ঘুস
মেজোমামার বই বাড়ছে, বড়মামার বাড়ছে জীবজন্তু আর মাসিমার চড়ছে মেজাজ। আজ মাসিমার স্কুল বন্ধ। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর আমাকে বললেন, ‘চলো লেগে পড়ি। আমাদের লাইফে তো বসার কোনও সময় নেই।’
লেগেপড়া মানে দু’জনে মিলে খুঁজে খুঁজে বের করা বড়মামার জীবজন্তুরা কি কি অপকর্ম করেছে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কতটা। বড়মামার কুকুরের সংখ্যা আপাতত সাত। শোনা যাচ্ছে আরও দুটো আসছে। একটা গোল্ডেন রিট্রিভার, আর একটা হাউণ্ড। গোল্ডেন রিট্রিভারের রূপের বর্ণনা শুনে শুনে আমাদের এখন মনে হতে শুরু করেছে—ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ নয়, গোল্ডেন রিট্রিভার। বড়মামাকে প্রশ্ন করেছিলুম—’বড়মামা, সব কিছুর একটা সীমা আছে তো! এত কুকুর কী হবে? সাতটা আছে, দেখতে দেখতে নটা হবে। এরপর তো কুকুর রাখার আর জায়গা থাকবে না।’
‘সে তুমি বুঝবে না। আমি গবেষণা করছি। আমার গবেষণার জন্যে কুকুরের প্রয়োজন।’
‘গবেষণার তো কিছু দেখছি না। ওরা খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘেউ ঘেউ করছে আর দুষ্টুমি করছে। আর আপনি একে বিস্কুট ছুঁড়ে দিচ্ছেন, ওর মাথায় চাঁটা মারছেন। এর নাম গবেষণা!’
‘শোনো-শোনো, এ তোমার মেজোবাবুর গবেষণা নয়। আমার এই গবেষণা সমস্ত কুকুর জাতির স্বভাব পালটে দেবে। এই যে কুকুরে কুকুরে দেখা হলেই খেয়োখেয়ি, সেই খেয়োখেয়ি আর হবে না। সব কুকুর ভাই ভাই হয়ে যাবে। মানুষ যেটা ভুলে গেছে। আমার এইটা হল কুকুরদের ট্রেনিং ক্যাম্প। ধরো এখানে সাতশো কি আটশো কুকুরকে ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে দিকে দিগন্তে ছড়িয়ে দিলুম। সেই ট্রেইনড কুকুর তখন এক এক এলাকার কুকুরকুলকে মানুষ করে দেবে। একেবারে মানুষ।’
মেজোমামা পরিকল্পনা শুনে বলেছিলেন, ‘একেবারে মানুষ হলে তো সেই একই হয়ে গেল। আবার খেয়োখেয়ি। তুমি কী করতে চাইছ? কুকুরকে মানুষ, না মানুষকে কুকুর, না কুকুরকে কুকুর! আগে ঠিক করে নাও।’
‘থাক তোমাকে আর গুলিয়ে দিতে হবে না। তুমি হলে সেই কথামালার শৃগাল, বাঘকে সে খাঁচায় বন্দী করে ছেড়েছিল। আমি আমার মতো তুমি তোমার মতো। তোমার ছাইপাঁশ গবেষণায় আমি নাক গলাই!’
