’
‘যাঁহ, তাঁ হঁয় নাঁকি? আঁমি থাঁকতে এঁই শী�তে এঁখানেঁ পঁড়েঁ থাঁকবেঁ? নিঁমোনিয়াঁ হঁয়ে যাঁবে যেঁ।’
‘আমাদের শীত করছে না স্যার।’ সুমন অস্ফুটে বলল, ‘আমরা ঘামছি স্যার।’
‘বুঁঝেছিঁ। লঁজ্জা পাঁচ্ছ। আঁরে বাঁবা, আঁমি এঁকাই থাঁকি। আঁমার ওঁখানে তোঁমাদের কোঁনও অ্যাঁসুবিধেঁ হঁবে নাঁ। আঁমার খাঁট আঁছে, বিঁছানা আঁছে, কঁম্বল আছে, আঁরাম কঁরে কঁয়েক ঘঁণ্টা শুঁয়ে নাঁও।’
পার্থ ডুকরে উঠল, ‘লাগবে না স্যার। আমাদের ঘুম পাচ্ছে না।’
‘দ্যাঁখো ছোঁকরা, পাঁকামিঁ কোঁরো নাঁ। তাঁ হঁলে আঁমি কিঁন্তু বঁকব।”
‘আঁইই, ভূতের বকুনি! সর্বনাশের মাথায় পা।’
সুমন ফিসফিস করে পার্থকে বলল, ‘বেশি চটিয়ে দিস না। ঘাড় মটকে দিতে পারে।’
ছায়ামূর্তি ঠিক শুনতে পেয়ে গেছে। বলল, ‘এঁমাঁ ছিঁ ছিঁ, এঁ কী কঁথা! এঁসো নাঁ আঁমার সঁঙ্গে, রঁসগোল্লাঁ খাঁওয়াবঁ।’
‘আমাদের খিদে নেই স্যার।’ আবার কোরাস বেজে উঠল, ‘আমরা বিয়েবাড়িতে প্রচুর খেয়েছি।’
‘তোঁমরাঁ এঁমন কঁরছ কেঁন? কঁত আঁদর কঁরে ডাঁকছিঁ তোঁমরাঁ এঁমন কাঁপছ কেঁন? কঁত নরম কঁরে ডাঁকছিঁ তোঁমাদেঁর। এঁসোঁ, এঁসোঁ আঁমার সঁঙ্গে।’ বলেই খপ করে হাত বাড়াল ছায়ামূর্তি। ধরে ফেলেছে। পার্থর হাত। বরফের মতো হিম আঙুলগুলো টানছে পার্থকে।
পার্থ পলকে অজ্ঞান। আঁ আঁ করতে—করতে সুমনও।
কখন জ্ঞান ফিরল, জানে না পার্থ! চেতনা আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মুখের কাছে ঝুঁকে আছে সেই গজাল—গজাল দাঁত, ঠেলে আসা চোখ।
দন্তপঙক্তি বিকশিত হল, ‘কী, এঁখন কেঁমন বোঁধ কঁরছ?’
পার্থ অতিকষ্টে বলল, ‘আমি কোঁথায়?’
‘আমার ঘঁরে। আঁমার বিঁছানায় শুঁয়ে আঁছ….’
সত্যি তো, এ তো একটা ঘরই বটে! আলো নেই তেমন, বোধ হয় লণ্ঠন জ্বলছে, তার মধ্যেও দেওয়াল—টেওয়ালগুলো বুঝতে অসুবিধে হয় না। আশ্চর্য, মাথার উপর একটা সিলিংফ্যানও আছে।
সুমনেরও সংজ্ঞা ফিরেছে। সে শুয়ে আছে সিঁটিয়ে, চোখ খুলেই বুজে ফেলছে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল—’আমরা এখানে এলাম কী করে?’
‘বুঁড়োমাঁনুষটাকেঁ খুঁব খাঁটিয়েছ। দুঁ’জনকেঁ টেঁনে আঁনতে গিঁয়ে আঁমার ঘাঁম ছুঁটে গেঁছে।’ গজাল—দাঁত বিছানার কোণে বসল। খ্যাঁচ করে শব্দ হল একটা। ফের নাকি—নাকি সুর বাজল, ”তোঁমরাঁ আঁমায় দেঁখে এঁত ভঁয় পাঁচ্ছ কেঁন বঁলো তোঁ? নাঁকি আঁমায় ভূঁত ভাঁবছ?’
একেই কি বলে ভৌতিক রসিকতা? ভূত বলে তাকে ভূত ভাবা হচ্ছে কেন?
সুমন মরিয়া হয়ে বলল, ‘কেন ঠাট্টা করছেন স্যার? আমরা জেনে গেছি।’
পার্থ বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, চেকারবাবু আমাদের বলে দিয়েছেন আপনি কে?’
‘কে চেঁকারবাঁবু? কাঁলোদাঁ নঁয় তোঁ? ওঁভারব্রিঁজের উঁপর দাঁড়িয়ে ছিঁল?