মাসিমা বললেন, ‘এই দ্যাখ বড়দার খরগোশ মেজদার অক্সফোর্ড ডিক্সনারির এ থেকে ডি পর্যন্ত চিবিয়ে খেয়েছে। মেজদা একবার দেখলেই ক্ষেপে যাবে। আর ক্ষেপে যাবারই তো কথা।’
‘এই দ্যাখো মাসি, বড়মামার সেই ধেড়ে বেড়ালটা এমন সুন্দর সোফার ফোমটাকে আঁচড়ে কি রকম দাগ দাগ করে দিয়েছে।’
‘সে কি রে, এই তো পরশু দিন নতুন করে দিয়ে গেল। আর পারি না। এ বাড়িতে ওই কুকুর বেড়াল ছাগলই থাক চল আমরা পালাই।’
তিনটে চাদর বড়মামার কুকুরে ফালাফালা করে দিয়েছে। আমি জানি বড়মামা বলবেন, ‘ও কিছুই না। সাতটা কুকুরের উচিত ছিল সাতটা চাদর ফালা করার।’ তারপর গলাটাকে গম্ভীর করে বলবেন—’কি হয়েছে কি, চাদরের ঝোলা অংশে তো বেশ ভালোই ঝালর মতো করে দিয়েছে। ডেকরেশান।’
মাসিমা বললেন, ‘তাহলে, এ সপ্তাহে বড়বাবুর পেয়ারের জন্তুরা কি কি উপকার করল—তিনটে চাদর খতম। সোফায় ফোমলেদারে বেড়ালের নখের নকশা। মেজোবাবুর ইংরেজি ডিক্সনারির এ থেকে ডি হজম। শিকার ধরতে গিয়ে বড়বাবুর পেয়ারের হুলো আমার বাঁয়া তবলাটা চুরমার করেছে। সবচেয়ে শয়তান ছোট কুকুরটা তোর হাওয়াই চপ্পলটাকে সজনে ডাঁটার মতো চিবিয়েছে। একটা সপ্তাহের পক্ষে যথেষ্ট, কি বলিস বুড়ো।’
‘এখনও তো তুমি গরু আজ ছাগলের দিকে যাওনি মাসি। ওপাড়ায় কি হয়ে আছে কে জানে?’
‘ও ছেড়ে দে, বাগানে তো একদিকে চলেছে বৃক্ষরোপন উৎসব, আর একদিকে বৃক্ষ হনন। বড়কর্তার পেয়ারের লক্ষ্মী তো বিশ্বপেটুক। সব কটা কলাগাছ মুড়িয়ে খেয়েছে। আর প্রাণের ছাগল রামু তো দেখি আজ দুপুরে বাগানের বেড়াটাকে টেস্ট করার চেষ্টা করছে। আর তিন দিন। তিনটে দিন পরে দেখবে বেড়া ফাঁক। বড় কর্তাকে বললেই বলবে, রিসার্চ হচ্ছে গবেষণা। ছাগলের হজম শক্তি দেখেছিস কুসি। ওদের হজম-রস থেকে একটা ওষুধ যদি কোনওরকমে বের করতে পারি তো, মার দিয়া কেল্লা। মানুষ তখন ছাতার বাঁট খেয়ে হজম করবে। দুটো পাগলে আমার জীবনটা শেষ করে দিলে!’
‘মেজোমামা অতটা নয়।’
‘ওই একই। টাকার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। বাড়িতে বই রাখার আর জায়গা আছে? সেদিন বলছে, আলমারি থেকে সব কাপড়-জামা বের করে দিয়ে বড় মাপের বইগুলো রাখবে। যুক্তিটা শুনবি, কাপড়-জামা পুটলি করে যেখানে হোক রাখা যায়, দামী দামী বই তো আর পুটলি পাকানো যায় না। বই হল জ্ঞানের ভাণ্ডার। গুচ্ছের জামা-কাপড়ে কি হবে।’
মেজোমামা বলছিলেন, ‘জানিস বুড়ো, বই দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না, অথচ জানিস শেষ মাসে না আমার দশপয়সার মুড়িও জোটে না।’
‘রাখ তো ওসব বাহারের কথা। দিন দিন ভুঁড়িটা কি রকম বাড়ছে দেখছিস, না খেলে ভুঁড়ি হয়?’
‘না, সে ভুঁড়ি হবার অন্য কারণ আছে। সে কথাও আমাকে বলেছেন। কি কষ্ট রে বুড়ো! একেবারে ডবল টানা। ডবল টানাটা কি জানো! সকালে খেতে বসে দু’জনের খাবার নেন। দুপুরে টিফিন আর খেতে হয় না।’
‘সে না হয় সকালে। আর রাতে? সেদিন রাতে গল্প করতে করতে পঞ্চাশখানা লুচি খেয়েছে। ভাবতে পারিস বুড়ো! পঞ্চাশখানা লুচি!’
‘সে কথাও আমাকে বলেছেন। বললেন, লুচি মানে কি? লুচি মানে এয়ার, বাতাস। ফক্কিকারি জিনিস। একশোটা ফুলচো লুচিতে কতটা ময়দা থাকে? তুই লুচির সংখ্যা দেখবি, না ময়দার ওজন দেখবি! তোর বিজ্ঞান কি বলে?’
‘ওসব ছেলেভোলানো কথা তুই শুনিস; আমাকে বোঝাতে আসিস নি। মেজদা চিরকালই ভোজনবিলাসী। আমি সেদিন লণ্ড্রীতে জামা পাঠাতে গিয়ে বুক পকেট থেকে রেস্তোরাঁর একটা বিল পেয়েছি। বাষট্টি টাকার চিকেন তন্দুরি খেয়েছে।’
‘যাকগে কারুর খাওয়া নিয়ে কথা বলতে নেই।’
‘না আমি তা বলছি না; তবে কি জানিস বেশি খাওয়া ঠিক নয়। শরীর তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়, এই আর কি?’
‘এইবার আমি একটা নোটিশ দেব। এ বাড়িতে বই আর বাড়বে না, জীবজন্তুও বাড়ানো চলবে না। সব কিছুরই একটা সীমা আছে।’
‘মাসিমা, জ্ঞান যে অসীম!’
‘তুই থাম। কটা বই পড়ে রে!’
‘মেজোমামা বলেন বইয়ের মলাটে হাত দিলেই অর্ধেক পড়া হয়ে যায়।’
‘আর বাকি অর্ধেক? সেই হিসেবে তো হাজার কয়েক বই পড়তে হবে।’
আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে কে খুব চিৎকার করে ডাকছে, ‘বাবু, বাবু।’
আমরা ছুটে গেলুম। একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে এক তারের খাঁচা। খাঁচায় অনেক পাখি কিচির মিচির করছে।
মাসিমা বললেন, ‘কি ব্যাপার!’
‘ডাগদার সাব।’
‘ডাগতার সাব বাড়ি নেই।’
মাসিমা বেশ রেগে রেগে উত্তর দিচ্ছে।
লোকটি বললে, ‘ডাগদার সাব ভেজিয়েছেন। এই যে চিঠি।’
মাসিমা চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে বললে, ‘পড়।’
আমি জোরে জোরে পড়লুম, ‘কুসি বোনটি আমার, রাগ করিস নি। জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এর পর আর মনে হয় কিছু বলার থাকে না। খাঁচাটার ডেলিভারি নিয়ে নিস। তোর হিসেব থেকে লোকটাকে এখন তিনশো টাকা দিয়ে দিস। আমি তোকে সুদ সমেত চারশো টাকা দেব। মনে রাখিস জীবে দয়া। জিভে দয়া নয়। যা মেজো-র ধর্ম।’
মাসিমা সাধারণত ইংরেজি বলেন না, আজ এত রেগে আছেন, যে চিঠিটা শেষ হওয়া মাত্রই লোকটিকে বললেন, ‘গেট আউট’।
সে ‘গেট আউট’-এর কি বুঝবে। সে হাসি হাসি মুখে বললে, ‘হ্যাঁ মা।’
মাসিমা তখন বললেন, ‘বেরোও, দূর হও।’
লোকটি বেশ মজার মানুষ। সে একটু নাচের ভাব করে বলল, ‘দূর হটো ভাই দুনিয়াওয়ালে হিন্দোস্তাঁ হামারা হায়।’
মাসিমা বিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন, ‘এটাকে হাটা না বুড়ো।’
‘ও হটবে না মাসি, বড়মামা যা বলেছেন তুমি তাই করে দাও।’
পাখিগুলো দারুণ দেখতে। আমিই বুদ্ধিটা বড়মামাকে দিয়েছিলুম। উত্তরের বারান্দাটা বেশ করে জাল দিয়ে ঘিরে মুনিয়া আর বদরি পাখি পুষুন। মনে হবে স্বর্গে আছি। আর ওদের বাচ্চা হবে। ছোট ছোট বাচ্চা ফুর ফুর উড়বে। মাসি খুব গজগজ করতে করতে তিনশোটা টাকা লোকটির হাতে দিলেন।
‘খাঁচাটা কোথায় রাখবো মা?’