‘হ্যাঁ স্যার। উনি তো বললেন, আপনি আসবেন, আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করবেন…’
‘আঁরে দুঁর বোঁকা, কাঁলোদাঁই তোঁ ভূঁত। সাঁত বঁছর আঁগে অঁপঘাঁতে মৃত্যু হঁয়েছেঁ, কাঁলোদাঁর। রাঁনিং ট্রেঁনে উঁটতেঁ গিঁয়ে পাঁ পিঁছলেঁ গিঁয়েছিঁল, কেঁটে এঁকেবাঁরে দুঁ আঁধখাঁনা। এই ঘোঁড়ামাঁরা স্টেশনেই। তাঁরপঁর থেঁকেই রাঁতবিঁরেতে লোঁককে ভঁয় দেঁখানোঁর জঁন্য দাঁড়িয়েঁ থাঁকে ওঁখানটাঁয়। বেঁচে থাঁকার সঁময়েঁ যাঁত্রীদেঁর উঁত্ত্যক্ত কঁরত খুঁব, মঁরে গিঁয়েও অ্যাঁভ্যেসটা যাঁয়নিঁ।’
‘ও, আপনি তা হলে সেরকম কিছু নন!’ সুমন সোজা হয়ে উঠে বসল, ‘সত্যি, এতক্ষণে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হয়েছিল।’
সাহসী পার্থও উঠে বসেছে। তবে তার এখনও ধন্দ যায়নি। জ্বলজ্বল চোখে দেখছে গজাল—দাঁতকে। সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘কিন্তু আপনার গলার আওয়াজটা তো…?’
‘ম্যাঁলেরিয়ায় ভুঁগে—ভুঁগে হঁয়েছে ভাঁই। এঁককালেঁ ঘোঁড়ামাঁরায় মঁশার খুঁব সুঁনাম ছিঁল তোঁ, কাঁমড়ালেই পাঁলাজ্বঁর।’ গজাল—দাঁত ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, ‘এঁখন আঁর সেঁই রাঁমও নেঁই, অ্যাঁযোধ্যাঁও নেঁই। সেঁইসঁব পিঁনপিঁনে মঁশা আঁর কোঁথায় এখন? ঝোঁপঝাঁড় সাঁফ হঁয়ে গেঁছে, ঘঁরে—ঘঁরে মঁশামাঁরা—ধুঁপের উঁতপাঁত, কঁতসঁব ট্যাঁবলেট বেঁরিয়ে গেঁছে….’
‘বুঝলাম। তা আপনার কোয়ার্টারটা এত অন্ধকার কেন?’
‘লোঁডশেঁডিং চঁলছে যেঁ! ঘোঁড়ামাঁরায় এঁরকমই হঁয়। কাঁরেন্ট এঁই আঁছে, এঁই নেঁই। যাঁক গেঁ, যাঁক, তোঁমরাঁ নিশ্চিন্ত হঁয়ে ঘুঁমিয়ে পঁড়ো। কঁম্বলগুঁলো ভাঁল কঁরে গাঁয়ে টেঁনে নাঁও।
কদাকার লোকটাকে আর তেমন কিম্ভূত কিমাকার লাগছিল না পার্থ—সুমনের। চেহারা যেমনই হোক, লোকটা সত্যিই বড় ভালো। নিজেদের বোকামির জন্য মনে—মনে হাসিও পাচ্ছিল দুই বন্ধুর। আসল ভূতকে মানুষ ভেবে তারা কিনা এক এক জ্যান্ত মানুষকে ভূত ভেবে ফেলেছিল! ছ্যা ছ্যা….।
গজাল—দাঁত লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর সুমন বলল, ‘বিশ্বাস হল তো, ভূত আছে কি নেই?’
ওভারব্রিজের কালোদার কথা ভেবে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পার্থর। তবু জোর করে একটা তাচ্ছিল্যের সুর ফোটানো গলায়, ‘দূর, ওটা কি একটা পাত্তা দেওয়ার মতো ব্যাপার? ঘুমিয়ে পড়।’
কম্বলের ওমে সুমনের চোখ জড়িয়ে এল। দু—মিনিটের মধ্যে পার্থরও নাক ডাকছে। মিশমিশে অন্ধকারে একটাই আওয়াজ—ফররফর…. ফরররর।
কনকনে ঠান্ডায় কাকভোরে ঘুম ভেঙে গেল সুমনের। চোখ রগড়ে উঠে বসতেই শরীর হিম। পাগলের মতো দু—হাতে ঝাঁকাচ্ছে পার্থকে।
জাগতে—না—জাগতেই পার্থরও চক্ষু চড়কগাছ। এ তারা কোথায়?
রাত্তিরের সেই ঘর, বিছানা, কম্বল বেবাক মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে। ঘোড়ামারা স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চিতেই তো তারা শুয়ে আছে দু—জনে। খোলা প্ল্যাটফর্মে!