‘আমার মাথায়।’
‘মা আমার রাগ হয়েছে।’
আহা কি বাংলা! লোকটি আপনমনে বাগানে ঢুকে গেল। গান চলছে কিন্তু। গান থামে নি। খাঁচাটাকে ভেতরের বারান্দায় রেখে সবে কি একটা বলতে যাচ্ছে, আর বড়মামার সাত সাতটা বড় ছোট কুকুর একেবারে ঝাঁ ঝাঁ করে তেড়ে এল। লোকটি কি ভালো ছুটতে পারে! আবার কি সুন্দর লাফাতে পারে! এক লাফে বাগানের বেড়া টপকে সোজা পুকুরে। জল থেকে উঠে এসে বললে, ‘নাইতে বেশ ভালো লাগে তো বাবু।’
‘তুমি আগে কখনো চান করোনি?’
‘সে দশ বছর আগে। যেবার গঙ্গাসাগর গিয়েছিলুম। চান করবার সময় কোথায়?’
‘তোমার কী এমন কাজ?’
‘বা বা আমার কাজ নেই? আমাকে তো সব সময় পাখি পাহারা দিতে হয়।’
‘কেন?’
‘বাঃ বেড়াল খেয়ে নেবে না?’
লোকটি বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বড়মামার কুকুরগুলো কিছু দূর তেড়ে এসে আর আসেনি। ওরা মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা পায়।
লোকটি বললে, ‘আবার ঠান্ডা না লেগে যায়! হঠাৎ চান করলুম তো!’
‘এই গরমে ঠান্ডা!’
‘ছেলেবেলায় আমার একবার বঙ্কা হয়েছিল।’
‘বঙ্কা আবার কী?’
‘সে তুমি বুঝবে না, ডাক্তারবাবু জানেন। সে খাঁশি, খালি খাঁশি। আরেব্বাপ। তা জানো, আমি চান করলুম, আর আমার মায়ের দেওয়া তিনটে নোটও চান করল।’
নোটটাকে ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘যাঃ ব্যাটা বরাত ভালো।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘চারটে তো বাজল?’
‘তা বাজুক না! চারটে বাজলে কি হয়?’
সুর করে বললে, ‘বাবুদের বাড়িতে চা হয়। হ্যাঁ গো তোমাদের চা হয়ে গেছে? দেখো না, একটু ম্যানেজ করো না। তোমাদের কুকুরের জন্যেই তো আমি জলে পড়ে গেলুম। আমি চেনা তাই। অচেনা হলে চিৎকার করতুম। চিৎকার করলে লোক জড়ো হলে জুলুম হত। দিনকাল তো ভালো নয়। দেখো না, আদা দিয়ে এক কাপ চা যদি হয়।’
বাবা, লোকটা তো খুব চালু! বড়মামার সব পার্টিই সমান।
‘তাহলে খুচরো একটা টাকা দাও। দোকানে চা খাই। আমার তো আবার সব একশো টাকার নোট।’
আমার পকেটে একটা টাকা ছিল, লোকটাকে দিলুম। যেতে যেতে বললে, ‘দোকানের চা ঠিক বাড়ির মতো হয় না।’
ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছি, ধরধর, ধরধর করে একটা টেম্পো এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে বললে, ‘মুখার্জি বাড়ি?’
‘হ্যাঁ মুখার্জি বাড়ি।’
ড্রাইভার তার চেলাকে বললে, ‘মোড়ের মাথায় লোকটা ঠিকই বলেছিল। দেখবেন যে বাড়ির ছাদের আলসে থেকে মুখ ঝুলিয়ে সাত আটটা কুকুর জিভ বের করে হ্যা হ্যা করছে, সেই বাড়িটাই মুকুজ্যে বাড়ি! প্যালা ছাদের দিকে একবার তাকা! দৃশ্য। দৃশ্য। মানুষ খেতে পাচ্ছে না, দশ বারোটা কুকুর। বড়লোকদের কি দশা প্যালা!’
মাসিমা বেরিয়ে এসেছেন, ‘এবার আবার কি?’
‘বোঝা যাচ্ছে না মাসিমা!’
ড্রাইভার ভাঁজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিতে দিতে বললে, ‘লেটার আছে, লেটার, পড়লেই বুঝতে পারবেন দিদি।’ এবার একটা চিঠি। এবার মেজোমামা। ‘কুসি, বোনটি আমার, রাগ করিস নে বোন। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, হঠাৎ, সেই পরমকরুণাময়ের দয়ায়, আমার হাতের মুঠোয়, হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ, এসে গেল, আর আমি জয় মা বলে খপাত করে ধরে ফেললুম। আজ একটা প্রাচীন লাইব্রেরি বিক্রি হয়ে গেল। আমি বেছে বেছে কিছু প্রাচীন পুঁথি আর গ্রন্থ এই টেম্পো করে তোর কাছে পাঠালুম। তুই করুণাময়ী। তুই জগদম্বা, তোকে পুজোর সময় আমি বোম্বাই নিয়ে যাব। আমি বড়কত্তা নই। আমার কথার দাম আছে। তুই মালটা ডেলিভারি নিয়ে, টেম্পো ভাড়া তিরিশ টাকা দিয়ে দিস। ত্রিসংসারে আমার কে আছে বল তুই ছাড়া। আপাতত আমার ট্যাঁক গড়ের মাঠ। খুব সাবধানে নামাস। অধিকাংশই জরাজীর্ণ। জোরে নিঃশ্বাস লাগলেও ড্যামেজ হয়ে যাবার সম্ভাবনা। মনে কর এক গাড়ি পাপড় ভাজা। এর মধ্যে একটা পুঁথিতে নানা টোটকার কথা লেখা আছে। মনে হয় চুল পড়া বন্ধেরও টোটকা আছে। একদিন তোকে পড়ে মানে করে দোব যদি সময় পাই। সোনা মেয়ে। আমার সন্টুটা আমার মন্টুটা। আমি এখনও বেছে চলেছি। ঈশ্বরের ইচ্ছায়, মনে হয় আরও এক টেম্পো পাঠাতে পারব। বই, শুধু বই। কি ঐশ্বর্য! ইতি, তোর মেজদা।’
ড্রাইভার জিগ্যেস করলে, ‘এই জঞ্জাল কোথায় ফেলবো দিদি?’
‘ডাস্টবিনে।’
মাসিমা ভেতরে চলে গেলেন। আমি মাথা খাটিয়ে কয়লার ঘরটা দেখিয়ে দিলুম।
প্রথমে এলেন বড়মামা। দুহাত সামনে বাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে অন্ধ মানুষের মতো হাঁটছেন। একটা করে পা অনেকটা উঁচুতে তুলে সাবধানে ফেলছেন। মাঝে, মাঝে টলে যাচ্ছেন। যাব্বাবা! এ আবার কি হল। জলাতঙ্কের মতো ভূমি আতঙ্ক নাকি? বড়মামার কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। সেটা ওইভাবে লেফট রাইট করে চলার জন্যে ধপাক ধপাক করে দুলছে। বড়মামা তো মেজোমামার মতো সাইডব্যাগ নেন না, বরং ঠাট্টা করেন। প্রফেসারদের জার্সি হল, কড়া মাড় দেওয়া পাঞ্জাবি আর সাইডব্যাগ আর তার চোখ খারাপ হোক আর না হোক, মোটা ফ্রেমের চশমা। সেই বড়মামার কাঁধে ব্যাগ!
আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে মাসিমাকে ডাকলুম। বড়মামার বোধহয় স্ট্রোক হচ্ছে। মাসিমাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। বড়মামার ওইভাবে এগিয়ে চলেছেন উঠান দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে। ওঃ মাসিমার লক্ষ্য বটে! আমি অতটা নজর করে দেখিনি। বড়মামার চোখে চশমা। প্রথম চশমা। মাসিমা এগিয়ে গিয়ে একটান মেরে চশমাটা খুলে নিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয় বাইফোকাল’।
বড়মামা বললেন, ‘বাঁচালি, কুসি। বাইফোকাল। কি অবস্থা রে! সব যেন ঢেউ খেলছে। এই তো দেখছিস সব সমান, চশমাটা পর, দেখবি সব উঁচু নীচু। শীতলাতলার কাছে তো দুম করে পড়েই গেলুম। ওই যে দেখছিস তলার দিকে গোল চাকা দাগ কাচের ওপর ওইটাই মারাত্মক। তুই বল, ওইটুকু জায়গা দিয়ে চোখ চালানো যায়।’
‘পড়ে না গিয়ে চশমাটা তো চোখ থেকে খুলে নিলেই পারতে।’
‘যাঃ তা কখনো হয়। চশমা তো পরার জন্যে, পড়ার জন্যে।’
‘তুমি তো পড়ার বদলে পড়ে গেলে। তোমার কাঁধে কি?’
‘ও কাঁধে!’ বড়মামা লাজুক লাজুক হাসলেন, ‘মেজোকে উপহার দোবো; কিছু বই রে কুশি।’
‘আবার বই!’ মাসিমা প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি।
আর তখনই ঢুকলেন মেজোমামা। তাঁর কোলে ভারি সুন্দর একটা বাচ্চা কুকুর।
মাসিমা বললেন, ‘এ কি, কুকুর! কুকুর তো তোমার সাবজেক্ট নয়!’
‘আমার এক ছাত্র দিলে। বড়দাকে প্রেজেন্ট করব।’
‘কি ব্যাপার বল তো। দু’জনে এত ভাব! বড়দা তোমার জন্যে বই এনেছে। ঝেড়ে কাশো তো। এ যেন দু’জনেই দু’জনকে ঘুস দিচ্ছে।’
বড়মামার বইয়ের ঝোলাটা মেজোমামার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ফ্যান্টাসটিক কিছু বই। ফর ইউ!’
মেজোমামা কুকুরছানাটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক কুকুর, চিওয়া ওয়া।’
বড়মামা বললেন, ‘বেশ এবার তুমি তাহলে কাজের কথাটা বলো!’
‘তুমি আগে বলো।’
‘আমি উত্তরের বারান্দাটা জাল দিয়ে ঘিরে পাখি রাখব। ওই দেখ খাঁচা।’
‘আমি তোমার ঘরের দুটো দেয়াল চাই। র্যাক ফিট করে বই রাখব। ওই দেখ এক টেম্পো বই।’ ওদিক ওদিক তাকালেন। ‘আমার বই!’
আমি বললাম, ‘কয়লার ঘরে রাখা হয়েছে।’
‘কয়লার ঘরে! কয়লার ঘরে মা সরস্বতী!’
মেজোমামা পড়ি কি মরি করে ছুটলেন। সেখানে বড়মামার পেয়ারের গরু লক্ষ্মী এক খাবলা মা সরস্বতী মুখে পুরে চোখ বুজে চিবোচ্ছে, আরামসে, আর চামরের মতো ন্যাজটা দুলিয়ে দুলিয়ে মশা তাড়াচ্ছে।